অপ্রকাশিত প্রবন্ধ
ডিরোজিও এবং বাংলার প্রগতিশীল সমাজচেতনা
৺শী তাং শু দা শ গু প্ত
"পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনো উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবেনা ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।"
কার্যত ভারতের পশ্চিম দ্বার ইতিহাসের শুরু থেকেই খোলা। শেষ বিদেশী ইংরেজ অবশ্য জলপথেই ভারত অভিযান করে আধিপত্য কায়েম করেছিল। তা না-হলেও পাশ্চাত্যের পরিবর্তনের ধারা থেকে ভারত বেশি দিন বিচ্ছিন্ন থাকতে পারত না। নবযুগের হাওয়া অবশ্যই এদেশে পৌঁছে যেত---হয়ত অত্যন্ত মন্থরগতিতে। কিন্তু ইংরেজ বণিকের মানদন্ড যে কূটকৌশলে রাজদন্ডে রূপান্তরিত হল, তার অব্যবহিত ফল---এদেশে পাশ্চাত্য নবজাগরণের দ্রুত প্রবেশ। এই বিষয়ে কার্ল মার্কসের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ভারত বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধের একটিতে তিনি বলেছেন, "একটা ঘুমন্ত অথবা মোহাচ্ছন্ন স্বভাব পরবশ জনমন্ডলীর মোহমুক্তি ঘটানোর জন্য ইংরাজ শাসন পরোক্ষ কৃতিত্বের দাবীদার হতে পারে।... ইংরেজ নিজের প্রয়োজনে যেভাবে কাঁচামাল পরিবহনের জন্য রেলপথ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যে স্বার্থে এদেশে কিছু কিছু শিক্ষা বিস্তার করতে বাধ্য হচ্ছে, তারই মধ্য থেকে একদিন ইংরেজবিরোধী এদেশীয় শক্তি ডায়েলেকটিকসের নিয়মে আবির্ভূত হতে বাধ্য।"
বার বার বিদেশী পদানত ভারতীয় জনমন্ডলীর ইতিহাস প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস মন্তব্য করেছিলেন, "ভারতীয়রা উদ্ভিদসুলভ জীবন যাপন করে।... বিদেশীদ্বারা বিজিত হবার অদৃষ্ট নিয়েই তারা জন্ম নিয়ে থাকে।... ভারতের ইতিহাস বস্তুত একটি জাতির বার বার বিজিত হবার ইতিহাস।" শেষ বিজেতা ইংরেজ আমাদের এই অপদার্থতার মূল কারণ ঠিকই ধরতে পেরেছিল। তাই আমাদের ধর্মীয় আচার-বিচার, অর্থহীন সংস্কার আর কূপমন্ডুকতার অচলায়তনকে চিরায়ত রাখতেই তারা সচেষ্ট ছিল। নিজেদের শাসনের জন্য যতটুকু দরকার, তার বেশি শিক্ষা বিস্তারে তারা ছিল অনিচ্ছুক। মক্তব-মাদ্রাসা-টোল-চতুষ্পাঠীর বাইরে কোনও শিক্ষাই তারা দিতে চায়নি।
কিন্তু যে সামান্য পাশ্চাত্য শিক্ষা ইংরেজদের স্বার্থেই বাংলায় প্রবর্তিত হল, সেটিই ব্যুমেরাং হয়ে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে দাঁড়াল। বাংলায় একদল প্রগতিকামী তরুণের আবির্ভাব স্বদেশপ্রেম ও বৈপ্লবিক স্বাধীন চিন্তার জন্ম দিল। রাজা রামমোহন রায়কেই সাধারণত বাংলার তথা ভারতের রেনেসাঁর প্রবর্তক বলা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে একটি অখন্ড কার্যকর পথে বাঙালি তথা ভারতীয়দের স্বাধীন পথে পরিচালনা করতে বাংলায় 'ইয়ং বেঙ্গল' দল দেশের মাটি থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে শহরে শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে তিনটি আলাদা ধারা দেখা গেল। চরমপন্থী হল নবগঠিত ইয়ং বেঙ্গল দল, মধ্যপন্থী হল রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন, আর নরমপন্থী হল হিন্দু ধর্মান্দোলন। বাংলার সেই রেনেসাঁর যুগে যদিও ইয়ং বেঙ্গল দল স্বদেশপ্রেম, যুক্তিনিষ্ঠা, কুসংস্কারহীনতা, ও বৈপ্লবিক স্বাধীন চিন্তা দিয়ে দেশবাসীর বিবেক জাগ্রত করতে চেয়েছিল, তবু নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, সেই মহান প্রয়াসের প্রেরণাদাতা ছিলেন দুজন মহাপ্রাণ মণীষী----ডেভিড হেয়ার ( ১৭৭৫--১৮৪২ ), এবং হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯--১৮৩১)। হেয়ার সাহেব বুঝেছিলেন যে, এদেশীয় লোকেদের যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে দরকার অশিক্ষা, দীনতা, ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ এবং সে কাজ এদেশীয় লোকদেরই করতে হবে। অনুরূপ ধারণার বশবর্তী, এদেশের কল্যাণকামনায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ ডিরোজিও তাঁর হিন্দুকলেজের ছাত্রদের উপদেশ দিতেন--- তাঁরা যেন পাশ্চাত্য ভাবনায় প্রভাবিত না হয়ে দেশীয় উন্নত প্রগতিশীল ধ্যানধারণার ধারক ও বাহক হয়ে দেশের জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করেন।
দুর্ভাগ্যজনক হল যে, দীর্ঘজীবি ডেভিড হেয়ারকে মনে রাখলেও আমরা ডিরোজিওকে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছি। অথচ এই তরুণ শিক্ষক প্রায় তাঁরই সমবয়েসী ইয়ং বেঙ্গল দলের ছাত্রদের বৈপ্লবিক, প্রগতিশীল জীবনদর্শন ও সমাজচিন্তায় এমন ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন যে, তাঁরাই পরিণত বয়সে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় সম্মানিত কৃতি পুরুষের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। এঁদের কয়েকজন ছিলেন--- রামগোপাল ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, মহেশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। ডিরোজিও মাত্র বাইশ বছর বেঁচে ছিলেন, তার শেষ চার-পাঁচ বছর তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজে ( বর্তমান প্রেসিডেন্সি ) শিক্ষকতা করেন। তাঁর শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডও ছিলেন স্বাধীনচেতা ও প্রগতিশীল। ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক, আধ্যাত্মিকতা নয়, তাঁর কাছে প্রত্যক্ষ ছিল মানুষ আর তার সমাজ। যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি দিয়েই তিনি সবকিছুর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করতেন। এমন গুরু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে চলতে শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, "মানুষের মধ্যে জাতিভেদ নেই। জাতিভেদ মানা অন্যায়। সকলের সাম্য আর স্বাধীনতার অধিকার মানুষের শ্রেষ্ঠ অধিকার। ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে যতখুশি তর্কবিতর্ক করতে পার, কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কিছুই মেনে নেবেনা।"
এটা অবশ্য মেনে নিতে হবে যে, ডিরোজিওর মতো যুক্তিনিষ্ঠ বিচারপদ্ধতি প্রাচীন ভারতেও ছিল। বৃহস্পতি, লোকায়ত, চার্বাক, পুরন্দর প্রমুখের যুগ থেকে আর্যভট্ট, বরাহমিহিরদের যুগ পর্যন্ত ভারতে যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তার প্রভূত প্রসার দেখা গেছে।
স্পেনের গৃহযুদ্ধে নিহত স্বেচ্ছাসেবী কম্যুনিস্ট ইংরেজ কবি জন কর্নফোর্ড, বাংলার বিদ্রোহী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আর তাঁদের পূর্বসূরী তরুণ শিক্ষক ডিরোজিও---কেউই জীবনে বাইশ বছর অতিক্রম করতে পারেননি। তবুও মহাকালের অঙ্গনে তাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে স্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে ১৮২৬ সালে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে শিক্ষক নিযুক্ত হন। বলা যায়, একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই তাঁর আবির্ভাব। অশান্ত, সঠিক পথের খোঁজে ব্যাকুল ছাত্রেরা তাঁর মধ্যে পেয়েছিল আদর্শ এক পথ প্রদর্শক। তাঁর সংস্পর্শে এসে ছাত্রেরা হয়ে উঠল যুক্তিবাদী, কুসংস্কার বিরোধী এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন। ইয়ং বেঙ্গল দলের ছাত্রেরা ক্লাসের বাইরেও নিয়মিত সভা-সমিতি, বৈঠক ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশনার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো বিকিরণ করতে লাগলেন। ডিরোজিও ছিলেন তাঁদের নিত্যসহচর। তাঁরা সর্বত্র পরিচিত 'ডিরোজিয়ান' নামে, আর তাঁরাই ছিলেন তৎকালীন সমাজের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও স্বাধীনচেতা বিপ্লবী তরুণ দল। তাঁদের সভাগুলিতে ডেভিড হেয়ার, উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের প্রাইভেট সেক্রেটারি, বিশপ কলেজের প্রিন্সিপাল, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রভৃতি বহু গণ্যমান্য শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সমাবেশ ঘটত। এই দলের সভাপতি ছিলেন স্বয়ং ডিরোজিও, আর সম্পাদক ছিলেন উমাচরণ বসু।
এই সময়েই গোঁড়া ব্রাহ্মণ ও রক্ষণশীল হিন্দু সম্প্রদায় নানাভাবে ডিরোজিয়ানদের উত্যক্ত করতে থাকে। একথাও সত্য যে, তারুণ্যের অদম্য আবেগে ইয়ং বেঙ্গল দলে কিছু কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা---যেমন, মদ্যপান, নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ, ধর্মবিরোধিতা দেখা যেত। প্রাচীন ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে থাকা অথবা নবযুগের প্রগতিশীল ধারা গ্রহণ--- এদের কোনটি শ্রেয়, তা নিয়ে সংঘর্ষও ঘটত। ইয়ং বেঙ্গল দলের অন্যতম নেতা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় রক্ষণশীলদের চাপে পড়ে বাসস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। অন্যান্য নেতৃস্থানীয় তরুণ নেতারাও নানাভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে থাকেন।
এই পরিস্থিতিতে ধূর্ত ইংরেজ শাসকেরা পরোক্ষে সনাতনপন্থীদেরই প্রশ্রয় দিতে থাকে। শুধু শাসনকার্যের সহায়ক হয় সেইটুকু ছাড়া পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে তারা ছিল একেবারেই অনিচ্ছুক। যে সামান্য পাশ্চাত্য শিক্ষা এদেশে প্রবর্তিত হল, তারই প্রভাবে আধুনিক প্রগতিশীল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি এদেশের তরুণ সম্প্রদায়ের আগ্রহ দারুণ বেড়ে গিয়েছিল। সে আগ্রহের বাস্তব ভিত্তি ছিল প্রগতিশীল জীবনযাপনের তথা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের তাগিদ। এই আগ্রহ সৃষ্টির সমস্ত কৃতিত্ব ইয়ং বেঙ্গল দলের ডিরোজিয়ান কর্মীবৃন্দ দাবী করতেই পারেন।
গোঁড়া ব্রাহ্মণদের চাপে এবং কর্তৃপক্ষের স্বার্থে ডিরোজিও কর্মচ্যূত হলেও হতোদ্যম হলেন না। যে জ্ঞানের আলো তিনি হিন্দু কলেজে জ্বালিয়েছিলেন, তা ক্রমশই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নিজের সর্বস্ব দান করে তিনি 'The East India' নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করলেন। তাঁর ছাত্র কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩১ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে প্রকাশ করলেন 'The Inquirer' নামে একটি পত্রিকা এবং আরেকজন ছাত্র দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় মাত্র সতেরো বছর বয়সে প্রকাশ করলেন একটি অগ্নিবর্ষী পত্রিকা--- 'জ্ঞানান্বেষণ'। ১৯৩০ সালেই তাঁরা 'Hindu Free School' নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুলের ১৯৩২ সালের প্রথম পরীক্ষায় লেখা হয়---"The rays that have emated from the Hindoo College and that are now diverging to other places must eventually dissipate the mists of ignorance and superstition."
ডিরোজিও তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ সম্বন্ধে নিশ্চিত থেকেও তার সফল প্রয়োগ দেখে যেতে পারেননি। রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু সমাজের নানা অপমান আর অত্যাচার সহ্য করে মাত্র বাইশ বছর বয়সে এই তরুণ মহাচিন্তাবিপ্লবী ১৮৩১ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর কলেরায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় পরলোকগমন করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর সুযোগ্য ছাত্রেরা স্বাদেশিকতায় চূড়ান্ত প্রগতিশীলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সমাজের বিকাশ ও অগ্রগতিতে বৃহত্তম কৃষক শ্রেণীকে সাথে নিয়েই চলতে হবে, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই বিদেশী শক্তিকে উৎখাত করে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের কর্তা হতে হবে---এই উপলব্ধি সেযুগে একমাত্র ইয়ং বেঙ্গল দলের অগ্রগামী নেতাদের কাছেই পাওয়া গিয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে ভারতে আর কোনও সংগঠিত দল বা গোষ্ঠী এধরণের মতামত প্রচার করেনি। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ডিরোজিও এবং তাঁর ইয়ং বেঙ্গল দলভুক্ত ছাত্রনেতারা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে প্রগতিশীল সমাজ চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যোগ্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ডিরোজিওর অন্যতম ছাত্র প্যারীচাঁদ মিত্র মনে করতেন শাসনশক্তির মূল ভিত্তি দেশের বৃহত্তর কৃষক ও পরিশ্রমী জনসাধারণ---মুষ্টিমেয় ধনী ও জমিদার নয়। সুতরাং শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাই শাসনকর্তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। বাংলার রায়ত শ্রেণীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দীনতার জ্বালা অনুধাবন করতে সর্বপ্রথম প্যারীচাঁদ যতটা উদ্যোগী হয়েছিলেন, সমকালীন আর কেউ ততটা হন নি। নিজের শক্তিশালী লেখনীর সাহায্যে তিনি সরকারের দরবারে বার বার দাবী পৌঁছে দিয়েছেন। ডিরোজিওর আরেক শিষ্য রামগোপাল ঘোষের মতোই তিনিও সিংহলী আর নিগ্রোদের মতো ভারতীয়দেরও কলোনির অধিবাসী হিসেবে পার্লামেন্টে আসন দাবী করেছিলেন।
শিক্ষাদান শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের শহুরে সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার বিরুদ্ধে ইয়ং বেঙ্গল দলের নেতা কিশোরীচাঁদ মিত্র রুখে দাঁড়ান।বিচার ব্যবস্থায় দেশীয় ও ইংরেজদের পৃথকীকরণের বিরুদ্ধেও তিনি প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর ফলে লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৮৪৪ সালে বিচারব্যবস্থায় সমতা আনতে বাধ্য হন। ইয়ং বেঙ্গল দলেরই তারাচাঁদ চক্রবর্তী এবং দক্ষিণারঞ্জন (নন্দন) মুখোপাধ্যায় তখনকার দিনেই এদেশীয়দের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানান।
ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে সমাজচেতনা বিকাশে তথা নবজাগরণে ইয়ং বেঙ্গল দলের প্রভাব অসামান্য। শিক্ষার আলোকে তাঁরাই প্রকৃত মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। বৃহত্তর গ্রামীণ জনতার অর্থনৈতিক মুক্তিই যে জাতীয় মুক্তির মূল শর্ত, সেকথা তাঁরাই সর্বাগ্রে উপলব্ধি করেন। আধুনিক সভ্যসমাজের ভিত্তি---বিজ্ঞান ও শিল্প পাশ্চাত্যে জয়পতাকা উড়িয়েছে, চার্চের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে। তাই এদেশেও ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পথে নয়, সমাজ বিকাশের প্রগতিশীল পথেই যে ভারতের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সম্ভব--- একথা ডিরোজিয়ানরাই দিকে দিকে প্রচার করতে লাগলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ইয়ং বেঙ্গল দলের শিহরণ জাগানো আন্দোলন একদিকে সরকারী কূটকৌশলে উচ্চপদ বিতরণ, আর অন্য দিকে ব্রাহ্মধর্ম ও অন্যান্য হিন্দুপুনরুজ্জীবন- আন্দোলনের ফলে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
প্রায় পৌনে দুশো বছর পেছনে তাকিয়ে অত্যন্ত বেদনার সাথেই উপলব্ধি করতে হয়, একটি যুগস্রষ্টার সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নিয়েও ডিরোজিও কাব্যে উপেক্ষিতার মতোই আমাদের সমাজ ইতিহাসেও উপেক্ষিতই থেকে গেছেন। কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তাঁর স্বল্পস্থায়ী জীবন সাধনা দিয়ে তিনি আজও আমাদের মনে চিরস্থায়ী আসন পেতে বসে আছেন। কবির ভাষায়,
"জীবনে যত পূজা হল না সারা,
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা,
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে হারাল ধারা,
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।"
[এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ৺শীতাংশু দাশগুপ্ত ২০০৫ সালে। তখন উনার বয়স ছিল ৯০ বছর। সম্প্রতি উনার পুত্র চন্দন দাশগুপ্ত উনার লেখা পান্ডুলিপিটি খুঁজে পেয়েছেন। তিনিও সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখির সাথে যুক্ত। চন্দন দাশগুপ্তর ঠিকানা:
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা--৭০০ ০৯২
ফোন---৮২৭২৯৭৬১২৮ ]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন