ভ্রমণ কাহিনী


পালানোর পাঁচকথা: দেওরিয়া তাল- তুঙ্গনাথ- চন্দ্রশিলা: পর্ব - ঙ

মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত

টর্চ ছিল। শুধু কার্যকালে অকম্মা হয়েছে। সুইচে চাপ দিলে বড় জোর তাকে দেখা যায়, সে কিছু দেখায় না। এদিকে গপ্পো অনেক। চন্দ্রশিলার আশপাশে জাম্বুবানের ধুমসো উত্তরপুরুষ-নারীরা পটি সারতে আসে রাতে। ঠিক এমন সতর্কবাণী জুগিয়েছিলেন এক শুভানুধ্যায়ী। বুঝে উঠিনি, ওই কাজের তরে অত উপরে চড়ার কী দরকার। অবশ্যি সেখানে মালিক শ্রীরামচন্দ্রের স্মৃতি জড়ানো আছে। 


লেজেন্ড মোতাবেক, দাশরথী রাবণ নিকেশ করে ভারী আফশোস করলেন। এত হানাহানি, রক্তপাতের পর মন ঠান্ডা করতে এই একান্ত নিরিবিলিতে ধ্যানস্থ হন তিনি।

আর এক লোকশ্রুতি, চন্দ্রদেব প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ রুদ্রদেবকে তুষ্ট করতে বসেন এখানেই। তাই চন্দ্রশিলা নাম। আবার রাবণশিলাও বর্তমান এখানে।

আবছা ঠাওর করে এগোচ্ছি। অদূরে ধূম্রবর্ণের চলমান বস্তুখানি আসলে কী! খাড়িয়ে আভাসে আধাআধি বুঝে হাঁটা চলছে। —না, মানুষই। সামনে। আমাদের আগে বেরিয়ে চড়াইয়ের কড়া শ্রমে পিছিয়ে পড়েছেন নিশ্চিত।

অন্ধকার সবসময় ঠিকঠাক নিরেট হয় না। তারার, না কীসের, নাকি আকাশের কেমন এক ফিনফিনে মায়াময় আলো থাকে। খোলা জায়গায় অমাবস্যাতেও এমন লক্ষ্য করেছি। সব দেখতে পাই যেন। কীসের আলো সর্বদা বোধ্য নয়। মাঝরাতে উঠে যে ট্রেকগুলো হয়েছে, তাতে আলোর জন্য দুর্ভাবনায় পড়তে হয়নি কখনও। তবে সারমেয়র মতো নিজের চক্ষুদুটি রাতে একটু-আধটু জ্বলে কি না জানা নেই। 

আরও উঠতে নজরে পড়ল, অনেকেই চলেছেন উপরে। এক-দেড় কিমি পথ। পুরোটা চড়তে হয় বলে ঘণ্টাটাক সময় লাগে।

ওই তাহলে পূর্ব দিগন্ত! শৈলতরঙ্গ পেরিয়ে দুর্লভ বিভা। চন্দ্রশিলায় অবস্থিতি বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে। অভীপ্সিত মুহূর্ত। বিস্ময় আর ঠান্ডায় বাকরুদ্ধ। মার্তণ্ডদেব তখনও অন দ্য ওয়ে। দেখা দিলেন বলে। ভেসে উঠছে, দৃশ্যমান হচ্ছে চতুষ্পার্শ্ব। ১২১১০ ফুটে দাঁড়িয়ে পর্বতরাজ্যের অন্যান্যদের নাগালে পেয়ে মন অহংকৃত হচ্ছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, সব্বাইকে —সব্বার মাথামুন্ডু তক দেখতে পাচ্ছি। কত নৈসর্গিক কারুকর্ম সেখানে! চন্দ্রনাথ পর্বতকে 'থ্যাংকস' বলতেই হয়। তিনি কাঁধে না তুললে এমন প্রাপ্তি সম্ভব ছিল না।

পূর্ব থেকে উত্তর বরাবর প্রায় পশ্চিম পর্যন্ত তুষারাবৃত শিখরগুলি শুদ্ধ-সমাহিত। নিশ্চুপ পাশাপাশি স্থিত আবহমান কাল। যেন কে কতখানি মাথা উঁচুতে তুলবে, তারই প্রস্তুতি চলছে।

সত্যি সত্যি হিমালয় নাকি উঁচিয়েই যাচ্ছেন পাঁচ কোটি বছর ধরে। এখনও বছরে পাঁচ মিমি করে লম্বাচ্ছেন। সবই ধাক্কাধুক্কির আফটার এফেক্ট। ইন্ডিয়ান টেকটনিক প্লেট আর ইউরেশিয়ান প্লেটের ঝামেলা।

এমুড়ো-ওমুড়ো চোখ ঘোরালে দেখা যাবে কেদার, মান্দানি, চৌখাম্বা, খর্চাকুণ্ড, ত্রিশূল, বান্দরপুঞ্ছ, নীলকন্ঠ ইত্যাদি ইত্যাদি। এলোপাথাড়ি লেখা হল। আর স্বীকার্য, সবাইকে যথাযথ নামে চেনা ক্ষমতায় আসেনি। পার্ফেকশনিস্ট না-হলেও দেখা এবং উপভোগে কোনও খামতি বা ফাঁকি নেই।

চন্দ্রশিলার মাথায় ছোট্ট পরিসরে জনা বারো মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ল সূর্যাগমনের সঙ্গে সঙ্গে। উজ্জ্বলতম অথচ স্নিগ্ধ, অযুত ছটায় বিভান্বিত মহিমাময় রূপ উন্মোচিত হল আমাদের সম্মুখে সেই প্রভাতে। সামান্য পল-অনুকলের মহামুহূর্ত জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে গেল। 

পর্বতশীর্ষগুলি মধুর আলোয় রম্য হয়ে উঠল। আমাদের মতো তারাও প্রতীক্ষায় ছিল। আলোকিত হবে বলে।

মনটা একটু মিইয়ে গেল ক্যামেরা খুলতে। নতুন ডিজিটাল যন্ত্রটার ব্যাটারির দম জানা ছিল না। খোলামাত্র তিনি চোখ বুজলেন। দুঃখ, অন্যকে ছবিটা দেখানো যাবে না। দুঃখ নেই, নিজে যখন-তখন সে ছবি দেখতে পাই।

তরতাজা রোদ্দুর আর মন ভর্তি তৃপ্তি শীতকষ্ট কমিয়ে দিল। আঁধার থাকতে যা মাইনাস তিন ডিগ্রি ছিল, তা-ই চড়ছে এখন। পাথর সাজিয়ে অস্থায়ী পূজাস্থলের বেশি কিছু নেই। জানা থাক, চোপড়া-তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা অঞ্চলটি পাহাড়ি মতে একটি রিজ। এর একদিকে কেদার থেকে নামছে মন্দাকিনী, অন্যদিকে বদ্রীনাথ থেকে অলকানন্দা। আর রিজ থেকে নেমে এসেছে আকাশকামিনী বা আকাশগঙ্গা, যার কোলে চিঁড়ে-ছাতু খাওয়ার স্মৃতি সম্ভব হয়েছে।


১১৩৮৫ ফুটের তুঙ্গনাথ পৌঁছতে হাঁটাপথে পেরোতে হবে চার কিমি। অন্য কেদারের তুলনায় সবচেয়ে কম দূরত্ব।

নামি নামি করেও নামতে দেরি করলাম। রাতের পথ এখন ফর্সা ফুটফুটে। তুঙ্গনাথেও খানিকটা প্রভাত-বিলাসে কাটিয়ে চোপতার দিকে পা ফেলতে মনে হল, চন্দ্রশিলা পুরোটাই নিশিস্বপ্নের মতো। তার ঘোর মগজে ছেয়ে আছে।

চোপতা বাসস্ট্যান্ডে জানা গেল, গুপ্তকাশী বা উখীমঠ যাওয়ার কোনও গাড়ি নেই। সেই তিনটে নাগাদ শেয়ার জিপ আসবে চমোলী থেকে। মোটে বারোটা বাজে।

নিরুপায় ফিরে গেলাম দেবেন্দ্র'র দোকান-কাম-লজে। থাকতে বলল ও। গাড়ি অনিশ্চিত।

ঘর রেখো ভাই। নিতান্ত যদি না পাই.....। একটা দিন গচ্চা যাবে তাতে। ট্রেকিং শেষ। নীচে নামতে পারলে ঋষিকেশ হরিদ্বার ভাল করে দেখা-জানা যাবে।

বাইরে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল সাজানোই আছে। বসলাম তিনজনে। ও, বলতে ভুলেছি। তৃতীয় জন হলেন বন্ধুপত্নী। চোপতায় পৌঁছতেই দেখা বড়িশার এক বন্ধুর সঙ্গে। স্ত্রী-কন্যা সহ ঘুরতে বেরিয়েছে। চোপতায় সুবিধার হোটেল না-মেলায় উৎকণ্ঠিত।

'মানিয়ে নিতে পারলে দেবেন্দ্র'র লজে যাও।' বলতে তা-ই গিয়েছে এবং থিতু হয়েছে। এদিকে আমরা দু'জন গাড়ি দেখলেই জিগাচ্ছি, উখীমঠ? গুপ্তকাশী? অনেকটা সময় ব্যয় করে ঠিক করি, চলো, তেমন বুঝলে থেকে যাব। লজ পানে হাঁটা দিতে দেখা হল ফের। বন্ধু সকন্যা অশ্বারূঢ়। স্ত্রী উঠবেন না। লজে কাটাচ্ছেন।

সেই তিনি ও আমরা চা-গল্পে কাটালাম ঝাড়া সাড়ে তিন ঘণ্টা। ভোরের বহুবাঞ্ছিত সূর্য এখন পশ্চিমে ঝুঁকে ধারালো রশ্মি বিকীর্ণ করছে। ভাবছি, থেকেই যেতে হয় কি না! তারপর 'কোনও সুব্যবস্থা নেই', 'লোকাল লোকের কী দুর্গতি', 'ট্যুরিস্টরা যাবে কোথায়' জাতীয় ভ্যাজরভ্যাজর রয়েইছে। কেমন অবস্থা ভাবুন, স্যাক গুছিয়ে সামনে রাখা আর জুতো-মোজা-জামাকাপড়ে প্যাকেটমোড়া হয়ে গাড়ির অপেক্ষায় এতক্ষণ বসে থাকা!

এক সেকেন্ডও নষ্ট না-করে তড়িঘড়ি দাঁড় করানো হল দেবদূতসম জিপকে। বন্ধুপত্নী ও দেবেন্দ্রকে যা-হোক তা-হোক টা-টা করে ঠাসা খোলে আমরাও ঠাসাই হলাম। পিছনে স্যাক কোলে বসিয়ে এবং কখনও অন্যের হাফ-কোলে নিজেকে, কখনও নিজের হাফ-কোলে অন্যকে বসিয়ে এগোলাম গুপ্তকাশীর উদ্দেশে।

জিগজ্যাগ পাথুরে আর গেছো পথে কিমি তিরিশেক জার্নি চমৎকার রমণীয়। ডাল দুলছে, পাতা খসছে, পাখি উড়ছে, পোকা ডাকছে নিসর্গের অবাধ সাম্রাজ্যে।
উদ্বমনের সম্ভাবনা নিয়েও পলায়মান দৃশ্য দেখি পিছনে বসে। দেখি, চলে গেল মাস্তুরা। —ওই —ওই শুঁড়িপথ বেয়ে চড়েছিলাম সারির দিকে। তারপর কুণ্ড মোড়ে  বাঁক ফিরে বাহন চলল গুপ্তকাশীর লক্ষ্যে। এইটুকু নতুন পথ। মন্দাকিনীর ধারা চোখে পড়ছে।

বেলাবেলি পৌঁছে গেলাম বাসস্ট্যান্ডে। আজ নীচের গাড়ি অমিল। থাকতে হবে। স্যাক সামলে অশোক দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। চললাম 'যিতনা সস্তা'র আস্তানা খুঁজতে।

মার্কেটের এদিক-সেদিক চেষ্টা চালাচ্ছি। মুখোমুখি দেখা তাঁর সঙ্গে। কালিদাস চক্রবর্তী। হিমালয়ে ট্রেকিং ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ধরে রেখেছেন বহু গ্রন্থে। গুপ্তকাশীর কাছে আশ্রম গড়েছেন। থাকেন সেখানে বছরের বেশিটাই। এখানে কালিদাস 'ফলাহারী' আর 'বাঙালিবাবা' বলে পরিচিত। উদ্দেশ্য জেনে বললেন, "এসো আমার সঙ্গে।" সবাই চেনে, সম্মান করে ওঁকে। দু'টো দেখে নিজেই বাতিল করলেন। শেষে পঞ্জাব-সিন্ধ্ লজে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন কর্তৃপক্ষকে। এ-ঘর ও-ঘর করার পর এক কর্মী আসতে জানা গেল, মালিক দেহরাদুন না কোথায় গিয়েছেন। মোবাইলে তাঁকে ধরলেন ক'বারের চেষ্টায়। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠেছি। উনিও। কথা বলতে বলতে আমাদের বসিয়ে শশব্যস্তে নীচে নামলেন। একটু পরে উঠে এলেন। আবার কাকে ফোন। আবার নীচে নামতে গেলে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে বাধা দিলাম, "দাদা, আপনি আর কষ্ট করবেন না, প্লিজ। এত ছুটোছুটি করছেন, আমাদের খারাপ লাগছে।"

"কিচ্ছু খারাপ লাগার নেই। বোসো তোমরা এখানে।" সস্নেহ জবাব।
একটা ঘরে ঢুকে পড়েছি। কত কী দেব-টেব তখনও জানি না। কিছুক্ষণের মধ্যে নীচ থেকে ফের উঠে কনফার্ম করলেন ঘরটি। মালিক নেই। সে ফিরে টাকা নেবে। বেশি যেন না-দিই। উনি বলে দিয়েছেন।

প্রবল কুণ্ঠা ও কৃতজ্ঞতা জানাতে বললেন, "দ্যাখো, বাঙালির জন্য এখানে এটা আমি করেই থাকি।" থেকে গেলে আমরা ওঁর আশ্রমে যেন যাই, বলে চলে গেলেন ব্যস্ত পায়ে।

তারপর দেখা হয়েছে বেহালায় আর ফি বছর বইমেলায় তাঁর 'ট্রেক্ স অ্যান্ড ট্যুর্স'-এর স্টলে। বছর তিনেক আগে উনি প্রয়াত হয়েছেন। খুব মনে পড়ে হিমালয়-দক্ষ মানুষটিকে!

ক'দিন পর লজে আরামনিদ্রা কাটিয়ে পরভোরে জিপ ধরি। কিন্তু অগস্ত্যমুনিতেই থেমে গেল সে। দশেরার জন্য গাড়ির সংকট। একঘণ্টার উৎকণ্ঠা শেষে বাস মিলল এবং চলল হেলেদুলে।

প্রথম দিনের ধ্বসের জায়গাটা নিয়ে কৌতূহল ছিল। অকুস্থলে এসে দেখি, ধ্বস সাফাই হলেও এই ক'দিন পরেও টুকটুক করে খসছে নুড়ি। গাড়িটা পেরোবার আগে একটু জিরিয়ে দম নিল। তারপর মজা আর আতঙ্ক নিয়ে ধাঁ করে ছুটে পার হল ধ্বসকেন্দ্র। ড্রাইভার উপরে সামনে দেখছে। আমরা জানলা দিয়ে উপরে তাকাই। বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় তখনও। দু'পাশে পুলিশ প্রহরা। তা গাড়ি মহাশয় যাত্রীদের অক্ষত পার করে নিজে থমকালেন। ব্রেকডাউন। ঠিক হওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই। ওদিকে একটা শেয়ার জিপে লোক ঠাসা শুরু হয়েছে।

কী হ্যাপা! 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়' কাকে বলে বিলক্ষণ বোঝার চেষ্টা করছি। তখ্খুনি স-ধমক একটা ডাকের মানে বুঝলাম, শিগগির ঘুসে পড়ো। কোথায় ঘুসব? কয়েক সেকেন্ডে ড্রাইভার কী করে যে ঘুসিয়ে দিল, সে তার এলেম।
দেখলাম, চিমড়ে শরীরটাকে ঘিরে শুধু মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বললাম, "অশোক, ঠিক আছো?'' গায়ে লেগে থাকলেও মুখ দেখাদেখির জো নেই। দশ টাকায় নিয়ে চলল শ্রীনগর।


কীভাবে নেমেছিলাম সে কিস্ সা  থাক। শ্রীনগরে লাঞ্চ সেরে বাসে উঠে আপাতস্বস্তি। তারপর সে বাস স-অস্বস্তি ঋষিকেশে রাত সাড়ে আটটায় চক্রার্পণ করল। পথে একবার পাংচার, একবার পিছনে বাঁ দিকের একটি চাকা নাট-মুক্ত হবার উপক্রম। পথচলতি দৃশ্যঝলক উপভোগ পর্বে বলা-কওয়া ছাড়াই বাঁকের মাঝে চালক গাড়ি থামিয়ে দিলেন। পরিচালক মহাশয় নেমে আমাদের জানলার নীচের চাকাটি পরখ করে লোহালক্কর এনে তাকে খুলে ফের জুতে দিলেন। সব্বোনেশে ব্যাপার! লিক সারানোর পর চাকা ফিটিং-এ নাট-বোল্ট ঠিক টাইট দেওয়া হয়নি। মুক্তিকামী সে চাকার বিরুদ্ধাচরণ চালক আঁচ করেছিলেন। ঠান্ডা মাথায় তাঁরা সারিয়ে ফেললেও, আমরা যাত্রীরা ঠান্ডা মেরে গেছি।

সন্ধ্যা নামার পর পাহাড় শুনসান হতে শুরু করে। সাড়ে আটটায় সব অন্ধকার ঋষিকেশে। হোটেলের হদিশ জানতে চাইলে এক তরুণ যে দুরন্ত আলোকপুরীর দিকে দেখিয়ে দিল, সেখানে দাঁড়ানো স্বপ্নাতীত রকমের দুঃস্বপ্ন। ফের পুছতে সটান পড়ে থাকা ভ্যানরিকশ'র তলায় ঢুকে পড়তে ইঙ্গিত করল। এ কী রে ভাই, এমন তো কখনও দেখিনি! কে জানে সে প্রকৃতিস্থ কিনা।

আশ্চর্য! যেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছে সেখানেই খুদে খিড়কিতে অন্য এক মুখে আশ্বাস মিলল। রাত হওয়ায় দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। মালিক ঘর খুলে আশ্রয় দিলেন।

উফ্, ভোর থেকে জার্নি, অপেক্ষা, পাংচার, লেট, ক্লান্তি —সব অতিক্রান্ত। ফলাহার সেরে ঘুম। কাল ঋষিকেশ ঘুরে হরিদ্বারে রাত কাটিয়ে পরশু রাতে ট্রেন। এখন তো ঘুমোই।

স্বপ্নে জাগুক দেওরিয়া তাল, চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশিলা আর অরণ্য, আকাশকামিনী, তুষারশিখর আর পাখি প্রজাপতি —আর মানুষ।
  
ছবি:  সপ্রতিবিম্ব চৌখাম্বা, নরম আলোয় তুষারশিখর ও পথচলতি ঝলক।
(গঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ড। অক্টোবর, ২০১০।)







আমার ছোট্ট সফর- মাতৃভূমি ঢাকা- পর্ব ৭ ও পর্ব - ৮

সু জা তা  দা স

পর্ব-৭

সে ভাবে গ্রাম কখনও আমার দেখা হয়নি, তাই ঢাকা থেকে যখন রায়পাড়া যাচ্ছি মামাশ্বশুরবাড়ি, সেখানে আমার এক ছোট্ট ননদ যে আমার সন্তানদের থেকে অনেকটাই ছোট--- ওদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়েছে আমাকে সঙ্গে নিয়ে। আসলে এখনতো গ্রামগুলো সবই আধা শহর, তাই গ্রাম বলতে যেমন কাঁচা মাটির রাস্তা বা মাটির ঘরে খড়ের চাল, সেসব কোনোটাই নজরে আসেনি আমার--- তবে ওখানে অনেক খাল বিল হাওড় নজরে এসেছে আর পাকা বাড়ি হলেও সেখানে দেশি বিদেশি ফল গাছের দ্যাখাও মিলেছে প্রচুর।

গাছ থেকে পাড়া কুলের স্বাদের সাথে ছোট্ট ননদিনীর মনের জমে থাকা অনেক গল্প আর অনেক অভিমান গল্পচ্ছলে করেও ফেলেছে মাতৃসম বৌদিদির কাছে অবলীলায়--- আসলে আক্ষেপ একটা সময়ের ভালোলাগা তৈরী করে, তাই আমি কেন এতদিন  বাংলাদেশ আসিনি, ওদের কাছে না যাই আমার জন্মভূমি হিসেবেও তো যেতে পারতাম এতদিন--- এটাকে আক্ষেপ বা ভালোবাসা কোনটা ভাববো!! আসলে একথাটা ওকে কীভাবে বোঝাই, সময় না হলে কিছুই হয় না, আসলে বড্ড ছোট এখনও এসব বোঝার জন্য সে।

আমি ওর সাথে হেঁটে চলেছি ও যেমন যেমন নিয়ে চলেছে আমাকে, কোনো একটা সময় হঠাৎই হয়তো মনে হয়েছে ওর, আমি এতটা হাঁটতে পারবো কিনা, তাই জিজ্ঞাসা করলো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে কিনা, এই জিজ্ঞাসা  ছিল প্রতি পদক্ষেপে--- সন্তান তুল্য এই ননদটি বৌদিদির হাঁটাতেও কষ্ট পেয়েছে বোধহয় প্রতি মুহূর্তেই, তার আন্তরিকতার কোনও তুলনা নেই, সেটা প্রতি মুহূর্তেই অনুভব করেছিলাম সেদিন আমি।

হাঁটতে হাঁটতে পদ্মার সামনে চলে এসেছিলাম একটা সময়, কী বিশাল নদী!! গঙ্গার মূল শাখা এটা, এপার ওপার দ্যাখা যাচ্ছে না শুধুই জল আর জল--- তার মাঝেই চলছে মাছ ধরার নৌকা। ওখানে বর্ষায় এক ধরনের ছোট্ট ছোট্ট মাছ পাওয়া যায়, সাগর পোনা--- প্রথম দেখলাম আর খেলামও আমার মামী শাশুড়ি রান্না করেছিলেন, অদ্ভুত সেই মাছের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে, খানিকক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎই আমার মাথা ঘুরতে লাগলো কেন জানি না!! হয়তো অতো জল দেখে।

আমি ছোটবেলায় নবদ্বীপে মানুষ হয়েছি, বাড়ির সামনেই গঙ্গা, কিন্তু এ যেন অন্যরকম একটা ভয় ধরানো অনুভব, তারপর তো কতবার গেছি ঢাকা, জেটিতে পার হয়েছি পদ্মা, তখন কিন্তু এমন লাগেনি আর--- হয়তো বর্ষার পদ্মা ছিল বলে এমন অনুভূতি হয়েছিল। যাই হোক সেদিন কিন্তু অনেক ঘুরেছিলাম ওর সাথে, আমাকে দেখিয়েছিল সেখানকার স্কুল বাড়ি, যেখানে ও পড়ালেখা করেছে, দেখিয়েছে একাত্তরে ফেলে আসা, আজও খালি পরে থাকা কিছু বাড়ি জমি--- যেগুলি সরকার অধিগ্রহণের পর কাজ চলছে সরকারি সংগ্রহশালা আর কার্যালয়ের জন্য, ভালো লেগেছে সরকারি প্রয়াস দেখে।

আজ সেই ননদ অনেকটাই বড় একটা ব্যাঙ্কে কর্মরত জয়পাড়ায়, মেয়েরা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায় ভাবতেই অবাক লাগে!! সেদিন ফেলে আসা স্মৃতির স্তূপে দাঁড়িয়ে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম অনেক মানুষের কলরব, যা একসময় পরিপূর্ণ ছিল আত্মজনের কোলাহলে। আজও যেন বলতে চাইছে সেই সময়ের অনেক অনেক ইতিহাস চুপি চুপি আমার কানে তারা--- যা কালের অতলে চাপা পরে থাকবে আগামী প্রজন্মের কাছে বিস্ময় হয়ে।

যেখানে বিরাটকায় বট অশ্বথ নিজের মর্জি মতো ডালপালা ছড়িয়ে স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে আছে, যা থেকে যাবে আবহমান কাল ধরে অবহেলায়--- যদি আবার কখনও আমার শাশুড়িমায়ের বাবার বাড়ির পথে পা পড়ে, তবে দেখতে পাবো নতুন ঐ অধ্যায়কে যা আজ শুরু হতে দেখে গেলাম---

আমার ননদ, ওর সাথে থাকার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল সেদিন, কিন্তু ঢাকায় ফিরতে হবে বলে চলে আসতে হয়েছিল সেদিন। আমি না থাকাতে হয়তো কষ্টও পেয়েছে কিন্তু আমার নিজস্ব কিছু অসুবিধার কারণে আমি ওখানে থাকতে পারিনি সেদিন, আমি লিখি শুনে, আর লেখার কারণেই আমি বাংলাদেশে এসেছি, এটাতে হয়তো ননদ কিছুটা অবাক হয়েছিল সেদিন--- আসলে হয়তো ওর মনের ভাবনা, অনেক অনেক লেখাপড়া না জানলে এই লেখার ব্যাপারটা আসে না--- যদিও সবটাই আমার অনুমান মাত্র, কারণ ওকে আমি একদম ছোট্ট দেখেছিলাম আবার এই দেখলাম।

অনেক যত্ন করেছেন আমার এই মামীশাশুড়ি, যিনি  আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট, আমি যতটুকু সময় সেখানে ছিলাম, মা এটা খাও, মা ওটা খাও করেই গেছেন সকলে, সবাই হয়তো ভেবেছেন আমি খেতেও পারদর্শী। ওখানেই দেখা হয়েছে আমার শাশুড়িমায়ের ছোট বোনের সাথে, আমি অবাকই হয়েছিলাম প্রথমে, অনেকটাই আমার বড় মাসিশাশুড়ির মতো দেখতে তিনি, অনেক ভালোবেসেছেন তিনিও আমাকে, তাদের এই সাদৃশ্য আমাকে আমার বড় মাসিশাশুড়ির কথা মনে করিয়েছে বারে বারে, কারণ তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন।

তিনি বোড়োই (কুল) খাব কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি 'হ্যাঁ' বলায় তিনি ঐ সামান্য জিনিস অনেক অসামান্য ভাবেই আমাকে দিয়েছিলেন খাবার জন্য, তার এই আন্তরিক ভালোবাসা মনে থাকবে আমৃত্যু---

আমি যেদিন ঢাকা ফিরে আসছি কোলকাতায় ফেরার জন্য, সেদিন অনেক সকালে এসেছিলেন আমাদের সাথে দেখা করতে আমার মাসি ও মামীশাশুড়ি, আসলে অনেক কম সময়ের যাত্রা ছিল এটা, তাই ঠিক মতো কারো বাসায়ই থাকা সম্ভব হয়নি, আর আমার বাবা মায়ের দেশ ও দেখা হয়নি--- আশা রাখি হয়তো আবার যাওয়া হবে, হয়তো ডাকবেন আমার জন্মভূমি।

বাংলাদেশ সফরে আমার পরম প্রাপ্তি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজো দেওয়া, রমনা কালিবাড়ি যাওয়া,
মন্দিরের বাইরে চার শিব মন্দির অনেকটা দক্ষিণেশ্বরের শিব মন্দিরের মতো, প্রত্যেকের পূজো আলাদা ভাবেই হচ্ছে মন্দিরের ঠাকুর মশাই এর সাথে আলাপ হলো, আমরা কোলকাতা থেকে গেছি শুনে নিজে থেকেই গল্প করলেন--- আগে পশ্চিমবাংলার শ্যাম নগরের বাসিন্দা ছিলেন পরে বাংলাদেশেই বসবাস করতে শুরু করেন। খুব সুন্দর ভাবেই পূজা করিয়েছিলেন আমাকে দিয়ে, তারপর অঞ্জলি দিলাম মায়ের উদ্দেশ্যে, নাট মন্দিরের বাইরে বিশাল জায়গা আছে সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, সেদিনও বিয়ে ছিল তাই মন্ডপ সাজানো হচ্ছিল খুব সুন্দর করে, আমরা সকলে মন্দির চত্বর খুব ভালো করে ঘুরে দেখলাম, তারপর ওখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফেরা---

হোটেলে ঢুকে একটু রেষ্ট নিতে নিতেই সুজনের ফোন দিদি আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি--- দশ মিনিটে তৈরি হয়ে বেড়িয়ে যাওয়া সুজানের সাথে বই মেলার উদ্দেশ্যে---


পর্ব-৮

আমি পনের বছরেরও আগে পাসপোর্ট করিয়ে ছিলাম আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ দেখার জন্য, দুই একবার যোগাযোগও করেছিলাম পশ্চিম বাংলার এক ট্রাভেল এজেন্সি এর সাথে— একটা সময় তারা বাংলাদেশ যেতেন টুরিস্ট নিয়ে, পরে অবশ্য তারা কোনও কারণে বাংলাদেশকে বাতিল করেছিলেন। যে কারণে আমার যাওয়া হয়নি তাছাড়া আমার পতিদেব যেতে নারাজ ছিলেন ভীষণ, কারণ তার একটাই বক্তব্য ছিল— ওখান থেকে গন্ডগোলের কারণেই ভারতে চলে আসতে হয়েছিল, ওখানে সবসময়ই গন্ডগোল, যদি আমরা যাবার পর গন্ডগোল লাগে, তখন আমাদের কে দেখবে, ওখানকার কাউকেই তো চিনি না।

তাই যেখানে খুশি যাও, বাংলাদেশ যাওয়া চলবে না কখনও, এটাই আমার শেষ কথা, কিন্তু আমার জন্মভূমি আমাকে প্রতিনিয়ত ডেকেছেন চুপি চুপি— আমি অনুভব করেছি আমার আরেক মা আমাকে খুঁজেছেন সময়ে অসময়ে। আমার জন্মভূমির মা যার পূজো দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছি আজ আমি, তিনি ঢাকার পূজিতা দেবি ঢাকেশ্বরী, সপরিবারে মাতা দূর্গা---

বাংলাদেশে পৌছে আমার কখনও একবারও মনে হয়নি অন্য একটা রাষ্ট্রে এসেছি, যা কাঁটা তারের বিভাজনে আজ পৌঁছাতে এতো ঝামেলা। পাসপোর্ট তৈরি করো, ভিসা রেডি করাও তারপরও নানা চেকিং আর ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে শেষ ধাপে পৌঁছানোর আগেও আবার চেকিং!! একটা সময় অবাক লেগেছিল এই ভেবে যে এতো চেকিং এর পরেও কেন মাঝে মাঝে ছাড় হয়ে যায় পাচারের জন্য বিরাট বিরাট চক্র!! অনেক বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম যখন এয়ার বাসে ওঠার মুহূর্তেও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন লাইটার বা দেশলাই নেই তো ম্যাম আপনার পার্সে? হেসে ফেলেছিলাম জোরেই আমি এই প্রশ্ন শুনে।

এয়ার বাসে বসার পর একটু হলেও নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম আমি, এবার তাহলে ঢাকা পৌঁছাব কোনও একটা সময়, চৌষট্টিতে আসার পরে আমাদের পরিবারের কেউই আর ফিরতে পারেনি তাদের জন্মভূমিতে— সকলেই আক্ষেপ নিয়েই গ্যাছেন হয়ত, তবে আমার মা অদ্ভুতভাবে কখনও যেতে চাননি বাংলাদেশ। কিন্তু আমি যে দেশ চোখেই দেখিনি শুধু মাত্র জন্মেই একটা টান অনুভব করেছি প্রতিনিয়ত, তাই হয়তো কেউ ডাকলেই ছুটে ছুটে যাই মাতৃভূমির গন্ধ গায়ে মাখতে।

একটা সময় নিজের দুই ডানা ছড়িয়ে উড়ল আকাশে--- একশো পঁচাত্তর জন যাত্রী নিয়ে আমার ইন্ডিগোর ছোট্ট এয়ার বাস। উপরে উঠতে উঠতে বিরাট আকাশের অসাধারণ রূপে আমি মুগ্ধ!!সূর্যদেব পাটে যাবার মুহূর্তে, তার অপরূপ ছটায় সমস্ত দিকচক্রবালে যে বর্ণময় রঙধনুর ছটা সমস্ত চরাচরকে সাজিয়ে তুলেছিল তা অবর্ণনীয়— আমার মতো এক সাধারণ মানুষও এটা দেখতে পাবার সৌভাগ্যের জন্য পরমপিতার কাছে চির কৃতজ্ঞ থেকে যাবো আমৃত্যু।

আস্তে আস্তে আধ ঘন্টার উড়ান শেষে যখন আমার মাতৃভূমির মাটি স্পর্শ করলো আমাকে উড়িয়ে নিয়ে আসা বিমানটি। তখন আমি মনে মনে হেসে ছিলাম, আমার ঠাকুরমার বলা একটা কথা সেই সময় মনে খুব পড়েছিল— একটা সময় মানুষ উড়ে উড়ে দেশ বিদেশ বেড়াতে শুরু করবে দেখিস সুজা, তুইও হয়তো যাবি তোর জন্মভূমি দেখতে, সে সময় আমি হয়তো থাকবো না। ঠাকুরমার কথাটা সত্য হয়েছিল, শুধু তিনি নন, আমার বাংলাদেশ পৌঁছানোর আগেই সবাই চলে গ্যাছেন পরমপিতার আশ্রয়ে শান্তির খোঁজে— যা তারা সব হারিয়ে খুঁজেছেন প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশ বিমানবন্দরে পা দিলাম আমি একটা সময়, একটা আনন্দ আমাকে ঘিরে ধরেছিল সেই সময়, যা আমি অনুভব করেছিলাম, এক সন্তানকে মায়ের জড়িয়ে ধরার আরাম ছিল সেটা। কয়েকশো মাইল পারি দিতে আমার পঁয়তাল্লিশ বছর লেগেছিল, আর এই ভাবনাটাই আমার চোখে জল এনে দিয়েছিল প্রথমে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে। এটা আমারও বাংলাদেশ যেখানে আমি জন্মেছি, কোনও আলাদা কিছু দেখিনি ওখানে আমি, দুই দেশের মানুষজন গাছপালা ঘরবাড়ি— এখানেও সূর্য ওঠে দিনে, এখানেও পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ, অমাবস্যায় অন্ধকার ছেয়ে যায়। সন্ধ্যা আকাশে তারারাও ঝিলমিল করে হেসে ওঠে ঠিক ওখানকার মতোই, এখানকার মানুষের মতো ওরাও রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথ কাজি সাহেব ও আরও অনেকের গান আমাদের মতোই গেয়ে থাকেন। কাঁচা রাস্তার দু'পাশে চৈত্রবাতাসে ধানগাছের মাথা দোলানো আমাকে মনে করিয়েছে, এই বাংলার কথাই, শুধু মাত্র কাঁটা তারের বিভাজনে আমরা কীভাবে আলাদা হতে পারি!!কবির কথায়— 'আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালোবাসি'--- কী করে ভুলি এই গান---
                         চলবে----
(শব্দ সংখ্যা: ১৪১৪)







পলাশে বিলাসে

প্র ল য়  ব সু

"...দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।"
 –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থ)
কি নিয়ে যে কবিগুরু লেখেন নি তা এতদিনেও খুঁজে পেলাম না!

রোববারের ছুটির দিনে ভ্রমণপ্রিয় দেবপ্রিয়র আহ্বানে তাই দুপুরের ভাতখাবারের পর বেরিয়ে পড়া দু'চারজন সাহিত্যসাথীর সঙ্গে - অদূরভ্রমণের হাতছানিতে। 

ইংরিজি সাহিত্যের অধ্যাপক অরিক্তম, ওঁর স্ত্রী সংহিতা আর ওঁদের সন্তান আমাকে আর অন্যতম বন্ধু সত্যদাকে ঠিক তিনটে নাগাদ তুলে নিয়ে পাড়ি জমালো ঐতিহ্যবাহী বেলুড়ের পথে। 


জানাই ছিল না ওখানে "ইএসআই" হাসপাতালের পিছন দিকে পলাশবনের কথা। মিনিট বিশেক অরিক্তমের দক্ষ (যদিও শিক্ষার্থী ছাপ লাগানো) সঞ্চালনায় পৃথিবীর দীর্ঘতম পথ মানে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড ধরে যখন সবে লালাবাবা কলেজ পেরিয়েছি মুঠোফোনে দেবপ্রিয়র টুংটাং - "প্রলয়দা তোমরা কদ্দূর?" অবস্থান জাহির করার সাথে সাথেই নির্দেশ- "পেরিয়ে চলে গেলে যে! লালবাবা কলেজের ঠিক উল্টোদিকের রাস্তা ধরে বেলুড় স্টেশন ক্রস করে হাসপাতালের ঠিক পিছন দিকে চলে এসো। আমরা টোটো ধরছি ওখান থেকেই।" অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে সঙ্কীর্ণতর পথে আরো মিনিট দশেক গিয়ে হাজির হলাম হাসপাতালের গেটের ঠিক সামনে।

গাড়িটা সবে পার্ক করে নেমেছি, দেখি এক দায়িত্বপ্রাপ্ত গোঁফেল ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন- "এখানে অ্যামবুলেন্স আসতে পারে। রাস্তার ওদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পার্ক করুন।" পরিচয় দিয়ে একটু যে মাতব্বরি করব তার সুযোগও পেলাম না। কারণ ইতিমধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে আমাদের স্পাইডারম্যান মানে সাধনদা জড়িয়ে ধরেছেন ওনাকে- "আরে অরূপ না!" ক্রমে জানা গেল দুইবাল্য বন্ধুর মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছর পর দেখা; আর তাতেই কেল্লা ফতে। অরূপবাবু তো আমাদের ছোট্ট অল্টোটা পারলে প্রায় মর্গের দেওয়াল ফুঁড়ে ঢুকিয়ে পার্ক করে দেন আর কি!

ততক্ষণে গোটাকয়েক যাত্রী ভর্তি টোটো নিয়ে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে দেবপ্রিয়- মানে আমাদের ফিল্ড ডিরেক্টর- কুচকাওয়াজ শুরু করে দিয়েছে। 
সাথে ওর স্ত্রী অন্তরা আর ছেলে ভাবলেশহীন মুখে চলেছে চিরাচরিত আরো বেশ কিছু আগ্রহী নানা বয়সের ভ্রমণার্থী সহযোগে।

পায়ে হাঁটা পথে একটু ঢুকতেই কিংশুকের  সুঘ্রাণ হৃদয়ে জাঁকিয়ে বসল। কি বললেন! পলাশ ফুলের গন্ধ নেই? তা কবিরাজ যখন লিখেছিলেন- "ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল..."-তখন কই কিছু বলেন নি তো! আমি উঠতি লেখক বলে সমালোচনা! যদি আমি পলাশের গন্ধ পাই আপত্তি কিসের?!

সত্যিই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য- বেশ কিছু পলাশের জঙ্গলে লাল থেকে ফিকে ফিকে হয়ে কমলা, আরো আরো ফিকে হয়ে হয়ে থরে থরে হলুদ পলাশের ঘ্রাণ "হরিৎ মদের মত গেলাসে গেলাসে" পান করার সৌভাগ্য হল এই অপরিচ্ছন্ন অথচ রংবাহারী পরিবেশে।

বিকেলের নরম রোদের আলোয় কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের দল পলাশের বনে অগ্রিম বসন্ত উৎসব শুরু করে দিয়েছে। আর হবে নাই বা কেন! কবিগুরু তো বলেই গেছেন- "ফুলের বনে যার কাছে যাই তারেই লাগে ভাল..."। 
আর আমার তো রোজই কাউকে না কাউকে ভাল লেগে যায় (গিন্নিকে বলবেন না যেন!)- এছাড়া আরো কিছু স্থানীয় ছোটছোট ছেলেমেয়ে "বটঝুরিতে দোয়েল দোল..."; না না, এসব আপনাদের প্রিয় ছন্দপথিকের লেখা, আমার এমন লেখার ক্ষমতা কই!


ইতিমধ্যেই এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন- "প্রলয়দা চিনতে পারছেন?" ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত হয়েই সামলে নিলাম, বললাম- "অবশ্যই সঞ্জয়দা তো?" ভদ্রলোক খুব খুশি হলেন। ইনিও এক ভ্রমণপাগল, কাজের ফাঁকতাল গলে পারলেই এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়েন দলবল নিয়ে, আজ যদিও একাই হঠাৎ এসেছেন জানালেন। 

প্রচুর ছবিশিকারী নানা জায়গা থেকে  তাদের নানান ধরণের ক্যামেরা নিয়ে  ছবি তুলতে এসেছেন চোখে পড়ল। ভুঁই চুমে চাপ চাপ পড়ে আছে পলাশের লাশ।  অনেকেই সেগুলো সযত্নে কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে বলতেই হয় অঞ্চলটির সৌন্দর্য্য বেশ কিছুটা ম্রিয়মান অনেক অনাহুত পরজীবী পরগাছায়। স্থানীয় বা বহিরাগত কেউ কেউ ডাল ভেঙে পলাশ নিয়ে যাচ্ছেন অহরহ- খবর পেলাম। কর্তৃপক্ষ যদি পুরো উদ্যানটির যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন তবে সেটি হবে পলাশপ্রিয় পর্যটকদের পরম পাওয়া উপহার- একটি নয়নাভিরাম ভ্রমণপ্রাঙ্গণও।

এরই মাঝে শেষ বিকেলের ঝুরু ঝুরু রোদ যখন সবে ফুটন্ত পলাশের ফাঁকফোকর দিয়ে আলগোছে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সংগোপন, ঠিক তখনই সংহিতা চুপিচুপি জানালেন উনি একটি ম্যাগাজিনের ৩১ তম বর্ষের দ্বিতীয় সংস্করণটি - পূজা বার্ষিকী "সার্ধদ্বিশতবর্ষে রামমোহন" আমাকে আর সত্যবাবুকে দেবার জন্য এনেছেন।

এতক্ষণ কোথায় যেন একটু খালিখালি লাগছিল। শুনেই বিরলকেশা মাথায় তড়াক করে বুদ্ধি খেলে গেল - "অশোকে কিংশুকে অলক্ষ রঙ" লাগানোর অকারণ সুখের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? সত্যদাকে বলতে উনি এগিয়ে গিয়ে দেবপ্রিয়কে বলতেই মুশকিল আসান। 

একটা সাযুজ্য বজায় রেখে স্থান নির্বাচন করে ফেসবুক লাইভ ছড়িয়ে দিল এই বর্ষীয়ান  স্বনামধন্য লিটিল ম্যাগাজিনকে অজস্র ফেসবুক বন্ধুর মধ্যে গোধূলির পলাশ রঙিন আলোয় - সাক্ষী থাকলেন  ভ্রমণপ্রেমী বেশ কিছু সদস্য আর কিছু অপরিচিত ভ্রামণিকও। 


অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানটির শেষে এক সুন্দরী অপরিচিতা এগিয়ে এলেন, বললেন- "খুব ভাল লাগল, তাই আলাপ করতে এলাম। আচ্ছা আপনাদের পত্রিকায় কি নতুনদের লেখাও ছাপা হয়? কোথাকার পত্রিকা যদি একটু যোগাযোগ দেন।" 
একটু সেলিব্রিটি মার্কা কায়দায় ওনার হাতে তুলে দিলাম পত্রিকার ছাপানো কার্ড, সংহিতা ম্যাডাম বনগাঁ থেকে প্রকাশিত পত্রিকার বিষয়ে কিছুটা জানিয়ে ওনার ফোন নম্বরও দিলেন। 

মাথায় যখন ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে ছন্দ পথিকের  কয়েকটি লাইন -

"ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় দোলে
শিমূল পলাশ শাখ,
সেইখানেতেই তোমার আমার
পথ ফুরোনোর বাঁক..."

-ঠিক তখনই আচানক একটা ষণ্ডা মার্কা লোক (আমার থেকেও বদখদ দেখতে) এগিয়ে এসে বলল - "আসলে ও নয়, আমার মা মানে ওর শ্বাশুড়ী একটুআধটু লেখালিখি করে..." ধুত্তেরি! আর কথা বাড়ালাম না, গম্ভীর ভাবে বললাম - "পত্রিকার দপ্তরে যোগাযোগ করে নেবেন।" 
আর ইতিমধ্যে যা বলার সাধনবাবু আর সংহিতাদেবী তো বলেই বসে আছেন। বরং এবার ফেরা যাক।

ফেরার পথে সাথে ছিল চা-টার অবৈতনিক আমন্ত্রণ। তারপর একাংশ বেরিয়ে গেলেন ১৮৯০ সালে পূর্ণচন্দ্র দাঁ প্রতিষ্ঠিত সুপ্রাচীন বেলুড় রাসমঞ্চ ও রাধারমণ জিউ মন্দিরের দিকে, আর আমরা "পুনর্মুষিকো ভবঃ"র পথে।


আর হাওড়ার এই পলাশ কানন যেকোনো দিন অল্প সময়ে নিজেরাও দেখে আসতে পারেন। প্লিজ কিভাবে যাবেন, কত খরচ - এগুলো জিজ্ঞাসা করে বিব্রত করবেন না। লেখায় সব বলা আছে।

সকলে সুস্থ থাকুন, ভ্রমণে থাকুন, সাহিত্যে থাকুন, কবিতায় থাকুন -

"আধখানা বেলা
বাকি আছে আর,
তারপর সব
কুয়াশার ভীড়ে -
আমার কবিতার ভার
থাকিবে লুকায়ে
আরো অনেক গভীরে তার..."




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪