রম্য রচনা





চাবি

চৈ তা লী  চ ক্র ব র্তী (চৈ তি)


ঠাকুমার কাছে তোরঙ্গ বাক্সে চাবি রাখা থাকতো। চাইলেই ঠাকুমা বলতেন "কিসের এত চাবি চাবি করো" জীবনের চাবি কি আর সহজ কথা? শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নিজের চাবি পাননি বলে পুরো বংশ লোপাট হয়ে গেল। নাহলে গান্ধারী না দেখে অভিশাপ দিলো আর ফলে গেল? ওসব হয় নাকি আসলে কৃষ্ণ বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে চাবিটাকে হারিয়ে ফেলেছিলো। 

-এমা ঠাকুর ছিলো না। তুমি তার নামে এসব বলছো? পাপ দেবে। 
-পাপ দেবে? কোথা থেকে দেবে যে ঘর থেকে খুলে দেবে সেই ঘরের চাবিই নেই। আর আমি এই সুযোগে হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ করা বন্ধ করে যা মনে আসে করে যাই। 
-ঠাকুমাআআআ এসব কি হচ্ছে?
-ওই যে কৃষ্ণ জীবনের চাবি হারিয়ে রাশলীলা 
করতে শুরু করেছিলেন। রাধার চাবি দিয়ে কাজ চলছিলো তারপর মনে হয় সেটাও বৃন্দাবনে হারিয়েছিলেন তারপর চলে গেলেন দ্রৌপদীর কাছে। তাকে দিলেন নতুন চাবি।
বললেন সামলে রাখতে কিন্তু দ্রৌপদীর আবার আঁচল থেকে চাবিটা খুলে নেবে বলে দুর্যোধন কত কান্ড করলো। কৃষ্ণ নাছোড়বান্দা কাপড় সাপ্লাই দিয়েই চলেছেন।
দ্রৌপদী পাঁচ স্বামীর চাবি সামলাতে সামলাতে হারিয়ে ফেললেন। কৃষ্ণের তখন আর উপায় নেই। চাবি খোঁজার জন্যে কুরুক্ষেত্রে থাকতে হবে সেখানেই যুদ্ধের সময় থেকে গেলেন। দু'পক্ষের যুদ্ধ শুরু হলো। ভাবলেন চাবিটা পাবেন। সারথি হয়ে অর্জুনকে নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন নিজেও যদি খুঁজে পান। অনেকেই অনেক ভাবে বাধা দিতে চাইলো কিন্তু তাঁর কাছে তো সুদর্শন চক্র ছিলো। তাই অনেকেই সত্যিটা জানতে পারলেও বলতেন হে মাধব তুমি রক্ষা করো। সেই তালে তিনি নিজের আর যাদের যাদের চাবি হারিয়েছে খুঁজে দেবার চেষ্টা করছিলেন। নরেশ বললো আচ্ছা ঠাম্মা আমাদেরও চাবি আছে?আছে বৈকি সবার থাকে। সেই চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়েই তো কেউ কাউকে নাচায়, গাওয়ায়, কাঁদায়, হাসায়। এই যে গডফাদার আর গডমাদার এদের কাজ কি? একটা ট্যালেন্ট খুঁজে বার করে তারপর তাদের ফেমাস করার টোপ দিলেই মাছ চারা খাবার জন্যে হাজির তারপর তাকে খাইয়ে পরিয়ে বলির পাঁঠা বানিয়ে পাবলিককে বুদ্ধু বানাতে পারলেই ব্যাস কোটিপতি হওয়া ঠেকায় কে? ওরা তো আসলেই চাবি তৈরি করে ঘোরায়।
-ওরে বাবা ঠাম্মা তুমি এসবও জানো? 
-জানিস একবার আমিও চেষ্টা করেছিলাম।
-সে কি গো তুমিও?
-হ্যাঁ চুপি চুপি বলছি বলিসনি যেন কাউকে। 
সেবার তোর দাদু একখানা নাটক লিখেছিলো। বেশ রসালো জমাটি নাটক।
ভাবলাম সেটাকেই চাবি বানাব। বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বসেছি। মনে সাধ গড মাদার হবো। ঘটা করে নোটিশ দিলাম একখানা 'পুরোনো পুঁথি নাটক' আছে আমার কাছে যারা প্রকাশে ইচ্ছুক তারা আসুন শীঘ্রই। আর নিজে একখানা বই লিখতে শুরু করলুম। মনে ইচ্ছে ছিলো বই কারা কারা প্রকাশ করে তাদের মুখগুলো এই চাবি দিয়ে তালা খুলে দেখবো। 
-ঠাম্মা পুরোনো পুঁথি পেলে কোথায়? 
-আরে শোন না। তোর দাদুর নাটকটার নাম বদলে অমন করেছিলাম। তখনকার দিনে পুরোনো পুঁথি মানেই অনেক দাম তার। সব এলো দেখা করতে। বললাম আগে সোজা কথা বলুন কত দেবেন? বললাম দামে পোষালে তবে দেখাব। 
অনেককে ঘোরালাম। ততদিনে কাগজে উঠে গেছে ব্যাপারটা। তোর দাদুকে কত শেখালাম এই বলবে ওই বলবে কিন্তু সেই আসল গল্প ফাঁস করে দিলো। আর কি চাবি হারিয়ে গেল। এক প্রকাশক সেই চাবি চুরি করলো আমার। সেই আইডিয়া কাজে লাগিয়ে কোটিপতি হয়ে গেল। তোর দাদু যদি আমাকে ফুটো করে না দিতো আজ দেখতিস আমিও গডমাদার হতাম। এই চাবি ব্যাপারটাই গোলমেলে। একজনের চাবি আর একজনের তালা খুলতে পারবে না। তোর ভাগ্যের চাবির কপি সাবানে ছাপ দিয়েও কেউ বানাতে পারবে না। তোর জীবনের চাবি তোকেই খুঁজে রাখতে সামলে রাখতে হবে বনে বাদাড়ে হারালে আর ঘরে ঢুকতে পারবি না। বুদ্ধ কে বলেছিলাম লুম্বিনি বনে খেলিস না। শুনলো না। চাবি হারিয়ে শেষে গাছের তলায় তপস্যা করতে হলো তো!
চৈতন্যকে বলেছিলাম ওরে খোল বাজাচ্ছিস চাবিটা সামলে রাখিস, রাখলো না ব্যাস আর ঘরে ঢুকতে পারলো না। লোকনাথকে বলেছিলাম, সে চাবি বেলপাতার সাথে শিবের মাথায় চড়িয়ে দিলে। নেতাজীকে বলেছিলুম তার চাবিখানা অদ্ভুত ছিলো খুললো তো খুললো অন্য তালা তাই নিজের ঘরে না ঢুকে অন্য ঘরে গিয়ে থাকতে হলো। এই চাবি যেমন ঘরের তালা খোলে তেমন মনের তালাও খোলা বন্ধ করে। 
রবিকে দেখলিনি সবার মনের সব জায়গার তালা খুলতে খুলতে বুড়ো মহাজন হয়ে গেল। শরৎকে বলেছিলুম। সে বলেছিলো আমি ঠাম্মি সমাজের তালার জং পরিষ্কার করবো। একটাই চাবি থাকবে আমার। বিবেককে বললুম, সে বললো ঠাম্মা আমি সবার মনের তালা খুলে সকলকে নায়ক নায়িকা বানাবো।
কত লোক যে আমার কাছ থেকে শিখে শিখে গেল কি বলবো। শুধু তোর বাবার চাবিটা যে কোথায় রেখেছি কে জানে? নাহলে ওর পাগলামিটা সারিয়ে ফেলতে পারতাম। একবার কি হলো জানিস চিলেকোঠার তালা কিছুতেই খুলছে না। প্রথমে এল তোর বড় জ্যাঠা সে এসে ভীমের গদার মতো চাবিটা চালালো। তালা বললো- 'না খুলবো না'।
মেজজ্যাঠা এলো যেন যুধিষ্ঠির, সে সোজা পথে সহজভাবে ঘোরালো। তালা বললো- 'না'। সেজ জ্যাঠা এলো সে আর এক বিদুর কোথা থেকে মাথার কাঁটা এনে চেষ্টা করলো, তালা বললো- 'না'। বড় কাকা এল কার্তিকের মতো দারুণ স্টাইলে চাবি ঘোরালো। তালা বললো- 'না'। মেজ কাকা এলো দুর্যোধনের মতো পেছনে শকুনি মামা, পাশার চাল চাললো দুজনে। কিন্তু তালা বললো- 'না'। ছোটকাকা অর্জুনের মতো তীর মারার চেষ্টা করলো।
তালা 'না' করে দিলো। ন কাকা এলো কর্ণের মতো। তালা একটু নড়তেই রথের চাকা কাদায় বসার মতো তালা আরো বসে গেল।
বললো- 'না'। তালা নানান চাবির খোঁচা খেয়ে খেয়ে এবার ঘাড় গুঁজে এঁড়ে গরুর মতো বেঁকে বসলো। হবে না চাবির অত্যাচার তো আর কম নয় তালার জীবন অস্থির করে দিলো। তাই বলি বাবু এই চাবি সবসময় ঠিক রাখবি নাহলে জীবনটা বন্ধ হয়েই থাকবে।





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪