কথিকা/মুক্তগদ্য
আমার জন্ম… আমার দেশ… আমার মৃত্যু
শা ন্ত ম য় গো স্বা মী
এই ধর্মের দেশ আমার নয়...
এই নানা ধর্মের দলদাস রাজনৈতিক দলের সৃষ্ট রাষ্ট্র আমার নয়...
আমার দেশ হোক মানবতার...
আমার দেশ হোক কবীর, নানক, যীশু, রামকৃষ্ণের...
আমার দেশ হোক নিবেদিতা, রোকেয়া, টেরিজা আর প্রীতিলতার...
আমার দেশ হোক সবুজ অরণ্যের, পাখি আর প্রজাপতিদের...
আমার দেশ হোক কাঁটাতার ছিঁড়ে ফেলা ভাই-ভাই মানসিকতার...
আমার দেশ হোক পরোপকারের, বন্ধুত্বের, উন্নত বিজ্ঞানের!
জন্মের একটা আড়াল লাগে। দেশের জন্মেও লাগে। তাই হয়তো আগাগোড়া শূন্যতা দিয়ে তৈরি মানসিকতার কাঠামোগুলোকে মানুষ ঢেকে রাখে। আর এই গোপনে, এই অন্তরালে, এই জরায়ুতে বেড়ে ওঠে হীন হূনরা। তাদের জানালার মতো চোখ আর সিঁড়ির মতো দাঁত হয়। এই তো আর কয়েকদিন! তারপর তারা দলে দলে যুবক খাবে, তরুণী খাবে, ছেড়ে কথা বলবে না শিশুদেরও। চুষে চুষে সবাইকে ভিখারী আর বেশ্যা বানিয়ে ছেড়ে দেবে। আপামর সবাই তখন তাদের গলায় আটকে থাকা দেশযাপন করতে গিয়ে দেখবে তাদের মস্তিস্কটাই লাপাত্তা। তারা তখন মুখস্তবিদ্যা আর অনুগত ভাবাদর্শকে কোলে পিঠে বড় করে তুলছে। বিপরীতমুখী যাকিছু সবতেই তাদের প্রতিহিংসা জেগে ওঠে। তাই দেখবো ভাঙচুর… গড়িয়ে যাবে রক্তস্রোত প্রতিবেশী, পরিজনদের মৃত্যু কান্না বেয়ে। উল্লসিত হবে শুধু কিছু আল্লা হো আকবর… নারায়ে তাকবীর বা জয় শ্রীরাম… হরহর মহাদেবের শৃঙ্খলিত পতাকার ঝাঁপান টহলে।
জন্মের আড়াল লাগে। কবিজন্মেও লাগে। তাই হয়তো এ বাংলার বিধ্বস্ত সাহিত্য চেতনার নানান মঞ্চে, পত্রিকায়, কাব্য সংকলনের পেটে প্রিয় কবিতারা নিজেদের অবিরাম জন্ম দিয়ে চলে। জরায়ুর গান লেখে, লেখে দ্বেষ… লিখে রাখে নানান মৃত্যুচিন্তা। কবি আর লেখকেরা এখন জীবন্ত লাশ, শুধু লাশ হয়ে ঝিমায় অদরকারী কিছু অক্ষর উঠোনে। সেইসব লাশও আশ্রয় খোঁজে, ঘরে যায়, সঙ্গম শেখে… সঙ্গম করে পরিচিত অথবা দখল করা জমিতে। কসাইয়ের দোকানে শিখে নেয় ধীর-স্থির জান্তব উল্লাস। লাশেরও কিছু সমাধা করার কাজ বাকি থাকে। লাশেরা পরিচিত উঠান খোঁজে, খোঁজে চেনা সুপারিগাছ। লাশেদের ভাবনায় থাকে কিছু প্রতিবাদের মীমাংসার কথা… যা তারা রোদের কোটরে লক্ষ সংখ্যায় গুছিয়ে রেখেছে।
মৃত্যুর জন্য আমার খুব মায়া হয়। মৃত্যুর সময়ও আমরা মৃত্যুর কথা ভাবি না… ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবি। কারণ, জীবন যাদু জানে। জীবন আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। কিন্তু জীবনই মৃত্যুকে জন্ম দেয়। একটা বয়সে মানুষ নিজের শরীরে গুটিয়ে যেতে শুরু করে, বৃদ্ধ বিধবাদের মতো। যৌবনের সমস্ত প্লাবনকে নিজের ভেতর ফিরিয়ে নেয়। কচ্ছপের মতো নিজেকে সমাহিত করে নিজের ভেতর। এত এত যে লালন পেয়েছে… আত্মরতির চূড়ায় দূরত্বকে পেয়েছে মুখোমুখি… এখন সে সহজেই আতরদান বদলে ফেলতে শিখে গেছে। এত যে মৃত্যু প্রতিদিন… জীবিত থেকেও তার দায় কে নেবে? কে করবে তার প্রকৃত সৎকার?
তনুময় এখন কোথায়
দু র্গা প দ ম ন্ড ল
জানিস সৃজন, সেদিন তনুময়ের সঙ্গে দেখা। তোর তো মনে আছে ভার্সিটির স্কলার তনুময়কে। সেদিন তখন তনুময় গোধূলির আলোর দিকে তাকিয়েছিল। মনে হলো ও বুঝি কাউকে খুঁজছে।
একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম: কীরে, কী দেখছিস! ও আমার দিকে কেমন একটা ঘোলাটে দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত দেখে বলল: এই যে স্যার, আপনি আমার বাড়ির রাস্তাটা দেখিয়ে দেবেন?--- তিন নম্বর ভোলানাথ স্ট্রীট, নাকি শিবদাস লেন!
ওকে জোরে নাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করি: আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি---। আমাকে থামিয়ে দিয়ে তনুময় আবার বললে: আমাকে রাস্তাটা একটু দেখিয়ে দিন না, প্লিজ।
জল ছবির মত দিগন্তের ওপার থেকে কেউ যেন ডাকছে কি তন্ময়কে! হঠাৎ হাত নেড়ে ও বলল: এইতো আমি এখানে। বর্ধমান ডাউনটা এলেই উঠে পড়ছি। বলতে বলতে দ্রুত কোথায় যে তনুময় হারিয়ে গেল, বুঝতে পারলাম না।
এমন অমিল পয়ার কেন বলতো সৃজন?
নৈঃশব্দ্যের তর্জনী এখন ঢেকে দিচ্ছে শালবনীর জঙ্গল সীমানা।দূরে কোথাও কে যেন সেতারে ছড় টেনে যাচ্ছে বাগেশ্রী বাহারে নাকি বসন্ত পঞ্চমে? প্রশ্নাতুর আমি এখনো অদৃশ্য তনুময়ের ভাস্কর্যের টানে।।
মৃত্যু
ত পু দে ব
জন্ম হলে মৃত্যু হবেই এটাই বাস্তব তবু মেনে নিতে কষ্ট হয়। প্রিয়জনের স্পর্শ লেগে থাকে হাতে, মননে। নিষ্প্রাণ শরীর জুড়ে অব্যক্ত ভাষা, আমি এই শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছি, বলছি- "ওঠো এই তো মনে হচ্ছে তুমি হাসছ, কেমন যেন শুয়ে রয়েছ, তোমার শরীরে এখনো তাপ অনুভব করছি তবে উঠছো না কেন? শুনছো আমি ডাকছি।"
তোমার তো কোকিলের ডাক শুনতে ইচ্ছে হোত, শুনতে পাচ্ছো গাছে গাছে কোকিল ডাকছে--- তুমি কথা দিয়েছিলে থাকবে..., কি সুন্দরী দেখাচ্ছে তোমায়! নতুন শাড়ি সিঁথিতে সিঁদুর কপালে বড়ো টিপ পায়ে আলতা- অপরূপা তুমি, চোখ ফেরানো যায় না, কে বলবে তোমার প্রাণ নেই, মনে হচ্ছে তুমি এখুনি উঠে বসবে বলবে তুই এসেছিস বোন?
চারদিক কেমন শূন্য লাগছে, শুধু শূন্য--- এত সুন্দর চোখ দুটো তুলসী পাতায় ঢেকে তুমি পাড়ি দিলে নিরুদ্দেশ যাত্রায়। ফিরে ফিরে তোমার কণ্ঠস্বর, কথা কানে বাজছে, আমাদের হাসি খুশির দিনগুলো মনে পড়েছে... আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে- চললাম, মুক্তি... মুক্তি... সমস্ত ব্যথা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। আমি জোরে জোরে ডাকছি দিদি... দিদি... প্রতিধ্বনি হচ্ছে দিদি... দিদি...।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন