বড় গল্প
দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে...
নীলিমা চ্যাটার্জ্জী
পিএসসি বিল্ডিং-এর গেট দিয়ে আরও অনেকের সাথে মুখে একরাশ দুশ্চিন্তার ঘন মেঘ নিয়ে হনহনিয়ে ভিতরে ঢুকল শুদ্ধসত্ত্ব মুখার্জ্জী। দেওয়ালে টাঙ্গানো লিস্টের সামনে এত ভিড় যে সামনে এগোতেই পারছিল না। অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে এগিয়ে একটু কোনাকুনি দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করল শুদ্ধসত্ত্ব। আজ WBCS-এর “এ” গ্রুপের লিখিত পরীক্ষার ফল বার হয়েছে। 1,2,3,4....পরপর নামগুলো দেখে যাচ্ছে কম্পিত বক্ষে.... কোনওদিন সেভাবে ঈশ্বরকে ডাকেনি.... কিন্তু 20 নম্বরটাও যখন পার হয়ে গেল শুদ্ধসত্ত্ব তখন বাড়ির আরাধ্য দেবতাকে স্মরণ করতে বাধ্য হল। পরীক্ষা তো ও খুবই ভালো দিয়েছিল, তবে নিজের নামটা এখনও দেখতে পাচ্ছে না কেন? 23, 24, 25.... চোখদুটোয় যেন হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল শুদ্ধসত্ত্বর! এই তো লেখা শুদ্ধসত্ত্ব মুখার্জ্জী, নিজের রোল নম্বরটাও মিলিয়ে নিল চট করে।
আনন্দে উড়তে উড়তে দুই বড় হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরল শুদ্ধসত্ত্ব। ফোনে না জানিয়ে বাবা-মাকে দারুণ খবরটা নিজমুখেই দিল বাড়ি এসে। হৈ হৈ পড়ে গেল বাড়িতে। বাবা রিটায়ার্ড জয়েন্ট সেক্রেটারি। সবাই আনন্দে আত্মহারা। বিকালে ছোটকাকু এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, তাহলে প্রথম বিডিও পোস্টিং কোথায় হচ্ছে, শুদ্ধ?
—আরে কাকু দাঁড়াও তো, এখনও ইনটারভিউ হল না, তুমি এখনই পোস্টিং-এর কথা বলছ!
— শোন, তোর মতো স্মার্ট সুদর্শন ছেলে পশ্চিমবঙ্গে কটা আছে রে? তোকে কোনো শালার ইন্টারভিউতে আটকানোর ক্ষমতা নেই.... এই বলে ছোটকাকু প্লেট থেকে একটা বড় রসগোল্লা একবারে মুখে চালান করে দিয়ে চামচে আর একটা পান্তুয়া তুলে নিলেন।
শুদ্ধর ছোটকাকু সুধাংশুর দুই মেয়ে, তাই দাদার একমাত্র ছেলে শুদ্ধকে পুত্রস্নেহেই ভালোবাসেন তিনি। শুদ্ধর বাবা হিমাংশু মুখার্জ্জী বালিগঞ্জ প্লেসের মতো নিরিবিলি কিন্তু অভিজাত এলাকায় বেশ বড় একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন, চারিদিক গাছগাছালিতে ঘেরা, অনেকটা জমি আছে তিনদিকেই। শুদ্ধ তাঁর একটু বেশি বয়সের সন্তান। স্ত্রী অনিন্দিতার অনেকগুলি মিসক্যারেজ হওয়ার পর সন্তানের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন একপ্রকার ..... তখনই ঈশ্বরের পরম আশীর্বাদের মতন শুদ্ধর আবির্ভাব। তাই পরিবারের সকলেই শুদ্ধকে চোখে হারায়।
এর মধ্যে ইন্টারভিউ হয়ে গেল এবং শুদ্ধ সসম্মানে উত্তীর্ণ হল। দেখতে দেখতে শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা তুলো-মেঘ আর কমলা টিপ পরা সুন্দরী শিউলির সাথে পুজো এসে গেল। মোড় ঘুরলেই পাড়ার পুজো। সারা সন্ধ্যা আড্ডা, রাত অবধি ঠাকুর দেখা সবই চলছে। বাবা-মাকেও সঙ্গ দেয় শুদ্ধ তারই মধ্যে।
ষষ্ঠীর দিনই তাকে দেখল শুদ্ধ..... প্রথম দিন দেখেই ভাবল , এই মেয়েকে তো ঈশ্বর আমারই জন্য সৃষ্টি করেছেন! লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট কি একেই বলে? কী অপূর্ব আয়ত চোখদুটো, ঠিক যেন কালো জলে ভরা দিঘি.... বোঝাও যায় না, তলও পাওয়া যায় না, আবার তাকিয়ে থাকলে বড় আপন লাগে! কলাপাতায় ফলগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে সেই মেয়ে যখন চোখদুটো তুলে তার দিকে দেখল, সে চোখে যেন বনহরিণীর চঞ্চলতা! মুখে একটা মৃদু হাসি যেন লেগেই আছে। শুদ্ধ বাড়িতে গলা ছেড়ে গান ধরল, ও কেন এত সুন্দরী হল.....!
পুজোটা এবার খুব ভালই কাটতে লাগল। মেয়েটি এ পাড়ারই নিশ্চয়ই, মনে হয় সম্প্রতি এখানে এসেছে। কোন্ বাড়ি জানে না, আলাপও হয়নি। শুধু চোখে চোখ পড়লেই মেয়েটির আঁখিপল্লব বন্ধ হয়ে যায়, মাথাটা নিচু হয়ে আসে। রোজ সন্ধ্যাতেই প্যাণ্ডেলে আসে সেই মেয়ে অন্য বন্ধুদের সাথে। নবমীর দিন ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। শুদ্ধ খুব সুন্দর একটা নীল রং-এর পাঞ্জাবি পরে এসেছে। একটু পরেই মেয়েটি বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে ঢুকল..... তার পরণের শাড়ির রংও নীল! শুদ্ধর মনে হল যেন স্বপ্নের দেশের কোনো পরী এল!
নাচ শুরু হল। শুদ্ধ তার বন্ধুদের সাথে নাচ শুরু করল। ডাড্ডা নাকুড়ের তালে তালে পা ফেলতে ফেলতে শুদ্ধ হঠাৎ দেখল, তার ছোটকাকুর বড় মেয়ে তিতলি সেই মেয়েটার পাশে বসে খুব হেসে হেসে গল্প করছে। তার মানে কাকুরা বাড়িতে এসেছে। তিতলিকে মেয়েটির সাথে গল্প করতে দেখে শুদ্ধর কি আর নাচে মন থাকে? পায়ে টান ধরেছে, একটু রেস্ট নিয়ে নিই.... এই বলে ধুনুচি রেখে সোজা বোনের কাছে।
— এই তিতলি কখন এলি? বাকিরা কি বাড়িতে?
— এই তো একটু আগেই এলাম, সবাই তোমাদের বাড়িতে আছে, এখুনি আসবে। দাদা, দ্যাখো এখানে আমার কলেজের এক বন্ধুকে পেয়ে গেলাম, আমার সাথেই কেমিস্ট্রি অনার্স পড়ে। ওর নাম ইলোরা খাতুন!
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না শুদ্ধসত্ত্ব! ঢাক বাজছে প্রবল জোরে, নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে। আবারও জিজ্ঞেস করল , কী নাম বললি, শুনতে পেলাম না....
— ইলোরা খাতুন। এবার খুব চেঁচিয়েই জবাব দিল তিতলি। দাদা জান, ও পড়াশুনায় খুউব ভাল....
আরও কী যেন বলছিল তিতলি , কিন্তু শুদ্ধর মাথাটা যেন ঠিক কাজ করছিল না তখন, শুধু গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাবার মুখটা ভেসে উঠল মানসপটে!
যে কোনও ধাক্কা খাওয়ার পর মনকে স্থির হওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হয়। শুদ্ধ এই কথাটায় খুব বিশ্বাস করে। দুর্গাপুজোটা কোনরকমে কেটে গেল। কালীপুজো এল। আবারও ইলোরা ফিরে এল, এবার যেন লক্ষ প্রদীপ জ্বেলে! প্যাণ্ডেলে তিতলি বসল তিনটে চেয়ারের মাঝখানে, দুই পাশে দুই জন…. একপাশে তিতলি, অন্যদিকে শুদ্ধ। সরাসরি না হলেও পরোক্ষে কিছু কথা হল। মনের ভিতরে সন্তর্পণে ভিতের গাঁথনি চলেছে.....
তিতলিকে এক শীতের দুপুরে কফি হাউসে আসতে অনুরোধ করে শুদ্ধ, সাথে ইলোরা যেন “ফাউ”! আর একদিন সিনেমার নিমন্ত্রণ। এই রকম আর দু একবার হওয়ার পর তিতলি বুঝল এটা সঠিক কাজ হচ্ছে না, রাশভারি জ্যেঠু জানতে পারলে আস্ত রাখবেন না। দাদাকে বলল নিজের আশঙ্কার কথা। শুদ্ধ দুহাত দিয়ে নিজের চুলগুলো মুঠি করতে করতে বলল, কী করি বল তো তিতুল! আমি যে জেনেশুনে বিষ করেছি পান। জানি, জানলে বাবা এই বয়সেও আমার পিঠের ছাল উঠিয়ে দেবে, কিন্তু আমি যে ওকে ভুলতেই পারছি না রে!
— দাদা, তুই না হয় জ্যেঠিমণিকে আগে বল...
—দাঁড়া আগে চাকরিটা জয়েন করি, জানুয়ারীতে জয়েনিং ডেট, প্রথমে এক বছরের উপর ট্রেনিং আছে। পোস্টিং পেয়ে তারপর মাকে বলব রে, এখন নয়। আচ্ছা তিতলি, ইলোরার মনের খবরটা কি রকম আমায় একটু বলতে পারিস? আমি ভুল করছি নাতো? আমার জন্য ওর ফিলিংস্ কিছু আছে তো?
— দাদা, ও খুবই চাপা, কিছুই বলে না, জিজ্ঞেস করলে মুচকি হাসে শুধু। তবে একদিন ওর একটা খাতা নিয়েছিলাম নোট লিখতে, দেখি একটা পাতা ভর্তি করে তোর নাম লিখে রেখেছে! তিতলির বলার ধরণে শুদ্ধ হেসে ফেলে, সেই সাথে স্বস্তিও পায় মনে মনে।
জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ থেকে শুদ্ধর ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। ইলোরাকে মনের মধ্যে প্রস্তরমূর্তির মতো রেখে নিজের কাজ করে যায়। আবারও পুজো ফিরে এল, আবারও দেখা হল, কথা হল, চোখের দৃষ্টিতে কিছু দেয়ানেয়া হল।পরের বছর বিডিও হিসাবে শুদ্ধর প্রথম পোস্টিং হল দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জে।
শুদ্ধ মন দিয়ে কাজ করে আর ভেবে চলে কেমন করে বাড়িতে ইলোরার কথাটা বলবে..... হে ভগবান, এইসব ধর্ম, জাত এগুলো কেন এল তোমার পৃথিবীতে? দোলাচলে দুলতে দুলতে আবারও একটা পুজো চলে এল। আবারও দুজনে দুজনার মনের নদীতে নৌকা ভাসাল!
শীতে তিন চারদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এল শুদ্ধ। মনে প্রবল জোর নিয়ে, সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব সব দূর করে এক দুপুরে ছাদে রোদে বসে মাথা নিচু করে মাকে বলল ইলোরার কথা। মা স্তম্ভিত! মাথায় বাজ পড়লেও বোধ করি এর থেকে ভালো ছিল! সুপারি কাটছিলেন, জাঁতিতে হাতটাই কেটে ফেললেন অনিন্দিতা। মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে উঠে গেলেন, শুদ্ধ স্থাণুবৎ ছাদেই বসে থাকল।
রাত নটা নাগাদ মায়ের চিৎকারে শুদ্ধ ছুটে বাবার ঘরে গেল। বাবার মুখ লালচে, থমথম করছে, চোখের কোণে কি জল? বিছানায় শুয়ে হাঁসফাঁস করছেন। “শুদ্ধ একবার ডাক্তারকাকুকে শিগগিরি ফোন কর, তোর বাবার খুব অস্থির লাগছে”...... এই বলে তিনি ইশারায় বললেন যে তিনি ইতিমধ্যে ইলোরার কথা বাবাকে বলেছেন।
ডাক্তারবাবু এসে দেখলেন, বললেন, কী হল, দুদিন আগে পর্যন্ত তো একদম ঠিক ছিল সব, আজ প্রেসার এ রকম হাই করে ফেললেন কী করে? প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে যাবার সময় শুধু বাড়ির লোককে বললেন, উত্তেজনার মতন কিছু হয়েছিল নাকি? দেখবেন রাতে যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারেন, ঘুমের ওষুধটা দিতে ভুলবেন না আর ডিনারে হাল্কা খাবার দেবেন। দরকার হলে আমায় ফোন করবেন।
রাত দশটা বাজে। শুদ্ধ পায়ের কাছে বসে। অনিন্দিতা স্যুপ আর টোস্ট নিয়ে এসেছেন খাওয়াবেন বলে।
— ছেলে কই? তাকে ডাক....
— এই যে বাবা, বল কী বলবে। শুদ্ধ এসে বাবার কাঁপা হাতটা ধরল।
— শুদ্ধ, শেষে তুই মুসলমানের মেয়েকে ঘরে আনবি, বাবা? বুড়ো বয়সে তুই আমায় এই দুঃখটা দিবি? আমি যে কিছুতেই মানতে পারছি না রে.... শেষের কথাগুলো যেন গলায় আটকে গেল, হিমাংশুবাবু জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন।
— বাবা, আমি এমন কিছু করব না যাতে তুমি কষ্ট পাও, তুমি প্লিজ একটু শান্ত হও, আমি তোমায় কথা দিচ্ছি বাবা.....
— তুই আমায় তা’লে কথা দিলি তো?
—হ্যাঁ বাবা, আমি কথা দিলাম!
কোথায় একটা ইমারত গড়ার কাজ চলছিল হৃদয়ে, নিভৃতে, শুধু ভিতটুকুই গড়া হল, প্রাসাদ আর উঠল না! ফুল ফোটার আগেই শুকিয়ে গেল। তিতলি মারফত ইলোরা খবর পেল শুদ্ধসত্ত্ব তার অসুস্থ বাবাকে কী কথা দিয়েছে! আবারও পুজো এল, কিন্তু ইলোরা আর শুদ্ধর আর দেখা হল না, কারণ প্রতি পুজোয় শুদ্ধ তার মা-বাবাকে নিয়ে কলকাতার বাইরে এখানে ওখানে বেড়াতে যায়।
ছয় বছর কেটে গেছে । অনেক পরিবর্তন হয়েছে সংসারের। শুদ্ধর বাবা এক বছর হল দেহ রেখেছেন। শুদ্ধ এখন অণ্ডালে পোস্টেড, এখনও বিয়ে করেনি। মা অনিন্দিতা বেশিরভাগ সময় ছেলের সাথেই থাকেন, মাঝেমাঝে কলকাতার বাড়িটায় আসেন ধুলো ঝেড়ে স্মৃতির বাতি উজ্জ্বল করতে।
দুমাস হল ছেলের কাছেই আছেন। সেদিন শনিবার। বেলা দশটা তখন। অফিস ছুটি। সব সময়ের লোক দশরথ এসে খবর দিল , মেয়েস্কুলের দুজন দিদিমণি এসেছে, জরুরি দরকার, একটু কথা বলেই চলে যাবে।
—ওনাদের বসতে বল, আমি আসছি। কাপের চা-টুকু শেষ করে পাঞ্জাবিটা গায়ে গলিয়ে ঘরে ঢুকে শুদ্ধসত্ত্ব বলল, নমস্কার ! ওঁরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিনমস্কার জানালেন। দুজন মহিলা, একজন বয়স্কা, একজন অল্পবয়সী। বয়স্কার মুখের থেকে চোখ ঘুরিয়ে অল্পবয়সীর মুখে চোখ পড়তেই, কেঁপে উঠল শুদ্ধসত্ত্ব.... তার সামনে দাঁড়িয়ে ইলোরা! হরিণীর মতো সেই টানা টানা দুটো কালো চোখ..... না আজ সেখানে কোনও চঞ্চলতা নেই, প্রবল ঝড়ের পর যেমন নৈঃশব্দ্য, আপাত শান্তি থমকে দাঁড়ায় , দুচোখে সেই স্থিরতা..... অতল গভীরে ভাবনার ঢেউ আছে কি না বোঝাও যাচ্ছে না!
—আমি সরোজিনী হাইস্কুলের হেডমিস্ট্রেস, সঞ্চিতা সান্যাল , আর উনি আমাদের কেমিস্ট্রির টিচার ইলোরা খাতুন। একটা ব্যাপারে আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এসেছি.......
স্কুলের জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু বলার ছিল সেসব কথা বলা হল, শোনা হল, শুদ্ধ বলেও দিল কী করতে হবে, কিন্তু তার মনটা পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল শুধু একটিবার ইলোরার সঙ্গে কথা বলার জন্য । কিন্তু সে অসম্ভব সম্ভব হল না। ওঁরা কাজ শেষে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে চলে গেলেন..... শুদ্ধ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখল ইলোরার চলে যাওয়া!
দুপুরে ভাত খেতেই পারছে না শুদ্ধ, শুধুই মনে হচ্ছে একটা কথাও বলা হল না তার ইলোরার সাথে। পরশপাথর আবারও হেলায় হারিয়ে গেল! ছেলের রকম সকম দেখে মা এসে তাড়তাড়ি কপালে, গলায় হাত দিয়ে দেখে বললেন, না তো গায়ে তো জ্বর নেই! তবে খাচ্ছিস না কেন? পেট ভার করে আছে?
শুদ্ধ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। মাকে বাঁ-হাতে জড়িয়ে ধরে ভাঙ্গা গলায় বলল, মা গো আজ ইলোরা এসেছিল!
মা সব শুনে ছেলের মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন, ওরে মন খারাপ করিস না। আমাকে একটু ভাবতে দে........
সোমবার। ছেলে অফিসে বেরিয়ে গেলে, মাও সরোজিনী হাইস্কুলের উদ্দেশে রওনা হলেন। প্রধান শিক্ষিকার সাথে দেখা করলেন..... অতীতের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটা একটা করে মুক্তো তুলে এনে দুই প্রৌঢ়া তা দিয়ে মালা গাঁথতে বসলেন। ইলোরাকে ডেকে পাঠালেন বড়দিমণি। শুদ্ধর মায়ের পরিচয় পেয়েই ইলোরা নত মস্তকে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। ইতিমধ্যে অনিন্দিতা জেনেছেন, ইলোরার বাবা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী, ভাই সম্প্রতি একটা চাকরি পেয়েছে, ওরা বালিগঞ্জ প্লেসের সেই বাড়িতেই এখনও ভাড়া আছে এবং ইলোরা এখনও অবিবাহিতা। ইলোরার কমনীয় মুখখানার দিকে তাকিয়ে, অনিন্দিতা বললেন, হ্যাঁ মা তুমি কি এখনও শুদ্ধকে ভালোবাস? তুমি যাবে আমার বাড়িতে? তোমার মা-বাবার সাথে কথা বলি?
ইলোরার দু চোখ তখন বর্ষায় কূলছাপানো নদী! অনিন্দিতা কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রাখেন না। ওখানে বসেই ইলোরার মায়ের সাথে কথা বলে পরের রবিবার দুজনের রেজিস্ট্রি হবে সেটা নিশ্চিত করে তবে উঠলেন।
সন্ধ্যার পর ছেলেকে সব বললেন তাঁর আজকের অভিযানের কথা! সব শুনে শুদ্ধ চেঁচিয়ে উঠল, মা তুমি কি পাগল হলে? আমি যে বাবাকে কথা দিয়েছিলাম....
— জানি তো! তুই বাবাকে কথা দিয়েছিলি যাতে বাবা কষ্ট না পান, যাতে তাঁর শারীরিক কোনও ক্ষতি না হয়! এখন তিনি নেই, তাই তাঁর কষ্ট পাবার প্রশ্নই নেই, তাঁর প্রেসার বেড়ে যাবার ভয়ও নেই। আর রইল ইমোশনাল ব্যাপারটা, সে....রাতে আমি মনে মনে তোর বাবার সাথে কথা বলে নেব'খন। আরে মেয়েটাও তো তোর জন্য এখনও বিয়ে না করে বসে আছে, অবশ্য ওর মাথায় অনেক দায় দায়িত্বও আছে.....। আর কথা নয়, আমি একটু ঠাকুরঘরে যাই, তোর বাবাকেও বুঝিয়ে আসি!
রবিবার এল। মা অনিন্দিতা একটা খুব সুন্দর ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে এসেছেন। ছেলেকে বললেন, নে এটা পরে নে দেখি। ইলোরার জন্যও একটা লাল স্বর্ণকাতান কিনে দিয়ে এসেছেন।
রেজিস্ট্রি অফিসে প্রবল আনন্দ, হাসি, উচ্ছ্বাসের মধ্যে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে সই সাবুদ হল। ইলোরার ভাইও এসেছিল। স্কুলের শিক্ষিকার দল হাসতে হাসতে মালা বদলও করিয়ে দিল। ইলোরার ভাই একটা সিঁদুর কৌটো বার করে শুদ্ধসত্ত্বের হাতে দিয়ে বলল, শুদ্ধদা, আম্মু পাঠিয়েছে, এই সিঁদুরটা তুমি আপাকে পরিয়ে দাও!
সবাই চমৎকৃত! শুদ্ধ কৌটো খুলে এক চিমটি সিঁদুর নিয়ে বাঁ হাতে ইলোরার চিবুক ধরে মুখটা উঠিয়ে সিঁথিটা রাঙিয়ে দিল.... অনেক দিন পর শুদ্ধ আবার সেই দুটো কাজল কালো দিঘির মতো চোখ দেখতে পেল, দেখতে পেল হরিণীর চঞ্চলতা.... মনে হল “ সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে!”
রায় বাড়ির রহস্য
পাভেল ঘোষ
হঠাৎ স্কুলবেলার বন্ধু মিহিরের ফোনে ঘুমটা গেল। ফোন তুলতেই কানে এল,"অনিরুদ্ধ, আগামীকাল মানে রবিবার আমার বাড়ি একটু আয় ভাই। আমাদের ব্যাচের অনেকেই আসছে, দারুন মজা হবে।গল্প,আড্ডা,সঙ্গে খাসির মাংস...."
মিহিরের এই তুমুল আহ্বানকে পরিহার করার মত দুঃসাহস দেখাবো, এমন অমানুষ আমি নই। সঙ্গে খাসি,পুরোনো বন্ধু। ব্যাপারটা যে জমে একদম ক্ষীর হবে, সেটা বুঝলাম।আহ্লাদে আটখানা হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কে কে আসছে রে..?"
"পল্টু, দেবু, অতনু, সুবু, ভানু, সামাদ, বাপ্পা এবং .." বলেই থেমে গেলো মিহির।
"এবং কে রে ভাই...?"
"নামটা শুনলে চমকে যাবি..!"
"ধানাই পানাই করিস না। বল না.…!"
"এবং..... সন্তোষ..।"
"কি বলছিস..? ও'তো দশম শ্রেনীকালে ওই বিখ্যাত শুক্রবারের পর সেই যে স্কুল ছাড়া হলো...! তারপর থেকেই তো নিরুদ্দেশ।"
"মনে আছে তোর..? সেই ভয়ংকর শুক্রবারের রাত..!"
"মনে থাকবে না..!"
আরো অনেক কিছু মনে পড়বে বন্ধু, রবিবার আয় তো তুই..." বলেই ফোনটা কেটে দিল মিহির।
মিহিরের কাছে সন্তোষের নামটা শুনে স্মৃতির ডানায় ভর করে পৌঁছে গেলুম গত শতকের আশির দশকের শেষে...!
আমি তখন দশম শ্রেণী। গোঁফের রেখা স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশঃ। দুই গালে ব্রণ হানা দিয়ে মৌমাছির চাকের মত গর্ত করে দিয়েছে। বেশ মনে আছে, স্নান করার সময় গা থেকে গেঞ্জি খুললেই মা বলতো, "ঘুরে ঘুরে চেহারাটা কি করেছিস..! পাঁজর তো নয়, যেন হারমনিয়ামের রিড।" আমি কোনো ভ্রূক্ষেপই করতাম না। ঘুড়ি উড়িয়ে, ক্যারাম পিটিয়ে, ফুটবল খেলে কৈশোরকালটা একদম চুটিয়ে উপভোগ করছি তখন। বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত স্কুল রসুলপুর ভুবনমোহন উচ্চ বিদ্যালয় ছিল আমার পাঠভবন দোর্দন্ডপ্রতাপ সুময়বাবু তখন প্রধান শিক্ষক। ওনার জুতোর আওয়াজ পেলে মুখে কোনো শক্ত খাবার থাকলেও গিলে নিতাম সবাই। নড়াচড়া সেতো অনেক দূরের ব্যাপার। কি ভয় খেতাম..! বাপরে...! সে একদিন গেছে...! যেন প্রত্যেকটা দিন এক একটা উপন্যাসের পৃষ্ঠা। পরতে পরতে উত্তেজনা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ক্লাসে গোলমাল লেগেই থাকতো, আর সেই উত্তেজনা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় দক্ষতার সঙ্গে সামলাতেন হেডস্যার।
সেই সময়েরই বিস্ময়াতীত এক ঘটনা মনে পড়লে এখনো আমার গায়ে কাঁটা দেয়। এই বয়সে এসে আমি এখনো এর বিন্দুবিসর্গ ব্যাখ্যা খুঁজে পাই নি। তারিখটা মনে না পড়লেও বারটা মনে আছে। শুক্রবার ছিল সেদিন। রসুলপুর স্কুলে বেশ কিছু শিক্ষক ও ছাত্রদের নামাজ পাঠের কারণে দ্বিতীয় পর্বের পর এক ঘন্টা টিফিন আওয়ার নির্ধারিত থাকতো। আমরা এই দিনটার অপেক্ষায় থাকতাম। এই ষাট মিনিট সময়টার প্রতিটা মুহুর্ত আমাদের কাছে ছিল সোনার চেয়েও দামী। উজ্জ্বল গান ধরতো,পল্টু জাকির হোসেনের ভূমিকায়। তখন তো কিশোর কুমারের বাংলা ও হিন্দী গানগুলো প্রত্যেকের ঠোঁটে লেগে থাকতো। সেদিন কিন্তু ওসব বন্ধই ছিল। আমাদের অত্যন্ত প্রিয় স্যার ভবানীবাবুর মৃত্যুর খবর আমাদের বিমর্ষ করে তুলেছিল সেই সপ্তাহ জুড়ে। দিন তিনেক আগে উনি চলে গেলেও সেই শুক্রবারে আমরা ওনার স্মৃতিচারণে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ওনার কথা বলার ধরণ আমাদের খুব আকৃষ্ট করতো। দেবু ওনার ক্লাসের মুহূর্তকথা মন দিয়ে বলে যাচ্ছিল। আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছিলাম।
এই ভাবগম্ভীর পরিবেশে ব্যাঘাত ঘটালো সুব্রত। ও হঠাৎ বলে উঠলো, "জানিস দেবু, ভবানীবাবু প্রায়ই বলতেন, পড়া না পারলে রায় বাড়িতে রেখে আসবো, বুঝবি। ভূতে ঘাড় মটকাবে..! মনে আছে?" "ক্লাস সেভেনে প্রায়ই বলতেন...। মনে পড়েছে। ঠিক বলেছিস সুবু..!" দেবু ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বললো।
সন্তোষ হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করলো। ও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ। "ওটা মানিক রায়ের বাড়ি। উনি করন্দা গ্রামের জমিদার ছিলেন।আমার মা'ও ছোট থেকেই বাড়িটা ফাঁকাই দেখে আসছে..! মায়ের কাছেই শুনেছি, উপরের একটা ঘরে ওই বাড়ির কাজের মাসিটা আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকে ফাঁকাই পড়ে থাকে বাড়িটা.!" সন্তোষ বড় বড় চোখ করে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল। "আমাদের বাড়ির দোতলা থেকে দেখা যায় বাড়িটা। সারাদিন নিঃঝুম। রাত্রে তো আরো শুনশান। দেখলেই ভয় লাগে…"
সুব্রতর চোখে মুখেও ভয়ের ছাপ।
পরিবেশটা একদম ভৌতিক হয়ে উঠলো। আমরা আট দশজন বুঁদ হয়ে শুনছি রায় বাড়ির কথা। হঠাৎ পল্টু আইসক্রিম মুখে নিয়ে যোগ দিল আড্ডায়। পল্টু আমাদের ক্লাসের ক্যাপ্টেন। স্লিম ফিগার। সাংঘাতিক ফিট বডি। স্কুলের গোলকিপার হিসেবে কত ম্যাচ জিতিয়েছে পেনাল্টি বাঁচিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। বকুলগাছের বেদীতে যখন ও হাতের উপর গোটা শরীরটা রেখে ঘুরপাক খেতো, গোটা স্কুলের ছাত্ররা সার্কাস দেখার মত ভিড় করে দাঁড়িয়ে যেত।
কানে রায় বাড়ির কথা আসতেই ও বলে উঠলো, "ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি..! পরের লাইনটা কি রে দেবু..?"
দেবু ওর কান্ড দেখে হেসে বললো, "রাম লক্ষণ সাথে আছে,ভাবনা আমার কি?"
মিহির এতক্ষন হাঁ করে শুনছিলো। ও হঠাৎ প্যান্টের পিছনের ধুলোকে দুহাতে ঝেড়ে অতি উৎসাহের সঙ্গে আমার মত ভীতুকে বলে বসলো, "যাবি নাকি অনিরুদ্ধ, রায় বাড়িতে..?"
"আজ রাতেই প্রোগ্রাম কর, বাবলুর হোটেল থেকে রুটি তড়কা নিয়ে নেব। ওখানেই জমিয়ে খাওয়া দাওয়া ভূতের সঙ্গে, কি বল..?" পল্টু দেবুর ঘাড়ে মাথাটা রেখে বলতেই ঘন্টা পড়ে গেল টিফিন শেষের।
গুরুগম্ভীর আড্ডা শেষ হলো বটে, কিন্তু পল্টুকে নেতা করে আমরা ক'জন 'সাহসী কিশোর' রায় বাড়িতে সেদিন রাত্রিবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম।
সুব্রত, দেবা, মিহির, সামাদ, অতনু এবং আমি প্রত্যেকেই বাড়িতে একপ্রকার জোর করেই রাজি করিয়ে রাত ন'টার মধ্যে হাজির হয়ে গেলাম রায় বাড়ির সামনে।
পল্টু সবার শেষে এল। আমরা একটু উষ্মা প্রকাশ করতেই পল্টু পাত্তা না দিয়ে বললো, "বাবলুর দোকান থেকে গরম গরম তড়কা রুটি নিয়ে আসতে দেরী হলো!"
"কিন্তু উপরের ঘরে যাবি কি করে পল্টু..? নীচে তো দেখছি, সব দরজায় তালা!"
দেবু বলতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো পল্টু। ডান হাতে তুড়ি বাজিয়ে ও বললো, "ছাড় তো..! আমার যা দেখার দেখা হয়ে গেছে..। তোরা গাছে চড়তে পারিস তো..?" সবাই ঘাড় নাড়তেই পল্টু হাসিমুখে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, "বাড়ির পিছনদিকে আমগাছ বেয়ে উঠলেই সামনে ব্যালকনি পাবি। ব্যালকনি থেকে একটা ঝাঁপ দিবি। দেখবি দরজাটা খোলা। বাড়ির মালিক লাগাতে ভুলে গেছে মনে হয়। প্রথমে মিহির, তারপর তোরা, সবশেষে আমি..! ব্যাস..!"
"কিন্তু একটু শব্দ হলেই তো নাইট গার্ড.…" আমি আমতা আমতা করে বলতেই পল্টু ধমকের সুরে আমাকে বললো, "তোর দ্বারা কিস্যু হবে না। ভয় পেলে বাড়ি পালা..! যাঃ...!" আমি ওর কথা শুনে চোখ পিট পিট করে ওর দিকে তাকাতেই পল্টু আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, "বাহাদুরদাকে বলেছি, আমরা বাগানে যাবো.….! বাড়িতে ঢুকবো বলিনি.…" "তাহলে বাড়িতে কি করে..." সুব্রত পল্টুর মেজাজ দেখে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো। পল্টু সেটা বুঝতে পেরে বললো, "আরে..শোন না... বাহাদুরদাকে রুটি তড়কা খাওয়ালেই কেল্লা ফতে..!"
"মানে..?" দেবু অবাক হতেই মিহির বললো, "আমি মায়ের ঘুমের বড়ি তড়কায় মিশিয়ে দিয়েছি। বাহাদুরদা খেলেই সারা রাতের নিশ্চিন্তি..! এতক্ষন মনে হয় ওঁর পেটে চলেও গেছে..! কি পল্টু..?"
পল্টু নিঃশব্দে হাসতেই আমরা বাকীরা বুঝলাম,পল্টু আর মিহির ভালোই হোমওয়ার্ক করে এসেছে। আজকে ভূতের দেখা যে পাবোই একদম নিশ্চিত।
হঠাৎ একটা পেঁচার কর্কশ আওয়াজ শুনতে পেলাম, ভাবগম্ভীর আঁধার পরিবেশে যা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। "খাবি না..?" সামাদ এতক্ষন চুপ ছিল। তড়কার সুবাস নাকে আসতেই ওর যেন আর তর সইলো না। "খালি খাওয়ার চিন্তা..! চল,উপরের ঘরে গিয়ে জমিয়ে খাবো। মিহির.... গাছে ওঠ...!"
পল্টু নির্দেশ দিতেই মিহির গাছে ওঠা শুরু করলো।
আমরা সবাই যখন রায় বাড়ির দোতলার শয়ন কক্ষে উপস্থিত হলাম, রাত তখন সাড়ে এগারোটা। পল্টু আর মিহির তড়কা রুটি প্লেটে সাজিয়ে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিল। একেই ঘন্টা দুয়েক লেটে খাচ্ছি, তার উপর বাবলুর বিখ্যাত তড়কা। সবাই হামলে পড়লাম প্লেটের উপর। এবার মনে হচ্ছে, পেটে ছুঁচোর ডন টানাটা বন্ধ হবে। "বুঝলি অনি, শুনেছি যে কাজের মাসিটা এই ঘরে সুইসাইড করেছিল, বিহারী ছিল...!সবসময় এক হাত ঘোমটা টেনে কাজ করতো...।"
"কোথা থেকে শুনলি তুই..? ঢপ মারার আর জায়গা পাস নি..!" পল্টুর কথায় প্রতিবাদ করলাম আমি। আসলে ভয়টা একটু একটু করে চেপে বসছে ঘাড়ে বুঝতে পারছি। শুকতারার ভূতের গল্পের গা ছমছমে পরিবেশ যেন চোখের সামনে। একটা বড় মোমবাতি জ্বেলেছে অতনু। আমরা সাত কিশোর বৃত্তের মত গোল হয়ে বসে আছি ওই লেলিহান শিখার সামনে। প্রত্যেকের মুখ ওই মোমবাতির হলুদ আলোয় স্পষ্ট হয়ে যেন ভূতাকৃতি ধারণ করেছে। "দেখ অনি, পল্টু ফালতু বকে না। জেনুইন খবর..! আজ সকালেই পেয়েছি অজিত স্যারের মুখ থেকে। একসময়ে উনি এই বাড়িতে পড়াতে আসতেন। বুঝলি.?"
পল্টু গম্ভীর মুখে প্লেটে তড়কা পরিবেশন করতে করতে বললো। একটা রুটির টুকরো তড়কা দিয়ে মুখে তুলেছি, হঠাৎ ব্যালকনিতে চোখ চলে গেল আমার। কেউ একজন আমগাছ থেকে লাফ দিয়ে পড়লো ব্যালকনির উপর। শব্দটা কানে যেতেই চমকে উঠলাম আমি।
"ক..ক..কে.... ওখানে..?" মুহূর্তের মধ্যে স্তম্ভিত হয়ে অপলক দৃষ্টিতে ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে তোতলাতে থাকলাম আমি। আমার দম বন্ধ হওয়া গলার আওয়াজে সবার খাওয়া তখন মাথায় উঠে গেছে। "ও কিছু না..! খেয়ে নে অনি..!" আমার পিঠ চাপড়ে নির্বিকার চিত্তে বললো পল্টু। "কিন্তু আমি তো ভুল কিছু দেখিনি। মানুষের মতো কেউ ঝাঁপ দিয়েছে ব্যালকনিতে, এটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট আমার কাছে পল্টু...!" "বলছি.…কিছু না...! সেই থেকে বাওয়াল করে যাচ্ছে..!" এবার পল্টু বিরক্ত হলো আমার উপর। ইত্যবসরে আমার চোখ চলে গেল দেবুর দিকে। দেখি, ও হাঁ করে চেয়ে আছে আমার ঠিক পিছনদিকে। চোখের পাতা স্থির। বুঝতে পারলাম, ও কিছু একটা দেখেছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই কেঁপে উঠলাম।
একি দেখছি আমি...! একটা ছিপছিপে,অস্বাভাবিক রোগা বউ আমার ঠিক পিছনে দরজার সামনে ঘোমটা পরে দাঁড়িয়ে...! দরজার শিকলে রাখা ওর মিশমিশে কালো ডান হাতটা দেখেই ভয়ে আমার বুকের ভিতর দিয়ে চোরা হিমেল স্রোত বয়ে গেল । শাড়িটা মনে হচ্ছে কোনো কঙ্কালের উপর জড়ানো। ওর স্থির শরীরে যেটা কাঁপছে হাওয়ায়।
এসব দেখেও পল্টু কিন্তু নির্বিকার। ও হঠাৎ একটা রুটির টুকরো অশরীরীটার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, "যাঃ....! বাবলুর তড়কা খেয়ে বাড়ি যা..!"
এরপরেই ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনাটা...! পল্টু রুটিটা ছুঁড়তেই একটা অট্টহাসি কানে এল সবার..। গোটা রায়বাড়ি সেই হাসিতে গমগম করে উঠলো।
" বা....বু...!" তীক্ষ্ণ আওয়াজে শব্দটা ভয়াল মূর্তিটার কাছ থেকে কানে আসতেই জ্ঞান হারালাম আমি।
কৈশোরকালের সেই রাতের কথা ভাবলে এখনো মনে হয়, একটা অন্য জগৎ নিশ্চিত আছে যেখানে জীবিত মানুষের প্রবেশাধিকার নেই।
হঠাৎ মুঠোফোনের শব্দে নিজের জগতে ফিরলাম। হাতে ফোনটা নিয়ে দেখি,স্ক্রিনে লেখা "পল্টু কলিং..."
ফোনটা ধরতেই সেই পরিচিত ভঙ্গিতে পল্টু বলে উঠলো," কিরে..! রোববার আসছিস তো..?"
আমি সম্মতি জানাতেই ও বলে উঠলো, "অবশ্যই আসিস..! তোর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আছে। অনেকদিন আগের এক রহস্য....!"
"রহস্য..?" আমি প্রশ্ন করতেই পল্টু বলে উঠলো, "আয় না..! আসলেই জানতে পারবি।"
ফোনটা কেটে দিল পল্টু।
রবিবার আসতেই সকাল সকাল স্নান করে শুধু চা আর বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মিহিরের বাড়ি গিয়ে দেখি পুরোনো বন্ধুরা ফিনিক্স পাখির মতো হাজির হয়েছে। বয়সের ছাপ পড়লেও কৈশোরের হাসি আর কণ্ঠগুলো সব অমলিনই আছে। মিহির আমাকে দেখেই বলে উঠলো, "উপরের ঘরে আসর বসেছে। তুই যা..! আমি মাছ ভাজা নিয়ে হাজির হচ্ছি।"
"সন্তোষ এসেছে....?" "আসছে..! ও ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ঢুকবে।" মিহিরের কথা শুনে উপরের ঘরে যেতেই দেখি, রায় বাড়িতে রাত কাটানো সব ডানপিটে কিশোরগুলোই হাজির। সময়ের দহনে পুড়ে যাওয়া আন্তরিক মুখগুলোকে দেখেই মনে হলো, সময় কেড়েছে অনেককিছু, কিন্তু সেই মুহূর্তকথাগুলো আজও অমর হয়ে আছে।
ঘরে ঢুকতেই 'হই হই' করে উঠলো সবাই। পল্টু তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলে উঠলো, "খবর কি বল অনিরুদ্ধ..? বছর পঁচিশেক হল দেখা হয় নি। অনেক কথা জমে আছে গুরু...."
"আছি ভালোই..! ক্লাস টেনের পর সবাই তো আলাদা হয়ে গেলাম পল্টু...!" "তাতে কি হয়েছে,আজকে আমরা আবার ক্লাস টেন...!"
"দারুন বললি তো..! তাহলে তো রায় বাড়ি থেকেই আবার শুরু করতে হয়। ওই ঘটনার পর আমরা সবাই কেমন নির্লিপ্ত হয়ে গেলাম। সেই বন্ডিংটা হঠাৎ ঝুপ করে ডুব দিল.." আমার কথা শেষ হতেই মিহির হাজির হলো মাছ ভাজা নিয়ে। মিহিরকে দেখে অবাকই হলাম। সেই ঝাঁকড়া চুলের মিহির এখন শুধুই স্মৃতি। মাথা জুড়ে টাক। দু একটা চুল উঁকি দিয়ে জানান দিচ্ছে আমরা এখনো আছি।
অতনুরও তথৈবচ অবস্থা। সুব্রতর কচি মুখটাই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। সামাদ এখন বড় চাষী। চেহারার সেই গরিমা রোদে পুড়ে উধাও। পল্টুর সেই চাবুক চেহারা আর নেই। গণেশের মতো ভুঁড়ি হয়েছে 'ইয়া বড়'। দেবু যে বড় পদে কর্মরত দেখলেই বোঝা যায়। শরীরের প্রতি যত্ন কম বলে আরে বেড়েছে ভালোই। "কি ভাবছিস অনি..?" দেবুর কথায় সংবিত ফিরে পেয়ে বললাম, "তোদের দেখছিলাম রে...! সবাই কেমন চেঞ্জ হয়ে গেছিস.."
"শোন, আজ সবার সামনে পঁচিশ বছর আগের এক রহস্য ফাঁস করবো.."
পল্টুর কথায় সবাই নড়ে চড়ে বসলাম আমরা। পল্টু শুরু করলো, "রায় বাড়িতে সেই রাতে আমি আর মিহির মিলে প্ল্যান করেছিলাম দেবু আর অনিকে ভয় খাওয়াবো..! তাই সন্তোষকে ঘোমটা পরা কাজের মেয়ে সাজিয়ে পেশ করেছিলাম তোদের সামনে। কিন্তু তোরা দুজন যে অজ্ঞান হয়ে যাবি বুঝতে পারিনি, বিশ্বাস কর.."
"এতদিন পরে এসব জানানোর কি মানে হয় পল্টু..." দেবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
"না দেবু, ওই রাতের পরেই তো বাহাদুরদা হেডস্যারের কাছে কমপ্লেন করলো আমার নামে। ব্যাস আমি শালা কেস খেয়ে গেলাম।মজা করতে গিয়ে বেজে গেল বারোটা। আমাদের টিমও গেল ভেঙে।" "কিন্তু পল্টু, তুই সন্তোষকে সাজিয়ে এনেছিলি, তাতো বলিসনি ভাই এতদিন.." " লজ্জায় বলতে পারিনি,বিশ্বাস কর..!অনুতাপের জ্বালায় জ্বলেছি এত বছর। শুধুই ভেবেছি, সত্যিটা বললে তোরা কোনোদিন হয়তো আমায় ক্ষমা করবি না.." "এতদিন এই রহস্য লালন করে এসে শেষে পঁচিশ বছর পর...." আমি অবাক হয়ে বললাম।
হঠাৎ ঘরে উপস্থিত হলো সন্তোষ। আমরা আবেগ সামলাতে না পেরে সন্তোষকে কাঁধে তুলে নিলাম সবাই..। "হারামজাদা, কোথায় ছিলি বল..? সেই শুক্রবারের পর আজ তোর দেখা পেলাম। স্টেপ জাম্প করে তো বাচ্ছা থেকে বুড়ো হয়ে গেছিস।" মিহির উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো।
"বলছিরে ভাই...! আগে বসতে দে….!"
ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা চেয়ার টেনে বসলো সন্তোষ। পা তুলে বলতে আরম্ভ করবে, এই সময় ওকে থামালো দেবু।
"দাঁড়া শালা...! আগে বল, কাজের মাসি সেজে তুই ঢুকলি কি করে রায়বাড়িতে…?" "পল্টু বলেছিলো ঠিকই, কিন্তু আমি ওইদিন যেতে পারিনি...!"
"তার মানে….? তুই ছিলিস না সেদিন..?" মিহির প্রশ্নটা করেই মেঝেতে বসে পড়লো।
"নারে ভাই, ওইদিন স্কুল থেকে ফিরেই শুনি, বাবা খুব অসুস্থ। আমি তো মামার বাড়ি থাকতাম। শুনেই আসানসোলে অসুস্থ বাবাকে দেখতে ছুটলাম। তারপর বাবা চলে যেতে আর ফেরা হয় নি রসুলপুরে..। অল্প বয়সে কাঁধে সংসারের জোয়াল পড়লে যা হয় আর কি...!"
সন্তোষের মুখে কথাটা শুনে আমরা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম কিছুক্ষন। কারোর মুখে কথা নেই। প্রত্যেকের মনে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,"তাহলে সেদিন রায় বাড়িতে মহিলাটি কে ছিল..?"
হঠাৎ অতনু বলে উঠলো, "মিহির শিগগির জল নিয়ে আয়, পল্টু অজ্ঞান হয়ে গেছে..!"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন