ভ্রমণ কাহিনী


পালানোর পাঁচকথা: দেওরিয়া তাল- চোপতা, পর্ব- গ

মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত

এখানে উপর থেকে দেওরিয়া তালকে আবার এক ঝলক দেখে সামনে পা ফেলি। সাংঘাতিক চড়াই। দু'হাতে উপরের শিলাখণ্ড আঁকড়ে হাতে বাড়তি বল খরচা করে উঠতে হচ্ছে কোথাও। একদমে খানিকটা ওঠার পর অবশ্য মন-জুড়ানো চোখ-পুরানো ফুল কি অন্য রকমের শ্যাওলা-মসের দর্শন মিলছে। আশ্বাস দিচ্ছে, 'আরে ইয়ার, পরেশান ভোলো। দ্যাখো, দ্যাখো আমাদের। তাতে আমরা তোমরা দু'পক্ষই সার্থক।

কিন্তু উঠেই যাচ্ছি। এমন কতক্ষণ চলবে! খুব কষ্ট হচ্ছে এই ঝান্ডি টপ টপকাতে। চড়া রোদে গায়ে ঘাম বইছে।
'অ্যায়সাই বরাবর!' ছেলেটা এ প্রশ্নে নিশ্চিত মনে হাসল। কলকাত্তাইয়াদের তাগদের ছিরি দেখে। নিজে আগে বেপরোয়া উঠে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের হাল। বলল, 'থোড়া।'
পাথরের গায়ে-খাঁজে নতুন-লাগা মস-গুল্ম, দু'একখানা ছোট্ট ফুল ক্লান্তিতে মলম বুলাচ্ছে। না-এলে কি দেখতে পেতাম? আনন্দটুকু অধরা থেকে যেত।
নীচে বসতি চোখে পড়ল। সারি গ্রাম। এক মন্দির। সেখানে বড় বার্ষিক মেলা বসে। ওঙ্কার রত্নেশ্বর মহাদেবের মন্দির।
আরও খানিক চড়ার পর হালকা নামা-ওঠা। বনভূমি গাঢ়তর। বিপুলাকার গাছগুলির তলায় নিজেদের ক্ষুদ্রতম লাগছে। ডানদিকে উঁচু হয়ে নেমে নেমে বোধ হয় চোপতার গাড়িপথ। বাঁদিকে শৈল সাম্রাজ্য। শ্যামল পাহাড় পেরিয়ে হঠাৎ সাদা চূড়াভাস। ঢালু হয়ে নেমেছে বাঁয়ে। শেষে এক ধারা থাকবেই। তারপর ফের উঁচুতে উঠবে ভূমিতল।
বিশেষ চাপ নেই আর। দেখতে দেখতে চলা। গল্প করছে জগদীশ। আমাদের স্যাক চাইল একবার। উচিত নয়। পীড়াপীড়িতে জলের বোতলটা থাকল ওর কাছে। হালকা পায়ে তরতরিয়ে এগিয়ে নজরের ভিতর দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা
খানটুক ধুঁকি, খানটুক এপাশ ওপাশ উঁকিঝুঁকি।


হিমালয়ের এই অরণ্যলোকে সবকিছু নতুন লাগছে। ছেলেমানুষী কৌতূহলে আক্রান্ত হয়ে পড়ছি। মেরি কুরিও নাকি বলেছিলেন, "All my life through, the new sights of Nature made me rejoice like a child."
সত্যিই অন্য রকম। একটা পোকাও নতুন লাগছে। গাছ-লতাপাতারা যেন ভিন্ন গ্রহের। বাংলার চেনা শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে যায় না। তাই ভারী আনন্দ হচ্ছে।

গাইডের দেখানো পথে হাঁটছি। যদিও পথ কিছু নেই।জঙ্গল কোথাও এত ঘন যে, মনে হচ্ছে ওর ভিতর থেকে কেউ বা কারা আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে। ডালপালা দুলিয়ে কে উড়াল দিল। বড়সড়ো পাখি। চলে যাওয়ার আভাসটুকু রেখে সে কোথায় হারাল! কী পাখি? শুনেছিলাম, এদিকে হিমালয়ের অপরূপ মোনাল থাকে। উত্তরাখণ্ডের রাজ্যপাখি। দেখতে না-পাওয়ার আফসোস রইল শুধু।

পাইনবনের যেখানটায় অন্ধকার জড়ো হয়ে আছে, সেখানে ভল্লুকভ্রম হচ্ছে। হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের চারণক্ষেত্র যে। সামনে পড়লে কী হবে! তেনারা নাকি দু'পায়ে দাঁড়িয়ে পড়লে হয়ে গেল। ওটা অ্যাটাক করবার প্রাক-মুহূর্ত। অযোধ্যা পাহাড়ে মুন্ডা বনজীবীর গল্প মনে পড়ল। বলেছিলেন, জঙ্গলে কাজ করন্ত তাঁর একেবারে নাগালে একজন মানুষের মতো দাঁড়িয়ে দুই হাত(?) তুলে রাখে। আক্রমণোদ্যত। হাতের চকচকে ফাড়সা বাগিয়ে তিনিও রেডি। এগোলেই আত্মরক্ষার্থে তাকে ঘায়েল করবেন। হিংস্র নখদন্ত আর ধারালো লোহা —দু'পক্ষই অনড় নাছোড় অনেকক্ষণ। বুদ্ধি করে শেষে ফাড়সাটিকে আড়াআড়ি দু'হাতে মেলে ধরতে বাঁশের হাতলে নখ বুলিয়ে শ্বদন্তে চিবিয়ে বিদায় নিলেন সেই জাম্বুবানের বংশধর। বনজীবীর ভাষায়, 'ভাইবলো শত্তুর শ্যাষ।'
আমাদের হাতে হাত ছাড়া কিছুই নেই। জগদীশ অভয় দেয়, চুপচাপ থাকলে ওর ইচ্ছেয় সরে যাবে।

পিছিয়ে পড়েছি অতি কৌতূহলবশত। ওরা বেশ এগিয়ে। পা চালাই জোরে। দেখি, অশোক এক গাছের তলায় কী খুঁজছে। গাইড ভাইটিও। যাঃ, কিছু হারাল?
আখরোট খুঁজছে এবং পাচ্ছে। কাঁচা-পাকা-পচা। পাথর ঠুকে ভেঙে.....। আহা! স্বপ্নেও ছিল না, এমন ভাবে আখরোট গাছ-ফল পাব, খাব।
বসে ভেজা ছোলার সদ্গতি করতে দম বাড়ল। লজেন্স বিস্কুট চানাচুর চলছে ফাঁকে ফাঁকে।
হাঁটছি আর হাঁটছি। দুপুর গড়াতে চমৎকার তৃণভূমি পড়ল। একপাশে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। অকস্মাৎ জমিটায় পা রাখলে বোঝা দুঃসাধ্য কোন দিক দিয়ে কীভাবে পেরোব। এদিক-ওদিক চেয়ে পরখ করে ভাইটি ঠিক দিশাই পেল। রাস্তার চিহ্নমাত্র নেই তো। মাঝামাঝি পৌঁছলে সত্যিই হতবুদ্ধি লাগে। একটা ব্যূহর মতো। এর নাম বোধ হয় রোহিণী বুগিয়াল।দেওরিয়াতাল থেকে আট কিমি গেলে।
চড়াই নেই প্রায়। নাগাড়ে অনেকটা এগোনো যাচ্ছে। জঙ্গল এখানে মোহ সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে হয়তো এমন বৃক্ষ তরু দ্রুম পাদপ মহীরুহ বিটপী লতা বল্লরী বিরুৎ ব্রততী গুল্ম পল্লব কুসুম ছাড়া কিছু নেই। এ সবুজ সাম্রাজ্য বিজনে আশ্চর্য বিতান সৃষ্টি করে নিজের সৌন্দর্যে নিজেই মুগ্ধ হয়ে কালক্ষেপ করছে। এখানে নাগরিক বেশবাসে হিসেবি মনের আমরা অপ্রত্যাশিত, বহিরাগত। প্রতিপক্ষও।


পিঠে স্যাক নিয়ে পদচারণার ঘোরে দেখতে পেলাম, অগণ্য মুখের করুণতম অভিব্যক্তি। শুনতে পেলাম, সংখ্যাতীত প্রাণের বিপন্ন স্পন্দন।
দশ হাজার বছর ধরে সভ্যতার উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব-বনভূমির এক-তৃতীয়াংশ মহাগ্রাসে হারিয়ে গেছে। বেয়াল্লিশ কোটি হেক্টর অরণ্য লোপাট গত তিরিশ বছরেই। হিমালয়ের সবুজ বিবর্ণ হচ্ছে প্রতিদিন। শেষ কোথায় জানা নেই। সবেরই শেষ থাকে। ধ্বংসের থাকে না বুঝি!
নগরায়ন চাই। সুখ চাই। গাছের পাতা রাজপথে?ঝেঁটিয়ে সাফ করো। শুঁয়োপোকা হয়, পাতা পচে, সাপখোপের আড্ডা, যত্তো জঞ্জাল! —হটাও সব। তারপরে তো ঝড়ে উপড়ে ঝক্কি বাড়ায়, পড়শির গাছের ডাল পাঁচিল টপকায়, ইত্যাদি হাজারো কিসিম। আর গণস্বার্থে (!) রাজকীয় কর্মকাণ্ডে, রাস্তা চওড়াতে, পুতুল খাড়া করতে, ভাবী ঐতিহাসিক সৌধ বানাতে বলি দাও ওই নির্বাক, সমাহিত বৃক্ষরাজিকে।
যুক্তি আছে শানানো। এক হাজার কাটলে এক লক্ষ পোঁতা হবে। হয়তো যুক্তিপরায়ণদের দাপুটে হুঙ্কারে একশো বছরের পরিণত গাছ এক বছরেই পূর্ণ চেহারা পাবে। বৃক্ষরোপণ উৎসবে মিডিয়া লাফ-ঝাঁপ করবে, কর্তা-কর্ত্রীর চারু হাতে একটি শিশু উদ্ভিদ অনুগ্রহ লাভ করেছে, সে ছবি দেখে আমরা পুলকিত হব। ছেলেমেয়েরা অনলাইনে পড়বে লিখবে 'গাছ লাগাও, প্রাণ বাঁচাও।'
এখনও শহরে, আধা-শহরে বকুলতলা শিমুলতলা অশ্বত্থতলা ঝাউতলা তেঁতুলতলা আমতলা বেলতলা কুলতলা সবেদাবাগান পেয়ারাবাগান লিচুবাগান নামের কত কত জনপদ। গাছগুলো ছাড়া এই সবখানে যাবৎ ভোগ্যদ্রব্যাদি বর্তমান।

এমন নির্মম সত্যের পাশে পাশে মহিমারা বেঁচে থাকে তবু। গাছ-প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষায় আলোড়ন উঠেছে বারবার দুনিয়ার এখানে-ওখানে। যে আরণ্যভূমিতে এখন আমাদের অবস্থিতি তার কাছাকাছি এক জায়গা এমন এক আলোড়নের উৎস। বলছি, চোপতা পেরিয়ে চমোলী জেলার গ্রাম মণ্ডলের কথা। অলকানন্দা উপত্যকায় এখানেই ১৯৭৩ সালে শুরু হয়েছিল চিপকো আন্দোলন। 'চিপকো' অর্থ আলিঙ্গন বা আঁকড়ে জড়িয়ে ধরা। বিদেশি মুনাফা সংগ্রাহকদের ঢালাও বৃক্ষহননের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে নারীর অংশগ্রহণ দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
সমাজকর্মী চণ্ডীপ্রসাদ ভট্ট'র নেতৃত্বে অবোলা ও অ-বলা গাছেদের সবলে জড়িয়ে ধরেছিলেন শৈলপল্লির অবলাকুল। অভিনব এই আন্তরিক অহিংস প্রতিবাদ প্রসারিত হয় পর্বতরাজ্যের অন্দরে-কন্দরে। ক্রমে দেশের সর্বত্র। এগিয়ে আসেন সম্প্রতি প্রয়াত সুন্দরলাল বহুগুণা। প্রশাসনের তৎকালীন বন-নীতির বিরুদ্ধে দু'সপ্তাহ অনশনে বসেন। বদলায় সরকারি নির্দেশিকা।
১৯৭৯ সালে পর্যন্ত উত্তরাখণ্ডের শ'দেড়েক গ্রামে যেখানেই গাছ কাটার উদ্যোগ দেখা গিয়েছে সেখানেই গ্রামবাসিনীরা পৌঁছে গাছ জড়িয়ে ধরে পতন থেকে রক্ষা করেছেন।
বীরাঙ্গনাদের উল্লেখনীয় ক'জনা হলেন গৌরা দেবী, সুরক্ষা দেবী, বিরুষ্কা দেবী, বচনী দেবী, সুদেশা দেবী। জানা থাক, ১৯৮৫তে রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান চণ্ডীপ্রসাদ ভট্ট। আর ২০০৯-এ ভারত সরকারের 'পদ্মবিভূষণ' পেয়েছেন সুন্দরলাল বহুগুণা। সকলের জন্য রইল যথোচিত সম্মান ও শ্রদ্ধা।
শিবের গীত গাইলে ধান ভানার কাজটায় কিছু সুবিধে হয়। তাই এমন পুণ্যভূমি স্পর্শ করে এত বলতে ইচ্ছে করল। মনের কথা, স্রেফ 'গেলাম রইলাম খেলাম দেখলাম' তরিকার ভ্রমণকথা লিখতে মন চায় না, কলম সরে না।


তরতরিয়ে এগোচ্ছি। ঝোপঝাড় লতাগুল্ম মহীরুহরা পিছনে থাকছে। জগদীশ লাফ মারছে যেন। পারি কত আর! ও মনে করাচ্ছে, সাম হলে বিপদ। অতএব, তুরন্ত.....।
কিন্তু এভাবে পালাই পালাই ভাল লাগে না। চুপচাপ একটু ঢিলে দিই গতিতে। যেন খুব তকলিফ হচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে খেয়ালই নেই সূর্য কোনদিকে হেলেছে। প্রায় তিনটে বাজতে শ্যাওলা-জড়ানো ছোট এক কংক্রিট সাঁকো মিলে গেল। তলে উপল-বাধার তোয়াক্কা না-করে কোন আকাশপ্রান্ত থেকে তোলপাড়িয়ে নামছে ঝরনা। কী অপরূপ লাগছে তাকে। বেহদিশ উচ্চতা থেকে ঐকতানে মুখর করে তার নেমে আসা। সাঁকো টপকে নামি। সুশীতল স্নিগ্ধ স্বচ্ছ সুপেয় বসুধাবারি।
অশোক লাঞ্চের প্রস্তাব দিল। নারাজ হতে কে চাইবে? সকাল থেকে এ পর্যন্ত কাঁচাছোলা আর টুকটাক ছাড়া মুখগুলো কিছু পায়নি। তায় এমন আয়াসী পাহাড় বাওয়া!
টিফিনবক্সে চিঁড়ে ছাতু চিনি দিয়ে জম্পেশ পিন্ডি তৈরি করল অশোক। তিনজনে মন-পেট ভরে খেয়ে কী পরম তৃপ্তি! তেষ্টা মেটাল ঝরনা। জগদীশ জানাল, এর নাম আকাশগঙ্গা। আকাশকামিনীও বলে।
  
ছবি: দেওরিয়া তাল, তুষার শৃঙ্গ ও আখরোট গাছ।
  গঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ড।







আমার প্রথম ছোট্ট সফর- মাতৃভূমি ঢাকা- পর্ব ৩ ও পর্ব ৪

সু জা তা  দা স

শাওলিন- একটু শ্যামলা রঙের ছোট্ট মুখে হাসি লেগে থাকা মেয়েটি আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসেছিল প্রথমেই,
তারপর জড়িয়ে ধরে বলেছিল ভালো আছেন তো দিদি? বড্ড মায়া মাখা একটা নরম ভাব আমি ওর মধ্যে লক্ষ্য করেছি সেই সময়- সম্ভবত আমার মেয়ের বয়সি শাওলিন, পরে অনেক আলাপ আড্ডা একসাথে নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়ানো আর এখন ঢাকা মানেই প্রথমে ওর বাড়ির ওর ঘরটা আমার দখলে। কলমযোদ্ধার অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার জন্য যখন, আমি সুব্রত আর শাওলিন ছোট্ট একটা মিটিং করে সব ঠিকঠাক করে নিচ্ছিলাম, সেই সময় শাওলিনের ভূমিকা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সুব্রত কতটুকু বলবে, ও নিজে কতটুকু বলবে আলাদা করে লিখে নেওয়া, মন দিয়ে সুব্রতর বক্তব্যকে অনুধাবন করা, এবং আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করা দিদি ঠিক হচ্ছে তো- "আমি তো কখনও করি নাই এমন সঞ্চালনা, তাই একটু ভয় ভয় লাগতেসে"। ওর কথা বলার ধরণ দেখে একটু হেসে বলেছিলাম সব ঠিক হবে চিন্তা কি--- সেদিনের অনুষ্ঠানে শাওলিন আর সুব্রতর যুগোলবন্দি মনে থাকবে অনেক দিন আমার। আজ যদিও আমি কলমযোদ্ধা পরিবার থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি কিন্তু শাওলিন রাসেল সায়মা আজও একই ভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছে। রাসেলের সাথে শাওলিনের স্বামী কম বন্ধু বেশি, আর এই দিকটাই আমাকে মোহিত করেছে--- এই ভাবেই এগিয়ে নিয়ে চলুক ওদের মিষ্টি সম্পর্কের মুহূর্তগুলো নিয়ে ওরা দুজনে--- সুব্রতর বাচিকভঙ্গি অসাধারণ তেমনই একজন ভালো আবৃত্তিকার, নতুন একটা নিবেদনে প্রত্যেকেই ডায়াসে ডাকার কৌশলটা একেবারেই অন্যরকম দেখেছিলাম আমি--- প্রত্যেকের কবিতার চার/ছয় লাইন আবৃত্তি করে ডায়াসে ডেকেছিলেন সুব্রত তৎকালীন লেখকদের, নিজের কবিতার আবৃত্তি শুনতে শুনতে আমি ও সকলেই এগিয়েছিলাম ডায়াসে নিজেদের বক্তব্য রাখতে--- আমি লিখতে পারি কিনা আমি জানি না, তবে আবৃত্তিকার নই যে এটা খুব ভালোই জানি তাই পাঠ করেছিলাম সেদিন সুব্রতর একটা কবিতা--- এই অভিনব প্রয়াসকে আমি সাধুবাদ জানাই আজও এতটা সময় পার করে এসেও--- সুব্রতর পথচলা সাফল্যে ভরে উঠুক, পরে আরও অনেক নতুনত্বের স্বাদ হয়তো অপেক্ষা করে থাকবে আমার মতো সাধারণ এক লেখিকার কলমে।

আমি ভালো বক্তা নই তবে অজয় দাদা, যে পশ্চিম বাংলা থেকে আমার মতোই আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঢাকাতে কলমযোদ্ধার অনুষ্ঠানে---
তার বক্তব্য আমার মনে থাকবে বহু সময় ধরে, দুই বাংলার মাঝে যে তুচ্ছ এক কাঁটাতারের বেড়া আমাদের মতো কিছু মানুষকে আটকে রাখতে--- তা হয়তো ভেঙে পড়বে একদিন আমাদের অধ্যাবসায়ে, যার সুফল হয়তো আমাদের আগামী প্রজন্ম দেখতে পাবে--- এভাবেই ফিরে ফিরে আসুন অজস্র অজয় চক্রবর্তী যাদের ভাষার গম্ভীরতা মুগ্ধ করবে আমাদের সাথে সাথে আমজনতাকেও একদিন---
আর আমার বিশ্বাস এ'ভাবেই হয়তো নিজের কলমকে তরোয়ালের ধারে প্রস্তুত করবে আমাদের উত্তর পুরুষ।

আসলে আন্তরিকতা যেটা অন্তর থেকেই তৈরি হয়, বাহ্যিক নয়--- তা আমি এই পরিবারের সকলের মাঝেই দেখতে পেয়েছি বার বার, এখানে মানুষ বড় ছিল ধর্ম নয়--- আর সেটাই আমাকে ওদের অন্তর পর্যন্ত যেতে সাহায্য করেছে।
আরও অনেকেই রইলেন আমি আস্তে আস্তে পরিচয় করাতে থাকবো সকলের সাথে, যেমন সায়মার ছেলে ইভান ও তার স্ত্রী সারা, সায়মাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়তো হবে না তবে তার ছেলেকে দেখে আমি ভীষণ খুশি--- বলবো তাঁদের সাথে সাথে আরও অনেকের কথাও---


আমার ছোট্ট সফর-জন্মভূমি ঢাকা- পর্ব ৪

সায়মার ছেলে আর বৌমা সারাকে ভীষন ভালো লাগলো, সকলের সাথে আলাপটা অবলীলায় নিজেই সেরে ফেলেছিল ইভান ও তার স্ত্রী--- দু'জনেই ভীষণ হাসি খুশি আর ফ্রেন্ডলি, দুজনেই মাসি মাসি করে কথা বলছিল কাজের ফাঁকে ফাঁকে--- আমার সব  ছবিগুলো বোধহয় ইভানই তুলেছে পরে আমাকে হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছিল, সন্তানতুল্য এই ছেলেটি যে মাতৃভাবে আমাকে আন্তরিকতা দেখিয়েছে প্রতি মূহুর্তে---
সেই মুহূর্তগুলোতে আমার চোখের সামনে আমি সায়মাকে দেখতে পেয়েছি প্রতিনিয়ত, পরিচয়ের পর ভিডিও কলিং করে সায়মার সাথে কথা বলিয়ে দেওয়া, 
আমাকে অনেকটা ওদের দিকে এগোতে সাহায্য করে ছিল অবলীলায়--- তপনের সাথে আমার ওর তোলা ছবিটা ইভানের জন্যই হয়তো থেকে যাবে আমার এলব্যামে আমাদের অ্যালবামে--- সেদিন প্রতিটি মানুষের আবদার ইভান হাসি মুখেই পালন করছিল, যেটা আমাকে মুগ্ধ করেছে--- আর প্রোগ্রামের একদম শেষে ওর আর আমার একটা ছবি,
যেটা দেখলে আমার এই অনুভব হয় যে আমি আর সায়মা দাঁড়িয়ে আছি--- এই ভাবেই হাসিখুশি থাকুন ইভান আর সারা এই আশীর্বাদ রইলো--- সম্পর্ক যদি অন্তরের হয় তবে তা টিকে থাকে আজীবন, সেখানে হিন্দু বা মুসলিম কোনও বাধা নয়। তেমনিই সায়মার সাথে দেখা না হয়েও যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা হয়তো থেকে যাবে আমৃত্যু। 

এবার আসবো আয়েষার কথায়, আমি অবাক হয়ে গেছি আয়েষাকে দেখে মাত্র তিন মাসের এক বাচ্চা নিয়ে ও এই প্রোগ্রামে এসেছে, শুধু তাই নয় নিশ্চুপে করে চলেছে নিজের কাজ সংগঠনের জন্য--- আমি হলে হয়তো ভাবতাম দু'বার অথবা ছেড়ে পালাতাম, কিন্তু গ্রুপের প্রতি আন্তরিকতার কোনও অভাব ওর মধ্যে লক্ষ্য করিনি সেই সময়ে অথবা পরেও--- যখন প্রথম ও এফ বি তে একটা স্পিচ দিয়েছিল ওটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল এই অনুভবের কথা- আমার বলা কথা রাখতে পুচুটা যেদিন পৃথিবীতে এসেছিল, সেদিন সুজান আমাকে পুচুটার ছবি পাঠিয়েছিল, যদিও ওদের মতো আয়েষাও আমাকে দিদি বলে কিন্তু ও আমার মেয়ের বয়সি বা একটু বড় হবে--- সেই হিসেবে আমি নিজ অধিকারে পুচুর দাদি হয়ে গেছি নিজে নিজেই আয়েষার ছেলের, আর আয়েষার লেখা নিয়ে কিছু বলার স্পর্ধা আমার নেই কারণ আয়েষা সায়মা সোহানা এরা প্রত্যেকেই অনেক অনেক ভালো লেখে, যা আমাকে আপ্লুত করেছে বার বার---' এক মা তার সন্তানকে নিয়ে অনেক অনেক এগিয়ে চলুক, সন্তান মানুষ করবার সাথে সাথে এগিয়ে নিয়ে চলুক তার নিজের সৃষ্টিকে এটাই কাম্য আয়েষার জন্য--- ভালো থেকো আয়েষা।

জয় জগবন্ধু আমার আরেক ভাই, প্রথমে নামটা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম কারণ এই শতকে এমন নাম বাবা মা রাখেন আমার জানা ছিলনা--- কারণ আমার সময়ে আমি আধুনিক নাম পেয়েছিলাম সুজাতা, যদিও আমার নামটা বুদ্ধ কালের তবুও আধুনিকতার ছোঁয়া রয়েছে এই নামে, এটা আমি মনে করি--- যাইহোক যার নামের সাথে অনেক অনেক ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও আমাকে অনেক ভালোবাসায় দিদি বলে সম্বোধন করেছে, মনে রাখবো আমৃত্যু জয়ের ব্যবহার- ওর জ্ঞানের সীমাতে পৌঁছানোর ক্ষমতা আর ধৈর্য্য আমার কখনও হবে না হয়তো, কিন্তু এই দিদিকে সম্মানের সাথে জোর করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানোর কথা মনে রাখবো আজীবন জয়--- পৃথিবীতে ভাই বোনের সম্পর্ক বোধহয় এমনিই হয়, আত্মজ শব্দটা এই কারণেই বোধহয় এখনও সুন্দর--- এখানে আরো দুইজনের কথা বলবো সে হলো সবুজ আর যুবরাজ-নিজ নিজ সাম্রাজ্যে এরা একেক জন অধীশ্বর--- এবারও পার্বত্য কাব্যের অনুষ্ঠানে যুবরাজের সাথে দেখা হয়েছে আমার, সেই আগের মতোই ছুটে এসে জিজ্ঞাসাও করেছে দিদি কেমন আছেন? আমাদের বাড়ি চলেন--- এই আন্তরিকতা সম্ভবতঃ ওপার বাংলা বলেই সম্ভব, প্রত্যেকেই এতো ভালো যে কাউকে বাদ দেবার কথা ভাবতে পারছি না--- এদের দু'জনকে আমি জয়ের সাথেই প্রথম দেখি পরে যুবরাজ অনেক কথা বলেছে আমার সাথে আমাকে বইও উপহার দিয়েছে--- এভাবেই সকলে এগিয়ে চলুক বন্ধুত্বের বন্ধনে, তবেই সুন্দর হবে পথচলা।

আন্তরিকতার ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের সকল মানুষের মধ্যেই বর্তমান, সেখানে গরীব বা বড়লোক বলে কোনও শব্দ নেই--- এখানে আমার এক ভাইয়ের কথা বলবো তার নাম উপমন্যু-
সে আমাদের সময় হচ্ছে না বলে হোটেলের রুমেই রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করে ছিলেন- আমি কখনও দেখিনি তবে চিনতে কোনও অসুবিধা হয়নি আমার- পরের দিন আমাদের বিক্রমপুর যাবার ছিল তিনিই গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেললেন হোটেলে বসেই- পরের দিন সকালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন দেখা করবার জন্য-
এমনিই বাংলাদেশ যেখানে জন্মেও থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি আমারই দুর্ভাগ্যের কারণে-
                          চলবে---







সিটি-প্যালেস (উদয়পুর)

নি ভা  চা ক লা দা র 

বছর দশেক পূর্বে ১৬ ই মার্চ  ২০১২...
দিল্লি হতে রেলপথে উদয়পুর উদ্দেশ্যে আমরা তিনজন যাত্রা করি। পর দিন সকালেই পৌঁছে যাই। বেশ সুন্দর একটি স্টেশন। আমরা কাছাকাছি এক Guest houseএ উঠে স্নান ও সকালের জলখাবার খেয়ে সিটি প্যালেস অভিমুখে চললাম ভাড়া গাড়ি করে। অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ির চালক বললে পৌঁছে গেছি। সম্মুখে একটা লেক, লেকের কাছেই পাহাড়... আহা ভারি সুন্দর, অপূর্ব। অপর দিকেই সিটি-প্যালেস। প্যালেস এর ছায়া পড়েছে লেকের জলে। লেকের মধ্যিখানে আর একটি যেন প্রাসাদ। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। অনুচ্চ ঐ পাহাড়ের ঢালে লেক, সিটি-প্যালেসটি। আমরা প্যালেস এর প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম, সাথে গাইড। গল্পে গল্পে এগিয়ে চলেছি। এক বিশাল চত্বরে এসে পড়লাম। সেটা পেরিয়ে দেখতে পেলাম দুই সারি স্তম্ভ, স্থাপত্য কারুকার্যমন্ডিত, তিনটি প্রবেশ পথকে পৃথক করেছে। প্রতিটি স্তম্ভের উপর দিকে আলো জ্বলছে। প্রবেশ দ্বারের মাঝামাঝি উপর দিকে ঝাড়বাতি লাগানো। গাইড এগিয়ে নিয়ে গেল অপর দিকে এক চত্বরে 'ধুনিমাতা' চত্বর। এখানেই দেখতে পেলাম উদয়সিংহের বীর পুত্র মহারানা প্রতাপসিংহের জীবন কাহিনীর চিত্রাবলী। প্রাসাদের ভেতর এ এসে পড়েছি। অনেক গুলো প্রকোষ্ঠ। এক এক করে দেখছি। একটিতে যোদ্ধা প্রতাপসিংহের পরিধেয় বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র সযত্নে রাখা। আর আছে মহারানার বিখ্যাত ঘোড়া চেতকের বর্মটি, মুখের দিকে নকল একটি হাতির শুঁড় জুড়ে দেওয়া। মেবারের প্রধান চার হিন্দু দেবদেবীর চিত্র--'চারভুজ', 'একলিং জী', 'শ্রীনাথজী', এবং 'অম্মামাতা' এখানে বিরাজমান। এবার সিঁড়ি দিয়ে উপরতলায় এসে পৌঁছাই। উঁচু একটি মঞ্চের উপর মার্বেল পাথরের মনোরম এক সিংহাসন। এই সিংহাসনেই মহারাণাদের অভিষেক হতো। মূল কক্ষগুলির দরজায় কাচের উপর অপূর্ব কারুকার্য করা।একটি কক্ষে কাচের রংবেরঙ এর নক্সা কাটা মেঝে, দেয়াল, এখনও ঝক্ ঝক্ করছে। এই কক্ষটির নাম- 'দিল খুশল', মহারাণা করণসিংহের আমলে এটি নির্মিত। কক্ষ যেন শেষ হয় না দেখে। এবার যে কক্ষে এলাম তার দেয়ালে, ছাদে বিচিত্র রংবাহারী পেন্টিং ১৮২৮ হতে ১৮৩৮ সালের মধ্যে উদয়পুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার জ্বলন্ত ছবি। আরও একটি কক্ষে এসে গেলাম, সেখানে সূর্যদেবের উজ্জ্বল মুখাকৃতি আঁকা। সূর্যের কিরণ যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। দুই পাশে দুই নারী মূর্তি দন্ডায়মান, চামর হাতে দোলায়মান। রাণারা ছিলেন সূর্য বংশীয়। সূর্যদেবের একটি পেন্টিংও আছে, উভয় পাশে দুই রাণার পেন্টিং। এর কাছেই রাজপ্রাসাদের এক প্রান্তের দেয়ালে বিখ্যাত 'সান উইন্ডো' আছে। জানতে পারি এটি মহারানা ভীমসিংহ তৈরি করান। সময়ে সময়ে এই জানালায় দাঁড়িয়ে প্রজাদের দর্শন করতেন ও উৎসাহ দিতেন। অপর একটি কক্ষে সিদ্ধিদাতা গণেশের অপূর্ব প্রতিকৃতি। পুষ্প আকারের নানা চিত্রে সজ্জিত। 


প্রাসাদের একটি চত্বরের দেয়ালের গায়ে ময়ূরের রিলিফ মোজাইক। ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে কারুকার্যমন্ডিত স্তম্ভ। 
আবার লেকের দিকে একটি দেয়ালের উপর দিকে পায়রার ছোট ছোট খোপ। পায়রার মাধ্যমে পত্রাদি প্রেরণ করার প্রচলন সেই প্রাচীন কালে ছিল। 
পায়ে পায়ে এবার আমরা রাণী মহল 'জেনানা মহল' এ  এলাম। এখানে অন্দরে যাওয়ার সময় মাথা নীচু করে প্রবেশ করি। দ্বারগুলো সব নীচু। হঠাৎ কোন শত্রু অন্দর মহলে পৌঁছানোর আগেই প্রহরী শত্রুর মস্তক ছেদন করতে সক্ষম হতো। রাণী মহলের বাইরের দিকে দেয়ালে জানালা নেই বললেই চলে। তবে সেখানে ১০০ ফুট উচ্চতার স্তম্ভ, যেগুলিতে জাফরিকাটা আছে। ১৯৭৪ সালের পর দর্শকদের নিমিত্ত এই মহল খুলে দেওয়া হয়। বেশ ক'টি কক্ষ এখানে। রাণীদের ব্যবহৃত আসবাব পত্র রাখা আছে আজও। বড় বড় হাঁড়ি কড়াই থেকে মাখন তৈরীর চরকি কাঠি, বেলন-চাকী, কলাই,গম পেষ্টনের জন্য ছোট, বড় আকারের যাঁতা দেখতে পেয়ে অবাক হই। পাশের কক্ষে মাটির উনুন, কাঠের জ্বালানি সবই দেখতে পাই। তার পাশের কক্ষে দেবতার মনোরম সিংহাসন। জানা গেল রাণীরা নিজ হাতে দেবতার ভোগ সামগ্রী প্রস্তুত করতেন। সিটি -প্যালেস এর অভ্যন্তরে একটি  বিশাল চত্বর দেখতে পেলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো আজও বিদ্যমান। এখানে সিনেমার শুটিং করা হয় বর্তমানে।  আমরা ক্লান্ত পায়ে বের হয়ে পিছোলা লেকের ধারে বিশ্রাম ও সামান্য কিছু খেয়ে নিচ্ছিলাম আর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। পিছোলা লেকের মাঝেই আর একটি অপূর্ব দ্বীপ প্রাসাদ- 'জগমন্দির' নামে পরিচিত।
 
লেকের ধারে ধারে সারি সারি মন্দির, হাবেলি, বাগ বাগিচা, এই পিছোলা লেক এর সাথে খাল দ্বারা যুক্ত একটি কৃত্রিম লেক 'ফতেসাগর লেক'। বিশ্রাম শেষে আমরা গেষ্টহাউস অভিমুখে রওনা হই। ফ্রেশ হয়ে ওখানেই খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। পরদিন আবার সেই পিছোলা লেকের বাঁধে চলে এলাম। লেকের মাঝের ঐ সুন্দর প্রাসাদ 'জগমন্দির' দেখতে টিকিট কেটে উঠে পড়ি একটি জলযানে লাইফ জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে। জলের বুকে চলেছি হেলে দুলে। ছোট্ট ঐএক পাহাড়, পাহাড়ের কোলেই পিছোলা লেকটি, প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করে পৌঁছে গেলাম 'জগমন্দির'। উঁচু বাঁধ দ্বারা পরিবেষ্টিত, গ্রানাইট ও মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি, স্থাপত্য শিল্প-সুষমায় ভরপুর। চত্বরে বড় বড় ফলের গাছ ,ফুলের বাগান, গাছে বসে  নানা প্রজাতির পাখি। মন ভরে  উঠল আনন্দে। জানতে পারি মহারাণা জগৎসিংহ এই অপূর্ব দ্বীপ-প্রাসাদটি নির্মান করেছিলেন। অনেকটা সময় এখানেই কেটে গেল, তবু যেন ফিরে আসতে চাইছে না মন। এবার আমরা ফতেসাগর লেক এর ধারে চলে এলাম। এখানেও একটি দ্বীপ, একটি পার্ক ও ঝর্ণা।দেখার অন্ত নেই এখানে। পিছোলা লেকের একধারে লেক সংলগ্ন বিখ্যাত 'সজ্জন নিবাস' উদ্যান বা গোলাপ বাগ। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই বাগটি। সবুজ ঘাসে ঢাকা বড় বড় লন, ছোট একটি চিড়িয়াখানা, কৃত্রিম বাঘ নজরে পড়ল। বিশাল আকারের ভিক্টোরিয়া হল। হলে প্রবেশ করে একটু এগিয়েই একটি লাইব্রেরি, একটি রিডিং রুম দেখতে পেলাম। গাইডের কাছে জানতে পেলাম এটি ১৮৮৭  সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জুবিলী উৎসব উপলক্ষ্যে তৈরী হয়। লর্ড ল্যান্স ডাউন ১৮৯০ সালে এই হলঘরটি উদ্বোধন করেন। একটি টিলার উপর মনোরম গোলাপ বাগ। একটি সিঁড়ি দিয়ে  পিছোলা  লেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। তবে এখন সর্বসাধারণের জন্য খোলা নেই। কাছ থেকে দেখে  ফিরে আসি। কাছেই সজ্জন গড় ফোর্ট। পায়ে পায়ে ওদিকে এবার রওনা দিলাম। বেশ উঁচু। ধীরে ধীরে বেশ খাড়া পথে উপরে উঠে এলাম। এখান থেকে গোটা সিটি-প্যালেস এর চারদিকটি  ছবির মত দেখতে লাগছে। নিজ চোখে না দেখলে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেতাম না। অনেকটা সময়  দাঁড়িয়ে নয়ন সার্থক করি। ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ের কোলে শহরটি, অনেক লেক, সব এক নজরে দেখা। ভুলতে পারিনি, আজও  চোখে ভেসে উঠে সময়ে সময়ে। 


ছোট্ট হলেও দেখে যেন আশ মেটে না, দেখে শেষ করাও যায় না দুই এক দিনে। ঝড়ের গতিতে কাছাকাছি সজ্জন ঘাট, বাগোরি কি হাবেলি, সাস্ বহু মন্দির ছুঁয়ে ছুঁয়ে এলাম। আমাদের পরের দিনের ভ্রমণ রানা প্রতাপ সিংহের জন্মস্থল কুম্ভলগড় ফোর্ট, হলদিঘাট, প্রতাপ মেমোরিয়াল। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এ সকল ইমারত শুধু মহাকালের সাক্ষী নয়, ইতিহাস সেখানে বাঙ্ময় ...







তোদে-তাংতার পথে

ড রো থী  দা শ  বি শ্বা স

"যত তুমি বকোঝকো মেরে করো কুচি কুচি-
আমি কিন্তু তবু বলবো এসবেই আন্তরিক রুচি:
ঘরে থাকতে অল্পমতি, রোদে রোদে পথে ঘুরে ফেরা,
আকাশে বিচিত্র মেঘ নানা ছন্দে তোলে যে অপেরা।
তাতে লুপ্ত হতে হতে রুক্ষ চুলে বাড়ি ফিরে আসা
পোড়া-মুখে চিহ্ন তার অকুন্ঠ বিস্মিত ভালোবাসা !"
             - শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষের এই কবিতার ছত্রকটির সাথে আমার ভ্রমনপিপাসু মন ভীষণ একাত্মবোধ করে। শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও আবারও বেরিয়ে পড়ি নদী-পাহাড়-অরণ্য অধ্যুষিত যাত্রাপথে। এবারে লক্ষ্য পাহাড়ি গ্রাম তোদে-তাংতা।

১৪৷০২৷২০১৮ সকাল সাতটা বেজে কুড়ি মিনিট, ভীষণ কুয়াশাচ্ছন্ন একটি সকাল। লক্ষ্য ছিলো সাতটায় বেড়িয়ে পড়বো, কিন্তু কুড়ি মিনিট দেরীতে যাত্রা শুরু হলো তোদে ও তাংতার উদ্দেশ্যে। তিস্তার বালুচর ঘন কুয়াশায় ঢাকা। সকালের তিস্তার বিস্তীর্ণ নদীবক্ষ অগোচরেই থাকলো। লাটাগুড়িতে এসে কুয়াশা হাল্কা হলো। ডুয়ার্সের এটাই হলো বিশেষত্ব। যতো শীতই পড়ুক আকাশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল থাকবেই। লাটাগুড়িতে বর্ষায় এক অনন্য রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। বর্ষায় অরণ্যে "তৃণময় শান্তি" বিরাজিত। একটা উঁচু ডালে বসে থাকা ময়ূরী বর্ষা ঋতুর কথা মনে করিয়ে দিলো। সকাল নয়টা বেজে এগারো মিনিট। এতোক্ষণে আমরা মূর্তি হয়ে খুনিয়া মোড় পার হয়ে রেলওয়ে ক্রসিং- এর কাছে এসে পড়েছি। রেললাইন পার হয়ে বাঁ-দিকে রেলেরই একটি পরিত্যক্ত কোয়ার্টার্স ছিলো। এই কোয়ার্টার্সের সামনেই এক ভদ্রলোক ছোট্ট সুসজ্জিত দোকান দিয়েছিলেন। সেখানে আমরা একসময় কফি খেয়েছিলাম। আজ সে রেল কোয়ার্টার্স ও নেই, দোকানঘরটিও নেই। হাতীর তান্ডবে গুঁড়িয়ে গেছে সে সব। এই অঞ্চলটি চালসা রেঞ্জ- এর অন্তর্গত। এখান থেকে মাত্র ছয় কি.মি. পথ পার হলেই শিবসু ফরেস্ট ভিলেজ। আমাদের গন্তব্যস্থল তাংতা এখান থেকে ৫৫ কি.মি. দূরে। খুনিয়ামোড় হয়ে চাপড়ামারী ফরেস্ট- এর মধ্য দিয়ে সুন্দর রাস্তা ধরে চলেছি আমরা। পূর্বের এই সরু বনপথটি এখন যথেষ্ট প্রশস্ত করে বানানো হয়েছে। পথের বাঁ ধারে নির্মীয়মান শিবসু বিধান পার্ক আগামীতে পর্যটন মানচিত্রে একটি  নবতম সংযোজন। এখানে এখন কুয়াশা লীন, ঝলমলে রৌদ্র। ভূটান বর্ডার কাছে, তাই এস.এস.বি. ক্যাম্প রয়েছে এখানে। এই পর্যন্ত জলপাইগুড়ি জেলা, এরপর শুরু হলো খুমানি বীট- নবগঠিত  কালিম্পং জেলা। এখান থেকে খারাপ রাস্তা শুরু হলো। কাঠের স'মিল ও কাঠের ডিপো আছে, যা বনজ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে চলে। হিমবাহবিধৌত সমভূমি (Outwash plain) ও পাহাড়ের সমাবেশ।গ্লাইকেনিয়ায় পাহাড় আছে ছেয়ে। এক্কেবারে ফার্ণরাজ্যে এসে পড়েছি। খুব খুব সুন্দর। শুকিয়ে যাওয়া ঝর্ণার খাত সুস্পষ্ট। বড়ো বড়ো গাছগুলিকে জড়িয়ে উঠেছে লাইগোডিয়ামের লতা। লাইকেনের উপস্থিতি দূষণহীন বাস্তুতন্ত্রের প্রমান। অরণ্য এখানে সবুজ, জনবসতিহীন। এ কি! বনের মাঝে মাঝে নিভন্ত ছাই ও পোড়া জমি কেন? দাবানল? না-- দাবানল নয়। তবে শীত শেষ হতেই আগুন জ্বলে বনে। শুধু চাপরামারীর অরণ্যেই নয়, বৈকুন্ঠপুর বনবিভাগের তারঘেরা, আপালচাঁদ ও কৈলাসপুর সংলগ্ন গজলডোবার জঙ্গলেও ডুয়ার্সের সর্বত্র শুকনো পাতায় আগুন ধরানোর ঘটনা চলছেই। গভীর জঙ্গলে কোথাও ধিকিধিকি, আবার কোথাও দাউদাউ করে জ্বলে আগুন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সারি সারি গাছের নীচে জমে থাকা শুকনো পাতা। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে জঙ্গলের নিজস্ব জীব বৈচিত্র্যও। এই আগুন লাগায় বনবস্তি ও জঙ্গলের কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দা ও গবাদিপশুপালকরা। জঙ্গলের কচি ঘাস-পাতা গবাদিপশুর প্রিয় খাদ্য।পর্ণমোচী উদ্ভিদের শুকনো পাতার চাপে কচি ঘাস জন্মাতে পারে না। আর এ কারণেই জানুয়ারীর শেষ থেকে বনের এক একটি অংশ ধরে গোপালকরা শুকনো পাতায় আগুন লাগিয়ে দেন। এর ফলে বর্ষার জল পেয়ে স্তূপীকৃত শুকনো পাতার স্বাভাবিক নিয়মে পচন সম্ভব হয় না, ফলে হিউমাস, মৃত্তিকা গঠনও ব্যাহত হয়। অতদূর চিন্তা করার সময় নেই কঠোর জীবন সংগ্রামে লিপ্ত পশুপালকদের। তাই বর্ষার আগমনের দু'মাস আগেই শুকনো পাতা এই পদ্ধতিতে সরিয়ে ঘাসজমি বের করে গবাদিপশুর খাদ্যভান্ডার নিশ্চিত করে নেন তাঁরা। পরিবেশপ্রেমীদের সচেতনতামূলক প্রচার, বনকর্তাদের কড়া নিষেধাজ্ঞা সত্বেও এই চিত্রের রদবদল হয়নি। বনে স্তূপীকৃত শুকনো পাতায় আগুন ধরানোর ফলে বনমুরগী, ময়ূর, সাপ- এদের ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় গাছের ফল থেকে বীজ হয়ে নতুন গাছ বেড়ে ওঠার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও। পাশাপাশি জঙ্গলের ভেতর বন্যপ্রাণীদের অবাধ গতিবিধিও বাধাপ্রাপ্ত হয়। বন্যপ্রাণীদের বিচরণক্ষেত্রের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হয়।
শিবসুর পর গৈরিবাস। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সম্ভার। বিস্ময়কর ট্রীফার্ণের সমারোহ। আকাশের রঙ মেখে পথের ধারে ফুটে আছে অ্যাজারেটাম যার পারিপার্শ্বিক বুনো গন্ধে প্লাবিত। গৈরিবাসের রাবার প্ল্যান্টেশন- এ শীতের রুক্ষ্মতা ছড়িয়ে পড়েছে।  চেকপোস্ট পার হয়ে নজর কাড়লো আমগাছ ও কাঁঠালগাছের মাঝে  অদ্ভুত এক  ট্রী হাউস। পাহাড় এখন অনেকটা দূরে। চাষের জমির চারধারে টেফ্রোশিয়া ( স্থানীয় নাম বগা গাছ )-র হেজ সীমানা নির্ধারণ ও জমি রক্ষার কাজ করছে। এই অঞ্চলে প্রচুর মাদার, শিমূল লাল ফুলে রঙীন হয়ে আছে। এছাড়াও রয়েছে কেয়াগাছ। পথের পাশে নীচু জলা জায়গায় হোগলা ও কুলেখাড়ার ঝোপ। জনবসতিহীন নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ময়ূরের ডাকে চমকিত হলাম। এখানে রাস্তা তো নয়, যেন শুষ্ক নদীখাত ধরে চলেছি। প্রাকৃতিক ভাবে ফুটে থাকা বোগেনভেলিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সব গাছই রোগগ্রস্ত। কফি প্ল্যান্টেশন জায়গাটিকে গাঢ় সবুজ করে রেখেছে। বিচিত্র পাতাবাহার ও ডালিয়ায়  ছবির মতো সুসজ্জিত ছিমছাম বাড়ী, নেপালী পরিবার এখানে বাস করেন । পাশেই পর্যটকদের জন্য White House Stay. পাশে রাস্তা থেকে অনেক নীচে বয়ে চলেছে ঝালং নদী, বর্ষায় যার রূপ অনন্য। গৈরিবাসের পর রাস্তা ভালো পেলাম। জলঢাকা, SSB Out Post পেরিয়ে ইপিকাকের নার্সারি। এখানে রাস্তাটা চুলের কাঁটার মতো একেবারে U Turn নিয়ে ঘুরে গিয়েছে। সম্ভবতঃ খুব সুন্দর সজ্জিত রঙীন ধর্মীয় পতাকাগুলি এই বিপদসঙ্কুল বাঁক নির্দেশ করার জন্যই প্রোথিত।


জলঢাকা, দক্ষিণ- পূর্ব সিকিম থেকে আগত কুপুপ (বিতাং) হিমবাহ-হ্রদে জন্ম...
সামচি ভুটান, কালিম্পং , জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত, অবশেষে বাংলাদেশের লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত। ভুটানের স্থানীয় ভাষায় বহু পূর্বে এর নাম ছিলো দিচু। ভুটানের স্থানীয় ভাষায় চু শব্দের অর্থ নদী। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ১৯২ কি.মি. জলঢাকা বাংলাদেশের যমুনা (ব্রক্ষ্মপুত্র)- এর উপনদী। কোচবিহার জেলায় এর নাম মানসাই ও সিঙ্গিমারী। বাংলাদেশে এর নাম ধরলা।জলঢাকার উপনদী মূর্তি, নকশালখোলা, সুটুঙ্গা, জর্দা, জিতি, কুজিডায়না, ডায়না, আংরাভাসা, রেতিডুডুয়া, মুজনাই। বিন্দুতে জলঢাকার সাথে আরো দুটো নদী এসে মিশেছে, বিন্দুখোলা ও দুধপোখরি। জলঢাকার সাথে পরিচয় আমার শৈশব থেকে। বাবার মুখে জলঢাকা হাইডেল প্রোজেক্ট-এর সম্পর্কে অনেক শুনেছি। ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম জলবিদ্যুত প্রকল্প এটি। এটি Eastern Hydroelectric Project-এর অন্তর্গত একটি মেজর প্রোজেক্ট। এর বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫ মেগাওয়াট। নদীর সর্বোচ্চ জল বহন ক্ষমতা থাকাকালীন এর বিদ্যুত উৎপাদন ৪৪ মেগাওয়াট পর্যন্ত হতে পারে। এর পাঁচটি ইউনিট। ১৯৬৭তে চালু হয় প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট। বাবা এই দুটি ইউনিটের কথাই বলতেন। ১৯৭২ সাথে চালু হয় তৃতীয় ইউনিট। এর পরই ওদলাবাড়ির সবজায়গা বিজলীবাতীর আলোয় আলোকিত হয়। ১৯৮৩-তে চালু হয় চতুর্থ ও পঞ্চম ইউনিট। সে বছর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অনন্তধামে। প্রথম তিনটি ইউনিটের প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা ৯ এম.ডব্লিউ.  চতুর্থ ও পঞ্চম ইউনিটের প্রত্যেকটর উৎপাদন ক্ষমতা ৪ মেগাওয়াট। জলঢাকা নদীর পরে আরো এগিয়ে একটি ঝোড়া পেলাম। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে বাঁয়ে খাড়া পাহাড়, ডানদিকে খাদ। গৈরিবাস ল্যাবের পাশে একটি চারতলা বিল্ডিং দেখে সত্যিই অবাক হলাম। এমনিতেই পার্বত্য অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ, তার উপর এইরকম একটি বন্ধুর ভূপ্রকৃতিতে এমন একটি বড়োসড়ো চারতলা বাড়ি বানানো কিন্তু যথেষ্ট ব্যায়বহুল ও কষ্টসাধ্য। আর একটু এগিয়ে বাঁয়ে অপর একটি পাহাড়ি গ্রাম রঙ্গো যাবার  রাস্তা। মনে পড়ে মেটেলির বিনোদভাই- এর ন্যানো চড়ে আমরা সেবার রঙ্গো গিয়েছিলাম। রঙ্গোর শেষ প্রান্তে একটি লেপচা পরিবারের গৃহিনী অঞ্জনার সঙ্গে পরিচয়। ফুলে ফুলে অপরূপ সুসজ্জিত প্রাসাদোপম বাসগৃহ তাঁর। নিজহাতে ফুলগাছের পরিচর্যা থেকে শুরু করে নিজ হাতে রান্না করা, অতোবড়ো বাড়ীর প্রত্যেকটি জানালা দরজার অত্যাধুনিক পর্দা সেলাই করা, সব কাজ সে করে। আমাদের দেখে যেন কতোদিনের চেনা এমন ভাবে একগাল হাসি হেসে এগিয়ে এসে জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলো  বসার ঘর, শোবার ঘর, রান্নাঘর- সব ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। বারান্দা ও সিঁড়ির উপর বাহারি ফুলের মাঝে তাঁর সেলাই মেশিন। ছাদে ফুল, প্রাচীরের ওপর ফুল, ফুলে ফুলে ফুলময় । যে ফুলের নাম সে জানে না, সে ফুলের একটা নামকরণ সে নিজেই করে নেয়। বড়ো বড়ো ট্রীফার্ণের গোড়া টবের মতো করে ব্যবহার করেছে দেখলাম। আমাদের ডেকে এনে নিজ হাতে সুদৃশ্য কাপ প্লেট এ দার্জিলিং চা ও ফ্রেশ ঝুড়িভাজা দিয়ে  আপ্যায়ন করলো সে। দুর্গম পাহাড়ী পথে গাড়ি চালিয়ে সে দূর থেকে বাজার করে আনে। স্বামী চাকুরীসূত্রে বাইরে থাকেন। বাচ্চারা হোস্টেলে থাকে। সেই সময়ে ছোট মেয়েটি ছুটিতে বাড়ি এসেছিলো। আমাদের সাথে কথা বলতে পেরে অঞ্জনাও যেমন খুশী, পার্বত্য বন্ধুর পরিবেশে তাঁর এমন আন্তরিক ব্যবহারে আমরা সত্যিই মুগ্ধ। আবার কখনো রঙ্গো গেলে অবশ্যই ওর সঙ্গে দেখা করবো। রঙ্গোর রাস্তা বাঁয়ে রেখে গাড়ি ছুটে চললো সামনের দিকে। এখান থেকে  গৈরিবাস ভিউ পয়েন্ট-এর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। জলঢাকার ওপারে অর্থাৎ ডানদিকে অসাধারণ পাহাড়চূড়ো এক অসাধারণ মহিমায় দৃশ্যমান। শুরু হলো ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপোনিকা ও পাইনের বন। বিশল্যকরণীর ঝোপে মৃত্তিকা আচ্ছাদিত। ঝরণার জল পানীয় জল হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে যাবার সময় এখানে সমগ্র পাহাড়টিকেই ভিজিয়ে দিয়েছে। 
"জলের ডালায় যদি হৃদয় প্রসার করি, তোমারই বিকাশ।
মেঘের গুহায় ঢালি হৃদয় যখন, দেখি তোমারই বিকাশ।
কুয়াশা, উথাল জটা দিক দিক ভরে যদি, তোমারই বিকাশ।
স্মরণ যেখানে, প্রাণ সেখানেই, সেখানেই তোমার বিকাশ।" আবারও কবি শঙ্খ ঘোষ। রঙ্গো থেকে প্যারেনগামী সাভারি চলে এই রাস্তায়। ঝালং- প্রকৃতির কোলে অপূর্ব পার্বত্য স্বাস্থ্যনিবাস। এই মুহুর্তে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটেছে এখানে। ঝালং রিভার ক্যাম্প পার হয়ে ডানদিকে যে রাস্তা চলে গেলো, ঐ রাস্তা ধরে চললে সোনালী ফার্ণের দেশ বিন্দু পৌঁছে যাওয়া যায়। আমরা সেই রাস্তায় না গিয়ে সোজা রাস্তা ধরে চললাম।কখনো চড়াই কখনো  উৎরাই পথ ধরে চলা। ঝকঝকে সূর্যালোক, নীল আকাশ, এই শীতে পথের ধারে ফুটে থাকা হাল্কা গোলাপী কাশফুল দেখে ক্ষণিকের জন্য শরৎকালের কথা মনে পড়ে গেলো। পথের ধারেই ফুলঝাড়ুর গাছ, পাহাড়ের ঢাল ধরে লাগানো হয়েছে সুপারী, বড়ো এলাচ, আর্টিমিশিয়া (যা থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরী হয়)। হাল্কা গোলাপী রঙের ফুলে ভরা প্রচুর চেরীগাছ প্রাকৃতিক শোভাবর্ধন করছে। দূরে দৃশ্যমান স্তূপীকৃত  ঝকঝকে মারোয়া-র খড় যা পশুখাদ্যরূপে ব্যবহৃত হয়। এখানকার অধিবাসীরা হাঁস, শূকর পালণ করে। প্যারেণ- অপূর্ব এক ছবির মতো সুন্দর একটি পাহাড়ী গ্রাম। প্রকৃতির রঙের  সঙ্গে মিলিয়ে এখানকার প্রত্যেকটি বাড়ীর রঙ- কোনটা সীসের মতো রঙ, জানালা দরজা সবুজ, ছাদে লাল টালি। ডানদিকের উৎরাই- এর পথ ধরে আমাদের গাড়ী এগিয়ে চললো। সজনে গাছে সাদা ফুল পুঞ্জীভূত। ডুমুর, ধুতুরা, আলুবোখরা ও প্রচুর ফুলঝাড়ুগাছ।এখানেই আছে Nature Holiday Camp. রাজহাঁস গর্বিত ভঙ্গীমায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জ্বালানী কাঠ  স্তূপীকৃত। সুন্দর একটি রিসোর্ট। এখানে রাস্তা বলতে কিছু নেই। সিমেন্ট দিয়ে ইট তৈরী করছে দেখলাম। হলুদ ফুলে ভ'রা টেকোমা, লালপাতা (ইউফরবিয়া পালচেরিমা), আইভিলতা, ইকুইজিটাম, সোর্ডফার্ণ,  ট্রীফার্ণের সমাহার। এতো উচ্চতাতেও দ্বিতল পাকাবাড়ি চোখে পড়লো। পিগারী, গোটারী রয়েছে। এখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কার্ডামম প্ল্যান্টেশন যেখানে দেখলাম Sprinkler irrigation চলছে। এটি এমন একটি সেচ পদ্ধতি যা প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাতের মতো শস্যের ওপর পড়ে। পাম্পের সাহায্যে বাতাসে জল স্প্রে করার মাধ্যমে সেই জল বৃষ্টিকণার মতো ভেঙ্গে মাটির ওপর পড়ে। এখানে বড়ো এলাচ গাছের ওপর সেচের জলকে পাম্প, ভাল্ভ,  সরবরাহকৃত নল ও Sprinkler এর মাধ্যমে যতটা সম্ভব সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে যেহেতু রাস্তা বলতে কিছুই নেই, খুব কষ্ট হলেও, "পথ চলাতেই আনন্দ"  আজ, দুঃখ হোক বিলীণ,/এরকমই এক পথের দু'ধারে দু'চোখ অন্তরীণ। একদিকে দুর্গম গিরি, অপরদিকে অতলান্ত খাদ। পথ জুড়ে সর্ষের তেলের রঙের স্থলপদ্ম ফুলে গাছ ভ'রে রয়েছে। আবারও হলুদরঙা টেকোমার দেখা পেলাম। জায়গাটির নাম সুরুক। নামটা উচ্চারণ করে দেখলাম বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দের মতোই খুব মিষ্টি একটি নাম। খুব সুন্দর একটি উচ্চ মালভূমির মতো জায়গাটিতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা নামলাম।শুধুমাত্র বাতাস বয়ে চলার শব্দ ছাড়া অদ্ভুত এক স্তব্ধতা এখানে বিরাজিত। ধূপের গন্ধে বাতাস সুবাসিত ও পবিত্র। এইখানে রয়েছে পাথরনির্মিত অদ্ভুত একটি ত্রিকোণাকৃতি প্রাকৃতিক গুহা  উপর থেকে তিনজন পাশাপাশি বসা যায় এমন একটি পাথর স্থানচ্যুত হয়ে সেখানে বেদীর মতো স্থাপিত, অপূর্ব। সুরুকে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে বাজে এগারোটা। একটি পরিবারে এক পাহাড়ী শিশু স্মিত হাসি হেসে মিষ্টি অভ্যর্থনা জানালো, হাতে তার বাটিতে ছিলো চিঁড়া-দই। এখানে বাড়ির টিনের চালে ফুলঝাড়ু শুকোতে দেওয়া হয়েছে। বড়ো এলাচ আর কমলালেবু প্রচুর ফলে। গাড়ি চললো। ভীষণ খারাপ রাস্তা।সুরুকে একটি প্রাথমিক স্কুল আছে। এখানে দেখলাম ট্রেকিং রুট তৈরী হচ্ছে। ঝর্ণা রয়েছে। এগারোটা বেজে একত্রিশ মিনিটে গোডাক পৌঁছোলাম। এখানে SSB ক্যাম্প আছে বলেই রাস্তাও ভালো। তবে বেশীক্ষণ নয়, আবারও শুরু হলো ভীষণ খারাপ রাস্তা। "দুর্গম গিরি লঙ্ঘিতে" ভারী কষ্ট হচ্ছে আজ, খাদ অতলান্ত, আকাশ অনন্ত, শিখরে ক্যাথলিক চার্চ। ঠিক বেলা এগারোটা ছাপ্পান্ন, পৌঁছে গেলাম তোদে - আমাদের গন্তব্যস্থল।








মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪