শ্রুতিনাটক
অন্য ভালবাসা
ভা র্গ বী
ইলা: এসেছ?
অপূর্ব: এত তাড়াতাড়ি ডাকলে যে? ট্রেন তো সেই রাত দশটা।
ইলা: এখন বাজে তিনটে, আমার জীবনের তোমার সাথে বেঁচে থাকার শেষ কয়েক ঘণ্টা। আহ্।
অপূর্ব: আবোল তাবোল কথা বন্ধ করলে তুমি? কেন এতো তাড়াতাড়ি এলে, এই শরীর নিয়ে সেটা তো বলো।
ইলা: বললাম তো শেষ ক’ঘণ্টা তোমার সাথে থাকব, গল্প করব তাই।
অপূর্ব: তুমি আর তোমার পাগলামি। কোনো মানে আছে?
ইলা: আছে গো আছে, এখন বুঝবে না। বুঝবে, যখন- “সেই প্রভাতে নেই আমি।”
অপূর্ব: একটার পর একটা জেদ করেই চলেছ। বললাম এতক্ষণের জার্নির ধকলটা নিও না। বাই-এয়ার যাও। শুনলে না। কেন যে জেদগুলো কর আমি বুঝি না।
ইলা: আচ্ছা হয়েছে, এই শেষ বেলায় আর রাগ করতে হবে না। শোনোনা-
অপূর্ব: বলো। শুনছি তো।
ইলা: এই দেখো চারিদিকে কি ব্যস্ত জীবন। সবাই ছুটছে জীবনের নেশায়। তার মাঝে আমরা টিকটিক্ টিকটিক্ করে ঘড়ির কাঁটার সাথে আমাদের শেষ দেখছি। এটা এয়ার পোর্টে হত?
অপূর্ব: শুধু এজন্য তুমি…!
ইলা: পাগল, শুধু এজন্য? এটাই তো সব গো। শেষ যাত্রায় যতটা গভীরভাবে, যতটা নিবিড়ভাবে বিদায় জানাতে পারি তাই এ ব্যবস্থা।
অপূর্ব: একটু চুপ করলে ভাল হয়। এসব ভাল লাগছে না এখন।
ইলা: চুপ তো করবোই রাজামশাই। তবে আজ নয়…
অপূর্ব: ইলা… বললাম তো ভালো লাগছে না এসব।
ইলা: রাজামশাই, বলেছিলাম তো পাঠিও না আমায় ট্রিটমেন্টের জন্য। শুনলে আমার কথা? মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না তোমার। এখন তো ভেঙে যাচ্ছ পুরো। আমি থাকবো না তুমি কি করে সামলাবে নিজেকে?
অপূর্ব: সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ঠিক আছি।
ইলা: যেটা সত্যি নয় সেটা বলে কি লাভ? তার থেকে ভাবো, আমার এসব কিছু হয়নি, আমার তোমার বিয়ে হয়েছে, আমরা বেশ বেড়াতে যাবো বলে ট্রেনের অপেক্ষা করছি।
অপূর্ব: আর গাড়ী এলে আমাকে একা ফেলে তুমি চলে যাবে, তাইতো?
ইলা: না না। তা কেন দুজনে যাবো, পাহাড়ে... মেঘ পাহাড়ে…।
অপূর্ব: আচ্ছা চুপ। এত কথা বলে না। দেখো কাশি আসছে আবার। একটু গরম চা নিয়ে আসি খাও, আরাম পাবে।
ইলা: উঁহু, কোত্থাও যাবে না এখন। চুপ করে বসে থাকো আমার পাশে।
অপূর্ব: তুমি দুপুরের ওষুধটা খেয়েছিলে?
ইলা: হ্যাঁ। ওসব ছাড়ো। শোনো না রাজামশাই…
অপূর্ব: বলো।
ইলা: আজ একটা কথা বলো, তোমার কেন আমাকেই ভালবাসতে ইচ্ছে হল?
অপূর্ব: এই প্রশ্ন কতবার করবে?
ইলা: হয়তো শেষ বার করছি। বলো কেন?
অপূর্ব: উফ্! তুমি মারবে আমায়।
ইলা: সে তো তুমি মরেইছো রাজামশাই। উত্তর দাও।
অপূর্ব: যেদিন প্রথম তোমায় দেখি, শ্যামলা রং, ছিপছিপে গড়ন, লম্বা বিনুনি, দুটো দীঘির মতো চোখ তলিয়ে তাকিয়ে আছো, আমি কলেজের ফেস্ট-এ গান গাইবো কি, মনে হচ্ছে এই তো মাধবীলতা। সেদিনই তোমাকে…
ইলা: ইশ্ আমি চোখ তলিয়ে তোমায় দেখিনি মোটেও, আমি মন দিয়ে তোমার গান শুনছিলাম। অ্যাই শোনো…।
অপূর্ব: বলো, শুনছি তো।
ইলা: তুমি রোজ গান পাঠাবে? না হলে ওষুধ বন্ধ করে দেবো।
অপূর্ব: দেবো।
ইলা: শোনো, রাজামশাই এই খামটা রাখো।
অপূর্ব: কি আছে এতে?
ইলা: একটা চিঠি, যেদিন খবর পাবে আমি আর নেই সেদিন খুলবে।
অপূর্ব: আমি বরং যাই তুমি একাই বোসো।
ইলা: রাজামশাই, সত্যেরে লও সহজে। আমাদের তো তাই কথাই ছিল। আমি যাচ্ছি। আমার ভালবাসা নয়। খবরদার যদি বিয়ে করো ঘাড় মটকাবো তার ভূত হয়ে।
অপূর্ব: আবোল তাবোল বক্ বক্। কি যে বলো…
ইলা: তো কি তুমি ভেবেছিলে আমি ওই সিনেমার হিরোইনদের মত বলব, ওগো তুমি বিয়ে করে নিও। ইশ্…তুমি আমার। আমারই থাকবে সে আমি থাকি বা না থাকি।
অপূর্ব: দেখেছ, কাশি আসছে। একটু থামবে তুমি। এত কথা কেন বলো?
ইলা: থামতেই তো যাচ্ছি। আজ না হয় একটু বলি…
অপূর্ব: অবাধ্য।
ইলা: রাগলে তোমায় বেশ দেখতে লাগে জানো।
অপূর্ব: উফ্! থামলে তুমি। কি হচ্ছে কি? নয়তো আমি চলে যাচ্ছি।
ইলা: যেটা পারবে না সেটা কেন বলো, বলোতো?
অপূর্ব: খুব চিনেছ আমায় না? আচ্ছা এটা রাখো।
ইলা: ১২ লাখ এর চেক। এত টাকা কোথায় পেলে?
অপূর্ব: মা মারা যাবার পর আর গ্রামের বাড়িটাতে যাওয়া হয়নি। পড়ে ছিল। বিশুদাকে বলেছিলাম লোক দেখরে, বিক্রি করব। হয়ে গেল।
ইলা: মানে? আমায় কিছু না জানিয়ে কেন?
অপূর্ব: ট্রিটমেন্টটার খরচ তো একটু বেশী। যতটা অ্যারেঞ্জ করা যায়।
ইলা: টাকাগুলো জলে দিচ্ছ। বাড়ি গেল, টাকা গেল। শেষটায় তোমায় সর্বস্বান্ত করলাম রাজামশাই।
অপূর্ব: তুমি চলে যাবে, এর থেকে বড় শূন্যতা আর কি দেবে তুমি?
ইলা: এটা আমি তোমার জন্য এনেছিলাম।
অপূর্ব: এটা আবার কিসের খাম?
ইলা: সংসার পাততে টাকা লাগবে। জমাচ্ছিলাম। রাজামশাই তো মেজাজ হারিয়ে চাকরিটা ছাড়লেন। আমিও চলে যাচ্ছি। তোমার চলবে কি করে? সংসার তো পাতা হবে না, এটা তাই তোমায় দিলাম।
অপূর্ব: তুমি রাখো। এটা অসম্ভব।
ইলা: ও! কথা দিয়েছিলাম একসাথে চলব। চলতে পারলাম না বলে পর হলাম রাজামশাই। তাই নেবে না তুমি?
অপূর্ব: এটা পাগলামো।
ইলা: এটা আমাদের রঙিন স্বপ্নগুলোর জন্যে। এটা ওই পচা অসুখে খরচ আমি করব না। তোমাকেই রাখতে হবে।
অপূর্ব: আচ্ছা আমি এটা দিয়ে কি করব সেটা তো বলো।
ইলা: রাজামশাই, দু’মাসের খরচ হয়ে যাবে এতে তোমার। তার মধ্যে একটা চাকরি জোটাবে বুঝেছ।
অপূর্ব: কি হবে আর চাকরি জুটিয়ে।
ইলা: মানে?
অপূর্ব: আমি নোটিশ দিয়ে দিয়েছি। নেক্সট মান্থ-এ বাড়ী ছেড়ে দিচ্ছি।
ইলা: আমায় না বলে আর কি কি করেছো শুনি। কেন করেছো এসব?
অপূর্ব: কি করবো এ শহরে তোমাকে ছাড়া। শহরটা গিলে খেতে আসবে আমায়।
ইলা: কোথায় যাবে তুমি?
অপূর্ব: নিরুদ্দেশ।
ইলা: বাঃ চমৎকার। আমাকে না জানিয়ে যত আবোল তাবোল কাজ… কোনো মানে আছে? ধরো আমি যদি ঠিক হয়ে যাই তখন কি হবে?
অপূর্ব: তখন তুমিও বিয়ে করবে না অন্য কাউকে। অপেক্ষা করবে আমার জন্য।
ইলা: ইয়ার্কি নয় রাজামশাই। এরকম কোরো না।
অপূর্ব: উপায় নেই ইলা।
ইলা: সারাটা জীবন পড়ে আছে তোমার।
অপূর্ব: এই তো সিনেমার নায়িকাদের মতো বলছ।
ইলা: আঃ! রাজামশাই… এত বড় জীবন…
অপূর্ব: পুরো জীবনজোড়া মৃত্যু পড়ে থাকবে তোমায় ছাড়া।
ইলা: আমি তোমার জন্য ঠিক হয়ে যাব, দেখো তুমি।
অপূর্ব: ডক্টর সেন বলেছেন হার্ডলি ছ’মাস। কেন মিথ্যে আশা দিচ্ছ।
ইলা: তুমি তো বললে একটু আগে আমি ঠিক হয়ে যাব।
অপূর্ব: তাই তো চাই, কিন্তু…
ইলা: কিন্তু যদি জানো, পাঠাচ্ছ কেন?
অপূর্ব: যাতে আমার সামনে না মরো।
ইলা: তোমার কোলে মাথা রেখে মরতে দাও না গো। একবার বলো যেতে হবে না।
অপূর্ব: না। আমার বেঁচে থাকাকে আর ভয়ংকর কোরো না।
ইলা: ক্ষমা করো রাজামশাই।
অপূর্ব: কিসের জন্য?
ইলা: এই যে আমাকে ভালবেসে এত কষ্ট পাচ্ছ।
অপূর্ব: আর কথা নয়, কাশি উঠছে। এখন একটা ওষুধ আছে খেয়ে নাও।
ইলা: এরকম কেন হ’ল বলোতো রাজামশাই।
অপূর্ব: জানিনা।
ইলা: তোমার জন্য মন কেমন করছে রাজামশাই। একরাশ শূন্যতা দিলাম তোমায়। তুমি তাই নিলেও মুখ বুজে।
অপূর্ব: ইলা শান্ত হও।
ইলা: আমি যে আর একটু জীবন চেয়েছিলাম রাজামশাই।
অপূর্ব: আমরা যা চাই সব কি পাই ইলা? আমি তো জীবন দিয়ে তোমাকেই চেয়েছিলাম।
ইলা: তুমি কি পেলে বলোতো? কিচ্ছুনা…।
অপূর্ব: আমি কি বলি ইলা, কিচ্ছু না মানে অনেক কিছু…।
ইলা: রাজামশাই, ট্রেনের টাইম হচ্ছে…
অপূর্ব: হুম্।
ইলা: একবার বল আমি তোমার কে?
অপূর্ব: একটা বুদ্ধু, পাগল একটা। যে শুধু রাজামশাই-এর।
ইলা: আমি বাঁচবো না বল।
অপূর্ব: ভালোবাসাটা বাঁচিয়ে রাখব কথা দিলাম তোমায়। আমার মন জুড়ে তুমিই বেঁচে থাকবে ইলা।
ইলা: আমাদের ভালবাসাটা মিলনের নিয়মে বাঁধা নয়। কিন্তু বড় কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে। অনবরত তা থেকে রক্তক্ষরণ। তোমায় একা বইতে হবে সে ভার, সে সব শূন্যতা রাজামশাই। শুধু ভাবি এ দুঃখ তো তোমার প্রাপ্য ছিল না। ভালবেসে কেবল ক্ষয় রইলো তোমার ভাগে। ক্ষমা করো গো, ইচ্ছে করেও তোমায় মুক্তি দিতে পারলাম না। এত স্বার্থপর আমি।
অপূর্ব: ইলা আমি ‘জেনেশুনে বিষ করেছি পান…’।
ইলা: আর আমি নিজে হাতে তোমায় সে বিষ পান করিয়েছি।
অপূর্ব: ইলা, থাক না, নিয়ম মাফিক ভালবাসার বাইরে একটা অন্যরকম ভালবাসার গল্প।
অসাধারণ লেখনী দিদি 👌🏼 একটা সাবলীল চলন, আর সত্যিই একটা অন্যরকম ভালোবাসা।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ।
মুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনসময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ
মুছুন