কবিতা
মানবী দুর্গা
সুমন্ত চক্রবর্তী
সত্যি কি তুই দুর্গা হবি!
অন্ধকার ওই অসুরটাকে,
বুকের মাঝে ত্রিশূল ঠুকে,
চোখ রাঙাবি 'আর জ্বালাবি'।
সত্যি কবে দুর্গা হবি!
রোজের মতোই 'দশ'টি হাতের কাজ সামলে,
সকল বেয়াদপির কানটি মলে,
হুকুম দিবি চাই পৃথিবী এমনধারা,
একমাত্র রাত্রি ছাড়া,
আর কখনো কোনো আঁধার
স্পর্শ করার নেই দরকার।
সত্যি কি তুই সব দুর্গতিকে,
তর্জনীতে ঠেকিয়ে রেখে,
একদিন সব ঘর চৌকাঠ করে দিবি পার।
তবে আয় মা আবার।
ভাসিয়ে দে মা সব কুটিরের দহন জ্বালা,
হিংসা ক্রোধ ঈর্ষা যেন না করে আর-
কোনো হৃদয় ফালাফালা!
মানুষে মানুষে বিভেদ যেন,আর সে ভীষণ,
নীরব কোনো অত্যাচারে, পোড়ায় না মন।
আর কোনো ঢেউ যেন না আছড়ে পড়ে,
ক্ষুধার এবং মারণ রোগের,
এই ধরণীর অভাবী কিংবা দুঃখী ঘরে।
এই দুনিয়ায় সবাই যদি না হয়ও সমান,
সুযোগ যেন সকলে পায়।
একদিন তারও উর্ধ্বে উঠে সমান হওয়ার
চেষ্টা যেন মান্যতা পায় নিয়ম করে।
তোরই মতোন দুঃসাহসী কন্যা যেন জন্মায় সব ঘরে ঘরে।
মাতৃরূপী হয়েও যেন শক্তিমতীর আগুন থাকে বুক পাঁজরে।
আমরাও চাই একদিন তুই,
শুধু নিয়মমাফিক পূজাতে নয়,
সকল দিনে, সকল ক্ষণে, সকল মনের সঙ্গী হবি।
সকল পাপ ও কলুষ হরণ,
মিথ্যা মোহের সব আভরণ
ছিন্ন করে সত্যি যেদিন দেবীর থেকে মানবী হবি,
সত্যি মা তুই, সেদিন মনের, বড় কাছের দুর্গা হবি॥
রাখবে কি আগলে
সন্দীপ কুমার মিত্র
ঐ শাপলা ফুলের সৌরভে
যদি তোমার মুখটা ভেসে উঠতে
দেখতে না পারি তবে
কেমন করে ভালবাসবো তোমাকে!!!
অনবরত বৃষ্টিতে ভিজে যদি
তোমাকে ছাতার আচ্ছাদনে শুকনো রাখতে না পারি তবে
ভালবাসা ঐ জলে যাবে ভেসে, আর
অবাক হয়ে চেয়ে দেখবে, মানুষটা
বদলে গেল কেমন যেন!!!
আমার কৈশোরের ভালবাসা যদি
তোমার মনে খুনসুটির দাবানল
জ্বালাতে না পারে তবে
ধিক্ সে ভালবাসা-
তোমার চোখের আলোতে যদি
পথ চলতে না পারি
তবে কি ভালবাসার যোগ্য হতে
পারবো কোনোদিন!!!
যদি হারিয়ে যাই অযোগ্যতায়-
তবে কি আমায় খুঁজবে সেদিন
ঘন অমানিশার অন্ধকার
আদরে।।
একটু ছোঁয়ার আশায়
সুজাতা দাস
মাঝে মাঝে অন্ধকারে হারাতে ভালো লাগে,
সেই অন্ধকার, যেখানে আঁধারেরও আলো আছে!!
ঠিক সেখানেই জোনাকিরা ঠিকানা খোঁজে।
ভেসে বেড়ানো ভেসেলগুলো, কিছুটা আমার মতো-
হয়তো জলের কান্না শুনতে পায়, যেমন আমি শুনি।
কিছুটা গল্প হলেও সত্যি, আকাশও নামে মাটিতে ভালোবাসার টানে-
ছুঁয়ে যায় বৃষ্টির ফোঁটাকে সাথে নিয়ে,
ঠিক তখনই রঙধনুর মতো রঙ মাখে ধরা!
ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় একবার মাটিকে-
অধরাই থাকে এই প্রক্রিয়া, যার টানে বারে বারে ফিরে আসে আকাশ!
বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে একটু ছোঁয়ার আশায়-
ভালোবাসা বোধহয় এমনিই, শুধু ছোঁয়ার চেষ্টা করা!
কিন্তু ছোঁয়া যায় না কিছুতেই।।
অপেক্ষাজন্ম
চিরঞ্জীব হালদার
জামরুল গাছ থেকে খসে পড়া
আকাশফুলের বেহায়া ওড়না।
কেতকী তুমি তাকে আলতা ভাবতেই পারো।
দেখো ন্যারেশানের ভেতর।
তাকে দেখো চিকন পাতায় পিছলে যাওয়া দশমিক
কান্না স্বরূপ।
কারা তাঁত বোনে।
পোষাকে পোষাকে আছড়ে পড়ে একুশগর্ভিনীর ক্ষুধার্ত আর্তনাদ।
তুমি বহুভোগ্যা জামরুল শাঁসের ভেতর জেগে থাকা
শ্রমন রমনী।
সরাইখানাহীন নক্ষত্র পথে পাঠ করো
ধরিত্রীর সামান্য সামগান।
প্রতিটি বুনোফুলে নির্ধারিত সুবাস বন্টন করে
ক্ষুধার্ত জীবের সামনে মেলে দিতে পারো
রূপসী ভাঁড়ার।
আজ আর এই প্রাচ্যশহরে একটাও জামরুল ফলে না।
ওই দেখো বালিগঞ্জ সারকুলারের গা ঘেঁষে
উদাসী মেফেয়ার বালিকা।
সে আমাকে এক কোঁচড় জামরুল দেবে বলে
ঠাঁয় দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
আমি তাকে গুগুল মিটের পাশওয়ার্ড জানাতে
ভুলেই গেছি।
পারোজিয়া কবিতা
চিরঞ্জীব হালদার
অকপট নামিথ্যা চাঁদের ঝালর দেখে
বুলবুলিটা হেসে হেলে পড়ছে
আতা গাছের ডালে ডালে।
পারোজিয়াগ্ৰস্ত দেওয়াল আর বুনো ঘাস ফড়িং এর
আলাপ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে প্রাজ্ঞতার
ভড়ংহীন মৌতাত।
মেঘ নর্তকীরা নেমে আসবে চাঁদের গা বরাবর।
দরজা খোলা রাখি।
মৃত আতাফুল ঠোঁটে মদির বুলবুলিটা
যদি কখনো কড়া নাড়ে।
নিষিদ্ধ প্রলাপ আর পোষাকের বিলাপ
শুরু হলো বলে।
ইচ্ছে নদী
আরতি ধর
মনটা যেন ইচ্ছে নদী
ইচ্ছে মতোন বয়
কখনো ঢেউ, কখনো স্থির
কখনো বন্যা হয়!
হাজার বোঝা মনের বুকে
তবুও চলতে থাকে
চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে
চরণ চিহ্ন আঁকে।
কখনো শুনি কুলুকুলু ধ্বনি
কখনো হাহাকার
কখনো যায় বাঁধ ভেঙে
সব হয় একাকার।
মন'রে তুই এমন কেন
বাঁধন মানিস না
পথের মাঝে কাঁটা এলেও
থেমে থাকিস না।
চলতে থাক আপন মনে
থামবি যখন শেষে
কোন সাগরের অতলে তুই
যাবি'রে তখন মিশে!!!
স্বয়ম্ভর শুদ্ধ হতে চাই
অসীম দাস
বরেণ্য বিশ্বাসের বিবর্ণ অপচয় অবক্ষয় দেখে,
আর হাড়ে দুব্বো গজানোর পরেও
ক্ষমতার এঁটো শুঁকে লালা-পাত মেপে,
ধিকিধিকি অবসাদ ও ক্ষোভের আঁচে
পুড়ে পুড়ে বড় শীত শীত অবসন্ন লাগে।
তাই, নিজেরই উঠোনে টামলিং নামের এক
টিলা বানিয়ে তারই পাশে ছড়িয়ে দিয়েছি
নৈঋতা নদীর স্বেচ্ছা-নীল ঢেউ।
এক আঁজলা গোলাপী সকাল তুলে
মেখে নিই উসখুস অশুচি সর্বাঙ্গে।
স্বয়ম্ভর শুদ্ধ হতে চাই।
লক্ষ বছরের প্রবীণ প্রাচুর্যে
পা দিতে ভয় হয়,
কখন ঝুরঝুর ঝরে পড়বে অতীত স্বপ্নের মতো!
সমুদ্র পাহাড় মেঘ ….সব যেন
বেঁচে বেঁচে বুড়ো হয়ে গেছে!
কার কাছে যাই ?
কার কাছে গেলে নতুন বাঁচার স্বাদ পাই!
অহর্নিশ অশ্লীল কোলাহলের মুখে আগুন দিয়ে
তাই নিজেই সৃজন করতে চাই
এক মুঠো ভার্জিন ভোর।
অক্ষৌহিণী জাতকের শবনম-চোখে
ফুটে উঠবে পয়মন্ত সমন্ত্যক- দ্যুতি,
শুধুমাত্র তারই অপেক্ষায়।
মুখোমুখি
মধুপর্ণা বসু
দুটো মন ছুঁয়েছিল একুশ যখন,
এলোমেলো ঝরে পড়া শব্দ তখন।
কিছু ছিল প্রশ্রয় অগাধ প্রতিশ্রুতি
ভিড়ে মেশা হারজিৎ নেশা মতিগতি।
তারপর বিপরীতে ভুলের মাশুল
মনের উঠোন জুড়ে শুধু বিষফুল।
হাঁটা পথ হয়ে গেছে ঠিকানাহীন ভ্রষ্ট
ভাবনারা রঙরুটে অচেনায় অস্পষ্ট।
কবেকার ঝড়বৃষ্টির পর একবার
অপেক্ষা করে আছে উপসংহার।
মুখোমুখি হঠাৎই আচমকায় আসা
নতুন চেনার পর্বে শেখা পরিভাষা।
দুটো চোখ জুড়ে ছিল স্বপ্ন আকাশী
কথারা আজ চুপ শুধু মন বানভাসি
কিছু ভুল স্বরলিপি জোড়াতালি থাক,
অভিমানী দুটো মন ভালোবাসা পাক।
আমার নীতা
নির্মাল্য ঘোষ
তিস্তা পেরিয়ে মুজনাই টপকে যখন ছুটে চলি মানসাই এর দিকে…
একগোছা কাশফুল শুধু আমার সাথী হয় সারাটা পথ ধরে…
ঘুঘুমারি মোড়ে রাজার শহর থেকে কে যেন এসে দাঁড়িয়ে থাকে আমার জন্য নত মস্তকে লাজুক চাহনি নিয়ে..
তার চুলের রঙ সাদা মেঘের মতই আর বুকে নীল আকাশের রঙ…
আমাকে হাত ধরে সে নিয়ে চলতে থাকে দিনহাটার দিকে…
আমি তার গায়ে শারদীয়া গন্ধ পাই…
দিনহাটার দূর কোনো মণ্ডপ থেকে ভেসে আসে নস্ট্যালজিক ঢাকের আওয়াজ…
ভালো করে তাকিয়ে দেখি - আমার হাত ধরে আছে আর কেউ নয়…
আমার নীতা…
মহাকাব্য
সুখেন্দু ভট্টাচার্য
প্রেম নিয়ে আমার কোনও উপাখ্যান নেই
যা আছে কিশোরবেলার এক আধ-পশলা
সেই এক আধ পশলাতেই মাটির গন্ধ
হিরো সাইকেলে নায়ক নায়ক ভাব
বৃষ্টি ভেজা সিনেমার মতো রাস্তা থেকে জানালায়
নায়িকাকে দেখা আমি ফিচার ফিল্মের নায়ক
আর নায়িকা স্থির চিত্রের ডকুমেন্টরি
চালের হাঁড়ির দোষ, না চটির স্টাইল
না গায়ের রং - বোঝার আগেই ফুড়ুৎ ধা ।
প্রেম নিয়ে আমার কোনও কাব্যনাট্য নেই
যা আছে যুবক সেনার ঝোড়ো হাওয়া
একসাথে অনেক ললিতা, হাজার ললনা
ভাবতে ভাবতে সময় খাওয়া …
বইয়ের পাতা বছর শেষে নতুনই থাকলো
কখন সবাই কেমিক্যাল বন্ড হয়ে গেছে!
চল্ তবে একটা দুঃখের গান গাইতে গাইতেই রাস্তায় হাঁটি।
তবে হ্যাঁ, প্রেম নিয়ে আমার একটা মহাকাব্য আছে
যুবক ছাড়িয়ে চাকরি সন্ধানী বেকার…….
সহপাঠিনীর সঙ্গে দেখা – ট্রেনেই… কেমন আছিস?
ট্রেনের চলার মতো আমাদের প্রত্যাশার দিন
অভাব নিরসনের অন্বেষনে সেও সামিল।
তার সঙ্গে দেখা হওয়া মনে হয় ভবিতব্য ছিল।
ফিরতি বসন্তেই দরখাস্ত দিলাম, চাকরি পেলাম
দু জায়গাতেই, একটা সরকারি - মাইনে দেয়
আর একটা মাইনে দিয়ে …
অনন্ত প্রেমের ভাগীদার হলাম
অভক্তি ভাববেন না –
এই প্রেমকেই আমি মহাকাব্য বলে মেনেছি।
তমসুক
সোনালী মন্ডল আইচ
ঝিলমিলিয়ে চাঁদের আলো
মনটা হল আটখানা
ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এলো
তাই যে মসী পিলখানা।
ঘ্যানঘ্যানিয়ে কাঁদছে বিড়াল
বায়না ধরে মাছ খাবে
উদবিড়ালের হয়রানি হাল
হায়না তাকে সাবড়াবে।
এসব প্রিয় নয়তো আসল
এলে যখন কালরাতে
ইচ্ছে ছিল আগুন কাজল
লাগুক এবার বজরাতে।
ধার বাকিতে বছর কাবার
সুদ কষা তো হ'লনা
কারবারি মন মুরগি খামার
(মঁসিয়ে) ধার-ধারিনা ছলনা।
টেক আ চান্স
প্রকৃতি দত্তা
প্রতিফলন, প্রতিসরণ, সূর্যের ঐ পথ চলা
পশ্চিমা আকাশে ফ্লেমিঙ্গো ডান্স,
টেক আ চান্স …
সবুজ ক্ষেত, অক্স বো লেক, পাতাদের কথাবলা
মাথাতে বোঝা চাপিয়ে স্টান্স,
টেক আ চান্স …
টেক আ চান্স,
দিবা শেষ যামে,
এক ক্লিকে এক ফ্রেমে
রঙ ছড়াও ক্যানভাসে
চোখ বোলাও চারপাশে।
ছলছল, জলতরঙ্গ বৈঠা বায় মাঝি ভাই
বাতাসের ফিসফাসে মিঠে রোমান্স,
টেক আ চান্স …
পিচরাস্তা, ধানের ক্ষেত, এই চড়াই ও উৎরাই
ছোট্ট গ্রামে চমৎকার ব্যালান্স,
টেক আ চান্স …
টেক আ চান্স,
বই রেখে,
দূরে পথ যায় বেঁকে
ক্যামেরার শাটারে
রাখো হাত এইবারে।
ছুটে চলো শ্যামলীমা প্রান্তরে
হাতরাখো দুই পাশে
ঘাস রাখি ছুঁয়ে যায় বারেবারে
ভালোলাগা আবেশে।
সীমানা ছাড়িয়ে যাবে দূর দেশে
আমাকেই পাশে পাবে
সূর্য পাড়ি দেবে দিন শেষে
রাত কেটে ভোর হবে।
টেক আ চান্স,
এক নিঃশ্বাসে,
চল না স্বপ্নের সেই দেশে
মন আঁকে সেই ছবি
স্বপ্নেরই নাইরোবি।
এলোমেলো চারপাশ, দুঃখেরই নাগপাশ
পৃথিবীতে শুধুই অভিজাতের ডমিনান্স,
তবুও টেক আ চান্স …
টেক আ চান্স,
এক সাথে,
রাখবো হাত ওই হাতে
নাও শপথ পাশে থাকার
টুঁটে যাক এই প্রাকার।
বাসন্তী বাতাসে শ্রাবণের বৃষ্টি
চৈতালী দাসমজুমদার
যন্ত্রণায় কাতর মন ইচ্ছা করে না সূর্যাস্তের রক্তিম আলোয় নিজেকে রাঙানোর।
নীল শ্যাওলা ভরা জীবনে খুঁজে চলেছি নতুন আলো।
ভোরের প্রসূতি রাতে লুকিয়ে দেখতে গেছিলাম তোকে ।
মন খারাপের পাহাড় বুকে নিয়ে ফিরে আসি আশ্রয়ের খোঁজে ।
পথে তখনও ল্যাম্পপোস্টের আলো ।
আবছা ভোরের আলোয় আমি একা পথের দিকে চেয়ে…………ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে মাতিয়ে দেয় প্রাণ ।
এ বিষাক্ত মনে দু মুঠো আবির নিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে লাজুক রাতে তোর মনের ঘরে।
ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করে সেই আবিরের হাত দিয়ে তোর শরীর ।
আমার উপস্থিতি জানিয়ে দিয়ে ছুটে লুকিয়ে পড়ি।
তোর চোখ দুটো অবুঝ রঙিন পাখির মতো আমাকে খুঁজতে থাকে।
আমি তোর অজান্তেই শঙ্খচিলের ডানায় কখন হারিয়ে যাই নীল আকাশে।
আর তুই দু'মুঠো স্বপ্ন নিয়ে দিগন্তের পানে চেয়ে থাকিস তোর অনুভূতি নিয়ে আমার অপেক্ষায়।
হয়তো বা কখনো ফিরে আসবো শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে তোর বাসন্তী বাতাসে।
মৃত্যুদূত
জয়ন্তী ঘোষ
গভীর অরণ্যে তার বসতি,
রুদ্র-নিবাস ছিল অন্দরমহল
দুর্গম পথ চলি তোমার স্মৃতি নিয়ে
রজনীর অন্তিমে চোখের পলকে
থাকো দিন প্রারম্ভে।
পেঁজা তুলোর মত শুভ্র এক আকাশ প্রেম,
তার সাথে কতবার ভেসেছি….।
উজানের স্রোতে নিয়ে গেছো জল জাহাজে,
অতলান্তিক গভীর থেকে নাগমণি
এনেছিলে…..।
মরুভূমিতে মরূদ্যান হয়ে হাত ধরেছো।
অকস্মাৎ……
মুচড়ে দেওয়া ডানা ঝাপটায়
আবারো উড়বো বলে মহাকাশে…
আবডালে সেই সুখের নীড় কবেই
দমকা হাওয়ায় গেছে উড়ে ।
টুকরো হৃদয়ের সংযোগের অঙ্গুলিতে
ভালোবেসে পরালে যে অমূল্য হীরের আংটি…
অজান্তেই হলে আমার মৃত্যুদূত।
নদী ও নারী
অমল বিশ্বাস
একটি নদী ছুঁয়ে এলাম।
তোমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে ভাসিয়ে দিলাম
জলের শরীরে,
সেও এক শৈল্পিক সামুদ্রিক রমণে
পরিপূর্ণ নারী।
পিঠ বেয়ে ঝরা চুলে শান্ত-কাজলী
কখনো খরস্রোতে ভাসাচ্ছে আঁচল।
উত্তল বুকে আধছোঁয়া জল
ঝর্ণার সঙ্গমে খুঁজছে সামুদ্রিক সুখ।
তীরভাঙা মাটির গন্ধে সুরামুগ্ধ পৌরুষ
নতজানু তার শরীরে।
বুকের সরুপথে নৌকার চলা,
কখনো বিক্ষুব্ধ বাতাসে ছিঁড়ে ফেলছে
মাছরাঙা পালের পালক।
ছিটকে পড়া মাঝির দুর্দশায়
সাদা হাঁস হাসছে তরঙ্গের দোলায়,
মধ্যনদীর ঘূর্ণিতে ঘোরাচ্ছে তাকে
ডুবে যাচ্ছে সে।
আহা, কি অদ্ভুত
জর্জরিত শক্তিমান পুরুষ-প্রণয়!
যখন বিবস্ত্র জলে জোয়ারের পূর্ণিমা
খঞ্জনি তুলছে মাদল,
ঢেউয়ে-ঢেউয়ে গিরিনিতম্ব জুড়ে
জলের উঠানামা।
ভাসাচুলে চুপচাপ-ফিসফাস
শব্দের মায়া,
জোয়ারের শেষবেলা
খেলাশেষে নেমে আসে ভাটায় শরীর;
তারপর ঘুম।
ভোরের লাজুক জল
নদী ছেড়ে দুইতীরে যেটুক রেখেছে দাগ
সোনামুখী সূর্যের প্রথম প্রভাতে,
স্নানশেষে সেইটুক প্রেম।
রাত্রির জোনাকির গুঁড়োরঙ
দুইগালে রেখে গেছে প্রণয়-প্রপাত,
তাও জানে সমুদ্রের জল।
যতো উচ্ছ্বল নদী
তার চেয়ে বেশি উচ্ছ্বল নারীর ভুমিকা,
ঝর্ণার জলে নুড়ি পায় প্রেমের আশ্বাস
নদীর আদর।
একটি নদী ছুঁয়ে এলাম।
আর স্মৃতিছুঁয়ে কষ্টের ছাই ভাসালাম
স্নিগ্ধ শরীরে,
ঠিক তক্ষুনি খরস্রোতায় অঙ্কিত হয়
এক পরিপূর্ণ নারী।
আঁচ
জারা সোমা
পরিতৃপ্ত ঠোঁট জানে ধ্রুপদী চুম্বন শেষে
জিভের আর্তি, পরিধি শেষের অধ্যায়।
সম্পর্কে ফাঁকিবাজি শিখিনি বলেই
কখনো হতে পারিনি সাধক- সর্বত্যাগী
বরং উষ্ণতা জড়িয়ে রাখে উন্মাদনা
নদী সঙ্গমে শুরু হয় সমুদ্র উল্লাস।
প্রেমে এক সূর্য আঁচ জমলে
আমরা সেঁকে রাখি বর্ণ ও সংলাপ।।
এক অ-কবির গান
ঊষা গরাই
আমার সমস্ত শোকতাপ
রাতপরীদের সোনার কাঠির ছোঁওয়ায়
প্রশমিত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ন্যুব্জ দিনরাত গুলি অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে
গোধূলির বৈরাগ্যে উদাসীন
কিরাত সময় হাঁটে ছায়াপথ ধরে।
পাথরের বুকে ফোটা ফুল
যেদিন হেসেছিল, সেদিন-
ওই ক্ষণজন্মা জানতোনা
আজই তার ঝরে যাওয়া……
ঝরে যাওয়া ব্যথারা আতিথ্য নিক
পাথরের খাঁজে
মহুল- মাদল একসাথে পা ফেলে
হেঁটে যাক মালভূমির হাটে
বৃদ্ধ উদাস ছাতিম দেখছে কেবল
খোয়াইয়ের মজে যাওয়া বুক।
যেখানে পৌষের পরবে আজও
অচেনা কুন্তলার আবদারে
প্রেমিক বাউল ঘুঙুর বাঁধে পায়।
কনকচাঁপার সোনালী গর্ব
অতিবেগুনি রশ্মিতে বিবর্ন
তবু তার শোক প্রশমিত করতে
জলপরীদের রজনীগন্ধা সুর
শোনাবোনা কোনও দিন
বরং সে শোক লালন করে নেবো
নিজের ব্যবচ্ছেদ বুকে
রক্ত গোলাপটির মতো…..।
কবিতার অন্বেষণে
পলাশ বিশ্বাস
(১)
অনন্ত সমুদ্রে আমি একা
কেউ রজনীগন্ধা হয়ে আসেনি
আমায় নিয়ে যেতে
কবিতা তুমি হাত ধরে নিয়ে চলো আমায়
তোমার ঘরে!
( ২ )
রাতে ফোটা শিউলি তুমি
ঝরে যাবে শিশির ঝরা প্রাতে বুঝিনি আগে
দুর্ব্বাঘাসের উপহাস মরমে গেঁথেছে
আমার বুকের টিয়া পাতা
ভাসিয়েছো বাতাসে
( ৩ )
বাতাস নিয়েছে মুখ ঢেকে
দিগন্ত ছোঁয়া কুয়াশার চাদরে
ফাঁকা ধূ ধূ মাঠ পড়ে আছে ঝরা পাতার অপেক্ষায়
যে পথে আমি খুঁজতে যাবো
কবিতা তোমায় আলেয়ার পিছু পিছু
( ৪ )
কবিতার মুঠো মুঠো প্রেম
সোনার হরিণের মতো ছুটে যায় ওই
মায়াবী রাতে নিঃশব্দে
চুপি চুপি পিছু নিয়েছি আমি তার
পরীর ডানা উড়িয়ে তুমি আজও সেই অধরা
( ৫ )
সোনা রোদ মেখে যাচ্ছে এখন শিশিরের ছোঁয়া
তোমার শুষ্ক দু'টো ঠোঁট গোলাপ কাপে
উষ্ণ চায়ের ধোঁয়ায় খুঁজছে আর্দ্রতা
ভেজা ভেজা আলাপচারিতায়
আর পুড়ে যাচ্ছে আমার কবিতার জিহ্বা
( ৬ )
দিগন্তের দরজায় খিল দিয়ে এসো
শিশির মুছতে দিয়োনা কাউকে
তোমার হৃদয়ের দুর্ব্বাঘাসে
শিউলি হয়ে ঝরে যাও তুমি
কবি আলো খুঁজে মরুক মন্থকূপে
ঋণপত্র
কল্যাণী দেব চৌধুরী (শিলালিপি)
মেঘের ভেলা বইছে আজ
আকাশে বাতাসে।
আকাশ বলে শরৎ আসে
কাশফুল আর ঘাসে।
শুভ্র শিউলি হলুদবাঁটা,
প্রিয় কাঁচাসোনা।
বাতাস আজ বড্ড দামাল
কাশফুল মেলে ডানা।
শরৎ শিউলির বরণ ডালায়
বাসর মুগ্ধ হয়।
ঠিক তেমনি ক্লান্ত বাতাস
মেঘের ভেলা বয়।
কাশবন কে এবার নাও
হৃদয় রাণী করে।
বেল কামিনী যূথী মালতী
বরণডালা ভরে।
আকাশ বাতাস বরণ করতে
মর্ত্যে এসেছি।
ঋণী আমি তোমার কাছে
ভালোবেসেছি।
অতল গভীর চোখটি তুলে
দেখি আমি মনে।
মাটির কাছে ঋণী আমি;
শুধাই সঙ্গোপনে।
মর্ত্যবাসী গাইছে আজ
তোমার জয়গান;
শুদ্ধ করো মর্ত্যবাসীকে
দান করো মৃতে প্রাণ।
ঐ শোনা যায় মায়ের চরণধ্বনি
আর্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শরতের ভোরে দিকে দিকে বাজে
মার আগমনী সুর,
হৃদয়ে ও মনে অনুভব করি
পুজো নয় বেশী দূর।
পাতায় পাতায় শিশিরের ছোঁয়া
দিঘিতে পদ্ম হাসে,
শত শেফালী ছড়িয়ে রয়েছে
সবুজ কোমল ঘাসে।
পাতা ঝরা দিন হবে যে শুরু
বনভূমি কাঁপে আজ,
প্রকৃতির মাঝে যেন খুঁজে পাই
শুধু পুজো পুজো সাজ।
সোনা সোনা রোদ হিমেল হাওয়ায়
ছুটির গন্ধ পাই,
শরতের মেঘ হেসে ভেসে বলে
আর তো বর্ষা নাই।
কাশের বনেতে হিল্লোল ওঠে
মালতীলতারা হাসে,
টগর সুন্দরীর শুধু অপেক্ষা
চম্পার অভিলাষে।
গুন গুন গুন মৌসোনাগুলো
প্রেমের আতর মেখে,
পরাগমিলনে সক্রিয় হয়
ফুলের পরাগ মেখে।
কতো পাখিদের কলকাকলিতে
মুখর আকাশ বাতাস,
ঢাকের বাদ্যি যেন বলে দেয়
এটা যে পুজোর মাস।
কদিন পরেই পুজোর শুরু
শুধুই ঠাকুর দেখা,
নতুন প্রেমিক প্রেমিকা নির্বাচন
কেউ নয়তো একা।
সূর্যাস্ত ছায়ায়
ছোটন গুপ্ত
বিকেল আলোর মায়া নদীতে আবছায়া।
পশ্চিম আকাশ পানে স্তব্ধ উতল প্রাণে–
স্নিগ্ধ প্রভায় জলের শোভায় সূর্যডোবার ছায়া।
দিনের শেষে রোজ কার যেন নেই খোঁজ
ফিরছে নীড়ের পাখি সেই ছবিটাই আঁকি,
দূরের পথিক দিক খুঁজছে বিশ্রামে চোখ বোজ।
নদীর জলের ছবি দেখছে কোন এক কবি,
জল করে টলমল অস্ত রবির ছল-
কেউ কী আবার ডাক পাঠালো– স্বপ্নদর্শী হবি !
সন্ধ্যে নামছে ক্রমে মায়াবী বিভ্রমে–
গাছের ছায়া বাড়ে হারায় অন্ধকারে।
আঁধারসাঁঝে মিশকালো রঙ শিরশিরে থমথমে।
উঠবে না আজ চাঁদ হাজার তারার সাধ…
জোনাক জাগে ওই খানিক চেয়ে রই,
মোহিন মায়ায় জলের ছায়ায় অলীক বিসংবাদ।
নিঝুম শূন্যপুরে যাত্রা অনেক দূরে,
এক সন্ধ্যায় থামি নদীর জলে নামি।
দিনের শেষে বাউল বাঁশি লোকগীতি মন জুড়ে।।
আগমনী
নীলাঞ্জন অধিকারী
ঢ্যাং কুড়াকুড় ঢ্যাং কুড়াকুড় ঢাকের তালে ওই,
কাশবনে আজ, পথ হারাবো, আয় না ওলো সই।
খুশির সুরে গাইছে কেমন, দিব্যি সবার মন,
তর সয় না, আর যে আমার, হারাই কতক্ষণ!
শিশির ভেজা শিউলি তলায় আয় না কুড়োই ফুল,
গাঁথবো মালা, সাজবো দু'জন, বাঁধবো বেণীর চুল।
নীল আকাশে ভাসবো দু'জন, ওই তো মেঘের ঘর,
হাসছে কেমন খিলখিলিয়ে, ভুবন চরাচর।
বছর ধরে অপেক্ষারা আজকে পেল ছুটি,
আগমনীর গন্ধ পেয়েই, মন যে লুটোপুটি।
নতুন জামা, নতুন জুতো, আর কি আমার চাই,
প্রাণের সুধা মিশিয়ে গানে, আগমনী গাই।
শরৎ ছড়ায়, সোনার আলো, চিন্তা কিসের আর,
রইবে না কো আঁধার ঘরে, খুলবে এবার দ্বার।
সবার জীবন উপচে উঠুক, খুশির রঙে ভোর,
হাতটা আমার থাকুক ধরা, ওই দুহাতে তোর।
শরতে বাংলার মুখ
দীপঙ্কর বিশ্বাস
ভালবাসি মা মাটি ও মানুষ
আর ক্ষেতের শেষে সীমানার আলপথ।
ভালবাসি শরতের শুভ্র কাশফুল
আর আশ্বিনের চাঁদিফাটা প্রখর রোদ।
ভালবাসি সবুজ আমনের ক্ষেত
আর জলে থৈথৈ খালবিল নদীনালা।
ভালবাসি সাদা সাদা তুলো মেঘ
আর দক্ষিণা মিঠেকড়া সিক্ত সমীরণ।
ভালবাসি হিমেল কুয়াশায় ভোর
আর আউস ধানের অমৃত সুবাস।
ভালবাসি নীল নীল মাছরাঙা পাখি
আর আধফোটা পদ্মের শীষ।
ভালবাসি রোদেজলে উজ্জ্বল দিন
আর স্নিগ্ধ জোছনায় নিশুতি রাত।
ভালবাসি ছায়া ঘেরা জারুলের বন
আর ভোরের পাখির সুভাষিত কলরব।
ভালবাসি ঘাসের উপর শিশির বিন্দু
আর নদীর বুক ভরা খরধারা ঢেউ।
ভালবাসি দোয়েল ফিঙের উল্কি নাচন
আর দোলখাওয়া বাবুইয়ের বাসা।
ভালবাসি কৌড়ির হাতে হাতে ডুব
আর দোপাটির পাপড়িতে মুক্তোর জল।
ভালবাসি কুমারী মেয়ের শাপলার বিল
আর মাটির কলস কাঁখে গাঁয়ের বধূর ছল।
ভালবাসি বাংলার বায়ু বাংলার জল
আর মাটির বাংলার আর্শিতে বাংলার মুখ।
ভালবাসি মাধবীলতা কুঞ্জলতার বেণী
আর সবুজে ঘেরা মাটির পল্লীসমাজের সুখ।
একলা বিহঙ্গ
পল্লব ভট্টাচার্য অনন্ত
চোখের কোলে জমা ছিল যতেক ধুলো
আবছা হয়ে রয়ে ছিল সব জাগতিক রেখা
এক পশলা বৃষ্টি ভেজা মন হারানোর
অনুভবের দৃষ্টিকোনে আতশকাচে দেখা।
পাথরপারা দৃষ্টি চোখে আবছা সবই
জলছবিতে বৃষ্টি ফোঁটা টুপুর টাপুর
ক্যানভাসেতে কে দেয় কালি আলতো হাতে?
জলসাঘরে নৃত্য তালে বাজায় নুপুর।
জলপরীদের হাওয়ায় ওড়া
বোশেখ ভোরে
ফুলপাখিদের আবেগ ভাঙে আলতো টোকায়
স্মৃতির পাতায় অবুঝ হাতে আঁচড় কাটা
ভালোবাসার শিউলি ঝরে থোকায় থোকায়।
চোখ চেয়ে রয় দুর আকাশের গহীন কোনে
সকল কথার সুপ্ত ব্যথার পরাগ ঝরা
মনকেমনের দিন গুলো সব মিলিয়ে যাওয়া
অনেক দুখের মাঝেও সুখের আবেশ ধরা।
হঠাৎ সেথায় অনেক কথার অনুপ্রবেশ
নেই দারোয়ান, মনের দ্বারে নেই পাহারা
সহসাথী,সমব্যথী কেউ কোথা, কই ?
থিকথিকানো সমারোহ তবু, নেই সাহারা।
পান্থ একা পানসি ভাসাই প্রানের খোঁজে
প্রান ফোয়ারায় তুলছে তুফান জলতরঙ্গ
এক পশলা বৃষ্টি নিবায় মনের আগুন
একলা আলয় একলা আমার প্রান বিহঙ্গ ।।
নাব্যতা
পিনাকী রঞ্জন মিত্র
বাতাসে পদ্ম ফুলের গন্ধ কাশবনে শ্বেত শুভ্র ঢেউ
শিউলির ডগায় ডাগর পোয়াতি মঞ্জরী
প্রহর গোনে আতাবনে আতা, উঠোনে ঝুমকো বাতাবি
পুজোর প্রসাদি হতে চায়, ঢাকে কাঠি,
লুকোচুরি খেলে মেঘ রোদ্দুর বৃষ্টি
সৃষ্টির মধ্য দুয়ারে খেলে অনাসৃষ্টি।
এখন তোমাদের পুজো পুজো মন
এবেলা সাজের বেলা
সাজাও দেউল
সাজাও অস্থায়ী প্যান্ডেল।
আমি শুধু চোখ মুঁদে দেখি যত দূর ঘুরে ফেরে মন
মনে তোলপাড়,
পাড় ঘেঁষে চলে যায় নাও
কোন তীরে নামা হবে, নাব্যতা বোঝে না এ দেহটাও।
ঝিনুক
কথাকলি সোম (পারুল)
জানো,
রোজ রাতে একটা স্বপ্ন দেখি
তোমার হাতে হাত রেখে সমুদ্রতটে দৌড়োচ্ছি।
ঢেউ… ঢেউ… উপচে পড়া ঢেউ
আছড়ে পড়ছে পায়ের কাছে এসে।
আমি পাহাড়ি মেয়ে,
পাহাড়ের চড়াই উৎরাই-এর বাইরে কোথাও যাইনি।
সমুদ্র একেবারেই অচেনা।
পাহাড়ি পাথুরে নদীতে পা চুবিয়ে বড়ো হয়েছি আমি।
ধামসা মাদলের তালে নেচে খুশিতে ভেসেছি,
জঙ্গলে ঘুরে পাখির ডাকের পেছনে ছুটেছি,
বুনো খরগোশ ধরে আদর করেছি
বাঁদরকে ভেংচি কেটে দৌড়ে পালিয়েছি
মযূরের ঝেড়ে ফেলা পালকে পাখা বুনেছি
বুনো ফুলে খোঁপা সাজিয়েছি
কিন্তু জানো, আমি কখনও ঝিনুক কুড়োইনি,
সাগরপারের রঙিন ঝিনুক।
রোজ রাতে স্বপ্নে দেখি,
তুমি আমার নীল আঁচল ভরে
ঝিনুক কুড়িয়ে পুঁটলি বেঁধে দাও ,
আমি খুশি হয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরি
তুমি আলতো চুমু দিয়ে আরো বেশি ঝিনুক কুড়িয়ে
আঁচল ভরাও।
রোজ একই স্বপ্ন
তুমি হাসতে হাসতে বলো, "ধরো আমাকে।"
বালিতে একের পর এক পায়ের ছাপ ফেলে
তুমি দৌড়াতে শুরু করো "ধরো, ধরো" - বলে,
আমি পেছনে ঝিনুকের বোঝা হাতে
দৌড় ..দৌড়.. দৌড় ..
আমি আর তোমাকে দেখতে পাইনা জানো!
হাসির শব্দও মিলিয়ে যায়
আমি চিৎকার করে ডাকতে থাকি
"কোথায় গো …তুমি?কোথায়?
ভয় করছে - ফেরো ,প্লিজ ফেরো এখনি।"
আমার স্বপ্নটা হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে
বড়ো বড়ো ঢেউ গর্জ্জন করে তোমার পায়ের ছাপগুলো
একবার নয়, দুইবার নয়, বারবার মুছে দিয়ে যায়।
ঝিনুকের বোঝা বুকে চেপে অস্ফূট স্বরে ভয়ে বলে উঠি
"ফিরে এসো, প্লিজ,
ঝিনুকগুলো বড়ো ভারী, চলতে পারছি না যে আর।"
-তবে কি তুমি সমুদ্র হয়ে গেলে!
নাকি রঙিন ঝিনুক, ঐ নীল সমুদ্রবালুকার!
পথ শপথ
তন্ময় দে বিশ্বাস
সব শপথেরা একদিন ঠিক এসে
মিলে যাবে তোমার মোহনায়-
মিশে যাবে কোলাহল হয়ে,
একদিন ঠিক সেই বুড়ো গাংচিল
ঠোঁটে করে তুলে নেবে একটা একটা করে-
খুঁটে নেবে, মাখবে শপথ, ডানায় পালকে,
একদিন ঠিক মোহনার বাঁকে,
জেলে নৌকায় পাতা চটজালের ফোঁকরে,
ধরা দেবে, রূপালী শপথ, আগমনী হয়ে,
একদিন ঠিক নদী সঙ্গমে,
নীল জল আবেগী তন্বী হয়ে ঢেউ তুলে
তোলপাড় করে ভাসাবে শপথ লোনা বুকে,
একদিন ঠিক ইছামতি পাড়ে,
একাকী মানুষ কোনো তোমার বুকের থেকে
খুঁজে নেবে, মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়, আগামী শপথ এক।
পদযাত্রা
আল্পি বিশ্বাস
শৈশব থেকে চেতনার আনুগত্যে
দেখেছি কত সংগ্রাম জীবনের
দেখেছি কত শত দর্প অহঙ্কার
কত বিবর্তন সরলতম মনের
ঈর্ষার ইস্পাতে সম্পর্ক খানখান
ক্রোধ জমা অবয়ব দুর্বাসার
থরথর বকুলের গন্ধে ভেজা মন
বুঝেছি তবুও বেঁচে থাকা দরকার
অস্থিরতা কোলাহল মিথ্যা মোহ
অশ্রুজলে মেখে নেওয়া ফেন ভাত
কখনও শরীর জুড়ে আলস্য নামা
কখনও পরিশ্রমী এ দু'টি হাত
এ জন্মে আর কত দীর্ঘ পথ
বাকি আছে আঁধারেতে পাড়ি দেওয়া
শূন্য হাতে ফিরবো না কখনই আর
শুধু যে আমার আজ এই চাওয়া •••
সুচেতনাকে সবুজ চিঠি
সুজিত মুখোপাধ্যায়
সুচেতনা- চল আজ একটি বার হেঁটে আসি সবুজ ঘাসে যেটুকু বেঁচে আছে আজও।
নীল ডানার ঘাস ফড়িং ধরি
প্রৌঢ় চামড়ার হাতে, যেটুকু বেঁচেবর্তে আছে।
পোয়াতি মেঘের পাশে খুঁজি,
চিকন কৃষচূড়ার পাতার ফাঁকে দু একটা লাল।
বেগুনি জারুল খোঁপা বাঁধ একটিবার।
সবুজ খেয়ে -খেয়ে ক্ষয় রোগ আমাদের ঘিরে।
তোর সেগুন দরজায় শাঁখ বাজানো পরী ডানায়,
স্যাঁতলা পাপের ছোপ।
মেহগনি সাজ আয়নায় - তোর পাশে মুখ দেখে একটা ময়াল।
সাজুগুজু সরীসৃপের জড়ানো পেঁচানো ক্ষিদে।
হাতে কুড়ুল ধরতে শিখেই
প্রথম কুপিয়েছি সবুজ নরম বুক-।
মাটির কোলে সে আমাদের আদিম পাপ।
চল আজ একবার সবুজকে চুমু খাই।
জড়িয়ে ধরি শাল গাছের গুঁড়ি।
যেমন জড়িয়ে ছিলাম তোকে প্রথমবার।
কেটে ফেলা গাছের বর্ষবলয়ে খুঁজে দেখি
কত আবর্তে জমে আছে আমাদের পাপ।
সুচেতনা- রুখা মাটিতে আমাদের সাথে বাসর জাগবে না আর কোনো নদী - গাছ আর নক্ষত্র।
নোয়ার নৌকা বাঁধার বিশ্বাসী চর নেই এ মাটিতে।
একটিবার তুই চিঠি খুলে দেখিস---
এতোদিন ভুল পথে হেঁটেছি আমরা।
তোর মেহেদি হাতে শুঁকে দেখ ঘাতকের গন্ধ ।
সবুজ গঙ্গা ফড়িংয়ের ডানা ছিঁড়ে,
নপুংসক আমি সাজিয়েছি হরিণের শিং আর বাঘ চামড়ার দেওয়াল।
ভুলে গেছি সেই শমী গাছ ; যেখানে লুকানো আছে
ক্ষত্রিয় অর্জুনের গচ্ছিত বেঁচে থাকা মন্ত্র আর অস্ত্র।
আজ এই অন্ধকারে-
পথ খুঁজে চিনে নিই ধ্রুবতারা।
হাঁটতে হাঁটতে ঠিক পৌঁছে যাবো হামাগুড়ি গুহার মুখে ক্লান্ত শুয়ে থাকবো ছায়া ছায়া সবুজের কোলে।
ধুলোর দুর্গা
স্বপ্না ভট্টাচার্য
পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের
কার্যত কোণঠাসা করে
আকাশের দখল নিচ্ছে জলভরা মেঘ।
ভিজিয়ে দিচ্ছে ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা অতীত।
ভিজিয়ে দিচ্ছে গার্হস্থ সুখ,
ফুটপাতের ওপর সাজানো পসরা।
কাচের শোকেসে সাজানো ঝলমলে পোশাকের
দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা বিস্ময়ের দৃষ্টি
আমার দুর্গার।
ভিজছে… ভিজছে…
অন্তর নাকি বাহির ধারায়!
বোতামহীন তস্য নোংরা জামাটা
কাঁধ থেকে নেমে যাচ্ছে বারবার!
এক হাতে ধরা উদোম-শরীর ভাইয়ের হাত,
কোমর থেকে প্যান্ট নেমে যেতে যেতে
সামলে নিচ্ছে!
ক্ষুধার্ত পেট পড়ে রয়েছে,
চোখ-নাক বহতা গঙ্গা।
আমার দুর্গার শীর্ণ আঙুল পথচলতি মানুষদের টোকা দিচ্ছে আলতো করে,
ফিরে তাকালেই ভাইকে দেখিয়ে হাত পাতছে।
একটা কয়েন!!!
ভাইকে নিয়ে ফুচকা ওয়ালার সামনে।
একটা ফুচকা, একটুখানি আলু ছুঁইয়ে,
আস্তে আস্তে ভাইকে খাইয়ে
আঙুল বেয়ে নেমে আসা টকজল
চাটছে দুর্গা,
দুচোখে তৃপ্তি।
দুটো অন্ন দানা যেভাবে তৃপ্ত করেছিল
বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে।
দুর্গা এভাবেই লজ্জা ঢাকে একহাতে,
অন্য হাতে ক্ষুন্নিবৃত্তি!!!
হায় একুশ শতক!!!
জল তরঙ্গে বিষাদের সুর মাখা
তুলি মুখার্জি চক্রবর্তী
জল তরঙ্গে বিষাদের সুর মাখা
প্রৌঢ় চাঁদ একলা দাঁড়িয়ে ঠায়
সন্ধ্যা নামলে আলোর মরীচিকা
বহ্নিশিখা এখানে অসহায়
জলের বুকে মুখ দেখে সব আলো
একতারাতে সন্ধ্যারাগের তান
ঢাকা পড়ে যায় বাঁকা সাঁকোর কালো
ওয়াট মাপে রূপোলী শিরস্ত্রাণ
হালকা দোলায় ভেঙে যায় অপলাপ
পটের বিবির পটিয়সী যত রঙ্গ
ধারাল যন্ত্র মোড়ানো কিংখাপ
মানুষ মেশিন একে অপরের সঙ্গ
স্বর্গীয় রূপ কখন যে আঁটে ফন্দি
নরক দৃশ্য সোনালী মায়ার জালে
মুঠোফোনে ধরা সকলেই রাজবন্দী
স্বীকার করেছে শিকারী কোন কালে??
হৃদয়পুরের সন্ধানে
মৌসুমী পাল
শপথ করে আমি একটা বাড়ী কিনেছিলুম
নাম দিয়েছিলুম "হৃদয়পুর"।
প্রতিদিনের সিকি আধুলি আনা জড়ো করে করে
সঞ্চয় করেছি মনোবাক্সে।
যন্ত্রণা লাঞ্ছনা গঞ্জনা ক্রোধ অপমান দিয়ে
ভাত মেখেছি দুটিবেলা। তবু …..
মায়ের আশীর্বাদী ফুলে ভুল দেখিনি কখনও।।
নিজেকে দারিদ্রতা দিয়ে ঢাকি নি
কেন জানো ?…….
মায়ের আঁচলে ছিল যে ভালোবাসার বীজমন্ত্র; সেই-
একটা শিউলি ফুল বুকে করে শিখেছি পেলবতা।।
আমি বিশ্বলোকের ডাক শুনেছি হাজার চাবুকের ঘায়ে।
দুঃখের বুক চিরেই বের করে এনেছি মিলনের নির্যাস।
দুখেরে নিত্য করেই মনে চাষ করেছিলুম মাধুকরী প্রেম।।
বিশ্বচরাচরের বিরাট পাঠশালায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমিই
হয়ে গেলুম ….রাজার রাজা রাজভিখারী!!
শানিত হাতের ধারালো অস্ত্রের অঙ্গারে এখন
অনুশোচনার ম্রিয়ময়তা।
মজা নদীও হয়েছে বেগবতী।
শত শত বিভেদী মানুষও তাই দলে দলে
চাক্ বেঁধেছে হৃদয়পুরে।।
মনুষ্যত্বের বর্ণপরিচয়ে হৃদয়পুর মনোবাসায় এখন তাই
প্রতিনিয়তই ঝরতে থাকে -
মৌচাক নিসৃত মাধুকরী রস।
বিশ্বমানবের ভালোবাসা নামক মাধুকরী আঁঠালো রস।।
এ আমারই জমানো সিকি আধুলি আনা পয়সার কাজ।
এ যে আমার সমগ্র জীবন।।
ওরা হাসে
কবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
হাড় জিরজিরে চেহারা
অন্ধকারে প্রায় কঙ্কাল মনে হয়
অথচ প্রবল জীবনীশক্তি আর অদম্য ইচ্ছায়
ওরা কাজ করে…..
খাবার বলতে শুধু পান্তা আর লঙ্কা
পেঁয়াজ কখনো কখনো,
নুন এর অভাবও যে হয় না তা নয়
তবুও মুখে হাসি;
চোখের জল কখনো চিকচিক….
উদয়াস্ত রোদে জলে শুধুই খাটুনি
দু'চার কলি গান গেয়ে ওঠে আকাশে মেঘ হলে…
একটু ভালোবাসাও জাগে বৈকি!
যখন শুধু শাঁখা পরা দুটি হাত
আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দেয়
পরম যত্নে পান্তা বেড়ে দেবার সময়….
ওরা কাজ করে, ওরা জানে
ওদের শুধু কাজ করে যেতে হবে…
ওদের পেট ভরে খেতে নেই,
ওদের ফলানো অন্ন
কেবল অন্যের জন্য….
তবুও ওরা হাসে, ওদের চোখেও স্বপ্ন জাগে
যখন কচি কচি মুখগুলো
দাওয়ায় বসে স্লেটে আঁক কাটে
অ আ ই ঈ…..
ভাদ্রমাস
দেবযানী ঘোষাল
জন্মেছিলি ভাদ্রের কোন এক দিন।
সেদিন কি মেঘ ফাটা বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছিল ধরণীর শ্রাবণ ভেজা মাটি?
শুষেছিল জল নিজের বুকে সে মাটি
অনেক অনেক দিন পরে?
হস্তরেখায় মেঘে ঢাকা রবি ছিল বুঝি বড্ড অভিমানী?
তাই অসময়ে ঝরে যাওয়া পাতারা পুষ্করিনীতে দেখেছে আমরণ যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি?
হয়তো তাই।
হয়তো কেন? নিশ্চিত তাই।
ভাদ্রের নানা রঙের জমাটি মেঘের বুকে জমে থাকা বোবা কান্নার অর্থ বোঝে কজন?
জন্মের ভুলে দোষ দেয় সে নিজেকেই।
তাই জমিয়ে রাখে অগাধ জল ঋতু বৈচিত্র্যে অপ্রয়োজনেও ঝরাবে বলে।
বুকের ব্যথা হাল্কা করার অকৃত্রিম নেশার সুখে।
জন্মমাসের নিত্য রঙিন মেঘেরা তাই
ভিজিয়ে রাখে নতুনত্বের দাবি নিয়ে হঠাৎ তপ্ত মাটির অসহ্য মনটাকে।
উড়ে উড়ে যায় মেঘ কখনো কখনো তুলো তুলো আবেশে,
নীলাকাশের স্মৃতি আগলে।
শরতের আনন্দ বার্তা বইবে বলে।
সবজে গালিচায় শিশু কাশগুলো যে তাই বলে যায় বারেবার।
তবু তো ভাদ্রের দুঃখ বোঝে না কেউ।
কাঁচা বাঁশে ভ্রমর খেলা করে।
অপেক্ষা করে উপেক্ষা জন্মসুখকে আঁকড়ে ধরে।
সে যে ভালবাসার দুত,
জানে কান্না আগলে রাখতে।।
সোনালি দিনের সোনালি তন্তু
সুজয় বিশ্বাস
বছর ঘুরে আবার এলো বৃষ্টি সাথে বর্ষাকাল,
টাপুর টুপুর মধুর সুরে মন হলো উত্তাল৷
জল জমেছে পাটের খেতে দুলছে তাদের মাথা,
পাট চাষীদের মুখে হাসি, নেই যে মাথায় ছাতা।
সোনালি আঁশে পড়বে আবার নতুন করে টান,
আকাশ এখন কাঁদবে আবার, নদে হবে বান।
টানের তালে দুলে ওঠে ডোবার জলের রাশি,
কৃষকে গায় গান আর রাখাল বাজায় বাঁশি।
ডোবার জলের ব্যাঙগুলো আজ আনন্দেতে খেলে,
পেশির টানে সোনালী আঁশ ধুয়ে নিচ্ছে জলে।
ঘুর্ণিটানে জলকণারা আঘাত করে কুলে,
পাট যে ছিলো সব বাঙালির অর্থনীতির মূলে।
সোনালি সে দিনগুলো সব হল বিসর্জন,
পাটকে আপন করে করো প্লাস্টিক বর্জন।
রচি গেহ গগনে
কাকলী বসু
বৃক্ষ জঠর পর্বত গহ্বর
আদি বাস মানবের
ক্রমে গ্রাম নগর জনপদ শহর
রচিল নাশি বৃক্ষের।
অট্টালিকা রাশি বনানী গ্রাসি
আছে করি উচ্চ শির।
শক্ত ইমারত ঢাকিছে জগৎ
দিবসেও গ্রাসে তিমির।
তবুও নীল গগন হরে লয় মন
স্বপ্নে মেলে দিই ডানা।
মনে মনে হায় হারাতে কোথায়
নেই কো তো কোন মানা।
ত্যাজিয়া প্রাসাদ মনে হয় সাধ
আকাশেতে যাই উড়ে
নীল আকাশেতে মেঘেদের দেশে
থাকিব আপন নীড়ে।।
একই বৃন্তে দুটি কুসুম
নিভা চাকলাদার
একই মায়ের কোলে জন্মেছিলে দুটি ভাই
কেমনে বিস্মৃত হলে মধুর সম্পর্ক, ভাবি তাই।
মায়ের কোলে, মায়ের বোলে,
বেড়ে উঠছিলে দুটিতে হেসে খেলে-
বাংলা মায়ের তোমরা দুটি সন্তান,
হিন্দু ও মুসলমান।
ভিন দেশী বণিকেরা এসেছিল বানিজ্য সন্ধানে,
ধীরে ধীরে রাজপাটে বসে শাসনে।
ধন দৌলত লোটে, পাচার করে স্বীয় দেশে ধীরে,
শস্য শ্যামলা বাংলা মাকে একদিন নিঃস্ব করে ।
দু ভাই এর মধ্যে জাতি বিভেদ বাধায়,
আপন স্বার্থ সিদ্ধ করে বিদেশী, অবহেলায়।
ভাই এ ভাই এ দাঙ্গা, মাকে ভেঙ্গে করে খন্ড খন্ড,
সুখের ঘর দুয়ার ধ্বংস, হয় লন্ড ভন্ড।
সন্তানের শোনিত ধারায় মা হলেন সিক্ত,
পথে ঘাটে শত শত সন্তান অভুক্ত।
মায়ের প্রাণে এ দুঃসহ যাতনা দুটি সন্তান এর শিরায় শিরায়
একই রক্ত বহমানা।
কেন মিছে এই রক্ত ঝরা দাঙ্গা হাঙ্গামা,
শুভ বুদ্ধি কি আর কভু জাগিবে না!
মোহময়ী চিলিকা
শিবানী চৌধুরী
মোহময়ী চিলিকায় সোনা রোদ ঝলকায়
মহিষের খুরে যেন বোল ওঠে লহরায়।
দূর ওই আকাশে কোন মেঘ হাসে আজই
বাতাসেরা বয় যেনো তুলে সুর পাখোয়াজে।
ঢেউগুলি কেঁপে কেঁপে ওঠে কার পরশে,
ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি রাঙা রোদ বরষে।
খুশি খুশি মন নিয়ে ভটভটি চড়ি সবে
আনন্দ কলতানে স্মৃতিটুকু পড়ে রবে।
মনলোভা সুন্দরী চিলিকা মনোহর
দেখিতে তোমার রূপ আসি ফিরে ফি বছর।।
অভিমান
কাবেরী রায় চৌধুরী
মনের ঘরে বসত করে অভিমানের পাহাড়
চোরাবালির ঝিনুক বুকে ব্যথা
চোখের জলের মূল্য বোঝে ক'জন
হৃদয়ে বালির বাঁধ সীমান্তরেখা টানা
অভিমানী মনে মেঘের ধূসরতা
বুকে জমাটবাঁধা রক্তের কালশিটে দাগ
পাহাড়প্রমান উচ্চতায় ঝিঁঝির ডাক
মেঘেদের আনাগোনা অবাধ
অভিমানের পারদের ওঠানামা
দৃষ্টিতে শ্রাবণের অজস্র ধারাপাত
পাহাড় থেকে ঝর্ণা যেন পায় দুর্বার গতি
মনের প্লাবন অধর বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে কন্ঠার কার্ণিশে।
চলাচল
টুলা সরকার
মধ্যগগন ছেড়ে ক্রমশ পশ্চিমে ঢলে পড়ছে রবির উজ্জ্বলতা,
সময় গেছে চলে বহুবছর পিছনে ফেলে,
প্রায় মধ্যজীবন আগত নিশানায় সতর্ক।
শুষ্কপত্র ঝরে পড়ার শব্দে আতঙ্কিত।
সিঁড়ির ধাপ শেষের দিকে ধাবিত।
পরপারের জগতের তরে প্রতীক্ষা।
যেতে হবে বহুদূর অজানা অচিনপুর।
ফুরাবে জীবনের দায়,শূণ্য হাতে যেতে হবে ফিরে।
অন্তরীক্ষ, নদী-সাগর,পাহাড়-পর্বত কাননের সৌন্দর্য
পরিবার-স্বজন, বিলাস-ব্যসন সব থাকবে পড়ে
এটাই জীবন!
শুরু থেকে শেষের এক অবধারিত বৈচিত্র্যময় পথে চলা।
দেবী
ব্রতশ্রী বোস
তাচ্ছিল্যই দিচ্ছে ছুঁড়ে দুচোখ নিরুত্তাপ ...
রোদেলা দিন, এখন গায়েব প্রবল নিম্নচাপ
নিশুত রাতে স্বপ্ন বুনে ঘুমিয়েছিলিস ভোরে
শিশির ছোঁয়া শীতল পেলব ইষ্টিকুটুম ডোরে
সকালবেলায় টেক্কা খুঁজিস ইস্কাপনের বিবি
যতই ভাবিস শোধ নিতে তোর বিষের ছোবল দিবি
প্রেমিক তোমার ভয়ডরহীন, আহ্লাদে আটখানা
বীণ বাজিয়ে বশীকরণ উপায় যে তার জানা!
বেহুলা তার ভেলা ভাসায় ওই গাঙুরের জলে
ইন্দ্র খোঁজেন দাবার গুটি মেঘের শীষমহলে
দেবাঙ্গনে নাচেন সতী, পায়ে ঘুঙুর বাঁধা,
কিসের বলো এ দোলাচল, এ নয় কোনও ধাঁধা
তবুও তো তুই দাঁড়িয়ে থাকিস বিষজর্জর রাতে
জানুসন্ধির রক্ত মুছে কাতরাতে কাতরাতে ....
পায়ের ঘুঙুর খুলতে পারিস, শিকল কেন নয়!!
কন্যেরে তোর কিসের এত বাঁধন, চোরা ভয়??
লক্ষ্মী সাজিস লালশাড়িতে, সিঁদুরকৌটো, কড়,
বেহুলা তুই, রাধাও যে তুই, ভাসানভেলায় জ্বর
কালীরূপে করতে পারিস অসুর নিধন, নাশ,
এবার হবে বোধন যে তোর এবং অধিবাস!!
দশমাস তোর গর্ভাশয়ে ধারণ করিস বিশ্ব
শুম্ভ এবং নিশুম্ভরা করছে তোকে নিঃস্ব ...
গুঁড়িয়ে দিবি, পুড়িয়ে দিবি স্পর্ধা এবং দম্ভ
রাক্ষসকুল পিঠটান আর নেহাত হতভম্ব!!!
দুর্গা হয়ে আশ্বিনে তুই আসিস যে দশহাতে
তবু কেন ধর্ষিতা হোস প্রত্যহ মাঝরাতে!!
পায়ের নূপুর খুলতে পারিস, এবার শেকল খোল
আর কতদিন কাঁদবি রে তুই?
ত্রিশূল হাতে তোল!!
প্রদর্শক
মানবেন্দ্রনাথ দত্ত
রোদ্দুরের পথ ভেঙে আসো বলে
তোমাকে আলো দেখাতে হয় না
এক বাঁক থেকে আর এক বাঁকে
মন্বন্তরের প্রতীক্ষায় থাকি।
সূর্যাভাসের কথাগুলো ভুলে গেল তারা
ঊষর প্রহর চলে রাশি রাশি
বাসী প্রলাপের সঙ্গে
দিগন্ত-কাঁপানো কটু সংবাদ আর
পিনদ্ধ কালো গল্পে শিশুরা নিঃশব্দ
কোথায় তোমার প্রসারিত উদ্বেলতা!
খানিকটা রোদ্দুর দিলে
শ্মশানে সবুজের খেলা শুরু হবে
খানিকটা রোদ্দুর দিলে
ভস্মস্তূপে উত্থিত হবে
প্রেমজ সাধনা।
খানিকটা রোদ্দুর দিলে
ইতিহাসের পাতা ওলটাবে
পাতার ইতিহাস বদলাবে
বদলের ইতিহাস আসবে
উচ্ছ্বাসের কথকতা নিয়ে
প্রত্যাশার রঙ্গিলা তরী ভিড়বে
জলনূপুর বাজিয়ে অভাবী দুয়োরে।
তোমার জন্য তাঞ্জাম সাজিয়ে রেখেছি।
এ নয় মুছে যাওয়া ক্ষণ
নীলাঞ্জনা মিত্র
ঐ দূরে গোধুলিঝড়ে আবছায়া পান্ডুর দিগন্ত
ধূসর খয়েরি দ্বীপ কিছুটা সবুজ জলঘাসে,
দিন শেষে ঘরে ফেরা যাপিতজীবন শ্রমে ক্লান্ত
তবু চেকনাই কম নয় কিছু, নধরকান্তি কখনো ধোঁকেনা স্তিমিত শ্বাসে।
ফেনার উত্তুঙ্গ শির সবুজাভ জলমগ্ন ফাইটোপ্লাংটনে নাচে আশেপাশে,
জল তীর বেলাভূমি বদ্ধপরিকর সীমাহীন অস্তিত্বের রূপবার্তা দিতে,
ঘরে ফেরা সূর্যও শেষ শক্তি দিয়ে অহঙ্কারটুকু আঁকে বাসন্তী সে ক্যানভাসে,
কোন জাদুকর পারে বলো দিনটাকে বেমালুম লুকিয়ে ফেলতে!
পান্থ-পিটুনিয়া সংবাদ
শক্তি প্রসাদ ধর
অচেনা অদেখা তুমি নাও ভালোবাসা,
কখনো হয়নি দেখা, চেনা ভাসা ভাসা।
দৃষ্টিতে ছুঁয়ে দিলে হৃদয় যে কাঁপে
তৃষিত মন ভেবে সিক্ত করো যাঁকে।
তোমার রূপেতে মুগ্ধ আমি, পথ ভুলেছি,
তোমার দেশেতে আজ পা রেখেছি।
কানে কানে বলে দাও কি তোমার নাম?
হে পাহাড়ি কন্যা,কোথায় যে ধাম?
হে পথিক বন্ধু, তুমি জিতেছো আমার মন,
এসেছো মেঘপাহাড়ে করতে ভ্রমণ।
স্বাগত জানাই আমি দল মেলিয়া
আমি যে নগন্য এক পি …টুনিয়া।
ছুটছে যারা
কল্পোত্তম
এই যে এতখানি পথ
হেঁটে এসেছো সারি সারি
আকাশের নিচে
এরও এক বিদগ্ধ ইতিহাস রয়ে গেল
খুরিদের চাপে।
মিশে গেল পথের ধুলায়।
আকাশ হাসছে।
সূর্যের বিদায় বেলায়
গাছেদের সারি
হারিয়ে যায় ষষ্ঠপদী আঁধারে আঁধারে।
ছুটে চলো
উঁচিয়ে রেখে শিং
অগুনতি নক্ষত্রের দিকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন