স্মৃতিকথা
কয়েকটি বুঝভুম্বুল যাত্রা
সু নৃ তা রা য় চৌ ধু রী
আমার জীবন ধরে যাত্রাপথে অনেক বাধা। অশ্লেষা মঘা বারবেলা ইত্যাদি কিচ্ছুটি গ্রাহ্য না করে বেরোলে যা হয় আরকি! আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এই যে এত এত লোক বাস, ট্রেন, ট্রাম, জাহাজ, উড়োজাহাজ বোঝাই করে হরদম চলাচল করছেন, তাঁদের সবাই কি পাঁজি পুঁথি মেনে চলেন? আমার বেলাতেই যত বিভ্রাট কেন?
আমার তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ার, স্কুল ছাত্রী তো নই, একা একা বেড়াতে না গেলে বড়ো হওয়ার প্রমাণ দেওয়া যায়না। তো দুর্গাপুরে চললাম আমার দিদির কাছে। নির্বিঘ্নেই যাওয়া হলো। ফেরার সময় দিদির শুরু হলো চিন্তা; তিনি আমাকে একা বর্ধমান ফিরতে দিতে নারাজ, কিন্তু জামাইবাবুর অফ ডে আসতে বেশ বাকি। এদিকে সময় মতো না ফিরলে বাবা মা চিন্তা করবেন। বিস্তর চিন্তা ভাবনা করে তিনি এক প্রতিবেশী মেয়ের সঙ্গে আমাকে ভিড়িয়ে দিলেন। সে দুর্গাপুর-বর্ধমান নিত্যযাত্রী, বর্ধমান ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। স্টেশনে এসে ওর সহপাঠী আরো তিন জন মিললো। আমার অভ্যাসবশতঃ টিকিট কাউন্টারের দিকে যেতেই ওরা হাঁ হাঁ করে উঠলো। কি? না টিকিট লাগবে না। ওদেরও লাগে না, রোজ এই ভাবেই ওরা যাতায়াত করে।
আমি তো আদর্শবাদী বাবার মেয়ে, তাই অপরাধবোধ এবং ভয়ের বিমিশ্র অনুভূতিতে দুরুদুরু বুকে চুপ করে রইলাম। তারপর ট্রেন এলে ওদের সঙ্গে আমিও দুদ্দাড়িয়ে সামনে যে কামরা পড়লো, তাতেই উঠে বসেছি। প্যাসেঞ্জার খুব কম, পরিচ্ছন্ন, সীটগুলোও বেশ চওড়া, আরামদায়ক। দেখেশুনে উপলব্ধি করলাম, ওটা প্রথম শ্রেণী।
হায় ভগবান! একেই বিনা টিকিটে, তার ওপর ফার্স্ট ক্লাস! প্রবল আশঙ্কায় আমি মুহ্যমান! ওদের কোনো হেলদোল নেই। সামনের সিটে একজন ভদ্রলোক বসেছিলেন, দেখতে অনুপ জলোটার মতো। তখন অনুপ জলোটার খ্যাতি মধ্যগগনে। সেই নিয়ে ফিসফিসিয়ে বেশ আলোচনা চলছিল। এমন সময় চরম ঘটনাটা ঘটলো। ট্রেন বর্ধমান ছাড়িয়ে চললো একটুও না থেমে প্রবল গতিতে। তখন জানা গেল ওটা কোল ফিল্ড এক্সপ্রেস, বর্ধমানে এর স্টপেজ নেই, সোজা হাওড়ায় গিয়ে থামবে। তার মানে? আমি এবার রুখে উঠলাম। "তোমরা রোজ যাতায়াত করো, তোমরা জানো না?" তখন ওদের মুখও শুকিয়েছে। কী ভাগ্যি! ওটা বর্ধমান ছাড়িয়ে কিছু দূর গিয়ে পরবর্তী স্টেশন থেকে সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সেই আঘাটায় আমরা পাঁচ জন একে একে নামলাম। প্ল্যাটফর্মে নামা আর রেল লাইনের ওপর নামা, আকাশ পাতাল পার্থক্য। তার ওপর প্রতি মুহূর্তে ভয়, এই নাকি ট্রেন ছেড়ে দেয়! অতঃপর শুরু হলো রেললাইন ধরে উল্টো মুখে হেঁটে বর্ধমান অব্দি যাওয়া। সাংঘাতিক নোংরা, তার ওপর আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় কাদায় ভর্তি। প্রতি পদক্ষেপে পা পিছলে যায়। আমার আবার সঙ্গে ব্যাগপত্তর আছে। সে যে কী করে স্টেশন পর্যন্ত এলাম! প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মতো শরীর বা মনের জোর ছিল না, বাইরের দিক দিয়ে আরো কাদার মধ্যে পায়ের পাতা ডুবিয়ে রিক্সাস্ট্যান্ডে পৌঁছে রক্ষা পেলাম। আমার ওপর ভরসা করে একা ছেড়ে দিলে এর কোনোটাই হতো না।
আরেকবার আমার ছেলের তখন পঁচিশ দিন বয়স, কলকাতা থেকে বর্ধমানে মায়ের কাছে যাব। সঙ্গে আমার স্বামী ছাড়াও দিদি, জামাইবাবু আর দিদির মেয়ে। আগেই কথা হয়ে আছে, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে মেয়েরা লেডিস কামরায় উঠে যাবে আর ওরা টিকিট কেটে, আমাদের হাতে দিয়ে পাশের কামরায় উঠবে। আমরা তো সিটে বসে বাইরে তাকিয়ে আছি, ওনাদের দেখা নেই। ট্রেন ছেড়ে দিল। কী বিপদ! এখন চেকার উঠলে? ঠিক যা ভেবেছি! চেকার উঠলেন। আমাদের আশেপাশে সামনে পিছনে সবার টিকিট চেক করলেন, আমাদের কাছে এলেন না। টিকিট চাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তিনি নেমে যাওয়ায় আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু এখনই কি? বর্ধমানে নেমে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও ওনাদের পেলাম না। এদিকে প্ল্যাটফর্মে সাদা কালো পোশাকের ছড়াছড়ি, ব্যাপক কড়াকড়ি চেকিং এর। কিন্তু এবারও সব বাধা কাটিয়ে গেটে পৌঁছে গেলাম। টিকিট কালেক্টর সাহেব কোলে শিশু দেখে নিজেই পথ ছেড়ে দাঁড়ালেন। আমার স্বামী এবং জামাইবাবু লম্বা লাইন ধরে টিকিট কেটে আসতে আসতে দেখেন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। পাঁচটা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট নিয়ে ওরা দুজন পরে লোকাল ট্রেনে বর্ধমান পৌঁছান।
বর্ধমানের দুটো স্টেশন আগে ল্যাংচার জন্য বিখ্যাত শক্তিগড়। ওখানে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের থেকে স্টেশনের দূরত্ব খুবই কম। বর্ধমানে আমাদের বাড়ি এই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড অথবা দুই নং জাতীয় সড়কের পাশেই। তাই অনেক সময় আমরা সময় বাঁচানোর জন্য শক্তিগড়ে নেমে বাস ধরে বাড়ি যেতাম। একবার আমার পুত্র তখন আড়াই বছরের। হাওড়া স্টেশনে আমাদেরকে লেডিস কামরায় তুলে দিয়ে আমার স্বামী উঠেছেন অন্য কামরায়। ট্রেন ছাড়ার আগে জানালা দিয়ে বলে গেলেন, "শক্তিগড়ে নেমে গেলেই ভালো হতো, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছনো যেত।" সেই কথার ওপর ভিত্তি করে শক্তিগড়ে নেমে দেখি তিনি তো নামলেন না! বিস্ময় বিহ্বল চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা চলে গেল। আমার পুত্র বলে উঠলো, "বাবা আমাদেরকে রেখে কোথা….য় চলে গেল?" প্রশ্নটা আমারও। প্ল্যাটফর্মের প্রতি স্তম্ভে দেওয়ালে ওর রিনরিনে গলার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো, আর কিছু না। তার পর প্রতীক্ষা, যদি ভুল বুঝতে পেরে ফিরতি ট্রেনে অথবা বাস ধরে ফিরে আসে! একবার বাস স্টপেজে একবার স্টেশনে উদভ্রান্তের মতো ঘুরছি। বাচ্চার খাবার সঙ্গে ছিল, তাই রক্ষা। বাস ভাড়া দেবার মতো পয়সা সঙ্গে নেই। এই ভাবে অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পর অবশেষে একজন বাস কন্ডাক্টরকে বললাম আমার অসহায় অবস্থার কথা। তিনি দয়াপরবশ হয়ে আমাদের বাসে ওঠালেন, ভালো সিটে বসতে দিলেন এবং ভাড়া চাইলেন না, সহযাত্রী কাউকে জানতেও দিলেন না। এখনও ওনার কথা মনে করলে আমার প্রণাম করতে ইচ্ছে করে।
যে কথা যায় না বলা বুঝে নিতে হয়
সি রা জু ল ই স লা ম
জন্মটা এক ক্ষয়িষ্ণু পরিবারে।ততোধিক ক্ষয়িষ্ণু ইছামতীর পাড়ে একসময় জমিদারী জৌলুস ছিলো। বিগতাযৌবনা নারীর মতই তলানীতে ঠেকে গেছে আজ। এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী বাবাও সেই অমোঘ স্রোতের ভাটার টানে কেমন নির্জীব হয়ে গেছেন। তাঁর আয়-রোজগারের একমাত্র পথ এখন জমি বিক্রি।
ফি-বছর সন্তানের জন্ম দিতে দিতেই মা জেরবার। প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য আর পথ্যের জোগান হতো না ঠিকমতো। হয়তোবা সে কারণেই মায়ের চারটা সন্তান অকালেই ঝরে গেছে। তারপরও ক্ষ্যান্ত দিতে পারেনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কাছে নারীমাত্রই ভোগের সামগ্রী আর সন্তান জন্মানোর মেশিন। তথাকথিত সমাজব্যবস্থার মূলমন্ত্র ঘরের লাঠি যার যত বেশী, সেই তত ক্ষমতাধর। বাকি ভরসা জোত-জমি আর লাঠিয়াল। এভাবেই একদিন- পৃথিবীর কক্ষপথ বিচ্যুত হয়ে সুড়ুৎ করে মায়ের গর্ভে ঠাঁই হলো। অপাংক্তেয় এই আমায় গর্ভে ধারণ করে মায়ের সে কী ভোগান্তি। নানান রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমার সাথে তাঁর নাড়ীর সম্পর্ক ছেদ হলো মাত্র ছ'মাস পঁচিশ দিনে। তার মানে আমি সাতমেসে। চোখ ফোটেনি, নখ গজায়নি, ইঁদুরের বাচ্চার মতন ট্যালটেলে পেটের চামড়া ভেদ করে নাড়ী দেখা যেতো। অনেকেই নাকি ভয় পেতো সেই আমায় দেখে। তবে জননী-স্নেহে তুলোয় জড়িয়ে ওম্ এ ভরিয়ে রাখতো মা আমায়। বুকের দুধ চুষে খাওয়ার শক্তিটুকুও ছিলো না বলেই তুলোর সলতেয় ফোটা ফোটা দুধ ঢেলে দিতো আমার হা করা মুখে। তাও একফোটা থেকে দু'ফোটায় গড়ালেই অবস্থা চিত্তির।
সমসাময়িক সময়ে কাকী, মাসীর কোলেও ছেলে সন্তান এসেছে। দেখতে বেশ নাদুসনুদুস। সকলের আগ্রহ তাই তাদের দিকেই। দুঃখিনী মা আমার তার কোলতলায় শুইয়ে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এভাবেই একদিন বড় হলাম।
ততদিনে আমার পরে আরও চার ভাইবোন। আর আমার আগেও চার ভাইবোন। চার চারের মাঝখানে আমি হলাম চিঁড়ে চ্যাপ্টা। বলা চলে ছাগলের তৃতীয়-বাচ্চা। তিড়িংবিড়িং ঝাঁপাঝাঁপি; খাদ্যে অকুলান। বৈষম্য শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। আমার আগের দুই দিদি আর পরের দুই বোন হওয়াতে আমার চাহিদার কোন মূল্যায়ন হয় না। তাদের চুড়ি-ফিতা কিনে দেয়, আমার ভাগ্যে জোটে না। কারণ আমি ছেলে। মন খারাপ হয়, প্রতিবাদ করি। নিভৃতে কাঁদি ; কোন লাভ হয় না।
বড় দুই দাদা। ধনীলোক বাবার সন্তান। পড়াশোনা, খেলাধুলায় চৌকস। সমাজে তাদের নামডাক তাদের কৃতকর্মে। দামী পোষাকে তাদের চালচলন। আমি ন্যাংটোপুঁটো। কালেভদ্রে কপালে জোটে লম্বা হাতাওয়ালা ক্যারোলিন কাপড়ের শার্ট। যার হাতার বোতাম দু'টো আমার স্বাভিমান আর লজ্জার কামড়ে হাপিস হয়ে গেছে সেই কবে। তারপর থেকেই জামার হাতা দু'টো হাতির কানের হাওদা হয়ে ল্যাপ্টালেপ্টি হয়ে থাকতো যখন সেই শার্ট আমার গায়ে চড়তো। পরনের পরিধেয় হাফপ্যান্ট। সেটা বড় দুই দাদার বাতিল হয়ে যাওয়া প্যান্ট দর্জিবাড়ী পাঠানোর পর আবু খলিফা (দর্জিকে কেন খলিফা বলে ডাকা হয়--- আজও আমার অজানা রয়ে গেছে সেই রহস্য) সেটআপ করে দিতো। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা যেতো পিছনের অংশ ফেঁসে গেছে (যদিও সেটা বাতিল বলেই তাপ্পি মারা) আর সামনের বোতাম হাওয়া। অনূঢ়া কচ্ছপের মতন মাথাটা আলগোছে বের করে দিয়ে জগৎসংসার দেখতো নুনুবাবাজ্বী। তা নিয়েও কত বিড়ম্বনা। কত না বিব্রতকর পরিস্থিতি।
একান্নবর্তী পরিবারের নিয়ম সবাইকে রান্নাঘরে মায়ের চারপাশে গোলাকার হয়ে পিঁড়িতে বসে খেতে হবে। মাঝখানে ভাতের হাঁড়ি, তরকারির কড়াই ; দশভূজার মত সবাইকে বিলিবন্টনে ব্যস্তত্রস্ত মা। মাছের মুড়োটা, সরভাসা দুধের বাটিটা নিত্যদিনেই চলে যায় বড় দুই দাদার দিকেই। কারণ তারা রাত জেগে পড়াশোনা করে। গতর ঘামিয়ে খেলাধুলা করে। তারপরও কখনো-সখনো তরকারির স্বাদটা যদি একটু সামান্য উনিশ-কুড়ি হয়েছে তো তরকারি বাটি ছুঁড়ে ফেলতো বড়দা। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে ভাতের থালা, তরকারির বাটি বনবন শব্দ তুলে আঁছড়ে পড়তো গিয়ে উঠোনে। মা তখন অসহায়ার হাসি হাসতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। পাশাপাশি বাস/ দেখাদেখি চাষ! ক্রমেক্রমে মেজদাও এই শিক্ষাটা আয়ত্ব করে নিলো বড়দার দৌলতেই। এরপর থেকেই হঠাৎ করেই নিয়ম হয়ে গেলো দু'জনের খাবার তাদের পড়ার টেবিলে রেখে দিতে হবে।
রোববার আর বুধবার সাপ্তাহিক হাটবার। বড়দার জন্য নির্দ্ধারিত "আটআনা", মেজদার জন্য পঁচিশ পয়সা। তীর্থের কাকের মতন বাড়ীর বাইরের রকে বসে বাবার জন্য অপেক্ষমান আমি। সারাটা দুপুর ঘ্যানরঘ্যানর করি। বিরক্ত হয়ে রুমালের খুঁট খুলে দশ পয়সা বের করে দিতো বাবা। সেই দশ নয়া পয়সা নিয়ে রকের আসন ছেড়ে একলাফে নেমে, দৌড়ে একেবারে বাজারের ভেতর। সেখানে পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানীরা। বারোভাজা, দুধমালাই, লালরঙা বরফ, বরফকুচির লাল নীল সরবৎ। ওপাশে ষাটোর্দ্ধ বয়সের দীনুময়রার দোকান। মাটির হাঁড়িতে সাজানো আছে রসে টুসটুসে রসগোল্লা, পান্তুয়া (লেডিকেনী) আর আছে বনরুটি।
বিচক্ষণ ক্রেতা আমি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দরদাম করি। কোনটা দু'পয়সা, কোনটা এক পয়সা। কোনটা তিন পয়সা। এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে দরদাম ঠিকঠিক হলে হয়তো মন চাইলো বানরুটি আর পান্তুয়া। দোকানীর সামনে পেতে রাখা ইঁটে বসে দু'পয়সার দু'টো পান্তুয়া আর এক পয়সার একটা বানরুটি খেয়ে তাপ্পি মারা প্যান্টের পিছনে ভিজে হাত মুছতে মুছতে ছুটলাম যাদুর খেলা "ভেল্কিবাজী"র জমায়েতে। সেখানে এর ওর হাঁটুর ফাঁক গলে গিয়ে দাঁড়াই সুবিধে মতন জায়গায়। যেখান থেকে পরিস্কার দেখা যায় একটা মানুষের পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে যাদুকর তার হাতের লম্বা তলোয়ার দিয়ে।কিম্বা বানর-খেলার আসরে। ডুগডুগি বাজিয়ে ওস্তাদ। আর চ্যামুড়ে বাঁদরের খেলা চলছে।
সেসব দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যায়। মন না চাইলেও ঘরে ফিরতে হবে। ফেরার সময় দীনু ময়রার দোকান থেকে একটা বানরুটি আর দু'টো পান্তুয়া কিনে কলাপাতায় জড়িয়ে, পকেটে ভরে লুকিয়ে ঘরে ফিরতাম আমার বড়দির জন্য। দিদি আমায় খুব ভালোবাসে। রাতে তার বুকে জড়িয়ে কত গল্প বলে আমায় ঘুম পাড়ায়। সুর করে গান শোনায় আর হাঁটুরে কবিতা শোনায়। গুনাই-বিবি, মামলার সাক্ষী ময়না পাখি, রহিম-রূপবান, গরীবের ছেলে শাজাহান ; কত বিচিত্র কবিতা। সেসব কবিতার বই ফেরি করে বিক্রি হয় হাটবারে হাটবারে। ফেরিওয়ালা সুর করে পড়ে, "তের শ পঁয়ষট্টি সালে /এই ঘটনা বরিশালে/ হয়েছিলো পাতার থানায়। সে সুরের মূর্চ্ছনায় রাতে শুয়ে আমি কাঁদি। টের পেয়ে বড়দি আমায় জড়িয়ে ওড়নার আঁচলে কান্না মোছায়। আমি তাঁর বুকে মুখ লুকোই নীরবে।।
হুইসল্ ভেসে আসে সীমান্ত পেরিয়ে
শু ভ্র জী ৎ বি শ্বা স
নব্বইয়ের দশক। কোচবিহার জেলার সীমান্ত শহর মেখলিগঞ্জের জনসংখ্যা তখন খুবই নগন্য। সদ্য শহরে পরিণত হওয়া মেখলিগঞ্জের বুকে এক একটা বাড়ির মাঝে অনেকটা দূরত্ব। এল.ই.ডি লাইটের প্রবেশ তো দূরের কথা। রাস্তার ধারে থাকা ল্যাম্প পোস্ট গুলো টিউব লাইটের আলোয় আলোকিত ছিল। রাস্তার মোড়গুলোয় শাল কাঠের পোস্টে শোভা পেত ভেপারের আলো। তখন হ্যাজাক, লন্ঠন থেকে টর্চ প্রায় সব বাড়িতেই বিদ্যমান। সন্ধ্যা হলেই নিয়ম মাফিক লোডশেডিং হতো। ধাপড়া স্টেট বাসটা ঢুকে গেলেই মোটামুটি ভাবে রাস্তা ঘাট ফাঁকা হওয়া শুরু হয়ে যেত। যদিও পাড়ার রকে কিংবা ক্লাব বা রাজনৈতিক দলের অফিসে পুরুষদের আড্ডা-বৈঠক চলতো নিয়মমাফিক। ডিডি ন্যাশনাল/ ডিডি বাংলা ও বাংলাদেশ বিটিভি ছাড়া সাদা কালো বোকাবাক্সে আর কোনো চ্যানেল না আসায় ও বিনোদনের মাধ্যম কম থাকায় প্রতি বাড়ির মহিলারাও সব কাজ সেরে নিজেদের আড্ডায় যোগ দিতেন। তবে সন্ধ্যার পর থেকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা কাজ করতো শহর জুড়ে। সে সময় চোর ডাকাতের উপদ্রবও কম ছিল না। অনেক পাড়াতে আর্জি পার্টি চলতো নিয়মমতো। রাত বাড়লে শোনা যেত 'জাগতে রহো' কিংবা রেফারির বাঁশির স্বর। সেসময় ভোর রাতে সময় আনুমানিক ৩ টা থেকে ৪.৩০ এর মাঝে জেগে থাকলে অনেকেরই কানে ভেসে আসতো একটি ট্রেনের শব্দ। রোজ প্রশ্ন করতাম বাড়িতে যে এখানে তো স্টেশন নেই! তবে ট্রেনের শব্দ কোথা থেকে আসে। উত্তর আসতো বাংলাদেশ বুড়িমাড়ি থেকে শব্দটা ভেসে আসে এপার বাংলার সীমান্ত শহরে। অবাক হতাম কিন্তু বিষয়টা খুব মজার ছিল তাই প্রায় রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম ভেঙ্গে তৈরি থাকতাম শব্দটা শোনার জন্য বিশেষতঃ স্কুলে যখন গরমের কিংবা পুজোর ছুটি চলতো, সেই সময়ে। এভাবে দিন মাস বছর যুগ গড়াতে লাগলো, বড় হওয়ার দৌড়ে আমরাও ভুলে গেলাম জীবনের এই ছোট্ট ঘটনাটির কথা। আজ হটাৎ কেন জানি না মনে পড়লো ঘটনাটির কথা। তাই লিখে ফেললাম। সত্যি কত কাল ধরে সেই শব্দটা কানে আসে না!
সিকিম ভ্রমণ: অমূল্য এক স্মৃতিচারণা
শ ম্পি তা রা য়
আজ আমার জীবনের কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতির পসরা খুলে বসলাম। ভ্রমণ আমাদের নেশা। প্রায়ই বেরিয়ে পড়ি কয়েক জন বন্ধুবান্ধব মিলে। এখানে আমার সিকিম ভ্রমণের কিছু অমূল্য স্মৃতিরচারণ করলাম।
বেশ কিছু বছর আগে আমরা বন্ধু বান্ধব মিলে গিয়েছিলাম সিকিমের ওখরে, হিলে ও ভার্সে বেড়াতে। এন জে পি থেকে সিকিমের জোরথাং হয়ে পৌঁছালাম অখরে-তে। পৌঁছেই মনে হলো কলকাতার কলরব থেকে মুক্ত হয়ে এ কোন শান্ত জায়গায় এলাম? নীল আকাশ ও বিশুদ্ধ বায়ু প্রথম দেখাতেই কাছে টেনে নিলো। ওখানে আমরা ছিলাম ওখরে শেরপা লজে। ঘরের জানলা খুলতেই পিছনে দেখলাম অতল খাদ আর তারপরে পাহাড়ের সারি। রাতে দেখা যেত পাহাড়ের গায়ে যেনো হিরে চকমক করছে। আসলে ওগুলো ছিলো অন্য পাহাড়ী এলাকার আলো। রাতের আকাশ এত পরিষ্কার যে আমি প্রচুর তারা আর আকাশগঙ্গা দেখতে পেতাম।
ওখানকার একটা ঘটনা না বলে পারছি না। সেইদিন সন্ধ্যের সময় আমরা লজের বাইরে ছিলাম। সেইসময় হয়ে গেলো লোডশেডিং। আমরা ঘরে তালা দিয়ে বেরোইনি, তাই একটু উদ্বিগ্ন হলাম। ফিরে এসে দেখি অন্ধকারের মধ্যেই লজের ছেলেটি এসে মোম বাতি রেখে দিয়ে গেছে। মোমবাতির পাশেই ছিলো আমাদের টাকা ভরতি ব্যাগ এবং সব টাকাই ঠিক আছে। শহুরে মনে ধাক্কা লাগল আর নিজেকে ছি ছিক্কার দিলাম।এরপর থেকে সাইট সিন এ যাওয়া ছাড়া আর কখনো তালা দিতাম না।
ওখরে থেকে পরের দিন গেলাম রিদবি বলে একটি ছোট পাহাড়ী গ্রামে। সেখানে একটি ছোট স্কুল আছে আর সেই স্কুলের বাচ্চাদের সবার গাল আপেলের মতো টুকটুকে। আমরা ঐ স্কুলের বাচ্চাদের জন্য কিছু পেন্সিল, ইরেজার, খুবই সামান্য জিনিস, নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার বদলে ওদের টুকটুকে লাল গালের অমলিন হাসি আমাদের হাজার ঐশ্বর্যের অধিকারী করে দিলো।
সেই দিন ছিলো বুদ্ধ পূর্ণিমা।ওখানকার একটি মনেস্ট্রিতে আমরা পুজো দেখতে গেলাম। গৌতমবুদ্ধ কে ওখানে গুরু পদ্মসম্ভাবা নামে সম্ভাষণ করা হয়। আমরাও প্রার্থনাচক্র ঘুরিয়ে প্রার্থনা করলাম। কিন্তু আমাদের মুগ্ধ করলো গ্রামবাসীদের ব্যবহার। ওনারা নুন চা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন, তারপর দিলেন লুচি তরকারি।ওনারা খুবই দরিদ্র। তাই প্রসাদ রূপে হয়তো কেউ মুড়ি, কেউ ছোলা বাদাম, কেউ আলু সেদ্ধ ইত্যাদি ভগবান বুদ্ধকে নিবেদন করেছিলেন। অনেকটা বৈষ্ণব ধর্মের মতো। তারাও সামান্য পুজোপচার দিয়ে গোপালের পুজো করেন। আমার মনে হয় প্রাচুর্যের মধ্য দিয়ে ভগবানকে হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু আরাধ্য প্রিয়তমকে কি পাওয়া যায়? যাই হোক ওনারা নিজেদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে আমাদের জন্য অনেকটা প্রসাদ দিয়ে দিয়েছিলেন, যা আমরা হোম-স্টে-তে ফিরে আয়েশ করে খেয়েছিলাম। আজও এই আতিথেয়তা ভুলতে পারিনি।
তৃতীয় দিন আমরা গেলাম হিলে ভার্সে সিঙ্গালিলা রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারিতে। হিলে থেকে ভার্সে পর্যন্ত ট্রেক করে যেতে হয় প্রায় ৪কিমি পথ। এই পথ পুরোটাই চড়াই আর এতটাই নিস্তব্ধ যে একটা পাতা পড়লেও শোনা যায়। আমরা তো চড়াই পেরিয়ে উপরে উঠছিলাম, হঠাৎই একটা বাঁকের পরে মেঘ সরে গেলো আর বেরিয়ে আসলো তুষার শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর আমার মনে হলো এনার জন্য লালমোহন গাঙ্গুলির শরণাপন্ন হতে হবে, কারণ আমার "বিশেষণ কম পড়িয়াছে"। হাঁ করে অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার হাঁটা শুরু করলাম। প্রচুর পাখি ডাকছিল, কিন্তু যেই ওদের দেখবো বলে দাঁড়াচ্ছি, অমনি লুকিয়ে পড়ছে।পাখিদের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে যখন ভার্সে-তে পৌঁছলাম মনে হলে স্বর্গ বোধ হয় একেই বলে। একটা সমতল জায়গা আর চারদিকে তুষারশুভ্র শৃঙ্গের ছড়াছড়ি। এখানে একটা হোম-স্টেও আছে, ইচ্ছে করলে রাতে থাকা যায়। আমাদের বুকিং ছিলো না, কিন্তু ঠিক করলাম পরের বার রাতের অপার্থিব সৌন্দর্য দেখার জন্য অবশ্যই এখানে থাকবো।
ভার্সে থেকে আস্তে আস্তে নামতে থাকলাম হিলের দিকে। নিচে নেমে একটা দোকানে অপূর্ব মোমো খেলাম। ওখরে-তে আমরা আরো একদিন ছিলাম। ওখানে বসে বসে ওদের রোজকার কাজকর্ম দেখতাম। দেখতাম খাবার জল আনতে বা অন্য যে কোনো কাজের জন্য ওরা কত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যাতায়াত করে। তাই বোধ ওরা এত কষ্টসহিষ্ণু।
শেষ হলো আমাদের সিকিম-ভ্রমণের পালা। ফিরে আসলাম অনেক কিছু সঞ্চয় করে। একটা দরিদ্র, কষ্টসহিষ্ণু জাতি, লোভহীন, অমায়িক যাদের ব্যবহার, তাদের কাছে আমাদের শহুরে মানুষদের অনেক কিছু শেখার আছে। তাছাড়া পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্য মনের মধ্যে অনেকখানি অক্সিজেন জুগিয়ে দেয়। ঘরে ফিরেও তাই তার আবেশ কাটেনা। কানে শুনতে পাই হিমালয়ের ডাক, তাড়াতাড়ি আবার এসো। যাবো হিমালয়। পাহাড় ও পাহাড়িদের ছোঁয়ায় মনকে পবিত্র করতে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন