গল্প
আলোর পথিক কবি
ছ ন্দা চ ট্টো পা ধ্যা য়
মাঝরাতে প্রচণ্ড কলিংবেলের শব্দে কবি দরজা খুলতেই পুলিশ অফিসার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট মুখের সামনে ধরলেন।- "অপরাধ?"- "মানুষ ক্ষ্যাপানো। কী সব ছাইপাঁশ লেখেন? জনতাকে বিভ্রান্ত করা সামাজিক অপরাধ, জানেননা?"-
কবি কখনো ধর্ষিতার বিচার চেয়ে মোমবাতি মিছিল করেননি, কৃষক-আন্দোলনে সশরীরে উপস্থিত হননি, বস্তুত কৃষক কেন কেউই তাঁকে দেখেই নি। কোন গণআন্দোলনে, কোন রাজনৈতিক সভায় তাঁকে কখনো দেখা যায়নি। টেলিভিশনের বিতর্ক সভায় বসে টি.আর.পি.ও বাড়াননি। থানায় সেলের কনস্টেবলকে দেখে বললেন- "অতনু না?" -ছলছলে চোখে অতনু বলে- "স্যার পরে কথা বলব।"- কবি ছিলেন অতনুর কলেজের বিজ্ঞান-শিক্ষক।বলতেন- "অন্যায় করবেনা, অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াবে।" -কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে বিজ্ঞানশিক্ষক অনায়াসে চলে যেতেন সমাজতত্ত্বের আলোচনায়, রামমোহন বিদ্যাসাগরের অবদানে। বলতেন- "শিরদাঁড়াটা সোজা রাখবে।" -একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস চাপে অতনু।
কবিতা লেখেন কবি। শিক্ষার অবনতি, মানবিকতার অবক্ষয়, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ বড় পীড়া দেয় নিঃসঙ্গ কবিকে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে পড়েন তাঁর প্রিয় বই রামায়ণ-মহাভারত। উপলব্ধি করেন অবিকল চলছে দ্বেষ-হিংসা, জাতপাতের লড়াই, নারীর অসম্মান। কবি কাগজ-কলম টেনে নেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আলোকপাত করেন। তাঁর প্রতিবাদী লেখনি অসি হয়ে আঘাত করে বিকৃত সমাজকাঠামোকে, আবার বিপথগামী তরুণসমাজকে অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের জন্য মশাল হয়ে জ্বলতে থাকে। তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হন অনেকেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তর্জনি তোলার কাজ শুরু হয়।অন্যায়কারীরা ভয় পায়, তাই-ই এই গ্রেপ্তার। কবির চোখে সাফল্যের জ্যোতি আলোকিত হয়। আলোর পথিকৃত কবি।
আমার ঈশ্বর নেমে আসুক
বী থি ক র
অফিস থেকে বেরোনোর ঠিক আগেই বিদিশার টেবিলে ফাইল এনে রাখল বিনয়দা। সেই সকালে নোটসিট করে ফাইল পাঠিয়েছিল বিদিশা। সারাদিন ফেরত আসেনি দেখে ভেবেছিল আজ আর হয়তো আসবে না । তাড়াতাড়ি ফাইলটা খুলে দেখল বস্ কী নোট দিয়েছেন। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল। আজকে সমিতাদের বাড়ি যেতেই হবে। কাল থেকে ওর পরীক্ষা শুরু। এদিকে আকাশ কালো করে আছে, হয়তো বৃষ্টি নামবে। বিনয়দাকে ডেকে বলল,
"স্যার কী চেম্বারে আছে গো?"
বিনয় প্রধান, বয়স আটান্ন। গায়ের রং মিশমিশে কালো। সরল সিধে মানুষ, কিছু বললেই আগে খিলখিল করে হাসে। আর ঠিক তখন একশ ওয়াটার আলো দাঁতে খেলা করে। এবারেও তার অন্যথা হল না।
"না গো বিদিশাদি, স্যার তো বেরিয়ে গেলেন। বেরোনোর আগে বললেন আপনাকে বলে দিতে। ওই ফাইলে যে কাজটা আছে সেটা কাল সকালে এসে দেখবেন।"
"এই তো তুমি চলে যাচ্ছিলে। আমি জিজ্ঞেস না করলে তো..." - একটু ঝাঁঝিয়ে বলল বিদিশা।
মাথাটা চুলকে হাসতে হাসতে বলল, "তুমি তো জানোই আমি সব ভুলে যাই। মাইরি বলছি একদম মনে ছিল না। আসলে সুব্রতদাকে একটা কথা বলার ছিল, তাই..."
বিদিশার মাথায় ততক্ষণে রক্ত টগবগ করে ফুটছে। ঠিক এই বেলায় ফাইলটা ইচ্ছে করে পাঠালো। নোটের নিচে সময় তো দেওয়া নেই কিন্তু আজকের তারিখ দেওয়া। আজকে কাজটা শেষ না করলে এটা নিয়েই পরে কথা শোনাবে। এমনিতেই তো বিদিশাকে কথা শোনানোর কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেন না। কী যে শত্রুতা আছে কে জানে!
তৃণা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বিদিশার টেবিলে এসে জিজ্ঞেস করল,
"কী রে, বেরোবি না? আবার ফাইল খুলে বসলি যে। সকালেই তো বললি সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে যাবি। আমিও তাই সব গুছিয়ে নিলাম। চল..."
"আর বলিস না। তুই চলে যা আমার দেরি হবে। শেষ বেলায় ইচ্ছে করে ফাইলটা পাঠালেন। কাজটা আজকেই শেষ করতে হবে রে। নইলে জানিস তো..." - কম্পিউটারে এক্সেল সিটটা খুলে কাজটা শুরু করে দিল বিদিশা।
"মানে! বলিস কী? এই যে বললি আজ টিউশন বাড়িতে যাবি। আর দেখেছিস আকাশের অবস্থা? ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি আসছে। ছাতা এনেছিস?" - কিছুটা বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করল তৃণা।
"না রে, ছাতাটা আনতে ভুলে গেছি। আমি ঠিক চলে যাব, ভাবিস না একদম। তুই বেরিয়ে যা রে। আমার ঘন্টাখানেক লাগবে হয়তো।" - জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল বিদিশা।
পাশের চেয়ারে বসে পড়ল তৃণা। ফাইলটা হাতে নিয়ে বলল, "না, আমি আছি। তোকে একটু হেল্প করে দিই। তারপর একসাথে ক্যাব বুক করে চলে যাব। তুই তো আমার বাড়ির দিকেই যাবি। তাছাড়া অফিসে তোকে একা রেখে যাব না..." -মিটিমিটি হাসতে হাসতে সুব্রতদার চেম্বারের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল তৃণা।
ঘড়িতে ঠিক ৫:৪০। সব গুছিয়ে নিয়ে বিনয়দাকে বলে ওরা অফিসের নিচে এসে দেখল বৃষ্টির বেগ বেশ বেড়েছে। তৃণা অনেকক্ষন ধরে ক্যাব বুক করার চেষ্টা করছিল কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছিল না। দেরি হচ্ছে দেখে বিদিশা বলল, "চল, বাসে বেরিয়ে যাই। দাঁড়িয়ে থাকলে আরও দেরি হয়ে যাবে।"
"এইসময় বাসে উঠতে পারবি? তাছাড়া রাস্তায় যা জ্যাম হবে এখন। দাঁড়া আর একটু দেখি..."
হাত ঘড়িটা খুলে ব্যাগে রাখল বিদিশা। মাঝে মাঝেই চারপাশ আলো করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঠিক এমন দিনগুলোতেই তাঁর কথা খুব মনে পড়ে ওর। বৃষ্টির দিনগুলো কত প্রিয় ছিল ওদের। আজ কতগুলো মাস হয়ে গেল, সে আর নেই ওর জীবনে। অথচ কেমন জড়িয়ে জাপটে আছে। কখনো প্রশ্ন করা হয়নি কেন চলে গেল। ইচ্ছেও করেনি কোনোদিন। শুধু ভাবে, এমন করে তাঁর কী বিদিশার কথা মনে পড়ে না! বেশ তো ছিল ওরা। চোখে কোণটা ভিজে ওঠে। তৃণার থেকে লুকিয়ে ওড়নায় আলতো করে মুছে নেয়।
এমন সময় ওদের সামনে এসে একটা গাড়ি জোরেজোরে হর্ন দিতে শুরু করে। চমকে ওঠে দু'জনেই। ছাতাটা সরিয়ে গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখে সুব্রতদা ইশারা করছে ওদের। জানালার কাঁচ খুলে মাথাটা বের করে ওদের ডাকল, "উঠে এসো গাড়িতে। এখন কোনো ক্যাব পাবে না। যা বৃষ্টি..."
বিদিশা তৃণার হাতটা চেপে ধরল। তৃণা একটু এগিয়ে গিয়ে হেসে বলল, "না না, আমরা চলে যাব ঠিক। আপনি বেরিয়ে যান। ক্যাব না পেলেও বাস পেয়ে যাব। ধন্যবাদ সুব্রতদা।"
"কিচ্ছু পাবে না এই বৃষ্টিতে। চলে এসো বলছি। আরে আমি তো ওইদিকেই যাব। জানোই তো তোমরা..." - ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সুর সুব্রতর গলায়। বিদিশার ইতস্তত হল খুব। তৃণা কানের কাছে এসে বলল "চল যাই। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া কিচ্ছু পাব না এখন, যা জোরে বৃষ্টি নেমেছে। একটু পরেই রাস্তায় জল জমে যাবে। কী রে, হা করে কী দেখছিস? চল না..."
বিদিশার হাতটা ধরে প্রায় টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠল দুজন। গাড়ির সামনে সুব্রত ব্যানার্জি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে। তার ঠিক পেছনেই বিদিশা, পাশে তৃণা। ছাতাটা বন্ধ করে ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে ভরে পায়ের কাছে রেখে দিল। একটা ছাতায় দুজন ছিল এতক্ষণ, তাই দুজনেই প্রায় ভিজে গেছে। গাড়িতে এসি চলছে, একটু শীত শীত করতে শুরু করল বিদিশার। আজ সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। সমিতাদের বাড়িতে বেশিক্ষণ বসা যাবে না। ফেরার সময় বাস পেলেই হয়! উফ্ যা দুর্যোগ।
"সুব্রতদা, আজকে কিন্তু বিদিশা আমাদের পাড়ায় যাবে। তাই আপনি আমাদের দুজনকেই লেকটাউনের মোড়ে নামিয়ে দিন। আমরা ওখান থেকে রিকশা নিয়ে নেব।" - তৃণা নীরবতা ভেঙে কথা বলতে শুরু করল।
"ওহ্! কিন্তু তোমরা ওখান থেকে এখন রিকশা পাবে?" - সুব্রত পেছনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।
"হ্যাঁ হ্যাঁ পেয়ে যাব ঠিক। তাছাড়া ওখান থেকে অটো ছাড়ে। একটা না একটা তো পাবই বল বিদিশা?" - বিদিশার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বলল তৃণা।
"হুঁ.." - একটা শব্দতে কাজ সারার মতো উত্তর দিল জানালার দিকে তাকিয়ে।
কাঁচের বাইরে জলের দাপট বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টির প্রত্যেকটা শব্দ ওর খুব চেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মার আত্মীয়। কতবার মানুষটির সাথে এমন বৃষ্টিতে ভিজেছে। একবার ওরা গেছিল দার্জিলিং। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। পাহাড়ি রাস্তায় দুজনে হাত ধরে ভিজেছিল খুব। যদিও রাতে জ্বর বাঁধিয়েছিল বিদিশা। শরীরে প্রবল উত্তাপের সাথে সাথে দুজনের মনের উত্তাপ বেড়েছিল। ভোররাতে জ্বর কমলে গায়ে চাদর জড়িয়ে বারান্দায় ওর কাঁধে মাথা রেখে পাহাড় দেখেছিল বিদিশা। তখন কী জানত, মানুষটি এমন করে বদলে যাবে? এত স্মৃতি এই মন জুড়ে যে মাঝে মাঝে মনে হয় এটা দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই আবার সব আগের মতো।
"তা তোমাদের আজ দেরি যেন হল? কাজ ছিল খুব?" - তৃণার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সুব্রত।
"হ্যাঁ, ওই আর কী! বেরোনোর আগে বিদিশার একটা ফাইল নিচে নামল, তাই। যদিও আজ একটু তাড়া ছিল, কিন্তু কী আর করা যাবে! "
"তোমার বন্ধু কী আমার সাথে একদম কথা বলবে না বলে ঠিক করেছে? " - হেসে প্রশ্ন করল সুব্রত।
"না না, কথা কেন বলব না? বলুন..." - অস্বস্তি আবার বাড়তে শুরু করল বিদিশার। মানুষটি যে ঠিক কী চায়! মাঝে মাঝে এমন করে তাকায় যে মায়া হয়। আবার কখনো কখনো ঠিক তার উলটো। আসলে একটা মানুষ ঠিক কী চায় বা তার মনে কী আছে সেটা বুঝতে না পারলে অস্বস্তি হয় বটে। তবে কোথাও যে দুর্বলতা কাজ করে সুব্রতদার সেটা বুঝতে পারে বিদিশা। সেই জন্য খানিকটা এড়িয়ে চলে। আজ প্রায় দুই বছর হতে চলল বিদিশার জীবনে মানুষটি নেই। চলে যাওয়ার পর থেকেই বড়ো ভয়। সারাক্ষণ একটা খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। এখন আর কাউকেই বিশ্বাস হয় না।
"সুব্রতদা, আমরা কিন্তু পরের সিগন্যালেই নেমে যাব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেকক্ষন ধরেই চেষ্টা করছিলাম ক্যাব বুক করতে। ট্যাক্সিও পাচ্ছিলাম না। সত্যি অনেক উপকার হল।" - হেসে কথাগুলো বলল তৃণা।
ঘাড় ঘুরিয়ে বিদিশার দিকে তাকিয়ে সুব্রতদা বলল, "বৃষ্টি কিন্তু এখনও হচ্ছে। তোমার ফিরতে অসুবিধে হবে। যদি বলো আমি..."
"এমা। না না, একদম নয়। আমি চলে যাব আপনি ভাববেন না। তাছাড়া আমার এখানে সময় লাগবে। " - বিব্রত স্বরে তৃণার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দিল বিদিশা।
"তৃণা, তোমার যদি অসুবিধে না - থাকে তবে আমার কিছু কথা আছে তোমাদের সাথে। আসলে কথাগুলো আগেই বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু..." - গাড়িটা সিগন্যালের আগেই ডানদিকে দাঁড় করালো সুব্রত।
"মানে? কী ব্যাপারে? ঠিক বুঝলাম না। অফিসে কী কিছু হয়েছে?" - তৃণা গাড়ির দরজাটা খুলেও আবার বন্ধ করে দিল।
"তোমাদের হাতে কী একটু সময় হবে? তাহলে কোথাও বসে কথা বললে ভালো হয়। এভাবে গাড়ির মধ্যে কথা বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। আর হ্যাঁ, ভেবো না...দেরি হলে আমি বাড়ি পৌঁছে দেব।" - হাসির ছলে কথাগুলো বলল বটে সুব্রত কিন্তু ওর মনের মধ্যে প্রবলবেগে ঝড় বইছে। একটু ভয়ও লাগছে। যদি বিদিশা ভুল বোঝে। আজ থেকে তো নয়, সেই কবে থেকে ওকে চেনে। ভীষণ জেদ ওর। তাছাড়া আত্মসম্মান প্রবল। এতদিনের অপেক্ষা কী ধুলোয় মিশে যাবে! যদিও তৃণাকে বহুবার আভাস দিয়েছিল সুব্রত।
"না না, আজ তো আমার হবে না। টিউশন বাড়িতে যেতে হবে, অপেক্ষা করছে। তাছাড়া রাত হচ্ছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। বাড়িতে মা ভাববেন। পরে কখনো... চল রে তৃণা। নাম জলদি..."
কেউ কিছু বলার আগেই বিদিশা তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়ল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। এই ভয়টাই পাচ্ছিল এতদিন ধরে। এতদিন ধরে সুব্রতদা-কে এড়িয়ে লাভ কিছু হল না। তৃণা গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল, "সরি সুব্রতদা। আজ সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না। কাল অফিসে দেখা হচ্ছে। আর আপনার কথা অবশ্যই শুনব। আজ আসি।"
"শোনো তৃণা, এই খামটা বিদিশাকে দিয়ে দিও। আমি জানতাম, ওর আমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। যাই হোক, সাবধানে যেও তোমরা। আসছি..." - গাড়িটা চলতে শুরু করল।
মোড়ের মাথায় একটা রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। এইটুকু হেঁটেই ওরা ভিজে গেল। বিদিশা ছাতাটা পর্যন্ত খুলতে দিল না এমন জোরে হাঁটা শুরু করল যেন ভূত দেখে পালাচ্ছে। ওর যে কেন এত ভয়! অথচ কেমন ঝরঝরে একটি মেয়ে ছিল। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকত। এই ডেস্ক সেই ডেস্ক করে বেড়াত অফিসে। একাই মাতিয়ে রাখত পুরো অফিস। এখন চুপচাপ, গুমরে থাকা একটা মেয়ে। অথচ সেদিন যদি ও সুব্রতদার কথাটা মেনে নিত তাহলে হয়তো এমন দিন আর ওকে দেখতে হত না। মাঝে কতগুলো বছর কেটে গেল শুধু।এমনটাই রিকশায় যেতে যেতে ভাবতে লাগল তৃণা। কিন্তু কিছু বলল না। বিদিশা একটু বাদে বাদে নাক টানছে। বাইরে আর বিদিশার ভেতরে একই সাথে বৃষ্টি পড়ছে। মেয়েটিকে এমন দিনে কিছুতেই সামলে রাখা যায় না। বাঁদিকের বাড়িটার কাছে রিকশা দাঁড় করিয়ে নেমে গেল তৃণা। ভিজে যাওয়া খামটা বিদিশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "সাবধানে বাড়ি ফিরিস। আর হ্যাঁ, পৌঁছে সম্ভব হলে আমায় একটু জানাস কেমন? কাল দেখা হবে।"
রাতে খাওয়ার পর নিজের ঘরে বসে সকালের খবরের কাগজটা হাতে নিতেই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। চার্জ থেকে খুলে দেখল তৃণা ফোন করেছে। রিসিভ করতেই, "কী রে, বললাম পৌঁছে জানাতে। ভুলে গিয়েছিলি?"
-না রে, চার্জ ছিল না। রাস্তায় বন্ধ হয়ে গেছিল ফোনটা। বল..
-ফিরতে অসুবিধে হয়নি তো?
-নাহ্।
-আর চিঠিটা?
-খুলিনি..
-আমার একটা কথা রাখবি?
-জানিস তো, পারব না রাখতে। কেন বারবার বলিস?
-জীবন অনেক বড়ো বিদিশা। এভাবে তুই কতদিন স্মৃতি জড়িয়ে পড়ে থাকবি? তাছাড়া সুব্রতদাকে এত বছর ধরে চিনিস, মানুষটা খুব ভালো।
-তুই তো তাঁকেও ভালো বলেছিলিস। সেও ভালো ছিল।
-সব কালো অধ্যায়গুলো দিয়ে জীবনকে বিচার করিস না। আমার কথা শোন। এবার তুই ঠকবি না দেখিস। তাছাড়া এতগুলো বছর ধরে মানুষটা শুধু তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। আজ রাতটা খুব ভালো করে ভাব। আর চিঠিটা খুলে পড়।
-হুঁ।
-কী হুঁ? বেরিয়ে আয়, আটকে থাকিস না এই মরা জীবনে। আর একবার ভেবে দেখ।
-রাখছি...
ব্যাগ থেকে খামটা বের করে খুলে দেখল ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো। তাতে লেখা,
"দমকে দামিনী বিকট হাসে;
গরজে ঘন ঘন, মরি যে ত্রাসে।
এমন দিনে হায়, ভয় নিবারি,
কাহার বাহু ‘পরে রাখি মাথা।।"
আমার ঈশ্বর নেমে আসুক....
সুব্রত"
বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল বিদিশা। বাইরে তুমুল বৃষ্টি মাঝে মাঝে আকাশ চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি। ওর কান্না পাশের ঘর থেকেও শুনতে পেল না বিদিশার মা। পৃথিবী আজ নিজেকে ধুয়ে নিচ্ছে বৃষ্টির জলে। শুদ্ধ হচ্ছে ধরণী নবসাজের আগে। বিদিশার জীবনে এমন একটি রাতের হয়তো খুব দরকার ছিল।
বালিশের পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। এত রাতে তৃণা নিশ্চয়ই চিঠির জন্যই ফোন করেছে। পাগল মেয়ে! মুচকি হেসে ফোনটা ধরে কানে নিতেই,
" বিদিশা, সুব্রতদার হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। সেন্ট ভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি। অফিসের গ্রুপ চ্যাট দেখ এক্ষুনি।"
আজ ১৪ই আষাঢ়। বাইরে বৃষ্টি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখে ভিজছে সদ্য বিবাহিত দুটো প্রাণ।
সর্বনাশের আশায়
সু নৃ তা রা য় চৌ ধু রী
বহুদিন পর দক্ষিণের বারান্দাতে এসে দাঁড়ালো সুদেষ্ণা। বাড়িটা আর রাখা গেল না। ওরা তিন বোন যে যার সংসারে, ছোড়দাভাইয়ের ছেলেরা বিদেশে। এত বড় বাড়িতে দুটি মাত্র প্রাণী, কি দরকার এত বড় বাড়ি রেখে? সংরক্ষণ করাও মুশকিল, এখানে ফাটল, ওখানে পলেস্তারা খসে পড়ছে! প্রমোটারের হাতে তুলে দিতে হলো অগত্যা। এই ব্যাপারে কিছু সই-সাবুদ করতে ওরা তিন বোন দীর্ঘ ষোলো বছর পর, মা চলে যাওয়ার পর এই প্রথম এই বাড়িতে এসেছে।
বারান্দায় পা রাখা মাত্র কত ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো!
সেই শিশুকালে ঐ কোণায় বসে পুতুল খেলা, রান্নাবাটির সংসার, শিশু বন্ধুর উৎসাহে বেঞ্চিতে বসে বাস বাস খেলা অথবা কুমীরডাঙা, কত দুরন্তপনা! সামনে অর্ধবৃত্তাকার তিন ধাপ সিঁড়ি, দু'পাশে বেল মল্লিকার ঝাড়, পূব দক্ষিণের পিলার বেয়ে জুঁই ফুলের লতা উঠে গেছে। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ জুড়ে সুগন্ধে ভরে থাকতো জায়গাটা। সামনেই একটা ডালিম গাছে লাল টুকটুকে ফুল আর পুরন্ত নিটোল গোল ফল, বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে ফল ছোঁয়ার চেষ্টা!
শ্রাবণ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা অব্দি বারান্দা চলে যেত শ্রীরাধাকৃষ্ণের দখলে। ইট বালি জোগাড় করে যত রাজ্যের প্লাস্টিক আর মাটির পুতুল দিয়ে সাজানো হতো ঝুলন। পাহাড়, নদী, জঙ্গল, বাড়িঘর, রাস্তা, পার্ক, কী না থাকতো সেই দেশে! সকালে মিলনী মাসী ঝাঁট দিতে এলে চিল চিৎকার জুড়ে দিত ও। ভয়, পাছে বালি, ইট, ঘাসের চাপড়া, কয়লার গুঁড়ো আবর্জনা ভেবে ফেলে দেয়! এখন ভাবলে হাসি পায়।
বারান্দার এখন যা অবস্থা দেখছে, তাতে সেই আবর্জনা তো কিছুই না। কোণায় কোণায় ধুলো, একরাশ পুরোনো ছেঁড়া জুতো চটির মধ্যে কয়েক জোড়া ভালো জুতোও রয়েছে। একটা ধুলো পড়া ফাটা বল, ছেঁড়া ব্যাগ! ইশ্! ছাদ, গ্রীলগুলি ভরে আছে মাকড়সার ঝুলে। মাঝখান বরাবর একটা ফাটল এঁকেবেঁকে চলে গেছে। একদিকে যেখানে লম্বা ভাবে একটা বেঞ্চ পাতা থাকতো, সেখানে জায়গা নিয়েছে ছোড়দাভাইয়ের বাইক। তার চাকায় চাকায় বালি এসে সিঁড়ি পর্যন্ত নোংরা করে রেখেছে। অদ্ভুত, এখনও তো ওরা বাস করে, ভেতরের ঘরগুলো সাজানো কত সরঞ্জামে, বাইরের বারান্দা কেউ এত নোংরা করে রাখে? নাকি এ বাড়িতে আর থাকবে না বলে পরিচ্ছন্ন রাখার প্রয়োজন নেই!
অথচ আগে? ভোর বেলাতে ঘরে তখনও দিনের আলো ঢোকেনি, বইখাতা নিয়ে এই বারান্দায় সে বসে যেত পড়তে। সামনের রাস্তায় লোকজন চলতো বটে, কিন্তু তেমন বেশি না। তাই পড়ায় ব্যাঘাত ঘটতো না তেমন। দক্ষিণের মিঠে হাওয়া, ফুলের গন্ধ। আহা! সেই ফুলগাছ, ডালিম গাছ, সেই মৌটুসী পাখির বাসা, কিছুই নেই।
বিকেল বেলায় বাবা একটা ইজি চেয়ারে, আর বাকিরা কেউ মোড়া পেতে, কেউ মেঝেতে বসে, বাবার হাতে বই কিংবা ইংরেজি ম্যাগাজিন; বাবা পড়ে শোনাচ্ছেন তাঁর ভালো লাগা কিছু। সবাই তন্ময় হয়ে শুনছে, বিশেষ করে ও নিজে। দিদিরা যে যার শ্বশুরবাড়িতে, দাদারা অফিসে।
দাদারা ভাবতেই বুক মুচড়ে কান্না উঠে এলো। বড় দাদা, সুদেষ্ণার দাদামণি, ছোট বোন বলে সবসময় তাকে আগলে আগলে রাখতেন, সবচেয়ে ভালোবাসতেন, পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন চব্বিশ বছর আগে। খবর পেয়ে এসেছিল ওরা। মা বাবাকে কি সান্ত্বনা দেবে? উথালপাথাল বুকের কান্না ঝরাতে সে এখানেই চলে আসতো ওঁদের চোখের আড়ালে। পুত্রহারা বৃদ্ধ দম্পতিকে আর কত দুঃখ দেওয়া যায়!
স্কুলের ছুটির দিনে সকালের পড়া চুকে গেলে আপন মনে ছবি আঁকতে বসতো ঐখানে, যেখানে রাশিকৃত ধুলোমাখা জুতো পড়ে আছে। কখনো বাবার ইজি চেয়ারের দুই পাশে দুই বালক বালিকা, পাশের বাড়ির বিলু আর ও। বাবা টিনটিনের বই পড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ওরা মুগ্ধ হয়ে শুনছে আর ছবি দেখছে। তখনও আনন্দ পাবলিশার্স বাংলায় টিনটিনের অনুবাদ বার করেনি।
কালবৈশাখী ঝড়ের দিনে এখানে বসেই দেখতো উড়ে যাওয়া ঝরাপাতা, কাঠিকুটো, ধূলোবালি। বাবা তখন আবৃত্তি করে চলেছেন, "ঈশানের পুঞ্জ মেঘ অন্ধ বেগে ধেয়ে চলে আসে….."। আবেগে বাবার গলা কখনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে যেন সুদেষ্ণা। বিকেল আরেকটু গড়ালে আসতেন পাড়ার কাকীমা, মাসীমারা। মা তো কোথাও যেতেন না, ওনারা এলে চায়ের কাপে, পানের বাটায়, কিছু কথায় মা একটু মুক্ত বাতাস পেতেন।
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় এই বারান্দা জুড়ে ও মনের মতো করে আল্পনা দিত চালের গুঁড়ি দিয়ে। রোগাভোগা, মাঝারি মানের মুখচোরা মেয়েটার ভাগ্য সেদিনগুলো একটু অন্যরকম হতো। অতিথিদের সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার বড়ো একটা প্রাপ্তির অনুভূতি হতো। দীপাবলির সন্ধ্যায় বারান্দার রেলিং জুড়ে প্রদীপ সাজানো, গ্রীলে মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতো কিশোরী মনটা। দেখে দেখে আশ মিটতো না।
শীতকালে এই দক্ষিণের বারান্দা রোদে ভেসে যেত। দাদামণির রোদে পিঠ দিয়ে চা খাওয়া, খবরের কাগজ পড়া, খেলার পাতা নিয়ে দাদামণি ছোড়দাভাইয়ের কাড়াকাড়ি, দিদিদের হাতে উল কাঁটা, বোনা চলছে সব বাহারী রং বেরঙের পশমি সোয়েটার, মাফলার, টুপি। সারি সারি কাচের বোতলে কুল, তেঁতুল, আমের আচার রোদ খেতো। মায়ের চোখ এড়িয়ে একটু আধটু চুরি চলতো।
বিয়ের পরেও যতবার এ বাড়িতে এসেছে, এই বারান্দায় বসে কত গল্প হতো! মেয়ে টিঙ্কার এখানেই হামাগুড়ি দেওয়া, গ্রীল ধরে উঠে দাঁড়ানো, টলমলে পায়ে হাঁটতে শেখা। সব যেন এখনো চোখে ভাসে।
এখানে আর বসে থাকার মতো পরিবেশ নেই, সময়ও নেই। কি হবে আর মায়া বাড়িয়ে? মা চলে যাওয়ার পর আদর করে কেউ তো ডাকে না। প্রয়োজনে আসা, কাজ শেষ হলে ফিরে যাওয়া। হঠাৎ একটা হাওয়া দিলো। কোথা থেকে খসে পড়লো একটা পরিত্যক্ত পাখির বাসা। ছড়িয়ে পড়লো খড়কুটো, পালক, ডিমের খোলা। কিছুদিনের সংসার বাস শেষ করে যে যার মতো মুক্ত আকাশে ফিরে গিয়েছে। এ যেন এক শিক্ষা! এই মায়াভরা বারান্দাটি বলতে চাইছে, তোমার নিজের বলে কিছু নেই। তুমি এসেছ, স্বপ্নের নীড় গড়েছো, যতক্ষণ আছো, থাকো, আমি তোমাকে আশ্রয় দেবো। তুমি চলে গেলে আর ফিরে ডাকবো না। একদিন এই ভাবেই হারিয়ে যেতে হবে, তুমি তোমার নিজের আকাশ খুঁজে নাও। আমি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাব বলে সর্বনাশের আশায় সকল নিয়ে বসে আছি। চারদিকে শুধু ভাঙন আর ভাঙন। শুনতে পাচ্ছি সমস্ত স্নেহ, প্রেম, শ্রদ্ধা, বন্ধন, মূল্যবোধ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, আমি এই ইট লোহালক্কড়ের ভার নিয়ে কেনই বা বসে থাকি!
সুদেষ্ণা ভাবে মন থেকে সব সম্পর্ক যখন শেষ, তবে যাক, সব ঘুচে যাক, আমৃত্যু স্মৃতিতে রয়ে যাক তার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের দিনগুলি।
বৃষ্টির নীচে আলো
মো য়া ল্লে ম না ই য়া
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাতের মায়াবী অন্ধকারে, জঙ্গলমহলের এক প্রত্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোয়ার্টারে তখন শহুরে ডাক্তার তুষার বৃষ্টির ফোঁটায় কাব্যিক ছন্দ খুঁজে চলেছে। হঠাৎ তার কোয়ার্টারের দরজায় ঠকঠক করে শব্দ! তুষার কান পেতে শোনে। সারাদিন কমবেশি ব্যস্ততা থাকলেও সন্ধ্যার পর পুরো এলাকা শুনশান। বিশেষ করে বর্ষাকালে, এই দুর্গম পথঘাট মাড়িয়ে সহজে এখানে কেউ আসতে চায় না। এক মাসের অভিজ্ঞতায় তুষার এটা বুঝে গেছে। কিন্তু এই বৃষ্টির মধ্যে কে এলো! তুষারের ভাবনার জাল ছিন্ন করে আবারও ঠকঠক করে আওয়াজ, সেইসঙ্গে এক কচি কন্ঠের উচ্চারণ,... "ডাক্তারবাবু একটু দরজা খুলবেন? আমার মায়ের শরীর বড্ড খারাপ।" তুষার দ্রুত দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে, বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাওয়া এক বারো তেরো বছরের বালক! হাফহাতা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরিহিত ছেলেটি তখন ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপছে! বড় মায়া হল তার, সেই সঙ্গে বিস্ময়। কারণ, জঙ্গলমহলে এই এক মাসে সে যেন নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। সব কালো মানুষের ভিড়ে এই ছেলেটি যেন একটু বেমানান! গায়ের রং ফর্সা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখে মুখে একটা অদ্ভুত মায়াবী লাবণ্যের ছোঁয়া! তুষার ভিতর থেকে একটা তোয়ালে এনে পরম মমতায় তাকে মুছিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে, "তোমার বাবা আসেনি কেন? কত দূরে তোমাদের বাড়ি?" তার বাবা নেই, জানিয়ে ছেলেটি অন্ধকারের দিকে আঙুল তুলে দেখায়,.."ওই ও দিকে৷"
তুষার ছেলেটির সঙ্গে অন্ধকার দুর্গম পথ মাড়িয়ে প্রায় আধঘন্টা পর যে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, সেই বাড়িটা যেন বাইরের অন্ধকারের থেকে আরও গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে আছে ৷ ছোট্ট কুঁড়ের মধ্যে ল্যাম্পের মিটিমিটি আলোয় সে দেখলো, এক ছায়া মূর্তি জীর্ণ কাঁথায় নিজেকে জড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাকে নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাথা নীচু করে তুষার সেই কুঁড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। তারপর ল্যাম্পের আলোটা উঁচু করে রোগীনির মুখের সামনে আনার সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে ওঠে। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে, "বৃষ্টি তুমি!?" বৃষ্টি নামক মেয়েটির চোখে মুখেও বিস্ময়। পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে বলে ওঠে, "প্লিজ ডাক্তার বাবু…আমাকে ও নামে ডাকবেন না ৷ তাছাড়া আপনার মত বুর্জোয়া ডাক্তারের ঔষধ আমার প্রয়োজন নেই।" তুষার মাথা নীচু করে নেয়। মনে পড়ে পনেরো বছর আগের কথা। কলেজ রাজনীতিতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন করা মেধাবী বৃষ্টির বাগ্মিতায় মুগ্ধ তুষার সেদিন তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল দক্ষিণপন্থী ধনী বাবার সন্তান সে। এভাবেই বৃষ্টির সঙ্গে কলেজ রাজনীতি করতে গিয়ে তৈরি হয় গভীর সম্পর্ক। যৌবনের জোয়ারে ভাসতে গিয়ে আবেগী তুষার, তাদের কষ্ট ত্যাগ তিতিক্ষায় পা মেলাতে না পেরে একটা সময় হাঁপিয়ে ওঠে। বুঝতে পারে, এ কঠিন কঠোর তাপস জীবন তার জন্য নয়। ফলে, দু'চোখে লেগে থাকা স্বপ্নের ঘোর ছিন্ন হয় বাস্তবে রুক্ষ মাটিতে। সেই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে সে ফিরে আসে তার ক্যারিয়ার সর্বস্ব জীবনে। কিন্তু ফিরে আসার আগে সে রেখে আসে তার যৌবনের উদ্দামতার ফসল। যদিও আসার আগে তুষার বৃষ্টিকে বলেছিল, "ওটাকে তুমি নষ্ট করে দাও।" প্রচণ্ড ঘৃণায় আর তীব্র অভিমানে সেদিন বৃষ্টি তাকে জানিয়েছিল, "এ সন্তান শুধুমাত্র তারই। সে নিশ্চিত থাকতে পারে, এজন্য তাকে কোথাও কোনো কৈফিয়ৎ দিতে হবে না।" তারপর দুজনের পথ হয়ে গিয়েছিল ভিন্ন। কেউ কারো খোঁজও নেয়নি। আজ পনেরো বছর পর আবার দেখা।
নিশ্চুপ অন্ধকারের মাঝে তুষার কিছু বলতে চাইলেও তার ঠোঁট দুটো শুধু কেঁপে উঠল। সে বুঝলো, তার আপাত ভদ্র চেহারার আড়ালে একটা বহুরূপী স্বার্থপরতা লুকিয়ে আছে। তা এই পৃথিবীর কেউ না জানলেও, নির্বান্ধব এই জঙ্গলের মাঝে, এই ছোট্ট কুঁড়ের মধ্যে এক আদর্শবাদী নারী জানে ৷ সে একবার বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, বাইরের বৃষ্টির নীচে অসংখ্য অন্ধকার জমাট বাঁধলেও এই ঘরের বৃষ্টিকে সে এক ফোঁটাও ছুঁতে পারেনি।
কাগজের নৌকো
সো মা ভা র তী
ভোররাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। এখনও থামার নাম নেই। বরং তার বেগ ক্রমশ বাড়ছে। খ্যাপা বাউলের মত নেচেই যাচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তরের খবর অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে গভীর নিন্মচাপ আর তার জেরে তিনদিন চলবে এই বৃষ্টি।
সুজাতা জানালায় মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন। বৃষ্টির ছাটে তার চোখমুখ ভিজে। বাইরের ঝাপসা দৃশ্যটা তার বেশ লাগে। তবে স্বরূপও যদি এখন কাছে থাকত বেশ হত। বিয়ের পর এই প্রথম বর্ষা। সেই কবে থেকে ভাবে সুজাতা। বৃষ্টির দুপুরে স্বরূপ ওর সঙ্গে খুনসুটি করছে ঠিক ওই বৃষ্টির ছাটের মত।
স্বরূপকে আজই যেতে হল কাজে। কি কাজ সেটা পর্যন্ত বলে যায়নি। দুটো ভাত খেয়েই তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। যাক, সঙ্গে ছাতা নিয়ে গেছে বটে। কিন্তু তাও নির্ঘাত ভিজেই ফিরবে। আর স্বরূপ ফেরার পর তো শুধু ওরা দুজন।
একটা পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে বসে সুজাতা। নৌকো বানাবে। ওদের সদর দরজা দিয়ে বেরলেই সামনে বড় রাস্তা। তবে মসৃন নয়। পিচের সঙ্গে রাস্তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বহুদিন হল। সেখানে ওর নৌকো ভাসাবে। স্বরূপকেও ধরে নিয়ে যাবে।
পাশের বাড়ির রূপা কাকিমা বৃষ্টির নাম শুনলেই কেমন নাক সিঁটকোয়। বলে, "হতচ্ছাড়া বৃষ্টি!" কিংবা "বাবাঃ! কী ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি!" ওদের বারাসাতের অনেককেও বলতে শুনত এসব কথা।
সুজাতা বলেনা। ওর বরং সেই ছোট্ট থেকেই বৃষ্টি বড় প্রিয়। সখীও বলা যায়। কত কথাই তো বলে সে বৃষ্টির সঙ্গে। মনের কথা।
ছোটবেলায় বৃষ্টি পড়লেই বাবাকে একটা খবরের কাগজ দিয়ে বলত নৌকো বানিয়ে দিতে। তারপর ওদের বারাসতের বাড়ির সামনের বড় ড্রেনের জলে ভাসিয়ে দিত। বাবাও পিছনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসত।
কী ভালো লাগত সুজাতার। মনে হত এভাবে ভাসতে ভাসতে বোধহয় সমুদ্রে পৌঁছে যাওয়া যায়। আর তারপর সমুদ্র পেরিয়ে দিগন্ত!
সমুদ্র একবারই দেখেছিল সুজাতা। বাবা যে চটকলে কাজ করত সেখানের কয়েকজন মিলে একবার দীঘা গিয়েছিল। সেই তখন। সুজাতা তখন বছর চোদ্দর। সমুদ্র দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল বহুক্ষণ। শেষে বাবার কাছে গিয়ে মুখ গোমড়া করে বলেছিল, "দূর,আমার কাগজের নৌকো এই বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে পারে না কি! আর আমি ভাবতুম আমার নৌকো সমুদ্রে গিয়ে মেশে!" বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,"পাগলী! ভাবতে দোষ কি!"
সেই তো। ভাবতে দোষ কি। সুজাতা তো কত কি ভাবে। ভেবে বেশ লাগে। একমাত্র ভাবনাতেই তো সর্বসুখ। কোনো কষ্ট নেই। কোনো অভাব নেই। এই যেমন এখন ভাবতে বেশ লাগছে যে স্বরূপ বৃষ্টিতে ভিজে ফিরবে। তারপর বৃষ্টির ওপর রাগে গজগজ করতে করতে ছাতাটা দুয়ারের তারে ঝুলিয়ে রেখে ঘরের কোণে রাখা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কাঠের নড়বড়ে পায়াযুক্ত একমাত্র চেয়ারটায় বসবে। বহুদিনের ব্যবহারে পাতলা হয়ে যাওয়া কিন্তু এখনো সভ্যসমাজে মুখ দেখাবার উজ্জ্বলতাটুকু ধরে রাখা জামাটার বোতাম খুলতে খুলতে এক কাপ চায়ের অর্ডার করবে। বলবে, "হালকা আদা দিয়ে দিও।" সুজাতা পিতলের ছোট্ট স্টোভে পাম্প দিতে গিয়ে প্রত্যেকবারের মত ফেল করা ছাত্রী হয়ে স্বরূপের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাবে আর স্বরূপ মৃদু হেসে কাছে এসে বলবে,"সরো!" তারপর স্বরূপের আধশুকনো হওয়া আদুল গা থেকে ওর ঘামের গন্ধটা ভেসে আসবে। আর সুজাতা প্রাণভরে টেনে নেবে সেই নোনা নোনা গন্ধটা! সমুদ্রেরও তো এমনই একটা গন্ধ! সুজাতা পেয়েছিল।
সুজাতা সেই কাগজের নৌকোটায় বসে সমুদ্রে ভাসতে যাবে এমন সময় বাইরের দরজায় খুট করে শব্দ হল। সুজাতাকে ফিরে আসতে হল সেই দশ বাই বারো স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল ঘেরা ঘরটায়। নিশ্চই স্বরূপ ফিরেছে। দৌড়ে গেল। ছোট্ট উঠোনটা পেরতে গিয়ে চোখ পড়ল সদর দরজার পাশে এককোণে লাগানো মাধবীলতা গাছটায়। ঘন গোলাপি রঙের ফুলে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে চকচক করছে সেই আধো অন্ধকারেও। ওই একটাই ফুলগাছ ওদের। আর একটা লঙ্কাগাছ। স্বরূপ কাঁচালঙ্কা দিয়ে মুড়ি খেতে খুব ভালোবাসে। তাই বাপের বাড়ি থেকে এনে লাগিয়েছিল সে।
উঠোনের আর একদিকে স্বরূপ ওর সাইকেলটা রাখে। আর ওর দোকানের মালপত্রও। প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে। ছোট্ট ঘরে জায়গা হয়না।
সদর দরজার খিলটা কদিন হল বেহায়াপনা করছে। কিছুতেই লাগতে চায়না ঠিকমত। অবশ্য সব দোষ তার নয়। দরজার পাল্লাগুলো ক্রমশ নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়াচ্ছে। বহুদিনের সম্পর্ক তো। চীড় ধরেছে। সুজাতা বেহায়া খিলটা সরিয়ে দরজা খুলতেই দেখল পদ্মাদি দাঁড়িয়ে।
গড়িয়াহাটের ফুটপাতে স্বরূপের দোকানের পাশেই দোকান পেতে বসে পদ্মাদি। শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট নিয়ে। এখানে পাশেই দত্তদের বাড়িতে ভাড়া থাকে।স্বামীর হঠাৎই একটা স্ট্রোক হয়ে ডান হাতটা চলে যায়। সঙ্গে কারখানার কাজটাও। তারপর থেকেই পদ্মাদি এই ব্যবসা ধরেছে। স্বরূপই ব্যবসার সব খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়েছিল।
স্বরূপ অবশ্য সবরকম জামাকাপড়ই রাখে। ওর কলেজে পড়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতেই এ ব্যবসায় আসে। মেধাবী ছিল স্বরূপ। ভূগোল অনার্স নিয়েছিল। কিন্তু ল্যাব ফি,পরীক্ষার ফি সব মিলিয়ে যে টাকা লাগে তা স্বরূপ জোগাড় করতে পারেনি। ফাইনাল পরীক্ষার আগেই বাবার হার্ট অ্যাটাক। জেদের বশে পড়া ছেড়ে রোজগারে মন দেয়। সুজাতাও সায় দিয়েছিল। যদিও জানত বাবা স্বরূপের সঙ্গে বিয়ে মেনে নেবেনা। হকার জামাই কে'ই বা চায়। তবু সুজাতা স্বরূপের পাশ থেকে সরে যায়নি। মোটে দু'বছরের প্রেম হলেও কোনো খাদ ছিলনা তাতে। পিতৃহারা স্বরূপও সুজাতাকে কথা দিয়েছিল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেখাবে।
দাঁড়িয়েওছিল। বাঘাযতীন এ নতুন করে এই ঘরভাড়াও নিয়েছিল। শুধু এই লকডাউনে এসে...
পদ্মাদি একটা শিক ভাঙা কালো ছাতা মাথায় হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে। পদ্মাদির হাসিটা বেশ লাগে সুজাতার। বেশ ছোঁয়াচে। একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আছে যেটা বৃষ্টির পরের টাটকা বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। চাইলেও আর মুখ ভার করে থাকা যায়না। এই দুঃস্বপ্নের দিনেও কেমন ঝরঝরে মন!
"আরিব্বাস,কি সুন্দর রে তোর নাইটিটা! নির্ঘাত স্বরূপ আলাদা করে এনেছিল তোর জন্য। আনবেনা কেন। নতুন বউ তার ওপর এমন মিষ্টি আর সুন্দরী। বিয়ের পর থেকেই ছেলেটাকে দেখছি তো। বউয়ের প্রেমে একেবারে গদগদ! আগে কেমন গম্ভীর হয়ে থাকত। আর বিয়ের পর থেকে কেমন মিশুকে হয়েছিল।" পদ্মাদি কথাগুলো বলেই আবার হেসে উঠল। সুজাতা একটু লজ্জা পেল। পদ্মাদি এমনই। কত সহজে বলে দেয় মনে যা আসে। সুজাতা প্রত্যুত্তরে শুধু মুচকি হাসে।
"শোন,কাল আমাদের হকার্স ইউনিয়নের মিটিং আছে।আমাকে এই রতনদা ফোন করে জানাল। স্বরূপকেও জানাতে বলল। তাই ছুটে এলাম। এবার একটা কিছু ব্যবস্থা ঠিক হবে দেখিস। লোকাল ট্রেনও তো চালু হয়ে যাবে শুনছি।" সুজাতা ঘাড় নাড়ে।
পদ্মাদি কিছুতেই ভিতরে এসে বসতে চায়না। ওর ছেলেটা মাধ্যমিক দেবে। ফোনে রিচার্জ করেই ফিরে যাবে।আজকাল তো সব ক্লাস অনলাইনে হচ্ছে।
সুজাতা দরজায় খিল দিয়ে একবার মাধবীলতার ভিজে পাতায় হাত বোলাল। শিরশির করে উঠল ওর শরীর।ভাগ্যিস এই গাছটা স্বরূপ এনে দিয়েছিল ওকে। এমন বৃষ্টিভেজা রূপ নইলে কি আর দেখতে পেত।
ঘরে এসে ছাতাটা রেখে সুজাতার মনে পড়ল পদ্মাদির হাসিটা। স্বরূপ এমনিতে গম্ভীর হলে কি হবে সুজাতা জানে ভিতরে ভিতরে ও খুব আবেগপ্রবণ। ঠিক পাহাড়ের মত। সব চেপে রেখে। কিন্তু মাঝে মাঝে চোরা ঝর্ণা দিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসে স্রোত। কলেজে যখন প্রথম দেখেছিল ভেবেছিল নির্ঘাত খুব অহংকারী। কিন্তু ফ্রেশার্স ওয়েলকাম অনুষ্ঠানে ওর বক্তব্য শুনে বুঝেছিল গভীরে ঘুমন্ত একটা লাভাস্রোত। ভালো লেগেছিল তখনই।
ঘন নীল রঙের মেঘছাপ নাইটিটা আজ সুজাতা পরেছে। পদ্মাদির নাইটিটা দেখে পছন্দ হয়েছে। হবেই তো। বড্ড অন্যরকম দেখতে। নাইটিটা সুজাতা পরেছে দেখে আজ স্বরূপও খুব খুশি হবে। সুজাতা নাইটির গন্ধটা নিল। নতুন কাপড়ের গন্ধটা বেশ লাগে।
লকডাউনের আগে শেষবার যেদিন স্বরূপ ওর দোকানের জন্য মাল তুলেছিল সেদিন সব জামাকাপড়ের মধ্যে এই নাইটিটা ছিল। সুজাতা দেখেই লাফিয়ে উঠেছিল। নীল রঙের নাইটিটা। আর তার ওপর কালচে মেঘের ছাপ। যেন এক আকাশ বুকে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সত্যি যে বানিয়েছে তার প্রশংসা করতেই হবে। সুজাতার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখে স্বরূপ মৃদু হেসে বলেছিল," ওটা তবে সরিয়ে রাখো।"
তারপর থেকে পরাই হয়নি। তার পরদিনই তো লকডাউন হয়ে গেল। স্বরূপ এমন চিন্তায় ডুবে গেল। কটা দিন ভালো কাটলেও সুজাতা বুঝতে পারছিল ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছে স্বরূপ। মালের গাঁটরি খুলে রোজ একবার করে সেগুলো গুছত। বিকেল হলে বেরিয়ে গিয়ে লেকের ধারে বসে থাকত।
দিনকয়েক হল একটু আশার আলো দেখা গেছে। দেখা যাক। পদ্মাদিও তো বলল। কাল মিটিং।
দরজায় আবার খুট করে শব্দ হল। সুজাতা দৌড়ে গেল।
স্বরূপ ছাতাটা রেখে ঘরে ঢুকেই গিয়ে বসল বিছানায়। ঘাম আর বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাওয়া সেই জামাটা খুলে চেয়ারের গায়ে রেখে দিল শুধু। ওর হিসাবের খাতাটা নিয়ে বসল জানালার কাছটায়। মহাজনের কাছে অনেক টাকা ধার হয়ে গেছে। হয়ত সেই হিসাব। আজ তো ওখানেই গেছিল।
সুজাতা চা করবে কিনা ভাবতে লাগল। স্বরূপ কিছুই বললনা। পিতলের স্টোভটা কেমন যেন ভেংচি কেটে তাকিয়ে আছে সুজাতার দিকে। সুজাতার ভাবনাগুলো আজ সত্যি হয়নি বলে যেন কত খুশি। সুজাতা গুম হয়ে বসে রইল।
পৈতৃক সূত্রেই পাওয়া মস্ত দেয়ালঘড়িটা শুধু নিশ্চিন্তমনে টিকটিক করেই চলল। বৃষ্টির ঘুঙুরের শব্দ ভেদ করেও। যেন জ্যাঠামো করে বলতে চাইছে ,"সব ঠিক হয়ে যাবে।"
তারপর ঢং ঢং করে ন'খানা ঘন্টা বাজিয়ে যখন জানান দিল যে এবার সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে তখন স্বরূপ খাতাটা বন্ধ করে সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলল,"চলো খেয়ে নিই। কাল সকাল সকাল বেরতে হবে। বৃষ্টির যা বাহার। কাল রাস্তা জ্যাম হবেই।"
ব্যাস! এটুকু! সুজাতা মনের কোণে আসা মেঘ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। কিচ্ছুটি না বলে ভাত বাড়ল। ওবেলার ভাত। আজ গরম পর্যন্ত করা হলনা। সুজাতা স্টোভে হাত দেয়নি। বাবুর সেদিকেও হুঁশ নেই!
বিছানায় শুয়ে সুজাতা একটা কথাও বললনা। স্বরূপও চুপ।
ওদিকে আকাশ ফুঁড়ে যেন বৃষ্টি নামছে। ঝমঝম শব্দে একটা ঘোর লাগা ভাব যেন। মেঘছাপ নাইটিটা পরে আজ বোধহয় আর সমুদ্রে ভাসা হলনা। সুজাতা দীর্ঘশ্বাস চাপল।
স্বরূপ হঠাৎই বলে উঠল, "মুখ গোমড়া কেন আমার বউয়ের আজ? মহাজনের হিসেবটা মিটিয়ে রাখলাম। কাল একটা লোন...সে যাক, আমার অভিজ্ঞতা তো বলছে মেঘছাপ নাইটি পরে আজ আমার বউয়ের বৃষ্টি হওয়া উচিত আর তারপর.."
স্বরূপের কথা শেষ হলনা। সুজাতা ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বরূপের ওপর। মনের মেঘটা জমাট বেঁধে ভার যে।
মেঘছাপ নাইটিটা বৃষ্টি নামাল।
স্বরূপ বলে চলেছে কিসব যেন। আনলক এর কথা। নতুন একটা লোনও পাবে। সে কথা। সব পুরনো ধার শোধ করে দিয়ে..
সুজাতা শুনছিল না সেসব। সে তখন ভাবছে সমুদ্রের কথা। নোনা গন্ধটা আঁকড়ে তার কাগজের নৌকোটা সে ভাসিয়ে দিয়েছে। ঢেউ এর সঙ্গে ভেসে চলেছে সে নৌকো। সামনেই দিগন্ত! নৌকোটা পৌঁছে যাবেই।
ভাবতে দোষ কি!
আজি ঝড়ের রাতে
কো য়ে ল তা লু ক দা র
বিয়ের কয়েক মাস পরের কথা। স্ত্রী বাপের বাড়ি নাইওর চলে গিয়েছে। সকালবেলা খবরে কাগজ পড়ে জানতে পারলাম, আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। জানালা খুলে দেখি, বাইরে সত্যি সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে। মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। এমন বাদল দিনে আমি একা। ঘরে সে নেই। বিটিভি অন করতেই জানা গেল আবহাওয়ার খবর। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। এ রকম মেঘলা বৃষ্টি থাকবে নাকি আরো তিন দিন। খবরটা শুনে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেল।
ঘর থেকে বৃষ্টির মধ্যেই বড় কালো ছাতাটি নিয়ে বের হই। প্রথমে আজিজের হোটেলে গরম পরোটা খেয়ে নেই। তারপর চলে যাই অফিসে। অফিস থেকে ফিরে আসি সন্ধ্যায়। রাতেও ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাই আজিজের হোটেলে। শুনলাম ওরা নাকি আজ কচু দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করেছে। আমি ইলিশ মাছের অর্ডার দিলাম। মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসেছি. তখন বেয়ারা এসে বলল- 'স্যার রুই মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডালের ঘন্টো রান্না করা আছে, দিবো নাকি?' আমি বললাম- দাও । হোটেলে ভাত খেয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় দিয়ে ঘরে চলে এলাম।
বাড়িতে আর কেউ নেই। রাতে একা একা বিছানায় শুয়ে আছি। গ্রামীন পরিবেশ। বাংলো টাইপের ঘর। টিনের চালের উপর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে ঝোড়ো বাতাসও বইছে। হঠাৎ করেই জানালার কাঠের পাল্লা বাতাসে শব্দ করে দুলে ওঠে। ঘরের পশ্চিম পাশে বাঁশ ঝাড়। দমকা বাতাসে হেলানো বাঁশগুলো টিনের চালে ঘর্ষণ লেগে বিকট শব্দ হচ্ছিল। একা একা একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। ঘুমও আসছিল না। বিছানা থেকে উঠে এক পাশে এসে বসি। বৃষ্টি তখনও অঝোর ধারায় ঝরছে। খুব ইচ্ছা হলো রাতের এই বৃষ্টি দেখতে। দরজা খুলে বাইরে চলে আসি। ঘরের চাল থেকে বৃষ্টির জল তখন গড়িয়ে পড়ছে। আমি হাত দিয়ে সে জল ধরি। বাইরে নিস্তব্ধ নির্জন অন্ধকার। দূরে কেবল এয়ারপোর্ট টার্মিনালের আলোটাই দেখা যাচ্ছিল।
আমি ঘরের ভিতর এসে আবারও শুয়ে পড়ি। ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। বাইরে বাঁশ ঝাড়ে কোঁত কোঁত করে পেঁচা ডেকে উঠল। তার কিছু পরে বিমান বন্দর স্টেশনে ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি শুয়ে আছি, জানালাটা আরো একবার ঝোড়ো বাতাসে দুলে ওঠে। হঠাৎ বাইরে বারান্দার গেটে কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাই। একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম, তারপরও উঠে দরজা খুলে বারান্দায় চলে আসি। দেখলাম, আমার স্ত্রী বাইরে দাঁড়ানো। পরনের সালোয়ার কামিজ বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে। আমি এত রাতে তাকে দেখে বিস্মিত হই। গেট খুলে দিই। সে ভিতরে প্রবেশ করে।
ঘরের ভিতর আমার বিছানায় এসে সে বসলো। হাতে ওর একগুচ্ছ ভেজা কদমফুল। ফুলগুলো আমার হাতে দিয়ে বলল- 'আজ এই প্রথম বর্ষার রাতে তোমাকে আমার ভালোবাসায় সিক্ত করলাম।' আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে তার সুবাস নিই, তারপর বলি - 'হঠাৎ এত রাতে কি ভাবে তুমি এলে ?'
স্ত্রী: ট্রেনে চলে এলাম। পথে কোনো অসুবিধাই হয় নাই।
আমি: তোমার তো আরো পরে আসার কথা ছিল, এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?
স্ত্রী: সকালে বৃষ্টি দেখে তোমার কথা খুব মনে পড়ল। তুমি বৃষ্টি পছন্দ করো এবং সেই বৃষ্টির সময়ে আমি তোমার কাছে থাকব না তা কি করে হয়? এটা মনে করেই তোমার কাছে চলে এলাম।
আমি: এই ফুল কোথায় পেলে?
স্ত্রী: রাজেন্দ্রপুর স্টেশন থেকে কিনেছি।
সে তার গায়ের ভেজা জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিল। হঠাৎ এই বৃষ্টির রাতে ওকে পেয়ে চিত্ত আমার আনন্দে ভরে উঠল। আষাঢ়ের প্রথম দিনে সকালবেলায় যে শূন্যতা অনুভব করছিলাম, আজ এই রাতে তাকে কাছে পেয়ে মন প্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। দেখলাম, সে একটি সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। মুখে কোনো সাজ সজ্জা করা নেই। নির্মল প্রকৃতির মতো মুখ। কবেকার সেই লোধ্ররেণুও সে মাখেনি। পায়ে তার রূপার নুপুরটাও আজ পরে নাই। বৃষ্টির রিনঝিন ধ্বনি যেন তার পায়ে বাজছে। এই বৃষ্টি ঝর ঝর বাদল দিনে স্টিরিওতে কোমল মৃদমন্দ সুরে গান শুনতে ইচ্ছা করল--
'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার॥
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম--
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার॥
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্ নদীর পারে, গহন কোন্ বনের ধারে
গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার।'
গান বাজতে বাজতে একসময় গান থেমে যায়। বাইরে বৃষ্টির ধারা প্রবল হতে থাকে। দমকা বাতাস ঝড়ের রূপ নেয়। ঝুমঝুম শব্দে ভরে উঠল বাইরের পৃথিবী। কে কবি কখন লিখেছিল-- 'এমন দিনে কি তারে বলা যায় !' অথবা 'দুঁহ করে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।' তারপর বৃষ্টির রিমঝিম স্বপন দোলায় কখন ঘুমিয়ে গেছি, জানি নাই।
সকালে দেরি করেই আমার ঘুম ভাঙে। বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল। পাশে ফিরে দেখি বিছানায় সে নেই। ভাবলাম, আগেই ওর ঘুম ভেঙ্গেছে । হয়তো সে স্নান ঘরে গেছে। অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু সে আসে না। খুঁজলাম এ রুম ও রুমে, কোথাও সে নেই। ঘরের দরজা এবং বারান্দার গেটও বন্ধ। বিস্ময়ে ভাবছিলাম- তাহলে কোথায় গেল সে ! আলনায় রাতের ভেজা সালোয়ার কামিজ মেলে দেওয়া দেখলাম। খাটের কাছে গিয়ে দেখি-- রাতের কদম ফুলগুলো এলোমেলো হয়ে বিছানার উপরে পড়ে আছে।
ভাঙা গড়ার গল্প
স র্বা ণী রি ঙ্কু গো স্বা মী
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলেই পূবের জানলাটা হাট করে খুলে দেয় অমৃতা। মশার জ্বালাতনে বিকেল থেকেই জানলাগুলো বন্ধ থাকে এই ঋতুবদলের সময়টাতে। এমনিতেই ছোটবেলা থেকেই তার হঠাৎ করে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ধাত, মা বেঁচে থাকতে বারবার সাবধান করতো... "মাফলার জড়াও মণি, এক্ষুনি তো কাশি শুরু হবে!" দশবছর হলো মা চলে গেছে আর সেইসঙ্গে সঙ্গে এই মণি ডাকটাও, বাবা তো কবে থেকেই আবছা একটা ছবি। একটু পরেই ওর সারাদিনের কাজ শুরু হবে, মুখে চোখে জল দিয়ে ও খালিপায়ে নেমে আসে বাগানে। বেলামাসি সুস্থ থাকলে ফুল তুলে সাজিয়ে দেয় মায়ের আর ভাইয়ের ফটোতে।
যতদিন ভাই অশোক ছিলো অমৃতা নিজের সংসার করার ভাবনাকে একবারও প্রশ্রয় দেয় নি। হার্টের অসুখে মা যখন বছর পাঁচেক আগে চলে গেলো তখন অমৃতার হাত দুটো ধরে ছলছলে চোখে বলেছিল..."তোকে বেঁধে রেখে গেলাম রে মণি!" ততোদিনে অমৃতার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে, ভাইয়ের মুখ বেয়ে পড়া লালাটুকুও মুছিয়ে দিতে হয় অমৃতাকেই... খাওয়ানো শোয়ানো স্নান করানো সবই। মাত্রই পাঁচবছরের ফুটফুটে ছেলেটার মাথায় খেলতে গিয়ে একদিন ফুটবল এসে লাগলো পার্কে, তারপর নার্সিংহোম ডাক্তার হাসপাতালের চক্কর সমানে। কিচ্ছুটি উন্নতি হলোনা, সেই থেকে এই হুইলচেয়ার সঙ্গী। মা আর পারতো না নিজের হার্টের অসুখ সামলে, তখন থেকেই অমৃতার ওপর ভার। মাত্র তিনবছরের বড়ো দিদিই তখন দ্বিতীয় মা অশোকের, তারপর একদিন বেলামাসী এলো।
কলেজের প্রথমবর্ষে বাসে যেতে গিয়ে আলাপ হলো সীমান্তর সঙ্গে ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠতা। ভবিষ্যতে ঘর বাঁধবার স্বপ্নও যে দেখেনি দুজনে এমন নয়, বয়সটা তো সেই রকমই। কিন্তু বাড়ি ফিরে অশোকের সামনে এলেই একটা অসম্ভব অপরাধবোধ ঘিরে ধরতো অমৃতাকে। এই অসহায় ভাইটাকে ফেলে সে নিজের সংসারের কথা ভাবছে কি করে, এতটা স্বার্থপর সে কবে থেকে হলো। কতো রাত এই দোলাচলে স্রেফ তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে হিসেব নেই। সীমান্ত তাকে গভীর ভাবে ভালোবাসে কিন্তু তার তো একান্নবর্তী পরিবার সেখানে অমৃতা হয়তো মানিয়ে নেবে কিন্তু অশোক? খুব স্বাভাবিক যে কিছুতেই পরিবারের অন্যরা তার উপস্থিতি মেনে নেবে না। কি হবে অশোকের ভবিষ্যৎ... শিউরে উঠতো অমৃতা। একদিন হয়তো খবর পাবে বন্ধ দরজার ভেতর পড়ে আছে দুটো মৃতদেহ... মা আর ভাই!
নিজের অক্ষমতার কথা যেদিন সীমান্তকে জানিয়েছিল অমৃতা ততদিনে সীমান্ত অনেকদূর ভেবে ফেলেছে। কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিলো অমৃতার দিকে তারপর শুকনো হেসে বলেছিলো, "একদমই নাকচ করে দিলে? না হয় ঘরজামাই হতাম মজুমদার বাড়ির!" অমৃতা জানতো তা অসম্ভব, বলা যতটা সহজ সত্যি জীবন ততটাই কঠিন। একদিন এই সীমান্তই হয়তো অমৃতাকে দায়ী করবে ওর আত্মীয় স্বজনের থেকে ছিঁড়ে আনার জন্য তখন নিরপরাধ অশোক হবে নিমিত্ত। না এমনটা করতে পারবে না অমৃতা, কখনই না।
আস্তে আস্তে সে সীমান্তকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো, চেষ্টা করলো ভুলতেও। সহজ নয় মোটেই সহজ নয়, কতো যে চোখের জল কতো যে ঘুম নেই রাত। চোখের নীচে গাঢ় কালির পোঁচ মায়েরও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিলো, কিন্তু হাজার প্রশ্নেও অমৃতার মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারেননি। সমস্ত হৃদয় ভাঙা টুকরোগুলো একা দু হাতে কুড়িয়েছিলো অমৃতা, এই সময়ই স্কুলের চাকরিটা পেয়ে যেতে খানিকটা বেঁচে যায় সে আর বাবার পেনশনে চলা সংসারটাও।
স্কুল আর অশোক এই দুইয়ের মধ্যে নিজেকে টুকরো করে অমৃতা নিষ্কৃতি চেয়েছিলো। ও জানতো সীমান্তর কাছে ও অপরাধী থেকে যাবে সারাজীবন, সীমান্ত সত্যিই ওকে ভালোবাসতো। অমৃতা যেদিন ওর অপারগতার কথা সীমান্তকে বললো প্রথমটা সীমান্ত সত্যিই ভেবেছিলো অমৃতা বোকা বানাচ্ছে ওকে! যাচিয়ে দেখছে কি বলে সীমান্ত, তারপর অমৃতার চোখের জল স্তব্ধ করে দিয়েছিলো ওকেও। কি ভাবে যে বাড়ি ফিরেছিলো অমৃতা, ওই জানে। ওর নিজেকে একটা অসহায় পাখির মতো লেগেছিলো, ডানা ঝাপটানোই যার নিয়তি আর এই সংসারের খাঁচাতেই যার মৃত্যু লেখা আছে একদিন।
সীমান্তকে যখন একটু করে মুছে ফেলছে জীবনের স্লেট থেকে, নিজেকে ডুবিয়ে ফেলছে কাজ আর কর্তব্যে তখন মায়ের অসুখ বাড়াবাড়ি। মাও বুঝতে পারছিলো একটু করে মুঠো আলগা হচ্ছে জীবনের। প্রায়ই রাতে শোওয়ার পর চুপচাপ মাথায় হাত বোলাতো অমৃতার। ওষুধ দেওয়ার সময় হাত চেপে ধরতো, মায়ের ঠোঁটের কাঁপুনি দেখে অমৃতা বুঝতো কিছু একটা বলতে চাইছে মা কিন্তু জোর পাচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট হতো ওর কিন্তু মন শক্ত করে মৃদু শাসন করতো মাকে... "একদম এসব কান্নাকাটি নয় মা, ভাই ভয় পাবে!" বেলামাসী সব দেখতো আর হা হুতাশ করতো শুধু, ততোদিনে ও বাড়ির একজন হয়ে গেছে।
ওদের জীবন চলতো ঐ হুইলচেয়ারে বসা অশোককে কেন্দ্র করে। অশোক তখন রীতিমতো জোয়ান ওকে সমস্ত কিছু করানো অমৃতার ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছিল, মা আর বেলামাসী তো পারতোই না। ঠিক তখনই ওদের জীবনে আসে শাশ্বত, এমন মানুষদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্য বিশেষ ট্রেনিং ছিলো ওর। অমৃতার স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের কাছে অমৃতা ওর খোঁজ পায়। শাশ্বত এসে শুধু অশোকই নয়, তার চওড়া কাঁধে অমৃতাদের তিনজনের সংসারের অনেক দায়িত্বই তুলে নিয়েছিল বলা যায়। তার সবটুকুই যে পেশাদারিত্ব ছিলো এমনটা মা মনে করতেন না। "ছেলেটা তোকে ভালোবাসে, তুই ঘরে ঢুকলে ওর মুখটা কেমন আলো আলো হয়ে যায় মণি!" অমৃতা উত্তর দিত না মায়ের এইসব কথায়, স্বপ্ন দেখে না সে আর। বরং মাসের শেষে শাশ্বতর পাওনা মাইনেটা দেওয়ার চিন্তা ঘোরে তার মাথায়। টাকাটা খুব কম নয়, তার ইস্কুলের চাকরিটার জন্য এসব চালাতে পারছে নইলে হয়তো অশোক তারও বোঝা হয়ে যেত।
মায়ের যত বয়স হচ্ছে আর অসুস্থতা বাড়ছে ততই যেন অলৌকিক কিছু চিন্তাভাবনা মাথায় আসছে। মা এখনও ভাবে শাশ্বতর মতো কেউ সবল হাতে তুলে নেবে তাদের নড়বড়ে সংসার আর খুব মসৃণ ভাবে কেটে যাবে অমৃতাদের জীবন। ওসব অমৃতা ভাবে না, সে জানে এত সহজ নয় সবকিছু। অশোক তার নিজের ভাই তার প্রাণ, কিন্তু মাঝেমধ্যে তারও অসহ্য লাগে। একটা জোয়ান পুরুষ যদি পঙ্গু স্থবির হয়, সে যে কতটা বোঝা তা ঐ ওপর ওপর সহানুভূতি দেখানো মানুষদের তা বোঝার কথা নয়। একদিন শাশ্বতর কাছেও অশোক বোঝাই হবে, এই মাইনের খামটুকু মাঝখানে না থাকলেই। তাছাড়া সীমান্ত এখনও তার স্মৃতিতে অটুট, অমৃতা বিশ্বাসঘাতক নয়। সে ঠকায়নি সীমান্তকে, যতই সীমান্ত চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে যাক... তার কানে শাশ্বতর কথা ঠিকই পৌঁছবে... কি ভাববে অমৃতাকে তখন সে?
একথা ঠিকই যে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশিই অমৃতাদের বাড়িতে থাকে শাশ্বত, অশোককে অসম্ভব যত্ন করে। মায়ের সঙ্গে অনেক গল্প করে মায়ের বিছানার পাশে বসে বসে। অমৃতা যখন ইস্কুল থেকে ফেরে দেখে মায়ের কাছে জোর আড্ডা চলছে, মা শাশ্বত আর সর্বক্ষণের বেলামাসী আর পাশে হুইলচেয়ারে অশোক। অশোকের চোখের হাসিটুকু আশ্বস্ত করে অমৃতাকে... অযত্ন হয়নি ভাইয়ের। রবিবার শাশ্বতর ছুটি সেদিনটা অমৃতারই দায়িত্ব ভাইয়ের দেখাশোনা করার, সে লক্ষ্য করে ভাইয়ের দুহাতের নখ নিখুঁত ভাবে কাটা, পরিচ্ছন্ন শরীর আর একমাথা চুলে সদ্যই গতকাল শ্যাম্পু করা হয়েছে। এক এক রবিবার হঠাতই শাশ্বত উদয় হয় তার হাতে গরম সিঙাড়া বা কচুরি। অমৃতা অপ্রস্তুত হয় কিন্তু সে দেখে ভাইয়ের আলো হয়ে ওঠা মুখ আর মায়ের খুশিতে বিছানায় উঠে বসা। অমৃতা বোঝে শাশ্বত আসলেই আস্তে আস্তে এদের কাছে আপনজন হয়ে উঠছে, যাকে এরা নিজেদের একজন বলে ভাবতে চাইছে।
স্বস্তি পায় অমৃতা, কিন্তু জীবন তাকে শিখিয়েছে অনেক সমীকরণ বদলে যায় কালের আঁচড়ে। সে জানে সকলে খুব চায় সে শাশ্বতকে বিয়ে করে এইবার সংসারী হোক, আসল সংসার পেতে বসুক অবশেষে। অমৃতা নিজের মনে তোলপাড় করে এই প্রত্যাশাগুলো নিয়ে, তা হলে সে এতদিন যেটা করেছে তা ধুলোখেলা শুধু... সংসার নয়! খালি স্বামী স্ত্রী আর তাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই সংসার, এতদিনে পরিশ্রম ভালোবাসা সেবা সবকিছুই তাহলে মূল্যহীন। তার চোখে জল আসে, বুকের ভেতর উথলে ওঠে অভিমান… বরং সে একটা স্বার্থপর মেয়ে হতে পারতো। যে আঠারো হওয়ার আগেই নিজের বর নিজের ঘর এই ভাবনায় মেতে থাকে শুধু, ভাই আর মায়ের কথা ভেবে পাকা চুলে এক চতুর্থাংশ মাথা ভরিয়ে ফেলাটা বোকামোই হয়েছে বোধহয়। সে অবাক হয়ে দেখে মা ইতিমধ্যেই শাশ্বতকে জামাই ভাবতে শুরু করেছে আর অশোক জামাইবাবু, তারা ধরেই নিয়েছে শাশ্বত একবার বললে অমৃতা আর না করতে পারবে না। আর না করার মতো কীই বা আছে ওর, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে প্রায়!
আজকাল তার প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, নিঃশব্দে সে ভাইয়ের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, রাতে ভাইয়ের ঘরে মেঝেতে বিছানা পেতে বেলামাসী শোয় আর মায়ের ঘরে সে থাকে। অমৃতা ভাবে শাশ্বত বিয়ের কথা বললে ও বরং হ্যাঁ বলে দেবে, সম্ভাব্য আর অসম্ভাব্য নিয়ে ওর মনের ভেতর কাটাকুটি চলতে থাকে অনবরত। শাশ্বত কিন্তু কিছুই বলে না বরং এক সন্ধেয় উপস্থিত হয় ওর প্রেমিকা আর বিয়ের কার্ড নিয়ে। আগামী মাসে ওদের বিয়ে, বড়লোক শ্বশুরমশাই তার ব্যবসার অংশীদার করে ওদের বিদেশ পাঠাচ্ছেন। তিনি এতদিন বেঁকে বসেছিলেন বলেই শাশ্বত কিছু জানাতে পারেনি কাউকে, ওদের মুখের হাসি দেখে অমৃতা নিজের বুকের ভেতর পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পায়। মা এতো হতবাক হয়েছিল যে কথা বলতে পারছিলো না কোনো, অশোক ও। অমৃতাই দায়িত্ব নিয়ে ওদের মিষ্টি এনে দেয়, ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানায়। ওরা চলে যাওয়ার পর ওর শুকনো দু চোখ দেখে মা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, অশোক গোঁ গোঁ করতে থাকে... অমৃতার মনে হয় , বাঁচা গেছে।
এক সপ্তাহের মধ্যেই মা ছেড়ে চলে যায় ওদের, ক্রমাগত মন ভেঙে যাওয়ার ধকল তাঁর দুর্বল শরীর আর নিতে পারছিলো না। বেলামাসী মায়ের মৃতদেহের সামনে চিৎকার করে কাঁদে, "মাইয়াটারে কার হাতে দিয়া গ্যালে গো মা!" অমৃতা স্থির হয়ে বসে ভাবে আর নয়, এবার সে নিজেকে শুধু মানুষ বলে ভাববে। অটল থেকে সে মায়ের সমস্ত কাজ সারে, অশোককে দিয়ে মায়ের মুখাগ্নি করায়। উড়ে এসে উপদেশ দেওয়া আত্মীয়দের হাজার বলা সত্ত্বেও ভাইকে আর কোনো নিয়ম পালন করতে দেয় না, বেলামাসী ওদের দুজনের নিরামিষ রান্না করে। অমৃতা নিজে হবিষ্যি করে তারপর তিনদিন পর কাজ সেরে নেয়। মায়ের ছবিতে মালা দিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে মায়ের ইচ্ছা সে অপূর্ণ রাখবে না, তার সংসার হবে আর একাধিক বাচ্চাও!
কিছুদিন পরে সে শাশ্বতকে ফোন করে, মায়ের মৃত্যুসংবাদ শাশ্বতকে আন্তরিকভাবেই দুঃখিত করে। অমৃতা জানায় সে শাশ্বতর কাছ থেকে একটা সাহায্য চায়, কিছুটা অবাক হলেও শাশ্বত জানায় সে যথাসাধ্য সাহায্য করবে। শাশ্বতর সাহায্য নিয়ে অমৃতা কাজ শুরু করে, অশোকের সেবা করার অভিজ্ঞতা ওকে অনেকটা মনে জোর এনে দিয়েছিলো। কিছুদিনের মধ্যে নিজের বাড়িতে ও একটা অনাথ আশ্রম তৈরি করে, নাম দেয় "আশ্রয়"। সরকারী অনুমোদন পেতে দেরি হয়নি শাশ্বতর শ্বশুরমশাইয়ের চেষ্টায়, উপরন্তু তিনি কিছু অনুদান দেন নিজে আরো কিছু যোগাড় করে দেন।
বেলামাসী তো ছিলোই রান্নাবান্নার জন্য, অশোক ভীষণ খুশি হয়েছিলো আরো সঙ্গীসাথী পেয়ে। অমৃতার চাকরির থেকে পাওয়া টাকাগুলো এই ক্ষেত্রে খুব কাজে লেগে যায়, সময়ের আগেই স্বেচ্ছাবসর নেওয়ায় অতিরিক্ত কিছু টাকাও হাতে আসে ওর। এই "আশ্রয়ে" আসা ছেলেমেয়েগুলো ওকে মা বলে ডাকতে শিখেছে, অশোক চলে গেছে বেশ কিছুদিন হলো কিন্তু রয়ে গেছে বেলামাসী অমৃতা আর আশ্রয়। রোজ সকালে মা আর ভাইয়ের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ায় অমৃতা, মনে মনে বলে, "দেখো, আমাকে ভাঙতে পারেনি কেউ বরং আমিই আজ ওদের আশ্রয় হতে পেরেছি।" যতদিন জীবিত আছে অমৃতা এই আশ্রয়ের অমৃতা মা, ওর মৃত্যুর পর এই আশ্রয় চলে যাবে ট্রাস্টের হাতে, "অশোক রঞ্জন স্মৃতি সেবা সংস্থান", যে মানুষটা আসলেই অমৃতার জীবনে ভাঙা এবং গড়া দুইয়ের কারণ... ওর ভাই। সারাজীবন নিয়তি ওকে ভাঙনের মুখে এনে ফেলেছে, আজ ও গড়বে অন্য অনেকের জীবন... তবেই না সার্থক ওর নাম .. অমৃতা!
দশটা বছর থেকেও
মা লা চ্যা টা র্জ্জি
“হ্যাঁগো, মেমসাহেব, বুড়োটা নাকি খাওয়াবে?”
দরজা ঠেলে ঘরে কাজ করার জন্য ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলি বলে মনামী রক্ষিতের কাজের লোক
কাতির মা‘র মেয়ে পুটকী। মা কাজে না আসলে সে এসে মিসেস রক্ষিতের ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়। কাজ বলতে বাসন-মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, মোছা এইসব নিত্যনৈমিত্তিকের কাজ। ষোল বছরের পুটকীর কথাটা প্রথম বুঝতে পারেন নি মিসেস
রক্ষিত। চুপচাপ কিছুক্ষণ পুটকীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ বুঝতে পেরে বলে ওঠেন,
“কে বসাক দা, যার পনেরো দিন আগে বিয়ে হয়েছে?” কথাগুলি বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে
বলেন, “ভীমরতি , আগের বৌ মারা যাওয়ার পর এত বড়বড় কথা বললো, ধর্মতত্ব নিয়ে পড়ে থাকতো, মাছ, মাংস, ডিম ত্যাগ করলো, রুদ্রাক্ষের মালা পরলো এক বছর পেরিয়ে যাবার সাথে সাথে, সব নাটক ছেড়ে আবার বিয়ে! আমার বাবা ঠিকই বলেছিলেন, ও সব শ্মশান বৈরাগ্য। কবে খাওয়াবে
বসাকদা, জানিস?
—শুনেছি তো সামনের রবিবার। তোমাদের নেমন্তন্ন
করে নি বুড়োটা?
—না, ছাড় বসাকদার কথা। ভালোই হবে না বললে।
কথাগুলি বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ কোয়াটারের মূল ফটকে কলিংবেলের
আওয়াজ শুনে কে এসেছে দেখতে দরজা খুলতেই
মনামী রক্ষিত দেখেন মূল ফটকে দাঁড়িয়ে স্বয়ং বসাকদা। তাঁর দু‘চোখে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি।
“আসুন ভেতরে আসুন। ” মিসেস রক্ষিত বলতেই
বলেন,
—না ভেতরে আর যাবো না সামনের রবিবার তোমরা
বিকেলবেলা যেও, সামান্য জলখাবারের ব্যবস্থা
করেছি। রাজেশকেও বলো যেতে।
রাজেশ রক্ষিত মনামী রক্ষিতের স্বামী। ভদ্র, স্বল্পভাষী , দুর্গাপুর স্টীলপ্ল্যান্টে মাঝারিগোছের
অফিসার। বসাকদার সাথেই কাজ করেন।
বসাকদার আমন্ত্রণে রবিবার সন্ধ্যেবেলা মিসেস
রক্ষিত সপরিবারে গিয়ে দেখেন কলোনীর প্রায় সবাই সপরিবারে এসেছে।বসাকদা ও তাঁর দ্বিতীয়
পক্ষের বৌ অতসী বৌদি সাদরে সবাইকে বসতে বলেন। জলখাবারের প্যাকেটও সবার হাতে তুলে দেন। খেতে খেতে মনামী রক্ষিতের স্টীলপ্ল্যান্ট
কলোনীতে বসবাসকারী অবিবাহিত শৈবাল সরকারের কথা মনে হয়। সে দু‘দিন আগে
বলেছিল, “এটা কিন্তু বৌদি আপনাদের খুব অন্যায়,
বসাক বৌদির সাথে আপনারা কেউ আলাপ করতে
গেলেন না। ওনার কী দোষ বলুন তো?
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মিসেস রক্ষিত বলেছিলেন, “আলাপ, আটান্ন বছরের একটা বুড়োর বৌ-এর সাথে আবার আলাপ।”
শিল্পাঞ্চলের কলোনীতে বসাকদার বাড়ি সবার হাসির খোরাক হয়ে উঠেছিল। মিসেস রিমিতা কর
তো হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “বসাকদার ঘরে পর্দা লাগানো হয়েছে। এবার চলবে প্রেমপর্ব।”
তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই মিসেস আরতী নন্দী বলেছিলেন, “একি আর আমাদের মতো সংসারের স্বামী স্ত্রীর প্রেম, একেবারে... কথাটা শেষই করতে
পারলেন না হাসির দমকে।
আজ রবিবারেও আমন্ত্রণে এসে মিসেস আরতী নন্দী অনেকের সামনেই হঠাৎ বসাক বৌদিকে প্রশ্ন করে বসেন “ কী দেখে তুমি বিয়ে করলে গো বৌদি?” আচমকা প্রশ্নে মুহূর্তকাল চুপ থেকে ধীরে ধীরে অতসী বৌদি বলেন, ভাবলাম দুই ছেলে নিয়ে
ভদ্রলোক বিপদে পড়েছেন, দেখি না কিছু সাহায্য করতে পারি কি না। ”
—মিসেস আরতী নন্দী সাথে সাথে বলেন, “ওরা তো রামকৃষ্ণ মিশনের হস্টেলে থাকে, সাহায্যের
তো দরকার নেই।"
—ছুটিছাটাতে তো বাড়িতে আসবে, মা‘র আদরযত্ন যে তখন প্রয়োজন। মা না থাকলে মা‘র স্নেহ কে দেবে বলুন। একমুখ হেসে হেসে কথাগুলি বলে
চুপ করে যান অতসী বৌদি।
এসব কথা যখন হচ্ছিল তখন সেখানে এসে দাঁড়ান পাশের কোয়ার্টারের চন্দনদা‘র মা। আশেপাশের সবার তিনি মাসীমা।স্নেহময়ী, হাস্যজ্বল মাসীমাটিকে
সবাই খুব পছন্দ করেন। তিনি একমুখ হেসে বলেন, “ঠিকই তো মা, সন্তানের মা‘র ভালোবাসা
যে খুব প্রয়োজন আর রণি, রন্টি তো খুব বড় হয়ে ওঠেনি, ফোর আর ফাইভে তো পড়ে। আহা, ওদের মা সীমা যেদিন কাপড়ে আগুন লেগে মারা যায় সে দৃশ্য আজও ভুলতে পারি না বাছা। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে গিয়েই তো অঘটন ঘটে ছিল। পরনে সিন্থেটিক শাড়ি ছিল যে। আশি শতাংশই শরীরের পুড়ে যায়, বাঁচবে কিভাবে! তুমি মা ওদের মা হয়ে এসেছো, বাছারা এবার “মা” বলে ডাকতে পারবে। সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী যে তুমি মা, যেমন দেখতে তেমনি মিষ্টি কথাবার্তা।" চন্দনদা‘র মায়ের স্নেহমিশ্রিত কথায় দু‘চোখ চিকচিক করে ওঠে অতসী বৌদির। তাড়াতাড়ি
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই উপস্থিত সবার মাসীমা বলে ওঠেন, “চির আয়ুষ্মতী হও মা, স্বামী ছেলেদের নিয়ে সুখে থাকো।"
—তাই আশীর্বাদ করুন মাসীমা বলে দাঁত ছড়িয়ে
হাসেন অতসী বৌদি।
এরপর তো অনেক শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে যায়। রণি, রন্টিও স্কুলের গন্ডী ছেড়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। আর বসাকদা‘র বৌ অতসী বৌদি মাত্র
তিন দিনের জ্বরে প্রাণ হারায়। এবার আর বসাকদা প্রথম বৌ সীমা বৌদি চলে যাওয়াতে যে
মুহ্যমান হয়েছিলেন তা আর হননি। মিসেস রক্ষিত জানতে পারেন স্বামী রাজেশ রক্ষিতের কাছ থেকে বসাকদা রিটারমেন্টের পর খুব সুন্দর বাড়ি
করেছেন রাজারহাটে। দুই ছেলেও প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। তাদের বিয়েতে বসাকদার আন্তরিক আমন্ত্রণে রাজারহাটে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যানও। শুধু তিনিই সপরিবারে যান না মিসেস কর, মিসেস
নন্দী ও আরও অনেকে দুর্গাপুর স্টিলপ্ল্যান্ট থেকে আসেন।
বসাকদা‘র সাজানোগোছানো বাড়ি দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন মিসেস
রক্ষিত। প্রায় প্রতিটি ঘরেই দেখেন বসাকদা‘র প্রথমপক্ষের বৌ-সীমা বৌদির সুন্দর ছবি, তাতে
বড় রজনীগন্ধার মালা পরানো কিন্তু কোন ঘরেই অতসী বৌদির ছোটো একটা ছবিও নেই। হঠাৎ
অতসী বৌদির জন্য বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে মিসেস মনামী রক্ষিতের। মনে মনে ভাবেন দশটা
বছর বসাকদার সংসারে ওতপ্রোত জড়িয়ে থেকেও
এতটুকু মনে কি বাসা বাঁধেন নি তিনি কারও! মিসেস রক্ষিত কেঁদে ফেললেন। আশেপাশে কয়েকজন তাঁর কান্নার কারণ খুঁজে পেলেন না। তাঁরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
তাল-নবমী
সি রা জু ল ই স লা ম
ভাদ্রের মাঝামাঝি। ভাটি অঞ্চলের অনেক নদীই আজ মরে হেজে গেছে। ক্ষীণকায়া সেসব স্রোতস্বিনীর পাড়ে সহায়সম্বলহীন মানুষেরা বাঁচার শেষ আশ্রয়টুকু আঁকড়ে ধরে মাটি কামড়ে পড়ে আছে। কাজ নেই, কাম নেই অভাব এখানে নিত্য সঙ্গী। পেটের ধান্ধায় তাই অনেকেই পাড়ি জমিয়েছে উজানের দেশে। নিম্ন আয়ের মানুষগুলো উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে যা আয় করে, তা দিয়ে একজনার পেট চলা দায়। তারপরও চেষ্টাচরিত্র চলে দু'পয়সা ডেড়ী করে একদিন ঘরে ফিরবে; বউ ছেলেমেয়ের মুখে হাসি ফোটাবে। মিথ্যে আশায় আশায় শহরের মোহে পড়ে একদিন যান্ত্রিকসভ্যতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয় মানুষ। জৈবিক চাহিদার কাছে ম্লান হয়ে আসে পিছনে ফেলে আসা ঘর সংসার। আস্তে আস্তে স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে যায়।
বাবার স্মৃতিটাও ঝাপসা হয়ে গেছে হাসান আর ফাতিমার কাছে। দশ আর চৌদ্দ বছরের দু'ভাইবোন। পিঠোপিঠি না জন্মালেও দু'জনারই এক আত্মা এক প্রাণ। জ্ঞান হওয়া অবধি যা কিছু কাজ দু'ভাইবোন মিলেই করে। নির্জন অজ পাড়াগাঁয়ে তাদের সাথে মিশবার মত নেই কোন সাথী। গরীব বলে সবাই কেমন অবজ্ঞা করে; এড়িয়ে চলে। বাবা রহিম শেখ একদিন কাজের সন্ধানে বিভূঁইয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। ফাতেমা তখন চার বছরের আর হাসান কোলে। নিজের বাপের মুখের আদলটা তাই আর মনে নেই দু'জনেরই।
হাসানের বয়স যখন দুই আর ফাতিমার ছয়; ওদের মায়ের আবারও বিয়ে হলো বাবুদের বাড়ীর পেটেভাতে কিষেন আবুলের সাথে। হ্যাংলা পাৎলা আর সারাবছর রোগে ভোগা মানুষটাকে দেখলে মনে হয় ভিজেবেড়াল। যেন কিছুই বোঝে না। যেমন খেতে পারে আর তার মেজাজটাও তেমনি তিরিক্ষে, এতদিনে তা বুঝে গেছে হাসান আর ফাতিমা দু'জনেই। কারণ এ দু'টোকে সহ্যই করতে পারে না আবুল। কথায় কথার খ্যাঁক্ করে ওঠে ওদের ওপর।
পেটের সন্তানের হেনস্থা দেখেও নীরবে অভিমানে দাঁতে দাঁত চেপে সব কষ্ট সহ্য করে আছিরণ। এ ছাড়া উপায়ই বা কি! প্রতিবাদ করতে গিয়ে দু'এক ঘা পড়েছে নিজের ঘাড়েও কখনো কখনো। তাছাড়া স্বামী নামের সার্টিফিকেট সম্বল করেই তো আরো দু'টো ট্যাঁ ফ্যাঁ জন্মেছে। সব পুরুষই এক, প্রয়োজন ফুরোলেই ভোঁ-কাট্টা ঘুড়ির মত পাল্টি খেয়ে অনেক দূরে সরে যায়,- ভেবে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আছিরনের দেহাভ্যন্তর থেকে।
সেবার, ফাতিমার বাবা চলে গেলে সংসারের হাল ধরতে বাবুদের বাড়ীতে ঝিয়ের কাজ জুটিয়ে নেয় আছিরন। কোলের বাচ্চাটা ফাতিমার দায়িত্বে দিয়ে সংসারের কাজ সারতে হয় তাকে। কেঁদে কঁকিয়ে গড়াগড়ি খায় হাসান। শিশু ভাইটাকে সামলাতে হিমসিম খেতে হয় ফাতিমাকে। সেদিকে তাকিয়ে দেখার মত ফুসরৎ হয়না আছিরনের। বাবুবাড়ীর কাজের ধকলে নাজেহাল বেচারী।
কারণে অকারণে মাঠ থেকে ফিরে আসে আবুল। হাসানকে কোলে তুলে নিয়ে আদরযত্নে কান্না ভুলিয়ে দেয়। দু'ভাইবোনের প্রতি তার বিশেষ যত্ন। মতিগতি দেখে একদিন বাবুবাড়ীর গিন্নীমা প্রস্তাব দেয় আবুল আর আছিরনকে। সুচতুরা গিন্নীমা এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুদূর পরিকল্পনা করেই এ প্রস্তাব করেছিলেন। বিনিপয়সায় তাহলে আবুল আর আছিরনকে রেখে দেয়া যাবে পাকাপোক্ত ভাবে।
অকূল দরিয়ায় ভেসে যাওয়া খোলাম-কুচির মত স্বামী পরিত্যক্তা আছিরনের সামনের পৃথিবীটা তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছেলেমেয়ে দু'টোর ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এ বিয়েতে সম্মত হয় আছিরন। তাছাড়া বাচ্চাদু'টোর প্রতি আবুলের প্রগাঢ় ভালোবাসা দেখে মনে মনে মুগ্ধ হয় আছিরন। শক্ত আশ্রয়ের সন্ধান পায় আবুলের মধ্যে। সলাজে কত কথার ফানুস ওড়ায় দু'জনে কাজের ফাঁকেফাঁকে। অথচ বিয়ের পর মানুষটা সম্পূর্ণ বিপরীত রূপ। পান থেকে চুন খসবার উপায় নেই। হাসান আর ফাতিমার কাছে মূূর্তমান আতঙ্ক, যমদূত।
খড়িওঠা দেহ। অনাহারের অপুষ্টি, অবহেলায় অজীর্ণ পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে দাউদাউ। দু'ভাইবোন তাই বাবুদের বাগানে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। কাক-পক্ষিও যখন ওঠে না-, দু'ভাইবোন সেই ঝুপসী আঁধার থাকতেই চলে আসে কষাঢ় অন্ধকার এই বাগানে। রাতে ঝরে পড়া নারকেল পেয়ারা পেঁপে কিছু না কিছু পেয়ে যায় প্রতিদিন-। দু'ভাইবোন মহাখুশি। বাড়ীতে নিয়ে ভাইবোন মহা উল্লাসে সেসব খায়।
জ্যৈষ্ঠ মাসের দমকা বাতাসকে দু'ভাইবোন খুউব ভালোবাসে। কারণ এই বাতাসে টুপটাপ ঝরে পড়ে আম। প্রতিদিন এই এত্তো এত্তো আম কুড়োয় দু'ভাইবোন। কিশোরের উন্মাদনায় ভরা দিনগুলো মানে না শাসন মানে না বারণ। নিভৃত পল্লীর অনামী এই কিশোর কিশোরীকে শাসন করে মানুষ করার কেইবা আছে।
আজ দু'দিন ধরে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। থামবার কোন লক্ষণ নেই। রাস্তাঘাট সব ডুবে গেছে। মনে হচ্ছে আকাশ বন্যায় ভেসে যাবে পৃথিবীটা এবার। গতকাল সন্ধ্যায় বাবুদের বাড়ীতে তাল রান্না হয়েছে। মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে এসেছে সমস্ত এলাকায়। নলেন গুড়ের ম ম গন্ধ। হাসান আর ফাতিমা রাতে শুয়ে শুয়ে ছক কষে। আগামীকাল ভোরে সোনা-দহ'র পাড়ের সেই তালতলায় গেলে দু'একটা পাকা তাল নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর আজকের কুড়িয়ে পাওয়া ঝুনো নারকোলটা তো আছেই। বেশ মজা হবে, খুশিতে ছটফট করে দু'ভাইবোন।
মালোপাড়ার তাল-নবমীর উৎসবে যে খুশির বান ডেকেছে, তার ছোঁয়া এসে লেগেছে অনাহারক্লিষ্ট, হতদরিদ্র কিশোর বয়সী দু'ভাইবোনের মনে। অশিক্ষিত দু'টি কচি নিষ্পাপ মনে যে স্বর্নাভ দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে তার আলো কোন শিক্ষিত সভ্য মানুষের দরবারে পৌঁছবে না। বিজাতীয় সংস্কারের নির্মল ছোঁয়ায় সভ্যতায় জড়ানো মানুষেরা এদেরকে কুচ্ছিৎ বলে দূরে তাড়িয়ে দেবে।
সোনাদহ!
এলাকার মানুষের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা, বলা চলে কুসংস্কার-, এই সোনাদহ প্রতিবছর "কর" নেয়। এর জলে একবার কেউ নামলে সে আর উঠে আসে না। কবে কোন এক জমিদার এটা খুঁড়িয়েছিলেন, তার হিসাব আজ আর কারো কাছে নেই। তবে সেই আদ্যিকাল থেকে জনশ্রুতি হয়ে আসছে "অপয়া দহ" হিসেবে এই সোনাদহ। একপাড়ে সারিসারি তালগাছ। দহের পশ্চিমপাড় ভেঙে নদীর সাথে একাকার হয়ে আছে। দু'দিনের বন্যায় তাই সোনাদহের রণরঙ্গিনী রূপ। উজান থেকে ধেয়ে আসা জলের স্রোত পাক খেয়ে খেয়ে সশব্দে দু'কূল ছাপিয়ে ছুটে চলেছে ভাঁটির দিকে। সেই স্রোতধারায় দু'একটা মরা গরু ছাগলও যে মিশে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাড়ভাঙা গাছপালা তো আছেই।
ঝুপসী কালো অন্ধকারে হাসান আর ফাতিমা যখন সোনাদহের পাড়ে এসে পৌছুলো, ঝিরঝির বৃষ্টি আর প্রচন্ড বাতাসের দাপট রয়েছে তখনও। বড় দেখে একটা মানকচু পাতা কেটে দু'ভাইবোন মিলে মাথাটা ঢাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে দু'জনারই। ঠান্ডা আবহাওয়ায় শীতের কনকনানি টের পায় দেহ। মানিকতলার তালতলায় এসে খুঁজেখুঁজে মাত্র দু'টো তাল পেয়েছে। আরও একটু খুঁজে পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দু'ভাইবোন। ওদিকে সোনাদহের পাড়ে মনে হচ্ছে একটা তাল পড়ে আছে। দু'ভাইবোনের মুখে খুশির হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে। অনাবিল অপার সৌন্দর্যে দু'ভাইবোন পরস্পর চেয়ে দেখে দু'জন দুজনাকে। ছোট্ট ভাইটার বৃষ্টিস্নাত মুখটা দেখে কিশোরী ফাতিমার বুকটা হঠাৎ কেন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। কষ্টের লোনাজল বেরিয়ে আসে দু'চোখ বেয়ে। ভাগ্য ভালো বৃষ্টির জলে তা ধুয়ে গেছে ; তা না হলে হাসানের সামনে তাকে বেশ লজ্জায় পড়তে হতো।
কে আগে তালটা ধরবে, দু'ভাইবোনের মধ্যে হিসাব হয়। হাসান বলে, আমি আগে দেখেছি অতএব আমিই নিয়ে আসি! ফাতিমার যুক্তি, 'দহের পাড় ভালো না, নরম মাটি ভেঙে পড়বে। সুতরাং আমিই নিয়ে আসি। " এ নিয়ে দু'জনাতে মান অভিমান হয়। অবশেষে ভাইকে খুশি করার জন্য ফাতিমা রাজী হয়। হাসানকে তালটা নিয়ে আসতে বলে।
সোনাদহের শুকনো পাড় এতদিনে খটখটে পাথর হয়ে ছিলো। প্রবল বর্ষায় এখন যেন একেবারে কুমোরপাড়ার ছলকানো কাদা। দুরন্ত বন্যার ঘূর্নীতে পাড়ের মাটি ক্ষয়ে ভেঙে গেছে ভেতরে ভেতরে। অসীম অতল জলের গহ্বরে টেনে নিয়ে যাবে যেকোন সময়। ওপরের মাটি দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরের ভাঙ্গনের রূপ। শুধু নিকষকালো অথৈজলে পাক খেয়ে চলে যাচ্ছে ভেসে আসা খড়কুটো, কচুরিপানা, শ্যাওলার দঙ্গল।
ফাতিমার হাতে মানকচূর পাতাটা ধরিয়ে দিয়ে বেশ তৃপ্ত হাসিতে বিজয়গৌরবে হেঁটে যায় হাসান। তালটা কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসার সময় মনে হলো শরীরের ভারটা হাল্কা হয়ে আসছে তার। পায়ের তলার মাটি যেন তেমন জোরালো নয়। ভয়ে বুকটা ধ্বক্ করে ওঠে। ফাতিমাকে ডাক দেয় চিৎকার করে।
যখন বড় হবে, ভাইটাকে নিজের কাছে রেখে দেবে সে। সবেমাত্র কল্পনার জাল বুনতে শুরু করেছে ফাতিমা। হাসানের চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে চেয়ে দেখে, ঝুপ করে পাড় ভেঙে সোনাদহের অতলে তলিয়ে গেলো হাসান। বন্যাজল পাক খেয়েখেয়ে পাড়ভাঙা ঘোলাজল হাসানের ছোট্ট দেহটাকে টেনে নিয়ে গেছে সোনাদহের মাঝ বরাবর। চিৎকার করতে যেয়েও কোন শব্দ বের হয় না ফাতিমার মুখে।
আকাশে শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ।
ঝাটু মাহাত্ম্য
স হ স্রাং শু মা ই তি
"এ্যই ঝাটু চা আন'- জোরে চিৎকার করে বললাম।
ঝাটুর সাড়া নেই--
অথচ অফিসের সামনে ওর মরচে ধরা বাদামি সাইকেলটা দেখতে পাচ্ছি। রুজি রুটি বলতে দীঘায় আমার লজ হোটেল। প্রতিদিন সকাল সকাল আমি আমার হোটেলে যাই। অফিসের কেদারায় বসে প্রথমে চা খাই। ঝাটুই আনে। ও আমার অপেক্ষায় থাকে, প্রথমে চা দেবে। তারপর হোটেলের রুম পরিষ্কারের কাজে লাগবে। হোটেলে ঢোকার সময় গেটের সামনে বাইকটা দেবদারু গাছের তলায় রাখতে গিয়ে নজরে পড়ল ঝুঁকে পড়া নিচের একটা ডালে গামছায় পুটলি বাঁধা। বিবর্ন গামছাটা রক্ত, রক্তরসের ছিঁটে, রক্ত ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ছে। দেখে ততোটা গুরুত্ব দিইনি তবে কৌতুহল ছিল।
"কোথায় গেলি" চিৎকার শুনে হোটেল কেয়ার টেকার শিবু হাজির।
-ঝাটু কোথায় ?
-ঝাটু চান করছে।
এই শীতের সকালে বার চৌদ্দ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসে চান করছে!
আঙ্গুল দেখিয়ে একটু দূরে গাছটায় গামছার পোটলাটা দেখালাম। শিবু কে জিজ্ঞাসা করলাম -
-ওটা কি?
-ঝাটুর পোঁটলা, ঝাটু জানে।
ততক্ষনে ঝাটু চান করে ফিটফাইন হয়ে টেরি বাগিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে- শীতে কাঁপছে। বিনয়ী ভাবে বলল-"বাবু চা নিয়ে আসি'- বলেই সামনের চায়ের দোকানে গেল। এবার শিবুর কাছে হোটেলের খবরাখবর নিলাম।কমবেশী টুরিস্ট হচ্ছে। টাকা পয়সার হিসাব নেবো, আগে চা-টা খেয়ে নিই। ততক্ষনে ঝাটু কাপে করে চা, প্লেটে বিস্কুট টেবিলে রেখেছে। অনেকক্ষণ চা খাইনি, কাপটা হাতে তুলে, চোখ গাছের পোঁটলাতে পড়তে জিজ্ঞাসা করলাম- ওটা কার?
গামছার পোঁটলায় নজর ফেলে নিঃসঙ্কোচে বলল- 'আমার'।
-কি আছে?
এবার মাথা নত ঝাটুর।
-চামড়া।
-কিসের?
-গরুর।
-গরুর! কোথায় পেলি?
-ভাগাড়ে।
-ভাগাড়ে!
আমি বাকরুদ্ধ! এর হাতে চা খাই!! হাতের চায়ের কাপ সোজা ছুঁড়ে মারলাম- ওর পাশকাটাতে দূরে পড়ে ভেঙে চৌচির হল। পায়ের তালু থেকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলছে। কাঁপছি ক্রোধে-
-তুই ভাগাড়ের মরা গরুর চামড়া তুলিস। আর আমি এত দিন তোর হাতে চা খাই! ইস্! ভেবেছিস্ কি? অভিধানে যে ভাষা পাওয়া যাবেনা, এখানকার কথ্য ভাষায় অকথ্য গালিগালাজ করলাম। রাগের চোটে এতটাই কাঁপছি সোজা হতেও পারছিনা।সপাটে টেনে চাটি মারতেও ঘেন্না-
বকতে বকতে এসে বাইক স্টার্ট দিলাম। আসার সময় শিবুকে বলে এলাম -ওকে ঘাড় ধরে বের করে দে। আর যেন হোটেলে কাজে না আসে। বাড়ী গিয়ে ভালো করে একটা শুদ্ধ স্নান সেরে নিলাম। পর দিন থেকে আর কাজে আসেনি। খুব খারাপ লাগলো, কাজটা না ছাড়ালে হত। এতটা না বকলে হত। বড্ড অনুগত ছিল। এত বকছিলাম যখন-অপরাধীর মত মাথা নত করে সব শুনে গেছে। গরিব তো! দুটো পয়সার জন্য কি না করে! অপরাধ তো করেনি! চুরি ও করেনি, ওদের অনেকেই করে।
তার পর ঝাটুর কথা ভুলেই গেছিলাম। কিছুদিন পর কাছে এক বিয়েবাড়ি। বিশাল ব্যন্ডপার্টি খুব জমিয়ে বাজনা বাজিয়ে বরকনে নিয়ে চলেছে- ঐ ঝাটু ব্যন্ড পোশাকে গলায় মস্ত ব্যন্ডড্রাম ঝুলিয়ে ড্রিমম ড্রিমম বাজিয়ে এগিয়ে চলছে। অবাক হইনি। দেখে ভালো লাগলো- কিছু করে রোজগার করছে। মনে মনে আশির্বাদ করলাম -ভালোথাকিস!
কিছু দিন পর- দীঘায় কোন এক ফাংশান হবে। কোলকাতা থেকে শিল্পী আসছে গান করতে। শুনে সন্ধ্যেবেলা গেছি দেখতে- দেখি শিল্পী হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান ধরেছে, বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে মাথা দুলিয়ে তবলায় সঙ্গত করছে সেই ঝাটু। ওদের তবলচি সমুদ্র ধারে চিংড়ি চপ খেয়ে লুজ মোশান, হাসপাতালে ভর্তি। গান গাইছেন দিকপাল শিল্পী, তবলায় সঙ্গতে- আমার খ্যদানো সেই ঝাটু। মনটা ওর জন্য 'বাহ!'বলে উঠল। ততোটা না বুঝলেও শিল্পীর সাবলীল গাওয়াতে বুঝলাম ভালোই বাজাতে জানে। ওরা এসব চর্চাও করে। পাশের বাড়িতে কালীপুজো- রাতভর মাঝে মাঝে ঢাকির ঢ্যংকুড় কুড় বাজনা ভেসে আসে। গিয়ে দেখি সেখানেও ঝাটু। তালে তালে দুলে দুলে নেচে নেচে ঢাক্ বাজিয়ে চলেছে। পৌষ পার্বণ মেলা- মেয়ে বৌ নিয়ে সমুদ্রধারে মেলায় গেছি। ঝুড়ি, পালি, কুলো, চুপড়ি, ফুলসাজি আরো কতকি নিয়ে দোকান। বেত ও বাঁশের তৈরী। দোকানে বৌ সংসারে ব্যবহার্য কয়েকটা জিনিস বাছলো। দরদাম করতে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ঝাটু। -কত করে?
দাম জিজ্ঞেস করাতে মুখ তুলে মুচকি হাসলো। সেই ভুবন ভোলানো হাসি। এসে মেলার মাঝখানে পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করল। দরদাম করতে হলনা।পয়সা নেবেনা- জোরকরে কিছু টাকা গুঁজে দিলাম। কেমন আছিস?, কি করছিস?, সংসারে কজন?- এসব কথাতে জানলাম দোকানের সব জিনিস বাঁশ,বেত থেকে নিজেরাই বানায়। মেলায় মেলায় বেচতে যায়। মেয়ের হাতে একটা ফুলের ঝাঁপি জোর করে গুঁজে দিয়ে বলল বৌ বানিয়েছে, দাম নেবো না। বৌকে নিয়ে বাড়িতে আসতে বলব কি বলব না ভাবতে ভাবতে কিছু বলা হল না। ভালো থাকিস বলে চলে এলাম।
হায়রে মানুষ আমি এমন বিধানে মনুষত্ব তৈরী করেছি! নিজেকে বার কতক "ছিঃ" বললাম। ওর হাতে তৈরী সাজির ফুলে আমার গৃহ দেবতার পূজা হবে। ও তবলা সঙ্গতে আমার মন ভরিয়ে দিল। ও ব্যন্ড বাজিয়ে নব দম্পতির শুভ জীবনের সূচনা করল। দেবী বন্দনায় ওদের ঢাক বাদ্যে মুখরিত হয়। তবু সে দিন---
সময় গেছে, কে কার কথা মনে রাখে! এক দিন দুপুরে খেতে বসছি- বাড়িতে হাজির সেই ঝাটু।
ঘরের গেটের বাহিরে ডাকে-"বাবু আছেন-" সাড়া দিয়ে বাইরে এলাম। কি জীর্ণ শরীর। পেটটা ফুলে গেছে। চোখগুলো গর্তে,
কিছু টাকা সাহায্য চাইল চিকিৎসার জন্য। কিছু দিলামও। হাত জোড় প্রণাম করে বলে গেল বাবু 'সুস্থ হলে দেখা করে যাবো।'
অনেক বছর হল সে আর আসেনি। আসবে বলে মনে হয় না- যদি ফিরে আসে- ওকে যে বকে ছিলাম যদি ক্ষমা পাই---!
চাই না থাকতে বৃদ্ধাশ্রমে
সা দে কু ল ই স লা ম
পবিত্র রমজান শেষের দিকে, ঈদুল ফিতরের ছুটিতে বাসায় গিয়ে মনোস্থির করলাম, এবার ঈদ উৎযাপন করবো একটা বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় লোকদের সাথে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ, ঈদের দিন সকালে মিষ্টান্ন নিয়ে গেলাম এক বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে গিয়ে সবার সাথে কথা বললাম, মিষ্টান্ন(সেমাই) খাওয়ার সময় এক বৃদ্ধ(৭০) প্লেট হাতে নিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো। ওনার কান্না দেখে এগিয়ে এসে বসে পড়লাম তার পাশে। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম,"বাবা আপনি কাঁদছেন কেন?"
উত্তরে বৃদ্ধ লোকটি বলতে লাগলেন তার জীবনে ফেলে আসা অতীত স্মৃতির কিছু গল্প।
হাউ মাউ করে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন, আর পাগলের মতো বিলাপ করে বলতে লাগলেন,
"আজ খুব মনে পরতেছে আমার ছেলে নিলয়ের শৈশবের কথা। ও যখন ছোট্ট ছিল, তখন ওর মা হঠাৎ তাকে রেখে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ও সবসময় কাঁদতো, আমি তার জন্য কোথাও যেতে পারতামনা, তাকে সবসময় আগলে রাখতাম আমার বাহুডোরে। তাকে না খাইয়ে আমি কোনোদিন এক ফোঁটা পানিও মুখে দিতাম না, তাকে না ঘুম না পাড়িয়ে আমি কখনোই দু'চোখ বন্ধ করতাম না। এসব বলতে বলতে বৃদ্ধ হুহু করে কেঁদে দিলেন---
নিজেকে সংযত করে তিনি আবার বলতে লাগলেন, "আমি যখন একাই সব কাজ করতাম, তাকে সামলাতাম, আমার খুব কষ্ট হতো, তখন সবাই বলতো আমাকে একটা বিয়ে করতে,
আমি না করে দিয়েছিলাম।
কেন জানেন? তার সৎ মা যদি তাকে আদর না করে এই ভয়ে।
ও যখন বড় হয়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো তখন শুরু হলো তার আর আমার মাঝে দূরত্ব। আমি বাসায় আর ও থাকতো বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। ও না চাইতেই আমি ওর সব চাওয়া পুরণ করতাম।
তার কোনো কিছুতেই অভাব রাখতাম না। ও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ভালো একটা চাকুরী নিলো, কিছুদিন পর বিয়ে করলো। হুহুহুহু...(ডুকরে কেঁদে উঠে বৃদ্ধ)।
বিয়ের পর ও আমাকে শহরে নিয়ে যায় ওর বাসায়। কিছুদিন বউমা, আমি ও সে, আমরা একসাথে বেশ ভালোই ছিলাম।একদিন হঠাৎ করে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম, আমার বাম পা অবশ হয়ে গেলো, চিকিৎসা করার পরেও খুব বেশি একটা সুস্থ হতে পারলাম না। আমি হাঁটতে পারতাম না বলে আমার হাতের নাগালে সব এনে দিতে হতো, কিছুদিন সহ্য করলেও আস্তে আস্তে বউমা ও আমার ছেলে বিরক্ত হয়ে গেল আমার উপর, আমার যত্ন নেয়াটা তাদের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে গেলো।
আমায় রেখে আসলো বৃদ্ধাশ্রমে।
বৃদ্ধের কথা গুলো শুনে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো চোখের পানি। আমি হতভম্ব হয়ে শুনতে লাগলাম তার করুণ ইতিহাস। বৃদ্ধ দু'হাতে তার চোখের পানি মুছে আবারো বলতে লাগলেন, বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে কেমন যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসে বাবা। আমার ছেলের কথা খুব মনে পড়ে। জানিনা ও কেমন আছে? ও তো ভুলেও এই বৃদ্ধ বাবাটার খবর নেয়না। এখানকার খাবার খেতে আর ভালো লাগেনা, কতদিন ভালো কিছু খাইনা। ছোটবেলায় তাকে কত আদর করে খাওয়াতাম, সেই স্মৃতি খুব মনে পড়ে।
বৃদ্ধ হুহু করে কাঁদতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, "ও খোকা! তোর এই বাবাটাকে নিয়ে যা তোর কাছে!
আমি কোনো আবদার করবোনা, ধরবোনা কোনো বায়না। শুধু তোর পাশে থেকেই মরতে চাই, তোকে ভীষণ ভালোবাসিরে খোকা!
আমি আর 'থাকতে চাইনা বৃদ্ধাশ্রমে"।
অপেক্ষা
জা রি ন আ না ন
সে বেশ আগের কথা। সময়ের ঘড়িতে তখন দিনের আলো এক ঘন্টা এগিয়ে আসেনি কিম্বা সিডর আইলা ও হয়নি। সেই তখনকার দিনের কথা।
একদিন এক ঝড়ের রাতে পথ হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট একটা টুনটুনি পাখি আশ্রয় নিলো জারিনদের বাগানে জবা ফুলের গাছের ডালে। ঝড়ের দাপটে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া জবাগাছটা টেরই পায়নি কখন যেন ছোট্ট টুনটুনিটা এসে তার ডালের আড়ালে পাতার ফাঁকে চুপটি করে বসে আছে। যখন জবাগাছটা টের পেলো, তখন টুনটুনি পাখিটা ঠান্ডায় জমে গেছে। টুনটুনির দুঃখ দেখে নিজের ভাঙা ডালপালার কষ্ট ভুলে জবাগাছটা পরম মমতায় টুনটুনি পাখিটাকে আগলে রাখলো। মাঝরাতে ঝড়বৃষ্টির দাপট থেমে এলে জবাগাছ আর টুনটুনি নিজেদের কথা একে অপরকে জানালো। টুনটুনি জানালো, আকাশে মেঘ দেখে সন্ধ্যার সময় তার বাবা-মা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে উড়তে শুরু করে। আর অমনি শুরু হলো দমকা হাওয়া। ঝড়ো বাতাসে অন্ধকারে পথ হারিয়ে বাবা-মাকে খুঁজতে খুঁজতে টুনটুনি এখানে এসেছে। বলেই কান্না শুরু করলো। টুনটুনিকে সান্ত্বনা দিয়ে জবাগাছটা বললো, "ভয় পেও না। সকাল হলেই তুমি তোমার বাবা-মাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। আর আমি তো এখন তোমার বন্ধু হয়েই গেলাম। আমার এখানে খেলা করতে কত চড়ুই পাখি, বুলবুলি পাখিরা আসে। ওদেরকে বলবো তোমার বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নিয়ে আসতে। তুমি অযথা মন খারাপ করো না।" "তুমি কত্তো ভালো!" এ কথা বলে টুনটুনি জবাগাছটাকে আদর করে দিলো তার ছোট্ট দু'টো ডানা দিয়ে। জবাগাছটা তার সমস্ত ব্যথা ভুলে গেলো। এভাবেই দু'জন সারারাত জেগে কাটালো নিজেদের সুখ দুঃখের কথা বলে।
ভোরের আলো ফুটতেই টুনটুনি বিদায় নিলো জবাগাছটার কাছ থেকে। বাবা-মায়ের খোঁজ পেলেই সে আবার আসবে, জানালো টুনটুনি। জবাগাছটা বললো, "আমি তোমার ফিরে আসবার পথ চেয়ে অপেক্ষায় থাকবো। তুমি ফিরে এসে দেখবে, এই এ্যাত্তো এ্যাত্তো ফুল ফুটে রয়েছে আমার ডালে। আর সেই লাল লাল ফুলের মাঝখানে তুমি চুপটি করে বসে থাকবে! কত্তো মজা হবে!"
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। বন্ধু টুনটুনির জন্য জবাগাছটা এই এ্যাত্তো এ্যাত্তো ফুল ফোটায় থরে বিথরে। প্রতিদিন ভোরবেলা সেইসব ফুল দেখে জারিন খুব খুশি হয়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই জবাগাছটার মন খারাপ হয়ে যায়। মনের কষ্টে সে তার ডাল থেকে পুরোনো সব ফুল ঝেড়ে ফেলে দেয়। আবারও সকালে হাসিমুখে ফুল ফোটায়!
আর সেই টুনটুনি! সেই যে গেছে, আজও ফিরে আসেনি! জবাগাছটা তবুও অপেক্ষা করে বসে আছে!
বর্ষার রাতে
আ র্য ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
সেই রাতের কথা আমার আজও মনে পড়ে। উহ্! ভাবতে গেলে আজও গাটা কেমন যেন ছমছম
করে ওঠে। গভীর রাতে আজও হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় সেই পায়ের শব্দটা যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আর মনে হয় সেই আবঝা ছায়ামূর্তি যেন আমার ঘরের দিকে ভয়ঙ্কর দুটি চোখে তাকিয়ে আছে।
এই গল্প শুরু করতে হলে চলে যেতে হবে আজ থেকে ষাট বছর আগের সেই বর্ষণমুখর রাতটাতে।
সত্যি কী অদ্ভুত সেই স্মৃতি। রাতের স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে শুধুই একটানা ঝমঝম ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। আর তারই সাথে ঝিঁঝিঁর কান্না। পরিবেশটাকে আরো বেশী ভয়ার্ত করে তুলেছে। এসবের মাঝেই দূর থেকে ভেসে আসছে বর্ষার জলে ভিজে যাওয়া কোনো কুকুরের আর্ত কান্নার শব্দ। এসবের মাঝেই বড় রাস্তা থেকে চিৎকার শোনা যায় এক পথচলতি মাতালের।
যে সময়ের ঘটনা এটা সেইসময় আমাদের এই শহরের অনেক বাড়িতেই বিদ্যুৎ আসেনি। ঘরেঘরে হ্যারিকেন বা রেড়ির তেলের বাতি জ্বলতো। সেদিন তখন রাত দুটোই হবে।আমরা সবাই ঐ বর্ষাবিঘ্নিত রাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎই ঘটে গেলো সেই অদ্ভুত ঘন্টার শব্দ আমাদের বাড়ির লাগোয়া সেই পুরোনো শিব মন্দির থেকে। সাথে অপূর্ব ধূপ ধুনো আর জুঁই ফুলের সুবাস।
আমরা তো তাজ্জব বনে গেলাম।এতো বৃষ্টি মুখর রাতে এটা কীভাবে সম্ভব?এরপর সব শান্ত।কিন্তু হঠাৎই ও কী ও? মনে হলো মন্দির থেক বেরিয়ে কে যেন খটখটাখট করে খড়ম পায়ে গলিতে হাঁটা চলা করছে। হ্যারিকেনের আলতো আলোয় মনে হলো একটা বিশাল ছায়া যেন গলিতে পায়চারি করছে। ভেসে আসছে শব্দ খট খট খট খট খট খট।
ঠিক এই সময় সেই মাতাল চিৎকার করে হেসে উঠলো হা হা হা হা করে। মামণির খুবই সাহস।ভাবলে কে হাঁটছে একটু খড়খড়ি ফাঁক করে দেখবে। মা যেই সেটা করতে গেছে, বাবা খপ করে
হাত ধরে বলে খবরদার ওটা করবে না। দুটো চোখ অন্ধ হয়ে যাবে। অগত্যা মা থামে। কিন্তু ঐ গভীর রাতে ও কীসের শব্দ, কার ছায়া, মন্দিরের ঘন্টার শব্দ কিছুই জানা যায়নি।
মেলবন্ধন
অ ন্ন পূ র্ণা দা স
নীলিমা এখন তার মায়ের জামাকাপড়ের দোকানে বসে। বাবা মায়ের সে একটাই মেয়ে।বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থায় আছে। মা তার স্বামীর সেবায় সব সময় ব্যস্ত থাকে। আগে স্বামী ও স্ত্রীর দু'জনে একসঙ্গে দোকানে বসে ব্যবসার কাজে একে অপরকে সাহায্য করত। এটি তাঁর মা এর কাছে অসময়ের সাথি। যখন তার বাবার কাজ চলে যায়, তখন তার মা জমানো টাকা দিয়ে ঘরের মধ্যে ছোট করে শাড়ির ব্যবসা শুরু করে। আজ সেটা কমলা বস্ত্রালয় নামে বিখ্যাত দোকান। কিন্তু মেয়ের সাথে মায়ের ব্যাবসা নিয়ে সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। কারো সাথে কারো মতের মিল নেই। তাদের বাবা সবসময় মধ্যস্থতা করছেন, সমস্যার সমাধান করছে। কিন্তু আজকে তার বাবা খুবই অসুস্থ। তার পক্ষে আর সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই তারা দু'জনে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরে। এদিকে দোকানের অবস্থা ভালো নয়। আগের মত তেমন বিক্রি নেই। মোবাইল ফোনের যুগে এখন ঘরে ঘরে দোকানে ব্যবসা গড়ে উঠেছে। তাই মেয়ে ভাবে ফেসবুকে একটি পেইজ খুলে, ক্যাশ-অন ডেলিভারি করবে।
তার মায়ের এতে খুবই আপত্তি। তার মায়ের ধারণা এইভাবে ফোনে ফটো তুলে ব্যবসা হয় না।যদি শাড়ি ভুল জায়গায় গিয়ে চুরি হয়ে যায়। তাই তার মত নেই। মেয়ে মাকে বোঝাতে চায়, কিন্তু মা কিছুতেই রাজি নয়। বি.এ.পাশ শিক্ষিত মেয়ে ভাবে সে আর তার মায়ের দোকানে বসবে না। মা দেখে এতে করে তার সাধের কষ্টের দোকান উঠে যাবে। তাই সে অগত্যা মেয়ের মতে মত দেন। তাই প্রথম যেদিন লাইভ ভিডিও করবে, সে দিন মেয়ে তার মডেল হয়। আর তার মায়ের অভিজ্ঞ কথায় দর্শকদের মন আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। মেয়ের নতুন ডিজিট্যাল পদ্ধতি এবং মায়ের অভিজ্ঞতায় মেলবন্ধন যেন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়ে দিল। এইভাবে মা ও মেয়ের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
হারায়ে খুঁজি
ছ ন্দা চ ট্টো পা ধ্যা য়
হু হু করে ছুটে চলেছে লোকাল ট্রেন। জানলার ধারে বসে বঙ্গভূমির সৌন্দর্য্য দু'চোখ ভরে দেখছে নন্দিনী। গত রাতের ফ্লাইটে এসেছে সে। রাতটা দমদমের একটা হোটেলে কাটিয়ে সকালেই ট্রেনে উঠেছে। বঙ্গ-প্রকৃতির রূপে বিভোর হয়ে মনে মনে গাইছে -"একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু বঙ্গ -জননী"-। সজল চোখে তোলপাড় হয়ে যাওয়া বুকে নিজেকেই প্রশ্ন করে নন্দিনী-"কেমন করে চল্লিশটা বছর এসব ছেড়ে ছিলাম আমি?"-আবেগে গলার ভেতর জমাট বাঁধে কান্না। ছুটন্ত ট্রেনের বাইরে পেছনে ছুটে যাচ্ছে ধানের ক্ষেত, বৃত্তাকারে ঘুরে যাচ্ছে আখের ক্ষেত, বাঁশবন, মাঠে কর্মরত কৃষক, চরছে গোরু-ছাগল। দিগন্ত-বিস্তৃত নীলিমাকে অর্ধবৃত্তাকারে স্পর্শ করেছে হরিৎক্ষেত্র। দূরের ঐ সীমান্ত যেন পাহাড়িয়া বিভ্রমের সৃষ্টি করেছে। রবি-কিরনে ঝলসে উঠছে পুকুর -জলাশয়। অপূর্ব নিসর্গ, শিল্পী স্বয়ং প্রকৃতি।
এই রকম পরিবেশ থেকেই চল্লিশ বছর আগে মুখুজ্জে বাড়ির মেয়ে নন্দিনীকে বিবাহসূত্রে চলে যেতে হয়েছিল বিদেশে। ভাল সম্বন্ধ পেয়ে দেরী করেননি প্রাচীনপন্থী অভিজাত মুখুজ্জেরা। নন্দিনীরও কত রোমান্টিক কল্পনা। বিলেত বলে কথা। সবে তো গ্র্যাজুয়েট হয়েছে সে। কিন্তু তার গান?রবীন্দ্রসংগীত? অভিভাবকদের আশ্বাসবাণী-"সব হবে। জামাই কথা দিয়েছে, গানের চর্চায় বাধা দেবেনা।" অতএব স্যুটকেসে ভরে নিয়েছিল গীতবিতান আর রবি ঠাকুরের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি।হায়রে তখন কী জানতো সব মরিচিকা, তার অভিভাবক স্বামীটি আরো বেশী সংরক্ষণশীল?!
চল্লিশ বছর কেটে গেল।নিঃসন্তান নন্দিনী গত বছর স্বামীকেও হারালো। এত বছরের মধ্যে মাত্র কয়েকবারই দেশে আসতে পেরেছে সে। শেষ আসা আট বছর আগে বাবার মৃত্যুশয্যায় তাঁকে দেখতে। নন্দিনীও বেশী চিন্তা করার অবকাশ পায়নি।বাড়ির প্রতি তীব্র অভিমান তাকে বিরূপ করে রেখেছিল। এতদিনে নন্দিনী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে, দেশে ফিরে যাবে সে। তাই মায়ের একমাত্র সন্তানকে আজ টানছে মা আর মাতৃভূমি।
স্টেশন থেকে রিক্সা করে মুখার্জি-ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলাতে পারছিলনা নন্দিনী। একি দেখছে সে? বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িটা ভেঙে পড়েছে। শ্যাওলাধরা চাপড়া খসা দেয়াল, ঠিক যেন তার জীবনের মতো। বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখে খিড়কিপুকুরটা ঝাঁঝিদামে ভরতি। পূবদিকে দুর্গামণ্ডপ, উত্তরের রাসমঞ্চের নুয়ে পড়া খিলান-দালান যেন নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা চাইছে। কান্নায় ভেঙে পড়ে নন্দিনী। হাঁটু মুড়ে ফেটে যাওয়া চাতালে লুটিয়ে পড়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় মাটিতে।- "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তারপর নন্দিনী ছুটে যায় মায়ের ঘরে। বিশাল খাটে গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে যাওয়া শরীরের মা তার। মৃত্যুর আগে আত্মজাকে শেষ দেখা দেখবেন বলে অপেক্ষা করছেন। বাড়িতে এখন আছেন কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। ফেটে যাওয়া দেয়ালে গজিয়ে ওঠা বট, অশ্বত্থের মতোই তাঁরা রয়েছেন শেষের সে দিনের অপেক্ষায়।সকলে হৈহৈ করে উঠলেন-"ননী, এলি শেষ পর্যন্ত? এই বাড়ি তো প্রমোটাররা নিয়ে নিয়েছে। যে কদিন বাঁচি ভিটেছাড়া না হই।দেখিস মা।"
দিন যায়। মাও চলে গেছেন গত মাসে। নন্দিনী এসে বসলেন মায়ের খাটে। জানলা দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছে এক ফালি জ্যোৎস্না। আজ শুক্লা চতুর্দশী। এখনো এই গ্রাম খোলামেলা আছে। কিন্তু বেশীদিন থাকবেনা। উন্নয়নের নামে নগর গ্রামকে গ্রাস করছে। ভোর ও সন্ধ্যার পাখির কাকলিকে সন্ত্রস্ত করে গর্জে উঠছে বুলডোজার।চারদিকে উঠছে হাইরাইজ। রাত্রির মোহময় চন্দ্রালোককে ম্লান করে দিচ্ছে চোখ ঝলসানো ফ্লাডলাইট।
নন্দিনী ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন। বিশাল ঘরখানায় গৃহসজ্জা বলতে মায়ের বিরাট মেহগনি খাট, দেরাজ, আলনা আর একটা বুককেসে রবীন্দ্ররচনাবলী। দেয়ালে গুরুদেবের একখানি আলোকচিত্র। প্রতিদিন ঐ ছবিতে একটি মালা, এবং চন্দনগন্ধী একগুচ্ছ ধূপকাঠি জ্বালিয়ে নিত্যপূজা করেন নন্দিনী তাঁর প্রাণের ঠাকুরের।
নন্দিনী এসে বসলেন তাঁর ঠাকুরের ছবির সামনে। তিনি জানেন তাঁর প্রাণের সমস্ত আবেগই তাঁর মাতৃভূমি, আর রবীন্দ্রনাথ। বহুদিন পড়ে গলা ছেড়ে গান ধরলেন নন্দিনী।--"ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা প্রভু তোমার পানে---"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন