অণুগল্প


নীতা

নি র্মা ল্য ঘো ষ


প্রচন্ড রোড অ্যাক্সিডেন্টে প্রায় অচেতন অবস্থায় যখন ষাটোর্দ্ধ বাদল বাবুকে আশেপাশের লোকজন অ্যাম্বুলেন্স ডেকে স্ট্রেচারে তুলছিলেন তখন যাঁরা খুব কাছে ছিলেন তাঁরা শুনতে পেলেন উনি বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। আগ্রহী কয়েকজন ওনার মুখের কাছে কান নিয়ে শুনলেন, উনি বলছেন: "আমাকে নীতার কাছে নিয়ে চল... নীতার কাছে..."

পকেট হাতড়ে একটি নোট বুকে ওনার বাড়ীর ঠিকানাটা পাওয়া গেল... আর ওনার মোবাইল ফোনে HOME লেখা একটি land phone নম্বর পাওয়া গেল। ফোন করাতে একজন ভদ্র মহিলা ফোন ধরলেন, জিজ্ঞাসা করাতে জানা গেল উনি ওনার স্ত্রী। ঘটনা শুনেই উনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কোথায় বাদল বাবুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে নিলেন।  

কিছুক্ষণ পরেই বাদল বাবুর স্ত্রী নির্দিষ্ট নার্সিং হোমে পোঁছে গেলেন। সঙ্গে দু একজন আত্মীয় ও বিবাহিত মেয়ে। অবস্থা গুরুতর- বাদল বাবু বাঁচবেন কিনা বলা মুশকিল। ওটি তে ঢোকানো হয়েছে। ভেঙ্গে পড়লেন  স্ত্রী এবং কন্যা। সান্ত্বনা দিতে কয়েকজন এগিয়ে এলেন। আগ্রহী একজন জিজ্ঞাসা করে উঠলেন, "আপনাদের মধ্যে নীতা কে?"

"কেন বলুন তো?" কাঁদতে কাঁদতেই বাদল বাবুর কন্যা পাল্টা প্রশ্ন করলেন। 

"না, মানে উনি জ্ঞান হারানোর আগে বারবার বিড় বিড় করে নীতার কাছে যাবার কথা বলছিলেন- তাই জিজ্ঞাসা করলাম আর কি!"

অস্ফুট স্বরে ক্রন্দনরত গলায় বাদল বাবুর স্ত্রী বলে উঠলেন..."নীতা নামে তো আমাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও কেউ নেই.... তাহলে...???"

লোকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।







বিপন্ন শৈশব

স ঞ্চি তা  গো স্বা মী


ছোট্ট মেয়ে রাই। এই তো সবে ৩ বছর পুরো করে ৪ এ পা দিয়েছে। এখনো play school এ যাচ্ছে। সামনের বছর নার্সারি তে উঠবে। বাড়িতে তার মা অন্বেষা নামী আই টি কোম্পানিতে চাকরি করে। বাবা সৌমিক একজন সাংবাদিক। খুব সুখেই ছিল তারা। মা বাবার নয়নের মনি রাই। হঠাৎ তার বাবার অফিসে একটা প্রমোশন হলো। বাবা কে দিল্লী বদলি করে দেওয়া হলো অফিস থেকে। এই নিয়ে বাড়িতে চাপা অশান্তি। বাবা চায় রাই আর তার মা ও দিল্লি যাক তার সাথে। ওখানেই রাই ভর্তি হবে স্কুল এ। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি নয়। তার অফিস যে কলকাতায়। এই নিয়েই রোজ রোজ কথা কাটাকাটি। যদিও ওরা রাই কে কিছুই বুঝতে দিতে চায় না.... কিন্তু, ছোট্ট রাই কিছু একটা আন্দাজ করে। সব কিছু যেনো ঠিক আর আগের মত নেই। মা গম্ভীর হয়ে থাকে। বাবা কম কথা বলে। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে রাই চাপা ঝগড়া শুনতে পায়। ওর খুব কষ্ট হয়। ও যে বাবা মা দুজনকেই খুব ভালোবাসে। সেদিন সকালে উঠে রাই কে কাছে ডেকে বাবা মা মাথায় হাত বুলিয়ে খুব নরম করে জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাদের মধ্যে কার কাছে থাকবে রাই? অবাক হয়ে রাই বলে কেনো? আমি তো তোমাদের দুজনের কাছেই আছি। একটু থেমে তার মা বলে, ধরো, বাবা দিল্লি চলে গেলো, আর আমি এখানে রইলাম... তাহলে? ডুকরে কেঁদে ওঠে রাই। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, আমি কারোর কাছে থাকবো না। আমি আকাশে স্টার হয়ে যাবো। 
নিশ্চুপ বসে থাকে সৌমিক আর অন্বেষা।






অকাল গোধূলি

কা ক লী  ব সু


শূন্য দৃষ্টিতে বাগবাজারঘাটে বসেছিল তোতা। গঙ্গাবক্ষে তখনো অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আলো প্রতিবিম্বিত। কিন্তু সেই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপ উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থা আর নেই। সব হারিয়ে গেছে ঐ গঙ্গার গভীর গর্ভে।
মুখে ভালো করে কথা ফোটার আগেই অনর্গল কথা বলতো বলে মা আদর করে নাম রেখছিলেন তোতা। তোতার বোন মৌ মানসিক ভারসাম্যহীন। মা, বোনকে নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছিলো তোতা। অভাব থাকলেও শান্তি ছিলো। বাবা তোতার বুদ্ধি ফোটার আগেই মা বোন সহ তাকে ফেলে নতুন সংসার পেতেছে। শৈশবে তোতা বুঝতো না ব‍্যাপারটা। মায়ের কাছে জানতে চাইলে মা আঁচলে চোখের জল লুকাতেন। এখন তোতা যুবতী সব বোঝে। যাই হোক, স্বল্প শিক্ষায় শিক্ষিতা মা ছাত্রী পড়িয়ে আর বাড়ির বারান্দায় তৈরী চায়ের দোকান দিয়ে সংসারে গ্রাসাচ্ছাদনের ব‍্যবস্থা করেছেন। তোতাকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী করেছেন। কিন্তু ছোটো মেয়ে মৌ এর ক্ষেত্রে তিনি অপারগ।

তোতার কচি মন জয়  করেছিলো অভিনন্দন। কলেজেই পরিচয় দুজনের। পরিচয়ের পর বন্ধুত্ব এরপর প্রেম। ব্যাস্, প্রেম আর পরিণতি লাভ করতে পারেনি। অভিনন্দন নিতে চায়নি তোতার মা ও বোনের দায়িত্ব। তোতাও হতে পারেনি স্বার্থপর। মায়ের কষ্টোপার্জিত পয়সায় লেখাপড়া শিখে বেসরকারী সংস্থায় যে সামান্য বেতন সে পেতো তাতে প্রাচুর্য না হলেও স্বচ্ছলতা ছিলো।
কিন্তু বিধি যার বাম তার তো ভাগ‍্যে সুখ জুটবে না। অভিনন্দনের সাথে সম্পর্কে ছেদ, আর তার ঠিক তিনদিন পরেই মৌএর শ্লীলতাহানি করলো একদল বিকৃতমনস্ক। মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েটা বুঝেছিলো এটা লজ্জা। তাই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লো মেয়েটা। এরপর থেকে প্রৌঢ়া মা কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎই গতকাল ম‍্যাসিভ হার্ট আ্যটাকে মুহূর্তে চলে গেলেন তোতার মা। আশেপাশের বাড়ির লোকজনের সহায়তায় মাকে দাহ করে গেছে গতকাল। এখানেই মায়ের অস্থি বিসর্জন দিয়েছে সে। পতিতপাবনী হিল্লোল তুলে বয়ে যেতে যেতে যেন বলছেন, ঠিক মায়ের মতো করে "তোওওতা….., সন্ধ্যে হলো ঘরে আয়………"







বড় কর্মকর্তা

প্র তী ক  মি ত্র


বড় কর্মকর্তা। বিরাট নিরাপদ অফিসের কোনো এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে। পাঁচ আঙুলের একটা বাদে বাকি চারটেতে আঙটি। ঈশ্বরের প্রতি তার ভক্তি তার পেছনে রাখা বাটিতে ফলগুলোর মতনই সরস আর তাজা।কাজ তিনি কি করেন কেউ জানেনা। কেন তার গুরুত্ব সাধারণেরা বিশেষ বোঝে না। মানুষটা বদ নিশ্চয়ই নয়।পরিবার আছে। বউ, ছেলে, ছেলের বউ, বয়স্ক বাবা-মা নিয়ে ভরা সংসার।তবু যে পুলিশ কেন জেরা করে; তুলেই বা নিয়ে যায়… সেটা আবার লোকটা জানেনা। যেমন ওকে পাহারারত অগুনতি পুলিশগুলো জানেনা যে ওকেই কেন আবার ওরা পাহারা দিচ্ছে। কর্মকর্তা যেই লাইনের কাজ দেখাশোনা করে সেই লাইনের লোকেরা কোনো কিছু জিজ্ঞেস করতে এলে সাধারণত ফিরে যায় হতাশ হয়ে। কর্মকর্তা কারো সাথে দেখা করে না, কারো সাথে কথা বলে না। সবসময় ঘাপটি মেরে থাকে বিরাট অফিসের কোনো এক কোণে এই ভয়ে যে এই বুঝি আবার জেরা করতে ওকে ডাকতে পারে। ও অত পাপবোধ টাপবোধের ধার ধারে না। চার আঙুলে চারটে আংটি। শুধু কর্মকর্তার বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই হলেও আগের মতন চুপচাপ থাকতে পারে না।ঘুমোতে পারে না অন্যদের মতন। কেমন যেন একটা অস্থিরতা ওকে তাড়া করে চলে। ও চোখ দুটো বুজলেই দ্যাখে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওর দিকে ধেয়ে আসছে আগুণ।আগুণের নিচে অন্ধকার, অনন্ত অন্ধকার। বাড়ির লোকেদের সাথে ফোনে একবার কথা বলে অভ্যেসবশত। তারপর যেই কে সেই কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়ে নিরাপদ অফিসের কোনো এক কোণে ঘাবড়ে গিয়ে বসে থাকে।







উত্তরাধিকারী

সা হা না  ন ন্দ ন


দমকা হাওয়ায় আঁচলটা উড়ছিল। গুছিয়ে নিয়ে বসল রীনা। ঘড়িটার দিকে আড়চোখে দেখল একবার। সন্দীপের আসার সময় হল। সন্দীপ অবশ্য স্যান্ডি নামটাই বেশি পছন্দ করে। এই প্রজন্মের ছেলে তো! সাবেকি নাম নিয়ে তার বড্ড আপত্তি। 
এই বাড়িটার আরও অনেক কিছুতেই তার আপত্তি। এমনকি.... সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়তেই একটু অস্বস্তিতে নড়ে বসল সে। 
বহুদিনের অভ্যেসমত একটা চওড়াপাড়ের শাড়ি পরেছিল। চুলটা খোলাই ছিল। কলেজ থেকে ফিরেই সন্দীপ সোজা দোতলার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যায়। আজ আবার নেমে এল। -ওহ্ মা! তুমি এই সত্তরের নায়িকার মত সাজটা বন্ধ করবে! প্লিজ! কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল বরাবরের মত। হঠাৎই খাওয়া ধাক্কাটা বুকে ধক্ করে লাগল! একসময় নামী স্কুলের শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদে ভালো স্কুলেই ভর্তি করেছিল একমাত্র সন্তানকে। ভাল শিক্ষা, সুষম পুষ্টিকর আহার, যত্ন এবং পর্যাপ্ত সময় দেবে বলে ইস্তফা দিয়েছিল চাকরিতে। ছেলে ছিল একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। 

এই বাড়িটাও তারা দুজনে তৈরী করেছিল একমাত্র ছেলের ভবিষ্যত ভেবে। ছেলে ডাক্তার/ উকিল হলে আলাদা চেম্বার করবে, তার ব্যবস্থা ওর বাবাই করে গেছে। দুজনের বড় স্বপ্ন ছিল এই স্বপ্ন-নীড় একসময় ছেলের সুকীর্তিতে বিখ্যাত হবে! 

স্যান্ডি বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টিভঙ্গী পালটাতে থাকে। স্কুল কলেজের হার্ডলস্ সে পেরিয়েছে অনায়াসে। বিদেশের স্কলারশিপ জিতে নিল হাজার ছেলেকে পেছনে ফেলে। বাবা-মায়ের আশার থেকে অনেকগুণ বেশি ভালো সে। কিন্তু দেশের কোনোকিছুই তার ভালো লাগে না। বাবাকে হারানোর পর, মায়ের একাকীত্ব, তার চোখে পড়ে না। মূল স্রোতে ফেরানোর ইচ্ছেই নেই তার। শুধুমাত্র বিদেশে পাড়ি দেবার দিনগুলো সে গোণে একমনে। ইদানীং মায়ের সব কাজকর্মে তার অসন্তোষ। প্রকাশ করে রূঢ়ভাবেই। 

অজান্তেই ভিজে আসা চোখের পাতা আঁচলটা দিয়ে মুছে নেয় রীণা। কৃতী ছেলে বিদেশে যাচ্ছে... মায়ের গর্ব হওয়ার কথা! কিন্তু... এতগুলো কথা একসঙ্গে মনের ভেতরে এবং বাইরে... মন বড় অশান্ত। বুকের ভেতর কেমন মুচড়ে ওঠে। আজ তার পরণের হলুদ শাড়িটা স্বামীর উপহার! এটা সে ছাড়বে না কিছুতেই। ঠিক যেমন এই বাড়িটাকেও।
এ প্রজন্ম খুব আলাদা! নিজেকে নিয়ে ভাবতেই ভালোবাসে। তা হোক! সে পুরোনো স্মৃতি বুকে নিয়েই বাঁচবে। নিজের মত করে। 

মন শক্ত করে সোফা থেকে উঠে রান্নাঘরে পা বাড়ায় রীণা।







মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪