গল্প





পিপাসা

র থী ন্দ্র না থ রা য় 


রোহিত আঢ্য। ওর খুব একটা যে বড় স্বপ্ন ছিল, তা নয়। তবে বাবা মায়ের কষ্ট লাঘব করতে খুব সচেষ্ট ছিল সে। গ্রাম থেকে মানে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকেই উঠে এসেছে। এলাকার কলেজ থেকে বি কম পাশ করার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম বি এ  করেছে। বন্ধুরা বলেছিল, বি কম পাশ করে তেমন কিছু হবেনা। তোকে আরও কিছু করতে হবে। সেই আরও কিছুর জন্য এম বি এ তে ভর্তি হওয়া। এর জন্য ওকে দুবেলা টিউশানি পড়াতে হতো। তারপর এমবিএর ক্লাসে আসতে পারতো। তারও পর ছিল রাত জেগে পড়াশোনা। ফলও ভালোই হয়েছিল। এমবিএ তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। খুব আনন্দ হল তার। কিন্তু তেমন ভাবে প্রকাশ করলনা। যেন কিছুই হয়নি। তবে বাড়ি ফিরে বাবা মাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়েছিল। 

এর আগে কয়েকটা কর্পোরেট সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদনও করেছিল। কিন্তু সেখান থেকে তেমন কোনও রেসপন্স আসেনি। তাই আবার নতুন করে আবেদন করতে মনস্থির করল। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ওর মোবাইলে রিং টোন বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে দেখল ডিপার্টমেন্টাল হেড সুমন্তবাবু--
-স্যার, ভালো আছেন ? 
-হাঁ, আছি। কালই মুম্বাইয়ের একটি সংস্থা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ নিতে আসছে। তুমি চলে এসো। 
-স্যার ? 
-ঠিক দুটোর মধ্যে। এখন রাখছি, কাল কথা হবে। 
রোহিত নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। স্যার নিজে ডাকছেন!
তাছাড়া ইতিপূর্বে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে সে যায়নি। কেমন হবে ব্যাপারটা কে জানে? যদিও স্যার তার পাশে থাকবেন। তবু একটা আশঙ্কার দোলাচল থেকেই যায়। ওইসব সংস্থায় ওয়ার্ক কালচার কেমন, সে জানেনা। তবে কর্পোরেট কালচার নিয়ে সে কিছু পড়াশোনা করেছে এবং শুনেছেও কিছু। ওদের সবকিছুই নাকি কেতাদুরস্ত। ঝাঁ চকচকে পোশাক পরিচ্ছদ, চলন বলন সবকিছুই। 

আগামীকাল ইন্টারভিউ। রাতটুকু সময়। তার জানার ব্যাপারে সে একশো শতাংশ আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু সাজপোশাক এবং বাচনভঙ্গি নিয়ে তার একটু খুঁতখুঁতুনি আছে। যদিও সে ব্যাপারে স্পোকেন ইংলিশের ক্লাসে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। তবু শেষ পর্যন্ত কি হবে কে জানে! কাল ঠিক দুটোর মধ্যে। তাহলে রাতটুকু মাত্র সময়। মাকে বলল, কাল একবার বর্ধমান যেতে হবে।
-ক'টায় যেতে হবে ? 
-বাড়ি থেকে ন'টা নাগাদ বেরোলেই চলবে। 
-তাহলে সকাল সকাল রান্না করে দেব?
-না মা, ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনেই খেয়ে নেব। জানো মা, এটা যদি হয়ে যায় তাহলে তোমাদের আর কষ্ট পেতে হবেনা। 
-আমাদের কষ্টের কথা ভাবিনা, তুই নিজের পায়ে দাঁড়ালেই আমরা খুশি। 
মা রান্নার কাজে চলে গেলেন। মা যেন সদা ব্যস্ত। একটুও কথা বলার সময় নেই। 

পরদিন যথা সময়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছাল রোহিত। স্যার যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। 
আরও অনেকেই এসেছে। তবু স্যার যেন ওকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ও যেতেই আশ্বস্ত হয়ে বললেন, যাক তুমি এসে গেছো! আমি খুব খুশি। আর তুমি সিলেক্ট হলে আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই সুনাম হবে। ব্যাপারটা মাথায় রেখো।

ব্যাপারটা মাথায় রেখেছিল রোহিত। ওর সি ভি দেখে এবং ওর সঙ্গে আলোচনা করে খুশি হল মুম্বাইয়ের সংস্থাটি। ওর হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক'বে জয়েন করতে পারবেন। 
-যখন বলবেন ? 
-ঠিক আছে। আমরা আপনাকে নেক্সট্ উইকে কোম্পানি ডিটেইলস আ্যন্ড প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দেব।
-থ্যাঙ্কস।
এবারও তার আনন্দ হল বটে কিন্তু প্রকাশ করলনা। বন্ধুরা বলে, ও নাকি বড্ড বেশি ইন্ট্রোভার্ট। উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া ওর স্বভাব নয়। 
কয়েকদিন পরেই একটা পার্সেল এল ওর বাড়িতে। কোম্পানি ডিটেইলস এবং প্লেনের টিকিট। আগামীকালই যেতে হবে। 
না, আর কোনও কিন্তু নয়। ও তো চেয়েছিল যা হোক একটা কিছু। কিন্তু এ তো যা হোক একটা কিছু নয়। দ্য এশিয়ান- একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এদের সাম্রাজ্য। চাকরিও হবে, আবার ঘুরে ঘুরে দেশ দেখাও হবে। মুম্বাইয়ের জুহুতে শ্রীরাম হাইটসের ছাপ্পান্ন তলায় এদের অফিস। তার মানে আকাশের সাথে হবে তার বন্ধুত্ব। সুতরাং আর পিছিয়ে থাকা নয়। 

দুপুর বারোটায় ওর ফ্লাইট। সুতরাং বাড়ি থেকে ওকে বেশ সকাল সকাল বেরোতে হল। একটা টেনশন ছিলই। কাজটা কেমন কাজ? কিছুই জানেনা সে। সম্পূর্ণ অপরিচিত। নানারকম ভালোমন্দ ভাবনায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি সে। ইতিমধ্যে নিজের ব্যাগটা নিজেই গুছিয়ে নিয়েছে। এই ভোরে বাবা মা দুজনেই উঠে পড়েছে। রোহিত বেরোবার সময় বলল, তোমরা কিচ্ছু ভেবোনা, আমি নিয়মিত তোমাদের ফোন করব। 
প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল সে। 
বাবা বললেন, তুমি ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকব। ব্যাগটা বাবার হাত থেকে নিল রোহিত। এ পর্যন্ত তো আমার ভার তুমিই বহন করেছ। এবার আমাকে সুযোগ দাও। 
-তাই বুঝি ! ছেলে আমার কতো বড়ো হয়ে গেছে । 
মা ওর চিবুকে হাত দিয়ে বললেন, ভালো থাকিস বাবা। 
বেরিয়ে পড়ল রোহিত। কিন্তু বর্ধমান স্টেশনে এসে সে আশ্চর্য হল। সায়ন্তিকা। সায়ন্তিকা রক্ষিত। ওকে তো সে মুম্বাই যাওয়া নিয়ে কিছু বলেনি। তাহলে ও জানল কেমন করে? এটা টেলিপ্যাথি না মনোপ্যাথি কে জানে?
সায়ন্তিকা ওর কাছে এসে বলল, তুই লুকিয়ে লুকিয়ে মুম্বাই যেতে চেয়েছিলি। ভেবেছিলি তোকে সি অফ করার কেউ নেই?
-না রে, সেরকম কিছু ভাবিনি। ভেবেছিলাম মুম্বাই পৌঁছে তোকে ফোন করব। তারপর ওখানে সেটল হয়ে তোদের বাড়ি আসব। 
-ভালো খবরটা আমাকে জানাতে পারিসনি। আর সত্যি আমি জেনে ফেললাম! এটা ভেবেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিস? আসলে তোর আমার সম্পর্কটা বাহ্যিক নয়, আন্তরিক। রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখলাম, তুই মুম্বাই চলেছিস। আর তোকে আমি সি অফ করতে স্টেশনে এসেছি।

রোহিত ওর চোখদুটোর দিকে চেয়ে থাকে। ওর চোখের গভীরে সে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। বলে, কিছু মনে করিসনা আমি তোর ছিলাম, আছি, থাকব।
-ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। শোন, তোর ট্রেন ক'টায়?
-আটটা কুডিতে। 
-বেশ এই খাবারটা রেখে দে। সকালেই বানিয়েছি। 
-তুই ? 
-হ্যাঁ। কেন, আমি পারিনা নাকি?
-পারিস। তবে--
-তবে?
-বলবনা।
-তুই না একই রকম আছিস। খাবি কিন্তু।
-নিশ্চয়। তুই নিজের হাতে বানিয়েছিস, আর আমি খাবোনা সে কি হয় নাকি?
খাবারটা ব্যাগে রেখে দিয়ে ধীরে ধীরে প্লাটফর্মের দিকে পা বাড়ায় রোহিত। 
সায়ন্তিকা হাত নাড়তে নাড়তে বলে, সাবধানে থাকিস। 

ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনালে পৌঁছে রিসেপশন এল রোহিত। উদ্দেশ্য সংস্থার তরফে যদি কেউ থাকে তাহলে তার পক্ষে অফিসে পৌঁছাতে অসুবিধে হবেনা। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল দ্য এশিয়ানের ব্যাজ এবং টুপি পড়ে এক ভদ্রলোক ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। ভদ্রলোক কাছে এসে বলল, এক্সকিউজ মি, আর ইউ রোহিত আঢ্য? ফ্রম ওয়েষ্ট বেঙ্গল?
-ইয়া। ইউ?
-রাও গনেশন, দ্য এশিয়ান। আপ হিন্দি সমঝতে?
-থোড়া। লেকিন বোলনেমে কভী কভী দিক্কত আতা হ্যায়। 
-জরুরৎ মে দিক্কৎ নেহি রহেগা। ম্যায় তেলেগু। অন্ধ্রকা আদমী মগর অব আসানী সে হিন্দি বোল শক্তা হায়। 
লোকটাকে ভালো বলেই মনে হল রোহিতের। বেশ টকেটিভ মানে কথা বলতে ভালোবাসে। তার মতো মুখচোরা নয়। ওদের গাড়িটা মসৃন গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। তার মানে এসি আছে নিশ্চয়। দ্য এশিয়ান- একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বলে কথা। একটা ট্রাফিক সিগন্যালে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল গাড়িটা। তারপর আবার এগিয়ে চলল। দুপাশে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং। কতগুলো ফ্লোর হবে কে জানে ? দুপাশে অজস্র গাড়ি। তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়িটা। 
মাঝে গনেশন একবার বলল, আপ বাঙালি হ্যায় না?
-হাঁ।
-হমারা বস্ মীন সিইও ভি বাঙালি। 
-আদমী?
-নেহি। আউরৎ। লেকিন বহোৎ মেজাজী। ম্যায় তো ফোর্থ ক্লাস হুঁ। ইসলিয়ে পাশ নেহি গ্যয়া। দূর সে দেখা। বলতে বলতেই গাড়িটা জুহুর মেরিন ড্রাইভের ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল। রাস্তাটা মসৃন। মানে কোথাও খানাখন্দ বলতে নেই। গাড়ি আশি - একশোতে ছুটলেও কোনও ঝাঁকুনি লাগছেনা। ডানদিকে নীল আরব সাগর আর তার বেলাভূমিতে অজস্র রঙিন মানুষের ভিড়। কেউ বলে মুম্বাই এক আজব নগরী। বেচারা বচ্চন ( অমিতাভ ) কলকাতায় পাত্তা করতে না পেরে মুম্বাইতে এসে বিরাট এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।‌
স্বপ্ন সে দেখে। কর্পোরেট জগতের। সুন্দর পিচাইয়া কি তার থেকেও ওপরে উঠতে হবে তাকে। গাড়িটা একটা বড় বিল্ডিং এর সামনে এসে থামল। দুজন সিকিউরিটি গার্ড লোহার গেট খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল। 

গনেশন সিকিউরিটির খাতায় লেখালেখি করে তার কাছে ফিরে এসে ফিরে এসে বলল, চলিয়ে সাহাব।
-সাহাব নেহি, রোহিত।
-ম্যায় তো ফোর্থ ক্লাস হুঁ!
-ওসব ছোড়িয়ে। মিত্র শোচিয়ে। 
-ঠিক হ্যায়--

গাড়ি থেকে নেমে বেশ বড় একটা লাউঞ্জ পার হয়ে ওরা লিফটের সামনে এসে থামল লিফট এখন টপ ফ্লোরে আছে মানে একশো দুইয়ে -তার অর্থ এই শ্রীরাম হাইটসে একশো দুটি ফ্লোর আছে। আর ওদের অফিস ছাপ্পান্ন তলায়। 

লিফট গ্রাউন্ডে এসে থামল। বেশ কয়েকজন কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এল লিফট থেকে। ওরা কোন ভাষায় কথা বলছে কে জানে?
গনেশন লিফ্টম্যানকে বলল, ফিফটি সিক্স।

একটার পর একটা ফ্লোর পার হয়ে চলল লিফট। রোহিত কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। স্বপ্নকে ছুঁতে পারার একটা রোমান্টিকতা এবং ভয় দুটোই একসঙ্গে তার বুকের  ভেতর ধুকপুকুনি শুরু করেছে।
এইচ আরও হেমন্ত সাকসেনা রোহিতের কাগজপত্র দেখে নিয়ে বললেন, শোচিয়ে মত্। নিয়োগপত্র মিল গিয়া, জয়েনিংভি হো গিয়া। অব আপকা বিশ্রাম কি জরুরৎ হ্যায়। 

কলিং বেল টিপতেই পিয়ন টাইপের একজন লোক এসে হাজির হল। হেমন্তবাবু তাকে বললেন, সাহাবকো হমারে রেসিডেন্সমে লে যাও। রুম নাম্বার সেভেনটিন সাহাবকা রেসিডেন্স হ্যায়। চাবি লো আউর সাহাবকো সবকুছ সমঝা দেনা। 
লোকটা চাবি নিয়ে রোহিতকে বলল, আইয়ে জী, ম্যায় হুঁ রাজ শ্রীনিবাসন, কেরলসে আয়া।
-ম্যায় রোহিত আঢ্য । পশ্চিম বঙ্গালসে।
হাতজোড় করে নমস্কার করল রোহিত। লোকটা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি হাতদুটোকে বুকের কাছে এনে বলল, নমস্তে সাহাবজী।

বেশ কয়েকটা ঘর পার হয়ে একটু ফাঁকা মতো জায়গায় দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে সমুদ্রটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আদিগন্ত নীল জলরাশি। বিকেলের সোনালী রোদ যেন মায়াবী আলোয় রাঙিয়ে দিয়েছে নীল সমুদ্রকে। পাশেই একটা ক্যান্টিন। কিছু স্ন্যাকস্, চা এবং লস্যির ব্যবস্থা রয়েছে বলে মনে হল।

শ্রীনিবাসন রোহিতকে বলল, লস্যি লিজিয়ে না সাহাব, মুম্বাইকা লস্যি বহুত মিঠা হোতা হ্যায়। 
-ঠিক হ্যায়, লিজিয়ে। লেকিন খর্চ ম্যায় দুঙ্গা। 
-ও সাহাব, আপকো খাতিরদারি করনেকা মওকাভি নেহি দেঙ্গে? বাঙালি লোগ বহুৎ ঈমানদার হোতা হ্যায় য্যায়সে বিবেকানন্দ, সুভাষ বোস কি মাফিক।

বিবেকানন্দ, সুভাষ- বাঙালির আইকন। কিন্তু আজ দুনিয়ার সেরা ধান্দাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্তরা হল নব্য বাংলার আইকন। 

শ্রীনিবাসন দুগ্লাস লস্যি নিয়ে এল। সমুদ্রের দিকে চেয়ে রয়েছে রোহিত। বেশ ভালো লাগছে ওর। শ্রীনিবাসন লোকটাও বেশ। কতো তাড়াতাড়ি একজন অপরিচিতকেও বন্ধু বানিয়ে নিতে পারে।

শ্রীনিবাসন ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় কি আছে সেটাও বুঝিয়ে দিল। রোহিত দেখল ব্যবস্থা বেশ উত্তম। একটা বেডরুম, ড্রয়িং, কিচেন, আ্যটাচড্ ওয়াশরুম- সবই আছে। সমুদ্রের দিকে খোলা বারান্দা। কাকে ধন্যবাদ দেবে? ভাগ্যকে না দ্য এশিয়ানকে? অবশ্য তার ভাবনাটা ভেবেছিলেন সুমন্তবাবু। সুযোগটা এনে দিয়েছিলেন তিনিই । একটু ফ্রেশ হওয়ার পরে স্যারকে ফোন করে প্রনাম জানিয়ে বলল, স্যার আপনি যদি এটাকে আমার উন্নতির প্রথম ধাপ বলেন তো এর কারিগর আপনিই। আপনার জন্যই এখানে আসতে পেরেছি। 
-ব্রাভো, মাই বয়। তোমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। আরও, আরও--
অনেক কিছু বললেন স্যার। 
স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে বাবা মাকেও ফোনে প্রনাম ও কুশল জানাল সে। সবশেষে সায়ন্তিকা। ও ফোন ধরেই বলল, যাক বাবা মনে পড়েছে। 
-হ্যাঁ, পড়েছে। কিন্তু- 
-কিন্তু আবার কি ? তুই না বড্ড ভীতু। 
-না রে, তা নয়। আসলে- একা এই এতো দূরে আরব সাগরের তীরে আমি খুঁজে ফিরি যারে-
-এই সাবধান, আর কাউকে খুঁজছিস না তো?
-যাহ্! তুই না বড্ড বেরসিক। তোর সঙ্গে আর কথাই বলবনা। কলটা কেটে দিল রোহিত। এবার ফোন করল সায়ন্তিকা। বলল, প্লীজ রাগ করিসনা। জানিসই তো, আমি ঠিকঠাক কথা বলতে পারিনা। 
-জানি বলেই রাগ করিনি। এখন রাখি। সারাদিন খুব ধকল গেছে। এখন স্নান করতে হবে। 
-বেশ রাখছি। তুই ভালো থাক। 
আর কোনও কথা হলনা। স্নান সেরে বুঝতে পারল এবার ক্ষিদে পেয়েছে। ফুড সাপ্লাইয়ের চেইনের একটা নাম্বার দিয়েছিল শ্রীনিবাসন। সেটায় ফোন করতেই ওরা খাবার দিয়ে গেল। বেশ সুস্বাদু। তবে ঘরানাটা কোন্ প্রদেশের মনে করতে পারলনা। 

পরদিন ঠিক দশটাতেই ও অফিসে এসে আ্যডমিনিস্ট্রেশনে আসল। অফিসার জগন্নাথ সুব্রহ্মণম যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। বললেন, আপ রোহিত আঢ্য?
-ইয়া।
-আপকো রেগুলার ইহা আকে রেজিস্টারমে সিগনেচার করনে পড়েগা। উসকে বাদ আপকা প্লানিং সেকসনমে-- আপকা সিনিয়র ভূপেন্দ্রজী আপকো হেল্প করেগা। কোঈ দিক্কত হোনেসে মুঝে ফোন করনা। 

ফোন নাম্বারটা নিল রোহিত। 
অফিসের সাজানো গোছানো ঝাঁ চকচকে পরিবেশ বেশ ভালো লাগে তার। বেশ কয়েকটা সেকশন পার হয়ে প্লানিং আ্যণ্ড ইনফরমেশন সেকশনে এল সে। সিনিয়র অফিসার ভূপেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ হতেই বুঝতে পারল অমায়িক ভদ্রলোক তিনি। বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা। কিন্তু বিয়ে করেছেন মালদা জেলার একটি মেয়েকে। মেয়েটি ট্রেনে ভিক্ষে করত। পুলিশ এবং স্টেশনের হকারদের দ্বারা অত্যাচারিত হত। যাওয়া আসার পথে একদিন বলেছিলেন, "তুই যদি একটা সম্মানজনক কাজ পাস, করবি? মেয়েটি রাজী হয়েছিল। এক প্রাইভেট স্কুলে সাফাইয়ের কাজ। লেখাপড়া শেখার ইচ্ছেও হয়েছিল তার। শেষ পর্যন্ত ভুপেন্দ্রবাবুই ব্যবস্থা করলেন। তারপর একদিন দ্য এশিয়ানে চাকরি পেলেন। মেয়েটিকে নিয়ে পড়লেন আতান্তরে। কি করা যায়? অগত্যা মেয়েটিকে বললেন, তুই বিয়ে করবি?
-আপনি বললে করব।
-কেন তোর নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছে বলে কিছু নেই?
-না। আপনি সাহায্য না করলে এতদিনে আমাকে শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেয়ে নিত। তাই আপনি যা বলবেন-- 
মেয়েটি জানতে চায়নি কাকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু মন্দিরে গিয়ে বরকে দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। ওর পায়ে পড়ে কেঁদে বলেছিল, আপনি মানুষ না, ভগবান। 

সে একটা গল্প বটে। তবে মানুষটা ভালো সেটা সে অনেকের মুখেই শুনেছে। অফিসের যে কেউ বিপদে পড়লেই ভূপেনদাদা হাজির। 
বেশ কয়েকদিন হল সে কাজে যোগ দিয়েছে।‌‌ কিন্তু এখনো তার বস্ সিইও'র সঙ্গে দেখা হয়নি। নাম শুনেছে। ওনার নাম গার্গী বোস। বাঙালি। তবে মিস্ না এসএমটি  জানেনা। কারণ নামের আগে তিনি কিছু লেখেন না। অফিস কলিগদের মুখে শুনেছে বেশ সুন্দরী, এবং মেজাজী। কাজের ব্যাপারে তেমন তাড়াহুড়ো নেই। তবে ভুল হলে ছেড়ে কথা বলেননা। 
সেদিন একটা মেসেজ পেল রোহিত। চেয়ারম্যান এবং সিইও ঠিক দুটোের সময় ফিনান্স আ্যণ্ড প্লানিং নিয়ে কিছু বলতে চান। তাই ওই দুই সেকসনের অফিসারদের দুটোর মধ্যে মিটিং হলে উপস্থিত থাকতে হবে। 
রোহিত ভাবল, যাক এবার দেখা হবে। তবে এই ক'দিনের মধ্যে একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে কিছু আউটলাইন তৈরি করেছে। যদি সে ব্যাপারেে গ্রীণ সিগন্যাল পাওয়া যায় তবেই এগোবে সে। এ ব্যাপারটা ভূপন্দ্রবাবুকে বলা যেত। কিন্তু ব্যাপারটা হল, প্রেজেন্টেশনের ওপরে এর সাফল্য নির্ভর করছে। 
ঠিক দুটোতেই ওর প্রজেক্ট ফাইল এবং একটা পেনড্রাইভ নিয়ে মিটিং হলে এল রোহিত। সিইও গার্গী বোস যে বাঙালি তার কথাবার্তায় তা বোঝার উপায় নেই। হিন্দি এবং ইংরেজিতে চোস্ত। এমনকি অন্যান্য ভাষাতেও। সুন্দরী এবং স্মার্ট। পোশাক পরিচ্ছদেও। তবে বয়স বলা যাবেনা। আলাপ পরিচয়ের পরে সিইও রোহিতকে বললেন, আপনি বাঙালি এবং আপনি বলছেন প্রজেক্টটা সাকসেস হবে?
-হোয়াই নট? কেন হবেনা?
-আসলে এতোটা আত্মবিশ্বাস সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায়না। ঠিক আছে, ইউ মে গো ফরওয়ার্ড। আপনি এগিয়ে চলুন। আমি একটা আ্যপ্রুভ অর্ডার পাঠিয়ে দেব। 

পরদিন অফিসে এসেই আ্যপ্রুভ অর্ডারটা পেয়ে গেল রোহিত। ওর প্রজেক্টের বিষয় দ্য এশিয়ানের সমস্ত প্রডাক্টগুলোকে একই ছাতার তলায় রেখে পাবলিসিটির ব্যবস্থা করা। তার জন্য একটা গাইড লাইন তৈরি করা। বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সে একটা টিম তৈরি করল। আর সমস্ত ব্যাপারটা তার মস্তিষ্ক প্রসূত বলে অন্যান্যরা তাকেই টিমলীডার হতে বলল। সে যে নতুন কিছু একটা করতে চায়, তার কোম্পানিকে সেরাটা দিতে চায় এটা সে বোঝাতে পেরেছে। 

সেদিন দুপুরে বস্ তথা সিইও গার্গী বোসের চেম্বার থেকে একটা কল এল। এক্ষুনি যেতে হবে। কি ব্যাপার বুঝতে পারলনা রোহিত। যেতেই হবে। বস্ বলে কথা। রেগে গেলে যদি যদি চাকরি থেকে নট করে দেয়? 
কি বলবে গার্গী বোস?
ওর চেম্বারে আসতেই ডোর কিপার বলল, আপ অন্দরমে যাইয়ে। আপকো জরুরী এত্তেলা দিয়া গ্যয়া। 
জরুরী এত্তেলা? কিন্তু কেন?
বুকটা কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। দরজা ঠেলে বলল, মে আই কাম ইন?
-আইয়ে। ম্যায় আপকি ইন্তেজারমে থী। ও হো, আপনি তো বাঙালি। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। বসুন। 

রোহিত বসল। বেশ আরামদায়ক ব্যবস্থা। পায়ের তলায় নরম গালিচা। ঘরে একটা নরম আলো। আর তার মাঝে সুন্দরী বস্। 
কি বলবেন? বসার পরেও বুকের মধ্যে ঢিপঢিপানি রয়ে গেছে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু কারণটা এখনো বলেননি। 
-কোন্ কারণটা? ও হো! আপনাকে ডেকেছি কেন? কারণ আছে। তবে সেটা এখনি বলা যাবেনা। লাঞ্চ করেছেন?
-না। দুটোর সময় ক্যান্টিনে গিয়ে করে নেব। 
-দরকার নেই। আমি লাঞ্চ আনিয়ে রেখেছি। 
-না মানে--
-না, মানের-- দরকার নেই। আসুন, বসের সাথে লাঞ্চ করতে আপত্তি আছে নাকি? 
-না, তা নেই। 

গার্গী বোস কলিং বেল টিপে ডোর কিপারকে বললেন, এখন তিনি লাঞ্চ করবেন। কেউ যেন না আসে। সিইও'র চেম্বারের সঙ্গেই একটা রেস্ট রুম। সেখানে ছোট একটা বেড, চেয়ার, টেবল, এবং প্রসাধনের সব ব্যবস্থাই ছিল। 
-বসুন। আপনি এখানে চাকরি করতে এসেছেন, আমিও তাই। আপনি চান সেরাটা দিতে, আমিও তাই। সেই সঙ্গে বস্ আর অধস্তনের সীমারেখাটাও আমি ভেঙে ফেলতে চাই। তাছাড়া আপনিও বাঙালি আমিও বাঙালি। সুতরাং-- খাবারটা দুটো প্লেটে সাজিয়ে নিল গার্গী বোস। ভাত, ডাল , পাঁচমিশালি সবজি এবং মাছের কালিয়া। গন্ধটাও বেশ। বিশুদ্ধ বাঙালিখানা বলেই মনে হচ্ছে। প্রায় দিন পনের হল এসেছে এখানে। হোটেল ক্যান্টিনের রান্নাও যেন একঘেয়ে। নিজেকে এখন ভাগ্যবান বলে মনে হল তার। সুন্দরী বস্ তাকে তাঁর নিজস্ব চেম্বারে ডেকে এনে লাঞ্চ করাচ্ছেন; একি কম সৌভাগ্যের ব্যাপার? কিন্তু মনের কোণে একটা সন্দেহও উঁকি দিচ্ছে। তাকে এতো তোয়াজ কেন? কোনও দুরভিসন্ধি নেই তো? আবার পরক্ষণেই মনে হয়, দূর, তা কেন হবে । তার প্রজেক্টটা বসের ভালো লেগেছে তাই। 
খাওয়ার শেষে ওই বিশেষ ঘর থেকে চলে আসছিল রোহিত। গার্গী বোসই বললেন, এখনো লাঞ্চ টাইম শেষ হয়নি। সুতরাং আপনি রেস্ট নিতেই পারেন। তবু একটু ইতস্তত করছিল সে। বসের সাথে এতখানি অন্তরঙ্গতাকে কি তার সহকর্মীরা ভালো চোখে দেখবে? মানুষের বাঁকা দৃষ্টির ধার যে বেশি। জীবনটাকে কেটে ফালা ফালা করে দেয়। 
আসলে কি জানেন-- বলতে বলতে নিজের মেকাপটা ঠিক করে নিচ্ছিল গার্গী- আমি তো এখানে একা। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে খুব বোর ফিল করি। তখন নিজের ভাষাভাষী কাউকে পেলে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। তাই আপনাকে এতো তোয়াজ করছি। 
-কি যে বলেন, আমি এক অতি সাধারণ-- 
-স্টপ ইট। সাধারণ ভাবলে চলবেনা। নিজেকে একস্ট্রা অর্ডিনারি ভাবতে হবে। নিজের কাজ দিয়ে প্রমান করতে হবে, আমি সাধারণ নই, অসাধারণ। 

সামনে ফিরল গার্গী। হাঁ, ওকে দেখে তাই মনে হয়। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয় সে। হয়তো বসিং করার জন্যই জন্ম ওর। 
কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর নিজের ডেস্কে ফিরে এল সে। না, তার কলিগরা তার এই বেশ কিছুক্ষণের অনুপস্থিতির জন্য কোনও প্রশ্ন করলনা। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। তার প্রজেক্টের ব্যাপারে টিমমেম্বারদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছে। তারা এখন নিজেদের মতো করে ভাববে। দুদিন পরে সবাই মিলে একটা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেবে। এ পর্যন্তই ঠিক হয়ে আছে। 
কিছুক্ষণ কম্পিউটারটা ঘাঁটাঘাঁটি করল। কয়েকজনের সঙ্গে অনলাইনে মিটিং করল। কিন্তু কাজটা যেন এগোলনা। বারবার গার্গী বোসের সঙ্গে লাঞ্চ করাটা নিয়ে একটু এলোমেলো ভাবনা আসতে লাগল। কখনো মনে হল বস্ হয়তো স্টাফের সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করতেই পারেন। কিন্তু এতখানি অন্তরঙ্গতা আশা করা যায় কি? এমনকি তার পার্সোনাল রুমে বাইরের কাউকে? কিন্তু বস্ তাকে মোটিভেট করার চেষ্টা করেছে। আজ হঠাৎ সায়ন্তিকার কথা মনে পড়ল। 
  
সায়ন্তিকা তাকে মোটিভেট করতে চায়নি। মোটিভেটেড হতে চেয়েছে। বসিং করতে চায়নি। তবু গার্গী বোসকে ভালো লাগছে তার। তাহলে সেকি সায়ন্তিকার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে? ইতিমধ্যে অনেকখানি সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। তবে অফিসের ভেতর থেকে সন্ধ্যে হয়েছে কি দিনের আলো আছে তা বোঝা যায়নি। প্রায় আটটা। কাজ করতে করতে সময়টা দেখতেও ভুলে গেছে সে। কেয়ারটেকার এসে মনে করিয়ে দিতেই বলল, হাঁ তাইতো। লিফট্ বেয়ে অফিসের বাইরে এল সে। না-- মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাট দেখে কেউ বলবেনা যে রাত্রি। এখানে মধ্য রাত্রিতেও শহর পুরোপুরি জেগে থাকে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে জুহুর সমুদ্র সৈকতে এসে বসল। সামনে আদিগন্ত নীল সমুদ্র। তবে রাতের বেলায় সমুদ্রকে নীল বলে মনে হয়না। মুম্বাইয়ের এই এলাকায় দিন ও রাতের মধ্যে কোনও ফারাক থাকেনা। নানা রকমের মানুষ-- দেশী ও বিদেশী, সবাই সমুদ্রতীরে হাজির হয়েছে। নানা রকমের মোটর চালিত নৌকায় সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। আর মাঝ সমুদ্র থেকে সাদা ফেনার মুকুট পড়ে এক একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরভূমিতে। 
হঠাৎ মনে পড়ল বাবা মায়ের কথা। গত দুদিন ভালো করে কথা বলা হয়নি ওদের সঙ্গে। আজ বলল। অনেক কথা। প্রথমে মায়ের সঙ্গে, পরে বাবার সঙ্গে। তবে ওর বিশেষ উৎকণ্ঠার কথা কাউকে বললনা। এমনকি সায়ন্তিকাকেও না। শুধু বলল, বেশ ভালো আছি। 
মুম্বাইয়ের কয়েকটা ছবিও পাঠাল ওদের। সায়ন্তিকা বলল, তুই ভালো থাকলেই আমার আনন্দ। 
-সত্যি বলছিস?
-সত্যি না তো কি? তুই কি বিশেষ কিছু ভাবছিস?
-না তো। নতুন চাকরি। বুঝতেই পারছিস; এখনো অফিসের ব্যাপারস্যাপার ভালো করে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। সেজন্য একটু চাপে আছি- এই আর কি!
-বেশ আজ আর বকবক করবনা। তুই আনন্দে থাক এবং ভালো থাক। এটাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। 
না, আর বেশি কথা হলনা। মোবাইলটা অফ করতে গিয়ে দেখল, দশটা বেজে গেছে। তবে মুম্বাইয়ের ক্ষেত্রে এটা সন্ধ্যে রাত। 

উঠে পড়ল সে। কিছুটা হাঁটতেই একটা বাজার পেল সে। সাবান, টুথপেস্ট এবং এবং কিছু শুকনো খাবারের দরকার ছিল। সেগুলো নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেসিডেনসিয়াল আ্যপার্টমেন্টে এল রোহিত। 
সিকিউরিটি গার্ড বলল, আপ পায়দলমে গিয়া থা ? 
-নেহি। অফিসকা কারমেই গিয়া থা। লেকিন ঘুমনেকে বাদ পায়দলমেই আগ্যয়া। 
গার্ডরা আর কিছু বললনা। 
ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে বসেছে এমন সময় কলিং বেলের টুং টুং আওয়াজ হল। খুলতেই দেখে ফুড ডেলিভারির লোক। 
লোকটা একগাল হেসে বলল, আপ ক্যায়সে হ্যায় সাব? খানা আচ্ছা হ্যায় কেয়া?
-ঠিক হ্যায়। লেকিন নমক থোরা জাদা থা। 
-জাদা থা ? ম্যায় কুককো বতা দেঙ্গে। কালসে আচ্ছা হোগা নেহি। টাকা দিয়ে খাবারটা নিল রোহিত। না, আজ বেশ হয়েছে। ঘ্রাণেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। খাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে যথারীতি সবাইকে ফোন করল। শেষে ঘুমাবার চেষ্টা করলেও সফল হলনা। পায়ে পায়ে উঠে এল। ওদের বিল্ডিংটা শুধু মাত্র মেল রেসিডেন্টদের জন্যই। সবাই দ্য এশিয়ানেরই কর্মী। মোট বারোটা ফ্লোর রয়েছে। চারপাশের বিল্ডিংগুলোর থেকে এটাই কম ফ্লোরের। লিফট্ তখনও সচল ছিল। টপ ফ্লোরে উঠে এল রোহিত। সমুদ্রকেও এখান থেকে বেশ দেখা যায়। রাত্রি প্রায় বারোটা। তবু সমুদ্র সৈকতে তখনও লোকের ভিড় কম ছিলনা। হঠাৎই মোবাইলটায় রিং হল। দেখল গার্গী বোস। বস্! সুতরাং ধরতেই হল। 
-হ্যালো, ম্যাডাম বলুন-- 
-কি ব্যাপার, দুপুরের পর থেকে দেখা করেননি যে- 
-আসলে ওই প্রজেক্টের ব্যাপারে টিমমেম্বারদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম।
-খুব ভালো কথা। আপনার এই একাগ্রতা দেখে খুব ভালো লাগছে। একটা কথা, অফিসে আমি বস্ হলেও এমনিতে তো বন্ধু হতে পারি, নাকি?
-তা না হওয়ার কোনও কারণ নেই। 
-মুখে বলছেন। অথচ প্রয়োজনে আমাকে ভুলে যাচ্ছেন। নতুন স্টাফদের কোম্পানি থেকেই কিছু আ্যডভান্সের ব্যবস্থা করা হয়। কালই ফিনান্স সেকসনকে একটা নোট দেব। 
-না, ম্যাডাম এতোটা দরকার হবেনা। 
-কোনো কথা নয়। কাল ডিউটি শেষে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। গুডনাইট। ফোনটা কেটে দিল গার্গী বোস। কথা বলার সুযোগই দিলনা। 

রোহিত ভাবল, গার্গী বোস তার প্রতি এতটা দয়ালু কেন? ম্যাডাম কি তার মার্কেটিং করা দেখেছে? গার্গী বোস কি সব স্টাফের ব্যাপারেই এতোখানি খোঁজ খবর রাখেন? না, শুধু তার ব্যাপারেই? এমনিতে ওনার সান্নিধ্য মন্দ লাগেনা। কিন্তু বস্ বলে কথা। তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ভালো দেখায় না। একটা সীমারেখা থাকা দরকার। কিন্তু উনি বন্ধুত্ব চান?

পরদিন কাজের মধ্যেই ডুবে রইল রোহিত। প্রজেক্টের আউটলাইন আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখন সেটা কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সেটাই টিম মেম্বারদের বোঝানোর চেষ্টা করছিল সে। মেম্বাররা নিজেরা কিছু ভেবেছিল বটে, তবে শেষ পর্যন্ত রোহিতের পরিকল্পনাকেই গ্রহন করল। এখন এই পরিকল্পনাকে কিভাবে বাস্তবায়িত করা যাবে তারও রূপরেখা তৈরি করল। যদিও হাতে এখনও তিনদিন সময় আছে তবু সে তাড়াতাড়িই শেষ করতে চাইল। এসব করতে করতে কখন যে লাঞ্চ টাইম এসে গিয়েছিল তা বুঝতে পারেনি। সহকর্মীরা একে একে ক্যান্টিনে গিয়েছিল। কিন্তু কম্পিউটারের সামনে বসেই ছিল রোহিত। হঠাৎই গার্গী বোসের কথা মনে হল তার। বস্ তার প্রতি একটু বেশিই আগ্রহী। সেটা মন্দ নয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল সে সায়ন্তিকার জায়গায় আর কাউকে ভাবতে পারছেনা সে। এদিকে আবার কাজের সুবাদে বস্ এর সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটাও জরুরী। পরিস্থিতিটা কোন্ দিকে যাবে কে জানে! যা হয় হবে! দেখাই যাক-- উঠতে যাবে, এমন সময় দেখে অফিসের অপর প্রান্ত থেকে হেঁটে আসছে গার্গী বোস। যারা তখনও ডেস্কে ছিল, তারা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল। রোহিতের দিকে এগিয়ে এল গার্গী বোস। বলল, আপনি এখনো লাঞ্চে যাননি?
 -এই উঠছিলাম- 
-আপনি তো কথা শুনবেন না। আসুন-- 

সহকর্মীদের উৎসুক চোখের সামনে দিয়েই বসের নিজস্ব কেবিনে গেল রোহিত। ইচ্ছে ছিলনা, আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারলনা। সেদিনের লাঞ্চে ছিল আলু বিরিয়ানি এবং কষা মাংস। এখানেও যে এতো ভালো রান্না করা খাবার পাওয়া যায় সেটা ভাবতে পারেনি রোহিত। বেশ ভালো লাগলো তার। বস্ যখন নিজের থেকে এতো কিছু করছে তখন তা প্রত্যাখ্যান করা উচিত হবেনা। গার্গী বোস বলল, খেয়ে নিন। একবার ওর দিকে চেয়ে দেখল রোহিত। ওকে বেশ সুন্দরী বলেই মনে হয়। সঙ্গে আধুনিকা। ব্লেজারের নিচে একটা ছোটখাটো টপ্। ফর্সা বুকের ভাঁজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। না, ম্যাডামের শরীর দেখানোতে কোনও কুণ্ঠা আছে বলে মনে হলনা। 
খাওয়া শেষ হল রোহিতের। 
গার্গী বোস বললেন, আপনার কিন্তু এই পোশাক এখানে চলবেনা। আজ আমার সঙ্গে কাজের শেষে আপনাকে বেরোতে হবে। 
-কিন্তু!
-কোনও কিন্তু নয়। আই আ্যম ইওর ফ্রেণ্ড আ্যণ্ড আই লাভ ইউ। 

শেষের কথাটা চারদেয়ালের মধ্যে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে লাগল ওর দুই কানে। বস্ তাকে ভালোবাসে! সামান্য একজন কর্মীকে? এতো অসম্ভব প্রাপ্তি! রাজ্য এবং রাজকন্যা একসঙ্গে! রোহিত স্তম্ভিত, মুগ্ধ। অনেক কিছু বলতে চাইছে সে। কিন্তু পারছেনা। জিভটা বুঝি আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। 

নিজের ডেস্কে এল সে। টিম মেম্বাররা এখনো আসেনি। গার্গী বোসের কথাটা এখনো তার কানের কাছে বেজে চলেছে। না, এর আগে এতখানি অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কেউ তাকে কাছে টেনে নেয়নি। কি আছে তার মধ্যে , যার জন্য এক সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট, উচ্চপদস্থ কর্মরতার তাকে ভালো লাগলো? সময়টা কখন কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারলনা রোহিত। বেশ কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে। বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। মাথাটা কেমন যেন ধরে এসেছিল। চুপচাপ শুয়ে রইল সে। একটু চা পেলে ভালো হতো। আ্যপার্টমেন্টের ক্যান্টিনে চা এবং স্ন্যাকসের অর্ডার দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এবং ভুজিয়া নিয়ে এল  প্রায় দশ বারো বছরের একটি ছেলে। 
রোহিত ওকে ডেকে বসাল। জিজ্ঞেস করল, তুমহারা নাম কেয়া?
-সত্যানন্দ। বিহার কি এক গাঁওসে আয়া। 
খুব অভাব ছিল ওখানে। তিনভাই। সে বড়। তারই দায়িত্ব। মাসে মাসে টাকা পাঠায় সে।‌‌যার এখন লেখা পড়া শেখার কথা- সে এখন চায়ের দোকানে! সমগ্র ভারতে কতো কতো শিশুর যে চায়ের দোকানে শৈশব কাটে, কে জানে? চা এবং ভুজিয়ার দাম দিতেই চলে গেল সত্যানন্দ। 

চা টা খেয়ে এখন মাথাটা বেশ ফ্রেশ মনে হল। জানালাটা খুলে দিতেই দেখল নীল সমুদ্র আর অজস্র রঙিন মানুষের ভিড়। 
কমার্স নিয়ে পড়ার সময় অন্য স্ট্রিমের বন্ধুরা বলত ওদের নাকি শিল্পবোধ নেই। মানুষের দুঃখ, কষ্ট, অসহায়তা-- এসব ওদের চোখে পড়েনা। ওরা নাকি টাকাপয়সা সংক্রান্ত নীরস বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মনে মনে একটু হাসলো সে। মানুষের জীবনবোধ নিয়ে তার ভাবনা কম নয়। কিন্তু সেটা একজন শিল্পী সাহিত্যিকের মতো করে প্রকাশ করতে পারেনা। রাজনৈতিক নেতাদের মতো মিথ্যে ভড়ং দেখাতে পারেনা। সে এটা বুঝতে পেরেছে যে টাকা না থাকলে সব 'বোধ'ই মিথ্যে হয়ে যায়। 

আজ আবার বেরোতে হবে গার্গী বোসের সঙ্গে। গার্গী বোস তার বন্ধুত্ব চায়। আপত্তি নেই। কিন্তু ও হল বস্। আর সে তারই অধস্তন কর্মী। বন্ধুত্বের কারণে সেই সীমারেখাটা মুছে গেলে সমীকরণটা কেমন হবে কে জানে?

রাত্রি প্রায় আটটা। তবে রাত্রি না বলে সন্ধ্যে বলাই ভালো। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। হঠাৎই মোবাইলে একটা মেসেজ দেখে উঠে পড়ল।" আই আ্যম আ্যট ইওর ডোর স্টেপ।" বস্ মানে গার্গী বোস তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্যান্ট শার্টটা পড়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো।

ম্যাডাম ওর জন্য ওয়েট করছে। না জানি এবার কি হবে! আ্যপার্টমেন্টের বাইরে এসে একটা দুধ সাদা মার্সিডিজ বেঞ্জ দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্টিয়ারিংয়ে স্বয়ং গার্গী বোস। কাছে আসতেই গাড়ির দরজাটা বাঁ হাত দিয়ে খুলে দিলেন তিনি। 
-এক্সকিউজ মি!
-নো এক্সিকিউশান। কাম ইন। 
ম্যাডামের পাশেই বসতে হল। ভিতরটা বেশ ঠাণ্ডা এবং একটা মিষ্টি গন্ধে ভরা। 
-ঘুমাচ্ছিলে ? 
-হ্যাঁ, এরজন্য দুঃখিত। 
-হোয়াই? 
-আপনাকে ওয়েট করতে হল এর জন্য।
-ও হো, এরজন্য!

হাসল গার্গী। এখন ওকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছে। ব্লু জিনস এবং ওপরে একটা সাদা রঙের টপ। না টাইট ফিটিং নয়। ওতে ওর বুকের সৌন্দর্যটা যথেষ্ট অনাবৃত। চুলগুলোও খোলা। বেশ উড়ছে। কিছুটা ছোঁয়া বাঁচিয়ে বসেছিল রোহিত। কেমন যেন একটা সংকুচিত হয়ে। গার্গী বোসের মতো একজন মহিলা তার পাশে- এটা তার কল্পনারও অতীত ছিল। গাড়িটা মসৃন গতিতে এগিয়ে চলেছে। স্পীড কখনো পঞ্চাশ অথবা ষাট। ড্রাইভিংয়ে চোস্ত বলতেই হবে। হঠাৎই গার্গী তার বাঁ হাতটা রাখল ওর হাতে। বলল, আর ইউ আ্যকসেপ্টিং মি?
-হোয়াই নট ? 
-তাহলে এতো দূরে কেন ? আপনার কি কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে? 
-গার্লফ্রেন্ড ? কি যে বলেন -আমার মতো একজন চালচুলোহীন ব্যক্তির কে গার্লফ্রেন্ড হতে চাইবে?
-আমি তো চেয়েছি।
-সেটা আপনার বদান্যতা। আমি জানি, আমি আপনার-- 
-ডোনট্ সে ফারদার। 
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়িটা একটা শপিং মলে এসে থামল। মলের সিকিউরিটির লোকেরা এগিয়ে এসে পার্কিংয়ের জায়গাটা দেখিয়ে দিল। ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হল ম্যাডাম বেশ পরিচিত। 
ঝাঁ চকচকে একটা মল। এর আগে রোহিত মল দেখেনি এমন নয়। তবে এ যেন অনেক বড় ব্যাপার। শয়ে শয়ে লোক আসছে, যাচ্ছে। তবে সবাই গাড়িতে চড়েই। বাণিজ্যিক গাড়িও আছে, সেই সঙ্গে আছে ব্যক্তিগত গাড়িও। রিসেপশনে একজন সুন্দরী মহিলা বললেন, আইয়ে জী, বহোৎ দিনো কে বাদ-- 
হাসল রোহিত। এই মলে সে প্রথম এল। ওরা হয়তো এভাবেই সবাইকে রিসেপশন করে। 
চলমান সিঁড়ি। চলেই যাচ্ছে। উঠে দাঁড়ালো সে। গার্গী বোস ভারসাম্য রাখতে না পেরে রোহিতের হাত ধরতে বাধ্য হল। সে লক্ষ্য করল ম্যাডাম অনেক কাছে সরে এসেছে। পিঠের ওপরে ওর বুকের ছোঁয়া। ইতিপূর্বে কোনও মহিলা এতোখানি কাছে আসেনি। সিঁড়িটা যেখানে শেষ হল সেখানে আবার একবার ম্যাডামকে ধরতে হল। হাত ধরেই মলের ভেতরে প্রবেশ করল ওরা। রোহিতের মনে হল ম্যাডাম বুঝি তার কতো কাছের মানুষ। মাত্র অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে কতো আপন করে নিয়েছে। এখন সায়ন্তিকার মুখটা বুঝি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। 
হঠাৎই এক মহিলার সঙ্গে দেখা হল গার্গী বোসের। মহিলা হেসে বলল, হাই গার্গী কেমন আছো? 
-খুব ভালো। আপনি? 
-ভালো। তো ইনি?
-মাই ফ্রেণ্ড। রোহিত আঢ্য। 
"হাই" বলে মহিলা হাত এগিয়ে দিলে রোহিত বাধ্য হল করমর্দন করতে। ভদ্রমহিলা সাজপোশাকে বেশ বেপরোয়া। এখানে মহিলাদের দেখে মনে হয় তারা বুঝি শরীর দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। 
গার্গী বোস এগিয়ে এসে বলল, আজ ব্যস্ত আছি। বেশ কিছু মার্কেটিং করতে হবে। রোহিতকে একপ্রকার টেনে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল সে। মৃদুকণ্ঠে বলল, এই ধরণের মহিলাদের একদম পাত্তা দেবেননা। আশ্চর্য হল রোহিত। গার্গী বোস কি স্রেফ প্রেম চায়? না, আরও কিছু?
গার্মেন্টস সেকসনে আসে ওরা। এখানে শুধু মাত্র পুরুষদের জন্য। ঘুরে ঘুরে দুটো ব্লেজার, দুটো প্যান্ট এবং দুটো শার্ট পছন্দ করল গার্গী। রোহিতের গায়ে মাপ দিয়ে দেখল-- না, ঠিকই হবে বলে মনে হল তার। ট্রলিতে রেখে দিল সে। পুরুষদের বেশ কয়েকটি অন্তর্বাস, গেঞ্জি-- এসবও নিল । মহিলাদের পোশাক বিভাগে এসে নিজের জন্যও কিছু নিল। রোহিত ওর অনেকটা কাছে সরে এসে বলল, ম্যাডাম, আমি আপনার জন্য কিছু নিতে চাই। 
-ম্যাডাম নয়, গার্গী, ওনলি গার্গী। 
-কিন্তু আপনি যে আমার বস্।
-সেটা অফিসে। আর অফিসের বাইরে ফ্রেণ্ড, ওনলি ফ্রেণ্ড। আর আপনি নয়, তুমি। 
রোহিত গার্গীর দিকে চেয়ে থাকে। সীমারেখাটা বুঝি অষ্পষ্ট হয়ে আসছে। এখন থেকে আর আপনি বলা যাবেনা। বলতে হবে তুমি। সে বুঝি এক অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় গল্পের নায়ক। যা নাকি রূপোলী পর্দায় সম্ভব।
-আ্যই, হোয়াটস আর ইউ থিঙ্কিং? 
-কুছ নেহি।
-তব শোচতে কেয়া?
-আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? 
-হাসল গার্গী। বলল, না গো। আই অ্যাম ইওরস, চলো-- 
স্টেশনারি সেকসনে এল ওরা। গার্গী পুরুষদের প্রসাধনের জন্য অনেক কিছু নিল। ট্রলিটা ভর্তি হয়ে এসেছে প্রায়। ঠেলে ঠেলে সেটা কাউন্টারে নিয়ে এল। কাউন্টারের মহিলা কম্পিউটারে হিসাব লিখতে ব্যস্ত হল। পেমেন্ট আ্যপের মাধ্যমে টাকাটা মিটিয়ে দিল গার্গী। রোহিত এগিয়ে এসে বলল, আপনি, স্যরি তুমি পে করলে যে? আজই কোম্পানি আমাকে পঞ্চাশ হাজার আ্যডভান্স করেছে। 
-গুড নিউজ। আর এটা আমার বন্ধুত্বের উপহার। আপনি, স্যরি তুমি কি এটা স্বীকার করবেনা? অভিভূত রোহিত। এই অযাচিত, অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে স্বীকার করতেই হবে।

বন্ধুত্ব ক্রমশই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকল। গার্গী বোসের বন্ধুত্বে যতটা না নিখাদ প্রেম ছিল, তার থেকেও বেশি ছিল পাওয়ার বাসনা। না, টাকাপয়সা বা প্রেম নয়। বাসনা ছিল শরীরের। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি হলেও শারীরিক সৌন্দর্যে মনে হবে কুড়ি পঁচিশের মধ্যে। যার ফলে কমবয়সী ছেলেদের ফাঁদে ফেলতে পারত। আর ওর অপারেশনের কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেতনা। নিজে ওপরতলার অফিসার হওয়ার সুবাদে ওর জানাশোনাও ছিল প্রচুর। তবে একই পদমর্যাদার লোকেদের সঙ্গে ওর মেলামেশা ছিলনা। ও চাইত একটু গরীব এবং ট্যালেন্টেড ছেলেদের। তাদের নিখাদ প্রেম এবং শরীর দুটোই উপভোগ করত সে। রোহিত তার পঞ্চম শিকার। বেশ ভালো লাগছে তার। একটা রোমান্টিকতা আবহে রোহিতের নেশায় মশগুল সে। তবে কাজের ক্ষেত্রে একশো শতাংশ পেশাদার। তবে সন্ধ্যে হলেই চাই পুরুষের ‌সান্নিধ্য। তবে যে কোনও পুরুষ নয়। তার পছন্দের পুরুষ এবং যে শুধু তাকে নিয়েই ভাববে। 
বেশ কিছুক্ষণ আগেই রোহিতকে ফোন করেছে। আজ সানডে নাইট ক্লাবে যাবে বলে গার্গী ঠিক করেছে। শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। একটু নির্জন এলাকায়। শহরের ভিড় এবং কোলাহল দুটোই অনুপস্থিত। রোহিতকে আর একবার ফোন করতেই সে বলল, আমি গান্ধিজীর স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। 
-ঠিক আছে। আমি আসছি। 
কিছুক্ষণের মধ্যেই রোহিতের পাশেই একটা গাড়ি এসে থামল। এটা আগের গাড়িটা নয়। এটা হয়তো কোনও ট্যুরিষ্ট কোম্পানির গাড়ি। ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে। রোহিত আজ গার্গীর পছন্দের স্যুটিং পড়ে নিয়েছে। না, ওকে আর সেই আগের গরীব গরীব চেহারায় দেখা যাচ্ছেনা। বেশ সফিষ্টিকেটেড। গাড়ির দরজাটা খুলেই গার্গী বলল, খুব খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। এস। পাশে বসতেই ওকে একটা ছোট্ট কিস করল গার্গী। বেশ ভালো লাগলো রোহিতের। কোনও বিশেষ নারীর কাছ থেকে এটা তার প্রথম পাওয়া। না, সায়ন্তিকার কখনো এরকম দুঃসাহস হয়নি। তারও না। নির্জনে ওরা অনেক গল্প করেছে বটে, তবে শারীরিক স্পর্শ ছিলনা। গাড়িটা ছুটে চলেছে। কোথায় সে জানেনা। গার্গী অনেক কাছে সরে এসেছে। আজ আর ও জিনস টপ পড়েনি। একটা লঙ স্কার্ট আর টপ। দুটোই সাদা। চুলগুলোও খোলা। বেশ সুন্দর লাগছে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে ছোট্ট একটা টাউনশিপের পাশ দিয়ে ছুটতে লাগলো গাড়িটা। দুপাশে নানারকমের বাহারি ফুলের গাছ-- আর তার মাঝ দিয়ে পথ। গার্গীর চুলগুলো ওর নাকেমুখে এসে পড়ছে। কেমন যেন এক রোমান্টিকতায় ভেসে যাচ্ছে সে। সায়ন্তিকার কথা আজ বারবার মনে পড়ছে। তাকে নিয়ে অনেক রোমান্টিক স্বপ্ন দেখলেও সময় হয়নি ওর। বারবার বলেছে, এখন না। আফটার ম্যারেজ আই উইল গিভ ইউ অল অফ মাইন। লক্ষীটি, জেদ কোরোনা। 
না, সে জেদ করেনি। সে ধৈর্য্য ধরতে পারে। সায়ন্তিকা তো তারই। কিন্তু আজ মনে হয় সে বুঝি এক ভিন গ্রহের বাসিন্দা। আর গার্গী খুব কাছের; ছোঁয়া যায়, অনুভব করা যায়। 

গাড়িটা বিরাট একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। নিয়ন লাইটের সাইনবোর্ডে লেখা "সানডে নাইট ক্লাব" মেম্বার্স ওনলি। তাহলে ম্যাডাম নিশ্চয় এখানকার মেম্বার এবং নিয়মিত এসে থাকে। আসতেই পারে। সিইও। সুতরাং লাইফটাকে এনজয় করতেই পারে। এখানে আসা তার কল্পনারও অতীত ছিল। নেহাৎ ম্যাডামের সুনজরে পড়েছে বলেই। গাড়িটা ওদের নামিয়ে দিয়েই চলে যায়। ওরা ভেতরে এল। রোহিতের হাত গার্গীর হাতে। 
যেন কতো আপনজন। ডান্স ফ্লোরে তখন কি একটা ইংরেজি গান বাজছে। সেই গানের তালে তালে নারীপুরুষ একে অপরের কাঁধে কোমরে হাত রেখে বিশেষ রকমের ডান্স করছে। এরকম সে সিনেমায় দেখেছে। গার্গীকে দেখে অনেকেই হাই বলল। যেন সে সবার পরিচিত। রোহিতকে সে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। এখানে এসে রোহিতের নিজেকে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে হল। এরকম যে একটা লাইফ আছে, এটা সে ভাবতেই পারেনি কখনো। গার্গী প্রথমে নাইট ক্লাবের অফিসে গিয়ে কিছু কথা সেরে নিল। তারপর রোহিতকে নিয়ে এল ড্রিঙ্কস কিয়স্কে। সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাসে নানা রংয়ের পানীয়ে ভর্তি। মদ! রোহিত রোমাঞ্চিত। মদ কখনো খায়নি সে। কিন্তু আজ বস্ কে খুশি করতে-- গার্গী দুটো গ্লাস তুলে নিল। একটা রোহিতের হাতে দিয়ে বলল, চিয়ার্স!
-চিয়ার্স ! রোহিত একটু একটু করে গলায় ঢেলে নিল সবটা। বেশ ঠাণ্ডা। না, দেশী মদের মতো গন্ধ নেই। কিন্তু একটা ভালো লাগা আছে। 
পাশের একটা পাত্রে পকোড়া জাতীয় কিছু একটা ছিল। গার্গীর দেখাদেখি নিজেও দুএকটা তুলে নিল সে। বেশ সুস্বাদু। আরও দুটো গ্লাস নিল গার্গী। রোহিতকে বলল, টেক ইট। না, ফেরাতে পারলনা সে। আজ সে যেন ভেসে যেতে চায়। আজ সে তার আবাল্য লালিত আদর্শও ভুলে যাচ্ছে। গার্গী ওর কোমরে হাত রেখে বলল, লেট ডান্স। মৃদু এবং মায়াবী নীল আলোয় গার্গীর চোখে চোখ রেখে অন্যদের মতোই গানের তালে তালে নাচতে থাকল। কতক্ষণ হিসাব ছিলনা।‌এর আগে সে কখনো মদ খায়নি। তাই স্টেপগুলো একটু এলোমেলো হয়ে হচ্ছিল। এরই মধ্যে গার্গী আরও কয়েক গ্লাস খেয়েছে। সে আর নাচতে পারছেনা। ডান্স ফ্লোর থেকে চলে এল সে। ওর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে এক এক করে অনেকেই নিজেদের ঘরে চলে গেল। ক্লাবের কর্মীরা জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ একা একাই ফ্লোরে দাঁড়িয়ে রইল রোহিত। ও এখন সায়ন্তিকার সাথে মিলিয়ে দেখছে গার্গীকে। না, গার্গী অনেক বেশি সুন্দরী। অনেক বেশি হট। দরজাটা দিয়ে পোশাকটা খুলে ফেলল। গার্গীকে ভালো করে শুইয়ে দিতে গিয়ে দেখল, ও যেন বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ওর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল রোহিত। গার্গী জড়ানো গলায় বলছে, আই লাভ ইউ, আই--  লাভ-- ইউ-- 
গার্গীর পাশেই শুল সে। প্রায় নগ্ন গার্গী অনেক কাছে সরে এল। জড়িয়ে ধরল রোহিতকে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিল ওকে। এই প্রথম কোনও নারীকে একান্ত ভাবে কাছে পেল সে। উদ্দাম যৌনতায় ভেসে গেল ওরা। পরদিন সকাল হতেই ওরা দেখল, না নিজেদের মাঝে আর কোনও আড়াল নেই। সুতরাং বারবার অনেকবার মিলিত হল ওরা। 
 
রোহিত অনেকটাই অগোছালো হয়ে পড়েছে। নাইট ক্লাব থেকে ফিরে স্নান সেরে অফিসে আসল বটে -কিন্তু কাজে মন বসাতে পারলনা। সে কাজ করতে এসেছিল। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল-- বস্ এর নজরে পড়ে তার আদর্শ, একাগ্রতা সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বস্ এর সঙ্গে দেখা করবেনা-- তাই বা কি করে হয়! এই সংস্থায় ম্যাডাম গার্গীই তো তার হেড। সুতরাং তার নির্দেশ মতোই তাকে চলতে হবে। কিন্তু এভাবে চললে তার কর্মদক্ষতাও কমে যাবে। 
কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার গার্গী বোসের কথা মনে পড়তে লাগল। অন্যদিন লাঞ্চের জন্য ম্যাডাম ডাকত। কিন্তু সেদিন তখনও ডাকেনি। তাই একটু চিন্তায় ছিল।‌‌ লাঞ্চ ব্রেকের সময় ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে দেখল বস্ এর কেবিন বন্ধ। তার অর্থ নিশ্চয় বাইরে কোথাও-- ক্যান্টিনে খেতে খেতে শুনল-- বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপ ভিজিট করবে ম্যাডাম।তাই সেদিন আসেনি। 

পরপর কয়েকদিনই ম্যাডাম এলনা। মালয়েশিয়া গেছে। এই কয়েকদিন সায়ন্তিকার কথা ভাবল রোহিত। মনে করল গার্গীর কথা ভুলে যাবে। মনে করবে ওটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। 
কিন্তু তা সম্ভব হলনা। দিন পনের পরে ফিরল গার্গী বোস। আবার রোহিতকে ডাকল। না, কাজের কথা বললনা। বলল, কেমন আছো? আরও বলল, ডোনট্ ট্রাই টু ফরগেট! 
ওর ঘরে যেতে বলল।
ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু বস্ এর অর্ডার। সুতরাং যেতেই হল। গার্গী যেখানে থাকে সেটা একটা আবাসন। একটাই বিল্ডিং। মোট ছাব্বিশটি ফ্লোর রয়েছে। ম্যাডাম থাকে এইটটিনথ্ ফ্লোরের একশো বাহাত্তর নাম্বার ফ্ল্যাটে। না, খুঁজে পেতে দেরি হলনা। রাত্রি তখন প্রায় ন'টা। ফ্ল্যাটে একাই থাকে। তবে সর্বক্ষণের জন্য একজন মহিলা থাকেন তাকে সাহায্য করার জন্য। 
কলিং বেলের শব্দে স্বয়ং ম্যাডামই দরজা খুলল। একেবারে ঘরোয়া পোশাকে। একটা পাতলা সিফনের নাইটি-- ভেতরে অন্তর্বাস আছে বলে মনে হয়না। বুকের বেশ কিছুটা অনাবৃত। না, এরজন্য কোনও সংকোচ নেই। 
-অফিসের মিটিংয়ে হঠাৎই ম্যালেশিয়া যেতে হল। তোমাকে বলাও হয়নি। ভেতরে এস।‌‌ নাইটে এখানেই খেয়ে যাবে। 
রোহিত গার্গীর দিকে চেয়ে রয়েছে। বেশ কিছুদিন না দেখার পর ওকে বেশ মোহময়ী লাগছে। যেন সব পতঙ্গকেই ধ্বংস করতে পারবে সে। ম্যাডামের সান্নিধ্যে বেশ কয়েকঘণ্টা কেটে গেল। তবু ম্যাডাম যেন ওকে ছাড়তেই চায়না।
লিফট্ সার্ভিস বন্ধ হয় রাত্রি বারোটায়। তার আগেই রোহিত বিদায় জানিয়ে ফিরে এল। রাত্রেও বেশ কিছুক্ষণ গার্গী ওকে ফোন করল। ম্যাডামের পিপাসাটা যেন বেড়েই চলেছে। পরদিন অফিসে বস্ ওকে ডেকে পাঠাল। ভেবেছিল যাবেনা। কিন্তু ও হল বস্। তাই ওর ইচ্ছে অনুযায়ী সে চলতে বাধ্য। এখন অফিসের কাজের বদলে বস্ কে এন্টারটেইন করাই তার প্রধান কাজ। কয়েকদিন পরে ঠিক হল ম্যাডামের সঙ্গে তাকে গোয়ায় যেতে হবে। ম্যাডামের কিছু অফিসিয়াল কাজ সারার পর ওরা সমুদ্রতীর সংলগ্ন হোটেলে একদিন ছুটি কাটাবে। রোহিতের আপত্তি ছিলনা। কারণ সে কখনো গোয়ায় যায়নি। গোয়ার সুন্দর বেলাভুমির ছবি সে দেখেছে।
সেটা ছিল অক্টোবরের মাঝামাঝি। দিনটাও ছিল মনোরম। বিকেলের দিকে এল ওরা। খুব হট পোশাক পড়েছিল গার্গী। আর সে ছিল ক্যাজুয়াল পোশাকে। বেলাভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য মানুষ। মহিলারা বেশিরভাগই সুইমিং কস্টিউমে।‌‌ কেউ একটু জড়তায়, আবার কেউ কেউ উদ্দামতায় ব্যস্ত। সি বিচেই রয়েছে কিছু রেষ্টুরেন্ট। যেখানে মাছ এবং চিকেনের নানারকমের ফ্রাই সঙ্গে ড্রিঙ্কসের ঢালাও ব্যবস্থা। পড়ন্তু রোদে বেশ ঝলমলে দেখাচ্ছিল বেলাভূমি। ওরা দুটো চেয়ারে বসতেই স্টলের ছেলেটা কিছু ফ্রাই এবং দুটো রঙিন গ্লাসে বিদেশী ওয়াইন ওদের হাতে তুলে দিল। আরও, আরও খেল ওরা। এরই মধ্যে রোহিতের অলক্ষ্যে কি একটা ট্যাবলেট ওর গ্লাসের পানীয়ে মিশিয়ে দিল গার্গী। সে আজ খুব অন্তরঙ্গ। রোহিতের হাত ধরে সে এগিয়ে গেল উত্তাল সমুদ্রের দিকে। একজন বোট ওয়ালা এগিয়ে এল। বলল, আইয়ে জী। 
রোহিত বেশ কিছুটা নেশাগ্রস্ত হয়েছিল। পা-টাও টলছিল। কথাগুলোও জড়িয়ে যাচ্ছিল। সে বোটে উঠে বলল, গার্গী কাম। 
-আমি আসছি, তুমি শুরু করো। রোহিতের মোটর বোট চলতে থাকল। দুরন্ত গতিতে বড় বড় ঢেউ অতিক্রম করে বোটটা ক্রমশই এগিয়ে গেল উত্তাল গভীর সমুদ্রের দিকে। 
তীরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানাল গার্গী। না, রোহিত আর ফিরবে না। নেশার ঘোরে নিয়ন্ত্রণ হারাবে সে। তারপর গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাবে রোহিত। এভাবেই হারিয়ে গেছে আরও কয়েকজন। না, তাদের খবর কেউ পায়নি। পুলিশ একটু আধটু খোঁজা খুঁজি করেছিল বটে। কিন্তু গার্গী বোস প্রত্যেকটা নিখোঁজের জন্য মাত্র দশ লক্ষ টাকা দেওয়ায় পুলিশ আর খোঁজাখুঁজি করেনি।
এবারেও করবেনা। বোট ওয়ালাকে টাকা দিয়ে একটু ক্রুর হেসে হোটেলে ফিরে এল সে।

নিশ্চিন্তে হোটেলে ফিরে এসে পোশাক বদলে নিল গার্গী। হোটেলের অফিসে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে সিসিটিভি ফুটেজের বেশ কিছুটা অংশ ডিলিট করে দিতে বলল। ম্যানেজার প্রথমে রাজী ছিলনা। বলল, হোটেলের এতোগুলো স্টাফ, তাদের মুখ বন্ধ করা সহজ নয়। 
-সেজন্যই তো বলছি, আপনি আমার ঘরে আসুন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমনিতেই ম্যানেজারের একটু নজর ছিল ওর প্রতি। -এটা গার্গীর বুঝতে দেরি হয়নি। এখন ওর মুখ বন্ধ রাখতে রিস্ক নিতেই হবে। ম্যানেজার ঘরে আসতেই বলল, দেখুন আপনার হোটেলের অনেক নাম শুনেছি। ক্লায়েন্টদের নিয়ে আসতেই হয়। অনেক সময় তারা নিজের থেকেই কোথাও চলে যায়। 
-বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে ডিলিট হয়ে যাবে। কিন্তু-- 
--ঠিক আছে, আপনি এটা রাখুন। এতে বিশহাজার আছে। 
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি ভাববেন না। 
টাকাটা নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেটে ভরে নিল ম্যানেজার। এটা তার বাড়তি রোজগার। আর এই রোজগারেই সে ফুলে ফেঁপে উঠছে।
-আপনি কি আজই চেক আউট করবেন ? 
-হ্যাঁ। আমি যে আপনার হোটেলে এসেছিলাম তার কোনও প্রমান রাখা চলবেনা। 
-সে আর বলতে-  এরকম আমরা প্রায়ই করে থাকি। কাষ্টমারের স্বার্থটাই আমাদের কাছে শেষ কথা। 
-ঠিক আছে। হোটেলের বিল তো আগেই পে করে দিয়েছি। এখন সিসিটিভির ফুটেজটা-
-বসুননা। আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি। বসল গার্গী। দেখল ম্যানেজার মাউসটা ঘুরিয়েই চলেছে। শেষ পর্যন্ত গার্গী নিজেই কীবোর্ডটা টেনে নিয়ে সিসিটিভির দুদিনের ম্যাটারটা একেবারে ডিলিট করে দিল। 
-পুরোটাই ডিলিট করে দিলেন ? 
-তাতে কি হয়েছে ! আমি তো আছি। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। চাইলে একঘণ্টার জন্য- 
-কি যে বলেন ! 
-আসুন না।

ম্যানেজার আর না করলনা। বাড়তি কিছু টাকা পেয়েছে। এখন যদি আরও কিছু পাওয়া যায় ক্ষতি কি! তাছাড়া পুরুষ্টু শরীরের স্বাদ! সুযোগ বারবার আসেনা। সুতরাং সে সুযোগ নিল। 
ফিরে এল গার্গী। তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা এরকম হবে। লিফট তখনও চালুই ছিল। নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল। 

আজ খুব ধকল গেছে। এর আগে তার জীবন থেকে আরও চারজন হারিয়ে গেছে। না, তাদের জন্য তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু রোহিতের জন্য বুঝি--  এসব দুর্বলতা তার জন্য নয়। নতুন নতুন পুরুষ তার উপভোগের বস্তু। ওসব নিয়ে তার ভাবার সময় নেই। 

পরদিন অফিসে এল ঠিক আগের মতোই। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। একটা কাগজে রোহিতকে দিয়ে সই করানো ছিল। সেটাতেই একটা রেজিগনেশন লেটার টাইপ করে নিল। স্বাক্ষর রোহিত আঢ্য। তারিখ তিনদিন আগের। 
সুতরাং সে জানেনা রোহিত রিজাইন দিয়ে কোথায় গেছে।

কর্মীরাও আর রোহিতের ব্যাপারে তেমন খোঁজখবর করলনা। তার বাড়ির লোকেরাও জানলনা , রোহিত কোথায়! এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেল ব্যাপারটা। কিন্তু গোয়া কোষ্টাল গার্ডের ইন্সপেক্টর লিঙ্কন ডিসুজা হঠাৎই একদিন গার্গী বোসকে ফোন করে জানতে চাইল, রোহিত আঢ্য বলে কাউকে চেনেন কিনা?
-চিনি। কিন্তু উনি তো আমাদের সংস্থা থেকে গত বারো অক্টোবর রিজাইন দিয়ে চলে গেছেন।-- আমরা তাঁর লাশটা খুঁজে পেয়েছি। পচাগলা। আপনাকে সনাক্ত করতে হবে। 
-কিন্তু-- আচ্ছা ওটাকে বেওয়ারিশ লাশ বলে চালানো যায়না ? তার জন্য-- 
--যেতে পারে, কিন্তু-- 
-আপনি আসুননা এখানে। মুম্বাইয়ের কোনও একটা হোটেলে-- তারপর আমাকে ফোন করবেন। 
-ওকে। আমি আজই বিকেলের মধ্যেই আসছি।
-হাঁ, তবে আজই লাশটার একটা ঠিকানা করে দিন। 
-ওকে ম্যাম ! 
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো গার্গী। সত্যিই লাশটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কত টাকা খসবে কে জানে! হোটেল সি ফেস এ একটা এসি রুম বুক করে রাখল সে। লিঙ্কন ডিসুজার এন্টারটেইনমেন্টের সব ব্যবস্থাই রাখতে হবে
আগের মতোই সব চলতে থাকল। কেউ তাকে সন্দেহ করলনা। পচাগলা লাশটা নিশ্চয় শকুন শিয়ালের ভক্ষ্য হয়ে জীবনলীলা সাঙ্গ করেছে। ইতিমধ্যে দেওয়ালী এসে গেল। অফিস স্টাফদের জন্য একটা স্পেশাল বোনাসের ব্যবস্থা হল। তারা তাদের বস্ কে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাল। 
সেদিনটা ছিল কালীপুজোর রাত। মানে ভূতচতুর্দশীর রাত। ভূতেরা নাকি সেদিন বেশি সক্রিয় হয়। তবে সেসব নিয়ে গার্গীর ভাবনা ছিলনা। শহরটা সেদিন আলোকমালায় সেজেছিল। মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংগুলোকে অনেক অনেক আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। অন্যান্য আবাসিকদের সঙ্গে সেও ছাব্বিশতলার একেবারে শেষ তলায় উঠে এসেছিল। বেশ সুন্দর লাগছিল চারপাশটাকে। দূরের সমুদ্রটাও যেন রঙিন হয়ে উঠেছিল। অনেক রাত পর্যন্ত সে ছাদেই রইল। কখন যে অন্যান্য আবাসিকরা নেমে গেছে সে বুঝতে পারেনি। হঠাৎই কেমন যেন একটা বিকট আওয়াজ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট চলে গেল। মনে হল পুরো শহরটা বুঝি অন্ধকারে ডুবে গেছে। মোবাইলটাও সঙ্গে ছিলনা। হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কেমন যেন ভুতুড়ে পরিবেশের মতো। লিফটও চলছে না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে থেকে মনে হল যেন ছায়ামূর্তির মতো কেউ এগিয়ে আসছে।
-কে ? 
কিন্তু ওর গলা থেকে বুঝি কোনও স্বর বেরোচ্ছেনা। গলাটা বুঝি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। না, ও কথা বলতে পারছেনা। প্রচণ্ড ভয়ে ও পিছোতে লাগল আর ছায়ামূর্তিটাও যেন এগিয়ে আসতে লাগল। পিছোতে পিছোতে ও একেবারে ছাদের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাল। 
-কে, কে তুমি? কেন এগিয়ে আসছ আমার দিকে?
কান ফাটানো পৈশাচিক হাসির শব্দ চারদিকে। ও আরো পিছোতে লাগল। ছাদের ওই অংশটায় কোনও দেওয়াল ছিলনা। গার্গী বোস পিছোতে পিছোতে ছাদের সেই অংশ থেকেই তীব্র আর্তনাদ করে পড়ে গেল একেবারে নীচে। সবাই প্রথমে একটা আর্তনাদ পরে একটা 'ধপ' শব্দ শুনতে পেল। কারেন্ট এল, আলো জ্বলল। সবাই দেখল একেবারে নীচে রাস্তার ওপরে গার্গী বোসের ছিন্নভিন্ন দেহটা পড়ে রয়েছে। মাথা থেকে তখনো গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। 
মারা গেল গার্গী বোস।
সমাপ্তি ঘটল এক পিপাসার।







ক্ষমা পরম ধর্ম তার ওপর বই যদি হয় জ্ঞানের দোসর, হয় পাপ ক্ষয় হয়, ভক্তি জাগে চিত্তে, ধুয়ে মুছে যায় সব মোহ ভ্রান্তি, অপরাধী দুরাচারীও হয় ব্রহ্মচারী। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই ছোট গল্প( সম্পূর্ণ কাল্পনিক)


শাস্তি

তু ল সী  ম ন্ড ল 


অবশেষে অপরাধ হাতে নাতে প্রমাণিত। শ্লীলতাহানি বলে কথা, বিচারক  কারাবাসের শাস্তি ঘোষণা করছেন এমন সময় সৌমিত্রী দেবী মহামান্য বিচারককে মাঝখানে থামিয়ে বললেন -মহামান্য, আমার আপত্তি আছে, ওনাকে মানে তারানাথ-কে ক্ষমা করে দিন।
কি বলছেন, শ্রেয়া যে আপনার মেয়ে- ওর অপমান আপনার গায়ে ফোঁড়ে না?আশ্চর্য! বললেন বিচারক।
কসুর মাফ করুন হুুজুুর, লেগেছে বলেই আদালতে বিচার চাইতে এসেছি। সে যাক আমি চাই উনি নজরবন্দী থাকুন নিজগৃহে, হেঁটে চলে বেড়ান, কাজ করুন, উনারও সংসার আছে। কিন্তু ওনাকে দিনে একটা করে আদালত নির্ধারিত বই পড়তে হবে এবং পড়ে সেই গল্পের বিষয়বস্তু প্রতিদিন নিয়ম করে এসে বলে যেতে হবে আদালতকে। সময় করে সেটা শুনতেও হবে আপনাকে, আমিও আসবো, এটা সমাজের দাবি।
অদ্ভুত! তাই হবে, তারপর বিচারক শোনালেন সেই নজিরবিহীন শাস্তি, বই পড়ার শাস্তি। পরিণাম দেখার জন্য আমিও উদগ্রীব, বললেন বিচারক, উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিমত নেই। সাধুবাদ আপনাকে সৌমিত্রী দেবী। হতবাক অপরাধী তারানাথও। লেশমাত্র অনুতাপ নেই হাবেভাবে তার। রক্তজবার মতো চোখ, নেশাখোর একটা। বিচারক অপরাধীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তারানাথ, জীবন একবার মেলে, সুযোগও, সদ্ব্যবহার করলে দানব দেব হয়ে যায়, শুভকামনা রইল আপনার জন্য, ভগবান আপনার সহায় হোন। বিকেল তিনটের সময় আমি ফাঁকা থাকবো প্রতিদিন। শুনবো তোমার বই পড়ার অভিজ্ঞতা। অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারানাথ। কোন প্রতিক্রিয়া নেই। অনেক অনেক ধন্যবাদ, নত সালাম ঠুকে সৌমিত্রী দেবী রওনা দেয় স্কুলের দিকে কিন্তু এমন অপরাধী খোলা আকাশের নিচে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে! তা হয় না, সমাজ কসুর করবে না , সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে আদালতে উপস্থিত গুণীজনেরা। তাই সশ্রম কারা দন্ড দেওয়া হলো তারানাথকে। এক চিলতে ঘর। একটিপ তামাক জিভের তলায় গুঁজে দেয় তারানাথ। মাথাটা নাড়তে থাকে, মনে মনে বলে- না ঠিক হয়নি কাছা খোলা কাজ হয়েছে, ওই টিনাটা যে কিভাবে দেখে ফেললো! কারারক্ষী এসে খোঁচা মারে- এই হারামজাদা, এই নে ধর- আমাকে উদ্ধার কর। বইগুলো হাতে ধরিয়ে আবার টেবিলে গিয়ে বসে খাতা উল্টাতে উল্টাতে মিশ্র বাবু বললেন- মনে থাকে যেন হুকুমটা যেন তালিম হয়। সময় নষ্ট না করে তারানাথ শুরু করে পড়া, নাহ কিছুতেই বসছে না মন। এ কেমন শাস্তি! যেন হরিণের লাঙ্গল চষা। আরো একবোল দোক্তা টিপে দেয় জিভের নিচে। এইতো আমেজ আসছে, মাথার মধ্যে বইটা ঢুকেছে, আবারো একটিপ দোক্তা, মাথাটা বনবন করে ঘুরছে, কি সর্বনাশ, মানুষ চাইলে কিনা হতে পারে, পথের ছেলে গোর্কির হাতে মায়ের জন্ম! বোকা আইনস্টাইন বিজ্ঞানী! বিটোফেনের হাতে অনন্তের সুর! রাজার ছেলে অশোক কিনা মহাসাধক! নদের নিমাই প্রেম ধর্ম ছড়ানোর জন্য ছাড়লেন গৃহ! ত্যাগ করলেন সুন্দরী প্রিয়া! একি পড়লাম! সামনের কারাগারটা যেন বনবন  করে ঘুরছে, খড়কুটোর মত সুখ-দুঃখ হাসি কান্না উড়ে যাচ্ছে জীবন ঝড়ে, মৃত্যু চিরশাশ্বত, ব্যক্তি মানুষের জন্ম ইন্দ্রিয়ের ভোগের জন্য নয়, সৎকর্মের দ্বারা এই ধরণীতে জীবের মঙ্গলবারতা রেখে যাওয়া জন্য। পাতার পর পাতা উল্টে যায়, ঘুরে যায় কারাগার 360 ডিগ্রি।
একদিন জেলখানার দুয়ার খুলে যায়, দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায় এক মহাযোগী, ললাটে চন্দন তিলক, গায়ে নামাবলী, মুন্ডিতমস্তক, মুখে পবিত্র হরি নাম। পেছনে বন্ধ হয়ে যায় দরজা, আর থামেনি পা, চলতেই থাকে, সটান এসে থামে সৌমিত্রি দেবীর দরজায়, মা মা করে পায়ে আছড়ে পড়ে ও সাধক। কে তুমি-- মুন্ডিতমস্তক, দিব্য ললাট চন্দন ল্যাপা, হাতে শ্বেত শুভ্র কুসুম মালা। বয়স হয়েছে, হাত কাঁপছে, দৃষ্টি ঝাপসা, সচকিতে উঠে দাঁড়ায় সৌমিত্রী দেবী। পায়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে সাধক বলে- মা মা আপনি কোনো সাধারণ মেয়ে নন, দেব দেবী আছে কিনা আমি জানিনা শুধু জানি আপনাকে-- যে জ্ঞানচক্ষু আপনি আমার  খুলে দিলেন, জনম জনম আমি তার ঋণ শোধ করতে পারব না। সব আপনার দয়া, আপনার করুণায় আজ আমি জেলের মেন্টর, বিজ্ঞ সচেতক। ধীরে ধীরে দুহাত বাড়িয়ে সাধক, সৌমিত্রি দেবীর গলায় পরিয়ে দেয় মালা। প্রণাম ঠুকে বলে-- -জানেন মা ,অনেক অনেক অপরাধী আজ আমার হাতে খুঁজে পেয়েছে পথ, পেয়েছে শান্তি, পেয়েছে নতুন জীবন। আর আমি কার জন্য এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছি জানেন? শুধু আপনার জন্য। এই ধ্যানে, এই জ্ঞানে, এই করে, শুধু আপনিই পুজিত। মাগো শিরে মোর রাখো তবো  চরণ দুটি। আর মা, এই দেখুন এই বইটা আমারই লেখা, আজ আপনার চরণে ঠেকিয়ে শুদ্ধ করব। আমি জানি আপনার থেকে বেশি খুশি বোধ হয় আর কেউ হবে না। জানি আপনার মত মহাদেবীর এককনা পদধূলির যোগ্য নয় এই বই, তবুও মা। চোখ দিয়ে টপটপ করে ঝরছে জল, হাতড়াচ্ছে সৌমিত্র দেবী, চশমাটা কই? তারানাথ এগিয়ে দেয় চশমা। বইটা সামনে ধরতেই সৌমিত্রী দেবী দেখতে পেলেন মলাটের ওপরে জ্বলজ্বল করছে তাঁরই ছবি। তার নীচে স্বর্ণাক্ষরে লেখা- 'আমার দেবী'
তারানাথ ব্রহ্মচারী।







মা

স র্বা ণী  রি ঙ্কু  গো স্বা মী


রাতের বেলা তেনাদের নাম নিতে নেই, নিলেই রাম রাম রাম রাম জপ। দক্ষিণমুখো বেলগাছটার নীচ দিয়ে সন্ধের পর সচরাচর কেউ যায়না। ঠাকুমা নাকি প্রায়ই কাকে একটা যেন দেখে সাদা ধুতি পরে ইয়া লম্বা পৈতে আর  পায়ে মস্ত খড়ম, থেলো হুঁকো হাতে এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে। ঠাকুমার নাকি ভাসুরঠাকুর তাই লম্বা ঘোমটা টানতে হয়!

বারোমাস আমার নাকে সর্দি, হাওয়া একটু এলোমেলো হলেই অমনি জ্বর। ডিগডিগে কোমর থেকে পেন্টুল ঝুলছে  আর ইস্কুল কামাই তো জানা গল্প। দেখা হলে সাইকেল থেকেই হেড মাস্টারমশাই হাঁকেন, "বিলে জ্বর নেই তো আজ, বইখাতা নিয়ে পেছনে চেপে যা।" এই শরীরে গঞ্জের হাই ইস্কুল অবধি পড়াশুনো চালিয়ে যেতে পারব কি জানিনা।

ঠাকুমা বলেন, "নাতি আমার পুঁয়ে পাওয়া!" কে জানে তার মানে কি! মা বলতে চিনি শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো আলতাছোপানো দুটো পায়ের ছবি শুধু। অনেক চেষ্টা করেও কোনো মুখ মনে পড়েনা। আমি সারাদিন ঠাকুমার আঁচল ধরে ধরে ঘুরি। দাদু মাছ ধরার নেশায় প্রায়ই সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে অন্য গ্রামে। এক পা কাদা নিয়ে মাঝরাতে ফিরে বলেন ,"দাদুভাই...তোমার মাছ!"

গড়িয়ে যাচ্ছে দিন এমনি করেই। মাঝেমধ্যে অতিথির মতো বাবা আসে, দু চার দিন থাকে আবার চলে যায় সেই কলকাতা। দেখা হলেই বলে, "মন দিয়ে পড়াশোনা করো বিলু। বড়ো হলে তোমাকেও আমার সঙ্গে কলকাতা নিয়ে যাবো।" দুর আমার একটুও ভালো লাগেনা সে কথা ভাবলে। 
ঠাকুমা ছাড়া আমি ভাবতেই পারিনা। সেদিন  রাতে হঠাৎ খুব জলতেষ্টায় ঘুম ভেঙে গেলো। ঠাকুমার দুদিন ধরে খুব পেটখারাপ, শরীর দুর্বল সবে একটু ঘুমিয়েছে। দাদু গেছে পাশের গ্রাম পলাশপুর, মাছ ধরতে। ভাবলাম কুঁজো থেকে আমি কাঁসার গেলাসে নিজেই জলঢেলে নিতে পারবো, বড়ো হয়ে গেছি তো! জল খেতে গিয়ে দেখি হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় দেখলাম দাওয়ায় হাঁটুতে মাথা দিয়ে বসে একটা ডুরে শাড়ি পরা বউ। কপালে এত্তো বড়ো একটা সিঁদুরের টিপ, আমাকে দেখে বললো- "আমি জল ঢেলে দিই খোকা... খুব তেষ্টা পেয়েছে না রে ?"





 

ভালোবাসার বাসা

সু ল গ্না  চৌ ধু রী


বড়ো আম গাছের মগডালেই ওদের পছন্দের ঘর হবে, দু'জনে গভীর আলোচনা করে ঠিক করেছে। পাশের বাড়ীর পিটুনের লাল টুকটুকে তোবড়ানো প্লাস্টিকের ব্যাটের উপর থেকে খানিক লাল প্লাস্টিকের টুকরো, তিন্নির ফেলে দেওয়া মালার ল্যাজের খানিকটা সুতো ছোঁ মেরে উড়ে গিয়ে চঞ্চুতে করে তুলে এনেছে শালিখযুবক, একটা সুন্দর ঘর বানাতে হবে যে! দু'চোখে এখন একরাশ স্বপ্ন, ওই বড়ো রাস্তা পার করে যে কদম গাছটা তার মগডালেই থাকে আমার বাড়ির আমগাছের মগডালে থাকা যুবক শালিখটার প্রেয়সী।

তাদের আলাপ হয়েছিল শীতের এক দুপুরে কাদাখোঁচার সাথে পোকা শিকারের সময়ে, ওই পাড়া থেকে এসেছিল শালিখ কন্যা। কী ভালো স্বভাব! পোকা শিকারের সময়ে যখন সাতভাই চম্পারা সমস্বরে ঝগড়া জুড়েছিল, শালিখ কন্যা তখন তাদের ঝগড়া বিবাদ থামিয়ে ছিল। মুগ্ধ শালিখ দু'চোখ ভরে দেখছিল আর ভাবছিল, "কি পারদর্শী! সুন্দর স্বভাবের সুন্দরী শালিখ কন্যা, সেই থেকে মন দেওয়া আর মন নেওয়া, দু'জন দু'জনকে চোখে হারায়, দিন গড়িয়ে বছর হলো, সেই ভালোলাগা ভালোবাসা হয়ে পরিণতি পেতে চলেছে পরিণয়ে।
নিমন্ত্রন পেয়েছে বনটিয়া, মৌটুসি, টুনটুনিরা। কাদাখোঁচা তো বরকর্তা! আছে বৃদ্ধ হাঁড়িচাঁচা তার লাল চোখ নিয়ে, পক্ষীকুলের সাজ, সাজ রবে, দিনভর আমাদের বাড়ির ছাদে চলছে আনন্দ, ওড়াউড়ি। নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য আসছে এ গাছ, সে গাছ থেকে নানাবিধ ফল, ফুলের কুঁড়ি, আসছে পোকামাকড় সে সব বয়ে আনার দায়িত্ব পেয়েছে ওই আকন্দ গাছের সেপাই বুলবুলি, আর কাঠঠোকরা। তারা আবার শালিখ দম্পতির বিশেষ বন্ধু কিনা!
বৌকথাকও, আর ময়নার এই বিয়েতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তারা দেখলাম এই বিয়ের অনুষ্ঠান চলা কালীন দূরের আকাশ দিয়ে উড়ে চলে গেলো, বোধহয় নেমন্তন্ন মন মতো হয় নি, তবে সাতভাই চম্পারা যতই ঝগড়াটি পাখি হিসেবে নাম করুক, ওদের মন কিন্তু খুব সাদা। শালিখ বাবু গিয়ে যেই বিয়ের নেমন্তন্ন করেছে, ওমনি তারা সব ঝগড়া ভুলে খুব খুশী হয়ে হাজির! ঘুঘু তো দুপুরবেলা এমনিতেই বাড়ির চিলেকোঠার মধ্যে বসে ডেকে ডেকে নির্জন দুপুরকে শব্দময় করে তোলে, তার অঢেল সময়, কাজেই এই বিয়েতে সে গাছের পাশেই উপস্থিত, বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রায় সকলে মিলে শালিখকে নিয়ে উড়ে গেলো বিয়ে করাতে তাতে সকল গাছের সদস্য এসে যোগ দান করলো। এলো কাঠবেড়ালী, তারা প্রচুর ব্যস্ততা নিয়ে গাছের ডালে, ডালে ছোটাছুটি করে আনন্দ করতে লাগলো। 
সকলের প্রচুর আনন্দের সাথে এই বিয়ের অনুষ্ঠান, মালাবদল, সাতপাক, টোপর, মুকুটের সাজে কনে আর বর শালিখের লাজুক হাসি, শালিখনীর গাল লাল, তাকে নিয়ে নানারকম ফাজলামি করলো দোয়েল, কোয়েল আর ফিঙে। ফিঙে যে এত রসিক আগে তা জানা ছিলো না! সারাদিনের শেষে নিমন্ত্রিত অতিথিরা ফিরে গেল তাদের যার, যার, কুলায়, গোধূলি পার হয়ে চাঁদের আলো এসে পড়লো নতুন পাতানো সংসারে, শালিখ দম্পতি সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে সূর্যোদয় দেখলো। আহ্লাদে আটখানা সংসারে পাখায় পাখায় প্রেমের বিচ্ছুরণ, সন্ধ্যা রাতে শালিখনী যাতে ভয় না পায় তাই শালিখ তার বাসা সাজায় জোনাকির আলোয়, শালিখনী তার শালিখ কর্তা যে যে ফল খেতে ভালোবাসে তাই জোগাড় করে এনে রাখে তার কর্তার জন্য, খোস মেজাজে গল্প করে, সুন্দর ভাবে দিন অতিবাহিত করে। নরম বুক ভরা সোহাগের সংসার, চঞ্চু তে চঞ্চু রেখে কতো  কথা হয়, সেই সোহাগের বাসায় তাদের সংসার বড়ো হয়। নির্দিষ্ট দিনে ছানারা ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে। সন্তানদের যত্নের কোনও ত্রুটি নেই তাদের।

ক্রমে ছানা শালিখরা বড়ো হতে থাকে বাবা, মা মিলে এক গাছের থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে যাওয়া শেখায়, খাবার খুঁটে নিতে শেখায়, আরও কতো শত, কর্মকাণ্ড তাদের। আমি ছাদে বসে দেখি, সত্যি কি নিপুণতায় ভরা সে শিক্ষা, পক্ষীকুলেরও কত নিয়ম কানুন, কত পদ্ধতি, সাদা চোখে যা ধরা পড়ে না। অবশেষে সেই আকাশে ওড়ার শিক্ষা, নীল আকাশটা কে আপনার করে নেওয়ার শিক্ষা। বাচ্চাদের বড়ো করে তুলে নিজেরা বৃদ্ধ হয় শালিখ দম্পতি। আসলে সকল জীব জগতের এই একটাই প্রচেষ্টা সন্তানের সুঅভ্যাস গড়ে তোলা।

নিশ্চিত জীবনের অধিকারী শালিখবাসাখানি আনন্দে ভরে থাকে তাই। আসলে সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে পারাটাই, জীবনের একটা শ্রেষ্ঠত্ব, যা ভবিষ্যৎকে  সুন্দর এবং নিশ্চিত করে তোলে, তার মধ্যেই সকল জীব জগতের সফলতা।





 

মনদীপ

সু মি তা  চৌ ধু রী 


রাস্তার মনোরম শোভা মনের কুঠুরির কানায় কানায় ভরে এবার ঘরে ফেরার পালা। সন্দীপ গেছে সিগারেট নিতে রাস্তার একপাশে গাড়িটাকে একটু অপেক্ষায় রেখে।  পিউও গেছে বাবার সাথে তার আবদারের কোল্ডড্রিঙ্কস আনতে। সৌমি মুগ্ধ হয়ে প্রাকৃতিক শোভা দেখছিল, হঠাৎই গাড়ির ড্রাইভার মনদীপের কথায় অনেক দূরাগত মনকে যেন বাস্তব জগতে নিয়ে এলো সৌমি। 

মনদীপ নিজের চালকের আসন থেকে সৌমির আসনের দিকে ফিরে সকরুণ সুরে জলভরা গলায় বলল, "মেমসাব, আপনি আবার আসবেন তো এখানে?" গলা শুনে সৌমি আশ্চর্যচকিত হয়ে, কিছুটা থতমত খেয়ে সংক্ষেপে বলল, "হ্যাঁ আসব"।  "কবে?" (নিজের অস্বস্তি লুকোতে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে) সৌমি: "এভাবে কি বলা যায়? ২/৩বার এসেছি এখানে। দেখি আবার যদি কখনো আসা হয়।" "মেমসাব কথা দিন আসবেন। আমি ওয়েট করে থাকবো।" এমন কথায় ও গলার স্বরে তাকাতে না চেয়েও হতচকিত চোখ অবাধ্য হয়ে চেয়ে ফেলল মনদীপের দিকে। তার তখন চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। সৌমির চোখে চোখ রেখে বলল, "যদি আমি যাই আপনার কাছে? যেতে দেবেন?" মনকে খুব সতর্কতায় বাস্তবের মাটিতে এনে হেসে সৌমি বলল, "হ্যাঁ বেশ তো, কোলকাতায় গেলে সময় নিয়ে এসো একদিন  আমাদের বাড়ি। আমাদেরও খুব ভালো লাগবে। তুমি আমাদের এতো সুন্দর করে ঘোরালে, এতো হেল্প করলে নিজে থেকে, আমরা তোমায় কোনোদিন ভুলতে পারবো না।" মনদীপ জলভরা চোখে ভারী গলায় নিজেকে সামলাতে না পেরে মরিয়া হয়ে সৌমির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, "আমি আপনার কথা জিজ্ঞেস করছি মেমসাব।" গাড়ির আয়নায় সন্দীপদের কায়া ধরা পড়ল। মনকে এবং মনদীপকে সতর্ক করতে কিছুটা স্বগতোক্তির সুরে সৌমি বলে উঠল, "দাদারা এসে গেছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে না?"  মনদীপ এক ঝটকায় নিজেকে সামলে চোখ মুছতে মুছতে নিজের আসনে চালকের ভূমিকায় ফিরে গিয়ে অশ্রুজড়িত গলায় বলল, "হ্যাঁ মেমসাব আলো নিভে এসেছে।" 

সন্দীপদের নিয়ে গাড়ি ফিরতি পথে চলল। সৌমির মনে হল, মনের দীপ তো কবেই নিভে গেছে, তবে অপরাহ্নের আলোয় না জ্বললে কি পারতো না? মনে মনে বলল, মনের দীপ যে নিভে গেছে মনদীপ। আমিও যে সায়াহ্নে পৌঁছে গেছি।






কবিতা ও আমি

হা মি দু ল  ই স লা ম

                         
তখনো ভাঙা ছাদে জলের স্রোত। ভিজে যাচ্ছে রাত। টুপটুপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে আমার ঘরে। আমার বিছানায়। বিজলি বাতি চলে গেছে একটু আগেই। আমার চারদিকে তখনো অমাবস্যার গাঢ়  অন্ধকার।

কবিতা নেই। আমি একা। নিঃসঙ্গ জীবন। নিঃসঙ্গতার একটা নতুন ব্যথা দলা পাকাচ্ছে আমার বুকের ভেতর। দীর্ঘ নিঃশ্বাসে যেনো বেরিয়ে আসছে ফেলে আসা অতীত। আমার শৈশব।

একসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা দুজন। কবিতা পড়তো আমার সঙ্গে। খেলতো। গান গাইতো। নাচতো। সেই বাল্যকাল থেকেই গানে পাকা হয়ে ওঠে কবিতা। ও আমাকে গান শোনাতো। পাখির মতো কন্ঠ ওর। সে কন্ঠে উঠে আসতো রবীন্দ্র সংগীত। এলোমেলো হিন্দি গান। আসতো সন্ধ্যা প্রতিমা  অরুন্ধতী হৈমন্তী। উঁকি দিতো লতা আশা। আমি কেবল শ্রোতা। আমি ওর গানে গানে হারিয়ে ফেলতাম নিজেকে।

আমরা তখন দশমের ছাত্র। স্কুলের সংগীত প্রতিযোগিতায় কবিতা প্রথম হল। সেই থেকে আমার মনেও একটা অজানা আকর্ষণ। একটা অজানা টান। বুঝতে পারছি এ টান  ভালোবাসার টান। একটা কচি মনকে কাছে পাবার টান। একদিন বেখেয়ালে কবিতাকে বলে ফেললাম,  'ইউ আর সো বিউটিফুল। ইউ আর সো হ্যান্ডসাম। আই লাভ ইউ কবিতা।' 

কবিতা আমার দিকে তাকালো। কী বলবে যেনো ভেবে পাচ্ছে না। কেবল দুচোখ আমার চোখের গভীরে রেখে একটু হাসবার চেষ্টা করলো। আমি বুঝলাম ওর মনের অবস্থা। পাখি উড়ছে। ধীরে ধীরে ডানা ভাঙ্গা পড়ছে পাখির। পাখি যেন এগিয়ে আসছে মন খাঁচার দিকে। ধরা দিবে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে।

তবু যেন অল্প বয়সে কবিতার বিয়ে হয়ে গেলো। আমার বুকে জগদ্দল পাথর। আমি পাথর সরাতে পারছি না। ভাঙতেও পারছি না পাথর। পাথরে চাপা পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি আমি। আমি একা। নিঃসঙ্গ। একাকীত্বই যেনো আমার জীবন। একাকীত্বকে বুকে নিয়ে আমি ভেঙ্গে পড়ছি বারবার। কবিতার সঙ্গে আমারও পড়াশুনা লাটে উঠে গেলো।

একটা মাছের আড়তে কাজ নিলাম। মাছের আঁশটে গন্ধ। বমি পাচ্ছিলো আমার। ভাবলাম কাজ ছেড়ে দেবো। এখানে আর থাকবো না। চলে যাবো কোনো এক দূর দেশে । কাউকে কোনো কথা না বলে একদিন মাঝরাতের আপ ট্রেন ধরে পাড়ি দিলাম ভিন রাজ্যে। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলাম না। ট্রেনে দেখা হয়ে গেল কবিতার সঙ্গে। কবিতা কপালের সিঁদুর মুছে ফেলেছে। হাতের শাঁখা ভেঙে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, 'কী ব্যাপার?' কবিতা কাঁদছে, 'সংসার হলো না। পণের টাকার জন্য স্বামী আমাকে রোজ মারধর করে। আর কতো  সহ্য করব? চলে আসলাম।'
'কোথায় যাচ্ছ?' 
 'মরতে।'

সামনেই গঙ্গা। কবিতা ট্রেনের গেট থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিলো। আমিও ঝাঁপ দিলাম। ওর হাতটা ধরে ওকে ঘাটে তুললাম।
কাঁদছে ও, 'আমাকে বাঁচালে কেন?'
'আমার সামনে কেউ মরে যাক আমি চাইনা।' 
 'কিন্তু মৃত্যু ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।' 'আমি তোমাকে ভালোবাসি।'

সকাল হয়ে গেছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ফিরে যাচ্ছি বাড়ি।






খুবসুরতী

কা বে রী  বো স (নী ল বৃ ষ্টি) 


বাইরে মুসুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে , রাধারানী তাঁবুর ভেতর থেকে বৃষ্টি দেখছে, তার ডাক পড়বে আরো দু ঘন্টা পর, রাধারানী তাঁবুর ধার থেকে সরে এসে ভেতরে গিয়ে চেয়ারে বসে, ওদিক থেকে না না হৈ হট্টগোল এর আওয়াজ আসছে!! লোকের হাততালি সিটি মারা নানা রকম, রাধারানী চুপ করে চোখ বুজে বসে থাকে, বাইরে বৃষ্টির হাওয়া তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে! কত কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! মনে রোজই পড়ে তবে এরমভাবে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে, সে রাধারানী নয় সে তবাসুম তার বাবা আনোয়ার হুসেন-এর একমাত্র মেয়ে! সারা গ্রামে সবচেয়ে সুন্দরী বোধহয় তবাসুমই ছিলো- সবাই তার রূপের প্রশংসা করতো, আব্বু গরীব হলেও তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে ছিলো, তবাসুমের খুব ইচ্ছে ছিলো বড় ডাক্তার হওয়ার- কিন্তু সে স্বপ্ন অধুরাই রয়ে গেলো, আব্বুজান মারা গেলো কি যেনো এক অজানা জ্বরে মাত্র কুড়ি দিনের মধ্যে, তবাসুম তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিয়েছে, আম্মি আর সে কি করবে ভেবে না পেয়ে গ্রামের সব বেচেবুচে শহরে মামুজানের কাছে চলে এলো তারা, কিন্তু মামুজান বৃদ্ধ মানুষ তাদের কি দেখবে!! মামুজানের ছেলেরাও পছন্দ করলোনা তাদের তবু আম্মি সেখানে থেকেই সেলাই এর কাজ শুরু করলো আর সেই সেলাই এর জামাকাপড় নিয়ে তবাসুম শহরের দোকানে দোকানে বেচে আসতো, পড়াশুনো করার ইচ্ছে থাকলেও আর এগোনো হয়নি, চলে যাচ্ছিলো মোটামুটি, এরপর সেলিম এর সাথে তার নিকা হলো, সেলিম খুব ভালোবাসতো তাকে কিন্তু সেলিমের মা আর বোন তবাসুম কে দু"চক্ষে দেখতে পারতোনা, সবসময় ঝগড়া করতো তার সাথে, আর সেলিম এলেই তার নামে মিথ্যে মিথ্যে বলতো দুজনে! প্রথম প্রথম কিছু না বললেও পরে সেলিম চেঁচামেচি করতো তবাসুম এর ওপর! এরপর মারধোর ও শুরু হলো ধীরে ধীরে!! তবু তবাসুম চেষ্টা করতো সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার!! কারণ গরীব বৃদ্ধ মা আর মামুজানের কাছে কি করে ফিরে যাবে!! এরপর আক্রম হলো তাদের ছেলে!! কিন্তু অশান্তি কমলোনা, তবাসুম আক্রমকে মানুষ করতে লাগলো সব অশান্তি কে দুরে সরিয়ে কিন্তু আল্লার বোধহয় অন্য মর্জি ছিলো!! এক অদ্ভুত রোগ হলো তবাসুমের!! প্রথম প্রথম মাথার চুল উঠতে লাগলো, তারপর ভুলে যেতে লাগলো খুব সাধারণ রোজকার কথা এরপর চেহারার পরিবর্তন হলো!! ডাক্তার ঘর করে জানা গেলো এন্ডক্রিন গ্রন্থি থেকে একধরনের হরমোন বেরিয়ে যা শরীরে লালার মাধ্যমে মিশে যায় যা গাছ বা পত্রে বেড়োলে তার বিকাশ ঘটে কিন্তু মানুষের শরীরে বেরোলে মানুষ দৈত্যকার ধারণ করে!! 

অতো সুন্দর মুখ ধীরে ধীরে চামড়া ঝুলে গালের ও চোয়ালের হাড় বেড়ে কুশ্রী এক মানবীতে রূপান্তরিত হলো সে!! সেইসঙ্গে হাত পায়েরও বৃদ্ধি ঘটলো!! সবাই ভয় পেতো তাকে দেখে!! তবাসুম নিজেও আয়নার কাঁচ ভেঙেছিলো নিজেকে দেখে!! এর ইলাজ প্রচুর খরচসাপেক্ষ!! সেলিম তাকে তালাক দিলো!!আক্রমকে কেড়ে নেওয়া হয় তার থেকে!! সবাই তাকে ঘেন্না করলেও ওই ছোটো শিশুটা তাকে ঘেন্না বা ভয় পায়নি সে আসতো তার কাছে গভীর রাতে নিজের বিছানা থেকে উঠে আম্মি বলে জড়িয়ে ধরে আদর করতো!! তবাসুম এর চোখ দিয়ে হু হু করে জল পড়তো!! সেই ছেলেকে কেড়ে নিয়ে তাকে বের করে দেয় সেলিম!! তবাসুম 
 ফিরে যায় মামুজানের ঘরে , মামুজান মারা গেছে ততদিনে, মা ও খুব অসুস্থ!! তবাসুম কি করবে ভেবে পায়না!! তার চেহারা দেখে কেউ তাকে কাজ দেয়না!!লোকে হাসাহাসি করে!! এরপর প্রায় না খেতে পেয়েই মা চলে যায়!!! মামুজান এর ছেলেরা তাকে তাড়িয়ে দেয়!! তবাসুম ভালো করে চলতেও পারেনা পায়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে!! সে ভিক্ষে করে যা পায় কোনোরকমে দিন চলে তার সারাদিন বোরখায় মুখ ঢেকে রাখে সে!! তবু কিভাবে যেনো ব্রজদা জানতে পারে তার কথা!! একদিন ব্রজদা আসে তার কাছে এই বটতলায় বলে," আমার তাঁবুতে শো করবে?অনেক পয়সা পাবে!!" তবাসুম হাঁ করে থাকে!!এই বিভৎস রূপই তার রোজগার হবে!! সবাই তাকে দেখবে টাকা দেবে এটাই কাজ!! তবাসুম রাজি হয়ে যায় আর উপায়টাই বা কি!! বাঁচতে হবেতো!! সেই থেকে ব্রজদার সাথে সে, ব্রজদাই তার নাম দিয়েছে রাধারানী!! ব্রজদার তাঁবুতে সেইই মূল আকর্ষণ!!প্রচুর টাকা পয়সা পড়ে সে এলেই!! ওই কুৎসিত মুখ দেখে সবাই পয়সা ছোঁড়ে, হাসে, সিটি মারে!! তবাসুম অবাক হয়ে দেখে তার চেয়েও কুৎসিত মনের মানুষগুলোকে!! কি আর করবে অভ্যাস হয়ে গেছে এখন!! হঠাৎ ব্রজদার গলা পায় "রাধা চলো তোমার সময় হয়ে গেছে!!" তবাসুম চোখ খুলে দেখে বৃষ্টি থেমে গেছে!! সে আস্তে আস্তে বাইরে যায় সবাই তাকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ে চেঁচায়!! হাত তালি দেয়!! মুঠো মুঠো টাকা আর পয়সা পড়ে তার পায়ের কাছে!!! তবাসুম তার লেহেঙ্গাটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাঁটে এদিক থেকে ওদিকে!! তার চেয়েও কুৎসিত উল্লাসে ফেটে পড়ছে সবাই!! তার অসুখ বহু মানুষকে সুখ দিচ্ছে আজ!!! হঠাৎ পেছনে চেঁচামেচির শব্দ পাওয়া যায়!! সবাই শো থামিয়ে ছুটে যায় তবাসুমও যায়!! দেখে একটা অল্প বয়সী ছেলে মাটিতে পড়ে কাঁদছে তার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে! আর যে তাকে মেরেছে সে ওর বুকের ওপর বসে বলে চলেছে, "তু হাসা কিউউ!! মার ডালুঙ্গা তুঝে মার ডালুঙ্গা!!" সবাই সেই ছেলেটাকে হাত ধরে টেনে তোলে!!! সেই ছেলেটি এবার তবাসুমের দিকে ছুটে এসে তার গলা জড়িয়ে গালের ঝুলে যাওয়া চামড়ায় চুমু খেয়ে বলে," আম্মি তুম দুনিয়াকি সবসে খুবসুরত আম্মি হো, ওর ম্যায় তুমারা বেটা আক্রম হু!!"  তবাসুম দু চোখে জলের ধারা নিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বুকে আর ভাবে ইতনি জিল্লৎ ভরি জিন্দেগে কে বাদ ভী খুবসুরতী আভি ভী জিন্দা হ্যায় ওর শায়দ উস্কে  নামহি আল্লাহ হ্যায়!!






মেয়েছেলের জুতো

সি রা জু ল  ই স লা ম


বাবা গম্ভীর কন্ঠে হাঁক দিলেনঃ, "মোবারক! শুনে যাও!" মোবারক আমার দূর সম্পর্কের মামা। ভাগ্যের সন্ধানে গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন শহরে কিছু করেকম্মে খাবে! নানান প্রতিষ্ঠানে ঢুঁ মেরে, অশিক্ষিত হওয়ার কারণে যখন নিরুপায় হয়ে স্বগ্রামে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করে ফেলেছেন, সেসময় বাবা তাকে একটা সিঙ্গার সেলাইমেশিন আর কিছু থানকাপড় কিনে দিয়ে আমাদের দোকানের একটা ঘর ছেড়ে দিলেন! খলিফাগিরি করার জন্য। সহজ ভাষায় আমরা যাকে দর্জি বলি। বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলে এদেরকে খলিফা বলে ডাকে। কেন? সে প্রশ্নের জবাব আজও জানা হয়নি।

সময়টা সম্ভবত উনিশ শ আটষট্টি / উনসত্তর। আমার সবেমাত্র চার/পাঁচ। বাবুগিরি সভ্যতার সাথে পূর্ব পাকিস্তানী মধ্যবিত্তরা ভালোভাবে নিজেদেরকে (ঘরে ঘরে মাটির শানকির পরিবর্তে রংচঙ্গা টিনের বাসন, আর পায়ে কাঠের খড়মের পরিবর্তে প্লাস্টিকের চটি-স্যান্ডেল বাজারে আসতে শুরু করেছে সবেমাত্র!) মানিয়ে নিচ্ছে।
আমরা যারা পরিবারের ছোট সদস্য এদের জন্য কাঠের খড়ম। দু'আঙ্গুুলের ফাঁকে কাঠের গুটুলিটা ধরে রাখা কষ্ট হয় বলেই বাসের টায়ার কেটে বেল্ট তৈরি করা খড়ম বরাদ্দ ছিলো। তাও সেটা সাধারনতঃ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগ মূহূর্তে অথবা সন্ধ্যার আলো জ্বালানোর পূর্বমূহূর্তে মুখহাত ধুয়ে পড়তে বসার আগে খড়ম পায়ে দিয়ে চলার অভ্যাস শুরু হলো। বাকি সারাটা দিন খালি পায়েই গোল্লাছুট!

দু'দিন আগে মেজভাই গোয়ালঘরের বাঁশের খুঁটির ব্যাংক (জায়গাটা বাঁশের দুই গিরার উপরের দিকে কেটে, ফুটো করে নেয়া) কেটে পয়সা বের করে একজোড়া ঝাঁ-চকচকে পাম-সু কিনে এনেছে। পায়ে দিয়ে পথ চললে মচমচ মচমচ শব্দ বের হচ্ছে। বয়সে অনেক ছোট আমাদের দু'ভাইবোনকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার সে কি উচ্ছ্বাস! কারণ আমরা ছোট। ওই ধরনের জুতা পায়ে গলাতে অনেক বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে।

মেজভাইয়ের তাচ্ছিল্য আর অভিমানে আমার বোনটা চলে গেলো তার অভিমান প্রকাশের জায়গাতে। উঠোনের ওইপাশে ঝাঁকড়া হাস্নুহেনা গাছের আবডালে। গাছের নীচে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘেরাটোপ বানানো আছে দুঃখ প্রকাশের জন্য, সেখানে। আর আমি ভ্যাঁদা গোবিন্দের মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদলাম! পিঠোপিঠি আমরা দু'ভাইবোন। দু'জনের জন্য মান অভিমানের দু'টো জায়গা আছে। একটা ওই হাস্নুহেনা গাছের নীচে, আর একটা শোয়ার ঘরে বড় কাঠের সিন্দুকটার আড়ালে। পাশাপাশি দু'টো ঘরের মাঝখানে! দরজা খুললে কপাটের আড়াল হয়ে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটাতে কোনমতে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। আমরা দু'ভাইবোন এই দু'জায়গার যে কোন একটাতে মান অভিমান করে থাকি মাঝেমধ্যে। যখন বড়রা এই দু'জনকে কানমলা অথবা চড়চাটি মেরে নিজেরা কৃতার্থ হন। তখন বোবাকান্নায় ভেঙে পড়ে ছুটে আসি এই নির্জন নিরালায়। আমি অবশ্য পারতপক্ষে হাস্নুহেনা তলায় যাই না, সাপের ভয়ে। ডালে জড়ানো থাকে সবুজ রঙের চিকন সাপ।

মেজভাইয়ের নতুনজুতো দেখে আমাদের দু'জনের ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হলো। মায়ের মুখে নরম সুর, দিচ্ছি, দেবো!" তাতে মন মানে না। বাবার কাছে বায়না ধরি। বাবা বললেন, হবে! কবে হবে তার কোন সীমারেখা নেই! ফন্দি আটলাম দু'ভাইবোন। সকাল থেকে নতুন করে বায়না হবে। যে কথা, সেই কাজ ঘ্যানঘ্যানানির ফলে বোনের পিঠে রামধোলাই আর আমার জুটলো কানমলা! নিদারুণ ব্যথা নিয়ে বোন চলে গেলো তার স্কুলে। আর আমি সেই গোপন ডেরায়, দরজার ফাঁকে নাকের জল চোখের জল একাকার করছি। খাবারের থালা পড়ে আছে অথচ আমরা দু'ভাইবোন কেউই ভাত ছূঁইনি! বিশ্ময় প্রকাশ করে মা খুঁজলেন আমাদেরকে। খোঁজ! খোঁজ! সাড়া নেই। তখন মা গিয়ে বাবাকে দিলেন আচ্ছামতো বকে-,
"ছেলেমেয়ে দু'টো সামান্য ক'পয়সার স্যান্ডেল চেয়েছে! তা যখন দিতে পারছো না, তাহলে ওদের মতই আমিও আর এ সংসারের ভাত খাবো না!"

মায়ের এ হুমকিতে বুঝি কাজ হলো। দরজার ফাঁক গলে আমি দেখলাম, বাবার ডাক শুনে মোবারক মামা বলির পাঠার মতন কাঁপতে কাঁপতে ছুটে এলো। অনাথ এই মামাকে বাবা অত্যন্ত স্নেহ করেন। নিজে দেখে শুনে ক'দিন আগেই মামার জন্য মামী এনে দিয়েছেন। তারপরও সেই মামা কেন যে বাবাকে এত ভয় পায় জানি না। হয়তো শ্রদ্ধা! হয়তো সম্ভ্রম, বিনয়! "তুমি তো দোকানের জন্য কাপড় কিনতে ঈশ্বরদী যাবে?" "জ্বী ভাইজান!" বাবা একটা সিকি পয়সা বের করে দিয়ে মামাকে বললেন, "এটা ধরো! খোকাকে সাথে নিয়ে যাবে! ওর জন্য ভালো একজোড়া চটি-স্যান্ডেল কিনে দেবে!" "জ্বী আচ্ছা"- বলে মামা দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে, সরে গেলেন। খুশীর আবেশে আমার ছোট্ট পৃথিবীটা তখন দুপুরের সূর্যের মত আলো ঝলমলে!

অভিমানী গোপন ডেরা থেকে দ্রুত বের হয়ে পুকুরঘাটলা থেকে ডুব দিয়ে এলাম। ক্যারোলিন কাপড়ের জামা আর হাফপ্যান্ট পরে, খেয়েদেয়ে মামার দোকানের চরাট (বাঁশের ফালিতে পেঁরেক পোতা। বেঞ্চের বিকল্প) এ অপেক্ষায় থাকলাম। ধৈর্যের শেষ সীমানা পার করে মামা এলো ঘর থেকে। আমাকে ডাক দিতেই একলাফে উঠে পড়লাম। চরাটে পোতা পেঁরেকের মাথায় বিঁধে চড়াৎ করে ছিঁড়ে গেলো প্যান্টের পিছনটা। অতিরিক্ত না থাকায় ছেঁড়া প্যান্টেই রওয়ানা হলাম! খুশীর অতিশয্যে মনে রইলো না প্যান্টের ছেঁড়া অঙ্গনের কথা। লোহার রড বাঁকিয়ে "দ" বানানো হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেক কসরৎ শেষে বাস ষ্টার্ট নিলো। ঝক্কড় ঝক্কড় শব্দ তুলে আর কালো ধোঁয়াতে আকাশটা অন্ধকার করে, এবড়োখেবড়ো পথে  বাস এগিয়ে চললো যুদ্ধং দেহি মনোভাবে।

বাস থেকে নেমে ঈশ্বরদী বাজারের এমাথা সেমাথা ঘুরে ঘুরে দোকানের জন্য কাপড় কিনলো মামা। এ দোকানে সে দোকানের বিহারী মাড়োয়াড়ি দোকানীরা কত মুচকি হেসে চা খাওয়ালো মামাকে। মামাকে বলি-, "আমাকে একটু চা দিও মামা।" "তুই চা খাবি! আচ্ছা দেবো!" অন্য এক দোকানে বিহারীবাবু চা আপ্যায়ন করলো! পাশে বসে মামাকে খোঁচা মারি, "আমার চা কই?" মামা ফিসফিস করে বলে, "আমি খেয়ে নিই, বাকিটুক তুই খাস!" মামার আধখাওয়া চা-এ ঢোঁক দিচ্ছি আর ঠ্যাং নাচাচ্ছি। ভাব এমন যেন কতদিনের চা-খোর  আমি। গরমে জিহ্বা পুড়ে গেলো। তাতে কি! চায়ে চুমুক দিতে দিতে একসময় পুরো চা মুখে পুরে দিলাম। আর তখনই মনে পড়লো, মামা তো আগে চা খেয়ে তলানী রেখে দিচ্ছিলো। এখন এখানে আমি যদি চায়ের তলানী না রাখি, তবে ওই বিহারীবাবু ভাববে, "বাঙালী ছেলে চা খেতে জানে না!" একথা মনে হতেই মুখ থেকে পুঁকুৎ করে একদলা থুতুসহ কিছু চা উগরে দিলাম চায়ের পেয়ালায়। আঁড়ে চেয়ে দেখি, চাপদাড়ি ওয়ালা বিহারীবাবু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। লজ্জায় লাল হয়ে কেঁদে ফেললাম।
মামা ভাবলো, আমার স্যান্ডেল কেনার দেরি হচ্ছে বলে হয়তো! জুতোর দোকানে ঢুকে মামা বললো,
"মেয়েছেলের চটি দেখান দেখি! "ফিসফিস করে বলি, "ও মামা! আমি কি মেয়েছেলে নাকি? তুমি বলবে ছেলেদের স্যান্ডেল দেখাতে। তা না, তুমি মেয়েছেলের চটি চাইছো। কী বোকা তুমি!" শুনে মামা বাঁকা হাসে। স্যান্ডেল এলে বুঝলাম, মামীর জন্যই স্যান্ডেল নেবে মামা। তা একথা আগে বললে কি হয়? আমার পালা এলো। অনেকক্ষণ ধরে, অনেক জোড়া স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে, দেখে দেখে শেষে পছন্দ হলো। কালো প্লাস্টিকের ওপর রেক্সিন পলেস্তরা করা নক্সাদার চটিজুতো। দাম পঁচিশ পয়সা। দরদাম। হাঁকাহাঁকি শেষে মামা দুইজোড়া কিনলেন চল্লিশ পয়সা দিয়ে।

মহামতি সম্রাট আলেকজান্ডার বিশ্বজয় করে এতো খুশি হয়েছিলো কি না জানি না। তবে জীবনের প্রথম স্যান্ডেল পেয়ে সারা রাস্তা বাসের সিটে বসে, জানালার বাইরে দ্রুত অপসৃয়মান গাছগাছালি, আকাশের মেঘের সাথে কত গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি, মায়ের বুকে ঘুমিয়ে আছি। আর আমার সেই মহামূল্যবান স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বোনটা ফিকফিক করে হাসছে।
কারণ আমি যে স্যান্ডেল কিনেছি- তা মেয়েছেলের জুতো!






দেবু টুডুর মেয়ে

বি উ টী  সা ন‍্যা ল


ঝাড়খন্ডের একটা প্রত‍্যন্ত গ্রাম, যে গ্রামের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে কেঁদ গাছের পাতা থেকে তৈরী বিড়ি, মহুয়া বিক্রি আর পাথর খাদানে কাজ করে। দেবু টুডু তেমনি এক মহুয়া বিক্রেতা। রোজ সকালে দেবু আর দেবুর বউ মালা বেরিয়ে যায় মহুল ফল, ফুল জোগাড় করতে। তারপর ফিরে এসে মালা সংসারের কাজ রান্না এসব সেরে যায় ওদেরই গ্রামের জমিদার বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করতে। দেবু সকাল থেকেই এসে লেগে পড়ে মহুয়া তৈরীতে। মহুয়া তৈরীতো দিনে দিনে হয় না, তা তৈরী করতে কয়েকটি দিন সময় লাগে। দেবুর বউ কাজ থেকে ফিরে দেবুর সঙ্গে হাত লাগায় কাজে। আগে মহুল গাছ উজাড় করে দিতো তাদের এখন গাঁয়ের মাতব্বররা সব মহুয়া গাছ গুলো লিজ নিয়ে রেখেছে। যাতে কেউ মহুয়া গাছের ফুল, ফল না নিতে পারে তার জন্য পাহারা বসিয়েছে। তবুও রাত থাকতে উঠে দেবু আর মালা দুজনে লুকিয়েচুরিয়ে জোগাড় করে মহুয়া ফল, ফুল।
                                                     মালা যে জমিদার বাড়িতে কাজ করে সেই বাড়ির মেয়ে পড়াশোনা করে ঝাড়খন্ডের রাজধানী রাঁচি শহরে। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। জমিদার গিন্নী মালার মেয়েকে বেশ পছন্দ করে। মালাকে ডেকে প্রায়ই গিন্নী মা তার মেয়ের ছোটো হয়ে যাওয়া দামি দামি জামা কাপড় দিয়ে বলে "তোর মেয়েকে পরাবি"।মালার মেয়ের চৌদ্দ বছর বয়স। কালো হলে কি হবে মেয়েটি দেখতে বেশ, এই বয়সে বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে।

দেবু দোকান খোলে ঠিক সূর্য অস্তাচলে যাবার আগেই। পাথর খাদান থেকে পাথর ভেঙে আসা যত মেয়ে মরদ গুলো জমায়েত হয় দেবুর দোকানে মহুয়া খাবে বলে। ওদের গ্রামে শিক্ষার আলো সেভাবে পৌঁছয়নি। তাই ওরা জানে গতর খাটিয়ে পাথর ভাঙতে আর দুপুরের পর থেকে একে একে এসে মহুয়ায় বুঁদ হয়ে যেতে। মহুয়ার নেশা রঙ ধরায় মনেও। দেবু মহুয়া বিক্রি করতে করতে নিজেও মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে যায়। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে মাদল আর ধামসা বাজিয়ে গাঁয়ের মেয়ে মরদ গুলো দেবুর দোকানের সামনে যে ছোটো মাঠ আছে সেই মাঠে নাচ গানে মত্ত হয়। সেই মাঠের পাশেই  রয়েছে পলাশের বন। বসন্তে লালে লাল হয়ে থাকে পলাশ গাছ গুলো।

এই ভাবে দেবুর জীবন চলতে থাকে। হঠাৎ করেই একদিন শুরু হয় দেবুর অসহ‍্য পেটে যন্ত্রনা। দেবু কাতরাতে থাকে আর তার সঙ্গে শুরু হয় বমি। দেবুকে নিয়ে যাওয়া হয় ওদের গ্রাম থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ধরা পড়ল দেবুর পেটে ক‍র্কট রোগ বাসা বেঁধেছে। ওই মারন রোগের চিকিৎসা করানোর মতো খরচ তাদের নেই। দেবু আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে থাকে। একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করে দেবু বিদায় নেয় পৃথিবী ছেড়ে।

দেবু চলে যাবার পর থেকে মালা আর তার মেয়ে মিলে মহুয়া বিক্রি শুরু করে। দেবুর মেয়ে দেবুর মতো খাটতে পারে না। মালার ওপর অসম্ভব কাজের চাপ শুরু হয়। যেভাবেই হোক দুটো পেট তো চালাতে হবে। কত মানুষ আছে যারা মহুয়া খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে যায় কিন্তু মহুয়া খাওয়ার পয়সা দিতে চায় না। অক্লান্ত বিরামহীন পরিশ্রম আর অর্ধাহারে আস্তে আস্তে মালাও যেনো নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকে। তারও শুরু হয় হৃদরোগ। এখন আর মালা মহুয়া তৈরী করতে পারে না। প্রায় দিনই বিছানায় শয্যাশায়ী থাকে সে। দেবু আর মালার মেয়ে রোজ সকালে উঠে সংসারের কাজ সেরে রান্না করে, মালাকে খাইয়ে নিজে খায়। 

ক্ষিদের জ্বালা যে বড় জ্বালা। তাই সূর্য অস্তগামী হলে দেবুর মেয়ে রোজ দোকান খোলে। এখন আর দেবুর দোকানে মহুয়া বিকোয় না। বিকোয় দেবুর টুডুর মেয়ের শরীর।






জয়ী

স ঞ্চি তা  গো স্বা মী


ঘড়ির কাঁটা রাত ১২ টার ঘর পেরিয়েছে কিছুক্ষণ। চারদিক নিস্তব্ধ। কলকাতার এই অভিজাত পাড়ায় হয়তো অনেকেই জেগে এখনও, কিন্তু সেসব রাস্তায় দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় নেই। পৌষের মাঝামাঝি এই সময় হঠাৎ বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের জেরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে বিকেল থেকে। তার সাথে ঝড়ো হাওয়া। ঠান্ডাটা তীক্ষ্ণ দাঁতে কামড় বসাচ্ছে শরীরে। হ্যালোজেন বাতি আর বৃষ্টির অবিরাম ধারায় ধুয়ে যাচ্ছে রাস্তা, ধুয়ে যাচ্ছে পর পর দাঁড়িয়ে থাকা মহার্ঘ সব অট্টালিকা। আহ্... সত্যি, আরাম করে ঘুমোনোর রাত আজ। কিন্তু, ঘুম নেই চন্দ্রানির চোখে। মধ্য চল্লিশের প্রতিষ্ঠিত নারী। তার স্বামী, অনির্বাণ ও নামী কলেজের শিক্ষক। চন্দ্রা নিজে একজন নামী গায়িকা। টিভি , রেডিও, সিনেমা... সব জায়গায় এখন তার গান বাজে। মাসের মধ্যে বেশিরভাগ দিনই হয় সে বিদেশে অনুষ্ঠান করে অথবা দেশেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রোগ্রাম করে। সংসারে দেবার মতো সময় নেই তার। 

বিয়ের বেশ কিছু বছর পরেও যখন চন্দ্রা আর অনির্বাণের কোনো সন্তান হলো না, তখন পরিবার ও চেনা পরিচিত অনেকেই প্রশ্ন করায় তারা বলেছিল, চন্দ্রা সন্তান ধারণে আগ্রহী নয়। সন্তান জন্মানোর আগের ও পরের এতগুলো মাস সে কিছুতেই তার গানের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারবে না। সবাই মেনে নিলো। আস্তে আস্তে বয়েস বাড়তে লাগলো তাদের। বিশাল বাড়িতে দুটি মাত্র প্রাণী। তারা স্বামী স্ত্রী। কাজের লোকজন অবশ্য আছে অনেকেই। কিন্তু, রাতের এই একলা সময়ে, ঘুম না এলে বড়ো একা লাগে আজকাল চন্দ্রার। আজ অনির্বাণ ও বাড়িতে নেই। সে দিল্লি গেছে কলেজের কোনো সেমিনারে যোগ দিতে। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে। এদিকে, কোলকাতায় প্রবল দুর্যোগের জন্য আজ থেকে ৫ দিন চন্দ্রার সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেছে। অখন্ড এমন অবসর এর আগে কখনো পায়নি চন্দ্রা। সারা রাত জানলার ধারে চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কেটে গেলো। ভোরের দিকে হয়ত চোখটা একটু লেগে এসেছিল তার। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। তাড়াতাড়ি উঠে গেট খুলে দেখে এই বৃষ্টি মাথায় করে সকালবেলায় কাজের মেয়ে মলিনা হাজির। কিন্তু, ওর কোলের কাছে ওটা কি? মনে হচ্ছে কাপড়ে মোড়ানো একটা বড়ো পুতুল!! চন্দ্রা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মলিনা ভয়ে ভয়ে বলে, ম্যাডাম, আমার বোনের মেয়ে এটা। এই সবে ১০ দিন বয়েস। ওকে ছেড়ে বোন অন্য কারোর সাথে পালিয়েছে কাল রাতে। ওর বর আর এই বাচ্চা রাখতে পারবে না। তাই কাল রাতেই আমার কাছে দিয়ে গেলো। আমার বাড়িতে তো কেউ নেই ওকে দেখার। তাই সাথে করে নিয়েই কাজে এসেছি। 

প্রচন্ড বিরক্ত হয় চন্দ্রা। তার এসব ঝামেলা একদম ভালো লাগে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাড়িতে একি উৎপাত!! বিরক্তিভরা মুখভঙ্গী করে বলে, বাহ্... ওকে নিয়ে এলে? তুমি যখন কাজ করবে ওকে কে দেখবে? মলিনা তাড়াতাড়ি বলে, কিছু হবে না ম্যাডাম। ওকে শুইয়ে রাখবো। ও কোনো বিরক্ত করবে না। গরীবের বাচ্চা এভাবেই মানুষ হয়। আর কিছু বলে না চন্দ্রা। মলিনা বাচ্চাটাকে এই ঠান্ডায়, মেঝেতে একটা শুধু চাদর পেতে শুইয়ে রাখে। বাচ্চাটা মাঝে মাঝে হাত পা নাড়ায়, আবার কখনো চুপ করে হাতের আঙ্গুল মুখে পুড়ে ঘুমিয়ে যায়। হয়ত ওর খিদে পায়, কিন্তু, ও বুঝে গেছে, খিদে পেলেই খাবার পাওয়া যায় না। 

কিছুক্ষণ দেখার পর চন্দ্রা মলিনাকে ডাকেন। বলেন, ওকে সকালে কিছু খাইয়েছো? মলিনা বলে, একবার দুধে জল মিশিয়ে খাইয়েছি। এতো কচি বাচ্চা। ওর তো এখন শুধু মায়ের দুধই খাবার কথা। কিন্তু পোড়া কপালি তো তা পেলো না। চন্দ্রা একটু চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, শোনো, ওকে এই বিছানায় তুলে শোয়াও। তারপর কিছু টাকা ওর হাতে দিয়ে বলেন, এখন ঘরের কাজ রাখো। বাজারে গিয়ে ওর যা যা দরকার... গরম জামা, অয়েলক্লথ, babyfood, বাচ্চাদের ক্রিম, তেল কয়েক সেট জামা প্যান্ট... সব নিয়ে এসো। আর, তুমিও আজ থেকে রাতে এখানেই থেকো। নাহয় আমরা দুজনে মিলেই ওকে মানুষ করবো!! 

চোখে জল আসে মলিনার। আজ প্রথম সে চন্দ্রা কে ম্যাডাম না বলে মা বলে ডাকে। বলে, মা... তুমি সত্যি ওর ভার নেবে? ওর কী এতো সৌভাগ্য হবে? চন্দ্রা বলে, চুপ করো মলিনা। কম বয়সে বুঝতে পারিনি একটা সন্তান... একটা বাচ্চা বড়ো দরকার জীবনে। ব্যস্ত দিনের শেষে ঘরে ফেরার টান থাকা তো চাই। নাহলে, ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হয় না। এখন বড়ো অনুতাপ হয় ওই জন্য। তোমার বোনের মেয়ে আমার জীবনে আশীর্বাদ। ওর জন্যই এখন থেকে ঘরে ফিরবো আমি আর অনির্বাণ। এবার বলো তো.... ওর নাম কি রাখি? মলিনা বলে, তুমি তো ওর মা... তুমি রাখো ওর নাম। চন্দ্রা বলে , ও হলো জয়ীতা। আমাদের জয়ী। জীবনের সব ক্ষেত্রে যেনো জয়ী হয়। তুমি শিগগির দোকানে যাও। আমি এখুনি অনির্বাণকে ফোন করে এতো বড় সুখবরটা দিই। উজ্জ্বল হাসিতে এই বৃষ্টির দিনে ও ঝক ঝক করে বাড়িটা।







মোর পানিতে ঘর

কা ক লী  ব সু


ডুবন্ত সূর্যের আলোয় পশ্চিম আকাশটা তখন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চারিদিকে কেমন একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ। একেই বোধহয় কনে দেখা আলো বলে। কাঠকুটো কুড়িয়ে ছাগলের পালটাকে তাড়াতে তাড়াতে বাড়ির পথ ধরেছে রূপাই। আনমনে পথ চলতে চলতে চোখ দুটো তার জ্বালা করে ওঠে। মনে মনে ভাবে সাজুর কথা। সাজু দলুই রপাইএর মরদ। সত্যিই মরদের মতো মরদ সাজু। মিশকালো গায়ের রঙে এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। লম্বা সুঠাম মেদবিহীন দেহ। আর রূপাই? টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। হাসলে গালে টোল পড়ে। কারণে অকারণে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া রূপাইএর স্বভাব। এইজন্য মা, জ‍্যেঠিমার কাছে অনেক ধমক খেয়েছে সে। কিন্তু এখন রূপাই কথায় কথায় হাসে না। বরং একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গেছে। কারণ প্রায় মাস দেড়েক হলো তার মরদটা গেছে ডিঙি নৌকো নিয়ে সাগরে। ফিরবার সময় হয়ে গেছে সেই কবে! এখনো ফেরে নাই। ছাগলগুলো আগে আগে চলেছে।মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুতি করছে। একটা গাছের ছোট্ট ডাল ভেঙ্গে রূপাই ছাগলগুলোকে নিয়ে পথ চলতে থাকে। মাঠের আলের পথ শেষে বাড়ির উঠোনে এসে পৌঁছায়  রূপাই। মাথার কাঠের বোঝাটা নামিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে ঘরের দাওয়ায়।ছাগলগুলো চলে যায় শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে গোয়ালে।রূপাই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা দুটো তারা উঁকি দিচ্ছে, কাস্তের মতো অষ্টমীর চাঁদটাকেও দেখা যাচ্ছে নারকেল গাছের আড়ালে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে সাজুর কথা ভাবতে ভাবতে চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসে রূপাইএর। চলে যায় স্বপ্নের দেশে। সেখানে সে দেখে তার সই পার্বতী তাকে ডাকছে ওরে ও মুখপুড়ী! ও রূপাই! সেই কক্ষণ থেইকা তুরে ডেকতেছি, শুনছিস না কেনে?" রূপসা ঝাঁঝিয়ে ওঠে পার্বতীকে। বলে "কেনে রে কেনে চিল্লাচিল্লি কইরবার লাগছিস? মোর মন মেজাজটো ভালো নাই। বোল কি বোলবি।" পার্বতী রূপসার গাল টিপে বলে "চল কেনে গাং পাড়ে। দেখবি কে আসিছে। আরে সাজুরে তোর মরদ আসিছে।" রূপসা দৌড়াতে শুরু করে মেঠো পথে। দৌড়ে পৌঁছে যায় সাজুর কাছে। সাজু বুকে জড়িয়ে ধরে রূপাইকে। রূপাইএর এলোমেলো চুল কপাল থেকে সরিয়ে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে সাজু।সাজুর প্রশস্ত বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে রূপাই। বলে "মোরে কথা দে তুই সাজু, আমারে না লইয়া আর পানিতে যাবিকনা। আমারে লইয়াই তুই এরপর থেইক্যা মাছ মারতে যাবি"। রূপাইএর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সাজু বলে, "মোর পানিতে ঘর, বন্দরে আসি তোর লাইগ্যা"। এরপর যখন জলে যাবো তখন তোরে লইয়া যাবো" শুধু প্রেমের পাল তুলিয়া দুজনে কুজনে ভাইস‍্যা" যাবো। হঠাৎ সাজুর মায়ের ক্ষীণ গলার স্বরে তন্দ্রা ছুটে যায় রূপাইয়ের। "ও বৌ! খিদে পাইছে বটেক, একটু চালভাজা দে না। নাই কি ঘরে?






প্রেমপত্র : কৈফিয়ত

ছ বি  ব্যা না র্জী


শুভ,
আজ মধ্য চল্লিশে এসে এই চিঠিটা তোকে লিখছি।বলতে পারিস তোর সেদিনের বিশ্বাস ভাঙার ঘটনাটা আজও আমি ভুলতে পারিনি।

সেই প্রাইমারি পড়ার সময় থেকে তুই আমি অভিন্ন বন্ধু ছিলাম।ক্লাস টেনে উঠে তুই আমি দু'জন দু'জনকে কিরকম যেন অন্য চোখে দেখা শুরু করলাম। তুই হঠাৎ করেই হিলহিলে লম্বা হয়ে গেলি। ঠোঁটের নীচে হাল্কা নরম সবুজ ঘাসের মতো গোঁফের আভাস। সেই সময় তোর চোখে চোখ পড়লেই তোর চোখে আমি মুগ্ধতা দেখতে পেতাম। তখন তোর আমার ঠিক ভালোবাসা বোঝার বয়স হয়নি। কিন্তু তোর মুখের দিকে আমার মাঝে মাঝে হাঁ করে চেয়ে থাকতে ভালো লাগত।

একবার আমার জ্বর হয়েছিল। পরপর দুদিন স্কুল যেতে পারিনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু তোর কথা আমার মনে পড়ত।

তারপর যেদিন স্কুলে গেলাম সেদিন এক ফাঁকে তুই আমাকে কাগজ দিয়ে বললি- ইন্দু এটা তুই বাড়ি গিয়ে পড়ে কাল আমাকে উত্তর দিবি।

এই চিঠিটাই তুই লিখেছিলি--- ইন্দু তোকে পরপর দুদিন দেখতে না পেয়ে আমার মনটা কেমন উদাস উদাস লাগছিল। লেখাপড়ায় মন দিতে পারছিলাম না। কদিন পর টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলে তোর সংগে আমার দেখা হবে না। এটা ভাবতেই এখন থেকে আমার মন খারাপ করছে। তুই কিন্তু আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখে তোর ভাইকে দিয়ে লুকিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। লিখবি তো? না হয় আবোলতাবোল কিছু লিখিস। আর আমি মাঝে মাঝে সাইকেল করে তোর বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে সাইকেলের ঘন্টা বাজালে একবার বারান্দায় দাঁড়াবি কেমন?
-ইতি শুভ।

আমি তারপর দিন তোকে সেই চিঠির উত্তরে লিখেছিলাম--- শুভ, আমারও তোর জন্যে খুব মন খারাপ করবে। কিন্তু আমরা তো এখন ছোট। আমরা অনেক বড় হয়ে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করলে তুই আমি বিয়ে করে সারাজীবন একসংগে থাকব। তুই এখন শুধু খুব মন দিয়ে লেখাপড়া কর।সামনেই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা। ইতি  ইন্দু।

তুই চিঠিটা পড়ে তোর বইয়ের ভাঁজে রেখে দিয়েছিলি। তোর মা তোর বই গোছাতে গিয়ে চিঠিটা পড়েছিল। তোকে জিজ্ঞেস করেছিল--- এসব পাকামি কতদিন ধরে চলছে? তুই অবলীলায় বলেছিলি--- আমার কোনো দোষ নেই মা।ইন্দু এটা লিখেছে।তোর মা তোকে কিছুমাত্র বকাবকি না করে সোজা চিঠিটা নিয়ে আমার মাকে দেখিয়ে বলল--- দ্যাখো রমাদি তোমার মেয়ের কান্ড দ্যাখো।এই বয়সেই কেমন এঁচোড়ে পেকে আমার ছেলেকে প্রেমপত্র লিখেছে। মা বলল- তোমার ছেলে কিছু লেখেনি? চিঠি লেখালিখি তো একতরফা হয় না।তোমার মা বলল--- ঠিক আছে তাহলে দেখাক। ও যদি লিখে থাকে তাহলে আমি ওকে আগাপাশতলা মেরে তোমার পায়ে নাকে খত দেওয়াবো।

আমার মা আমার চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে বলল--- শুভর চিঠি বের কর। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম--- শুভ আমাকে কোনো চিঠি লেখেনি। তোমার মা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে গেল।

আচ্ছা শুভ তুই এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা কেন করেছিলি? তারপরও আমাদের টেস্ট পরীক্ষার দুটো সাবজেক্ট বাকি ছিল।ঐ দুদিন তুই তোর মায়ের বাধ্য ছেলের মতো আমাকে এড়িয়ে গেলি। একটা বারও আমার মুখের দিকে চাইলিই না। অথচ তোর দেওয়া কোন অজানা পাখির রঙিন পালকটা আজও আমার সঞ্চয়িতায় যত্ন করে রেখে দিয়েছি।তোর দেওয়া ঝুটো মুক্তর দুল জোড়া আমার সোনার গয়নার বাক্সে আজ ও রাখা আছে।

আমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর আমরা কলকাতা চলে এলাম। অনেকবার মনে হয়েছে তোদের ল্যান্ডফোনে একবার ফোন করি। গভীর অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম।জানিনা এই চিঠি তোর হাতে কোনোদিন পৌঁছাবে কি না। 

ইতি ইন্দ্রাণী।

 চিঠিটা খামে ভরে রাখতেই ইন্দ্রাণীর বর সৈকত বলল-এত মন দিয়ে ফোনের যুগে কাকে প্রেমপত্র লিখছ ইন্দু?--- ইন্দ্রাণী বলল--আমার বাল্যপ্রেমিককে।

সৈকত বলল- সর্বনাশ কান্ড। তাহলে এই বয়সে আমার কপালটা কি পুড়ল?---চিঠি লেখাই সার। এই চিঠি কি কোনোদিন তার হাতে পৌঁছবে? সৈকত বলল--- শুনেছি বাল্যপ্রেম সর্বনেশে প্রেম। এই প্রেমের কখনও পরিণতি হয় না। ইন্দ্রাণী বলল--- প্রেম না ছাই।শয়তানটা আমার সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তখন অল্প বয়স ছিল বলে ওকে মার খাওয়া থেকে দয়া করে বাঁচিয়েছিলাম।আজ সামনে পেলে হাতের সুখে মেরে ঠ্যাং ভেঙে দিতাম।

সৈকত বলল--- তাহলে তো তোমার এই চিঠিটা তো যেমন করেই হোক পৌঁছাতেই হবে।দরকার হলে তোমাদের গ্রামে চলে যাব। ওকে হিড়হিড় করে টেনে তোমার সামনে নিয়ে আসবই।আমার বৌয়ের সংগে বিশ্বাসঘাতকতা?চিঠিটা আমি পড়তে পারি ইন্দু?

ইন্দু বলল--- না পড়ার কি আছে? চিঠিটা পড়ে সৈকত বলল--- ইস্ বড্ড দাগা দিয়েছে আমার ভালো মানুষ বৌটাকে। না আমি কিছুতেই ও ব্যাটাকে ছাড়ব না। দরকার হলে শুভর মাকে এই চিঠিটা পড়াবো। তখন তোমার মা আর শুভর মা দুজনে মিলে কেমন কোমর বেঁধে ঝগড়া করে সেই ভিডিওটা তোমাকে এনে দ্যাখাবো। তারপর শুভর ঠিকানা জোগাড় করে তোমার সামনে তাকে না এনে ফেলেছি তো আমার নাম নেই।

*প্রেম পত্রের উত্তর: কৈফিয়ত*

ইন্দ্রাণী বলল--- সৈকত তুমি আমার সিরিয়াস বিষয়টা নিয়ে ঠাট্টা করছ?সৈকত বলল--এটা তুমি কি বলছ ইন্দু।আমি লঘু বিষয় নিয়ে তোমার সংগে ঠাট্টা করি বলে এই সাংঘাতিক সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করব? চিঠিটা লেখার পর আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার মুখটা একদিকে  রাগে গনগনে করছে অন্যদিকে পুরনো স্মৃতি মনে করে চোখ দুটো ছলছল করছে।ইন্দু বলল--আবারো ঠাট্টা?

সৈকত বলল--এই দ্যাখো এইজন্যে কথায় আছে কারোর ভালো করতে নেই।আমি কোথায় ভাবছি আমার বৌটাকে ছেলেমানুষ বয়সে, রোমান্টিক করার বয়সে ঐ শুভ হতচ্ছাড়া এমন একখানা দাগা দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করল, এমনকি তোমার মায়ের হাতে উদোম ধোলাইও খাওয়ালো তাকে আমি অত সহজে ছেড়ে দেব? আমি ওদের গ্রামের বাড়িতে যাবই যাব। ওকে না পেলে ওর মাকে এই চিঠি পড়িয়ে তোমার মায়ের কাছে অন্তত ক্ষমা চাওয়া করিয়ে শুভর ঠিকানা ফোন নম্বর নিয়ে আসব।

ইন্দু বলল--সত্যি বলছ?--একশোভাগ সত্যি বলছি। তোমার যোগ্য স্বামী হবার জন্য এটা আমাকে করতেই হবে। কিন্তু শুভর লেখা রোমান্টিক প্রেমপত্রটা তো আমাকে প্রমাণ হিসাবে নিয়ে যেতে হবে। সেটা তোমার কাছে আছে তো? ---আছে মনে হয়।আর ঐ যে শুভ তোমাকে একটা রঙিন পালক দিয়েছিল সেটা তো সঞ্চয়িতায় থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে। ওটা আমি বরং ল্যামিনেশন করে আনব। অনেকদিন পর যখন অরিজিনাল পালকটা নষ্ট হয়ে যাবে তখন এই ল্যামিনেশন পালকটি থেকে যাবে। আর  মুক্তর দুল দুটোও পালিশ করে আনব।

ইন্দু বলল--বুঝতে পেরেছি, এতক্ষণ সিরিয়াস মুখ করে তুমি আমাকে  ঠাট্টা করছিলে। সৈকত বলল--- দ্যাখো ইন্দু সিরিয়াস মুখে আর যাই হোক ঠাট্টাটা অন্তত করা যায় না।ঠাট্টা করলে আমার গোঁফের ফাঁকে তুমি মুচকি হাসি দেখতে পেতে। তুমি দেখেছিলে?---না তা অবশ্য দেখিনি। ---আসলে ছেলেবেলার স্মৃতি অমূল্য। সেই স্মৃতিকে মণি মুক্তর মতো আগলে রাখতে হয়।

ইন্দু বলল--তোমার ও এরকম স্মৃতি নিশ্চয়ই আছে। আগে তুমি দেখাও তারপর আমি দেখাবো। সৈকত বলল--- আমার কিছু সুখ স্মৃতি সত্যিই নেই।শুধু একটা দুঃখের স্মৃতি আছে। ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময় ইলেভেনে পড়া একটা মেয়েকে আমার খুব ভালো লাগত। মেয়েটা আমার সংগে অনেকবার হেসে হেসে  কথাও  বলেছে।এমনকি একসংগে ফুচকাও খেয়েছে।সেটা দেখে আমি একদিন সাহস করে একটা প্রেমপত্র লিখে ঐ মেয়েটির হাত দুটো ধরে চিঠিটা দিয়ে বলেছিলাম--- আমি কিন্তু এটার উত্তর চাই।মেয়েটা চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে আমার গালে ঠাসিয়ে একটা চড় মেরেছিল।সেই থেকে নারী জাতিকে আমি ভয় করে চলি।

ইন্দু বলল--- ইয়ার্কি হচ্ছে? আমিও তো নারী জাতির একজন।তুমি আমাকে ভয় করো?--- বিয়ে করা বৌ ঠিক নারী জাতির মধ্যে পড়ে না। ---আবার?---বাদ দাও, আমি কিন্তু এই রবিবার তোমাদের গ্রামে যাচ্ছি।

গ্রামে গিয়ে শ্বশুরবাড়িতে দেখা করে সৈকত টুক করে খোঁজ করতে করতে শুভর বাড়িতে গিয়ে শুভর মাকে প্রণাম করে বলল--- কেমন আছেন কাকিমা?শুভর মা বলল--- তুমি মুখার্জি বাড়ির জামাই না? সৈকত বলল--- হ্যাঁ, কিন্তু আমি আপনার ছেলে শুভর বন্ধুও। শুভ এখন কোথায় পোস্টিং?

শুভর মা বলল--- ও এখন মেদিনীপুরে পুলিশ অফিসার পোস্টে আছে। ---আসলে অনেকদিন ওর সংগে যোগাযোগ নেই। ফোন নম্বরটাও হারিয়ে গেছে। ওর ফোন নম্বরটা একটু দেবেন? ---হ্যাঁ দিচ্ছি, তুমি বোসো বাবা।

পরদিন ফ্ল্যাটে এসে সৈকত বলল--- ইন্দু কেল্লা ফতে। এই নাও তোমার শুভর ফোন নম্বর। আজ সন্ধ্যে বেলায় আমার সামনে ফোনটা স্পিকারে দিয়ে চোখা চোখা শব্দ দিয়ে শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করো। ইন্দু বলল--- ওর মাকে কি বললে?---আরে আসল ভিক্টিম তো শুভ। ওর মা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ।তাকে প্রণাম করে শুভর বন্ধু বলেই তো ফোন নম্বরটা আনলাম।

সন্ধ্যের পর ইন্দু ফোন করতেই ও প্রান্ত ভরাট গলায় বলল--- হ্যালো শুভদীপ সেন স্পিকিং। আপনি কে বলছেন? ---আমি ইন্দ্রাণী বলছি। কি রে বাক্যিহারা হয়ে গেলি নাকি? শুভ বলল---ইন্দু তুই?কেমন আছিস?---এই ইডিয়েট, রাস্কেল, উল্লুক, ভাল্লুক, ছুঁচো পাজি, হনুমান তুই আমার সংগে সেদিন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলি কেন আগে তার কৈফিয়ত দে। ---সেদিন মানে? আর ইংরাজির সংগে বাংলা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি গালিগালাজ করছিস কেন? সে তো বহুবছর আগের কথা। তুই এখনও মনে রেখেছিস?

ইন্দু বলল--- তোকে সামনে পেলে তোর মুন্ডু চিবিয়ে খেয়ে নিতাম। শুভ বলল--- বেশ তাই খাস। কিন্তু বিশ্বাস কর সেদিন মিথ্যে কথাটা না বললে মা শুধু চড় থাপ্পড়ই মারত না।আমার বদমেজাজি বাবা আমার ঠ্যাং ভেঙে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত। তোকে তোর মা মেরেছে শুনে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। আমি সেদিন রাতে না খেয়ে ছিলাম। কিন্তু চিঠিটাও তুই মারকাটারি লিখেছিলি। এটুকু বয়সে হাই জাম্প দিয়ে একেবারে বিয়ে?

ইন্দু বলল--- আর তুই বুঝি ধোয়া তুলসীপাতা? তুই লিখিসনি আমাকে না দেখলে তোর মন খারাপ  করে। আমাকে তোর ভালো লাগে। ---আরে অমন ভালোলাগা তো আরো দুটো মেয়েকেও লাগত। তোকে একটু বেশি ভালো লাগত।বিয়ে করতে গেলে তো চার পাঁচ জনকেই বিয়ে করতে হত।

ইন্দু একটু নরম গলায় বলল--- সত্যি সেদিন তুই না খেয়েছিলি?শুভ বলল--- শুধু তাই? তারপরেও আমি তোর সংগে ভাব করব ভেবেছিলাম।অনেক চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু তুই মুখটা যা হাঁড়ির মতো করে রেখেছিলি।এবার বল তোর বর কি করে? ইন্দু বলল--- আমার বর তোর চেয়ে ঢের ঢের ভালো। সে কলেজে অধ্যাপনা করে।পুলিশের চাকরি আমি দু'চক্ষে দেখতে পারি না। ভাগ্যিস তোর সংগে আমার বিয়ে হয়নি।

শুভ বলল--- আমার বৌও তোর চেয়ে ঢের বেশি সুন্দরী। ইন্দু বলল--- বেশ তাহলে তোর বৌকে নিয়ে একদিন আমাদের বাড়ি বেড়াতে আয়।তখন দেখবি আমার বরের মতো বর লাখে একটা মেলে। শুভ হো হো করে হেসে বলল--- আমার একটা মেয়েও আছে। ---আমার ও একটা ছেলে আছে। তাহলে আসবি তো?---অবশ্যই যাব।কত্তদিন পর ভাব হল এটা আমি মিস করতে পারি?







ভাঙ্গন

সু ন ন্দা  চ ক্র ব র্তী


অনিমার বড় ছেলে অর্ণবের বিয়েতে অনিমা বউয়ের সাথে প্রচুর ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছে। সবাই ধন্য ধন্য করছে যে এমন শাশুড়ি ছন্দা কোনদিন পাবে না। এত আধুনিক মনস্ক অনিমা যে সবাই পিছনে বলে যে বেশীদিন দেখবে আর এসব ভালোলাগবে না। ফেসবুকের কিছু বন্ধুদের ডেকে মিট করে ছন্দাকেও বগলদাবা করে নিয়ে গেছে অনিমা। ছন্দা অপরূপ সুন্দরী। কয়েকটা সিরিয়ালে সে অভিনয় করেছিল। তারপর আবার পড়াশুনাতে মন দেওয়ায় অভিনয় জগত থেকে সরে এসেছে। এখন কয়দিন সংসারটাই করবে ভাবছে। এইতো একমাস হল সবে বিয়ের জল এখনও লেগে। 
বিয়ে, বৌভাত, লোকজনের যাওয়াআসা, হানিমুন সেরে জাস্ট থিতু হয়েছে এক সপ্তাহ হল। ছন্দা পেটের ব্যথায় কাতর। পিরিয়ড হলে খুব কষ্ট পায়। অনিমা ছেলের ঘরে ভ্রূ কুঁচকে ঢুকে বলল, “কি ব্যাপার? তুমি এখনও শুয়ে আছ?” 
ছন্দা উঠে বসলেই অনিমা আঁতকে উঠল, “ই বাবা! একী! রক্তে মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছ যে? তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? এত সুন্দর গোলাপি চাদরটা নষ্ট করে দিলে?” 
ছন্দা প্রাণপণ তাড়াতাড়ি উঠে বিছানার চাদর সার্ফ জলে দুবিয়ে দিল। অনিমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। “এবার যে তোষকটাতেও লেগেছে। এর উপরে তুমি নতুন চাদর পাতবে?” 
ছন্দা অসহায়ের মতন তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মা যে ঠিক কি করত জানা নেই। বাপমায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে একটু বেশী আদুরে ছিল। একটা রুমাল ভিজিয়ে জায়গাটা ঘষতে লাগল আপ্রাণ। অনিমা হিসহিস করে বলল, “এই কয়দিন বাবুল আমাদের সাথেই শোবে। এই নোংরায় শোবে না।” ছন্দা মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রইল। 

“ইশ! এটা চা? ঘোড়ার মুত ছাড়া কিছুই না। তোমাকে দিয়ে দেখছি কিছুই হবে না। রাধিকাদি ঠিক বলেছিল যে এক মেয়ে তাও আবার রূপের ডেলা একে বউ করে ঘরে এনো না, এরা কোন কম্মের নয়। খালি বরের সাথে শোয়া ছাড়া বিশেষ কিছুই পারে না।”  
ছন্দাকে অর্ণব মানিয়ে নিতে বলে। মা বাবাও মানিয়ে নিতে বলে। ছন্দা চুপ করে সব শোনে। অভিযোগ পাহাড়প্রমাণ হতে হতে এমন হয় যে অর্ণব অফিস থেকে ঘরে ঢুকে জুতো খুলতে পারে না। “ছন্দা জানিস দুধে একগাদা জল দেয়, সরটাও মিসিং। আগে সর পড়ত এখন দুধে সর নেই।”   
“উফ! মা ছন্দা দুধে বেশী জল মেশাবে কেন? ও দুধ খায় না তো সর খাবে এমন তো নয়। ছন্দা তোমার মেয়ে হলে কি করতে?” অর্ণব নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে শোনে। 
“এরকম মেয়ে আমার মোটেই হত না। আমি তাকে পড়াশুনা শেখানোর সাথে সাথে ঘরের কাজ শেখাতাম আর সে আমার রক্ত হত ফলে আমার মতন হত বুঝলি?”

রোববারের সকাল। ছন্দা বেশ কয়েকবার উঠতে চেয়েছে। অর্ণব উঠতে দেয়নি। অন্যদিন অফিসের তাড়া থাকে। একটা দিন বউকে বেশীক্ষণ জড়িয়ে ধরে শোবে এটাই তার অভিপ্রায়। নয়টার সময় দরজায় ধাক্কা। “ছন্দা, লজ্জার মাথা খেয়ছো নাকি? বাড়িতে কাজের লোক ঢুকে গেছে। সে ঝাড় দেবে মুছবে। আশ্চর্য মেয়ে তো তুমি? আমাকে নাহয় বলদ ভেবে নিয়েছ। সেই বিয়ের পর ইস্তক কলুর বলদের মতন সংসারের ঘানি টেনেই আসছি আজও রেহাই নেই। সকাল থেকে চা জলখাবার বানিয়ে বসে আছি যে কখন খেয়ে উদ্ধার করবে।” 
অর্ণব কিছু বলতে গেছিল এক দাবড়ে চুপ করিয়ে দেওয়াতে রেগেমেগে অর্ণব গ্রিল খুলে বেরিয়ে গেছে। দুঘণ্টা হয়ে গেছে অর্ণব ফেরেনি। ছন্দা দেখল রাগের চোটে ক্যাসারলে রাখা এক পাঁজা লুচি বাগানে ফেলে দিল অনিমা। ছন্দার লুচি দেখে খিদেটা চেগে উঠল। একটার সময় ম্যাটাডর থেকে অর্ণব নামল সাথে বেশ কিছু ছেলেপুলে। সোজা ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে ম্যাটাডরে তোলা শুরু হল। অনিমা খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে চুপ করে রইল। অর্ণব বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “ছন্দাকে নিয়ে মায়ের খুব প্রবলেম বাবা, আমি ওকে নিয়ে অন্যত্র থাকছি। তোমরা এই বয়সে এসে অশান্তিতে থাক চাই না। আমিও অফিসের চাপের পর ঘরে এসে এক দণ্ড শান্তি পাইনি বাবা। একজনের চিৎকার আর আরেকজনের কান্না আমাকে অসহ্য করে দিয়েছে। তুমি বুঝবে বাবা।” 
ছন্দা প্রণাম করতে গেছিল অনিমা পা সরিয়ে নিয়েছে। সে একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। কে বলবে তিন চার ঘণ্টা আগেও এক নাগাড়ে চিৎকার করে ছন্দাকে পাগল করে দিয়েছে। ছন্দা ক্যাবের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলল। পাশের বাড়ির সেনকাকিমা এসে দাঁড়াতেই বলল, “আমি মায়ের থেকে কিন্তু ছেলেকে আলাদা করতে চাইনি জান” 
“জানিনে আবার? আমরা কি কানে শুনতে পাইনে? অনিমা বরাবর চোপাদারনি। শাশুড়িকে কম চোপা করত নাকি? বুড়ি মরে বেঁচেছে। যাক, তোমরা সুখে থেকো।” 
দরজার সামনে অনিমা দাঁড়িয়ে দুবার ঢোঁক গিলল। 
অর্ণবের বাবা গেট বন্ধ করে এসে সোফায় বসে পড়ল। “ভাঙ্গনটা কি খুব জরুরী ছিল বাবুলের মা?” 
অনিমা ঘটনার আকস্মিকটায় বোবা হয়ে গেছে।







সূর্যাস্তের পর

শাঁ ও লি  দে


(এক)

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেওয়ালে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে অভীক অনেকক্ষণ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সন্ধে থেকে লোডশেডিং। রাস্তার বাতিগুলোও জ্বলছে না তাই। বাড়িতে ইনভার্টার আছে, অথচ আজ কেউই কোনো ঘরে বাতি জ্বালায়নি। রাত অনেক হয়েছে তাই আশেপাশের সবাইও আলো নিভিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু এ বাড়িতে কারো চোখে ঘুম নেই। 

এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই অভীক ওর পিঠে একটা স্পর্শ অনুভব করল। মাম এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। শুকনো মুখে হাসির চেষ্টা করল অভীক। মাম অন্ধকারে টের পেল না কিছুই। ফিসফিস করে বলে উঠল, শোবে না? অনেক রাত তো হল! 
-মা শুয়ে পড়েছে? শান্ত গলায় জানতে চাইল অভীক। 
-হ্যাঁ। আমি এইমাত্র ও ঘর থেকে এলাম। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একটা ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। কেমন কৈফিয়ৎ দেওয়ার গলায় বলে উঠল মাম। 
-উফ্‌ ! আবার ঘুমের ওষুধ দিতে গেলে কেন? ডাক্তারকাকু না করেছেন তো? অধৈর্য হল অভীক। 
-সে তো জানি। কিন্তু আজ যা ছটফট করছিলেন ওষুধ না দিয়ে উপায় ছিল না। সারারাত কে পাহারা দিত? মাম বেশ জোরের সঙ্গেই কথাগুলো বলল। 
-আমি দিতাম! অভীক বলল।
-হ্যাঁ। সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সেই সন্ধে থেকে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ। না কারো সঙ্গে কথা বলছ, না কিছু খেলে! তোমার দেখাদেখি যে বাড়ির কেউ খেল না সে খেয়াল আছে? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল মাম। 
-দেখাদেখি মানে? তুমি কি বলতে চাইছ কারো দুঃখ হয়নি? একমাত্র আমিই ... 
আর কিছু বলতে পারে না, গলা বুজে আসে অভীকের।
মামের খারাপ লাগে। এমন করে বলা উচিত হয়নি ওর। এমনিতেই সেই বিকেল থেকে কম ঝড় গেল না ওর মনের ওপর দিয়ে। একটু কাছে এসে গা ঘেষে দাঁড়ায় ও অভীকের। প্রসঙ্গ পালটে বলে, যাও চোখে মুখে জল দিয়ে শুয়ে পড়ো এবার। কাল সকাল হোক। দেখবে নতুন ভোর হবে, সব পালটে যাবে।
-নাহ্‌! কিছুই পাল্টাবে না, আমি জানি। চিনি ওঁকে ভালো করে। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে আর তার থেকে তাঁকে টলানো যাবে না। দেখে নিও তুমি! মামের ঘাড়ে হাত রেখে বলে অভীক। 

হঠাৎ করেই আর কোনো কথা খুঁজে পায় না মাম। অভীক যা বলল, মাম জানে তা কতটা সত্যি! সেও তো কম দিন হল না এ বাড়িতে এসেছে! একটু হলেও তো এ বাড়ির মানুষগুলোকে চিনেছে ও। 

অন্ধকার আরও গাঢ় হতে লাগল। অভীক ও মামের শোওয়ার ঘরেও এখন ঘন অন্ধকার। শুধু দু'জনের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে ঘরময় নাচতে লাগল। 

(দুই)

সকালে খাওয়ার টেবিলে কারো মুখেই কোনো কথা নেই। মাম ইচ্ছে না থাকলেও লুচি, আলুর তরকারি বানিয়েছে। গরম গরম ফুলকো লুচি আর ডুমো ডুমো করে আলু কেটে কাঁচা লঙ্কা, তেজপাতা, কালো জিরে দিয়ে সাদা তরকারি, অভীকদের প্রিয় জলখাবার। অন্যদিন লুচি করতে করতে হাত ব্যথা হয়ে যায় মামের। আজ একটাই আস্তে আস্তে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে অভীক। খাওয়ার চাইতেও বলা ভালো দাঁতে কাটছে কেবল। উলটো দিকের চেয়ারে অভীকের বোন অভিলাষা মাথা নিচু করে বসে আছে। মাম জানে ওর চোখেও জল। অস্থির লাগল ওর। সত্যি এক মুহূর্তে মামের সাজানো সংসারটা কেমন খাপছাড়া হয়ে গেল শুধুমাত্র একটি মানুষের জন্য। আর এই মানুষটাকেই এ বাড়িতে শ্রদ্ধা করত ও সবচেয়ে বেশি।    
-তোমায় আর একটা লুচি দিই? কথা বলার জন্যই কথাটা বলে উঠল মাম। যদিও দেখছে অভীকের প্লেটের খাবার প্রায় সরেইনি। কথা বলেনা অভীক, দু’দিকে ঘাড় নাড়ে। একটা বড় শ্বাস বেরিয়ে আসে ওর বুক থেকে। উল্টোদিকে বসে থাকা অভিলাষার গায়ে এসে লাগে কিনা কে জানে আর চেপে থাকতে পারে না ও। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সদ্য কলেজ পাশ করা মেয়েটা। মামের রাগ হয়, খুব রাগ হয়। নিজের হাতে একটু একটু করে দশ বছর ধরে সাজিয়েছে ও এই সংসার। আর আজ শুধুমাত্র একজনের সিদ্ধান্তের জন্য সব তছনছ হয়ে যেতে পারে না। ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে কাল থেকে ঘর বন্ধ করে বসে থাকা ওই ভন্ড লোকটাকে অপমানে জর্জরিত করে, চিৎকার করে বলে ওঠে, কেন কেন কেন?

কিন্তু মাম পারে না। কী এক অসম্ভব শক্তি ওর পা আটকে ধরে রাখে, কিছুতেই নড়তে পারে না মাম। কিছুতেই না।    

কোনোমতে সামান্য খেয়েই উঠে পড়ে অভীক। মামের চোখে চোখ রেখে দৃঢ়  গলায় বলে ওঠে, সে কোথায়?
মাম বুঝতে পারে অভীক কার কথা বলছে। সে উলটো দিকের ঘরের  দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, এখনো ঘরে। কাল থেকে কী করছে কে জানে?

কথাটা বলেই মাম বুঝতে পারে কাল দুপুর পর্যন্ত যে মানুষটাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করত ও, আর তার কণামাত্র অবশিষ্ট নেই। উলটে ওই লোকটার কথা মনে হতেই রাগে সারা শরীর জ্বলতে লাগল ওর। ব্যাপারটা মাথার থেকে বের করে ফেলার জন্যই ও অভিলাষার দিকে তাকিয়ে বলল, কলেজ যাবি না?

বৌদির দিকে জলভরা চোখে তাকাল সে, তারপর ধীরে ধীরে বলল, কলেজ কেন বৌদি এ বাড়ি থেকে বের হওয়ার উপায় রেখেছে লোকটা? আমাদের আর মরা ছাড়া কোনো গতি নেই।

মামও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এবার। সত্যি ওর এই সোনার সংসারে এমন ঘটনা ঘটবে এটা ভাবতেই পারছে না ও। কী ভাবে এই লজ্জা ঢাকবে মাম। কীভাবে সকলের দিকে তাকাবে? আদৌ কি কোনোদিন বেরোতে পারবে এ বাড়ি থেকে? নানা প্রশ্ন মাথার ভেতর গিজগিজ করতে থাকে মামের। কবে ওরা এই লজ্জা থেকে নিস্তার পাবে জানা নেই ওদের কারোরই।   

(তিন)

আজ তিনদিন ধরে ঘুমের ওষুধেও কোনো কাজ হচ্ছে না। সেদিন অভীকই ঘুমের ওষুধ দিতে বারণ করেছিল কিন্তু এখন নিজেই দিচ্ছে বাধ্য হয়ে। অভীকের মা আজ পাঁচবছর হল অসুস্থ। বেড রিডেন। ডাক্তার বলেছেন যত্নে রাখতে, উত্তেজনা একেবারেই নয়। দু'দুটো স্ট্রোকে বাম দিকটা অসাড়। তবে কথা বলতেন ওই যতটুকু বলা দরকার। ক’দিন ধরে তাও বন্ধ। না, সেভাবে রিয়্যাক্ট করেননি তিনি। শুধু সারাদিন ফ্যালফ্যাল করে মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছেন গত তিনদিন। ঘুম, খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ। দুপুর বেলা ধীর পায়ে মায়ের ঘরে এসে দাঁড়ায় অভীক। জানালা বন্ধ। ঘর জুড়ে ওষুধের গন্ধ, ফিনাইলেরও। মাম যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখে ঘরটা, রুগীর ঘর মনেই হয় না। তবু ঘরে ঢুকলেই একটা অদ্ভুত নৈরাশ্য চেপে বসে। ঘরে ঢুকেই নাক কুঁচকে ফেলে অভীক।গা গুলিয়ে ওঠে ওর। তারপর হঠাৎই লক্ষ্য করে মা কি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে? মা কি একটু হাসল? ঠোঁটের কোণে কেমন একটা হাসি লেগে আছে না? তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল অভীক। জানালাগুলো খুলতে খুলতেই গলায় একটু জোর এনে বলল, একটু উঠে বসবে? ধরব? মা কিছুই বলে না। শুধু ইশারায় অভীককে কাছে ডাকে। হাত দিয়ে বিছানার ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বসতে বলে হয়ত, বুঝতে পারে অভীক। 
মায়ের সারা শরীরে ওষুধের গন্ধ। বেড সোরও হয় মাঝে মাঝে। সারাদিনের আয়া রাখা আছে সেই সব পরিষ্কার করে। বসবে কি বসবে না ভেবেও বসেই পড়ে অভীক। মা হাসে, তারপর ওঁর হাত দিয়ে অভীকের গায়ে হাত বুলোতে থাকে সেই ছোটবেলার মতো। 

কেমন যেন অচেনা লাগে মায়ের সেই স্পর্শ। সেই নরম, মোলায়েম হাতটা কেমন খসখসে হয়ে গিয়েছে। গা ঘিনঘিন করে ওঠে ওর। তবু মুখে হাসি এনে বলে, কিছু বলবে?
জড়ানো গলায়  অভীকের মা বলে ওঠেন, খুব কষ্ট পাচ্ছিস না?
মায়ের প্রশ্নের  উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে অভীক- তোমার হচ্ছে না কষ্ট?
-হচ্ছে তো খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে ওঁর চাইতে কম। বলার সময় মায়ের গলা বুজে আসে। 
-কী বলছ তুমি এসব? এখনও তো সহানুভূতি? ওই লোকটা শেষ করে দিয়েছে আমাদের সাজানো সংসার, আর তাঁকে তুমি...

উত্তেজিত হয়ে পরে অভীক। 

-আর আমি তাঁকে শেষ করিনি? মা এবার আর কাঁদে না। 
অভীক অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। কী বলছে মা এসব? আরও কিছু শোনা কি বাকি থেকে গেছে? 
অভীকের মা বলতে থাকে, সেই যখন তুই আর লিষা একটু একটু করে বড় হচ্ছিস, সেইসময় থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছিলাম আমরা। তোদের নিয়েই তো ব্যস্ত ছিলাম, ওঁকে তো সময়ই দিইনি কোনোদিন। 
-তাই কী মা? প্রায় চিৎকার করে ওঠে অভীক।
-আজ পাঁচ বছর হল আমি বিছানায়, কথাও ঠিক মতো বলতে পারি না। একটা পঙ্গু মানুষকে কতদিন সহ্য করা যায় বল তো বাবু? একটানে কথাগুলো বলে তিনি হাঁফাতে থাকেন। 
-ও তুমি অসুস্থ বলেই যা ইচ্ছে করা যায়? এটা একটা কথা হল ! তবে তো...

 অভীকের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মা বলে ওঠে, এই যে তুই এ ঘরে এলি, খুব ভালো লাগছিল তোর? দেখছিলাম আনমনেই পকেটে হাত দিচ্ছিলি রুমালের খোঁজে। অসুখের গন্ধ ভালো লাগে না রে, আমি জানি। তোদেরও লাগে না। 

কী বলবে বুঝতে পারে না অভীক। ভীষণ ছোট লাগে নিজেকে । মায়ের হাতে হাত রাখে, দু’চোখে জল। নরম গলায় ডাকে, মা।
-কাঁদিস না বাবু। সেই কবে থেকে তোদের বাবা অসুখের সঙ্গে সহবাস করছে, একাকীত্বের সঙ্গে সহবাস করছে। আর কত? ও যদি এবার নিজের মতো করে রেহাই পেতে চায়, পাক না, ক্ষতি কী? আমি তো আর ওঁকে কিছুই দিতে পারব না রে।

অবাক হয় অভীক, ভীষণ অবাক। এত মনের জোর কোথা থেকে পেল ওর মা? চিরকাল তো মাকে নরম মনের মানুষ বলেই জেনেছে ও। কিভাবে ভাবল এত কিছু? মায়েরা যেমন সব বুঝতে পারে, তেমনি অভীকের মাও বুঝি পড়ে ফেলল ছেলের মনের কথা। হেসে বললেন, ভাবছিস কীভাবে পারলাম?  পেলাম কোথা থেকে এত মনের জোর? অসুখটাই জীবনটাকে চিনতে শিখিয়ে দিল রে। শক্ত করে দিল। 

মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে অভীক। অস্ফুটে শুধু বলে ওঠে, তুমি হলে কী করতে? পারতে এমনভাবে হাত ছাড়তে?
-‘নাহ, পারতাম না। শেষ দিন অবধি সেবা করে যেতাম। কিন্তু মন? মন হয়ত অন্য কথা বলত? দাঁতে দাঁত চেপে মনের কথা অগ্রাহ্য করতাম। কিন্তু সবাই কি তা পারে?
-তাই বলে এভাবে সব ছেড়ে চলে যাবে সে? লোকে কী বলবে? কাতর গলায় বলে অভীক। 
মা হেসে বলেন –লোক যাই বলুক না কেন তোর বাবার হয়ত এতেই খুব ভালো লাগবে। যা আর ওঁকে আটকাস না। যেখানে যেতে চান, যার সঙ্গে যেতে চান যেতে দে। জোর করে ধরে রাখলে শুধু শরীরটাকেই পারবি, মনকে বাঁধতে পারবি না। 

সেই মুহূর্তে ঠিক কী বলবে বুঝতে পারে না অভীক। মায়ের ধৈর্য, সাহস দেখে অবাক হয় ও। খুব প্রণাম করতে ইচ্ছে করে। কতদিন প্রণাম করা হয় না মাকে, জড়িয়ে ধরা হয় না কতদিন! মায়ের দিকে তাকায় ও। 

(চার)

চোখ বুজে আছেন তিনি। সারা মুখ জুড়ে প্রশান্তি। একটু আগেও সারা মুখের যে অসুখের ভাঙচুর লেগে ছিল কোন জাদুবলে তা মিলিয়ে গেল টেরই পেল না অভীক। মাকে আর বিরক্ত করে না অভীক, ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায়। যে চলে যাচ্ছে, তার যাওয়ার আয়োজন করতে হবে এবার। আর ভয় নেই, লজ্জা নেই কোনো। 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এসেছে বাইরে। দূরে দূরে উড়ে যাওয়া পাখিরা ঘরে ফেরার আয়োজন করছে। আর একটু পরই ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফিরবে। অভীক মনে মনে ভাবে, ওর বাবাও এভাবেই উড়ে চলে যাবে কোথাও। উড়তে উড়তে একদিন তো ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করবেই, তাই না!   

সেদিনেরই অপেক্ষা করবে ওরা। মায়ের চোখেও তো সে অপেক্ষাই দেখেছে সে। আর কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। ডুবে যাওয়া সূর্যের সঙ্গে সঙ্গেই ওরা একটা নতুন সকালের অপেক্ষা করবে, একটা সূর্যাস্তের ঝলমলে  দিন তো আসবেই। তাই না?







বৃষ্টির জন্মদিন

বী থি  ক র


সকাল থেকেই শরীরটা ঠিক নেই মেঘনার। কাল বৃষ্টি ছিল না, তবে গরম ছিল খুব বেশি। চুলের গোড়ায় গোড়ায় ঘাম জমে বাসা বাঁধে। বড়ো অপছন্দের যদিও কিন্তু বিশেষ কিছু করার থাকে না। যতক্ষণ ঠান্ডা ঘরে থাকে ঠিক ততক্ষণ রক্ষে। তখনই বুঝেছিল আজ আর রক্ষা নেই, আর সেটা  হল না। ছুটির দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই মেঘনার। আজ এত সকালে উঠতেই মায়ের চোখে বড়ো বড়ো প্রশ্ন দেখতে পেল। মা কিছু বলার আগেই বলে দিল---

-আজ কোথাও যাব না, বাড়িতেই থাকব। 
-তাহলে উঠলি যে? কাল রাতে ঘুমের ওষুধ নিসনি? 
-হুম্। নিয়েছিলাম। শরীরটা ঠিক নেই। মাথাটা খুব ভারী হয়ে আছে। রাতে এসে কেউ মাথায় জোরে লাঠির বাড়ি দিয়ে গেল কি না, কে জানে? 

মা হাসতে থাকেন। বটিতে সবজি কুটতে কুটতে বলেন,
-তোর মাথায় আবার কারোর মারতে লাগে নাকি? বিশ্বের চিন্তা মাথায় ভরে রেখেছিস! চা করে দিচ্ছি, খেয়ে দেখ ছেড়ে দেবে ব্যথাটা। 

চায়ের কাপ হাতে জানালা দিয়ে বাইরেটা একবার দেখে নিল। নাহ্, সম্ভাবনা নেই কোনো। কিন্তু এই দিনে তো বৃষ্টি হয় বরাবর। তবে এবার কি হবে না? মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। মা ডেকে বললেন,

- হ্যাঁ রে, কেউ মেসেজ করেনি? 
- হ্যাঁ, অনেকেই করেছে। ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ গিজগিজ করছে। উত্তর দেব সবার। 
-আর কেউ? 
-কার কথা জানতে চাইছ? 

মা মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। বুঝলেন এর বেশি এগোলে মেয়ে রাগে ফেটে পড়বে। আবহাওয়ার মতো তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ পালটে দিতে হবে। রান্না ঘর থেকে ভেসে এল তখন,

-সকালে কি খাবি? দুপুরের রান্নার জোগাড় করে ফেলেছি। দয়া করে খাবার অর্ডার করতে যাবে না কিন্তু। 
-খেতে ইচ্ছে করছে না। শরীরটা সত্যি ভালো লাগছে না। জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। 
-বারবার বললাম এত রাতে স্নান করিস না এসে। কথা শুনিস না মোটেই। ওষুধ আছে ঘরে? 
-উফ্! মা! আসুক না। বহুদিন তো জ্বরও আসে না! সবাই চলে গেলে হবে? 
-উম্! কথার ছিরি দেখো মেয়ের! অসহ্য লাগে। আরে জ্বর এলে আমার এই বুড়ো হাড়ের কাজ লাগবে। তাই সকালের খাবার খেয়ে ওষুধ গিলে আমায় কৃতার্থ করো! 

বোঝা গেল রান্নাঘরের হওয়া বেশ উষ্ণ। আর বিশেষ কিছু বলা যাবে না। বাধ্য মেয়ের মতো যা বলছেন সবটা করে ফেলতে হবে। 

দুপুরে ভরপেট ভাত খেয়ে বিছানায় গেল ভাত-ঘুম দেবে বলে মেঘনা। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। ঝিরঝির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এদিকে সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণা! মাথার ভেতর ড্রিম ড্রিম করে বাদ্য বাজছে। চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে বালিশ ভিজছে। উত্তাপ তখন শরীর থেকে বিছানায়, চাদরে, বালিশে আশ্রয় নিয়েছে। বুঝতে পারল জ্বর বেশ বেড়েছে। মাকে এখন বললে কি যে করবেন! কিন্তু ঠিক তক্ষুনি পাশের ঘর থেকে মা মেঘনার ঘরে এল। চোখের দিকে তাকাতেই বুঝে গেলেন, কিছুই বলতে হল না। 

-জ্বর মেপেছিস? 
-হুম্।
-কত?
-১০৩°
-বাহ্! তাহলে আর কি? বলেছিলাম তোকে আমি। একটা কথা শুনিস না তুই। ওষুধ খেয়ে নে এক্ষুনি। 
-খেয়েছি একটা। 
-যাক। সেটা সেরে নিয়েছ তবে। 

জ্বর বাড়ছে, না না... শরীরের উত্তাপ বাড়ছে। সাথে মনের। বেহিসাবি কত কথা এসে জড়ো হচ্ছে একসাথে। জ্বর, একটা হাত মাথার কাছে, বারবার এসে মানুষটির থার্মোমিটার দেখা, প্লাস্টিক মাথার নীচে রেখে বালতি ভরে মগ দিয়ে জলের ধারা দেওয়া, আধ ঘণ্টা পর পর স্নান করিয়ে দেওয়া আরও কত কিছু! 

-মনা, চোখ খোল। ঘুমাস না। কি রে? 
মায়ের কথা শুনতে পেল মেঘনা। চোখ খুলতেই মনে হল বন্যায় ভেসে যাবে চারপাশ। আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। জল আর আগুন দুটো একসাথে থাকে না, থাকতে পারে না। বেলা গড়িয়ে গেল। আকাশ মেঘলা হল। সন্ধ্যা নামছে পশ্চিম আকাশ জুড়ে। হুহু করে জ্বর বাড়ে। মায়ের মুখ কালো হতে শুরু করে। তাঁর যে জানা মেয়ের জ্বর এলেই আকাশছোঁয়া! কোনোকিছু মান্য করে না। অন্ধকার বাড়তে থাকে ক্রমশ। ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। আর তারপর? 

এক রাজকন্যা ভেসে বেড়ায় মেঘের কোলে। হাতে তার জিয়ন কাঠি। ছুঁয়ে দিলেই ফুসমন্তর ! সব কিছুর থেকে মুক্তি। রাজকন্যা হিরে বসানো পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক! ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে যত ছিল ভাগ্যহারার দলকে। আর নিমেষেই বদলে যাচ্ছে সব। রাজকন্যা এসে কপাল ছুঁয়ে বসল পাশে। শীতল এক হাতের স্পর্শ। আঃ! কি শান্তি। যেন শরীর বেয়ে নেমে গেল জ্বরের ধারা। ঝরঝর, ফুরফুরে হয়ে উঠল শরীর। রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে হাসতেই...

-মনা, মনা... হাসছিস কেন? কি হয়েছে? কখন থেকে ফোন বাজছে। ধর ফোনটা...

চোখ খুলে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে এল অচেনা নম্বর। রিসিভ করতেই ও-পাশ থেকে,

-শুভ জন্মদিন, বৃষ্টি। তোমার সব শুভ হোক। ভালো থেকো...

বোবা, বধির হয়ে থাকা ছাড়া আর যে কোনো উপায় মেঘনার খোলা ছিল না!






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪