ভ্রমণ কাহিনী
আমার প্রথম ছোট্ট সফর-মাতৃভূমি ঢাকা
সু জা তা দা স
পর্ব ১
আমার প্রথম ঢাকা সফর, খুব যে মসৃণতায় ভরা ছিল প্রথমে তা কিন্তু নয়- অনেক সময় লেগেছিল এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে দমদম বিমানবন্দর অবধি পৌঁছোতে। সেখানে পৌছে প্রাথমিক কাজগুলো শেষ করার পর হঠাৎই ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আমাকে আটকে দিয়েছিলেন ওখানকার কর্মরত অফিসার ভদ্রলোক,
কেন তা আজও বোধগম্য হয়নি। অফিসার ভদ্রলোকটি আমার থেকে ছোটই হবেন বোধহয়, আমাকে ভেতরে ডেকে পাসপোর্ট ভালো করে দেখে নিয়ে, জিজ্ঞাস্য ছেড়ে গল্পই করলেন বেশি তারপর------ সম্ভবত তিনি শিলিগুড়ির বাসিন্দা, কেনও এই একস্ট্রা চেকিং? জিজ্ঞাসা করার মুহূর্তে একটু হেসেছিলেন মাত্র। তবে আমার সেই সময় মনে হয়েছিল আমাকে পাচারকারীই ভেবে ছিলেন বোধহয়!! পরে নানা কথোপকথনের মাঝে আমি একজন লেখিকা জানতে পেরে আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ ঐ অফিসার ভদ্রলোক। পরে আমি ঐ তেরো তারিখটাকেই দায়ী করছিলাম মনে মনে, কারণ আমার মনে হয়েছিল ঐদিন বেরিয়েছি বলেই আমার এই হেনস্তা। সবশেষে উড়ান এর অপেক্ষায় বসে থাকা, এবং এয়ারবাসে ওঠার আগেও একবার পার্স চেকিং এর সময় ওদের "আমার ব্যাগে দেশলাই সিগারেট আছে কিনা" এই জিজ্ঞাসা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে না পারা------ তবে পরে আমার মনে হয়েছিল এখনতো এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা এবং স্ট্যাটাসের মধ্যেই পরে।
একসময় আকাশে ওড়া তারপর নিচে নামা ও জন্মভূমি বাংলাদেশের ভূমি স্পর্শ করা, একটা অদ্ভুত অনুভূতি----- যেটা মা ছাড়া আর কারও দেবার ক্ষমতা নেই!!
জন্মভূমি---
বহু আকাঙ্ক্ষিত এই দিন যা সফল হলো আমার নিজের কলমের জোরে। এখানে ধন্যবাদ জানাবো কলমযোদ্ধার সমস্ত পরিবার ও পরিচালন কমিটিকে,
যদিও তাদের একজন আমিও----- সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ আমাকে এই সন্মান দেবার যোগ্য মনে করেছেন এটা ভেবে।
আসলে রক্তের সম্পর্ক আর ধর্ম এক হলেই যে সকলে ভাই হয়ে উঠতে পারে এই ধারণাটা ভেঙে দিয়েছেন আমার কলমযোদ্ধার ভাই/বোনেরা, মনে রাখবো আমৃত্যু সকলকেই।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর পর অন্য একজনের মোবাইল থেকে ফোন করলাম কলমযোদ্ধার যোদ্ধাদের, কারণ তখনও আমার নতুন সিম নেওয়া হয়নি--- এই কাজে আমাকে সাহায্য করলেন ঢাকা বিমানবন্দরের এক সাফাই কর্মী। আমার ফোন পেয়ে সাথে সাথেই এগিয়ে এলেন প্রত্যেকেই, যারা আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন রাস্তার ঐপারে। আমি অভিভূত কিছুটা সময়ের জন্য, কারণ আজ সকলকেই সামনে থেকে দেখছি--- তাদের অভিব্যক্তিতে এক অদ্ভূত পাওয়ার আনন্দ আমাকেও খুশিতে ভরিয়ে তুলল। প্রাথমিক কথোপকথনের পর গাড়িতে লাগেজ তোলা এবং বেড়িয়ে পড়া হোটেলের উদ্দেশ্যে---- আমাদের পৌঁছে দিয়ে তারপর তারা বিদায় নিল পরের প্রোগ্রাম এর জন্য।
পরের দিনই ছিল মাসপয়লা, ফাল্গুনের প্রথম দিন--- সকালে এক অদ্ভুত দৃশ্য নজরে এলো রাস্তায় পা দিয়েই- বসন্তের মাস শুরু হয়েছে বলে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি মেয়ের (সেটা ছোট থেকে বড় প্রত্যেকেই) মাথায় ফুলের মুকুট পরে রাজকুমারীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঢাকার রাজ পথে----- বসন্তকে এভাবে স্বাগত জানাতে আমি ভারতের কোনও রাজ্যে দেখিনি, আমি আপ্লুত হয়েছিলাম ঐ দৃশ্যটি দেখে।
তারপর কলমযোদ্ধার ভাইদের সাথে বই মেলা দেখা বাংলা একাডেমীতে যাওয়া,
বাংলাদেশ বইমেলায় এসে একটা জিনিস ভীষণরকম ভাবে উপলব্ধি করেছি- তা হলো লেখক আর পাঠকের মিলনমেলা যেটা কোলকাতা বইমেলাতে দেখিনি। এটা সম্ভবত ওখানকার বাংলা একাডেমীর কৃতিত্ব যা নতুন লেখকদের সাথে পাঠকদের মেলাতে সাহায্য করেছেন------- আমাকে অবশ্য বই কিনতে হয়নি আমার বন্ধু ভাই বোনেরা আমাকে এতো বই উপহার দিয়েছেন যে আমি ঢাকা থেকে এক ব্যাগ বই নিয়ে ফিরেছিলাম- বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, তবে আমি জন্মেই ভারতে চলে আসি-
আর অসময়ে বাবার হঠাৎই চলে যাওয়ার কারণে আমার আর বাংলাদেশে ফেরা হয়নি--- এটা আমার বাংলাদেশে প্রথম সফর, এখানকার চেনা অচেনা সকল মানুষের আন্তরিকতা আমাকে আপ্লুত করেছে প্রতিটা মুহূর্তে। প্রতিটি মানুষ আপন করেছে বার বার আমাকে, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়---- আমি প্রথম থেকেই শুরু করি সুব্রতকে দিয়ে, খুব ঠান্ডা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ সে-
ফোনে কথা বলার সময় আমার তাই মনে হয়েছিল আর সামনেও তাই দেখেছি অসীম ধৈর্য তার। সোহানা- আমার ছোট বোন সেও ব্যক্তিত্বময়ী একজন নারী,
যার মধ্যে সহনশীলতা আর মাতৃত্বের মিশেল দেখেছি আমি---- শান্ত স্নিগ্ধ এক মহিলা যে আমার ছোট বোন।
পর্ব ২
আমার আরেক ছোট্ট ভাই রাসেল,
একটু চঞ্চল, আর প্রাণখোলা হাসিমুখ সদাই ব্যস্ত----
ওর সাথে মাঝে মাঝেই ফোনে বা ম্যাসেঞ্জারে কথা হতো আগে,
'সুজাতা দিদি'- বলে ডাকে তবে আমার সন্তান তুল্য সে-----
এয়ার পোর্ট থেকে এমব্যাসি ইন্ যাবার রাস্তায় রাসেল আমাদের গাড়িতে উঠেছিল,
খুব হাসিখুশি আর সদ্য বিবাহিত এক যুবক।
ঢুকেই- 'দিদি কেমন আছেন?'
আমি বলেছিলাম, 'বিয়ের নিমন্ত্রণ পাইনি তাই কথাও নেই মিনহাজ রাগ করেছেন এই দিদি'-
গাড়িতে থাকা সকলেই হেসে উঠেছিল একসাথে আমার কথা শুনে।
একটা খুশির পরিবেশ তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগে না বোধহয় সেটা গাড়িতে যেতে যেতে উপলব্ধি করছি সেদিন----
আসলে সকলেই এতো ভালো যে প্রত্যেককেই ছুঁয়ে যাবার চেষ্টা না করলে নিজেরই কষ্ট হবে, তাই ছোঁয়ার চেষ্টা করবো আমি প্রত্যেককেই।
আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসে এমব্যাসি ইন্ এর ঘর পর্যন্ত পৌঁছানো পুরোটাই ওরা মানে সুব্রত সুজন শিশির রাসেল আর শাহ্ আলম ছিল, পরে রাসেল উঠেছিল-
ঢাকার যানজটের কথা জানতাম কিন্তু চোখে দেখলাম সেদিন,
এয়ারপোর্ট থেকে একঘণ্টার রাস্তা পার করতে সেদিন চার ঘন্টা লেগেছিল ঢাকা শহরের যানজটের দৌলতে-----
দেখেছিলাম ঢাকার যানজট, আমাদের কোলকাতা সেখানে শিশু।
তবে এতটুকুও কষ্ট হয়নি রাস্তায়,
কোথা দিয়ে যে পার হয়ে গেছিল সময়টা গল্প আর হাসি ঠাট্টাতে বুঝতেও পারিনি আমার ভাইদের উপস্থিতির কারণে-
শাহ্ আলম-
একে ভাই না বলে আমার সন্তান বললেই ভালো হবে, বাচ্চা একটা ছেলে খুব বেশি হলে বছর কুড়ি বয়স হবে-
মিষ্টি চেহারার সুন্দর একটা ছেলে, খুব হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত-
আমাদের গ্রুপের টেকনিক্যাল দিকটা ঐ দেখে-
অবশ্যই সোহানা সুব্রত ও অন্যান্য সকলের সাথে আলোচনা করেই-
তবে সেদিনই প্রথম দেখলাম ওকে, আর কথা বললাম সেদিন প্রথম।
প্রোগ্রাম এর দিন (এটা কি 2441139-বেলা বোস তুমি পারছো কী শুনতে) গানটা শুনলাম ওর কন্ঠে-
সুন্দর গায় তবে শাহ্ আলমকে একটা কথাই বলবো, ও যেন আর একটা স্কেল বাড়িয়ে গান করে-
শুনতে অনেক বেশি ভালো লাগবে।
দিদি তো, তাই বললাম ভাইকে, যাতে আমার এই পুত্র সম ভাইটা অনেক সুন্দর গাইতে পারে- অনেক বড় হোক্ এই আশীর্বাদ রইলো শাহ্ আলম এর জন্য।
আসলে এখানে মানে এই গ্রুপে কেউ ছোট বা বড় নেই-প্রত্যেকেই সমান,
আর প্রতিটি সদস্য আপন করতে পেরেছেন প্রত্যেক সদস্যকেই- তাই হয়তো আন্তরিকতা অনেক বেশি আর অহমিকা কম এখানে।
বই মেলায় ঘুরতে ঘুরতে যখন প্রচন্ড পা ব্যথা আমার হঠাৎই কানে এলো সুব্রতর আবৃত্তি, আমারই লেখা একটা কবিতা-- আসলে নিজে লিখে তো বোঝার উপায় নেই আমি কেমন লিখি যখন কেউ সেটা কন্ঠে ধারণ করেন সেই সৃষ্টি একটা অন্য মাত্রা পায়, যা নিজের কানকেই আনন্দে ভরিয়ে অন্তরে প্রবেশ করায়!!
একটা অদ্ভূত অনুভূতি সেদিন আমার পায়ের ব্যথা কমিয়ে দিয়েছিল। হোটেলে ফিরতে অনেকটাই রাত হলো সেদিন। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানায়, কারণ তখন আর শরীরে শক্তি ছিল না। আমি প্রত্যেকের সাথেই আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবার অঙ্গীকার রাখছি, এবং আমি যেখানে যেখানে গিয়েছি তার বিবরণ----- আশা করবো পাশে পাবো সকলকেই এই যাত্রায়-
এখানে এক জন সংগীতশিল্পী ছিলেন তিনি রাসেল পত্নী শাওলীন-
(ক্রমশঃ)
সিকিম বাইকভ্রমণ
প্র সে ন জি ৎ আ রি য়া ন
এই পথ যাত্রা শুরু করেছিল রাসেল আলী, সুদীপ সরকার। কখনো বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে সামনে চায়ের দোকানে বসে আলোচনা, কখনো বা শক্তি মন্দিরে মাঠের ধাঁপিতে বসে। প্রতিদিনই বাপ্পাদার চায়ের দোকানে বসে আড্ডার ছলে কথোপকথন হত সবার সঙ্গে। সবাই কিভাবে পথ যাত্রা শুরু করবে...
দূর্গাপুজো শেষ...
দিনটি ছিল একাদশী -১৬/১০/২০২১
বাড়িতে না বলেই বেরিয়ে পড়লাম। শুভদা কাজের বাহানা করে, শুভ কাউকে কিছু না জানিয়ে, সোমু, সুদীপ, রাসেলদা বাড়ির সম্মতি নিয়ে। বিগত চার মাস আগের পরিকল্পনা আজ সত্যি হতে চলেছে। মনে ভরপুর আনন্দের ছটা, আমার যাওয়ার কথা ছিল দুপুর একটা সময়। আগের দিন রাত ২:৩০ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়ি। কথাটা বন্ধুরা জানতোনা। আমার যাত্রাসঙ্গীর সাথে রাত দেড়টার সময় কথা বলে নিশ্চিত করি। আটজনের গ্রুপ। আমি মানে প্রসেনজিৎ আরিয়ান, রাসেল আলী শুভজিৎ দেব বর্মন, শুভ বিশ্বাস, সুদীপ সরকার, সোমু দাস, সোনা সেখ, সুজিত সাউ। একটি বাইকে দু'জন সওয়ারী। সোমু ও তার সঙ্গী রাত্রিবেলায় মার্কেটিং করে রাখে। যাত্রা শুরুর নির্ধারিত সময় ছিলো ভোর চারটে। একে অপরের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে নিলাম। সোমু তখনো জানতো না যে তার সঙ্গী বাড়ির অসুবিধার জন্য যেতে পারবেনা।
রাসেলদা- সোমুকে ফোন করে বলে- (ফোনের রিংটোনে সোমুর ঘুম ভেঙে যায়) "তোমরা কি যাবেনা"?
সোমু- হ্যাঁ, পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে আসছি। ইতিমধ্যে সোমু সুজিতকে তিন চার বার ফোন করে, সুজিত ফোন রিসিভ করেনা। সোমুর মনে তখন সন্দেহ হয়, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ৫ থেকে ১০ মিনিট অন্তর অন্তর ফোন করে। বন্ধুরা ৫:৪৫ এ আবার সোমুকে ফোন করে- তখনও সে বলছে- "এইতো যাচ্ছি।" ঘড়িতে বাজে তখন ৬:৩০, বহরমপুর বাস স্ট্যান্ড ট্রাফিক মোড়ে বসে আছে সোমুর অপেক্ষায়। আরো ১০ মিনিট কেটে যায়, বন্ধুরা একত্রিত হয়ে আলোচনা করে, বলে- চল্ সোমুর বাড়িতে। সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে, সোমু তখনো শুয়ে আছে। তার মনের ইচ্ছে ছিল সঙ্গী না গেলে আমি যাব না, যাবই বা কি করে। বন্ধুরা "সোমু" বলে ডাক দেয় বাইরে থেকে, সোমু অবাক হয়ে যায়- বলে- "যাচ্ছি"। অথচ সত্যি বলতে কি তার যাবার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। তবুও চোখে মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে যায় মা এবং বউয়ের দিকে তাকায় সমু। তারা যদি মানা করত সোমু যেত না। নিষেধ করা তো দূর অস্ত, বরং দু'জনেই অফুরন্ত উৎসাহ দিয়েছে। ধীরে ধীরে সমুর মন উৎফুল্ল হলো, কিন্তু একটা ব্যাপারে চিন্তায় পড়ে যায় সে। পুরনো প্যাশন প্রো গাড়ি নিয়ে যাবে কি করে সে? তার ওপর কোনো সার্ভিসিং করা নেই। শেষে হঠাৎই বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে, "চল্, বেড়িয়ে পড়ি, যা হবার হবে, দেখা যাবে।" সুদীপ বলে ওঠে গাড়িতে দুজন যাওয়ার কথা। সবাই একে অপরের দিকে তাকায়। সুদীপ বলে ছোট্টু-মানে প্রসেনজিৎ আরিয়ানকে ফোন করি। রাসেলদা বলে উঠে ও এত তাড়াতাড়ি আসবে কি করে ওকে আগে থেকে জানানো হয়নি। ওর ব্যাগ গোছানো আছে কি নেই, ওর বেরোনোর কথা একটা সময় সোনাদার সঙ্গে। ইয়ামাহা গাড়ি সার্ভিসিং করিয়ে শিলিগুড়ি হোটেলে রাতে দশটার সময় মিট করার কথা আছে।
সুদীপ - রাসেলদা সোনাদা বলছিল বাইক সার্ভিসিং করতে দেবে তারপর যাওয়া হতে পারেও পারে আবার নাও হতে পারে, কারণ আজ একাদশী।
রাসেল - দেখ তোরা কী করবি।
সোমু - ছোট্টু কে ফোন কর্।
সুদীপ- আমাকে ফোন করে, তখন বাজে ঘড়িতে 6:45, ঘুমিয়ে আছিস
আমি - হ্যাঁ।
সুদীপ- তুই আসতে পারবি আধঘণ্টার মধ্যে
আমি- সোনাদা যাবে তো একটা সময়।
সুদীপ- সোনার উপর ভরসা নেই, তুই যাবি নাকি বল।
আমি- হ্যাঁ যাবো।
সুদীপ- তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে চলে আয়।
আমি - যাচ্ছি...
আমার তখনো ব্যাগ গুছানো হয়নি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শুভদা ফোনে বলল আর কত দেরী? আমি বললাম ১০ মিনিট। আমরা ট্রাফিক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক আছে।
আমি - ওকে।
তখনও আমি জানতাম না আমি কার সঙ্গে যাব বাসস্ট্যান্ডে আমাদের দোকানে সাইকেল রেখে বন্ধুরা একসাথে হলাম। য
সবাই যে যার গাড়িতে ব্যাগগুলো গোছাতে ব্যস্ত, আমার ব্যাগটা একটু বড় ছিল, সবাই বলে উঠল, "এত বড় ব্যাগ, কি আছে এতে?" -জামাপ্যান্ট দুটো ক্যামেরা সঙ্গে একটি ল্যাপটপ।
-এটার বিশাল ওজন হবে। বললাম- ২৫ থেকে ৩০ কেজি ওয়েট হবে।
সবাই অবাক হয়ে গেল কি করে ক্যারি করবি?
-চল না সব ঠিক হয়ে যাবে। যে যার সঙ্গী নিয়ে গাড়িতে চেপে পড়ল আমি সোমুর গাড়িতে চেপে পড়লাম। বহরমপুর গঙ্গা ব্রিজ পার হয়ে পেট্রোল ভরে নিলাম ১১০০ টাকার। NH34 এ গাড়ির ওপর একে অপরকে দেখে খুব ভালো লাগছিলো। গাড়ির স্পিড তখন ৫০ থেকে ৬০ কিমি/ঘন্টা। টোল ট্যাক্স পার করে আমরা কয়েকটি ছবি তুলি এবং রাসেলদা ব্লগ করতে শুরু করে। একের পর এক সবার নাম ধরে ভিডিও করে নিলাম সবাই হাই হ্যালো করে, কেউ আবার হাত দেখিয়ে আর হেসে...। চলমান পথে সময় কেটে গেল একঘন্টা। পৌঁছে গেলাম ৫০ কিমি অমরপুর। ঘড়িতে বাজে তখন ৯:৪০, সবাই টিফিন করতে চাইলো। সোমু পলিউশন করাতে গেলো। শুভদা, শুভ, সুদীপ রাসেলদা চার জন এরা তেলে ভাজা খাবে না রুটি খাবে। হোটেল খুঁজছে। ধোঁয়া চেক করছে, পাশে দেখি প্রিন্স হোটেল খোলা আছে সোমু সুদীপ কে ফোন করে বলে চলে আয় এখানে রুটি পাওয়া যাবে। চারজন চলে আসে দেখি হোটেলে, ধোঁয়া চেক আমাদের কমপ্লিট হয়ে গেছে ৩৪০ টাকা খরচা হয়েছে, আমরা হোটেলে ঢুকতে দেখি রাসেলদা আর শুভ নেই। ১০ মিনিট সময় লেগেছিল।
আমি - রাসেলদা শুভ কোথায়?
সুদীপ - তোমরা খাও আমরা বেরিয়ে পড়ি আস্তে আস্তে যাব রাস্তায় দেখা হবে, বলে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
ওরা ভেবেছিল অনেক দেরি হবে, তাই খায়নি। হোটেলে গিয়ে দেখি দরজা খোলা কিন্তু হোটেলটি বন্ধ, হোটেলের মালিক পাশে বসে আছে। ৫ মাস ধরে বন্ধ ছিল হোটেলটা।
সোমু- রুটি কোথায় পাব দাদা,
হোটেলের মালিক - রুটি পাবেনা ডিম-টোস্ট পাওয়া যাবে,
আমি বললাম ধুলিয়ানে গিয়ে খাবো, ওখানে কলাই রুটি পাওয়া যাবে ভালো খেতে ৩০ কিমি যেতে হবে।
শুভজিৎ - দেরি হয়ে যাবে, যা পাচ্ছি খেয়েই নিই। সময় হলে ওখানে গিয়ে খাওয়া যাবে।
সোমু- দাদা চারটে ডিম টোস্ট আটটা কলা দেবেন তাড়াতাড়ি।
আমরা সবাই চেয়ারে বসে আলোচনা করি ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে গেলে কি হতো।
সোমু- দেরি হবে এজন্য ওরা চলে গেছে, ছাড়- রাস্তায় ধরে নেব।
আমি - দাদা তাড়াতাড়ি খাবারটা দিন, আমাদের দেরী হচ্ছে, যেতে হবে অনেকদূর।
হোটেলের মালিক- এইতো হয়ে,গেছে- নিয়ে যাচ্ছি,
কথাটি বলেই আমি হাত ধুতে চলে গেলাম এসে দেখি তিনটি ডিম পাউরুটি টোস্ট তিনজনে মিলে খেতে শুরু করেছে, আমিও নিয়ে খেয়ে নিলাম। বিল হল ১৪০ টাকা সিগারেট নিয়ে ২১০ টাকা। হোটেলওয়ালাদাদাকে বললাম কলার দাম বেশি নিয়েছো ১০ টাকা কম নাও, দাদা হাসিমুখে ২০০ টাকা নিল। 'দাদা আসছি'- বলে ব্যাগ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আয়রন ব্রিজের ওপর চলন্ত অবস্থায় গাড়ি থেকে হাত মেলে দিলাম। প্রকৃতির অনুভূতিটি অন্যরকম যদি সঙ্গে থাকে বন্ধুরা। এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলোতো। সত্যি সময়টা সিন্দুকে গুছিয়ে রাখার মত। মনে মনে ভাবছি আমি...
সোমু একটু ভয়ে ভয়ে ছিল। চাঁদপুর টোল ট্যাক্স পেরিয়ে গিয়েছে তিন থেকে চার মাইল অতিক্রম করলে ফারাক্কা ব্যারেজ। পাশ থেকে গাড়িগুলো যাচ্ছে খুব আনন্দ আর খুশিতে চলেছি, তার থেকেও ভালো লাগছে গাড়িগুলোকে যখন ওভারটেক করছি তখন... পৌঁছে গেলাম ফারাক্কা ব্যারেজের ওপরে আমাদের গাড়ির গতিবেগ ঘন্টায় ২০ কিমি, ব্রিজের ওপর মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে কিছুদূর পর পর। ২.২ কিমি মুহূর্তে পেরিয়ে এলাম।
দেড় ঘণ্টা যাওয়ার পর....
কানের পাশে বেজে উঠল সোমুর রিংটোন।
রাসেল - তোমরা কোথায়
সোমু - রাস্তায়, তুমি কোথায়
রাসেল - কালিয়াচক মোড় পার করে দাঁড়িয়ে আছি।
সোমু - কালিয়াচক ঢুকছি
রাসেল - বেশ তোমরা এসো আমি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
সোমু - ওকে যাচ্ছি।
কালিয়াচক মোড় পেরোতে দেখি দুইজন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, আমরা গাড়ি স্লো করে বললাম চলো। এখানেই আমরা ছয় জন একসঙ্গে হলাম। কালিয়াচক পার করে একটি পাকুড় গাছের নিচে আমরা সবাই দাঁড়াই, একটি ছোট্ট পাথরের মূর্তি ছিল। শুভদা ব্যাগটা গাড়িতে বাঁধে সুদীপ সাহায্য করে। আমি জলের বোতল বার করে জল খেলাম, সমু জল নিল, খেলো, রাসেলদাও একটু গলা ভিজিয়ে নিল।
সোমু - ছোট্টুর ব্যাগটা
প্রচন্ড ভারি।
রাসেলদা - না সেরকম ভারী হবে না।
সোমু - একবার ঘাড়ে তুলে ৫ মিনিট দাঁড়াও তাহলে বুঝতে পারবে।
রাসেলদা - তো কি হয়েছে দাও আমি নিচ্ছি ওটা কোন ব্যাপার নাকি।
রাসেলদা আমার ব্যাগটি নিয়ে চার মিনিট ছিল সবাই রাসেলদার দিকে তাকিয়ে ছিল। সোমু ফিক্ ফিক্ করে হাসছিল আর সুদীপের দিকে ইশারা করছিল। শুভদা তাকিয়ে দেখছিল। রাসেলদা বললো সত্যিই ব্যাগটি ভারি
আছে। শুভ বলে উঠলো ধাবা দেখে দাঁড়িও, আমি বাথরুমে যাব। পেটটা একটু ভার ভার করছে। বাড়িতে সবাই ফোন করে খোঁজ খবর নিয়ে নিল, একমাত্র আমি বাড়িতে ফোন করিনি।
শুভদার মা বলল সময় মত খেয়ে নিস, দেখেশুনে যাস।
সবাই ওখান থেকে রওনা হলাম। মালদা কি করে অতিক্রম করব সেটা আলোচনা করছি। চলন্ত গাড়িতে, রাসেলদা বললো, মালদা রথবাড়ি না গিয়ে বাই পাশ দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হবে, সবাই বলে বাইপাস দিয়েই যাবে।
সোমু - একটু চা খেলে ভালো হতো।
এই বলাবলি করতেই ১ কিমি মালদা বাইপাস রাস্তা পার করছি আমি শুভদা অতিক্রম করে ফেলেছি। সবার পেছনে রাসেলদা ছিল সোমু আমাকে বলছে রাস্তায় গ্যারেজ দেখলে মিটার চেন টা ঠিক করে নেব এ বলতে না বলতে রাসেলদা পিছন থেকে হাত দেখাচ্ছে আর হর্ন দিচ্ছে। তার গাড়িটির টায়ার তখনই পাংচার হয়ে যায়, আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। আমাদের সামনে শুভদা ছিল আমরা রাসেলদা কে গিয়ে বলি মালদার বাই পাশে ডান দিকে তুমি যাও, বামদিকে আমরা যাই। যারা আগে গ্যারেজ পাবে তারা ফোন করবে
রাসেলদা - বেশ।
রাসেলদা স্কুটি নিয়ে হাঁটতে শুরু করল শুভদা রাসেলদার সঙ্গে আসছে।
মালদা বাইপাস থেকে রথবাড়ি যেতে 100 মিটার মধ্যে বামদিকে গ্যারেজ পেলাম।
সোমু - রাসেলদা গ্যারেজ পেয়েছি চলে এসো
রাসেল - বাইপাসে ডানদিকে গ্যারেজ আছে আমরা সারিয়ে নিচ্ছি।
সোমু - বেশ তাহলে তোমার গাড়ির কাজটা ওখানে করাও আমার গাড়ির কাজটা এখানে করে নিই তাহলে সময়টা বেঁচে যাবে। গ্যারেজে একটি ৩২ বছরের, দুটি ১২ / ১৩ বছরের বাচ্চা ছিল, ওদের বললাম- ভাই একটু জল খাওয়াবে? সে এক বোতল জল এনে দেয়, জল খেয়ে একটু মুখ ধুলাম দুজনে। জলটা খুব ভালো ছিল...
আমি জিজ্ঞেস করলাম পড়াশোনা করিস না?
- হ্যাঁ করি। লকডাউন এর জন্য স্কুল বন্ধ তাই এখানে কাজ করছি আমি সেভেনে পড়ি ও ফাইভে পড়ে..
-ও কে হয়?
-ও আমার বড় দাদা। কাজটা শিখে নিচ্ছি এই ফাঁকে।
-বেশ ভালো করছিস শিখেনে...
ভাইকে বললাম তুই এক বোতল জল দিবি আমরা নিয়ে যাব। তার কাছে জলের বোতল ছিলনা সে দিতে পারল না। আমাদের গাড়িটা ঠিক হয়ে গেছে ৪০০ টাকা বিল হল আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এদেরও লিক সারানো শেষের দিকে শুভদা অন্যদিকে স্মোক করছিল। আমি বললাম কাকা তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে দাও অনেকটা পথ যেতে হবে। আমার গাড়ি গতিবেগ তখন ৮০/৯০ আমার পেছনে শুভদা তার পেছনে আছে রাসেলদা।
কিছুদুর যাওয়ার পর রাসেলদের গাড়ি আর দেখতে পেলাম না।
আমি আর শুভদা রায়গঞ্জ টোল ট্যাক্স পার করে একটি ধাবাতে দাঁড়ালাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়াটা এখানেই করবো ভাবছি সবাই। সোমু রাসেলদাকে ফোন করে বলল- কতদূর?
-এইতো রায়গঞ্জে ঢুকছি। আমরা রায়গঞ্জ টোল ট্যাক্স পার করে ধাবাতে আছি।
১০ মিনিট পর রাসেলদা শুভ ধাবাতে পৌঁছে যায়। আমি ডেকে আনি ধাবাতে, সবাই মিলে আলোচনা করি কে কি খাবে চৌকিতে বসে। ধাবাটি গাছের নিচে ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল ঘরটা। আমি বললাম ডিম ভাত খাবো। সবাই এতে রাজী হলো।
রাসেলদা - শীতকাল ডিম ভাত খাওয়াটা ভালো হবে।
শুভদা আর সুদীপ - তাই অর্ডার করো।
রাসেলদা - ছটা ডিম ভাত দিন।
কিছুক্ষণ বসার পর তখন বাজে ২:২০। থালাতে সাজিয়ে ভাত, ডিমের ঝোল, আলুভাজা, ফুলকপি তরকারি, ডাল, পাঁপড় ভাজা চাটনি, পিঁয়াজ, লেবু, লঙ্কা, সঙ্গে গ্লাসটি সাজিয়ে চৌকির উপর দিয়ে দিল একসঙ্গে। সবাই চেটেপুটে খেলাম প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল পরে একহাতা করে ভাত নিয়েছে সবাই বেশি করে। সবাই হাত ধুয়ে চৌকির উপর এসে বসলাম। সোমু ১০০ গ্রামে পেপসির বোতল কিনে আনল সবার জন্য। সবাই খেতে খেতে আলোচনা করছে একঘন্টা আমাদের হাতে সময় আছে এরমধ্যে বেরিয়ে যাব। সবাই পায়চারি করছি, আর শুভদা চৌকিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পায়চারি শেষে চৌকিতে এপাশ-ওপাশ করতে করতেই আরো ৪৫ মিনিট কেটে গেল। সময় হয়ে এসেছে বেরোতে হবে এবার, শুভদাকে ডাকা হল। বোতলে জল ভরে ব্যাগ নিয়ে রওনা হলাম। পাঁচ কিমি যাওয়ার পর ওভারব্রিজের
নিচে দাঁড়ালাম, সুদীপ বলল একটু ছবি তোলা হোক ছবি তুললাম একে অপরের। পাশে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল কৌতূহল না সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে দেখছিল কে জানে! সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। ৭ কিমি যাওয়ার পর বৃষ্টি পড়তে লাগল রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম চারজনে। রাসেলদা শুভ পিছনে রয়েছে। ৪০ মিনিট ধরে বৃষ্টি। আমি সুদীপ আলোচনা করছি বৃষ্টি ছাড়লে গাড়িটা নিয়ে একেবারে বেরিয়ে পড়বো। শুভদা- সোমু বিড়ি ফুঁকছে... সোমু বারবার রাস্তায় গিয়ে দেখে আসছে বৃষ্টি পড়ছে নাকি, ৫ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেল আমরা রওনা হলাম ৫ কিমি যাওয়ার পর শুভদার পটি পেয়েছে, আমরা একটি ধাবাতে দাঁড়ালাম বাথরুম করে ফ্রেশ হয়ে চা খেল, আমি চা খাইনা। লেইজের প্যাকেট কিনে খেলাম। ওখানে একটি রাইডার এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সোমু অনেক কথা বলছিল। ৪০ টাকা বিল দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ৪০ কিমি যাওয়ার পর রেলগেটে জ্যামে পড়ে যাই। ১০ মিনিট পর পাশ কাটিয়ে জ্যাম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ডালখোলা মোড় পেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ইসলামপুর মোড়ে ডান দিকে একটি ধাবাতে দাঁড়ালাম, ৭:৩০ বাজে ধাবার বাইরে অপেক্ষা করছি রাসেলদা শুভর জন্য।
সোমু - ফোন করে জিজ্ঞেস করলো কতক্ষন লাগবে।
রাসেলদা - আধঘন্টা পর ধাবাতে পৌঁছাবো।
গাড়িটি ডবল স্ট্যান্ড করে গাড়ির ওপর বসি। সামনে দেখি ওভারব্রিজে, সাইনবোর্ডে লেখা আছে হিমাচল প্রদেশ ৬৮০ কিমি।
দূর থেকে দেখছি অন্ধকারে গাড়ির লাইট গুলো জোনাকির মতো দেখাচ্ছে। কাছে আসতেই দেখি ১০০/১২০ স্পিডে সব যাচ্ছে। বাতাস এসে গায়ে লাগছে, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ধাবাতে সব মিলিয়ে তিন চার জন লোক। ধাবার সামনে একটি পুলিশ গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে ধাবার ভিতরে ঢুকে গেল খোঁজাখুঁজির পর রিসেপশনে লোকটিকে জিজ্ঞেস করে বেরিয়ে পড়ল। ততক্ষণে রাসেলদা চলে এসেছে ধাবার সামনে।
রাসেলদা- প্রচন্ড খিদে পেয়েছে।
সোমু- তিন প্লেট তরকা ও কুড়ি পিস রুটির অর্ডার দিয়েছি। হাত মুখ ধুয়ে সবাই টেবিলে বসে পড়ি, ব্যাগগুলো গাড়ির সঙ্গে বাইরে ছিল। দুটো করে খাবে বলে চারটে করে খেয়ে নিয়েছিল রুটি।
সোমুর দিকে তাকিয়ে শুভ বলে- এরপর কখন খাবো জানিনা এখন তো খেয়ে নিই। এ নিয়ে সবাই হাসাহাসি করি। ৫৩০ টাকা বিল দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ৯.০০ বাজে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। এখন খুব অন্ধকার। আমাদের গাড়ি পর পর চলছে। ঘণ্টা দুই-এর মধ্যে শিলিগুড়িতে পৌঁছে যাবো।
বচনদা এবং সুদীপের দাদা কালিম্পং ঘুরতে যাবে শিলিগুড়িতে রয়েছে তারা।
সুদীপ বললো সে কথা।
সোমু - আমাদের যেতে দেরি হবে। তোর দাদাকে বল হোটেল বুক করে দিতে। টাকা আমরা দেবো।
সুদীপ হাসতে হাসতে বলে- ঠিক আছে, বলছি।
সুদীপের দাদা হোটেল বুক করে দিল।
শিলিগুড়িতে পৌঁছে দাঁড়ালাম খানিক। রাসেলদা অনেক পিছনে ছিল। এসে বললো চলো, সবাই বসে কেন তোমরা?
সোমু - তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
রাসেলদা- এসে পড়েছি, বেশ চলো এবার।
সবাই একসঙ্গে চললাম..
সুদীপের দাদা বলেছিল স্বস্তিক হোটেল সুদীপ শুনেছে শুভম হোটেল।
সোমু - সুদীপ হোটেলের নাম কি।
সুদীপ- শুভম। মোবাইলের লোকেশন চাওয়া হল দাদা দিতে পারল না। আমাকে বলল বাস স্ট্যান্ড পেরিয়ে বাম দিকে ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে গিয়ে গলিতে।
সোমু - বেশ।
গাড়ি নিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়ার চেষ্টা অনেক রাত হয়ে গেছে। হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে বললাম এই নামে রুম বুক করা আছে।
রিসেপশনের দাদা - নাম বলুন।
রাসেলদা - শুভম।
রিসিপশনের দাদা - এটা শুভম হোটেল সুদীপ নামে বুক করা নেই ভালো করে জিজ্ঞেস করুন...
রাসেলদা সুদীপকে এসে বলে তোর দাদা কে ফোন কর।
সুদীপ ওর দাদা কে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো আবার হোটেলটি নাম কি?
সুদীপের দাদা - স্বস্তিক রেসিডেন্সি।
রাসেলদা এসে রিসেপশনে দাদাকে বলল স্বস্তিক রেসিডেন্সি।
রিসেপশনের দাদা - রাস্তার ওপারে আছে।
রাসেলদা - ধন্যবাদ দাদা।
রিসিপশনের দাদা- থ্যাংকইউ সো মাচ।
রাস্তার ওপারে গিয়ে হোটেল
খুঁজছি সবাইকে বলছি কেউ বলতে পারছে না। এই নামে হোটেলটি কোথায় আছে। তোরা দাঁড়া, আমরা আসছি- এই বলে আমি আর সোমু দুই-তিনটি হোটেল দেখে এলাম। সুদীপ তার দাদার কাছে হোটেলটির অবস্থান জানার চেষ্টা করছে।
রাস্তার ওপারে হোটেলের দালাল কিছু দাঁড়িয়ে আছে তাকে বলা হল একজন তার মধ্যে ১০০ মিটার দূরে গিয়ে একটি রুম দেখালো আমাদের পছন্দ হয়নি। বাথরুমটি নোংরা ও ভাঙ্গাচোরা ছিল ৬০০ টাকা চাইছিল রুম ভাড়া। আমি সোমু চালাকি করে বললাম বন্ধুবান্ধবকে জিজ্ঞেস করে আসি। একটি ভুল হোটেলে গিয়ে উঠে পড়ে আবার বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে ব্যাগগুলো নামিয়ে গাড়ি পার্কিং করাও হয়ে গিয়েছিল। রাত্রি ১১:৪৫, সবাই এসে এক জায়গায় হলাম। আমি সুদীপ কে বললাম তোর দাদা কি বললো
সুদীপ - জানাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে সুদীপের ফোন রিং হয়। ফোন রিসিভ করে বলে স্বস্তিক রেসিডেন্সি।
দালালগুলো পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওরা শুনতে পেয়েছে আমাদের নিয়ে চলে গেল দালালরা বলে পাশের গলিতে লাজটি আছে যেতে যেতে শুভ, সোমু, সুদীপ হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে ওদের সঙ্গে আমরা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। হোটেলের সামনে দেখি সাইনবোর্ড টাঙ্গানো আছে লেখা আছে লোকনাথ বাল সারণী প্রধান নগর শিলিগুড়ি-৭৩৪০০৩
স্বস্তিক রেসিডেন্সি লেখা রয়েছে ফোন নাম্বার দেওয়া আছে ০৩৫৩-২৫৩১০৬৪, ২৫৩১৭২৪, কল- ৯৪৩৪০-৪৪৩৪০।
হোটেলে এসে ঢুকলাম ৩০২ / ৩০৪ নম্বর রুম।
একটি ছেলে এসে বলল তোমাদের আই কার্ড জমা করতে হবে। আমি বললাম সবাই ফ্রেশ হচ্ছে দিচ্ছি একটু পরে।
আমি বললাম রাত হয়েছে সোমু তুই খাবার আন, এই দিকটা আমি দেখছি। এই দিকে রুমে ঢুকে সবাই ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছে। রাসেলদা সমু খাবার আনতে যায়।
সোমু - ফোন করে বলে ভাত ডাল আলু ভাজা আছে, আর কিছু খাবার নেই।
আমি- তাই নিয়ে চলে আয়। সোমু - এইখানে এসে খেতে হবে হোটেলে তাই বলছে।
আমি - সবাই ফ্রেশ হচ্ছে দেরী হবে।
সোমু - রাখ দেখি কি করা যায়।
ফ্রেশ হয়ে সবাই আই কার্ড দিয়ে দিলো, সমু খাবার নিয়ে এলো।
আমি বললাম- রাসেলদা ফ্রেশ হয়ে নাও একসঙ্গে খেয়ে নেব।
রাসেলদা - বেশ, তাড়াতাড়িই আসছি।
একটি রুমে আমরা তিনজন করে আছি। রুমগুলো সাজানো-গোছানো ছিল। অন্য রুমে ঢুকতেই দেখি সোমু বিলাতী মদ কিনে এনে খাচ্ছে, সঙ্গে সুদীপ।
আমি - বললাম ফ্রেশ হবি না। সোমু - এটা খেয়ে খাবার খেয়ে একেবারে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে যাব।
আমি - বেশ তাই করিস, সবাইকে গুডনাইট জানিয়ে রুমে চলে এলাম। তিনজন মিলে খেয়ে নিলাম আমি বিছানায় বসে আছি শুভ গুডনাইট বলে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি আর রাসেল দা ১০ মিনিট কথা বলার পর ঘুমিয়ে পড়বো। রাসেলদা কিছুক্ষণ গান শুনে, মোবাইল দেখে ঘুমিয়ে পড়ল গুডনাইট বলে।
আমি চোখ বন্ধ করলাম ওরা তখনও মদ খাচ্ছে লাইটটা বন্ধ করলাম।
একদিনের পর্ব শেষ হলো...
ঘুটঘুটে অন্ধকারে স্বপ্ন দেখছি
তিনটে বাইক নিয়ে পাহাড় কে জয় করব...
(ক্রমশঃ)
পাহাড় নাকি সমুদ্র
ই মা ম মে হে দী আ শ ফী
পাহাড় নাকি সমুদ্র?
সমুদ্র; মেঘের সমুদ্র, তার উপর পাহাড়, আর তার উপর আমি, এক জ্যোৎস্না রাতে স্নিগ্ধ বাতাস আর কিছু প্রিয় বন্ধু, তিনটি ক্যাম্প তার সামনে আগুন; তারপর সেই আগুনের কয়লা দিয়ে বারবিকিউ।
ব্যাপারটা একদিন আমার কাছে ছিলো স্বপ্নের মতো। তবে এই স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখিনি, জেগে জেগে দেখেছিলাম। তাইতো স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে একদিন বেরিয়ে পড়লাম কিছু ভ্রমণপ্রিয় বন্ধুদের সাথে। এই স্বর্গে পৌঁছানোর পথ মোটেও সহজ ছিল না। পদে পদে পেরোতে হয়েছে অনেক বাঁধা, যার কিছু বলার মতো, বাকীগুলো নাহয় এক বাদলা দিনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একদিন সেরে ফেলা যাবে। যাক্, কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক… কিন্তু… কিন্তু নবাব সাহেব (চট্টগ্রাম মেল এক্সপ্রেস ট্রেন) আসতে তো অলরেডি ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট দেরি করে ফেলেছে, ছাড়তে ছাড়তে আরো ১ ঘণ্টা। তবে এইখানেই শেষ না ট্রেনে উঠে শুরু হল আরেক ঝামেলা- সেন্সর্ড। যাক্, অবশেষে রাত পেরুলো কিছু অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার মধ্য (অবশ্যই না ঘুমিয়ে) দিয়ে, তবে ভোরের সূর্য উঠতে না উঠতেই শুরু হল আরেক
ঝামেলা। সামনের এক ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পুরো রাস্তা বন্ধ, আনুমানিক ৬-৭ ঘণ্টা তো লাগবেই। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে আর অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না কারো। বেড়িয়ে পড়লাম বিকল্প রাস্তার উদ্দেশ্যে। বি.বাড়িয়ার প্রত্যন্ত এক উপজেলা হতে দুইবার বাহন বদলে কয়েক ঘণ্টার সফর, অবশেষে পৌঁছাই কুমিল্লার কোম্পানিগঞ্জ। এটা অবশ্য আমার কাছে বোনাসই ছিল। বি.বাড়িয়ার কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলের দেখা পেলাম যা হয়তো অদেখাই থেকে যেত। তবে আমাদের ট্রিপ কি কখনো ঝামেলা ছাড়া কাটতে পারে? একেতো আমাদের মতো হতদরিদ্রদের বাজেটে আরো ৭০০ টাকা যুক্ত হল তার উপর যুক্ত হল কিছু সেন্সর্ড ভেজাল। যাইহোক অবশেষে দুপুরে চিটাগং তার পর চকরিয়া হয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই পৌঁছোলাম আলিকদম আবাসিক এলাকায়। জার্নির শেষ অংশটা বেশ অসাধারণ ছিল। বিশাল পাহাড় আর পাহাড়ের রাস্তায় আঁকাবাঁকা চলা আমাদের গাড়ি আর মৃদু পাহাড়ি বাতাস নিমেষেই যেন আমাদের সকল ক্লান্তি দূর করে দিলো। পাহাড়ের সম্মোহনী শক্তিতে বিমোহিত হয়ে গেলাম আমি। দীর্ঘ ৪ বছর পর যেন আবার নিজেকে খুঁজে পেলাম। ওখানে টুকটাক খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম দুর্গম পাহাড়ের খাড়া পথ দিয়ে। আমাদের জ্যোৎস্নারাতে আসার ভাগ্য হয়নি তবে যেটুকু আলো চাঁদ মামা দিচ্ছিল, পথ পার হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট।
দীর্ঘ ১৫০০ ফুট ট্রেকিং শেষে পৌঁছোলাম পাহাড়ের শীর্ষে। এবার একে একে স্বপ্ন পূরণের পালা। পাহাড়ে ক্যাম্প করা হলো, জ্বালানো হলো আগুন, তৈরি করা হলো বারবিকিউ। পাহাড়ের উপর আবহাওয়া নিচের তুলনায় বেশ শীতল, এই গ্রীষ্মকালেও নাকি ওখানে কম্বল নিয়ে ঘুমোতে হয়। মেঘের উপরে দোলনায় ঝুলতে ঝুলতে পরোটা আর বারবিকিউ খেতে অসাধারণ লাগছিলো। আমরা যে পাহাড়ে ছিলাম তার চূড়ায় ছিলো একটি বৌদ্ধ মন্দির। সেটি দেখার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে নারাজ আমি। সাথে ছিলো মাহিন। আর দেরি না করে রওনা হয়ে যাই মারায়াংথং জয়ের উদ্দেশ্যে। তখন প্রায় মধ্য রাত, আমাদের আশে পাশে নেই কোন প্রাণীর চিহ্ন।
পাহাড়ের উপরে বুদ্ধের মূর্তিটাকে যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে। একদিকে পাহাড়ের চূড়ার শীতল বাতাস, দূরের ছোট ছোট আলোকবিন্দু, আর এক দিকে গৌতম বুদ্ধের জীবন্ত মূর্তি, এক অন্যরকম অনুভূতি জাগাচ্ছিল। Unlike anything I’ve ever experienced! কিছুটা ভয় কিছুটা আনন্দ কিছুটা রোমাঞ্চ আর কিছু অজানা অনুভূতি, এক অন্যরকম জগতে যেন চলে এসেছি। আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় তখনও এই অনুভূতির সাথে পরিচিত ছিলো না। যাক এই রোমাঞ্চ নিয়ে কিছু ইন্তেজাম শেষে এলো জীবনে প্রথম তাঁবুতে কাটানো রাত। তবে এই রাতে সকল ক্লান্তিও আমার জীবনের সম্ভাব্য সবচেয়ে সুন্দর সকাল দেখার আগ্রহকে দমিয়ে রাখতে পারছিলো না। তবে ঘুমিয়েছিলাম ২ কি ৩ ঘণ্টা যা ২১ ঘণ্টার টানা জার্নির পর মোটেও যথেষ্ট ছিলো না। সকালের ঝোড়ো বাতাস আর বৃষ্টির শব্দে আর সেই স্বর্গীয় সূর্যোদয় দেখার আগ্রহে এর বেশী ঘুমোনো সম্ভব হলো না।
তবে চোখ খোলার সাথে সাথে সব ক্লান্তি যেনো নিমেষেই উড়ে গেলো। পাহাড়, মেঘ, ঝির ঝির বৃষ্টি সব কিছুই যেন জানান দিচ্ছে এক অন্যরকম নৈসর্গিক সকালের শুরু হতে চলেছে; তাঁবু থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে এ যেন এক স্বর্গে প্রবেশ করলাম। যা দেখলাম তাতে আর কোনো শব্দ মাথায় আসছে না স্বর্গ ছাড়া। এক দিকে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, অপর দিকেও তার বিস্তার, সাথে রৌদ্র মেঘের লুকোচুরি খেলা। মৃদু শীতল বাতাস গা ছুঁয়ে বইছে, দূরে দূরে কিছু পাহাড়ি গ্রাম। চলে গেলাম খাড়া পাহাড় বেয়ে অন্য একটি চূড়ায়। চোখ বন্ধ করলাম জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম; প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন নতুন একেকটি জীবন উপহার দিচ্ছে, সব দুঃখ ভুলে নতুন করে বাঁচার আগ্রহ জাগাচ্ছে। এইভাবেই চলে এলো, ফিরে যাওয়ার মুহুর্ত, এই পাহাড়ি জীবন ছেড়ে।
আমরাও চললাম অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আর বাতাসের স্বর্গীয় সুবাস-এর স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে। তবে গল্প এখনো শেষ হয়নি। কোরাণ বলে They plan, and Allāh plans. And Surely Allāh is the best of planners. সৃষ্টিকর্তা তেমনি একটি পরিকল্পনা যেন করে রেখেছিলেন আমাদের জন্য। গোসল করার জন্য যায়গা খুঁজছিলাম; ইয়াসিন ভাই একটি যায়গা suggest করলো। তার কথা মতো অটো নিয়ে চলে গেলাম গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে। এক ঘাটলার সামনে নামিয়ে বলল এই নদীতে গোসল করতে পারো। একটু সামনে এগুতে যা দেখলাম তার জন্য হয়তো আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। দুটো সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মাঝে বয়ে যাচ্ছে এক খরস্রোতা নদী যার পানি আবার আয়নার মতো স্বচ্ছ। সেরে ফেললাম জীবনের অন্যতম স্মরণীয় এক স্নান। এইবার ফিরে যাওয়ার পালা। চট্টগ্রামের বিখ্যাত ঝাল খাবার খাওয়া শেষে চট্টগ্রাম শহর ঘুরে ফিরে এলাম স্বগৃহে।
পালানোর পাঁচকথা- দেওরিয়া তাল
মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত
পর্ব- খ
মাস্তুরা থেকে যেমন উঠেছিলাম, সারি থেকেও তেমনই। চড়া চড়াই আড়াই কিমি। পাথর-সাজানো পথ। দম নিয়ে হাঁটো, হেঁটে দম ছাড়ো। দাপুটে রোদ্দুর। দূরত্ব কম বলে তেমন চাপ নেই। পাহাড়ু গিরগিটি, রং-দার পাখি, আজব রকমের গাছগাছালি আর মালবাহক ঘোড়ার টুংটাং ভাল লাগছে। সামনের ঢিপিতে ঘর দেখে বুঝি, পথ শেষ। —না, পথ শেষ হয় না। যেখানে শেষ, সেখান থেকেই আর একটা শুরু। দেওরিয়া তাল এলাকার সীমানায় পৌঁছতে সদ্য-তরুণী একজন হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। চেনা মানুষের মতো।
—'কলকাত্তা সে?'
হাসলাম। আঙুল দেখাল তন্বী। —'ইধারই।'
পূজা। আমাদেরগুলো বোবা থাকলেও সারি থেকে দাদাজি উপরে ফোন করে দিয়েছেন আগাম। নাতনিটি প্রস্তুত হয়ে বসে আছে।
শ্যামল শষ্পাবৃত জমির একধারে জোড়াতালি দেওয়া বড়সড়ো দোকান-কাম-হোটেল। রান্নার বাসন-কোসন, লেপ-তোশক, তক্তা পেতে খাট ধরনের কিছু। পূজা বারো ক্লাসে পড়ছে। দায়িত্বশীলা, আলাপপ্রিয়। পানীয় জল দিয়ে দু'গ্লাস চা বানাল অচিরেই।
টি টেবিলের সামনে চোখ সোজা কাঙ্ক্ষিত সরোবর। অভ্যস্ত হাতে ডোম-শেপ্ ড টেন্ট চটপট পিচ করছে নব্যনারী। কীসের সঙ্গে কী কীভাবে জুতে দিচ্ছে ও-ই জানে। এ-বাদে ওর স্টকের সব বকবকিয়ে জোগান দিচ্ছে আমাদের। বিস্মিত শ্রোতা আমরাও সাগ্রহ প্রশ্ন করছি।গরম চায়ের মৌতাতে।
দেওরিয়া তালে রাতে বন্যজীবকুল তেষ্টা ঘুচাতে আসে। তাদের কারও কারও বুক-ঠান্ডা-করা স্বরে ডাকবার অভ্যেস আছে। ভল্লুক, লেপার্ড, হরিণ যথেষ্ট।
পূজা বলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝুপড়িতে ও একলা রাত কাটায়। ঘন ঘুমঘোর ছুটিয়ে কানে ধাক্কায় ওই সব জান্তব আওয়াজ। এককাঁড়ি লেপ-তোশকের ভিতর নিজেকে জড়িয়ে পাটিসাপটা বানিয়ে রাখে। হুঙ্কারকদের কেউ এলেও রেজাই-পাকানো পুর খুঁজে পাবে না অত সহজে।
'কী মেয়ে গো তুমি! বাবারে!'
তবে আর কোনও ডর-কারণ এখানে অনুপস্থিত।
তাঁবু পরিপাটি করে খিচুড়ির আয়োজনে ব্যস্ত হল পূজা। কোথা থেকে একজন এসে বিল কাটতে উদ্যত হলেন। বনকাজি। দেড়শো টাকা মাথাপিছু দাও।
এ কী, জানা ছিল না তো! বললেন, 'নয়া কানুন লাগু হয়েছে।'
বাতচিতের মধ্যে ক'টা ঘোড়া নিয়ে হাজির জনা পাঁচেক বিদেশি। মার্কিন মুলুকের। আমাদের ফেলে ধাঁ করে বনকাজি সেদিকে ছুটলেন।
স্থানীয় গাইডের সঙ্গে কথা কইতে কইতে কেমন বাদানুবাদের পর্যায়ে চলে
গেল। গাইড যুবকটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেন সমর্থন চাইলেন। ভ্যাবলা হয়ে দেখছি কী দাঁড়ায়। যুবক বিদেশিদের একটা প্যাকেজে নিয়ে এসেছেন। নতুন কানুনে তাদের মাথাপিছু পাঁচ-ছ'শো করে দিলে লাভের গুড় পিঁপড়েয় চাটবে।
মৃদু উত্তেজনার পর রফা হল ওঁদের। আমরা বাধ্যতামূলক তাল-দর্শনী নিয়ে বসে আছি। সংগ্রাহক ঘাসে বসে বিলবই পেতে বানান করে করে লিখতে শুরু করেছেন।
'আপনারা একটা কাটুন। দেড়শো।' নিজেই নরম গলায় বললেন।
এভাবে নিষ্পত্তি হল। এবার সরোবরে প্রতিবিম্বিত তুষারশৃঙ্গের দিকে চাইতে পারব কি?
বনকাজি হাসলেন। ওঁর ভুল নেই।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল নেমেছে। আঁধার নামে হেথা কিছু বিলম্বে। সামনে নীচের খোলা ভূমিতে তাঁবু পাতছে ভিনদেশি ট্রেকাররা। দু'জনে বেরোই দেওরিয়া তালের গায়ে গায়ে হাঁটতে।
স্বচ্ছ থই থই জলভরা হ্রদটি ৭৯৯৯ ফুট উঁচুতে। দূরস্থিত চৌখাম্বা শৃঙ্গাদির অপরূপ ছায়াগর্বী তালের সঙ্গে 'দেওরিয়া' শব্দ 'দেবরিয়া' থেকে। দেবতারা নাকি রাতে গিরিদহে চান সারতে আসেন। এই ঠান্ডায় রাতে কেন? দিনে আসলে দু'একটা ছবি তুললে কি খুব আপত্তি করতেন?
দেওরিয়া নামে জনৈক সাধুজনের নাম থেকেও তাল-নাম হতে পারে বলে কারও মত। আর একটা নাম ছিল, ইন্দ্রসরোবর। ব্যাখ্যা জানা নেই। অনুমান করা যায় খানিকটা। কেননা ইন্দ্র ভদ্রদেবের কুকর্মে কিছু ঘাটতি ছিল না। দেবদেবীদের নাহা করবার সরোবরে তাঁর আগমনের বিশেষ উদ্দেশ্য থাকা আশ্চর্যের নয়। তারপরে রাজা, মানে সবেরই দখলদার।
পুরাণকথা হিমালয়ের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যে, মেজো পাণ্ডব ভীম বড়দা'র রিকোয়েস্টে তৈরি করেছিলেন এই জলাশয়।আবার মহাভারতে বিবৃত যক্ষ এখানেই বকের মেক-আপে তাঁর প্রশ্ন না শোনার কারণে একে একে চার ভাইকে পার্মান্যান্টলি শুইয়ে দেন। শেষকালে যুধিষ্ঠির অকুস্থলে পৌঁছে বিলাপ করলেন, "আমিহ ত্যাজিব প্রাণ মৃত্যু-সরোবরে।" (কাশীদাস)। যক্ষ নিরস্ত করে ক'টি অফলাইন কোয়েশ্চেন ছাড়েন। যার উত্তরে ধর্মনন্দন একশোয় একশো তুলে সব ভাইকে জ্যান্ত ফিরে পেলেন।
হাত-পা খানটুক ছাড়াতে আমরা তাঁবুর মধ্যে রুকস্যাক রেখে বেরিয়ে পড়ি। সরোবরের জলে আঁজলা ভরে মুখে-চোখে ঝাপট মারতে দু'এক ঢোঁক চুপিসাড়ে টেস্ট করলাম। না, কেউ কোনও প্রশ্ন করেনি। করলে কেলো হয়ে যেত।
পুঁথিপোড়ো বিদ্যে অসার। অনলাইন টেস্ট-এর ডিম্যান্ড করার উপায়ও ছিল না তখন। পেল্লায় গোল্লা জুটত নির্ঘাত। আর অনন্ত শয়ান।
তালের ধারে প্রকাণ্ড গুরাস, এখানে বুরাশ। মানে, রডোডেনড্রন গাছ। জলে ইতিউতি ভাসছে ছ'সাত ইঞ্চি সাইজের মাছ। নিশ্চিন্তে। সবজে জল নিস্তরঙ্গ।
ফালি রাস্তা পাড় ধরে। চক্কর দেওয়া চলে। তবে একদিকে ঘন বন আর বন্ধুর ভূমি বলে অসুবিধের। সে কোণে রাস্তা উপরে ধেয়েছে। বোধ হয়, এ পথেই কাল...। যদি অবশ্যি গাইড ভাই আসে।
উঁচু চত্বরটায় বাঁধানো চেয়ার। বসলে সুখ, চেয়ার ধরে দাঁড়ালেও সুখ। এক ধার থেকে অন্য ধার তক কেবলই তুষারকিরীটিনন্দিত শৃঙ্গাদি। কে নেই? কেদারডোম, মেরু, সুমেরু, খর্চাকুণ্ড, ভার্তিখুন্টা, নীলকন্ঠ, কালানাগ এবং দুর্দান্ত গর্বোন্নত চৌখাম্বা। দেওরিয়া তালে এরাই দ্রষ্টব্য।
শুভ্রদ্যুতিধন্য চৌখাম্বার প্রতিবিম্ব সহ সরোবরের দৃশ্য অতি মনোহর। কয়েক পল তাকিয়ে থাকলে ঘোর লাগে। বিস্ময়পুলকমোহ একাকার হয়ে যায়। লোকালোকে কুহক-জাগানো বহুরূপতায় ভাস্বর সে। সে মহাসুন্দরের সম্মুখে প্রণিপাত হই। পরিপূর্ণ নিবেদন করি নিজেকে। সত্তায় মাখামাখি করে নিই এ লাবণ্য। দেখেছিলাম, পেয়েছিলাম, ঋদ্ধ হয়েছিলাম। ছুঁড়ে ফেলি নাগরিক আবর্জনা।
দু'জনে শীতলাসনে বসে বিকেল যাপন করি। অস্তায়মান মার্তণ্ডদেব। এতগুলো চূড়া নিশিগ্রস্ত হয়ে পড়বে অবিলম্বে। ডানদিকে একটু নিচুতে বিদেশিরা হ্যা-হ্যা হো-হো করছে। এমন জগতে ঘেরাটোপের ভিতরে হাসির কারণ কী, কে জানে! ক্যাম্প-টেবিলে চোদ্দো রকম কৌটো-বোতল সাজিয়েছে। রসুই-তাঁবুতে রান্নার আভাস। একখান আবার পটি-তাঁবুও বানাইছে দেখি।
তরুণ জগদীশ ভাই আসতে ওকে সব বুঝিয়ে পূজা সারিতে নেমে গেল। হুটহাট উঁচুনিচুতে হাঁটাহাঁটি ওরা গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না।
আঁধার আর ঠান্ডা নেমে আসছে। তাঁবুতে দু'জনের জায়গা ফাঁকা। ঠান্ডারা আয়েস করে সেখানে জমিয়ে বসেছে। প্যান্ট-শার্ট-মোজায় শরীরটাকে প্যাকেট করে স্লিপিং ব্যাগে বন্দি হয়ে পড়ে আছি।
খাবার ডাক উপেক্ষা করতে মন চাইছে। গরম খিচুড়ির টানে পাঁচ পা হেঁটে দোকানে ঢুকি। প্রেশার কুকার থেকে জগদীশ যত্ন করে বেড়ে দিল। উষ্ণতা বড় লোভনীয় এই মুহূর্তে। কার্যত মোমের আলোয় কতকতিয়ে গিলে হাত ধুতেও ফ্যাসাদ। আঙুলে কোপ পড়ছে যেন।
তাঁবু-গর্ভে সেঁধিয়ে স্বস্তি। ঘুম আসে না এত তাড়াতাড়ি। থার্মোমিটারটা বাইরে নাগালে রেখেছি।
নৈঃশব্দের অনন্য ভাষা আছে। বিদেশিরা অনেক আগেই থেমেছে। উসখুশিয়ে হাঁফিয়ে উঠছি। অনড় না-ঘুম শুয়ে কাঁহাতক স্থির থাকা যায়! নিশীথের অর্ধস্ফুট অজ্ঞাত ধ্বনি বাইরে। দেওরিয়া তালে আসবেন তাঁরা চান সারতে? আরে নিদেন চতুষ্পদেরা? পূজা তো অনেক ঘাঁইঘুই শুনেছে। আমাদের কানে একটা-দুটো ও'রম পৌছলে মন্দ হত না।
জল খেতে উঠে বসি। থার্মোমিটারের কথা মনে পড়ল। লম্বা চেন টেনে হাত বাড়াই। টর্চের আলো ফেলে বিস্ময়ে ডাকি, 'অশোক, দ্যাখো দ্যাখো।'
'কত?'
'মাইনাস ওয়ান।'
রাত বাড়লে আরও নামবে। ওখানেই রেখে দেই।
তাঁবু থেকে বাইরে মাথা নিতে ঊর্ধ্বদিকে নজর পড়ল। ওভারহেল্মড! অভিভূত! ফের চাপা উত্তেজনায় বললাম, 'শিগগির বেরোও। দ্যাখো?'
বাড়তি চাদর গায়ে জড়িয়ে দু'জনে হাঁ করে চেয়ে আছি। ওঃ, কী আশ্চর্য মায়াভুবনে আমরা!
"আজি যত তারা তব আকাশে....।"
সব —সব্বাই সে-রাতে আকাশ জুড়ে সেজে আছে। কত? শত, হাজার, লক্ষ, কোটি? প্রায় গায়ে গায়ে জ্বলজ্বল মিটমিট করছে। আকাশে এত তারা থাকে? —থাকে। কলকাতায় মুখ দেখায় না। কিন্তু ছাত্রবেলায় তারা বেশ দেখা দিত। গরমকালে উঠোনে পড়বার সময় তেল ফুরিয়ে যেতে দপদপিয়ে হ্যারিকেন নিভে যেত। আকাশমুখো হয়ে তারা দেখতাম মা কেরোসিন ভরবার ফাঁকটুকুতে। —ওই তো জিজ্ঞাসাচিহ্নের মতো সপ্তর্ষিমণ্ডল। —ওই কালপুরুষ। —আর ওই-ই দিকে....। তারপর পঁচাশি সালে হ্যালি'র কমেট দেখতে দু'টো আস্ত রাত এলোমেলো আকাশচর্চা হয়েছিল। টেলিস্কোপ জুটে গিয়েছিল। একটা মানচিত্রও জোগাড় হয়। চেনার চেষ্টা বৃহস্পতি গ্রহ, রক্তাভ মঙ্গল, শুকতারা, শনি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে রোহিণী, স্বাতী, অশ্বিনী, মৃগশিরা, কৃত্তিকা, পুনর্বসাদের ঠিকঠাক চেনার এলেম তৈরি হল না একদম।
আজ এই মুহূর্তে অগণ্য নক্ষত্রের ভিড়ে মিশে তারা স্মিত হাসছে ব্রহ্মাণ্ডের পানে চেয়ে। হয়তো জানে না, আমরাও চেয়ে আছি হতবুদ্ধি হয়ে, অটুট বিস্ময়ে। এত উজ্জ্বল, এত কাছে, মনে হচ্ছে দু'চারটে পেড়ে নিই।
অমন ধারালো ঠান্ডায় আকাশ-বিলাস বেশিক্ষণ চালানো গেল না। তালের দিকে চোখ পাতি। স্তব্ধ শুনসান রাত্রির কোলে একদহ জল আলগোছে শুয়ে আছে। ক্বচিৎ পাখির ডাকাডাকি।
ঢুকে পড়লাম তাঁবু হয়ে ঘুম-থলিতে। হিহি করছে সর্বাঙ্গ। নট নড়ন-চড়ন ভঙ্গি।
পাহাড়ে প্রথম রাতে খাবলখোবল স্বপ্ন দেখা অভ্যেসে ঢুকে গেছে। পরের রাতগুলোতে কমবেশি। প্রায় সবই পাহাড়-ঝরনা-খাদ সংক্রান্ত। এর নাকি ব্যাখ্যা আছে। কী জানি, ফ্রয়েড সাহেব কিছু বলে গেছেন কিনা!
নতুন দিনটার সূচনায় চরাচর ঝিলমিল করছে। দেওরিয়া তালের সবুজাভ জলে শৃঙ্গের ছায়া। বেশ দর্শনীয়, স্মরণীয়। প্রথম উঁকি থেকে সূর্যের ষোলো আনা উদয়ের কালপর্বে বরফচূড়ার বর্ণান্তর ঘটে। কখনও মৃদু, কখনও উজ্জ্বল। সীমাহীন আনন্দে শুধু চেয়ে থাকা। আহা, মোহ-জাগানিয়া ভারী!
চা পিয়ে সকালে জগদীশই আমাদের নিয়ে চলল
চোপতার দিকে। গাড়িতে গেলে আগের মতো সারি-মাস্তুরা নেমে যাওয়া যাবে। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার পেয়ে বসেছে। যাব উপর দিয়ে বনভূমি ভেদ করে। রাস্তা-ফাস্তার বালাই নেই। চাইও না। "Leave the road, take the trails." পিথাগোরাস শিরোধার্য।
দেওরিয়া তালকে টা-টা করে তার এক কোণ ধরে উঠে যাই। পা রাখি একেবারে না-জানা বন-মুলুকে।
ছবি : ওঠার পথে, ফল সাজানো গাছ ও রামদানা খেত, গঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ড।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন