ভ্রমণ কাহিনী




অজন্তার অরণ্যের অতিথি

শ্র য় ণ  সে ন


“খবরদার জানলা খুলে শোবেন না। সাপ ঢুকে যাবে। পারলে ঘরের আলোও জ্বালিয়ে রাখবেন।”
ঠিক ঘুমোতে যাওয়ার মুহূর্তেই ভয়টা ধরিয়ে দিলেন সইদ ফকরুদ্দিন ওরফে ফকিরা ভাই। পেশায় ফরেস্টের গার্ড। আমাদের দেখভালের নজর রয়েছে তাঁর ওপরেই। 


এখন রাত দশটা। আমরা রয়েছি অজন্তা ফরেস্ট রেস্ট হাউজে। সাতপুরা পাহাড়শ্রেণির তীক্ষ্ণ পাহারার মধ্যে অবস্থিত এই বনবিশ্রামাবাস। চারিদিকে জঙ্গল। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে এক শীর্ণকায়া নদী। চারিদিক নিস্তব্ধ। তবে হরেক রকমের পোকার ডাক সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে অবলীলায়। মোবাইলে নেটওয়ার্ক? অবশ্যই নেই। 
আবহাওয়াটাও বেশ রোমাঞ্চর। কিছুক্ষণ আগেই বেশ বৃষ্টি হয়েছে। ফলে পরিবেশটা কিছুটা ঠান্ডা যেন। 

এমনিতে সরকারি বনবাংলোতে থাকতে গেলে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। তার ওপর যদি সেটা আবার আমাদের বাইরের কোনো রাজ্য হয়, তা হলে তো কথাই নেই। চিঠি চালাচালি করেই সময় ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু কী অদ্ভুত সুন্দর ভাবে আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল! ভারতের পশ্চিমের রাজ্যে যদি প্রধান বন আধিকারিক তথা চিফ কনজারভেটর অব ফরেস্ট কোনো বঙ্গসন্তান হন, তা হলে গর্ব একটা হয়ই। আবার সেই ভদ্রলোক যদি আমার বাবার পরিচিত হন তা হলে তো কথাই নেই। সেই বন আধিকারিক নীল মজুমদারের কিছুটা বদান্যতাতেই আমাদের এখানে রাত্রিবাসের সুযোগ হয়ে গিয়েছে। 


মাসখানেক আগে নীলবাবুকে বাবা জানিয়েছিলেন আমাদের অজন্তা ভ্রমণের পরিকল্পনা। ব্যাস, অজন্তা যাব শুনে বন বিশ্রামাবাসেই থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন তিনি।
আমি যে গল্পটা করছি, সেটা আজ থেকে ১৩ বছর আগের। তখন অজন্তায় সাধারণত রাত কাটাতে হলে মূল গুহা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ‘টি-জংশন’ তথা ফরদাপুরে থাকতে হত। সেখানে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। রয়েছে মহারাষ্ট্র পর্যটন নিগমের রিসর্টও। কিন্তু বাবা আর নীলবাবু একে অপরের পরিচিত হওয়ায় আমরা যে একটু বেশি খাতির পেলাম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে ভুসওয়ালে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে গেলাম ফরদাপুরে। তখন বিকেল ৩টে। গাড়ি থামতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন খাকি পোশাকের এক ভদ্রলোক। নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, ‘সাহেব’-এর নির্দেশে তিনি আমাদের নিতে এসেছেন। কাকে তিনি ‘সাহেব’ বললেন, সেটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হল না। জমজমাট ফরদাপুর ছেড়ে আমাদের যেতে হবে জঙ্গলের ভেতরে। গুহার এক্কেবারে কাছে। কিন্তু এখানে ব্যাটারিচালিত বাস ছাড়া কেউ ঢোকে না। মোটামুটি মিনিট কুড়ির বাসযাত্রা শেষে শুনশান একটা জায়গায় পৌঁছোলাম। মূল সড়ক থেকে কিছুটা উঠতে হল ঢালু একটা রাস্তা দিয়ে। ফকিরাজি আমাদের বিশ্রামাবাসে এনে স্বাগত জানালেন।


সরকারি বিশ্রামাবাস যেমন হয় আর কী! বাংলো টাইপের বাড়ি। বিশাল বিশাল ঘর। আর ততোধিক বিশাল বাথরুম। আমরা পৌঁছোতেই চা নিয়ে হাজির বিশ্রামাবাসের খানসামা মহম্মদ আলি। আমরা আসব বলে আলি সাহেবকে নিজের গ্রাম থেকে ডেকে আনা হয়েছে। বিশ্রামাবাসে ঢুকতে প্রথমেই একটা বিশাল বড়ো বসার এবং খাবার ঘর। তার দু’দিকে দুটো দ্বিশয্যা বেডরুম। আমাদের জন্য দুটো ঘরই খুলে দিলেন ফকিরাজি।

এই ধরনের বিশ্রামাবাসে থাকার অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। তাই কিছুটা উত্তেজনা ছিল। চা খেয়ে ফকিরাজিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বেরোলাম। পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে কিছুটা হাঁটার পরেই অজন্তা গুহার মূল প্রবেশপথ। বিকেল হয়ে গিয়েছে, তাই গুহা এখন বন্ধ। অগত্যা উলটো দিকের একটা রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের পথের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেলেন ফকিরাজি। না, এটা কোনো রাস্তা নয়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সরু মেঠো একটা পথ উঠে গিয়েছে ওপরে। গাইডের দেখানো পথে এগিয়ে চললাম। চোখে পড়ল একটা সরু ঝরনা। বেশ সুন্দর, তবে বৃষ্টির অভাবে জল কম। বনপথে যেতে যেতে বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল। বেশ কিছু গাছের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন ফকিরাজি। কোন গাছের কী উপকারিতা রয়েছে, সেটাও বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। এ ভাবেই চড়াই ভেঙে বেশ অনেকটা ওপরে উঠে এলাম। 
একটা ভিউ পয়েন্টে পৌঁছোলাম। সামনে প্রধান সড়ক। যে সড়ককে আমরা ফর্দাপুরে ছেড়ে এসেছিলাম, সেই ঘুরে এই ভিউ পয়েন্টে চলে এসেছে। ভিউ পয়েন্ট থেকে কিছুটা নীচে অজন্তার বিশ্বখ্যাত গুহাগুলো দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পাহাড়ের গায়ে সারি সারি জানলা আর দরজা। অন্য দিকে আকাশ রাঙিয়ে সূর্য নামছে পাটে।


ঝুপ করে অন্ধকার নেমে গেল। ফকিরাজির সতর্ক দিক নির্দেশনায় ফিরে এলাম বিশ্রামাবাসে। চারিদিকে নানা রকম পোকার ডাক শুরু। বৃষ্টি নামতেই যেন অন্য রকম এক অনুভূতি। পোকার ডাকের সঙ্গে গাছের পাতা দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ার আওয়াজ মিশে গিয়ে অদ্ভুত একটা পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে বাইরের ঘুরঘুট্টে অন্ধকার ভেদ করে মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানি পুরো এলাকাটাকে বড়ো মায়াবি করে তুলছে। 
সন্ধ্যার সৌন্দর্যের মায়ায় মোহিত হয়ে আন্দাজই করতে পারিনি যে রাতটা কী ভাবে কাটবে আমাদের।
খুব খাতির পাচ্ছিলাম বলার অপেক্ষা রাখে না। ডিনারে এলাহি আয়োজন। পেট ভরে খাওয়াদাওয়া সেরে শুতে যাব, তখনই ফকিরাজির সতর্কবার্তা। “সাহাব, জানলা খুলবেন না। পারলে ঘরের আলো জ্বালিয়ে শোবেন। নইলে সাপ ঢুকে যাবে।”
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম এমন সতর্কবাণীতে। সাপে ভয় নেই অতটা, ভয়টা অন্য জায়গায় যে। যাই হোক, ঠিক আছে। ও যা বলেছে সেটা করব।
অন্য যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, সেটাই হল। তীব্র গরম কাহিল করতে শুরু করল। ঘরে যে মান্ধাতার আমলের পাখা। সে তো ঘোরেই না প্রায়। ফুল স্পিডে চললেও ব্লেড গোনা যাচ্ছে। তার ওপরে তার বিকট আওয়াজ। আর এমন মশারি আমি জম্মে দেখিনি। কাপড়ের মশারি, ওপরে ছিদ্র প্রায় দেখাই যায় না। এই মশারি ভেদ করে কোনো ভাবেই পাখার হাওয়া ঢুকছে না। জানলা বন্ধ। সব মিলিয়ে একটা দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে।
জানলা খুলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু খুললে বিপদ ফনা তুলতে পারে, সেই ভয়ও করছে। না, আর পারা গেল না! রাত তিনটে পর্যন্ত কোনো রকম ভাবে কাটিয়ে জানলা খুলে দিতেই হল। মশারিও খুলে ফেললাম। ঘরটা ঠান্ডা হল। রাত তিনটের পর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত একটা শান্তির ঘুম দেওয়া হল। না, সাপখোপ কিছুই আসেনি। হয়তো ওদেরও মায়াদয়া হল আমাদের অবস্থাটা দেখে।
প্রাতরাশ করে বেরিয়ে পড়লাম অজন্তার গুহারাজি দেখতে। সে তো সম্পূর্ণ অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতা ঠিক ভাষায় বোঝানো যায় না। যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে হলে শব্দের পর শব্দ খরচ করলেও মনে হয় বড্ড কম হয়ে গেল। 


গুহাদর্শন করে ফিরে এলাম বাংলোতে। তার পর মধ্যাহ্নভোজনের পালা। আলি সাহেবের হাতের অপূর্ব রান্না, যার স্বাদ ভোলা যায় না। তার পরেই অজন্তাকে বিদায় নিয়ে পরের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাওয়া। 
আমি কখনোই বাঁধাগতের পর্যটক হতে চাই না। ঠিক সেই কারণেই অজন্তার এই বনবিশ্রামাবাসে কাটানো একটা দিন, আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। একটা রাত জঙ্গলের অতিথি হয়ে থাকলাম, অভিজ্ঞতাটা কিন্তু দারুণ হল।







বাংলার গোকুলে

শ ম্ভু সে ন


আরে, এ তো আর-এক পঞ্চরত্ন মন্দির। তবে পোড়ামাটির প্রাচীন মন্দির নয়, একেবারে হাল আমলের ইট-বালি-সিমেন্টের। গা থেকে এখনও নতুনের গন্ধ যায়নি। তবে এই মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই। রয়েছে প্ল্যাটফর্ম, টিকিট কাউন্টার, স্টেশনমাস্টারের ঘর। এ হল গোকুলনগর স্টেশন, বাংলার গোকুল। হবে না-ই বা কেন? মল্লভূমি বিষ্ণুপুর যদি গুপ্ত বৃন্দাবন হয়, তা হলে ঢোলসাগর থেকে প্রবাহিত যমুনা-তীরের গোকুলনগর কৃষ্ণভক্ত মল্লরাজাদের গোকুল হবে না কেন? মল্লরাজ প্রথম রঘুনাথ সিংহ এখানেই তৈরি করেছিলেন গোকুলচাঁদ শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। আর সেই ঐতিহ্য মেনেই এখানকার স্টেশনটিও মন্দিরের আদলে তৈরি। এ-ও এক দ্রষ্টব্য।    
একটু আগে জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। আমরা তখন এই রাঢ়ের মাটিতে বিরসা মুন্ডা হল্ট স্টেশনের খোঁজে। তথ্যটা পেয়েছিলাম নেট থেকে। এখানে এই বিষ্ণুপুর-আরামবাগ রেলপথে আদিবাসী বিদ্রোহের নায়ক বিরসার নামে স্টেশন কেন? এই কেন-র উত্তর খোঁজার জন্য এখানে সরেজমিন তত্ত্বতালাশে আসা। এবং এখানকার ভূপ্রকৃতি বুঝিয়ে দিল এ অঞ্চল তো ছোটোনাগপুর মালভূমিরই এক প্রান্ত। সুতরাং বিরসার বিদ্রোহভূমির বাইরে নয়। তাই বিরসার নামে স্টেশনে দোষ কী? বৃষ্টির পর লাল মাটি থেকে কেমন একটা অন্য রকম গন্ধ উঠছিল। এ গন্ধ ঠিক সোঁদা নয়। পাহাড়-মালভূমিতে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি হলে শুখা মাটি থেকে যে গন্ধ ওঠে, সেই গন্ধটা। একটু যেন বুনো, মন-কেমন করা। এই বনবাসুদেবপুরের গ্রাম-জঙ্গলে মাটি-পথ হঠাৎ-আসা বৃষ্টিতে কিছুটা অগম্য। তাই হল্ট স্টেশনের অন্বেষণ ছেড়ে পুবের স্টেশন গোকুলনগরে চলে আসা।
স্টেশন-প্ল্যাটফর্ম থেকে পুব দিকে তাকাতেই গাছপালার মাঝ থেকে উঁকি মারল বাঁকুড়া জেলার বৃহত্তম মন্দিরটি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম সলদা-গোকুলনগর পথে। ডান দিকে কিছুটা গেলে রেল-ক্রসিং। রেলগেটের ঠিক আগে বাঁ দিকে অল্প দূরে অনুচ্চ এক ঢিবির ওপর গন্ধেশ্বর শিবের পুবমুখী পাথরের দেউল-মন্দির। এই দেবালয়ের যোনিপট্ট-সহ শিবলিঙ্গটি পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত সব চেয়ে বড়ো। গর্ভগৃহের ভিতরে এক কোণে মহিষমর্দিনীর এক অপূর্ব মূর্তি রাখা আছে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এটি পাল যুগের। নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে মন্দিরটির। এর ছাদ চারচালা ধাপ-পদ্ধতিতে বিন্যস্ত। গন্ধেশ্বর শিব দর্শন করে রেলপথ পেরিয়ে কিছুটা যেতেই বাঁয়ে পড়ল গোকুলচাঁদের সেই পরিত্যক্ত মন্দির। জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়েছিল এই মন্দির। মন্দিরের গা থেকে গজিয়েছিল নানা গাছপালা। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬-তে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ মাকড়া পাথরের এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটি দেখভালের দায়িত্ব নেওয়ায় এটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। প্রথম দর্শনেই মন্দিরের দুর্গসম প্রাচীরটি রীতিমতো সম্ভ্রম জাগায়। পুব দিকের প্রাচীরের মাঝখানে রয়েছে প্রবেশদ্বার। অঙ্গনেই ঢুকতেই পুবমুখী মন্দিরের পুরো চেহারা নজরে আসে। উঠে পড়লাম মন্দিরের চার দিকের তিন খিলানযুক্ত বারান্দায়। এক চক্কর ঘুরে আসার পর বুঝলাম, গর্ভগৃহের চার দিকেও একটি অভিনব প্রদক্ষিণ-পথ আছে। মন্দিরটি পাঁচ শিখরযুক্ত। কিন্তু এই শিখরগুলিরও বৈশিষ্ট্য আছে। চার কোণে চারটি শিখর চতুষ্কোণবিশিষ্ট আর যে শিখরটি মন্দিরের মধ্যমণি সেটি আটকোনা। এবং বাকি চারটির তুলনায় অনেক বড়ো। মন্দিরের সেই গর্বোন্নত শিরের দিকে নজর আগে পড়ে। মন্দিরের পুব ও দক্ষিণের দেওয়ালে যাই-যাই করেও কিছু অলঙ্করণ এখনও রয়ে গেছে। তার মধ্যে বর্গাকার প্যানেলে দশাবতার, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি সহজেই চিহ্নিত করা যায়। নৃত্যশৈলীর কিছু প্যানেলও নজরে আসে। দক্ষিণের দেওয়ালে কার্নিশের নীচে ঠিক মাঝে যে প্রতিষ্ঠা-ফলকটি রয়েছে তা আজ পাঠোদ্ধার করা খুব দুরূহ। তবে মন্দিরের বাইরে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সাইনবোর্ড থেকে জানা যায়, এই মন্দির ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রঘুনাথ সিংহের আমলে তৈরি। মন্দির-অঙ্গনের দক্ষিণ দিক বরাবর নাটমণ্ডপ। বিশাল এক ভিত্তিবেদির ওপর সুবিশাল পাথরের সৌধ। ছাদ পুরোপুরি ভেঙে গেছে, কিন্তু দেওয়াল এবং তিনটি ফুলকাটা খিলান আজও অক্ষত। এক কোণে রয়েছে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। গোকুলচাঁদের বিগ্রহ বহুকাল অন্তর্হিত। প্রাঙ্গণে এ-দিক ও-দিক ছড়িয়ে রয়েছে পাথরের অজস্র ফলক। কী ভাবে এই মন্দিরের ওপর অত্যাচার হয়েছে এই সব ফলকই তার প্রমাণ। এই মন্দির থেকে পাওয়া বেশ কিছু মূর্তি বিষ্ণুপুরে যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের সংগ্রহশালায় রাখা আছে। এর মধ্যে সব চেয়ে সুন্দর সম্ভবত কালো পাথরের ‘অনন্তশয়ানে বিষ্ণু’ মূর্তিটি। ‘প্রবাসী’র ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই মূর্তির উল্লেখ করে লিখেছিলেন, “বাঁকুড়া জেলার জয়পুরের কাছে একটি মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে একটি সুন্দর মূর্তি উদ্ধার করেছেন জে সি ফ্রেঞ্চ”।
সলদা-গোকুলনগর অঞ্চলে এক প্রাচীন সংস্কৃতির যে রমরমা ছিল তার প্রমাণ এখানকার ঘাটেবাটে আজও মেলে। গন্ধেশ্বর মন্দির থেকে গোকুলচাঁদ মন্দির যাওয়ার সময় পথের ধারে নজরে পড়ে এক বিরাট শিবলিঙ্গ। সলদার দিক থেকে রেল-ক্রসিং পেরিয়ে বাঁ দিকে রেলপথ বরাবর কিছুটা গেলে ডান দিকে পড়ে এক জলাশয়। এর পাশ দিয়ে ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে প্রায়-না-থাকা পথ দিয়ে হেঁটে এলে সন্ধান পাওয়া যায় সবুজ ক্লোরাইট পাথরের এক বরাহমূর্তির। হাত ভাঙা, পা-সহ দেহের অনেকটাই মাটিতে গাঁথা। মাথা-বুক এখনও অক্ষত। অক্ষত মাথার সাজসজ্জা ও গলার অলঙ্কার। চরম অবহেলায় পড়ে রয়েছে অসাধারণ এক মূর্তি। জায়গাটা দেখে মনে হয় এক সময় এখানে কোনো মন্দির ছিল। এই অঞ্চলের বহু গাছতলায় জৈন ও হিন্দু দেবদেবীর অজস্র মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। হয়তো ভবিষ্যতের কোনো পুরাতাত্ত্বিকের অনুসন্ধানের অপেক্ষায়।






রুবির সঙ্গে সুন্দরবনে

দে বি কা চ ট্টো পা ধ্যা য়


শেখ সামসুদ্দিন এর লেখা "সুন্দরবনের ইতিকথা" বইটি পড়া শেষ করে এ লেখা শুরু করলাম। কিছুদিন আগে রুবির আতিথেয়তায় সুন্দরবন ভ্রমণ করতে গিয়ে বইটি উপহার হিসেবে পাই রুবির হাত থেকেই।


রুবির সঙ্গে আমার চেনাশোনা মাত্র কয়েক মাস আগে। আমার এক ভাই ইন্দ্রজিৎ ঘোষের একটি ফেসবুক পোস্ট দেখে আমি রুবিকে চিনি। রুবি সুন্দরবন ট্যুর অর্গানাইজ করে জেনেই আমি আগ্রহী হয়ে উঠি। অনেক দিন থেকেই সুন্দরবন ট্যুর এ যাওয়ার ইচ্ছে মনে মনে লালন করে চললেও, এতদিন তা হয়ে ওঠেনি। এবার "রুবির সঙ্গে হীরাবন্দরে" যাওয়ার আশা ভীষন ভাবে জেগে উঠলো।

ব্যক্তিগতভাবে আমি এবং আমার স্বামী দুজনেই নির্জনতা পছন্দ করি এবং বেড়াতে যাওয়ার সময় সঙ্গের সাথীরাও সমমনস্ক হোক এটাই চাই। সেই জন্য দলবল সহকারে বেড়াতে না গিয়ে আমরা নিজেরা নিজেরাই বেড়াতে যেতে পছন্দ করি। আগে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে গেছি কিছু কিছু জায়গায়, আজকাল ওরা পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় আমরা দুজনেই কাছে পিঠে বেরিয়ে পড়ি। তবে যাওয়ার প্ল্যান প্রোগ্রাম ও বুকিং করার দায়িত্ব থাকে আমারই। এ ব্যাপারে উনি পুরোপুরিই হাত-পা ঝাড়া থাকেন।


ইন্দ্রজিৎ এর পোস্টটা পড়েই আমি ফেসবুক এ রুবির প্রোফাইলে যাই। সেখানে রুবির কয়েকটি পোস্ট দেখে এতটাই ভালো লেগে যায় যে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই। শুধু সুন্দরবন ট্যুর অর্গানাইজ করাই নয়, সুন্দরবনের গরিবগুর্বো মানুষদের জন্যও যে রুবি অনেক কাজ করে তার পরিচয় ও পেয়ে গেছি তখন। নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত মানুষ তো ক্রমশ ই হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে।আত্মস্বার্থরক্ষাই এখন বেশির ভাগ মানুষের একমাত্র কামনা বাসনা ও সাধনা, সেখানে রুবির কর্মপরিকল্পনা, পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার বিবরণ জানতে পেরে সত্যি সত্যিই আপ্লুত হয়ে পড়লাম। আরো জানলাম রুবির সুন্দরবন ট্যুর এর ভ্রমণপথটি অন্যান্য অনেক ট্যুর এর মত একই পথ ধরে না এগিয়ে আরো নির্জন খাঁড়ি ও সোঁতা দিয়ে রিজার্ভ ফরেস্টের ধার ঘেঁষে চলবে এবং ২০/২৫ জন ভ্রমণযাত্রী বহনক্ষম নৌকায় ১০জনের বেশি মানুষ না নিয়েই ট্যুর হবে। সবই আমাদের মনের মতো হতে চলেছে দেখে তো আমরা যারপরনাই খুশি। ইতিমধ্যে রুবির দৌলতে সুন্দরবনের মধু, রুবির বাবার হাতে বানানো নলেনগুড়, পাটালি, রুবির মায়ের তৈরি আচার ও জয়নগরের মোয়ার সন্ধান পেয়ে গেছি। আদতে জয়নগরের মোয়া বলে যা বিক্রি হয় তা বহরুর। বহরু জয়নগরের কাছেই একটি জায়গা, ভাগ্যদোষে তার নামমাহাত্ম্য প্রচারলাভ করেনি।


শেখ সামসুদ্দিন এর লেখা বইটাও রুবির ফেসবুক পোস্ট দেখেই কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। তখনো জানি না যে শেখ সামসুদ্দিনই রুবির বাবা। পরে নৌকায় বসেই জানতে পারি রুবির বাবাই লেখক, এবং তিনিই নিজহাতে খেজুর রসের পাটালিও তৈরি করেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন রিটায়ার্ড উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।


এবার আসি "সুন্দরবনের ইতিকথা" বইটির বিষয়ে, বইটিকে এককথায় জলজঙ্গলের কাব্য বললে ভুল বলা হবে না। ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় ওখানকার মানুষদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি, তাই ঐ সকল মানুষের জীবনযন্ত্রণার সাক্ষীও তিনি। তবে শুধু মাত্র সাক্ষী হলেই তো মানুষের যন্ত্রণাকে অনুভব করা যায় না, তার জন্য চাই সংবেদনশীল একটি মন। সেই সংবেদনশীল মনটিকে আমি অনুভব করতে পেরেছি তাঁর লেখা পড়ে। ঐ অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকাটা যে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানটিতে একটা মাত্র সুতোর উপর দাঁড়িয়ে আছে, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। বইটি পড়ে ঐ মানুষগুলোর দুঃখ কষ্টের সাথী হবার পথে এতটুকুও এগোতে পেরেছি হয়তো, এটাই সার্থকতা।







পালানোর পাঁচকথা: দেওরিয়া তাল- চোপতা- তুঙ্গনাথ: পর্ব- ঘ

মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত


ম্লান অপরাহ্নে আকাশগঙ্গার জলযোগ কিছু ভারী হয়ে গেল। প্রথম খানিক চড়াই ঠেলতে হাঁফ ধরছে। এমন ভরা পেটে ট্রেকিং সুবিধের হয় না। বুঝলাম, বোঝালাম জিহ্বোদরকে—পাহাড়ে গোগ্রাসে গিলবিনি কো।
  ধৈর্য কমে আসছে, মুরোদ কমে আসছে, আলো কমে আসছে। থেমে জিরিয়ে ধুঁকে এগোচ্ছি। ঘাসে মুখ গুঁজে আছে ক'টা মোষ। আননোন আদমি দেখে সক্কলে ঘাড় তুলল। কী'রম করে চাইল তারা, সে লিখে বোঝানো শক্ত। ঢুঁ লাগাবে নাকি! তা হলেই জব্বর। প্রতিরোধের তরে কানাকড়ি এনার্জিও গতরে নেই। সটান শুয়ে পড়ব। জগদীশ ওদের দিক ধরে হাঁটতে বোধ হয় চিনতে পারল। আমাদের অগ্রাহ্য করে আবার ঘাসই গ্রাহ্য মনে করল। খা বাবা, আমাদের আস্ত চোপতা পৌঁছতে দে।প্রায় সমতলে পা টেনে টেনে চলি। থোড়া-থোড়া করতে করতে হঠাৎই পিচপথ পেয়ে গেলাম। এ সেই উখীমঠ থেকে আসছে। যাবে চোপতা পেরিয়ে গোপেশ্বর। তারপর আরও। যেমন পথ যায়। সে পথ পাকড়ে বাঁয়েমুড় করে অল্প পরেই লোকালয়। টুকটাক দোকান-বাড়ি। চোপতা বাসস্ট্যান্ড কিমিখানেক বাদে। দোকানে চা নিয়ে হোটেলের কথা তুলতে জগদীশ এখানেই থাকার পরামর্শ দিল, যদি মানাতে পারি। থাকার ঘরদোর নিতান্ত ছোট, না-জৌলুস।


শোনা ছিল, চোপতায় হোটেল কম এবং মহার্ঘ। স্বভাবতই পরামর্শ স্বাগত। দোকানের পিছনে পরিচ্ছন্ন কুঠিখানি দু'জনের জন্য যথেষ্ট। সামনে ঘাসমোড়া ঢালু চত্বর সোজা নীচে লুটিয়ে রয়েছে। অস্তপ্রায় সূর্যালোকের মায়াময় ছটা ধুইয়ে দিচ্ছে সে সবুজালি। চমৎকার লেগে গেল জায়গাটা। অনেক ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা থাকল সারাদিনের অমন গমন পথের পা-চালক জগদীশের জন্য। দৌড় বুঝে 'রহনে কা জগাহ'-র সন্ধানও দিল। ভাল থেকো ভাইটি। রেজাই মুড়ে খাটে বসে দেখছি চেনা সূর্যটা কেমন সেজেছে পশ্চিম প্রান্তদেশে। সবুজ নীল ধূসর পাহাড়ের ওপারে তার বাড়ি আছে। কপাট বন্ধের আগে পর্যন্ত অনিন্দ্যহাস্যে বিদায় জানাল। নাঃ, কুঁড়েমি ভাল্লাগছে না। 'চলো অশোক, চড়ে আসি।' বাইরে গোরু ঘোড়া ভেড়ারা চড়ছে তখনও। ঝরনাকলে জল ঝরছে। ঘরনিরা গুটিয়ে তুলছে বাইরের কাজ।

খালি হাতে হালকা পায়ে হাঁটছি। সেই গোটা দিনের হাঁটার মতো নয়। তাড়া নেই। ভল্লুকাতঙ্ক নেই। নুড়িশিলায় ঠোক্কর নেই। দেওরিয়া তাল থেকে এভাবে চোপতা আসার মাদকতা অন্য। আকর্ষণ অন্য। এত থ্রিল অভিজ্ঞতার থলেতে কমই ছিল তখন। রাত কাটিয়ে তুঙ্গনাথ যাব। আবার রাত পার হবার আগেই রওনা দেব চন্দ্রশিলার উদ্দেশে। দেবেন্দ্র'র সঙ্গে কথা হচ্ছিল। 'হ্যাঁগো, কিছুই তো জানি না চিনি না। উপরে থাকতে না পেলে....। পুজোর সময়। ভিড়ভাট্টা নাকি বহুৎ।'
  রাতে রুটিসবজি রেডি করতে করতে দেবেন্দ্র আশ্বস্ত করল, 'সোচনে কা জরুরত নেই।' তার দোস্তকে লিখে দিচ্ছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাহা, বাহা রে বন্ধু। সুক্রিয়া।

একটা কথা বলা থাক। চোপতা বাসস্ট্যান্ড তথা তুঙ্গনাথ যাত্রার সূচনাস্থল লজ-হোটেল-খাবার দোকান-লোকজনে জমজমাট। সেখানে না-থেকে আমরা এক কিমি আগে উখীমঠ যাওয়ার পথে ছোট্ট ডেরায় ঠাঁই পেতেছি। ড্রাইভার ও ছোট কারবারিরা এমন জায়গায় থাকে। নিঃশব্দ নিরিবিলি ঢালাও নিসর্গ চতুর্দিকে। নীচে কারা যেন অনেকগুলো টেন্ট পিচ করেছে। কোনও প্রকল্পের কর্মীদের আস্তানা বুঝি।

জাঁক-ছাড়া ঘরে শরীর লেপে মুড়ে কমলা রোদের বিকেল দেখা অবিস্মরণীয়। কোন দূরে পাহাড়ের রং বদলাতে বদলাতে, আবছা হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেছে। ওইখানে সূর্যের সঙ্গে তাদের বড় ভাব। 
আলো যত নিভে আসছে, সুড়সুড়িয়ে শীত তত জমিয়ে নামছে। পাতলা হাওয়ার ডানায় ভর করে ঠান্ডা ল্যান্ড করছে উপত্যকায়। লেপের প্যাকেটে কোথা দিয়ে যে সে ঢুকে পড়ে গায়ে জিভ বুলাচ্ছে কে জানে! পাঁচ পা হেঁটে দোকানে রাতে খেতে যেতে হবে ভেবে আরটু গুটিয়ে গেলাম।


রোদ্দুর তার সব আলো ঢেলে দিয়েছে সকালটায়।তুঙ্গনাথের বন্ধুকে দেবেন্দ্র'র এক লাইন লেখা চিরকুটটা নিয়ে রওনা হলাম সাড়ে সাতটা নাগাদ। চোপতা থেকে পাকা ধাপ-পথ ধরে হাঁটা শুরু। ডানহাতে মঙ্গল সিং-এর চটি, যাঁর সঙ্গে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সখ্য ছিল।

বড় বড় রডোডেনড্রন গাছের ছায়ায় ছায়ায় কেবল উঠে এগিয়ে যাওয়া। কখনও গাছ পাতলা, পার্বত্য দিগন্ত দেখা যাচ্ছে। কখনও সবুজ বুগিয়াল, একটা-দুটো ছোট দোকান। গ্রাম বা লোকবাস নেই। অল্পস্বল্প ভ্রমণার্থী আর পুণ্যপ্রার্থী। ভালই হাঁটছি খাসা রাস্তা পেয়ে। হঠাৎ খাড়াই শর্টকাট মিললে সাহস করে পা ফেলা। পাথর ডিঙিয়ে, হাঁটু তুলে, হাঁটু মুড়ে পাহাড় চড়া। উপরে উঠে হালকা ফুর্তি জাগে মনে। চটপট এখানে আসা গেল, নয় —ওই —ওই ভাবে ঘুরতে ঘুরতে কখন পৌঁছতাম! অনেকটা পথ কমে গেল। দম থাকলে এভাবে চোরবাটো ধরা সুবিধের। দৈর্ঘ্য খর্ব হয়। 'চোরবাটো' নেপালি কথা। সন্দকফু রুটে খুব চালু। অবশ্যি একবার ফালুট যেতে দূরত্ব কমানোর বাটো পাকড়ে বেশ গড়বড় হয়েছিল। অন্যত্র বিবৃত হয়েছে সে উদ্বেগ-কাহিনি।কংক্রিটের পথের মাঝখানটায় বসে কী আমোদ পাচ্ছেন তিনি, কে জানে! চিত্রময়, বর্ণময় এক প্রজাপতি। ডানা ছড়িয়েছেন যেন অহংকার প্রকাশ করতেই। কী অপরূপ নয়নসুখদ তার রূপ! 
বোতল থেকে দিব্য ঢকঢকিয়ে জল খাচ্ছেন এক ঘোড়া।পিঠে বাড়তি মাংসবান একজনা। হেঁটে ওঠা তাঁর ক্ষমতায় নেই। বোঝাই যায়, মেদ সঞ্চয়শীল মানুষটি এখন পুণ্য সঞ্চয়ে।

চড়াই বেয়ে উঠছি তো উঠছিই। হাঁফ ধরছে। থামছি, এগোচ্ছি। জন চারেকের একটা দলকে ওভারটেক করতে স্বাস্থ্যবান শিখ যুবকেরা হাসলেন এবং জানিয়ে দিলেন, বাঙালিরা মছলি খাই বলে এমন হাঁটতে পারছি। মাছখোর বলায় মনটা প্রসন্নই হল। অনেক হাঁটতে চাই যে 'পৃথিবীর পথে'। ১২০৭৩ ফুট উচ্চতায় পৌঁছে তুঙ্গনাথ মন্দির ও তার পরিপার্শ্ব এবং দূর-পরিপার্শ্ব নিরীক্ষণ করে বোঝা গেল, মানুষ কেন আসে। তীর্থের পুণ্যাকাঙ্ক্ষা কি শুধু! তীর্থকে আকর্ষণীয় করার জন্যই বুঝি পৃথিবীর এমন মনোরম অংশটুকু বেছে নেওয়া হয়েছে। হিমালয়ের সর্বত্র এমনই। তা হোক, সমস্যা নেই। তবে সত্যি হল, দুরন্ত দেখনবাজি ছাড়া তীর্থ-পুণ্যের বাসনা ব্যতিরেকে ভ্রমণ করে আনন্দ কিছুমাত্র কম হচ্ছে না। চারপাশে অ্যাত্তো বড় বড় পাহাড়। দূরে পাশে পাশে সার বেঁধে পড়ে আছে দুগ্ধফেননিভ শৃঙ্গকুল। তার আগে নিচু পর্বতগুলো নীলাভ, ঈষৎ ঘোলাটে। ঝলমলে রোদ্দুরে ধুয়ে যাচ্ছে ব্যাপ্ত দ্যুলোক।

চিরকুট মোতাবেক ঘর মিলল কালীকমলী ধর্মশালায়। চলতে চলতে টুকুর-টাকুর মুখ চলে বলে ভরপেট লাঞ্চের চাহিদা নেই। খাদ্যবন্ধু ছাতুচিঁড়েরা পুষিয়ে দিল। পড়তা পোষাল পকেটেরও। অবাধ শব্দ খরচা করে যে কেউ 'কিপটে' এবং আরও কিছু বলতেই পারেন। আমাদের সব বেরোনোতে এই আয়োজন গুছিয়ে থাকে। ঘাড় কিঞ্চিৎ বেগড়বাঁই করলে মুখে লজেন্স ঠেলে দিই।

গ্রানাইট পাথরে নির্মিত, সহস্রাধিক বছরের পুরোনো মন্দিরের গঠনশৈলী হিমালয়ের চেনা নাগারা রীতি মেনে। শৃঙ্গকুলের দেবতা তুঙ্গনাথ। বিশ্বের নিরিখে দ্বিতীয়, ভারতে সর্বোচ্চ শিবালয়। পাঁচ কেদারের তৃতীয়। পাণ্ডবদের কাহিনি-সম্পৃক্ত মন্দিরে ভিন্ন রূপে প্রতিভাত দেবাদিদেব। বছরের ছ'মাস অতি-তুষারের কারণে বন্ধ থাকে। এখন তীর্থপথিক ও ভ্রমণপথিকদের আসা-যাওয়া। চত্বর ঘিরে পায়চারি, ইতিউতি থেবড়ে বসে দুপুর-বিকেল বিলাস, দু'একজনের সঙ্গে আলাপচারিতা উপভোগ্য। এক বিদেশি দীর্ঘ রুখা কেশদামে লাল ফিতে বেঁধেছেন। ওমা, পায়ের মোজার উপরেও দেখি লাল ফিতে! আরও কী সব মাকড়ি-ফাকড়ি কানে-গলায় পেঁচানো। হাতে নজরটানা ক্যামেরা। পাশে বিদেশিনি। ইনিই কি হিপি বা পাঙ্কদের প্রতিনিধি? তা হোক, হাই-হ্যালো'র সঙ্গে একটু কথাকথি মন্দ লাগছে না। জানায় দোষ নেই। টুরিস্ট এক কিশোরী ছ'ফুটের দামড়ার এই গেট-আপের রহস্য অনুসন্ধানে নাছোড়। দামড়া হাসেন। কন না কিছু। ক্যামেরা তুলে কায়দা করেন। সঙ্গিনীটি আলাপী। তাঁর নাম কী বলেছিলেন মনে নেই। কিন্তু সঙ্গীর নাম তিনি জানেন না বলেছিলেন। অর্থাৎ?
ইন্ডিয়া এসে পরস্পরের পরিচয়। সপ্তা'খানেক একসঙ্গে ঘুরেও নাম জানা নেই বা জানার প্রয়োজন পড়েনি। "What's in a name?" শেক্সপিয়রের ভক্ত কি? জিগানোর মন করে না। সবখানে সাহিত্যের দিকে মোড় ঘোরাবার কী প্রয়োজন! সিকিমে ভিলেজ ট্রেকিং-এ একবার তিন ফরাসিনির সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায় মোপাশ্যাঁ'র প্রসঙ্গ টেনে আনলে তন্বীরা ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে কয়েকটা অনর্থক 'ইয়া ইয়া' ছেড়ে লাফ দিয়েছিল, 'ও ইয়া ইয়া, মোপাশ্যান্ট।'—না, কিচ্ছু পড়েনি। কী জানি, পেশায় এমআর হলে বুঝি সাহিত্য ছুঁতে নেই। ওরা তো খুব পড়ে শুনি।
 
প্রকাণ্ড শিলাখণ্ডে বসে দু'জনে রোদ নিচ্ছি। সূর্যের পশ্চিমে নেমে যাওয়াটা বেশ স্পষ্ট। তার জোশ ঝিমিয়ে যেতে ঠান্ডা জোর পেল। ট্র্যাকসুট বেতোয়াক্কা করে গায়েপড়া তার জোরজারির আভাস পাচ্ছি। উঠি-উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে করছে না। এই উচ্চলোকে নিজেদের ক্ষুদ্রতা, অসহায়তা, অকিঞ্চিৎকরতা সম্যক উপলব্ধি করছি। আশ্চর্য মায়াময় এক জগৎ! সমতলের ঝঞ্ঝাট-বহুল নগরবাসী আমরা বড় বেমানান, অপ্রত্যাশিত, অবাঞ্ছিত এখানে। ভয় হয়, নিভৃত দুনিয়ায় নাগরিক কূটকচালের আবর্জনা না প্রবেশ করে। যদিও এই বহিরাগত বেনিয়া আর 'অহং' সর্বস্ব সংস্কৃতি এখানে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে। এটা চোখে পড়ে, যখন একই স্থানে পাঁচ-দশ বছর পর ফিরে আসা যায়।
কালো গা, লাল ঠোঁট, হলুদ পায়ের কাক অ্যালপাইন চোফ-এর ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে। উঁচুতে চিলেরা অক্টোবরের স্বচ্ছ আকাশে আলসে গ্লাইডিং করছে। একটা রাস্তা, পাহাড়ের গায়ে সরু রেখা হয়ে উপর দিকে ধেয়েছে। পিঠে বিপুল বোঝা নিয়ে সেই গা-শিরশিরানো পথে এগিয়ে আসছেন স্থানীয় বৃদ্ধ। ভোর চারটেয় এ পথ হাতড়েই কাল আমরা যাব চন্দ্রশিলা ছুঁতে। 

ঘরে ঢুকে কম্বল সম্বল করে পড়ে রইলাম। বাবা রে ঠান্ডা! তার মধ্যেই ঝিমুনি এল। না-ঘুম না-জাগা —এই অবস্থাটায় মন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। টিভি-র চ্যানেল ঘোরানোর মতো অনবরত তার ভাবনার বিষয় বদলে যাচ্ছে। একবার দেখি, বাড়ির পথে পা রেখেছি।

'খেতে যাবেন না?' অশোকের ডাকে চটকা ভাঙল। যাবার তাগিদ নেই তেমন। নেই, কিন্তু একটু উপরে ছোট্ট এক চটিতে বলা আছে চাউল বানিয়ে দেবে রাত ন'টা নাগাদ।
থার্মোমিটার দেখাচ্ছে তিন ডিগ্রি। কাপড়-চোপড় জড়িয়ে জবুথবু হয়ে টর্চ জ্বেলে রওনা দিলাম। খাব। মহাপ্রয়োজনীয় কর্ম।
পাথরের খাঁজে পলিথিন জুড়ে সাধু চেহারার তিনি থাকেন এবং অভ্যাগতদের খাওয়ার বন্দোবস্ত করেন। অপেশাদার মানুষটি পরম যত্নে কাঠের চুলায় কড়াইয়ে তখনও শাক নাড়ছেন। সমাদরে বসালেন। হেসে বোঝালেন, আর একটু সময় লাগবে। —বেশ। একজন ভিতরে পাতা চাদরে বসে আছেন। চারজনে গল্প চলল। হাতগুলো বাড়ানো আগুনের দিকে। প্রায় উন্মুক্ত সেই আস্তানায় আঙুলকাঁপা ঠান্ডায় যে ধৈর্য-নিষ্ঠা-মমতায় সাধুজনটি নিজের আর আমাদের দু'জনের জন্য ভাত-ডাল-মুলোশাক রাঁধলেন, তা আমাদের কুণ্ঠিত করে তুলল। বড় বিব্রত লাগল।অপটু হাতে থালায় বেড়ে দিলেন সে-সব বহুকাঙ্ক্ষিত ভক্ষ্য। আত্মবিস্মৃত তিনি সেবাকর্মে। নিজের জন্য রাখার কথা আমাদেরই মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে।কোন ঈশ্বরের সাহচর্য তাঁর প্রার্থিত, জানি না। কোন মোক্ষের এষণা তাঁকে এই প্রতিকূল পরিবেশে টেনে এনেছে, জানি না। তিনি সাধু। সাধু কাকে বলে ঠিকঠাক, জানি না। বিশেষ, নাগরিক গালফুলো কথাবাজ সাধুবেশী ঢের চোখে পড়ে বলে। জানি না, তিনি কবে কোথায় পৌঁছলে হবেন 'সিদ্ধ', তাঁর সেই পৌঁছনো ব্যক্তির না সমূহের স্বার্থে। শুধু জানি, এই বিকৃত মুদ্রান্বেষার কালসন্ধিতে, আত্মার্থে ভোগ-সম্ভোগের অস্থির ক্ষণে, তিনি ইতিমধ্যেই সিদ্ধজন। নির্লোভ, সেবাপরায়ণ, স্নেহময়, আত্মভোলা। তাঁর চর্চা যা-ই হোক, চর্যা অতুলনীয়। মানবগুণসম্পন্ন সর্বার্থে। তাঁকে স্মরণে রাখলাম। প্রসঙ্গ উঠল বলে জানাই, হিমালয়ে এমন কৃচ্ছ্রবেশী ক'জনকে পেয়েছি, যাঁরা মনুষ্যজাতির প্রকৃত প্রতিনিধি। শিক্ষণীয় তাঁরা।


কোনওক্রমে ঠকঠকিয়ে ঘরে ঢুকে সটান কম্বলের ওমে। উ-হু-হু-হু, পায়ের আঙুলগুলো কে বরফ ঘষছে রে! কাত বদলাতেও আলস্য, জড়তা। আবার নাকি ভোর চারটেয় উঠে রওনা দিতে হবে।মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া হল। দেরি হলে সূর্যোদয় মিস হবে। যাব আরও উপরে, চন্দ্রশিলা।
  
ছবি: আকাশগঙ্গা, তুঙ্গনাথ মন্দির ও তুষারশৃঙ্গ। গঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ড। অক্টোবর, ২০১০।







পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড় ঘুরে---( পলাশ মোহে)

সী মা সা ন্যা ল


বসন্তের রেশ ধরে চৈতী পলাশ
পুরুলিয়া না গেলে মেটেনা সে আশ


হাওড়া- চক্রধরপুর ট্রেন (রাত ১২-৫) ধরে পরদিন ২৫ শে মার্চ (২০২২) পৌঁছে গেলাম পুরুলিয়া স্টেশানে।
আমাদের আগে থেকে ঠিক করা গাড়ি ছিল স্টেশানে। আমাদের হোটেল বুক ছিল অযোধ্যা পাহাড়ের টপে।গাইড সুখেন প্রামাণিক-এর কথায় ওখানে আগে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে বেরোলে অনেকটা সময় নষ্ট হবে, তাই ওই একটা লজ ঠিক করে দিল ঘন্টাখানেকের জন্য একদম স্টেশানের গায়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে। 
নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থলের দিকে এগোতে এগোতে আমাদের গাড়ি প্রথমেই দাঁড়ালো অযোধ্যা যাবার পথে-- টামনা পার হয়ে বরাকডি পলাশবনে।
চারিদিক লালে লালে ছেয়ে গেছে। যতোদূর চোখ যায় শুধুই পলাশ। এতো রূপ, এতো সৌন্দর্য তাই বোধহয় সে রূপঅহঙ্কারী। মাত্র কয়েকদিন থেকে ঝরে যায়।
"কিংশুক ফুল হিংসুক ভারি
আজ করে ভাব কাল করে আড়ি
মন তার বোঝা যায়না"---


আদিবাসী শিশুরা মাটিতে পরে থাকা পলাশ নিয়ে মালা গেঁথে বিক্রি করছে মাত্র দশ টাকায়। কোন জবরদস্তি না। নিলে নাও না নিলে নিওনা। আপন মনে ওরা মালা গাঁথতে ব্যাস্ত। মুঠোফোনে বন্দী করলাম কিছু পলাশ মুহূর্ত যা আজীবন স্মৃতিতে সঞ্চিত হয়ে থাকবে---


মুরগুমা থেকে হিলটপ যাওয়ার পথে আমাদের গাড়ি হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়লো কেঁদ গাছ দেখে। শুনেছি এতোদিন কেঁদ সম্বন্ধে। আজ দেখে চোখ সার্থক হলো।
ছোটছোট বাচ্চারা মনের আনন্দে গাছের তলায় খেলা করছিল।
আমিও সামিল হলাম ওদের সাথে। কুড়ালাম ফল--- এই ফলে প্রচুর পরিমানে শর্করা, প্রোটিন, ফাইবার এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ বি-ক্যারোটিন, টের্পেনয়েডস,স্যাপোনিন এবং ট্যানিন থাকে। কেন্দুল পাতা থেকে বিড়ি তৈরী হয়। 


বাগমুন্ডি থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার পথে বামনি ফলস। বারিয়া গ্রামের কাছে। প্রায় ৫০০ সিঁড়ি হেঁটে পাহাড়ের নীচে এই জলপ্রপাত। ঝর্ণায় নামার সময় সবুজ ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে যাবার সময় মনে হচ্ছিল জঙ্গল ট্রেকিং করছি। একটু একটু করে নামা আর তীব্র কৌতুহল না জানি পরের বাঁকেই কি অপরূপ সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে।
দুটো ধাপ আছে এ জলপ্রপাতের। প্রথম ধাপ অব্দি উঠে অনেকেই আর নামতে পারছেন না।ওখানেই বিশ্রাম সাথে ছবি তোলা। আমরা দমিনি, নামতে থাকলাম। 
জলপ্রপাতের কাছাকাছি যেতেই পাথরে জল প্রবাহিত এবং ফাটলের শব্দ যে এক আবেশ তৈরী করে দিল!! সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। ঝরনার তলদেশে পৌঁছে, যখন দেখলাম পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রবাহিত জল সামনে এসে পড়েছে। একটু সাবধান হতেই হলো, জল পড়ে পাথর পিছল। সে জল চোখে মুখে দিয়ে কি শান্তি! 
ওঠার সময় কষ্ট আরো বেশী--- তবুও মনে হলো---"যা দেখলাম তা জন্মজন্মান্তরেও ভুলবোনা।


এর পরের গন্তব্য তুর্গা ফলস। অল্প পাহাড়ি সিঁড়ি। কিন্তু সাঙ্ঘাতিক দুর্গম।
ছোট ছোট ১০/১২ বছরের ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে, ওরা সাহায্য করবে ওই ফলসে নামাতে ও ওঠাতে মাত্র ২০ টাকার বিনিময়ে।
এতো অল্প চাহিদা আর এতো অল্পতেই মুখে খুশির ঝলকানি বোধহয় এরা বলেই সম্ভব--- তুর্গা ফলসে পাহাড়ের গা বেয়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় জলরাশি নীচে আছড়ে পড়ছে।
এ সৌন্দর্য দেখে ফিরে আসার পথে পেছন থেকে ঝর্নার কলতান যেন বলে উঠেছিল--- "আবার কিন্তু দেখা হবে"---

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু , তর্কে বহুদূর---
শিবমন্দিরে পাঁঠা বলি!! চমকে উঠলেন তো?? হ্যাঁ এটাই সত্যি। লহরিয়া শিব মন্দির আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল।
বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ পরিবেশে এ শিবমন্দিরে মন শান্তিতে ভরে উঠলো। মন্দিরে দুটি প্রবেশপথে নন্দীভৃঙ্গীর শ্বেত পাথরের মূর্তি চোখে পড়ার মতো।
শ্রাবণ মাসে তো ঢল নামে মানুষের পুজো দিতে এ জাগ্রত বাবার থানে তাছাড়াও সারা বছর চলে মানসিক পূরণ করে পাঁঠা বলি দেওয়া--- বিশ্বাসে আপনিও পারেন এখানে মানসিক করতে। কথিত আছে লহরিয়া শিবমন্দিরে মানত করলে তা সফল হবেই।

মার্বেল লেক--
লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে--

লাল সবুজ সাদা কালো পাথরে
আদর জড়িয়ে মার্বেল লেক আখরে---


হঠাৎ করে মনে হলো আমি কি সেই আদিম প্রস্তর যুগের পাথরের দেখা পেলাম? রঙিন পাথরে পাথরে এ এক অপুর্ব জায়গা---

পৃথিবীর চতুর্থ সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পুরুলিয়া পাম্প স্টোরেজ প্রোজেক্টের কাজের জন্য বিস্ফোরণ করে পাথর ভাঙতে গিয়ে সেই পাথরের খাঁজে এই লেকটি তৈরি হয়৷
 এর চেহারা দেখে অনেকেই তুলনা করছেন আমেরিকা-কানাডা সীমান্তে ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’-এর সঙ্গে৷
গভীর খাদে নীল জল আর পাথরের খাঁজ। তার পাশে যতোদূর চোখ যায় পাহাড়ে ঘন সবুজ জঙ্গল।
চোখ সার্থক হলো এ মার্বেল লেক দেখে।

পরের গন্তব্য লোয়ার ও আপার ড্যাম। 
এ যেন অজানা এক পথ---


গাড়ি এগিয়ে চললো লোয়ার ড্যামের দিকে। এখানে আমরা নামিনি। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে এগোলাম 
কি অপরূপ সৌন্দর্যর সম্ভারে সাজানো এ ড্যাম।সবুজ চাদরে যেন পাহাড় ঘেরা। 

আপারড্যামে এসে গাড়ি থামলো। কি বিশাল চওড়া রাস্তা---- এ ড্যামের জল সঞ্চয় করে টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরী হয়। সেই জল পৌঁছায় লোয়ার ড্যামে। দিগন্ত ছুঁয়ে গেছে জলের ধারা। এতবড় জলাধার পাহাড়ের মাঝে না দেখলে কল্পনাতেই রয়ে যেতো।সত্যিই বিস্ময়। প্রচুর ছবি তুললাম। আপারড্যাম থেকে পড়ন্ত সূর্যের লালিমা মোবাইল ক্যামেরায় বন্দী করলাম।

ময়ূরপাহাড়---


মন মেতেছে মন ময়ূরীর কি খেলায়---
 এ পথ খুব একটা খাড়া না।পাথরের পথ বেয়ে উঠতে হলো। 
একটা গাছের ডাল ধরে সাপোর্ট নিতে যাচ্ছিলাম-- পিছন থেকে শুনি এক আদিবাসী দিদির গলা--"হামরা অনেক কষ্ট কৈরে,গাছগুল্যান লাঁগাইছি দিদিমনিরা,গাছের ডালপালহা ভাঙ্গৈ না"---
কি নিবিড় বন্ধন এদের গাছগাছালির সাথে। এরা যেন একএকজন শকুন্তলা আর ময়ূরপাহাড় তপোবন।
 আছে কিছু বড়ো বোল্ডার। ঠিক সামনেই পাথরের চাতাল আর তার পরেই এক খাদ।যেখানে বসে মনে হলো এই কি সেই এই কি সেই যাকে কতোদিন স্বপ্নে দেখেছি!


ধীরে ধীরে সূয্যি লালপলাশের গাছের পিছনে লাল আকাশে ঢলে পড়তে লাগলো। আমরাও প্রস্তুত তাকে মুঠোফোনে বন্দী করতে। টুপ টুপ ডুব দেবার আগে সুয্যি যেন বলে দিল --"দেখো আর জ্বলো আমার এ অগ্নিভ রূপ দেখে"---







আমার ছোট্ট সফর- মাতৃভূমি ঢাকা-পর্ব ৫ ও পর্ব ৬

সু জা তা দা স

পর্ব ৫

আমার দুইভাই, শিশির আর সুজনের কথা বলতে শুরু করলে শেষ হবে না, আমার প্রথম ঢাকা সফরের কর্ণধার ছিল আমার এই দুই ভাই। এই দু'জনের ভালোবাসাতেই হয়তো পৌঁছেছিলাম আমার প্রাণপ্রিয় জন্মস্থান ঢাকা শহরে, এই দুইজন প্রায় প্রতিদিন রাতে ম্যাসেঞ্জারে নক করেছে, আমি কবে টিকিট কাটছি? কীভাবে ঢাকা পৌঁছাব? আমরা সবাই থাকবো এয়ারপোর্ট, কোনও চিন্তা নাই দিদি--- তদুপরি আমার সময় মতো ফাংশানের দিন ঠিক করা, এমনই সব কথা চলতো অনেক রাত পর্যন্ত।

ওখান থেকে আসার পর আমি যেহেতু এর আগে কখনও বাংলাদেশ যাইনি, তাই একটা অসহায়তা বা ভয় কাজ করতো সব সময়--- কারণ আমার ওখানে শ্বশুরবাড়ির অনেক আত্মীয় থাকা অবস্থাতেও আমি কাউকেই সেভাবে চিনি না আর দেখিওনি, আর যাঁদের চিনি দেখেছি তাদের কাছেও কখনও যাওয়া হয়নি— তবে এখন আমি একাই যাতায়াত করি, অনুষ্ঠান শেষ করে জয়পাড়া মামাশ্বশুর বাড়ি থাকি সময় পেলে--- আর সেই ভাবনাগুলো কাজ করেনা, আমি সত্যিই আপ্লুত যখন এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই ওদের দেখা পেলাম, আরও অবাক হলাম ওদের সাথে আমার মামাশ্বশুরের ছেলেকে দেখে।

আমি ভাবতেও পারিনি শুধু মাত্র একটা গ্রুপের কোর-কমিটিতে থাকার জন্য এতটা সন্মান প্রদর্শন করতে পারে কেউ, এটা বাংলাদেশ বলেই হয়তো সম্ভব--- ওরা কথা রেখেছেন আমাকে আগলে রাখার, শুধু তাই নয় আমাকে সর্বদা ঘিরে থেকেছেন--- সেটা বইমেলা বা বাংলা একাডেমী অথবা অনুষ্ঠান মঞ্চ বা এয়ারপোর্ট সব জায়গায় সমান ভাবে আমি ওদের সাথে পেয়েছি--- আমি যখন বাংলাদেশ বিমানবন্দরে আমার ফোন কাজ না করার কারণে দিশেহারা, ভাবছি ওরা খুঁজে পাবে কীভাবে আমাকে--- সেই সময় এক বাংলাদেশি বিমানবন্দর কর্মী আমাকে তাঁর ফোন দিয়ে সাহায্য করেছিলেন--- বলেছিলেন চিন্তা করেন কেন, আমার ফোনে কথা বলেন, আমি কৃতজ্ঞ থাকবো চিরজীবন ওনার কাছে এই উপকারের জন্য।

আমি সত্যিই সেদিন অবাক হয়েছিলাম!! সুজন ফোন রিসিভ করে যখন বলেছিল, বিকেল থেকে ওরা এয়ারপোর্টে এসে বসে আছে গাড়ি নিয়ে আমাকে হোটেলে পৌঁছানোর জন্য--- আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এমনভাবে হাত নেড়েছিল, সেই সময় আমার মনে হয়েছিল আমি নিজের ভাইয়ের বাড়ি এসেছি--- কিন্তু টেনশনের কারণে কিছুতেই দেখতে পারছিলাম না ওদের, দেখা হওয়ার পরের চার ঘন্টা কীভাবে কেটেছিল সেটা আমি প্রথমেই বলেছি, তাই আর বলছি না--- এই হলো আমার শিশির সুজন, একজন ভারতীয় দিদির দুই হাত হয়ে যারা বাংলাদেশে আমাকে আগলে রেখেছিল ঐ আটদিন।

হয়তো আবার দেখা হবে কিন্তু আমার প্রথম অভিজ্ঞতা আমার শেষ দিন অবধি মনে থাকবে, এভাবেই আন্তরিকতায় ভরে থাকুক ওদের মন প্রাণ প্রতিক্ষণে এই কামনা রইলো ওদের জন্য আমার তরফ থেকে— এখানে আমি আমার আর এক ভাইএর কথা বলবো, যে সুদূর সৌদিতে থেকেও আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন আমার এই বাংলাদেশ ভ্রমনের সময়--- আর তিনি বাংলাদেশে না থাকা সত্ত্বেও তাঁর বাসায় নেবার জন্য অনেক আবদার করেছিলেন আমার কাছে, কিন্তু সময়াভাবে আমি বারন করি- আমার এই ভাই (কুসুম কুসুম)এর আন্তরিক ডাক আমার মনে থাকবে আজীবন কাল ধরে স্মৃতিতে।

তেমনি মনে থাকবে আমার ঐ ছেলেটিকে যে আমার সাথে দেখা করার জন্য বইমেলায় এসেছিল সুজনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে এবং পুরো সময়টা আমাদের সাথেই ছিল--- সম্ভবত আমার এই পুত্রটি ওকালতি পাশ করেছেন এর মধ্যেই, মনে থাকবে ওর আন্তরিকতাও, আমার ফোন চুরি হওয়ার পর নতুন করে ওকে আর খুঁজে পাইনি--- এবার আসবো অনুষ্ঠানের কথায়, এতো সুন্দর ছিল এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান তা আমি আর ভাষাতে প্রকাশ করতে পারবো না--- যেমন ছিল আন্তরিকতা তেমনই ছিল সন্মান প্রদর্শন, অনুষ্ঠান হলে সকলেই সমান ছিল কেউ ছোট বা বড়, কাউকে বেশি সন্মান বা কাউকে (ও এসেছ খুব ভালো)এই গোছের কোনও অবমাননা পেতে দেখেনি---

কেউ ছিল না সভাপতি বা কেউ বিশিষ্ট অতিথি, প্রতিটি মানুষ ছিলেন সমান ও সম্মানের--- এভাবেই ফিরে ফিরে আসুক কলমযোদ্ধার যোদ্ধারা, যাদের থেকে হয়তো উঠে আসবেন ভবিষ্যতের কোনও সুনীল-শংকর-মহাশ্বেতা অথবা এখনকার জয় গোস্বামীর মতো কেউ--- আশা করতে তো মানা নেই- তাই না? সেই আশাতেই এগিয়ে চলুক কলমযোদ্ধা---

পর্ব-৬

অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত হলো, হোটেলে ফিরতে আরও অনেকটাই দেরি, কারণ ততক্ষণে জয় ভাইয়ের আবদার মেটাতে অনুষ্ঠান শেষে তার দিদির বাড়ি এবং ইস্কনের প্রসাদ খাওয়া, ততক্ষণে আমিও কাহিল হয়ে গেছি অনেকটাই--- তারপরে হোটেলে ফিরে গোছানোতে ব্যস্ত কারন বারোটার আগে হোটেল ছাড়তে হবে, এবার যাত্রা-শ্বশুর শ্বাশুড়ির বাবার বাড়ি অর্থাৎ আমার দাদাশ্বশুরের জন্মভূমি ও কর্মভূমি দেখে তাদের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করা— তারই মধ্যে একটা মেসেজ এসেছিল দুই বাংলার পরিচিত কবি মুখ মি. অমল দাস মহাশয়ের- যিনি লিখেছিলেন বই মেলায় দেখা হলে নিয়ে যাবেন তার বাসায়, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমি তারজন্য অপেক্ষা করতে পারিনি কারণ উনি সতেরো তারিখ ঢাকা পৌঁছানোর কথা বলেছিলেন আর আমি সতেরোতেই জয়পাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিই।

এরই মধ্যে সৌম্য ফোন করলো, "দিদি আমাদের বাড়িতে আসতে হবে আপনাকে।" সৌম্য দে- এই ভাইটির সাথে দেখা হয়েছিল আনন্দ প্রকাশনীর স্টলে, কাকলি মান্নার সাথে--- আমি ভাবতেও পারিনি ঐটুকু সামান্য পরিচয়ে সৌম্য আমাকে তার বাড়ি যাবার জন্য বারবার বলবে, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমি সৌম্যর বাড়িও যেতে পারিনি শুধু সময় নেই বলে--- এই ভাইটির আন্তরিকতা আমি দেখেছি কোলকাতাতেও আর সেদিন দেখেছিলাম বাংলাদেশে--- যাইহোক সৌম্যর সাথে কথা শেষ করে সব গুছিয়ে উঠতে উঠতে রাত্রি দুটো বেজে গেছিল যদিও আমার রাত্রি জাগার অভ্যেস আছে কিন্তু উনি মানে আমার পতিদেব তাড়াতাড়ি ঘুমোনোর পাবলিক--- তাই উঠতে দেরি হলো, স্নান সেরে বেরোতে বেরোতে এগারোটা বেজে গেল- গাড়ি চলে এসেছিল তাই তাড়াতাড়ি মালপত্র তুলে বেড়িয়ে পড়লাম বিক্রমপুরের উদ্দেশ্যে।

দাদা শ্বশুরের বাড়ি জয়পাড়া, সে ভাবে গ্রাম কখনও আমার দেখা হয়নি, জয় পাড়ার গ্রাম্য পরিবেশ বেশ লাগলো, এখন তো গ্রাম আর গ্রাম নেই শহরের অনুকরণ চলে এসেছে সব জায়গায় এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি--- তবুও একটা গ্রামের গন্ধ পেয়েছিলাম সেখানে, প্রত্যেকের অনেক অনেক জমির মাঝে একটা করে পাকা বাড়ি, আধুনিকীকরণের সমস্ত উপকরণ সেখানে মজুত, তবে আন্তরিকতার কোনও অভাব সেখানেও চোখে পড়েনি--- চেনা অচেনা প্রতিটি বাড়িতেই একেক বেলা খেতে হয়েছে আমাকে, কেউ বারণ শোনেননি--- প্রতিটি বাড়িতেই সব রকম গাছের সমাহার, কী গাছ নেই সেখানে, উঠোন জুড়ে আম জাম কাঁঠাল জামরুলের গাছ এছাড়া আরও অনেক রকমের গাছ--- আমি কখনও সাদা পিঠে দিয়ে মাংস খায়- দেখিনি আর শুনিনিও!! এখানে খাওয়ালেন এক মামি শাশুড়ি, মনে থাকবে আমৃত্যু এই সুন্দর খাবারের কথা, আমি জানি না শুনে অবাক হয়েছিলেন ঐ বাড়ির সকলেই। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি পশ্চিমবাংলায় সকলে এই সাদাপিঠা বা সরাপিঠা নতুন গুড় দিয়ে অথবা দুধ দিয়ে জ্বাল দিয়েই খান---

গ্রামের মাঝেও শহরের স্বাদ এক নতুন অনুভূতি যা আমাকে অভিভূত করেছিল- আর আন্তরিকতা--- সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার শাশুড়ি মানে তাদের মেয়ে বাসন্তীর ছেলে ও বৌমাকে দেখতে সকলেই এসেছেন পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয়, এটা আমাদের ইট কাঠের জঙ্গলে বিরল দৃশ্য- উনারা প্রত্যেকেই আমাদের মাঝে হয়তো আমাদের শাশুড়ি ও শ্বশুরকেই দেখতে চেয়েছেন, এটা সম্পূর্ণ আমার মনে হওয়া যা আমি তাঁদের আন্তরিকতায় উপলব্ধি করেছি--- সেই কোন ছোট্ট বেলায় খেলে বেড়ানো মানুষটা আজও এদের স্মৃতিতে বিরাজ মান- এটা ছেলের বউ হিসেবে আমার অনেক বড় প্রাপ্তি- যা আমার শেষের পাথেয়ও।

                                                চলবে—






পাহাড় ছুঁয়ে মোহনায়

সু নৃ তা রা য় চৌ ধু রী


সত্যি বলতে কি একেবারেই ভাবতে পারিনি--- এই তো সেদিন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গমে ত্রিবেণীর অজস্র নুড়ি পাথর বিছানো তটে ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে, তিস্তা ব্যারেজ, কালিঝোরা পেরিয়ে দশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কত জটিল বাঁক ভরা পাহাড়ী পথ বেয়ে ঘুরে এলাম পেশক, তিনচুল্লে, লামাহাট্টা, তাকদা। পার্বত্য প্রকৃতির শোভা দু'চোখ ভরে দেখে সরলবর্গীয় আলোকপিয়াসী গাছগাছালির আকাশ ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখে বিস্মিত হয়েছি, সাতদিনের মধ্যে আবার ভ্রমণ? এবার জলজঙ্গলে বনবিবির রাজ্যে।

দুই রাত দিনের প্যাকেজ, ওদের নির্দেশ মত সাত সকালে, অর্থাৎ সকাল সাতটায় গড়িয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ক্যানিং, সেখান থেকে গাড়ি ধরে গদখালি গিয়ে ওদের লঞ্চ 'অভিরাম'এ নিজেদের সমর্পণ করাই আমাদের লক্ষ্য তখন। গড়িয়া স্টেশনে এসে শিহরিত হলাম। গাঢ় কুয়াশার মধ্যেও থিকথিক করছে লোক। আমাদের সামনে রেল লাইন, তার ওপারে আর কিছুই দেখা যায় না। তারস্বরে কোথাও গান বেজে চলেছে। একটা নামখানাগামী ট্রেন এলে ভীড় কিছুটা হালকা হলো। ক্যানিঙের ট্রেন এলে ভীড়ের মধ্যে কোনো রকমে শরীরটাকে গলিয়ে দিতেই আর কিছু করতে হলো না, অগুনতি জনতা আমার ভারসাম্য রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। অবশ্য শেষের দিকে অনেকটাই ফাঁকা হয়ে বসার জায়গাও মিলেছিল। ক্যানিং থেকে বড় একটা অটোরিকশায় চেপে গদখালি ফেরিঘাট। সেখানে নদীর বিস্তৃতি দেখে প্রথম বিস্ময়ের পালা। মাতলা এবং রায়মঙ্গল নদী এক হয়ে গোসাবা নদীর সৃষ্টি হয়েছে। লঞ্চ চলতে শুরু করলে বিস্ময় আরো বাড়তে লাগলো। যতদূর চোখ যায় ছলছল করছে জল, তার তীরে তীরে ঘন ম্যানগ্রোভের বন।

অদ্ভুত এই গাছগুলোর অভিযোজন ক্ষমতা! নোনা জলে জোয়ার ভাটা, প্রায়শই ঝড়ের মোকাবিলা করার জন্য এদের জটিল সর্পিল মূল, সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসমূল ঠেসমূলের সাহায্যে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম দেখে বিস্মিত হয়েছি বারবার।

পাহাড়ের গাছগুলি কেমন মাটিতে পা রেখে সূর্য ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষায় দীর্ঘতর হয়ে উঠেছে। এখানে শুধু মাটি আঁকড়ে থাকার জন্য কী সংগ্রাম! এমনও দেখেছি, তলা থেকে সব মাটি ধুয়ে গেছে, নানা দিকে থামের মতো শিকড় ছড়িয়ে গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। 

প্রথম দিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো এবং বেকন বাংলো দেখতে। স্কটল্যান্ডের সমাজসেবী সাহেব ড্যানিয়েল হ্যামিলটন সুন্দরবনের উন্নতির উদ্দেশ্যে সারা জীবনের অর্জিত অর্থ এবং জীবনের বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় করেছেন। আজও তাঁর নাম গোসাবার লোকের মুখে মুখে ফেরে। বেকন বাংলোয় সাহেবের কর্মকাণ্ড স্বচক্ষে দেখতে তাঁর আমন্ত্রণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছুটে এসেছিলেন। এখানে বসে তিনি রচনা করেন, "স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগত হতে" ইত্যাদি। এখানে হ্যামিলটন সাহেব এবং বিশ্বকবির স্ট্যাচু রয়েছে। এরপর আবার জলযাত্রা, এবার গন্তব্য সুধন্যখালি। এখানে কোথায় যে জল, কোথায় স্থল বোঝা মুশকিল। ম্যানগ্রোভের বন ডাঙা ছেড়ে জলে নেমে এসেছে আবার জোয়ার এলে স্থলভূমিতে নোনা জলের অবাধ প্রবেশ। আম্ফান ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। শোনা যায় নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করায় ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছিল। এখন কোথাও কোথাও ম্যানগ্রোভ প্ল্যানটেশন হচ্ছে দেখলাম। হরিণেরা কচি পেয়ে আবার সেগুলি খেয়ে ফেলে বলে জাল দিয়ে ঘেরা আছে জায়গাগুলো। এমন সময় কাদার মধ্যে চোখে পড়লো, না, দক্ষিণ রায় দেখা দেননি, তবে পদচিহ্ন রেখে গেছেন সদ্য। 

সুধন্যখালিতে গিয়ে সত্যিই ধন্য হলো দুই চোখ। এই প্রথম ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখলাম জঙ্গলের অনেকখানি। এখানেও নানা গাছের চাষ হচ্ছে। এখানে মিষ্টি জল রাখা আছে, বন্যপ্রাণীরা পান করতে আসে। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে তাদের দর্শন মিললো না। দেখলাম কাদাজমিতে অগুন্তি হরিণের পায়ের ছাপ আর আছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া। ওখান থেকে নেমে আসার পর গাছগাছালির ফাঁকে দেখা গেল হরিণ, সপরিবারে এসেছে জল খেতে। গরাণ, গেওয়া, বাইন, কেওড়া গাছের নামের সঙ্গে পরিচয় ছিল, তাদের দেখা পেলাম। তবে সুন্দরী গাছ, যার নামানুসারে নাকি সুন্দরবন, তার সংখ্যা কমছে। একটা গাছ বড় বড় লাল বেলের মতো ফল নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল, পরিচয় পেলাম cannon ball tree নামে। গাছে গাছে প্রচুর বাঁদর। এরা মাংসাশী। নোনা জলের মাছ, কাঁকড়া এদের খাদ্য। দো বাঁকির ওয়াচ টাওয়ারেও একই দৃশ্য, তবে এখানে দেখা মিললো একাধিক গোসাপের। বিশাল এক সারসকেও উড়ে এসে বসতে দেখলাম।

এরপর আমাদের যাত্রা রিসর্টের দিকে পাখিরালয়ে। ফেরার সময় খাঁড়ির বুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অনেক কাল মনে থাকবে। একটা নড়বড়ে বাঁশকে অবলম্বন করে কর্দমলিপ্ত শালের খুঁটির অস্থায়ী জেটিতে অবতরণ এবং তাই বেয়ে বাঁধের উপর উত্তরণের স্মৃতিও ভোলার নয়। এবার একদা ইঁটের তৈরি, অধুনা শুকনো এঁটেল মাটি ( জায়গায় জায়গায় ফাটলও ধরেছে) বেয়ে কিছুটা গিয়ে রিসর্ট গ্রীন ভিউ বাঁধ থেকে নেমে যেতে হয়। পাখিরালয়ে পাখিরা আর আসেনা , লয় পেয়েছে। কিন্তু বাঁধের এপাশে জনবসতি, চাষের ক্ষেত। চমৎকার গ্রাম্য পরিবেশে সম্পূর্ণ শহুরে সুবিধাযুক্ত পরিচ্ছন্ন রিসর্টটি।

সন্ধ্যা হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা এসে ঘরের মেঝে, বিছানা ঢেকে ফেললেও মশা দেখতে পাইনি। ওরা স্প্রে করে সব পরিষ্কার করে দিলো আর বললো বাথরুমের একজস্ট ফ্যানটা চালিয়ে রাখতে। এদিন স্থানীয় কয়েকজন মেয়ে এসে ঝুমুর গানে নাচে সারা সন্ধ্যা মাতিয়ে রাখলো। হতদরিদ্র মানুষগুলির সামান্য উপকরণ, নাচ যেমনই হোক, গান এবং গায়কীর প্রশংসা করতেই হয়।

পরের দিন ঘুম ভাঙতেই কী ঘন কুয়াশা! রিসর্টের সিঁড়ির ওপারে আর দৃষ্টি চলে না। কথা ছিল সকাল সাতটায় বেরোনোর, হয়ে গেল সোয়া নটা। এই কুয়াশা পাহাড়েও দশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে যাওয়ার সময় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছিল, এখন মোহানায় পৌঁছেও পিছু ছাড়েনি। ঝড়খালির বিশাল ঘেরা পার্কে জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ, দু'জনের দর্শনই মিললো। তবে দক্ষিণরায়ের বড়োই আলস্যভাব তখন। কুমীরও নড়েচড়ে মুখটা হাঁ করলো, আমরা যতক্ষণ ছিলাম, হাঁ করেই রইলো। আরেকজন জলের ওপর চোখ ভাসিয়ে ডুব সাঁতার কাটছিলেন।

বন্য প্রাণীর দেখা পাওয়া, সে তো তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, জল জঙ্গল দেখে দেখেই মন ভরে যায়। পঞ্চমুখানিতে অতি বিস্তীর্ণ জলরাশিতে ভাসার সময় ঢেউয়ের দোলা লাগলো। বঙ্গোপসাগরের থেকে আসা ঢেউ। এখানে সব লঞ্চ বা ট্রলারে ভারতের জাতীয় পতাকা লাগানো থাকে। বাংলাদেশ সীমান্তে যাতে না ঢুকে যায়। চাঁদ সওদাগরের দেশে ঘুরতে ঘুরতে অগাধ অপার জলে দেশের ভৌগোলিক সীমানা লুপ্ত হয়। মন চলে যায় সেই বনবিবির, শাহ জঙলীর উপকথায়, এমনই কোনো এক অজানা দ্বীপে পিতৃহারা বালক দুখেকে পিতৃব্যদ্বয়ের চক্রান্ত থেকে কেমন করে রক্ষা করেন তাঁরা। বেহুলা কি এমন বিস্তৃত গাঙে কলার মান্দাসে চড়ে তার সর্পাহত স্বামীকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছিল? কি করে সম্ভব হয়েছিল? নেতি ধোপানীর ঘাট নামটি তো তাকেই সমর্থন করে। 

এদিন আমাদের 'অভিরাম' যখন ঘাটে ভিড়েছে, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। পথে পড়ন্ত সূর্যের বর্ণচ্ছটায় সেজে থাকা আকাশটা কেমন কালির পোঁচ লেগে সবটুকু কালো হয়ে গেল জল জঙ্গলের ভয়াবহতাকে বাড়িয়ে তুলে, তাও দেখলাম। দেখা গেল শুক্লা তৃতীয়ার এক ফালি বাঁকা চাঁদকে। এবারে ঘাট তত ভয়ানক নয়, স্থায়ী সিমেন্ট লোহালক্করে তৈরি শক্তপোক্ত জেটি। কাছে একটা গঞ্জও আছে। কিন্তু রিসর্টের দিকে যাবার রাস্তা সেই একই রকম, তদুপরি ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে আধ কিলোমিটারের ওপর পথ পা টিপে টিপে লাইন করে পেরিয়ে এলাম।

পরের দিন আমাদের ফেরার পালা। অনেক ভোরে ঘুম ভাঙলো ঠকঠক আওয়াজে। দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। আবার ঠক ঠক…. ঠক ঠক ঠক..! এবার একটু ভয় পেলাম, সুন্দরবন তো শুধু দক্ষিণ রায় বনবিবির দেশ নয়, কত অশরীরী আত্মার গল্প একে নিয়ে। ওখানে লোকে রান্না করা খাবারে পোড়া দেশলাই কাঠি দিয়ে রাখে, যাতে কোনো অশুভ ছায়া না পড়ে। কিন্তু দেখি ভয়ের কোনো কারণ নেই, দুটি দোয়েল পাখি জানালার সার্সিতে ঠুকরে ঘুম ভাঙাচ্ছে। বাইরের মোরগের ডাক আমাদের কানে যায়নি বলে এই ব্যবস্থা নিয়েছে পাখিরালয়ের স্থানীয় পাখিরা। দেখাচ্ছে, "দেখো, আমাদের ভোর কত সুন্দর! আমাদের আকাশে কত পরিসর!" সেদিন সত্যিই কুয়াশাহীন স্বচ্ছ চারপাশ। কোথাও ধান কাটা শূন্য ক্ষেত, কোথাও ঘন সবুজ আলুর চাষ, জাল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট পুকুর, আটচালা খোড়ো বাড়িটি, গৃহস্থের ভরা গোলা, হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু, সব কিছু থেকে সুখ উঁকি মারছে। নিকোনো উঠোনের এক ধারে একটা মনসা গাছ, তলায় মাটির ভাঁড়ে দুধকলা ছিল, দুধটুকু কিছুতে খেয়ে গেছে, কলা পড়ে আছে তখনও।

ভুলে যেতে হয় বাঘ কুমীর ছাড়াও সাপ, বিছে, পোকামাকড়, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নোনা জল, কত প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে ওদের বাঁচতে হয়। আমরা আমাদের তল্পিতল্পা নিয়ে আগের রাতের সেই পথ পেরিয়ে চললাম বাঁধানো জেটির দিকে। দিনের আলোয় সেই পথ কী অপূর্ব! কোথাও পুকুর ভরে লাল শালুক ফুটে আছে, কোথাও জেলেডিঙি মেরামতের কাজ চলছে! নানা ব্যস্ততার মধ্যে নিযুক্ত জনজীবন।

এদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সজনেখালি ব্যাঘ্র প্রকল্প। কিন্তু সেখানেও বাঁদর ছাড়া আর কোনো প্রাণী দেখতে পাইনি। এখানে লেবেল লাগানো একটি সুন্দরী গাছ আছে। একটি সংগ্রহশালা রয়েছে, কিন্তু দারোয়ান বললো করোনার সময় থেকে সেটা বন্ধ।

এই খানে ওয়াচ টাওয়ারের গায়ে বিশাল এক মৌচাক। মৌচাক তো মৌচাক, তার সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য কী হুড়োহুড়ি! প্রমাদ গুণছিলাম অত্যুৎসাহী কেউ যদি চাকে খোঁচা দিয়ে উড়ন্ত মৌমাছির সঙ্গে ছবি তুলতে চান! ব্যাঘ্র প্রকল্পেও ব্যাঘ্র মহাশয় আত্মগোপন করেই রইলেন। ছোটবেলায় ভূগোলে পড়েছি সুন্দরবনের বাসিন্দারা গোলপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি দেয়। সেই গোলপাতার গাছ দেখলাম। তাল জাতীয় পাতার গঠন, কিন্তু দৈর্ঘ্যে না বেড়ে প্রস্থে এদের বৃদ্ধি। গোড়ায় গোড়ায় একেকটি কালো রঙের ডালিয়া ফুলের মতো কোন(cone).
সর্বত্র ক্ষুদ্র মাঝারি, নানা আকারের বাঁদর ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জন করছিল। ওদের কোন খাবার দেওয়া নিষেধ, কিন্তু অনেকেই তা অগ্রাহ্য করে ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ওদের বিপদ ডেকে আনছেন। বাইরে একটা বাজার, তাতে প্লাস্টিকের বোতলে মধু ইত্যাদি বিক্রি হতে দেখলাম।

 লঞ্চে গদখালি ফেরার পালা। ডাঙায় চোখে পড়ছে টুকরো টাকরা গ্রামীণ জনজীবনের ছবি। এদিন বাংলাদেশের পতাকা লাগানো দুটি ট্রলার চোখে পড়লো। জঙ্গলে দেখা গেল একটি বাঘরোল জল খেতে নেমেছে। সূর্য উঠছে মাথার ওপর, হীরে ঠিকরোচ্ছে নোনা জলে। হঠাৎ এক টুকরো মেঘের মতো রোদ আড়াল করে উড়ে গেল এক ঝাঁক মৌমাছি। গদখালির অনেকটা কাছে যখন এসেছি, দেখি বিশাল এক হাঁসের ঝাঁক উড়ছে, আবার বসছে জলে। ওরা পরিযায়ী, মধ্যাহ্নের স্নানাহার সারতে থেমেছে একটু। আমাদের দৃষ্টিনন্দন করার জন্যও। আমাদের 'অভিরাম' লঞ্চে এই সব আনন্দ দিয়েই যাত্রা শেষ হলো।

আমরা, সমতলের মানুষ ধারণা করতে পারিনা ওদের জীবন সংগ্রাম। কত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ওদের বাঁচতে হয়!আমরা বাড়তি লাভের আশায় নির্বিচারে গাছ কাটি, পাথর বালি তুলে নিঃস্ব করে তুলি পাহাড় প্রকৃতিকে। পাহাড়ের গায়ে বীভৎস ধসের চিহ্ন তার পরিচয় রেখে গেছে। আর মোহানায় ঝড়ের তাণ্ডবের চিহ্নও দেখেছি। পাহাড় দেখিয়েছে পাথর বিদীর্ণ করা সার্থকনাম্নী উদ্ভিদ পাষাণভেদকে, মোহানায় পায়ের তলার মাটিটুকু ধরে রাখতে গাছেদের প্রচেষ্টা। দেখেছি এত সংগ্রাম সত্ত্বেও ওদের ব্যবহার কী মধুর! যেমন কালিঝোরায় চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ফল পসারিণী কাঞ্ছিদের হাসিমুখ, তেমনি রিসর্টের দরজায় সুস্বাদু খেজুর রসের জোগান দেওয়া শিউলিদের ব্যবহার। ওদের কোথাও কোনো কুটিলতা নেই।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪