মুক্তগদ্য

* পথচলা *

শ্রী সা র থী ম জু ম দা র

আধোজাগা ভোরে জেগে ওঠেন আলোর দেব।ছলছলানি আলোয় বনে বনে ফুল ফোটে।কমলকলিকা উন্মুখ হয়ে থাকে বিনত শ্রদ্ধায় দেবদিবাকরের পথের দিকে ফুটে ওঠার বাসনায়।বিহঙ্গের কাকলিতে মুখরিত হয় ভোরের সভা।এবার তো প্রভাত, সব প্রাণের পথচলা।উদাস বাউল একতারা হাতে গান ধরে- "রাই জাগো রাই জাগো গো"। এমনি করেই পথচলা শুরু হয়। শিশিরসিক্ত ঘাসের উপর বধূমাতা রিক্তপদে ঘাটে যায়।

জীবন মানেই তো পথচলা।সহজ সরল পথ তো সবার জন‍্য নয়। কতদূর যেতে হবে কোথায় গিয়ে থামতে হবে জানা নেই। তমসাময়ী রজনীতেও পথ চলতে হয়।প্রান্তিক জীবনে পথিক পথ চলে ক্ষুধা অন্নের তরে।দুমুঠো অন্ন আনে পথের আনন্দ। আগামীকাল আবার পথচলা। তারপর আবার আবার চলা। প্রতিদিন চলা পথেই বাঁচে জীবন, হয়ত পথেই মরণ, তবু চলতে হয়। দূরে রাজারপ্রসাদে বাজে ভৈরবীর তান। সোনার অলংকারে ঝংকৃত হয় প্রাসাদ, তাদেরও পথচলা শুরু হয়।

ভৈরবী রাগিনীতে থেমে থেমে কেঁপে কেঁপে বেজে ওঠে সানাই মিলনের তরে। নবীন পথিকের পথের দিকে মন ছুটে যায় যুবতীর।আগামীদিনের পথিকের সাথে হবে তার পথচলা।নবযৌবনার হ‍ৃদয় থরথর কম্পিতা, দূরে কোথাও ডেকে ওঠে অচিন পাখি সেই তার সাথী।
তারপর অশোক অলক্তরাগে সিঁথি রাঙিয়ে চলে যায় বধূ হয়ে। এবার নবীন পথচলা।বেজে ওঠে সানাই বেহাগের তানে। নব বরবধূ চলে পথে আগামীর।

পথের শেষ কোথায় কেউ জানে না। তবু মঙ্গলকর্ম সমাপন করে পথচলাই জীবনের ব্রত। বর্ষার মেঘ জলভারনত হয়ে ঝরে পড়ে ধরার বুকে। ধরার বুকে বহে যায় জলকলতান। সবুজে সবুজে পূর্ণ হয় ধরা তারপর রিক্তবৃষ্ট জ‍্যোতিশুভ্র হয়ে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে চলে মুক্তির পথে পরমানন্দের পথে।
জীবনে পথে পথে মানুষের এ এক অনন্ত পথচলা। যত বঙ্কিম পথ হোক তাদের চলতে হয়। একদা যে দেহে ফাগুনের আনন্দ ছিল প্রেম ছিল ভালবাসা ছিল আজ হয়ত সম্পূর্ণ একা পথচলা।কেউ নাই আছে তার চিরসখা, তার জীবন। তাই সে চলে ধরার পথে পথে। বিগত হয়েছে যৌবন কারও, প্রেম নেই তবু জীবনকে ভালবেসে চলে মানুষ। জীবনই তো চিরসখা তাই তাকে নিয়েই পথে চলা।এরপর একদিন সেও চলে যাবে, তখন চলা শেষে পথের শেষে পথকে হয়ত শেষযাত্রায় একটিবার প্রণাম করে যাবে পথিক।





* এ খেলা চলছে নিরন্তর *

ড. ম য়ূ রী মি ত্র


থালা ভরে ফুল ফল সাজিয়ে নদীপথে বেলুড়মঠ যেতেন আমার ঠাকুরদা অশোক মিত্র। ঈশ্বর সম্বন্ধে আমার নাক কোঁচকানি যদিও সেই ছেলেবেলা থেকেই, তবুও কেন যেন ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে আমাকেই বারবার সাথে নিতে চাইতেন অশোক। আমিও অবলীলায় বইতাম পুজোর উপকরণ। বইতাম আমার অশোকের জন্য। ভালোবাসার মানুষটির ভারটুকু বয়ে দিতাম।
   জল কেটে নৌকো এগোত। অশোক দেখতেন আকাশ, গঙ্গার ঘোলা রঙ, পাড়ের শ্রমজীবী মানুষ। মুচকি হেসে একদিন শুধিয়েছিলাম ---সোজা তাকালে বেলুড়ের মন্দির দেখা যায়! তা না দেখে কষ্ট করে ঘাড় উঁচিয়ে কী এত খোঁজো আকাশে? সেদিন আমার মহাআস্তিক ঠাকুরদার উত্তর আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। বলেছিলেন ---"আকাশে ঈশ্বর, নদীতে ঈশ্বর, নদীর জলে ভেসে আসা গাছের টাটকা সবুজ পাতায়ও ঈশ্বর। অনন্ত বিশ্বচরাচরে ব্যাপ্ত মধুরিমাটাই তো ঈশ্বর।"
        একবার বেলুড় ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে নৌকোটা। পাড়ের লোকেরা চেঁচাচ্ছে ---পিছনে বান। এবার মরবে এ নৌকো। ছোট্ট মুণ্ডুটা চেপে ধরেছি ঠাকুরদার বুকে। কাঁদছি। খুব কাঁদছি। বিদ্যুৎবেগে আমার কান্নাঝরা মুখটা তুলে ধরলেন আকাশের দিকে। বললেন -- "ঢেউ যত বড়ই হোক তা তো আর আকাশ স্পর্শ করতে পারবে না। নাস্তিক হ ---ক্ষতি নেই | নির্ভয় হ।"
    ঘাটে ভিড়েছিল নৌকো। ভিজে সালোয়ার আষ্টেপৃষ্টে শরীর সাপটে ধরেছিল। সর্ব বিঘ্ন হটিয়ে অশোক পৌঁছে যাচ্ছিলেন তাঁর ঈশ্বরের কাছে। আর আমি? ঈশ্বর বিশ্বাস না করে, অনেকটা ক্ষণ হেঁটেছিলাম আমার জীবনের সবথেকে সাহসী পুরুষটির সাথে। দৃষ্টি যাঁর আসমানে চরে।
          সেদিন বালী থেকে ফেরার পথে দেখলাম দক্ষিণেশ্বরের sky walk, সোজা পথটি সোজাসুজিই নাকি পৌঁছে দেবে ভগবানের দোরে। সে পথের মাথার ওপরটাই ঢাকা। আকাশচাপা আকাশপথ। চুরি হয়ে গেছে অশোকের আসমান।


এক মানুষ দুখ দেয়। অন্য মানুষ জল মোছে। দৃঢ় হাতে ঘষে ঘষে তুলে ফেলে জলছবি। উজ্বল হয় নতুন হর্ষ। 
      এক সে রাত। গোটা নিশি জুড়ে বিচ্ছিরি কান্নার কিরিকিরি চলছিল আমার। কান্নার কিরিকিরি --এ শব্দ আমার। কান্না থেকে বেরোতে না পারলেই এইসব অদ্ভুত শব্দ বুনি আমি। নিজের শব্দে নিজেকে গাল পাড়ি। তো পরদিন সকাল অব্দি চলল সে গ্লানি।
       বেশ খানিকটা বেলা গেলে প্রিয় মানুষের নতুন সম্বোধন এল। সাজলাম। গহনায় নয়। আনন্দে। সাজতে সাজতে মনে হল ---- ওহ! দুদিন বাদে সরস্বতী পুজো। আজই তো স্কুলের পুজোর বাজার সারতে হবে। বাচ্চাদের বেখাপ্পা পছন্দের মিষ্টান্ন --কদমা, রঙিন মঠ, তিলের নাড়ু বেশি বেশি করে কিনতে হবে। শসা, আপেল ইত্যাদি ফালতু ( শিশুর মতামতে ) পুষ্টিকর ফল কম। আর একটি মায়াময় দেবীমূর্তি -- যে কিনা তার নরম দুটো নয়নে চেয়ে থাকবে শিশুর পাঠবইয়ে। কতকাল ধরে যে সে চেয়ে আছে শিক্ষরত মানুষের পানে!
        হাঁটছি বাজারে। হঠাৎ ----- অদূরে অপূর্ব এক মূর্তি। মহানাস্তিকও যাকে পুতুল না ভেবে দেবী ভেবে সুখ পায়। ঠোঁট দুটো কী আদুরে কী আদুরে! সবুজ আর হলদে আভায় কী সপ্রতিভ দেবীর মুখ! দর শুরু হল। সাতশো টাকা। সঠিক দামই বলেছেন দোকানি। আর সঠিক বলছেন বলেই দাম কমাবার ব্যাপারে একেবারেই রাজি হলেন না। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও না। 
        শেষে একবার কেবল বললাম ---"ভাই এটা একটা প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের স্কুল। আমাদের অত টাকা বাজেট নয়।" ---"অন্য ঠাকুর নিন।"
      বললাম ---"এই ঠাকুরটার দুরকম রঙের মিশেল ওরা খুব ভালোবাসবে। জানেন ভাই, এ সব বাচ্চা রঙের রকমারি খুব ভালোবাসে।" 
        ঘন ঘন মাথা নাড়া চলছে দোকানির। রাফ টাফ কথা বলে চলেছেন। যতদুর মনে হয় --শেষ কথাগুলো নিজের মনেই বলতে বলতে চলে যাচ্ছিলাম। চলে যাচ্ছিলাম দেবীকে ছেড়ে। বিক্রেতাকেও ছেড়ে অনেকটা দূরে যখন, দেখি -- মাথা নাড়া বন্ধ করে স্থির চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। দৌড়ে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলেন ----"দিদি আমার বাচ্চাটাও তো এরকম হতে পারত! আপনি ওই দামেই নিয়ে যান। এই মুর্তিটাই নিয়ে যান। দাঁড়ান --সাজগুলো পরিয়ে দি!"  
       দেখলাম --- নারাজ দোকানি উত্তেজনায় থরথর! কম করে শ'চারেক লোকসান দিয়ে কাঁপা হাতে আরো আরো রঙের গয়না পরিয়ে দিচ্ছেন। বাচ্চারা রঙ ভালোবাসে কিনা। ঠাকুর নিয়ে রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে ফল কিনছি। --কে যেন দেখছে আমায়! চোখ তুলে দেখি ---ওপারে দোকানি। পথের অগুনতি মানুষের ফাঁক দিয়ে দুই চোখ তাঁর হাসছে। রাফটাফ চোখে এখন খুব প্রীতি! খুব।
      আমার দেবতা হাসে। ভক্ত দেখে। হাঁ হয়ে দেখে। ময়ূরা এতো ক্যালাস তুই? একটা নমস্কার করে আসবি তো। -- বাক্সে তোল আজকের পাঠ। ভাগ যা ইঁদুরের পাল।






মন্তব্যসমূহ

  1. ময়ূরী দিদিভাই
    কলম তো আপনার শক্তি অবশ্যই,
    তার চেয়েও বড়ো শক্তি
    আপনার দৃষ্টি
    আপনার চেতনা

    উত্তরমুছুন
  2. কি অপূর্ব লেখা! ঘটনা তো কতই ঘটে সবার জীবনে! কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে এ লেখা সম্ভব নয়! অন্তহীন শ্রদ্ধা আপনাকে! আরও লিখুন, আমরা ঝদ্ধ হতে থাকি! 🙏

    উত্তরমুছুন
  3. আপনার ভাবনা আর অসাধারণ উপলব্ধি দুই এর মিশেলে অনবদ্য লেখা ।

    উত্তরমুছুন
  4. খু্ব স্পর্শ করে থাকে এ লেখনী

    উত্তরমুছুন
  5. পথচলা ...একটি অতুলনীয় লেখা পড়লাম

    উত্তরমুছুন
  6. দারুণ লাগলো। আপনার রচনার কোনও তুলনা হয় না। সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইলে গভীর মনস্তাত্ত্বিক লেখনী। আরও অনেক সৃষ্টি হোক। শুভেচ্ছা জানবেন।

    উত্তরমুছুন
  7. Apurbo bolleo kom bola hobe... Tomar lekha montobbo korar jonno noye.... Besh anekhon pore boshe chilum... Ghran nichchilum... E ek opurbo gondhe sara ami take ghire rekheche.... Tumi astik ki nastik amar kichu ese jai na... Tumi je ekta shundor moner manush tomar lekhay ta dhora pore❤

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪