স্মৃতিকথা
পুজোর ছুটির একাল ও সেকাল: স্মৃতির পাতায় শারদপ্রেম
ঋ তু প র্ণা ধ র
সেকালের পুজোর ছুটির গন্ধ ছিল আলাদা— একটু কাঁচা মাটির, একটু নতুন খাতার, আর খুব বেশি করে ভালোবাসার। পুজোর দিন গুনতে গুনতেই আমরা বুঝে যেতাম, জীবনের একটা আস্ত সময় জুড়ে রয়েছে এই কয়েকটা দিনের ম্যাজিক।
স্কুলে যখন শেষ ঘণ্টায় ‘পুজোর ছুটি’ ঘোষণা হতো, মনে হতো যেন মুক্তির সনদ হাতে পেলাম। স্কুলে পুজোর ছুটির দিনটি আসত নির্ভেজাল আনন্দের রথে চড়ে। সেদিন রঙিন জামা পরে স্কুলে যাবার রেওয়াজ ছিল। সেদিনই এক টুকরো পুজো নেমে আসতো আমাদের সাদা, লাল স্কুলবাড়িটার মাঠ জুড়ে। মনে হত কতগুলো রঙিন প্রজাপতি মনের মধ্যে সদ্য ফোঁটা পুজো নামক ফুলের মকরন্দ আহরণে ব্যস্ত। ছুটির দিন শিক্ষিকারা মিষ্টি হাসিতে বিদায় জানাতেন, আর বন্ধুরা ফিসফিস করে প্ল্যান করতে থাকত—"কে কোথায় যাবে", "কে কী জামা কিনেছে", "কে ক’টা ঠাকুর দেখবে"। মনে হত, স্কুল বন্ধ মানেই এক বিশাল উড়াল।
তারপর এল সেই অমোঘ অপেক্ষার দিন—মহালয়া। ভোরবেলা ঘুম চোখে কাঁথা গায়ে টেনে বসে পড়তাম বিছানায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে “চণ্ডীপাঠ” যেন কাঁপিয়ে দিত ঘরের দেওয়াল। সেই কণ্ঠ মানেই দেবীপক্ষের সূচনা। ছোটবেলায় মনে হতো, এই কণ্ঠের মধ্যেই আছে এক রহস্যময় শক্তি—যা ধীরে ধীরে পৃথিবীতে নিয়ে আসছে মা দুর্গাকে।
আর টেলিভিশন? তখনো ছিল না হাজারো চ্যানেল। ছিল শুধুই দূরদর্শন, আর তাতেই ছিল পুজোর নির্ভেজাল আনন্দ। 'ছুটি ছুটি' নামের সেই বিশেষ অনুষ্ঠান—যেখানে দেখানো হতো রংবেরঙের গান, ছোটদের জন্য পাপেট শো, কার্টুন, ছোট ছবি—তা যেন আমাদের ছুটির রঙিন জানালা খুলে দিত। কখনও 'রবিঠাকুরের গল্প', কখনও ‘ভানু-জহর’ এর হাসির নাটক, কখনও বা পুরনো দিনের বাংলা সিনেমা—সবকিছুর মধ্যেই ছিল এক ঘরোয়া উষ্ণতা।
সেই সময়ের ‘শারদীয়া সংখ্যা’ ছিল আরেক ধনভাণ্ডার। 'আনন্দমেলা', 'শুকতারা', 'কিশোর ভারতী' বা 'দেশ'-এর পাতায় পাতায় লুকিয়ে থাকত একেবারে নতুন গল্পের রাজ্য। একটা বই হাতে পেয়েই আমরা হারিয়ে যেতাম অন্য জগতে—সেই মলাটের গন্ধটাই ছিল আলাদা!
সন্ধেবেলা নতুন জামা পরে বেরোনো, ঠাকুর দেখা, মণ্ডপে ধুনুচি নাচ দেখা, ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা— সবকিছু ছিল নিখাদ আনন্দে গাঁথা। খাবারের লোভে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, কখনও বুট-ভাজা, কখনও চাউমিন, আর ফেরার সময় কিনে আনা একটা কাগজের বাঁশি বা প্লাস্টিকের তলোয়ার— সেই আনন্দের তুলনা আজকের কিছুর সঙ্গেই চলে না।
একালেও পুজোর ছুটি আসে, হয়তো বেশি পরিসরে, বেশি ছড়ানো আয়োজন নিয়ে। ছুটির আগে হয় অফিসে ‘টিম লাঞ্চ’, হোয়াটসঅ্যাপে ‘Happy Puja’ স্টিকার, ফেসবুকে প্রোফাইল বদল। ইউটিউবে লাইভ অঞ্জলি, আর ক্যামেরাবন্দী সব মুহূর্ত—যেন প্রতিটি আনন্দের ক্লিক দরকার!
তবু কোথাও যেন কমে গেছে অপেক্ষা, কমে গেছে সেই নির্ভেজাল চঞ্চলতা। আজকের ছুটি ডিজিটাল, রেজিস্টার্ড, রুটিনবদ্ধ। হয়তো খারাপ নয়, শুধু অন্যরকম। তবে মনের এক কোণে আজও গাঁথা আছে সেই দিনগুলোর চিত্রপট।
আজ যখন ‘ছুটি ছুটি’ আর ফিরে আসে না, দূরদর্শনের সেই মন ভোলানো অনুষ্ঠান শুধু স্মৃতি হয়ে বাঁচে। তবু পুজো এলেই মনে হয়—সেই ছোটবেলার পাতা ওল্টানো ছুটিগুলো আজও জেগে আছে, একান্ত নিজের মতো করে।
কারণ পুজোর ছুটি, তা একালের হোক বা সেকালের—সবসময়েই হৃদয়ের এক নিরবধি উৎসব।
পুজোর বাল্য স্মৃতি
তা প স পা ল
সে তখন একটা সময় ছিল বটে, শ্রাবণ মাস আসা মানেই শুরু হয়ে গেছে পুজোর তোড়জোড়। ঝাড়গ্রাম থেকে কার্তিক জ্যাঠা( মালাকার) চলে এসেছেন ইন্দকুড়ির দুর্গা ময়দানে, দুর্গা ঠাকুর গড়তে। সন্ধ্যে হলেই শুরু হয়ে যেত যাত্রাপালার মহড়া। পুজোর তিনদিনে তো তিনটে যাত্রা হোতই, একটা বয়স্কদের,
একটা মাঝ-বয়সীদের, আর একটা উঠতি যুবকদের। ঠাকুরমা বলতেন, "গমা এলেই জোড়ো হয় যত পরব।"
যাত্রা আমার ছোটবেলা থেকে বড় প্রিয়, বিশেষ করে গ্রামের যাত্রা। আসলে যাত্রা আমার রক্তে, যৌবন বয়সে দাদু ছিলেন যাত্রার প্রধান নারী চরিত্র। ঠাকুমার মুখে শুনেছি গ্রামের জমিদার শীতল প্রসাদ লাহা বাবুর সেরেস্তায় কাজ করতেন দাদু। ছবির মত সুন্দর ছিল তাঁর হাতের লেখা, তাঁর লেখা কয়েকটি খাতা আমি এখনো সযত্নে রেখে দিয়েছি আমার সংগ্রহশালায়। এখনকার ছেলে-মেয়ের চোখে বিস্ময়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দাদু ছিলেন শিক্ষিত, দাদু গর্ব করে বলতেন, ৪২ সালে লালগড় স্কুল থেকে আমি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিলাম, কয়েকটা নম্বরের জন্য পাস করতে পারিনি। দিদির বাড়ি চ্যাম্পটাআড়ায় চাষের কাজ, গোরুর সেবা, আনাজ পরিচর্যার কাজ করে, আল ভেঙ্গে স্কুলে যেতেন যা এখনকার ছেলে মেয়ে কল্পনাই করতে পারবে না। এখন এর মায়েরা তো ছেলে মেয়েদের ড্রেস করে স্কুলে এনে টিফিনে, কি খাবে বাবা, কি খাবে বাবা,--- তখন দুটো শুকনো মুড়ি ছিল বড় সৌভাগ্যের জিনিস।
জমিদারি সেরেস্তায় দাদুর চাকরি, রাজবাড়ীর সঙ্গে যোগাযোগ, অত্যন্ত সুদর্শন দাদু যাত্রায় প্রধান নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করার সময় কেউ ধরতে পারতেন না তিনি ছেলে। দাদু বলতেন, "কলকাতা থেকে তার ড্রেস, জুয়েলারি, হেয়ার সব আসতো। রাজ বাড়ির সেজবাবু কোলকাতা থেকে মেকআপ ম্যান আনতেন। "ভাবা যায় প্রায় আশি বছর আগের কথা। আর বিখ্যাত সব পালা লিখতেন শিলদার দিবাকর চট্টোপাধ্যায়। যার মধ্যে বজ্রসৃষ্টি, দক্ষযজ্ঞ অজামেল, সাবিত্রী সত্যবান, কুরুক্ষেত্র, দ্রৌপদী, ও সুলতানা রিজিয়া-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বলা অত্যুক্তি- প্রতিটি পালারই প্রধান নায়িকা চরিত্র আমার দাদু। দ্রৌপদী, মহামায়া, সাবিত্রী-তে অসামান্য দক্ষতা দেখালেও সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে জয়ের শিরোপা সুলতানা রিজিয়া চরিত্রই দাদুকে আলাদা মাত্রা দিয়েছিল, যার জন্য এখনো আমাকে অনেকেই কৌতুক করে সুলতানা রিজিয়ার নাতি বলতেন। উল্লেখ্য যে কয়েকটি পালা মাখনলাল নট্ট, নট্ট কোম্পানির জন্য দিবাকর বাবুকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে নিয়ে যান। লাহাবাড়িতে পুজোতে যাত্রা মাস্ট, আগে সাত দিন ধরে যাত্রা চলতো, এখনো সেই ধারা অব্যাহত তবে একদিন হয়।
আমার বয়স যখন ছয় বা সাত আমাদের বাড়ির কাছে একটা নির্মীয়মান পাকা বাড়িতে চলত মহড়া। বাবা বলতেন তাড়াতাড়ি পড়া করে নেয় মহড়া দেখতে নিয়ে যাব। তখন এন্টারটেইনমেন্ট বলতে তো কেবলমাত্র রেডিও, আর পাড়াগ্রামের থিয়েটার যাত্রা। "ভূতের মুখে রাম নাম", "জেল থেকে বলছি", "ঝিনুকের মুক্তো", "গোলাপের রক্ত"," রাধার নিয়তি"," সাপুড়ের মেয়ে", "মীনাবাজার," বাঙালি নাচ ঘরের কান্না," কেনারাম বেচারাম, "সেমসাইড", "ভাড়াটে চাই", "চোখে আঙ্গুল দাদা, "শিবঠাকুরের আপন দেশে", এখনো যেন আমার চোখের সামনে ফুটে উঠে। আমার সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা ছিল গ্রীনরুম। যাত্রা আরম্ভ হওয়ার দু'ঘণ্টা আগে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারতাম। কখনো বা একটু সাহস করে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে অবাক চোখে দেখতাম আমাদের মাস্টারমশাই কেদারবাবু পরচুল ও দাড়ি লাগিয়ে কেমন অচেনা মানুষ হয়ে গেছেন।
মীনাবাজার যাত্রাপালায় ঁঅশোক চৌধুরী দিল্লির বাদশা আর শোভারাম মন্ডল আহম্মদ শা আবদালি, যার অসাধারণ মেকআপ আর হাসি ছোট ছেলেদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। তরোয়ালের ডগায় চোখের মনি তুলে নেওয়া যা আমার শিশুমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। বাবা বলেছিলেন বোকা কোথাকার, মুকুটের পেছনেই তো রং লাগানো তুলো ছিল ওইটাই চোখ!
আজ বড় মিস করি সেই রঙিন দিনগুলো, কতো বর্ণময় ছিল, আজ বড় ফ্যাকাসা, বিবর্ণ। মানুষ বড় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, শুধুমাত্র স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়েই ছোট্ট পরিধি, বাবা মা আজ বোঝা, শুধুমাত্র রোজগার বাড়ানো, অর্থের পেছনে কলুর বলদের মতো ছুটে চলেছে মানুষ, অর্থই একদিন হয়ে যাবে অর্থহীন, নিজের মরনকূপ নিজেই খনন করে রোগে-জ্বালায় হয়ে যাবে দিশাহীন। তাই উচিত অর্থের পেছনে না দৌড়ে নিজে আনন্দে এবং সকলকে আনন্দে রাখার প্রচেষ্টা, তাতে নিজের ও নিজের পারিপার্শ্বিক সকলের মঙ্গল।
বন্ধুদের সাথে প্রথম পুজো
দী পা লি দা স
দিনটা ছিল ২৩ শে অক্টোবর সোমবার নবমীর দিন। আমরা সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করে ছিলাম ফালাকাটা যাবো। কথা মত সবার সকাল ১১ টায় বের হওয়ার কথা। কিন্তু ওই যে বাঙালি বাড়ি থেকে বের না হতেই বলে আর পাঁচ মিনিট! যাইহোক ১১:৪০ নাগাদ টোটোতে উঠে ধূপগুড়ি বাস টার্মিনাসে যাত্রী সংগ্রহরত কন্ডাক্টরের সাগ্রহ আহ্বানে বাসে উঠে পড়লাম, তারপর গিয়ে দেখি সবাইকে আলাদা আলাদা বসতে হলো বলে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। যাইহোক আমি সানা আর নিকিতা তিন জন কোনো মতে ২ জনের জায়গায় বসে আছি। সামনে চুমকিদি ও পায়েল ঠিকঠাক করেই বসেছে। বাকি রইলো পুজন, দীপঙ্কর আর তন্ময় ওরাও কোনরকমে কোলাকুলি করে কিছুদূর গিয়ে একটি ফাঁকা সিট পেলো, তাও আবার পাশে একটা মেয়ে! এমন সুযোগ আর কে ছাড়ে! ব্যাস পূজন গিয়ে ওখানে বসে পড়লো যদিও বেচারা মেয়েটির সাথে কোনো কথাই বলে নি! তাতে কি আমরা তো বন্ধু একটু পর পর কি রে! ওই--- উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না, নাকি? এসব বলতে শুরু করি আর মেয়েটির দিকে ইশারা করি। এমন করতে করতেই আধ ঘণ্টার মধ্যে ফালাকাটা পৌঁছে গেলাম।
আমরা ভীষণ এক্সসাইটেড ছিলাম কারণ প্রথমবার এভাবে বন্ধুরা মিলে পুজোয় ঘুরতে যাওয়া। কিন্তু আমাদের মন ভেঙে গেলো ফালাকাটায় পৌঁছে, যেমনটা ভেবেছিলাম সেরকম জাঁকজমক ছিল না আর কি।
প্রথমেই একটা প্যান্ডেলে গিয়ে ঠাকুর দেখে একটা সেলফি নিতেই নাকে আসলো খিচুড়ির গন্ধ, আহা! ভাবলাম খিচুড়ি খেয়েই যাই। কিন্তু কে জানে কতক্ষণে হবে। তাই আমরা দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম অন্য প্যান্ডেল দেখতে, কিন্তু সেখানে আর খুব একটা মন লাগছিলো না আমার, মন তো প্রথম থেকেই কোচবিহার কোচবিহার করছিল, জানি--- আমি যদি এটা কাউকে বলি আমাকে প্রথমেই ধুয়ে দেবে। তবু মনের কথা মনে না রেখে বলেই ফেললাম চল কোচবিহার যাই! সে কথা শুনে প্রথমেই পায়েল বলে উঠলো যে তোরা যা আমরা বাড়ি যাই, মানে পায়েল আর চুমকি। নিকিতা ও যাবে না বলে ঠিক করে নিল। ওদের অসুবিধা হলো কোচবিহার গেলে বাড়িতে ফিরতে দেরি হবে। এদিকে আমি যে নাকি সন্ধ্যা বেলার পর বাড়ি থেকে বের হতাম না, সেদিন যেনো এক অন্য শক্তিই কাজ করছিল আমার মধ্যে। যাইহোক কোচবিহার যাওয়া নিয়ে দীপঙ্কর, পূজন, তন্ময় ও আমার কোনো আপত্তি ছিল না। তখন প্রায় ১ টা বেজে পার হয়ে গিয়েছিলো। আমরা চার জন মেয়ে এখন একজন কমে গেছে, সুতরাং চার জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে কোচবিহার যাওয়া নিয়ে! আমি ওদের কে আশ্বাস দিলাম যে সন্ধে ৬ টার মধ্যে ফিরে আসবো। এই বলে নিকিতা রাজি হলেও পায়েল ও চুমকি দি নারাজ। কি আর করা যায় আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি ওদের রাজি করানোর জন্য। আমাদের এই দ্বন্দ্বকে আলোচনা করে ঠিক করতে বলে ছেলেরা একটু দূরে খেলনার দোকানে গিয়ে বাচ্চাদের বন্দুক দিয়ে খেলছিল...
তারপর আরো ১০ মিনিট পর ওদের রাজি করানো গেলো। অবশেষে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে সাতটা টিকিট কেটে আনলো ছেলেরা। তারপর দেখি বাসটাতে এত ভিড় যে উঠতেই পারছিলাম না আরো মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে রইলাম এই ভেবেই যে বাসে উঠবো কিভাবে? তারপর আমিই বলে উঠতে লাগলাম যে উঠে পড়ি ধাক্কা ধাক্কি করে, এই বলে আমি একদম পেছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম কোনো মতে, আমার পাশে নিকিতা, দীপঙ্কর, পায়েল ও চুমকি দি। আর তন্ময় ও পূজন আটকে গিয়েছিলো গেটের সামনে। এবার আরো মিনিট দশেক পর ২ টা নাগাদ বাসটা ছাড়লো, কিমি খানেক যেতেই এক বয়স্ক মহিলা নেমে পড়লেন। আর সেই খালি সিটটায় নিকিতাকে বসতে বললাম, সাথে দীপঙ্কর ও বললো "নিকিতা কে বসতে দে", কারণ ওর মাথা সব থেকে বেশি গরম ছিল তখন। এদিকে তো বলতে ভুলেই গেলাম যে তন্ময় আর কন্ডাক্টরের মধ্যে কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি লেগে গেলো। সেসব কথা যাক, এদিকে আমরা দাঁড়িয়ে যাচ্ছি বাসে, তার মধ্যে আমি কিছু বলতে গেলেই দীপঙ্কর আমাকে চুপ করিয়ে দেয় বলে আর বেশি কথা বললাম না রাস্তায়। অনেক ধানক্ষেত , পুকুর, আর মাঝে মাঝে দু'একটা করে প্যান্ডেল দেখতে দেখতে খাগড়াবাড়ি পার করে গেলাম। মণীন্দ্রনাথ হাইস্কুল পার হতেই বুঝতে পারলাম কোচবিহার পৌঁছে গেছি। কিন্তু বাসটা ডিপো পর্যন্ত যাবে না, তাই আগেই নামতে হলো। বাস থেকে নেমেই তন্ময়কে জিজ্ঞেস করলাম বাসে কী নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল? তখন ও বলল যে কন্ডাকটর নাকি কটুক্তি করেছে। ততক্ষণে এক টোটোওয়ালা কাকু এসে হর্ন দিচ্ছিলো যে যাবে নাকি? কিন্তু আমরা কেউই ঠিক কোথায় কোথায় পুজো হয় কিছুই চিনি না। তাই কাকুকেই জিজ্ঞেস করলাম উনি বললেন যে সুভাষপল্লীতে ভালো পুজো হয় আরো কয়েকটা ক্লাব এর নাম বললেন। আমরা উঠে পড়লাম টোটোতে উনি প্রথমেই আমাদের সুভাষ পল্লী নিয়ে গেলেন আমরা গিয়েই দেখতে পেলাম বাঁশ দিয়ে তৈরি বড় প্যান্ডেল যার মধ্যে কোনো কাপড় লাগানো ছিল না। পুজো সেখানে জমজমাট দেখে আমরা সবাই খুশি হলাম হাতে মাত্র ২ ঘণ্টা নিয়ে আরো পাঁচ-ছটা প্যান্ডেল ঘুরে দেখালেন টোটোওয়ালা কাকু। যার মধ্যে একটায় ছিল লাল কেল্লা যেখানে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডটা সুন্দর আসছিল। তারপর পূজন সম্ভবতঃ টোটোওয়ালা কাকুর হিসেব মিটিয়ে দিলো। ওই কাকু আমাদের আবার বাস ডিপোর সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো।
আমরা হেঁটে হেঁটে খাওয়ার দোকানের দিকে এগোতে লাগলাম। তারপর একটা ছোট্ট দোকানে গিয়ে বসলাম । দোকানে খাওয়ার কান্ড কারখানা না বলাই ভালো। শুধু এতটুকু বলতে পারি যে, যে কেউই ভাবতে পারে আমরা বহুদিন যাবৎ খাওয়া দাওয়া করিনি। আসলে কিন্তু তা নয়, বন্ধুরা এমনই হয়ই- কে কার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে খাচ্ছে--- এটাই আনন্দ, থাক সেসব কথা।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার গেলাম টিকিট কাউন্টারে, সেখানে গিয়ে আমিই জিজ্ঞেস করলাম কাকু "এর পর ধূপগুড়ির বাস কখন আছে?" উনি বললেন "এটাই লাস্ট", ব্যাস উঠে পড়লাম বিনা টিকিটে। উঠেই ভিড়, আবার দাঁড়িয়েই যেতে হবে উপায় নেই। পাশের সিট থেকে একটা দাদা উঠে যাওয়ায় নিকিতা বসলো কিন্তু ওই দাদাটা আবার ফিরে আসায় জায়গাটা ছেড়েও দিতে হলো।
তখন বাজে ৫:১০ মিনিট সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামল কেবল। বাস চলতে শুরু করল আমি আর নিকিতা--- ওহ্, হ্যাঁ--- আমার নামটা তো বলাই হলো না, আমি দিপালী। আর দীপঙ্কর পূজন, পায়েল ও চুমকি দি সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। কিছু পরে আমরা মুখোমুখি দুটি সিট পেলাম, যার একটিতে আমি আর অপরটিতে নিকিতা বসে পড়লাম। এবার আমার কোলে চুমকি দি আর পায়েল ও নিকিতার সিটে পূজন ও তন্ময় সিটের হাতলে বসে পড়লো। দীপঙ্কর বেচারা দাঁড়িয়ে, কিছুদূর গিয়ে পূজনকে বললাম, "দীপঙ্করকে বসতে দে"। শেষে সে কিছুক্ষণের জন্য বসে এসেছিল। আমাদের পাশের সিট দুটিতে এক দাদা ও এক দিদি বসেছিলো। আমাদের কথাবার্তা শুনে ওদের চোখেও খুশির ঝিলিক, একসময় ওরা বলে উঠলো যে আমাদের কলেজ লাইফের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তারপর গল্পে গল্পে পাহাড় ঘুরতে যাবার কথা বললো, ছবি দেখালো।
এদিকে বাইরের আকাশটা যেনো একেবারে লাল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে কী যে ভালো লাগছিলো! ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। ওদিকে নিকিতা, পায়েল ও চুমকি দি বাড়ি গিয়ে কি বলবে, এই ভেবে তাদের মনে ভয় জমতে শুরু করেছে। আমার যেনো কোনো তাড়া নেই বাড়ি যাওয়ার। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো এই পথটা আজ যেন শেষ না হয়--- চোখে প্রত্যাশা ছিলো সেদিন আমার। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বইছে আর আমার চুলগুলোও খুলে দিলাম!
কেনো খুলে দিলাম? কেউ বলছিলো! হ্যাঁ, বলেছিল! কে বলছিলো? আমার অন্তরাত্মা!সেদিন আমার সাথেই ছিল, ছিল একরাশ আক্ষেপ। তখন মনে হচ্ছিলো সাথে থেকে যাক সব স্মৃতি এভাবেই ...।
ফালাকাটা তো আর আসে না! পথ আর ফুরোয় না--- আত্মমগ্নতা কাটিয়ে অবশেষে পৌঁছোলাম নিজের জায়গায়।
এদিকে পায়েল আবার বলছিলো কখন যে বাড়ি আসবে , আমার তখনো ও মনে হচ্ছিল আজকের পথটা শেষ না হোক। এত হইহুল্লোড় করছিলাম যে বাসের লোক গুলো আমাদের দিকে তাকিয়েই রয়েছে। আর ওরাও হাসাহাসি করছে আমাদের কথা শুনে। আমি কোচবিহার এর আগেও অনেকবার গেছি এর পরেও যাব। কিন্তু বন্ধুদের সাথে যাওয়ার এই দিনটি আমার জীবনের চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন