কথিকা / মুক্তগদ্য


জানালা নেই-

ভা র্গ বী

ঘর তৈরীর বরাত পেয়ে জেনেছিলাম ঘরে কেবলমাত্র একটি মাত্র জানালা হবে। চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেওয়াল উঠে গেলে তো আর জানালা হবে না। ভাঙার নিয়ম নেই। শুধু গড়তে পারবে। অতএব সিদ্ধান্ত বড়ো সাবধানে নিতে হবে।

অনেক ভেবে স্থির করলাম উত্তর দিকেই রাখি জানলার বন্দোবস্ত। ধ্রুব তারার উত্তর আকাশে ঠাঁই । জানলা খুলেই রোজ তাকে দেখবো। বেশ নিবিড় এক আত্মীয়তা ঘটবে তারার সাথে আমার। কিন্তু বহু ব্যবহার তাকে অভ্যেসের আওতায় এনে  ক্লিশে করে তোলে যদি – নাঃ থাক বরং সে বহু আলোকবর্ষ দূরের অজানা এক রোমাঞ্চের মতো। ঘর তো আর জাহাজ নয় যে তার দিক ভুল হবে। অতএব ঘরের জানলায় ধ্রুবতারাকে আটকে রাখা খুব উচিৎ হবে না সে বরং দিক নির্দেশ করুক মাঝ সমুদ্রের হাল ভাঙা নাবিকের। আর তাকে উত্তাল সমুদ্রে দিশা দেখানোর জন্য যেন এই মুহূর্তে আমিই মুক্ত করলাম– এমন ভেবে এক অপার্থিব মহত্ব অনুভব করলাম। দেওয়াল তুললাম উত্তরের দিকে।
পরে রইলো বাকি তিন। গুনলাম, ইন পিন সেপ্টিপিন। গোনা শেষে দেখলাম সামনে পূর্ব দিক। আশ্বস্ত লাগলো। এই তো কাজ এইবার শেষ হবে। যথেষ্ট যুক্তি পাওয়া গেছে পূব দিকের জানালার পক্ষে। সে দিকে জানালার বড়ো সুবিধা এই যে বেশ ভোরের লাল আকাশের মায়াটুকু এসে বসবে জানালার পাশের সুপুরী গাছের মাথায়। তারপর দিনের প্ৰথম সূর্য এসে পা রাখবে আমার জানালায়। গুটি গুটি আসবে আমার ঘরের ঠিক মধ্যিখানে, বিছানার পাশের মেঝেতে। শিশু-রোদ্দুর সকালের মায়া মেখে এসে বসবে আমার ঘরের বইয়ের তাকের গা ঘেঁষে। ভোরের বেলার শিউলি ফুল যেমন করে মাটিকে আদর করে ঠিক তেমন আদরে ভরে যাবে ঘর আমার। 
জানলা করতেই যাব কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাধ সাধল দখিন হাওয়া। অতএব দেওয়াল তুলে ফেললাম পূবের দিকেও। দক্ষিণ দিকই ভালো। দক্ষিণের জানলা থাকলে সে জানালার সামনে একটা পড়া লেখার টেবিল থাকা অনিবার্য। টেবিল সাজাতে বিশেষ উপকরণের দাবীও নেই। একটা যতদূর পড়া হয়েছে যাতে পাতা না ওড়ে টেবিলের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ছিন্নপত্র আর ঠিক তার পাশেই খোলা ডাইরির পাতা উড়বে খস খস শব্দে। হঠাৎ পুরোনো স্মৃতির পাতা থেকে উড়ে যাবে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ ফুলের শুকনো পাপড়ি। হাহুতাশ করবে সারাটা ঘর শেষ হয়ে যাবার পরও যেটুকু রয়েছিল সেটুকু হারিয়ে ফেলায় সময় কাটবে বিলাসবহুল শোক উদযাপনে। না বাবা থাক, বরং যেটুকু আছে ডাইরির পাতার ভেতর অলক্ষ্যে একাকী। সেটুকু তবু থাক। অগত্যা দখিন হওয়ার লোভ সম্বরণ করে দেওয়াল তোলা গেল সে দিকেও।
পড়ে রইলো পশ্চিম। দিবসের শেষ সূর্য ঘরের কপালে নরম চুম্বন দিয়ে বলে যাবে, "যাবার সময় হলো। বিদায় দাও। প্রস্তুত হও আঁধারের।" তখন সন্ধ্যা মালতি ফুটবে বাগানে। শুরু হবে আলোর অপেক্ষা। অপেক্ষা বড়ো আক্ষেপ না হয়ে ওঠে চিন্তায় দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে দ্রুত দেওয়াল তুললাম পশ্চিমে। 
দেওয়াল তোলার পর দেখলাম উফফ কি অন্ধকার। আমি জানলার চিন্তায় দরজা বানানোর কথা ভুলেছি। কিন্তু নিয়ম তো ভাঙা যাবেনা। আলোর অপেক্ষা দীর্ঘ হতে পারের আক্ষেপ আর এখন রইলো না। কারণ এখন ঘর জুড়ে অন্ধকারের বসত। 
ঘরে যে একটাও জানলা বানানো হলো না।






সুচিস্মিতা উবাচ-- 𝙰𝙽 𝙴𝙿𝙸𝚃𝙾𝙼𝙴 𝙾𝙵 𝙻𝙾𝚅𝙴--

দে ব ব র্ণা

জৈষ্ঠের প্রান্তিকে মেঘের অস্থিরতা মার্জনীয়--- প্রাগৈতিহাসিক ছাদ বয়ে চলে দহনের ঐতিহ্য, রান্নাঘরের কাজ মাছ ভাজা, কড়াই জুড়ে ফুটে ওঠে পৃথিবীর তিনভাগ সত্য, মায়ের সাথে অনাবিল রবীন্দ্রনাথ আর প্রিয়ংবদার কিশোরীবেলার ট্রমা। হাতের তালুতে সময় অপচয় হলেও ফোনের স্ক্রিনে দুর্ভাগ্য মাপছে বয়স। বৈজ্ঞানিক চারুকলায় নীরবতাই একমাত্র মির‌্যাকেল, আকাশের সাথে মৌসুমীর নিগূঢ় আঁতাত তাই বৃষ্টির সম্ভাবনাকেও এখানে ঐশ্বরিক মনে হয়। মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ড খুলে দিয়েছে শরীর, কি-বোর্ডের অক্ষর খাঁজে জ্ঞাতব্য যৌনতা, শুধুমাত্র প্রেমই এখানে চলনসই কেবল। আঙুল জানে কত জোরে চেপে ধরলে বেরিয়ে আসবে খাম্বাজ রাগের তেহাই, যেমন দাঁত জানে কাঁটার গলায় কামড় বসিয়ে উপড়ে নিতে মাছের শরীর। ভৌতবিজ্ঞানের স্পেকট্রাম ছাড়িয়ে আলোর ঢুকে পড়া প্রাসঙ্গিক তাই পিঠের সাথে দূরত্ব মেপে নেয় বৈদ্যুতিক টেরাহার্জ। মানুষের সাথে প্রকৃতির শত্রুতা, ষড়রিপুরই এক অভেদ্য বখরা তবুও খুঁটিয়ে পড়া হয় না উপসংহারের বিব্লিওগ্রাফি। বর্ষা নিয়ে কাব্য করার সময় নেই কারণ বিষন্নতার গায়ে হাওয়া লেগেছে আজ--- ঝমঝমিয়ে কবিতা নামবে, নেমে আসবে একান্তের রবীন্দ্রনাথ যান্ত্রিক ফোল্ডারে। লিপি ধর্মঘট উঠে যায় অকাল শ্রাবনী সংগমে, ধ্রুপদী সজ্জায় সাহিত্যের দিগম্বরী খাঁচা খুলে উড়ে যাবে রোম্যান্টিসিজম। কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিচ্ছে মা, আবারও আলজিব খসে এগিয়ে আসে ঠাকুরবাড়ির ছেলে।
দুপুর দুটো, কান্না পাচ্ছে ভীষণ এদিকে প্রিয়ংবদার কোপিং মেক্যানিজম মানেই কবিতা--- ভাগ্যরেখায় স্পষ্ট লেখা বিষণ্ণতা তবুও কেনো খিদে পাচ্ছে? ভুত বলে কিছু নেই তবুও ভুতুড়ে কান্ড ঘটে যায় যখন তখন, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার কিছুই মেলে না জীবনশৈলীর স্কুলে। খুন্তির আওয়াজ স্পষ্টবাদী, মশলা তেল ছেড়েছে তাই ঝোলে মাছ দেবে মা। বিরতির নাম মিনিট পনেরো---

--মা, তুমি কোন কবিতাটা গুনগুন করছিলে?
--কেনো তোর ভালো লেগেছে? ওই তো "এমন দিনে তারে বলা যায়"..
--কেনো যে আবৃত্তি ছেড়ে মাছের ঝোল বানাতে গেলে কে জানে!!এসব ভালো লাগে?
--দাঁড়া পানটা গালে দিয়ে বলছি... উম! কি যেন বলছিলি? ওহ আবৃত্তি না মাছের ঝোল? আমি বলবো মাছের ঝোল।
--ওই করো, বিরক্তি লাগে এসব --এই নাও আবার পিক গিলো না যেন, এক্ষুনি কাশি শুরু হবে।
--আচ্ছা মা, দিব্যিতো বলো, আজও কি আর শুরু করা যায় না?
--ধুর, সেই কবে এসব ছেড়ে দিয়েছি, চর্চা নেই কিছু নেই, না রে হয় না হয় না বুঝলি, সবেরই একটা নিত্যদিনের অভ্যেস দরকার। অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস।
--তোমার শাড়ীর আঁচল থেকে কাঁচা মাছের গন্ধ ছাড়ছে গো, গা গুলোচ্ছে আমার।
--দেবো? দেবো তোকে ছুঁয়ে? আমার মাছের ঝোল নিয়ে বললে আমিও কিন্তু অমনি ছুঁয়ে দেবো।
--ধুর, ছাড়োতো, ভালো লাগে না আর এসব আমার, আদিখ্যেতা।
--দাঁড়া মাছের ঝোল ফুটে গেলো বোধহয়, গ্যাস নিভিয়ে আসি... স্নানে যা।
--নিভিয়ে এসো, কবিতা শুনবো, একদিন দেরি করে খেলে কেউ মরে যাবে না।
--কি হলো? একটা গ্যাস বন্ধ করতে এতক্ষন? রান্নাঘর পরে পরিষ্কার করবে, এসো আগে। অতিকষ্টে দুফোঁটা পড়েছে, বন্ধ হয়ে গেলে ওই কবিতা শুনতে আমার অসহ্য লাগবে।

সত্যিই রবীন্দ্রনাথ? নাকি এসব শুধুই বাতুলতা? কোনো এজলাস আছে যেখানে গাছের নামে আমি মামলা দায়ের করবো? সূর্যের মৃত্যুর আগে মরে যাবে অনেক গাছ --তবুও গড় ব্যাসার্ধ মেপে আড়াল করে দিচ্ছে এই এত্ত এত্ত পাপ। বৃষ্টির সাথে পরকীয়ায় আড়ি পাতছি আমি আর সঙ্গত করে চলে চিলেকোঠা।

--নে, বল, স্নানে গেলি না এখনও? কটা বাজে? তোর বাবা এক্ষুনি এলো বলে, একটা ফোন কর না, দেখ কোথায় আটকে রইলো মানুষটা?
--আমি পারবো না এসব, কবিতাটা বলো, এক্ষুনি।
-- আচ্ছা কি মুশকিল, ঘেমে নেয়ে কি অবস্থা আমার, এরমধ্যে আবার.. যাক গে সঞ্চয়িতাটা দে, অত বড়ো কবিতা মনে নেই আমার।
--দিচ্ছি, আচ্ছা মা, আমি খুব উদ্ধত, তাই না? এই যে সবসময় কেমন কথা শুনিয়ে দিই তোমাদের। রাগ হয় না? মনে হয় না পয়সা খরচ করে একটা অশিক্ষিত তৈরী করেছো তোমরা?
--দেখছিস এই ভর দুপুরে এখন কিসব শুরু করেছিস? না একদম এসব বেকার কথা মনে হয় না আমার।
--মা, কবিতাটা কার জন্য পড়ছিলে রান্নাঘরে? আমিতো এখন অনেকটা বড়ো হয়েছি, কেনো এভাবে ছোটো সাজিয়ে রেখে দাও? একবারতো ভরসা করে বলে দেখতেই পারো। হতেও তো পারে তোমার শিক্ষা বৃথা যায়নি?

এই বিরাট মহাজাগতিক নৈসর্গের এককোণায় ছিটকে গেছে মেদিনী, নজর পড়ে না ঈশ্বরের --খুঁটে খুঁটে মৃত্যু খেয়ে চলেছে মানুষ, যাবতীয় প্রেমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আজন্মকাঙাল বিচ্ছেদ। মতবিরোধ এখানে ব্রাত্য, ব্যস্ততা, অসুখ, থাইরয়েড সবই আত্মপক্ষ সমর্থনে কৈফিয়ত মাত্র। ছেড়ে যাওয়াই আদ্য-টিঁকে থাকার লড়াই মানেই বিবর্তনের সূত্র। জেনোম বিন্যাসের ছুতো খোঁজে বেয়াদপ বিজ্ঞানী ---আসলে শান্তিতে টিঁকতে দেবে না ডারউইন।

--আমাকে বলতে পারো মা, কিছুটা জানা আজ যদি বাকিটা বলো, বাবা আসার আগে।
--কেনো? বাবা আসার আগে সারতে হবে কেনো?
--কিছু মনে করো না, তোমার যদি অস্বস্তি হয় সেই ভেবেই আর কি..
--উঁহু অসুবিধা কিসের বোকা? ভালোবাসা অন্যায় নাকি?
--ঠিক বুঝলাম না মা, একটু ঝেড়ে কাশো দেখি... সরি সরি কিছু মনে করো না, মানে বাবা কি জানে?
--কি জানবে? আরে বাবা তুইতো দেখছি এখনও সেই ছোটোই রয়ে গেছিস.. বেশ বলছি শোন।

মায়ের চোখ চুঁইয়ে নেমে আসছে নির্ভীক প্রেমের অধীশ্বর যেন মল্লারের স্বরলিপিতে কোমল গান্ধারের চিরায়ত আবাদ।

--মেঘ, মেঘরথ গুপ্ত
--গুপ্ত কাকু? সেতো বহুবার এসেছে আমাদের বাড়িতে ছেলেবেলায়। বাবার সাথে দারুন বন্ধুত্ব ছিলো ওনার। মা, তাহলে বাপি? বাপিকে তুমি ভালোবাসো না?
--ভালো না বাসলে এতগুলো বছর কিভাবে আছি?
--একসাথে থেকে যাওয়াই কি আদৌ ভালোবাসা মা?
--একসাথে থাকতে গেলে যে ভালোবাসার দরকার আছে সোনা। প্রেমহীন দাম্পত্য পাপ, যেমন দাম্পত্যহীন প্রেম।
--বুঝতে পারছি না কিছু আমি, তোমাকে যেভাবে দেখেছি এইসব কি মিথ্যে?
--তাই মনে হয় তোর? এই যে সকাল থেকে রাত অবধি নিরন্তর পরিশ্রম, তোদের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবা, তোর পড়াশোনা,তোর ভালো থাকা, আবার ভালো না থাকা সবটা বুঝে চুপচাপ মেনে নেওয়া, এই এতো বছরের সব মিথ্যে বলছিস? নাটক?
--না, সেটা বলিনি তবে...
--তবে? একজনকে ভালোবাসলে আরেকজনকে কি একইভাবে ভালবাসা যায় না? মান্তু, তোমার বাবা আমার জীবনের একমাত্র সত্য পুরুষ, মেঘ নয়। ভালোবেসেছিলাম এ কথা মিথ্যা নয় তবে শুধু ভালোবাসা থাকলেই যে ঘর বাঁধা যায় না রে। তোমার বাবা দায়িত্ববান, তিনি আমাকে আমার মতন করে গ্রহণ করেছেন। যেটা মেঘ করেনি তাই ঘর হয়নি আমাদের। তাই বলে অতীত মুছে ফেলবো, একমুহূর্তে সব অস্বীকার করে ফেলে দেবো --একি তোমাদের ল্যাপটপের রিসাইক্লিন বিন ভেবেছো?
--ভালোবাসার কোনো দরকার নেই তবে? শুধুমাত্র প্রেমে কি কিছুই হয় না?
--না, হয় না। দায়িত্ব একটা ভীষণ বড়ো বোধ মান্তু, সেটা নারী পুরুষ উভয়েরই থাকতে হয়। যে সেই দায়িত্ব নেবে না সে তোমার ঘর নয়--- বড়োজোর বারান্দার এক কোণা হতে পারে। কিন্তু আমরাতো মানুষ, আর স্মৃতি বড়ো বেঢপ মান্তু, মুছতে চায় না। মেঘকে আমি ভুলতে পারিনি এ সত্য কিন্তু জগতে যে একটিই সত্য নেই, অনেক অনেক সত্য আছে। তেমনই আরেক চরম সত্য তোমার বাবা, আমার জীবনের শেষ ও উৎকৃষ্টতম প্রেমিক পুরুষ। আজ বছর দুয়েক হলো মেঘ আর নেই, তোমার বাবাও তাঁকে মাঝেমাঝেই মনে করে।
--তুমি? তোমার মনে পড়ে না মা?
--তুই তোর ক্লাস ফাইভের বসে আঁকো'য় প্রথম হয়ে যে পেন্সিল বক্সটা পেয়েছিলিস সেটা এখনও রেখে দিয়েছিস? তোর প্রথম কবিতা প্রকাশ পাড়ার পূজো ম্যাগাজিনে... আছে?
--এর মধ্যে এসব কেনো? 
--আহা শুনিই না, আছে?
--আছে..
--কিভাবে আছে?
--মানে? আলমারিতে মানে বাইরের ঘরের ওই ক্যাবিনেটে, কেনো?
--আমার মধ্যেও মেঘ একইভাবে আছে, বারান্দার একেবারে কোণে, শুধু আছে.. বাকিটা আমাকে আজ আর ভাবায় না।
--বাবা যখন বলে গুপ্ত কাকুর কথা, তখনও না?
--না, তখনও না।
মান্তু, একটা কথা মনে রেখো সবসময়েই.. সমাজিক সম্পর্কের জটিলতা পার্থিব নিয়মহীনতার সাথে চিরকাল যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। বিবাহ অতিরিক্ত প্রেম এখানে পাপ, নির্লজ্জতা। কিন্তু জীবন কিন্তু সবসময় এক নীতিতে রীতিতে চলে না মা।  আমরা সকলে মানুষ আর এটাই আমাদের একমাত্র ও শুধুমাত্র পরিচয়। প্রেম অপার্থিব অনুভূতি আর ঘর এক জাগতিক সম্বিৎ যাকে যাপন করতে হয়, দুটো বিন্দুকে যারা মেলাতে জানে তারাই একসাথে থেকে যায়, বাকিরা ডারউইনের তত্ত্ব অনুযায়ী দলছুট হয়ে যায়। এই মহাবিশ্বের কক্ষপথে হাজার জ্যোতিষ্ক আছে আর এখানে একটু দাঁড়িয়ে ভেবে অপেক্ষা করবার ধৈর্য নেই কারোর। ভালোবাসার মতন কাজ যদি করতে পারো তবে তাঁকে সম্পূর্ণ গ্রহণের মতন ঔদার্য্য দেখাও নয়তো অযথা কারোর সময় নষ্ট করো না। মেঘ অতি উত্তম প্রেমিক এ সত্য কিন্তু একাধারে আমাকে অপেক্ষার তিমিরে দাঁড় করিয়ে সে চলে গেছিলো। দীর্ঘ বহুবছর পর ফিরে এসেছে।
--ক্ষমা চায়নি তখন?
--হুম, চেয়েছিলো তো, কিন্তু ক্ষমারও যে একটা মেয়াদ থাকে মা। মেয়াদ ফুরালে প্রকৃতি তোমার জন্য এক সিকি অক্সিজেনও খরচ করবে না। আমরা প্রকৃতির বাইরে নই যে।
--সামাজিকতার বাইরে গিয়ে এমন একটা অসমাপ্ত প্রেম?
--অসমাপ্ত নয় তো, সে আমাকে নিরুত্তর করে চলে গেছিলো, আমিও তাঁকে আমার বারান্দা করে নিয়েছি।

দুই কন্যার মধ্যবর্তী অববাহিকায় সেদিন পাঁচ প্যাস্কেল মনস্তাপ আর এক বিষন্ন পৃথিবী বিবস্ত্র হয়ে অপেক্ষা করছিলো --অল্প নিঃশ্বাসের। কশেরুকা দিয়ে নেমে গেছিলো বরফ জমাট ধৃতি।

--কি ভাবছিস? মা চরিত্রহীন?
--না, বুক জুড়ে ভীষণ স্রোত, জোয়ার এসেছে, চলেও যাবে শুধু আমি জানি মহাকর্ষীয় বিরতির ভাটায় আরো কি কি ভাঙবে আমার। তারচেয়ে বরং আমি প্রেমিকা হই, মা'তো সবাই হয়।
--এ জগতে যা কিছু হতে চাও, সবের প্রকৃষ্টতায় পৌঁছনো কিন্তু সাধনার কাজ মান্তু। সহজ কিছুই না--- শুধু ছেড়ে দেওয়া ছাড়া।
--বেল বেজেছে, বাবা এলো বোধহয়।
--যা স্নানে যা, খেতে দেবো।







মন্তব্যসমূহ

  1. কি মন্তব্য করবো? এমন লেখা পড়ে আমার তো কথা বন্ধ হয়ে যায় আর কি!

    উত্তরমুছুন
  2. মামনি রে কি বলি! কি অসাধারণ প্রকাশ! ভাবিয়ে তুলিস বার বার

    উত্তরমুছুন
  3. বলতে পারলে নিশ্চিত কিছু বলতাম। নিস্তব্ধতাই সদুত্তর দিতে সক্ষম বলে মানলাম। ❤️

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪