গল্প

অবশেষে গল্পটা...


পা ভে ল  ঘো ষ


"মনা, ওঠ রে….. সুবলকাকা এসেছে.."

মায়ের আদরমাখা কণ্ঠে চোখ মেলে মনোজ।

ঘুমের আবেশে একটা লম্বা হাই তুলে বলে ওঠে,  "সুবলকাকা...? বসতে বলো...।"

বাবা চলে যাওয়ার পর সুবলকাকাই ওর লোকাল গার্জেন। ক্লাস থ্রিতে পড়তে মনোজের বাবা হঠাৎ ব্লাড ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে কোনো প্রয়োজনে এক ডাকে ওদের বাড়িতে চলে আসে সুবলকাকা।

আদ্রা শহরের পাশে জিয়ারা গ্রাম। এখন জিয়ারাতেই মাকে নিয়ে একটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে থাকে মনোজ। সঙ্গে বছর দেড়েকের ছোট্ট কুকুর 'লালু'।


বাবা চলে যাওয়ার পর আদ্রা শহরে মামার বাড়িতেই থাকতো মনোজ। সারাটা দিন শহরের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সাইকেল নিয়ে পাক খেত সে। বাবা'ই ওকে হাত ধরে হঠাৎ একদিন আদ্রা থানা পেরিয়ে শিব মন্দিরের কাছে লালডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো। ছোট থেকেই দুষ্টুমিতে কারোর থেকেই কম যেত না মনোজ। ওর ঠাকুমা বলতেন, 'নাতির আমার হাতে, পায়ে সমানে বয়।' শুনে সবাই হাসতো।


প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর আশ্রম স্কুল থেকে কষ্ট করে মাধ্যমিকটা যাহোক করে পাস করেছিলো মনোজ। তারপর সবার অমতে একপ্ৰকার জোর করেই ভর্তি হয়েছিলো ইলেভেনে। 

"কি রে মনা..? তোর সুবলকাকা কখন থেকে বসে আছে....!"

মায়ের ডাকে নিজের জগতে ফেরে মনোজ। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওর এই আদ্রা শহরে। জন্ম থেকে বাইশটা বছর। ভাবা যায়..!

"যাই মা... " চোখে ঘুম নিয়ে জোর করেই উঠে পড়ে মনোজ।কাল অনেকরাত পর্যন্ত ঘুম হয় নি ওর। জোনাকীদের সঙ্গে কাল সারা রাতই প্রায় জেগে কেটেছে ওর। মহালয়া আসলেই নয়নের কথা মনে পড়ে খুব। ওর চুলে জড়িয়ে থাকা লাল ফিতেটা নাকের কাছে নিয়ে মাঝে মধ্যেই গন্ধ নেয় ও। নয়নের চুলের তেলচিটে গন্ধটা এখনো যেন লেগে আছে ফিতেটায়।


"শোন মনা, এবার কিন্তু 'না' করবি না তুই। করোনার চোটে এবার কলকাতা যাওয়া বন্ধ।পূজোয় এবার আদ্রায় কাজ।" সুবলকাকার কণ্ঠে সম্বিত ফেরে মনোজের। বুঝতে পারছে, আজ বারবার আনমনা হয়ে পড়ছে ও।

"আদ্রা আমায় যেতে বলো না কাকা। গোটা শহর জুড়ে অনেক স্মৃতি..! আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না আমি...! খুব কষ্ট হয় গো।"


"শোন, এই পুজো তোদের পাড়া থেকে অনেক দূরে..। আদ্রা কি আর একটুখানি শহর রে খ্যাপা...!" সুবলকাকা হাতটা ধরে ফেলে মনোজের।


"আমি যাব না কাকা..." মাথা নীচু করে 'না' তে অনড় থাকে মনোজ। চোখের কোনে বেদনার বিন্দুজল জমা হয়।


"যা না মানিক...তোর কাকা এত করে বলছে..." মনোজের মা ছেলের পিঠে স্নেহভরা হাত বুলিয়ে বলে ওঠে।


"যেতে পারি... কিন্তু একটা শর্তে...!" হঠাৎ কান্নাভেজা চোখদুটো মেলে বলে মনোজ।

"আচ্ছা, ঠিক আছে... তোর সব শর্ত না শুনেই মঞ্জুর করলাম। তুই যাবি বলেছিস, এতেই আমি খুশী..।"


"কিন্তু দাদা, শর্তটা শুনবে না...?" মনোজের মা জিজ্ঞাসা করে সুবলকাকাকে।

মায়ের কথায় চোখের জল মোছে মনোজ। বিদ্যুতের মতো এক ঝিলিক হাসি খেলে যায় ওর মুখে।

"দুদিন আগে চলে যাবো আদ্রা..।মানে চতুর্থীর দিন...."


"ঠিক আছে যাবি.. কিন্তু ওখানে থাকবি কোথায়?"


"মলয়ের বাড়ি..। আমি জানি ও না করবে না। বরং আনন্দ পাবে কাকা।"


মনোজের কথা শুনে সুবল স্বস্তি পায় ঠিকই, কিন্তু একটা অজানা চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ওর।


হাতদুটো মুঠি করে খুশিতে উঠে পড়ে মনোজ।


"দাঁড়া..। এবার তুই মনে হয় রিকশাওয়ালা সাজবি। চাপ নেই।সারাক্ষন বসে থাকা। তবে দৃষ্টি স্থির, আর ক্লান্তিটা যেন চোখে মুখে ফুটে ওঠে....। মনে থাকবে?"


"মনে থাকবে কাকা..।" হাসিমুখে চোখ বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে যায় মনোজ।


দেখতে দেখতে চতুর্থীর সকালটা চলে আসে। শিউলি ফুলের তীব্র গন্ধে ঘুমটা ভেঙে যায় মনোজের। মনোজের আদ্রা যাওয়ার দিন আজ। জানালা দিয়ে দূরে চোখ চলে যায় ওর। আকাশ জুড়ে 'মেঘের নৌকাগুলো' পাড়ি দিচ্ছে যেন অজানা কোন পথে। কাশ ফুলের দল হাওয়ার ছন্দে এক অজানা আনন্দে মেতে উঠেছে এই সময়।


চাপা আনন্দে কাল সারা রাত ঘুম হয় নি মনোজের। ভিতরে একটা আনন্দধারা বইছে। আবার আদ্রা...! একসময় স্বপ্নের মতো মনে হওয়া সেই রেলওয়ে কলোনি, পলাশ বন, খোসলা বাঁধ- সব যেন হাতের তালুর মতো মুখস্থ ছিল ওর। মা একটা ছোট্ট চায়ের দোকান চালিয়ে কোনোরকমে মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতো। কিন্তু রঙিন পৃথিবীর রং এত তাড়াতাড়ি ফিকে হয়ে যাবে, বুঝতে পারে নি মনোজ। ক্লাস টুয়েলভ পড়ার সময় মায়ের হঠাৎ শরীর খারাপ হলো একদিন। মনোজ সেদিনই বুঝেছিল এবার তাকে কোমর বেঁধে সংসারের হাল ধরতে হবে। কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিকটা পাস করে ঢুকে পড়েছিলো সুভাষদার গ্যারেজে। বেশ নির্বিঘ্নেই চলছিলো মা-বেটার জীবন। হঠাৎ ধূমকেতুর মতো হাজির হলো নয়ন। খুব মনে আছে,আলাপ হয়েছিলো ওদের অকাল শ্রাবনের এক বৃষ্টিস্নাত দিনে। আধ ভেজা নয়ন আশ্রয় নিয়েছিলো ওদের গ্যারেজে। নয়নের মিষ্টি ঠোঁটের ছোট্ট কথাটা আজও মনে পড়ে মনোজের।


"হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা কিছুতেই ছাড়ছে না..." নয়ন বলতেই নিজের ছাতাটা ওকে এগিয়ে দিয়েছিলো মনোজ। সেই শুরু..! তারপর ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণতি পেতে বেশী সময় লাগেনি ওদের। সপ্তাহে একটা দিন রবিবার ছুটি পেতো মনোজ। সুভাষদার স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তো ওরা। কোনোদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে শিমুল-পলাশের তলায়, কোনোদিন আবার শহরের বাইরে মেঠো পথ ধরে অনাবিল আনন্দে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতো ওরা। ওদের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো রূপকথা হয়ে ধরা পড়তো রবিবারে। মনোজের মা'ও মেনে নিয়েছিলো নয়নকে। কিন্তু দুর্ভাগাদের ললাটে সুখের লিখন মনে হয় বেশিদিন স্থায়ী হয় না।মনোজেরও হলো তাই। মলয়দের বাড়িতে সত্যনারায়ন পূজোর প্রসাদ খেয়ে ভাঙা স্কুটিটা  দ্রুত গতিতে চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলো ও টিভিতে 'চাঁদের পাহাড়' সিনেমাটা দেখবে বলে। এক চিলতে ঘরে ঢুকেই মায়ের গম্ভীর অবসন্ন মুখটা দেখে ও চমকে উঠেছিলো অজানা আশঙ্কায়। 

গাড়িটা যাহোক করে দাঁড় করিয়ে মা'কে  মনখারাপের কারণটা জিজ্ঞাসা করতেই অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলো মনোজের মা।

"নয়নকে ধোবি তালাওতে অত্যাচার করে ফেলে দিয়ে গেছে শয়তানেরা...!" 


মায়ের কথা শুনে সেদিন বোবা হয়ে গেছিলো মনোজ। 

পরের দিন সকালে এক ছুটে হাসপাতাল। নয়নের ঘোলাটে চোখ দুটোর দিকে তাকাতে পারে নি বেশীক্ষন ও। নিষ্ঠুর অত্যাচারের ছাপ সারা শরীর জুড়ে। ঠোঁটে জমাট বাঁধা রক্ততে বসা মাছিটাকেও তাড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না নয়নের।

ঘটনার পর মাস তিনেক ঘুমাতে পারে নি মনোজ। বিছানায় ছটফট করে কাটিয়ে দিয়েছে একটার পর একটা বিনিদ্র রাত।

ছেলের ধারাবাহিক যন্ত্রনায় চুপ করে থাকা মুখটা দেখে সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হয়েছিল মনোজের মা। সুবলকাকার উদ্যোগেই মা মনোজকে নিয়ে চলে এসেছিল এই জিয়ারা গ্রামে। গ্রামেই শিল্পী সংঘে একটা কাজও পেয়ে গেছিলো ও। প্রথম প্রথম বড় অসুবিধা হতো মনোজের। তিন চার ঘণ্টা স্ট্যাচু হয়ে থাকা। এখন অবশ্য খুব নাম করেছে এই কাজে। স্মৃতিগুলো আজ বড্ড ভিড় করছে মনোজের মনের আকাশে।


"খেয়ে যাস..আমি রান্না চাপিয়েছি.."  মায়ের কথায় স্নান করতে যায় মনোজ।


দেখতে দেখতে চতুর্থী ,পঞ্চমী পেরিয়ে আজ ষষ্ঠীর সকালটাও চলে এলো। এই দুদিন সারা শহর ঘুরে বেরিয়েছে মনোজ। ওর হারানো দিনের গল্পগুলো কষ্টের আড়ালে স্মৃতির ছোঁয়ায় ফিরে এসেছে দুদিন ধরে অবিরত। যাপনচিত্র তো স্মৃতির পাতায় এভাবেই নিভৃতে বাঁচে। 


মণ্ডপে যাওয়ার আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে অবাক হয় মনোজ। যন্ত্রণাগুলোকে কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় কিভাবে নিখুঁত এঁকেছে মুখ জুড়ে সুবলকাকা...! আনন্দকে নিয়ে এভাবেই তো আছে মনোজ নয়ন চলে যাবার পর থেকে।


"মনা চলে আয়, সময় হয়ে গেছে...."

সুবলকাকার কথায় নিজের জগতে ফেরে মনোজ।


"চলো কাকা,আমি রেডি.."

নদীর স্থির জলের মতো স্থবির হয়ে বসে পড়ে মনোজ মূর্তি হয়ে। 

"চোখের পলক পড়ছে না দেখ..."

একটি বাচ্চার কথা কানে যায় মনোজের। আমল দেয় না ও। অস্থির, এলোমেলো পরিবেশে নিজেকে কিভাবে নির্বাক মোমের মূর্তির মতো থাকতে হয়, সুবলকাকার কাছেই নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনে শিখেছে মনোজ।

গোধূলির মুহুর্ত থেকে 'মনোজের চুপকথা' ঘন্টার চৌকাঠ পেরিয়ে যায় ধীরে ধীরে। সন্ধ্যার  ভিড় ক্রমশঃ পাতলা হতে থাকে। হঠাৎ দূরে দৃষ্টি চলে যায় ওর। বড় চেনা মুখ..! পরনে শতচ্ছিন্ন শাড়ি। ধুলো বালির নকশা সারা শরীর জুড়ে। ছেঁড়া আঁচলটাকে  মাঝে মাঝে টেনে মজা নিচ্ছে কচি-কাঁচার দল। আলো থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া, আঁধারে ডুবে থাকা নির্বাক একটা মুখ। 

"নয়ন না...?" যন্ত্রণাগুলো পোকার মতো কিলবিল করতে থাকে মনোজের। বুকের বামদিকে একটা অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করে ও। কিন্তু নয়ন তো বেঁচে নেই..! সুবলকাকার মুখে নয়নের মৃত্যুর খবরটা এখনো  কানে বাজে ওর.."তোর নয়ন চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে রে মনা.."


খবরটা যে "ডাহা মিথ্যা" সেটা এখন বিলক্ষণ বুঝছে মনোজ। 

আরো কাছে এসে পড়েছে নয়ন।

"মনোজ, আমাকে বাঁচাও..! ওরা মেরে ফেলবে আমাকে..! বাঁচাও আমাকে ...!" একটা অস্ফুট আওয়াজ শুনতে  পায় মনোজ। 

ধীরে ধীরে দৃষ্টির বাইরে ঝাপসা হতে থাকে  নয়নের মুখ। বুঝতে পেরেও মনোজ যন্ত্রণাটাকে ধূপকাঠির মতো পোড়াতে থাকে বুকের মধ্যে।


ইতিমধ্যে ম্রিয়মাণ মণ্ডপে মানুষের আনাগোনা কমতে শুরু করে।আলোপোকারা মনোজের স্থির চোখদুটোতে আছড়ে পড়তে থাকে ঢেউয়ের মতো...!

"খেতে চল মনা..."  মনোজের পিঠে সুবলকাকা হাতের টোকা মারতেই ওর নিষ্প্রাণ দেহটা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে...। ভালোবাসার সব নেশা গলায় ঢেলে সাঙ্গ হলো মনোজের প্রজাপতি জীবন...!





তেরি মেরি কাহানি হ্যায়


ছ ন্দা  চ ট্টো পা ধ্যা য়


একতারাটির একটি তারে আঙুল চলছে উদাসী বাউলের। মানুষের গান বাউলের কানে কানে মন্ত্রোচ্চারণের মতো ছুঁয়ে দেয় একতারা। নাম তার নিতাই বৈরাগী। পূবের আকাশে শুকতারাটি যখন দপদপিয়ে জ্বলে, আদিগন্ত মাঠের খোলা হাওয়া লাগিয়ে প্রাণে... বাউল বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণে। দখিন পাড়ার একটি মাটির কুটিরের দুয়ার খুলে উঠোনে শিউলি ফুল কুড়োতে আসে রাই। নিতাইকে বলে- 'আজ কুন্‌ দিগরে ভেমনে যাও গো ঠাকুর?'- -'দেকি, চরণদুটি কুন দিগরে নে যায়।'- নেতাই উত্তর দেয়। ঊষার আলোয় মাঠের আল বেয়ে ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে যায় বৈরাগীর ছবি। 


রাই সেই কোন্ ছোটবেলায় বিধবা হয়ে ফিরেছিলো বাপের ঘরে। ভাগ্যিস কৈবর্তদের ঘরে জন্ম, বিধবার আচার বিচার অতো মানতে হয় না ওদের। বামুনবাড়ির বিধবা গৌরীর দশা তো দ্যাখে রাই! দেখে কষ্ট হয়। মাছ ছাড়া ভাত খাওয়া যায়? আলো চালের দলা পাকানো ভাত নুন, কাঁচালঙ্কা, সর্ষের তেল আর তেঁতুল দিয়ে মাখে গৌরী। নিরামিষ তরকারি গৌরীর ভালো লাগে না। বরং টক টক ভাত তবু গলা দিয়ে নেমে পেটটা জুড়িয়ে দেয়। রাতে মা রুটি করে। গৌরীকে দেয় দুধ কলা রুটি। গৌরী রাইয়ের স‌ই। বড়ো পুকুরে চান করতে গিয়ে গোপন কথা কানাকানি করে দুই সখী। রাই বলে -'তোরে আমি নুক্কে নুক্কে মাচ খাওয়ায়ে দুবো। তোর দুক্কু আমি দেকতি পারিনে কো'-। গৌরী বলে,- 'আমার পেরোজোন নেই কো। একটাই তো জেবন! কেটে যাবেনে নেতাইদার মতো।'- দুই অকাল বিধবা সখীর‌ই পরাণ পোড়ে নেতাই বৈরাগীর তরে।


খালি পায়ে হেঁটে যায় বৈরাগী এক গাঁ থেকে আর এক গাঁ। কন্ঠটি ভারী মিঠে বৈরাগীর। আর আশ্চর্য, যে কোনো গান সে তুলে নিতে পারে কন্ঠে। এমনকি হিন্দি গান‌ও। একদিন মাধুকরী শেষে ফিরে এসে শুনিয়েছিলো এক আশ্চর্য গান। 'এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়, মৌজঁ কা রবানি হ্যায়... জিন্দেগি ঔর কুছ ভি নেহি... তেরি মেরি কহানি হ্যায়।'- ভাষা বোঝেনি গাঁয়ের মানুষ। কিন্তু কি আকুল আবেদন! সুরের রণনে হারিয়ে যেতে চায় মন কোনো এক সুদূরে। চোখে জল এসে যায়। বৈরাগী বুঝিয়েছিলো আমাদের সবার গল্প‌ই তো জেবন গো গোঁসাই! দুই সখীর‌ই মনে হয় বৈরাগীর চলার পথে ঘাস হয়ে শুয়ে থাকে। খালি পায়ে কাঁটা না ফোটে। সে কাঁটা ওরা বুক পেতে নেবে। একদিন ফিরেছিলো নেতাই নতুন এক গান কন্ঠে নিয়ে--- 'তোমায় কিছু দেবো বলে চায় যে আমার মন, নাই বা তোমার থাকলো প্রয়োজন।'- স্তব্ধ বিস্ময়ে অভিভূত দুই সখী তাকিয়ে থাকে। এ যে তাদের‌ও মনের কথা।-'ভালোবাসা দিতে মন চাইলে দাও না হে! যাকে দেবে তার দরকার থাকুক না থাকুক তোমার কি! আমি তো তার কাছে কিছু চাইতে যাচ্ছি নে কো। আমার তো দিয়েই তৃপ্তি গো!'- নেতাই বলতে চায়, দ্বিধাহীন, স্বার্থহীন ভালোবাসায় যে কি সুখ, যে সেভাবে বেসেছে সেই জানে। সেই জানে এর পরম সুখানুভূতি। 'ভগবান কখনো বলেন না, আমার পুজো করো। তুমি পুজো করো তোমার মন চায় তাই।'--- কি সুন্দর বুঝিয়ে বলে নেতাই। গাঁয়ের লোক তদ্গত হয়ে শোনে। সত্যিই তো! বুনো গাছপালা তো প্রকৃতির জল হাওয়া শুষে নিয়ে বড়ো হয়, মানুষ তাকে জল দিলো কি না দিলো তার ভারি বয়েই গেলো! তবু তো মানুষ মনে মনে কিছু মানত ক'রে অশ্বত্থ, বটবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালে। এই যে নেতাই বৈরাগী ভগবানকে গান শোনায়, ভগবানের প্রয়োজন আছে কিনা সে তো ভাবে না।নেতাইকে ভালোবেসে তাই কল্পনাতেই তার বুকে মাথা রাখে গৌরী আর রাই। চোখ বুজে অনুভব করে চন্দনের সৌরভ।


আলাভোলা নেতাইকে ভালোওবাসে গাঁয়ের সবাই। সংসারে তার এক বালগোপাল ছাড়া আর কেউ নেই। গোপালকে তাই ঝোলায় পু্রেই মাধুকরীতে বেরোয় নেতাই। বেলা দ্বিপ্রহরে ধু ধু বালুচর পেরিয়ে কুটিরে ফেরে। মাটির দাওয়ায় মাটির উনুনে মাটির মালসায় দুটি সেদ্ধ ভাত রাঁধে। গোপালের বাড়িয়ে রাখা হাতে এক মুঠো ভাত দিয়ে নিজের কপালে ঠেকিয়ে অন্ন গ্রহণ করে। রাই আর গৌরী কখনো দিয়ে যায় একটু শাক চচ্চড়ি, লাউয়ের ঘন্ট। কোনো চাহিদা না থাকায় এই তো তার অমৃত! 


একদিন ফিরলো নেতাই ফাটা রক্তাক্ত কপালে ন্যাকড়ার ফেট্টি বেঁধে। কোথায় যেন একটা বাচ্চা মেয়েকে কারা ধর্ষণ করে খুন করে খালের পাড়ে ফেলে গেছে। মেয়েটির মা আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছে। বাউল সেখানেই বসে পড়ে জুড়ে দিলো কান্না। -'হা কৃষ্ণ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ রুখে দিয়েছিলে, এখন তুমি কোথায়? ও দয়াল... বিচার করো!'- হঠাৎ ক্ষিপ্ত জনতা ওকেই ধর্ষক মনে করে দিলো আচ্ছা করে ঠেঙিয়ে। 'এ ভেকধারীটা কোথা থেকে এলো? আগে তো ব্যাটাকে দেখিনি। এর‌ই কাজ কিনা কে জানে।'- পরে ভুল বুঝতে পেরে মাথায় ফেট্টি বেঁধে ছেড়েও দিলো।


গাঁয়ের লোক বললো -'কি দরকার ছেলো পরের কথায় নাক গলিয়ে বিপদ ডেকে আনার? এখন তো শোনাই যাচ্ছে এসব খুব হচ্ছে। ডাক্তার দিদিমনি, উকিল দিদিমনি কেউ রেহাই পাচ্ছে নে কো '- নেতাই বলে, 'ভগবানের জীব সবাই। অসুর দেকলি মাত্তি হবে নে? কত্তো বড়ো বড়ো মিছিল বের হচ্ছে গো! দিনির বেলাতেও মোমবাতি জ্বালিয়ে সড়কের পরে পিতিবাদ হচ্ছে। আমারেও যেতি হবে গো।'- তারপরে নেতাইয়ের ঘরে ফেরার সময় 'বেব্ভম- হয়ে যায়। কি করতে পারে সে? পথে পথে কেঁদে বেড়ানো ছাড়া! মানুষের কল্যাণে যে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে চায় সে। তাকে কার প্রয়োজন! নিজের জন্য কিছুই চায় না নেতাই। শুধু খুঁজে বেড়ায় অসহায়, অত্যাচারিত দুঃখী মানুষদের। যেখানে প্রতিবাদের স্লোগান শোনে সেখানেই ভীড়ে ভিড়িয়ে দেয় নিজের পা দুটিকে। কোন মন্দির দেখলে ছুটে গিয়ে দেবমূর্তিকে প্রশ্ন করে, 'কেন এতো অত্যাচার, অবিচার! ঐ মূর্তিতে কি আছো তুমি ঠাকুর? নাকি বোবা,কালা, অন্ধ বিকলাঙ্গ করে তোমাকে দিয়ে ভিক্ষে করাচ্ছে সমাজপতিরা!' দেবতার এই পরিণতি সহ্য হয়না নেতাইয়ের। ঝোলায় হাত পুরে ছোট্ট গোপালকে মুঠোয় নিয়ে বুকে চেপে ধরে। যেন এই অরাজক, অদৈবিক অসুরের রাজত্ব থেকে ঈশ্বরকেই রক্ষা করতে চায় তাঁর এক ভক্ত। সারাদিন ঘুরে ঘুরে রোদেলা তাপ কি সহ্য হয়! দুদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর ঘরে ফেরে নেতাই। সে যে বৈরাগী গো!


নেতাই জ্বরে অচেতন। নিত্যদিনের মানসিক চাপ, খাওয়া ঘুমের অনিয়ম আর সহ্য হয়নি নেতাইয়ের। গৌরী আর রাই কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মাথায় তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। ভিজে গামছা দিয়ে গা পুঁছিয়ে দিচ্ছে। দুধ সাবু রান্না করে খাইয়ে দিচ্ছে। গাঁয়ের হোমিওপ্যাথি জেঠু ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই নিয়ম করে খাইয়ে দিচ্ছে। ওদের যে প্রেমের ঠাকুর নেতাই। ঈশ্বর কারো একার তো নয়! এই সেবাতেই যে পূর্ণতার আনন্দ দুই নারীর। এই ভালোবাসাই ভরে দিয়েছে রিক্ত দুটি সমর্পিত হৃদয়কে। নেতাই বৈরাগীর প্রয়োজন সেখানে তুচ্ছ। কাঠের সিংহাসনে বসে গোপালের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। ভগবান শুধু ভক্তের নয়, ভক্ত‌ও ভগবানের।





তিস্তাপারের উপকথা


মী না ক্ষী  চ ক্র ব র্তী  সো ম 


বনানী পায়ে পায়ে হেঁটে এলেন দোমোহনি স্টেশনে। ফাঁকা বেঞ্চ একটিতে বসে দেখতে লাগলেন চারপাশ। একাই আসতে চেয়েছিলেন ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত জায়গায়। শুনেই "আমিও যাবো ঠামির সাথে" বলে হৈ হৈ করে উঠল নাতনি আনিশা। জোজো বলল "একা কেন যাবি দিদি। আমাদেরও অনেকদিন দোমোহনি যাওয়া হয় না। চ' এই সুযোগে আমিও ঘুরে আসি।" 

পাঁচজন ভাইবোনদের মধ্যে জোজো সবচেয়ে ছোট। দিদি বনানীর ন্যাওটা ছিল ছোটবেলা থেকেই। এখনো এই মধ্যবয়সে পৌঁছে দিদির প্রতি অটুট রয়েছে স্নেহবন্ধন। ষাটের দশকের শেষে দোমোহনি ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে আসার দিনগুলো মনে হলে বিবশ হয়ে পড়েন বনানী। 


ডুয়ার্সের সবচেয়ে সুন্দর রেলশহর ছিল দোমোহনি। সেই স্টেশনের স্টেশনমাস্টার ছিলেন বনানীর বাবা। একটু বড় হতেই ভাই-বোন সবাই পল হোয়েল স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছিল। কয়েকজন ব্রিটিশ শিক্ষক ছিলেন। তারা যত্ন করে ইংরেজি সাহিত্য ও গ্রামার পড়াতেন। থমাস স্যার পরম মমতায় পিয়ানো এবং মাউথ অর্গান বাজাতে শিখিয়েছিলেন জোজোকে। কী সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি! তিস্তাপারের দোমোহনি শহর ছিল বেশ জমজমাট। অগুন্তি রেল কোয়ার্টার চারিদিকে। ন'টা বেজে গেলে রান্নাঘর থেকে মা বলতেন, "এ্যাই, বই গুছিয়ে রেডি হয়ে নে।" ভাইবোনেরা চটপট স্নান করে রেডি হয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ছবির মত আবর্জনাহীন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে চলে যেত। বনানী তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। শাড়ি পরে লম্বা বিনুনি পিঠে ফেলে বাস ধরত দিদি বনানী। সাকুল্যে দুটো বাস শিলিগুড়ি পর্যন্ত রোজ যাতায়াত করে। বাস ভর্তি হয়ে গেলে প্রায় দিনই সময়ের আগে বাস ছুটে যায়। সেদিন বাড়িতে বসে লেখা পড়া করে, নোটস্ লেখে বনানী। 

"বুঝলে গিন্নি, আর কয়মাস বাদে বেতন আদ্ধেক হয়ে যাবে। তোমার কষ্ট হবে সংসার চালাতে।" বাবার গলা শোনা যাচ্ছে। বাবার আজ তবে ইভনিং শিফট ডিউটি। "ও নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। বনি ততদিনে কিছু একটা চাকরি পেয়েই যাবে।" মায়ের কথায় গভীর আশ্বাস শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল বনানী।"  আরে তুই কলেজ যাস নি?" বাবার প্রশ্ন শুনে বনানী বলল, "বাবা, ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে যে। এখন স্টাডি লিভ চলছে।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা বললেন, "আমার মামনি, তুই এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছিস ভাবলে আমার গর্ব হয় রে।" 

ডুয়ার্স অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু দোমোহনি। এখানকার চায়ের এককালে খুব সুনাম ছিল। চা-ব‍্যবসা বাড়ার সাথে সাথে দোমোহনির রেল যোগাযোগের গুরুত্ব বাড়ে। ব্রিটিশরা সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছিল দোমোহনি শহরকে। বনানীর বাবা কর্মস্থল থেকে ফিরে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কথা বলেন মাকে। "পল সাহেব স্কুলের চারপাশে অনেক ফুল-ফলের গাছ লাগিয়েছেন। বিকেলে গিয়ে দেখে এসো তোমরা।" মা এবং মায়ের বন্ধুদের সাথে গিয়ে দেখতো আর গর্বে মন ভরে উঠতো। পল হোয়েল সাহেব তৈরি করেন এখানকার সবচেয়ে বড় স্কুল। চারপাশের ছাত্রছাত্রীরা এসে এই স্কুলে পড়াশোনা করেছে।    


সমৃদ্ধিশালী শহর দোমোহনি। তিস্তা নদীর পূর্বপাড়ে জমজমাট শহর। পাহাড় থেকে নেমে আসা জলের ঢল নিয়ে স্ফীত তিস্তা একটু একটু করে প্লাবিত করতে লাগল দোমোহনির পথঘাট। অবশেষে দোমোহনির যাবতীয় দুঃখের কারণ হয়ে উঠেছিল তিস্তা। পাহাড়ি নদী বারবার গতিপথ পরিবর্তন করে দোমোহনির রূপরেখা পাল্টে দিতে থাকে। মানুষের মনে দুঃখ জাগতে থাকে তিস্তাকে নিয়ে। বনানীর মন খারাপ হয়েছিল যেদিন বাবা ক্লাব থেকে ফিরে বলেছিলেন, "অনেকেই দোমোহনি ছেড়ে বাড়ি তৈরি করে চলে যাচ্ছে ময়নাগুড়ি আর জলপাইগুড়ির দিকে।" চিন্তিত মুখে বনানীর মা বললেন, "তোমার চাকরি এখানে। বললেই তো আর চলে যাওয়া যাবেনা। তাছাড়া মেজোছেলের ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে।" ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব‍্যস্ত দুজন অভিভাবকের অনুভূতি ছুঁয়ে যায় বনানীকে। "একটু জমির সন্ধান করলে আমরাও অন‍্যরকম করে ভাবতে পারি" মার কথায় আশার আলো। কথাটার পেছনে যুক্তি আছে অবশ্যই। গেল মাসে জলপাইগুড়ির মাসকালাই বাড়িতে জমির খবর পেয়েছিলেন বনানীর বাবা। আর দেরি করা ঠিক হবেনা। কাল সকালে এই ব‍্যাপারে কথা বলবেন সম্ভব হলে বায়নামা সেরে রাখবেন। নেবেন। একটি বাড়ির স্বপ্ন অনেকদিন ধরে লালন করছেন তিনিও।

তিস্তার জল শুধু বর্ষায় মারমুখী হয়ে ফুঁসে উঠত। অথচ সেবার পুজোর আগে রাতের অন্ধকারে বাঁধ ভেঙে তিস্তা হুড়মুড়িয়ে আছড়ে পড়ে দোমোহনির বুকে। প্রবল জলস্রোতে হারিয়ে গেছে কত প্রিয়জন, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু। এত মৃত্যুর করাল গ্রাস সহজে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। বীভৎস কালো রাতের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে গেলেন অনেকেই। পল হোয়েল স্কুল তিস্তার বুকে দাঁড়িয়ে রইল অসহায় অবস্থায়। তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন হল সাথে পাল্টে গেল দোমহনি জনপদ। ক্রমশ প্রাণবন্ত রেলশহরটির স্পন্দন ক্ষীণ হতে লাগল। 

মুখার্জিবাবুর বাড়িতে সন্ধেবেলা রেডিওতে সংবাদ শুনতে আসতেন অফিসার্স কলোনীর পরিচিত জন। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের জন্য বৃষ্টির পূর্বাভাস জানিয়েছিল। আশ্বিন-কার্তিক মাসের বৃষ্টিতে বর্ষার প্রবল প্রকোপ থাকে না বললেই চলে। 

তাই বৃষ্টির খবর পেয়েও কেউ তেমন শঙ্কিত হননি। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে পাহাড়ি জলের ঢল নেমে এসে বাঁধ ভেঙে তিস্তার জল ঢুকে পড়ে দোমহানি শহরে। জলের শব্দে মিশে যাচ্ছিল মেঘের গর্জন। মুহূর্তে বানভাসি চরাচর। পল হোয়েল সাহেব বেরিয়ে এসে জলের তোড় দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তারপর বন্দুক হাতে নিয়ে তিস্তার জলস্রোত লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি ছুঁড়লেন। রাগে কাঁপছিল তার শরীর। চেঁচিয়ে বলছিলেন, গো ব্যাক। ডোন্ট স্পয়েল মাই স্কুল।" সে এক ভয়ানক পরিবেশ। ততক্ষণে রেল কোয়ার্টারে জল ঢুকে গেছে। রেললাইনের ওপর দিয়ে তিস্তার জল বইছে। সেই রাতেই বনানীর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার বন্দ্যোবস্ত করার কোন উপায় ছিল না। চারিদিকে জল আর জল। অসহায় অবস্থায় বনানী দৌড়ে গিয়ে পাশের কোয়ার্টারে দত্তকাকুকে খবর দিয়ে এসেছিল। শহরে দুজন হাতযশ থাকা ডাক্তার রয়েছেন কিন্তু খবর দেবার কোন উপায় ছিল না। গভীর রাতে এক ভয়ংকর পরিবেশে সকলকে কাঁদিয়ে বনানীর বাবা, সকলের প্রিয় মুখার্জিবাবু মারা গেলেন। 

           

প্রতিবছর তিস্তা ভয়ংকরী হয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিন্তু এবার সেই তিস্তাই ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে গেছে ডুয়ার্সের প্রাণকেন্দ্রটিকে। তিনদিন পর জল নেমে গেছিল। ততদিনে বেশিরভাগ প্রতিবেশীরা পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যত্র বাড়ি তৈরি করে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। এদিকে নিয়ম মেনে কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হবে ভেবে বনানীর চোখে ঘুম আসেনা। মা এবং ছোটভাই-বোনের সাথে কথা বলে স্থির হল দুমাস আগে বাবার কেনা জমিতে ঘর বানিয়ে দোমহনি থেকে চলে যাবে ওরা। জলপাইগুড়ি আসাযাওয়ার সেই দুটি ট্রেন আর বাস ভরসা। সব ট্রেন দোমহনি রুটে আসেনা। যখন যেমন সুবিধা হয় তেমনি গিয়ে সারাদিন বাড়ির কাজ দেখাশোনা করতে যেতে হত বনানীকে। সাতসকালে উঠে টিফিন কৌটো রেডি করে দিত মা। বিজু সেবছর পলিটেকনিক পড়ছে জলপাইগুড়িতে। পড়ার চাপ কম থাকায় দিদির সাথে চলে আসতে জোজো। কষ্ট মনেই হয়নি অথচ ভেবে ভেবে কষ্ট হত মায়ের। 


জোজো এখনও মনে রেখেছে বাড়ি তৈরির সেই কষ্টের দিনগুলোকে। সকাল হতেই ট্রেনে বা বাসে করে ভাইবোন মিলে চলে আসত জলপাইগুড়ি। টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরবেলার জন্য নিয়ে আসা খাবারের ভালো পদ দিদি বনানী যত্ন করে দিয়ে দিত ছোটভাই জোজোকে। প্রয়োজন পড়লে পাশের বাড়ির মাসিমাদের বাড়ির টয়লেট ব্যবহার করত বনানী। মিস্ত্রিদের কাজ দেখভাল না করলে ফাঁকি দেবে। বয়সে ছোট হলেও জোজো বেশ বুদ্ধিমান। মিস্ত্রিদের অপেক্ষায় সময় নষ্ট না করে কোন কোন সময় এটা সেটা কাজ সাধ্যমত এগিয়ে রাখে সে। দোমোহনি যাবার শেষ বাস ছিল সাড়ে চারটে নাগাদ। নিত্য সহযাত্রীরা ড্রাইভারকে বলে কয়ে বনানীদেরকে গলির মুখে বাস দাঁড় করিয়ে ওদেরকে তুলে নিতেন। সেসব দিন মনের পর্দায় চিরসবুজ হয়ে আছে। 


রোদে-জলে তেতে-পুড়ে তিন চার মাসের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল দুটো রুমের একটি ঘর। বনানী যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সবকিছু। জিনিসপত্র নিয়ে আসা ঝক্কির কাজ ছিল সেসময়। দোমোহনির কোয়ার্টার ছেড়ে আসার দিন দুমড়ে মুচরে গেছিল বুকের ভেতর। শুধু বনানীর নয়, বাড়ির সবারই। দীর্ঘ কয়েক বছরের স্মৃতি বিজড়িত এই কোয়ার্টার, ফল-ফুলের বাগান। খুব শখ করে বাবা এনে লাগিয়েছিলেন নানারঙের গোলাপ। আম-কাঁঠালের গাছ। আজ সব ছেড়ে যেতে স্বাভাবিক ভাবেই মন খারাপের আবহ তৈরি হয়েছে। বিধ্বস্ত স্কুলটিকে দেখে চোখের জল বাধা মানে না। জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকবে এই স্কুল। অথচ আজ থেকে দূরত্ব তৈরি হবে স্কুলের সাথে। পরিচিত আপনজনেরা বেশিরভাগ চলে গেছেন অন্য শহরে। বাকিরাও যাবার দিন গুনছেন। বিদায় কথাটার মধ্যে বিষাদ জড়িয়ে থাকে এমনিতেই। সবাই এসে দেখা করে গেছেন, আন্তরিকতায় ভরিয়ে দিয়েছেন মনপ্রাণ। বাবার বাঁধানো ফটোখানা হাতে করে বেরিয়ে আসার সময় মা যখন কোয়ার্টারের সামনে গড় করে প্রণাম করছিলেন, চারপাশ থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ পরিবেশকে ভারী করে তুলেছিল। চোখের জল অবাধ‍্য হয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে বনানীর চিবুক। 


থমাস স্যারের প্রিয়পাত্র জোজো তখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। চলে আসার সময় একটি মাউথ অর্গান উপহার দিয়েছিলেন জোজোকে। জলপাইগুড়ি বাড়িতে একটু রাত হলে মাউথ অর্গান বাজাত সে। এত দুঃখের মাঝে একঝলক সুখের রুপোলি রেখা দোমোহনির স্মৃতি ভেসে বেড়াতে সারা বাড়িতে। থমাস স্যারের ছলছল চোখ অনেকদিন ভুলতে পারেনি জোজো। বনানীও কি ভুলতে পেরেছিল থমাস স্যারকে? হোয়েল সাহেবের গাড়ি করে বনানীদেরকে জলপাইগুড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন থমাস স্যার। তিনি সময় পেলে মাঝে মাঝেই চলে আসতেন জলপাইগুড়িতে। সুন্দর দোমোহনি শহরটির ভগ্নদশার গল্প শুনতে শুনতে মন খারাপ হত বাড়ির সবার। থমাস স্যার খুব সুন্দর বাংলা বলতেন, রবীন্দ্রসংগীতের সুর তুলতেন মাউথ অর্গানে।


সুখে দুঃখে দিন কেটে যাচ্ছিল বেশ। বিজু, বনি দুজনেই সরকারি চাকরি পেয়েছে। সিধু ব্যবসা করবে বলে আগেই জানিয়ে রেখেছিল দিদিকে। এখন শুধু জোজোর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত। প্রাইভেট স্কুলের চাকরিতে বনানীর ভীষণ ব্যস্ততা। পাড়ায় সুনাম রয়েছে বনানীর। পাশের বাড়ির মাসিমার সম্পর্কিত এক ভাসুরপো পরিবার নিয়ে গুয়াহাটি থেকে ঘুরতে এসেছিল এখানে। বনানীকে দেখে ভীষণ পছন্দ হল ওদের। ছোটভায়ের জন্য বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে ফিরলেন তারা। পনের দিনের মধ্যে বনানীর ঠিকানা হয়ে গেল আসাম রাজ্যে। বিয়ে-থা হয়ে বনানী এখন ষাটোর্ধ মহিলা। আসাম টাইপের দুই রুমের ঘর এখন অতীতের গর্ভে। জলপাইগুড়ির সেই বাড়ি সেজে উঠেছে এখন ফ্ল্যাট হয়ে। তবু জলপাইগুড়ি বনানীর নস্টালজিয়া। মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে গেলে জোজোকে একান্তে জানিয়েছিলেন দোমোহনি দেখে আসার প্রবল ইচ্ছেটুকু। দিদিকে একা যেতে দেয়নি জোজো। দল বেঁধে বাড়ির অন্যান্য সবাই বহুশ্রুত দোমোহনির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেল। 


রেলস্টেশনে পাকা বেঞ্চে একা বসে আছেন বনানী। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে স্টেশনের গায়ে। তবুও কোথায় যেন হারানো শোক লেপ্টে আছে একসময়ের সমৃদ্ধিশালী জনপদ দোমোহনির সারা শরীর জুড়ে। তিস্তার পরিবর্তিত গতিপথ দোমোহনির গর্বকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বনানীর সর্বশরীর জুড়ে দোমোহনির বাস। সময়ের সাধ্য কি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার! "ঠামি, ঠামি, এই ভিলেজে তোমরা স্কুলিং করেছ? ও মাই গড। চারপাশে প্যাডি ফিল্ড, রিভার এত কাছে। তোমাদের ভয় করত না? ওপেন ভারান্ডা। গেট নেই, বাউন্ডারি ওয়াল নেই। তোমরা পালাতে না?"  একঝাঁক প্রশ্নের তীর ছুটে এল। বনানী সেই মুহুর্তে নীরবতা বেছে নিয়েছেন। হতগৌরব পুনর্নবীকরণের মন্ত্র জানা নেই বনানীর। সহস্র ঘটনা ভিড় করে আসছে মনে। 


সন্ধ্যা নামছে একটু একটু করে। ফিরে যাবে বনানী সব মায়াবন্ধন ছেড়ে। থমাস স্যারের সমাধির কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। জোজো শুনতে পাচ্ছে বিরহী আত্মার ক্রন্দন ধ্বনি।  থমাস স্যার আর দিদির কত চিঠি আদানপ্রদানের সাক্ষী জোজো। অথচ বিয়ের কথায় দিদি পিছিয়ে গেল। থমাস স্যারের আত্মহত্যার ঘটনা কাকতালীয় নয় একথা জোজো ভালো করে জানে। পাথরচাপা হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট উঠে এল চোখের পাতায়। 


এভাবেই হৃদয়ের অন্দরে গভীর ক্ষত নিয়ে মানুষ লিখে রাখে যাযাবর জীবনের দিনলিপি।।





উপলব্ধি


দী প্তি  ন ন্দ ন


শ্রাবণ শেষ হয়ে ভাদ্র মাস এসে গেছে তবুও বৃষ্টি বাদল কমার নামগন্ধ নেই। চারিদিকে স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে আবহাওয়া।নিবারণ সামন্তর মনটাও যেন চারিপাশের বিষন্ন আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কদিন ধরে বিষন্ন হয়ে আছে। আজ ভোর বেলায় ঘুম ভাঙতেই কদিন একটানা বৃষ্টির পর ঝলমলে রোদ উঠেছে দেখে নিবারণ বাবুর মনটা খুশি হয়ে উঠলো। বেশ প্রফুল্ল মনে হাতমুখ ধুতে গেলেন তিনি। সেখান থেকে ফিরে এসে সবে ভাবছিলেন গতকালের অর্ধ সমাপ্ত গল্পটা এইবলা শেষ করে ফেললেই বোধহয় বেশ ভালো হয় এই  সাত সকালের নিরিবিলিতে।যেমন ভাবা তেমনি কাজ! সঙ্গে সঙ্গে মালতীর আনা চায়ের তোয়াক্কা না করে সবেমাত্র সব সরঞ্জাম গুছিয়ে টেবিলে বসতে যাবেন ঠিক সেইসময়ই শুরু হয়ে গেল উপরের ঘর থেকে বধূমাতা নবনীতার ইলেকট্রিক গীটারের টুংটাং শব্দের মূর্ছনা। এই সাতসকালেই তিনি তাঁর যন্ত্র সঙ্গীতের সাধনা শুরু করে দিয়েছেন! প্রচন্ড বিরক্তিতে কপালে গোটা কতক ভাঁজ পড়ল তাঁর। এতো সত্যিই সহ্যের সীমা পেরিয়ে যেতে চলেছে! গত কয়েকদিন ধরে এই বস্তুটির একঘেয়ে শব্দ শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত, তিতিবিরক্ত! ---নাঃ, এভাবে চললে এখানে এখন থাকা অসম্ভব! প্রচন্ড বিরক্তির সঙ্গে স্বগতোক্তি করে উপরে উঠলেন নিবারণ বাবু, ছেলে দীপঙ্করের খোঁজে।


---দীপু কোথায় রে?

তখনি বন্ধ ঘর থেকে বাজনার টুংটাং শব্দ থেমে যায়। একটু পরেই দরজায় দীপঙ্করের মুখটা উঁকি মারে।

----কি বলছ, বাবা?

----বলছি কি, কতদিন তোর দিদিকে দেখিনি। ওখানে গিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসি।

----তা বেশ তো। কিন্তু এখন পুজোর মাস। আর তো বেশি দেরিও নেই পুজোর। এখনই যাবে?

---হ্যাঁ, এই সময়েই যাব। তুই আমার জন্য একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দে তোদের অফিসের কোটা থেকে। আর পুজোর তো এখনো কিছুটা দেরি রয়েছে। আমি ঠিক পুজোর সময়ে চলে আসব'খন।


দীপু চুপ করে যায়। সে বুঝতে পারে তার বাবা যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন তাঁর বৌমাটির 

এই ছেলেমানুষি কাণ্ডতে, কিন্তু কিছুই বলার নেই তার। তার তো উভয় সংকট, একদিকে বাবা অন্যদিকে বৌ! সে কোনদিকে যাবে ভেবে না পেয়ে অফিসের জন্য তৈরি হতে স্নানঘরে ঢুকে  পড়ে কাজের মাসি মালতীকে বাড়তি জোরে একটা হাঁক দিয়ে।তাকে আজ তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে!

---ও মাসি, ভাত বাড়োগো।

---আচ্ছা দাদাবাবু।

অভ্যেস মতো সে সাড়া দ্যায় ঠিকই, কিন্তু মনে মনে মালতী খুব চমকে যায়। এইতো সবে চায়ের পাট শেষ করে ভাত চাপাল সে!এখন কি করে ভাত দেবে! উপায় না দেখে পাশের ওভেনে একটু মুগডাল চাপিয়ে ভাবতে লাগলো, এরপর কি করবে সে! কোন  জাদুবলে এই ঝামেলা সামাল দেবে সে! একি অনাসৃষ্টি কাণ্ড রে বাবা! আর এদিকে নিবারণ বাবু নীচে নেমে এসে তাঁর  দরকারি জিনিসপত্রগুলো গোছাতে থাকেন। আজ কালের মধ্যে তাঁকে এখান থেকে চলে যেতেই হবে। এখনও এখানে থাকলে তাঁর কোনো লেখাই আর শেষ হবেনা।

তিনি একজন মোটামুটি নামকরা সাহিত্যিক। তাঁর লেখা বিভিন্ন স্বাদের গল্পগুলো পাঠকদের খুবই পছন্দের। তাই ঠিক এই পুজোর মরশুমে তাঁর অনেকগুলো লেখার ফরমাশ এসেছে। বেশ কিছু শারদীয়া পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে ঘনঘন তাগাদা আসছে। অল্প কদিনের মধ্যেই তাঁকে লেখাগুলো শেষ করতে হবে আর এদিকে হঠাৎ করে  ঠিক এই সময়েই তাঁর বৌমা নবনীতা তার নতুন কেনা ইলেকট্রিক গীটারে কিছু গানের সুর তুলতে ব্যস্ত হয়ে থাকছে সারাক্ষণ। সে নাকি এবার পুজোয় পাড়ার ক্লাব থেকে পুজো মণ্ডপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাজানোর আমন্ত্রণ পেয়েছে। তাই এখন উঠে পড়ে লেগেছে কিছু গান তুলে রাখতে। নতুন শিক্ষার্থী সে, তাই উৎসাহটা খুবই বেশি। 

যদিও সে ঘরের দরজা বন্ধ করেই বাজনা প্র্যাক্টিস করে তবুও সেটুকু শব্দতেও নিবারণ বাবুর মনোসংযোগ ব্যাহত হয়। নতুন কোনো গল্পের প্লট তাঁর মাথায় আসতেও পারছেনা এই লাগাতার  বাজনার শব্দে। কিছু বলতেও পারেন না। ছেলেমানুষ, কি আর বলবেন। তাই মনে মনে ঠিক করেছেন মেয়ে বৈশালীর কাছে গিয়ে এখন কিছুদিন থাকবেন।জামাই শ্রীকান্তর বাড়িটা বেশ নিরিবিলি। ওখানে গেলে তিনি নিশ্চিন্তে সব লেখাগুলো লিখতে পারবেন বলেই তাঁর স্থির বিশ্বাস।

সন্ধ্যেয় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দীপু জানালো তার এজেন্ট ভুল করে আগামী কাল সকালের বদলে আজ রাতের টিকিট কেটে ফেলেছে। আর এখন তো বুকিং কাউন্টার বন্ধও  হয়ে গেছে, তাই কাল সকালের আগে কিছু করা যাবেনা।

নিবারণ বাবু বললেন,--- কোনো আপত্তি নেই, আজ রাতেই যাব।আমার গোছগাছ সব হয়ে গেছে।

 দীপু প্রথমে একটু আপত্তি করছিল।

--এই রাতে যাওয়ার কি দরকার! আমি কালকের টিকিট কিনে দেবখন।

কিন্তু নিবারণ বাবুর প্রবল অসম্মতির মাথা নাড়া দেখার পর সে বাধ্য হলো রাজি হতে। কারণ সে বুঝতে পারছিল তার বাবার অসুবিধেটা। তাই রাতের গাড়িতেই তিনি বৈশালীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট আসনে বসার পরেই খেয়াল হলো কামরাটা বেশ ফাঁকা। মাত্র অল্প কয়েকজন যাত্রী বসে। তিনি যাবেন একটু দূরে। অন্তত ঘন্টা তিনেক লাগবে পৌঁছতে। যাকগে একা নিরিবিলিতে বসে নতুন গল্পের প্লট ভাবা যাবে'খন এই সময়টায়।মনে মনে ভাবছিলেন তিনি। ঠিক এমন সময়ে কোনো একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই টাকমাথা, বেশ গোলগাল এক ভদ্রলোক কামরায় উঠে এত জায়গা থাকতেও ঠিক তাঁর সামনের সীটে এসে বসেই একগাল হেসে বললেন,--- দাদার কি অমুক স্টেশন নাকি?

---হ্যাঁ। আপনি?

---হুঁ, হুঁ বাবা, ঠিক ধরেছি। হ্যাঁ আমিও তাই। তাইতো এখানে এসে বসলুম। বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। একটা দেঁতো হাসি হেসে নিবারণ সামন্ত বললেন,--- তা বেশ, বেশ।

আর মনে মনে বললেন এ তো আচ্ছা আপদ জুটল দেখছি!কোথায় একটু নিরিবিলিতে বসে গল্পের প্লট ভাবব, তা নয় এ উটকো ঝামেলার হাত থেকে এখন রেহাই পাই কি করে!

ততক্ষণে সামনের সীট থেকে বাক্যের গোলা দাগা শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর ঠিকুজি কুষ্টির সবটা এখনই এই নতুন সহযাত্রীটিকে মহা উৎসাহে শোনাতে বসেছেন! কথা নয়তো যেন কামানের গোলা! সেগুলি একের পরে এক দেগে চললেন।

---আসুন দাদা পরিচয় করে নিই। অনেকক্ষণ একসঙ্গে থাকব তো, তাই আলাপ পরিচয় থাকা জরুরি। আমি বনমালী ভট্ট।

পানের ব্যাবসা করি। কলকাতার জগুবাজারে  আমার দোকান আছে। গ্রামে আমার কয়েকটা পান বরজ রয়েছে। এছাড়াও সেখানে আমার বেশকিছু জমিজমা আছে। চাষবাস করা হয়। ভাইরা সব চাষের কাজ  দেখাশোনা করে। আমি কাঁচামাল আনতে মাঝে মাঝে  দেশের বাড়িতে  যাই। এই এখন যেমন চলেছি। এখানে থাকি একটা মেসে। এইরকম একটানা বকবকানি চলতেই লাগলো। 

সামনের সীটে বসে  নিবারণ সামন্ত বিরক্তি চেপে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। নেহাৎ অভদ্রতা হবে ভেবে কানে হাত চাপাটা আর দ্যাননি। সামনে বসে পা দোলাতে দোলাতে নিজের মনেই আত্মকথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছিলেন বনমালী।

---কি মশাই শুনলেন তো সব! কিছু বললেন না যে! আমার আবার চুপ করে থাকতে একদম ভালো লাগে না, বুঝলেন?

---- হ্যাঁ, শুনেছি সব। আচ্ছা আপনি তো এই লাইনে যাতায়াত করেন, বলুন তো সামনের স্টেশনে কি ট্রেনটা থামবে?

---হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই এখনই একটা স্টপেজ রয়েছে তো। কেন, নামবেন নাকি? কোনো জরুরি দরকার?

--হ্যাঁ, জরুরি বলে জরুরি! হঠাৎ আমার একটা খুব জরুরি কাজ মনে পড়ে গেছে। আমাকে এখনই ফিরে যেতে হবে বাড়িতে।

--সে কি? কেন দরকারি কিছু ফেলে এসেছেন নাকি?

---হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন! আচ্ছা  এবার আমার পরিচয়টা দিই। আমি একজন লেখক, গল্প লিখি। নানান স্বাদের গল্প। এখনই একটা নতুন প্লট পেয়েছি তাই এখনই আমাকে বাড়ি ফিরতেই হবে এই রাতের শেষ ফিরতি ট্রেনেই। আমাকে এই নতুন পাওয়া একদম ভিন্ন স্বাদের গল্পটা লিখে ফেলতে হবে টাটকা থাকতে থাকতেই। আচ্ছা চলি, নমস্কার।


শান্ত শিষ্ট মানুষটির হঠাৎ এই ফিরে যাওয়ার চঞ্চলতা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যাওয়া বনমালীর  গোলাকার  চক্ষুদ্বয়কে আরও গোলাকার বানিয়ে নিবারণ নেমে পড়লেন একলাফে, ট্রেনটা থামতেই! এর চেয়ে তাঁর বধূমাতার বন্ধ ঘরের মৃদু টুংটাং বাজনার শব্দ যে যথেষ্টই শ্রুতিমধুর এখন এতে আর কোনো সন্দেহ নেই তাঁর! তাই ঝোঁকের মাথায় মেয়ের বাড়ির অচেনা পরিবেশে যেতে আর ভরসা পাচ্ছেন না এখন তিনি। কে জানে, সেখানে এখন কি অবস্থা হয়ে রয়েছে! এর চেয়ে তাঁর চেনা ঘরটাই ভালো বলে মনে হলো তাঁর! তিনি  হন্তদন্ত হয়ে দৌড়লেন অন্য প্ল্যাটফর্মের দিকে ফিরতি ট্রেনটার উদ্দেশ্যে!





ডাইরি


অ ন সূ য়া  পা ঠ ক


স্টেশনের ভিড় পেরিয়ে আবীর ট্রেনের ভেতরে নিজের সিটে গিয়ে বসে। সিটের নীচে নিজের ব্যাগটা রাখতে গিয়ে সে একটা গোলাপি রঙের ডাইরি দেখতে পায়। ডাইরিটা তুলে সে একমনে তাকিয়ে থাকে। হাল্কা গোলাপি তার ফ্রন্ট কভারে একগুচ্ছ রঙ বেরঙের ফুল ও একটি নীল প্রজাপতির ছবি। এটা দেখেই তার মনে হয় যে ডাইরির অধিকারিণী কোন একজন মেয়ে। অজানা কারো এই ডাইরিটা তার খোলা ঠিক হবে কি না এটা ভাবতেই ভাবতেই সে খুলে ফেলে। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে। ডাইরির প্রথম পাতায় একটা ময়ুর পালক ও কালী পূজোয় হাজার টাকা চা়দা দেওয়া একটা রসিদ। এটা দেখে আবীরের মনে হয় মেয়েটি অত্যন্ত ভক্তিমতি। পরের পাতা ওল্টালে সে দেখে লাল কালিতে স্পষ্ট লেখা "অরুনিমা"। পরের পাতায় ওপরে একটা হেডিং জ্বল জ্বল করছে , প্রথম প্রেম । আবীরের ডাইরি পড়ার আকর্ষণ বেড়ে যায়।  


         " ডিয়ার ডাইরি 

আজকে একটা টপ সিক্রেট তোমার সাথে শেয়ার করতে চলেছি, দশ বছর আগের কথা- আমার বাবা স্টেট ব্যাংকে চাকরী করেন এবং একবার তাঁর বদলি হয় মল্লরাজবংশের স্মৃতি বিজড়িত মন্দির নগরী বিষ্ণুপুরে। আমরা সবাই তখন ওখানে শিফট করে যাই। কারন বাবাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই পারি না। ওখানকার একটা স্কুলে আমি ভর্তি হই। স্কুলের প্রথম দিন আমার দেখা হয় একটি ছেলের সাথে। কে জানে কেনো নব্বই জনের ক্লাশের মধ্যে ওকে এমন লাগছিলো যেনো রাতের আকাশের চাঁদ। ইচ্ছে করছিলো যে ওর কাছে গিয়ে ওর নাম জানতে চাই। কিন্তু পারিনি। পরে ওর নাম জানতে পেরেছিলাম, যখন বিনয় বাবু ওকে ডাস্টার আনতে স্টাফরুমে পাঠিয়েছিলেন। পড়াশোনায় ভালো নম্র মেধাবী, দেখতেও সুন্দর, মনে হতো ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে পারলে বেশ হয়। কিন্তু ভাবাটা যতো সহজ কাজে পরিনত করাটা ততটাই কঠিন। ক্লাশে নানান জিনিস নিয়ে দু একটা কথা হতো। তারপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ, বিশ্বকবির জন্মদিবস উদযাপন। অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রতি ক্লাসের গান আবৃত্তি জানা ছেলে মেয়েদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকের জন্য ও কিছু ছাত্র ছাত্রী স্যাররা নিচ্ছিলেন। আমাদের ক্লাস থেকে আমি আর ও দুজনেই সুযোগ পেয়েছিলাম।  কে কে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে সেই লিস্ট ঠিক করার সময় গানে ওর নাম দেখে আমি বলেছিলাম, বারে তুই গান ও জানিস? ও বলেছিলো তুই যদি বক্তব্য রাখতে পারিস তাহলে আমি কেনো পারবো না গান গাইতে। আমি বলেছিলাম, নারে এমনই জিজ্ঞেস করছিলাম। তারপর ও বললো, আচ্ছা তোর পছন্দের রবীন্দ্র সংগীত কোনটা? একটু অবাক হয়ে বলেছিলাম, ওগো বিদেশিনী। কো ইনসিডেন্ট কিনা জানি না, তবে রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিন ও স্টেজে বলেছিলো যে রবীন্দ্রনাথের সব গানই তার প্রিয় তবে যে গানটি তার মনকে বারেবারে নাড়া দেয় তা হল, ওগো বিদেশিনী। ওর গলায় গানটা অপুর্ব সুন্দর লাগছিলো। 


তারপর ক্লাশে মাঝে মাঝে নানান বিষয় নিয়ে কথা হতো। এরপর বার্ষিক পরীক্ষায় আমি টপার হয়েছিলাম আর ও হয়েছিল সেকেন্ড। রেজাল্ট আউটের দিন আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে ও বলেছিল, কনগ্রাচুলেশন টপার, নেক্সট টাইম আরও ভালো করতে হবে। কিছুদিন পর আমি শম্ভু স্যারের কাছে বাংলা টিউশনিতে ভর্তি হলাম। স্যার বিকেল পাঁচটায় আমাদের ব্যাচটা শুরু করতেন। আর ওই বিল্ডিংয়ের অপোজিটে ও রমেশ বাবুর কাছে কেমিস্ট্রি পড়তে আসতো। আমি যে কলোনীতে থাকতাম সেখান থেকে আর কেউ শম্ভু স্যারের কাছে পড়তে যেতো না। আর শীতের সন্ধ্যা মানে টিউশনি শেষ হতে না হতেই অন্ধকার নেমে আসতো। যদিও ওর টিউশনি সাড়ে পাঁচটায় শেষ হয়ে যেতো কিন্তু প্রতিদিন আমার জন্য ও ছটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার বাড়ির কাছাকাছি  যে ওর বাড়ি তাও কিন্তু ছিলো না। তবুও ও কিছু না কিছু বাহানায় আমাকে টিউশনির সপ্তাহে তিনটা দিন বাড়ির গেট অবধি পৌঁছে দিতো। বর্ষায় আবহাওয়া খারাপ হলে বা ঝমঝম বৃষ্টি পড়লে আমার বারণ করা সত্ত্বেও ও আমাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতো। একবার আমি ও মা মামাবাড়ি যাবো বলে বাস স্ট্যান্ড এ দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় দেখি আমার পাশে ও দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুই এখানে? ও বললো ওর এক বন্ধুর দাদার বিয়ে, সেখানে যাবে বলে বাস ধরতে এসেছে। আমাকে ওর সাথে কথা বলতে দেখে মা বলে একে চিনিস নাকি তুই? আমি বলি হ্যাঁ, আমরা এক ক্লাশে পড়ি। ও মাকে প্রণাম করে। ও প্রণাম করতেই মা খুশিতে গদগদ হয়ে আমার দিকে তাকায়। ভাবখানা এরকম যেনো, দেখে শিখ, কেননা প্রণামটা আমার হয়ে ওঠে না। মা ওকে জিজ্ঞেস করে তোমার বন্ধুর দাদার বিয়ে কোথায় হচ্ছে? ও থতমত খেয়ে বলে এতো তো জানিনা কাকীমা, বাস স্ট্যান্ডে বন্ধুর নিতে আসার কথা, তারপর দেখি কোথায় নিয়ে যায়। বাস এলে আমরা সবাই তাতে উঠে পড়ি। বাসে একটা সিট ফাঁকা ও মাকে সেটাতেই বসতে বলে। আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। পরের স্টপেজে দুটো সিট ফাঁকা হলে আমরা সেখানে বসে পড়ি।  এমনিতে আমার বাসের জার্নি একদম পছন্দ নয়। কিন্তু সেদিন কেনো জানিনা মনে হয়েছিলো, এই পথ যদি না শেষ হয়। তারপর পথ একসময় শেষ হতেই আমরা নেমে পড়ি। বাসস্ট্যান্ড এ কাউকে দেখতে না পেয়ে আমার মা বলে তোমার বন্ধু কোথায়? ও বলে সেটাই তো কাকীমা দেখছি না, তবে ঠিক চলে আসবে একটু দেরী হচ্ছে হয়তো। তারপর লালমাটির মেঠো রাস্তা ধরে আমি আর মা মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করি। ওখানে পৌঁছনোর পর হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতেই আধঘণ্টা পেরিয়ে যায়। তারপর আমার ভাই আমাকে বলে চল তোকে আমাদের সব্জী বাড়িটা দেখিয়ে আসি, দেখবি কতরকম সব্জী হয়েছে। সব্জী বাড়ি থেকে বাস স্ট্যান্ড পরিষ্কার দেখা যায়। ওখান থেকে দেখি ও এখনও সেই বাস স্ট্যান্ড এ দাঁড়িয়ে। তারপর বিষ্ণুপুর যাবার একটা বাস আসতেই ও উঠে পড়ে। আমার তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে ও আমার জন্যই এসেছিলো। আমি শুধু একটু মুচকি হাসি।


 প্রায়ই ফ্রি পিরিয়ড থাকলে ও আমাদের সবাইকে গান শোনাতো। খুব ভালো গিটার ও বাজাতে পারতো। আমার জন্মদিনে ও আমাকে একটা কালো রঙের ফাউন্টেন পেন গিফট করেছিলো যার উপর সাদা কালিতে একটা ইংরেজি এ অক্ষর ছিলো। কেননা ও জানতো পেন কালেকশনে আমার দুর্দান্ত নেশা। আর ওর জন্মদিনে আমি গিফট করেছিলাম একটা নীল রঙের মাউথ অর্গান। বলেছিলাম তোর মাউথ অর্গান বাজানোর ইচ্ছা পূর্ণ হোক। শুরু কর এটা দিয়ে। কিছুদিন পর বাবার বদলি হয়ে যায় অন্য জায়গায়। 

যেদিন আমরা চেনা বিষ্ণুপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম সেদিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ওকে বলেছিলাম , ভুলে যাসনা যেনো। ও চোখে চোখ রেখে বলেছিল না। কিন্তু তুই মনে রাখবি তো? আমি বলেছিলাম সারাজীবন। 


একবুক ভালো লাগার স্মৃতি নিয়ে আমরা বিষ্ণুপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। তারপর নাম্বার চেঞ্জ মোবাইল হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি সব কারনে আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। ওকে একটা চিঠিও লিখেছিলাম যার উত্তর আজো আসে নি। তবে উত্তর আসুক বা না আসুক আমি জানি, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। কে জানে ও এখন কোথায় কেমন আছে আমাকে মনে রেখেছে কি না"...


আবীর এতক্ষণ ভাবতন্ময় হয়ে পড়ে চলেছিলো মিষ্টি প্রেমের একটা অসমাপ্ত গল্প। এরপর দেখে ডাইরীর বাকি পাতাগুলো ফাঁকা। শুধু শেষ পাতায় মেয়েটির ঠিকানা লেখা আছে। আবীর পরের স্টেশনেই নেমে পড়ে। এবং ডাইরীটা ফিরিয়ে দেবার জন্য অরুনিমার ঠিকানায় পা বাড়ায়।


ডাইরীর সেই ঠিকানা তাকে একটি সাদা রঙের দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড় করায়। গেট খুলে ভেতরে ঢোকে। গোটা বাড়িটা সুন্দর ফুলে সাজানো। একটা মিষ্টি গন্ধ যেনো ভাসছে বাতাসে। একজন মধ্য চল্লিশের মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কে, এখানে কি দরকারে? আবীর তাকে বলে যে অরুনিমাকে ডেকে দিতে, একটা জিনিস দেওয়ার ছিলো। মহিলা সেখান থেকেই হাঁক দেয়, অরুনিমা কোথায় গেলি দেখ কে একজন খু়ঁজছে তোকে। দূর থেকে অরুনিমা বলে কে গো? মহিলা বলে আজকের বিয়ে বাড়িতেও তোদের অনলাইনে অর্ডার আসছে, দেখ ডেলিভারি বয় হবে হয়তো। আবীর একটু মুচকি হাসে, দেখে চারদিকে উৎসব মুখর খুশির পরিবেশ।  এরপর ভেতর থেকে হলুদ রঙের শাড়ি পরে অরুনিমা আসে। অরুনিমা আবীরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, বলুন কিছু বলছেন? আবীর অরুনিমার দিকে ডাইরিটা এগিয়ে দিয়ে বলে, এটা আপনার? অরুনিমা ডাইরিটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ এটা আমারই। আপনি কোথায় পেলেন? এটা তো হারিয়ে গিয়েছিলো, আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো... আবীর বলে ধন্যবাদটা এখন তোলা থাক, তবে নিজের জিনিস সাবধানে রাখবেন এটুকুই। অরুনিমা বলে আসুন ভেতরে, চা বা কফি কি পছন্দ বলুন। আবীর বলে আজ থাক হবে কোনোদিন। এবার আবীর গেটের দিকে পা বাড়ায়। অরুনিমা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার পথে ডাইরির পাতাগুলো দেখতে থাকে, দেখে ও যেখানে লিখেছিলো, আমাকে মনে রেখেছে কিনা..  তার নীচে লাল কালিতে লেখা, হ্যাঁ সব মনে আছে। অরুনিমা অবাক হয়ে গেটের দিকে তাকায়, দেখে আবীর মোরাম বিছানো পথ দিয়ে পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে একটা নীল রঙের মাউথ অর্গান বের করে বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। আবীরের দৃষ্টি সামনের দিকে।





গন্তব্য

 

অ সী ম  পা ঠ ক


ঠিক পাঁচটায় আ্যালার্ম বেজে ওঠে ব্রজমাধবের, আর একদম দেরি করা ঠিক হবেনা, সাড়ে পাঁচটার বাসটা ধরতে না পারলে মুশকিল আছে, সাতটা দশে রূপসী বাংলা ট্রেন ধরে কোলকাতা যেতে হবে। শালডিহা থেকে বাঁকুড়া দেড় ঘন্টার বাস জার্নি শেষ করে ট্রেন ধরার জন্য তার সময় থাকবে মাত্র পনেরো মিনিট। পুরো দিনটাই দৌড়ের উপর। পাঁচ ঘন্টার ট্রেন জার্নি। তারপর কোলকাতার কাজ গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। 


ব্রজ স্টেশনে এসে দেখে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারির সকাল, মেঘলা আকাশ বোধহয় আর কিছু পরেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। মেঘ মল্লার রাগের কথা মনে হলো তার, ব্রজর বাবা কি দরদ দিয়ে গাইতেন। বলতেন মেঘ মল্লার রাগ মানে মনে করতে হবে ঝমঝম বৃষ্টি নয়, এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, চারদিকে বৃষ্টি স্নাত সজীব সবুজ প্রকৃতি, আকাশ কালো করে আছে, আরো বৃষ্টি নামবে। মেঘ মল্লারের আদর্শ সময় এটাই। 


যাইহোক তার ভাবনায় ছেদ পড়ে, রূপসী বাংলা নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে এসে পৌঁছেছে।


উঠেই জানালার পাশে সিট পেয়ে যায় ব্রজ। একি তার সামনে মুখোমুখি বসে তার পছন্দের সিঙ্গার নিশা মুখার্জি। বিবর্তন ব্যান্ডের কোকিলকন্ঠি তন্বী ছিপছিপে সুদর্শনা গায়িকা নিশা।  গত ডিসেম্বরে বিষ্ণুপুর মেলা কভার করতে গিয়েছিলো আনন্দ বাজারের পক্ষ থেকে ব্রজমাধব। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়া শেষ করার পর আনন্দ বাজারে ধারাবাহিক ভাবে গ্রাম বাংলার লৌকিক বিষয়ের উপর লিখে চলেছে সে। হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে সংরক্ষিত করাই তার কাজ। ফেরার পথে ভিড় বাসে দেখাও হয়েছিলো। কিন্তু মনের সংকোচ কাটিয়ে পারেনি পরিচয় করতে। সেবার নিশাকে সিটটা সেই ছেড়েছিলো, তার স্টপেজ আসতে মিনিট দশ বাকি ছিলো। নিশা ছোট্ট করে থ্যাঙ্ক ইউ বলে সিটে বসে পড়েছিলো, প্রায় আড়াই মাসের ব্যাবধানে আবারও সহযাত্রী নিশা। কনকনে শীতের রাতে নিশার সেই মাতাল করা সুর মনে পড়ে ব্রজর, "আমাদের গল্পগুলো অল্প সময় ঘর বাঁধালো, তারপর পথ হারালো তোমায় আমায় নিয়ে"।

দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে সামনের পাঁচ ঘন্টা সময়  নিশার  উষ্ণ সান্নিধ্য পেতে চায় ব্রজ। পরিচয় শুরু করে, হেলো নিশা, আই আ্যাম ব্রজমাধব পাত্র, আর আপনাকে আমি চিনি, আপনি নিশা, বলতে পারেন আমি আপনার গানের গুনমুগ্ধ শ্রোতা। 


রেড টপ আর ফেডেড জিন্সে স্মার্ট নিশা আরো যেনো আ্যাট্রাক্টিভ। হাত বাড়িয়ে বলে, হাই, আমি আর কি বলি আমার কথা সবই তো জানেন। ব্রজ বলে জানি শিল্পী নিশার কথা, আমি আপনাদের প্রোগ্রাম নিয়ে আনন্দ বাজারে লিখেছি, আপনাদের ব্যাতিক্রমী ভাবনা এবং আপনাদের বিবর্তন ব্যান্ডের বিষয়ে। নিশা বলে, ও হো আপনি সেই ব্রজমাধব, কেমন যেনো গুলিয়ে যাচ্ছিলো। আপনার ওই লেখাটা আমি শুনেছিলাম।  আসলে এতো শিল্পী আর হরেক প্রতিভার মাঝে আমাদের কথা বলার লোক যে খুব কম ব্রজ বাবু। ব্রজ বলে এই বাবু টাবু একদম নয়। আর আমরা তুমি দিয়ে কথা বলতে পারি। এবার নিশা বলে আপনার নামটা তো বেশ পুরানো পুরানো, তবে অনেক আদুরে। ব্রজ সীমিত হেসে বলে হ্যাঁ ওই পারিবারিক প্রথা, ঠাকুর দেবতার নাম তো, তবে বলতে পারো অনেকটা ঠিক কানা ছেলের পদ্মলোচন এরকম গোছের, কথাটা বলেই সরি বলে ব্রজ। নিশা বলে ইটস ওকে, নো প্রোবলেম। ব্রজ বলে আর কেউ নেই আপনার সাথে? নিশা বলে না, তবে সমস্যা হবে না। বাঁকুড়া স্টশনে কাকু এসেছিলো আর হাওড়াতে আমার এক দূর সম্পর্কের ভাই আসবে আমাকে নিতে। আর তাছাড়া আমার একা একা পথ চলা অভ্যাস আছে। 


এমন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। নিশা বলে কাঁচের জানালার বাইরের আকাশটা এই সময় কত সুন্দর তাই না। আর এমনিতেও বৃষ্টির মধ্যে ট্রেইন জার্নি বেশ মজাদার। ব্রজ বলে , একদম, তবে রাতের জার্নি আরও সুন্দর। 


এরপর কিছু সময় চুপ থেকে ব্রজ বলে জানো এই সময় পাহাড়ে যদি ঘুরতে তাও সেটাও দারুন। আর দেরাদুন মুসৌরি হলে তো কথাই নেই। ফায়ার প্লেসের সামনে ব্রান্ডি হাতে বসা আর বাইরে এক অপুর্ব সুমিষ্ট গন্ধমাখা নাম না জানা ফুলে ভরা প্রকৃতি। সোনালী রোদ আর মিঠে বাতাস। 

নিশা বলে, তোমার বুঝি পাহাড় পছন্দের? আমার কিন্তু সমুদ্র, কি বিশাল কি সুন্দর। ব্রজ বলে আমার সবই পছন্দের। আমার সবচেয়ে পছন্দ মুহূর্তের প্রেমে পড়া।  অজস্র ভালো লাগার স্বর্নালী মুহূর্ত জীবন জুড়ে, সেগুলোই প্রেরণা। যেবার গোয়া গিয়েছিলাম আরব সাগরের উত্তাল ঢেউ... ব্রজর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে যেনো নিশা বলে, আহা কি দারুণ, আমিও গেছি, গোয়ার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, সামুদ্রিক ভাংড়া মাছ সুজি দিয়ে আর মোটা চালের ভাত সাথে চাটনি আর কাজুর স্পেশাল ড্রিংকস।

ব্রজর চোখ চকচক করে ওঠে, বলে ওঠে একদম, সী বীচের সেই দীর্ঘতম বালি রাস্তা আর বিদেশী ট্যুরিস্টদের অপরূপ সম্ভার একটা সাজানো গোছানো ছিমছাম স্বপ্নের মত শহর। নিশা বলে ওল্ড গোয়াটা আরো বেশী সুন্দর। এমন সময়ে একজন হকার আসে চা নিয়ে, ব্রজ দুটো চা আর বিস্কুট অর্ডার দেয়, নিশাকে ধরিয়ে দিলে থ্যাংকস বললে ব্রজ বলে, এতো থ্যাংকস দিও না , বইতে পারবো না।


এরপর সংক্ষিপ্ত নীরবতা।

নিশা মনে মনে ভাবে আচ্ছা এই ব্রজ ছেলেটা কেমন, কেমন দেখতে? তার গা থেকে কেমন যেনো একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে, ওর চুল গুলো কি কোঁকড়া? চোখ গুলো নিশ্চয়ই খুব সুন্দর?

এমন সময় ব্রজ বলে কি ভাবছো? নিশা মনের অব্যক্ত কথা চেপেই বলে, তেমন কিছু না, ভাবছি এইযে আমাদের প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে তুমি কলম ধরেছো আনন্দ বাজারে , ওটাই। ব্রজ বলে শারিরীক প্রতিবন্ধকতা জয় করে তোমরা অপরাজেয়। তোমার গানে এক সোনালী সময়ের স্বপ্ন দেখি আমি। পৃথিবীর সবটুকু রঙ তোমার মুখে লেগে থাক নিশা। 

নিশা বলে ডাক্তার বলছে একটা সার্জারি করলে আমি আংশিক দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবো, যদি সেটুকুও পাই, তার জন্যই কোলকাতা যাওয়া। ব্রজ বলে আমি যাচ্ছি নন্দন চলচ্চিত্র উৎসব কভার করতে। নিশা বলে শুভেচ্ছা শুভকামনা সবসময়, এরপর  কালো চশমাটা খুলে বলে, জানো ব্রজ কখনও যদি আমি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাই ওই তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে গাইবো, তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে। ব্রজ বলে, দেখো একদিন সব ঠিক হবে। তারপর নিশার চোখে চোখ রেখে বলে, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখে তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য... তুমি জানো নিশা তোমার চুলগুলো খুব সুন্দর। তুমি ব্যাতিক্রমী সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। নিশা বলে এতো জানি না, কখনো তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবে এটুকু শুনি যে এক্সেলেন্ট ওয়ান্ডারফুল, এসব শুনতে শুনতে হাসি পায়। ব্রজ বলে তা যা  বলেছো আসলে আমরা এখন এতো বেশী এক্সেলেন্টে এগিয়ে যাচ্ছি যে সুন্দর কথাটা হারিয়ে যাচ্ছে। নিশা বলে তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো ব্রজ। 

ব্রজ বেশ খুশী হয়ে বলে, ফোলাবে না কিন্তু, তবে নিজের সম্পর্কে ভালো শুনতে কার না ভালো লাগে। একটা মিষ্টি হাসির ঝংকার। জীবন যেনো কতো রঙিন দুজনের কাছেই।

অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ। বৃষ্টিও থেমে গেছে।  একটা খসখস শব্দ শুনছে নিশা। কে জেনো কাগজের উপর কিছু লিখছে, নিশা বলে কিছু কি  লিখছো তুমি ব্রজ? ব্রজ বলে আজ্ঞ না ম্যাডাম, ছবি আঁকছি। তোমার মনে আছে আজ রোজ ডে? নিশা বলে হ্যাঁ, তবে কি হবে মনে রেখে? আমাকে গোলাপ দেবার লোক নেই, আর সবাই শিল্পী নিশাকে চায়, মানুষ নিশার খবর আর কে রাখে? ব্রজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, আমি  মানুষ নিশার খবরই রাখতে চাই। আজ আমার হাতে গোলাপ নেই। এই ট্রেনে আর কোথায় গোলাপ পাবো, তাই ডায়েরীতে একটা গোলাপ আঁকলাম আর হ্যাঁ এটা তোমাকে দিলাম, এই ডাইরীটা রাখো।  নিশা বলে আচ্ছা, আমি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেই এটা দেখবো, আর সেদিন তুমি যেখানেই থেকো ঠিক তোমাকে খবর দেবো, যে আমার ভাবনার গোলাপ আর তোমার আঁকা গোলাপ কতটা এক কতটা মিল তাদের মধ্যে। 


এসে পড়ে জনবহুল হাওড়া স্টেশন। এবার নামতে হবে, মিলিয়ে যাবে জন অরণ্যে। কিন্তু এই ট্রেনে আজ যা পেলো ব্রজ তাকে সে কেমন করে সাজাবে জীবনের আঙিনায়। সুগন্ধি ফুলের নির্যাসটুকু নিয়ে পাড়ি দেবে অজানা ভবিষ্যতে। পড়ে থাকবে মোহময় ভালোবাসার আনন্দঘন এই মুহূর্ত। এই গন্তব্য শেষ, কিন্তু জীবনের গন্তব্য তাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে। অপরদিকে নিশার মনেও দোলা লাগে, এই ভালোবাসার আভাসটুকু ঝরা ফুলের মত বিস্মৃত বেদনায় নিরুদ্দেশের পথে মিলিয়ে যাবে না তো? স্টেশনের বাইরে এসে ব্রজ বলে, আসি আবারো দেখা হবে। নিশা অস্ফুটে যেনো কিছু বলতে গিয়েও পারে না।





শবসিদ্ধ মহাতান্ত্রিক


র থী ন্দ্র না থ  রা য়


আজ থেকে প্রায় দশবারো বছর আগের কথা। শিবু তখন সবেমাত্র বিএ পাশ করেছে। রেজাল্ট আহামরি নয়। বাপের ততো টাকাও নেই। যে টাকা দিয়ে চাকরি কিনবে। আবার বাড়িতেও বসে থাকা যায়না। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি করা যায়? ভাবতে ভাবতে বেশ কয়েকমাস কেটেও গেল। বাড়ি ঢুকলেই মায়ের অমৃতবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। সেজন্য পারতপক্ষে সে বাড়ি ঢোকেনা। এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়। কখনো গঙ্গার ঘাটে, কখনো রেলস্টেশনে সময় কাটায়। খাওয়াদাওয়ার কথাও মনে থাকেনা।


সেদিন গঙ্গার ঘাটে ঘুরছিল। ঘুরতে ঘুরতে ঘাট থেকে বেশ কিছুটা দূরে কাশবনের মধ্যে চলে এসেছে। এদিকটায় সাধারণত লোকজন আসেনা। তাই প্রায় ঘনজঙ্গলের মতো। শিয়ালের উপস্থিতি প্রায়ই নজরে পড়ে। শিবু একটু ডাকাবুকোও বটে। তাই শিয়াল বা ভুত পেত্নিকে গ্রাহ্য করেনা। 


তখন সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। হঠাৎ পিছন ফিরতেই দেখে রক্তবসন পরিহিত বিরাটকায়  এক জটাধারী সন্নাসী। একঝলক দেখেই বেশ হকচকিয়ে যায় শিবু। কি বলবে বা করবে ঠিক করতে পারেনা। প্রায় বাজখাঁই গলায় সন্নাসী বললে, কে তুই? কেন এসেছিস এখানে? এটা প্রেতপুরী। এখানে প্রেতাত্মাদের বাস। ভুলেও আর এদিক মাড়াসনে। যা ভাগ এখান থেকে।


শিবুর গলাটা শুকিয়ে কাঠ। একটাও শব্দ করতে পারছেনা। কোনওরকমে বললে, যে আজ্ঞে। তারপর পড়ি কি মরি করে দে ছুট। বাড়ি এসেও কাউকে কিছু বললনা শিবু। মা অনেক কথা বললেও জবাব দিলনা। যাহোক একমুঠো খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা ভুলে গেলনা। শ্মশানেমশানে ভুতপেত্নিদের আড্ডা এটা সে জানে। ভুতপেত্নিদের সম্পর্কে কৌতূহল আছে বটে কিন্তু  তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। আসল ব্যাপার ওই রহস্যজনক সন্নাসী। সে যখন কাশবনের ভেতর ঢুকল তখন ধারেকাছে কোথাও সন্নাসীর টিকি দেখা যায়নি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ফেরার সময়ে পিছন ফিরতেই ওই  সন্নাসী- কোথা থেকে এল? আর ওখানে ওর দরকারটাই বা কি? এখান থেকে গঙ্গার দূরত্ব বেশি নয়। প্রায় গঙ্গার ধার ঘেঁষেই ওদের বাড়ি। শ্মশানে কোনও মৃতদেহের দাহ হলে চিতার অগ্নিশিখা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। রাত্রে অনেকবার শিয়ালের চিৎকার শোনা যায়। নিশুত রাতে কখনো কখনো কারোর কান্নার শব্দ শোনা যায়। মা বলে যে সব আত্মার সদ্গতি হয়না--- তারা অন্ধকার রাতে ঘুরে বেড়ায় আর কাঁদে। যখন ছোট ছিল তখন বেশ ভয় পেত। এখন অতটা ভয় না পেলেও কৌতূহল মেশানো ভয় একটু আছে বৈকি! কখনো কখনো অন্ধকার রাতে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি তেনাদের দেখা পাওয়া যায়? তবে কখনো কখনো অন্ধকার রাতে গঙ্গার ধার থেকে আলো হাতে কে একজন উঠে আসে। কিন্তু গ্রামের কাছাকাছি হতেই সেই আলোটা মিলিয়ে যায়। একদিন মায়ের চোখ এড়িয়ে পিছু ধাওয়া করেও সেই আলোর হদিশ করতে পারেনি। হঠাৎ করে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে ওই শ্মশানের দিকে একবার দেখে নেয়। না তেমন কিছু চোখে না পড়লেও ওর যত কৌতূহল ওইদিকে। শুধু আজ নয়। সে অনেককাল আগে থেকে। ঠাকুমার কাছে অনেক ভুতের গল্প শুনত। তবে সেসব ছোটদের ভয় দেখানোর জন্য। তাতে কোনও রহস্য থাকতনা। কিন্তু এখন সেইসব ভুত, পেত্নি, শাঁকচুন্নিরা তার কাছে খুব রহস্যজনক। অনেককিছু জানতে ইচ্ছে করে। আবার একটু ভয় ভয়ও করে। রাতের বেলায় একা শ্মশানে যাওয়ার কথা ভাবেনা। কিন্তু দিনের বেলায় শ্মশান, গঙ্গার ধারের জঙ্গলে সে ঘুরে বেড়ায়। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে সেদিন ওই সন্ন্যাসীর সঙ্গে সাক্ষাত। যদিও ওই সন্ন্যাসীও তার কাছে রহস্যজনক। বেশ কিছুদিন ওর ওপরে নজর রাখতে হবে।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। শিবু দিনের বেলায় শ্মশানের ওই বিশেষ এলাকাটা ঘুরেও এসেছে কয়েকবার। কিন্তু না ওই সন্ন্যাসীর দেখা মেলেনি। তবে সেদিন গঙ্গার ধার থেকে কতকগুলো পায়ের ছাপকে অনুসরণ করে গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল শিবু। দেখল এদিকসেদিক যাগযজ্ঞের কিছু উপকরণ পড়ে রয়েছে। একটা ঝোপের আড়ালে তৈরি হয়েছে যজ্ঞবেদি। তার পাশেই পড়ে রয়েছে একটা নরকরোটি। তাতে এখনো রক্তের দাগ স্পষ্ট। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটা মদের খালি বোতল । এতে স্পষ্ট যে সন্ন্যাসী এখানে নিয়মিত আসেন। কিন্তু জায়গাটা এমন জনমানবহীন যে কারোর নজরেই পড়েনা। সন্ন্যাসীর রহস্যজনক কাজকর্ম নিয়ে তার মনে কৌতূহল বাড়তেই থাকে। শিবু মনে মনে ঠিক করে আজ রাতেই একবার এখানে এসে দেখবে।

সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। রাত প্রায় বারোটা। গভীর ঘুমে অচেতন বাবা মা। তাদের ঘর পেরিয়ে পিছনের খিড়কির দরজা দিয়ে মাঠের ধারে এসে পৌঁছাল। এখন নিশুত রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কোনও শব্দ নেই। শুধু ঝিঁঝিঁর একটানা কর্কশ আওয়াজ ছাড়া। পকেটে একটা ছোট্ট টর্চ আছে বটে তবে সেটা ব্যবহার করলনা। চেনা আলপথ। তাই তেমন কোনও অসুবিধা হলনা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। হঠাৎ কয়েকটা শিয়াল ওকে দেখে সরে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। এমনিতে শিয়ালরা তেমন হিংস্র নয়। তবে ওরা দলবদ্ধ থাকলে একাকী কোনও মানুষকে আক্রমণও করে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা আধপোড়া বাঁশের টুকরো তুলে নিল শিবু। এগিয়ে চলল সে। হঠাৎ একটা পেঁচা কর্কশ আওয়াজ করল। বেশ কিছুটা দূরে শোনা গেল শিয়ালের খ্যাক খ্যাক আওয়াজ। কেমন যেন একটা আধিভৌতিক পরিবেশ। ভয় একটু পেল বৈকি। মনে হল না এলেই বুঝি ভালো হতো। কিন্তু এখন তো ফিরে যাওয়া যায়না। প্রাণের মায়া সে করেনা। ভুত মানে তো অতীত। আর রামলক্ষণ যখন বুকের মাঝে আছে তখন আবার ভয়টা কিসের?


এবার জঙ্গল পার হয়ে কাশবন আর আকন্দের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পথ। বেশ কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখল একটা মশাল জ্বলছে। তার আলোয় দেখা গেল একটা কালীমূর্তি। ওই মূর্তির সামনে একটা ছোট্ট প্রদীপ আর ধূনি। সন্ন্যাসী এবং আর একজন যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত। ওই  আর একজন লোকটাকে সে চেনে। রতন মাঝি। ওর একটা ছোট নৌকা আছে। সেটা নিয়ে কখনো কখনো মাছ ধরতে যায়। তবে বেশির ভাগ সময় মদ খেয়ে গঙ্গার ধারের পিটুলি গাছটার তলায় পড়ে থাকে।


চুপি চুপি একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসল শিবু। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা গেল লোকটা এবং সন্ন্যাসী একটা অবিকৃত  মৃতদেহকে টেনে আনল। মৃতদেহটাতে কোনও পোশাক ছিলনা। তাই দেখা গেল ওটা একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। লোকটা বলল, এই মড়াটার জন্য আমার পাঁচশো টাকা বেশি লাগবে। অনেক বুদ্ধি করে এটাকে চুরি করতে হয়েছে।

-- সব পাবি। আগে আমাকে সিদ্ধ হতে দে। আমি হবো শবসিদ্ধ মহাতান্ত্রিক, তখন আমার অগম্য বলে কিছু থাকবেনা। প্রেত আত্মারা হবে আমার আজ্ঞাবহ।

-- সে তো পরের কথা । কিন্তু--- 

-- এই নে কারণরস।

 লোকটার হাতে একটা মদের বোতল দিল সন্ন্যাসী। খুশি হল লোকটা। একটু দূরে গিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিল কিছুটা। সন্ন্যাসী মৃতদেহটাতে কি একটা মাখিয়ে দিয়ে যজ্ঞাসনে এসে বসল। যজ্ঞের আগুনে একমুঠো ধুনো ছুঁড়ে দিতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। এবার তার বাজখাঁই গলায় সন্নাসী মন্ত্র আওড়াতে লাগল--- ওঁ করালবদনা ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শবাসনা তুষ্ট হ'। নে রক্ত নে। নিজের আঙুল কেটে একফোঁটা রক্ত নরকরোটিতে মাখিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সেই হাসির শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খানখান করে প্রতিধ্বনি তুলে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। হয়তো ভয় পেয়েই অনেকগুলো শিয়াল একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।

---জাগ 'জেগে ওঠ মা। জেগে ওঠ শবভৈরব।'

আবার একমুঠো ধুনো ছুঁড়ে দিল যজ্ঞের আগুনে। লেলিহা শিখায় জ্বলে উঠল অগ্নিকুণ্ড। সন্ন্যাসী এবার একমুঠো সাদা সরষে মন্ত্রঃপুত করে শবদেহের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে বলে উঠল, জেগে ওঠ পিশাচিনী। মৃতদেহটা এবার বুঝি একটু নড়ে উঠল। খোনা গলায় বলে উঠল, ওঁ জ্বঁলে গেল, পুঁড়ে গেল-- আঁর পাঁরছিনা।

-- তোকে আমি বন্দী করেছি। আমার কথা মতো তোকে চলতে হবে। 

-- পাঁরবনা। 

-- তবে এইনে মর।

আবার একমুঠো সরষে ছিটিয়ে দিতেই শবদেহটা চিৎকার করে উঠল-- মঁরে গেলাম, জ্বঁলে গেল। 

-- শুনবি আমার কথা?

-- শুঁনবো। বঁল কিঁ কঁরতে হঁবে?

-- এখন এই বাক্সটায় শুয়ে থাকতে হবে। যখন কাজের সময় হবে ডাকব তোকে।


ঝোপের আড়াল থেকে একটা কফিন বের করে আনল সন্ন্যাসী। মৃতদেহটাকে বলল, নে শুয়ে পড়।

নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা শিবু। একি দেখল সে! মৃতদেহটা গিয়ে ধীরে ধীরে কফিনের মধ্যে শুয়ে পড়ল!

ঢাকনাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার নিজের আসনে এসে বসল সন্ন্যাসী। ধুনো ছিটিয়ে যজ্ঞের আগুনকে আবার জাগিয়ে তুলল। পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার করে বলল, আজ আমি সিদ্ধ। শবসিদ্ধ মহাতান্ত্রিক। আজ আমি সবকিছু করতে পারি। জয় মা মহাকালী।

এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল শিবু। আর যেন সে পারছিলনা। যজ্ঞের আলোটা গিয়ে যেখানে থেমেছে, মনে হল সেখানে কারা যেন পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত। বিকটদশনা, বিস্ফারিত নয়না, লোলজিহ্বা সেই নারীমূর্তিদের দেখে আর ঠিক থাকতে পারলনা। একপ্রকার তীব্র আর্তনাদ করে জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই সে পড়ে রইল । 

রাতের অন্ধকারে  ঢাকা পড়ে রইল শবসিদ্ধ মহাতান্ত্রিকের সাধনা। 

যতদূর শুনেছি শিবু আর তারপর থেকে কথা বলতেই পারেনি।






স্মৃতির আয়না


সু দী প  ঘো ষা ল


আমার এক স্কুলের বন্ধু দুদিন স্কুল না আসাতে আমরা সকল বন্ধুরা ওর বাড়ি গেলাম। জিজ্ঞেস  করতেই ওর মা বললো, কি হলো গো আমার অলোকের।  সেই যে সকালে বেগুন তুলতে গেলো আর ফিরলো না।


ওর মায়ের আর্তনাদে আমাদের সকলের মন খারাপ হয়ে গেলো। কেথায় গেলো জলজ্যান্ত ছেলেটা। গায়েব হয়ে গেলো কি করে? বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো, কোনো খবর নেই। 


একটা বেগুনি রঙের স্করপিও চলেছে সোজা রাস্তা বরাবর।  আমি ও রতন হাত দেখাতেই থেমে গেলো। দুজনেই গাড়িতে চেপে বসলাম। আমরা দুজনেই কথা বলে চলেছি। ড্রাইভার সাহেব কোনো কথাই বলছেন না।  শুধু ঘাড় নেড়ে কথার উত্তর দিচ্ছেন। আমাদের কেমন যেনো একটা অসুবিধা হচ্ছে। কেউ পাশে থেকে কথা না বললে যেমন হয় আর কি?


পাশ দিয়ে একটা সুন্দরী মেয়ে চলে গেলো।  সাধারণতঃ সবাই তাকায়। কিন্তু লোকটা ঘাড় সোজা করে আছে রোবোটের মতো। আমরা দেখলাম গাড়ি রেললাইনের সিগনাল না মেনে অদ্ভুদভাবে পার হয়ে গেলো। রতন বললো, গাড়িটা কি উড়তে উড়তে চলেছে? আমি বললাম, আমরা কোথায় চলেছি?


ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, বন্ধুর কাছে যাবে না।  তার কাছেই নিয়ে চললাম। গাড়ি ছুটছে তবু ঘাড় ঘুরিয়ে কি করে ড্রাইভার কথা বলছে আমাদের সঙ্গে। রতন বললো, আপনি কি করে আমাদের বন্ধুর কথা জানলেন? ড্রাইভারের মুখে রহস্যের হাসি। 


যখন বারো তোরো বছর বয়স তখন লিলুয়া সিনেমা হলে, ছোটোদের রামায়ণ, ছবিটা দেখতে ইচ্ছে হলো। আমরা চার ভাই একত্রে মাকে বায়না করতে শুরু করলাম, মা আমরা সিনেমা দেখবো। তুমি ছাড়া আমাদের গতি নাই। মা বললেন, যা, রবি মামাকে ডেকে নিয়ে আয়। আমরা রায়দের পুকুরের পাড় দিয়ে চলে গেলাম মামাকে ডাকতে। মামা, মা একবার ডাকছে। মামা বললেন, বুঝেছি, কোনো মতলব আছে। আমরা বললাম, প্যান্ট, জামা পড়ে একেবারে রেডি হয়ে এসো তাড়াতাড়ি। মামা বললেন, তোরাও রেডি হয়ে নে। চ,দেখি দিদি কি বলেন। মামা আসার পরে মা বললেন, ওদেরকে রামায়ণ দেখিয়ে নিয়ে এসো। এই নাও তিরিশ টাকা। তখন তিরিশ টাকায় অনেককিছু হয়ে যেতো।সিনেমা হলের বাইরে কত মানুষ। সবাই রামায়ণ- সিনেমা দেখতে এসেছে। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। অন্ধকারে হোঁচট খেলাম। একজন টর্চ হাতে আমাদের বসার জায়গা দেখিয়ে দিলেন।আমরা তিন ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধের মত রাম রাবণের যুদ্ধ দেখলাম। কিভাবে শত যন্ত্রণা সহ্য করে সীতা পাতাল প্রবেশ করলেন তাও দেখলাম। তারপর বাড়িতে এসে মাকে গল্প শোনানোর পালা। মা বললেন, তিন ঘন্টায় রামায়ণ সবটা বোঝা যায় না। বড় হয়ে পড়বে। তখন আরও বুঝতে পারবে ঘটনাগুলো।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে।মেরি মাসি একদিন বললেন মাকে, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।আমি পোলাদের সিনেমা দেখাবো নিজের খরচে। মা বললেন,কি সিনেমা? মেরি মাসি বললেন, বিদ্যাসাগর। খুব ভালো বই।ছোটোদের দেখার উপযুক্ত সিনেমা এসেছে শিয়ালদার প্রাচীতে। সেই প্রথম ট্রামে চাপা। এর আগে আমরা ট্রেন দেখেছি, কিন্তু ট্রাম দেখিনি। সেটা ১৯৭৫ সাল। বিদ্যাসাগর, সিনেমা দেখে আমরা পড়াশোনায় জোর লাগালাম। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের  টিকি বেঁধে রাত জেগে পড়াশোনা করাটা আমাদের মনে গভীর দাগ কেটেছিলো। আমার মনে হত, আমি কেন পারবো না? নিশ্চয় পারবো। পরে বুঝেছিলাম, মহাপুরুষরা যা পারেন, সবাই তা পারেন না। একটা পার্থক্যের প্রাচীর ঐখানে আঁকা হয়ে যায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে।


আমার  বড়দা আর রবিমামা কলকাতায় ঘুরতে ভালোবাসতেন খুব। তখন তো টি,ভি ছিলো না সহজলোভ্য। তাই ঘুরে ঘুরে চিড়িয়াখানা, সিনেমা দেখে বেড়াতো মানুষের দল। এখন টি,ভি র দৌলতে বাড়িতে বসে সবকিছু পাওয়া যায়। কিন্তু ঘোরার আনন্দ পাওয়া যায় কি?


আমার প্রিয় বন্ধুর নাম ছিলো বিশু। বিশু যখন গ্রামে কাকার কাছে থাকতো তখন বেলতলা, তালতলা ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। সামনেই ছিলো একটা পুকুর।বর্ষার দিনে ভিজতে ভিজতে বিশু টেঁটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো মাছ ধরতে এক হাতে টর্চ আর এক হাতে টেঁটা বা বর্শা। ঝমঝম সুর তুলে বৃষ্টি বিশুকে পরম আদরে মায়ার চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে মায়ের স্নেহে। টর্চ জ্বেলে রাতের অন্ধকারে বিশু দেখলো, ওটা মাছ নয়। বিশাল আকৃতির একটা শাঁখামুটি সাপ পাক দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে একটা মাগুর মাছ। তার পাশেই বিশাল আকৃতির একটা রাঘব বোয়াল। মনে হচ্ছে বিশুর সামনেই আছে। বিশু জানে এটা টর্চের আলোয় অসদবিম্ব গঠিত হয়েছে। রাঘব বোয়াল কিন্তু তার একটু পাশে। বিশুর টেঁটার অভ্যর্থ নিশানায় বিদ্ধ হলো প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের বোয়াল মাছটা।দুহাতে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এলো বাড়িতে। বগলে জ্বলে থাকা টর্চ।কাকাবাবু বললেন,ঠিক বুঝেছি, তুই পুকুরে গেছিস। সাপে খেয়ে মরবি যে। বিশু জানতো, আপনজনের সব সময় প্রিয় মানুষের জন্য মন্দ চিন্তাই হয়।


কাকাবাবু ও বিশু ঐ মাছ পাড়ার সবাইকে ভাগ করে দিয়েছিলেন।



আমি দূর দূরান্তে না গিয়ে কাছাকাছি না দেখা গ্রাম দেখতে ভালোবাসি। এবার গেলাম বেলুন ইকো ভিলেজ পরিদর্শনে। হাওড়া আজিমগঞ্জ লোকাল ধরে শিবলুন হল্টে নামলাম। সেখান থেকে অম্বলগ্রাম পাশে রেখে দু  কিলোমিটার টোটো রিক্সায় বেলুন গ্রাম। একদম অজ পাড়াগাঁ। মাটির রাস্তা ধরে বাবলার বন পেরিয়ে তন্ময়বাবুর স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করলাম।তন্ময়বাবু ঘুরিয়ে দেখালেন। তার জগৎ। প্রায় একশো প্রজাতির গাছ। পশু, প্রাণীদের উন্মুক্ত অঞ্চল। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে, সেখানে।তার নিজের হাতে বানানো মা কালীর মূর্তি দেখলাম। কাঁচের ঘরে ইকো সিষ্টেমের জগৎ। কেউটে সাপ, ব্যাঙ থেকে শুরু করে নানারকমের পতঙ্গ যা একটা গ্রামের জমিতে থাকে। বিরাট এক ক্যামেরায় ছবি তুলছেন তন্ময় হয়ে। আমি ঘুরে দেখলাম প্রায় দু কোটি টাকা খরচ করে বানানো রিসর্ট। ওপেন টয়লেট কাম বাথরুম। পাশেই ঈশানী নদী। এই নদীপথে একান্ন সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ অট্টহাসে যাওয়া যায় নৌকায়। তন্ময়বাবু হাতে সাপ ধরে দেখালেন। শিয়াল, বেজি, সাপ, ভাম আছে। তাছাড়া পাখির প্রজাতি শ খানেক। একটা পুকুর আছে। তার তলায় তৈরি হচ্ছে গ্রন্থাগার। শীতকালে বহু বিদেশী পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। তন্ময়বাবু বললেন, স্নেক বাইটের কথা ভেবে সমস্ত ব্যবস্থা এখানে করা আছে। ঔষধপত্র সবসময় মজুত থাকে। তারপর বেলুন গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। এখানকার চাষিরা সার, কীটনাশক ব্যবহার করেন না। তারপর বিকেলে নৌকাপথে চলে গেলাম অট্টহাস সতীপীঠ। এখানে মা মহামায়ার ওষ্ঠ পতিত হয়েছিলো। সোন মহারাজ এই সতীপীঠের প্রধান। তারপর দেখলাম পঞ্চমুন্ডির আসন। ঘন বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। মন্দিরে মা কালীর মূর্তি। রাতে ওখানেই থাকলাম।


তার পরের দিন সকালে হাঁটাপথে চলে এলাম কেতুগ্রাম বাহুলক্ষীতলা। কথিত আছে এখানে মায়ের বাহু পতিত হয়েছিলো। এটিও একান্ন সতীপীঠের এক পীঠ। তীর্থস্থান। সুন্দর মানুষের সুন্দর ব্যবহারে মন ভালো হয়ে যায়। এর পাশেই আছে মরাঘাট। সেখান থেকে বাসে চেপে চলে এলাম উদ্ধারণপুর। এখানে লেখক অবধূতের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।গঙ্গার ঘাটে তৈরি হয়েছে গেট, বাথরুম সমস্তকিছু। শ্মশানে পুড়ছে মৃতদেহ। উদ্ধারণপুর থেকে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে চলে এলাম কাটোয়া। এখানে শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেবার পরে মাথা মুন্ডন করেছিলেন। মাধাইতলা গেলাম। বহুবছর ব্যাপি এখানে দিনরাত হরিনাম সংকীর্তন হয় বিরামহীনভাবে। বহু মন্দির, মসজিদ বেষ্টিত কাটোয়া শহর ভালো লাগলো।






পিতৃ-তর্পণ


ম ম তা  শ ঙ্ক র  সি ন হা(পা ল ধী)


এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সামান্য গ্রাজ্যুয়েট উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়ে মৌপ্রিয়া। কলেজের ইংরাজীর অধ্যাপক দীপমাল্যর সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে দীপমাল্যর বাবা-মার অমতেই বিয়ে করে দুজনে। বাড়িতে এই অসম বিয়ে মেনে না নেওয়ায় দীপমাল্য মৌপ্রিয়াকে নিয়ে চলে আসে দিল্লিতে। সেখানে এক নামী কলেজে অধ্যাপনার চাকরিও পায় সে। দিল্লিতেই তাদের সংসারে আগমন ঘটে এক নতুন অতিথি--- তাদের আদরের একমাত্র কন্যাসন্তান প্রমিতার।প্রমিতার ডাক নাম হিয়া। প্রমিতা আসতে, আসতে দীপমাল্য আর মৌপ্রিয়ার আদরে সোহাগে বড় হতে থাকে দিল্লিতেই। ছোটো থেকেই এলবামে দাদু-ঠাকুমার ছবি দেখে হিয়া অনেকবার তার বাবা-মার কাছে বায়না করেছে কলকাতায় গিয়ে দাদু-ঠাকুমার সাথে দেখা করে আসার জন্য। যদিওবা তারা সবাই মিলে দু একবার দুর্গাপুজোর সময় কলকাতায় গিয়েছে তবুও প্রমিতার মানে হিয়ার তার দাদু-ঠাকুমার সাথে দেখা করা হয়নি। কারণ একটাই-- দীপমাল্যর স্ত্রী অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে মৌপ্রিয়া, যাকে একদমই পছন্দ নয় দীপমাল্যর বাবা-মা ও দীপমাল্যর সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা একমাত্র বোন মেঘমালার। বর্তমানে মেঘমালা তার কর্পোরেটে কর্মরত স্বামী তৃষাণজীতের সাথে মালয়েশিয়া নিবাসী।


প্রমিতাকে (হিয়াকে) দাদু-দিম্মার সাথে দেখা করেই পুজোর ছুটি কাটিয়ে দিল্লি ফিরতে হয়েছে।

অনেক আদরে আবদারে হিয়াকে বড় করে তুলেছিল দীপমাল্য আর মৌপ্রিয়া। আজ সে "ল" পড়ছে। প্রমিতাকে দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে। তার মুখের আদল অনেকটাই দীপমাল্যর মা শ্রীতমাদেবীর মত হয়েছে।


এবার হঠাৎই প্রমিতা (হিয়া) আবার তার বাবা-মার কাছে বায়না করে বসলো যে-- সে দাদু-দিম্মাকে নিয়ে কলকাতায় দাদু-ঠাকুমার কাছে যাবে এবং সেখান থেকে তাদের দিল্লিতে নিয়ে আসবে। সেই মত তাদের সাথে কলকাতায় ফোনে যোগাযোগ করল হিয়া ও দীপমাল্য। দীপমাল্যর বাবা-মার কাছ থেকে সদুত্তর না পেয়ে হিয়া তার বাবা-মাকে বলল--- চলো মা-বাপি, আমরা কলকাতায় গিয়েই ওদের এখানে জোর করে নিয়ে আসি। দেখি কেমন করে না এসে পারে ওরা এখানে। ওরা মাঝে মধ্যেই বিদেশে পিমণির কাছে যেতে পারে আর এখানে কেনো আসতে পারবে না?


মেয়ের জোরের কাছে পরাস্ত হয়ে দীপমাল্য ও মৌপ্রিয়া বাধ্য হয়ে সেখানে গেলেও, নিরাশ হয়ে ওদের ফিরতে হলো দিল্লির ফ্ল্যাটে। দীপমাল্য সেদিন থেকেই ভীষণ মানসিক কষ্ট পাচ্ছিল। দীপমাল্য ভেবে ছিলো মেয়েকে দেখে হয়তো তার বাবা-মা সব ভুলে তাদের কাছে আসবেন।কিন্তু তা হলো না। এইসব ভাবতে ভাবতেই মনে মনে গুমরে গুমরে একদিন কলেজ থেকে ফিরে দীপমাল্য হঠাৎই বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে লাগল কলেজে ক্লাস নেওয়ার সময়।সেদিন দীপমাল্য কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো তাড়াতাড়ি। স্ত্রী মৌপ্রিয়াকে বলল--- তার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। তাই আজ কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে।এখন সে একটু রেস্ট নেবে। কেউ যেনো তাকে ডিসস্টার্ব না করে।


এরপর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। হিয়া ওর কলেজ থেকে ফিরে মায়ের কাছে জানতে চাইলো বাপি বাড়ি ফিরেছে কিনা? মৌপ্রিয়া মেয়েকে দীপমাল্য অসুস্থতার কথা বললে--- হিয়া (প্রমিতা) বলে মা অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।বাপি তো এখনও ঘুম থেকে উঠছে না। আমি এখনই ডাক্তারবাবুকে কল করছি। উনি একবার এসে দেখে যান বাপিকে।


হিয়া বাবার এই অবস্থা দেখে ডাক্তারকে কল করলো বাড়িতে।ডাক্তার এসে বললেন দীপমাল্যবাবু আর নেই। মৌপ্রিয়া ও প্রমিতা (হিয়া) বেশ ভেঙে পড়লো। দীপমাল্যর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে দিল্লিতে দীপমাল্যর বাবা-মা ও হিয়ার পিসি রণিতা যে কর্মসূত্রে মালয়েশিয়া থাকে, এসে হাজির হয়। হিয়া মেয়ে বলে সে নাকি তার বাবার মুখাগ্নি করতে পারবে না, এই বিধান দেন দীপমাল্যর বাবা-মা। এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে প্রমিতা (হিয়া)। সে বলে-"এতদিন তো আমি আর মা---বাবা, দাদু-দিম্মা ছাড়া তোমাদের থেকে কোনও রকম সাহায্য, ভালোবাসা, সহানুভূতি কিছুই পায়নি। যখন আমি মা-বাপী তোমাদের আমাদের কাছে নিয়ে আসবো বলে বড় সাধ করে কলকাতা গিয়েছিলাম তোমরা আসলে না কিছুতেই এই দিল্লির বাড়িতে।পিমণি তুমিও তো সেদিন নীরব দর্শক হয়ে শুনেছিলে দাদু-ঠাকুমার এখানে না আসর অবিবেচক কারণগুলো। কেনো প্রতিবাদ করলে না তুমি সেদিন পিমণি। তাহলে বাপীকে এইরকম ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের সকলকে ছেড়ে অসময়ে চলে যেতে হতো না! আজ তাহলে তোমরা এ রকম অযৌক্তিক দাবী কি করে করো? আমার আর মা'র কাছে। আমার বাপীর আমিই মুখাগ্নি করবো। কারণ আমি তার একমাত্র উত্তরাধিকারী তাই আমি আমার বাবার মুখাগ্নির অধিকার তোমাদের কাউকে দেবো না। দেখি কে? কোনো সমাজ আমাকে আজ আটকায় এ কাজের থেকে? পরাস্ত হয়ে ওরা ফিরে গেল।


প্রমিতা যথাযথ নিয়ম মেনে দীপমাল্যার মুখাগ্নি করল। সমাধা করল শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের। এরপর কেটে গেলো বেশ কিছু বছর।আর প্রমিতা (হিয়া) তার কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসয়ের গুণে মস্ত নামকরা উকিল। প্রমিতা ঠিক করল এবছর সে মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে পিতৃ-তর্পণ করবে।এখানেও সেই একই প্রশ্ন আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছিলো যে---মেয়েরা তর্পণ করে না। মৃত পিতৃপুরুষদের জল দানের অধিকার একমাত্র ছেলেদের আছে। এই প্রথার কাছেও নতি স্বীকার না করে প্রমিতা তার পিতৃ-তর্পণের কাজ সমাধা করে এবং তার পরিবার ও সমাজকে সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়ে চাইলে মেয়েরা সব কিছুই করতে পারে। ছেলে-মেয়ের মধ্যে নেই কোনো ভেদাভেদ। তারা যে উভয়ই রক্তমাংসের মানুষ। এ সমাজ সভ্যতার উন্নয়ন তাদের উভয়ই এরই অবদান ও অধিকার সমান সমান। তারা একে অপরের পরিপূরক।


আজ প্রমিতা তার মা'কে নিয়ে রৌনকের সাথে নতুন সংসারে কর্মময় জীবন সহ সংসার জীবনে সুখী। কিন্তু মনের কোনে আজও তার একটা দুঃখ রয়ে গেছে--- তার বাপী আজ তাদের সাথে নেই। এ সমাজ সংসারকে অনেক কিছুই দেবার আশা আছে তার।আর সেই আশা পূরণের লক্ষ্যেই রৌনককে তার সঙ্গী করে আগামীর পথচলা।





শ্রাবণ সন্ধ্যা

 

সু স্নি গ্ধা  রা য়  চৌ ধু রী  মা ম্পি


তমালিকা, সুচিস্মিতা, দেবপর্ণা আর নিরুপমা কোলকাতার এক লেডিস হোস্টেলে থাকে। এক একজনের বাড়ি এক এক জায়গায় হলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব খুব গভীর। এদের মধ্যে তমালিকা ও নিরূপমা চাকরি করে আর বাকী দুইজন চাকরি খুঁজতে মফস্বল শহর থেকে কোলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে, পরিজন আছে তবুও হস্টেলে থাকে কারণ এখন যা চাকরির বাজার অপরের বাড়িতে থাকলে অনেক অসুবিধা হবে। তমালিকা ও নিরূপমা সরকারি চাকরি করে একজন স্কুলশিক্ষক আর অপরজন সমবায় ব্যাংকে, ফলে সবাইকে রোজ বাইরে থাকতে হয় বেশ কিছুক্ষণ। এই চারজন হস্টেলে থাকে এটাই এখন তাদের পরিবার। তমালিকা ও নিরূপমা তিনবছর হলো এখানে আছে আর সুচিস্মিতা ও দেবপর্ণা এক বছর হলো এখানে এসেছে। পরিবার ছেড়ে সবাই আছে তাই ভালোমন্দ মিলিয়ে তারা একসঙ্গে থাকে। থাকতে থাকতে এখন এই চারজন খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে, এক ঘরে থেকে পরিধান থেকে খাওয়া-দাওয়া- সব এক সময় এক জায়গায় করে। এক সময় এই হস্টেল ছিল নিঝুম কিন্তু এই চারজন একসাথে হয়ে এখন হস্টেলে যেনো একটা প্রাণ এসেছে। শীতকাল থেকে গরমকাল এখানে বিভিন্ন উৎসব হয়, পুজোতে একসাথে ঠাকুর দেখা, ঘুরতে যাওয়া এ ওর বাড়িতে যাওয়া এতো চলতে থাকে। এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় জল ঝড়ের রাতে চারবন্ধু ঠিক করে এবার তারা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে তাদের এই হস্টেলে, পরিবেশনায় থাকবে লেডিস হোস্টেলে সব আবাসিকরা সর্ব প্রথমে তারা হস্টেলের সুপারকে বললে সে প্রথমে রাজি হয় না, শেষমেশ সবার জোড়াজুড়িতে রাজি হয় । তিনমাস ধরে চলতে থাকে রিহার্সাল। হস্টেল সুপার থেকে সবাই একসাথে, দেখতে দেখতে শ্রাবণ মাসের শেষ রোববার দিন স্থির হয় অনুষ্ঠানের। আবাসিকদের হস্টেলের বারান্দায় মঞ্চের আয়োজন হয়। কবিতা পাঠ থেকে গান একক নাচ, সম্মিলিত শ্রুতি নাটকে অনুষ্ঠান মুখরিত হয় হস্টেল, শেষ আকর্ষণ শ্রাবণ সন্ধ্যায় বরীন্দ্রনৃত্য। এই চার বন্ধু তমালিকা, সুচিস্মিতা, দেবপর্ণা আর নিরুপমা নৃত্য পরিবেশন করে, সবাই শুধু তাকিয়ে থাকে 

   ---- আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে--- এই গানের সাথে নৃত্য দিয়ে সম্পুর্ন অনুষ্ঠান শেষ হয়।।




মূল পাতায় যান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল ও বাসন্তী সংখ্যা || ৯ চৈত্র ১৪৩১ || ২৩ মার্চ ২০২৫

চতুর্থ বর্ষ || চতুর্থ ওয়েব সংস্করণ || বাদল সংখ্যা || ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ || ২৯ জুলাই ২০২৫

পঞ্চম বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১১ কার্তিক ১৪৩২ || ২৯ অক্টোবর ২০২৫