স্মৃতিকথা
কাশ্মীর চতুর্থ পর্ব
শু ভ্র জী ৎ বি শ্বা স
কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে মুখ ফেরানো প্রায় অসম্ভব। কার্পণ্য না করে ধরিত্রী যেন তার সবকিছু দিয়ে কাশ্মীরকে সাজিয়েছেন। ফাঁকা সময় গুলোয় আমার একটা খুব পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছিল ডাল লেক। ছোট থেকে বই এর পাতায় কিংবা কারো মুখে ডাল লেকের কথা শুনলে খুব ভালো লাগতো। কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। সুতরাং সেই জায়গাটার প্রতি একটা আলাদা টান থাকাটাই স্বাভাবিক। তার ওপর সেই জায়গায় যদি রোজ যাওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে তো কথাই নেই। প্রথম একদিন মোমিনের কাছে রাস্তা শুনে দুপুর নাগাদ আমি আর ছেত্রী বেড়িয়ে পড়লাম ডাল লেকের উদ্দেশ্যে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
বিরাট বড় এক লেক যার মধ্যে ভাসছে অসংখ্য ছোট বড় হাউস বোট। মাঝে রয়েছে ভাসমান বাজার। যদিও লালচক অপেক্ষা সেখানে জামা কাপড়ের দাম একটু বেশি বলেই মনে হলো। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো দরাদরি করার অভ্যাস না থাকলে বুদ্ধু হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অনেকক্ষণ দরাদরির পর উঠে পড়লাম নৌকাতে। নৌকায় বসে যখন চারিদিকটা দেখলাম তখনই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। নৌকা ছাড়লো। নৌকার বৃদ্ধ মাঝি গাইড হয়ে দেখাতে শুরু করলো ডাল লেকে মিশন কাশ্মীর সিনেমা সহ অন্যান্য শুটিং এর জায়গা। মন হারিয়ে গেলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। ইতিমধ্যে আর একটি নৌকা আমাদের নৌকার সামনে এসে দাঁড়ালো।
দুজন মানুষ ফ্যারন পড়া অবস্থায় বসে রয়েছেন। দুজনের গলাতেই কাংরী ঝুলছে। একজন নৌকাটা চালাচ্ছিলেন। অপরজনের হাতে চায়ের কেটলির মতো একটা কিছু । সাথে প্রচুর জিনিস। কাশ্মীরী ভাষায় কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। মাথার ওপর দিয়ে বাউন্সার গেলো। অতঃপর ভাঙাচোড়া হিন্দী বলায় বুঝলাম তারা কাশ্মীরী কাওয়া বিক্রি করতে এসেছেন। জিজ্ঞেস করছিলেন খাবো কি না? নতুন কিছু জানা বা স্বাদ নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে বললাম আগে বলুন জিনিসটা কি, কত বছর ধরে বিক্রি করছেন ইত্যাদি তারপর খাবো। উনি নিজের জীবনের গল্প শুরু করলেন। ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে সেসব কল্পনা করতে শুরু করলাম। যাইহোক আগে কাশ্মীরী কাওয়া সম্পর্কে একটু বলি। স্থানীয় জাফরান, দারুচিনি, এলাচ এবং মাঝে মাঝে কাশ্মীরি গোলাপ দিয়ে সবুজ চা পাতা সিদ্ধ করে কাশ্মীরি কাওয়া তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত চিনি বা মধু এবং চূর্ণ করা বাদাম, সাধারণত বাদাম বা আখরোটের সাথে পরিবেশন করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে, কাওয়া একটি তামার কেটলিতে তৈরি করা হয় যা একটি সমোভার নামে পরিচিত। কাওয়ার এক চুমুকে চনমনে হয়ে গেলো সারা শরীর।
নৌকা কিছুটা এগোতে আরো দু'জন অন্য একটা নৌকা নিয়ে সামনে এসে উপস্থিত হলো। এনারা ছবি তোলার কাজ করেন। তবে দরাদরি আগে ঠিক না করে নিলে পরে কিন্তু কপাল চাপড়াতে হতে পারে। ওনাদের কাছেই কাশ্মীরী ট্রাডিশনাল পোশাক থাকে পুরুষ, মহিলা, শিশু সবার জন্য। সেগুলো পরেই ছবি তুলতে হবে। আপনি যতক্ষণে ডাল লেক ঘোরা শেষ করবেন ততক্ষণে আপনার ছবি প্রিন্ট আউট হয়ে আপনার হাতে পৌঁছে যাবে। উল্লেখ্য যে ছবি তোলার পর কিন্তু তারা আপনার কাছে পুরো টাকা চাইবে। তখন বুদ্ধি করে কিছু টাকা দেবেন। পুরোটা কখনোই নয়। আমাদের নিজস্ব ক্যামেরাও ছিল। তাই খুব বেশি ছবি তুলিনি। তবুও দাম হয়েছিল মোট ৩০০ টাকা। ছবি তোলার পর ১০০ টাকা দিয়েছিলাম। বাকিটা ছবি পাওয়ার পর দেবো বলে রেখেছিলাম। এবারে ডাল লেকে ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হলাম ভাসমান বাজারে। সেখানে জামা কাপড় থেকে শুরু করে প্রচুর জিনিস রয়েছে। যদিও আমরা কিছুই কিনিনি। কারণ দীর্ঘদিন ওখানে থাকার সুবাদে বাজার ঘোরা আগেই হয়েছিল সুতরাং জিনসপত্রের দাম সম্পর্কে ভালোই অবগত ছিলাম। লালচক থেকে একটা শাল কিনেছিলাম যার দাম পড়েছিল প্রায় ৭০০ টাকা। এক বান্ধবী সেই শাল ভাসমান বাজার থেকে ২১০০ টাকা দিয়ে কিনেছিল। ফেরার পথে কিছুক্ষণ নৌকা চালালাম। যাই হোক এবার নৌকা পাড়ে আসলো। পাড়ে সেই ভদ্রলোক ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাকি টাকা তার হাতে দিয়ে নিজেদের ছবি দেখতে দেখতে আমি আর ছেত্রী বিদায় নিলাম।
এরপরেও বহুবার ডাল লেকে গিয়েছি। ডাল লেকের ধারে বসে মুড়ি, চানাচুর খেতে খেতে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়েছি। কিন্তু প্রথম বারের মতো অনুভূতি হয়নি ।
জীবনের গল্প
ন ন্দি তা সো ম
স্মৃতির খাতার আর একটি পাতা খুলে ধরছি তোমাদের কাছে। মানুষের জন্মের পরের দিন থেকেই তার জীবন কাহিনী শুরু হয়। প্রতিটি ঘটনার সাথে তার জীবন জড়িত, স্মৃতি বিজড়িত বা জর্জরিত হয়। আমিও তার থেকে আলাদা নই। আমার জীবনের দুটি ছোট গল্প হারানো আর পাওয়ার, জীবনে জড়িত আর স্মৃতিবিজড়িত আজ সে গল্প তোমাদের শোনাই।
প্রথমে বলি হারানোর গল্প। ১৯৫৮-এর ঘটনা। বেথুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি ক্লাস থ্রী তে। বাবা বললেন স্কুল শুরু হলে বেড়ানো যাবে না। চলো এখনই আমরা বেনারস ঘুরে আসি। মনে আনন্দের জোয়ার। যাবার দিন চারেক আগে ছিল পয়লা বৈশাখ। নতুন জামা, নতুন বালা পরে পড়শীদের সাথে পার্কে বেড়াতে গেছি। আমি উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ার মেয়ে। সামনেই টালা পার্ক। আমার নেশা ফুল দেখা, ফুল তোলা আর গাছ লাগানো, গাছের দিকে চেয়ে থাকা। সবাই খেলছে, আমি ফুল তুলছি। হঠাৎ এক মহিলা আমায় ডাকলেন, 'তুমি সোনার বালা পরে ঘুরছো, চুরি হয়ে যাবে'। আমায় একপাশে নিয়ে হাত দুটো ঢেকে বললো "আমার স্বামী তোমার জন্য ফুল এনে দেবে"। এইকথা বলে আমায় একটু দূরে রেডিও পার্কে (ওখানে একটা রেডিও সিগনাল টাওয়ার ছিল) নিয়ে গিয়ে বসালো। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, কেউ ফুল আনলো না, তখন ভয় করছে। হঠাৎ শুনি সবাই আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি হাত ছাড়িয়ে দিলাম এক ছুট। বাড়িতে মা জামা বদলাতে গিয়ে প্রথম প্রশ্ন বালা কই? যেই বললাম জানিনা, পিঠে বেধড়ক পড়লো। বাবা সব কাহিনী শুনে সকালে নিয়ে গেলেন চিৎপুর পুলিশ স্টেশনে। অত ছোট, কিন্তু মনে কি মজা কত পুলিশ একসাথে দেখছি। ওঁরা কিছু ছবি দেখতে দিলেন, যদি কাউকে চিনতে পারি। আমি মহিলার ছবি দেখে চিনতে পারি। পুলিশের বক্তব্য "বালার কথা ভুলের যান, আপনার মেয়ে বরাত জোরে বেঁচে গেছে, এরা খুব ঘাঘু চোর"। "ঘাঘু" কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগলো, খুব মজার শব্দ তো। নতুন শব্দ পেয়ে বালার দুঃখ ভুলেই গেলাম। মার খাওয়ার দুঃখ ভুলিনি অবশ্য।
এবারে বলি পাওয়ার গল্প, এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি।আমাদের পাড়া খুব সমৃদ্ধ ছিল। নামকরা সব স্মরণীয় মানুষের বাস। সবাই নমস্য, গণ্যমান্য। এঁদের মাঝে একজন ছিলেন শুধু নমস্যই নন "প্রাতঃস্মরণীয়"। উনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের বাড়ি থেকে ওঁর বাড়ি ছিল তিন মিনিটের পথ। পার করা অসাধ্য ছিল না, কিন্তু ঘরে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ছিল। জন্মদিনের দিন সবাই প্রবেশ করতে পারত। বিশাল লাইন হতো। মাকে বললাম আমি যাব, মা বেঁকে বসলেন, কারণ জানিনা-- বাবাকেও বললাম। বাবা মাকে বললেন বিকেল পাঁচটায় নিয়ে যেও। বাজার থেকে রজনীগন্ধার মালা, সাদা ফুলের গুচ্ছ আর কিছু রজনীগন্ধা ফুল রেখে গেলেন। মনের আনন্দে সবাইকে বললাম যাবার কথা। বিকেলে কিছু সাথীও সাথে চলল। দরজার সামনে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। ঘরে ঢুকে কি দেখলাম তা বর্ণনার অতীত। সারা ঘর ধূপধুনোর মিষ্টি গন্ধে ভরা। সাদা শার্ট, ধুতিতে ঘরের সব আলো ম্লান করে উনি উজ্জ্বল হয়ে বসে আছেন। মুখে অদ্ভুত এক শান্ত হাসি। চোখের চাহনি কি সুন্দর! মনে হচ্ছে সব বুঝতে পারছেন। নির্বাক কবি, নির্বাক আমি। মালা পরালাম, পাশে ফুলের গুচ্ছ রাখলাম। স্পর্শ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কবির নাতনীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে ফুল ছড়িয়ে দুই পা ধরে প্রণাম করলাম। কবির এক নাতনী এসে ওঁর ডান হাত আমার মাথার উপরে স্থাপন করে দিলো। কবি কি বুঝলেন জানিনা। আমি ধন্য হলাম। মনে সাধ জাগলো যদি বিদ্রোহী কবির মতো লিখতে পারি! সাধ কোন অজানার অতলান্তে হারিয়ে গেল সময়ের সাথে জানিনা। সময় শেষ, কবির খাবার সময় হয়ে গেছে, কবিকে বাড়ির লোকজন ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমরা চলে এলাম। আজো মনের মণিকোঠায় সেই স্মৃতি অমলিন। আমরণ থাকবে। সার্থক লেখা- "ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি?"
আমাদের গ্রামের বাড়ির পুজো
চ ন্দ্রা নী চৌ ধু রী
আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে আমাদের দূর্গা পূজা হয় প্রায় দুশো বছর ধরে। একথা শুনে আসছি বিয়ের পর থেকেই। কিন্তু শুরুতে যাওয়াই হয় নি। কারণ কলকাতায় তখন স্থায়ী থাকা হতো না। পরে যখন শ্বশুর মশাই মারা গেলেন তখন আমাদের এক খুড়শ্বশুর মশাই, আমাদের প্রায়ই এই পুজোর গল্প করতেন আর বলতেন যাওয়ার জন্য। সেই থেকে আমাদের যাওয়া শুরু।
পুজোয় কলকাতা থাকলে গ্রামের পুজোয় যাই। ভীষণ ভালো লাগে। চৌধুরী ঠাকুরবাড়ি ট্রাস্ট যেখান থেকে বারোমাসের সব পুজো, দোল দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। এবং এটা আমাদের পারিবারিক পুজো হলেও গ্রামের আর সবাই চাঁদা দেয়, পুজোর কাজ করে আনন্দ করে। আবার সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের লোকজন মিলে ঠাকুর দালানে যাত্রাও করে। দারুণ জমজমাট ব্যাপার। নবমীতে আগে পাঁঠাবলি হলেও এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। পাঁঠাবলির রক্তারক্তি কান্ড একেবারেই নিতে পারি না। শরীর খারাপ লাগে। বলি ঘিরে ঐ উল্লাস পৈশাচিক মনে হয়। যদিও অনেকেই বলেন যে বলি আসলে নিজের অহংকে ঠাকুরের কাছে বলি দেওয়া। তবুও বলি বন্ধ হওয়ায় আমি খুব খুশি।
আমি যখন প্রথম যাই, কাউকেই সেভাবে চিনি না জানি না কিন্তু কাকু আমাদের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সড়গড় করে দিয়ে ছিলেন। কেমনভাবে যেন সেই পুজোর সঙ্গে লেপ্টে গেলাম। ভালো লাগতো। নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো, আত্মীয়স্বজনের মাঝে বসে অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদ খাওয়া। সবকিছু বড্ড নিজের। সবাই নতুন শাড়ি জামাকাপড়ে সজ্জিত, কুশল বিনিময়ে এত আন্তরিকতার ছোঁয়া আগে কখনো পাই নি। অনেকেই খুব খুশি যে আমরা শহরের জাঁকজমক ছেড়ে ওখানে ওমন গ্রাম্য সারল্যে খুব সাধারণ মানুষগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে মজা করছি। চোখে মুখে আনন্দ। গ্রামের রাস্তায় অক্লেশে ঘুরে বেড়িয়ে, কোনটা কার বাড়ি, কোন বাড়ির কে নামকরা অফিসার কিংবা প্রফেসর কিংবা ডাক্তার উকিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে বিদেশে নাম করেছে, তার গল্প করছি। কেউ ডাকছে। আমার কর্তাকে বলছে তুমি শিবুদার বড়ো ব্যাটা লও। আর ঐ শিবুদার বড়ো বউমা। তা বউমা এই অজগাঁয়ে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে লাই তো। আমি একগাল হেসে কি বলবো ভেবেই পাচ্ছি না। মনে মনে আমি তো দিশেহারা। সবকিছু গোগ্রাসে গিলছি। মাটির দেওয়ালে ঘুঁটের আল্পনা, আচ্ছা এতো ঘুঁটে ঘরের দেওয়ালে গন্ধ বেরোয় তো। আমি পাচ্ছি। খড়ের গোলায় ধান, ঝুলে পড়েছে মাথার উপর তেঁতুল গাছের ডাল, সামনেই মস্ত বড়ো বাঁশবাগানের ঝোপ, তার কাছেই শ্যাওলা ধরা পুকুর, আবার কারোর আঙিনা শিউলি ফুলে একাকার। কোনো কলাগাছে বিরাট মোচা ঝুলছে। কোনটা ছেড়ে কার ছবি তুলবো আমি। ফোকলা কুঁজো হয়ে যাওয়া আশি বছরের বুড়ির আনন্দ নাকি দূরের সবুজ তেপান্তর। কোনটা বেশি সুন্দর, এই ধাঁধায় আমি তো মনেমনে দিশেহারা।
আমি তো আদ্যন্ত শহুরে পরিবেশে বড়ো হওয়া, বারোয়ারি পুজো দেখে অভ্যাস। এই একান্ত আপন ব্যাপারটা আমার কাছে অভাবনীয় লোভনীয়ও বটে। অনেক রীতি নিয়ম শিখেওছি। সবার সঙ্গে একাসনে মন্দিরে বসে ঠাকুরের সামনে মুগ্ধ। আমাদের ঠাকুর আমাদের পুজো।
তারপর কাকুর বাড়িতে অনেক গল্প। কতো বইয়ের আলোচনা। কাকু ইংরেজির প্রফেসর ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের। কত বই লিখেছেন। আমি সাহিত্যের ছাত্রী জেনে আমাকে অনেক বই দিয়ে ছিলেন। কতো রকমের গাছপালা। বাড়িতে কাজের মাসিরা কত কিছু রান্না করছে। সব বাড়ির ক্ষেতের টাটকা। পুকুরের মাছ। জাল ফেলে মাছ ধরা। সবই দেখছি। রাতের বেলা কেমন যেন নিঝুম। আশ্বিনের আকাশ তারায় ভরা। উঠোনে ইজিচেয়ারে বসে আছেন কাকু, আর বলে চলেছেন কোনটা কোন তারা। আমাদের সেই তারা চেনানো সঙ্গে কত রকমারি গল্প। এক কথায় অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ঋদ্ধ হয়েছি মনেপ্রাণে। সবমিলিয়ে আমার চেতনার রঙে রাঙিয়ে সেই গ্রামের বাড়ির নিতান্ত সহজ সরল পুজো এখন আমার হৃদমাঝারে। কোনোদিন আর ছাড়তে পারবো না। কলকাতায় থাকলে ঠিক যাবোই যাবো।
শারদ বদল
শি বা নী চৌ ধু রী
ছোটোবেলায় নিজের গ্রামে দুই বাড়ির পূজো হতো। সাত বাড়ি আর পাঁচ বাড়ির।শরিকানার পূজো। বারোয়ারি পুজো তখন গ্রামে হতোনা।পঞ্চমীতে হাফ স্কুল হয়ে পূজোর ছুটি পড়তো। সে যেন অন্য আনন্দ!
মহালয়ার আগে পরে নতুন জামা হতো একটিই। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জামার গন্ধ নেওয়া চলতো ষষ্ঠী অবধি।সপ্তমীর সকালের অপেক্ষায় আগের দিন ঘুম আসতো না।ওই দিনই নতুন জামা পরার অনুমতি মিলতো।
পুজোতেই পেতাম বসন্তমালতী, নেলপলিশ, পন্ডস্ পাউডার, কাজল পেনসিল, সিঙ্গার বিন্দি, একহাত কাঁচ বা প্লাস্টিকের চুড়ি। চুড়ি বাদে সবই মিলেমিশে ব্যবহার বোনের সাথে।
কখনো কখনো জামায় লাগানো দামের টিকিট ইচ্ছা করে তুলতাম না পাছে জামা পুরনো হয়ে যায়। অষ্টমীতে ডালডার ফুলকো লুচির গন্ধে বাতাস ম ম করতো, সাথে বেগুন ভাজা, নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, ছোলা দিয়ে কুমড়োর তরকারি আর সিমুইয়ের পায়েস। আহা! যেন অমৃত! নবমীতে বাটি সাবানের মতো আলু দিয়ে খাসির মাংসের ঝোল ও চাটনি, ভাত কলাপাতায় খাওয়া। চোখ বুজলে এখনও যেন দেখতে পাই!
অষ্টমীর দিন দাদুর কাছ থেকে পেতাম পনেরো পয়সা। তাই দিয়ে দশ পয়সার বন্দুক, পাঁচ পয়সার টিপ টোটা তিন কৌটো।কতবার যে টোটা রোদে পড়তো আর গুনতাম তার ইয়ত্তা নেই।
রান্না ঘরের তাকে ঝকঝকে হরলিক্সের শিশিতে থাকতো মায়ের পরিপাটি হাতে তৈরী হালকা এলাচ গন্ধ চিনি ও গুড়ের নাড়ু, মুচমুচে কুঁচো নিমকি। অবাক হয়ে ভাবতাম মা কেমন করে এতো ধপধপে সাদা চিনির নাড়ু করে! হাতে সেসব জিনিস পরিমিত পেলেও আনন্দ ও খুশি ছিল অপরিমিত।
দশমীর সন্ধ্যায় গ্রামের ঠাকুর জলে পড়লে নতুন আলতায় কলম ডুবিয়ে বেল পাতায় লেখা হতো দুর্গা নাম। তারপর বাড়ির বড়দের প্রণাম করা।
দশমীর রাতে বিসর্জনের বাজনা শুনতে শুনতে বুকের মধ্যে একদলা কান্না পাক খেয়ে উঠতো। মনে হতো বড়ো আপনজন বুঝি চলে গেলো একটি বছর জন্য।
আস্তে আস্তে কবে যেন নিজের অজান্তেই বড়ো হয়ে সংসারের দুর্গা হয়ে সবদিক সামলাতে শিখেছি একটু একটু করে জানিনা! সেই সাথে আবেগ উচ্ছ্বাস কমেছে মৃন্ময়ী মায়ের প্রতি। পূজো মানেই এখন আর পাঁচটা দিনের মতোই মনে হয়।
নিজের জন্য নতুন শাড়ি কেনার আগ্রহ নেই, নেই ঠাকুর দেখার আকুলতা, খাওয়ার সাধ, টোটা ফাটানোর ইচ্ছা। হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। তাই পূজোয় আর মা মা গন্ধ পাইনা।
বদল হয়েছে ভেতরের 'আমি'র। সেটা টের পায় শুধুমাত্র আমার ভেতরের 'আমি'।
টুকরো স্মৃতি
বি ধা ন ঘো ষ
সন্ধ্যাবেলায় রোলকলে কুশল মেজর ঘোষণা করলেন, "বাচ্চেলোগ, তুমহারে লিয়ে এক খুশখবরি হ্যায়! কোম্পানি কমান্ডার সাহাবসে ইজাজত মিলা হ্যায়! কাল আপলোগ একঘন্টে কে লিয়ে বাহার যাকে মা দুর্গা কি প্রতিমা দর্শন কর পাওগে!"
সবাই তো ডিউটি ছেড়ে একসাথে বেরোতে পারিনা। রাতের বেলায় নিজেরা বসে ঠিক করে নিলাম দুই দলে ভাগ হয়ে পালা করে বার হবো। দু'বছর হলো পুজোয় বাড়ি যেতে পারিনি। মনটা ভীষণ খারাপ। কি আর করা যাবে! মনে মনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম! এখানে পুজো বলতে স্থানীয় 'ডিমাকুচি টি এস্টেট'-এর ভিতরে একটা পুজো হয় সেটার কথা বলা হচ্ছে। অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে পুজো।
রাতে ডিউটি ছিলো, সেকেন্ড শিফটে, রাত নটা থেকে বারোটা। সবেমাত্র ক'দিন হলো জায়গাটাতে এসেছি। ভূটানসীমান্ত ঘেঁষা ছোট্ট জনপদ, ডিমাকুচি। চারিদিক জঙ্গলময়। অনতিদূরেই পাহাড়ের সারি। অরুনাচল প্রদেশ দূরে নয়। বোড়ো উগ্ৰবাদীদের ডেরা এই আসাম ভূটান ও অরুনাচল সীমান্ত লাগোয়া এলাকাটা। জঙ্গল থেকে বার হয়ে বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করে আবার টুক করে সীমানা পার হয়ে ভূটানের জঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয় নেয় ওরা। কয়েকদিন আগেই বাদলাপাড়া চা বাগানের শ্রমিকদের মাইনের গাড়ি লুট করে এদের একটা দল। সঙ্গে ম্যানেজারকেও কিডন্যাপ করে ভূটানের জঙ্গলের কোনো গোপন আস্তানায় রেখে দিয়ে বিশাল অঙ্কের মুক্তিপণ চায়। আসাম পুলিশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। এমত অবস্থায় আমাদের এক প্লাটুন জওয়ানকে ডিপ্লাই করা হয়েছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে। আমাদের আস্তানা হয়েছে বনদপ্তরের এক পরিত্যক্ত বাংলোয়। বছরখানেক আগে উগ্ৰবাদীরা এখানে লুটপাট চালায়, আগুন ধরিয়ে দেয় সমস্ত ঘরবাড়িতে।
রাতে ডিউটি দিচ্ছি। হাতে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। যেকোনো মুহুর্তে বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু আমি কিছুতেই মনোসংযোগ করতে পারছি না। আজ অষ্টমীর রাত। বাড়ি থাকলে কি করতাম ... হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ার মন্ডপে বসে আড্ডা দিতাম! হয়তোবা সবাই মিলে একটু পানাহারের আয়োজন করতাম! বাবা-মা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়তে লাগলো। গ্ৰামের সব সুন্দরী মেয়েদের মুখগুলো এক এক করে চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগলো! একজন সদ্য কুড়ি পার হওয়া যুবক যা যা ভাবতে পারে সব ভাবনাগুলোই নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম!
আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো সামনের জঙ্গলের ভিতরে কিছু একটা নড়াচড়ার আওয়াজে! সজাগ হয়ে উঠলাম! ষষ্ঠেন্দ্রীয় ইঙ্গিত দিচ্ছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে! আঙুল নিজের অজান্তেই কখন ট্রিগারে চলে গেছে! আওয়াজ একটুখানি থেমে যাওয়ার পর আবার কানে ভেসে আসলো! সঙ্গে গাছপালাগুলোও যেন ভীষণ ভাবে আন্দোলিত হতে লাগলো! মনে খটকা লাগলো। আর যাইহোক দু-পেয়ে জন্তু হতে পারে না! যা ভাবলাম তাই! ঝোড়জঙ্গল ফুঁড়ে যিনি বার হয়ে আসলেন তাঁর জন্যে তো একদম প্রস্তুত ছিলাম না! গজরাজ, মেরেকুটে একশো থেকে দেড়শো হাত দূরে! কি করবো ভেবে উঠতে পারলাম না! উগ্ৰবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে। কিন্তু এটা তো আউট অফ সিলেবাস!... ওকি! ওতো সোজা ক্যাম্পের দিকেই এগিয়ে আসছে! একা নয় সদলবলে! একটা , দুটো ... তিনটে... চারটে! আর গোনার সময় পেলাম না! কি ঘটতে চলেছে সহজেই অনুমান করতে পারলাম। বাঁশি বাজাতে শুরু করলাম। সঙ্গে মরণপণ চিৎকার-- হাতি! হাতি! সব বাহার নিকলো! মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত জওয়ান বার হয়ে আসলো নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে! মেজর কুশল নেগি গাড়োয়ালের লোক। জঙ্গলজীবনে পোড় খাওয়া মানুষ। চিৎকার করে হুকুম করলেন "গোলি মত চালানা!"... "সব ভাগো ইঁহাসে!" যে যেমন পারলাম অন্ধকারের মধ্যেই দৌড় লাগালাম। যাকে বলে বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ তাই করতে হলো!
না, হস্তি বাহিনীর আমাদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আমাদের শিবিরে প্রবেশ করে নি। আমাদের লঙ্গরে রাখা চাল, ডাল, আটা সমস্ত রেশন সাবাড় করে নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর দূরের বস্তী থেকে ঢাক, ঢোল, ক্যানেস্ত্রা পেটানোর আওয়াজ কানে ভেসে আসলো। পরিস্থিতি নিরাপদ বুঝে আমরা এক এক করে সব ক্যাম্পে ফিরে আসলাম। আবার আমাদের 'ফল ইন' করিয়ে জওয়ানদের গুণতি করানো হলো। কিন্তু একজন জওয়ান তখনও এসে পৌছায়নি! কে আসেনি! খোঁজ নিতে দেখা গেলো সিপাহী মাঙ্গিরাম! রাতের বেলায় ওর মেসের দেখভাল করার ডিউটিই তো ছিলো। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবাই মিলে সার্চ লাইট জ্বালিয়ে আশেপাশের জঙ্গলে তলাশ করলাম। কিন্তু মাঙ্গিকে পাওয়া গেলো না। ওকে কি হাতিতে উঠিয়ে নিয়ে গেলো তাহলে! অবশ্যই জঙ্গি হাতির দলের কাজ হবে এটা। রাতারাতি কোম্পানি হেডকোয়ার্টার, ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টার চারিদিকে ম্যাসেজ পাঠানো হলো--- সিপাহী মাঙ্গিরাম ইজ্ মিসিং! ইট ইজ্ সাসপেক্টেড দ্যাট আ্য হার্ড অব্ ওয়াইল্ড এলিফ্যান্টস কিডন্যাপড্ হিম!
পুনশ্চঃ - পরের দিন সকালে একটা ভালো ও আর একটা খারাপ খবর আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ভালো খবরটা হলো মাঙ্গিরাম নিজে থেকেই পরদিন সকালে ক্যাম্পে ফিরে এসেছিল! ও বেচারা হাতির ভয়ে রাতের অন্ধকারের মধ্যেই একটা ট্রি হাউজে উঠে বসেছিল! তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে! (গোপন সত্যিটা হলো দ্রব্য গুণে ঘুম এসে পড়েছিল! এই ব্যাপারে ওর বিশেষ খ্যাতি বা কুখ্যাতি যাই বলুন না কেন ওর ছিলো!)
খারাপ খবরটা হলো আমাদের আর প্রতিমা দর্শনের জন্যে বাইর যাওয়া হয়ে ওঠে নি । সারাটা দিন ক্যাম্পের চারিদিকে পরিখা খুঁড়তে আর তারকাঁটার ফেন্সিং দিতেই পার হয়ে গেলো !
দিনটা ছিলো শুভনবমী, ১৯৯১ সাল ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন