রম্য রচনা

নববর্ষ

অ সী ম পা ঠ ক

সবটাই কি ডারউইনের তত্ত্ব? যোগ্যতমের উদ্বর্তন... অবশ্য যে হারে ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে, লালমুখো সাহেবরা দেশ ছাড়লেও সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইংরেজিকে আমরা অনুভব করি। শুভ নববর্ষ ডাইনোসরের রাস্তা ধরেছে, অলিতেগলিতে হ্যাপি নিউ ইয়ারের রঙিন বর্ণময় উচ্ছ্বাস। আমি ইংরেজির কট্টর সমালোচক নই, কিন্তু বাংলাকে বিস্মৃত হয়ে ইংরেজি নিয়ে মাতামাতিতে আমার আপত্তি আছে বৈকি। যদিও এ আপত্তি এখন সংখ্যালঘুদের। কারনটা তো হেল্থড্রিংকের বিজ্ঞাপনের মতো, আমরা বাড়ছি মাম্মি। হাতে গোনা কয়েকজন আমরা স্মৃতি নিয়ে বাঁচি, আর কলমে খই ফোটাই থুড়ি হুল ফোটাই সব নব্য বাবুদের।

আমরা পশ্চিমী দুনিয়ার অন্ধ অনুকরণ করতে করতে ১লা জানুয়ারি উৎসবে মাতি, আর ১লা বৈশাখ তো ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা, সরস জীবনে বড্ড নীরস। কর্কশ অভিজ্ঞতা মধ্যবিত্ত বাঙালির।

স্বীকার করছি সেই বাবু কালচার নেই, পরিপাটি করা লম্বা চুল নেই, ফিটন গাড়ি নেই। গিলে করা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবী পরে আতর মেখে নিষিদ্ধ পল্লীতে ভিড় নেই। কদমছাঁট চুলে ফাটা জিন্স আর টি শার্ট-এ গঙ্গার ঘাটে সেলফি তো আছে , ভিক্টোরিয়া বা নন্দনচত্বরে জড়াজড়ি করে প্রকাশ্য যৌনতা উপভোগের সুযোগ আছে। মাল্টিপ্লেক্স-এর মজা আছে। আর বারে গিয়ে আকন্ঠ বিয়ার পান আছে। নববর্ষের দই মিষ্টিতে আজকাল আর মন ভরে না। বাঙালির হেঁসেলে চিনা খাবারের আমদানি, ইউটিউবে রান্নার পাঠ। আর কাজের ব্যাস্ততায় সন্ধ্যায় ব্যস্ততম ফ্ল্যাটের কেবিনে পিৎজার ছড়াছড়ি। খাসির ঝোল বা কাৎলা মাছের ভাজা আজকাল ব্যাকডেটেড। পায়েস পিঠে নয় নতুন বছরে চিকেন ললিপপ চাই। আপরুচি খানা এখন ফ্যাশন। বাংলার গ্রামগুলো এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, অথচ এরাই সমাজ সভ্যতার চালিকাশক্তি। অনাহারে অর্ধাহারে অপমৃত্যুর পথে বাংলার ছাত্র যৌবন ধুঁকছে। দিগন্ত জোড়া বঞ্চিতদের মিছিলে হাজার অপ্রাপ্তির ভিড়ে নববর্ষ আসে।

গ্রীষ্মের সেই তপ্ত দুপুরগুলোতে কাঁচা আম তেঁতুলের সন্ধানে আজকাল আর কেউ ঘোরেনা, দল বেঁধে কাবাডি সীতাহরণ খেলে না। নববর্ষ আসার আমেজটাই বদলে গেছে, গ্রীষ্মের খর রৌদ্রে মন্দির চত্বরে রামায়ন মহাভারত পাঠ আর সন্ধ্যায় কাঁসর ঘন্টার সাথে ছোলা গুড় বেলের শরবত সব এখন ধূসর অতীত। 

নববর্ষ এখন একটা সংখ্যা মাত্র। বাংলা সন এবং বাংলা তারিখের ব্যাবহার খাতা কলমে কোথাও নেই। হালখাতার খাওয়া আর নববর্ষ সংখ্যা শুকতারার নন্টে ফন্টেকে আজকের বাচ্চারা জানে না। তারা জানে স্পাইডারম্যান,  এসো হে বৈশাখ আর পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে বাজে না। শোনা যায়  কাঁচা বাদাম... ট্রেন্ড আর ফ্যাশনের বিপণনের মাঝেও কোনো অখ্যাত লালমাটির গ্রামের খড়ের চাল দেওয়া মুদির দোকানে এখনও লাল শালুতে মোড়া খাতায় দোকানদার লেখেন শ্রী শ্রী গনেশায় নমঃ।  বাংলা সনের নাম। বাংলা ক্যালেন্ডার ও আর খুব একটা ছাপা হয়না। অথচ গোয়ালা এখনও দুধের যোগান দেয় বাংলা তারিখে।  নববর্ষের দিন বাংলার গৃহকর্ত্রীরা এখনো গৃহস্বামীদের বলেন, সকাল সকাল বাজারে গিয়ে বড়ো মাছটা আনতে, এবং এসব কিছু টুকিটাকির জন্যই টিকে আছে অভিমানে অবহেলায়  অনাদরে আমাদের প্রিয় ১লা বৈশাখ। অথচ বাংলা সাল আর বাংলা মাস ঋতু বিন্যাসে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন জুলাই আগষ্ট বললে আমাদের কাছে রিমঝিম বর্ষার ছবি ভাসে না। অথচ আষাঢ় শ্রাবণ বললে ঘনঘোর বাদল দিন মনে পড়ে। এপ্রিল মে  বললে খররৌদ্রের দহন দিন চোখের সামনে ভাসে না, ভাসে না গ্রীষ্মের দুপুরে সবাই ভাতঘুমে ঢলে পড়লে পা টিপে টিপে গেট খুলে বাগানে ঘোরার কথা, অথচ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ বললে মনে পড়ে আম জাম তাল তেঁতুলে ঢাকা সুশীতল পল্লীবাংলার ছবি, গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ। পুকুর পাড়ে লাল কৃষ্ণচূড়ার উপরে উঠে জলে ঝাঁপ, বাড়ির সবার বকুনি অগ্রাহ্য করে একঘন্টা সাঁতার। সময়ের স্রোতে সব অবলুপ্ত। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যান্ত্রিক আবহে ১লা বৈশাখ নয় একলা বৈশাখ আসে। আমরাও যে যার মতো এগিয়ে চলি। ঐ যে গতিশীল জীবনে আমরাও এক একটা রোবট। তবুও নির্জন সন্ধ্যায় নীল আকাশের নীচে  কখনও যেনো  আনমনে গেয়ে উঠি, "প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। তব ভুবনে তব ভবনে ... মোরে   আরো আরো আরো দাও স্থান..."
ব্যাস এটুকুই।






পাখিরা সব বাপের বাড়ি 

প্র দী প কু মা র দে 

এতদিনে আমার মাথা খুলে গেল... আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঠুকে, ফুলে আলু হয়ে গেল।

সকালবেলা রজতজয়ন্তী পার করে ঘরে আনা পুরানো বউ এককাপ লিকার আর একটা কুকুরের বিস্কুট এনে মুখের সামনে ধরল, আর চলা মুখ
বলা কথা আওড়ে গেল,
---এবার বুঝলেতো আমার কত দাম? ছিলাম তাই কত সুবিধা হল? বিনে পয়সায় কত লাভ করে নিলে আমার ভাঙিয়ে?

অনিচ্ছা থাকলেও বউয়ের হাত ধরে টেনে নিলাম আমার কাছে, পাশে বসিয়ে নিলাম... বললেম
শোন তাহলে,

---তুমিই না থাকলে, টুথপেস্ট কিনতাম না। বাড়িতে জামাকাপড় পরতাম না, ডিটারজেন্ট লাগত না। প্রসাধনীর
প্রয়োজন হত না। মাথার গায়ের তেল প্রসাধনীর খরচ লাগত না।চাল আর ডিম সিদ্ধ করে দিন
চালাতাম। রান্নার গ্যাস, ইলেকট্রিক খরচ হতই না।

বেড়ানো, রেস্তোরাঁর বিল হত না। ছেলেমেয়ে আসত না, বিরাট খরচ থেকে নিরাপদ থাকতাম
আজীবন। কত খরচ কম হত তুমি না থাকলে তুমি নিজেই ভাবো...

গিন্নির মাথায় হাত। শালা বলে কি? আমায় ছিবড়ে বানিয়ে ত্যাঁদরামি হচ্ছে এখন? এ মিনসেকে উপযুক্ত শিক্ষা দেব এবার...

বউয়ের লাল চোখে ক্রোধ, পিলে চমকে গেল আমার। পরিস্থিতি ভাল নয়। অন্ধকার থেকে
নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে উঠে পড়েই সোজা ছাদের সিঁড়িতে পা দিলাম।

বউ তেড়ে উঠলে,
---কোথায় যাও মিনসে?

---ছাদে পাখিদের পানীয় জল দিয়ে আসি। যা গরম পড়েছে...

বউ আমার হাত ধরে টেনে এনে তার হাতের সামনে থাকা সাঁড়াশিটা দিয়ে আমার মাথায় এক ঘা বসিয়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা ফেটে
গিয়ে গল গল গল করে রক্ত বের হতে লাগল!    

কি রক্ত! কি রক্ত! আমি বেদনায় চিৎকার করে উঠলাম।

বউয়ের ওই সবে কোন হোলদোল নেই। হাতখানা ধরে টেনে মুখ ভেংচালো,

---এখন ছাদে পাখিরা কেউ নেই, ওদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। সবাই বাপের বাড়ি চলে গেছে...




 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল ও বাসন্তী সংখ্যা || ৯ চৈত্র ১৪৩১ || ২৩ মার্চ ২০২৫

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চতুর্থ বর্ষ || চতুর্থ ওয়েব সংস্করণ || বাদল সংখ্যা || ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ || ২৯ জুলাই ২০২৫