গল্প


এপিটাফ

মো য়া ল্লে ম  না ই য়া


অনেক স্বপ্ন দেখেছিল দুজনে। শুধু ভিন জাত বলে সমাজ মানেনি। ওরা বাবাকে বুঝিয়ে ছিলো- এমন হলে ছেলেকে যেন ত্যাজ্যপুত্র করে। এ দেশ শুধু পোশাকের মধ্যে ধর্ম খোঁজে,খাদ্যের মধ্যে আস্তিক নাস্তিকের সন্ধান পায়। কিন্তু বুকের মধ্যে যে একজন ধ্যানমগ্ন মানুষ আছে তার খোঁজ এরা কেউ রাখে না। তবু সায়ন চেয়েছিল আফসানাকে নিয়ে সে পালাবে, দূরে গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে শহরের ভিড়ে ৷ যেখানে থাকবে না নামাবলীর চোখ রাঙানি, জপ- তপের হুমকি, টুপি দাড়ির হুজ্জতি। বাপ মার দেওয়া এই নাম পদবী সব রেখে নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে 'ও' আর আফসানা বেঁচে থাকবে। কিন্তু কি যে হলো কে জানে! যে রাতে ওরা বাড়ি ছাড়বে বলে ঠিক করল, সেই রাতে আফসানাদের মসজিদ থেকে ঘোষণা হল- হাসিমপুরের হিন্দুরা জোট বেঁধেছে ভাইজান, তোমরাও জোট হও। সায়নদের শিব মন্দির থেকেও হাঁক দিল- চন্ডীপুরের মোল্লারা আজ রাতে আমাদের গ্রাম আক্রমন করবে তোমরা সবাই সজাগ থেকো।  সায়নরা জানে, বহুদিন থেকে একটা চাপা উত্তেজনা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। নেতারা নানাভাবে এসে বুঝিয়ে গেছে- মোল্লাদের দেশ এটা নয়, ওদের দেশ পাকিস্তান। এখান থেকে যদি ওদের তাড়ানো যায় সবকিছু হিন্দুদের হয়ে যাবে। সায়ন বুঝতে পারেনা জন্ম থেকে সে দেখে এসেছে- আওলাদ চাচা, রমজান চাচা, নওশাদ ভাইদের। অথচ নেতারা বলছে এদেশ ওদের নয়! একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে সায়ন ভাবতে থাকে- আওলাদ চাচার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়েই তো তার মেয়ে আফসানার সঙ্গে পরিচয়। রহিমা চাচি তাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে, স্নেহ করে। এ সম্পর্ক তো বুকের মধ্যে ওই ধ্যানমগ্ন মানুষটার সঙ্গে। তাকে কি পোশাক-আশাক, নামাবলী, খাদ্যাভ্যাস দিয়ে আটকে রাখা যায়! এ প্রশ্ন নিয়ে সে আজও অপেক্ষা করে আছে পরপারের জন্য ৷

সেদিন ছিল ঘুটঘুটে কালো রাত। যে যার ঘরে নিদ্রাহীন চোখে সতর্ক৷ দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক। কিছু মানুষের আর্তনাদ, ছুটোছুটির শব্দ৷ নীরব রাত বোমা গুলির আওয়াজ আর আর্ত চিৎকারে ক্রমশ ভারী হয়ে এল। সারারাত ধরে চলল তান্ডব লীলা। ভোরের আলো ফোটার আগে শান্ত হয়ে এল সবকিছু। কেউ জানে না কারা এমন করে গেল। পরদিন সায়ন দেখলো, তাদের গ্রাম অক্ষত। পাশের চন্ডীপুর গ্রাম দাঁড়িয়ে আছে তার পোড়া কঙ্কালসার দেহ নিয়ে  সেই রাতে মারা গেল অনেকে৷ প্রচুর মানুষ জখম হল। গ্রাম ছেড়ে পালালো বহু মানুষ। সায়ন ছুটে এলো আফসানাদের গ্রামে। বুকে যন্ত্রণা আর চোখে অশ্রু নিয়ে পোড়া শ্মশানে খুঁজতে লাগলো তার ভালোবাসাকে, তার প্রিয়জনকে। চেনাই যাচ্ছে না কোন কিছু। একরাতেই কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল৷ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পুলিশ এল, প্রশাসন এল, মিডিয়া এল, এমনকি হারানো মানুষগুলোও ফিরে এলো! তবে তারা সাদা কাফনে সমস্ত শরীরটাকে ঢেকে!প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সবাই কাঁদছে৷ এমনকি তাদের হাসিমপুর গ্রামও কাঁদছে। সায়ন নীরবে এসে দাঁড়ায় চন্ডীপুরের সার্বজনীন কবরস্থানে। অনেক মানুষের ভিড়৷ কেউ তাকে কিছু বলল না। সবাই যেন ক্লান্ত। শেষবারের মতো প্রিয় মানুষের মুখ গুলো দেখিয়ে দাফন করা হবে। একে একে রহমত চাচা, আসগার ভাই, মমিন দা, তাহিরা চাচি.....হঠাৎ একটা লাশের কাছে এসে সায়ন থমকে দাঁড়াল। তারপর চোখে মুখে সব হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে সে নিষ্পলক চোখে লাশটার দিকে তাকিয়ে রইল।

অনেকদিন পর। শোকের সাগর পার হয়ে সবাই যখন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে, সায়ন একদিন এল আওলাদ চাচার কাছে। তার ইচ্ছা আফসানার কবরের উপর নিজের হাতে স্মৃতিসৌধ বানাবে। সেই মতো মৌলভী সাহেবের অনুমতি নিয়ে সায়ন তৈরি করল তার ভালোবাসার ঘর। আফসানা জীবিত থাকতে যে ঘরের স্বপ্ন দুজনে দেখেছিল, সেই ঘর তার মৃত্যুর পরে সায়নের অশ্রু দিয়ে নির্মিত হলো। সবাই দেখল সমাধি স্তম্ভের গায়ে এক অভিমান ভরা এপিটাফ জ্বলজ্বল করছে- "আমাদের প্রেম লেখা হোক জলের অক্ষরে"৷ হয়তো আফসানাও অনেক কথা বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি। তাই অভিমান নিয়ে প্রিয় মানুষের ঘরে সে আজও পাশ ফিরে শুয়ে আছে৷








কি নামে ডেকে

সু ল গ্না  চৌ ধু রী


বছর বত্রিশ পরে ফিরলো একটা সম্পর্ক। যে সম্পর্কটা ভেঙেছিলো কিশোর বয়েসে, তখন তাদের মনের চাওয়া ছিলো একান্ত আনন্দের এক চোখ স্বপ্নমাখা, সে বয়েস জানতো না অনেক কিছু, অভি তখন বছর উনিশ কি কুড়ি, আর টিনা রায় মাধ্যমিকের পরীক্ষার সম্মুখীন। ওরা একে অপরকে ভালোবেসেছিলো খুব। ভালোবাসা হলে, প্রেয়সীর জন্য পেড়ে আনা যায় আকাশের চাঁদ আর তারা! ফুল তুলে দেওয়া যায় হাতে! আর স্বপ্ন মাখিয়ে দেওয়া যায় দুই চোখে, সেই স্বপ্নমাখা চোখ দেখে দুনিয়ার সকল সৌন্দর্য। বাস্তব বোধ থাকে বহুদূরে। অভি পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলো, টিনা ছিলো মস্ত ফাঁকিবাজ, পড়তে বসলে অকারণে মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। আর বই, খাতা জুড়ে আঁক কাটতো সে, কোনো দিকেই ভ্রূক্ষেপ ছিলো না তার। আজকের ভাষায়- বিন্দাস। 

অভি টিনার বন্ধুকে দিয়ে বলে পাঠাতো মন দিয়ে পড়াশোনা করার কথা। টিনা পড়ার বই এর ভেতরে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তে থাকতো আর সময় পেলেই তার প্রেমিকের জন্য চিঠি লিখতে বসতো। প্রতি ছত্রে থাকতো উজাড় করা ভালোবাসার শব্দ। হঠাৎ করেই তাদের সম্পর্ক দমকা হাওয়ায় আছাড় খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। টিনার বাড়ির লোকজনেরা হঠাৎ করেই টিনার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে থাকে সে কথা  কানে যায় অভির, অভি তখন কলেজ পড়ুয়া, একদিন সে তার বন্ধুদের নিয়ে টিনাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জানতে চায়, টিনা তাকে আশ্বস্ত করে। আশ্বস্ত করে এই বলে যে, তুই চিন্তা করিস না, তোর কাছ থেকে কেউ কেড়ে নেবে না আমায়, আর সম্বন্ধ আসলে সে বা কি করতে পারে? টিনা তার বাবাকে যমের মতো ভয় পায়, আর ভীতু টিনা গুরুজনদের অবাধ্য হওয়ার মতো মেয়ে ও না, মফস্বল এলাকায় মেয়েরা একাদশ শ্রেণীর দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেই আশপাশ থেকে সম্বন্ধ আসা শুরু  হয়ে যেতো।  যদিও টিনার পরিবার শিক্ষিত পরিবার, সে পরিবার অনেকটাই অন্যরকম, কিন্তু আজ থেকে বছর ত্রিশ, বত্রিশ আগে এ ধারনাটাই মানুষ পোষণ করতো যে মেয়ে বড়ো হলেই তাকে গৃহিণী হয়ে যেতে হবে। 

 বাল্যপ্রেম বড্ড সমস্যায় পড়েছিল সেই দিন । প্রেমিকের অভিমান আর বাড়ির  টানাপোড়েনে টিঁকলো না একটা ভালোবাসার সম্পর্ক।
ভালোবাসা যে কাউকে কোত্থাও কৈফিয়ত দিতে নারাজ। সে যে কখন কি ভাবে কেন হয় তা যে বোঝা বড্ড দায়! এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব একটা সহজ কাজও নয়। তাই এক সকালে পড়তে যাওয়ার পথে টিনা অভি কে জানিয়ে রেখে আসে- যে সম্পর্ক শুধু প্রশ্নের সম্মুখীন হয় বারবার, প্রেমিকের বিশ্বাস ভেঙ্গে যায় প্রেমিকার প্রতি,  ঘরে আর বাইরে এত জবাব দিতে হয়- সে সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো বড্ড অস্বস্তিকর। তাই টিনা সম্পর্কের ইতি টানতে চায় এখানেই। বুক ভেঙে যায় তার, তবুও ফিরে চায় নি সে সম্পর্কের দিকে আর একবারও। অপরিণত বয়েস, বুঝলো না কি যেন হারিয়ে গেলো, হারালো যে একটা স্বপ্ন। কিন্তু যে ভালোবাসা পরিনতি পাবে না তাকে বয়ে বেড়াবে কি করে? টিনা তার ঘুম না আসা চোখে বিছানায় শুয়ে রাতের আকাশের তারা গোনে, কান্না পায় হু-হু করে, মনখারাপ লাগে ভালোবাসা ভরা মনের জন্য। সকাল হলে স্বাভাবিক থাকে সে, সকলের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, একা হলেই একটা মুখ মনে পড়ে যায়, জোর করে তাড়িয়ে দেয় সে মনের কোণে উঁকি দেওয়া মুখ খানি। তারপর দিন গড়িয়ে যায়, বছর ঘুরে যায় কিশোরী টিনা তরুণী হয়ে ওঠে, জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পদার্পণ করে সে, জীবনের বোধ, অন্তরের আন্তরিকতায় জীবন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। দুই পুত্রের জননী টিনা কবে যেন তরুনীর দুয়ার খুলে প্রৌঢ়ত্বের সিঁড়ির ধাপে পা রেখে বাইতে থাকে জীবন তরী, এখন তার ভরা সংসার। তবুও আজও কেন যে উতল হাওয়ায় খোলা চুল উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে টিনার, এখনো বৈশাখের মালতী ফুলের মালা দুই হাতে জড়িয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়, এখনো বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল দেখলে ফিরে যায় সে সেই সব ফেলে আসা দিন গুলোতে। মন খানি কিশোরীর চঞ্চলতায় ঘিরে ধরে। হঠাৎ করেই প্রৌঢ়ত্বের সিঁড়ির ধাপে উঠতে, উঠতে নেট দুনিয়ায় দেখা হয়ে গেলো অভির সাথে। সে যে কি উত্তেজনাময় দিন! আজও মনে করে অবাক হয়ে যায় টিনা! সেই গলার স্বরে আজও যাদু, সেই ডাকে আজও অপার সম্মোহন, যাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা হলো না এই পূর্ণ গৃহিণী টিনা রায় থেকে যিনি টিনা ব্যানার্জি তে আজ পৌঁছেছেন। আজ তারা দুজনেই সুখী, এবং নিজেও কর্মজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত, শুধু পার্থক্য তারা এখন অন্য কারোর ঘর, একে অপরের পর, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার অন্তরের ভালোবাসা যা বত্রিশটা বছরেও দূরত্ব মানসিক ভাবে আজও কাছের। দুই প্রৌঢ় অবাক হয়ে গেলো নিজেদের খুঁজে পেয়ে, অনুতাপ আর অনুশোচনায় ভরে রইলো বত্রিশ বছর পরের প্রতিটি বাক্যালাপ। কখনও এপার থেকে প্রৌঢ়া সান্ত্বনা দিল কখনও ওই পারের কণ্ঠস্বর দিলো সান্ত্বনা। অভিমান ভরা শব্দ বিদ্ধ করলো দুজনকেই।দুজনেই ফিরে গেলো ফেলে আসা দিনের কথায়, ভেসে গেলো রেখে আসা দিন গুলোতে, স্মৃতির দুয়ার খুলে তুলে আনলো মনিমুক্তো আজও যা মূল্যবান। 
হঠাৎ করেই খেয়াল হলো তারা এখন আর কেউ কারো নেই! অন্য কারোর সম্পত্তি, কারোর উপর আর কারোর অধিকার ও নেই, শুধু সেইদিনের অনুভুতিটুকুই সম্বল, এই তিরিশ, বত্রিশ বছর পরের ফিরে পাওয়া সম্পর্কের নাম তবে কি হবে? আজ যে সমাজের কাছে প্রশ্ন থাকবে এই সম্পর্ক কে ঘিরে? 
টিনা বোঝালো অভি কে আমরা খুব ভালো বন্ধু হতে পারি তো! চাল, ডাল, তেল, লবণের বাইরের হিসাবের সম্পর্কে। একে অপরের খুব ভালো বন্ধু। অভি সম্মতি সূচক শব্দ দিয়ে বলল বটে, কিন্তু প্রতিদিনই  তার কথায় টিনাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা প্রকাশ করে ফেলতো। প্রৌঢ়া টিনা কিন্তু অভিকে বোঝায় বর্তমানে শব্দ "প্রেম" আর সস্তা শব্দ "পরকীয়া"-য় কিন্তু আমাদের এই সম্পর্ক নয়।  এ সম্পর্ক  ফিরে আসার অনূভুতি সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ কারো সংস্রবে না থেকেও যে দু'জনের জন্য দু'জনের এত ভালোবাসা অন্তর জুড়ে একে কি এই পরকীয়া আর প্রেমের চটুল শব্দে বাঁধা যায়? যায় না। 
এই সম্পর্কখানি দু'জনেরই বড্ড প্রিয়, আর স্পর্শকাতর ও বটে। এই সম্পর্ক ছেড়ে এতদিন বেঁচেছে, বাঁচতে হয়েছে পরিস্থিতির প্রয়োজনে কিন্তু তা যে অন্তরের এক পাশে সুপ্ত হয়ে ছিলো। 
এত বছরের জীবনের গল্প করতে তাই অনেক শব্দের আওয়াজ হলো, তারপর দুজনেরই সংসার বাঁচানোর তাগিদে আবার সে কথার কোলাহল থেমে গেলো। 
বড্ড নিঃস্তব্ধতা, অনেক আওয়াজের পর হঠাৎ করে নীরবতায় বেদনার রঙ প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। তাই হলো  এই সম্পর্কেও। বত্রিশ বছরের গল্প কি এক বছরের মধ্যে শেষ করা যায়? তাই কতকথাই আর বলা হলো না। অন্তরের বিবেক আর চৈতন্য এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবার ও ভিন্ন হয় পথ চলা। টিনা প্রতিদিন বোঝাতো অভিকে এই বয়েসে এসে এই যে ফিরে পাওয়া এ তো জীবনের অন্য রকম স্বাদ।  
তবু্ও অভি বলতো না রে কেমন যেন পরকীয়া, পরকীয়া লাগে, কেমন যেন ছলচাতুরী মনে হয়, তুই যদি সেদিন আমায় ছেড়ে না আসতি এই ছেলেমানুষীর খেসারত তো আজ  দিতে হতো না"। টিনার বুক ভেঙে কান্না এসে দলা পাকায় গলার কাছে, সে অভি কে বলে আমি যে খুব অসহায় ছিলাম রে অভি। টিনা বুঝতে পারছিলো অভি ঝোঁকের মাথায় তাকে খুঁজে  বার করেছে, কিন্তু সমাজের ঊর্ধ্বে উঠে তারা এই সম্পর্ক কে টিঁকিয়ে রাখার মতো মানসিক জোর পাচ্ছে না। দু'জনেই পরিবারের সম্মানের সাথে তাদের আত্মসম্মান এর কথা মনে করিয়ে দেয়।কাছে এসেও কাছে আসা হয় না তাই আর। সেই কিশোর বয়েস থেকেই সমাজ আর সম্মান ভাবতে, ভাবতে একটা প্রেম পরিণত হলো না, অন্তর জুড়ে শুধু অসম্ভব আকর্ষণ রয়ে গেলো। সত্যি তো তাদের যে সম্পর্কের বৈধতা নেই, সকল সম্পর্কের একটা বৈধতা লাগে, টিনার মাথার সিঁথিপাটী তে যে নেই অভির হাতের রাঙানো রঙ, যা সমাজের চোখে স্বীকৃতি দিতে পারে। অধিকার যেখানে মূল্যহীন অন্তর মূল্যবান করে রাখার মূল্য এই দুনিয়াকে আর তাদের পরিবারকে তারা বোঝাবে কি করে? পৃথিবীর সব সম্পর্ক গুলো যে স্বার্থপূর্ণ। সব সম্পর্কের যে সুন্দর নাম আছে। সেদিনও যেমন পরিস্থিতির মূল্য চোকাতে হয়েছিলো, আজও প্রৌঢ়ত্বে এসেও আর একবার মুল্য দিতে হলো এই ভেবেই, যে কি নামে ডাকি এই সম্পর্ক কে? তাই অন্তর জুড়ে থেকে গেলো সেই দুটি কিশোর, কিশোরীর মন, যা এই পৃথিবীতে এসেও চিরকাল ধরাছোঁয়ার বাইরে রইলো। অসীম ভালোলাগা পরিস্থিতির চাপে পড়ে বারবার মৃত্যু বরণ করে। এতো চাওয়া ছিলো তাও যে কেন পাওয়া হলো না?   
দু'জন দু'জনকে পেয়ে ভেবেছিলো এই স্বার্থময় সংসারের ঘানি ঘোরাতে ঘোরাতে একটা মুক্ত জানলা বুঝি খুলে দাঁড়ালো তারা, যে জানলা দিয়ে আসবে শুধু হাওয়া, আসবে বৃষ্টি, তা আর হলো কই? ক্লান্ত দিনে না হয় এই মুক্ত জানলার পাল্লাটা খুলে একটা দিন না হয় নিজের জন্য বাঁচতো তারা, একটা সকাল, একটা দুপুর এই এত বছরের পর স্বার্থহীন উন্মুক্ত জানালার গরাদে মাথা রেখে অনেকখানি হেসে কেঁদে হাল্কা করে নিতো, নিজেরা গাইতে পারতো গান যা বয়ে আনতো বেলা মাঝের অনাবিল আনন্দ। কিছু সম্পর্ক অদ্ভুত ভাবে মানুষের মন ছুঁয়ে থাকে, এটা সেই সম্পর্ক যা সবকিছুর ঊর্ধ্বে, ক্লান্তিহীন  যে ভালোবাসা তা আর স্বার্থময় জগতে হলো কই? একখানি অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধুত্বের গল্প, আজ কিন্তু দুই প্রৌঢ়ের একখানি প্রশ্ন বিশ্বমাঝে অনুরণিত হতে লাগলো, ও হে সম্পর্ক, কি নামে ডাকি তোমায়?







ছোট সে মায়া

কো য়ে ল  তা লু ক দা র


তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। কার্তিক মাসের এক 
ছুটির দিনে একাকী মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার বাড়ি ছিল গোপীনাথপুরে। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে। যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে বাড়ি। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মাঝখানে একটা ছোট নদীও পড়ে। খেয়া নৌকায় পার হতে হয়।     

রবিনহুডের মতো একদিন হেঁটে হেঁটে মাঠ ঘাট প্রান্তর পার হয়ে পৌঁছে যাই গোপীনাথপুর আমার  মামার 
বাড়ি। 

সারা বিকাল পর্যন্ত মামাতো ভাই ছাইদুলের সাথে পুরো গ্রাম চষে বেড়াই। যমুনার কূলে যাই বেড়াতে। দেখি, সেখানে  মাটির পাড় ভেঙে পড়ছে নদীতে। বয়রা ঘাট থেকে ছেড়ে আসা বড়ো স্টীমারটি ভেঁপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের দিকে। চলছে লঞ্চ ও পাল তোলা সারি সারি নৌকা। জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরছে। দূরে মাঝ নদীতে জেগে ওঠা চর জুড়ে দেখতে পাচ্ছিলাম সাদাকেশি কাশবন।   
  
মাঠে কার্তিকের রোদ্রতাপে কিষাণেরা কাজ করছিল। কেউ কেউ জারীগান গাইছিল আপন মনে। কেউ হুকোয় তামাক তুলে মনের সুখে গরগর শব্দ তুলে টান দিচ্ছিল। নদীর কূলে উপরে ছেয়ে আছে  নীল আকাশ, সেই আকাশে বিভিন্ন পাখি উড়ছে। উড়ছিল চিলও। নদী থেকে বাতাস বয়ে আসছিল শন শন করে। কী যে ভালো লাগছিল -- কূলে দাঁড়িয়ে জল দেখতে!  
                       
কিন্তু যমুনার একটি জিনিস দেখে আমার খুব 
মনখারাপ হয়েছিল। দেখলাম, আধা পাকা ধানক্ষেত, সরিষা ক্ষেত, আখ ক্ষেত ভেঙে ভেঙে পড়ছে উত্তাল নদীতে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল- চোখের সামনে দেখলাম, একটি বহু প্রাচীন জীর্ণ মঠ  মাটি উপড়ে নদীর জলে তলিয়ে যেতে।    

যমুনার পাড় থেকে ফেরার পথে ছাইদুল আমাকে বলছিল- 'তুই তো খুব মন খারাপ করেছিস দেখছি। চল্ তোর মন ভালো করে দেই।' 
আমি বললাম, কী সে!

ছাইদুল বলল - 'আলেয়া আপুর নাম শুনিস নাই? আমার চাচাতো ফুপুর মেয়ে। পূর্ব পাড়ায় ওদের বাড়ি।  তোকে ওখানে ঐ বাড়িটায় নিয়ে যাব।'
আমি বললাম, 'আলেয়া আপুর নাম শুনেছি মার কাছে থেকে। কিন্তু কোনদিন দেখি নাই তাকে।'
      
আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি ও নারিকেল গাছ বেষ্টিত ছিমছাম পরিবেশে আলেয়া আপুদের বাড়ি। আমরা বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলাম- আলেয়া আপুকে। এমন পল্লীর নিবিড় কোণে, এমন প্রতিমার মতো মেয়ে থাকে! বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম। চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ,... চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি করে না। আমি তখন নিতান্তই  কিশোর-উত্তর এক তরুণ। মেয়েদের রূপ লাবণ্য ঐ ভাবে তখন বুঝতাম না। 

আমি যখন অনেক বড়ো হয়ে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলাম- চন্দ্রাবতী, পদ্মাবতী, পার্বতী, লাবণ্যদের রূপ বর্ণনা যখন পড়েছি, তখন অনেক আগের- সবুজ পত্রপল্লব ঘেরা পল্লী গৃহকোণের একজন আলেয়া আপুকে দেখা তার অপূর্ব শ্রীময়ী মুখখানি মনে মনে মিলাতাম।  
                     
কী সুন্দর করে কত কথাই না বলেছিল আলেয়া আপু-' তুমি কী পড়ো, কী হতে চাও জীবনে, কী ভালো লাগে তোমার, আমার কথা তোমার মনে থাকবে,  তুমি অনেক ভালো ছেলে!'  এমন অনেক ভাঙা ভাঙা কম্পিত কথা।   
          
আলেয়া আপুদের বাড়ি থেকে যখন চলে আসি- তখন আপু বলেছিল- 'ফাল্গুনের চার তারিখে আমার বিয়ে হবে। তুমি এসো বিয়েতে। কী আসবে না তুমি?'

আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম- 'আসব আপু। আমি এসে সারা বাড়ির উঠোনে আলপনা আঁকবো আর নেচে নেচে হারমোণিকা বাজাবো।'      

পথে আসতে আসতে ছাইদুল আমাকে বলছিল -- কী!  আলেয়া আপুকে দেখে তোর মন ভালো হয়েছে তো?'  আমি বলেছিলাম- 'হয়েছে।'

কিন্তু, ছাইদুল জানতে পারেনি, সেদিন আমার কোমল কিশার তরুণ মন অনেকখানি খারাপও হয়েছিল। সেই মনখারাপের বিষণ্ণতা আজও মনের উপর অমাঙ্গলিক ছায়া ফেলে।        

বিকালে যখন বাড়ি ফিরে এসছিলাম, তখন আমার সাথে খেয়া পার হচ্ছিল একজন বোষ্টুম ও একজন বোষ্টুমি। ওদের পরনে ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়। দুজনের হাতে দোতারা!  আমি বললাম- তোমরা একটা গান গেয়ে শোনাবে আমাকে! টাকা চাইলে টাকা নেবে। আমার কাছে দশ টাকা আছে। তাই দেব তোমাদের।                                    

বোষ্টুমি বলছিল -- 'আমরা কত ঘাটে কত বাটে, কত চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে- কত গান গেয়ে শোনাই মানুষকে। কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। আজ আমরা তোমাকে এমনি একটা গান শোনাব, কোনো পয়সা লাগবে না।'        

বোষ্টুমি দোতারায় তান তুলল। বোষ্টুম বাজাচ্ছিল খঞ্জরি টুংটাং করে --
দুজনেই একসাথে গেয়ে শোনাল গান।

'...ছেড়ে দিয়া মায়াপুরী
দিতে হবে ভব পাড়ি
চেয়ে দেখো মন-ব্যাপারী
দিন গেলে হয় সন্ধ্যা ..
আপনি যদি ভালো বুঝ
সুসময়ে মুর্শিদ ভজ
জ্ঞান থাকিতে পাগল সাজো
চোখ থাকতে হও আন্ধা ..
এই দুনিয়া মায়া জালে বান্ধা ..'
                      
                                       
মানুষের জীবনে শুরু থেকে কত কিছুই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি থাকে! কত সুখ অনুরণরিত হয় বোষ্টুমীর ঐ দোতারার তানের মতো চিরকাল।  আবার কত ছোট্ট কোনও মায়া-বেদনা আটকে থাকে বুকের গভীরে অনন্ত জীবন ধরে, কান্না হয়ে তা ঝরে পড়ে না। 

কী এক অদ্ভুত সন্ধ্যা ছিল সেদিন। ছোট্ট সেই নদীর জলের ক্ষীণ ধারা ছলাৎছল করছিল। সন্ধ্যা আকাশের সব সোনালি আভা যেন মেখে দিচ্ছিল আমার  অন্তরের মাঝে!  

কিছু রঙ তার এখনও মনকে রঙিন করে।







বৃষ্টির পাঁচালী

ছ ন্দা  দা শ


সকাল থেকেই আজ অঝোর ধারায় বৃষ্টি। আকাশটা যেন কেউ ফুটো করে দিয়েছে। বিশাখা বারান্দায় বসে বৃষ্টির গান শুনছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে তার শাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে তা নিয়ে তার ভাবান্তর নেই। আাঁচল টেনে আরও একটু জড়িয়ে নেয় সে। বারান্দায় বসলে খোলা রাস্তা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায় কোন বাধা ছাড়াই। খুব ভালো লাগে তার বৃষ্টিস্নাতা এই সকাল। সোজা এই রাস্তা কতদূর গেছে জানতে ইচ্ছে হয়। হয়তো কোথাও গিয়ে ভাগ হয়ে গেছে। ওখানে গিয়ে ভাবতে হবে কোন ভাগ সে বেছে নেবে জীবনের মতো।
আজ রাস্তায় কেউ নেই। জনশূন্য। বিশাখা বারান্দায় বসে মানুষ দেখে। এটা তার শখ। তাদের হাঁটার অভিব্যক্তি, চেহারার সাদৃশ্য এসব নিয়ে তাকে ভাবায়।
খুব জোরে একটা বাজ পড়লো। আলো এসে তার চোখে পড়ে। বিশাখা চোখ বুজে কানে হাত দেয়।
তারপরেই চোখ খুলে দেখে রাস্তায় একজন লোক ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। ছাতা নেই, বর্ষাতি নেই।
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে সে যেন জীবনকে মধুরতায় ভরে
নিয়ে চলছে।
বিশাখা খুব কৌতূহল নিয়ে চেয়ার ছেড়ে রেলিং ধরে
দাঁড়িয়ে দেখছে। বৃষ্টির ফোঁটা ধারালো সূঁচের মতো
লোকটার গায়ে বিঁধছে। আবার একটা জোরে বাজ পড়লো। ঠিক তখুনি লোকটা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলে বিশাখার চোখে চোখ পড়ে। আর বিশাখা বুকের মাঝখানে এসে বৃষ্টির ফলার মতো বিদ্ধ করে।
মুহূর্ত মাত্র। লোকটা দাঁড়ায় না। ঠিক তেমনি কপালের অবাধ্য চুল বাম হাতে সরাতে সরাতে বৃষ্টির মধ্যেই মিলিয়ে গেল।
বিশাখা অতীতের পাতা ওল্টাতে থাকে। কে কোথায়? কেন নামটা মনে করতে পারছে না! এতো পরিচিত মনে হচ্ছে তার। দু'হাতে মাথা চেপে চেয়ারে এসে বসে। 
ভাবনার মাঝপথে কাজের মেয়েটা ভগ্নদূতের মতো এসে বলে, 'আপনার স্নানের সময় তো হয়ে গেছে'।
বিশাখা শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে তন্ন তন্ন করে কতো নাম মনে করার চেষ্টা করছে। কিছুতেই মিলছে না। দরজায় আবার টোকা। আফা এতো জল ঢাললে কাশি বাড়বো।
বিশাখা দ্রুত কাপড় পাল্টে খাবার টেবিলে বসেও একই চিন্তা তাকে সুস্থির হতে দিচ্ছে না। প্লেটে অনেকখানি ভাত নিয়ে শেষে নষ্ট করে উঠে পড়ে। বেডরুমে এসে ছাই রঙা পর্দা টেনে দেয়। ছায়া ছায়া আলোয় সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আরেকবার
চেষ্টা করে মনে করার এ মুখ কার? কেন তাকে এমনভাবে আকুল করছে! শৈশব, কৈশোর, যৌবনের আলো রেখায় সে হাঁটছে। কিন্তু না। স্মৃতি তার সাথে বেইমানী করছে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পর্দা সরিয়ে দিয়ে ডাইনিং এ গিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এখন বৃষ্টি নেই। প্রকৃতির মুখ ভার। ভালো লাগে না তার। লঘু পায়ে সে ঘরে ঢুকে ওয়ার্ডরোব খুলে শাড়ি বের করতে করতে ভাবছে কোন শাড়ি পরবে। কতো শাড়ি কিনেছে, পরা হয়নি। অবহেলায় পড়ে আছে সেসব। আকাশ রঙ চিরদিন তার প্রিয়। হাতে নিয়েও আবার রেখে সাদা খোলের শাড়ি বেছে ময়ুরকণ্ঠি রঙের ব্লাউজ নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। 
তাকিয়ে দেখে কানের দুপাশে রূপোলী চুলের ঝিলিক। ময়ূখ চৌধুরীর সেই কবিতার লাইন মনে পড়ে যায়- "এখন আয়না দেখার সমস্ত যোগ্যতাই তুমি হারিয়েছো"। বিশাখা চিরুণী হাতে তার বয়সের সিঁড়ি ভাঙছে। 
আঠারোতে এসে থমকে যায়। বিদ্যুৎ গতিতে একটি কিশোরের আবছা মুখের ছবি তার স্মৃতির ডালপালা নাড়িয়ে ঝুরঝুর করে ফুল হয়ে ঝরতে ঝরতে মনে পড়লো "অয়ন "। আশ্চর্য সকাল থেকে এতো কষ্ট করেও নামটা তার মনে করতে পারেনি। আঠারোতে সে এসেই চলে গেছে।শহরতলীর সেই বাড়িতে তাদের দু'বাড়ি পরেই থাকতো। তখন থেকেই ঠিক এমন কপাল জুড়ে অবাধ্য চুল বাম হাতে সরানো এখনো একই ভঙ্গিতে আজও রয়ে গেছে। সেই বাড়ির রাস্তার দুপাশ জুড়ে ছিল কৃষ্ণচূড়ার সারি। রোজ স্কুলে যাওয়ার পথে দুজনের দেখা হতো। অয়ন কপালের চুল সরাতে সরাতে তাকিয়ে দেখতো বিশাখার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি। একবার ফাজিল অতনু ওদের দেখে গান গেয়ে ওঠে "দুজনে দেখা হলো মধুযামিনীতে-
কোন কথা কহিল না, চলিয়া গেল ধীরে।"
ওরা দুজন ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি নিজ নিজ পথে চলে যায়। তারপর আর কোনদিন ওদের দেখা হয়নি। পরে শুনেছে ওরা এখান থেকে চলে গেছে। ওর বাবার বদলীর চাকরি। বিশাখার মন খারাপ হয় বহুদিন। আবার একসময় ভাটিতে বিলীন হয়ে যায় সে মুখ। এতো বছর পর আবার ফিরে এলো এভাবে । আসলে কিছুই হয়তো মুছে যায় না মন থেকে। কতো তাড়াতাড়ি জীবন ফুরিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে সে শাড়িতে আয়নার দিকে তাকায়। খোলা চুল, নীল টিপ ঠোঁটে আলতো লিপস্টিকের ছোঁয়া। মনে মনে সে নিজেকে বলে এখনও ফুরায়নি বেলা।
মেইন গেট বন্ধ করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
আবার বৃষ্টি এলো। বিশাখা বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটছে। অনেকদিন পর সে এভাবে ভিজতে ভিজতে গান গেয়ে ওঠে "দুজনে দেখা হলো--







এক বিধবা নারীর জীবন

গৌ রী  স র্ব বি দ‍্যা


খুব ভোরে এসে সিন্ধুর দরজায় কড়া নাড়ে ডাক্তারবাবু। যেন কেউ টের না পায় তাই খুব আস্তে আস্তে শান্ত গলায় বলে সিন্ধু শুনছিস? আমি.... দরজা খোল। সিন্ধু তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে দরজা খুলে বলে, দাদা তুমি? এখানে কি করছো? ঠাকুরাণী দেখলে কেলেঙ্কারি হবে যে।
ডাক্তারবাবু পেছন থেকে সব্জির থলেটা হাতে দিয়ে বলে এখানে কিছু সব্জি আছে রান্না করে খেয়ে নিস। সিন্ধু তাড়াতাড়ি সব্জি ঢেলে থলেটা হাতে দিয়ে বলে এবার এসো দাদা।

ডাক্তারবাবুর খুব কষ্ট হয় ছোট বোনটাকে নিয়ে। ছোটবেলায় বিয়ে দিয়েছে, তারমধ্যে বার বছরের সংসারে স্বামী মারা যায়।এমন একটা রোগ (কুষ্ঠরোগ) যে রোগের কোন  চিকিৎসা ছিলো না তখন। সবাই সেটাকে ছোঁয়াছে বলে কেউ গায়ের কাছেও যেতো না!
ডাক্তার হয়ে বড়ভাই অনেক চেষ্টা করেছিলো ছোটবোনের স্বামীকে বাঁচাতে। সেরকম কোন ওষুধপত্র ছিলো না বলে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। সিন্ধু অনেক সেবা করেও স্বামীকে বাঁচাতে পারেনি।

নিঃসন্তান ছিল বলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন সিন্ধুকে তেমন ভালো চোখে দেখতেন না। বিধবা নিঃসন্তান নারীকে সমাজের  নারী পুরুষ কেউই ভালো চোখে দেখে না। কোন উপায়ান্তর না দেখে তাঁকে বাবার বাড়ি চলে যেতে  হয়।

ছোট বয়সে বিধবা তাই জীবনের সব সুখ আল্লাদ বিসর্জন দিয়ে কোনরকম বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয়েছিলো সিন্ধুর। স্বামীহারা, নিঃসন্তান বলে বাবার বাড়ির উঠোনের এক কোণে ঘর হয়েছিলো তাঁর। সরকারী ডাক্তার ছিলেন বলে ডাক্তারবাবুর এক বছর পর পর বদলি হতে হতো এক জেলা থেকে অন‍্য জেলায়। তাই বোনের দায়িত্ব পড়েছিলো ছোটভাইয়ের ওপর। 

গলায় কাঁটা লাগলে কাঁটা নামানোর মন্ত্র জানতো সিন্ধু যার কারণে  সবার কাছে এক নতুন পরিচিতি পেয়েছিল। কারো গলায় কাঁটা লাগলে সবাই ছুটে যেতো সিন্ধুর কাছে। সবাইকে গল্পে, আড্ডায় মাতিয়ে রাখত সারাক্ষণ। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে  বিবাহিত জীবনের ইতি টেনে সেই জীবনকে মেনে নিয়ে চলছিল বছরের পর বছর।

সুন্দরী হবার পরও অন‍্য কোন স্বামীর ঘর করতে পারেনি সিন্ধু কারণ সমাজের বিধিনিষেধ ছিলো।
সিন্ধুর দুঃখ কষ্টের সেই জীবন এসে থামে বিরাশি বছর বয়সে। একজন নারী বলে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন‍্য তাকে এতোবছর একা কাটাতে হয়েছিলো সমাজের কথা চিন্তা করে অথচ সমাজ চাইলে তাঁকে একটা সুন্দর জীবন দান করতে পারতো।






এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়

অ সী ম  পা ঠ ক 


রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল। নববর্ষের উন্মাদনা গঙ্গার ঘাটে। মা গতকাল সন্ধ্যায় অরিন্দমকে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, নবর্ষের সকালে গঙ্গাস্নান করে দক্ষিনেশ্বরে পূজো দিয়ে আসতে। রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র অরিন্দমের লক্ষ্য একজন ভালো ল'ইয়ার  হওয়া। তার বাবাও কোলকাতা হাইকোর্টের নাম করা উকীল। বাবা মা দুজনেই ধর্ম আর ঐতিহ্যর পরম্পরাকে গভীর বিশ্বাসে সযত্নে লালন পালন করেন।
বাবুঘাটে গঙ্গা স্নান সেরেই একটা চলন্ত এ সি  বাসে উঠে পড়লো। বাবা অবশ্য বলেছিলেন গাড়ি নিয়ে বেরুতে, কিন্তু না অরিন্দম সহজ সরল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। তাই বলেছিলো  বাপী আমি বাসেই যাবো। বাসে ট্রাভেলটা বেশ এনজয় করে অরিন্দম। বাসে উঠে টিকিট কাটতেই মাঝ বরাবর একটা সিট পেয়ে গেলো সে। পাশেই ট্যাবে মুখ রেখে একটি মেয়ে টাইপ করে চলেছে নিঃশব্দে। অরিন্দম আড়চোখে দেখে নেয় একবার, ফর্সা, সুশ্রী, কপালে তোলা সানগ্লাস, প্রসাধনের চিহ্ন মাত্র নেই। হাতে গোলাপি রিস্টওয়াচ। সাদার উপরে ছোট ছোট জুঁই ফুল কালো রঙে আঁকা একটা  টপ আর ডেনিম জিন্স...  অরিন্দম যেনো চোখ ফেরাতে পারে না। মনের অবচেতনে যেনো এরই ছবি আঁকা... বাবুঘাট থেকে দক্ষিনেশ্বর  পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। বাসে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে, এসো হে বৈশাখ .... অরিন্দম অস্থির হয়ে ওঠে, মেয়েটার দিকে বারবার চোখ যায়। একসময় মেয়েটি বলে ওঠে, এই যে হ্যালো মিষ্টার, কি এতো দেখছেন? অরিন্দম আমতা আমতা করে- না মানে... সাদা শার্টে অরিন্দম কে বেশ আ্যাট্রাক্টিভ লাগে। কালো সানগ্লাসের আড়ালে দুটো উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। হাতে মা কালীর পুজোর জন্য ফুল ফলে ভর্তি একটা প্যাকেট, আর একটা ব্যাগে  বাবুঘাটে স্নান করা তোয়ালেটা রাখা। মেয়েটি ইতিমধ্যে ট্যাবটাকে তার সাইডব্যাগে রেখে  অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বলে, 'আমি ময়না  আপনি?' অরিন্দম দেরী না করে উত্তর দেয়- 'আমি অরিন্দম মুখার্জি, ল নিয়ে পড়াশোনা করছি। ফাইনাল ইয়ার চলছে।' ময়না বলে যে সে একটি নিউজ চ্যানেলের জন্য সাংবাদিকের কাজ করে। বালিতে থাকে। বাবা ডাক্তার, মা নেই, এক ভাই। এভাবেই পরিচয় পর্ব শেষ হয়। ভালো লাগে অরিন্দমের  ময়নার প্রতিটি কথা।  ফাইবারে মোড়া জানালার পাশ থেকে কল্লোলিনী তিলোত্তমাকে কি অপরূপ লাগে অরিন্দমের। একসময় ময়না বলে ওঠে চুপিচুপি, আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ চুনী উঠলো রাঙা হয়ে। অরিন্দম গলা মেলায়, 'আমি গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর,সুন্দর হলো সে।'  ময়না তাকিয়ে থাকে অরিন্দমের দিকে, যেনো বড্ড চেনা। ভালোলাগার আবেশ। অরিন্দমের ও মনে হয়, আচ্ছা কোথাও কি সে ময়নাকে দেখেছে? ব্যস্ততম নগরীর কোনো নির্জন সন্ধ্যায় অথবা শপিং মলে  নয়তো বা  কোথায় নয়। সব ভ্রান্তি। কিন্তু তা কি করে হয়... স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সব দু'জনের আলাদা। কথায় কথায় বেরিয়ে আসে দু'জনে অনেক সাংস্কৃতিক মঞ্চে আবৃত্তি করেছে কিন্তু কেউ কাউকে দেখেনি, অথচ... হঠাৎ ময়না বলে ওঠে, 'আচ্ছা আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই?' ততক্ষণে দুজনেই আপনি থেকে তুমিতে এসেছে।  অরিন্দম ময়না দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে  "জন্মান্তর।" তারপর হাসি হাসি মুখে একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে।  হঠাৎই অরিন্দমের স্মার্টফোনটা বেজে ওঠে। মা কালীর পূজার জন্য ফুল ফল মিষ্টির প্যাকেটটা  ময়নার কোলে বসিয়ে  ফোনটা ধরে। কথা শেষ করে ময়নার নাম্বার নিয়ে একটা মিস কল করে, বলে সেভ করে নাও। ময়না বলে, 'হ্যাঁ মিষ্টার অরিন্দম মুখার্জি, আমি নাড়ুগোপাল বলে সেভ করলাম। ঐ নামটা তোমাকেই মানায়। আর তুমি আমার নাম ময়না শুনেছো, এতোই মশগুল যে পুরোটা জানতে চাওনি। তা কি নামে সেভ করলে শুনি?' অরিন্দম হাসতে হাসতে বলে, 'পেত্নী।' আর পাঁচ মিনিট, তারপর দুজনেই নামবে। নামার আগেরটাতে ময়না বলে আমার পুরো নাম  ময়না খাতুন। অরিন্দমের মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। অপলক তাকিয়ে সে। ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি নিয়ে ময়না বলে কি হলো, তোমার পুজোর জিনিস কি অশুদ্ধ হয়ে গেলো? অরিন্দম বলে, না আরও পরিশুদ্ধ হলো। অবেশষে ক্ষনিকের  যাত্রা পথ শেষ হয়। ঘড়ির কাঁটাটা যেনো দ্রুত ঘুরতে থাকে। নিরলস গতিতে সময় পেরিয়ে যায়। দুজনেই নেমে পড়ে।
অরিন্দম বলে, 'একটা কথা বলবো, রাখবে?' ময়না বলে, 'অবশ্যই, বলো।' অরিন্দম বলে চলে, 'না আজ নববর্ষের দিন, একসাথে মায়ের মন্দিরে পূজো দিই।' ময়না বলে, 'হ্যাঁ চলো। আমাদের পবিত্র রমজান মাস, রোজা চলছে।' মন্দির চত্বরে গিয়ে ময়না বলে, 'আচ্ছা তোমাকে যদি বলি কখনও আমাদের মসজিদে আসতে, আসবে?' অরিন্দম বলে, 'কেনো আসবো না। আমার হবু বৌ এর জন্য তো এটুকু করাই যায়।' ময়না চমকে ওঠে বলে, 'এও কি সম্ভব?' অরিন্দম বলে, 'সময় সব কথা বলবে। মন্দির আর  মসজিদ সব জায়গাতেই শুধু  ভালোবাসার বিকাশ। কি মাঝরাত  কি দুপুর দুটো  কি শীত কি বৃষ্টি আমি শুধু ভালোবাসা বুঝি।
ভালোবাসি।' ময়না সুর মেলায়  'ভালোবাসি  ভালোবাসি ....'  পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ যেনো ভালোবাসার সুনামি তে ঢেকে দিলো দুটি তরুণ প্রানকে। অসম্ভব সম্ভবের চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভালোবাসার স্বপ্নালু চেতনার দেশে  আমন্ত্রণ জানায় যেনো। আলোয় আলোময় হৃদয়ের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ। তাদের মনের গহন গভীরে প্রেমের আশাবরী যেনো শান্ত সাধনার সুর তুলেছে।
 দক্ষিনেশ্বর মন্দির চত্বরে এই মুহূর্তে এক অপার্থিব পবিত্রতা স্নিগ্ধতা... বৈশাখের প্রথম দিনেই  দীর্ঘ পথ চলার বার্তা। মানবতার অমল আলোয় প্রেমের পূজারী দুটি  সবুজ প্রান  তখনো মনের আনন্দ আবৃত্তি করে চলেছে রবি ঠাকুরের কবিতা ,,,, 
'পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দু'জন চলতি হাওয়ার পন্থী।।'






গল্প নয়, সত্যি ঘটনা

বি ধা ন  ঘো ষ


যখন তুরা এসে পৌঁছলাম প্রায় দুপুর ছুঁই ছুঁই। হেড কোয়ার্টারে কিছু দরকারি 'পেপার্স' ডেলিভারি করে আবার সটান আমার কর্মস্থল চিচিংপাড়া রিটার্ন- এই ছিলো আমার প্রোগ্রাম। পাঠকদের অবগতির জন্যে বলি, আজকে যারা ওয়েস্ট গারো হিলস্-এ অবস্থিত মেঘালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই তুরা শহরকে চেনেন তার সাথে আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে আমার দেখা তুরা শহরের বিন্দুমাত্র কোনো মিল ছিলো না। মেরেকেটে পনেরো কুড়ি হাজারের বেশি লোক বাস করতো না। না ছিলো কোনো ভালো হোটেল, না বাজার। যাইহোক ওসব অন্য প্রসঙ্গ। আমি বরং আমার ঘটনাটা বর্ণনা করি। কাজ তো তাড়াতাড়িই মিটে গেলো, এবার ফেরার পালা। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখলাম আমার গন্তব্য স্থানে যাওয়ার বাস ছাড়তে প্রায় ঘন্টাখানেক দেরি। সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। খিদেও পেয়েছিল  জব্বর! কতদিন মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাইনি! বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া একটা সস্তার হোটেলে পেটপুরে খেয়ে নিলাম। তারপর ধীরে ধীরে গিয়ে আমার নির্ধারিত বাসে আরাম করে একটা আসন গ্ৰহণ করলাম। কিন্তু বাসের ভিতরকার পরিবেশটা একদম ভালো লাগলো না। একেতো গরম, তার ওপর গারো আদিবাসী লোকজন ছাগল, মুরগি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ‍্যে বাসটিকে পুরো ভর্তি করে ফেললো। চট করে মাথায় একটা আইডিয়া এসে গেলো---- বাসের ছাদে গেলে কেমন হয়! যেমনি ভাবা তেমনি কাজ! বাসের ছাদে চড়ে ভ্রমণ আমার কাছে কোনো ব‍্যাপার ছিল না তখন, বহুবার করেছি। তাছাড়া ভাবলাম পাহাড়ি রাস্তায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বাসভ্রমণ, এমন সুযোগ আর পাবো নাকি! যাইহোক কিছুক্ষণের মধ্যে বাসের চাকা গড়াতে শুরু করলো,  তখন সময় দুপুর আড়াইটে।

 দেখতে দেখতে তুরা শহর পার হয়ে গেলাম। যেদিকে তাকাই শুধু অন্তহীন সবুজের সমারোহ। চোখ জুড়িয়ে যায়। বাসের ছাদে আমি একা একা বসে প্রাণভরে প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্যকে দুচোখ ভরে উপভোগ করে চলেছি। কিন্তু সে উপভোগ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। হঠাৎ ভীষণ রকম চড়াই উৎরাই শুরু হলো, তার সঙ্গে মুহূর্তে মুহূর্তে তীব্র বাঁক। নীচের দিকে তাকালেই হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার জোগাড়,  গভীর খাত! মনে হয় এইবুঝি ছিটকে পড়লাম নীচে,  আমার এতদিনের বাসের ছাদে চড়ে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা কোনো কাজে আসলো না। ভীষণ গা গোলাতে লাগলো। দুপুরে যা কিছু খেয়েছিলাম সবকিছুই বার হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো! নিজের বোকামির জন্যে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করলো। যাহোক কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর নিজেকে আবার সামলে নিলাম। অবশেষে বাস পাহাড়ি এলাকা পার করে সমতল ভূখণ্ডে প্রবেশ করলো। কিছক্ষণের মধ্যে বারিঙ্গাপাড়ায় এসে বাস থামলো। তখন ঘড়ির কাঁটা বলছে বিকেল পাঁচটা।

তুরা থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা আসতে সময় লাগলো প্রায় আড়াই ঘন্টা। পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ি, সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। বারিঙ্গাপাড়া জায়গাটা একদম পাহাড় যেখানে শেষ হয়ে সমতলভূমি শুরু হয়েছে, ঠিক সেখানেই। অদ্ভুত সুন্দর এবং শান্ত জায়গা। স্টেট ব‍্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটা শাখা আছে, যেখানে আমাদের মাঝেসাঝে আসতে হয়। এখান থেকে সোজা দখিনমুখো রাস্তা চলে গেছে একদম বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত। সীমন্তের ওপারে বাংলাদেশের সিলেট জেলা। আর এপারে ভোগাই নদীর তীরে অবস্থিত ছবির মতো জনপদ ডালু। না আসলে কোনোদিনই জানতে পারতাম না এইরকম পরিবেশে একটা বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাসভূমি আছে। কিছুদিন ডালুতে থাকার সুবাদে এলাকাটা ঘুরে দেখার এবং এলাকার মানুষজনের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলাম। এখানে মেঘালয় বোর্ডের অধীনে একটা সম্পূর্ণ বাংলা মিডিয়াম হাইস্কুল আছে। এছাড়া একটা শিবমন্দির ও একটা রামকৃষ্ণ আশ্রমের শাখা রয়েছে। ডালু থেকে দু'কিলোমিটার আগে কিলাপাড়া বিওপি। যেখানে রয়েছে একটা 'ওয়ার মেমোরিয়াল'। ১৯৭১ সালের ২৪ মে পাক হানাদারদের অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হন ন'জন ভারতীয় জওয়ান। প্রতিদিন সূর্য ডোবার পূর্বে শহীদ জওয়ানদের শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং জাতীয় পতাকা নামানো হয়। অনেকটা পাঞ্জাবের ওয়াগা সীমান্তের মতো। আমার সৌভাগ্য, এখানে কিছুদিন ডিউটি করতে পেরেছিলাম।

ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। আসলে পুরোনো স্মৃতিগুলো আমাকে উসকে দিচ্ছে গল্প বলার জন্য। যাইহোক আমার গন্তব্যস্থল ডালু নয়, চিচিংপাড়া। বারিঙ্গাপাড়া থেকে ইউটার্ন নিয়ে সোজা উত্তর-পশ্চিম দিকে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেটাই পৌঁছে গেছে চিচিংপাড়া, প্রায় দশ কিলোমিটার রাস্তা হবে।  একদম বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা রাস্তা। রাস্তা বললে ভুল হবে। পীচের কোনো নামগন্ধ নেই, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নুড়ি বিছানো পথ। পথের মধ্যে পড়বে অসংখ্য নালা। বাসের যাত্রীরা প্রায় সবই নেমে গেছে। ফাঁকা বাস বললেই হয়। আমি নীচে নেমে এসে বাসের ভিতর বসলাম। বাস চলতে শুরু করলো। জানলা দিয়ে বাঁ দিকে তাকালাম। দূর দিগন্তে সূয‍্যিমামা পাহাড়ের আড়ালে ডুব দেবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে। বাস ধীরে ধীরে সমতলভূমি ছেড়ে আবার পাহাড়ি  রাস্তায় চলতে শুরু করলো। জঙ্গলও গভীর থেকে গভীরতর হতে শুরু হলো। ফাঁকা বাস এবরো খেবরো রাস্তায় চলার সময় যেটা ঘটে, বাসের প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে বসে থাকাই দায় হলো। এইভাবেই বেশ কিছুক্ষণ বাস চললো। সম্ভবত তিন চার কিলোমিটার রাস্তা পার করে এসেছি, তখনই বিপত্তিটা ঘটলো, যার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভয়ংকর শব্দে সারা জঙ্গল কেঁপে উঠলো। ভীষণ চমকে উঠলাম। বাস কাঁপতে কাঁপতে পথের একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। বাসের পিছনের চাকার টায়ার ফেটে গেছে! কি হবে এখন! বাস থেকে নেমে পড়লাম। ড্রাইভার-কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম। কোনো আশার বাণী শুনতে পেলাম না। বাসে নাকি কোনো 'স্টেপনি' নেই ! সকাল নাহলে কোনো সুরাহা হবে না। ইতিমধ্যে যে দু-একজন আমার সহযাত্রী ছিলো কখন অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে টেরই পেলাম না! দেরি করার কোনো সময় ছিলো না। সামনে প্রায় পাঁচ ছয় কিলোমিটার রাস্তা, তারপর আমার গন্তব্য স্থল। পুরো রাস্তা পাহাড় আর জঙ্গলময়। এখন সিদ্ধান্ত আমার, হয় এদের সাথেই বাসে রাত কাটাও নাহয় বাকি রাস্তাটা ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাও! মোবাইলের যুগে পদার্পণ করতে তখন অনেক দেরি। কাউকে আমার খবরটা পৌঁছে দেবো, সে গুড়েও বালি। 

একটু ভেবে দ্বিতীয় রাস্তাটাই বেছে নিলাম। যা লেখা আছে কপালে হবে ক্ষণ। হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে বরাবরই ভালোবাসি। কিন্তু আজকের হাঁটাটার সাথে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ রয়েছে, জ‍্যোৎস্না রাত। কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলাম । অন্তত পথ চলতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অসুবিধাটা অন্য জায়গায়। এলাকায় বেশ কিছুদিন ডিউটি করার ফলে জঙ্গলে জংলী জানোয়ারের উপস্থিতির কথা আমার কাছে অজানা নয়। বুনো শূয়োর, হরিণের সাথে দু-একবার সাক্ষাৎ ও হয়েছে ডিউটি চলাকালীন। ভয় ওদেরকে নিয়ে নয়। এলাকায় যে মাঝেসাঝে বুনো হাতির দল নেমে আসে পাহাড় থেকে! ভালুকের উপস্থিতির কথাও টের পাওয়া যায় কখনোসখনো! আমার বাল‍্যকাল কেটেছে একটা বেপরোয়া লাইফস্টাইল এর মধ্যে দিয়ে। রাতের অন্ধকারে বিলে মাছ ধরার জন্য নল পাততে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে রাতের বেলায় খেজুরের রস চুরি করে খাওয়া কিংবা জেলেদের নৌকা খুলে রাতের অন্ধকারে জলঙ্গী পার হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ওপারে আখ চুরি করতে যাওয়া-- এর প্রভাবেই হয়তো ভয়ডর অতটা কোনোদিনই তেমন ছিলো না। আ্যডভেঞ্চার বরাবরই আমাকে আকর্ষণ করে। একটু বড়ো হয়ে যবে থেকে বই পড়া শুরু করেছি, প্রিয় বই-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে বিভূতিভূষণ এর 'আরণ‍্যক', বুদ্ধদেব গুহের 'কোয়েলের কাছে' কিংবা জিম করবেটের ' Man eaters of Kumayun '.
বেশ কিছুটা পথ চলার পর ভয়টা অনেকটা দূর হলো । রাতের অন্ধকারে চোখ দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু কান দুটো তো রয়েছে, একটা পাগলের মতো প্রকৃতিপ্রেমী হৃদয় তো রয়েছে! জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে অসংখ্য পতঙ্গের বিচিত্র আওয়াজ। মাঝেমধ্যে অজানা নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর বনমোরগের ডাক। একবার কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম! এই নির্জন জঙ্গলে কুকুরের ডাক কোথা থেকে আসবে! এখানে তো আশেপাশে কোনো বস্তি নেই! আসলে ওটা 'বার্কিং ডিয়ার' এর ডাক! ওদের চিৎকারকে সময় সময় কুকুরের ডাক বলে ভুল হয়। এর আগেও শুনেছি। জানা ছিলো না বুনো ফুলের সুগন্ধ পরিবেশকে এইভাবে মাতোয়ারা করে দিতে পারে! আমার মন বলছে আমার জন্যে আরও অনেক বিষ্ময় অপেক্ষা করছে!

ইতিমধ্যে উল্টো দিক থেকে একটা খালি ট্রাক আসতে দেখলাম। কিন্তু আমার উপস্থিতি ভ্রুক্ষেপ না করেই পাশ দিয়ে চলে গেল। এই রাস্তায় দিনের বেলা বহুবার যাতায়াত করেছি, অবশ্যই গাড়ি করে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছি নে--- কতদূর এসে পৌঁছলাম, আর কত রাস্তাই বা বাকি! এক একটা চড়াই-উৎরাই পার হচ্ছি আর মনে হচ্ছে এইবুঝি এসে গেছি। হঠাৎ মনে ভয় ঢুকে গেলো-- অন্ধকারের মধ্যে রাস্তা ভুল করে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়লাম নাতো! তখন সীমান্তে কাঁটাতারের  কোনো বেড়া তৈরী হয়নি। বর্ডার লাইন রোড বলেও কিছু ছিলো না। ভাবতেই আতঙ্ক গ্ৰাস করলো। ঠিক তখনই সামনে চেনা একটা নালার দেখা পেলাম। প্রায় প্রতিদিন সকালে পিটি করার সময় এই নালা পর্যন্ত দৌড়াতে আসি। যাক রাস্তা ভুল হয়নি। এখান থেকে ক‍্যাম্প আর মাত্র তিন কিলোমিটার রাস্তা!

নালাটার কাছে জঙ্গল অনেকটা পরিস্কার। চাঁদের আলোয় অনেক দূর পর্যন্ত নজর যায়। নালার জলে চাঁদের আলো পড়ে চিকমিক করছে। উপযুক্ত পরিবেশ ও সময়- জংলী জানোয়ারদের জন্য জলপান করতে আসার। নালা পার হবার আগে দাঁড়িয়ে গেলাম চারপাশটা একটু ভালো করে দেখে নেবার জন্যে। পরিবেশটা কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকালো। ভীষণ রকম স্তব্ধ, একদম শুনশান। নাকে কেমন একটা বটকা বটকা গন্ধ প্রবেশ করলো। প্রমাদ গুণলাম। আশেপাশে অবশ্যই কোনো জংলী জানোয়ারের উপস্থিতি আছে। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় আমাকে নালা পার হতে নিষেধ করলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। দৃষ্টি নিবদ্ধ নালাটার অপর পারে। হঠাৎ কি যেন নড়াচড়া করে উঠলো। আমি সাবধান হয়ে গেলাম। একটু পিছিয়ে এসে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম। যা দেখলাম নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। একটা পূর্ণ বয়স্ক ভালুক! আমি নিশ্চিত ও আমাকে অনেক আগেই দেখেছে। অপেক্ষা করছিলো কখন নালাটা পার হবো, ওর কাছাকাছি যাবো। সেটা না হতে বার হয়ে এসেছে ঝোপ থেকে। এবার আমার কি করা উচিৎ? গাছে উঠে পড়বো, নাকি মরা মানুষের ভান করে শুয়ে পড়বো! কোনোটাই করলাম না। চুপচাপ স্থানু হয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ওপার থেকে ও আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে। যেন শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ভালো করে সবকিছু যাচাই করে নিচ্ছে! আমার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। জানি না কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সম্বিত ফিরলো হঠাৎ একটা আলোর ছটায়। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের গা বেয়ে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে। মরীয়া হয়ে রাস্তার মাঝে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। যে কোনো মূল্যে গাড়িটাকে দাঁড় করাতেই হবে! গাড়ির চালক সম্ভবত আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলো। দাঁড়িয়ে পড়লো। গায়ে ইউনিফর্ম দেখে সম্ভবত বুঝতে পেরে গিয়েছিল কোন ডিপার্টমেন্টের লোক। আমিও গাড়ি দাঁড়াতেই বুঝতে পারলাম ওটা GRREF (General Group Reserve Engineering Force)- এর গাড়ি। আমাকে তুলে নিলো গাড়িতে। সামনের দিকে তাকালাম, কিন্তু সেই মূর্তিমান বিভীষিকাকে আর দেখতে পেলাম না।  ড্রাইভারকে বললাম ওর কথা। একদম অবাক হলেন না। এইরকম অভিজ্ঞতা ওনার আগেও নাকি বেশ কয়েকবার হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমার গন্তব‍্যস্থলে, চিচিংপাড়াতে। গাড়ি থেকে নেমে অজানা বন্ধুকে ধন্যবাদ ও শুভরাত্রির শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি ক‍্যাম্পের দিকে পা বাড়ালাম।

আমাদের ক‍্যাম্পটা একটা পাহাড়ের মাথায়। পাকদন্ডি বেয়ে উপরে উঠলাম। গাছতলায় বাঁধা আছে "রাণী', আমাদের প্রিয় ঘোড়ী (ক‍্যাম্পের যাবতীয় পানীয় জল রাণীই পিঠে করে নীচের চশমা থেকে বয়ে আনে)। জড়িয়ে ধরে আদর করলাম। সেন্ত্রী ডিউটিতে যে জওয়ান ছিলো এগিয়ে আসলো। দেরী হবার কারণ জিজ্ঞেস করলো। কিছু না বলে সোজা CHM এর কাছে report করলাম। কিছুক্ষণ পর Company Commander তলব করলেন। উনি সর্দারজী ছিলেন, যশওয়ান্ত সিং। যেকোন কারণেই হোক আমাকে খুব স্নেহ করতেন । সব শুনলেন। প্রচণ্ড বকাঝকা করলেন, বললেন যদি তোকে ভালুকে খেয়ে নিতো কিংবা বিডিআর এর লোকজন যদি উঠিয়ে নিয়ে যেতো তো কি করতিস! আমার উচিৎ ছিল আমাদের কোম্পানির অন্য বিওপি চন্দ্রকোনাতে গিয়ে রিপোর্ট করা, যেটা আমার আসার রাস্তার মাঝেই পড়ে। আমি দোষ স্বীকার করে নিলাম। স‍্যালুট জানিয়ে সাহেবের কামরা থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ব‍্যারাকে আসলাম। নাইট ডিউটি ছিলো না। খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমোতে গেলাম, কিন্তু সারারাত চোখের পাতা একজায়গায় করতে পারলাম না।

সকালে পিটি ছিল যথারীতি। যে রাস্তা দিয়ে রাতে ফিরেছিলাম ওই রাস্তা দিয়েই দৌড়াতে যাচ্ছি। সঙ্গে আরো অনেক জওয়ান ছিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর স্থানীয় মানুষের একটা জটলা দেখলাম। যেটা শুনলাম, গত রাতে কোনো জংলী জানোয়ার বস্তীর একটা গোয়ালঘর থেকে গরুর বাছুর তুলে নিয়ে গিয়েছিল । (বস্তি বলতে এখানে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু কুঁড়ে ঘরকে বোঝায়। রাতের বেলা এরা সবাই গাছের উপরে মাচা বাড়িতে বাস করে, জংলী জানোয়ারের আক্রমণের ভয়ে) বাছুরটার অর্ধভুক্ত দেহ রাস্তার ধারে ঝোপের মধ‍্যে সকালবেলা পাওয়া গেছে। থেমে গেলাম । কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ঝোপের মধ‍্যে উ়ঁকি দিলাম। কোনো বাছুর দেখতে পেলাম না। দেখলাম এক অর্ধভুক্ত জওয়ানের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে বিস্ফারিত চোখে!!

পুনশ্চঃ : যে সকল পাঠকদের ধৈর্য্য কম, পুরো গল্পটা পড়া সত্যিই কষ্টকর, তাদের জন্য গল্পের সারসংক্ষেপ-
-----একদা তুরা থেকে আমার কর্মক্ষেত্র চিচিংপাড়া প্রত‍্যাবর্তনের পথে আমি জঙ্গলের ভিতর এক ভালুকের দর্শন পাইয়াছিলাম !







বউ কথা কও

তু লি মু খা র্জি চ ক্র ব র্তী


ইটভাঁটার শ্রমিক বাবলুর একমাত্র মেয়ে সোনি। বাবা মায়ের সঙ্গে কাঁসাই নদীর ধারে গ্রামে তাদের বাড়ি। গাছপালা, ফুল, পাখি আর বয়ে চলা নদীর জল তার খুব ভালো বন্ধু। আর তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল পাশের গ্রামের নবীন। এক স্কুলে পড়তো ওরা। বাড়ি ফেরার সময় একসাথেই। বিকেলে দুই গ্রামের সীমানার মাঠে খেলাধূলা আরও অনেক বন্ধুর সাথে। ধীরে ধীরে ওরা বড় হতে লাগলো এবং ঝগড়া, মারপিট, খেলাধূলো সব নিয়েই ভালোবাসার রং লাগলো দুজনের মনেই। 

একদিন ঝগড়া হতে সোনি আর নবীনের সাথে কথা বলে না। তখন নবীন সোনি কে বললো 'বিয়ের পর যদি এমন কথা না বলিস তো আমি তখন বলবো ও বউ কথা কও না আমার সাথে, এই বউ কথা কও।' এই শুনে ফিক করে হেসে ফেলে সোনি। আবার ভাব হয়ে যায় ওদের। 

দিন মাস বছর যেতে যেতে সোনি নবীনের বউ হয়ে চলে যায় ভিনরাজ্যে। নবীন পরিযায়ী শ্রমিক। পিছনে ফেলে আসে তার প্রাণের সখ্যতা গ্রামের ইটভাঁটা, নদীর জল, ফুল, পাখি আর স্কুলের চেনা রাস্তা। পড়ে থাকে মাটির বাড়ি, বাবা, মা আর চেনা সব। 

গণ্ডি কাটা নতুন জীবন, নতুন জায়গা, অচেনা মানুষের সাথে। নবীন চলে যায় কাজে সকালে। ফেরে সেই সন্ধ্যায়। সারাদিন একা থেকে প্রাণ চঞ্চল প্রজাপতি মুষড়ে যন্ত্রের মতো কাজ করে যায় আনাড়ি হাতে। ফুল পাখি গাছপালা নদী সব হারিয়ে মূক হয়ে গেছে সোনি। কিচ্ছু ভালো লাগে না তার এখানে। কাঠের উনুনে ভাত চাপিয়ে সে ছুটতে শুরু করে.... ছুট ছুট ছুট... এই তো তার চেনা নদী, গাছ... নাকে আসে পোড়া গন্ধ। নিমেষে সোনি ফিরে আসে। দ্যাখে ভাতের তলা ধরে গেছে। 

নবীন বুঝতে পারে তার সোনির কষ্ট। রাতে শুয়ে নতুন বৌ কে আদর করে জিজ্ঞেস করে, 'কি হয়েছে বউ? কথা কৈবি না আমার সাথে? বাবা মা র জন্য মন খারাপ?' নবীনের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদে সোনি।কিছু বলে না মুখ ফুটে। তখন সে বলে মাইনের টাকা পেলে তোকে বাড়ি নিয়ে যাবো। 
এই কথা শুনে আনন্দে জলভরা চোখে হাসি চিক চিক করে সোনির। এভাবেই কাটছিল দিন। 

কিন্তু সব তো ভালো হয় না সবার। সোনিরও সেই না ভালো সময় টা এলো সেদিন। মিস্ত্রির কাজে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফেরার কথা যার, ঠিকাদারের কাছ থেকে খবর এলো সে দূর্ঘটনায় আহত। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না নবীন কে। এই খবরে স্বামী সোহাগী সোনি এত আঘাত পায় যে একদম থম মেরে চুপ হয়ে যায়। বাবা মা এসে নিয়ে আসে গ্রামের বাড়িতে। একমাত্র মেয়ের এই অবস্থায় ভেঙে পড়ে বাবা মা। সোনি কিন্তু কাঁদে না, হাসে না, কথা বলে না, কেবল বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। 

দিন কয়েক পরে হঠাৎ একদিন সোনি শুনতে পায় কে যেন ডাকছে 'বউ কথা কও, বউ কথা কও'। একলাফে বেরিয়ে আসে সোনি... নবীন.... তার নবীন এসেছে ঐ তো। বলেছিল রাগ করে কথা না বললে বলবে সে এই কথা। সে জানতো তার নবীন তার কাছে ফিরে আসবেই। বাইরে বেরিয়ে দ্যাখে নিমগাছের ডালে বসে একটা পাখি তার দিকে তাকিয়ে বলেই চলেছে 'বউ কথা কও' 

চেঁচিয়ে ওঠে সোনি। ছুটে আসে বাবা মা। 'মা ঐ দ্যাখো নবীন, ও বলেছিল আমি কথা না বললে ও এই কথাই বলবে আমাকে, আমার রাগ ভাঙাতে।আমি জানতাম নবীন আসবেই।' 

মূক হয়ে যাওয়া বৌয়ের মুখে কথা ফুটায় ঐ পাখি। এখন সোনি অপেক্ষা করে রোজ ঐ পাখির জন্য। সে এসে ডাকলেই অনেক কথা বলে সোনি, হাসে আগের মতোই। বৌয়ের এত কষ্ট দেখেই সে বুকো টাকো পাখি হয়ে এখন রোজ এসে ডাকে 'বউ কথা কও'। বেঁচে থেকে যা বলেনি কখনো.....








মধুমাখা সোহাগ নদীর সাগরে

প্র দী প দে


নদী'র কথা আর কি বলবো? প্রবাহিত জীবনরেখা যার নিজস্বতায় ভরা তাকে দূর থেকে দেখাই ভালো। সান্নিধ্যের ইচ্ছে আমার মনকে এমনভাবে আক্রান্ত করে দিয়েছে তা আর ব্যাখ্যা করা আমার অনিচ্ছার কারণ। তবুও কোথা দিয়ে কি হয়ে যায় বুঝি না- মেঘ দেখেও ঘর ছাড়ি, কাঁটা থাকলেও গোলাপ ধরি, জোয়ারে সাঁতার দিই।

বিবাহিত জীবনযাপন করছিলাম অবলীলায়। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত, নিজের অধিকারে থাকা গৃহবধূর সঙ্গে বেশ ভালোই ছিলাম। সাত বছরের ছোট, ২৭ বছরের একেবারে গৃহনিপুণা আটপৌরে সুন্দরী, অবশ্যই বোকা আমার এই সঙ্গিনী। অর্থাভাবে ছিলাম ঠিকই কিন্তু শারীরিক অভাব আমদের কখ‌নো হয় নি, উপরন্তু তা এতই তীব্রতর ছিল যার ফলতঃ আমরা দুজনায় কোনদিন আলাদা থাকিনি। আক্ষেপের কারণ অন্য- ওর শরীরে ছিল এক অক্ষমতা আর তা হল ওর সন্তানধারনের।

ও আমাকে অনেকবারই হেসে বলেছে- আরো এক‌টিকে নিয়ে আসো!

আমি ওকে একেবারে জাপটে ধরে এমন যন্ত্রনা দিয়েছি যাতে ওর খুব ব্যথা হয় আর মুখের হাসি ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি- তারপর কি করবো ?

-অসভ্য! আমি শিখিয়ে দেবো?

অভাবহীন ভালোবাসা ভেসে গেল। আটবছরের বিবাহিত জীবনে নদী ঘরে ঢুকে পড়লো তার উৎফুল্ল জলরাশির সমারোহে- উজ্জয়িনীর মত একরাশ হাসিতে ভাসিয়ে দিল স্ত্রী মধু আর আমার, মানে সোহাগের জীবনযাপন।

মধু বলেছিল- নদী আমার মাসতুতো বোন হলেও আমার নিজের মায়ের পেটের মেয়ের মতোই।

আমি বলেছিলাম- ও কিন্তু অনেক লেখাপড়া জানে। আধুনিকা তবে তোমার মতো মধুমন্তী বা সুন্দরী নয়। অবশ্যই চাটুকে এক লোভাতুরা কামিনী বিহঙ্গী।

মধু হেসেছিল মজায়। আমিও মজায় ছিলাম। নদী-কে দেখে একটা লোভের শাখা আমার শরীরে তরতরিয়ে বাড়ছিল- নদী-তে অবগাহনের জন্য।

নদী বুঝে লোভ দেখালো- আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অথবা সব বুঝেও ওর প্রেমে, না দেহে মজে গেলাম। বাইরে থেকে শুরু হয়ে একেবারে ঘরে, ততোক্ষণে মধু কি বুঝলো জানি না, একদিন বোকা নারীর মতো সব ছেড়ে ওর পিতার আশ্রয়ে বিদায় নিল।

বাঁধা দেওয়ার ইচ্ছে আমাকে তেমনভাবে পীড়ন করলো না। অনাবশ্যক ভাবে নদী রয়ে গেল নিজেকে গুছাতে- সব গুছিয়ে নিয়ে নিল- যা আমি অনেক পরে বুঝেছি -তখন একেবারে এক জোয়ান যুবক সাগর তার বিরাট ঢেউ তুলে নদীকে গিলে নিল। নদী যেন তৈরি ছিল। অপেক্ষা তর সইলো না- যতটুকু মধু-র সঞ্চ‌িত লুকানো সম্পদ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমি অবাক হলাম এক‌টি অভাবী সংসারে এক বোকা মেয়ের কষ্টার্জিত লুকানো সম্পদের বহর দেখে আর অন্য এক চতুর কামিনীর আত্মসাতের চাতুরতা দেখে।

এরপর আর আমি দেরি করিনি আর সময় অপচয়ের চেষ্টা না করে দৌড়ে গেছি আমার বোকা বউটার কাছে। ভগবানের অপার করুণা আমার উপর, তাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পেলাম।

আমি লজ্জিত চোখে ওর চোখ রেখে বলেছি- মধু ভুল করে ফেলেছি- ফিরে চলো, তুমি কেন আমায় এই অযাচিত সাহস দিলে? জানো না পুরুষ মানুষের চরিত্রের অক্ষমতা?

মধু দৌড়ে এসেছে। আমি ওকে সজোরে জাপটে ধরেছি- ঠিক তেমন ভাবেই যাতে ও ব্যথা পায়- ঠিক যেমনটা আগে করতাম।

ও আমার জামা ওর অশ্রু দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আর অত্যন্ত বোকার মতোনই মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত দিয়ে আমার বুকে আঘাত করছিল আর বলছিল- মধু যে সোহাগেরই।

শুভম সমাপয়েৎ!






শুধু তোমারই জন্য

আ র তি ধ র


-জানিস অনু ,আজ আমার বসন্ত ঋতু নিয়ে লেখা কবিতাটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে? 

কলেজ থেকে ফিরে মায়ের এই কবিতার কথা শুনে ভীষণ রেগে যায় অনু। কাঁধের ব্যাগটা বারান্দায় রাখা বেঞ্চে নামিয়ে এগিয়ে আসে মায়ের দিকে। বলে- মা তোমার লজ্জা করে না এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এসে ন্যাকা- ন্যাকা প্রেমের কবিতা লিখতে, লেখার আগে অন্ততঃ এটা ভাবা উচিত যে তোমার এখন সে যৌবন কাল ফুরিয়ে গেছে আর তোমার একটা উঠতি বয়সের মেয়ে আছে, জানো তোমার কবিতা পড়ে বান্ধবীরা তো সবাই হেসেছে কিন্তু আজ অয়ন ও বলেছে, বুঝলে অনামিকা তোমার মা কিন্তু জিনিয়াস? 

-কি হয়েছে রে অনু, ভরদুপুরে মা মেয়ে কি শুরু করলি, চোখটা একটু লেগেছিল....? 

বিজন কথাগুলো বলতে বলতে বারান্দায় এসে দেখেন অদিতির চোখের জল গাল বেয়ে নেমে আসছে! 

বাবাকে দেখে কোনো কথা না বলে অনু ঢুকে যায় ঘরে। বিজন এসে হাত রাখেন অদিতির কাঁধে। অদিতির আরও জোরে কান্না পায়। 

-কি এমন হলো বলোতো, অনু তো এই সবে এলো এরমধ্যে কি বলেছো তুমি ওকে যে এভাবে রেগে উঠল? 

বিজন জিজ্ঞাসা করেন অদিতিকে।

অদিতির কষ্ট হয় বিজনের কথা শুনে। আশ্চর্য ও হয় সে! কারণ তার স্বামীর কেন মনে হলো যে অনুকে সেই কথা শুনিয়েছে! চোখের জল মুছে ঘরে ঢোকে অদিতি, টেবিল থেকে সংবাদ পত্র'টি নিয়ে তার লেখা কবিতার পৃষ্ঠা টি খুলে বিজনের হাতে তুলে দেয় সে। 

মাথা থেকে চশমা নামিয়ে নিজের স্ত্রীর নাম দেখে চমকে গিয়ে পড়তে থাকেন বিজন বাবু। পড়তে পড়তে মুখে এক চিলতে হাসির রেখা দেখতে পেয়ে খুশি হয় অদিতি। 

--তা লিখেছো তো ভালোই, আর এ নিয়ে সমস্যা কোথায় তাইতো বুঝতে পারছি না? 

প্রশ্ন করে বিজন তাকিয়ে থাকেন স্ত্রীর দিকে।

স্বামীর কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে অদিতি ভাবতে থাকে স্কুল জীবনের কথা। কবিতা লেখার নেশা তার ছোটবেলা থেকেই, তবে তখন শুধুই মজার ছড়া লিখত সে, দু তিন বার ছাপা হয়েছিল স্কুল ম্যাগাজিনে। তারপর আর সুযোগ পায় নি কখনো। এখন নানা জায়গায় লেখা পাঠানো যায় ঘরে বসেই তাই মাঝেমধ্যে লিখে পাঠিয়ে দেয় সে। ছাপা হলে বাড়িতে জানায়। বিজন খুশি হয়, মজা করে বলে- আরে এত সহজ কবিতা তোমার আসে কি করে? আসলে তুমি হলে সহজ কবি? 

অনুর আগ্রহ নেই এসবে। ও কলেজ, বন্ধু, বান্ধবী, এসব নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। ইদানীং মায়ের লেখা মাঝেমধ্যে ছাপা হচ্ছে সে খবর সে জানে কিন্তু এনিয়ে খুশি বা অখুশি কিছুই প্রকাশ করে নি সে!

কিন্তু আজকে মেয়ের এই কথায় খুব অবাক হয়ে যায় সে! আসলে বসন্তকাল চলছে তার ওপরে লেখা চেয়েছিল ওরা। তাই এই প্রেমের কবিতা। 

আচ্ছা কবিতা, গল্প এসব কি বয়সের কথা মাথায় রেখে লিখতে হয় নাকি লেখা যায়! এসব আসে হৃদয় থেকে। হৃদয় কখন কি চায় তা তো মস্তিষ্কের ও অজানা থাকে প্রকাশ না হওয়া অব্দি...! বান্ধবীরা কেউ কেউ নাকি দিনে তিন চারটি গল্প লিখছে! কি জানি কিভাবে তা সম্ভব হয়! অদিতির মাথায় তো সপ্তাহে একটা গল্প আসতে চায় না! ওরা কিভাবে লেখে?

-কি হলো, বিকেল হয়ে গেছে যে! আজ কি চা পাবো না...?

বিজনের ডাকে তাকিয়ে দেখে, সত্যি সূর্য ডোবার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, চারিদিকে কি সুন্দর একটা লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে! পাখিরা বাসায় ফিরে যাচ্ছে, বাগানে সদ্য ফোঁটা গন্ধরাজ কেমন গন্ধ বিলিয়ে দিচ্ছে....! 

সব বেদনা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায় অদিতির! মন'টা যেন ফুরফুরে হয়ে ওঠে! একটা কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে........।

-প্রেমের কবিতা, গভীর প্রেমের। মনে হয় আকাশ, বাতাস, পাখি, ফুল, ফল ওরা সবাই তাকে কত যে প্রেম নিবেদন করছে সর্বক্ষণ! 

এবার থেকে ওদের জন্য কেবলমাত্র প্রেমের ই কবিতা লিখবে অদিতি। হাসিমুখে বিজনের দিকে তাকিয়ে অদিতি বলে ,তুমি গিয়ে অপেক্ষা করো, আমি আসছি? 

চমকে উঠে বিজন অদিতির এই কথায়! প্রশ্নবোধক নজরে অদিতির দিকে তাকাতেই অদিতি হাসতে হাসতে বলে, আরে বলতে চেয়েছিলাম চা নিয়ে আসছি? 

দু'কাপ চা, গন্ধরাজের গন্ধ আর রক্তিম গোধূলি, প্রেম আসে অনায়াসেই...!







গ্রীষ্মের অলস দুপুর

সা য় ন্ত ন ধ র 


আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। তিনদিন টানা রোদের পরে যেন কিছুটা একঘেয়েমি এসেছে। তাই সে বিষন্ন। বেলা দশটার সময় ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও হলো। দীপ্ত ভাবছিলো আজ হয়তো একটু স্বস্তি মিলবে। কিন্তু কোথায় কি? ইঁলশেগুড়ির পর আবার সেই কাঠফাটা রোদ্দুর। দীপ্ত সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডী পেরিয়েছে। ছাত্রজীবন শেষ করে তথাকথিত বেকার জীবন যাপন করছে। সবাই ভাবছে দীপ্তর তো এখন তেমন কোন কাজ নেই... এই সময়টাকেই তো বেকার জীবন বলে। এই সময়ে ভবিষ্যতের জন্য যে সে প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেটা কারো চোখে পড়ার কথাও নয়... এখন কিন্তু আগের দিন নেই, যে চাকরীর দরখাস্ত লিখবার জন্য গাদাগাদা কালি ও কাগজ নষ্ট করতে হবে, আর সেগুলি পোষ্ট করবার জন্য জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে যাবে। এখন সব Online form fill up... দীপ্তকেও এখন আর এ অফিস বা ও অফিস ঘুরতে হয় না। www. দিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের website খুললেই হয়ে যায়। সারাক্ষণ net searching এ একঘেয়েমিটা যেন একটু বেশীই পেয়ে বসে দীপ্তকে। দীপ্তর বাবা-মা দুজনেই চাকুরীজীবী। প্রতিদিনের মতো আজও বেলা দশটায় উনারা কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। খালি ঘরে দীপ্ত একা। অন্যান্য দিন সময় কেটে যায় চাকুরীর জন্য পড়াশুনা ও Internet এর মাধ্যমে। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই সময় কাটতে চাইছে না। টুকটাক কিছু কাজেও আজ মন বসছে না তার। হঠাৎ শোবার ঘরের আধখোলা জানালা দিয়ে দূরে তার দৃষ্টি ধাবিত হয়। আগে এই জানালা দিয়ে তাকালে দূরের জমিদার বাড়ী, তৎসংলগ্ন সিংহদুয়ার, মনসা মন্দির দেখা যেতো। ও চত্বরে একটি বড়ো বটগাছ আছে। দেখা যেত পথচলতি পথিক ঠা ঠা রোদ্দুরে পুড়ে খানিক জিরিয়ে নিত প্রাচীন বটের তলে। ছোট ছোট ছেলেদের খেলার উচ্ছ্বাস শোনা যেত এতো দূর থেকেও। দেখা যেত মজা পুকুরে ফার্ণের জঙ্গল, বিশাল উঁচু হয়ে ওঠা নলখাগড়ার বন। আজ বেশ কিছুদিন হলো সেসব আর অতোটা পরিষ্কার দেখা যায় না। না, না... কোন কংক্রীটের জঙ্গলে সেসব ঢাকা পড়ে নি। কিছুদিন আগে দীপ্তর বাবার পরামর্শে পাশের "নারায়ণ কুটীর" - এর কেয়ারটেকার ফটিককাকু নিজে হাতে সারি দিয়ে ঘোড়ানিম গাছ লাগিয়েছে। বর্ষার জল পেয়ে তারা ডালপালা বিস্তার করে পাতা ছেড়ে বেশ ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। তাই বটগাছের গাঢ় সবুজ, মনসামন্দিরের লাল ও জমিদার বাড়ীর সাদা রঙের পরিবর্তে চোখ জুড়ে আজ ঘোড়ানিমের হালকা সবুজ পাতার সমারোহ। দীপ্ত সেই জানালার গ্রীলে চিবুক ও কপাল ঠেকিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঘোড়ানিম গাছে। মুহুর্তে তার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হল । টাইমমেশিনে করে তার মন প্রায় বারো বছর আগে রিওয়াইন্ড করে। ও এই শহরে এসেছে প্রায় দশ বছর হল। এর আগে ও একটি মফঃস্বল শহরে থাকতো। ওর বাবা স্থানীয় বিদ্যালয়েরই শিক্ষক ছিলেন। বিদ্যালয়ের একদম বিপরীতেই একটি লালরঙা বাড়ীতে থাকত ওরা। শিশুবয়স থেকেই একা থাকে দীপ্ত। তাই সকলের যেমন ছুটির দিন বেশী ভালো লাগে, দীপ্তর তা লাগত না। ছুটি মানেই একা থাকা। বাবা-মা- এর তো ছুটি নেই। ও তখন ওদের সেই বাড়ীর জানালাতেও এভাবেই চিবুক ও কপাল ঠেকিয়ে রাখতো। এ সময় একা থাকতে থাকতেই প্রতিধ্বনিকে আবিষ্কার করে ফেলে সে। প্রতিধ্বনির ঘটনায় মজা পেয়ে সামনের বিদ্যালয় ভবনের দিকে চেয়ে প্রাণপন চীৎকার করতো আর অব্যবহিত পরেই প্রতিধ্বনি ফিরে এসে তাকে কানে কানে বলতো, "তুমি তো একা নও, এই তো আমি আছি তোমার সঙ্গে।" সঙ্গীসাথীদের সাথে দেখা হতো বিদ্যালয়ে অথবা বিকেলে খেলার সময়। ছুটির দিনের সেই অলস দুপুরগুলোতে তাকে নিঃসঙ্গই থাকতে হতো। ওর বাবা ওদের বাড়ির সামনে ও পিছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান তৈরী করেছিলেন। তাতে যেমন ছিল বড়ো বড়ো গাছ, তেমনই ছিল তৃণ-গুল্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "বলাই" এর মত ছোট্ট দীপ্তও ঘুরে বেড়াতো সেই বাগানে। তবে বাবা-মা বাড়ী থাকলেই সেটা সম্ভব হত। এছাড়া তাকে ছুটির দিনগুলো কাটাতে হতো গৃহে তালাবন্দী অবস্থায় সম্পূর্ণ একা। আরো ছোটবেলায় তার এক মাসী ছিল, সারাটি দুপুর সে মাসীর সাথে সাথে হেঁটে মাসীর মাদার গাছের ডাল সংগ্রহের সঙ্গী হতো, লিচু গাছের ছায়ায় বসে থাকতো। সেই মাসী হঠাৎ চলে যাওয়ায় ছুটির দুপুরগুলিতে সে একদম একা হয়ে গিয়েছিলো। তখন সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতো তার বাবার আপনহাতে গড়ে তোলা বাগানটার দিকে। ও জানতো গাছেদের প্রাণ আছে। হয়তো এ জন্যই সে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করত সেই ছুটির দুপুরগুলিতে। তার মনের কথা সে মনে মনেই বলত তার চেয়ে মাত্র তিন বছরের ছোট জারুল গাছকে। দীপ্তর মা রোজ খাতা ভ'রে Homework দিয়ে যেতেন। সেগুলি পড়ে থাকতো। সেই বিষন্ন দুপুরে ঘুঘুপাখি একটানা বিষন্ন সুরে দীপ্তকে "পাঁচুগোপাল" সম্বোধন করে ডেকে বলতো "পাঁচুগোপাল, পড়্ পড়্ পড়্।" ছোট্ট দীপ্তর মন একা থাকার কষ্টে অভিমানী হয়ে উঠত। আর ভাবত, ঘুঘুপাখিটাই ওর সবচেয়ে আপন কেউ। সাতকাওয়া ঠ্যা ঠ্যা করে ডেকে উঠত, বসন্তে কোকিল কুহুতানে মন ভরিয়ে দিত, হলুদপাখী যেন দীপ্তর মনের কথা বলে উঠতো, "কাঁঠাল পাকো।" দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে একঝাঁক টিয়া এসে ঘোড়া নিমের ফল ঠুকরিয়ে খেত, যত না খেত, শানবাঁধানো চাতালে ছড়াত বেশী। টিনের চালে টুং টাং শব্দ তুলতো। ঝরে পড়া শুকনো পাতায় খস্ খস্ আওয়াজ তুলত শুকসারির দল। প্রতিটি শব্দই এক একটি কথা হয়ে দীপ্তর কানে প্রবেশ করত। গাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য গালে তারজালির ন্যায় গ্রীলের দাগ বসে যেত, দীপ্তর খেয়ালই থাকত না সে সব। "অমল"- এর যেমন "দইওয়ালা" ছিল, তেমনি দীপ্তর ছিল খামখেয়ালী কদুকাকু, যে মাঝে মাঝে শিশু দীপ্তর ডাক শুনে গল্প করে যেত তার সাথে। মাঝে মাঝে দিয়ে যেত গাছপাকা আম। এ ভাবেই প্রতিটি শনিবার কাটতো তার। তারপর যখন ঘড়ির ছোটকাঁটাটা 3 এবং বড় কাঁটাটা 12 ছুঁই ছুঁই , তখন সে ভাবত – 

“তিনটে থেকে তাকিয়ে থাকি
কখন আসবে জয়া
মা যে কখন আসবে আমার
কখন করবে দয়া।”

ওর মা একমাত্র শনিবার করেই দিনে দিনে ঘরে ফিরতে পারতেন "জয়া" বাসে করে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সেই বিষন্ন দুপুরের দিনগুলি। 
হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে ওঠে টিংটং শব্দে। আর সেই যান্ত্রিক শব্দে দীপ্তর চিন্তায় ছেদ পড়ে। সচকিত হয়ে দেখে তার নোনাজলে সিক্ত গালের ওপর গ্রীলের দাগ হয়ে গেছে। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। তার মা এসেছেন। ছোটবেলার মতোই ফ্যানের নীচে মাকে বসতে বলে এগিয়ে দেয় জলের গ্লাস। তারপর একসাথে খাবে বলে তার মা রান্নাঘরে যান খাবার গরম করতে। দীপ্ত আবার এসে দাঁড়ায় সেই জানালার সামনে। সত্যিই কি করে যেন দুটি দুপুর মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। ওর ফটিককাকু ঘোড়ানিম গাছ লাগিয়ে ওকে পৌঁছে দিয়েছিল ছোটবেলায়। আজকাল তো WINDOWS এর দৌলতে গ্রীল লাগানো জানালাগুলি হারিয়েই গেছে। আজ WEB এর যুগে মাকড়সার জালে মাকড়সাকে ঝুলে থাকতে দেখে তাকে ভীনগ্রহের জীব কল্পনা করে রোমাঞ্চ অনুভব করে না কোন শিশু। দীপ্তর মনটা আজ একাধারে অদ্ভুত ভালোলাগা ও বিষন্নতায় ভ'রে যায়। হয়তো ওর জীবনে এরকম আরও গ্রীষ্মের দুপুর আসবে, শুধু তা আর অলস দুপুর হবে না।








ও ভোলামন

ডঃ ম য়ূ রী মি ত্র


রিহার্সাল দিতে বসে বড্ড খিদে পেয়েছিল। মনও ক্লান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল, একা একটু রাস্তায় হেঁটে এলে ভালো লাগবে। এমন হয় মাঝে মাঝে। আর হলেই যে থিয়েটার আমার প্রাণ, আমার শরীরের এক টুকরো সেই থিয়েটারেও কেমন অনীহা আসে। কিছুক্ষণের জন্য এ বিতৃষ্ণাকে allow করি। নাহলে দুগুণ তৃষ্ণা জাগাব কী করে ?   

তো পালালাম থিয়েটার থেকে- কিছুক্ষণের জন্য অন্য কোনোখানে। দলে তখন ছেলেমেয়েরা রিহার্সাল দিচ্ছেন। তোয়াক্কা করলাম না কারোর। পালাবার সময় চেনাকে ভুলতে হয় তো। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে। রিহার্সাল রুম থেকে বের হওয়া এ রাস্তা ভারী চমৎকার। দু'পাশের বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের যাপন প্রায়ই চলে আসে রাস্তায়। খেলাচ্ছলে- কথার ছলে। রোদ ডুবলে দুই বাসিন্দার গল্পে শোনা যায়- কেমন কাটল রে আজ তোদের দিন ?- জানিস আজ আমাদের কী হল দুপুরে? কত অতিথ এল আজ- সে এক ঝক্কি- এমন কত যে শব্দ- কত কত বাক্য। সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ- ঠিক জীবনের সুখ দুখের মতোই তাদের দৈর্ঘ্য। পোষা ময়নাকে পথের ওপর নিয়ে আসতেও দেখেছি- খাঁচা উঁচু করে বাড়ির বনেদী পাখিকে বুনো গাছ চেনাচ্ছেন গৃহস্থ। আকাশের লোভ ঝাঁকি দেয় বিহঙ্গের ডানায়।

যে কথা হচ্ছিল। রিহার্সাল পালিয়ে গেলাম ছোট্ট একটি মুড়ি বাদামের দোকানে। হাতে গোনা কটা পণ্য। বাবা বসে বসে বালিতে বাদাম ভেজে তুলছে। বাচ্চা মেয়েটা বাবাকে মন দিয়ে সাহায্য করছে। ছোট্ট কানের গোড়ায় ব্যস্ত দোকানীর মত হিসেব লেখার পেন্সিল গুঁজে রাখা। বারবার কানে হাত দিয়ে দেখছে- হিসেবের পেনসিলটা কানে আটকে আছে কিনা!
হাসি পাচ্ছিল। বললাম- "পেন্সিল আছে ! হিসেবের খাতা কই রে?" গম্ভীর মুখে বলল- "বাবার কাছে। ছোটদের কি হিসেবের খাতা দেখতে আছে?" ভাজা ঠিক হচ্ছে কিনা দেখার জন্য ছোট মাথাটা যখন প্রায় বাদামফোটা কড়াইয়ে ঢুকিয়ে দিল ভয় হচ্ছিল- এই না বাদামের সাথে তার মাথাও ভাজা হয়ে যায়। উনুনের কাছ থেকে সরাবার জন্য গাল টিপে আদর করতে গেলাম। ঝট করে গালটি সরিয়ে নিলে। দেখলাম- যে গালে আদর করতে গেছি সেখানটা ফুলে টুলে মামস হয়ে রয়েছে। মামসের ওপরে সেই ফুটো ফুটো কাপড়ের টুকরোটা বসানো।
-"খুব ব্যাথা না রে?" একদম পাত্তা দিল না আমার কথায়। বালি ঢেলেই চলল বাদামের কড়াইয়ে। বাদাম কিনলাম। কানের পেন্সিল খুলে হওয়ায় লিখল মিছিমিছি হিসেব। চলে আসছি। দৌড়ে এল- "এই গালটায় টেপ গ। এটায় মামস নেই!" 
ঘামে ভিজেছে বাবার খুকির মামস গাল।








স্বপন যদি

সু নৃ তা রা য় চৌ ধু রী 


মধুরিমা ঘুম থেকে উঠে দেখলো সাতটা পাঁচ। ওরে বাবা! এত দেরী হয়ে গেল! পল্লবের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চবক্স, ঋষির সকালের কর্নফ্লেক্স দুধ, শাশুড়ির জলখাবার চা ভাবতে ভাবতে হুড়মুড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে শাশুড়ি মা টোস্টে মাখন লাগাচ্ছেন। ডিম সেদ্ধ করা হয়ে গেছে, দুধ জ্বাল দেওয়া, এমন কি খাবার টেবিলে পল্লবের জন্য ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, আরো কি কি সব ঠাণ্ডা করতে দেওয়া আছে লাঞ্চবক্সে ভরার অপেক্ষায়। মধুরিমা খুব অবাক হয়ে বললো, "এত সব কখন করলেন মা?"
পূর্ণিমা এক গাল হেসে বললেন, "কেন বৌমা, বুড়ো হয়েছি বলে কি ছেলের খাবারটুকুও করে দিতে পারি না? তুমি যাও, দাদুভাইকে ঘুম থেকে তোলো।" বলতে না বলতেই ঋষি একদম ফিটফাট স্কুল ড্রেস পরে এসে হাজির। স্নানও করে নিয়েছে। কর্নফ্লেক্স দুধ দেওয়া মাত্র খুব আগ্রহের সঙ্গে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, "কি টিফিন দেবে আজ?" পূর্ণিমা বললেন, "তোমার জন্য নুডলস্ বানিয়ে রেখেছি দাদুভাই। ডিম চিকেন সব দিয়ে।" এক চওড়া হাসি ফুটে উঠলো ছোট্ট মুখে। রোজ রোজ ওর কেক, কুকিজ খেতে ভালো লাগে না। পল্লব ইতিমধ্যে রেডি হয়ে এসেছে। মধুরিমা দেখলো ওর শার্টের কনুইয়ের কাছে একটু কুঁচকে আছে। বললো, "অন্য শার্ট বার করে দিই?" পল্লব বলে, "না না, ও ঠিক আছে।" চেয়ার টেনে বসে টোস্টে কামড় দিয়ে বলল, "ও ভালো কথা! আজ তোমার হাফ স্কুল তো? বিকেল পাঁচটায় তৈরি হয়ে থেকো, বেরোবো।" মধুরিমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে মৃদু হেসে বলল, "একটা সিনেমা দেখে বাইরে ডিনার করে ফিরব।" 
মধুরিমা বলে, "আর ঋষি?"
"ও থাকবে কিছুক্ষণ মায়ের কাছে।" বলে পল্লব মায়ের দিকে তাকায়। তিনি বলেন, "সে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না বৌমা, দাদুভাইকে নিয়ে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমরা দুজন খুব লুডো খেলব। কি দাদুভাই?" পল্লব বলল, "আমরা তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসব।"
ঋষি বলে, "বাপি, মটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ।আর…. আর একটা আইসক্রিম। "পূর্ণিমা যোগ করেন, "একটা বেনারসী পান"। মধুরিমা দ্রুত অভ্যস্ত হাতে লাঞ্চবক্স রেডি করে, ঋষির ব্যাগ চেক করে। প্রাতরাশ শেষ করে ওরা বেরিয়ে যায়। মধুরিমার মন জুড়ে তৃপ্তি ছড়ায়, শান্তি নামে। এই তো তার সংসার!

এই ভালো লাগার মাঝে শুনতে পায় অ্যালার্মের টুং টাং! ফোন জানান দিচ্ছে ছটা বাজে, উঠতে হবে এবার। সুখস্বপ্নের রেশ এখনো কাটেনি। জলদি মুখহাত ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরোতেই কানে এলো, "মহারানীর এখনও ওঠার সময় হয়নি। এরপর তো তাড়াহুড়ো করে যেমন তেমন করে রেখে ছুটবে ইস্কুলে।
মধুরিমা উত্তর করেনা। চায়ের জল চাপিয়ে ফ্রীজ থেকে খাবার বার করে, দ্রুত হাতে জলখাবার রেডি করে, চা দিয়ে পল্লবকে ডেকে তোলে, ঋষিকে ঘুম থেকে তুলতে গিয়ে প্রতিদিনের মতো হিমশিম খায়, কোনো ভাবে মুখ ধুইয়ে টেবিলের কাছে আনে, রোজকার মতন সে খাওয়া নিয়ে বায়না ধরে। চা মনোমত হয়নি বলে পল্লব বিরক্তি প্রকাশ করে, পূর্ণিমা তাতে সায় দেন। ঋষির ঘোরতর আপত্তির কথা শুনতে শুনতে ওর টিফিন বক্সে চকোলেট কেক আর কাজুবাদাম ভরে। পল্লব আবার খোঁচা দেয় ওর শার্টের কলার ঠিক ঠাক ইস্ত্রি হয়নি বলে। ইতিমধ্যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো চলতে থাকে পূর্ণিমার গঞ্জনা। যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মধুরিমা তার বাপের বাড়ির দায় সামলাতে এই সংসারে প্রভূত দায়িত্ব পালন না করে চাকরি করতে ছোটে। তাঁর শক্তি সামর্থ্য যথেষ্ট থাকলেও তিনি কোনো কাজে হাত না লাগিয়ে সবটুকু শক্তি নিয়োজিত করেন রসনায়। মধুরিমা নিজেদের ঘর, শাশুড়ির ঘর গুছিয়ে, ছাড়া কাপড় সাবান জলে ভিজিয়ে, রান্নার মেয়েটিকে সব বুঝিয়ে বলে নিজের স্কুলের জন্য তৈরি হতে গেল। নাকেমুখে কিছু খাবার গুঁজে বেরোবার সময় শুনতে পেলো, "আজ হাফ ছুটি বলে আবার বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থেকো না। মধ্যমগ্রাম থেকে আমার মামাতো ভাই দেখা করতে আসবে ওর বৌ মেয়ে জামাই নিয়ে। ওদেরকে রাতে খেয়ে যেতে বলেছি।" থমকে গেল মধুরিমা। রান্না হবার আগে এ কথা তিনি বলেননি। বাজারও সেরকম নেই অতিথি আপ্যায়ন করার মতো। সময় নেই। মধুরিমা স্কুলের পথে বেরিয়ে পড়লো।ফেরার সময় বাজার করে আনতে হবে। কি জানি, ঐ ভর দুপুরে কিছু পাওয়া যাবে কিনা! ভেবেছিল একবার মাকে দেখে আসবে। মায়ের ওষুধ ফুরিয়ে যাবার আগেই দিয়ে আসবে। ওর থেকে দশ বছরের ছোট ভাইটা যতদিন চাকরি না পায়, ততদিন ওদের ভার তো ওকে নিতেই হবে। বিয়ের আগে এই তো শর্ত ছিল। ওর নিজের কোনো শখ, কোনো ইচ্ছের খোঁজ কেউ রাখে না। কাউকে ও খুশি রাখতে পারে না, তবু নিরন্তর চেষ্টা সবাইকে ভালো রাখার। শুধু ওর নিজের জন্য কোনো অবকাশ নেই, নেই কোনো পরিসর। অভিমান হয়, কিন্তু কার ওপর অভিমান করবে?সবাই তো ওর নিজের। অভিমান, অভিযোগ কিছুই নেই। ওর ভালো লাগা গুলি স্বপ্ন হয়েই দেখা দিক, মুক্তিপ্রিয় মনটা সেই আকাশেই ডানা মেলুক।
মধুরিমা এগিয়ে চলে।







পুনর্জন্ম

অ শো ক কু মা র মো হা ন্ত
   

"দাদা, পাঁচ টাকা দামের দুটো মিষ্টি দিন তো।"
পরক্ষণেই পকেট হাতড়ে  দেখে বলল' "নাহ্, একটাই দিন।" 

না এটা কোন সিনেমার শুটিং এর দৃশ্য নয়। এটা মালদার মালঞ্চপল্লীর লোকনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে মাঝ দুপুরের একটি দৃশ্য। যেখানে উত্তরবঙ্গগামী রেল লাইন আর ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক পাশাপাশি হাত ধরে দুই রাগিণীর যুগলবন্দীর মতো অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। ব্যস্ততা যেখানে জীবনের চঞ্চলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। সেইখানে  দাঁড়িয়ে একটি কৈশোরোত্তীর্ণ বালক, বয়স বোধ হয় ষোলো সতের হবে, হাতে ধরা বিভিন্ন আকারের কতগুলো ছোটখাটো থলে-পুঁটুলি। মুখটা শুকনো ভয়ার্ত ও  আতঙ্কগ্রস্ত। বার বার নীচু হয়ে পিছন ফিরে কাকে যেন দেখছিল। মনে হচ্ছিল কোন সন্ত্রস্ত মৃগশাবক জঙ্গলে সিংহের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে দুই কান জাগিয়ে বিপদের উৎসস্থলকে অনুধাবন করবার চেষ্টা করছে। 

আসলে তেমন কোন  বেচা কেনা হয়নি আজ তার। ফুটপাতের উপর পেতে বসা লম্বায় সাত ফুট আর চওড়ায় ছয় ফুট দৈর্ঘ্যের হরেক রকম প্লাস্টিকের বিক্রেতা নবীন বাড়ী ফিরছে দুপুরবেলা। খিদে আর তৃষ্ণায় একটু জল খেতে গিয়েছে ঐ মিষ্টির দোকানে। খিদে পেটে জল খেলে তৃষ্ণাটা মিটবে না।বুকের কাছে আটকে থাকবে। তাই দুটো মিষ্টি খেয়ে জল খেতে গেছিল। 

পুলিশের  ঝামেলা চলছে প্রতিদিনই ফুটপাতের দোকানদার গুলোর সাথে। পেরে উঠছে না ওরা পুলিশের সাথে লুকোচুরি খেলে। ওদিকে মায়ের জন্য পান সুপারী নিয়ে যেতে হবে। মা আসার পথে বলে রেখেছেন। দুটো পয়সা সাশ্রয়ের চেষ্টা। 

মাস ছয়েক আগে বাবা মারা গেছে নবীনের। নবীনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল হঠাৎ করে। শান্ত পাহাড়ি নদী যেমন হঠাৎ করে হিংস্র হয়ে উঠে হড়কা বানে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমন করে  নবীন এক নিমেষে সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত। উদভ্রান্ত, দিশেহারা নবীন। ফুটপাতে তার স্থান। অথচ কত স্বপ্ন ছিল তার চোখে। বড় হবার স্বপ্ন দেখত নবীন। 

আজ যেন হঠাৎই একলা ।বাধাপ্রাপ্ত জলপ্রবাহ যেমন ঘূর্ণনের সৃষ্টি করে তেমনি চিন্তার ঘূর্ণন নবীনের মস্তিষ্ক জুড়ে। সব আশা এক লহমায় চুরমার হয়ে গেছে।সে আর তার সদ্য বিধবা মা, দুই জনের পেট চালানোই আজ দায়। পড়াশুনায় প্রথম দিকে থাকা নবীন পড়ত মালদার টাউন হাইস্কুলে। এখন মালদার  মালঞ্চপল্লীর বাজারে ফুটপাতের প্লাসটিকের সরঞ্জাম বিক্রেতা। জমি জায়গা সব বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে চলে গেছে। বাড়ির জায়গাটাও বন্ধক রাখতে হয়ছে। এক কোণায় ছোট একটা ঘর এখন মা ও ছেলের আস্তানা। তাও বাবাকে ফেরাতে পারেনি মারণ ক্যান্সার রোগ থেকে। হঠাৎ করেই যেন সব আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল  আলোকিত দেউলের পূজামন্ডপে। 

বাবার একটা ছোট ঝুপড়ি দোকান ছিল। রথবাড়ী এলাকায়। টিমটিম করে চলত। চিকিৎসার খরচ মেটাতে তাও হাতছাড়া  হয়ে গেছে। চিন্তিত ছিল নবীন । পাখীর বাসা ঝড়ে ভেঙে গেলে যেমন অনিকেত পাখি এ গাছ ও গাছ ঘুরে বেড়ায়, বুঝতে পারেনা, কি করবে, নবীনেরও একই অবস্থা। পড়াশুনা ছেড়ে দিল নবীন। বিপদের সময় আত্মীয়দের চেনা যায়। সব আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নিল। শেষ সম্বল মায়ের একটা পুরাণো বালা ছিল, সেটা বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করে প্লাসটিকের বাসন আর কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে মালঞ্চ পল্লীর মোড়ে ফুটপাতের উপর  বসে। মাঝে মাঝে পুলিশ উঠিয়ে দিয়ে যায়। আবারও বসে নবীন। এই ব্যবসায়ও তেমন সড়গড় হয়নি নবীন। বেশী লাভ করতে পারে না। তবুও বসে। নবীন মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে সততাই ব্যবসার মূলধন। তার বাবার শেখানো বুলি। 

 সেদিন দুপুর বেলা দোকান গোটাচ্ছে নবীন। হঠাৎ করে একটা কালো রংয়ের গাড়ী এসে ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দাঁড়াল। দুইজন মোটা মতো ভদ্রমহিলা ওর দোকানের সামনে এল গাড়ী থেকে নেমে। একজনের হাতে একটা  লেডিস ব্যাগ।  দোকানের সামনে উবু হয়ে বসে প্লাস্টিকের বাসন পত্রগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো। নিজেদের মধ্যে  বলাবলি আর দাম জিজ্ঞেস করতে থাকে। নবীন ও কাজ করতে করতে এক ঝলক চোখ তুলে হাতে ধরা জিনিসটা দেখে নিয়ে দাম বলে দিতে থাকে। দুটো মাঝারি সাইজের প্লাস্টিকের গামলা কিনে তাড়াতাড়ি গাড়িতে গিয়ে উঠল আর গাড়ি ও স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল। পরক্ষণেই নবীনের চোখ পড়ল একটা লেডিসব্যাগ ওর দোকানের প্লাস্টিকের কোণায় পড়ে আছে। নবীনের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এটা সদ্য প্রস্থানোদ্যত দুই প্রৌঢ়ার যে কারো একজনের। নবীন কি করবে বুঝতে পারে না। দৌড়ে রাস্তায় যায়। যদি গাড়িটা দেখা যায়। নাহ্ গাড়ি চলে গেছে। নবীন ব্যাগ খুলল। ফোনটা থাকলে ফোন করবে যে কোন একটা নম্বরে। ব্যাগ খুলতেই অবাক। ব্যাগের মধ্যে একটা ছোট মতো বটুয়া। বটুয়ার মধ্যে মোটা পুরানো সোনার হার। বেশ দামী বলে মনে হচ্ছে। আর কিছু তেমন নাই। টুকরো কিছু কাগজ। ঠিকানা উদ্ধার করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। 

এমন সময় পুলিশের গাড়ি ছুটে এল সাইরেন বাজিয়ে। সাথে আরো দুটো মাল তোলা গাড়ি। ওদিকে ন্যাশনাল হাইওয়েতে জ্যাম লেগেছে। ফুটপাত খালি করতে হবে ওদের। যে যেদিক পারল মালপত্র পোঁটলা করে দে ছুট। হতভম্বে নবীন ও প্লাস্টিকের চারকোনা ধরে নিয়ে ছুট লাগাল। ব্যাগটাও ওর মধ্যে ফেলে ছুটতে থাকল। নবীন লোকনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে এসে দাঁড়াল। 

পরেরদিন থেকে ওখানকার সব জায়গা খালি। পুলিশে আর বসতে দিচ্ছে না। 

কাউকে কিচ্ছু জানায়নি নবীন। মাকেও না। হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খায়। কার ব্যাগ, কি করেই বা তার কাছে পাঠাবে। ব্যাগটা রেখে দিয়েছে বাড়িতে লুকিয়ে। মাথায় নানান চিন্তা ঘিলুটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে চলেছে। ঘুণ পোকার মতো। একবার ভাবল থানায় জমা দেবে কিন্তু পুলিশের উপর ভরসা নেই। সঠিক মালিক যে জিনিস ফেরৎ পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। 

অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। নবীন ব্যবসায় বেশ উন্নতি করেছে। পরিপক্ক হয়েছে। একটা দোকান কিনেছে। স্টেশনারী দোকান। মালদা শহরে। মহানন্দা পেরিয়ে হবিবপুর যাবার পথে আইহোতে একটা বাড়িও করেছে। মা বিয়ে করবার জন্য পীড়াপীড়ি করে। ওসব নবীনের ভাববার সময় নেই। মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মাকে নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই। নবীন মানুষকে ঠকায় না। সামান্য লাভ রেখে বিক্রি করে। সেজন্য নবীনের দোকানে ক্রেতারও অভাব হয় না। একজন কর্মচারী রেখেছে। নাম দুলাল। ভীষণ বিশ্বাসী ছেলে। আজকালকার দিনে এমন পাওয়া ভার। ওর হাতে কদিন দোকানটা রেখে নবীন ওর মাকে নিয়ে কোলকাতা যাবে। কিডনির সমস্যা দেখা দিয়েছে মায়ের, পিজিতে দেখাতে হবে। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে ভর্তি করে দিতে বললেন কদিনের জন্য। ডাক্তারই সব ব্যবস্থা করে দিলেন। 

পাশের বেডে ওর মায়ের বয়সী রোগা চেহারার আরেক জন ভদ্রমহিলা ও শুয়ে কম্বল গায়ে ঢেকে। ওনার ও কিডনির সমস্যা।মাকে ভর্তি করে নবীন হোটেলে ফিরে এল। 

দিন সাতেক পর মা একটু সুস্থ হল। নবীন মাকে নিয়ে হোটেলে ফিরছিল। ফেরার পথে গল্পের ফাঁকে মা শোনাল, "জানিস পাশের বেডের ঐ মহিলার ও আজ ছুটি হবে। ওনার বাড়িও মালদা। ওনার খুব দুঃখ। ছেলে বিদেশে থাকে। আর কেউ নেই। কেউ ওনাকে নিতে আসবে না। তুই আসবি আর ওনার কেউ আসবে না। দুঃখ করছিলেন। তোর কথা জিজ্ঞেস করল কি করিস ? বললাম স্টেশনারী দোকান আছে। দোকান করিস শুনে উনি ওনার আক্ষেপের কথা বললেন। ওনার জীবনে ঘটা একটা 'মন খারাপে'র ঘটনা। মালদার কোন এক জায়গাতে নাকি একবার ফুটপাতের উপর এক দোকানে ওনার মায়ের দেওয়া হারটা ফেলে এসেছিলেন ভুল করে, ফিরে গিয়ে আর পাননি। সে দুঃখ এখনো ওনাকে কষ্ট দেয়। এখনো ভুলতে পারেননি হারটার কথা। ঘুরে ফিরে ক'দিন ঐ হারটার কথাই বলছিলেন।" 

বাড়ীতে মাকে রেখে নবীন বলল, মা তুমি থাকো আমি এখুনি আসছি। ছুটতে ছুটতে পিজির ঐ বেডের কাছে গেল নবীন। গিয়ে দেখে বেড খালি। নার্সকে জিজ্ঞাসা করলে নার্স বলল ওনার তো ছুটি হয়ে গেছে। চলে গেছেন। নবীন উৎকন্ঠিত হয়ে বলল ওনার ফোন নম্বরটা একটু পাওয়া যাবে ? নবীনের ব্যস্ততা দেখে নার্স কি বুঝল কে জানে, বলল দাঁড়ান রেজিস্টার দেখে বলছি। ফোন নম্বর দিল।   ওনার নামটাও  জেনে নিল নবীন। সুজাতা ঝা। 

নবীন ঐ নম্বরে ফোন করলে এক নারী কন্ঠ ভেসে এল। সুজাতা ঝা বলাতে বলল "হ্যাঁ, আমার এখানে থাকেন। আমি ওনার বান্ধবী।" উৎকন্ঠিত নবীন ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। "কী দরকার?" জিজ্ঞেস করল ওপার থেকে, নবীন বলল, "আমার বিশেষ দরকার আছে। আসলে উনি পিজিতে মায়ের পাশেই ছিলেন তো। মা একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বলেছেন।" বাড়ির ঠিকানা বলে, উনি আরো কি যেন জিজ্ঞেস বলতে যাচ্ছিলেন, নবীন ফোন কেটে দিল। ওলা নিয়ে ওনার দেশপ্রিয় পার্কের বান্ধবীর বাড়িতে পৌঁছল নবীন। কিন্তু ওখানে গিয়ে ওনার বান্ধবী জানালেন সুজি মানে সুজাতা তো একটু আগে বেরিয়ে গেল। গৌড় ধরবে বলে। নবীন দেখল এখনো ঘন্টা খানেক সময় আছে। নবীন ছুটল আবার ও ট্যাক্সি নিয়ে শিয়ালদা মুখে। মৌলালী মোড়ে ওর ট্যাক্সি জ্যামে আটকে গেল। বেশ লম্বা লাইন। নবীন ঘামতে থাকল দরদর করে।  যাই হোক শিয়ালদা গিয়ে দেখল গৌড় এক্সপ্রেস ঢুকে গেছে নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে। সবাই উঠেও পড়েছেন। । সময় বেশী নাই। নবীন ছুটল প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে যেখানে প্যাসেঞ্জার রিজার্ভেশন চার্ট লাগানো থাকে। খুঁজে পেল সুজাতা ঝা, বি ৫, সিট নং ৫৬। হাঁফাতে হাঁফাতে কোচ খুঁজে উঠে পড়ল। ওদিকে সময় ও শেষের পথে। সিগন্যাল সবুজ। এখনি হয়তো গার্ড বাঁশি বাজাবে। দৌড়ে নবীন যখন ওনার সীটের কাছে পৌঁছল গার্ড ফাইনাল বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যে কোন কারণে ছাড়তে একটু দেরী হল। নবীন কোন ভনিতা না করেই ওনার ফোন নম্বরটা চাইল, বলল বিশেষ দরকার আছে। ভদ্রমহিলা হকচকিয়ে নবীনের দিকে চাইলেন। নবীন বলে চলে , "শুধু জানুন আপনার সেই হারটা আমার দোকানে ফেলে এসেছিলেন। আমি সেই প্ল্যাসটিক দোকানদার। বাকি কথা পরে জানাব।" এবার আর উনি ফোন নম্বর টা দিতে দ্বিধা করলেন না। গাড়ি ছেড়ে দিল। নবীন চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল। 

নিয়ে এসেছিল নবীন হারটা ওনার মালদার বাড়ীতে। ভদ্রমহিলা বললেন, "আজ থেকে তুমি আমার আরেক ছেলে। আমার অবর্তমানে এ বাড়ি ঘর সব তোমার। ছেলে আর ছেলের বৌ  আমেরিকা থেকে আর হয়তো কোনদিনই ফিরবে না। আমি ও আর বেশীদিন থাকব না। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন। 

এতবড় বিশ্বাসী  ছেলেকে আমি কিছুতেই হারাতে পারব না। ঐ হারটার মতো সে আমাকে আর আমার সব সম্পত্তি  আগলে রাখবে। আমি জানি। আমি যে তোমার নতুন মা।"










মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪