অণুগল্প

* তদন্ত চলছে *

বি কা শ  গুঁ ই


পার্থ প্রতীম দত্ত। দুঁদে ব্যারিষ্টার। কোলকাতায় অভিজাত এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি। বাড়িতে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে ভরা সুখী পরিবার। প্রতিদিন সকালে গড়ের মাঠে মর্নিং ওয়াকে বেরনো দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। ড্রাইভারকে নিয়েই যান। স্ত্রীকেও সঙ্গে নেন। ইদানিং স্ত্রী কমলার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তাই আজ একাই বেরিয়েছেন। বাড়ি ফেরার পথে প্রচন্ড বৃষ্টি। ১৫ মিনিটৈই রাস্তা ঘাট জলের তলায়। ধীরে ধীরে গাড়িটা এগোচ্ছিল... হঠাৎ বাড়ির কাছাকাছি এসে গাড়িটা আটকে গেল। মনে হ'ল চাকার সামনে কোনো ইঁট বা পাথর পড়েছে। পার্থ প্রতীমবাবু ড্রাইভারকে বললেন, কী হল রে শ্যামলাল ?
দেখছি স্যার বলে,  হাঁটু জলে নেমে হাতড়াতে লাগল। হঠাৎ একতাল বুদবুদ হাইড্রেন থেকে উঠে এসে গাড়ির কাছে মিলিয়ে গেল....আর ড্রাইভার সাহাব... সাহাব বলে , চিৎকার করতে করতে জলের তলায় তলিয়ে গেল। পার্থ প্রতীম বাবু নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। ড্রাইভার যে পা হড়কে হাইড্রেনে পড়েনি তিনি নিশ্চিত। মনে হ'ল কে যেন ওকে পা ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। সন্বিত ফিরতেই ফোন করলেন পুলিশ কমিশনার বন্ধু সঞ্জয় চক্রবর্তীকে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী এল। কারণ ইতিমধ্যেই এরকম দু'টো কেস আগেই তারা পেয়েছেন। পুলিশ তল্লাশি শুরু করল। কিন্তু কী আশ্চর্য ! ডেডবডি আগের মতোই কর্পূরের মতো উধাও। পুলিশের সাহায্যে বাড়ি ফিরে এলেন। ঘটনাটা বললেন বাড়িতে। প্রত্যেকেই মুহ্যমান। শ্যামলাল বহুদিনের বিশ্বস্ত ড্রাইভার।
কিছুদিন পর আস্তে আস্তে বাড়ির সবাই ভুলতে বসেছে ঘটনার কথা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেদিন বাড়ির জল নিকাশির পাইপের মুখ জ্যাম। ঠিকমত জল পাস হচ্ছে না, জল উপরে উঠে আসছে। মাঝে মাঝে একটা চোঁ চোঁ আওয়াজ। প্লাম্বারকে ডাকা হ'ল। প্লাম্বার পাম্পার দিয়ে চেষ্টা করেও ঠিকমত পরিষ্কার না হওয়ায় একটু মুখ বাড়িয়ে দেখতে যেতেই
...মুখের মধ্যে থাবা মেরে কে যেন মাথাটা টেনে নিল পাইপের মুখে- তারপর টেনে হিঁচড়ে পাইপের মুখে টানতে লাগল...পার্থ প্রতিম বাবুর ছেলে দেখতে পেয়ে, ও বাবা বলে ডেকেই, ছুট্টে এসে প্লাম্বারের পা দুটো টেনে বার করার চেষ্টা করতে লাগল...
কিন্তু ভিতরের টান এত তীব্র যে ওর ব্যায়াম করা পেটানো চেহারার শক্তিও সেখানে তুচ্ছ। পারলে ওকেও টেনে ঢুকিয়ে নেবে এমনই। বাবা, বাবা বলে ডাকতে ডাকতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বডিটা পাইপের ভেতর ঢুকে গেল। যথারীতি আবার ফোন থানায়। পুলিশ বাহিনী এল। এমন ঘটনা আগেই ঘটেছে এই বাড়ির এলাকায়। তদন্তে দেখা গেছে...
যেখানে জলের সংস্পর্শ সেখানেই এই রকম এক অদ্ভুত, অদৃশ্য শক্তি মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এবং আরও আশ্চর্য ব্যাপার, ডেডবডি হাওয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। কোন ভাবেই ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট টোট্যালি কনফিউজড। রেড এলার্ট জারি। জমা জলে বুদবুদ দেখলেই সাবধান করা হচ্ছে। তাতেও কোনভাবেই ঐ অদৃশ্য শক্তিকে ঠেকানো যাচ্ছে না। গোয়েন্দা বিভাগ ও নাস্তানাবুদ। কোন ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু পাইপের ক্ষেত্রে , পাইপের মুখে রক্ত-মাংসের নমুনা ছাড়া। তা থেকেই ফরেনসিক রিপোর্টে আততায়ীকে - জলে কুমির বা অক্টোপাসের থেকেও শক্তিশালী একটা "লাইভ নন-ভিজিবল পাওয়ার" বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু আসলে সে টা যে কি !!! এখনও তদন্ত চলছে ...।





* পার্থক্য *

সো ম না থ বে নি য়া

ছিনতাইবাজ গলার হার ছিনতাই করে হাতেনাতে ধরা পড়লো। পাবলিক জিজ্ঞাসা করলো, 'হার কোথায় রেখেছিস বল?'
- হার গিলে ফেলেছি।
- চল, পায়খানা করে হার বার করবি চল।
- পায়খানা হবে কোথা থেকে! বিশ্বাস করেন, তিনদিন ধরে শুধু জল খেয়ে আছি। পেটে একটাও দানা পড়েনি। তাই তো খাওয়ার জন‍্য ছিনতাই করলাম। যদি হার পেতে চান, তাহলে আমাকে আগে পেট ভরে খাওয়ান। খুব খিদে! সত্যি বলছি, তারপর না হয় আমার শরীর কাটাছেঁড়া করে হার বের করে নেবেন ...
- না-না, তোকে মেরে ফেললে হবে না!
- ঠিক বলেছেন। আমাদের এখানে পিটুনি খেয়ে মরলে 'কেস' হয় আর না খেয়ে মরলে 'বেশ' হয় ...






* বনলতা সেন *

ম ধু মি তা রা য়

আজ ভাগ্যক্রমে জানলার পাশের সিটটা পেয়ে গেল তনিমা। প্ল্যাটফর্মে থিকথিকে ভিড়।
"এই বনলতা এটায় ওঠো"...
নামটায় একটা জাদু আছে। বনলতা ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ালো তনিমারই সামনে।হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছাড়লো।

বনলতার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বোতল খুলে ঢকঢক করে জল খেল। হালকা আকাশি শাড়ি। অবিন্যস্ত রুক্ষ চুল হাতখোঁপায় বাঁধা, চোখের নীচে ক্লান্তির গাঢ় কাজল।
"মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য"
 কেন যেন লাইনগুলো...  

হঠাৎ তনিমার কৌতূহল হল। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন...

 "তোমার নাম কি গো?"
"বনলতা"
"বনলতা কি?"
"সেন"

একটু থেমে মেয়েটি উদাস হেসে বলল...
"আমিও পড়েছি।"






* হলুদ পাখি *

শ্যা ম ল কু মা র মি শ্র

একটা নাম না জানা হলুদ পাখি এসে বসে রান্নাঘর সংলগ্ন বারান্দায়। ঊর্মিলা রোজ রান্না করতে করতে দেখে। কোনদিনই সময়ের একটুও ব্যত্যয় ঘটে না। প্রতিদিন ঠিক দুপুর বারোটা। রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঊর্মিলা বারান্দায় আসে। গ্রীলের উপর বসে আপনমনে গান করে পাখিটা। তারপর একসময় ওর দিকে তাকিয়ে হাত থেকে খাবার নিয়ে উড়ে যায়। এ যেন এক নিত্য দিনের খেলা ঊর্মিলার। পাখিটা আসে গান করে চলে যায়। কেমন যেন একটা মায়া পড়ে যায় ঊর্মিলার। প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলেই ঊর্মির মন চলে যায় বারান্দায়। একদিন বারোটা বাজল। পাখিটার গান শুনতে পেল না ঊর্মি। ১২-১৫ হয়ে গেল, তবুও এলো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ঊর্মি। হঠাৎ রাস্তায় একটা চিৎকার উঠল। তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো ঊর্মি। গেট দিয়ে বেরোতেই চোখে পড়ল একটা জটলা। শুনল একটা পাখি ইলেকট্রিক তারে ধাক্কা খেয়ে মারা গেছে। দৌড়ে গেল ঊর্মি। ভিড় ঠেলে দেখল মরে পড়ে আছে 'হলুদপাখি'। কয়েকদিন আগেই পথ দুর্ঘটনায় একমাত্র ছেলে শোভন হারিয়ে গেছে। পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ঊর্মির দুচোখে তখন জলের ধারা...






*মিতালি দিদিমণি*

শ্যা ম ল কু মা র মি শ্র

অগ্রহায়ণের শেষ বিকেলের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে খোলা ছাদে। নরম রোদ্দুরে পিঠটা এলিয়ে দিয়ে বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখে চলেছেন মিতালি দিদিমণি। কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার সময় প্রায় এসে গেছে কিন্তু মিতালি শেষ দিন পর্যন্ত ভীষণই শৃঙ্খলাপরায়ণ। তাঁর ঋজুতা, মূল্যবোধ আর পাঁচ জনের থেকে সহজেই তাঁকে চিহ্নিত করে। নাকের নিচে চশমাটা নেমে এসেছে।
গভীর মনোযোগে খাতা দেখতে দেখতে কলমটা এক জায়গায় এসে থমকে যায়। মেয়েটি যুদ্ধের রচনায় লিখেছে--- যুদ্ধ হলো প্রেমহীনতার মহাকাব্য। যুদ্ধ কখনই শান্তি দিতে পারে না। মহামতি যুধিষ্ঠির কি শান্তি পেয়েছিলেন যুদ্ধ জয়ে?... মিতালী দেখতে পাচ্ছে কারগিলের প্রান্ত। সবুজ ভেদ করে সাঁজোয়া ছুটে চলেছে। মুহুর্মুহু কামানের গর্জন। তেমনি এক ব্যাটালিয়নের প্রধান অনির্বাণ। নির্ভুল লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।

মিতালির মুখে ফুটে উঠছে এক চিলতে হাসি। পড়ন্ত রোদ্দুরে তা যেন বড়ই অনৈসর্গিক। বড় মলিন সেই হাসি।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। মিতালী তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, অনির্বাণ তৃতীয় বর্ষের। বড়ই আনন্দের ছিল কলেজের দিনগুলো। হঠাৎ একদিন, সেদিনও ছিল এমনি এক শীতের শেষ বিকেল। হাতে হাত রেখে অনির্বাণ জানায় আগামীকাল চলে যেতে হবে জম্মু-কাশ্মীর। সেনাবাহিনীর অফিসার পদে সে মনোনীত হয়েছে। এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে মিতালির। দেশের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চলেছে এক নিষ্ঠাবান সৈনিক। সেদিন আম্রবীথি তলে অনেকটা সময় কেটে যায় ওদের। অনির্বাণ প্রতিশ্রুতি দেয় ফিরে এসে মিতালিকে সে চিরদিনের জন্য নিয়ে যাবে। অনির্বাণকে জড়িয়ে ধরে অঝোরধারায় কাঁদতে থাকে মিতালি। 

অগ্রহায়ণের সূর্য অস্তমিত হয়। মিতালির সেই দিন গোনা শুরু। রাত যায় দিন আসে। মাঝে মাঝে অনির্বাণের চিঠি আসে তবে বড়ই অনিয়মিত। সময় এগিয়ে যায় কিন্তু অনির্বাণ আর ফেরে না। ইতিমধ্যে সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অনির্বাণদের সমস্ত ছুটি বাতিল হয়ে যায়। রোজ রাতে বাঙ্কারের মধ্যে শুয়ে অনির্বাণ ভেবে চলে মিতালির কথা আর তার দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। কিন্তু সে আজ নিরুপায়। কোন দুর্বলতা অনির্বাণকে মানায় না। সে যে সৈনিক। 

ভোর হয়। যোদ্ধৃবেশে অনির্বাণ এগিয়ে চলে। দেশের জন্য যুদ্ধ। হাসিমুখে এগিয়ে যায় অনির্বাণ।
দুদিকে অপূর্ব হিমবাহ। সবুজ বনের মাঝে সংকীর্ণ পথ। একটা নাম না জানা পাখির কান্না ভেসে আসছে। নিমেষের জন্য আনমনা হয়ে পড়ে অনির্বাণ। একটাগুলি এসে লাগে অনির্বাণের বুকে। নিমেষেই সব হারিয়ে যায়। পাখিটার কান্না তখনও শোনা যাচ্ছে।

তেরঙ্গা পতাকা মুড়ে কফিনটা সেনাজোওয়ানরা এনেছিল অনির্বাণের বাড়ি। হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছেন অনির্বাণের মা। মিতালির চোখে জল নেই। 

তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। কলেজ শেষে স্কুলে চাকরি নিয়েছে কিন্তু যুদ্ধের কথা শুনলে আজও কেমন শিউরে ওঠে মিতালির হৃদয়। বারে বারে মনে হয়--'কেউ কথা রাখেনি'। 

সূর্যটা হারিয়ে যাচ্ছে। অনন্ত আকাশ জুড়ে প্রদীপ জ্বলে উঠছে। আর সেই প্রদীপ্ত আলোয় ভেসে উঠছে একটা মুখ আর দুটো চোখ যে চোখের দিকে তাকিয়ে একদিন মিতালি বলেছিল--'তোমার চোখে খুঁজি আমার ঠিকানা'। সে ঠিকানা আজও খুঁজে চলে মিতালি। পাশের বাড়ি থেকে তখন রুমির গলা ভেসে আসছে--- 'কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে'... অনেকদিন বাদে মিতালি কেঁদে চলেছে...




মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪