স্মৃতিকথা





কাশ্মীর পঞ্চম পর্ব

শু ভ্র জী ৎ বি শ্বা স


কাশ্মীরের আবহাওয়ার সাথে মিশে যাওয়ার একটা অন্য রকম মজা রয়েছে। কখনো কখনো সেটা আমাদের এমন পরিস্থিতিতে দাঁড় করাতো যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সব মেনে নিয়ে সহ্য করা ছাড়া আর কিছু মাথাতেই আসতো না। আগের পর্ব গুলিতে উল্লেখ করেছিলাম যে আমাদের সমতলে যে ধরণের শীতের পোশাক পাওয়া যায় সে সব ওখানে কাজ করে না বললেই চলে । টুরিস্ট হিসেবে দিন চারেক এর জন্য ঘুরতে যাওয়া, রুম হিটার, ইলেকট্রিক ব্লাঙ্কেট ব্যাবহার এক বিষয় আর ছাত্র হিসেবে পড়তে যাওয়া ভিন্ন বিষয়। টুরিস্ট হিসেবে ঘুরতে যাওয়াটা অনেকটা কাঁচ ঢাকা গাড়ির ভেতর থেকে পৃথিবী দেখার মতো। স্বাভাবিক ভাবেই কটস উল প্যান্টের ওপর গোটা দু এক জিনস, জ্যাকেট এমনকি জুতো পড়ে রাত্রিযাপনের অভ্যাস হয়েছে। যাদের কাছে স্লিপিং ব্যাগ ছিল তাদের বিষয় ভিন্ন। পড়াশুনার সূত্রেই প্রথম সোফিয়ান গভর্নমেন্ট ডিগ্রী কলেজে যাওয়া। তারপর থেকে নিয়মিত সেখানে যাতায়াত ছিল। কলেজের প্রফেসরদের ব্যবহার এত ভালো যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তাদের ভাষাতে আঞ্চলিকতার স্পষ্ট ছাপ মানুষগুলোকে একদিকে যেমন মিষ্টি করে তোলে অন্য দিকে ভিন্ন ভাষার মানুষদের কাছে সমস্যার পাহাড় গড়ে তোলে। শ্রীনগরে আমাদের বাসস্থান থেকে সোফিয়ান এর গন্তব্য স্থলের দূরত্ব প্রায় ৫০ 
কিমি। সাধারণত যেখানে দেড় থেকে এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিটে পৌঁছনো সম্ভব সেখানে আমাদের সময় লাগতো তিনঘন্টারও বেশি । কারণ একদিকে পাহাড়ী পথ অন্যদিকে কিছুদূর যেতে না যেতেই চেক পোস্ট। বাসে ওঠার প‍র সবাই নিজেদের সচিত্র পরিচয়পত্র থেকে ইউনিভার্সিটির আইডিকার্ড , কাগজপত্র হাতেই রাখতো। প্রতিটা চেক পোস্টে সেগুলো দেখাতে হতো। আমরা সাধারণত পুলওয়ামা রোড হয়েই সোফিয়ানের পথে যেতাম। তবে নিরাপত্তার খাতিরে অনেক সময়েই অন্য পথে ফিরতাম। সোফিয়ানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকটাই। সোফিয়ান গভর্নমেন্ট ডিগ্রী কলেজে প্রথম দিন প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়ে ঘটলো ভাষাগত বিভ্রাট। উনি আমাকে হিন্দিতে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন "আপ কৌনসে সাকুল মে পড়তে থে" ? আমি সাকুল এর মানে উদ্ধার করতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম! কিছুক্ষণ পর বললেন "আপ সিকাস মে যাইয়ে"। আমি তখনো চুপ! সেদিনই কলেজের বিল্লাল স্যারের সাথে প্রথম দেখা। ওনাকে এই দুটো কথা জিজ্ঞেস করার প‍র উনি যা বললেন তা শুনে মাথাই নষ্ট! সাকুল মানে হলো স্কুল আর সিকাস মানে সিক্স অর্থাৎ ছয়। তখন বুঝলাম উনি আমার স্কুলের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে আমাকে ছয় নম্বর রুমে যেতে বলেছিলেন। যাই হোক সোফিয়ান গভর্নমেন্ট ডিগ্রী কলেজের কথা আমি আমৃত্যু ভুলতে পারবো না কারণ ঐ জায়গাটাই এত বিশেষ। বড় লোহার গেট দিয়ে ঢুকেই ডান হাতে মূল বিল্ডিং এ যাওয়ার রাস্তা। তারপাশেই ছাত্র ছাত্রীদের বসার জন্য বেঞ্চ । আর সেই বেঞ্চ গুলি স্বর্গের বরফে আচ্ছাদিত। ওখানে পথের পাশে গাছের ডাল গুলোতে বরফ জমে থাকে, ঠিক যেমন শিলিগুড়ি থেকে বাসে কোলকাতা যেতে গেলে রাস্তার পাশের গাছগুলোতে ধুলো জমে থাকতে দেখা যায়। ভাবলে আজও রোমাঞ্চ জাগে। প্রতিটা ক্লাস রুমে রয়েছে হাত সেঁকার ব্যাবস্থা। শীতে হাত শূণ্য হয়ে গেলে কিছুক্ষণ তা অনায়াসে গরম করে নেওয়াই যায়। কলেজ থেকে বেড়িয়ে  বাঁদিকের রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে ডানদিকের গলিতে একটা চায়ের দোকান ছিল। যেখানে চা আর আগুনে স্যাঁকা গরম পাউরুটি ঐ ঠান্ডায় অমৃতকেও হার মানাবে। অন্য দিকে রইলো আমাদের কলেজ। জনমানবহীন প্রান্তরে ধু ধু আপেল বাগানের মাঝে এক টুকরো স্বর্গ থুড়ি জান্নাত। সামনে ফুলের বাগান। তবে চিৎকার করে মরে গেলেও বাইরের মানুষ আপনার আওয়াজ শুনবে না একথা ঠিক। যাইহোক বাঁচার আনন্দ তো সেখানেই যেখানে মরার ভয় রয়েছে।

                                                 (ক্রমশঃ)




















মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪