প্রবন্ধ
ও হেনরি : (মাষ্টার অফ স্টোরি টেলার)
শং ক র ব্র হ্ম
ও হেনরি আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের একজন অন্যতম ত্তস্তাদ ছোট-গল্পকার। গল্পে বিশেষ ধরণের চরিত্রায়ন, গল্পে রসিকতাবোধ ও গল্পের শেষে টুইস্টের জন্য বিশ্ব সাহিত্যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। তিনি আমেরিকান জীবনযাপন নিয়ে প্রায় ছয়শোর মতো গল্প লিখেছেন।
১১ই সেপ্টেম্বর ১৮৬২ গ্রিন্সবরো, নর্থ ক্যারোলাইনা, কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা (বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র) উইলিয়াম সিডনী পোর্টার (William Sydney Porter)-এর জন্ম হয়।
অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া ছেড়েছিলেন মাত্র পনেরো (১৫) বছর বয়সেই। কখনও সাপ্তাহিক পত্রিকার ব্যবস্থাপক, কখনও কলাম লেখক, আবার কখনও ওষুধের দোকানের কর্মচারী হয়ে কাজ করেছেন, পরে ব্যাংকের কেরানি সহ বিভিন্ন ধরণের চাকরি করেছেন উইলিয়াম সিডনী পোর্টার (ও হেনরি)। তিনি ও হেনরি (ও হেনরি, অলিভিয়ার হেনরি, অলিভার হেনরি) ছদ্মনাম লেখা লেখি শুরু করেন জেলে থাকার সময়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই এই ছদ্মনাম নেন।
১৮৯৬ সালে অর্থ আত্মসাৎ-এর অভিযোগে অভিযুক্ত হলে উইলিয়াম সিডনী পোর্টার (হেনরি) পালিয়ে যান। পরে স্ত্রীর অসুস্থতার খবর শুনে, লুকিয়ে বাড়িতে দেখা করতে এলে পুলিশ তাকে হাতে-নাতে ধরেন। বিচারে তার পাঁচ বছর জেল হয়ে যায়। এইসময় তিনি এই জেলের ভিতরে বসেই লেখালেখি শুরু করেন।
জেলে বসে ‘অলিভার হেনরি’ ছদ্মনামে গল্প লিখে পোষ্ট করতে থাকেন পত্র পত্রিকায়। মোট চোদ্দটি গল্প লিখে পাঠিয়েছিলেন সে সময় তিনি। পত্রিকাওয়ালারা জানতেন না যে গল্পের লেখক একজন আসামী।
তবে তাঁর ভাল আচরণের জন্য তিন বছর পরেই জেল কর্তৃপক্ষ তাকে মুক্তি দেন। মুক্তি পেয়েই উইলিয়াম সিডনী পোর্টার (ও হেনরি) আবার ফিরে যান মেয়ে মার্গারেটের কাছে। মেয়ে জানত না বাবা জেলে ছিলেন এতদিন, জানত বাবা ব্যবসার কাছে বাইরে ছিলেন।
বিষয়বস্তুর গভীরতা, শব্দের নিপুণ খেলা, নিখুঁত চরিত্র চিত্রায়ন ও চমকপ্রদ পরিসমাপ্তি ছিল তাঁর গল্পের মূল সম্পদ। তাঁর গল্পগুলো খুব আকর্ষণীয় এবং মর্মস্পর্শী। তাঁর গল্পে ফুটে ওঠে একজন সাধারণ নাগরিকের জীবন সংগ্রাম, তাঁর লেখায় বিচিত্র পেশার মানুষের দেখা মেলে, জীবনের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হাসি-কান্নার ছবি ধরা পড়েছে তার গল্পে। সব ক্ষেত্রের মানুষকে নিয়েই ও. হেনরি গল্প লিখেছেন। তবে তাঁর গল্পের একটি অসাধারণ বিষয় হলো তিনি কখনোই কোনও মানুষকে খারাপ মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেননি। তাঁর গল্পের পাত্রপাত্রীরা এতই সাধারণ স্তরের যে পড়তে গেলে মনে হবে এরা তো আমাদের চারপাশেরই মানুষ।
জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে ওঠেন বেশ প্রভাবশালী একজন লেখক। তাঁর গল্প বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর গল্প বিভিন্ন দেশের পাঠ্যক্রমে স্থান পেয়েছে। কেননা তাঁর গল্পের মধ্যে আছে মনুষ্যত্ববোধ ও নীতির শিক্ষা৷ এইজন্য তাকে 'মাষ্টার অফ স্টোরি টেলার' বলা হয়ে থাকে।
তাঁর ‘উপহার’ (The Gift of the Magi) গল্পের কাহিনী সংক্ষেপে এইরকম।
ডেলা আর জিম দম্পতি, বড়দিন উপলক্ষে দু'জনে দুজনকে উপহার দিতে চায়। কিন্তু দুজনেরই অভাব। হাতে তেমন অর্থ নেই। ডেলার ছিল লম্বা চুল যা জিম খুব ভালবাসত, আর জিমের ছিল পূর্ব-পুরুষের দেয়া সোনার একটি ঘড়ি যা সে খুব ভালবাসত। দু'জনই দু'জনের জন্য উপহার কেনে। ডেলা তার লম্বা চুল বিক্রি করে জিমের সোনার ঘড়ি ঝোলানোর জন্য প্লাটিনামের চেন কেনে, আর জিম তার বাপ-দাদার সোনার ঘড়ি বেচে ডেলার জন্য উপহার কিনে আনে চুলের চিরুনি ও সোনার ক্লীপ। এরচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার আর কি হতে পারে?
ও হেনরি তাঁর এক-একটা গল্পে একেক রকমের চমক হাজির করতে পারেন। এই জন্যই গল্পকার হিসাবে তাঁর যেন জুড়ি মেলা ভার।
লেখকের আরেকটা গল্প।
গল্পটার নাম ‘শেষ পাতা’ (The Last Leaf)
এই গল্পে জনসি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। ডাক্তার তার বন্ধু স্যুকে বলেছিল বাঁচবার আশা নেই। শুধু যদি জনসির নিজের বাঁচার ইচ্ছা তীব্র করতে পারে, তবেই হয়তো বাঁচতে পারে। কিন্তু জনসি স্যুকে বলে তার বিছানার পাশে জানালা দিয়ে যে গাছটা দেখা যাচ্ছে, সেই গাছের শেষ পাতাটা যেদিন ঝরে যাবে সেদিন সেও মারা যাবে। অল্প কিছু পাতা নিয়ে বড় গাছটা দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে তখন। কিন্তু একে একে সব পাতা ঝরে গিয়ে, টিকে থাকে মাত্র চারটি পাতা। জনসি ভাবে কাল সকালেই সবগুলো ঝরে যাবে। কিন্তু সকালে উঠে দেখে, শেষ অবধি একটা পাতা টিকে আছে, ঝরেনি। জনসিও সুস্থ হয়ে ওঠে। তারপর জনসি জানতে পারে একটা পাতা সহ গাছটার ছবি এঁকেছেন তারই বাসার ওপরতলায় থাকা আরেক শিল্পী বেরম্যান। এটাই তার জীবনের শেষ ছবি, কারণ এই ছবিটা আঁকার পর বৃষ্টির রাতে ভিজে সেখানে রাখতে গিয়ে নিউমোনিয়া হয় বেরম্যানের। এবং সে মারা যায় শেষপর্যন্ত।
জীবদ্দশাতেই ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ব সাহিত্যের জগতে একটি জনপ্রিয় নাম। তার জীবদ্দশায় মুক্তি পায় তিনটি নির্বাক ছবি- ‘দ্য স্যাক্রিসাইস’ (১৯০৯), ‘ট্রাইং টু গেট এ্যারেস্টেড’ (১৯০৯) ও ‘হিজ ডিউটি’ (১৯০৯)। তার লেখা অবলম্বনে নির্মিত আরও দুটি বিখ্যাত ছবি হলো ‘দ্য এ্যারিজোনা কিড’ (১৯৩১) ও ‘দ্য কিসকো কিড’ (১৯৩১)।
১৯৫২ সালে তাঁর পাঁচটি গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ও হেনরিস ফুল হাউস’। এতে স্থান পেয়েছে ‘দ্য কপ এ্যান্ড দ্য এ্যান্থেম’, ‘দ্য ক্লারিওন কল’, ‘দ্য লাস্ট লিফ’, ‘দ্য রানসাম অব রেড চিফ’ ও ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’।
তাঁর লেখা- ‘উপহার’ (The Gift of the Magi), ‘সুর ও বেসুর’, ‘শেষ পাতা’ (The Last Leaf), ‘বিশ বছর পর’, ‘প্রেম, ঘড়ি ও খলিফা’, ‘সাজানো ঘর’, ‘কুবের ও ফুলশর’, ‘বিশ্ব নাগরিক’, ‘প্রথম প্রেম’, ‘প্রকৃতির বিধান’, ‘জাত শহুরে’, ‘দালালের প্রেম’, ‘একটি অসমাপ্ত কাহিনী’, ‘সবুজ দরোজা’, ‘প্রেমের পূজায়’, ‘গরম অমিয় ভেল’- এই গল্পগুলি সংগ্রহ করে পড়ে দেখতে পারেন গল্পপ্রেমী পাঠকরা। সব গল্পগুলিই অসাধারণ। এর মধ্যে আমার খুব ভাল লেগেছে ‘উপহার’, ‘সুর ও বেসুর’, ‘শেষ পাতা’, ‘সবুজ দরোজা’, ‘বিশ্ব নাগরিক’।
কিন্ত বড় আপসোসের কথা, মাত্র সাতচল্লিশ (৪৭) বছর বয়সে, ১৯১০ সালের ৫ই জুন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে, এই মহান গল্পকারের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্ব সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। বিশ্ব সাহিত্যের তিন দিকপাল গল্পকারের মধ্য তিনি ছিলেন অন্যতম একজন (বাকি দু'জন হলেন - ফ্রান্সের গী দ্য মোপাসাঁ (guy de maupassant) ও রাশিয়ার আন্তন চেখভ (Anton Chekhov))।
মধ্যস্বত্বভোগী
ত প ন ম ন্ড ল
Middle man বা মধ্যস্বত্বভোগী শব্দটির সঙ্গে শোষণ, অত্যাচার, ভয় প্রদর্শন এবং জমিদার বা মহাজন শ্রেণীর যোগসূত্র রয়েছে। এই যোগসূত্র মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমানভাবে বজায় আছে। তবে বর্তমানে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী আগের মতই তাদের শোষণের ধারা এবং প্রতাপ প্রতিপত্তি অব্যাহত রেখেছে। আধুনিক ঘোড়ার যেমন বিবর্তন ঘটেছে তেমনি মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজেদের বিবর্তন ঘটিয়েছে। ভাষা, আদব-কায়দা ও পাশ্চাত্যের অনুকরণে তারা সাধারণ জনতা থেকে পৃথক তা স্পষ্ট করেছে। এরা গিরগিটির মত রং পরিবর্তন করে গতিশীল সমাজে মিশে গিয়ে শোষণের ধারাটি বজায় রেখেছে। তবে মূল শিকড়টি কিন্তু পূর্বের শোষনকারী পূর্বপুরুষের সঙ্গে সংযুক্ত রেখেছে।
অক্ষয় কুমার দত্তের 'পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা' প্রবন্ধে মধ্যস্বত্তভোগী শ্রেণীর সার্বিক চরিত্রের বিভিন্ন উপমা প্রয়োগ করে খুব সুন্দর ভাবে চিত্রায়িত করেছেন। তিনি তুলে ধরেছেন কিভাবে প্রজা শোষণের দ্বারা মধ্যস্বত্তভোগী শ্রেণী নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতো। কিভাবে সম্পত্তি আত্মসাৎ করত। মনিব সাহেব বা জমিদারদের পদতলে বসে সহানুভূতি আদায় করতো তা অক্ষয় কুমার দত্ত স্পষ্ট তুলে ধরেছেন তার প্রবন্ধে। তবে তিনি যে প্রজা শোষণকারী মধ্যস্বত্তভোগীদের কথা উল্লেখ করেছেন তা নিতান্ত প্রারম্ভিক বা সূচনাকালীন বিবরণ। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বলবান হয়েছে মধ্যস্বত্তভোগী। পোশাক পরিচ্ছদ এবং গুরুচন্ডালি ইংরেজি ভাষাতে নিজেদের চরিত্রে আধুনিকতার নতুন চিত্র চিত্রায়িত করেছে।
নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করতেও সব সময় সদা ব্যস্ত। বকলমে শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত বা প্রচলিত কয়েকটি গদাই ইংরেজি ভাষণে সমস্ত স্থানে এরা নিজেদের সর্বাসর্বা হিসেবে ঘোষণা করে। প্রকৃত শিক্ষিত জ্ঞানীরাও এদের মুখের দাবানলে শয্যাশায়ী।
মধ্যস্বত্তভোগীরা 'দালাল' হিসেবে নতুন রূপ পেয়েছে। ইংরেজিতে 'এজেন্ট'। অবশ্য এই নতুন স্বল্পশিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে 'এজেন্ট' শব্দটি বেশ সম্মানসূচক। তবে দালাল শব্দটিতে এদের বেশ আপত্তি আছে। এই শব্দটি তাদের কাছে অসম্মানজনক। এই শব্দতে তাদের রক্ত বেশ গরম হয়। বর্তমানে এই অসৎ স্বল্প শিক্ষিত দালালদের দৌরাত্ম্য বহুগুণ বেড়েছে। অফিস, আদালত, হসপিটাল, রাস্তাঘাট, শ্মশান, সম্পত্তি কেনাবেচা, সিনেমা ঘর এমন কি আধুনিক কালের ডিজিটাল দুনিয়াতে অনায়াসেই তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়।
দালালরা অর্থলোভী, অর্থই তাদের কাছে শেষ কথা। অর্থের লোভেই তারা গরীব থেকে মধ্যবিত্ত সকলের রক্ত ঝরানো পরিশ্রমের ফসল আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে ওত পেতে বসে থাকে। গরিব অসহায় কি নিঃশেষ করার জন্য নানা প্রকার কৌশলের আশ্রয় নেয়। আগে সুযোগ পাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে সর্বশান্ত করার মন্ত্রধ্বনিতে এরা সমৃদ্ধ। অপরের বুদ্ধি হরণ করে নিজেকে সর্ব জ্ঞানী মনে করে গরিবকে সর্বদিক থেকে প্যারালাইজড করে দেয়।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘ লাইনে না দাঁড়িয়ে অর্থশালীরা বা ভিআইপিরা খুব সহজে তাদের মনোস্কামনা পূরণের জন্য পাথররুপী ঈশ্বরের সম্মুখীন হয়। এখানে ঈশ্বর ভক্তি বা শ্রদ্ধা নিতান্তই অর্থের কাছে মাথা নত। বড় বড় ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলো এখন প্রায়ই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। আর এর প্রধান কান্ডারী হল দালাল।
অর্থ সমাজের প্রধান মাপকাঠি । তাই সে অর্থ সৎ বা অসৎ যেভাবেই আসুক না কেন! এ কারণেই বোধ হয় দালালরা জঙ্গলের নেকড়ের মত শিকার ধরার অপেক্ষায় ওত পেতে বসে থাকে। যেমনটা বর্তমানে বেসরকারি হসপিটালগুলোতে ঘটে। রোগী মরণাপন্ন। হসপিটালের ভাষায় বেড নেই। কিন্তু দালালদের কাছে বেড সংরক্ষিত।
রোগীর রক্তের প্রয়োজন। ব্লাড ব্যাংক বলে সাপ্লাই নেই। অথচ দালাল ধরলেই পাওয়া যায় রক্তের ভান্ডার। অকারণে রিপোর্টের ফাঁদে ফেলে রোগীর পরিবারকে সর্বশান্ত করে বেসরকারি এই রক্তচোষা বাদুড় গোষ্ঠীর দালাল। রোগী এবং রোগীর পরিবার গয়না, সম্পত্তি বিক্রি করে নিঃশ্বাস হয়। তখন হয়তো দেখা গেল রোগীর শেষ অবস্থা। আর বাঁচার উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে রোগীর পরিবার সব কুল হারিয়ে একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে। আসলে বেসরকারি হসপিটালগুলি অসহায় রোগী ও তার পরিবারকে ডিম পাড়া সোনার হাঁস বিবেচনা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানবিক ডাক্তার চাপে পড়ে এই সমস্ত রক্তচষা বাদুড়ের সঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। যদিও এর ব্যতিক্রম কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়।
সম্প্রতি সম্পত্তি কেনাবেচার ক্ষেত্রেও দালাল চক্রের ফাঁদে আমাদের পড়তে হয়। জমি রেজিস্ট্রি বা রেকর্ড এর ক্ষেত্রে অনিচ্ছা থাকলেও এই অসাধু দালালদের দ্বারস্থ হতে হয়। এক্ষেত্রেও উপভোক্তা বেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়।
মধ্যস্বত্তভোগীদের সবচেয়ে বড় চক্র হলো কর্মসংস্থান ক্ষেত্র এবং অফিস আদালত চত্বর। বেকার যুবক-যুবতী স্বাবলম্বী হওয়ার তাড়নায় অসাধু দালালের চক্রে পড়ে নিঃশেষিত হয়। পরিবারের জমানো সামান্য অর্থ দালালদের হাতে দিয়ে প্রায়ই প্রতারিত হতে দেখা যায়। সংবাদপত্র ও প্রশাসন এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতনতামূলক বার্তা দিলেও সব যেন থোড়াই কেয়ার। অফিস বা আদালত চত্বরে অসাধু দালালদের প্রতিপত্তি সবচেয়ে বেশি। এখানকার ধুলো, এখানকার পরিবেশ সব যেন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্থের দিকে। চাই অর্থ, শুধুই অর্থ। কিছু অসাধু সরকারি কর্মীর সম্মতিতে অসাধু দালালরা, অসৎ কারবারি সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। এখানে কোরাপশন নিচু থেকে উঁচু তলা পর্যন্ত। যেমনটা মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামন্ত ব্যবস্থা ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে গরিব, এই ব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে নিজের শেষ সম্বলটুকু বিসর্জন দিয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ঘরে ফেরে।
প্রশাসন ক্ষমতায় আসে। বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেয়। কিছু প্রতিশ্রুতি পালনও করে। কিছু ক্ষেত্রে জনগণকে সন্তুষ্টও করে। কিন্তু জনগণ ও প্রশাসনের মাঝে গড়ে ওঠা স্বল্প শিক্ষিত দালাল গোষ্ঠী বেশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সাধারণ জনতার কাছে। ইংরেজ কোম্পানির আমলে যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় যে শোষণ ও অত্যাচার এবং দমন পীড়ন ও ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে নতুন ভূ-মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী রায়তদের উপর প্রভুত্ব চালাত ঠিক তেমনিই বর্তমান যুগে নতুন আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য শোষক দালাল গোষ্ঠী। জনগণের বাক স্বাধীনতা এমনকি চলাফেরার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে চরম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এই গোষ্ঠী তরফ থেকে। চরম হুমকিতে পিছিয়ে পড়ে নিরপরাধ জনতা। প্রতিটি পদক্ষেপে হয়রানির শিকার হতে হয়। নারীদের প্রতি শ্লীলতাহানি, এমনকি ধর্ষণেরও হুমকি মেলে এই অভদ্র গোষ্ঠীর কাছ থেকে।
সরকারি প্রকল্পগুলির সুবিধা সাধারণ জনগণের পরিবর্তে সুবিধাভোগীর পকেট জাত হয়। পরিচয় গোপন রেখে দুর্বলের সম্পত্তি আত্মসাৎ সবেতেই এই নতুন দালাল গোষ্ঠী পারদর্শী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্তার কথাকে অগ্রাহ্য করে এই অসাধু অশিক্ষিত দালালরা নিজে এলাকায় স্বয়ং নিজেকে সর্বোচ্চ প্রভু বলে প্রতিপন্ন করে। গ্রাম বা শহর অঞ্চল সবখানেই চলে তাদের দৌরাত্ম্যে। ভারতবর্ষের মতো পবিত্র ভূমিতে ছোট ছোট গ্রাম বা শহর অঞ্চলে সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া বা অভাব অভিযোগ দূর করার মতো সদিচ্ছা প্রশাসনের থাকলেও স্থানীয় সর্বোচ্চ প্রভু ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কারণে তা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আসলে মধ্যবিত্ত গরিবের অন্তরফাটা কান্না চিরকাল স্থানীয় সর্বোচ্চ প্রভুর সাম্রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের নীরব কান্না চাপা পড়ে গম্ভীর হুমকির নিচে। বিচারের ক্ষেত্রে দোষীদের হয়ে সাক্ষ্য দেয় এই দালাল গোষ্ঠী। এভাবেই দোষীদেরকেই হাত শক্ত করে তারা।
আধুনিককালের ডিজিটাল দুনিয়াতেও দালালদের সক্রিয় ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। ব্যাংকিং বা শপিং এর মত বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলিতে দালালরা নতুন রূপে সেজে উঠেছে। এই দালালদের নতুন পরিভাষা হলো হ্যাকার। যাদের কবলে পড়ে হাজার হাজার অসহায় মানুষকে সর্বস্ব হারাতে হয়।
দালাল চক্রের কবলে পড়ে কত গরীব ঘরের আদরের কন্যাকে অপরের দাসত্ব করতে হচ্ছে। দালালরা অপহরণ করে। অন্যত্রে তাদের বিক্রি করে। পতিতালয়গুলিতে কত নারী এভাবে নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছে তার কোন পরিসংখ্যা নেই।
বর্তমানে দালাল চক্রে নেই, এমন স্থান পৃথিবীতে মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাড়া থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে হালিশহ বা মহানগর, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য, অনুন্নত থেকে উন্নত দেশ, পর্যটন কেন্দ্র বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সবেতেই আমরা খুঁজে পাই এমন দানবীচক্র।
এবারে আসি আধুনিক মধ্যস্বত্তভোগীদের চরিত্রের বিষয়ে। বাস্তবিক পক্ষে এদের চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা খোশমেজাজি, দুরাচারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। আবার কোন ক্ষেত্রে ভ্রষ্টাচারী দানবী প্রকৃতির। কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যাচারী অসৎপ্রবণ, আবার কিছু ক্ষেত্রে মিষ্টভাষী ষড়যন্ত্রকারী, দোর্দন্ড প্রতাপী, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। পর নারীর প্রতি আসক্তিতে এরা মুক্ত নয়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কর্ণধার এই দালাল গোষ্ঠী। অসৎ কর্মে মত্ত এই ব্যক্তি গোষ্ঠীর বৃহৎ অট্টালিকা কোনো রাজপ্রাসাদের থেকেও কম নয়। জনসাধারণের আত্মসাতের টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। উন্নয়নমূলক কাজে বাধা দিয়ে হুমকির জোরে অর্থ উপার্জন এদের নেশা এবং পেশা। কখনো কখনো সামান্য অর্থ সমাজে দান করে নিজেদেরকে ভাগ্যবিধাতা রূপে জাহির করতে চায়। মানুষের বিপদে সুযোগ সন্ধানী রূপে কাজ করে। সাধারণ জনতাকে পদতলে রাখতে পিছুপা হয় না। সামান্য সহানুভূতি দেখিয়ে সকলের মন জয় করতে ব্যতিব্যস্ত।। অহংকার আর পাশবিকতায় দানবদেরকেও হার মানাতে পারে। এদের কাছে নারীর সম্মান পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে না। দামি ফোন, চশমা, স্যুট, কোর্ট, আদব-কায়দা, কথাবার্তায় বুঝিয়ে দেয় এই দানব গোষ্ঠী সাধারণের থেকে কতটা পৃথক। মানবিকতার পাঠ তাদের কাছে অজানা। এ সমাজ পরিবর্তিত হবে। আগামীতে নতুন সমাজের আবির্ভাব হবে। হয়তো তখনোও দেখা যাবে এই দালাল গোষ্ঠী নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে দুর্নীতির চাদরে মোড়া নতুন দেহ ধারণ করে নতুনভাবে শোষণের ধারা অব্যাহত রাখবে। হয়তো মানবিকতার পাঠ তুলে দিয়ে হিটলারি শাসনে, এ জগতকে পদদলিত করবে।
হায় রে আধুনিকতা
রা ণা চ ট্টো পা ধ্যা য়
শুধু গতি গতি আর গতি, সমাজ জীবনের সাথে জুড়ে গেছে এই দুই অক্ষরের শব্দটা ভীষন অঙ্গাঙ্গিভাবে। জীবনে যদি না থাকে স্পিড বা গতি কিসের এত ক্ষতি গেলো গেলো রব! এটা ছাড়া কি জীবন ম্রিয়মাণ! মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও ধারণায় এখন এই বিষয়টাই বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে স্থবিরতা মানেই মৃত্যু। গতি, ইঁদুর দৌড়, নিজেকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব থাক বা না থাক জাহির করার প্রবণতা আখেরে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে সবার থেকে বাস্তব পরিস্থিতি অনেকক্ষেত্রে সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাদের। মানুষ আর মানুষ থাকছে কোথায় নিজের স্বভাব গুণ পরিবর্তনে! কিছু হাসিল করার উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের প্রাণপণ অপেক্ষা নইলে যদি গতির বিপরীত মুখে ক্রমশ পিছোতে পিছোতে ফুরিয়ে যায়! এ এক অদ্ভুত ভয় মানুষের সাবলীল স্বত্তা, ঘুম, খিদে সব কেড়েছে। নিজের কাছে হেরে যাই ক্ষতি নেই তাই বলে লোকে যদি নিন্দে করে, স্বরূপ জেনে যায় তাহলে তো অস্তিত্ব সংকট!সুতরাং গতির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলো যতদুর পারো, তাতে হোঁচট খাও পরোয়া নেই।
তুলনা মানুষের জীবনে এমন ভাবে এসে গেছে যে মানুষ সুস্থ ভাবে বাঁচতে ভুলেছে, এই বুঝি পিছিয়ে যাচ্ছি--- এই পিছিয়ে যাওয়ার বিশ্রী একটা ভয় মনের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে যার থেকে পরিত্রাণের উপায় মানুষ জেনেও বেরিয়ে আসতে পারছে কোথায়? "দেখ পাশের বাড়ির ছেলেটাকে, কত দৌড় ঝাঁপ করছে, চৌখস, চোখ কান খোলা রেখে দিন রাত কতই না পরিশ্রম করছে, আর তুই ঠায় ঘরে বসে আয়েশে কিনা সময় পার করছিস!" সন্তানকে নিয়ে এমন প্রশ্ন উত্থাপনে মানসিক অশান্তিকে প্রশয় দেওয়া এখন প্রায় প্রতি বাড়িতে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার কাজ নেই তো খই ভাজের মতো, অনলাইনে ফেসবুক ঘেঁটে কে কি করছে, কি পরছে, ঘুরছে কোথায় হাজারো প্রশ্নের ঢেউ মনের মধ্যে নিয়ে তোলপাড় করানো, মানুষে মানুষে অশান্তি লাগিয়ে চুপ করে মজা দেখার লোকজন আশেপাশে কম আছে সেটাও নয়! এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমরা বেঁচে আছি।
সুখে থেকেও অন্যের সাথে তুলনা, এই বুঝি পিছিয়ে গেলাম ভাবনা আসলে মানসিক রোগের মতো মানুষকে ক্রমাগত অস্থির করে তুলছে। আবার এর সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে আর একটা ভয়ংকর অভ্যাসগত ত্রুটি, প্রকাশভঙ্গী বা দেখনদারি। অনলাইন যুগে প্রতিনিয়ত নিজের আপডেট, নিজের প্রশংসা কুড়াতে মানুষ বড্ড বেশি প্রকাশ করে ফেলছে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, আচরণ, খাদ্য অভ্যাস, ভাবনার দৃষ্টিকোণ। অনেকক্ষেত্রে মিথ্যাকে আশ্রয় করে জাহির করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা একেবারেই ভুল দিশা দেয়। তবু এই বুঝি হেরে যাবো, ছোট হয়ে যাবো লোকের চোখে- এমন ভাবনায় ক্রমাগত কিছু না কিছু প্রকাশ করে নিজেকে অন্যদের থেকে সমীহ আদায় করা এ এক মস্ত ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে যাওয়া। অথচ চুপ চাপ থেকে নানাবিধ পড়াশোনায় মগ্ন থেকে শুভচিন্তায় গা ভাসানো যে সমাজ ও সংসার সকলের ক্ষেত্রে ভালো বুঝবে কজন!
আলো ঝলমল জীবন যাপন আচরণ, দেখনদারি, প্রকাশভঙ্গি সবকিছুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে গতির ভাবনা। আমি সবার থেকে সেরা, দেখো আমরা কত হাসি খুশি, আমরা কত সুখী পরিবার তার বিজ্ঞাপনের বহর দেখে যারা বোঝার তারা কিন্তু মুখ টিপে হাসে। অথচ এই এত প্রকাশ ভঙ্গির ভেতরে অসুখী, অশান্তির বাতাবরণ বিরাজ করছে বেশ বোঝা যায়। সেসব আড়াল করে আদতে ঘোরের মধ্যে অসুস্থ মানসিকতাকেই প্রশয় দেওয়া হয়। এইযে ভেতর আর বাইরেই দু ধরণের পরিস্থিতি মানুষকে সামলাতে হচ্ছে শুধু পাছে লোকে কিছু বলে, এই বুঝি অন্যদের চোখে খেলো হয়ে যাবো ভাবনা যা সামগ্রিকভাবে ক্ষতি করছে সম্পর্কের রসায়ন। এরই সঙ্গে চারিদিকে কেমন যেন একটা অসহিষ্ণুতার পরিবেশ মনের মধ্যে থাবা নিয়ে বসে আছে। সবাই নিজের পরিমণ্ডলে কর্মব্যবস্থায় দিব্যি ঘুরছে ফিরছে, নিজেকে নিয়ে মনোযোগী থাকার সুন্দর অভ্যাস তবুও এই যে সবার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে যতটা ভালো থাকা যায়, এই অতি আধুনিক পরিমন্ডলে থেকেও হঠাৎ হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে উঠছে এই প্রজন্ম। নিজেদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা নেই সেটা কিন্তু একদম নয় বরঞ্চ নিজেরা স্বাধীনভাবে আছে পার্টি করছে আনন্দ করছে যা কিছু করছে সব বেশি পরিমাণে কিন্তু কোথায় যেন এটা তাল কেটে যাওয়া হঠাৎ ছন্দহীন পরিস্থিতি। একটা শিশু মা-বাবার উৎসাহ অনুপ্রেরণায় গতির টানে ছুটে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন হচ্ছে, পড়াশোনা শেষ করেই পায়ের তলার মাটি শক্ত করছে এটা ঠিক, তবুও কোথাও যেন অদৃশ্য কারনে মনের ভিত হয়ে উঠছে নড়বড়ে। এই যদি হঠাৎ জব চলে যায়, এই যদি হারিয়ে ফেলি সামাজিক পদমর্যাদা এমন ভাবনা ক্রমশ টান মারছে তাদেরকে! কিভাবে চলবে তবে অভ্যস্ত এই জীবন যাত্রা, যদি সবাই টপকে যায় আমায়!
গতির স্রোতে এমন অবান্তর প্রশ্ন খামচে ধরছে মানুষকে! আসলে মানুষ নিজেকে নিয়ে এত বেশি ভাবছে, এত বেশি পরীক্ষা করছে পাছে লোকে কিছু বলে এই ভাবনায় ক্রমশ উত্তরণের পথে এগিয়ে চলেছে তত জলদি অসহিষ্ণুতা বিরক্তি প্রকাশ একঘেয়েমি, হতাশার চাদর মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলছে। এর চেয়ে মুক্তি কোথায়? কই আগে তেমন তো হতো না, মানুষ হতাশায় ডুব দিত না, তবে এখন কিসের এত হতাশার কালো মেঘ ক্রমশ বেড়েই চলেছে, আচ্ছন্ন করছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা! একটা মেকি হাসি খুশি জীবন আঁকড়ে মানুষের এগিয়ে চলা আদতে কি খুশি রাখতে সক্ষম হচ্ছে, এই লাখ টাকার প্রশ্ন উঁকি মারছে চারিদিকে, অথচ সঠিক দিশা কিসে আসবে, কি হবে সমাধানের পথ তার কোনো সদর্থক উত্তর নেই কারুর কাছে।
সেই সব নস্টালজিক জীবন, বারো ঘর এক উঠোন, যৌথ পরিবার, আকাশ, প্রকৃতি, বাগান, প্রজাপতি ফড়িং, উঠোনে জমা বৃষ্টির আর জলে রঙিন কাগজ কেটে নৌকা ভাসানোর সুখ স্মৃতি ভেসে আসছে, সব কিছু নিয়ে একটা অদ্ভুত ভালোবাসার পরিমণ্ডল ছিল তখন। আজ এই স্ট্যান্ডার্ড লিভিং এর সৌজন্যে স্ট্যাটাস হয়তো বেড়েছে, গতির অভিমুখে মানুষের দৌড়ঝাঁপ সবই হচ্ছে কিন্তু মানুষ বড্ড একা হয়ে উঠছে, আখেরে মনখারাপের ব্যামো গ্রাস করে মানুষকে পিছিয়ে দিচ্ছে অথচ একথা মুখফুটে কিন্তু মানতে পারছে না মানুষ কারণ ইগোর বাড়বাড়ন্তে সত্যিটাকে স্বীকার করে নিতে মানুষের যে বড্ড দ্বিধা!
প্রতিদিন নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে তুলে, সকলের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা, এই যদি কিছু কমেন্ট কম আসে পাগল পাগল অস্থির হয়ে ওঠা, একে তাকে যা খুশি বলে আক্রমন, সকলকে কপি করতে করতে ক্ষয়িষ্ণু হওয়া, মেজাজ হারানো এ সবই একপ্রকার গতির দিকে ধাবমান হতে গিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার দিক নির্দেশ। এক্ষেত্রে ভালো কিছু বললে, সদুপদেশ দিলেও বেশ মুস্কিল, হয়ে উঠবেন স্বঘোষিত শত্রু। মোদ্দা কথা গুণ থাকলে এমনি মানুষ জানবে, সমীহ করবে আলাদা করে দেখো আমি কত গুণী, সেরা সেটা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করা মূর্খামি। কথাতে আছে আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড্ড দৃষ্টিকটু লাগে ভালো কিছু বললে এইবুঝি সবাই হিংসা করছে, এমন ভুল ব্যাখ্যায় ক্রমশ নিজেকে সরিয়ে গতির সাথে পাল্লা দিয়ে এমন প্রকৃতির মানুষেরা আবার নিজের গুণকীর্তন, পিঠ চাপড়ে নতুন কিছু আঙ্গিকে নিজেদের প্রশংসা করতে বসে, অনলাইনে মুখ গুঁজে সমাজ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটায়। আজকে যারা শুভাকাঙ্ক্ষী কাল কে তারা বড্ড খারাপ, আবার নতুন পরিচয়, পছন্দের আবর্ত তৈরিতে মনসংযোগ, এগিয়ে চলা ডোন্ট কেয়ার ভাব আরও বেশি করে তাদের বিচ্ছিন্নতা প্রমাণ করে। হায়রে স্ট্যাটাস, গতিকে পকেটে ভরে দৌড়, যেখানে স্নেহ ভালোবাসা সব গৌণ।
ভেতরের ফাঁপা অজ্ঞানতা বিষয়কে প্রশয় দিয়ে নিজেই নিজেদের প্রশংসা করা, দেখো আমি কতখানি সেরা। এর মধ্যে কিন্তু ক্ষতি সর্বাধিক নিহিত কারণ মানুষ নিজেকে তুলে ধরে উজাড় করে লোকের কাছে প্রকাশ করতে করতে সবার মধ্যে থেকেও একটা মিথ্যা সুপিরিয়র গণ্ডি টেনে ক্রমশ সবার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। এই মানসিক রোগ ক্রমশ বেড়েই চলে ধ্বংস করছে মানবতা, ভালোবাসা, পরস্পরকে সম্মান করার বোধ, কৃতজ্ঞতা।
এক যুগ্ম সমন্বয়—অভিনেতা ও পরিচালক রবীন্দ্রনাথ
গী ত শ্রী সি ন হা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিস্ময়ের আলোকে বিশ্ববাসী মগ্নতায় বিভোর ! অনেক গবেষকদের মনে প্রশ্ন জাগে পরিচালক রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন? সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গ্যাছে!
চলচ্চিত্রের পরিচালনার দিকটা নিয়ে--- "নটীর পুজো" নামে একটি মাত্র চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটি তাঁরই লেখা নাটক। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্র রচিত নাটক "তপতী" ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস লিমিটেড চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করে। কবি এই চলচ্চিত্রের প্রধান ভূমিকায় অভিনয়ও করেন। কবির স্বপ্নের বাস শান্তিনিকেতনেই এই আট রিলের ছায়াছবির শুটিং। "নটীর পূজা" নাটকটি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীদের দিয়ে অভিনয় করান নৃত্যনাট্য হিসেবে। নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী বসু এই নৃত্যনাট্যে অসাধারণ অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে 'উপালী' চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯২১ সালের ২২ ডিসেম্বর বিশ্বভারতী হলে বিশ্বভারতীর সাহায্যে বেশ কয়েকবার এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। বি এন সরকার নৃত্যনাট্যটি দেখে মুগ্ধ হয়ে কবিকে অনুরোধ করেন যে, তার নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে "নটীর পূজা"র মঞ্চ রূপকে চলচ্চিত্রে পরিণত করার। কবি সম্মতি দিলে নিউ থিয়েটার্সের স্টুডিওর এক নম্বর ফ্লোরে শুরু হয় শুটিং! একটা খড়ের চালের গোলঘর তৈরি করা হয়, সেখানে শুটিংয়ের ফাঁকে কবি বিশ্রাম নিতেন। এটি রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য বিখ্যাত গোলঘর, রবীন্দ্রনাথ যাকে--- 'এটা আমার দ্বিতীয় শান্তিনিকেতন' বলে আখ্যায়িত করেন। নিউ থিয়েটার্সের পঁচিশ সদস্যের টিম পাঁচদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে শুটিং করে ছবিটি শেষ করে। ক্যামেরাম্যান ছিলেন নিতেন বসু। সহযোগী ইউসুফ মুলাজী। সম্পাদনায় সুবোধ মিত্র। মুকুল বসু শব্দ গ্রহণ করেন, সঙ্গীত পরিচালনায় দিনেন্দ্র নাথ ঠাকুর। বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ পরিচালক হিসেবে বিস্ময়কর নজির রাখেন। "নটীর পূজা" ১৯৩১ সালের শেষের দিকে শুটিং করেন রবীন্দ্রনাথ, আর ১৯৩২ সালের ১৪ই মার্চ এটি সেন্সর সার্টিফিকেট লাভ করে। ঐ সালের ২২শে মার্চ কোলকাতার চিত্রা সিনেমা হলে মুক্তি লাভ করে। ললিতা সেন, লীলা মজুমদার, সুমিতা চক্রবর্তী প্রমুখ শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা অভিনয় করেন।
১৯৪০ সালে নিউ থিয়েটার্সে আগুন লাগলে অন্যান্য ছবির সাথে "নটীর পূজা" র নেগেটিভ পুড়ে যায়। তাই চলচ্চিত্রের কলা কৌশল ও রীতিনীতি কতটা উন্নত হয়েছিল সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। রবীন্দ্রভবনে ১৬ মিলিমিটার আংশিক একটা ফিল্ম রাখা আছে। মূল ছবিটির দৈর্ঘ্য ছিল ১০ হাজার ৫৫৭ ফুট।
আজ সব ইতিহাস, তবুও স্মৃতির সড়কপথে উঁকি মারে রবীন্দ্র প্রতিভার আলো। ২৬শে জুলাই ১৯৩০- রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে প্রথম বাংলা নির্বাক চলচ্চিত্র "দালিয়া" মুক্তি পায়। এরপর ১৯৩২ সালে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র "চিরকুমার সভা" মুক্তি লাভ করে।
এবার আসি, রবীন্দ্রনাথের নাট্য, পরিচালনা ও তাঁর নাটকের দিক নিয়ে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে গীতিপ্রধান যাত্রাভিনয় যেমন হয়েছে, পাশাপাশি বিদেশি রীতিতে একাধিক নাটকের অভিনয়ও হয়েছে। উনিশ শতকের বাংলা নাট্য সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্য অনেকটাই স্বতন্ত্র। তাঁর প্রথম গীতিনাট্য "রুদ্রচন্ড" ১৮৮১- এটি অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের নাট্য আঙ্গিক আশ্রয়ী প্রথম রচনা। "রুদ্রচন্ড" কাব্যনাট্য প্রকাশ কালেই তিনি "বাল্মিকী প্রতিভা" ১৮৮১-তে নাটকটি রচনা করেন। ঐ সালে ২৬শে ফেব্রুয়ারি বিদ্বজ্জন সমাগমে ঠাকুরবাড়ির থিয়েটারে "বাল্মিকী প্রতিভা" নাটকে তিনি প্রথম বাল্মিকীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
এরপর, "কালমৃগয়া", "রাজা ও রানী" "বিসর্জন" "গোড়ায় গলদ" এবং "বৈকুন্ঠের খাতা" নাটকে তিনি পর পর অভিনয় করেন।
বাংলা নাটকে মধুসূদন দত্ত, শেক্সপিয়ারের বিলাতিয়ানার ধারাকে রবীন্দ্রনাথের নাটকে একচ্ছত্র ছায়া ফেলেছে। "রবীন্দ্র-নাট্য -পরিক্রমা" গ্রন্থে অশোক সেন অকপটে বলেছেন,--- 'শেক্সপিয়ারের পর পৃথিবীতে আর এতোবড় প্রতিভাবান জন্মেছেন কিনা সন্দেহ আছে! বাংলা নাটকের সমস্ত দ্বিধা সংশয় কুয়াশা থেকে মুক্ত করে স্বমহিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এরপর তিনি রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে "কালমৃগয়া" গীতিনাট্যে অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরিচালক রবীন্দ্রনাথকে বার-বার বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করতে দেখা গেছে। কবি রবীন্দ্রনাথ কোথায় যেন পরিচালকের ভূমিকায় অভিনেতা রবীন্দ্রনাথকে খুঁজেছেন।
শেক্সপিয়ারীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত তাঁর "রাজা ও রাণী" এবং "বিসর্জন" ১৮৮৯ সালে "রাজা ও রাণী" নাটকের যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রগুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৯৭ সালে "বৈকুন্ঠের খাতা" নাটকে কবি কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯২৬ তিনি "প্রজাতির নিবন্ধ" উপন্যাসটি কে "চিরকুমার সভা" নামে একটি প্রহসন মূলক নাটকে রূপ দেন। শান্তিনিকেতনে অভিনয়ের দল গড়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মঞ্চস্থ করতেন। পরিচালনা এবং অভিনয়ে সমান দক্ষতা ছিল তাঁর। ১৯১১ সালে "শারদোৎসব" নাটকে সন্ন্যাসী এবং "রাজা" নাটকে রাজা ও ঠাকুরদাদার যুগ্ম ভূমিকায় অভিনয় করেন, "অচলায়তন" নাটকে অদীনপুন্যের ভূমিকায় অভিনয়, এবং "ফাল্গুনী" নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় অভিনয় অসাধারণ ছিল! ১৯১৭ সালে "ডাকঘর" নাটকে ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায় অভিনয় সে সময়ে বাংলা নাট্যমঞ্চে ও থিয়েটারকে সমৃদ্ধ কর।
রবীন্দ্রনাথ জাতীয় জীবনের পঙ্গুতার কারণ হিসেবে নির্দেশ করেছেন আচারসর্বস্ব ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে। তিনি ঐতিহ্যের পক্ষপাতী হলেও গতানুগতিক প্রথাগত সংস্কারের বিরোধী ছিলেন। "অচলায়তন" নাটকে এইভাব প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা নাট্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ রূপক ও সাংকেতিক নাটকের আবিষ্কারক এবং শ্রেষ্ঠ শিল্পী। এই শ্রেণির নাটকগুলো বাংলা নাট্য সাহিত্যের সম্পদ বিশেষ!
১৮৯২ সালে রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ও অভিনীত "গোড়ায় গলদ" নাটকটি সমাদৃত হয়। এরপর ১৮৯৭ "বৈকুন্ঠের খাতা" সংগীত সমাজের উদ্যোগে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। কেদারের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ যেমন অভিনয় করেন, তেমনি অবনীন্দ্রনাথ তিনকড়ির ভূমিকায় অভিনয় করেন। শান্তিদেব ঘোষ তাঁর 'প্রযোজক রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে লিখছেন,--- "নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয় একা তিনি শিখেছেন পাখি পড়ানোর মতো করে। প্রত্যেকটি কথার সঙ্গে কোথায় কীভাবে ঝোঁক দিতে হবে, কীভাবে স্বরের বৈচিত্র্য আসবে, সব-ই তিনি পূঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দেখিয়েছেন। নাট্য পরিচালক রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এখানেই সার্থক।
নাট্যমঞ্চ, নাট্য প্রযোজনা, নাট্যাভিনয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক "তপতী" নাটকের অভিনয়ের দৃশ্যপটের পরিবর্তন করেননি। তার কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন--- "আধুনিক ইউরোপীয় নাট্যমঞ্চের প্রসাধনে দৃশ্যপট একটা উপদ্রবরূপে প্রবেশ করেছে। ওটা ছেলেমানুষী। লোকের চোখে ভুলবার চেষ্টা"।
রঙ্গমঞ্চের সাথে প্রেক্ষাগৃহের কৃত্রিম ব্যবধান রবীন্দ্রনাথ তুলে ফেলতে চেয়েছিলেন। শিশির কুমার ভাদুড়ি বলেছেন,--- "আমাদের দেশে নাট্যকারদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছেন যে, দর্শক বিচারকের মতো আসনে বসে থাকবেন এবং অভিনেতা মঞ্চের বা কাঠগড়ায় আবদ্ধ আসামীদের মতো অভিনয় করবে--- এর ব্যবস্থার মধ্যে একটা ঘোরতর অসামঞ্জস্য আছে।"
বাংলা থিয়েটারে যখন পেশাদারি নাট্যশালার যুগ চলছে তখন রবীন্দ্রনাথের নাট্য রচনার প্রয়াস, নাট্য পরিচালনার ব্যবস্থা করে শুধু নাট্য সাহিত্যের নয়, নাট্যমোদীদের কাছেও আদর্শস্থানীয় হয়ে আছেন। অজিত কুমার ঘোষ যথার্থই বলেছেন,--- "রবীন্দ্রনাথ আসিয়া বাংলা নাটক তাহার পরিপূর্ণ আভিজাত্য এবং গৌরব লাভ করিল। নাটকের মধ্যে তিনি যে সূক্ষ্ম কলা-কৌশল এবং সুগভীর অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিলেন তাহা তাঁহার পূর্বে দেখা যায় নাই।"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন