গল্প

টেবিল পাতুরি

র ত্না দা স

ভেটকি পাতুরিটা স্বামী স্ত্রী দুজনেই বেশ চেটেপুটে খাচ্ছিল। কিরে, কলাপাতাটাও খেয়ে নিবি নাকি! অবশ্য গরুরা কিইবা না খায়! আমাকেও দে দেখি। দুজনেই মানে চন্দ্রপ্রভ আর মৃদুমায়া এমন চমকালো মনে হলো ঘরে বাজ পড়েছে। দাদা তুই! হ্যাঁ রে আমি।

তুই তো এখন বাতাস খাস! কেন মাছের বাসও তো খাই (স্লাইট আনুনাসিক স্বরে)। চাঁদু তুই শুধু আমাকে কোপালি না, আনারকলির মত জ্যান্ত কবর দিলি! আমার প্রাণটা তখনও বেরোয়নি, সেই অবস্থায় মাটিতে পুঁতে তার ওপর সিমেন্টের গাঁথনি দিলি, এখন ওখানেই বসে খাস!

কী করবো! তোকে যদি ঝোপেঝাড়ে কোথাও ফেলতাম পুলিশ তো কুত্তা শুঁকিয়ে ঠিক খুঁজে বের করতো আর আমার যাবজ্জীবন। তাই এই ট্রিকসটা করতে হলো।

সূর্যপ্রভ বলে ওঠে তা তোর টাকাপয়সার দরকার ছিল আমাকে বললেই পারতিস। তুই তো ছোটবেলাতেই বখে গেলি, নেশাভাং, গাঁজা, চরস কিছুই বাদ দিসনি। তাই বাবা সব আমার নামে লিখে দিলেন।

এবার চন্দ্রপ্রভ গরগর করে ওঠে, তুই ছাই দিতিস, তোর আঙুলের ফাঁকে জল গলে! দুটো ভাইপো, ভাইজি তাদেরও কক্ষনো কিছু দিতে দেখলাম না। ওদের পড়াশোনার খরচ আছে, বিয়েশাদি আছে, আমার তো তেমন সংস্থান নেই। তাছাড়া তোর লোভ তো...
মৃদুমায়ার কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রপ্রভ চুপ করে গেল।

কিন্তু ও জানতো দাদা আর বৌয়ের রাসলীলার কথা। মাঝে মাঝেই দেখতো মাঝরাতে মৃদু পাশে নেই। চুপিচুপি গিয়ে ওদের ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছে, তখন থেকেই প্ল্যান কষেছে তারপর একদিন ঝোপ বুঝে কোপ। মৃদুমায়া জোরালো আপত্তি জানিয়েছিল কিন্তু চন্দ্রপ্রভ বলেছিল বেশি কথা বললে ওকেও দাদার পাশেই পুঁতবে আর দুজন প্রেমলীলা চালাতে পারবে। এরপর আর কিছু বলতে পারেনি মৃদু, ওর মরার ইচ্ছে ছিলনা।

কি হলো মৃদু... দাও। মৃদুমায়া যত্ন করে দুটো মাছের ফিলে টেবিলের তলায় রাখে। সঙ্গে সঙ্গে ওদুটো উধাও। মৃদু ডাকটা কানে যেতেই ওর গাল লাল হয়ে ওঠে। সূর্য'র আদরটা ছিল সেতারের সুরে আর চন্দ্র তো ধামসায় জোরে। মাঝে মাঝেই অনেক রাতে একটা ঠান্ডা হাওয়া খেলে বেড়ায় সারা শরীর জুড়ে, মৃদুমায়া গাঢ় অনুভবে ডুবে যায়।

যাক শেষপর্যন্ত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রইলো। মানুষে ও প্রেতে মিলেমিশে একসাথে।







বিপন্ন রাতের কালো গোলাপ এবং অশরীরী কবিতারা

শা শ্ব ত বো স

রাইডার অ্যাপ টা থেকে সন্ধ্যের প্রথম ট্রিপটার খবর এল। ‘সন্ধ্যের আপাত শান্ত নির্জনতাকে চিরে ফালা ফালা করে দিয়ে একটা তাগিদকে প্রতিষ্ঠা করে দেবে’ এই বাণী বুকে করে, গ্রহণযোগ্য কোন একাকিত্ব আর কোলাহলের মাঝামাঝি, দ্বন্দ্ববিহীন এক বৈপরীত্বের সংকেত হয়ে। আজ উনিশে ফেব্রুয়ারী ২০২৫। দুবাইয়ের মাটিতে ভারত-নিউজিল্যান্ড মুখোমুখি হয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে। খেলা শুরু হবার প্রায় মুখে মুখে এন্টালির ননী গোপাল রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে স্বরূপ। আজ এমনিতেই রোববার, কলকাতার রাস্তায় মানুষজন কম। সারাটা সপ্তাহ যে শহরটা কলকলিয়ে ওঠে জীবনের যাবতীয় ব্যস্ত সাউন্ডস্কেপে, সপ্তাহান্তের এই একটি দিনে সে সলিটিউডের আবছায়ায় নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে ফেলে, শব্দ ও শব্দান্তরের মাঝে দৃশ্যগত ফারাক খুঁজতে থাকে। তবু যদি দু-একটা ট্রিপ পাওয়া যায় কোন অদৃশ্য দৈব জাদুবলে তবে তা পাওয়া সম্ভব এই নিউটাউন চত্ত্বরেই। এই তথ্য প্রযুক্তিই এমন এক শিল্প যার চাকা রোববারেও গড়ায়। এমনিতেই যত রাত বাড়ে ট্রিপের সংখ্যা বাড়তে থাকে এখানে। বিশেষ করে IT এর মহিলা কর্মীদের বিশেষ পছন্দ এই ট্রান্সপোর্টেশন অ্যাপের বাইক রাইড। স্বস্তা এবং সেফ! স্বরূপের মত শয়ে শয়ে শিক্ষিত বেকার এখন এ লাইনে দিব্যি করে খাচ্ছে।

যাত্রীর লোকেশন দেখাচ্ছে UNITECH SEZ মেইন গেট এর কাছে। হাতের ফোনটা থেকে ‘হটস্টার’টা বন্ধ করে বাইকটা স্ট্যান্ড থেকে নামিয়ে দাঁড়ায় স্বরূপ। রবীন্দ্রতীর্থর মেইন গেটের পাশে বেশ একটু গা সওয়া অন্ধকারের মাঝে গাড়িটা পার্ক করেছিল ও। মাথায় হেলমেটটা চাপিয়ে ক্লাচ টা চেপে ধরে বাইকটা স্টার্ট দেয় এবার। এর মধ্যেই ট্রিপটা একসেপ্ট করে নিয়েছে ও। জায়গাটা খুব বেশি দূর নয় এখান থেকে। খেলাটার কোন আপডেট আর নেওয়া হবে না এই যা! তা সে বাহ্যিক হাসি-মজা-আনন্দ এসব রংচঙে জিনিসগুলো চিরকালই হার মেনে এসেছে পেটের খিদের কাছে, এটা অতি অল্প বয়স থেকেই মানতে শিখে গেছে স্বরূপ। গ্র্যাজুয়েশন করে যখন টাকা পয়সার অভাবে পড়াশুনাটা বেশীদুর আর করা গেলো না, বাড়িতে বাবা বেকার, শারীরিক সামর্থ্য নেই কিছু করার, মায়ের অসুখ সেদিনই স্বরূপ ঠিক করে নিয়েছিল কিছু একটা করতে হবে! কিছু টাকা পয়সা জমাতে হবে। বাইকটা ফিন্যান্সে কিনে নিয়ে এই বাইক রাইডিং অ্যাপে কাজ করা শুরু করেছিল। শুরুতে পেমেন্ট খারাপ না থাকলেও ইদানিং যাত্রীদের সুবিধা টা দেখতে গিয়ে, বিশেষ বিশেষ ডিসকাউন্ট অফার দিতে গিয়ে রাইডারদের দিকটা আর দেখেনা কোম্পানি! পেটে টান পড়ে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা স্বরূপ। এটা ছাড়া ও আর কীই বা করত? ফুড ডেলিভারি? ও ধান্দায় যা অপমান সহ্য করতে হয়! স্বরূপের এক বন্ধু ও লাইনে ছিল। একদিন তো প্রচন্ড ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে স্বরূপকে বলেছিল, “দূর শালা রেলে মাথা দিয়ে দেব।” তবু তো স্বরূপ নরমে গরমে যাত্রীদের সাথে ডিল করতে পারে। কখনও সখনও কোম্পানিকে এড়িয়ে ডাইরেক্ট ডিল করে নেয়! ওর মত এত স্বল্প শিক্ষিত ছেলেকে এই বাজারে কেই বা চাকরী দেবে? ক্লাচটা হাতে চেপে বাইকটায় ফার্স্ট গিয়ার দিল স্বরূপ। হঠাৎই বাইকটা যেন একটু পিছন দিকে ধাক্কা দিল। এতক্ষন তো ছিল না! এমনকি বাড়ি থেকে এতটা চালিয়ে এসেছে স্বরূপ, কই কিছু তো বোঝেনি! ক্লাচপ্লেট এর কোন ইস্যু নাকি? সেকেন্ড গিয়ারেও ঠিক যেন স্পিড নিচ্ছে না! কি করবে স্বরূপ এখন? রাইড টা ক্যানসেল করে দেবে? যদি সেরকম ঝামেলাবাজ পার্টি হয় তাহলে তো কমপ্লেইন ঠুকে দেবে! কিছুক্ষণ মনে মনে ভাবল স্বরূপ। পরে ঠিক করলো সন্ধ্যের প্রথম রাইড! না বউনির টাকা ছাড়া ঠিক হবে না। ট্রিপটা শেষ করে ক্লাচ প্লেটটা খুলে না হয় দেখা যাবে। একটু আস্তেই না হয় যাবে! ইঞ্জিন খুব বেশী গরম না হলেই হল। চোখ বুজে একবার মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো স্বরূপ! টেনশনে পড়লে ও এটা করে। মাকে মনে মনে দেবতার মত পুজো করে প্রায় ও! সামনের ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে বাঁদিক চেপে এসে দাঁড়াল স্বরূপ। আজ সন্ধ্যের প্রথম অতিথি তাড়াতাড়ি ওর সামনে এসে উপস্থিত হলে ও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে! পারফেক্ট লোকেশনেই তো এসে দাঁড়িয়েছে ও! আজ রোববার বলে এদিকে খাবার দোকানের ঝোপড়িগুলোও বন্ধ। জায়গাটা জুড়ে আজ যেন ছড়িয়ে আছে আরো গাঢ় অন্ধকার। তারই সঙ্গে যেন প্রায় গায়ে গায়ে মিশে আছে কালান্তক শূন্যতার সাথে নিগূঢ় চেতনার রহস্যময় এক কথোপকথন! সেই ফিসফিসানি যেন শুনতে পায় স্বরূপ। আসন্ন বসন্তের মৃদু শিরশিরানি যেন গায়ে এসে লাগে ওর। চোখে মুখে টুকরো টুকরো অস্থিরতা এসে জমা হতে থাকে। কব্জি ঘুরিয়ে কমদামি রিস্ট ওয়াচটায় সময় দেখে ও। এখন ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকারটার ওপর ট্যাঙ্ক ব্যাগটার ভেতর হালকা একটা জ্যাকেট, একটা ছাতা, জলের বোতল, শুকনো কিছু খাবার নিয়ে নিয়েছে ও। আজ সারারাত ট্রিপ করার ইচ্ছে আছে ওর, একদম কাল ভোর ছটা অবধি! সুতরাং এগুলো ঠিকই লাগবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা সিগেরেট ধরাতে যাবে, এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা ঠান্ডা উপস্থিতি যেন টের পেল স্বরূপ! একটা নারী শরীর! পিছনে ঘাড় না ঘুরিয়েই সেটা দিব্যি বলে দিতে পারে স্বরূপ। কমদিন তো আর এ লাইনে হল না! স্বরূপ জানে প্রতিটা মেয়েশরীরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। পেছনের সিটে বসা মেয়েদের খোলা চুলের ঢেউ বেয়ে ভেসে আসা মাত্রাহীন সেই সোঁদা সোঁদা গন্ধগুলোয় কিংবা ওদের গা বেয়ে কূলহীন নদীর মত বয়ে এসে কালবেলার সীমাকে অতিক্রম করে, পুরুষ শরীরের কোন গোপন প্রকোষ্ঠে ঢেউ তোলা সুমিষ্ট পারফিউমের গন্ধই যেন ওদের আলাদা করে চিনিয়ে দেয়! যদিও স্বরূপ ছেলে হিসেবে নেহাত মন্দ নয়। আজ অবধি কোন ফিমেল প্যাসেঞ্জার ওর বিরুদ্ধে ‘ব্যাড টাচ’ বা ‘ফিলদি বিহেভিয়ার’ এর কমপ্লেইন করেনি। সুস্থতাকে নিজের জায়গা করে দিতে জানে ও। পিছন দিকে না ফিরেই ওটিপি টা জিজ্ঞেস করে স্বরূপ, কোন উত্তর আসে না। শুধু দুটো মেয়েলি হাতের স্পর্শ স্বরূপের দুটো কাঁধে এসে পড়ে। সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায় ওর! একটা ঝালঝাল এলাচ-দারুচিনি ভাঙা-বারুদ ঘেঁষা-রংমশাল পোঁড়া গন্ধ এসে লাগে স্বরূপের নাকে। একটা আনুমানিক যৌনগন্ধ! এমন গন্ধ হয়তো কোনদিন রোহিণীর শরীর ছুঁয়ে পশমিনা বাতাস হয়ে আসতো, তেতলার ছাতের ঘরে। সারাদিনের শ্রমে ভেজা ক্লান্তি আর ধারাবাহিক ঘনত্ত্বে পথ চলার একটা স্থির গন্ধ, ঠিক যেমনটা হয়তো আজও সন্ধ্যে সাতটা বাজলে পাড়াগেঁয়ে তুলসীতলা থেকে ভেসে আসে। স্বরূপ মন্ত্রমুগ্ধের মত স্টার্ট দেয় বাইকটা! ওর মস্তিস্ক অবাস্তব মনোলোগের মত একবার ওকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চায়, “হেলমেটটা পড়ে নিন।” অ্যাপটা যেন দুর্বার কোন মোহমায়ায় আপনা থেকেই রুট ম্যাপ দেখতে শুরু করেছে। মোট একুশ মিনিটের রাস্তা, গন্তব্য বেলেঘাটা ID কোয়ার্টারের কাছাকাছি। স্বরূপ বিশ্ববাংলা গেট রেস্তোরাঁর আন্ডারপাস পেরিয়ে সোজা বিশ্ববাংলা সরণী ধরে, ফেয়ারফিল্ড বিল্ডিং, ক্রোমার শোরুম বাঁয়ে ফেলে ‘স্বপ্নভোর’ মেট্রো স্টেশনের তলা দিয়ে ডানদিকে লেমনফ্রী প্রিমিয়ার বিল্ডিংকে ফেলে রেখে সেক্টর ফাইভের ফ্লাইওভারে উঠে পড়ে। পেছনে বসা ছায়াশরীর যেন তখন স্বরূপের দিকে ঝুঁকে পরে ক্রমশঃ ওর শরীরটাকে আঁকড়ে ধরছে। ঠিক যেমন নিঃসঙ্গ, নিশ্চুপ, ছায়াচ্ছন্ন শোভাবাজারের বুকে গ্যাস চুল্লিতে বসানো জ্বলে যাওয়া ভাত আর টক ডালের গন্ধ হয়ে ভেসে থাকা পোড়ো বাড়িটাকে চেপে ধরে থাকে, অনন্ত সূর্য্যাস্ত পেরিয়ে আসা বট অশ্বত্থের ঝুড়ি। বুড়িয়ে যাওয়া শব্দরা সেখানে খেলা করে সম্পর্কের শরীর জুড়ে। স্তব্ধতার ভিতর ঠিক সেরকম একটা সচেতন শরীরী সঞ্চার চলতে থাকে ওদের মাঝেও! বাক্যের অবশেষগুলো লেগে থাকে কোণায় কোণায়!

সত্যি স্তনের কি অদ্ভুত কুহক! অন্যান্য দিনের চাপা অস্বস্তিগুলো আজ অনায়াসে যেন কবিতার মত ভালো লাগার বৃষ্টি নামায়। স্বরূপের গোটা পিঠ ভরে থাকে উত্থিত সুডৌল এক জোড়া নারীস্তনে! পৃথিবীর দুই গোলার্ধ এই মুহূর্তে যেন ওর দখলে! রাস্তার দুপাশের তেপায়া বাতিস্তম্ভের গায়ে ঝিকিঝিকি ঝিল্লিওয়ালা এল.ই.ডি স্ট্রিপগুলোর সর্পিল উপস্থিতি, সামনে সান্ধ্যকালীন বাসন্তিক অন্তরীক্ষে ভারী মাথা নিয়ে স্থির হয়ে যাওয়া উদ্ধত বহুতল, আঁধো অন্ধকারে ডুবে গিয়ে বাজারদরের আলো জ্বেলে রাখা কর্পোরেট অফিস, তারই মাঝে অন্তধীর ছায়াপথ হয়ে কালপুরুষ-ধ্রুবতারার উজ্জ্বল জ্যোতির্মন্ডল, মাথার ওপর পূর্ণিমা থেকে সামান্য সরে আসা লালচে চাঁদ, এই সব কিছুই এই ক্ষয়ে যেতে থাকা সন্ধ্যের মায়া মমতায় অনায়াসে ভুলিয়ে দিতে পারে উপস্থিত অতিথির নাম-নক্ষত্র-উদ্দেশ্য-বিধেয়। তবু ভোলা যে যায় না তার কারণ এই যাত্রাপথে চারপাশের সবকিছুই যেন বড় শান্ত সমাহিত! অপূর্ব এক আত্ম সম্মোহন যেন বিরাজ করছে এই শহরের চিরায়ত ধ্বনিপ্রবণ নাগরিক কথকতায়! শুধু এই দৃশ্যময় স্তব্ধতার মাঝে শরীরী বিহঙ্গে অবাধ গতিময়, স্বরূপের সফরসঙ্গিনী। লোলুপ জিহবা দিয়ে সে তখন স্বরূপের কানদুটো জুড়ে স্বরবর্ণ চলনে এঁকে চলেছে চুমু আর সিডাক্টিভ ক্রিয়ার বিস্তৃত আল্পনা। গুনগুন করে একটানা দীর্ঘ্য একটা বাক্যরাজি ভেসে আসে স্বরূপের কানে, প্রবাহ পথে কান পেতে থাকে স্বরূপ। অর্ধ জ্ঞানে অর্ধ নিমজ্জনে স্বরূপ শোনে, অস্থির হাওয়ার সাথে কথোপকথনে যেন কবিতা রচনা হচ্ছে। বড় চাপা সে শব্দ! একমাত্র তীব্র মনোযোগী কোন শ্রোতার অনুভব বোধের উপর নির্ভর করেই যেন ঝরে পড়ছে শব্দজননীর এই আশ্চর্য্য সংকেতময় বিস্তার! আসা যাওয়ার পথে লুব্ধ চোখে সিগন্যালে কান পাতে স্বরূপ। কল্পনায় চেনার চেষ্টা করে সেই ক্ষীণ অথচ বর্ণময় কাহন। 
“একটা খোলা রাত!
চেনাগাছের থেকে অশুচি অন্ধকার ধার চেয়ে নিচ্ছি।
নির্বাক হিংসায় হা-হুতাশ পাগলের দল,
ভয়ের একটা বস্তুবাদী ভীত ছাড়িয়ে 
স্নিগ্ধ বালকের ছায়া বোনে,
বাষ্পাকুল আচ্ছন্ন মায়া জীবনের শিকড়ে গিয়ে।
রক্ত ভাঙা গোলাপী গন্ধে ম-ম করে চতুর্দিক!”

উচ্চারণ হয়তো ভীষণ অস্পষ্ট! তবু যেন তা ভাবের ঘরে দোল দিয়ে যায়। ভাবনার পাল ঠেলে স্বরূপ গিয়ে ভেড়ে দশটা বছর পেছনে। যাতায়াতের দোরগোড়ায় পরে থাকা অবশিষ্ট চা-টুকু বেয়ে যখন, পিঁপড়ের ওঠানামাকে পেছনে ফেলে চৈত্রের রোদ এসে পড়ত ভিক্টরিয়া কিংবা মোহরকুঞ্জের শাখামুখে। কত সহস্র শনি রবিবার জুড়ে যখন ও রোহিনীকে কবিতা পড়ে শোনাত। এরই ফাঁকে ওরা সেক্টর ফাইভ ফ্লাইওভার পেরিয়ে Technopolis এর সামনে দিয়ে নির্মীয়মান মেট্রো লাইনের তলা দিয়ে এসে, সেক্টর থ্রি এর খালপাড়ের রাস্তা বেয়ে, বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে করুণাময়ী মোড়ে পৌঁছেছে। নেভিগেশন বলছে, এবার বাম দিকে সোজা। সামনেই মণিপাল হাসপাতাল। এটাই আগে ‘কলম্বিয়া এশিয়া’ ছিল। মণিপাল তো সল্টলেক আমরিকেও নিয়ে নিয়েছে এখন! আরেকটু এগোলে ডানদিকে ‘যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন’। 
“পশ্চিম পারের সূর্য্য বলেছিল
ইতঃস্তত কোন অমিত আয়ুর কথা।

জলের সমুদ্র পেরিয়ে আসা জলের মতই সহজ ছিল এতদিন।
সন্ধ্যেটা ফুরিয়ে গেলে কোন পশুর হাত
আগুনের পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল!
যমুনাবতী কমলে কাজলে, এখন ইতিহাসের সিলেবাসে।
অবিচুয়ারী লেখা হবে তার নামে।
পূর্ণচ্ছেদে জমা হয় কালো গোলাপ!
আসলে কি বলতে চেয়েছিল, আর কি বলে গিয়েছিল,
এক আকাশ অভিমান আকাশ জুড়ে ফুটে উঠেছিল শুধু!
সুতোহীন উষ্ণতায় একটু একটু করে জামা ছেঁড়া হবে তার!
একটু একটু করে রমণের শ্যামল জঙ্ঘায় হয়তো
জড় হয়েছে একগোছা বিবাদী জোঁক।
যেন শবের শরীরে অসুরের সঙ্গম!”

একরাশ মুহূর্তের ভিতর জেগে থাকা স্বপ্নের গভীরে ডুব দিয়েছে যেন স্বরূপ! কি অপূর্ব শব্দচয়ন! কি অসামান্য দখল! চাপা অথচ কি গভীর মেটাফিকশন! দুটি নদী যেমন লম্বা পথ পেরিয়ে এসে মিশে যায় তুরীয় সঙ্গমে, সেখানে একজনের স্নিগ্ধতা আর অন্যজনের উচ্ছ্বাস একে অপরকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসে, ঠিক তেমন কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে কি ভীষণ একটা এলোমেলো আলিঙ্গনের রীতি! এই নদীর ঢেউহীন মোহনায় নিজেকে ছেড়ে রাখতে মন চায় স্বরূপের। আবার ওর কানের কাছে হিলহিলিয়ে সেই মহিলাকণ্ঠ। বলে ওঠে, 
“প্রেমিকের শিকড়ে শব্দেরা হেঁটে যায়!
নির্জন নগ্ন বৃক্ষকে জড়িয়ে থাকে নির্বাক হিংসা।
গুল্মলতার ভারে নয়নতারা পাখনা মেলে
লাল গোলাপ হয়। তারা দেখে এক নির্জন কালো রং!
দোলযাত্রা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে ক্রমশঃ 
এক ভ্রান্তিবিহ্বল বালিকার অপ্রকাশিত কৈশোর।
বনস্পতি বেড়ে উঠছে অযুত মঙ্গল কামনায়।
রাস্তার পিচ জুড়ে শুধুই ছলনা নদী বয়ে যায় শতভাগে।”

নিজের বাম গাল জুড়ে একটা নরম স্পর্শ অনুভব করে স্বরূপ। ঠিক যেন কোন উন্মুক্ত পাখির শরীর থেকে ছিড়ে আনা একটা মসৃণ পালক, নিজের শরীরের দীর্ঘ ছায়ায় রোদ গুটিয়ে নিয়ে, বিরহের ক্যানভাস এঁকে দিচ্ছে ওর গালের খসখসে অমসৃণ চামড়া জুড়ে। মেয়েলি ঠোঁটের উপর লেগে থাকা স্যালাইভার মত মৃদু সুগন্ধে স্বরূপ বুঝতে পারে ওটা গোলাপফুল। রঙের পিঠে রং চাপিয়ে স্বরূপের চোখে ভেসে ওঠে, ইতিউতি উড়ে বেড়ানো অন্ধকারের প্রজাপতিরা! ওর নরম ছায়াচ্ছন্ন মনে তীব্র উষ্ণতার গন্ধ চাগাড় দিয়ে অদম্য এক প্রশ্ন জাগে, ফুলটার রং কি? লাল-নীল-হলুদ রঙের অবাস্তব মনোলগেরা ভিড় করে ওর শুনশান হৃৎপিন্ডটা জুড়ে। 

বেলেঘাটা মোড় থেকে সোজা যেতে গিয়ে সিগন্যালে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা। চারপাশে এখন জাতীয় পতাকা আর আতসবাজির রোশনাই। ভারত জিতেছে তাহলে! মনের মধ্যে বাস্তব আর পরাবাস্তব একসাথে ভুবনজোড়া ঢেউ বুনছে যেন স্বরূপের। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় নাকা ফর্মেশন ঠেলে বাম দিকে পড়ে থাকা সরকার মাঠের সামনে দিয়ে সোজা এসে বেলেঘাটা ID কোয়ার্টারের মেইন গেটের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। অনেক ছোটবেলায় এখানে একবার এক আত্মীয়ের বিয়েতে এসেছিল স্বরূপ। এই রাস্তাতেই সেদিন একটা কুকুর ছানাকে চাপা দিয়েছিল নাম না জানা মৃত্যুর সংকেতবাহী কোন আরোহী! বাচ্চাটার দেহটাকে সামনে নিয়ে মা কুকুরের সে কি বুক ফাটা কান্না! আজও মনে আছে স্বরূপের। চারিদিকটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে জমাটবাঁধা কালচে রক্ত! দৃশ্যটা যেন ওর চোখের সামনে ঝলসে ওঠে হঠাৎ! বেলেঘাটা ID কোয়ার্টারের ভোল পুরো বদলে গেছে এখন। আগের মোড় থেকে ডানদিক নেয় ও। এইখানেই এক চিলতে গুমোট অন্ধকারে ঢেকে আছে ছোট গেটটা। হঠাৎ সামনে ছায়ার মত ভেসে ওঠে কিছু মদ্যপ যুবক। প্রত্যেকেই এরা বাইক আরোহী। টেনে হিঁচড়ে জোর করে এক যুবতীকে নিয়ে যাচ্ছে কোয়ার্টারের বাউন্ডারির ভেতর! আর কিছুক্ষন পরেই এরা সবাই মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে, এই গৌরবর্ণা অনাম্নী নরম শরীরটিকে। কোয়ার্টার গুলোর রং হঠাৎ কেমন যেন পাল্টাতে থাকে। সেই ছোটবেলায় দেখা গায়ে শ্যাওলার দাগ ধরা, ভাঙা-চোরা ভুতুড়ে চেহারাটা যেন ফুটে উঠতে থাকে স্বরূপের চোখের সামনে। পেছন থেকে ভেসে আসে সেই মা কুকুরের দোমড়ানো মোচড়ানো বুকফাটা কান্না! মুহূর্তের মধ্যে চৈতন্য হারায় স্বরূপ। বাইকের পেছনটা হঠাৎ হালকা মনে হয় ওর। সামনে একটা প্রচন্ড আলো, তারপরই স্বরূপের দুচোখ জুড়ে নেমে আসে ক্লান্ত-শ্রান্ত ভাঙাচোরা অন্ধকার। 

রাস্তার ঠান্ডা ব্যস্ততা চিরে আশেপাশে তখন গুটিকয়েক কৌতূহলী মানুষের জটলা। ইতিউতি টায়ার জ্বালিয়ে ভারতের জয় উদযাপন চলছে। বাজি ফাটছে দেদার। বেলেঘাটা ID কোয়ার্টার এর ছোট গেটের মুখে রংহীন অন্ধকারে তখন কাত হয়ে পড়ে আছে একটা কালো রঙের বাইক। পাশেই মুখ থুবড়ে পরে আছে বাইকারের দেহ। মাথার পিছনটা খুবলে গিয়েছে যেন। সেখান থেকে চুঁয়ে পড়ে গাঢ় রঙের রক্ত জমা হচ্ছে, পিচকালো রাস্তার বুকে হঠাৎই গজিয়ে ওঠা মসৃণ মোলায়েম কৃষ্ণগহ্বরে। বুকের ভিতর তখনও বিপ-বিপ-বিপ, বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি। রাস্তার ধারের ‘Accident Prone Area’. কশন বোর্ডটা অন্ধকারে ঠিক করে দেখতে পায়নি স্বরূপ। হয়ত আরো একটা ভুল কোনোদিন করেছিল স্বরূপ! হয়তো বা কারো বুক ভরা জমাট অভিমান হেলায় ফেলে ভাসিয়ে এসেছিল ও। এগিয়ে এসেছিল অনেকটা জীবন। প্যারাবোলিক কক্ষপথ ধরে গ্রহের আপাত ঘূর্ণনে এসে দাঁড়িয়েছিল এমন একটা প্রস্তর সমাধিতে, যেখান থেকে দূরবীক্ষণেও মাপা যায় না ফেলে আসা শব্দের নিমেষহীন দীর্ঘশ্বাস। স্বরূপের চোখের সামনে একবার রোহিণীর মুখটা ভেসে ওঠে। একবার হয়তো সেই অশরীরির কালো হয়ে যাওয়া পাংশু মুখটাও দেখতে পায় স্বরূপ! তার তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁতগুলো যেন কালো হয়ে যাওয়া ঠোঁটের ফাঁক থেকে ঝলমল করে ওঠে। সে ঠোঁটে তখন ক্রুরতার হাসি! 
কেউ দেখেনি এতক্ষণ, রাস্তার এককোণে তখন পড়ে আছে একগোছা গোলাপ। রাস্তার কালো কিংবা জমাট বাঁধা রক্তের কালো অথবা রাতের নিয়মমাফিক ছায়াহীন কৃষ্ণময়তা বা ধুলোয় মিশে যাওয়া নির্বাক কোন কবিতার শরীরে বাসা বাঁধা কোন কালো রঙের পাপ, ওদের হাড়মাংসহীন বিবর্ণ শরীরে ইচ্ছেমত কালো বসন্তদাগ এঁকে দিচ্ছে ততক্ষণে!







শাড়ি

মী না ক্ষী চ ক্র ব র্তী সো ম   

কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার সময় মণিকার বাড়িতে একটা যুদ্ধং দেহি অবস্থার সৃষ্টি হয়। জলের বোতল, টিফিন বাটি ইত্যাদি খুঁটিনাটি সব কিছু খেয়াল করে নিতে হয় সাথে। আর তা নাহলে সারাদিন ভুগতে হবে। এমনিতেই নতুন করে শুরু হয়েছে অম্বলের রোগ। সবচেয়ে ঝামেলার ব‍্যাপারটি হল পরিপাটি করে শাড়ি পরা। অনেকটা সময় চলে যায় ওতে। আগের রাতে শাড়ি-কাপড় ঠিক করে রাখে মণিকা। সকালের ব‍্যস্ততায় আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে সবকিছু ঝাপসা দেখে সে। এই নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও কম হয়না মহিলা সহকর্মীদের মধ্যে।

মণিকা ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রেখেছে আজ তাঁতের শাড়ি পরে কলেজে যাবে। সাদা জমিতে লাল-সবুজ-ফিরোজা রঙের ফুল রয়েছে শাড়ির জমিতে। কত যে সুখস্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই শাড়ির সাথে। ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে মেয়েবেলার আনন্দোচ্ছল সময় উঁকি দেয়। মনের ময়ূরপঙ্খী চেপে বাপের বাড়িতে চলে যায় মণিকা। মেয়েবেলাতে শাড়ি পরার প্রয়োজন হলে মায়ের শাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। মা নিজেই পরিয়ে দিতেন পরিপাটি করে। কতবার মায়ের প্রিয় শাড়ি ছিঁড়ে গেছে অসাবধানে। এরজন‍্য মা কিন্তু কখনো বকতেন না।

বাবা তখন চাকরির শেষপ্রান্তে। সাদা জমিতে লাল-সবুজ-ফিরোজা রঙের ফুল থাকা শাড়িটি সেবার পুজোয় মাকে দিয়েছিলেন বাবা। প্রতিবার পুজোয় মা-র জন‍্য বরাদ্দ ছিল একখানা তাঁতের শাড়ি। সে শাড়ির সাদাখোলায় পাড়ে থাকত উজ্জ্বল লাল রঙের ছোঁয়া। ঠাকুমা চাইতেন সধবার চিহ্ন লাল, তাই মায়ের শাড়িতে যেন লাল রঙের উপস্থিতি থাকে। ঠাকুমা আর মায়ের রসায়নটা খুব পোক্ত ছিল। শাড়ির ব‍্যাপারে ঠাকুমার কথা বিনাবাক‍্যে মেনে নিয়ে মাকে মনে হত খুব তৃপ্ত। পাড়া-প্রতিবেশীরা গুলিয়ে ফেলত ঠাকুমা প্রকৃতপক্ষে কার মা ভেবে। মনে পড়তেই হাসি ছড়িয়ে গেল মণিকার ঠোঁটে। 

অনেকদিন পর আজ মণিকা সেরকমই একটা শাড়ি পরবে। এই শাড়ি সে এনেছিল কলেজে চাকরি পেয়ে প্রথম দিকে নতুন শহরে আসার পর। সালোয়ার কামিজের প্রতি ঝোঁক থাকা অধ‍্যাপিকা মণিকার কাছে শাড়ির সংখ্যা খুবই সীমিত ছিল। তখন কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে কখনো কখনো লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরতে ভালো লাগত। সেরকম সময় মায়ের শাড়ি নিয়ে মণিকার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতেন বাবা। অনেকদিন পরে অনেক শাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গেছিল সেই শাড়িগুলো। অথবা বলা যায় মনোযোগের অভাব ছিল কিছুটা।

সেদিন পুরোনো আলমারি গোছানোর সময় চোখে পড়েছে। কয়েকটি শাড়ি রয়েছে মায়ের। বাবা মারা যাবার পর সাদা থান বেছে নিয়েছিলেন মা। মণিকা অনেক জোরাজুরি করে পাড় দেওয়া শাড়ি পরিয়েছিল মাকে। তাই বাবার মৃত্যুর পর অনেকদিন পর্যন্ত থরে থরে সাজানো পড়েছিল লাল রঙের ছোঁয়া থাকা শাড়িগুলো। মায়ের শাড়িগুলো সরিয়ে ফেলতে মন চাইত না। কে জানে মা হয়ত বাবার স্মৃতি বিজড়িত শাড়িগুলোতে ভালোবাসাকে লালন করে চলেছে। মুখ ফুটে না বললেও মণিকা মায়ের কোমল অভিমানটুকু বুঝতে পারত। কলেজে চাকরি পাওয়ার পর শাড়ির প্রয়োজন ভীষণভাবে অনুভূত হল। সেভাবে গুটিকতক কেনাও হয়ে গেল। তবে সাদা-লাল থাকা শাড়ির দরকার হলে মায়ের আলমারি থেকে নিয়ে যাওয়া আবার কেচে ইস্ত্রি করে এনে রেখে দেওয়া প্রায় সময়েই চলত। এই কাজটুকু দায়িত্ব নিয়ে করত মণিকা। মায়ের শাড়ি পরলে মা খুশিই হত। বাবাও খুশি হতেন বোঝা যেত।

মায়ের মৃত্যুর পর শাড়িগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয়নি মণিকা। তেমন করে মনেও ছিলনা। আলমারি গুছিয়ে রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল আজ। এরমধ্যে অনেকগুলো বছর কেটে যাবার পর সেই শাড়ি হাতে নিয়ে অজস্র কথা ভেসে উঠল মনে। শাড়িটাতে মায়ের গন্ধ আছে কিনা ভেবে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখল মণিকা। স্নেহময়ী আটপৌরে মায়ের স্নেহপরশ গায়ে জড়াতে গিয়ে চোখ জলে ভরে উঠল মণিকার। 

অজস্র শাড়ির ভারে আলমারি ঠাসা। রকমারী সিল্ক, বিভিন্ন রাজ‍্যের এম্পোরিয়াম থেকে সংগৃহীত শাড়ি, তাঁত, মেখেলা-চাদর আরও কত কিছু। অনুষ্ঠানে পরার একধরনের, কলেজে পরার অন‍্যধরনের। অথচ সাদামাটা মায়ের শাড়িগুলো সবার মধ্যে থেকেও নজরকাড়া হয়ে তাকিয়ে আছে মণিকার দিকে। মায়ের গন্ধজড়ানো শাড়িটা এককালে মায়ের হাতের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল আভা ছড়াতো। অনিত‍্য এই জীবনের প্রতিটি কোণে মায়ার বাঁধন। সব ছেড়ে যেতে হবে একদিন। মণিকার শাড়ি-কাপড়গুলো কেউ কি পরবে? অমন করে বুকের কাছে ধরে গন্ধ শুঁকে কেউ কি খুঁজবে মণিকার পরশ!








ধস

কা বে রী রা য় চৌ ধু রী  

সৌম্য ও মধুজা এস. এস. সি পরীক্ষা দেবার সুবাদে একই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে প্রস্তুতি পর্ব চলাকালীন দুজনের বন্ধুত্ব, লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা, দিন রাত এক করে সফল হওয়ার স্বপ্নে  কয়েক মাস আগে থেকেই জোর কদমে ধ্যান জ্ঞান। চাকরিটা যে ওদের দুজনেরই খুব প্রয়োজন, সৌম্যর বাবার কিডনী খারাপ, নিয়মিত ডায়লেসিস চলছে। সরকারি চাকরি করতেন, বাড়ি করে সংসারের দায়িত্ব পালন করে পেনসন ছাড়া হাতে তেমন কিছু নেই। ছেলে বড় হয়েছে লেখাপড়া শিখে রোজগারের চেষ্টা স্বাভাবিক। এম, এসসি, বিএড করে শিক্ষা জগতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে। মধুজা স্বাবলম্বী হতে চায়, চাকরি করে স্বাধীন ভাবে দাঁড়ানোর মূল্য একটি ছেলে ও মেয়ে উভয়ের কাছে সম্মানজনক।

২০১৪ - ২০১৬ টেট পরীক্ষায় প্যানেলে নাম নথিভুক্ত হয়ে চাকরিটা দুজনের হয়ে গেল। সৌম্য সংসার ও বাবার চিকিৎসায় হাল ধরে বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটালো। মধুজার বাড়িতে মেয়ের বিয়ের জন্য তৎপরতা দেখা গেলো। সৌম্য ও মধুজা একসঙ্গে পড়াশোনা করতে গিয়ে দুজনের বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়ের সম্পর্ক কখন যে গড়ে ওঠে, মনের মিলে গাঢ়তর রসায়ন। চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে ও হয়ে যায়। সংসারের দায়িত্ব উভয়ে মিলেমিশে চার হাত এক করে সমঝোতায় সুখের দিন অতিবাহন। ওদের একটি শিশু সন্তান হয়েছে এখন, এমতাবস্থায় ২০২৫ এ টেট কেলেঙ্কারিতে যোগ্য হয়েও অযোগ্যের মিশ্রণে চাকরিহারা। পাহাড়ে যেমন ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধস নেমে অচল করে দেয় জীবনযাত্রা, ঠিক তেমন বহু সাধনায় পাওয়া চাকরি হারা হয়ে মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়া। পরিবার দেখবে না বাবার অসুস্থতা সামাল দেবে শিশুর পরিচর্যা করবে, দুজনে একসঙ্গে চাকরিহারা, বিনা মেঘে বজ্রপাতে বেসামাল জীবনতরীখানি।

২৬ হাজার চাকরি প্রার্থীদের নাকানিচুবানি অবস্থা, সুপ্রীম কোর্ট থেকে অর্ডার সব চাকরি বাতিল। সামনে বিধানসভার ভোট তাই জোড়াতালি কথাবার্তায় ২০ হাজার ভিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার রফা হয়েছে। সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে এই ব্যবস্থা কতদিন চালু থাকবে সন্দেহে অনিশ্চয়তা। বেতনের টাকায় অভ্যস্ত জীবনে দয়া দাক্ষিণ্যে চলা একজন শিক্ষিতের পক্ষে নিদারুণ দুঃখবহ। শিক্ষার মান এতো নিচে নেমে গেছে যে চাকরি চুরি করে সুযোগ পেতে হয়, নির্ভেজাল পরীক্ষার্থীদের যোগ্যতা ধূলোয় মিশে গেছে। সৌম্য ও মধুজা বাড়িতে বসে আছে, চাকরি চুরির অপবাদে কে দোষী আর কে নির্দোষ বোঝা যাচ্ছে না ফলে মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েও অপবাদের গ্লানিতে টিউশন পর্যন্ত ধরতে ভয় পাচ্ছে। মধুজা সৌম্যর কাঁধে মাথা রেখে চিন্তায় মন মেজাজ ঠিক ঠাক কাজ করছে না, সৌম্যর কাঁধে সংসার বাবা মা, স্ত্রী, সন্তান সব নিয়ে হতাশায় দিন গুজরানো।

ঘুণধরা সমাজে শিক্ষিতের জীবন আঁধারিতে অমানিশা ঘোর, অশিক্ষিতরা ছলে বলে কৌশলে দলবাজির দৌলতে পুঁজিপতি, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে বারবার। সৌম্য ও মধুজার মতো হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার, আর মেধাবীরা ঘরের ভাত না খেয়ে বাইরে খাওয়া দাওয়ার কষ্ট করে চাকরির জন্য ভিনদেশে বা বিদেশে পাড়ি। বৃ্দ্ধ বাবা মায়েরা একাকী নিঃসঙ্গতা নিয়ে দিনের পর দিন অসহায়।

নিজের দেশে চাকরির শোচনীয় অবস্থা, বিদ্যালয়গুলো শিক্ষকের অভাব, প্যারা টিচার দিয়ে ঠেকা দিয়ে পড়াশোনা ঠিমে তালে চলছে। স্কুলের শিক্ষার থেকে বাইরে কোচিং সেন্টারে গাদা গাদা টাকা দিয়ে পড়াতে হচ্ছে, শিক্ষার মূল স্রোত বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত ত্রুটির ফলে ভুগছে ছাত্র ছাত্রী ও অভিভাবকরা। সৌম্য ও মধুজার কথোপকথনে ধরা পড়ছে- ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের সামনে অন্ধকারে স্তম্ভিত জীবনের যান।।






সম্পর্ক 

দে ব যা নী ঘো ষা ল 

সম্পর্কটাকে শেষ করে দেবার অনেক পন্থাই সে অবলম্বন করেছিল। কারণ ব্যাক্তিগত ভাললাগা না ভাললাগার ওপর বড্ড বেশী আগ্রহ ছিল তেমন একটা ভাল না লাগার মেয়েটার। তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর ইনবক্সে। হয়তো এমন অনেকেই আছে। কিন্তু ভাললাগার কারণগুলো ভাললাগা থেকে ভালবাসাতে পরিবর্তন করার ক্ষমতা ছিল তার অপরিসীম। মেয়েটি ভেবেছিল ভালবাসি যখন সে বলেছে এবং বারবারই বলেছে তখন সে আর কাউকেই তেমন ভালবাসেনি। অথচ কমেন্ট বক্সে ভালবাসাবাসির গন্ধ পেয়েছে মেয়েটি একাধিক কমন ফ্রেন্ডের প্রোফাইলে। যদি মেয়েটি অসৎ হত বারবার জিগেস করতো না ছেলেটিকে কেন এত গভীরতা ওদের সাথে। ছেলেটি বারবারই তাকে বলেছিল মেয়েটি নাকি অপরিষ্কার মন নিয়ে জন্মেছে। পরিষ্কার মন বুঝি সব সইতে পারে। একশোটা মেয়ের সাথে প্রেমালাপ! একটা মেয়ের সাথে ফেসবুক কমেন্ট বক্সে পরের পর রিপ্লাই দিতে গিয়ে তাঁর একমাত্র ভালবাসার মেয়েটিকে বুঝি বলতেই পারে সে তখন ভীষণ ব্যস্ত। হোয়াটসঅ্যাপ এ কথা বলার সময় নেই? সেই ছেলেটা এখনো জানেনা যে মেয়েটি তাকে কত ভালবেসে বারবার এইরকম অপমানিত হতে হতে চোখের জলের বন্যায় ভেসেছে। এটা কি অমুলক সন্দেহ? সব মেয়েরাই কি এত বড় মনের? যে একাধিককে গ্রহণ করতে জানে? একবার অনেকদিন কোন সাক্ষাৎ নেই। সাক্ষাৎ বলতে তো Wapp বা ফোনকল। এদিকে এক বিরল দুর্ঘটনায় নেট সার্ভিস বন্ধ। মেয়েটি বাপের বাড়ি চলে গেল মেসেঞ্জারে একবার সবুজ আলো দেখবে বলে। দেখবে হোয়াটসঅ্যাপ এ লাস্ট সিন। না বন্ধ থাকতো না ফোনের নেট তার। অথচ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলে বলতো সে এখন বেশী ফোনের সাথে যোগাযোগ রাখেনা। বেশ কিছু বছর সম্পর্ক তেমন জোরালো না থাকলেও সংযোগ ছিল মারাত্মক। তাই বারে বারেই প্রমাণ দিয়েছে মেয়েটির ভালবাসা বুঝি শান্ত হবে শরীরী বার্তায়। কিছু ভিডিও কিছু গিফ্ট এ। তৎক্ষনাৎ সুখানুভূতী হলেও আবারও অবহেলায় আবারও অবহেলায় মেয়েটি তাকে প্রতারক বলতে বাধ্য হল ফেসবুকের পাতায়। আত্মসম্মানে লেগেছিল খুব ছেলেটির। আরও অবহেলা উপেক্ষায় মেয়েটি ছেলেটিকে ব্লক করলো। এত বড় কান্ড ঘটাবে মেয়েটি কল্পনার অতীত ছিল ছেলেটির। কৈফিয়ত চাইলো। মেয়েটি বললো, হোয়াটসঅ্যাপে একলা তাকে দেখতে চায়। নাই বা থাকুক ফেসবুকে। শেষমেষ ছেলেটি আরও উপেক্ষা করতে লাগলো মেয়েটিকে। কবি কবিতা লিখে ইচ্ছে হলে পাঠাতো হোয়াটসঅ্যাপে। মন্তব্য দেখার আগ্রহ আজ আর তার নেই। হয়তো বা আছে। মেয়েটি জানতে পারেনা। কারণ সিনের সবুজ সিগনাল দেখতে পায়না। তাহলে মেয়েটি তাকে প্রতারক বলে কি ভুল করেছিল?







আহ্বান 

অ র্ণ ব ঘো ষ 

দোল পূর্ণিমা। সাজোসাজো রব প্রকৃতিতে। আকাশের গায়ে পলাশের চাদর, বৃক্ষে যৌবনের উন্মাদনা, বাতাসে বিহঙ্গের কলকাকলি। প্রকৃতির যেন নববধূবেশ। জনমানসও দোলায়িত। আজ হৃদয় ব্যাকুল মৌলীর। তার দু'চোখ অবগাহন করে চলেছে নিসর্গে আর মন মজে আছে স্মৃতি রোমন্থনে।

বাইশ বছর আগের কথা। মৌলী তখন অষ্টাদশী। রূপসী, লাবন্যময়ী, প্রানোচ্ছাসে ভরপুর। চোখে ছিল তার অদ্ভুত এক মায়া। আর সৃজন শান্ত-সৌম্য, সুদর্শন, মেধাবী। দুজনেই খুব ভালো বন্ধু। এমনই এক দোলের দিনে হলুদ শাড়ি আর ছোট্ট লাল টিপে সেজে মৌলী এসেছিল রাঙা আবির হাতে। তার সেই চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়নি সৃজনের। তবু সাহস হয়নি। মৌলীও অব্যক্ত রেখেছিল তার হৃদয়ের কথা। সৃজন পড়াশোনা করতে চলে যায় বাইরে। মৌলী বাধা দেয়নি। বিশ্বাস ছিল হৃদয়ে বাঁধতে পারলে সে ফিরবেই।

_শুভেচ্ছা রইল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আর এই ছোট্ট উপহার।
_"শেষের কবিতা" ( বই হাতে স্মিতহাস্যে সৃজন শুধাল)। যাই তবে। ভালো থেকো।
_যাই বলতে নেই, বলো আসি।

সৃজন ফেরেনি। স্কলারশিপ পেয়ে সে পাড়ি দেয় সুদূর ইউরোপে। চোখে তার আবিষ্কারের নেশা, স্বপ্নপূরণের হাতছানি। মৌলী গুনেছে প্রতীক্ষার প্রহর, একের পর এক বিয়ের সম্বন্ধ করেছে প্রত্যাখ্যান। সৃজন কেরিয়ারে ধীরে ধীরে পৌঁছে গেছে সফলতার শীর্ষে। যোগাযোগের চেষ্টা করেনি মৌলী, পাছে কেরিয়ারে প্রভাব পড়ে সৃজনের।

কিন্তু আজ হৃদয় বড়ই অস্থির। একটা জমা আক্ষেপ যেন বুকের গভীরে দলা পাকিয়ে আছে। সেদিন যদি পথ আটকাতো মৌলী, অকপটে বলে দিত হৃদয়ে উত্তাল ঢেউয়ের কথা...
চারিদিকে আজ রঙের মেলা। শুধু ফিকে হয়ে আছে মৌলীর জীবনের রঙ।

সৃজন ক্লান্ত। গা এলিয়ে পড়ে আছে সোফায়। আজ সে সফলতার শিখরে তবু কোথাও যেন এক অদ্ভুত অপূর্ণতা। সব থেকেও যেন কিছুই নেই। জীবনের অপরাহ্নে এসে আজ সে বড়ই ক্লান্ত। প্রয়োজন যেন শীতল ছায়ার, একটা স্নিগ্ধ আঁচলের।

বইটা শোকেস থেকে বার করল সৃজন। এতগুলো বছরে মলাটে জমা ধূলো ঝাড়তে গিয়ে ছোট্ট একটা চিরকূট খুঁজে পেল সে। তাতে লেখা-

না বলা যত কথা
গোপনে, যত্নে রেখেছি সাজিয়ে
খুঁজে যদি পাও কভু, এ বিরহব্যাথা
হাতটি দিও বাড়িয়ে।

জীবনদর্শন পাল্টে গিয়েছিল সৃজনের। অব্যক্ত প্রেম আগ্নেয়গিরির লাভাসম নিষ্কাশিত হতে চাইছে আজ।

দিন দুয়েক পর। দরজায় খটাখট শব্দ। বিস্মিত হল মৌলী।
_কে এই অসময়ে!

দরজা খুলতেই-
গৌরবর্ণ এক সুদর্শন পুরুষ, ছ-ফিট লম্বা, সুঠাম শরীর, একগাল দাঁড়ি। দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছে দেহ থেকে। সুদূর থেকে এসেছে সে হৃদয়ের আহ্বানে। আজও আছে সেই একইরকম। মৌলীর প্রাণের দোসর, মৌলীর সৃজন।







অপেক্ষায় রইলাম 

ম ম তা শ ঙ্ক র সি ন হা (পা ল ধী)  
     
নবগঞ্জে নতুন সেতুটির উদ্বোধন হয়েছে সবেমাত্র। পুরো সেতুটিকে নয়ন ভরে দেখছিলাম একাই। তখন গোধূলিবেলা--- পশ্চিমাকাশ তখনও রঙে রঙে রাঙানো। কোপাই নদীর মিষ্টি স্রোত সেতুটির তলায় লুকোচুরি খেলছে। খেয়া নৌকা থেকে ভাটিয়ালী সুর ভেসে আসছে।পালতোলা নৌকাগুলি শান্তভাবে দক্ষিণা পবনে মেতে উঠেছে।অদূরে নদী-তটে বলাকারা নিশ্চিন্ত মনে বসে আছে।মাছরাঙা পাখিটি নদীর পাড় সংলগ্ন বাবলা গাছের শাখায় নিরিবিলিতে শিকারের আশায় চিন্তামগ্ন।পাখ-পাখালী, গাছ-গাছালী আর দক্ষিণা পবনের ত্রিবেনী সঙ্গমে নদী-বিধৌত বনাঞ্চল মাতোয়ারা। মনে পড়লো অনেক কাল আগের বইয়ে পড়া অনেক কথা--- বেহুলা-লখীন্দর, চম্পক নগর, গাঙুড় নদী ইত‍্যাদির কথা। তখনও আঁধার নামেনি সেভাবে--- তবুও সন্ধ‍্যা ঘনিয়ে আসছে প্রাকৃতিক নিয়মেই। 

তারপর ধীরে ধীরে সন্ধ‍্যা নামল।সেতুর কিছুটা দূরে, পূর্বদিক থেকে সন্ধ্যা আরতী ও প্রার্থনা সঙ্গীতের মঙ্গলময় সুর ভেসে এলো আমার কানে। সন্ধ‍্যার ছায়াচ্ছন্নতায় ঢাকা নদী-তীরবর্তী পর্ণকুটিরের তুলসী মঞ্চে মায়েরা শঙ্খধ্বনির প্রদীপ প্রজ্বলনে ব্যস্ত।হঠাৎ পিছন থেকে শুনলাম--- "বাবু দুটো পয়সা দিবি? পিছন ফিরে দেখলাম আধা উলঙ্গ শিশুকে দুধ খাওয়ানোর জন্য 'আমফান'-এ সর্বহারা শীর্ণকায়া ক্লান্ত ভিখারিনী মায়ের আর্তি--- নিরন্ন, বীভৎসা অথচ ভাবনাহীনা। মুখ ফেরালাম সেই করুণ দৃশ্যর থেকে।

লকডাউনে কর্মহারা পরিবারের জনাতিনেক কিশোর-কিশোরী চটি চটি বই হাতে নিয়ে ঘুরে ফিরে বিক্রি করছে। ওরা এগিয়ে এলো। ওদের একজনকে আমার খুব চেনা চেনা মনে হলো; আপন বলে মনে করতে ইচ্ছে হলো কিশোরীকে। বয়স উনিশ-কুড়ি হবে। পরণে হালকা নীলাভ সালোয়ার কামিজ। শতছিন্ন নয়, অথচ তাতে অভাবের ছাপ বড়ই স্পষ্ট। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি নিয়ে সে আমার দিকে এগিয়ে এলো এবং বললো--- "বাবু এই বইটি নেবেন? খুব কম দাম, মাত্র চল্লিশ টাকা। কিশোর দু'টি বললো--- "বাবু এই বইটি নিন। দশ টাকা দাম।" আমি কিশোরীর বইটি কিনলাম। আমার বিবেক মনুষত্ব বোধকে প্রশ্রয় দিল--- তাই আমি বই কিনলাম কিশোরীর থেকে। ওরা চলে গেল। তখন তবুও সন্ধ‍্যা। সেতুর আশেপাশে মানুষের আনাগোনা অনেকটা কমেছে।দোকানপাট বেশির ভাগ বন্ধ হয়েছে। হঠাৎ আমার সামনে দিয়ে দু'চারজন ছোকরা সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে চলেছে। ওদের সবাইকে আমি চিনি। প্রত‍্যেকেই শিক্ষিত ও সম্ভ্রাম্ত পরিবারের। ওরা টলতে টলতে চলছিল। আমাকে চিনতে চাইলোনা ওরা। আসলে ওরা অনেক দিন আগে আমার চেয়ার-টেবিলের সামনে বসত। হয়তো সে সব কথা ওরা মনে করতে পারছেনা কিংবা মনে করতে চাইছেনা। যাইহোক আমার সঙ্গে ওদের সম্পর্কের কথাটা গোপন থাকাই ভালো।বাড়ি ফিরবো ভাবছি। এমন সময় সেতুর শেষ প্রান্তের আবছা অন্ধকার থেকে নারী-পুরুষের হাস‍্যের ও লাস‍্যের চাপা ফোয়ারা উঠলো। দেখতে পেলাম বই বিক্রয়েত্রী নব যৌবনা নারীটি নব‍্য যুবা ক্রেতার সঙ্গে কথা বলছে। বিস্মিত হলাম! বুঝলাম অন্ধকার ঘনিয়েছে। হঠাৎ পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করলাম। "হ‍্যালো হ‍্যালো,হ‍্যাঁ প্রতীমদা আমি শুভ বলছি।শোনোনা, তোমার কথা পরে শুনছি। আগে আমার কথা শোনো। সেই যে আমাদের সঙ্গে সি টি কলেজে পড়ত, মনে আছে তোমার; অভিনব দাশগুপ্তকে--- ডঃ হিমালয় দাশগুপ্তের গুন্ডা ছেলে, যে নিশার সাথে অশ্লীল ব‍্যবহার করা সত্ত্বেও কোনো শাস্তি পায়নি---।

"নিশা?"-প্রতীমদা বললো।
 
"নিশাকে মনে পড়ছে না! সেই যে, গরীব মাষ্টামশাই, তাঁর মেয়ে, যে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচে-গান-আবৃত্তিতে প্রথম হতো। যার গুণে মুগ্ধ হয়ে আমাদের ফিলোজফির অধ‍্যাপক অতীত রায় তাকে একটি লাল গোলাপের তোড়া উপহার দিয়েছিলেন।"

"ও-হো, হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ চিনতে পেরেছি, যাকে আমরা মজা করে 'নিশানা' বলতাম।"-প্রতীমদা বললো।

"হ‍্যালো দাদা, যে কথা বলছিলাম--- অভিনব তো শাস্তি পেলোইনা, অথচ দাপটের সঙ্গে কলেজে ঘুরে বেড়াত। কি, এবার মনে পড়ছে?"

"হ‍্যাঁ বুঝতে পেরেছি; মনে পড়েছে। অভি মানে প্রফেসরের ছেলেটা তো?"--- প্রতীমদা বললো।

"হ‍্যাঁ, যে তিন তিনবার ফেল করে শেষ পর্যন্ত পাশ-কোর্সে থার্ড ডিভিশান পেয়েছিল। ও তো তোমাদের ওখানে কোনো একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে ওর বাবার এক বন্ধু ছিলেন। ওখানে....।"

"হ‍্যালো হ‍্যালো--- যাঃ লাইনটা কেটে গেল।" ফোনটা রাখলাম।

চাপা হৈ চৈ আওয়াজ ভেসে এলো, ভাবলাম আঁধারের কোনো হাট। গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে হলোনা।ঘরমুখী হলাম। হঠাৎ আমার পিলে চমকে গেল!

"শ্রাবণ না!" ও তো অনেকদিন আগে মারা গেছে। আমার এক ভাই প্রফেসর তিমির ওকে প্রথম দেখে আলাপ করেছিল। আলাপ করে ওকে লাস‍্যময়ী, হাস‍্যময়ী ও মার্জিতা মনে হয়েছিল ওর। ওদের মধ‍্যে হৃদ‍্যতাও হয়েছিল। প্রফেসর স্বল্প মূল‍্যে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক গভীর রাতের ভূমিকম্পে শ্রাবণের মৃত‍্যু হয়েছিল বলে শোনা যায়। যদিও প্রফেসারের কষ্ট হয়েছিল অনেক, কিন্তু সে একটুও দুঃখ করেনি সেদিন। শ্রাবণকে আমিও চিনতাম। সেই শ্রাবণ রাতের অন্ধকারে, মানে... চাপা হৈ চৈ করা আঁধারের হাটে অভিসারে চলেছে! হঠাৎ জীবন্ত শ্রাবণকে দেখে বিস্মিত হলাম! কিন্তু না, জীবন্ত না, ও আলেয়া--- ভূমিকম্পে চাপা পড়ে থাকা মৃত পচা কায়া। টিকতে পারলাম না; দুর্গন্ধে-ভয়ে-হতাশায়। পালিয়ে গেলাম। সেই সেতুটি গাঢ় অন্ধকারে আর দেখা গেলনা।
             
 গভীর ভাবনায় ডুবে গেলাম--- সিগারেট ধরালাম। বাড়িতে ঢোকার আগেই অন্ধকার রাস্তায় উত্তমকে দেখলাম। যে দু-তিন বার 'এস.এস.সি'-র ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েও চাকরি পায়নি। যাকে মিষ্টি দোকানের প্লেট ধুতে হয়। চাকরিওয়ালাদের কাছে যে যোগ্যতাহীন বলে আজও পরিচিত। আর এই যন্ত্রণা থেকে সে আজও রাতের অন্ধকারে সিগাারেট খেয়ে হারিয়ে যেতে চেষ্টা করে যোগ্যহীন উপায়ীদের ভিড়ে। 

বাড়িতে ঢুকলাম--- স্ত্রী তখনও বাড়িতে আসেনি। চাকরি করে ও--- ওভার করতে হয়! বসের গাড়িতে এখুনিই হয়ত পৌঁছে যাবে। কিংবা গাঢ় অন্ধকার উপেক্ষা করে আসতে পারছেনা বাড়ি! রাত বাড়তে লাগলো। তবুও খিদে নেই আজ আমার তেমন। ভাত খেতে ইচ্ছে হোলনা।ছাদে গেলাম। একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে চন্দ্রালোকের পুলকিত জ‍্যোৎস্নাধারার অপেক্ষায় রইলাম। মন বলে চলে কার অপেক্ষা---? কিসের অপেক্ষা---?






চোরের উপর বাটপাড়ি 

সু স্মি তা ম ন্ড ল পা ই ক (মা লা) 

প্রথম বার বাস মিস করেই দ্বিতীয় বাসের আগমন... আর তাতেই চেপে আসতে হল তিন কিলোমিটারেরও কাছাকাছি পিসির বাড়ি। ভীষণ ভোজনরসিক মানুষ তো তাই পিসি ভালোবেসে 'পেটুক' বলে ডাকে যখন তখন! তাই বলে তো আর হোঁতকা নই। তুই বাবা বেশী খাসনে, নিজেকে আর মহাভারতের দ্বিতীয় পান্ডব বানাস নে... তবে পিসি যাই বলুক মোগলাই, মাংসের কিমা, কচুরি এসব কি ছাড়া যায় বলুন তো!নৈব চ, আমার বেশি নয় সাতদিনের আপ্পায়ন অবশ্যই মেনুতে খাবারের ঝলকানি হওয়া চাই মনোরম ও সুস্বাদু। পড়াশোনা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখে যদিও এসেছি পিসির মেয়ে সুমনার জন্মদিনে... তাই মন তো টেনশন ফ্রী রাখতেই হয়। বাড়ি ফিরে আবার সেই একঘেয়ে স্কুল, এক্সজামিনেশন। যাই হোক, আগের খাবার গুলো ছিল সকালের। দুপুরের মেনু আবার একটু ভিন্ন ধরনের পঞ্চব্যঞ্জন ডাল, ভাজা, ভেজ-ননভেজ আর কত বলবো! অবশেষে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা মিটলো... সন্ধ্যে বেলাটা গ্রাস করলো আলোর ঝকমকানি ও নানান প্রসাধন দিয়ে ঘর সাজানো নিয়ে, সুমনাকে দিলাম নিজ হাতের একটি চিত্রাঙ্কন। ফুটফুটে মুখের কোনায় হাসি ও ইনোসেন্ট চোখের চাহনি দেখে মনে হল বেশ খুশি। অনেক গেস্টই এসেছেন, এরপর শুরু হল 'শুভ প্রত্যাবর্তন'। খাবার সুসময় আসন্ন... আমি আবার খিদে কন্ট্রোল করতে পারিনা, তাই বসে পড়লাম প্রিয়জনদের সাথে। প্রিয়জন বলতে এইকজন আরকি রাকেশ, হরি, ভজন, ডালিয়া, অঙ্কিতা। সবরকম খাওয়া-দাওয়া হয়েছে, এরপর তো মাংসের পালা। আমার প্রিয় লেগপিসটা পড়ল ডালিয়ার থালায়... 'কুচ পরোয়া নেহি' ডালিয়া এদিক-ওদিক তাকাতেই টুক করে লুঠতরাজ করলাম। লেগপিস নিয়ে খেতে যাচ্ছি এমন সময় শেফ অ্যারেঞ্জমেন্টের দায়িত্বে থাকা ওই মাংস দেওয়া ক্যাটারিং-এর লোকটি পুনরায় এলো চাটনি দিতে। উনি বললেন, একি একজনের মাংস একজন চুরি করে খাচ্ছে আবার একটা জাঁকজমক পূর্ণ পার্সও আর একজন লুটে নিয়েছে! উনার কথা শুনে সবাই হতবাক! সবাই আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। সত্যি আমি এবার অপ্রস্তুতে পড়লাম। জীবনে কোনোদিন এমন হয়নি! দু'জন ভদ্রমহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, "একি এটা তো আমার... কি করে গেল"?
আমি তো এটা নিইনি তবে...
তাছাড়া দুজনই তো দাবি করছে দু'জনের বলে! হলুদ রঙের শাড়ি পরা মহিলা অপর মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার কি করে হল"?

উনি আমতা আমতা করে বললেন, না মানে...
ওহ বুঝেছি, "চোরের উপর বাটপাড়ি"!

আমি পেছন ফিরে তাকালাম পার্সটা আমার নয় ডালিয়ার কাছে রয়েছে।
ভদ্র মহিলা গর্জন করতে করতে চেয়ার থেকে বেরিয়ে এলেন, "আমি পুলিশে খবর দেবো, বল মেয়ে কোথা থেকে তুই এটা নিলি"?
আমি তো আপনারটা নিইনি... এটা তো উনার!
আচ্ছা তুমি বা কোথা থেকে পেলে?
মহিলাটি লজ্জায় মাথা হেট্ করলেন...।
ডালিয়ার একটু স্বভাব আছে তবে এমনটা যে হবে সকলের মধ্যে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরোল না, লজ্জায় ঘরভর্তি লোকের সামনে মাথা হেট্ হয়ে যাচ্ছে! নিচু হয়ে ভদ্রমহিলার পা ছুঁয়ে কাঁদতে লাগল, "আর কক্ষনো করবো না... কক্ষনো না।
আমি ওর পাশে বসলাম, ডান হাতটি ওর মাথায় রেখে বললাম দেখলি তো চুরির ফল কি হল, আর কক্ষনো এমন করিস নে যতদিন বাঁচবি সৎ হয়ে চলিস, মাথা উঁচু করে বাঁচিস।





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল ও বাসন্তী সংখ্যা || ৯ চৈত্র ১৪৩১ || ২৩ মার্চ ২০২৫

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চতুর্থ বর্ষ || চতুর্থ ওয়েব সংস্করণ || বাদল সংখ্যা || ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ || ২৯ জুলাই ২০২৫