প্রবন্ধ

কিছু সাহিত‍্যিকের স্বভাব ও পরামর্শ

শং ক র  ব্র হ্ম

বেশ কয়েকজন স্বনামধন‍্য সাহিত‍্যিকের অদ্ভুত কিছু স্বভাব ও পরামর্শের গল্প বলব এখানে।

প্রথমেই শুরু করি আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই। তিনি কখনও এক জায়গায় বেশিদিন লিখতে পারতেন না। কখনও শ্যামলী, কখনও উদয়ন, কখনও নৌকায়, কখনও ঝুল-বারান্দায়। শোনা যায়, তিনি নাকি গাছের ওপরও একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেখানে বসে লিখবার জন্য।

গ্রিক সুবক্তা, রাজনীতিবিদ এবং বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ লেখক - ডেমোসথিনিস (৩৮৪ বি সি_৩২২ বি সি)। তিনি ছোটবেলায় ভালো করে কথা বলতে পারতেন না। জিভে জড়তা ছিল। সে কারণে মুখে ছোট ছোট পাথর দিয়ে কথা বলতে বলতে বলাটা খানিকটা ভালো হয় এবং পরে তিনি একজন অসাধারণ বক্তা হন। তার একটি অভ্যাস এমন ছিল, কোনো একটি সিরিয়াস বিষয়ে লিখতে বসার আগে মাথার আধেক চুল কামিয়ে ফেলতেন। তারপর যতদিন সেই আধেক চুল বড় না হতো তিনি লেখা থেকে উঠতেন না এবং বাইরে বের হতেন না।

ভিক্টর হিউগো (১৮০২-১৮৫৫)- 'হাঞ্চব্যাক অফ নোটরডামের' লেখক, লিখতে বসার আগে শরীরের সব কাপড় খুলে তার পরিচারককে বলতেন, এগুলো লুকিয়ে রাখো যতক্ষণ না আমার লেখা শেষ না হয় এগুলো আমাকে দেবে না। যখন খুব শীত লাগল গায়ের চারপাশে একটা কম্বল জড়িয়ে বসে লিখতেন। 'লা মিজারেবল' লেখার সময় তিনি দীর্ঘদিন কাপড় পরেননি। কারণ ভালো কাপড়চোপড় পরলেই তার বাইরে যেতে ইচ্ছা করত, বই লেখা আর শেষ হতো না। কাজেই সেগুলো লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিতেন, এবং লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত, তিনি চাইলেও যাতে না দেওয়া হয় এমন নির্দেশ, কঠোর ভাবে পালন করার কথা পরিচারককে বলা থাকত।

বালজাক (১৭৯৯_১৮৫০) এবং ভলটেয়র(১৬৯৪_১৭৭৮)-  ওরা ছিলেন ভয়ানক কফিখোর। দিনে পঞ্চাশ কাপ কফি না খেলে তারা নাকি লিখতে পারতেন না।এভাবেই বালজাক নাটক, অপেরা, উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। ভলটেয়ারের 'কানদিদাও' এই কফি পানের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে।

টুর্গেনিভ (রাশিয়ান গল্প লেখক ও উপন্যাসিক)- খোলা জানলার দিকে মুখ করে, আর টেবিলের তলায় গরম জলের বালতিতে পা ডুবিয়ে বসে লিখতে পছন্দ করতেন। তিনি মনে করতেন, এই ভাবে বসাটাই লেখকদের পক্ষে ঠিক উপযুক্ত। গরম জলের বালতিটি হচ্ছে প্রেরণা, সৃষ্টির উৎসের প্রতীক, আর খোলা জানলাটি হচ্ছে বাইরের পৃথিবী, যেখান থেকে স্রষ্টা তার সৃষ্টির মালমশলা সংগ্রহ করবেন।

জার্মান কবি শিলার (১৭৫৯_১৮০৫)- তাঁর ছিল ভয়ানক এক অদ্ভুত অভ্যাস। একবার জার্মান কবি গ্যেটে গেছেন তার বাড়িতে, তখন শিলার বাড়িতে ছিলেন না। বসে আছেন শিলারের লেখার ঘরে। হঠাৎ একটা বাজে তীব্র গন্ধে তিনি ভাবতে লাগলেন, এ গন্ধ আসছে কোথায় থেকে। হঠাৎ শিলারের লেখার টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখেন, সেখানে এক ড্রয়ার পচা আপেল। তিনি শিলারের স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বললেন_ আপনি দেখছি আপনার স্বামীর দিকে খেয়াল করেন না। এক ড্রয়ার পচা আপেল ওর ড্রয়ারে। স্ত্রী হেসে বললেন- পচা আপেলের গন্ধ না পেলে শিলার লিখতে পারেন না। গ্যেটে তো অবাক!

মার্ক টোয়াইন (১৮৩৫_১৯১০)- তিনি সবসময় বিছানায় শুয়ে লিখতেন। এ ছাড়া তিনি লিখতে পারতেন না। আমাদের বাংলার লেখক সন্তোষ ঘোষেরও এই একই অভ্যাস ছিল। বুকে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে তিনি লিখতেন।

ব্রিটেনের শিশুসাহিত্যিক মাইকেল মোরপারগো (১৯৪৩_ মৃত্যু জানা নেই) - তাঁর একই অভ্যাস ছিল। বিছানায় বসে পেছনে বালিশের পাহাড় বানিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে লেখেন তিনি। আজকের দিনের লেখক হয়েও তিনি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ব্যবহার করেন না। কলমে লেখেন।

ব্রিটেনের বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক রোয়াল্ড ডাল (১৯১৬- ১৯৯০)- তিনি লেখেন বাগানের শেডে একটি সোফায় বসেন। কোলের ওপর বোর্ড রাখেন। সেই বোর্ডের ওপর কাগজ রেখে মোটা কলমে লেখেন। পাতাটা শেষ হলেই নিচে ফেলে দেন। এভাবে পাতার পর পাতা বড় বড় অক্ষরে লেখেন। সেই শেডে কেউ যেতে পারেন না, তার সঙ্গে কথা বলতে বা ডাকতে পারেন না। সেখানে চা-কফির ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজন হলে সেই চা-কফি তিনি একাই বানিয়ে নিতেন ।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯_১৯৬১)- তিনি লিখতেন সবসময় দাঁড়িয়ে। দাঁড়াতেন একটা টাইপ রাইটারের সামনে। বুক বরাবর উঁচু একটি টাইপরাইটার ছিল তার। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখতেন। এভাবেই তার অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন এবং লিখে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।

আলেক্সজান্ডার ডুমাস (১৮০২_১৮৭৯)- ইনি লেখেন বিভিন্ন রঙের কলম দিয়ে। নীল রঙ দিয়ে যখন লেখেন সেটা হলো উপন্যাস বা গল্প, গোলাপি রঙের কলমে বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং হলুদ কলমে নানা রকম কবিতা। এভাবেই তিনি লিখেছেন 'দি থ্রি মাসকেটিয়ার্স', 'দি কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো' নামের বিখ্যাত বইগুলো।

ডান ব্রাউন (১৯৬৪)- তিনি লেখেন বাড়ির ছাদঘরে। যাকে ইংরেজিতে বলে লফ্ট। সেখানে এক ঘণ্টা পর পর বাজে এমন একটা ঘড়ি আছে, যা তাকে বলে দেয় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। তখন তিনি ওঠেন, শরীর টানটান করেন। সিট আপ এবং পুশ আপস করেন। এরপর ছাদে দুই পা দিয়ে উল্টো হয়ে নিচে ঝোলেন। এতে নাকি শরীরের রক্ত চলাচল ভালো হয়। ছাদ থেকে ঝুলবার জন্য তিনি দুই পায়ে স্পেশাল বুট পরেন, যা দিয়ে তার পা ছাদে আটকে থাকে। তারপর আবার লিখতে শুরু করেন। 'দ্য ভিনচি কোড' এবং আর সব বই এভাবেই লিখেছেন। 'দেয়ার আর সো মেনি থিংগস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরেশিও'।

হারুকি মুরাকামির (১৯৪৯)- তাঁর লেখার গল্প অনেকটা ডান ব্রাউনের মতো। তিনিও ভোর চারটায় ওঠেন। যখন কোনো বড় উপন্যাস লেখেন তখন এই ভোর চারটাতে ওঠা তার নিয়ম। পাঁচ-ছয় ঘণ্টা একটানা লেখেন। এরপর বিকেলে দশ কিলোমিটার দৌড়ান এবং অনেকক্ষণ সাঁতার কাটেন। এরপর ধ্যানমগ্ন হন। যাকে তিনি বলেন, - আমি নিজে নিজেকে সম্মোহিত করি এবং একেবারে অন্তরের গভীরে প্রবেশ করি। লেখার জন্য আমার এ আত্মমগ্নতা প্রয়োজন।

মায়া অ্যাঞ্জেলো (১৯২৪_২০১৪ সাল)- তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বাইরে চলে যান। যান একটি হোটেলের ছোট ঘরে। যান সকাল সাতটায়। সাতটা থেকে বেলা দু'টো পর্যন্ত একটানা লেখেন। যাওয়ার সময় সঙ্গে নেন একটি বাইবেল, একটা প্যাকেট তাস (মাঝে মধ্যে পেশেন্স বা সলিটেয়ার খেলেন) আর এক বোতল শেরি। এই নেন তার লেখার সময়। এভাবেই তিনি মুঠো মুঠো লেখার জন্ম দেন। তার একটি বিখ্যাত কোটেশনের সঙ্গে আমি এক মত 'সবচেয়ে যন্ত্রণাময় সময় সেটি, যখন ভেতরে একটা অজাত গল্প ছটফট করতে থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেই গল্পকে লেখায় আকার দেওয়া না যায়।'

জেন অস্টেন (১৭৭৫_১৮১৭ সাল)- তিনি একটি কাগজে নানা সব শব্দ লেখেন। যা তার মনে আসে তাই। যেমন ডার্সি। বারবার লেখেন ডার্সি ডার্সি ডার্সি। একসময় ওই ডার্সি একটা মানুষের রূপ নেয় এবং সে হয়ে যায় 'প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের' নায়ক। কেবল যে মানুষের নাম লেখেন তা নয়। লেখেন আরও নানা শব্দ। তারপর সেসব শব্দ থেকে তৈরি হয় বাক্য। এরপর হয়ে যায় বই।

আগাথা ক্রিস্টি (১৮৭৬_১৯৭৬)- তাঁর লেখার টেবিলের দুই পাশে বইয়ের দেয়াল করেন। একটি বইয়ের ওপরে আর একটি বই। এরপর লেখেন ওই দুই বইয়ের দেয়ালের মাঝখানে। কখনও স্নান করতে করতেও নোট দেন সেক্রেটারিকে। আবার খেতে খেতেও একই কাজ করেন। 

চার্লস ডিকেন্স (১৮১২_১৯৭৬)- তিনি প্রতিদিন দশ মাইল হাঁটতেন। হাঁটতে গিয়ে ইচ্ছা করেই হারিয়ে যেতেন। যখন হারিয়ে যান তখন নাকি তার লেখার 'স্পার্ক' চলে আসত। এরপর যখন বাড়িতে ফিরে আসতেন। লিখতে বসে যেতেন। অসংখ্য বই তিনি এই 'স্পার্ক' থেকে সৃষ্টি করেছেন। আবার লিখতে লিখতে কখনও সে লেখা নিজের কানকে শোনাতেন। নিজের কাছে ভালো না লাগলে ছিঁড়ে ফেলতেন। তারপর আবার লিখতে বসতেন।

কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ (১৭৭০_১৮৫০)- তিনি একটা কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরোন। জোরে জোরে আবৃত্তি করেন তার কবিতাগুলো। যখন কুকুর চুপ করে সে কবিতা শোনে তিনি বুঝতে পারেন, তার কবিতা ঠিক হয়েছে। যখন কুকুর খুব ঘেউ ঘেউ করে তিনি বুঝতে পারেন, কবিতা কুকুরের পছন্দ হয়নি। বাড়িতে এসে সেই কবিতাকে বদলান। আবার নতুন করে লেখেন। 

জন স্টেইনবেক (১৯০২_১৯৬৮)- সব লেখা লেখেন পেন্সিলে। 'গ্রেপস অফ রথ' নামের বিখ্যাত উপন্যাসটি লিখতে তার ক্ষয় হয়েছিল প্রায় তিনশোটি মোটাসোটা বড় পেন্সিল। তার 'ইস্ট অফ ইডেন' লিখতেও ক্ষয় হয়েছিল ওই পরিমাণ পেন্সিল। 

ব্রন্টি বোনেরা(১৮১৬_১৮৫৫ সাল) , শার্লোট (১৮১৮_১৮৪৮ সাল), এমিলি ও অ্যান (১৮২০_১৮৪৯)- একটা বড় ফায়ার প্লেসের সামনে বসে তিন বোন একটা টেবিলে লিখতেন। শার্লোটের চারখানা, এমিলির একটি বড় উপন্যাস, অ্যানের তিনখানা উপন্যাস সেই টেবিলে বসে লেখা।

শিশুসাহিত্যিক এনিড ব্লাইটন (১৮৯৭_১৯৬৭)- তিনি সকালে লিখতে বসেন, সঙ্গে থাকে তার লাল রঙের একখানা মরোক্কান শাল। এই রঙ নাকি তাকে লেখায় উদ্দীপ্ত করে। একটা টাইপরাইটারে লিখে যান একটানা। দুপুরে খেয়ে আবার লেখেন। দিনে তিনি ছয় হাজার শব্দ লিখতে পারতেন। একবার কেউ কেউ বলেছিল, তার নাকি কিছু 'ঘোস্ট রাইটার' ( ভূত লেখক) আছে, যারা তাকে লিখে দেন। তিনি এই সব নিন্দুকদের নামে কেস করেন এবং জিতে যান।

শীর্ষ দশজন লেখকের দশটি পরামর্শ

লেখক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় খাতা কলম নিয়ে চা-কফি গলায় ঢেলে একটার পর একটা সিগারেট-গাঁজা ফুঁকে যুতসই একটা শব্দ লিখতে না পেরে বসে বসে মাথার চুল ছেঁড়েন, এমন লোকের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। পৃথিবীর অনেক দেশে রয়েছে কবিতা লেখার কোর্স। এমনকি বিশ্বের অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়েও নানা ধরনের কোর্স চালু আছে সাহিত্যিক হওয়ার জন্য। খোদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত একবার কবিতা লেখার এমন এক কোর্স চালু করেছিলেন 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার তরফ থেকে। টিপসগুলো তবে বলেই ফেলি। এসব টিপসগুলি, বিখ্যাত সব লেখকরা অনুসরণ করে ভাল ফল পেয়েছেন, আপনি যে পাবেন না, এমন কথা কোথাও বলা হয়নি। তবে আর দেরি না করে, দেখে নিই বিখ্যাত সব লেখকদের লেখার পিছনের অদ্ভুত সব কীর্তি-কাণ্ড! 

১) বিশ্ব বিখ্যাত রুশ লেখক 'লিও টলস্টয়'-এর মতে, ‌'আমি সব সময় সকালে লিখি। পরে আমি জেনে খুশি হয়েছি যে, রুশোও ঠিক একই কাজ করতেন।' সকালে সাধারণত যে কারও মন মেজাজই ঝরঝরে থাকে। সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভাবনাটা বেশিরভাগ সময় সকালেই আসে।

২) নিউজিল্যান্ডে বড় হওয়া ইংরেজি ভাষার ছোটগল্পের লেখিকা 'ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড'-এর মতে, 'অতীতে তাকিয়ে আমি ভাবি, আমি সবসময় লিখছি। যদিও অর্থহীন কথাবার্তা, কিন্তু কিছু না লেখার থেকে অর্থহীন কথাবার্তা লেখাও অনেক ভাল।

৩) নোবেল ও পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত আমেরিকান লেখক 'উইলিয়াম ফকনার'-এর মতে - 'কি বলেছেন, কি লিখেছেন নিজেই তা পড়ুন, পড়ুন, পড়ুন। এবং সবকিছু পড়ুন- বাজে, ধ্রুপদী, ভালো, মন্দ, এবং কীভাবে লেখা হয়েছে তা দেখুন। ঠিক একজন ছুতোরের মতো, যে শিক্ষানবিশের কাজ করে, এবং গুরুর কাজকে অধ্যয়ন করে। পড়ুন! তবেই আপনি অনুধাবন করবেন। তারপর লিখুন। লেখা ভালো হলে আপনি নিজেই বুঝবেন। আর না হলে, নির্দ্বিধায় ডাস্টবিনে ফেলে দিন।'

৪) ম্যান-বুকার পুরস্কার বিজয়ী ইংরেজ লেখিকা 'হিলারি ম্যানটেল'-এর মতে, 'লেখকের জন্য সবচেয়ে উপকারী স্বভাব হচ্ছে আত্মপ্রত্যয় তথা আত্মতুষ্টি লালন করা, যদি তা সামাল দিতে পারেন। আপনি নিজেকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চান, এবং সেজন্য আপনার কাজ সম্পর্কে আপনারই আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে, এমনকি যখন কেউই আপনার সাথে একমত হবে না তখনও।'

৫) 'হেমিংওয়ে'-র পরামর্শ শুনতে একটু অদ্ভুত ঠেকতে পারে, কিন্তু কি আর করা যাবে, এমন একজন লেখকের কথা তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। তিনি বলেছেন, 'গল্পটা ভাল মতো তরতর করে এগোতে থাকলে লেখা থামান এবং এ নিয়ে পরের দিন লেখা শুরুর আগে ভাববেন না। এতে আপনার অবচেতন মন সব সময় লেখাটি নিয়ে ভাববে। কিন্তু আপনি যদি সচেতনভাবে লেখাটি নিয়ে ভাবেন, অথবা দুঃশ্চিন্তা করেন, তবে ওটা মরে যাবে, এবং লেখার আগেই আপনার মাথা ক্লান্ত হয়ে পড়বে।'

৬) একজন চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালককে ধরা যাক। আমেরিকার লেখিকা 'মিরান্ডা জুলাই'-এর মতে, 'প্রথম উপন্যাস লেখার সময় নিজেকে সবচেয়ে বাজে লেখক মনে হত। তখন মনে হয়নি, আমি প্রথম খসড়া লিখছি। কিন্তু প্রথম খসড়া লেখার পর মনে হতো বাকি সবকিছু তুলনামূলকভাবে সহজ কাজ।'

৭) ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্প লেখিকা 'জাডি স্মিথ'-এর মতে, 'ইন্টারনেট সংযোগ নেই, এমন কম্পিউটারে বসে আপনাকে লিখতে হবে। যে গল্প আপনি কখনও শেষ করতে পারবেন না, তা বাদ দিন। বরং চার'শো পাতা নিন এবং প্রতিদিন একপাতা করে লিখুন।'

৮)লেখক হওয়ার পরামর্শ দিতে গিয়ে অনুরূপ কথাই (লেখিকা জাডি স্মিথের কথাগুলি) বলেছিলেন নোবেল ও পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী আমেরিকান সাহিত্যিক 'জন স্টেইনব্যাক'।

৯) বিশ-শতকের একজন সেরা আমেরিকান লেখক 'এফ স্কট ফিটজেরাল্ড', যার লেখনিতে জ্যাজ সংগীতের শুরুর দিককার আমেজ পাওয়া যায়। তার মতে,- 'লিখতে হলে, এটা খুবই পরিস্কার বিষয় যে, বড় কিছু বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে কোন রকম উত্তেজক পানীয় কিংবা মদ পানকরা অবস্থায় লেখা চলবে না। তাতে ছোটগল্প হয়তো লেখা গেলেও, উপন্যাসের জন্য আপনাকে নিরন্তর মাথা খাটাতে হবে এবং এ'জন্য অবশ্যই ত্যাগ স্বীকার করতে হবে (সমরেশ বসুও এটা মনে করতেন)।

১০) হেমিংওয়ের পরামর্শ যদি অদ্ভুত লেগে থাকে তবে 'মুরিয়েল স্পার্কে-এর কথায় আপনি হয়তো ভিরমি খাবেন, কিংবা কিঞ্চিত বিস্মিতও হতে  পারেন। স্কটিশ ঔপন্যাসিক, ছোট গল্প লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক মুরিয়েলের মতে লেখক হতে হলে নাকি বিড়াল পুষতে হবে। আর তাতেই নাকি কলম দিয়ে ঝরঝর করে লেখা বেরোতে থাকবে। 'লিখতে হলে বিড়াল পুষতে হবে। একটি ঘরে বিড়ালের সাথে একা… বিড়ালটি লেখার টেবিলে উঠে টেবিলে রাখা বাতির নিচে বসবে। বাতির আলো বিড়ালকে বেশ তুষ্ট করে। বিড়াল তখন প্রশান্ত হবে, এ প্রশান্তি দেবে অনুধাবন ক্ষমতা। বিড়ালের এ প্রশান্তি আপনাকে ধীরে ধীরে আবেশিত করবে, আপনি ফিরে পাবেন আত্ননিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। আপনাকে শুধু সব সময় বিড়ালটির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। মনোযোগের উপর বিড়ালের প্রভাব চমকপ্রদ, এবং রহস্যময়।'

ভাবতে পারেন 'মুরিয়েল স্পার্ক-এর কথা?





এ ভরা ভাদর

ত প ন  পা ত্র

সাহিত্য-শিল্পের প্রধানতম বিষয়টি যে প্রেম একথা রসিকজন মাত্রই স্বীকার করবেন। বিদগ্ধজনেরাও বিপক্ষে যাবেন না। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, বলা যায় সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের ভান্ডারটি বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য। রাধা-কৃষ্ণের সরস প্রেমলীলা তথা শ্রীরাধার প্রেমের ক্রমবিকাশ যে শুধুমাত্র স্বর্গীয় নয়, কল্পরাজ্য বৈকুন্ঠের সম্পত্তি নয়, এই মর্ত্যের তরুণ তরুণীর, মানব মানবীর প্রণয় লীলা এ কথা আমরা প্রায় সকলেই স্বীকার করি। মানবপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথও বৈষ্ণব কবিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুলেছিলেন --
     "সত্য করে কহ মোরে, হে বৈষ্ণব কবি,
      কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমছবি,
      কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
       বিরহ-তাপিত? হেরি কাহার নয়ান,
      রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে?
      বিজন বসন্তরাতে মিলন-শয়নে
      কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,
        আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
       রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা,
        রাধিকার চিত্ত-দীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা,
         চুরি করি’ লইয়াছ কার মুখ, কার
          আঁখি হ’তে ?"

আসলে প্রকৃত প্রেম যেখানে, সেখানে মানব ও দেবতার মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। তাই তো ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
   "দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি, আকাশে প্রদীপ জ্বালি, 
আমাদের এই কুটিরে দেখেছি মানুষের ঠাকুরালি।"
  সে কারণেই --
                       "আমাদেরি কুটীর-কাননে
           ফুটে পুষ্প, কেহ দেয় দেবতা-চরণে,
           কেহ রাখে প্রিয়জন তরে—তাহে তাঁর
            নাহি অসন্তোষ! এই প্রেম-গীতি-হার
            গাঁথা হয় নর-নারী-মিলন-মেলায়
             কেহ দেয় তাঁরে, কেহ বঁধুর গলায়!
             দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
             প্রিয়জনে—প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই
              তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
             দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা!"

সে যাই হোক মানবখেলা অথবা ভগবৎ লীলা যেখানে প্রেম, সেখানেই বিরহ। বিরহ প্রেমের একটি মহামূল্যবান অঙ্গ। বর্ষায় সেই বিরহ বহুগুনিত হয়। বৈষ্ণব কবি  ভাদ্র মাসের ভরা বাদল দিনে বিরহিনী রাধিকার চিত্তবিদীর্ণ তীব্র হাহাকারের কথা লিখেছেন --
                "এ সখী হামারি দুখের নাহি ওর।
   এ ভরা বাদর                            মাহ ভাদর
                       শূন্য মন্দির মোর।।"

সখিরে আমার দুঃখের সীমা পরিসীমা নেই। এই ভাদ্র মাসের ভরা বাদল দিনে আমার গৃহ শূন্য। কারণ আমার কান্ত প্রবাসী। মানভূমের ঝুমুরেও প্রায় একই অন্তর্দহনের কথা রয়েছে --
             "ঝিঙা ফুল সারি সারি 
              বঁধু বিনে রঁইতে লারি,
              সহচরী দিবা নিশি ঐ ভাবনায় ঝু'রে মরি।"

আর একটি গানে ঝুমুর কবি বলছেন--
             "এমন কে জানে
              বঁধু গে'লে ভা'বতে হয় মনে,
             ভাদর আদর মাইরি গেল অকারণে।"

এরকম সাহিত্যের আরো অন্যান্য শাখাতেও ভাদ্র মাসের যন্ত্রণাদায়ী পরিবেশ পরিস্থিতির কথা শুনতে পাই। মানভূম-পুরুলিয়ায় অন্য ধরনের হাহাকার বিজড়িত প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে "ভাদর মাসে রাজার ভান্ডারও খালি"। ভাদর মাস কোন কোন বছর ৩২ দিনের হয়। তাই লোকে বলে, "সমান ভাদরের ভাত নাই, আরঅ দুদিন বা'ড়তা।" কিন্তু এই বিরহ বেদনা এই অন্নের হাহাকারের মধ্যেই ভাদর শেষ নয়। এখানে অনেক কিছু নাই এর মাঝেও ভাদর যেন আনন্দের মাস, প্রত্যাশার মাস, স্বপ্ন পূরণের মাস না হলেও স্বপ্নদর্শনের মাস। এই সময় আউশ ধান কাটা হয়, তা বড়ই স্বল্প; প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। গোড়া ধানের মাড়ভাত খেয়ে মানভূমের নবান্ন উৎসব পালিত হয়। অপরদিকে আমনের চাষবাস চুকিয়ে অঘ্রাণ পৌষের দিকে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো তাকিয়ে থাকা।
                       মানভূম-পুরুলিয়ায় ভাদ্র মাসটির গুরুত্ব অপরিসীম। বহু পূজা-পার্বণ উৎসব অনুষ্ঠান আর চতুর্দিকে সবুজের সমারোহে মাসটি ভরা নদীর মতোই উচ্ছল, চঞ্চল, গতি তরঙ্গময়। করম, জাওয়া, ইঁদ, ছাতা, এবং জিতা, গোয়াল পূজা, তিথিতে তিথিতে মনসা পূজা ইত্যাদি উৎসবের গন্ধে উঁচা নিচা বন-ডুংরী, জঙ্গল, নদী-নালা গ্রাম-গঞ্জ ঢেকে থাকে। কুমারী, কাঁসাই, অজয়, শিলাই সুবর্ণরেখার হাড় জিরজিরে শরীরে ষোড়শী যুবতীর মত ভরা যৌবন।

নানা দিক থেকে ভাদ্র মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রেম বিরহের পাশাপাশি এতদঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক জীবনযাপনের ছবিও ফুটে উঠেছে সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গে প্রত্যঙ্গে। মূলত কৃষিভিত্তিক সভ্যতার মানুষ সমস্ত কিছুর মধ্যেই উৎপাদনের প্রার্থনা আরাধনা করে থাকেন। ভাদু, করম জাওয়া, জিতা-এই চারটি লোক উৎসবের মূল সুর প্রজনন শক্তি ও উৎপাদনের জন্য লৌকিক ব্রত উদ্ যাপন। ইঁদ, ছাতা রাজা তথা জমিদারদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রদর্শনের উৎসব। অন্যান্য উৎসবের সঙ্গে এই উৎসব দু'টির বা প্রায় একই উৎসবের দু'টি অঙ্গের একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য উৎসবগুলি একেবারে কৃষক ও কৃষিশ্রমিক সাধারণ জনগণের উৎসব কিন্তু ইঁদ ও ছাতা অভিজাত জমিদার সম্প্রদায়ের উৎসব।

ভাদ্র মাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব করম। এই পরব শস্যবৃদ্ধি কামনার পরব। উর্বরতাবাদের পরব। পরবটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কুমারী যুবতীদের জাওয়া পরব। করমে পাশাপাশি দু'টি করম ডাল প্রোথিত করে পুজো অর্চনা। এ যেন রাজা ও রাণীর বিবাহ অনুষ্ঠান। করম রাজাকে সূর্য দেবতা এবং করম রাণীকে ভূ অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়।

এখানে ইঁদ পরবের ১২ দিন পর জিতাষ্টমির ব্রত উদ্ যাপিত হয় বা জিতুয়া পরবের অনুষ্ঠান হয়। জিতাষ্টমীর ব্রত অনেকাংশে করম-জাওয়ার মতোই। করমে করম ডাল আর জিতাতে আঁখ দাঁড়ি এবং ডুমুর গাছের ডাল প্রোথিত করে পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও থাকে বট গাছের ডাল। গাছের ডালে শালুক ফুল। পূজার উপকরণ এবং পদ্ধতির মধ্যেও অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। পার্থক্য এটাই যে সামাজিক দৃষ্টিতে উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যে করম জাওয়ার প্রচলন নেই কিন্তু জিতার প্রচলন রয়েছে।

ভাদ্র মাসের আরেকটি প্রাণবন্ত উৎসব ভাদু পূজা। ভাদু পূজাতেও কুমারী মেয়ে এবং সধবা মেয়েদের আধিপত্য। এই ভাদুব্রত বা ভাদু উৎসব সারা ভাদ্র মাস জুড়ে চলতে থাকে। এটি করম যাওয়া বা জিতার মতো সরাসরি কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে হয় না। তবে প্রচ্ছন্নভাবে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে যেহেতু যুবতী কুমারীদের মধ্যে উর্বরতার বিষয়টি প্রকট এবং তারাই এই ব্রত উদযাপন করে থাকেন এবং কৃষি উৎপাদনের মরসুম ভাদ্র মাস জুড়ে এই উৎসব উদযাপিত হয় সুতরাং এই ব্রত বা উৎসবের সাথেও কৃষি উৎপাদনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত মেলে।

লোকসাহিত্যের সঙ্গে ভাদ্র মাসটির যোগ যে কতো নিবিড় তা বোঝা যায় এখানে প্রচলিত ঝুমুর গানের একটি সুর "ভাদরিয়া সুর" নামে পরিচিত, এক বিশেষ শ্রেণীর ঝুমুর গান "ভাদরিয়া ঝুমুর" নামে নামাঙ্কিত। সাধারণভাবে কেউ কেউ বলেন ভাদ্র মাসে অনুষ্ঠিত লোক উৎসবগুলিতে যে ঝুমুরগানগুলি গীত হয়, সেগুলিকে  বলে ভাদরিয়া ঝুমুর। যুক্তিটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর পাঁচটা ঝুমুর গানের সঙ্গে ভাদরিয়া ঝুমুরের বিষয় ভাবনাটিতে হয়তো আকাশ পাতাল প্রভেদ নেই, কিন্তু অন্যান্য ঝুমুরের সঙ্গে ভাদরিয়া ঝুমুরের গঠনগত ও রচনার কারুকর্মগত, বিশেষ করে সুরের দিক থেকে একটা প্রভেদ অবশ্যই আছে। এই শ্রেণীর ঝুমুর অন্যান্য ঝুমুরের তুলনায় আকৃতিগত দিক থেকে ক্ষুদ্র এবং সুর লয়ের দিক থেকে দ্রুত। তবে অন্যান্য ঝুমুরের মতো এখানেও রাধা-কৃষ্ণ প্রেম কথা এসেছে, এসেছে আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের ঘর কন্যার কথা।

আগেই বলেছি ভাদর বিরহের মাস। পদাবলীর রাধিকার মতো পুরু'লা-বৃন্দাবনের প্রেমোন্মাদিনী বিরহিনী নায়িকা বলছেন -
     "কোকিলার ডাক শুনি নিজে মনে ভাবি গুণি,
      আমার কলপি কলপি উঠে ছাতিরে।।
       ওরে পাখি কেনে ডাক, নিশি ভোর রাতি।
       দিবানিশি কেঁদে মরি, না আসিল বংশীধারী,
       আমার ঝর ঝর ঝরে দু'টি আঁখিরে।।
       নিশি হল অবসান, না আসিল বাঁকা শ্যাম,
          শ্যাম আমায় দিয়ে গেল ফাঁকিরে।।"

     শুনতে পাচ্ছি পদাবলীর চরণ--- 
             "মত্ত দাদুরি,         ডাকে ডাহুকী, 
                     ফাটি তাওতো ছাতিয়া"।
               চির দিগ ভরি।          ঘোর যামিনী
                       অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
              বিদ্যাপতি কহ      কৈছে গোঁয়াঅবি
                     হরি  বিনে দিন রাতিয়া।।"

কবি ভরত কিশোরের একটি ঝুমুরের কলি ---
           "ঘন ঘটা রাতিয়া চমকে বিজলিয়া ,
            থাকি থাকি জলে বিরহ আগুনিয়া।
            কোথা আছো প্রিয়তম দেখ ন আসিয়া,
            তব আদর্শনে আছি মরমে মরিয়া।।"

এ তো গেল নর-নারীর চিরন্তন শাশ্বত প্রেম বিরহের কথা। কিন্তু অন্ন বস্ত্র বাসস্থান তো যে কোন মানুষেরই জীবন যাপনের প্রাথমিক শর্ত। এই অঞ্চলে যে মৃত্তিকা তার গঠন প্রকৃতি এবং জলবায়ু তাতে এহেন প্রবাদের জন্ম হয় যে,"চাষ নাই বাস, টুরুই ব্যাঙের আঁশ"। ইতিপূর্বে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আকাশের প্রসন্ন দাক্ষিণ্য মেলেনি। কালো মেঘ কৃপণ হয়ে উঠেছিল।
 একটি ঝুমুরে কবি বলছেন,
                  "আষাঢ় শ্রাবণ মাসে নবীন মেঘে ঘেরোলি
                   ওহো রে পানিক বুঁদা না বরিষে,
                   ও প্রাণ দিন ধরিব কেইসে।"

আবার যদি কোন বছর নামিবর্ষা হয়, অর্থাৎ বর্ষার আগমন ঘটে বিলম্বে, তখন হঠাৎ বৃষ্টিতে একসঙ্গে সকলের চাষ লেগে যায়। কৃষক কামিন মুনিশ খুঁজতে গেলে পায় না।
             "শরাবন ভাদর মাসে
              চাষী বুলে ঘরে ঘরে,
               কামের মাসে।
               কত ছল করে গো কামিন মুনিসে
               বড় 'রীত ভাদর মাসে।"
         শ্রাবণ-ভাদর মাসে চাষবাসের পর মানভূমবাসীর পরিবারে পরিবারে অন্যের হাহাকার। সে সময় মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির একটি বড়ো মাধ্যম জনহা'র অর্থাৎ ভুট্টা। পুড়িয়ে, সিজিয়ে, পাকা জনহা'র শুকনো করে খই ভেজে অথবা ছাতু বানিয়ে  মানুষ ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটায়। বাড়িতে অতিথি এলেও তখন জনহা'র পোড়া দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। প্রতিবেশীদেরও খাওয়ানো হয়। না খাওয়ালে অভিমান হয়। অভিমান ধরা দিয়েছে গান হয়ে --
                    " এত বড় ভাদর মাসে
                       পথে চ'লে  যাই হে ,
                       কেউ না শুধা'ল মুখে
                     জনা'র পড়া খাও হে।"

মানভূমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লোকনৃত্য কাঁঠি নাচ। এই নাচের গানেও এসেছে ভাদ্র মাসের কথা।
         "ও ভাদরের ভরা নদী     
          ছে'লা নাই মোর ঘরে গো 
          আর আশ্বিনে অম্বিকা পূজা 
            আমরা সবাই করি গো।"

আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজাতে মন্ডপে মন্ডপে গ্রামে গ্রামে কাঠি নাচের দল নিত্য পরিবেশন করে ঘুরে বেড়ায়। সেই নৃত্যের আখড়া বা অনুশীলনটি শুরু হয়ে যায় ভাদ্র মাসেই। তাই ভাদ্র শুধু বিরহের মাস আর মনস্তাপের মাস নয়, মানভূম-পুরুলিয়ার দৈনন্দিন জীবনে ভাদ্র ভাদরের যৌবনবতী ভরা নদীর মতোই প্রাণবন্ত টইটুম্বুর, ভাদর প্রত্যাশার মাস, প্রস্তুতির মাস, স্বপ্নযাপনের মাস।





নতুন এবং অভিনব

গী ত শ্রী  সি ন হা 

পুরাকালে এক পূর্নিমা রাতে কৈলাশ শিখরে শিব আর পার্বতী বসেছিলেন। যুগলে বসে আলাপ করছেন। আলাপের মাস তো বসন্ত, তাই বসন্ত সমীরণে পার্বতী আস্তে আস্তে শিবের কোলে মাথা রাখলেন। এতোক্ষণে হয়তো পার্বতীর চোখে ষোলকলার চাঁদ দৃষ্ট হয়নি। চারিদিকের গিরিশৃঙ্গগুলো চাঁদের আলোয় মোহময় হয়ে উঠেছিল। পার্বতী মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গগুলো চন্দ্রমায় ভাসছে। যেন একে অপরকে ধাক্কা মারছে, সদ্য যুবতীদের মতো খিল খিল করে হাসছে। চারিদিকের হাসির আওয়াজে চন্দ্র নিজেও লজ্জা পাচ্ছেন। তাই বুঝি মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে চলে যাওয়া! পার্বতীর তো বেশ মজা লাগছিল। 
মাঝে মাঝেই বলছিলেন, 'চাঁদের লজ্জাটা দেখো।' শিব পার্বতীর কথায় মৃদুমন্দ হাসছিলেন। 
প্রতি বসন্তের পূর্নিমায় একই দৃশ্য, চন্দ্রমার সেই মায়াবী খেলা পার্বতীর কাছে আর নতুন থাকে না। কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে যায়। একঘেয়ে বলতেও আপত্তি নেই পার্বতীর। সন্ধ্যা নামতেই বুঝতে পারেন পার্বতী, চন্দ্রের যাত্রাপথ এবং গিরিশৃঙ্গের লুকোচুরি খেলা। ভালো লাগছিল না তাই তিনি শিবকে বললেন, 'একটা গল্প বলো'।
শিব ভাবলেন, পার্বতী হয়তো চন্দ্রের জীবনকাহিনী শুনতে চায়। তাই তিনি বলতে শুরু করলেন 'চাঁদের বাবার নাম ছিল... ' 
পার্বতী শিবের মুখটা চেপে ধরে বলেন, 'না না চন্দ্রের গল্প নয়, অন্য গল্প।'
শিব অবাক হন, 'অন্য গল্প মানে?'
পার্বতী সময় নষ্ট না করে উত্তর দিলেন, 'নতুন এবং অভিনব।'

(২) 

আগামী পৃথিবীর গল্প যদি বাঙলা ভাষায় ভাবতে হয়, তাহলে হয়তো এরকম হবে, গল্পের নাম, 'আমি আর সীমা। 'তার নীচে লেখকের নাম। তারপর পুরো পাতাটাই সাদা থাকবে। কোন কোন লেখক দু'এক লাইন ক্লু দেবেন। পাঠক নিজের মতো করে গল্প লিখে নিতে পারবেন। পাঠক নিজের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গল্প বানাবেন। কেউ নায়ক হিসেবে শ্রীকান্তকে নিতে পারেন, কেউ গ্রগর সামসাকে নিতে পারেন, কেউবা হিজিবিজিবিজকেও চাইতে পারেন। যে যে-রকম চাইবেন, তিনি সেই রকম গল্প তৈরি করে নিতে পারতেন। এতে দুটো কাজ হবে। লেখক বা গল্পকার ক্লু দিয়ে দেওয়ায় তার গল্প যে-রকম হতে পারতো সে-রকম না হয়ে পাঠকের হাতে অন্যরকম হবে।একই চিন্তা থেকে দুটো চিন্তা প্রবাহ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। অর্থাৎ পাঠক গল্পকারের সৃজন শক্তির সাহায্য নিয়ে কথাকার হয়ে উঠছেন। এর প্রথম এবং প্রধান কারণ আমাদের ছেলেমেয়েদেরা মাতৃভাষা বাংলা শিখছে না। তাদের বর্তমান পরিস্থিতি মাতৃভাষা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। মাতৃভাষায় চিন্তা করার ইচ্ছে বা ক্ষমতা তাদের থাকবে না। তা-ই গল্পের বদলে সুত্র নয়, ক্লু দিতে হবে। তারা নিজের মতো করে গল্প নির্মাণ করে পাঠ করবে। প্রাসঙ্গিক ভাবে সাম্প্রতিক ঘটনা বলি, না বললে যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! জন্মদিনের অনুষ্ঠান, নাচ গান খাওয়াদাওয়া প্রচুর প্রাচুর্যের প্রেক্ষাপটে উপহার স্বরূপ বাচ্চাদের বিভিন্ন গল্পের বই, ছড়ার বই, ভৌতিক গল্পের প্লট নিয়ে মজাদার বই, সাথে খ্যাতিমান লেখকদের বই তো আছেই...  দেওয়া হলে... বাচ্চারা সমবেত ভাবে বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে বলল, বেঙ্গলি দিলে?  ইংলিশ নেই?
এর কোনো উত্তর ছিলো না!

( ৩ )

ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন জানিয়েছেন, 'পুস্তক প্রকাশের প্রথম দিকে বটতলার খুব নামডাক ছিল। সেইসময় বিক্রেতারা বৈশাখ মাসে বড় বড় বোঁচকা বেঁধে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তেন। এঁরা গ্রামে গল্প বা কারও বাড়িতে পুস্তক পড়ে শোনাতেন। নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিত লোকেরা পুস্তক পাঠ করতে না পারলেও পুস্তকের বিষয় বা কাহিনী জানতে পারতেন। তাতে তাদের কোনো অসুবিধা হতো না। 'পুস্তক পাঠের জন্য পাঠকরা কোনো পারিশ্রমিক পেতেন কিনা অবশ্য জানা যায় না। তবে হ্যাঁ, পুস্তক বিক্রেতারা গল্প, উপন্যাস, রামায়ণ, মহাভারত, পাঁচালি সব কিছু পড়ে শোনাতেন। তাতে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ হতো নিশ্চিত। না হলে এ পেশায় থাকবে কেন!
আধুনিক সময়ে লেখকরা তাঁর লেখা বিক্রি হবে অথবা নতুন পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হবে এই চিন্তায় বিভিন্ন শহরে যান। সেই শহরে বিশেষ বিশেষ জায়গায় নিজের প্রকাশিতব্য বা সদ্য প্রকাশিত বই পড়ে শোনান। কোথাও কোথাও বিশিষ্ট বাচিক শিল্পীরা পাঠে অংশগ্রহণ করেন।পাঠ আরও আকর্ষণীয় হয়। যারা এইসব অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হন, তাঁরা মন দিয়ে শোনেন, প্রশ্ন করেন, লেখক উত্তর দেন। 
আগামী দিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গল্প পড়ে শোনাতে হবে। পাঠকেরা গল্প এবং লেখক দু'জনের সঙ্গেই পরিচিত হবেন। ঘরোয়া আসরে আয়েস করে গল্প শুনবেন। তারপর গল্প বিষয়ক প্রশ্ন করতে চাইবেন। 

( ৪ ) 

ইদানিং অণু গল্পের চল বেড়েছে। গল্পের আঙ্গিকে অণুগল্প নয়। গল্পের আকৃতি অণু পরিমাণ হচ্ছে। সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ গল্প লিখতে হবে। লেখকেরা তো পিছিয়ে নেই। তিনি যতটুকু জায়গা পাবেন তার মধ্যেই গল্প লিখবেন। লেখক প্রতিনিয়ত তাঁর কথা বলার জন্য প্রস্তুত। স্থানটা তার কাছে বড় কথা নয়। পরমাণু গল্প লিখতে হয় আরও ছোট, সেখানেও লেখকরা সফল!
তিনশো শব্দের বদলে তিন লাইন বরাদ্দ হবে। লেখক লিখবেন---
'আমি আর বিতান বসে আছি। 
অপেক্ষায়। 
সুখ এখনও আসেনি। 


( ৫ ) 

আগামী পৃথিবীর গল্প হবে নতুন এবং অভিনব।
লোকে নাকি 'বই' পড়ে না! আর্থসামাজিক বিস্ফোরণের ফলে আমাদের সময় কমে গ্যাছে। সম্পর্ক পাল্টাচ্ছে, জীবন পাল্টাচ্ছে সাথে সাথে সমাজ পালটে যাচ্ছে। প্রচলিত একটা কথা আছে 'এক নদীতে দু'বার স্নান করা যায় না '। কারণ কেউ তো নদীতে স্নান করে না, করে জল প্রবাহে।  জল স্থির থাকে না, প্রবাহিত হয় অবিরাম। তাই প্রতি মুহূর্তে নতুন জলে স্নান করতে হয়। এমনকি যে জলে পায়ের পাতা ভেজে, সেই জলে হাঁটু ভেজে না। যে জলে হাঁটু ভেজে সেই জলে বুক ভেজে না। যে জলে বুক ভেজে সে জলে মাথা ভেজে না। সেই জন্যই এক জলে দু'বার স্নান করা যায় না। নদী এক জল আলাদা। অর্থাৎ নদী এক জল নতুন। সময়ও নতুন। নতুন সময়ে নতুন গল্প লেখক লিখতে চাইবেন, পাঠক নতুন গল্প পড়তে চাইবেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বরং দাবিটা খুবই স্বাভাবিক। না চাইলেই অস্বাভাবিক হতো। 
মনন এবং চিন্তনের পরিসীমা বহুমাত্রিক হচ্ছে। পাঠক আর শুধু মাতৃভাষার সাহিত্য পাঠ করছে না। পৃথিবীর যেকোনো ভাষার সাহিত্য তাঁর হাতের কাছে এসে যাচ্ছে। পাঠক আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। পড়ুয়ার আন্তর্জাতিকতা সাহিত্য নির্মাণে অন্য কিছু দাবি করছে। বিভিন্ন মানুষ ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জীবন যাপন করেন। জীবনের সত্যকে নিজের মতো করে গড়ে তোলেন। পাঠকের অভিযানের নেশা তীব্র হয়। পাঠক নিত্যনতুন অভিযান করতে চান। অভিনব অভিজ্ঞতার প্র‍য়োজন তীব্রতর হয়। গল্প অভিনব হয়। উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর বেশ কিছু সাহিত্য সে কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। 
প্রতিমুহূর্তে গল্পের অভিনবত্বের বিস্তার দাবি করছি এবং সেটা প্রাপ্তিও হচ্ছে। তবেই তো সাহিত্য জগতের বটবৃক্ষ উচ্চশিখরে অবস্থান করবে নিজ মহিমায়।





মমি লামা

রা না  স র কা র

"মমি" শব্দটি শুনলে যে দেশটির কথা আমাদের প্রথম মাথায় আসে, সেটি হলো মিশর বা ঈজিপ্ট। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যে, মৃত‍্যুর পরেও জীবনের অস্তিত্ব থাকে। তাই তারা তাদের স্বজনদের দেহ সাধারনভাবে কবর না দিয়ে, পিরামিডের ভেতর মমি করে রেখে দিতো। যেহেতু এই মমি তৈরী এবং পিরামিড নির্মাণ ইত‍্যাদি খুব ব‍্যয়বহুল ছিলো, তাই এসব ছিলো সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে।

সাধারনতঃ রাজা-মহারাজা  মানে ফ‍্যারাওদের দেহই মমি করে রাখা হতো। বহুবছরের অভিজ্ঞতা থেকে মিশরীয়রা এই মমি তৈরীর কৌশল আয়ত্ব করেছিলো।কয়েকটি ধাপে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতো। প্রথমে   মাথার ভেতর থেকে ঘিলু ও মস্তিস্ক এবং পেটের বা পাশ কেটে পাকস্থলী, ফুসফুস, লিভার এসব পচনশীল অঙ্গগুলো বের করে নিতো।এই অঙ্গগুলোকে চারটি বিশেষ পাত্রে রাসায়নিক পদার্থের মধ‍্যে কিছুদিন ডুবিয়ে রাখতো। তারপর মৃতদেহ আর অঙ্গগুলোকে লবন মাখিয়ে শুকোনো হতো। ভালো করে শুকোনোর পর একরকম গাছের আঁঠা আর নানারকম মশলা মৃতদেহের গায়ে ভালো করে লেপে রেখে দেওয়া হতো।এরপর শুকিয়ে যাওয়া অঙ্গগুলোকে আবার মৃতদেহের ভেতর ঢুকিয়ে এয়ারটাইট ভাবে পেট সেলাই করে দেওয়া হতো। এভাবে চল্লিশ দিন রেখে দেবার পর বায়ুনিরোধক লিনেন কাপড়ের ফিতে দিয়ে দেহটিকে আপাদমস্তক পেঁচিয়ে এবং ঢেকে একটা ঢাকনাযুক্ত কাঠের বাক্সে মমিটিকে রাখা হতো। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে সময় লাগতো সত্তর দিন। বিশেষভাবে দক্ষ লোকেরা কাজটি করতো।এবার মমিটিকে পিরামিডে বা কবরে রাখার ব‍্যবস্থা করা হতো।

আমরা জানি এবং বেশীরভাগ গবেষকও মনে করেন যে, মমির উৎপত্তিস্থল হলো প্রাচীন মিশর।তবে পরবর্তী গবেষণায় উঠে এসেছে যে, প্রাচীন মিশরীয় সভ‍্যতারও একহাজার বছর আগে উত্তর চিলি এবং দক্ষিণ পেরুর চিনচেরাতে মমি তৈরীর সংস্কৃতি ছিলো। এছাড়াও ইনকা, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী, প্রাচীন ইউরোপীয় সভ‍্যতাতেও মমি করার চল ছিলো।

এবার আসি ভারতবর্ষের কথায়। আমরা জানি, ভারতীয় সভ‍্যতাও অনেক প্রাচীন। কিন্তু এখানে কি মমির অস্তিত্ব ছিলোনা? ছিলো।মমি আছে আমাদের দেশেও। হিমাচল প্রদেশের স্পিতি উপত‍্যকায় একটা ছোট্ট গ্রাম হলো "গিউ", বা "গেউ" বা, "ঘুয়েন"। পর্যটকদের কাছে গ্রামটির পরিচয় হলো "মমি গ্রাম"।এই গ্রামে একটি ছোট কংক্রীটের ঘরে, পাতলা কাঁচের বাক্সে সংরক্ষিত আছে পাঁচশো বছর আগের মমি। তবে এটি মিশরীয় মমির মতো অত পুরনো নয়। এটি হলো, পনেরোশো শতাব্দীর বৌদ্ধ ভিক্ষু সাংহা তেনজিন এর মমি। মিশরের মতো এটি ব‍্যান্ডেজে মোড়া নয়। এই বৌদ্ধ লামা পদ্মাসনে বসে প্রাণত‍্যাগ করেছিলেন ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে। মমিটির হাতে এখনো রয়ে গেছে জপমালা। বৌদ্ধ বিশ্বাস মতে তিনি তপস‍্যার সর্বোচ্চ পথ "জোগচেন" অনুশীলন করে স্বেচ্ছামৃত‍্যু বরন করেন। দেহটি কোনো রাসায়নিক ব‍্যবহার করে সংরক্ষণ করে রাখা নয়। প্রাকৃতিক উপায়েই তা সংরক্ষিত। কঠোর যোগের ভঙ্গিমায় বসে থাকার জন‍্য এবং প্রাকৃতিক শীতলতায় থাকার জন‍্য মমিটি সংরক্ষিত থেকে গেছে দীর্ঘকাল। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন এই লামা এখনো মৃত নন, তিনি তপস‍্যারত। গ্রামবাসীরা ভালোবেসে তাকে ডাকেন "মমি লামা"।





আলিপুর বোমা মামলা

অ লি পা  ব সু

১১০ বছরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের দোরগোড়ায়। 
ক্যানাল ইস্ট রোড ধরে মুরারিপুকুর এলাকায় ঢুকতেই চোখে পড়বে রাস্তা থেকে শুরু করে অ্যাপার্টমেন্ট, ক্লাব থেকে শুরু করে বাড়ির নাম সবই প্রায় বিপ্লবীদের নামাঙ্কিত। বিপ্লবী বারীন ঘোষ, ঋষি অরবিন্দ, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী— বাদ নেই কারও নাম!‌ কিন্তু বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই ঘটনাবহুল বাগানবাড়িটি কোথায়? কোথায় সেই বোমার কারখানা? ৩২ মুরারিপুকুর ! গোটা বাগানবাড়ি ও বোমার মাঠের আজ আর কোনও অস্তিত্বই নেই। ঐতিহাসিক সেই জায়গায় এখন কেমিক্যাল কারখানা আর সামান্য কিছু বসতবাড়ি। একই সঙ্গে বদলে গেছে ঠিকানাও। সামনের অংশ ২২৬/‌এ/‌এইচ/‌১৫ বাগমারি রোড এবং পেছনের অংশটি ৩২/‌২ মুরারিপুকুর রোড (‌জজবাগান)।

শুক্রবার গভীর রাত সশস্ত্র পুলিশে ভরে উঠল ছোট্ট ঘরটা ৷ সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট ক্রেগান  ২৪পরগণার ক্লার্ক সাহেব কয়েকজন ইন্সপেক্টর  লাল পাগড়ি, গোয়েন্দা,পরিচিত বিনোদকুমার গুপ্ত।
শ্রীঅরবিন্দের গ্রেফতারের ঘটনা ১৯০৯-১০ সালে সুপ্রভাত কাগজে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ৷

বিছানায় বসে অরবিন্দ৷ ক্রেগান জিজ্ঞাসা করলেন, অরবিন্দ ঘোষ কে? খানাতল্লাসীর ওয়ারেন্ট চাইল অরবিন্দ, সাথে ক্রেগানের অতিশয় অভদ্র কথায় দু'জনের বাকবিতণ্ডা। ওয়ারেন্টে বোমার উল্লেখ যা মজঃফরপুরের খুনের সাথে যুক্ত। শ্রীঅরবিন্দ শুধু বুঝতে পারেনি তার বাড়িতে বোমা বা অন্য কোন স্ফোটক পদার্থ পাওয়ার আগেই body warrant এর অভাবে কেন তাকে গ্রেপ্তার করলো। সাথে গ্রেপ্তার হল শ্রী অবিনাশ ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্র বসু। ক্রেগনের ভাবে প্রকাশ পেয়েছিলো সে হিংস্র পশুর গর্তে ঢুকেছেন, যারা আইনভঙ্গকারী, তাদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা নিষ্পয়োজন। অহংকারী ক্রেগন শ্রীঅরবিন্দ'কে বলেছিলো 'আপনি নাকি বি-এ পাশ করিয়াছেন? এমন সজ্জাবিহীন কামরায় মাটিতে শুয়ে আছেন, এই অবস্থায় থাকা কি আপনার মত শিক্ষিত লোকের পক্ষে লজ্জাজনক নহে?' উত্তরে শ্রীঅরবিন্দ বলেন 'আমি দরিদ্র, দরিদ্রের মতই থাকি'। উত্তরে সাহেব সজোরে বলে 'তবে কি আপনি ধনী লোক হবেন বলে সকল কাণ্ড ঘটাচ্ছেন? 'শ্রীঅরবিন্দ বুঝলেন দেশহৈতেষিতা, স্বার্থত্যাগ বা দারিদ্র্যব্রতের মাহাত্ম্য স্থূল বুদ্ধি ইংরেজকে বোঝানো দুঃসাধ্য। 
খানাতল্লাসী চলছে। ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় আরম্ভ হয়ে শেষ হয় সাড়ে এগারটায়। বাক্সের ভিতর বাইরে যত খাতা চিঠি কাগজ কাগজের টুকরো কবিতা নাটক পদ্য গদ্য প্রবন্ধ অনুবাদ যা ছিলো কিছুই বাদ যায় না এই সর্ব্বগ্রাসী খানাতল্লাসীর থেকে। তবে ছোট কার্ডবোর্ডের বাক্সে দক্ষিণেশ্বরের মাটি ছিলো, ক্লার্ক সাহেব সন্দিগ্ধচিত্তে অনেক্ষণ নিরীক্ষণ করেছিলেন- তার ভাবনা- ভয়ঙ্কর তেজবিশিষ্ট স্ফোটক পদার্থ।

তল্লাসী শেষ হলে ধৃত তিনজনকে স্থানীয় থানা থেকে লালবাজার হয়ে রয়ড স্ট্রীটে নিয়ে যাওয়া হয় আবার লালবাজারে চলে জিজ্ঞাসাবাদ। অতিবাহিত হয় তিন রাত। 

আই. সি.এস পরীক্ষার প্রস্তুতিকালে শ্রীঅরবিন্দকে যথেষ্ট আইন বিষয়ক পড়াশুনা করতে হয়েছিল যার ফলে তিনি কোন ফাঁদে পা দেননি। জোর জবরদস্তি সত্ত্বেও তিনি কোন বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেন এবং নিজের অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন৷ প্রথম থেকে ইংরেজ সরকার শ্রীঅরবিন্দকে যথাসাধ্য হেনস্থা করার চেষ্টায় ছিলো। তাঁর খাদ্য ছিলো খাওয়ার অনুপযুক্ত।

সোমবার, ৫ই মে কলকাতা চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বন্দীদের পেশ করা হল৷ ইতিমধ্যে আটটি বিভিন্ন স্থানে তল্লাসী চালিয়ে ২৪মে তারিখে প্রায় পঁচিশজনকে আটক করা হয় এবং পরে সংখ্যায় আরও বেড়ে মোট ৪২জন গ্রেপ্তার হয় ৷ যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে ৩ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। বাকী ৩৯ জনকে নিয়ে ১৭ই মে ১৯০৮, শুরু হয় ২৪ পরগণার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্লির আদালতে, যা আলিপুর বোমা মামলা নামে খ্যাত।

শ্রীঅরবিন্দের কারাজীবন আরম্ভ হয় ৫ই মে, পরের বছর ৬ই মে তিনি মুক্ত হন। শ্রীঅরবিন্দ ও বহুসংখ্যক বিপ্লবীদের আটক সংবাদ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। দেশবাসী হ'ল হতবুদ্ধি। মুজঃফরপুর বোমার ঘটনায় ইতিমধ্যে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। যে দুজন যুবক ধরা পড়েছিল, তার মধ্যে প্রফুল্ল চাকী গ্রেপ্তার এড়াতে নিজেকে গুলি করে। অন্যজন, ক্ষুদিরামকে আদালত অভিযুক্ত করে ফাঁসি দেয়। অতি অল্প লোকই বিশ্বাস করেছিল যে শ্রীঅরবিন্দ আতঙ্কবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। তবু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সরকার উঠে পড়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে তিনি হচ্ছেন নাটের গুরু, সকল অনর্থের 
মূল। দেশবাসী হতচকিত, বিমূঢ় ও যুগপৎ হয়েছিল শোকাচ্ছন্ন।
শ্রী অরবিন্দ বলেছেন— 
            '১লা মে শুক্রবার১৯০৮,
জানিতাম না যে এই দিনই আমার জীবনের একটা অঙ্কের শেষ পাতা, আমার সম্মুখে এক বৎসরের কারাবাস, এই সময়ের জন্য মানুষের জীবনের সঙ্গে যতই বন্ধন ছিল, সবই ছিন্ন হইবে, এক বৎসর কাল মানবসমাজের বাহিরে পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মত থাকিতে হইবে। আবার যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিব, তথায় সেই পুরাতন পরিচিত অরবিন্দ ঘোষ প্রবেশ করিবে না। কিন্তু একটী নতুন মানুষ, নতুন চরিত্র, নতুন বুদ্ধি, নতুন প্রাণ, নতুন মন লইয়া নতুন কর্মভার গ্রহণ করিয়া আলিপুরস্থ আশ্রম হইতে বাহির হইবে। বলিয়াছি এক বৎসর কারাবাস, বলা উচিত ছিল এক বৎসর বনবাস, এক বৎসর 
আশ্রমবাস। বৃটিশ সরকারের কোপ দৃষ্টির একমাত্র ফল, আমি ভগবানকে পাইলাম।'

এই বিচার পর্বে ঘটে গেল এক নাটকীয় ঘটনা। একজন অভিযুক্ত বন্দী নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হতে রাজি হল। ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে। বিনিময়ে নরেন গোঁসাই আদালতে স্বীকারোক্তি দেবে। সকল তথ্য জানাবে ও ইংরেজ সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। এই সময় গোঁসাইকে অন্য বন্দীদের থেকে আলাদা রাখা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। দুই বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বোস স্থির করলেন বেইমানীর মূল্য প্রাণ দিয়ে শোধ করতে হবে গোঁসাইকে। তারা দুজনে রাজসাক্ষী হতে ইচ্ছুক জানালেন কর্তৃপক্ষকে। নরেন গোঁসাই এর সাথে সাক্ষাতের বন্দোবস্ত হল৷ কথা চলাকালীন হঠাৎ গুলির আওয়াজ। গোঁসাই ছুটছে, পিছনে কানাই ও সত্যেন, তাদের পিছনে কারারক্ষী বাহিনী। গোঁসাই আহত হয়ে পথের ধারে ড্রেনের মধ্যে পড়ে যায়। কানাই ও সত্যেনের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত বিচার শুরু হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনে অনিচ্ছুক
হওয়ায় তাদের ফাঁসি হয়। সকল দেশপ্রেমিকের চোখের জলে ধৌত হয়ে বীরের ন্যায় তাঁদের মৃত্যু হ'ল। গোঁসাইয়ের মৃত্যু মামলার উপর সামগ্রিকভাবে চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তার করে। সে এমন সব বিবৃতি দিয়েছিল যা শ্রী অরবিন্দের বিপক্ষে নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারত। গোঁসাই একজন প্রধান সাক্ষ্য হতে পারত। কিন্তু তার মৃত্যুতে তার বিবৃতি সাক্ষ্য হিসাবে পেশ করা যাবে না, কারণ আসামী পক্ষ মৃত গোঁসাইকে কাঠগড়ায় জেরা করা যাবে না। অর্থাৎ তার বিবৃতি আইনের চোখে বাতিল।

কানাই ও সত্যেন রিভলবার কোথায় পেলো? সত্য ঘটনা জানা যায়নি। তবে অনুসন্ধান করে জানা যায় চন্দনগরের এক বিপ্লবী রিভলবার দুটি গোপনে জেলে বারীনের কাছে পৌছে দিয়েছিলো। পদ্ধতি যাই হোক, যে ভাবে বিশ্বাসঘাতকের মুখ বন্ধ হয়েছিল তা প্রশংসনীয়।

প্রাথমিক বিচারপর্ব ১৪ই সেপ্টেম্বর শেষ হল। ৩৯ জন অভিযুক্তদের মধ্যে ৩ জন কানাই, সত্যেন ও নরেন গোঁসাই মারা গেছে। বাকি ৩৬ জনের শুশানী শেষ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো সংঘবদ্ধভাবে হিংসার আশ্রয় নেওয়া, ষড়যন্ত্র, গুপ্ত হত্যা প্রচেষ্টা, অন্তর্ঘাতমূলক কর্যাবলী, অবৈধ বিস্ফোরক তৈরী ইত্যাদি ইত্যাদি—এই সকল অভিযোগ প্রমানিত হলে সর্ব্বোচ্চ দণ্ড দিতে কোন বাধা থাকবে না। শুরু হল প্রধান বিচার কার্য ২৪পরগণা ও হুগলী জেলা দায়রা জজ মিঃ চার্লস পোর্টেন বীচক্রফট এর আদালতে ৷

সাক্ষ্য হিসাবে ছিলো আনুমানিক ৪০০০ দলিল, ৩০০ থেকে ৪০০ দস্তাবেজ, বিস্ফোরক, বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র আদালতে পেশ করা হল ২০০ ব্যক্তির সাক্ষী। মামলা শুরু হয় ১৯শে অক্টোবর, ১৯০৮ থেকে ১৩ই এপ্রিল, ১৯০৯, মোট ১৩১দিন। রায় প্রকাশ পায় ১৯০৯ সালের ৬ই মে।

বিস্ময়কর এই আইন যুদ্ধ। যার ফলাফলের উপর বহু ব্যক্তির জীবন মরণ নির্ভরশীল ৷এই মামলার প্রতিদিনের বিবরণ সারা দেশের লোক শ্বাস রুদ্ধ আবেগের সাথে লক্ষ্য করত। এই মামলায় জন্য যে প্রচুর খরচ তা সহজেই অনুমান করা যায়।
শ্রীঅরবিন্দের বোন সরোজিনী Defence fund গঠন করেন ৷ 
দেশের দূরদূরান্ত থেকে জনসাধারণ অর্থ সাহায্য করে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মামলার বিচারক ছিলেন বীচক্রাফট সাহেব। তিনি ১৮৯০ সালে শ্রীঅরবিন্দের সাথে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (I.C.S) পরীক্ষায় একই সাথে উত্তীর্ণ হন ৷ পরীক্ষায় শ্রীঅরবিন্দ সাহেবের তুলনায় ভালো ফল করেন। দুজনেই কেম্ব্রিজের ছাত্র।
সরকারপক্ষ মাদ্রাজের সুপ্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার ইয়ারডলি নর্টনকে এই মামলায় নিযুক্ত করেন। নর্টন ছিলেন দায়রা মামলায় দুর্ধর্ষ,মানসিক চাপে বহু সাক্ষী বশ্যতা স্বীকার করত।

শ্রীঅরবিন্দ ও অভিযুক্তদের পক্ষে
উদীয়মান এক বিখ্যাত ব্যারিস্টার
চিত্তরঞ্জন দাশ দায়িত্বভার গ্রহন 
করেন। শ্রীঅরবিন্দের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো নিবিড়। রাতদিন পরিশ্রম করে বিনা পারিশ্রমিকে অদ্ভুত অধ্যাবসায়ে মামলাটি পরিচালনায় আত্মত্যাগের এক নজির সৃষ্টি করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের আবির্ভাব, শ্রীঅরবিন্দের স্বপক্ষে মামলার গতি ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। তার সওয়াল ভাষণ দীর্ঘ আটদিন ব্যাপী চলেছিলো। আইনের দুনিয়ায় এই সওয়াল অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই মামলা তাকে খ্যাতির শীর্ষে তুলে ধরে এবং তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইনজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। শ্রীঅরবিন্দের উদ্দেশ্যে সি আর দাশ বলেছিলেন—  আজ যিনি অভিযুক্ত তিনি শুধু এখানে নন, ইতিহাসের বিচারালয়ে বিচারপ্রার্থী। বিতর্ক যে দিন কালের গর্ভে নীরব হবে, তিনি দেহত্যাগ করবেন, তার পরেও বিশ্ব তাঁকে মান্য করবে দেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তার নবী মানব প্রেমিক হিসাবে।

বিচারাধীন বন্দীদের দিনের পর দিন মামলা চলাকালে আদালতে পেশ করা হত। তাদের রাখা হত জালের মধ্যে। আদালত ঘর ঘিরে থাকত সশস্ত্র পুলিশ। নর্টন আত্মরক্ষার জন্য গুলি ভর্তি পিস্তল নিয়ে আসত। এমন গম্ভীর পরিস্থিতিতে বন্দীদের ব্যবহার ছিলো আশ্চর্যজনক ভাবে দেখার মত। অরবিন্দ থাকতেন শান্ত, নির্লিপ্ত, আত্মমগ্ন—বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। অন্যদের মধ্যে কোন চঞ্চলতা দেখা যেত না৷ তারা থাকত উদ্বেগহীন প্রফুল্ল। তাঁদের ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে ফাঁসিকাঠে অথবা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে। অথচ তাঁরা একাগ্র মনে পড়ে চলেছেন বঙ্কিম উপন্যাস, বিবেকানন্দের রাজযোগ বা sience of Religions, গীতা,পুরাণ, কেউবা ইউরোপীয় দর্শন।

বিচারের রায় ১৯০৯ সালের ৬ই মে প্রকাশিত হবে। ঐদিন যাতে কোন গণ্ডগোল হাঙ্গামা না হয় তার জন্য ছিলো ব্যাপক পুলিশি ব্যবস্থা। বন্দীদের আদালত কক্ষে আনা হল। কিছুক্ষণ পরে দণ্ডাদেশ ঘোষনা হল। বারীন ও উল্লাসকর এর মৃত্যুদণ্ড, দশজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, সাতজনের দ্বীপান্তর ও বিভিন্ন মেয়াদী কয়েদবাস। বাকি সতের জনের বেকসুর খালাস—এর মধ্যে ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ ও নলিনীকান্ত গুপ্ত। অবশ্য আপীলে বারীন ও উল্লাসকর এর মৃত্যুদণ্ড মুকুব হয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ধার্য হয়। দণ্ডাদেশের কঠোরতা সত্ত্বেও শ্রীঅরবিন্দের মুক্তিতে দেশে আনন্দের সাড়া পড়ে গিয়েছিল। শ্রীঅরবিন্দ সহ অন্যান্য মুক্ত অভিযুক্তদের মাল্যদান সম্বর্ধনার মাধ্যমে সি আর দাশের বাড়িতে আনা হয়, সেখানে ছিলো খাওয়া দাওয়া ও রাজকীয় অভ্যর্থনার আয়োজন। এই সব আনন্দ উল্লাসের মধ্যে শ্রীঅরবিন্দ ছিলেন ব্যাহত অবিচলিত ও উদাসীন। দৃষ্টি ছিলো গভীর।





"শয়তান, দেহ পাবি, মন পাবি না" এবং আমাদের সনাতনী চিন্তাধারা

জা হি দ  হা সা ন  রা জু 

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন যেখানে একজন শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতাকে দমিয়ে রাখা হয়। যেখানে যুগের পর যুগ স্রেফ মুখস্থ করা এবং খাতায় সেটাকে বমি করে দেওয়ার মাঝেই শিক্ষা ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ ছিল সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এমন চমৎকার একটা প্রশ্ন লোকজন সহজে হজম করবে না এটা বেশ অনুমিত বিষয়। একজন শিক্ষক বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্সে প্রশ্ন করেছেন - "শয়তান, দেহ পাবি, মন পাবি না" and "শয়তান, দেহ পাবি, চিন্তা পাবি না" Briefly examine in the light of 'British Hegemony' in Indian Subcontinent. 

প্রশ্নটা আগাগোড়া চমৎকার এবং সৃজনশীল। চমৎকারভাবে এটার উত্তর দেওয়া যায়। অন্তত যে শিক্ষার্থীরা দুইটা জানা বিষয়কে রিলেট করার জ্ঞান এবং সৃজনশীলতা রাখে তারা চমৎকারভাবে এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারবে। প্রশ্নকর্তার সৃজনশীল মুন্সিয়ানা এখানে প্রশংসিত হওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু লোকজন কেন হজম করতে পারছে না? এর কারণ হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীলতাকে শুরু থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। 

একটা উদাহরণ দিই। স্কুলে বাংলা পরীক্ষায় শিক্ষক প্রশ্ন করেন, "এই কবিতার মাধ্যমে কবি কি বোঝাতে চেয়েছেন?" ভাবখানা এমন যেন কবি নিজে এসে বাংলা শিক্ষকের কানে কানে বলে গেছেন তিনি কি বুঝিয়েছেন। অথচ কোনো কবিতার বইয়ে কবি তার কবিতার সারমর্ম লিখে দেননি। অর্থাৎ পাঠকের নিজের মতো করে কবিতাকে ইন্টারপ্রিট করার স্বাধীনতা এখানে আছে। প্রশ্নটা এমন হওয়া উচিত- "তুমি কবিতাটা/আলোচ্য অংশটুকু পড়ে কি বুঝেছ?" এখানে ১০ জন শিক্ষার্থীর ইন্টারপ্রিটেনশন ১০ রকমের হতে পারে, এবং ১০ টাই সঠিক। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা শিক্ষকরা বাজারের গাইড বইতে দেওয়া একটা মাত্র ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেন। সৃজনশীলতার অবদমন এখান থেকেই শুরু হয়। 

কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন, "নিউট্রন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না।" এই লাইনটাকে আপনি কেবল রাজনৈতিক আঙ্গিকে পরিবেশন করতে পারেন। রাশিয়া, আমেরিকার মতো যুদ্ধবাজদেরকে এই লাইন দিয়ে সবক দিতে পারেন। আবার, আপনার যে প্রেয়সী আপনাকে বুঝতে পারছে না তাকেও অভিমানের সুরে বলতে পারেন, "নিউট্রন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না।" খেয়াল করুন কোনো ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক না। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এই স্বাধীনতাটুকু দিতে চায় না। কবি এবং শিক্ষার্থীর মাঝে অযাচিতভাবে ঢুকে পড়ে মাফিয়া টাইপের বাংলা শিক্ষকরা। (ভালো বাংলা শিক্ষকও আছে সেটা অস্বীকার করছি না।)

"শয়তান, দেহ পাবি, মন পাবি না" সংলাপটা আমাদের উপমহাদেশের বিভিন্ন মানের সিনেমায় পাবেন। তার মধ্যে কিছু ক্লাসিক সিনেমাও আপনি পাবেন। ক্লাসিক সিনেমার একটা ক্লাসিক সংলাপকে বিবেচনায় নিয়ে আপনি 'British Hegemony in Indian Subcontinent' কে ব্যাখ্যা করতে পারছেন কিনা এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানতে চাইতেই পারেন। যে শিক্ষক এভাবে প্রশ্ন করতে জানেন ওনাকে সমাদর করেন, যত্ন করেন। সেটা না পারলে 'পাঞ্জেরী' কবিতায় 'পাঞ্জেরী' শব্দটা কতবার ব্যবহৃত হয়েছে টাইপের সৃজনশীলতাহীন শিক্ষকদেরকে যুগের পর যুগ হজম করতে হবে।

এবারে অনেকেই বলতে পারেন যে সিনেমার ডায়ালগ একজন শিক্ষক কেন কোট করবেন, কিন্তু আমি এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করছি। সিনেমা বিষয়টাকে খারাপভাবে তুলে ধরলে হবে না। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য সিনেমা আছে যেগুলো একেকজন টপ ক্লাস প্রফেসরের লেকচারের থেকেও বেশি অর্থবহ। একটা বইয়ের সংলাপ যদি দ্যুতি ছড়াতে পারে, সিনেমার সংলাপ কেন নয়? আমরা শশাঙ্ক রিডেম্পশনের "Hope is a good thing, probably the best thing ever" ডায়ালগটাকে লাইমলাইটে আনতে পারলে "শয়তান, দেহ পাবি, মন পাবি না"-এর মতো ক্লাসিক সংলাপ কি দোষ করল? তারচেয়েও বড় কথা ব্রিটিশ হেজেমনিকে ব্যাখ্যা করার মতো প্রাসঙ্গিকতা এই সংলাপটার মধ্যে আছে। সমস্যা হল লোকজন সংলাপটাকে অশ্লীল মনে করছে, যেটা আদৌ অশ্লীল বা নিম্নমানের সংলাপ না। সংলাপ হিসেবে এটা ক্লাসিক লেভেলে অবস্থান করে। এই সংলাপের মাঝে একজন নারীর ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আকুতি লুকিয়ে আছে। এর সাথে ব্রিটিশ হেজেমনির যে প্রাসঙ্গিকতা এটা বুঝতে পারা এবং বুঝাতে পারাই একজন শিক্ষকের নৈপুণ্য। 

আমি যদি কখনো আইন বিভাগের জুরিসপ্রুডেন্স পড়াতে যাই ক্লাসটা শুরু করব মিঠুন চক্রবর্তীর একটা সিনেমার রেফারেন্স দিয়ে যে সিনেমায় মিঠুন প্রচুর টাকা ঘুষ নিয়ে বস্তির গরিব মানুষের মধ্যে বিলি করে। ভরা ক্লাসে বলব, "তোমরা মিঠুনের কাজটার সাথে কে কে একমত এবং কেন একমত? কে কে দ্বিমত এবং কেন?" পুরো ক্লাস দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। এরপর আমি জুরিসপ্রুডেন্স ঢুকাবো আলোচনায়। এবিষয়ে জুরিসপ্রুডেন্স কি বলে সেটা বলব।




প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্য

শং ক র  ব্র হ্ম

প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যকে বিশ্বের প্রাচীনতম সাহিত্য গণ্য করা হয় (ফ্যারাওদের রাজত্বকাল থেকে শুরু করে রোমান রাজত্বকাল পর্যন্ত।) 


মিশরীয় চিত্রলিপির কার্টুশে খোদিত "দ্বিতীয় রামেসিস" নামটি; লাক্সার মন্দির, নতুন রাজ্য

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ ভাগে অর্থাৎ, মিশরে প্রাক্‌রাজবংশীয় যুগের অন্তিম পর্যায়ে হায়ারোগ্লাফিক ও হায়রাটিক উভয় আকারেই প্রথম লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। পুরনো রাজ্যের সমসাময়িক কালে (খ্রিস্টপূর্ব ষড়বিংশ থেকে দ্বাবিংশ শতাব্দী) সাহিত্য বলতে ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলি, "ইপিসল" (ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে নির্দেশিত বা প্রেরিত চিঠি), সাধারণ চিঠিপত্র, স্তোত্র ও কবিতা এবং বিশিষ্ট প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের কর্মজীবনের স্মৃতিচারণামূলক স্মারক আত্মজৈবনিক গ্রন্থাবলি। মধ্য রাজ্যের প্রথম পর্যায়ের (খ্রিস্টপূর্ব একবিংশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী) আগে সে দেশে আখ্যানমূলক সাহিত্যের উদ্ভব ঘটেনি। রবার্ট বি. পার্কিনসনের মতে, মিশরে আখ্যানমূলক সাহিত্যের উৎপত্তি ছিল একটি "গণমাধ্যম বিপ্লব" এবং তা ছিল বুদ্ধিজীবী লিপিকর শ্রেণির উত্থান, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিষয়ে নতুন সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা, সাক্ষরতার নজিরবিহীন মাত্রা এবং লিখন উপকরণগুলি সর্বসাধারণের কাছে সহজলভ্য হয়ে ওঠার ফলশ্রুতি। অবশ্য এই সময় সাক্ষরতার সামগ্রিক হার সম্ভবত মিশরের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম ছিল। তাই সাহিত্য রচনা ছিল অভিজাত শ্রেণির কুক্ষিগত। এই কাজে একচেটিয়া অধিকার ছিল সরকারি কার্যালয় ও শাসক ফ্যারাওয়ের দরবারের সঙ্গে যুক্ত লিপিকর শ্রেণির। অবশ্য প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্য রাজসভার সামাজিক-রাজনৈতিক বিন্যাসক্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল কিনা তা নিয়ে আধুনিক গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে।

মধ্য রাজ্যের কথ্য ভাষা মধ্য মিশরীয় নতুন রাজ্যের সময়কালে (খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ থেকে একাদশ শতাব্দী) ধ্রুপদি ভাষায় পরিণত হয়। তৎকালীন স্থানীয় ভাষা পরবর্তী মিশরীয় সেই সময় প্রথম সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়। মধ্য মিশরীয় ভাষা তখন পবিত্র চিত্রিলিপিতে লিখিত গ্রন্থাবলির মৌখিক পাঠের ভাষা হিসেবে রয়ে গিয়েছিল। নতুন রাজ্যের লিপিকরেরা সেই ভাষায় লিখিত অনেক সাহিত্যকীর্তি প্রামাণ্যকরণ এবং অনুলিপি করেন। মধ্য রাজ্যের সাহিত্যের কয়েকটি বর্গ, যেমন "উপদেশ" ও আখ্যায়িকা নতুন রাজ্যেও জনপ্রিয় থেকে যায়। যদিও টলেমীয় যুগের (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে প্রথম শতাব্দী) আগে ভবিষ্যদ্বাণী-সংক্রান্ত গ্রন্থের ধারাটি পুনরুজ্জীবিত হয়নি। জনপ্রিয় কাহিনীগুলির অন্যতম হল সিনুহের গল্প ও বাগ্মী কৃষক এবং গুরুত্বপূর্ণ উপদেশগুলির অন্যতম হল আমেনেমহাতের শিক্ষা ও আনুগত্যবাদী শিক্ষা। নতুন রাজ্যের যুগে পবিত্র মন্দির ও সমাধির দেওয়ালে স্মারক দেওয়াল লিখন সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র বর্গ হিসেবে বিকশিত হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও তাতে অন্যান্য বর্গে ব্যবহৃত সূত্রগত রচনাশৈলী ব্যবহৃত হত। অল্প কয়েকটি বর্গের ক্ষেত্রে সঠিক লেখকের নাম উল্লেখ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল। ছদ্মনামে লেখা "উপদেশ" বর্গের রচনাগুলিকে ভুলভাবে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক চরিত্রের উক্ত বলে চালানো হত।

প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্য রক্ষিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের লিখন-মাধ্যমে। এগুলির মধ্যে প্যাপিরাস লেখ্যপট ও মোড়ক যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে চুনাপাথর বা চীনামাটির অস্ট্রাকা (এক ধরনের মৃৎপাত্র), কাঠের তৈরি লেখার বোর্ড, প্রস্তরনির্মিত স্মারক সৌধ ও শবাধারও। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদরা খননকার্য চালিয়ে যে সকল গ্রন্থ উদ্ধার করেছেন এবং সংরক্ষণ করে থাকেন, তা প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যিক উপাদানের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। নীলনদের প্লাবন সমভূমি এলাকার আর্দ্র জলবায়ু প্যাপিরাই ও কালিতে লিখিত অভিলেখমালা সংরক্ষণের উপযুক্ত নয়। তাই প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যের একটি বৃহৎ অংশ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে সহস্রাধিক বছর ধরে ভূগর্ভে প্রোথিত সাহিত্যের গুপ্ত ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে মিশরীয় সভ্যতার শুষ্ক মরুভূমির প্রান্তবর্তী জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলিতে।


(লিপি, মাধ্যম ও ভাষা - চিত্রলিপি, হায়রাটিক ও ডিমোটিক।)


A flat limestone block with a painted, carved raised-relief of woman in spotted linen cloth, seated near table with food items. Painted hieroglyphs decorate the rest of the surface.

গাজায় মিশরের পুরনো রাজ্যের রাজকুমারী নেফারেতিয়াবেতের সমাধি থেকে প্রাপ্ত স্ল্যাব স্টেলা; আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫৯০-২৫৬৫ অব্দ। এটি চুনাপাথরে চিত্রিত এবং চিত্রলিপি সংবলিত।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে আদি রাজবংশীয় যুগে মিশরীয় চিত্রলিপি ও তার গোটা গোটা হাতের লেখাবিশিষ্ট রূপ হায়রাটিক লিখিত লিপিগুলিতে সুপ্রচলিত হয়েছিল। মিশরীয় চিত্রলিপিগুলি ছিল বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুর ছোটো ছোটো শিল্পগুণসমৃদ্ধ ছবি। উদাহরণস্বরূপ, দরজার হুড়কার চিত্রলিপিটির উচ্চারণ ছিল সে এবং সেটি ছিল স শব্দের উদ্‌গাতা। এই চিত্রলিপিটি অন্য এক বা একাধিক চিত্রলিপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের ধ্বনি সৃষ্টি করত, যেগুলির অর্থ ছিল দুঃখ, আনন্দ, সৌন্দর্য ও অমঙ্গলের মতো নানা বিমূর্ত ধারণা। প্রাক্‌রাজবংশীয় মিশরের শেষ পর্বে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দ নাগাদ খোদিত নারমার প্যালিটে মাগুর মাছ ও বাটালি বোঝাতে ব্যবহৃত চিত্রলিপিগুলি যুক্ত করে রাজা নারমারের নাম লেখা হয়েছিল।

মিশরীয়রা তাদের চিত্রলিপিকে বলত "দেবতার শব্দাবলি"। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত গ্রন্থের মাধ্যমে দেবতা ও মৃতের আত্মার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মতো বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন উদ্দেশ্যেই এই চিত্রলিপির ব্যবহার সংরক্ষিত রেখেছিল। প্রতিটি চিত্রলিপিগত শব্দ ছিল একাধারে একটি করে নির্দিষ্ট বস্তুর প্রতীক এবং সেই বস্তুর সারতত্ত্বের মধ্যে নিহিত। এই ধারণার মাধ্যমে সেই শব্দটিকে দৈব উপায়ে সৃষ্ট এবং বৃহত্তর ব্রহ্মাণ্ডের অংশ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হত। মনে করা হত, পুরোহিত ধূপ প্রজ্বলনের মতো আচারগুলি পালন করলে মৃতের আত্মা ও দেবতারা মন্দিরগাত্রে খোদিত চিত্রলিপিগুলি পড়তে পারেন। দ্বাদশ রাজবংশে প্রবর্তিত এবং পরবর্তীকালেও অনুসৃত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত গ্রন্থগুলিতে দেখা যায়, মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন যে কোনও কোনও চিত্রলিপির বিকৃতি এমনকি সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া ভালো অথবা মন্দ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কারণ, সমাধিস্থ মৃতের আত্মার কাছে লিপিগুলি পরলোকে পুষ্টিসাধনের অন্যতম উপায়। একটি বিষধর সাপ বা অন্য কোনও বিপজ্জনক প্রাণীর নাম-দ্যোতনাকারী চিত্রলিপি বিকৃত করলে কোনও সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় বলে মনে করা হত। যদিও মৃত ব্যক্তির নাম-পরিচায়ক চিত্রলিপির প্রতিটি নিদর্শন মুছে দেওয়ার অর্থ ছিল মৃতের আত্মার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত লিপিগুলি পাঠের ক্ষমতা চলে যাওয়া এবং মনে করা হত, এর ফলে সেই আত্মা জড় বস্তুতে পরিণত হয়।

A faded document with cursive hieratic handwriting in black ink, slightly torn and fragmented on the right.

অ্যাবোট প্যাপিরাস, হায়রাটিক লিপিতে লিখিত একটি নথি। এটিতে থিবান নেক্রোপলিসে একটি রাজকীয় সমাধি পরিদর্শনের বর্ণনা পাওয়া যায় (সময়কাল নবম রামেসিসের রাজত্বকালের ষোড়শ বছর,আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১১১০ অব্দ)।

মিশরীয় চিত্রলিপির একটি সরলীকৃত ও গোটা গোটা হাতের লেখাবিশিষ্ট রূপ হল হায়রাটিক। চিত্রলিপির মতোই হায়রাটিক ব্যবহৃত হত পবিত্র ও ধর্মীয় গ্রন্থাবলিতে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে চারুলিপিমূলক হায়রাটিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত প্যাপিরাই ও মন্দিরের বেলনাকারে পাকানো বস্ত্রের প্রধান লিপি হয়ে ওঠে। চিত্রলিপিগুলির লিখনের জন্য নিরতিশয় শুদ্ধতা ও যত্নের প্রয়োজত হত। কিন্তু গোটা গোটা হাতের লেখাবিশিষ্ট হায়রাটিক অনেক দ্রুত লিখে ফেলা যেত। সেই জন্য লিপিকারদের নথি-লিখনের কাজে এটির ব্যবহার ছিল অনেক সহজ। এটি প্রাথমিক ভাবে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, আইন-সংক্রান্ত নথিপত্র, কবিতা, রাজস্বের তথ্যাদি, চিকিৎসা-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলি, গাণিতিক গবেষণামূলক আলোচনা গ্রন্থ ও নির্দেশনামূলক সহায়িকার মতো অ-রাজকীয়, অ-স্মারকীয় ও অপেক্ষাকৃত কম আনুষ্ঠানিক লেখালিখির জন্য শর্টহ্যান্ড লিপি হিসেবে ব্যবহৃত হত। হায়রাটিক লেখা হত দু’টি পৃথক শৈলীতে। একটি ছিল অধিকতর পরিমাণে চারুলিপিমূলক এবং সাধারণত সরকারি নথি ও সাহিত্যিক পাণ্ডুলিপি রচনার জন্য সংরক্ষিত। অন্যটি ব্যবহৃত হত অপ্রাতিষ্ঠানিক বিবরণ ও চিঠিপত্র লেখার কাজে।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগেও চিত্রলিপি ও হায়রাটিক লিপিগুলি রাজকার্যে, স্মারকের গায়ে, ধর্মীয় ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত লেখালিখিতে ব্যবহৃত হত। কিন্তু সেই সময় একটি নতুন এবং আরও অধিকতর পরিমাণে গোটা গোটা হাতের লেখাবিশিষ্ট লিপি অপ্রাতিষ্ঠানিক ও দৈনন্দিন লেখালিখির কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সেটি হল ডিমোটিক। প্রাচীন মিশরীয়দের দ্বারা গৃহীত শেষ লিপিটি হল কপটিক বর্ণমালা, যা ছিল গ্রিক বর্ণমালার একটি সংশোধিত রূপ। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষিত হলে কপটিক লিপিটিই স্বীকৃতি অর্জন করে। চিত্রলিপিগুলি পৌত্তলিকতাবাদী ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত পৌত্তলিক চিত্র এবং বাইবেলীয় শাস্ত্র লিখনের কাজে অযোগ্য ঘোষণা করে বাতিল করে দেওয়া হয়।

(লিখন যন্ত্রপাতি ও উপকরণ)

A light-colored stone fragment with hieratic handwriting in black ink scrawled on its surface.

মিশরের একবিংশ রাজবংশের শাসনকালে স্থাপিত একটি অস্ট্রাকনে হায়রাটিকে লিখিত রয়েছে সমাধি পরিদর্শন ও পরিমার্জনার কাজে নিযুক্ত আধিকারিকদের নাম, (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০৭০-৯৪৫ অব্দ)।

মিশরীয় সাহিত্য বিভিন্ন প্রকার মাধ্যমের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। শিলালিপি খোদাই করার কাজে দরকারি একটি যন্ত্র ছিল বাটালি। সেই সঙ্গে প্রাচীন মিশরের প্রধান লিখনযন্ত্র ছিল তুলি-লাগানো এক ধরনের শরের কলম। কার্বন কালো ও লাল গিরিমাটির রঞ্জক লাগিয়ে এই কলম দিয়ে প্যাপিরাসের পাকানো লেখ্যপটে লেখা হত। প্যাপিরাস ছিল সাইপেরাস প্যাপিরাস নামক গাছের শাঁসের ফালি চ্যাপ্টা করে বানানো এক ধরনের পাতলা উপকরণ। এছাড়া চিনামাটির ছোট পাত্র বা অস্ট্রাকা নামে পরিচিত চুনাপাথরের ভাঙা টুকরোর উপরেও এই কলম দিয়ে লেখা হত। মনে করা হয়,গোল করে পাকানো প্যাপিরাস ছিল মোটামুটি দামি বাণিজ্যিক পণ্য। কারণ, অনেক প্যাপিরাসই ছিল প্যালিম্পসেস্ট অর্থাৎ,যে পাণ্ডুলিপি থেকে নতুন লেখা লিপিবদ্ধ করার জন্য মূল লেখা মুছে ফেলা হয়েছে। এই প্রথাটি এবং সেই সঙ্গে বড় আকারের প্যাপিরাসের নথিগুলিকে ছিঁড়ে ছোটো করে চিঠি লেখার কাজে ব্যবহার করা হত দেখে মনে করা হয় যে, সাইপেরাস প্যাপিরাস লতার বৃদ্ধির মরসুমের স্বল্পতা এর কারণ। এই একই কারণে অস্ট্রাকা ও চুনাপাথরের তবক অপেক্ষাকৃত ছোট রচনাগুলি লেখার কাজে ব্যবহার করা হত। পাথর, চীনামাটির অস্ট্রাকা ও প্যাপিরাস ছাড়া লেখার অন্যান্য উপকরণ ছিল কাঠ, হাতির দাঁত ও পলেস্তারা।

মিশরে রোমান শাসনকালে প্রথাগত মিশরীয় শরের কলমের বদলে গ্রিকো-রোমান আমলে লিখনযন্ত্রটির প্রচলন ঘটে। এটি ছিল একটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও মোটা এবং কাটা নিব-যুক্ত শরের কলম। একইভাবে আদি মিশরীয় রঞ্জকগুলি পরিত্যক্ত হয়ে সেই স্থান অধিকার করল গ্রিক সিসা-ভিত্তিক কালি। গ্রিকো-রোমান লিখনযন্ত্রগুলি গ্রহণ করার ফলে মিশরীয় হাতের লেখাও প্রভাবিত হয়েছিল। হায়রাটিক চিহ্নগুলি অধিকতর স্থান জুড়ে লেখা হতে লাগল এবং সেই সঙ্গে অধিকতর বৃত্তাকার রূপ ধারণ করল এবং সেগুলির কৌণিক নির্ভুলতাও বৃদ্ধি পেল।

(লিখিত উপাদানের সংরক্ষণ)

মরুভূমি অঞ্চলে নির্মিত ভূগর্ভস্থ মিশরীয় সমাধিস্থলগুলিই সম্ভবত প্যাপিরাস নথি সংরক্ষণের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, অসংখ্য সুসংরক্ষিত মৃতের বই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত প্যাপিরাই সমাধিস্থলগুলিতে রাখা হয়েছিল যাতে তা সংশ্লিষ্ট সমাধিতে সমাধিস্থ মৃতের আত্মাকে পরলোকে সহায়তা করতে পারে। যদিও সমাধিকক্ষে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্যাপিরাই রাখার প্রথা শুধুমাত্র ছিল মধ্য রাজ্যের শেষ পর্যায়ে এবং নতুন রাজ্যের প্রথম ভাগে। এই কারণে অধুনা-লভ্য অধিকাংশ সুসংরক্ষিত সাহিত্য-সংক্রান্ত প্যাপিরাইই এই সময়কালের।

প্রাচীন মিশরের অধিকাংশ জনবসতিই গড়ে উঠেছিল নীল নদের পলিগঠিত প্লাবন সমভূমিতে। এই অঞ্চলের আর্দ্র জলবায়ু প্যাপিরাস নথিপত্রের দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণের অনুপযুক্ত ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ প্লাবন সমভূমি থেকে উচ্চে অবস্থিত মরু অঞ্চলের জনবসতি এলাকা এবং এলিফ্যান্টাইন, এল-লাহুন ও এল-হিবার মতো যে সকল অঞ্চলে সেচব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না সেই সকল এলাকা থেকে অনেক বেশি সংখ্যক প্যাপিরাস নথি আবিষ্কার করেছেন।

"Two black-haired Egyptian peasants dressed in white-colored linen garb, standing in a field while collecting papyrus plants, with a motif of green vegetation at the bottom, and cut-off lower portion of another scene with peasants in a field at the top".

মিশরীয় কৃষকেরা প্যাপিরাস চাষ করছেন, দেইর এল-মদিনার একটি সমাধিস্থলের প্রাচীরচিত্র, রামেসাইড পর্যায়ের প্রথম ভাগ (অর্থাৎ, ঊনবিংশ রাজবংশ)

[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া। ]
(১৫০০ শব্দ)







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪