অণুগল্প

চোখের ভিতর আলো


ঋ তু প র্ণা  ধ র

  

নীলাঞ্জনার চোখ দুটি যেন এক বিস্ময় ছিল—পটলচেরা, দীপ্তিমান, স্বপ্নময়। চোখের দৃষ্টিতে যেমন ছিল রঙের খেলা, তেমনি ছিল গভীর অনুভবের ছায়া। ছবি আঁকত সে— পাহাড়, নদী, কুয়াশা, শিশির, আর মানুষ। ছবিগুলো যেন তার চোখ দিয়েই কথা বলত।


বন্ধুরা মাঝেমধ্যে মজা করে বলত, “তোর চোখে রঙ আছে গো, রং চুরি করে তুই ছবি আঁকিস!”

নীলাঞ্জনা হেসে জবাব দিত, “চোখ তো শুধু দেখা নয়... অনুভবও। আমি যা দেখি, তার বাইরেও অনেক কিছু দেখি।”

এই স্বপ্নদৃষ্টি নিয়ে সে বেঁচে ছিল আপন গতিতে।


তবুও জীবন সব সময় ছন্দে চলে না। এক সকালে কলেজে যাওয়ার পথে ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের নিচে চাপা পড়ে গেল সে। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই থেমে গেল তার প্রাণের স্পন্দন। নীলাঞ্জনার হঠাৎ মৃত্যু যেন স্তব্ধ করে দিল চারপাশের রং। তার আঁকা অসমাপ্ত ক্যানভাসটা পড়ে রইল টেবিলের কোণে।


শোকের গভীরতম সময়ে, তার মা সামনে আনলেন নীলাঞ্জনার ইচ্ছাপত্র। সেখানে সে লিখেছিল, “আমি মারা গেলে আমার চোখ দুটো দান করে দিও। কোনো একজন যেন আমার চোখ দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে পায়—যেটা আমি এত ভালোবাসি।”

চোখের কর্নিয়া সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। ডাক্তাররা বললেন, প্রতিস্থাপন সম্ভব।


চোখের প্রাপক কুহেলি—এক দরিদ্র পরিবারের কিশোরী। জন্ম থেকেই অন্ধ। সে কখনও দেখে না পৃথিবীর রঙ, আকাশের বিস্তার কিংবা মায়ের মুখের আদর। আলো তার কাছে কেবল এক কল্পনা।


অপারেশনের কয়েক সপ্তাহ পর, প্রথম আলো এসে পড়ল কুহেলির দৃষ্টিপটে। প্রথম যা সে দেখল, তা ছিল জানালার ধারে রাখা একটা হলুদ গাঁদা ফুল। তারপর আস্তে আস্তে খুলে গেল রঙের দরজা—সবুজ ঘাস, মায়ের মুখ, বাবার চোখে জল, নীল আকাশ, মেঘের নকশা।


কুহেলির ভেতর যেন এক নতুন পৃথিবী জন্ম নিল। আগে সে অনুভব করত, এখন সে দেখতে পায়। সেই দেখাকে ধরে রাখার জন্য সে রঙ-তুলির আশ্রয় নেয়। কুহেলিও শুরু করে আঁকা। তার ছবিতে থাকে বিস্ময়, আলো, আর এক গভীর কৃতজ্ঞতা।


কয়েক বছর পর তার প্রথম একক প্রদর্শনী হলো শহরের একটি ছোট্ট গ্যালারিতে। প্রদর্শনীর প্রথম ছবিটার নাম—“চোখের ভিতর আলো”।

সেই ছবিতে ছিল একজোড়া দীপ্ত চোখ, যেখান থেকে বেরিয়ে আসছে রঙধনুর রেখা।


এক দর্শক জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি এত সুন্দর আঁকো কীভাবে?”

কুহেলি মৃদু হেসে বলেছিল, “এই চোখ আমার নয়। এ আমার পরম প্রাপ্তি। এক দেবীর উপহার। যার চোখে স্বপ্ন ছিল, আমি এখন তার স্বপ্নের পথ ধরে হাঁটি।”


প্রদর্শনীর এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধা—নীলাঞ্জনার মা। চোখে জল, মুখে হাসি। হয়তো মেয়ের প্রাণ ফিরেছে অন্য চোখের আলোয়।

তাঁর মনে হলো, মৃত্যুর পরেও কেউ বেঁচে থাকতে পারে অন্য কারও জীবনে—অন্য কারও দৃষ্টিতে।




মাতৃ রূপেণ সংস্থিতা


পা র মি তা  দা স  চৌ ধু রী 


এবারের ট্রেন যাত্রায় আমার প্রায় সব সহযাত্রীই কুম্ভমেলায় যাচ্ছিলেন। এদের মধ্যে এক বিহারী দম্পতিও ছিলেন। তাদের সাথে গল্পে কথায় সময়টা ভালোই কাটছিল। কিন্তু কোচবিহারে এসে একটু ছন্দপতন হলো। সেই দম্পতির বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে কোচবিহারে। সাধারণত এখানে ট্রেন থামেনা। কিন্তু এবার হয়তো ক্লিয়ারেন্স না পেয়ে সেখানে ট্রেনটি প্রায় আধঘন্টার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। মা বারবার মেয়েকে ফোন করে আফশোস করছিলেন। যদি আগে জানতেন তাহলে মেয়ে ষ্টেশনে আসলে একটু চোখের দেখা হয়ে যেত। আমি একমনে সেই বিষন্ন চোখের দিকে দেখছিলাম। তার বুকে দলা পাকানো কান্নার ঢেউ আমার মাতৃহৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, এই বিরহ তো চিরন্তন। আসলে আত্মজার মাঝেই আমরা নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পাই। তাই প্রতিনিয়ত তাকে চোখের সামনে দেখতে চাই। কিন্তু সংসারের দোটানায় তা আর হয়ে ওঠে না। সেই বিহারী দম্পতির বিষন্ন মুখের দিকে চেয়ে আমার মনে ভেসে ওঠে আমার মেয়ের মুখ। তার সাথেও আমার নমাসে ছমাসে দেখা হয়। পড়ালেখার জন্য সেও থাকে দুর শহরে। আমি যেমন তার ছুটির অপেক্ষায় থাকি, তেমনি বুঝি মা মেনকাও অপেক্ষা করেন উমার জন্য। আবদার করেন, "গিরি এবার উমা এলে, আর উমায় পাঠাবোনা"। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। উমাকে পতিগৃহে ফিরতেই হয়। ভালো থাকুন পৃথিবীর সব মায়েরা। প্রতিবার মহালয়ার পুন্য লগ্নে বেজে উঠুক,"যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা"।





বিড়াল তপস্বিনী


র ত্না  রা য় 


"আঁ,আঁ, আঁও...,"


"না সোনা না, এই তো হয়ে গেছে।  আর একটু।


আহ্ মা, কি যে করো না!  ওর লাগছে দেখতে পাচ্ছ না!"


দেখতে তো সবই পাচ্ছি বাছা। কিন্তু তোমরাও একটু দেখো  এদিকে। আমি বলে নিজেকে মাতঙ্গিনী হাজরা ভেবে 'আগে কেবা প্রাণ, করিবেক দান' মনে মনে জপতে জপতে গোটা হাতে কাপড় বেঁধে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছি। অবশ্য সেনাপতি সেজে আগে প্রাণ ত্যাগ করার কোনো ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনটাই বাকিদের নেই। অতএব ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো এই আমি। কিন্তু সে না হয় আমি একটু মানবসেবা, থুড়ি জীবসেবা করেই দিলাম। সেই যে রামকৃষ্ণদেব কি যেন বলেছিলেন, 'জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।" একটু না হয় বৈকুন্ঠধামের পথ পরিস্কার করলাম। কিন্তু তা বলে সামান্য সৈন্য‌ সেজে পায়ের সাথে পা তো মেলাবি! সেটাও যদি ঠিকঠাক না পারিস, চিয়ার লিডার হয়ে উৎসাহ তো অন্তত দিবি। বেশি কিছুতো আর চাইছি না, বলছি তো আর না, তুই তোর নিজস্ব ঝিঙ্কুমামণিকে ছেড়ে আর তোর পাপা মুখবইএর এলোকেশী, উড়োকেশী সইদের ছেড়ে আমার সাথে নীলচে আলোয় ডিনার করতে চলুক তাহলে!


সব একেবারে জ্ঞানদানন্দন। জ্ঞান দিতে পারলে আর কিছু চায় না। কথার ছিরি দ্যাখো। যেন জন্ম থেকেই বেলগাছিয়া হসপিটালে ডিউটি করছি। মনে হচ্ছে এক থাপ্পড়ে বত্রিশ পাটির অন্তত দু'চারটে ফেলে দিই। কিন্তু সে ম্যাঁও তো আমাকেই সামলাতে হবে। সব তো একেবারে নবাবের বেটা খাঞ্জা খাঁ।  তবু রাগ তো আর তার বাপের কথা থুড়ি বাপের ছেলের কথা শোনে না। তাই তিনি অল্পবিস্তর স্ফুলিঙ্গ ছড়ালেন। 


"কি করছি দেখতে পাচ্ছিস না! বড় বড় দুটো চোখ তো দিয়েছে ভগবান। শুধু দুটো কেন আবার তারপরে আরও দুটো চোখ হয়ে বসে গেছে অল্পবয়েসেই।  জিজ্ঞাসা করছিস কেন? আমি আমারটা ঠিকই করছি তোমরা দুজনে একটু আলগা সোহাগ কম দেখিয়ে এদিকে মনটাকে দাও। 


এতক্ষণ ধরে একটু বড় করে হাঁ করাতেই পারলি না। আর এই যে  নবাব আলীবর্দী খাঁ আলোটা ঠিকমতো ধরে পথটা দেখাও। খালি এপাশ ওপাশ করছে। ফোকাসটা কোথায় তোমার! 


অবশ্য তোমাকে বলে আর কি হবে, দোষটা তো আমার। কাকে দিয়েছি রাজার পার্ট! যে জীবনে ফোকাস কি তাই জানেনা...."


"তুমি কি বিশ্বরূপ দর্শন করবে! এইটুকু তো শরীর আর কতটা বড় চাইছো তুমি!" ছেলের বাবা কিছু না বললেও ছেলে ফোঁস করে উঠলো।


বুঝি বাবা, আমি সবই বুঝি। পাপার হেনস্থা তুমি কি আর সুচক্ষে হজম করবে। ফোস্কা তো তোমার গায়ে পড়বেই। কুছ পরোয়া নেই আমি একাই তোদের মতো একশো জনের পাল্লা টানতে পারি।



"নিজেরা করো না। শখ তোমাদের আর শখদারী মায়ের!" 


টিঙ্কা মাছি ঢুকে যাওয়া মুখেই বলে ওঠে," শখটা তো বুঝলাম। শখদারীটা কি বস্তু!"


"শখ+ জিম্মাদারী" মহিমার সংক্ষিপ্ত গম্ভীর উত্তর।


বাপবেটা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। 


টিঙ্কা ফিক করে হেসে বলে ওঠে। উফ্ মা তুমি ইংলিশে কাঁচা জানতাম। কিন্তু বাঙলায় তুমি এভাবে চালালে শিগ্গিরী কাঁচা বাদামের মতোই ভাইরাল হয়ে যাবে। তুমি বরঞ্চ মা একটা বাঙলায় নতুন অভিধান লেখো। নাম দাও 'কিম্ভুতাকার কেতাব' বা 'কেতামারা ক্যারদানী' একেবারে বেস্ট সেলিং। 


কয়েকদিন ধরেই আমিও গাড়িটাকে চেঞ্জ করবো ভাবছিলাম। এবার আর তাহলে চিন্তা থাকলো না। স্পন্সর তো বাড়িতেই..."


আর একজন এতোক্ষণ ধরে হাসি চাপার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছিলো। এখন সে হাসি আর বারণ না মেনে পুচ করে বেরিয়ে এলো আর তার সাথে ফাউ, গা জ্বালানো বাক্যি।


"বুঝলি টিঙ্কা নামটা আর একটু ধামাকেদার হলে ভালো হয়। যেমন ধর, অষ্টাবক্রের অষ্টাক্ষর হলে কেমন হয়?"


কি অপমান! কি অপমান! সীতা, কেন পাতাল প্রবেশ করেছিলো এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি। একটু আধটু লেখালিখি করি বলে, বলে কিনা, কিম্ভুতাকার কেতাব, কেতামারা ক্যারদানী! আর বাপ তো আরো সরেস, তিনি আবার নীচে নামতে নামতে বডি সেমিং এ এসে পৌঁছেছেন। না হয় তড়বড় করতে করতে একটু, না, না একটু নয়, বেশিই পড়েই যাই। এমনকি এই ক্যাটাগরিটা থাকলে, এতোদিনে গিনেস বুকের বিশ্বরেকর্ডটা আমার জিম্মাতেই থেকে যেতো। এটাও ঠিক শরীরের নানা জায়গায় নাটবল্টু দিয়ে টাইট করাও আছে। তাই একটু খুঁড়িয়ে ঝুঁকে হাঁটতে হয়। তার জন্য এভাবে বলবে! না, এদের জন্য সীতা নয়। পাঞ্চালির প্রয়োজন। রক্ত দিয়ে চুল বাঁধবো, না হলে কালি ছিন্নমস্তা। ধ্যুত সে তো জ্ঞাতির রক্ত, আর এতো নিজের রক্ত। কত যে জ্বালা জননীর। 


"উঁ উঁ, উঁ..," মহিমা আফশোস করার আগেই এমিটা আবার যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো।


আহারে, বেচারা অবলা জীব। যতই হোক পেটে না ধরলেও আমিতো ওরও যশোদামা। এইসব তেএঁটে, তেলচিটে, তেলাপোকাদের ফরফরানিতে কান দিলে এখন চলবে না।


এমির যন্ত্রণা তখন অন্য বুকেও জ্বালা ধরিয়েছে। আমি ছাড়লেও তাই কমলি ছাড়নেওলা পার্টি নয়।


"শখদারী! এই তোমার শখদারীর নমুনা! কতবার বলেছি তোমাকে ওকে মাছ, দুধ দেবে না। ও খেতে চায় না। আর দিলেও কাঁটা বেছে, ছাল ছাড়িয়ে দেবে। তুমি তো কোনো কথাই শুনবে না। সব ব্যাপারে তোমার ওস্তাদি..,"


"থাম, থাম, কেউ কোনোদিন শুনেছে বেড়াল বলে মাছ খাবো না, করেছি একাদশী। তিনি চিজ খাবেন, পনীর খাবেন, পায়েস খাবেন চেটেপুটে। তাও আবার মিষ্টি একটু কম থাকবে। বেড়াল বলে কি আর ফিগার সচেতন হতে পারবে না। যতই হোক এমি ওয়াইনহাউসের নামে তেনার নাম। নামেরও তো একটা মর্যাদা আছে নাকি? মালিক তো শখ মিটিয়েই ক্ষান্ত বেড়াল, কুকুর, পাখি, মাছ। ম্যাও সামলাতে আছে তো এই একজন অবলা, গৃহপালিত জীব। তার দিকেও তো মাঝে মাঝে নজর দিলে পারো। খেটে খেটে হাড় একেবারে কালি হয়ে গেলো। যতসব আদ্যিখেতা।" এই আদ্যিখেতায় যে মহিমারও ষোলআনার জায়গায় আঠারোআনা প্রশ্রয় আছে সেটা বেমালুম চেপে গেল। এই সুযোগ, হাতি কাদায় পড়েছে। অতএব ডাইনে বাঁয়ে না দেখে শট নিয়ে যাও। গোলকিপার আর স্টপার দুজনেই সেম সাইড গোল খেতেও রাজি। 


ঠিক তাই। 


"তুমি যদি অবলা হয়ও সবলা তবে কে..,"


বাকীটা টিঙ্কা বলার আগেই ওর পাপা হইহই করে ওকে থামিয়ে দিলো, "আরে দ্যাখো দ্যাখো এমিটা কতো কষ্ট পাচ্ছে। 


আরে বাবা, পাকা মাথার অভিজ্ঞতার ও তো একটা দাম আছে। কর্পোরেট অফিসের বড়বাবু, নরমে গরমে সাবঅর্ডিনেটদের দিয়ে কাজ করার পলিসিটা ভালোই রপ্ত।


না, সত্যিই বেচারা খুব কষ্ট পাচ্ছে। এসব উড়নচণ্ডীদের সাথে এই দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন হীন অনন্তকালের আলাপচারিতা তো চলতেই থাকবে। তার থেকে এমির দিকে ইমিডিয়েট পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। 


"এই যে, এই যে। যাক বাবা বেরিয়েছে।" এমির মুখ থেকে মাছের কাঁটাটা বের করে আনার আনন্দে মহিমার আর্কিমিডিসের মতোই নাঙ্গা নাচ নাচতে ইচ্ছে করছে।


ততক্ষণে কৃতজ্ঞ এমি আদরের গুড়গুড় করে আওয়াজ করতে করতে আমার পায়ে তার মাথা, মুখ ঘষে যাচ্ছে। আর এমির মালিক, এতোক্ষণ যে দোষারোপের ফোয়ারা ছোটাচ্ছিলো এখন সব ভুলে "মা মা, তুমি জিনিয়াস।" বলতে বলতে জড়িয়ে ধরে দুই গালে দুই চুমু।


মহিমা ভাবতে থাকে বাড়িটার নামটা এবার একটু পাল্টে নেবো। শুধু নীড়ের বদলে স্বর্গনীড়। 


কেমন হবে বলুন তো?






নির্বাণ


দে বা শী ষ  স র খে ল 


তার ভীষণ সফল দাদাদের মাঝে নীলু একজন অসফল মানুষ। সে অবিবাহিত, নিজে রান্না করে খায় এবং টিউশন করে তার দিন চলে। মা বেশ কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন।


বাবা ইদানিং আর কাউকে চিনতে পারছেন না।

 

বড় ছেলে সাফল্যের শিখরে। প্রায় দু দশক আমেরিকাবাসী। এক দশক কোন যোগাযোগ নেই।তবু কেউ এলেই বাবা বলেন, বিলু এলি? বৌমা ভালো আছে তো? নারীকন্ঠ পেলেই বলেন, হাসি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার অপেক্ষাতেই তো আছি? বলা বাহুল্য, হাসি তার ধর্মপত্নী। তার স্মৃতি বিভ্রম এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে খাওয়ার দশ মিনিট পরেই বলেন, কই খাইনি তো, খেতে দে নীলু।


ওঠার শক্তি থাকলেও বিছানা ছাড়তে চান না, বিছানা ভিজিয়ে ফেলেন অনেকবার। তাতান নীলুর বিশেষ বন্ধু। নীলুকে দেখে তার ভীষণ খারাপ লাগে। জীবনটাকে কেটে ছেঁটে সে ন্যাড়া করে ফেলেছে। কোন শখ আল্লাদ নেই, যৌবনেই জরা তাকে যেন গ্রাস করেছে। মলিন মুখ, কলে পড়া জন্তুর মত অবস্থা। 


তাতান ইদানিং শাক্যমুনির খুব ভক্ত। প্রত্যহ কুঞ্জছায়ায় পঞ্চশীল পাঠ করার জন্য মন্দিরে যায়। প্রভুর চরণপদ্মে পুষ্পার্ঘ্য প্রদান করে। আসলে তার প্রার্থনা একটিই নীলু মুক্তি পাক, তার পিতৃদেব নির্বাণ লাভ করুন।





অজানা মন


র ঞ্জ না  বি শ্বা স


স্টেশনে এসেই বজবজ লোকালটা পেয়ে গেল সুমন, যাক্ ৫: ৩০ এর মধ্যেই ট্রেনটা বালিগঞ্জ পৌঁছে যাবে, মাধবী গড়িয়াহাট আনন্দমেলার সামনে দাঁড়াবে। মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আজ মাধবীর সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। দিদিভাইকেও ডেকেছে মাধবী, আজ সব জানিয়ে দেবে বলেছে। দেখা যাক ও কতদূর কি পারে! সুমন নিজের মনটা বুঝে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে, কই আজ তো মাধবীকে ছাড়ার কথা ভেবে কোনো কষ্ট হচ্ছে না! একদিন বারবার মাধবীকে বলতো মাধু আমাকে বিয়ে করবে? আর মাধবী বলতো দূর বোকা যতই তোমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি না কেন তবু আমার তো আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, আমার মেয়ের আট বছর বয়স। তোমার বাড়ি থেকে কিছুতেই আমাদের বিয়েটা মানবে না, কোনো মা ডিভোর্সী মেয়ের সাথে ফ্রেশ ছেলের বিয়ে দেয়না। সুমন বারবার বলতো না মাধু আমি তোমাকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতবো। মাধবী বলতো মন আমি তোমাকে স্বার্থপরের মতো সবার থেকে কেড়ে নিয়ে ভালোবাসতে পারব না, শুধু তুমি আমার পাশ থেকে সরে যেও না। 


হঠাৎ সুমনের মনটা বর্তমানে ফিরে এল, ট্রেন বালিগঞ্জ ঢুকছে। বাড়ি থেকে দেখাশোনা করে দিয়ার মতো একটা সুন্দর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর মাধবী, মাধবীর মেয়ে ছোট্ট মোহর- ওদের আজ অনেক পর লাগে। মাধবীর সব গুণ, অনমনীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ার রূপের কাছে সুমনের চোখে আজ সব ফিকে হয়ে গেছে। নাহ্ ছটায় দিদিভাই আসার আগেই মাধবীর সঙ্গে সম্পর্কটা শেষ করতে হবে। খুব ভুল ছিল ওকে ভালোবাসাটা; যার একবার বিয়ে হয়েছিল একটা মেয়ে আছে তাকে স্ত্রী বলে সমাজের কাছে পরিচয় দেওয়া অসম্ভব। 


ঐ তো আনন্দমেলার সামনে মাধবী মোহরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সুমন কে দেখেই ছোট্ট মোহর আঙ্কেল বলে ছুটে এল, কিন্তু আজ যেন মোহরকেও কাছে টানতে ইচ্ছে করছে না। ছিহ্! মাধবী না বলেছিল ও আমাকে স্বার্থপরের মতো ভালোবাসেনা তাহলে আজ আমার দিদিভাইকে সব জানিয়ে  বিয়েটা পন্ড করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, মাধবী ভালোবাসার মানেই জানেনা। চটকা ভাঙল মাধবীর ডাকে। ওহ্  তাইতো আজকে কেন মনটা বারেবারে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে;


মন? আজ তো দিদিভাইয়ের জন্মদিন, এই   গিফ্টটা দিদিভাইকে দিও বলে মাধু রিবন বাঁধা ছোটো একটা বাক্স এগিয়ে দিল। বলল আজ আমার একটু তাড়া আছে, আমি দিদিভাইকে ফোন করে যা বলার বলে দেব। বাহ্ রে চলে যাবে মানে, তুমি যে আজ আমাকে বলেছ সবকিছুর শেষ দেখে ছাড়বে? হ্যাঁ মন দেখবই তো; তবু আজ আমাকে যেতে হচ্ছে। বলেই মোহরের হাতটা ধরে মাধবী হাঁটতে শুরু করে দিল। বিরক্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে গিফ্টটা পকেটে ঢোকাতে গিয়ে রিবন দিয়ে বাঁধা সাদা খামটা চোখে পরল সুমনের। খামটা খুলে দেখল শুধু দুটো লাইন-  দূর বোকা আমি কি তোমাকে কারোর কাছে ছোটো করতে পারি! আমি যে তোমাকে ভালোবাসি। চললাম.........। ঝাপসা চোখের দৃষ্টি নিয়ে সামনে যতদূর চোখ যায় সুমন মাধবীকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে।





শারদীয়া তোমায়


শি ঞ্জী নী  চ্যা টা র্জী


মহালয়া আসতে আসতেই Whatsapp ভরতি হয় শুভ শারদীয়া মেসেজে। মেকি হেসে রিজুলও সবাইকে শুভেচ্ছা জানায়! আচ্ছা শারদীয়া, তুমি কী বেঁচে আছো? কুমোরটুলির কিছু ফটো, অসংখ্য সেলফি আর মিথ্যে হাসিতে তোমার কষ্ট হয়? পুজো বলতে রিজুল বুঝতো বাড়ি ফেরা, বুঝতো তাকে চোখ ভরে দেখার চারদিন আর ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে সরল সেই হাসিতে ফিরে যাওয়া...!


বছর চারেক পেরিয়ে গেছে, তার কথা বলতে গেলে রিজুলের মনে পড়ে একটা গান, "চোখে আমার তৃষ্ণা.."। আর ছোটবেলার বাকি সকলকে দেখেও মনে হয় ভাঙা কাঁচের টুকরো, ভালো আছি বলতে হবে বলে ভালো থাকা! এই চারদিন যেনো শুধু রঙিন গ্লাস আর হাতে পুড়তে থাকা সিগারেটের সঙ্গেই সবার সবচেয়ে বেশী বন্ধুত্ব! শারদীয়া, তুমিই কি এসবের কারণ নাকি তুমি সত্যিই আর নেই?


আজ বছর চারেক পর রিজুল দেখলো তাকে... সেই ফলসা শাড়ি, মুক্তোর মতো হাসি আর ছোট্ট টিপ... রিজুল চোখ সরালো না... মনের ক্যামেরায় যতক্ষন পারলো, বন্দি করে রাখলো মুহূর্তটাকে। সওব এক আছে, সব এক? নাঃ, ঘোর ভাঙতে একটু দেরি হলো ওর, যখন বুঝলো সবার মাঝে এসেও স্মার্টফোনটা ওর বেশী কাছের, যোগাযোগের মানুষটা হয়তো দূরে! বুঝলো ওরা অপরিচিত, সে আর তাকায় না আড়চোখে রিজুলের দিকে!কথার মধ্যে থেকে যায় শূন্যতা। Rebound কথাটা শুনেছে রিজুল, এবার দেখেওছে, শুধু ভাবেনি সেও ভুলে যাবে চিরন্তন ভালোবাসাটা... শারদীয়া, তুমি শুধুই উপলক্ষ্য, তোমার অস্তিত্ব আজ বড্ডো ম্রিয়মান! তুমি হারিয়ে যাচ্ছো বা হারাতে দিচ্ছো!


রাতের নিভু নিভু আলোয় রিজুল খালি নিজেকে প্রশ্ন করে, তবে যে সে বলেছিলো, "তুমি সারাজীবন আমার!" রিজুল যে শুধু সেই নিয়ে বেঁচে আছে, থাকবে আজীবন! শারদীয়া, তুমি সবার কাছে নতুন রূপে আসতে পারো, তবে রিজুল যে গাইবেই,"আমি রূপে তোমায় ভুলাবো না..."।আজ নবমী, তোমায় আমি বাঁচিয়ে রাখবো আমার মধ্যেই। জানি, দশমীর আগেই নিজেকে ভাসিয়ে এসেছো আজ... তুমি নেই!


ঠিক তোমারই মতো সে অন্য কারো সঙ্গে বেঁধেছে ঘর।রিজুলের বিসর্জনে যেনো শুনতে পাচ্ছিলো ও, সে যেনো কবেই তো বলে গেছে, "খেলার সাথী, বিদায় দ্বার খোলো.."। তবে রিজুল ভালোবাসায় গেয়ে যাবে, "আমার ভিতরও বাহিরে, অন্তরে অন্তরে আছো তুমি..."।


আজ আর আদিগন্ত নীল আকাশ নেই, সেই কুঞ্জবীথি নেই!তবে রিজুল জানে, একদিন ঠিক জেগে উঠবে তুমি, সবাই রঙিন গ্লাস আর মিথ্যে হাসির সেলফি ছেড়ে ছুটে যাবে কাশবনে! আবার সারাজীবনের জন্যেই ভালোবাসবে, আবার বন্ধুরা মিলে ছোট্টবেলার গল্পে মাতবে... আবার আসবে সেই পুরোনো দিন... শারদীয়া ভরে থাকবে অনেক রিজুল আর সেই মুক্তো হাসির মতো তাদের নিয়ে... অপেক্ষার সেতু ভাঙবে না আর! আর যেদিন আসবে তুমি, কোনো এক রিজুল তার ভালোবাসার মানুষকে পাঠাবে ছোট্ট চার লাইন,


বছর গুলো ফিরিয়ে নিলাম সব কেটে,

তোমায়, আমার করে রাখলাম বেঁধে!

তারপর?

আগের মতোই ভেজা চোখে তাকাই,

তোমার হাতে হাত রয়েছে রাখা...

একবার শুধু আবার জানতে চাই,

তোমার আমার কাল কখন হবে দেখা...?


শুভ নবমী... ফিরে আসুক হারানো সেইদিন... শাশ্বত হোক শারদীয়া। মনে মনে সবাই হয়তো রিজুল, মনে মনে সবার চাওয়া বোধহয় এটুকুই...।






ক্ষতি কী হলো


র ত্না  দা স


আমার ঊনসত্তুরে বাবাকে আজকাল বেশ খুশি খুশি দেখায়। সেদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলাম, 'রিমঝিম গিরে শাওন' গানের সাথে পা নাচাচ্ছেন। কী আশ্চর্য রবীন্দ্রসঙ্গীত বা নজরুলগীতিই তো শুনতো সবসময়!


বাবা কিন্তু পুরোদস্তুর আমার বন্ধু। মা চলে যাওয়ার পর কৈশোর থেকে যৌবন সবেতেই বাবা আমাকে আগলে রেখেছেন। তাই খুব সহজ সম্পর্কের সুতোয় আমরা বাঁধা আছি।


একদিন দেখলাম ল্যাপটপে কার সাথে বেশ চ্যাটিং করছেন। আমি সামনে দাঁড়াতেই একটু আড়াল করছিল, আমি বললাম,

'কী লুকাচ্ছো, তোমার তারুণ্যের উৎস কী!'


এবার বাবা ধরাপড়া মুখ একগাল হাসিতে ভরিয়ে বললেন,

'ডেটিং অ্যাপস'।

আমি তো পুরো পাজলড! 

'সেকি! বাবা এখন এসব! বয়স কত খেয়াল আছে!'

'আরে প্রেমের কোনো বয়স হয়না বুঝলি! দ্যাখ সেই কবে থেকে একলাই তো আছি। এখন যদি ডিলেইড বসন্ত ডাক দেয় সাড়া না দিলে চলবে!'

' বাবা তুমি ম্যানেজ করতে পারবে!'

'কেন নয়, তিনিও কিছু সুইট সিক্সটিন নয়, তিনিও পঁয়ষট্টির উইডো।'

'মা কে ভুলে গেলে! বলতে যে মা-ই তোমার একমাত্র প্রেম।'

'তা তো অবশ্যই। যে জায়গাটা তোর মা'র, সেটা আর কাউকে দেবো কি করে! তবে সাইড বিজনেস চালানোই যায় কি বল!'


ল্যাপটপে ছবিটা কেমন যেন চেনা লাগলো। আমার ফিঁয়সেকে দেখালাম, সে তো আঁতকে উঠলো,

'আরে এ তো আমার মা!' আমরা কি করবো! এরা আর কাউকে খুঁজে পেলোনা!'


বাবাকে গিয়ে জানালাম সবটা। বাবা কিন্তু বেশ খুশি। বললেন,

'দ্যাখ তোরা তোদের ভবিষ্যৎ ভাব। আমরা তো আর নিজেদের কোনো বন্ধনে জড়াবোনা কিন্তু আমরা যদি একটু ডেটিং চ্যাটিং করি তবে অসুবিধে কোথায়! তোর ফিঁয়সেকে তো আমার ভারি পছন্দ, খুব ভালো মেয়ে, তার সাথে যদি তার মা' ও পছন্দের তালিকায় থাকে, তো বাত কেয়া!'


আমরা দুই প্রেমিক প্রেমিকা মিট করে জানলাম, ওর মায়েরও নাকি একই কথা। যৌবন চলে গেছে বাচ্চা বড় করতে করতে, আর বিয়ের সময় কেউ জানতে চায়নি পাত্র পছন্দ কিনা, তা এখন যদি কাউকে মনে ধরে, তার সাথে কিছুটা ভালোলাগা, ভালোবাসা শেয়ার হয় তাতে গোটা পৃথিবীর কী ক্ষতি!


যাক মধুরেণ সমাপয়েৎ। আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের বাবা ও আমাদের মা দুজনেই গভীর মনোযোগী ছাত্রছাত্রী হয়ে প্রেম করছেন। সত্যিই ক্ষতি কী! বাবার ফোন বাজলেই আমি গুনগুন করি বাবার কানের কাছে, 'বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।' বাবাও মুচকি হেসে বলেন, 'আমায় গুণ করেছে, খুন করেছে ও বাঁশি।'





ভাবনা


ম ঞ্জু শ্রী  দা স


শরীরের অসংখ্য শিরা-উপশিরার মত বাড়ির গা বেয়ে উঠে গেছে, নেমে গেছে অগুনতি লোহা আর প্লাস্টিকের পাইপ। কোনটায় বর্জ‍‍্য জল, কোনোটায় পানীয় জল।


কিছু মানুষের থাকে অবিরত অসন্তোষ, আবার কিছ মানুষের আছে শেষ বয়সের ফেলে আসা  জীবনের ঝক্কি পেরোনোর পর অত্যন্ত সন্তুষ্টি। 


অগুন্তি সিঁড়ির ধাপ পেরোতে হয় না এখন এঘর থেকে অন‍্য ঘরে পৌঁছতে--- তবু, পৌঁছনো হয় না--- জানা হয় না, পাশের ঘরের প্রতিবেশীকে--- বাধাটা কোথায়?


একেবারে নীচে আগেকার গাড়ি বারান্দার মত এক বিশাল চত্বর--- লোহার গ্রিলের দরজা দিয়ে আটকানো, ভেতরে ছয় থেকে আটটা গাড়ি রাখার জায়গা--- বিভিন্ন মডেলের, বিভিন্ন রংয়ের, বিভিন্ন মালিকানার গাড়ি।


শুধু দুটো পরিবার জীবনের শেষ সম্বলে খরিদ করেছেন এই আকাশচুম্বী ইমারতের দুটি ঘর।  কথা তাদের ফুরিয়ে গেছে, আজ মনের রংও ফিকে, শুধু ক্ষীণ দুটি  দেহ, পাশাপাশি, নড়েচড়ে নিজেদের বেঁচে থাকা প্রমাণ করে  রোজ রোজ। খোঁজ রাখে সবাই, খবর রাখেনা কেউ।


শহরের বুকে এক মালিকানার বাড়ি এখন খুব কম। কেন এমন? ইতরেতর প্রাণী মানুষের চেয়ে কম বুদ্ধিমান, অশিক্ষিত, কম বোঝে, কম জানে,--- তবু, কাকমায়ের স্নেহের প্রশ্রয়ে এবং ভরসায় মা-কোকিল ডিম পেড়ে চলে যায়। ভরা পোয়াতি মা--- কুকুরটা মরে যায় বাচ্চা প্রসব করেই, পাশের বাড়ির বিন্তি নামের মেনিটা তার নিজের বাচ্চাগুলোর সাথে নিশ্চিন্তে সারমেয়বাচ্চাদের নিজের দুধের ভাগ বসাতে দেয়। কোন কার্পণ্য নেই, ছুঁৎমার্গীতা নেই, বিচার নেই, কি করে হয় এমন?


এখন   হাসপাতালে শুয়ে থাকা শিবু, তার  নিজের মাটির ঘর চাপা পড়েছিলো--- পাড়ার অকাজের, অকর্মণ‍্য দীনু--- তার  নিজের খেয়ালে রক্ত দিয়ে এল' হাসপাতালে গিয়ে,--- কোন পুরস্কার বা টাকা পাওয়ার আশা ছাড়াই--- কি করে সম্ভব এমন 'মন '?  


যমজ ছেলে-মেয়ে দুটোকে বহুকষ্টে চেয়ে চিন্তে মানুষ করেছেন বিধবা মহামায়া--- আজ তারা স্বাবলম্বী--- প্রতিষ্ঠিত--- ছেলেমেয়ের ছোটবেলায় তাদের জন্মদিন পালন করতেন অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের সঙ্গে। আজও তারা তাদের ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালনের সেই ধারা বজায় রেখে চলেছে। কি করে, কোন শিক্ষা মানুষকে শেখায় "যে ধনে হইয়া ধনী/মণিরে, মান' না মণি/সবই তার আপনার ধন।"


মেঘহীন নির্মল আকাশ মানুষের মনে শান্তি আনে, অহংহীন নির্মল মন--- "এরা পরকে আপন করে/আপনারে পর।"





সুখপাখি


সা হা না


দুপুরটা আজ ধুলোমাখা, ধূসর। গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক দ্যাখে মিত্রা। বেশ কিছু পথচলতি দৃষ্টি তার দিকে ফিরেছে। বরাবরের মতোই তার আগুনরঙা লং ড্রেসটা মৃদুমন্দ হাওয়াতে লুটোপুটি... চোখে বাহারি লাল-সাদা ফ্রেমের রোদ চশমা.... সব মিলিয়ে কি সুন্দর যে লাগছে! চট্ করে একটা সেলফি নেবে? সেলফোনটা তো হাতেই আছে। মাত্র কদিন আগেই তো কিনল। যে সে ফোন নয়, অ্যাপেলের লেটেস্ট আই ফোন! হুঁ! এইরকম ঠাঁটবাটে থাকবে বলেই তো...


একটু আনমনা হয় আর ঠিক তখনই

-মা, কিছু দেবে? দু'দিন খাইনি...

একটা কালো রুক্ষ হাত এগিয়ে আসে।

-ইসস্! সরে যাও...

চেঁচিয়ে ওঠে সে। কি মুশকিল! এই ভিখিরি ক্লাসটাকে একদম স্ট্যান্ড করতে পারে না সে। উফফফ্!

ব্যাগ খুলে একটা পঞ্চাশের নোট ফেলে দেয় হাতের খাঁজে। কর্তব্য শেষ! এবারে গটগট করে এগোয় সিনেমা হলের দিকে।

ঠিক এইরকম, ঠিক এইরকম ভিখিরিপনা ছিল অনমিত্রর মধ্যে। সরকারী চাকুরে অথচ একদম নিম্ন মধ্যবিত্তের হাবভাব। সেইজন্যই তো এক চৈত্রের দুপুরে হুশ্ করে বেরিয়ে পড়েছিল এক চিলতে ফ্ল্যাট থেকে। আর উঠে বসেছিল অনমিত্রেরই বসের অপেক্ষমান দামী গাড়িটায়। তারপর থেকে জীবন কত রঙিন! হাত খুলে খরচ, বিলাস ব্যসন, দামী জুয়েলারি... আহ্! এই তো জীবন! দামী মাংস মদে ছিপছিপে চেহারাটা একদম পাল্টে গিয়েছে! আজ সকালে, না ঠিক আজ নয়, গত কদিন ধরেই নিজের চেহারাটা... গৃহকর্তার একটা হালকা অবজ্ঞাও যেন আস্তে আস্তে নজরে আসছে... একটা অসঙ্গতি! ভাবতেই চলার গতিটা কমে আসে। এত সুখের মাঝেও কেমন একটা কাঁটার খোঁচা ঠিক যেমন সুন্দর গোলাপের ডাঁটায় হাত দিলেই ঝটকা লাগে... ঠিক তখনই নজর পড়ল তার উল্টো ফুটে। রাস্তার ধারে পা ঝুলিয়ে বসেছে সেই কালো নোংরা হাতের অধিকারিণী, পাশে ততোধিক কালো আর একটি অবয়ব... স্বামী স্ত্রী বোঝা যাচ্ছে! একহাতে ভাতের থালা ধরে গ্রাস তুলে খাইয়ে দিচ্ছে অন্যজনকে আর হেসে উঠছে। দুজনের হাসি আর খাওয়া... খাওয়া আবার হাসি... দেখেই কেমন তাক্ লাগে। ছেঁড়া প্লাস্টিকে ফুটের জীবন! অথচ হাসি, আর এদিকে? রঙিন রামধনুটা থেকে বেণীআসহকলা-র রঙগুলো একে একে ঝরছে। চাপা দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে আসে... ভাড়া বাড়িতে ছোট্ট বারান্দা... স্বল্প আয়ের চাকুরিজীবি আর নিভৃত আলাপচারিতার বিকেল... হাসিখুশি ছবি... ছবিগুলো সরে সরে যাচ্ছে জীবন্ত বায়োস্কোপের মত।

চোখটা জ্বালা করছে কেন!


(শব্দ সংখ্যা: ২৮৮)




জয়ী


ত পু  দে ব


মা হারা জয়ী সারাক্ষণ মনমরা  হয়ে থাকে। জয়ীর বাবা অনেক চেষ্টা করেও জয়ী-র মুখে হাসি  ফোঁটাতে পারে না। জয়ীর যখন দশ বছর জয়ীর মা মারা যায়।  ক‍্যানসার মারণ ব‍্যাধীতে জয়ীর মা আক্রান্ত হয়েছিলেন। অনেক চেষ্টা করেছিল বাঁচাতে। ঠিক একবছরের মাথায় লড়াই শেষ হলো। সেদিন মাকে ওরকম অবস্থায় দেখে জয়ীর মুখ থেকে কথা হারিয়ে গিয়েছিল, একটুও কাঁদতে পারেনি। স্কুলে সব বন্ধুরাই খেলাধূলা করে আনন্দ করে জয়ী ক্লাস ঘরেই চুপচাপ বসে থাকে। স্কুল থেকে ফিরে সারাদিন আয়া মাসির কাছে থাকে জয়ী। সারাদিন অফিসে থেকেও কাজের ফাঁকে মেয়ের সমস্ত খোঁজ খবর নেন ওর বাবা, সন্ধ‍্যে হলে ঘরে ফিরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন আর মনে মনে ভাবেন এই পৃথিবীতে আমাকে একা ছেড়ে চলে গেলে তুমি দীপা, আমি যে আর পেরে উঠছি না নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে। সব রকম চেষ্টা করেও মেয়ের মুখের ভাষা ফেরাতে পারছি না,পারছি না হাসি ফোটাতে।  রাতে বাবা নিজে হাতে জয়ীকে ভাত খাইয়ে দেয়, জয়ী ও বাবাকে এক দুবার খাইয়ে দেয়। এভাবেই বাবা মেয়ের দিন কাটে।  একদিন বসন্ত কালের রবিবারের বিকেলের দিকে কোকিল ডাকছিল, জয়ীর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। জয়ী দেখেছিল তার মা ডায়েরি লিখতেন, গল্পের বই পড়তেন, জয়ীও ডায়েরি লিখতে পছন্দ করে। সে নিজের ডায়েরি লিখতে লিখতে হঠাৎ তার মায়ের ডায়েরি পড়তে ইচ্ছে হলো। ডায়েরি খুলে পড়তে পড়তে সে দেখতে পেল একজায়গায় লেখা "মা জয়ী, আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। তেমনই তোমার বাবাও তোমাকে খুব ভালোবাসেন। আমি জানি বেশি দিন বাঁচবো না। তোমার পাশে তোমার  বাবা থাকবেন। তোমার বাবা ভীষণ ভালো মানুষ। বাবার কথা শুনে চলবে। বাবা কে ভালোবাসবে। আমার জন্য  তোমার মন খারাপ হবে, তবুও হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবে।

মানুষের মতো মানুষ হবে। এমন ভাবে নিজেকে তৈরি করবে যেন তোমার ছত্রছায়ায় অনেক মানুষকে ছায়া দিতে পারো, তোমার বাবাকে একা করে দিও না। ভালো থেকো আমার আশীর্বাদ তোমার মাথায় সব সময় থাকবে।" জয়ীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে থাকলো চিৎকার করে কান্না করতে থাকলো বাবা দৌড়ে এসে জয়ীকে জড়িয়ে ধরলো 

জয়ীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল 

বাবা আমি চেষ্টা করবো হাসিখুশি থাকার, বাবা আর মেয়ের দু'জনেরই চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকলো।





পণ্য


অ র্ণ ব  ঘো ষ


গোপীবল্লভপুর। জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম। গ্রামের বছর ষোলোর কিশোরী মুনিয়া। মুনিয়া লাকড়া। মুখশ্রী আর উজ্জ্বল গায়ের রঙ দেখলে কেউ ধরতেই পারবেনা যে ও আদিবাসী পরিবারের মেয়ে। মা গত হয়েছে তিনবছর। ছোট বোন নয়বছরের। বাবা সারাদিন নেশা করে থাকে। সংসারের হাল ধরতে তাই মুনিয়াকেই জঙ্গলের কাঠকুটো সংগ্রহ করে বিক্রি করতে হয়। জীবনের লড়াই চলছিল এভাবেই।


হঠাৎ একদিন দশরথ কাকু ওর বাবার খোঁজে আসলেও দেখা পায়না। 

সন্ধ্যায়..

---কিরে দশরথ, বাড়ি কেন্ গেসিলি?

---বস্ আগে। নে (দেশী মদ হাতে ধরিয়ে দিয়ে)।

---শুন্। তুই সালা কুথায় কুথায় ঘুরিস। তোর ডাগর মেয়ে বাড়িতে একা। কিছু অঘটন ঘইটে গেলে কী হবে?

---তাইলে? 

ওকে কাজে পাঠায় দে। ভালো মাইনা পাবে। তোরও অভাব থাকবেনা।


দশরথ অগ্রিম কুড়ি হাজার টাকার প্রলোভন দেয়। মাতাল বাপ এক কথাতেই রাজী । মুনিয়াকে নিয়ে দশরথ বাবুলালের বাড়িতে যায় পরদিন। সেই ওকে নিয়ে যাবে কাজে। গুজরাটে।


---ঝাক্কাস মাল তো! গুইনে নে। পুরা সত্তুর হাজার।

---আরে বাবুলাল, তুই আমাকে কম দিবি নাকি?


রাতের ট্রেনেই চারজনকে নিয়ে বাবুলাল রওনা দেয়। খুব ভয় করতে থাকে মুনিয়াদের। 


এরপর…


সোলাঙ্কি অ্যাপার্টমেন্ট। বেসমেন্টের নীচের এক খুপরি ঘরে ওদের নিয়ে যাওয়া হয়।


---ইমরান ভাই, ডেলিভারড্।---আস্লাম, ওকে ছয় লাখ আশি হাজার দিয়ে দে।


রাতে জনা বিশেক মেয়ে নিয়ে নির্জন একটা স্থানে পৌঁছায় আস্লামরা। একটা জীর্ন পুরোনো দোতলা বাড়িতে ঢোকানো হয়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় ওদের। কি কাজ, কখন যেতে হবে কিছুই বলছেনা ওরা। একজন খাবার দিয়ে যায়। বুক দুরুদুরু, ক্লান্ত বিধস্ত শরীর, চোখ বুজে আসে। কারোরই পাত্তা নেই পরদিন। শুধু একজন খাবার দিয়ে যায়। সন্ধ্যে ঘনালে মুনিয়াকে একটা লাক্সারি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ঝকঝকে লাইট সেখানে। ঘরে একটা বড়ো স্ট্যান্ড ক্যামেরা রাখা। মুনিয়া কিছুই আঁচ করতে পারছেনা। তবে অজানা একটা বিপদের গন্ধ খুব টের পাচ্ছে।


হঠাৎ দুজনের আগমন... 


---জামাটা খুলে ফেল্। 


মুনিয়া হতভম্ব! আপত্তি করেও লাভ হয়না। এরপর অন্তর্বাস খুলতে বললে পালাতে চায় ও। বদলে জোটে সপাটে চড়।


---শালী যা বলবো করবি। এক লাখ সত্তুর হাজার মাগনা দিছি নাকি!


এরপর ক্যামেরাম্যানকে দিয়ে বিভিন্নরকম আঙ্গিকে নগ্ন ছবি তোলানো হয়। লজ্জায় অপমানে মুনিয়া লাল হয়ে যায়। ঘৃনায় থুতু ছেটাতে ইচ্ছে করে ওদের মুখে।

সে বিক্রি হয়ে গেছে। ঘুনধরা এই সমাজে অসহায় নারীদেহ আসলে পণ্য! ছিঃ, নির্মম এই সমাজব্যবস্থা, নির্লজ্জ মানবজাতি!


প্রায় চারমাস পর হঠাৎ একদিন হানা পড়ল জীর্ণ বাড়িটায়। আশি জন কিশোরীরকে উদ্ধার করল পুলিশ। বাড়ি ফিরতে পারবে এই আশায় বুক বেঁধেছে মুনিয়া। কিন্তু সেদিনই ছিল সেই অভিশপ্ত রাত! ওর কোমল শরীরটাকে খুবলে খেল কেউ। আধমরা শরীরটাকে লুটে খেতে হায়েনারা তো আসবেই, বা..র.বা..র আসবে!


সকালে বাইরে মাইকিং হচ্ছিল। কথাগুলো কানে বাজল মুনিয়ার।

“মেয়েদের সাহসী, আত্মনির্ভর হতে হবে, আত্মরক্ষার দায় নিতে হবে নিজেকেই।” মুনিয়া মনকে শক্ত করল। সংকল্প করল এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর। তারজন্য যেকোনো পদক্ষেপ নিতে সে প্রস্তুত। 


রাত একটা। দরজায় ঠকাঠক্ শব্দ। মুনিয়াকে আজ পালাতেই হবে। ঘরে পাওয়া বিয়ারের বোতলটা মাঝবরাবর ভেঙে রেখেছে ও। তেড়িবেড়ি দেখলে একদম বসিয়ে দেবে বুকের ওপর।


দরজা খুললে... কেউ নেই! শুধু একটা টেপ রেকর্ডার রাখা। অন করতেই তাতে একটা কথোপকথন। খুব চেনা গলা। হ্যাঁ বাবাই তো। মুনিয়া স্পষ্ট শুনতে পেল...


---“সাহেব আমার বেটিকে আর ফিরানোর দরকার নাই। তুই উকে রাইখে দে। আমাকে মাসে মাসে পাঠাইস্ বিশ হাজার টাকা।”





গল্প হলেও সত্যি


শ ম্পা  মু খা র্জী  কো লে 



জীবনটাকে নিপুন ভাবে সাজাতে চেয়েছিলেন নিজের মত করে। কিন্ত ঈশ্বরের কি পরিহাস।! সব কিছু ওলোট পালোট করে দিল জীবনের সপ্ত সুরের ছন্দকে।

আজ কেউ নেই একটু তাঁর দুঃখের কথা শোনার। অসহায় বৃদ্ধা সবই মেনে ও মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আশ্রয় মিলেছে বনেদী বাড়ির পরিত্যক্ত গুদাম ঘরে। তার সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে ইঁদুর, সাপ,  ব্যাঙ, চামচিকে। 

বয়সের ভারে প্রাত্যহিক জীবনের ছন্দ মেলাতে ব্যস্ত "নামিয়ে মুখ চুকিয়ে সুখ বিধাতা বিমুখ"  বৃদ্ধা। 

একদিন প্রশ্ন করেছিলাম,  আপনার আত্মীয় স্বজন তো সবাই আছে, আপনাকে কেউ দেখে না কেন? ওনার সরল প্রত্যুত্তর--- মাগো, গরীব অত্যন্ত ভাইরাস রোগ তাই......... 


কি অদ্ভুত প্রত্যুত্তর! কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ওনার যে কেউ ছিল না, তা নয়। একটি মাত্র পুত্র সন্তান ২০ বছর বয়সে দুর্ঘটনার বলি প্রায় ২৭ বছর আগে। স্বামী ৯ বছর আগে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। সম্বল বলতে পাড়া-প্রতিবেশী ভালোবেসে যা দেন পরম তৃপ্তি ভরে হাতে তুলে নেন। আর তাঁর অকৃপণ আশীর্বাদ দুহাত তুলে উজাড় করে দেন। ওনার এই অকৃপণ আশীর্বাদ পাবার লোভে আমি সময় পেলে ওনার কাছে যাই। মুখের দিকে তাকিয়ে অমলিন হাসি হেসে বলেন, ভালো আছো মা? ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি এত দুঃখ কষ্ট কি করে সাবলীল ভাবে বয়ে চলেছেন! কারর উপর রাগ, খেদ, অভিযোগ কিছুই নেই। দিনের বেশীর ভাগ সময়টা স্বামী সন্তানের ফটোর সামনে বসে থাকেন। আর কি ভেবে যান বা হয়ত মনে মনে কথা বলেন কি না জানিনা! 


৮০ বছরের শরীরটা বেশীর ভাগ দিনই এই জীবন যুদ্ধের প্রতিকূলতাকে মানিয়ে নিতে পারছেনা। কোন সুদূরের হারিয়ে যাওয়া কৈশরের শরীরটাও আজ আর কোনও কথা রাখেনা।





পুরস্কার না তিরস্কার


কু শ ল  ব র্ম ন 


ঋষভ ও মৈনাক ছোটবেলার বন্ধু এখন তারা কলেজে পড়ছে। কলেজ থেকে গল্প করতে করতে বাড়ি যাচ্ছে---

ঋষভ: আচ্ছা মৈনাক, আমি বাদে বাদবাকি সবাই ভালো, তাই নারে?

মৈনাক: কেন?

ঋষভ: আরে দেখ আমার থেকে তোরা কত ভালো পড়াশোনা করছিস!

মৈনাক: সেটা নয় বন্ধু, মুশকিল ব্যাপার হলো নিজেকে চেনা/জানা, নিজের মানসিক দিকটি বোঝা। আসলে নিজেকে বুঝে ওঠার স্বভাব নেই আমাদের কোনোদিন‌‌।

ঋষভ: তার মানে তুই বলছিস বিশেষত্ব নেই কোনও; তাই আমি  সাধারণ?

মৈনাক: হ্যাঁ। বেখেয়ালী, পাগলাটে, অগোছালো, কিছুটা নরম মনের।

ঋষভ: তাহলে আমায় কি করতে হবে?

মৈনাক: নিজেকে চিনতে শিখতে হবে; নিজেকে চিনে ওঠা একটা আলাদা শান্তি। 

ঋষভ: কিন্তু কবে হবে জানা নেই!

মৈনাক: আচ্ছা ভাব, সন্ধ্যার সেই ল্যম্প পোস্টে শহরের উজ্জ্বল আলোগুলি যদি নিভিয়ে দিই, বড্ডো চোখে লাগে। মাঠের ধারে কখনো বৃষ্টি নামে। এলোমেলো বাতাস। দমকা হাওয়া। ডুবন্ত স্রোত। ভেসে চলেছি, পারাপার নেই, কোনও ঠিকানা নেই--- গন্তব্য কোথায়, জানা নেই, অথবা শান্ত, নিশ্চুপ, ফাঁকা রাস্তায় আমি একা--- তবে কি ঘড়িগুলি সময়ের সাথে চলতে চলতে তাল মেলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে? 

ঋষভ: হ্যাঁ,  বুঝেছি এবারে। নিজের লক্ষ্য স্থির করতে হবে, সেটাকে অবহেলা করেছি। তাই তো আমার শুধুই জুটলো তিরস্কার, কোথায় পেলাম পুরস্কার!





শিক্ষা


র মে শ  দে 


রাহুল অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাড়িতে দুটো পেয়ারা গাছ লাগিয়েছিল। আজ সে বিদেশে পড়াশোনা করে। অনেক বছর বাড়ির বাহিরে আছে। মা কে ফোন করে জিজ্ঞেস করে গাছেদের কথা। গাছেদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন অনেক পুরোনো। আবার রাহুলের বন্ধু তপন ওরা দু'ভাই দুজনে অনেক বড়ো চাকরি পেয়েছে। ওর বাবা মা দু'জনে খুব অসুস্থ। ছেলে বউমা আজ আর তাদের কোনো খবর রাখে না। ওরা ভুলে গিয়েছে ভালোবাসার কথা। কিন্তু রাহুলের লাগানো গাছ দুটো আজও ফল, ফুল দিয়ে যায়। তারা জানে না 

গরীব, বড়োলোক। তারা বিচার করতে পারে না।

তারা আপনমনে, আপন ছন্দে পরিবেশকে ভালো রাখতে চায়।তারা কখনো ছেড়ে চলে যায় না। সময়, অসময়ে তারা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। তারা ফল দেয়, ফুল দেয়, বিশুদ্ধ বাতাস দেয় কিন্তু বিনিময়ে কিছু চায় না। কিন্তু তপন আর তার ভাই বিত্তহীন বাবা-মার দায়িত্ব নিতে চায়না। মানুষ কেন যে সবসময় হিংসা, স্বার্থপরতা বজায় রাখতে চায়!গাছ কিন্তু নীরবে সকলের ভালো করে যেতে চায়। গাছ যেন একবিংশ শতাব্দীর মানুষকে শিখিয়ে যেতে চায় টাকার গাছকে মনে না লাগিয়ে ভালোবাসার গাছেদের হৃদয়ে লাগাও।





ঘড়ি


র মে শ  দে


জন্মের সময় বাবা ঘড়ি দেখে জন্ম সময় লিখে রাখে। এরপর ঘড়ি যেন আর থামতে চায় না।

সে যেন বয়স বাড়িয়ে দিয়ে আপন মনে চলতে থাকে। সে যেন কারো কথা শুনতে চায় না। ঘড়ি যেন ভালো মন্দের বিচার জানে না। ঘড়ি ধনী, গরীবের ভেদাভেদ জানে না। কারো জন্য সে যেন

দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না। কোনো বারণ মানে না সে!


আজকে যে জন্ম নিলো, আবার যে বাড়িতে মৃত্যু হলো ঘড়ি যেন একদিনে করো জীবনে সুখ, আবার কারো জীবনে দুঃখ বয়ে নিয়ে আসে। একই সময়ে কারো কাজে জয়, আবার কারো কাজে পরাজয় ডেকে আনে। সে নিজ কাজে সদা বিরাজমান। সে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে চায় না। পিছিয়ে গিয়ে হারানো দিন ফিরিয়ে দিতে জানে না। নিজের গতির থেকে বেশি জোরে ছুটে কিছু পাইয়ে দিতে অপারগ। জগতে সেই যেন আসল সত্য।


সে সকালের পরে বিকেল, বিকেলের পরে রাত্রিকে ডেকে আনতে জানে। এটাই যেন তার ধর্ম। তার ধর্মে কেউ বা জিতে যায়, কেউ বা হেরে যায়, কেউ পেয়ে যায়, কেউ বা সর্বস্ব দিয়ে যায়।





প্রায়শ্চিত্ত


সু নৃ তা  রা য়  চৌ ধু রী 


বছর পনেরোর ভোলাভালা ছেলেটিকে টার্গেট করলো শিবু। ইচ্ছে করে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।স্টপেজে ছেলেটি নামবার উপক্রম করতেই পকেট থেকে পার্সটা তুলে নিয়ে নিজেও নামলো। একটু পরেই উদভ্রান্ত ছেলেটিকে ফ্যাকাশে মুখে ফিরতে দেখে ডাকলো শিবু,"এই ভাই! এটা খুঁজছো?"

উজ্জ্বল হয়ে উঠল দৃষ্টি।

"কে অসুস্থ? কার প্রেসক্রিপশন?"

"আমার মা"

"শোনো, তোমার ব্যাগে যা আছে, তা দিয়ে তো সব ওষুধ কেনা যাবে না! এটা রাখো"।

ছেলেটি কিছু বলার আগেই ওর হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে চট করে সরে পড়লো কুখ্যাত পকেটমার শিবু।


তিন বছর আগে আজকের দিনে শিক্ষিত বেকার শিবুর মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।




মূল পাতায় যান।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল ও বাসন্তী সংখ্যা || ৯ চৈত্র ১৪৩১ || ২৩ মার্চ ২০২৫

চতুর্থ বর্ষ || চতুর্থ ওয়েব সংস্করণ || বাদল সংখ্যা || ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ || ২৯ জুলাই ২০২৫

পঞ্চম বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১১ কার্তিক ১৪৩২ || ২৯ অক্টোবর ২০২৫