প্রবন্ধ
কার্ল মার্কস ও ভারতবর্ষ
চ ন্দ ন দা শ গু প্ত
অন্যান্য বহু দেশের মত ভারতবর্ষেও 'মার্কসবাদ' কথাটা মোটামুটি পরিচিত। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস (১৮১৮ -- ১৮৮৩) ভারতীয় জনগণের ইতিহাসের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাঁর নানা প্রবন্ধে এবং রচনাবলীতে দেখা যাবে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের বিস্তৃত বিশ্লেষণ। আর এইগুলি ভারতের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অনুসরণে আমাদের সঠিক পথের সন্ধান দেবে।
ভারত সম্পর্কে মার্কসের আগ্রহ ও রচনাবলী :---
বৃটেনে নির্বাসিত জার্মান যুবক কার্ল মার্কসের পক্ষে ভারত সম্পর্কে জানবার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হলেও তিনি অনন্য-সাধারণ ভঙ্গীতে সমাজ বিজ্ঞানের ভিত্তিতে ভারতের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করেছিলেন। ১৮৫১ থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত তিনি তৎকালীন 'নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন' পত্রিকায় ভারত সম্পর্কে যেসব প্রবন্ধ লেখেন, তার কয়েকটির নাম ও রচনাকাল হল :
ক) ভারতে বৃটিশ শাসন (১৫/০৬/১৮৫৩)
খ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস (২২/০৬/১৮৫৩)
গ) ভারতে বৃটিশ শাসনের ভবিষ্যৎ (২২/০৭/১৮৫৩)
ঘ) ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ (৩০/০৬/১৮৫৭)
ঙ) ভারতীয় প্রশ্ন (২৮/০৭/১৮৫৭)
চ) ভারতীয় বিদ্রোহ (০৪/০৯/১৮৫৭)
প্রচন্ড কাজের চাপের ফাঁকে ফাঁকে মার্কস সপ্তম শতাব্দী (৬৬৪ খৃষ্টাব্দ) থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী (১৮৫৮ খৃষ্টাব্দ)-- এই সুদীর্ঘ প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী ভারতের সামাজিক ইতিহাসের এক অতিমূল্যবান কালপঞ্জী রচনা করেছিলেন (১৮৭০)। বলা বাহুল্য, ভারতবর্ষ সম্পর্কে মার্কসের চিন্তাধারা জানবার মূল সূত্র এইগুলিই।
ভারতবর্ষ সম্পর্কে মার্কসের মতামত:
(ক) সামাজিক পরিস্থিতি :
ভারতের সামাজিক পরিস্থিতি ও সমস্যাগুলির সাথে কার্ল মার্কস কতখানি ওয়াকিবহাল ছিলেন, তা তাঁর রচনার বিভিন্ন জায়গায় সুস্পষ্ট। তিনি যথার্থই বলেছিলেন যে, সুপ্রাচীন কাল থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত ভারতের সামাজিক অবস্থা অপরিবর্তিতই থেকে গেছে--- কোনও বিকাশ হয়নি। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও ভারতীয়দের অলঙ্কারপ্রিয়তাও তাঁর অজানা ছিলনা। এদেশের সমাজের তৎকালীন জড়তা, বর্বরতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, ধর্মান্ধতা প্রভৃতিকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি।
মার্কসের অপরিসীম প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরই অপ্রিয় সত্য ভাষণে, "....এই হীন, অচল ও উদ্ভিদসুলভ জীবন এই নিষ্ক্রিয় ধরণের অস্তিত্ব থেকে অন্যদিকে, তার পাল্টা হিসেবে সৃষ্টি করেছে বন্য লক্ষ্যহীন এক অপরিসীম ধ্বংসশক্তি এবং হত্যা ব্যাপারটিকেই হিন্দুস্থানে পরিণত করেছে এক ধর্মীয় প্রথায়।... ছোট ছোট এইসব গোষ্ঠী ছিল জাতিভেদ প্রথা ও কৃতদাসত্ব দ্বারা কলুষিত, অবস্থার প্রভুরূপে মানুষকে উন্নত না করে তাকে করেছে বাইরের অবস্থার পদানত, স্বয়ং বিকশিত একটি সমাজ ব্যবস্থাকে তারা পরিণত করেছে অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়তিরূপে এবং এইভাবে আমদানি করেছে এমন পূজা যা পশু করে তোলে লোক-কে, প্রকৃতির প্রভু যে মানুষ তাকে হনুমান দেবরূপী বানর এবং শবলাদেবীরূপী গরুর অর্চনায় ভুলুন্ঠিত করে অধঃপতনের প্রমাণ দিয়েছে।"
(খ) অর্থনৈতিক পরিস্থিতি :
কার্ল মার্কস ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতারও কারণ খুঁজেছিলেন। তাঁর মতে, ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলী অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত। ভারতীয় সমাজের ভিত্তি হল কৃষি ও হস্তচালিত তাঁত। আর ইংরেজ আমলে দুটির কোনটিরই বিকাশ ঘটেনি। মার্কসের ভাষায়, "...১৮১৮ সাল থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত গ্রেট বৃটেন থেকে ভারতে সূতা চালানের অনুপাত বেড়ে ওঠে ১ থেকে ৫২০০ গুণ! ১৮২৪ সালে ভারতে বৃটিশ মসলিনের চালান প্রায় ১০ লক্ষ গজও ছিলনা, অথচ ১৮৩৭ সালে তা ৬ কোটি ৪০ লক্ষ গজও ছাড়িয়ে যায়। অথচ এই সময় ঢাকার লোকসংখ্যা ১,৫০,০০০ থেকে ২০,০০০ এ নেমে আসে। শিল্পের জন্য বিখ্যাত এইসব ভারতীয় শহরগুলির অবক্ষয়টুকুই কিন্তু সর্বনিকৃষ্ট ফলাফল নয়। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কৃষি ও হস্তচালিত শিল্পের যে ঐক্য ছিল, বৃটিশ বাষ্প ও বিজ্ঞান তাকে উন্মিলিত করে দিয়েছে।" অন্যত্র তিনি আরও লিখেছেন, "...ভারতের প্রগতিতে এতদিন পর্যন্ত গ্রেট বৃটেনের শাসক শ্রেণীগুলির যা স্বার্থ ছিল সেটি নিতান্তই আকস্মিক...। অভিজাত শ্রেণী চেয়েছিল জয়, ধনপতিরা চেয়েছিল লুন্ঠন, এবং মিলতন্ত্রীরা চেয়েছিল সস্তায় বেচে বাজার দখল। ... মিলতন্ত্রীরা আবিষ্কার করেছে যে, উৎপাদনশীল দেশরূপে ভারতের রূপান্তর তাদের কাছে একান্ত জরুরি এবং সেইজন্য সর্বাগ্রে সেচ ও আভ্যন্তরীণ পরিবহণব্যবস্থা তাকে দিতে হবে...।" প্রকৃতপক্ষে রেলপথ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন এই উপলব্ধিরই ফল। বলাবাহুল্য, ভারতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী।
মার্কস তাঁর 'ক্যাপিটাল' গ্রন্থের প্রথম খন্ডের চতুর্দশ অধ্যায়ে ভারত সহ এশিয়াটিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, "আত্মনির্ভরশীল গোষ্ঠীগুলি সব সময় একই রূপে নিজেদের পুনঃসৃষ্টি করে... এইসব উৎপাদন সংস্থা ও সহজ-সরলতাই এশিয়ান সোসাইটির অপরিবর্তনশীলতার গোপন চাবিকাঠি। এই অপরিবর্তনশীলতার স্পষ্ট বিপরীতে রয়েছে এশিয়াটিক রাষ্ট্রগুলির অনবরত ভাঙ্গন ও পুনর্গঠন, এক রাজবংশের পর আর এক রাজবংশের উত্থান... তবে রাজনৈতিক আকাশের ঝড়ো মেঘ কিন্তু অর্থনৈতিক মৌল উপাদানের কাঠামো এতটুকুও স্পর্শ করে না।"
উপনিবেশবাদীরা কিভাবে ইউরোপের বাইরে থেকে সম্পদ আহরণ করত এবং কিভাবে আদি সঞ্চয় ব্যবস্থার বিকাশ ঘটল, সে-সম্পর্কে খুব স্বচ্ছ ধারণা করা যায় এন. দানিয়েলসনকে লেখা মার্কসের চিঠি থেকে : "...খাজনার আকারে, হিন্দুদের পক্ষে যা মূল্যহীন সেই রেলওয়ের ডিভিডেন্ড হিসেবে, সামরিক ও সিভিল সার্ভিসের লোকেদের পেনসন, আফগানিস্তান ও অন্যান্য যুদ্ধ ইত্যাদি বাবদ ইংরেজরা বছরে বছরে যা নেয়, তা তারা নেয় কিছু প্রতিমূল্য না দিয়ে এবং ভারতের অভ্যন্তরে বছরে বছরে যা তারা নিজেরা দখল করে তা বাদে----ইংল্যান্ডে বছরে বছরে বিনামূল্যে যে পণ্য ভারতীয়দের পাঠাতে হয়, কেবল তারই দামটুকু দিলে--- তা ভারতের ৬ কোটি কৃষি ও শিল্প শ্রমিকদের মোট আয়ের চেয়েও বেশি...।"
মার্কসের শেষ জীবনে রচিত "ভারত ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্য" নামক গ্রন্থটিতেও রয়েছে ভারতের অর্থনীতি, কৃষিসম্পর্ক এবং তার শিল্প ও বৃটিশ অর্থনীতির মধ্যেকার বন্ধন সম্পর্কিত মহামূল্যবান তথ্যাবলী।
(গ) রাষ্ট্রনৈতিক পরিস্থিতি :---
প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রনীতির বিষয়ে যে মার্কস সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে তাঁরই লেখায় : "...প্রাথমিক ধরণের পৌরশাসনের আওতায় স্মরণাতীত কাল থেকে এদেশবাসী বাস করে আসছে। গ্রামের সীমানা বদল হয়েছে ক্বচিৎ, যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ, বা মারী-মড়কে গ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি বিধ্বস্ত হলেও সেই একই নাম, একই সীমানা, একই স্বার্থ, এমনকি একই পরিবারসমূহ চলে আসছে যুগের পর যুগ। রাজ্যের ভাঙাভাঙি নিয়ে অধিবাসীরা মাথা ঘামায় না, গ্রামটি অখন্ড হয়ে থাকলেই হল, কোন্ শক্তির কাছে তা গেল, কোন্ সম্রাটের তা করায়ত্ব হল, এ-নিয়ে তারা ভাবে না--গ্রামের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি অপরিবর্তিতই থাকে। সেই একই প্যাটেল প্রধান, মন্ডল তথা ক্ষুদে বিচারপতি বা শাসনকর্তা এবং গ্রামের কর আদায়ের কাজ সে তখনো চালিয়ে যায়।
ভারতে ইংরেজ শাসন কায়েম হবার কারণ বিশ্লেষণ করে মার্কস লিখেছেন : "...দেশটা শুধু হিন্দু আর মুসলমানেই বিভক্ত নয়, বিভক্ত উপজাতিতে, বর্ণাশ্রম জাতিভেদে, এমন একটা স্থিতিসাম্যের ভিত্তিতে সমাজটার কাঠামো গড়ে উঠেছিল যা এসেছে সমাজের সভ্যদের মধ্যস্থ একটা সাধারণ বিরাগ ও প্রথাবদ্ধ পরস্পর বিচ্ছিন্নতা থেকে--- এমন একটা দেশ এবং এমন একটা সমাজ কি বিজয়ের এক অবধারিত শিকার হয়েই ছিল না ?... এই মুহূর্তেও ভারত ইংরেজ রাজ্যভুক্ত হয়ে আছে ভারতেরই খরচে পোষিত এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারাই। বিজিত হওয়ার নিয়তি ভারত তাই এড়াতে পারত না এবং ভারতের অতীত ইতিহাস বলতেও যদি কিছু থাকে তো তার সবখানিই হল পর পর বিজিত হবার ইতিহাস।" বক্তব্যটির স্পষ্টতর ব্যাখ্যা করে মার্কস লিখেছেন যে, অপরাপর বিদেশী হামলাকারীদের তুলনায় ঢের বেশি সভ্যতার অধিকারী ছিল বলেই ইংরেজরা ভারতীয়দের সাথে মিশে যায়নি। ভারতীয় সমাজকে ধ্বংস করে সে নিজের স্বার্থে এমন কার্যকলাপ শুরু করল, যার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। মার্কসের ভাষায় : "....সেদিন দূরে নয়, যখন রেলওয়ে ও বাষ্পীয় পোতের সমন্বয়ে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যেকার দূরত্ব সময়ের পরিমাণে নেমে আসবে আটদিনে এবং একদা এই রূপকথার দেশটা এইভাবে সত্যি করেই পাশ্চাত্য জগতের অন্তর্ভুক্ত হবে।"
(ঘ) সিপাহী বিদ্রোহের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে:--
ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসকের শোষণনীতি সম্পর্কে মার্কস সর্বদাই ছিলেন সজাগ। এমন সময় ঘটল সেই যুগান্তকারী ঘটনা--সিপাহী বিদ্রোহ। মার্কসের লেখনীও হয়ে উঠল সোচ্চার: "দেশীয় সেনাবাহিনীর ওপর কতদূর নির্ভর করা যায় তা স্পষ্ট দেখা গেছে দেশীয় সৈন্যবাহিনীর সাম্প্রতিক বিদ্রোহ দ্বারা। এর আগেও ভারতীয় বাহিনীতে বহু বিদ্রোহ দেখা গেছে, কিন্তু বর্তমান বিদ্রোহ বৈশিষ্ট্যসমূহ ও মারাত্মক প্রকৃতির ফলে অন্য বিদ্রোহের থেকে ভিন্ন। এই প্রথম সিপাহী রেজিমেন্ট তাদের ইউরোপিয়ান অফিসারদের হত্যা করেছে, এই প্রথম মুসলমান ও হিন্দুরা তাদের নিজেদের মধ্যেকার পারস্পরিক মনোভাব পরিহার করে তাদের অভিন্ন প্রভুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে...।" প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, দূরদর্শী মার্কস নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, "বিদ্রোহ দমন হবে, বিদ্রোহীরা দীর্ঘকাল সুসংগঠিত উন্নততর অস্ত্র-সজ্জিত বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না।" বৃটিশ শাসকেরা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, ভারতীয় বাহিনীতে বিদ্রোহ কেবলমাত্র একটা 'মিউটিনি'। কিন্তু মার্কস এটিকে দেখেছিলেন বঞ্চিত ভারতীয় জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও ক্রোধ হিসেবে এবং তাঁর মতে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহী সিপাহীরাই ছিলেন ভারতের অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি।
(ঙ) সংস্কৃতি প্রসঙ্গে:
মার্কসের সাহিত্য-সংস্কৃতি তত্ত্বও তাঁর সমাজতত্ত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ভারতের সাম্প্রতিক শিল্প সাহিত্যে অসুস্থতার উৎস হল ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রসার। ১৮৪২ সালের মে মাসে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে সৃষ্টিশীল রচনার স্বাধীনতার বিষয় আলোচনা প্রসঙ্গে মার্কস বলেছিলেন : "যে সংবাদপত্র ব্যবসায়ে পরিণত হয়নি---সে-ই কেবল স্বাধীন এবং যে লেখক জীবিকার্জনের উপায় হিসাবে লেখেন না, তিনিই স্বাধীন লেখক।"
শ্রমিক শ্রেণীর বৈপ্লবিক চেতনা বিকাশের জন্য যেমন ইস্তাহার, প্রচার পুস্তিকা, বুলেটিন প্রভৃতি আছে, বিপ্লবী শিল্পী-সাহিত্যিকের জন্য তেমনি আছে লিটল ম্যাগাজিন, ই-ম্যাগাজিন, স্বল্পবিত্ত প্রকাশক, চলচ্চিত্র প্রভৃতি। কুরুচিপূর্ণ যাত্রা-থিয়েটার ও বাণিজ্যিক সিনেমার বিপরীতে জীবনমুখী প্রগতিশীল মার্কসীয় আদর্শানুসারী বেশ কয়েকজন লেখকের সাহিত্য ও পরিচালকের চলচ্চিত্র বিগত কয়েক দশকে ভারতবর্ষে সুস্থ সংস্কৃতির প্রসারে অপরিসীম গুরুত্বলাভ করেছে। সাম্প্রতিককালে বাংলার কয়েকটি কমার্শিয়াল স্বঘোষিত 'শ্রেষ্ঠ' পত্রিকার মাঝেও বেশ কিছু ই-ম্যাগাজিনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বেরই জয়ের সূচক।
সাম্প্রতিক ভারত ও কার্ল মার্কস:-
শেষজীবনে নৃতত্ত্ব বিষয়ক বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করে মার্কস প্রচুর মালমশলা নোটস্ আকারে রেখেছিলেন----সম্ভবত এশিয়ার, বিশেষত ভারত ও সিংহলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যে। এমনই একটি গ্রন্থ হল স্যার জন বাড ফিয়ারের (১৮২৫ - ১৯০৫) লেখা 'দ্য এরিয়ান ভিলেন : ইন্ডিয়া অ্যান্ড সিলোন'। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বৃহত্তম উপনিবেশ ভারতের তৎকালীন শাসনকেন্দ্র বাংলার জনজীবন সম্পর্কে মার্কসের বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান অতুলনীয়। দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে একমাত্র তাঁর পক্ষেই দৃশ্যমান ও আগামী ভারত সম্পর্কে মূল্যায়ন ও পথনির্দেশ করা সম্ভব ছিল। আর সেজন্যই তিনি এই সার্থক উক্তি করতে পেরেছিলেন : "মানবিক সম্পর্কের এমন কোনও দিক নেই, যা আমার কাছে দুর্জ্ঞেয়।"
দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারতের স্বাধীনতালাভ আপোষমূলক পথে হওয়ায় সাম্রাজ্যবাদের অবসান হলেও পুঁজিবাদী শোষণ অব্যাহত থেকে গেছে। এদেশের অধিকাংশ অর্থনৈতিক সম্পদ আজও মুষ্টিমেয় মানুষের নিয়ন্ত্রণে। ভারতের কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের জীবনেও তাই অর্থনৈতিক সমস্যা ক্রমবর্ধমান। সরকারী জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি স্বল্পমেয়াদে কিছু মানুষের উপকার করলেও, মূল সমস্যার সমাধান করতে এরা অপারগ। আর ঠিক সেই কারণেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মিলিত সংগ্রামের আদর্শ আজ মার্কসবাদ ছাড়া কি হতে পারে? নানা বিভ্রান্তির মধ্যেও, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সম্পর্কে মার্কসের শিক্ষাই আজ ভারতের নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণীর সামনে আশার দীপবর্তীকা। ক্ষমতাবান মালিকশ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের যে পথ মার্কস দেখিয়েছেন, তা আজও ভারতের জন্য সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
লক্ষ্যণীয়, প্রত্যেকটি বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রই আজ ধর্ম ও জাতিসত্বা ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতার সমস্যায় কমবেশি জর্জরিত। ভারতের মতো জমিদার-শিল্পপতি অধ্যুষিত বহুভাষাভাষী দেশে তো পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। অথচ মার্কসবাদী শিক্ষার আলোকে এ-সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান যে সম্ভব, তা একাধিক দেশের ক্ষেত্রে প্রমাণিত। প্রকৃতপক্ষে জাতিসত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও শ্রমিক শ্রেণীর বৃহত্তর ঐক্য ও আন্তর্জাতিকতাবোধ শুধু জাতিগত বিচ্ছিন্নতার সমাধান নয়, ধর্মান্ধ পুঁজিবাদী ও যুদ্ধোন্মাদ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরও প্রধানতম রক্ষা কবচ।
শেষ কথা:-
মনে রাখতে হবে, কার্ল মার্কস ধনতন্ত্রের বর্তমান সর্বগ্রাসী বিকাশ দেখে যাননি। দেশে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার কায়েম করার পর উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলির ভিডিও টেপ, স্যাটেলাইট, টেলিভিশন সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রভৃতি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজস্ব সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশকেওঅ কিভাবে বিপদাপন্ন করতে শুরু করেছে, তা না-দেখেও ধনতন্ত্রের সংস্কৃতি-ধ্বংসকারী রূপের তিনি সঠিক বর্ণনা করে গিয়েছেন এবং তা প্রতিকারেরও উপায় নির্দেশ করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কার্ল মার্কসের ১৪০ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে গত বছর (২০২৩), যেটি ছিল তাঁর ভারত সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধগুলির ১৭০ তম বছর-পূর্তি। আশার কথা, ভারতের মার্কসবাদী মানুষ আজ তাঁদের নিজেদের পথ বেছে নিয়েছেন---তাঁরা একদিকে যেমন শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামী সংগঠনের ঐক্যকে জোরদার করছেন অন্যদিকে তেমন সকল প্রকার ধর্মান্ধতা-অশিক্ষা-ভোগবাদ-স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের পথে এগিয়ে চলেছেন।
বিবর্তনবাদ ও প্রাণের উৎপত্তিতে পুরাণের গ্রহণযোগ্যতা আদৌ কতটা?
শা শ্ব ত বো স
ভারতবর্ষ এক বৃহত্তর ধর্মযাপনের দেশ। কথাটা লিখলাম শুধু এটা বোঝাতে নয় যে এই দেশ এক সুবৃহৎ জনসংখ্যার ধারক হিসেবে বহু প্রাচীন কাল ধরে নানা ভাষা-জাতি-সভ্যতার মানুষের ভরসাযোগ্য যাপনচিত্র এঁকে চলেছে অগণিত নদীশাখার বহমান ধারায়, সেই সাথে আমি এই ধর্মাচরণ বা ধর্মযাপনের ব্যবহারিক ভিত্তির উপরও জোর দিতে চাইছি। ধর্মকে ঘিরে বহু জাগতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস গঠনতন্ত্র ও নির্দেশিকার প্রবহমান আত্মিকতার সুপ্ত একটি ধারা একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে ধ্বনিত হয়ে চলেছে গোটা দেশটার স্নায়ুতন্ত্রের ভেতর, সেই সভ্যতার প্রারম্ভিক সময়কাল থেকে। হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্মের আখ্যা দেওয়া হয়, এর প্রাচীনতার হিসেবেই শুধু নয় একই সাথে এর বিশালতা ও বিচিত্র ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে সময়বিশেষে এই ধর্মের যাপনের ভিন্নতাও এক্ষেত্রে সমানভাবে বিচার্য হয়ে থাকে। মহাকাব্য, বিজ্ঞান কিংবা অনুমান এই সব কিছুই এই ধর্মের সাথে মিলেমিশে গেছে প্রলম্বিত এক গুরুমন্ত্রের মত। মনে করা হয় মহাভারতের রচয়িতা ব্যসদেব ভারতীয় পুরাণের সংকলক। তবে ইতিহাস অনুসারে পুরাণের সব থেকে প্রাচীন পাঠগুলো গুপ্ত সাম্রাজ্যের কালেই সংকলিত হয়েছিল। এর অধিকাংশ উপাদানই ঐতিহাসিকদের মতে এই সময়কালের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। পুরাণ গ্রন্থগুলি ভারতের নানাস্থানে রচনা করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দে রচিত ছান্দোগ্য উপনিষদে পুরাণের একটি প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ পুরাণকে পঞ্চম বেদ বলে অভিহিত করে (ইতিহাসপুরানম্ পঞ্চম বেদম্)। অথর্ব বেদ এই ধারণাকে পুষ্টি দেয়।
ভারতীয় পুরাণ মোট পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত। যেমন সর্গ বা ব্রম্ভান্ড সৃষ্টির কাহিনী, প্রতিসর্গ: এর পরবর্তী যুগের বা প্রলয় পরবর্তী যুগের কথা বলে, বংশ: এতে দেবতা ও ঋষিদের বংশবৃত্তান্ত নিয়ে বলা আছে, মন্বন্তর: মনুর শাসনকাল যা তিরিশ কোটি চুরাশি লক্ষ আটচল্লিশ হাজার বছরের সমান এবং সেই সময়ের মনুষ্যজাতির সৃষ্টির বর্ণনা দেয় এবং বংশানুচরিতম: যেখানে রাজবংশের ইতিহাস বর্ণিত আছে। আরিয়ান রচিত ইন্ডিকায়, মেগাস্থিনিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে ভারতীয়রা শিব (ডায়োনিসাস) থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (সান্ড্রাকোটাস) পর্যন্ত "ছয় হাজার তেতাল্লিশ বছরে একশো তিপান্ন জন রাজা র কথা স্বীকার করে। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে রচিত বৃহদারণ্যক উপনিষদে গুরু-পরম্পরায় ৫৭টি যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ গুরু-পরম্পরা তারও ১৪০০ বছর আগে থেকে প্রচলিত ছিল। যদিও এই তালিকার যথার্থতা নিয়ে মতদ্বৈত রয়েছে। কহ্লন রচিত রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে বর্ণিত রাজাবলিতে খ্রিস্টপূর্ব ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজাদের তালিকা পাওয়া যায়।
এখন আসা যাক সৃষ্টির আদিকল্পের কথায়। আধুনিক বিজ্ঞানচর্চ্চা শুরু হবার আগেও মানুষের মনে নিজের উৎপত্তি সম্পর্কে কৌতূহল ছিল। এই অজানাকে দেখা, অচেনাকে চেনার স্পৃহাই কিন্তু একদিন জন্ম দিয়েছিল দর্শনবাদের, যা মানুষকে ধর্মীয় মাদকতার পাশাপাশি এক স্বাধীন যুক্তিসম্মত মনন গড়ে তোলার ভিত্তি যোগায়। সেই চিন্তনশীলতাকে আধুনিক ও প্রমাণসাপেক্ষ করে তোলে বিজ্ঞান। তবু আজ এই উত্তর আধুনিক যুগেও, পুরাণ, দর্শন ও বিজ্ঞানের সংঘাত থামেনি। যদি আমরা তুল্যমূল্য বিচারে আসি তাহলে কিন্তু দেখবো, খুব গভীর স্তরের যুক্তিগ্রাহ্য প্রামাণ্য নথি না দিতে পারলেও, সৃষ্টির আদিকালে এই ব্রম্ভান্ডের রূপ ঠিক কেমন ছিল সেই নিয়ে একটি আভাস কিন্তু আমরা আমাদের পুরাণের থেকে পাই। এই যেমন বিজ্ঞান বলছে, এই মহাবিশ্ব প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর পুরোনো। এ প্রসঙ্গে বলা যায় বিগ ব্যাঙ তত্ত্বই প্রাথমিক ভাবে আমাদের সৃষ্টির আদিকাল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটা দিয়েছিল। সে এক ভয়ানক বিস্ফোরণ, যা সাধারণ মানুষের কল্পনাশক্তিরও বাইরে, তাকে অনায়াসে পুরাণে বর্ণিত সৃষ্টির শুরুতে স্থিত মহাপ্রলয়ের সাথে তুলনা করা চলে। সেই সময় থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়েছে ক্রমে, ব্রম্ভান্ডের তাপমাত্রাও কমেছে। এর কিছু পরে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস গঠিত হয়েছে। ক্রমশঃ মহাকর্ষের অধীনে গ্যাসগুলো ঘনীভূত হয়ে বর্তমান মহাবিশ্বের ছায়াপথ তৈরী হয়। সেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সৌরজগতে ৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী তৈরী হয়। আদিমতম পৃথিবীতে কোন বায়ুমণ্ডল ছিল না। গলিত ভর থেকে নির্গত মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া ভূপৃষ্ঠকে ঢেকে দেয়। সূর্য্যের অতিবেগুনী রশ্মি জলকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত করে। অক্সিজেন এবং মিথেনের সাথে মিলিত হয়ে জল CO2 ও অন্যান্য যৌগ গঠন করে। ওজোন স্তর এই সময়েই তৈরী হয়েছিল। পৃথিবী শীতল হওয়ার সাথে সাথে জলীয় বাষ্প অঝোর ধারায় ঝরে পড়ে ও সাগর তৈরী করে। পৃথিবী সৃষ্টির ৫০০ বিলিয়ন বছর পর প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল। সূচনার স্তরে জীবনের প্রথম নন সেলুলার ফর্মগুলি ৩ বিলিয়ন বছর আগে উদ্ভুত হয়েছিল। এরাই হল দৈত্যাকার অণু (আর.এন.এ, প্রোটিন, পলিস্যাকারাইড) ইত্যাদি। এরাই তাদের অণুগুলিকে পুনরুৎপাদন করেছিল। জীবনের প্রথম সেলুলার ফর্মেশন সম্ভবত কোষ গঠনের মাধ্যমেই হয়েছিল। সমস্ত প্রাণের রূপই ছিল শুধুমাত্র জলের পরিবেশে।
এই সূত্রে আমরা বিষ্ণুর দশ অবতারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারি। মানুষ ও জীবজগতের উৎপত্তি ও বিবর্তনের প্রথম যুক্তিগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানসম্মত ধারাটি আমরা ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত, চার্লস ডারউইনের দ্বারা লিখিত গ্রন্থ, ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিন্স অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ এর মাধ্যমে জানতে পারি। গ্রন্থটি প্রকাশের পর যা ডারউইনের মতালম্বীদের ভিতরে “ডারউইনবাদ” রূপে আখ্যায়িত হয়। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে এই মতবাদটির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মনে করা হয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও গবেষণার দৃষ্টান্তের বদলে এটি একটি আদর্শ মাত্র। ডারউইন মূলতঃ প্রাকৃতিক নির্বাচন ও অসংগঠিত বিন্যাসের উপর জোর দিয়েছিলেন তাঁর বক্তব্যে। এই তত্ত্ব মূলতঃ মিউটেশন ও নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির বিবর্তনীয় বৈচিত্র সম্পর্কে জৈবিক তত্ত্বের ধারণা দিতে গিয়ে, “সমষ্টির মধ্যে কিছু জীবের প্রাকৃতিক নির্বাচন”, এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ঠ হয়। জন্ম নেয় একই প্রজাতির অনেক জীব, সৃষ্টির খেয়ালে শুধুমাত্র কিছু কিছু জীবের মধ্যেই সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাদের অস্তিত্ত্বের সংগ্রামে সাহায্য করে। সেই বিশেষ কিছু জীবই পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এখন প্রশ্ন হল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার সময় ডারউইন সাহেব কোন কোন প্রকরণ নিরীক্ষণ করেছিলেন। শোনা যায় যাত্রাকালে চার্লস ডারউইন, গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জে যান। সেখানে তিনি জীবের এক আশ্চর্য্য বৈচিত্র লক্ষ্য করেন। সেখানে তিনি “ফিঞ্চস” নাম পরিচিত এক বিশেষ ধরণের ছোট কালো পাখি দেখেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একই দ্বীপে অনেক জাতের ফিঞ্চ রয়েছে এবং প্রায় সব কটি জাত ওই দ্বীপেই বিবর্তিত হয়েছে। যাদের মূলতঃ বীজ খাওয়ার বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে পরিবর্তিত ঠোঁট সহ আরো অনেক রূপের উদ্ভব হয়েছিল।
এখন আবার আসা যাক পুরাণ প্রসঙ্গে। এই ডারউইনবাদকে অনেক দার্শনিক ও পুরাতত্ত্ববিদ বিষ্ণুর দশ অবতারের প্রাচীন ধারণার সাথে সমানুপাতিকভাবে চিহ্নিত করেন। অগ্নি, পদ্মা, গরুড়, লিঙ্গ, নারদ, স্কন্ধ ও বরাহ পুরাণে এই দশাবতার রূপের বর্ণনা আছে। বিষ্ণু বা নারায়ণ সৃষ্টির আদিকালে ছিলেন যোগনিদ্রায় মগ্ন। প্রলয়ের পরের অবস্থা হল, বিলুপ্তি ও পুরুষ প্রকৃতির মধ্যে বিভাজনের সময়কাল। বিভিন্ন পুরাণ বিশেষতঃ বিষ্ণু পুরাণে বর্ণিত আছে প্রলয়ের পরবর্তীকালে ব্যাপক বর্ষণের পর তৈরী হয়েছিল নিখিল সুরার সাগর। সেই সাগর থেকে উঠে আসেন বিষ্ণু স্বয়ং যোগনিদ্রায় মগ্ন হয়ে। সে নিদ্রা স্বপ্নহীন। তাঁর নাভিপদ্ম থেকে উঠে আসেন সৃষ্টি বিধাতা ব্রম্ভা। বিষ্ণুর এই নিদ্রার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন, তাঁর নয়নাশ্রিত অতুল তামসী শক্তি, বিশ্বেশরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতি সংহার কারিণী, ভগবতী যোগনিদ্রা দেবী। স্বয়ং শ্রী শ্রী সপ্তশতী চন্ডি বর্ণিত ব্রম্ভার স্তবে উল্লিখিত আছে,
“অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ ।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা ।।
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা ।।”
অর্থাৎ তিনি অমৃতরূপা এবং অ-উ-ম ত্রিবিধ মাত্রারূপে অবস্থিত প্রণবরূপা। বিশেষরূপে যা অনুচার্যা, নির্গুণা বা তুরীয়া। তিনিই এই জগৎ ধারণ করেছেন। তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন, পালন করেন আবার প্রলয়কালে তিনিই তা সংহার করেন।
বিষ্ণুর দশাবতার হলেন, যথাক্রমে মৎস, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ এবং কল্কি। এ প্রসঙ্গে গৌড়ের রাজা লক্ষণসেনের রাজসভার পঞ্চরতের অন্যতম এক অসামান্য প্রতিভাধধর কবি জয়দেবের নাম স্মরণ করতেই হয়। বর্তমান বীরভূম স্থিত কেন্দুলী যা সেই সময়ে কেন্দুবিল্ব নামে পরিচিত ছিল, সেই গ্রামেই এই ক্ষণজন্মা পুরুষের জন্ম হয়। ১২ শতকে তাঁর রচিত কাব্য “গীতগোবিন্দ” তে দশাবতার স্তোত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কাব্যের দশাবতার-স্তোত্রেই প্রথম গৌতম বুদ্ধকে 'যজ্ঞনিন্দাকারী' বিষ্ণুর অবতাররূপে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কাব্যের শেষে ভগবানরূপী কৃষ্ণ ভক্ত রাধার শ্রীচরণ নিজের মাথায় রাখার যাচ্ঞা জানিয়েছেন, "দেহি পদপল্লবমুদারম্"। ভগবান বিষ্ণু যুগে যুগে ধরিত্রীর চিরাচরিত প্রাকৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখতে জগতের মঙ্গলের জন্য অবতাররূপে ধরাধামে নেমে আসেন। এই স্তোত্রে জয়দেব অবতাররূপী কেশবের দশরূপের বর্ণনা দিয়ে বন্দনাগানে লিপ্ত হয়েছেন। এই কাব্যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা, রাধার বিষাদ বর্ণনা, কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতা, উপালম্ভ বচন, কৃষ্ণের রাধার জন্য উৎকণ্ঠা, রাধার সখীদের দ্বারা রাধার বিরহ-সন্তাপের বর্ণনা গ্রন্থিত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করাই যায় দশাবতারের প্রাচীন ধারণার ক্রমটিকেও বহু ক্ষেত্রে আধুনিক ডারউইনীয় বিবর্তনের প্রতিফলন হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই ধারণাটিকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করার জন্য এখন যদি আবার আমরা বিজ্ঞানের আঙিনায় ফিরে যাই তাহলে দেখবো এই পৃথিবীতে প্রথম জীবিত রূপ হল প্রায় ৩.২২ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেওয়া নীল সবুজ শৈবাল, “সায়ানোব্যাক্টিরিয়া”। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৩৫০০ মিলিয়ন বছর পুরোনো পাথরে পাওয়া জীবাশ্ম দ্বারা এই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ত্ব প্রমাণিত হয়। এই সায়ানোব্যাকটিরিয়া কিন্তু সাধারণ শৈবাল নয়, এগুলি হল প্রোক্যারিওটিক জীবন রূপ এবং সেই কারণে কোষগুলিতে অর্গানেল ও স্বতন্ত্র নিউক্লিয়াস থাকে না।
দশাবতারের প্রথম শ্লোকে কবি জয়দেব বলছেন,
“প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং।
বিহিতরহিত্রচরিত্রমখেদম্।।
কেশব ধৃতমীনশরীর জয় জগদীশ হরে।।”
অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে অনন্ত জলরাশির তলায় জগৎ সংসার যখন নিমজ্জিত প্রায়, তখন সৃষ্টি রক্ষার্থে জীবের জন্মবীজ স্বরূপ জ্ঞানকেই তিনি নিমজ্জমনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন মৎসরূপী নৌকার ন্যায়। জ্ঞানের স্বরূপার্থে, সৃষ্টির প্রতিরূপার্থে বেদ বা জ্ঞানালোকের প্রতিবম্বই এখানে জীবন বা প্রাণের স্বরূপ। অর্থাৎ কিনা বিজ্ঞানের কত শত বছর আগে পুরাণ আমাদের ধারণা দেয় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল জলে।
দ্বিতীয় শ্লোকে তিনি বলেছেন,
“ক্ষিতিরতিবিপুলতরে তিষ্ঠতি তব পৃষ্ঠে
ধরণিধরণকিণচক্রগরিষ্ঠে।
কেশব ধৃতকূর্ম্মশরীর জয় জগদীশ হরে।।”
পুরাণ বলে বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার হলেন কূর্ম বা কচ্ছপ। সমুদ্রমন্থনকালে মন্থনদণ্ডরূপী মন্দার পর্বতকে পৃথিবীর কেন্দ্রে স্থির রাখার জন্য ভগবান পরিগ্রহ করেছিলেন ভীমকায় কচ্ছপের রূপ, নিজ পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন মন্দার পর্বতকে। সমুদ্র মন্থনের তাড়নায় পৃথিবীর ভারসাম্য যাতে হারিয়ে না যায় তাই পৃথিবীর ভরকেন্দ্রকেই নিজ পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন তিনি। তার সেই গুণবলে পৃথিবী আজও নিজ অক্ষে স্থির আছে। জয়দেব তার কবির অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলেন, পৃথিবীর ভার ধারণের ফলে ভগবানের কূর্মপৃষ্ঠে কিণাঙ্ক রেখা, আবার সেই রেখা তার ক্ষমতার প্রতীকও বটে। পৃথিবীপৃষ্ঠের সাথে ঘর্ষণের ফলে তাঁর পিঠে যে কিণাঙ্ক বা কড়া পড়েছে তা এক অর্থে তাঁর অঙ্গের শোভাও বটে। এবার যদি বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু চোখে এর ভেতর বিবর্তনবাদের ধারাটি খুঁজে দেখতে হয়, তাহলে দেখবো কচ্ছপ উভচর প্রাণী অর্থাৎ জল থেকে স্থলে প্রাণের আগমন হল সবে। কোথাও গিয়ে এই ধারণা বৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদের সাথে মিলে মিশে গেল না কি?
দশাবতার স্তোত্রের এর পরের শ্লোকে কবি বলেছেন,
“বসতি দশনশিখরে ধরণী তব লগ্না
শশিনি কলঙ্ককলেব নিমগ্না।
কেশব ধৃতশূকররূপ জয় জগদীশ হরে।।”
পুরাণ মতে সৃষ্টির অতিপ্রসবহেতু ধরণী যখন রসাতলে তলিয়ে গিয়েছিল, তখন শ্রী হরি একশৃঙ্গী বরাহরূপ ধারণ করে, আপন একদন্ড শীর্ষে পৃথিবীকে সমুদ্র তলদেশ থেকে উদ্ধার করে আনেন। আসলে বসুন্ধরা হরিপ্রিয়া। বরাহ অবতারে তাঁর যেমন রক্ষকের ভূমিকাটি স্পষ্ট তেমনি ব্যঞ্জিত তাঁর প্রেমিক রূপও। উদ্ধারকালে পরম পুরুষ তিনি, ধরণীকে একশৃঙ্গে কর্ষণ করে নবসৃষ্টির সূচনা করেছিলেন। কবি বলেছেন, হে কেশব, চন্দ্রের অবিচ্ছেদ্য রূপ কলংকের ন্যায় বরাহরূপধারী তোমার শুভ্র দশনশিখরে শ্যামলিমা ধরণী মগ্ন হয়ে আছেন। কবি এখানে শৃঙ্গাররসে বিষ্ণুর বরাহরূপকে উজ্জ্বল করে তোলেন। আবার এই বরাহ অবতাররূপেই যেমন পুরোপুরি স্থলভাগে প্রাণের সঞ্চারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি জনন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাণের পুনরোদ্গম ও বংশবৃদ্ধি ভাবনারও একটি স্বচ্ছ ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তিনবার মনুষ্যেতর রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবার পর, চতুর্থবার কেশব ধারণ করলেন অর্ধ মানব-অর্ধ পশু, নৃসিংহ রূপ দুর্দমনীয় দানব হিরণ্যকশিপুর নৃশংস অত্যাচারের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার নিমিত্তে। এই হিরণ্যকশিপু স্বয়ং ব্রম্ভার কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন যে দেবতা মানব দানব তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না, এমনকি তিনি দিন বা রাতে হত হবেন না, এমনকি তাঁর মৃত্যু হবে না কোন অস্ত্রের আঘাতেও। বিবর্তনবাদ, বিজ্ঞান বলে “এপ” নামক এক বিশেষ বন মানুষের জিন মিউটেট ই জন্ম হয়েছে আধুনিক মানুষের। তারা লোমশ ছিল এবং গরিলা এবং শিম্পাঞ্জীর মত হাঁটত। ইথিওপিয়া ও তানজানিয়ায় মানুষের মত হাড়ের কিছু জীবাশ্ম পাওয়া গেছিল, যেগুলি প্রমাণ করে মানুষের পূর্বপুরুষের একটি প্রজাতি পূর্ব আফ্রিকায় ছিল। আবিষ্কৃত হাড়ের মধ্যে কিছু হাড় ভিন্ন প্রকৃতির ছিল, এই হাড়গুলিই ছিল প্রথম কোন মানব সদৃশ প্রাণীর, যাদের বলা হত “হোমো হ্যাবিলিস”। তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা ছিল ৬৫০ থেকে ৮০০ সিসি এর ভেতর এবং তারা সম্ভবত শাকাহারী ছিল। ১৮৯১ সালে জাভাতে আবিষ্কৃত জীবাশ্ম থেকে “হোমো ইরেক্টাস” নামক একটি মানব প্রজাতির কথা জানা যায়, যাদের ৯০০ সিসির মত মাথা ছিল এবং সম্ভবত এরা মাংসাশী ছিল। আজকের উন্ন্ত মানুষের সব থেকে কাছের প্রকরণ “হোমো সেপিয়েন্স” আফ্রিকায় উত্থিত হয়েছিল এবং মহাদেশ জুড়ে তারা স্থানান্তরিত হয়েছিল। জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৭৫ থেকে ১০ হাজার বছর আগে আধুনিক হোমো সেপিয়েন্সের আবির্ভাব হয়েছিল। অর্থাৎ মানুষের শরীরে আজও রয়ে গেছে বন্যতার জিন। সুযোগ পেলেই তাই আজও মানুষ ধরে পশুর রূপ। জীবজগৎ ধরাধাম কেঁপে ওঠে তার নৃশংসতায়। তবু মানবসৃষ্টির আদি পাঠ কিন্তু আমরা পাই, সেই আদি পুরাণেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের অনেক আগেই যার প্রচলন হয়েছিল।
তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল
(শব্দসংখ্যা: ১৮৪১)
এক অদ্ভুত শিল্পী: রামকিঙ্কর বেইজ
সু জা তা দা স
ছেলেটা যে কেন এমন হলো তা আজও বুঝতে পারেননি বাঁকুড়া জেলার যুগীপাড়ায় বসবাস করা মাতা সম্পূর্ণা ও পিতা চন্ডীচরণ পরমাণিক।
তাদের পারিবারিক পেশা ছিল ক্ষৌরকর্ম, কিন্তু এ ছেলেতো ওসবের ধারেকাছেও যেতে চায় না! অবাক বাবা মা'কে আরো অবাক করে যখন তার পছন্দের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে, আর সেই কারণেই মূর্তি তৈরি শিখতে হাতেখড়ি দিলেন রামকিঙ্কর বাঁকুড়ার কুমোর পাড়ার কুমোরদের কাছে তখন ভাগ্যকেই দোষারোপ করেছিলেন এই দম্পতি। একটা সময় সেখান থেকেই দেখে দেখে তৈরি করতে লাগলেন কাদামাটি দিয়ে মূর্তি রামকিঙ্কর, অনন্ত সুত্রধর ছিলেন তার বাড়ির পাশের প্রথম শিক্ষাগুরু। তার কাজে সহযোগিতা করতে করতেই একদিন ভাস্কর্য শিল্পের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় সেই ছেলেটির, দু'চার আনার বিনিময়ে পতিতালয়ের মহিলাদের প্রতিকৃতি বানানোতেও হাত পাকিয়ে ফেললেন একটা সময় সেই ছেলেটি। তিনি ছিলেন জাত শিল্পী, স্বশিক্ষিত শিল্পী বলতে যা বোঝায় এই ছেলেটি হলেন সেটাই, পড়াশোনা তার অপছন্দের ছিলো টেনেটুনে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন এই ভাস্কর যিনি পরবর্তী সময়ে তার নিজস্বতা দিয়ে ভারতীয় ভাস্কর্য কলার অন্যতম অগ্রপথিক হতে পেরেছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প অধ্যয়ণ করে সেই শৈলীকে নিজের ভাস্কর্যে প্রয়োগ করেছিলেন আপন প্রথম প্রয়াসে।
খুব ছোট্ট বেলায় অনেক দারিদ্রতার মধ্যেও ছবি আঁকতেন ছেলেটি, শিমের পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে সবুজ রঙ, মায়ের রান্নার হলুদ দিয়ে হলুদ রঙ, পুঁইএর বীজ দিয়ে বেগুনি, পাহাড়ি মাটি দিয়ে গেরুয়া সাথে ভুষাকালি আলতা এসবই ছিল তার রঙের ব্যবহার। একটু বড় হতে জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার আঁকতেন তেল রঙে এই শিল্পী, আন্দোলনের না বলতে পারা আর না দেখা মুহূর্তকে নিজের মনের রঙে রাঙাতেন নিজেই রামকিঙ্কর। তার প্রতিবাদ অন্যের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাবে এটা কখনো আশাও করতেন না সে'সময় সেই ছোট্ট ছেলেটি।
কিন্তু একদিন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চ্যাটার্জি রাস্তায় পড়ে থাকা রত্নকে কুড়িয়ে নিয়ে এলেন রবি ঠাকুরের সামনে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার নিজের প্রতিকৃতি দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে নিজের সত্ত্বাকে ব্যবহার করবে পিছনে ফিরে দেখবে না কখনো। রামানন্দের সহায়তায় ভর্তি হলেন কলা ভবনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসুর তত্বাবধানে ছেলেটি। উনিশ বছরের রামকিঙ্করের কাজে মুগ্ধ হলেন নন্দলাল বসু ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে তার ছাত্র হয়ে শান্তিনিকেতনে ঢুকে টানা ৪৬ বছর পার করে এই ছেলেটিই একদিন হয়ে উঠলেন ভারতীয় বাঙালি ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ।
শান্তি নিকেতনের শিক্ষা শেষে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ছেলেটি, পরে স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে পদার্পণ করেন ১৯৩৪ সালে। তারপর একসময় ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান হয়ে রামকিঙ্কর অবসর গ্রহণ করেন ৪৬ বৎসর পর ১৯৭১ সালে। একসময় যেমন তার সহপাঠী ছিলেন রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় সহ অনেকে তেমনিই তিনি নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী জহর দাশগুপ্ত ও শঙ্খ চৌধুরীর মতো অনেক ছাত্রকে কারণ তার শিক্ষক নন্দলাল বসু বলেছিলেন স্বপ্ন আঁকতে আর রাতের স্বপ্নকে না ভুলতে, আজীবন কাল সেটাই করে এসেছেন রামকিঙ্কর ভুলে যাননি গুরু মন্ত্র। চল্লিশের দশকে উপনিবেশবাদে নিমজ্জিত ভারতের সংস্কৃতি যখন প্রায় ধুলিস্যাৎ হতে চলেছিলো, সেই সময় শান্তিনিকেতনকে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে গেছিলেন এই ছেলেটিকেই সাথে নিয়ে বিনোদবিহারী মুখার্জী ও নন্দলাল বসু। এভাবেই একদিন শান্তিনিকেতন ভারতের শিল্প সাহিত্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল তাদের সহযোগিতায়। ভাস্কর্য অথবা তৈল চিত্র প্রতিকৃতি অথবা ক্ষুদ্র প্রতিরূপ, একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী হিসেবে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন রামকিঙ্কর। নিজেই ছিলেন নিজের শিক্ষক, তাই হয়ে উঠেছিলেন ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সেরা শিল্পী, ভাস্কর্য গড়ায় ওস্তাদ ছিলেন এই শিল্পী তার সমস্ত শিল্পকর্ম শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত বাতায়নে আজও বিদ্যমান।
নিজের চোখে দেখা সাধারণ নিত্যদিনের জীবনকে পাশ্চাত্যের ধাঁচে মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন তার সকল শিল্পকর্ম, যা আজও শান্তিনিকেতনের আনাচেকানাচে জীবন্ত--- এদের মধ্যে সুজাতা, গৌতমবুদ্ধ, সাঁওতাল পরিবার, যক্ষ যক্ষী, ও আরও অনেক শিল্পকর্ম তার হাতের গুণে আমাদের আজও আকৃষ্ট করে।
আকন্ঠ সুরাপানের ফলে মানুষটার ভেতর থেকে যে অদ্ভুত মানুষ বেড়িয়ে আসত সে ছিলো এক কল্পলোকের বাসিন্দা, সেই রামকিঙ্করের ভেতর থেকে বার করে আনতো সেই শিল্পকলাকে কখনও সিমেন্ট বালি পাথরের সংমিশ্রণে কখনো রঙ তুলির আঁচড়ে। সারা জীবন তো বটেই এমনকি হাসপাতালে মৃত্যুকালীন প্রতীক্ষার সময়ও তার কাজ চালিয়ে গেছেন রামকিঙ্কর।
যিনি দারিদ্র্য সম্বল করে জন্মেছিলেন এক ক্ষৌরকর্মীর ঘরে, সেই মানুষটিই একদিন সন্মানের মুকুট মাথায় নিয়েছিলেন অবলীলায়।
১৯৭০ খৃষ্টাব্দে তিনি পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন তাছাড়াও ১৯৭৫ এ আনন্দ বাজার থেকে সন্মানিত হন তারপর সাহিত্য একাডেমীর দেশিকোত্তম এবং বিশ্বভারতীর থেকে ডিলিট উপাধি পান, ৭৪ বছরের অবাধ জীবন কাটিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন অমৃত লোকে। তারপর কেটে গেছে তিনটি যুগ তবু আজও তিনি প্রাসঙ্গিক ভাস্কর ও চিত্রশিল্পে আধুনিকতার জনক হিসেবে।
এই নমস্য ব্যক্তিত্ব রামকিঙ্কর বেইজ যিনি ১৯৮০ সালের দোসরা আগষ্ট রাত বারোটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তার প্রিয় শান্তি নিকেতন থেকে অনেক দূরে।।
সম্পর্ক
স ঙ্ঘ মি ত্রা ব্যা না র্জি
সম্পর্ক হল এমন কিছু চার অক্ষরের মিলিত শব্দ যেই শব্দের অর্থ খুঁজতে খুঁজতে মানুষের গোটা জীবনটাই চলে যায় তাও মানুষ সঠিক অর্থ খুঁজে পায় না। সম্পর্ক হল এমন এক বিরল অনুভূতি যেই অনুভূতির বশবর্তী হয়ে আমরা সবাই পৃথিবীতে আসি। আমরা সেই মানুষটিকে ভুলে যাই যার সুসম্পর্কের বশবর্তী হয়ে আমরা পৃথিবীতে এসেছিলাম পৃথিবীটা উপভোগ করছি পৃথিবীতে এই সব রকম অনুভূতি আমরা ভোগ করছি সে হলো আমাদের মা। মাঝে মাঝে আমরা সেই মা শব্দটারই অর্থ ভুলে যাই। সম্পর্ক গুলো সেটাই যেটা হৃদয় থেকে অর্থাৎ মন থেকে গ্রহণ করতে হয় শুধু মুখ থেকে নয়। সম্পর্ক শুধু সুখে-দুখে পাশে থাকা নয় সম্পর্ক হল এমন এক অনুভূতি যা অনেক সময় কাছে না থেকেও অনুভূত হয়। যেকোনো সম্পর্কেই থাকে দায়বদ্ধতা। আর সেই দায়বদ্ধতা সঠিকভাবে পালন করতে পারলেই যে কোন সম্পর্ক সু সম্পর্কে পরিণত হতে পারে। বর্তমানে কর্মব্যস্ত জীবনে ছোটখাটো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে জটিল সমস্যা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। এই নিজে থেকে তৈরি করার সমস্যাগুলি অনেক সম্পর্ককে নিয়মিত আঘাত করে চলেছে। সম্পর্কগুলো এমন স্বাধীন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ যা জোর করে কারো সাথে করা যায় না। সম্পর্ক তখনই কারো সাথে সম্ভব যখন দুজন মানুষ একই চিন্তার বশবর্তী হয় অর্থাৎ তাদের দুজনের মধ্যে মনের মিল থাকে। সম্পর্কের ভিত হল বিশ্বাস ও ভালোবাসা। এই দুই অনুভূতি না থাকলে সম্পর্ক কখনো সঠিকভাবে তৈরি হয় না। যেই সম্পর্কের মনের মিল থাকেনা শুধু লোক দেখানোর জন্য তৈরি হয়, সেই সম্পর্ক বেশি দূর বেশি দিন চলতে পারে না। আবার যে সম্পর্কে বিশ্বাস ও ভালোবাসা দায়বদ্ধতা থাকে সেই সম্পর্ক মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্তও টিঁকে থাকে কারণ এই সম্পর্কের ভীত ছিল ভালোবাসা। যেই সম্পর্কের মূলে বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকবে সেই সম্পর্ক টিঁকে থাকতে বাধ্য কারণ বিশ্বাস ও ভালোবাসা হলো সম্পর্কে একে অপরের পরিপূরক. নইলে যে কোন সম্পর্ক তাসের ঘরের মতো যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।বর্তমান সমাজে মানুষের ধৈর্য কমে যাচ্ছে যা যে কোনো সম্পর্কের বাঁধনটাকে সক্রিয় করে না। ইগো অহংকার এবং অবিশ্বাস যা কিনা একটি সম্পর্কের ভিতকে নষ্ট করে দেয় কোন নতুন সম্পর্কের শুরুর আগেই বিনাশ করে দিচ্ছে। তাই প্রত্যেকটি মানুষ যদি জীবনে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের কথা যথা আত্মমর্যাদা সততা সম্মান যোগাযোগ ও স্পেস এগুলো বিপরীত মানুষটিকে দিতে পারে তবে সেই সম্পর্কে কখনো চিড় ধরে না দীর্ঘদিন ধরে তার সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে। সম্পর্ক হল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যা বিশ্বাস ও ভালবাসার উপর দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে এক শব্দের অভাব ঘটলেই অন্য কোন উত্তাল ঢেউ এসে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু মানুষের এত কিছু সমস্যার মধ্যেও সম্পর্ক ছাড়া মানুষ বাঁচতে অক্ষম তাই সম্পর্ক মানুষ তৈরি করতেই পারে। যেমন জল ছাড়া মাছ বাঁচতে পারে না, বাঁচা সম্ভব নয়। তেমনি মানুষও প্রতিনিয়ত সম্পর্ক তৈরি করে চলেছে আঘাত খেয়েও। সে সম্পর্ক মাতৃত্বভিত্তিক হতে পারে বা বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক হতে পারে। সবকটি একেকটা বিভিন্ন দিক থেকে দেখা সম্পর্কে উদাহরণ যা প্রত্যেকটা মানুষের নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের মধ্যে আছে। আমরা জানি না আমাদের জীবনে খুব কাছের সম্পর্ক ছাড়াও বাইরের জগতে বিভিন্ন মানুষের সাথে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্নভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। কোন সম্পর্ক ঠিক কতদূর হতে পারে তা নিয়ে মানুষ অজ্ঞাত তবুও মানুষ বাজি রেখে সম্পর্ক তৈরি করে। একটা বাগানে যখন একটা ফুল ফোটে তখন সে ফুলটিকে আরো সুন্দর বড় করার জন্য নিয়মিত জল দিতে হয় তখন সে ফুল দেওয়ার মানুষটির সাথেও ফুলটির একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটাও একটা সম্পর্কের উদাহরণ। একটা পশুকেও যখন একটা নির্দিষ্ট সময় নিয়মিত খেতে দেওয়া হয় তখন এই পশুটির সাথেও যে খেতে দিচ্ছে তার একটা সুন্দর সম্পর্কও গড়ে ওঠে নাইবা হোক সেটা আত্মিক, আজকের পৃথিবীতে সব আত্মিক সম্পর্ক গুলো মিথ্যা সম্পর্কে পরিণত যেটা সমাজের ওপর খুব বাজে প্রভাব পড়ছে। তাই সম্পর্ক যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে যে কোন মানুষ পশুর নিথর জিনিসের হতে পারে। কোন মানুষকেও আপনি না চিনলে তার সাথে দুটো ভালো করে কথা বললেও একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এই পৃথিবীতে এমন অনেক অনাথ ছেলে-মেয়ে আছে। যাদের সত্যিই নিজের বলে কেউ নেই তবুও আজকের দুনিয়ায় তারা কিন্তু একা নয়। সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাছে। শুধুমাত্র মিষ্টিমুখ, হাসি আর সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিলেই সম্পর্ক তৈরি হয়, পোক্তও হয় কালক্রমে।
মেরিলিন বোবস লিওন (কিউবার কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক ও সম্পাদক)
শং ক র ব্র হ্ম
১৯৫৫ সালে হাভানা, কিউবাতে মারিয়া দে লস অ্যাঞ্জেলেস বোবেস লিওন জন্মগ্রহণ করেন। মেরিলিন বোবস লিওন ১৯৭৪ সালে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা শুরু করেন এবং ১৯৭৮ সালে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি প্রেসা ল্যাটিনা এবং ম্যাগাজিন রেভোলুসিয়ন ওয়াই কালচারার মতো প্রধান সংবাদ আউটলেটগুলির জন্য কাজ করা একজন সাংবাদিক হিসাবে তার পেশাগত জীবন চালিয়ে যান। তিনি কবিতার ক্ষেত্রে তার আত্মপ্রকাশ করেন যখন তার কবিতার সংকলন লা আগুজা এন এল পাজার (১৯৭৯ সালে প্রকাশিত) ১৯৭৯ সালে কবিতার জন্য ডেভিড সাহিত্য পুরস্কার জিতেছিলেন।
পরবর্তীতে, ১৯৯৬ সালে, তার ছোট গল্পের সংকলন, Alguien tiene que llorar (১৯৯৫ সালে প্রকাশিত) Casa de las Américas পুরস্কার জিতেছিল। এই একই বছর, বোবস কিউবার ফিলোলজিস্ট, শিক্ষক এবং লেখক মির্তা ইয়ানেজের সাথে এস্টাতুয়াস দে সাল প্রকাশ করেন। কিউবার মহিলা লেখকদের কথাসাহিত্যের প্রথম সংগ্রহ ছিল 'ইস্তাতুয়াস দে সাল'।
তিনি ১৯৯৩ সালে মেক্সিকোতে Premio Latinoamericano de Cuento Edmundo Valdés এবং ১৯৯৪ সালে পেরুর Premio de Cuento Hispanoamericano Femenino Magda Portal পুরষ্কার জিতেছিলেন তার কবিতা "Alguien tiene que llorar" এর জন্য।
২০০৫ সালে, তিনি তার উপন্যাস Fiebre de invierno এর জন্য Premio Casa de las Américas de Novela এবং ২০১৬ সালে তার গল্প "A quien pueda interesar" এর জন্য পুরস্কার পান জুলিও কর্তাজার।
উপরন্তু, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে তিনি Unión de Escritores y Artistas de Cuba (ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অফ কিউবা, UNEAC)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন যে তিনি UNEAC ত্যাগ করেছেন কারণ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি তার লেখার মাধ্যমে আরও কার্যকরভাবে বিশ্বের পরিবর্তন করতে পারবেন।
তাঁর লুক্সেমবার্গের লেখক জিন পোর্টান্তের সাথে মেসিডোনিয়ায় একটি কবিতা উৎসবে তাদের দেখা হয়েছিল। ছয় বছর পরে তারা বিয়ে করেছিলেন।
মেরিলিন বোবস তার প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন যখন তাঁর বয়স প্রায় বারো বা তেরো বছর। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মনে করেন যে যখন চিলি থেকে তার স্কুলের একজন বন্ধু তাকে সিজার ভ্যালেজো, জুয়ান গেলম্যান এবং রোক ডাল্টনের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি লেখালেখি করতে চান। এই সময়ে (১৯৭০ সালের দিকে) তিনি সিলভিও রদ্রিগেজ, পাবলো মিলানেস এবং কাতালান গায়ক ও গীতিকার জোয়ান ম্যানুয়েল সেরাতের সঙ্গীত দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন যা কিউবায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার কিশোরী বয়সে, তাঁর মা এখন মৃত কবি রবার্তো ব্রানলিকে (তাঁর প্রতিবেশীর বন্ধু) বোবসের কবিতা দেখান। তিনি কিউবার তরুণ লেখক ও শিল্পীদের একত্রিত করে এমন একটি সংগঠন ব্রিগাডা হারমানস সেনজ-এর সাহিত্য কর্মশালায় যোগ দেওয়ার জন্য বোবসকে পরামর্শ দেন। এই কর্মশালায় তিনি তার কাজের জন্য যথেষ্ট সমালোচনা পেয়েছিলেন, যেহেতু তার সমবয়সীদের থেকে ভিন্ন, তার কবিতা কিউবার সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা সম্পর্কে নয়, কিন্তু যৌন স্বাধীনতা, ক্যাথলিক মতবাদ এবং ঐতিহ্য ভঙ্গের বিষয়ে ছিল।
তিনি ১৯৭৪ সালে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ১৯৭৮ সালে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তার পড়াশুনা চলাকালীন, তিনি নিজে থেকে কবিতা লিখতে থাকেন, কারণ তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে তার লেখা তার সমবয়সীদের দ্বারা গ্রহণ করা হবে না। তিনি শুধুমাত্র তার লেখা বন্ধুদের একটি ছোট গ্রুপের সাথে শেয়ার করবেন যারা অপ্রচলিত থিম নিয়ে পড়া এবং লেখার আগ্রহও শেয়ার করেছেন। এর মধ্যে কবি আন্দ্রেস রেনাল্ডো।
তার প্রথম কবিতার সংকলন, Alguien que está escribiendo su ternura, ১৯৭৮ সালে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের "13 de marzo" কবিতা প্রতিযোগিতায় সম্মানসূচক উল্লেখ জিতেছিল। ১৯৭৯ সালে তিনি লা আগুজা এন এল পাজার শিরোনামের কবিতা সংকলনের জন্য ইউনিওন দে এসক্রিটোরস ওয়াই আর্টিস্টাস ডি কিউবা (ইউনইএসি) এর "প্রিমিও ডেভিড" পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি দাবি করেন যে "প্রিমিও ডেভিড" পুরস্কার জেতা কিউবার সাহিত্য জগতে তার আনুষ্ঠানিক প্রবেশকে চিহ্নিত করেছে।
১৯৭৮ সালে ইতিহাসে ডিগ্রী সহ হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর, বোবস তার পেশাগত পেশা সাংবাদিকতায় উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে তিনি এই কর্মজীবনের পথটি বেছে নিয়েছিলেন কারণ এটি লেখার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করার একমাত্র উপায় বলে মনে হয়েছিল। তিনি দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে Prensa Latina এবং Revolución y Cultura পত্রিকার সংস্কৃতি বিভাগের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭৮ সালে ইউনিয়ন ডি পেরিওডিস্তাস দে কিউবা (কিউবান সাংবাদিকদের ইউনিয়ন) তাকে জনপ্রিয় কিউবান সঙ্গীত সম্পর্কে ধারাবাহিক নিবন্ধ লেখার জন্য একটি পুরস্কার প্রদান করে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার সময়, বিশেষ করে প্রেনসা লাতিনার সংস্কৃতি বিভাগে, বিশেষত কাজের জায়গায় নারীবাদ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতি তার প্রতিফলন করার একটি উপায় হিসাবে কাজ করেছে। প্রেনসা লাতিনার সংস্কৃতি বিভাগে তিনি যাদের সাথে কাজ করেছেন তাদের বেশিরভাগই মহিলা, যখন তার সমস্ত বস ছিলেন পুরুষ। তিনি সাংবাদিকতায় তার কর্মজীবনকে একজন লেখক হিসাবে তার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখেন কারণ এটি তার লেখায় শৃঙ্খলা দেয়।
সমালোচকরা মেরিলিন বোবসের কবিতাকে নারী চরিত্রের প্রান্তিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার অনেক কবিতায় তিনি প্রখ্যাত মহিলা লেখকদের ইঙ্গিত করেছেন। তার কয়েকটি কবিতায়, যেমন "Triste oficio", তিনি একজন পুরুষ সাহিত্য সমালোচকের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করেছেন। অনেক সমালোচক এটিকে লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারী প্রান্তিকতার দিকে মনোযোগ দেওয়ার একটি উপায় হিসাবে দেখেন।
তার প্রথম কবিতা সংকলন, Alguien que está escribiendo su ternura বিখ্যাত মহিলা কবিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যারা তার পূর্ববর্তী এবং নারী লেখক হওয়ার কষ্টগুলি অনুভব করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে হল: Sor Juana Inés de la Cruz, Gertrudis Gomez de Avellaneda, Gabriela Mistral এবং Alfonsini Storni। নারী চিত্র তাই এই সংগ্রহের একটি বিশিষ্ট বিষয়।
তিনি ১৯৭৯ সালে লা আগুজা এন এল পাজার শিরোনামের কবিতা সংকলনের জন্য "প্রিমিও ডেভিড" পুরস্কার পেয়েছিলেন। তারপর তিনি ১৯৮৯ সালে আরেকটি কবিতা সংকলন, Hallar el modo প্রকাশ করেন। এই সংকলনের শিরোনামটি রোজারিও কাস্তেলানোসের বিখ্যাত কবিতা "Meditación en el umbral"-এর প্রতি ইঙ্গিত করে এবং এইভাবে তাকে সচেতনভাবে নারীবাদী হিসেবে দেখা হয়েছে। তার তৃতীয় কবিতা সংকলন, Revi(c)itaciones y homenajes, ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত, ধারণা এবং চিত্রের ইঙ্গিত করে আন্তঃপাঠ্যতা ব্যবহার করে যা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট যেমন হোসে মার্টি, জর্জ লুইস বোর্হেস, রেইনার মারিয়া রিল্কে। এটি করার মাধ্যমে, সমালোচকরা এই সংগ্রহটিকে উত্তর-আধুনিক ধারণার সাথে জড়িত এবং বহুবিধ কণ্ঠস্বর ব্যবহারের মাধ্যমে নারী পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ হিসাবে দেখেন।
ববসের বর্ণনামূলক লেখা (ছোটগল্পের সংকলন এবং উপন্যাস উভয়ের সমন্বয়ে গঠিত) মূলত নারীদের নিয়ে, বিশেষ করে সমসাময়িক সমাজে নারীদের ভূমিকা নিয়ে। তার কয়েকটি কাজের মধ্যে তিনি কিউবার সামাজিক বাস্তবতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রান্তিক চরিত্রগুলিতে ফোকাস করতে পরিচিত।
তার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে একটি, 'অ্যালগুয়েন টাইনে কুইলোর' হল ১৯৯৫ সালে সালে প্রকাশিত গল্পের একটি সংকলন, যা ১৯৯৬ সালে কাসা দে লাস আমেরিকাস পুরস্কার জিতেছিলএই সংকলনের মধ্যে তার সবচেয়ে পরিচিত গল্পে, যার শিরোনামও "অ্যালগুয়েন টাইনে কুইলরর," বোবস এমন একদল বন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন যারা সকলেই মারিটজা নামে একজন মহিলার আত্মহত্যার বিষয়ে তাদের স্বতন্ত্র মতামতের সাথে মিলিত হচ্ছেন এবং তাদের স্বতন্ত্র মতামত প্রকাশ করছেন। মারিৎজা তার যৌন স্বাধীনতার জন্য এবং তার পরিবারের চেয়ে তার ক্যারিয়ারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য প্রশংসিত এবং সমালোচিত। যদিও অনেক সমালোচক এই বইটিকে লেসবিয়ানিজমের বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রথম কিউবান বর্ণনার একটি হিসাবে দেখেন, বোবস নিজেই যুক্তি দেন যে বইটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিদের সম্পর্কে যে রায় দেয় সে সম্পর্কে, কারণ তিনি সরাসরি সমকামিতার উল্লেখ করেননি। তদুপরি, তিনি 1989 সালে শুরু হওয়া কিউবার অর্থনৈতিক সঙ্কটকে দেখেন, শান্তির সময়ের বিশেষ সময়কাল (Periodo বিশেষ) হিসাবে বিবেচিত হয়, এই গল্পের মূল কারণ এটি দেশে ঘটতে থাকা বৃহত্তর সঙ্কট থেকে উদ্ভূত স্বতন্ত্র সংকট মোকাবেলা করে। এই সংগ্রহের মধ্যে আরেকটি গল্প, "প্রেগনতাসেলো এ ডিওস" কিউবার প্রেক্ষাপটে নারী চরিত্রগুলিকে অন্বেষণ করে, বিশেষ করে নির্বাসনের পরিণতি। সংগ্রহটি আবার কিউবা, আর্জেন্টিনা এবং ইতালিতে সম্পাদনা করা হয়েছিল।
২০০৫ সালে বোবস তার প্রথম উপন্যাস 'ফিব্রে দে ইনভিয়ের্নো'-র জন্য "প্রিমিও কাসা দে লাস আমেরিকাস ডি নভেলা" পুরস্কার পান। শিরোনামটি ডিলান থমাসের শ্লোকের প্রতি ইঙ্গিত করে: "মুডা প্যারা ডিসিরলে আ লা রোসা এনকোর্ভাদা/কুয়ে ডোবলেগা মি জুভেন্টুদ লা মিসমা ফিব্রে ডি ইনভিয়ারনো" [এবং আমি কুটিল গোলাপকে বলতে বোবা/ আমার যৌবন একই শীতের জ্বরে বেঁকে গেছে]। উপন্যাসটি একজন চল্লিশ বছর বয়সী মহিলার সম্পর্কে, যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার স্বামী অবিশ্বস্ত হয়েছে, নিজেকে খুঁজে পেতে কিছুটা সময় নেয়। 90-এর দশকে কিউবায় সেট করা হয়েছে (দ্য স্পেশাল পিরিয়ড), উপন্যাসটি তার চল্লিশের দশকের একজন মহিলার অভ্যন্তরীণ জগতকে অন্বেষণ করে যিনি সবেমাত্র দ্বিতীয়বার বিবাহবিচ্ছেদ করেছেন। fiebre de Invierno পপ সংস্কৃতির রেফারেন্স যেমন সেক্স এবং সিটি এবং মারিয়া ব্রাউন এবং এমা বোভারি সহ পরিসংখ্যানগুলিকে নির্দেশ করে।
(অ্যান্থোলজিস)
কিউবার নারী লেখকদের দৃশ্যমানতা বাড়ানোর জন্য ববস তার অনেক লেখা উৎসর্গ করেছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত কিউবার নারী লেখকদের মির্তা ইয়ানেজের সাথে এস্টাতুয়াস ডি সাল নামে একটি সংকলন তৈরি করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে ১৯৯০-এর আগে বিশেষ করে কিউবায় সাহিত্য জগতে নারীদের বেশিরভাগই বাদ দেওয়া হয়েছিল, এবং এইভাবে এই সংকলনটি কিউবায় প্রথমবারের মতো নারীদের কথাসাহিত্যকে একচেটিয়াভাবে সংকলন করে। বোবস এবং ইয়ানেজ এই কাজটিকে "সাহিত্যিক প্যানোরামা" হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি এই কাজটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা বিন্দু হিসাবে দেখেন যা সাহিত্যের অত্যন্ত পুরুষালি জগতের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
ববস ইরোস এন লা পোয়েসিয়া কিউবানা (১৯৯৫ সাল) এবং কুয়েন্টিস্টাস কিউবানাস ইনকুয়েট্যান্টেস: অ্যানটোলজিয়া সোব্রে ইনফিডেলিদাড (২০০৩ সাল) সহ মহিলাদের লেখার আরও কয়েকটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও তিনি আলফনসিনা স্টর্নি সম্পর্কে বিশেষভাবে এন্ট্রে এল লারগো ডেসিয়ের্তো ওয়াই লা মার (১৯৯৯ সাল) নামে একটি সংকলন এবং সোমব্রা সেরে কিউ নো দামা: অ্যানটোলজিয়া পোয়েটিকা (২০০০ সাল) নামে একটি সংকলন করেছেন যাতে ক্যারিল্ডা অলিভারের কবিতা রয়েছে।
(গ্রন্থপঞ্জি ও পুরস্কার)
প্রিমিও ডেভিড ডি পোয়েসিয়া দে লা ইউনিওন ডি এসক্রিটোরস এবং আর্টিস্টাস ডি কিউবা (UNEAC) (১৯৭৯ সাল)।
Premio Latinoamericano de Cuento "Edmundo Valadés" del Instituto de Bellas Artes de Mexico, (১৯৯৩ সাল)।
ফ্লোরা ট্রিস্টান পেরুভিয়ান উইমেন সেন্টার (১৯৯৪ সাল) থেকে প্রিমিও
হিস্পানোআমেরিকানো ডি কুয়েন্টো "ম্যাগদা পোর্টাল"।
প্রিমিও কাসা দে লাস আমেরিকা দে কুয়েন্টো, লা হাবানা (২৯৯৫ সাল)।
প্রিমিও কাসা দে লাস আমেরিকাস ডি নভেলা (২০০৫ সাল)।
Premio Iberoamericano Julio Cortázar (২০১৬ সাল)।
[তথ্য - অন্তর্জাল]
(১,৪৬৪ শব্দ)।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন