স্মৃতিকথা

কাশ্মীর

শু ভ্র জী ৎ বি শ্বা স

পর্ব ৩


শ্রীনগরে বেশ কিছু দিন কাটলো। ততদিনে ইসলামপুরের ভদ্রলোকের দয়ায় স্থানীয় বিষয়ে অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে আমার। আসলে আমার সকাল ও সন্ধ্যার নিয়মিত আড্ডার জায়গা হয়ে উঠেছিলো ইসলামপুরের ভদ্র লোকের দোকান। আর হলফ করে বলতে পারি বাংলা হোক বা কাশ্মীর, চায়ের দোকানে যদি কিছুটা সময় কাটানোর ধৈর্য্য আপনার থাকে তবে যে কোনো বিষয়ে যা তথ্য আপনি সেখান থেকে পাবেন তা আপনি খবরের কাগজ, চ্যানেল বা ইউটিউব দেখে জানতে পারবেন না। দোকানটায় দিনের বেশ কিছুটা সময় কাটানোর ফলে ওনার ছেলে মোমিন এর সাথেও বেশ একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, যদিও বয়েসে সে অনেকটাই ছোট। শ্রীনগরে সাধারণত কাশ্মীরি ভাষাই বহুল প্রচলিত। হিন্দি আর ইংরেজীর ওপর দক্ষতা থাকলে তো সমস্যাই নেই। তবে বাংলা দিয়ে ওখানে চলা মুশকিল। একদিন শ্রীনগরের এক সমৃদ্ধ কাপড়ের ব্যবসায়ী সওকত সাহেবের সাথে ঐ দোকানেই প্রথম দেখা হলো। প্রচন্ড ঠান্ডায় আগুনের পাশে বসে চা পান করতে করতে উনি ওনার দোকানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন যা শ্রীনগর লাল চক এ অবস্থিত। স্থানীয় পথ ঘাট প্রায় পরিচিত ছিলো তাই একদিন বেড়িয়ে পড়লাম একাই ওনার দোকানের উদ্দেশ্যে। সরু গলির মধ্যে দিয়ে ওপর তলায় দোকান। ভেতরে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। বিপুল সম্ভার কাশ্মীরি শালের। সেদিন শুধু চা সহযোগে আড্ডা মেরেই ফিরলাম। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি প্রতি রবিবার লাল চকে হাট বসে। সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত মোটামুটি হাট চলে। সেখানে ২০০ টাকা থেকে শাল, জ্যাকেট, চাদর, ফ্যারন সমস্ত কিছুই আপনি পেয়ে যাবেন। তাই যদি কখনো কাশ্মীর যান তবে অন্তত দুটো রবিবার যাতে শ্রীনগরে কাটাতে পারেন সেই পরিকল্পনা নিয়েই যাবেন। কারণ একটা রবিবার যদি হাতে নিয়ে যান আর পকেটে পর্যাপ্ত টাকা ও দরদামের অভিজ্ঞতা থাকে তবে খুব আফসোস করতে হবে। সেই হাটে যদি একটু দরদাম করেন তবে হাজার চারেক টাকার জিনিস ও ৭০০ /৮০০ টাকা বা তার ও কমে কিনতে পারবেন। আমার প্রথম উদ্দেশ্য ছিলো একটা জ্যাকেট কেনা কারণ বাড়ি থেকে যা কিছু পরার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে গিয়ে সেগুলো বেকার মনে হচ্ছিল। মোটামুটি হাজার টাকার কমেই খুব সুন্দর ও টেঁকসই একটা জ্যাকেট নিলাম। সেই লাল চকেই একটা বিশাল তিন তলা রেস্টুরেন্ট ছিল যার নাম মামিস প্লেস। আমাদের পাঁচ তারার ডাল ভাত খেতে খেতে যখন মন ভরে যেত মাঝে মধ্যেই এক বেলা মুখ পরিবর্তন করতে ওখানে ছুটে যেতাম সবাই। একবার ওখানে খাওয়ার পর সবাই ১০/২০ টাকা করে জমা করে টিপস্ দেওয়া হবে বলে স্থির করা হলো। এক বন্ধুর যা ঘটলো তাতে একদিকে লজ্জা অন্যদিকে হাসিতে অবস্থা খুব খারাপ হলো। যে লোকটি বিল দিয়ে গিয়েছিলো তার হাতে বিল সমেত টিপস্ তুলে দিতেই আমাদের বন্ধু রেগে আগুন। শেষে ভাঙ্গাচোরা হিন্দিতে রাগে গজগজ করতে করতে বলেই উঠলো "টাকা কি পেড়পে ফলতা হ্যায়।"-সবাই ভীষণ লজ্জা বোধ করলো। অবশ্য যে বিল নি‌তে এসেছিলো সে এই কথার মাথা মুন্ডু অনুধাবন করতে না পেরে ফিরে গেলো। এবার শুরু হলো সেই বন্ধুকে খিল্লি করার পালা যা অনেক দিন চললো। বলে রাখা ভালো ঐ রেস্টুরেন্ট এ মাছ ভাত , চিকেন, মটন, বিরিয়ানী থেকে অনেক কিছুই পাওয়া যেতো বেশ কম দামেই।
                        (ক্রমশঃ)







বই- বিশ্ব গ্রন্থাগার দিবসে আমার স্মৃতিচারণা

শ্যা ম লী ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়


শৈশব তখন কৈশোরের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে।একে একে চোখের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে। মনের আকাশে ভিড় করে আসছে একরাশ নক্ষত্র। কী তাদের দ্যুতি!! বইয়ের পাতায় কখনো তাঁদের তেজোময় অরুনোদয়, কখনো শান্ত করুণ চন্দ্রমা। এই সময় বাড়ির বড়দের জন্য আনা নবকল্লোল, উল্টোরথ, প্রসাদ, সিনেমাজগত, পূজা সংখ্যা দেশ ও আনন্দ বাজার
লুকিয়ে পড়ে ফেলছি। বড়দের জন্য আনা বই পড়ায় অনেক বাধা নিষেধ ছিল। কিন্তু ওই যে! বই পড়ার ব্যাপারে আমি চিরকালের অবাধ্য ছিলাম।এই প্রসঙ্গে আরো ছোট বেলার একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। তখন আমার বছর নয়েক বয়েস হবে। এক ছুটির দুপুরে দাদুর কাছে বায়না করে গ্রন্থাবলীর আলমারির চাবি খুলিয়ে শরৎচন্দ্রের 'গৃহদাহ' ও
'চরিত্রহীন' বই দুটি বার করে
একমনে পড়ছিলাম। অনেক কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না তবু নেশাগ্রস্থের মতো পড়তে পড়তে কখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। জেঠু অফিস থেকে ফিরে আমাকে ওই বই দুটি পড়তে দেখে ভীষণ বকাবকি শুরু করলেন । "এইটুকু মেয়ের হাতে এসব নভেল কে দিয়েছে"?কোনো মতে দাদুর ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে সেবার রক্ষা পেয়েছিলাম।
এই প্রসঙ্গে কবি হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা মনে পড়ছে- "বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে,/বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।/যে বই জ্বালে ভিন্ন আলো,/তোমায় শেখায় বাসতে ভালো/সে বই তুমি পড়বে"। ইতিমধ্যে
কোম্পানি বাগানে (অধুনা রবীন্দ্র কানন) অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র মেলায় প্রতিবছর রবীন্দ্র সাহিত্যের গল্পে পড়া নায়ক নায়িকাদের মঞ্চে দেখতে পাচ্ছি। জটিল মনস্তত্বের ওপর লেখা 'যোগাযোগ', 'চোখের বালি', 'ঘরেবাইরে' চোখের সামনে এসে ধরা দিচ্ছে। শক্ত হচ্ছে রবীন্দ্রমনস্কতার ভিত।
"বইয়ের প্রতি ভালোবাসা
 হলো হৃদয় থেকে মস্তিষ্কে বয়ে চলা এক পবিত্র নদীর মতো যা অন্তরের সংকীর্ণতা কে ধুয়ে দেয়"। হৃদয় থেকে মস্তিষ্কে চললো স্রোত। ভেসে গেলাম । ডুবে গেলাম। মনের সব ক্লেদ, গ্লানি মুছে মন চলেছে কোন অমরাবতীর দিকে। কোন নন্দন কানন! অনুভবের ও জ্ঞানের পাগলঝোরা অন্তরভুবন কে প্লাবিত করছে। প্রকৃতিপ্রেমী বিভূতিভূষণের হাত ধরে শহরের মেয়ে আমি প্রকৃতিকে চিনলাম, 
আরণ্যক, দেবযান ,পথের পাঁচালী, অপরাজিত, ইছামতী। দেবযান পড়তে পড়তে মনের মধ্যে এক অব্যক্ত কষ্ট। গজেন মিত্রের শ্যামা উমাদের ও আশাপূর্ণাদেবীর সত্যবতী, সুবর্ণলতাদের আত্মার আত্মীয় বলে মনে হয়। সুবোধ ঘোষের হিমু, অতিথির তারাপদ, স্ত্রীর পত্রের মৃনালের মতো যুগান্তকারী চরিত্রের সংস্পর্শে আসছি। এর মধ্যে চলছে রামায়ণ, মহাভারত পড়া। হাসির রাজা শিবরাম চক্রবর্তী, যাঁর অক্ষরে অক্ষরে অনুপ্রাস পড়ছি। প্রেমেন মিত্রের ঘনাদা, নারায়ণ গাঙ্গুলীর টেনিদা, আর সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা জীবনে ঢুকে
 পড়েছেন। পড়ছি রহস্য উপন্যাস। আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারো, নীহাররঞ্জনের কিরীটি সুব্রত,
হেমেন্দ্রের জয়ন্ত মানিক, সুন্দর বাবু , শরদিন্দুর ব্যোমকেশ অজিত মনের আকাশে বিচরণ করছে। এতদিনে নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে অনেক বই। বৈঠকখানা ঘরের দেওয়াল
 আলমারী দুটিতে চালু করে দিয়েছি লাইব্রেরি। প্রতিটি বইতে ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে তালিকা তৈরি করে পাড়ার ও স্কুলের বন্ধুদের খাতায় নাম লিখে বই ইস্যু করা শুরু করেছি। লাইব্রেরির দেওয়ালে লিখেছি পিয়ারসন স্মিথের উক্তি- যে বই পড়ে না তার মধ্যে মর্যাদাবোধ জন্মে না"।শনিবার বিকেলে বই নিতে বেশ ভিড় হয়। বন্ধুরা তাদের নিজস্ব বই, পড়া হয়ে যাওয়ার পর অনেক সময় লাইব্রেরিতে দিয়ে যায়।লাইব্রেরিতে ইংরেজি গল্পের বইয়ের ও ভালো স্টক ছিল। 
H.G. Wells এর টাইম মেশিন, জুল ভার্নের Around the World in 80 days, ভিক্টর হুগোর Les' Miserable, Robert Louis Stevenson এর ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড, Mary Shelley র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, Jonathon swift এর গালিভার্স ট্রাভেল, Alexander Dumas এর কাউন্ট অফ মন্তেক্রিস্ট, Charles Dikens এর A tell of two cities, David copperfield, Oliver
Twist আরো কত কী!

বেশ কিছুদিন এই খেলাটা খুব মন দিয়ে খেলেছিলাম ।ইতিমধ্যে স্কুলের দুই বন্ধুকে নিয়ে 'ত্রিশাখা' বলে একটি হাতে লেখা মাসিক পত্রিকা বার করেছি। তাতে নিয়মিত গল্প, কবিতা লিখি। পাতায় পাতায় আমার আঁকা ছবিও থাকে। অন্যান্য বন্ধুদের লেখা, ছবি দিয়ে সাজানো পত্রিকাটি বন্ধু মহলে বেশ মনোগ্রাহী হয়েছিল। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকে দিলেন আমার বাবা। প্রথম পাতায় আমার মা দিলেন তাঁর আশীর্বানী- "সুদীপ্তা তার দীপ্তি দিয়ে/করবে জগৎ আলো,/শ্যামলী তার সজীব রূপে/শ্যামলতা ঢালো।/ স্মৃতির মাঝে সবাই খোঁজে,/অতীত ছায়া খানি,/আমি দিলাম 'ত্রিশাখা'রে/আমার আশীষ বাণী"। বলাবাহুল্য সুদীপ্তা ও স্মৃতি আমার দুই বন্ধু যারা এই পত্রিকার দায়িত্বে আমার সঙ্গে ছিল। যখনই কোনো সৃজনশীল
 কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি
 পিতামাতা সোহোৎসাহে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ।

নবম শ্রেণীতে পিওর সায়েন্স
নিয়ে বেথুন স্কুলে ভর্তি হলাম। এবার বিজ্ঞান এসে হাত ধরলো সাহিত্যের। বিজ্ঞানমনস্ক মন দিয়ে বিচার করছি জগৎকে। নিখিল বিশ্ব যেন হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে। "বই মস্তিষ্কের সন্তান"- Swift এর উক্তি। সন্তান স্নেহে বইকে আঁকড়ে ধরছি বুকের মধ্যে। পড়ার বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্পের বই পড়াও চলছে। সুবোধ চক্রবর্তীর ২৩ খণ্ড "রম্যানি বীক্ষ"। গল্পের গোপাল ও স্বাতীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মন 
 ছুটে বেড়াচ্ছে অচেনা ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে।হাতে পেলাম বনফুলের ছোট গল্প সমগ্র। এই সময় পড়া o Henry র "Short Stories"-এর কথাও মনে পড়ে। ছোট গল্পের সম্ভার নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ সামনে এসে দাঁড়ায়। 
সুনীল, শংকর, সমরেশ বসুদের প্রভাবের কথাও ভুললে চলবে না। আর পূজা সংখ্যায় ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ওঁর মনকাড়া উপন্যাস গুলো নিয়ে। পূজা সংখ্যা দেশ ,আনন্দ বাজারে প্রকাশিত বিখ্যাত লেখকদের উপন্যাস পড়ছি। আমাদের বাড়িতে একতলা থেকে তিন তলা ওঠার দেওয়ালে দেওয়ালে টাঙানো ছিল মহাপুরুষ ও মহানায়ক দের ছবি। বিবেকানন্দ, যীশু
খ্রীস্ট রামকৃষ্ণদেব, গান্ধীজি, সুভাষ চন্দ্র, ঋষি অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন দাশ, সিস্টার নিবেদিতা। উদ্দেশ্য বাড়ির ছোটদের চরিত্র গঠন। এবার তাঁদের জীবন ও কর্ম জীবন নিয়ে বই পড়তে শুরু করলাম। "আমি সুভাষ বলছি"থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস 
জানতে থাকলাম। ইতি মধ্যে উপনিষদ, পৌরাণিক কাহিনী জাতকের গল্প পড়ছি। এই সময়ে আমার দিদির বিয়ে হলো দেব সাহিত্য কুটিরে।দেব সাহিত্য কুটির- যেখানে রূপ কথারা কথা বলে।কলেজের অফ পিরিয়ডে মাঝে মাঝে চলে যাই সেখানে। একবার মাকে নিয়ে দিদির বাড়ি গেছি। মাকে তিনতলায় উঠতে বলে
আমি দাঁড়িয়ে গেছি ওদের দোতলায় জালের দরজার সামনে। সে এক বইয়ের সাম্রাজ্য। দরজার ওপারে বইয়ের মলাট লাগানোর দায়িত্বে অনেক কর্মচারী।আমাকে একটা টুল এগিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। একটি অপ্রকাশিত বই হাতে আমি চলে গেছি এক স্বর্গলোকে।
‌এক ঘন্টা পরে কাজের লোক এসেছে আমার খোঁজ করতে। মায়ের কাছে আমার এই ব্যবহারের জন্য মৃদু ভর্ৎসনা ও জুটেছে। ওঁদের সঙ্গে দেখা না করে ওঁদের বিনা অনুমতিতে নীচের তলায় বই পড়তে বসে গেছি এই অপরাধের জন্য। এই সময় মা ও বাবা বেলুড়ের
বীরেশ্বরানন্দ মহারাজের কাছে দীক্ষা নিলেন। বাড়িতে এলো শ্রী ম লিখিত কথামৃতম। তার প্রতিটি খন্ড আগ্রহে পড়ি। চলছে ইংরেজি সাহিত্যের চর্চাও। পড়ছি Sidney Sheldon, Harold Robins এর Adventures, Carpet Baggers, Arther Hailey র Hotel, এয়ারপোর্ট। বাইরের চঞ্চলতা কমে মন ক্রমশ পরিণত ও অন্তর্মুখী
হচ্ছে। অন্তরের সৌন্দর্য্যে ঋদ্ধ হতে থাকলাম। লহমায় মন থেকে ঈর্ষা, হিংসা,পরশ্রী কাতরতা দূর হয়ে গেল। জীবনের মণি মুক্তা কুড়িয়ে নিতে শিখছি। যে ঐশ্বর্য্য মনের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে তার কাছে সাংসারিক লোভ, মোহ, ক্ষুদ্রতা অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়। চারিদিকে শুধুই আনন্দের সাগর। শুধু অবগাহন করার অপেক্ষা।
কবি শ্রীসুদীপ্ত চক্রবর্তীর ভাষায় "অশান্ত কষ্টের মাঝে 
অনন্ত আশ্রয়, বই যদি সাথে থাকে লাগে নাতো ভয়"। টুপার বলেছেন "একটি বই হলো বর্তমান ও চিরকালের জন্য সব চেয়ে উৎকৃষ্ট বন্ধু"।
সত্যিই তাই। দিশেহারা মুহূর্তে বই কাঁধে হাত রাখা পরম বন্ধুর মত। বই দুঃসাহসীকে দিয়েছে পরিণত ও স্থীতধী হবার, দুরন্তকে শান্ত হবার, অবিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানমনস্ক হবার শিক্ষা। স্বভাবে ছিল গভীরে পৌঁছবার নেশা। জীবনরূপী মৌচাকের পরতে পরতে যে মধু জমে আছে মধুকরের মতো সেই অমৃত রস সন্ধান করে চলেছি।আজও সেই চলা অব্যাহত।








আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

চ ন্দ্রা ণী চৌ ধু রী


রবীন্দ্রনাথকে প্রায়ই আমার সমবয়সী মনে হয়। এই তো সেদিন যখন করোনায় আমার পিসতুতো দাদা অসময়ে চলে গেল, একা একা, অদেখা অজানার দেশে, হসপিটাল থেকে শুধুমাত্র একটা ফোনকল। ব‍্যাস। আর কিছু নয়। আর দেখা হয় নি। বাবা মারা যাওয়ার পর ঐ দাদাই খানিকটা বটের ছায়ার মত এক মায়াময় আরাম দিত। সময়ে অসময়ে পাশে থাকত। সেদিনও এমন অকাল নিম্নচাপের বৃষ্টি নেমেছিল। আমি জানালায় আর বাইরের ঘোর কালো আকাশটা। মাত্র আমরা দুজন মুখোমুখি। আর কেউ নেই চারপাশে। তখন মনের মধ্যে বেজে চলেছে --- আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে। বসন্তের বাতাসটুকর মতো। সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে---ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত – সে চলে গেল বলে গেল না – সে কোথায় গেল ফিরে এলো না --- এই গানটা গুনগুন করে আলোড়িত করছে আমার মনপ্রাণ চোখের জলে। সত্যিই তো। কেমন হঠাৎ চলে গেল। বলে গেল না। ভাবছি, কবি আমার মনের কথা জানলো কেমন করে। আমিও তো ঐ কথাই ভাবছি। 

তারপর খরস্রোতা নদী হয়ে সময় ধীরে ধীরে শোক ভুলিয়ে মন নরম করে আবার জীবনমুখী করে তোলে। সত্যিই তো। কত কাজ। রোজনামচায় তখন মনে হয় আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। শীত গ্রীষ্ম বর্ষার সাতরঙে ভেসে চলে যাই। মাঝে মাঝে রাতের দিকে বারান্দায় দাঁড়াই। হয়তো পূর্ণিমার আলোয় চারদিক উচ্ছ্বসিত। মনেহচ্ছে চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে। কি অদ্ভুত। সত্যিই জোৎস্না প্লাবিত হাসিখুশি আকাশ যেন আমার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। আমিও তো ঐ গানটাই ভাবছি মনে মনে। কি আশ্চর্য। এমন ধ্রুবসত‍্য অনুভূতি যেন আবহমান কালের। কোনোদিন পুরোনো হবার নয়। হয়তো বা কোনো নিবিড় ভালোলাগাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলেও তা থাকে না। ভালোলাগা ভীষণ ক্ষণিকের। তখন মনেহয় সব ভালো লাগাই আসলে ক্ষণিকের অতিথি। স্বল্পায়ু। 
সকালে যখন এককাপ লেবু চা নিয়ে বারান্দায় বসে আলোর সঙ্গে মাখামাখি করি তখন তো সেই গানটা গাই – আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে সঠিক বাণীর সঙ্গে সঠিক সুর মিললে কি জিনিস হতে পারে এবং আমরা তা আজও উপলব্ধি করছি। যেমন সুমন চট্টোপাধ্যায়ের জীবনমুখী গান বাঙালির ভাবনাচিন্তার খোলনলচে পাল্টে দিয়ে রবীন্দ্রপরবর্তী একটা আল্ট্রা মডার্ন আলোয় ভরিয়ে তুলেছিল। এবং গান কবিতায় নূতন ধারা এনেছিল। 
আবার জীবনে এমন কঠিন সময় আসে যখন মন ব‍্যাকুল হয়ে কাঁদে। কোথাও জুড়াবার পথ খুঁজে পাই না। তখন আবার তাঁর কথাতেই সান্ত্বনা -- ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত‍্যেরে লও সহজে। এও এক অমোঘ বাণী মনেহয়। 

জীবনের সব পরিস্থিতির জন‍্য তিনি তাঁর কাব‍্য কথা গান নিয়ে ঠিক যেন আমার পাশটিতেই দাঁড়িয়ে আছেন নিখাদ স্নেহে। মাথায় হাত রাখছেন। আমার মনের কোণে। আমার চলার পথে।








পয়লা বৈশাখ হালহকিকত ( নিজের কথা ) 

ম ধু প র্ণা ব সু 


তখন আমার দশ পার হয়ে গেছে। রেজ্জাক মিঞার কাছে তৈরী হত পয়লা বৈশাখের নতুন ফ্রক, হালকা ফুলেল ছাপায় বুকে ফ্রিল। শুধু তাই নয় দিদি আর আমার নতুন জামাই নয়, মায় টেপ ফ্রক ইজের অবধি একেবারে আনকোরা নতুনের উচ্ছ্বাস মাখা। সে ছিল আমাদের বিংশ শতকের নববর্ষ। আমাদের দু মহলা বাড়ির তিন দালানে নববর্ষের আগে চুনের পোঁচ পড়ত একবার। মা, ছোটমা, মেজমার জন্যেও আসতো তাঁতের শাড়ি। বাবু, কাকাদের জন্যে ফতুয়া পাজামা। ঠাকুরদার চালের ব্যবসা থাকলেও তার তিন ছেলে কেউই সে ব্যবসা রাখেনি, সবাই সওদাগরি অফিসে ঢুকে পড়ে এবং বিয়ে থা করে সংসারী হয়। আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার, সতেরো জনের পাত পড়তো দুবেলা। বাড়ির উঠোনের মাঝে সিমেন্টের ওপর ছিল একটা লাল পদ্মফুল আঁকা, আর মা আমার পয়লা বৈশাখের দিন বঁটি নিয়ে বসতো চার কেজির কাতলার মুড়ো ধর আলাদা করতে। খিদিরপুরের দোকান থেকে আসতো বেহারি ভুকোলের ভেট, দাদুর জন্যে। বস্তা চাল, কাঁদি কাঁদি কলা, গ্রীষ্মের প্রথম আম, আর ইয়া পেল্লাই এঁচোড়। চিঙড়ি মাছ দিয়ে জম্পেশ করে রান্না, মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, লম্বা ডাঁটিঅলা বেগুন ভাজা, কাতলার কালিয়া, সাথে দাদুর প্রিয় ক্ষীর আর আমের অম্বল। নববর্ষের দ্বিপ্রাহরিক ভোজন এমনই ছিল ছোট বেলায়, তারপর এই নাতনীদের সুবাদে মাছের সাথে শুরু হল খাসির মাংস। বিকেলে বাবু কাকাদের বন্ধুরা ভিড় জমালে ছাদে একপ্রস্থ ঘুড়ির প্যাঁচ ছিল অব্যর্থ, আর মা কাকিরা জোগান দিত চা, আলুর চপ, বেগুনি। আবার কোন বছর স্পেশাল মাংসের ঘুগনি। 
আমাদের জন্য নতুন জামা পড়ে হুটোপুটিই ছিল এক অনাবিল আনন্দের। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরোনো নববর্ষ ছিল পাটভাঙা হলুদ তাঁতের শাড়িতে নিজেকে বেশ নায়িকা স্বপ্নে খেয়ালী করে সান্ধ্য জলসায় বাংলা গানে বিভোর, দূরদর্শনের পর্দায় পুরাতনী আড্ডায় বাঙালি নস্টালজিক স্মৃতিতে গর্বিত হয়ে ওঠার একটা ক্ল্যাসিক্যাল যুগ। রামকুমার চাটুয্যের পুরাতনী টপ্পা গান, পঙ্কজ সাহার অতুলনীয় সঞ্চালনায় বাঙালির বর্ষবরণ। ক্রমশ চলে এলো কালীঘাট মন্দিরের আশেপাশে হালখাতা পুজো, রসধারার মিষ্টি দই, পাঁঠার মাংসের নাক ভোজন। যুগের রকেট গতিতে তারপরেই এসেছে ৬, বালিগঞ্জ প্লেস, আহেলি, ভজহরি মান্না, তেরো পার্বনের আদবকেতা, বাঙালী হয়েছে রেস্তোরাঁ মুখী। বাংলাদেশী ঢাকাই জামদানী, গিলে করা পাঞ্জাবী পরিহিত ধোপদুরস্ত বাবু বিবিরা হলেন আধা সাহেবিয়ানায় মুহ্যমান। নববর্ষের সেকাল তার আভিজাত্য নিয়ে যতই সঙ্কটে থাকুক না কেন, ধনী বাঙালীরা বাড়ির হেঁসেলের পাট চুকিয়ে হয়ে পড়েছেন রেডিমেড রসনা তৃপ্তির পক্ষপাতি। সেই সাথে দোকান দপ্তরের সাবেকিচলনও এখন আধুনিকতার পোশাকে প্রসাধন বদলে ভীষণ রকম ছাঁটকাট সংক্ষিপ্ত। এখন মা ঠাকুমার হাতের বোঁদে, নিমকি, গজা, বাদ দিয়ে ঢুকে পড়েছে দোকানের সরভাজা, গুঁজিয়া, জলভরা, উজ্জলার চানাচুর। বিকেলে দোকানে দোকানে হালখাতায় কোকালোলা খেয়ে মিষ্টির বাক্স কদাচিৎ আসে। তবুও গ্রীষ্ম বরণের সাজসজ্জায় নববর্ষের দিনটা যতটা অনাবিল আনন্দ আর গৌরবের ছিল, হাল ফ্যাশানের পয়লা বৈশাখ তার কৌলিন্য খুইয়ে 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' হয়ে ওঠার পথে বেশ কিছুটা এগিয়েছে বলতেই পারি। সেকালের বাংলা বর্ষবরণ ছিল এক উৎসব, আনন্দের, কোলাকুলির জিহ্বা তৃপ্তির, একালের নববর্ষ ভারি পকেটে রেস্তোরাঁমুখী হয়ে উঠলেও মিলনের আশ্বাস আর কুশল বিনিময়ের থাকুক চিরকাল মনের এমনই সাধ রয়ে গেছে আজও।








চুপি কথায় স্মৃতি আঁকি

ড রো থী দা শ বি শ্বা স


আজ আষাঢ়ের অষ্টাদশ দিবস। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্র, এরই মাঝে জলভরা মেঘের দেখা মিললেও বৃষ্টির দেখা নেই। ভিজে মাটিতে আষাঢ়ের রথের চাকার সদ্য ছাপ ছড়ানো- এমনটা বুঝি আর হবে না। যোগমায়া কালীবাড়ি থেকে রথ আসতো ওল্ড পুলিশ লাইন (এখন যেখানে গৌড়িয় মঠ)... আমাদের পাড়ার কাকীমা, মাসীমা, দাদা, দিদিদের সাথে আমরা ছোটরাও এসে জুটতাম। রথের রশি ছুঁতে গিয়ে ভিড়ের ধাক্কায় পড়েও যেতাম, আর পরণের ভালো জামা কাদায় মাখামাখি হয়ে যেতো। মোটা বেগবান রশির ঘষা খেয়ে কেটে যেতো কচি হাত। ব্যথায় কষ্ট হতো না, যতো না জামাটার জন্য কষ্ট হতো। আরো কষ্ট হতো যখন দেখতাম সবিতার দু'হাত লুটের বাতাসা প্রসাদে ভরা, আর আমি একটাও পাইনি, কারণ আমি তখন জামার কাদা নিয়ে চিন্তিত, ততোক্ষণে রথ সে স্থান ছেড়ে অনেক দূরে... একে তো পড়ে যাওয়ার লজ্জা, তার ওপর নরম মন, কান্না পেয়ে যেতো, চোখের জল লুকোতে সোজা বাড়ি। সবিতা, জবা, টুলু- ওরা ছিলো খেলোয়াড়। পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে যখন যেমন, তখন তেমন ভাবে চলতে জানতো। প্রয়োজনে দৌড়ে পিঠ বাঁচাতো, বা অনেক সময় নির্ভেজাল মিথ্যা বলে পার পেয়ে যেতো। মিথ্যে বলাটা যে নিঃসন্দেহে একপ্রকার গুন- মন যখন পরিণত হলো, বুঝতে পারলাম সে কথা। কোন গাছে কি ফল, ফুল আছে- সব ছিলো নখদর্পণে। ঋতুভেদে কাঁচা আম, বাতাবিলেবু, জলপাই, ডউয়া, গাব, কুল, আতা, নোনা, পেয়ারা- সব দলবেঁধে ওরা সংগ্রহ করতো। আমি দলে থাকতাম। কিন্তু আজ কি কর্মসূচী, সেটা ওরাই জানতো। জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং স্কুলের জলপাইগাছ থেকে জলপাই সংগ্রহ করতে গিয়ে পড়বি তো পড় বোকাভাইয়ের খপ্পরে আমিই পড়লাম। ওরা সবাই কোচর ভরা জলপাই নিয়ে আমায় ফেলে রেখে দৌড়তে দৌড়তে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো। বেঁটে ও কুঁজযুক্ত বিকটদর্শণ বোকা ভাইয়ের দিকে চোখ পড়লেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে যেতো। বোকাভাই আমাকে নিয়ে সোজা বেসিকের শিক্ষক মেজদার কাছে বিচারের আশায় নিয়ে ফেললো। ধুতি পাঞ্জাবী পড়া সৌম্যকান্তি মেজদা তখন রীতিমতো আমার ইন্টারভিউ নিতে শুরু করেছেন। নাম শুনেই জিজ্ঞেস করলেন, "কে রেখেছেন এই নাম ?", বাড়ি কোথায়, তারপর কোন্ স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ি, রোলনং কতো- তারপর যখন জানলেন, ক্লাসে প্রথম হই, তখন শুরু হলো ইংরেজীতে ট্রান্সলেশন ... মনে হয় খুশী হয়েছিলেন, এরপর বোকাভাইকে বললেন, ছেড়ে দিতে। আমাকে বললেন, বাড়ি যাও। সেই যে মেজদার মতো পন্ডিত ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়েছিলো, মেজদা এখন নেই, কিন্তু মেজদার পরিবারের সাথে আমার আজও সম্পর্ক টিঁকে আছে। উনার একমাত্র মেয়ে টুসিদি আজও আমাকে নিজের বোনের মতোই দেখে। 
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা - নির্বিশেষে আমার খেলার সাথীরা ভোরবেলা বড়ো বড়ো পাঁচিল টপকে ফুল ছিঁড়ে আনতো। ফুল আনতে ইঞ্জিনীয়ারীং কলেজ পর্যন্ত যেতাম। আমি কোনদিন পাঁচিল টপকাতে পারিনি। ফলে ওরা দয়া করে যতোখানি ফুল দেবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ওরা শর্টকাট রাস্তা ধরে করলানদী সাঁতরে রাজবাড়ি মনসাপুজোর মেলায় আসতো, আমি কোনদিন তা পারিনি। করলার পাড় খাড়া, দেখলেই ভয় লাগতো। বিলের জলে নেমে জলসিঙারা সংগ্রহ করতাম, কিন্তু জলঢোঁড়া সাপের ভয়ও পেতাম খুব। ওরা, বিশেষ করে সবিতা ছিলো আমাদের টিমে সবথেকে ডানপিটে মেয়ে। 
এরপর ছিলো পুতুলখেলা। জ্ঞান হবার পর থেকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত চুটিয়ে পুতুল খেলেছি। এই পুতুল খেলাতেও সবিতার বুদ্ধির কাছে আমি হেরে গিয়েছি। চুপি চুপি বলি সেই কথা। পুতুলের বিয়ে হবে, সবিতাই বললো, "আমার ছেলে, তোর মেয়ে"- বিয়েতে তো কনের বাড়িতেই জাঁকজমক আনন্দ বেশী হয়, আমি তো এই ভেবে খুব খুশী, যে কোন বিষয়ে দাদা (দাদু) ছিলো আমার সহায়, দাদু দর্জির দোকান থেকে লাল রেশমী কাপড় পুতুলের শাড়ি হিসেবে কিনে দিলেন, আমি তাতে জরির পাড়, চুমকী সেলাই করে পুতুলের বিয়ের কাপড় তৈরী করি। লাল ওড়না ও অন্যান্য পোশাকও প্রস্তুত। দাদাকে বলে বেতের ফার্নিচারের দোকান থেকে পুতুলের খাট, টেবিল, চেয়ার , আলনা কিনলাম। দাদু দোকান থেকে অ্যালুমিনিয়ামের ছোট্ট খেলনাপাতি বাসনের সেট কিনে দিলেন। মনে আছে, দিদাকে দিয়ে মাটির উনোন তৈরী করিয়েছিলাম। তারপর সত্যিকারের খাবারদাবারের আয়োজনও করা হলো বন্ধুদের জন্য। বিয়ে হলো পুতুলের। বাসি বিয়েও হলো। তারপর সবিতা বললো, "নে, এখন কনে জামাইকে বিদায় দে, সাথে জিনিষপত্রগুলো সব পোঁটলা বেঁধে দিলেই হবে।" একথা শুনে আমি তো "থ" বনে গেলাম।শক্তি সঞ্চয় করে বললাম, এতো খেলা, মিছামিছি" ... সবিতা বললো, "বিয়ের পর ছেলের বাড়িতে মেয়ে ও বিয়েতে পাওয়া উপহার সব যায়, এটাই নিয়ম.." সবিতার অকাট্য যুক্তির কাছে সেদিন হেরে গিয়েছিলাম এভাবেই।... এই হলো রথ থেকে পুতুলখেলার ইতিকথা, "চুপি কথায় স্মৃতি আঁকি ...।"

বি:দ্র
☆☆☆
একই সংস্কৃতিতে বড়ো হওয়া সকলেরই এ পুতুল খেলার ইতিহাস জানা। পুতুলখেলা একটা নেশা ছিলো। পড়াশুনোর ক্ষতি হচ্ছে ভেবে মামণি আমাদের দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে পুতুলের সব কিছু উনুনের আগুনে কতোবার যে পুড়িয়ে দিতেন তা ভাবতে পারি না। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি পুতুলের বাক্স ফাঁকা। বুকের ভেতরটাও এমনি করে ফাঁকা হয়ে যেতো। দিনদশেক পর আবার নতুন করে কাপড়ের পুতুল বানিয়ে আবার খেলা শুরু। ছাড়তেই পারতাম না কিছুতেই। তবে এ নেশা নয় তো কি ?








ছিঁচকে বদ‍্যিনাথ

দি ব‍্যে ন্দু ধ র


গ্রামের তরুণের দলের কেউ দেখলে বলে, ভাগনে রোদে রোদে ঘুরে বেড়াও কেন? আমগাছের ডালে উঠে বসেছিলে কেন, যদি পড়ে যেতে? দাঁড়াও বড়দাকে বলে দেবো। বলি, মামা প্লিজ বড়মামা খুব বকবে। এখন তো আমার গরমের ছুটি তাই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিনয়মামা, পলানমামা, নবমামা স্কুল থেকে এনসিসি করে ফিরে আসার সময় আমাকে কাঁধে বসিয়ে নিয়ে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। গ্রামে সবাই সবার আত্মীয়। বেশি বয়সীর দল বলে, দাদা নদীতে একা একা যেও না, সাঁতার জানো না, ডুবে যেতে কতক্ষণ। খেড়ু ঘোষ (পরে জেনেছি ক্ষেত্রমোহন ঘোষ), গঙ্গা ঘোষ, নন্দ ঘোষ, ব্রজেন ঠাকুর- এদের দাদু বলি। রাধাকান্ত ভট্চাজ, শচীন চৌধুরী, বসন্ত বিশ্বেস এরা দাদুর বন্ধু। বিকেলে দাদুর কাছে ঝড়, জল বৃষ্টি হলেও ঠিক হাজির। শচীন দাদু দিদিমাকে বলবেন, বুনডি চা করো দিনি কড়া ডোজের। রাধাকান্ত দাদু বলবেন , ডাক্তার (ডাক্তার আমার দাদু) সেদিন দু-টুকরো মাংস পাঠিয়ে আমায় গাছের মাথায় তুলেছে, বুনডি এইবারে টিফিন বাটি ভরে পাঠিও কিন্তু, তোমার হাতের রান্না আহা অমর্ত (অমৃত)। বসন্ত বিশ্বেস বলবেন, ডাক্তার এইবার আমার জন্য একখান পিতল বাঁধানো লাঠি এনো। মাঝে মাঝে আসেন জ‍্যোৎস্নাময় মজুমদার, হাইস্কুলের রিটায়ার্ড হেডমাস্টার। এসে বলবেন কই হে অনিল ডাক্তার, কোথায় তোমার নাতি ? 
ভয়ে থাকি। ডাকাবুকো মানুষ, তাঁর ভাই শম্ভুবাবু তখন আমার স্কুলের অ্যাসিস্ট‍্যান্ট হেডমাস্টার। শম্ভুবাবু ডাকনাম, আসল নাম গৌরীশঙ্কর মজুমদার, সে নামে কেউ ডাকে না। হেডমাস্টার মশাই গুরুপদ ঘোষ, নিচু ক্লাসে আসেন না তাই বাঁচোয়া। সামনে দেখলে মাথা নিচু করে চলে যাই। পেছন থেকে ডাক আসে, মশাই কোথায় যান? ক্লাস নেই নাকি। মাথা নিচু করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে মেঝেতে গর্ত করার নিষ্ফল প্রচেষ্টা করি। হেসে বলেন, মশাই ডাক্তার দাদা কেমন আছেন? বুঝি কাল টিফিন আওয়ারে মালোদের নৌকা চুরির খবর তাঁর কানে পৌঁছোয় নি।
বলি, ভালো আছেন তিনি। স‍্যার আমি ক্লাসে যাই? 
বলেন, এবার বাংলায় কত পেয়েছ দাদু? কিছুতেই অংকের নম্বর জিজ্ঞেস করেন না। ওতে তো আমি একশো পাই। মুখ লাল হয়, কিছুতেই বাংলায় একশো পাই না। বলেন, লজ্জা পেওনা। বড় হলে আমি বাংলা পড়াবো। দাদু বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়, বলি, আচ্ছা স‍্যার।
বদ‍্যিনাথ মণ্ডল প্রতিবেশী। তিন ছেলে দুই মেয়ে। জমিজিরেত নেই, কোনোদিন কাজও করতে দেখিনি। তাও বিরাট উঠোন জুড়ে টিনের আটচালা, মাটির মেঝে, বাঁশের খুঁটি। সে আটচালা ফাঁকা সারা বছর, কেউ থাকে না। উঠোনের চারপাশে মাটির ঘর তিনচারটে। সেখানে থাকে ছেলে ছেলেবৌ মেয়ে নাতি নাতনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সকাল হলেই বদ‍্যিনাথের একটাই কাজ, এর বাগানের এঁচোড়, তার বাগানের কলাটা, ক্ষেতের মুলোটা কপিটা হাপিস করা। আমরা বলি ছিঁচকে বদ‍্যিনাথ। ছেলেরা টুকটাক কাজ করে, সংসার টেনেটুনে চলে যায় তাতেই। পদ্মদিদা তার বৌ , আমি ডাকি বৌ। বলে, তোদের দাদুর স্বভাব এটাই , কি করি আর।
ফাল্গুনের বাতাস বইলেই বদ‍্যিনাথ দাদু বেরিয়ে পড়েন কোথায় যেন, তারপর টানা দুমাস পর ফেরেন। বৌকে জিজ্ঞেস করি। বলে , ভিক্ষা করতে যায়। 
বলি , কেন ?
বৌ বলে, স্বভাব।
ফেরেন দুমাস পরে বৈশাখের শুরুতে গরুর গাড়িতে চাল ডাল নুনের বস্তা চাপিয়ে। কুমোর পাড়া থেকে আনেন সরা খুরি মালসা। তারপর বৈশাখে শুরু হয় মহোৎসব। আমরা বলি মচ্ছব। দূর দূরান্ত থেকে আসে কীর্তনের দল। আটচালায় চৌষট্টি প্রহর জুড়ে সংকীর্তণ হয় , পালাগান যাত্রা হয়, মাথুর নৌকাবিহার হয়। সব কি বুঝি ছাই। সেসব গাইয়ে বাজিয়ের দল, যাত্রার দল তখন আমাদের প্রধান আকর্ষণ। তারাই হিরো। বেড়ার ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখি দুপুরে সীতা স‍্যাণ্ডো গায়ে বিড়ি খেতে খেতে ঘামাচি মারে নখে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। সন্ধ্যায় তার বিলাপ শুনে হুতাশে কাঁদি। সবাই ওই সব মালসায় ভোগের প্রসাদ খায়, বাড়িতে নিয়ে যায়। বালক ভোজনের দলে পদু, নাটু, বুধু বসে যায় আনন্দে, আমাকে কেউ ডাকে না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখি ছিঁচকে বদ‍্যিনাথ খিঁচুড়ি তুলে দেন সবাইকে কলার পাতায় পাতায়। আমাকে দেখতে পান না। বাঁশের খুঁটি ছুঁয়ে আমি পায়ে পায়ে ফিরে চলি সেদিনের মতো। কালকে আসবো আবার, হয়তো কালকে আমাকে ডাকবেন।

উত্তরকথা :
দাদু আর দাদুর বন্ধুরা না ফেরার দেশে চলে গেছেন বহুদিন। বড়মামা , মেজমামা, সেজমামা নেই। বিনয়মামাও নেই। গুরুপদবাবু হেডমাস্টারমশাই কথা রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের রত্নাকরের সন্ধান আমাকে দিয়ে আমার ছাত্রাবস্থাতেই চলে গেছেন। বদ‍্যিনাথ দাদু নেই, আটচালাটাও নেই আর। চূর্ণিনদীর খাল কঙ্কনা এখন শুধু বর্ষায় টইটম্বুর থাকে। ওপারে শিবনিবাসে মেলা হয় নিয়ম মেনে ভীম একাদশী থেকে একমাস। মালোদের নৌকো আঘাটায় বাঁধা পড়ে থাকে, কোনো কিশোর চুরি করে কিনা জানি না। এখন ঘাটে নৌকো নেই, বাঁশের সাঁকো পেরিয়েই ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে।

সেদিনের কিশোরী রাইয়ের দলের কেউ কেউ ট্রেনে দেখা হলে হয়ত অনায়াসে বলে ফেলবে, তোকে খুব ভালো লাগতো রে। জিজ্ঞেস করব, এখন? তার মেয়ে অমনি হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠবে, কি মজা হত বলো!!!

স্কুলের শতবর্ষ অনুষ্ঠানে নবতিপর শম্ভুবাবু এসেছিলেন। পা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, স‍্যার চিনতে পারছেন ?
বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তুই অনিলদাদার নাতি তো।

             ( সমাপ্ত )









মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪