গল্প


সমুদ্র

সর্বাণী রিঙ্কু গোস্বামী

ওরা চলে যেতেই চাদরটা সরিয়ে লাফ দিয়ে উঠলাম, সমুদ্র আমাকে দেখতেই হবে এক্ষুনি। সমুদ্র....তার নীঈঈঈল জল আর সাদা সাদা ফেনা সঙ্গে নিয়ে আকুল ঢেউয়ের ছুটে আসা। যেদিন থেকে এখানে এসেছি, সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলে তখন তার আওয়াজ পাই। ভীষণ ডাকে আমাকে ... বলে আয় আয় আয়! খালি এই সাদা সাদা বোবা দেওয়াল গুলোর ভেতরেই শুয়ে থাকবি? কত কথা আমার জমা আছে তোকে বলব বলে!"

টানা একটা বড় চৌকো বারান্দা আর সবুজ ঘাসের লন পেরোলেই দেখতে পাই সারি দিয়ে নারকেল গাছ। তারপরই নিশ্চয়ই সে ...নীল নীল আর নীল শুধু, আমি জানি খালি টুক করে এইটুকুনি পেরিয়ে যেতে পারলেই ব্যাস্।

এতক্ষণ ওরা বিষন্নগলায় ফিসফিস করে কি সব যে বলছিলো, আমি কিচ্ছুটি শুনিনি, শুনিও না আজকাল। যত রোগ আর ওষুধের হবিজাবি ফিরিস্তি। সাদা পোশাকে নার্স দিদি আসে বারেবারে, হাসিমুখ দেবদূতী যেন। কী মিষ্টি করে যে কথা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু কি যে তেতো ওষুধগুলো আর কি অসম্ভব ব্যাথা লাগে ইঞ্জেকশনে। আমি কুঁকড়ে যাই ভয়ে ব্যথায়, তখন আমার আর কিচ্ছু ভালোলাগে না।

আজ ওরা কেউ নেই দেখে ফাঁক পেতেই দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে পড়ি, কোথায় তুমি সমুদ্র কত দূর?সেরে উঠলেই আমি ঠিক দৌড়ে গিয়ে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বো। সারা গায়ে মাখবো তোমার আদর-ফেনা। তুমিই ধুয়ে দিতে পারবে আমার সব অসুখ সব যন্ত্রণা, আমি ঠিক জানি ।

গির্জার ঘন্টা আমাকে চমকে দেয় , ঢং ঢং ঢং। এখনই আমাকে বেডে ফিরতে হবে নাহলে নার্সদিদি এসে হইচই লাগিয়ে দেবে। ঘরে ফিরে আমার বিছানাটা খুঁজি নম্বর ধরে ধরে। একি ......আমার বেডে মুখ ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে কে ওটা?

আমার বেড টা কোথায় গো, আমার বেড টা???




প্রসাদ

শিবানী বিশ্বাস

সেজতরফের গোপালের আজ জন্মদিন। ভোর হতে না হতেই কত আয়োজন! ভোরের বাল্য থেকে শুরু করে রাত অবধি নানান সময়ে রকমারি ভোগের ব্যবস্থা। ননীবালা হা’ করে তাকিয়ে দেখে আর সেজ-মা’র রান্নার সময় হাতে হাতে এটা সেটা করে দেয়। ফুলের দোলনায় গোপাল নাড়ু আর বাঁশি হাতে বসে দুলতে থাকে। কী রাজকীয় বেশ! ননীবালার চোখ আটকে থাকে। কী ভালো যে লাগে ! ভাবে তার গোপালটা যদি এরকম একটু জামা পেত ! সে-ই তো শাড়ি বা বিছানার ছেঁড়া চাদরের তৈরি দোলনায় দুলেই বড় হয়ে গেল ওর নাড়ু। সেজ-মা আর বড় তরফের থেকে যে জামা পেয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ননীবালাকে।ইচ্ছে থাকলেও পরাতে পারেনি ভালো জামা। দোকানে ঝোলানো জামাগুলো দেখে লোভ হয়েছে কিন্তু পারেনি দামের কথা ভেবে। খাওয়াতেই পারে না ভালো-মন্দ, তার উপর জামা-কাপড়! এই ঠাকুরঘরে ওর ঢুকতে খুব ইচ্ছে হয়। ও যখন পাশের ঘরগুলো মোছে এই ঘরটা থেকে কী সুন্দর গন্ধ বেরোয়। জ্বলা ধূপ, ফুল, চন্দন, ধুনোর গন্ধ মিলেমিশে ওর ভেতরটা ভরিয়ে দেয়। একমুহূর্তের জন্য ভুলে যায় ও ছোটজাতের, ও ননীবালা, নাড়ুর মা। সেজ-মা লুচি ভাজছে। লুচি ভাজার গন্ধে ভেতরটা আকুল হয়ে উঠছে।গতবছর খাঁটি ঘিয়ে ভাজা একটা লুচির মধ্যে একটু হালুয়া দিয়ে প্রসাদটুকু সেজ-মা যখন হাতে দিয়েছিল, প্রাণে ধরে খেতে পারেনি। নাড়ুটার জন্য নিয়ে এসেছিল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল ওর নাড়ুগোপালের খাওয়া। সেজ-মা‘র গোপালের সামনে কত খাবার! কিন্তু দেওয়ার সময় এইটুকুনি। অথচ নিজেদের বাড়ি বা যারা পুজো দেখতে এসেছে তাদের প্লেটে করে প্রসাদ দিচ্ছে। লুচি, হালুয়া, ছানা, ফল, মিষ্টি, নাড়ু , তালের বড়া, মালপোয়া — কত কী! ওকে দেওয়ার সময় হাতের মধ্যে একটা লুচির মধ্যে একটু হালুয়া, একটা নাড়ু , দু’টুকরো ফল! তালের দিনে বড়াটুকুও দেয়নি সেজ-মা। অথচ ছ’খানা তাল ওই তো ঘষে দিল! কিন্তু এটুকুই বা মুখে দেয় কী করে ? নাড়ু আছে যে ঘরে,ও খায় কী করে ? হাতের মধ্যে প্রসাদটুকু দিয়ে সেজ-মা বলে দিল বিকেলে কাজে তাড়াতাড়ি আসতে। ‘সেজ-মা একটু ছানা দেবে ? নাড়ুকে দিতাম।’ উত্তর না দিয়ে সেজ-মা ভেতরে চলে গিয়েছিল ।

বিকেলে কাজে এসেছে ননীবালা। রাতের খাবার রাখা হয়েছে গোপালের সামনে। ছানা দেওয়া হয়েছে এখনও। প্রসাদ হিসেবে একটা মিষ্টি দিলে ননীবালা আবার বললো, ’রোজ প্রসাদ থেকে একটু ছানা দেবে সেজ-মা নাড়ুর জন্য? ওর একটু পুষ্টি হতো!’ সেজ-মা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,’ প্রসাদী ছানার জলটা রেখে দেব। ওতেও সমান পুষ্টি।কাল থেকে একটা কিছু আনিস, ভরে নিয়ে নাড়ুকে দিস। এই ছানাটুকুই তো আমিই প্রসাদ হিসেবে খাই। যা যা ... কাল সকাল সকাল আসিস কাজে ।’

পরদিন ছানার জলটা সেজ-মা ঠাকুরঘরের বাইরে বের করে দিলে নাড়ুর মুখটা মনে করতে করতে ননীবালা একটা কৌটোর মধ্যে যত্ন করে ভরে নিল শেষবিন্দুটিও নষ্ট না করে।





খাঁচার পাখি

বিকাশ গুঁই

নামজাদা ব্যারিষ্টার অনিমেষ দত্তের একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতা। গাড়ীতে করে কলেজে যায় আসে। বিশেষ কিছু বন্ধু বান্ধব ছাড়া কেউ বাড়িতে আসে না অনিন্দিতারও কারও বাড়িতে যাওয়ার পারমিশন নেই। গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবার।

অনিন্দিতার একদম ভালো লাগে না। বন্ধুরা কত ফ্রি। সবাই বাড়িতে যেতে বলে। ওদের বাবা-মা কত লিবারাল। সেদিন মনিকা বলল,আয় না একদিন আমাদের বাড়িতে। মা তোকে অনেক করে যেতে বলেছে।

মনিকাদের অবস্থা তত ভালো নয়। বাবা রিটায়ার্ড স্কুল টিচার। মনিকা কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। প্রাইভেট টিউশন নেই। একটা কোচিং সেন্টারে পড়ে। বাকিটা বাবাই দেখিয়ে দেয়। আর অনিন্দিতার প্রতিটা সাবজেক্টেই প্রাইভেট টিউটর। সবাই বাড়িতে পড়াতে আসেন। অথচ বন্ধুদের সঙ্গে কোচিংএ‌ যেতেই ওর ভাললাগে। এই বন্দীজীবন ওর একদম ভালো লাগে না।

সেদিন ‌মনিকা ওদের বাড়ির‌ পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েই ছুটে গেল বারান্দায়...বলল, মনি, আয় না।
মনিকা বলল, না রে ! এখন যেতে পারব না। ওর সঙ্গে ছিল‌ মামাতো দাদা। নিচ থেকেই পরিচয় করিয়ে দিল। 
আমার অর্ণবদা। গ্রামে বাড়ি। 
আমাদের বাড়িতে এসেছে।‌
তাই একটু শহরে ঘুরতে বেরিয়েছি। জানিস, অর্ণবদা এবার থার্ড ইয়ারে ডিস্টিংশান পেয়েছে। হেসে নমস্কার বিনিময় করল ওরা।

আজ রবিবার। মনিকার আসার কথা। ভাবতে ভাবতে কলিংবেল বেজে উঠল।
অনিন্দিতা দরজা খুলেই অবাক !
- আরে অর্ণববাবু, আপনি ! মনিকা আসেনি ?
- না। মনিকার শরীরটা ভালো নেই। তাই আপনার খাতাটা আমাকে দিয়েই পাঠাল। 
- ঠিক আছে। ভেতরে আসুন।
- না, ভেতরে গিয়ে কি করব ! তার চে' চলুন, ঐ মাঠে গিয়ে বসা যাক। আপনাদের বাড়ির সামনে এত সুন্দর মাঠ !
- না, মানে ...মা যদি আমাকে দেখতে না পায়, তাহলে রাগারাগি করবে।
- কেন, রাগারাগি করবে কেন ? আপনার বাড়ির পাশের মাঠেই তো আছেন। ডাকলে, সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে পারবেন।
- তা ঠিক। তবে...চলুন ...

জীবনে এই প্রথমবার। খোলা মাঠে এক অপরিচিত কারুর সঙ্গে গল্প করা। গল্প করতে করতে কমলা‌ বিকেল মিশে যায় পশ্চিম দিগন্তে। ঝিঁঝিঁর ডাকে সন্ধ্যা নামে। গল্প আর শেষ হয় না। অনিন্দিতা মশগুল হয়ে যায়।
অর্ণব বলতে‌ থাকে ...সবুজ ছায়াঘেরা নদীমাতৃক গ্ৰামের কথা। চড়ক, দোল, গাজন, বসন্ত উৎসবের কথা। অনিন্দিতা অভিভূত।

যাবার সময় অর্ণব বলে, একবার সময় করে মনিকার সঙ্গে যাবেন আমাদের বাড়ি। একটা দিন নিশ্চয়ই ‌আপনার ভালো লাগবে।

মাসখানেক পর একদিন মনিকা‌ বলল, সামনের রবিবার মামার বাড়ি যাব। বসন্ত উৎসবে অর্ণবদা যেতে বলেছে। তোর কথাও‌ বলেছে। 

খবরটা পাওয়ার পর থেকেই অনিন্দিতা ঘরের মধ্যে ছটফট করছে... কী যে চায়, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। একটা টান অনুভব করছে। কে যেন বাড়ির বাইরে ওকে টানছে। কিছুতেই কোন কাজে, পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। কয়েকটা দিন কেটে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, আজই তো সেই রবিবার। সঙ্গে সঙ্গে মনিকাকে ফোন করে বলল ...
- মনি, তুই কখন বেরচ্ছিস ? 
- এই তো ...
- আমি আসছি, তুই দাঁড়া।
- মানে ! তুই যাবি আমার সঙ্গে ? অর্ণবদার বাড়ি ?
- গিয়ে সব বলছি। 

আজ ও মরিয়া। চেঁচিয়ে মাকে বলল, মা আমি আসছি ...
- কোথায় যাচ্ছিস ? 
- মনিকাদের বাড়ি। 
- মানে ! কেন ? দাঁড়া, শোন...তোর বাবা ...

- মনি, মনি দরজা খোল। আমি এসেছি।
- আয় অনি। তুই ‌মাসিমাকে বলে এসেছিস তো ? মানে, ক'দিন থাকবি ? কবে ফিরবি ?
- না রে মনি, তাহলে তো আর কোনদিনই বেরোতে পারব না রে ! আমাকে তুই নিয়ে চল মনি।
এমনি করে খাঁচার ভেতর থাকলে আমি ঠিক মরে যাব রে ! তুই আমাকে বাঁচা।
- মনির চোখে জল। অনির মাথাটা কাঁধে‌ টেনে নিয়ে বলে, ঠিক আছে চল।

" খাঁচার পাখি চলল বনে ....
    মিলবে বলে, বন পাখিটার সনে।'




খুঁজে ফিরি তারে

অশোক কুমার মোহান্ত 


আমার যে সব দিতে হবে, সে তো আমি জানি ...

 গুন গুন করে গাইতে গাইতে এঘর ওঘর করছিল মৌবনি। গুছিয়ে নিচ্ছিল আনুষঙ্গিক সরঞ্জামগুলো। গানের খাতা, ব্যাগ ইত্যাদি। ভীষণ ব্যস্ত। কলেজের ফ্রেশার্স ওয়েলকাম এ তাকে উদ্বোধনী গাইতে হবে। সঙ্গে তবলা সঙ্গতে থাকবে সৌভিক। ওদের ক্লাশের-ই। দুজনই দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে কলেজে। মনের বনে হাজার ভ্রমরের গুঞ্জরণ। রঙে রঙে মাতোয়ারা। মৌবনিদের দায়িত্বটা বড্ড বেশী। ওদের সময়েও হয়েছিল। এমনই মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে ওদের ও নবীন বরণ। এটাই কলেজের রীতি। প্রথম বর্ষের আগন্তুকদের সাদরে গ্রহণ করা। ফুল-চন্দন-মিষ্টি-মুখে আপন করে নেওয়া। আপন করে নেওয়া আলাপচারিতায়। নবীন বরণের অনুষ্ঠানে সবার পরিচিতি ও কার কি শখ তারই সালতামামি। সেখানেই মৌবনি জেনেছিল সৌভিক তবলা বাজাতে পারে। অজানা শিহরণের তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেছিল মৌবনির শরীর জুড়ে। সেও জানিয়েছিল তার হবি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া। পরিচয় পেয়েছে পরে সৌভিকের দক্ষতার । 

সত্যিই ভালো  বাজায় সৌভিক। লহরার ঢেউ তুলতে ওর মতো কাউকে দেখেনি। আঙুলগুলো কি অনায়াসে খেলা করে বাঁয়া ডুগির উপর। কি সুস্পষ্ট ঠেকা দেয়‌ । কি নৈপুণ্য! বোল তোলে কাটা কাটা। মৌবনি ওর তবলায় বার দু'য়েক গেয়েছে। অন্য মাত্রা দেয় তবলার বোলে। দর্শক সম্মোহিত হয়ে প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেরামতের কেরামতি দেখবার জন্য। 

সেবার কলেজে রবীন্দ্র জন্মোৎসবে মৌবনি গেয়েছিল , "হে নূতন দেখা দিক আরবার....।" সৌভিক বাজিয়েছিল তবলা। কাহারবা তালে মাতিয়ে দিয়েছিল। গানের পরে মৌবনির প্রশংসার চেয়ে সৌভিকের তবলার প্রশংসা পেয়েছিল বেশী। ধীর লয়ে কি অসাধারণ বাজিয়েছিল! মৌবনি ও এক অজানা খুশিতে টইটম্বুর হয়েছিল সৌভিকের প্রশংসায়। ইচ্ছে করছিল গান থামিয়ে ওর বাজনা একটু আত্মস্থ করে নেয়। উপভোগ করে নেয়।  মনের কোণে আপনা থেকেই বেজে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের গানের কলি, "তোমারি আনন্দ আমার দুঃখ সুখ ভ'রে, আমার ক'রে নিয়ে তারে নাও যে আপন ক'রে , আমার বলে যা পেয়েছি শুভক্ষণে যবে, তোমার ক'রে দেব তখন তারা আমার হবে, সব দিতে হবে।" ধীর পায়ে সৌভিকের মাদকতা যেন মৌবনিকে গ্রাস করতে বসেছিল। এক পরিযায়ী পাখির বিচিত্র পক্ষজাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল মৌবনিকে। নিস্তরঙ্গ জলাশয়ে কে যেন  খোলামকুচি নিক্ষেপ করে ক্ষুদ্র লহরমালায় ভরিয়ে দিল সমগ্ৰ পুষ্করিনীটাকে। সে ঢেউয়ের দুলুনিতে দুলে ওঠেছে মৌবনি। ব্যাগ পাইপারে ভুটিয়াদের করুণ সুরের রাগিনীতে যেমন দার্জিলিংয়ের বার্চহিলের  দেবদারুর পাতা শিহরিত হয়, লেবং এর পাহাড়ী চূড়ায় রৌদ্র এসে ঝিলিক দিয়ে সৌন্দর্যের ভান্ডার উজাড় করে দিয়ে যায়, সৌভিকের তবলার ছন্দিত সুরের সৌন্দর্যের জাদুতে মৌবনি ও তেমনই কেঁপে উঠেছে বারংবার। 

 আজকের অনুষ্ঠান তাই যেন এক মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি মৌবনির কাছে। শিক্ষকরাও অনুধাবন করবে তাদের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীর পারঙ্গমতা।মৌবনি গাইবে , প্রাণ উজাড় করে গাইবে, 

" আমার যে সব দিতে হবে, সে তো আমি জানি,
আমার যত বিত্ত প্রভু, আমার যত বাণী।" 

সেজেছে মৌবনি সাদা রঙের  লালপেড়ে পাটের শাড়ীতে। জলে ভেজা চুল গুলোকে আলতো করে গোড়া বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে পিছন দিকে। বাঁদিকের চুলে গুজেছে সাদা রংয়ের কুন্দ ফুলের গোছা। দু'হাতে পরেছে  দু'গাছা সোনার চুড়ি। 

   একটু পরেই শুরু হবে অনুষ্ঠান। ছেলেগুলো সাদা চোস্ত পাজামার উপর শেরওয়ানি চাপিয়েছে।  সবাই কেমন ব্যস্ত। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা গুটিশুঁটি মেরে ওদের বসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বসে আছে। মৌবনির চোখ খুঁজছে সৌভিককে। ইতিউতি। নিশ্চয়ই এদিক ওদিক কোথাও আছে। সঠিক সময়ে ছুটে আসবে। অনুষ্ঠান শুরুর তোড়জোড়। মৌবনিকে গান শুরুর নির্দেশ ঘোষিত হল। কিন্তু সৌভিক কোথায় ? একজনকে জিজ্ঞেস করল মৌবনি। বলতে পারে না সে। অবিন্যস্ত খোঁজাখুঁজি। কিন্তু নাহ্ ,পাওয়া গেল না কোথাও। 

হঠাৎ করেই মাইকে ঘোষিত হল অনিবার্য কারণ বশত আজকের নবীন বরণ উৎসব বাতিল করা হল। 

বুঝতে পারে না মৌবনি, কি এমন হ'ল অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হল! তবে কি কোন বরিষ্ঠ শিক্ষকের কিছু হয়ে গেল। ইন্দ্রপতন হয়ে গেছে, সেটুকু অনুমান করতে কষ্ট হয় না মৌবনির। নানান অশুভ ভাবনার পহাড় মৌবনির কল্পনায়। অস্ফূটে কানে এল হাসপাতালে নেবার সময় দেয়নি একদমই। তারপরে যে নামটি শুনলো ,তাতে  মৌবনির কানে কে যেন তপ্ত শলাকা আমূল বিদ্ধ করে দিল। হাজার ঝাড়বাতি সুসজ্জিত সুরম্য প্রাসদখানি নিস্প্রদীপ হয়ে ভেঙে পড়ল এক মুহুর্তের মধ্যে। সৌভিক কলেজে আসার পথে মোটর সাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করেছে। স্পট ডেথ।  

কাউকে কিছু না বলে এক ছুটে চলে এল মৌবনি বাড়ীতে। দরজা খুলে সজোরে আছড়ে পড়ল খাটের উপর। আকাশের সামিয়ানার চারটে কোণ ছিঁড়ে যেন হুড়মুড় করে ঢেকে দিল মৌবণিকে। মনের কোণের জমতে থাকা সাদা মেঘখানাকে ঝোড়ো বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল কোথায় যেন! উপুড় হয়ে  পড়ে রইল খাটের  উপর। উড়ন্ত ঘুড়ির সুতো ছিঁড়ে ভেঙেচুরে নীচে এসে লুটিয়ে পড়ল। ডানাভাঙা পাখির মতো পড়ে রইল মৌবনি। কবির ভাষায় , "তার ভিতর মহলের ব্যাথা আজ গেরুয়া বসন পরেছে। পথে বাহির হতে চায়। যে পথ একটি মাত্র সরল তারের একতারার মতো। কোন মনের মানুষের চলায় চলায় বাজছে।" 

পাশে আধখোলা গীতবিতান।

সেই পাতাটা খোলা , 
"আমার যে সব দিতে হবে সেতো আমি জানি....।"






হিয়ার মাঝে...... 

সীমা রাহা 

দরজা নক করে হিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে। কি যে করবে বুঝতে না পেরে যাবার জন্য পিছন ফিরতেই দরজাটা খুলে গেল।হিয়া দেখল সামনে সৌম্যদর্শন এক বছর তিরিশের যুবক দাঁড়িয়ে। কিন্তু তার দৃষ্টি কিছুটা বিভ্রান্ত। তা হিয়ার দিকে নয়,বরং হিয়ার মাথার ডানপাশ দিয়ে ছেলেটি একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হিয়া দেখল সে একমনে বাগানের গোলাপ গুলোর দিকে তাকিয়ে।হিয়া একটু গলা ঝেড়ে বলল, "বাড়িতে অন্য কেউ আছেন কি? আমি আদমশুমারীর তালিকা প্রস্তুত করতে এসেছি।"হিয়া দেখল ছেলেটি একই ভাবে দাঁড়িয়ে। ভাবল বোঝেনি,তাই আবার বলল,"আমি জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধনের জন্য এসেছিলাম।বাড়িতে কি অন্য কেউ আছেন?"
এইসময় ভেতর থেকে এক মহিলা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন।এসেই ছেলেটিকে টেনে সরিয়ে বললেন, " কি চাই?" হিয়াকে বসতে বলে তিনি ভোটার শংসাপত্র নিয়ে এসে দিলেন তার হাতে।হিয়া ঝটপট প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে ফেলতে লাগল সঙ্গের ফর্মে।ছেলেটির নাম দেবমাল্য রায়।মা তখন যেখানে তাকে টেনে বসিয়ে দিয়েছেন সেইখানেই একভাবে বসে আছে ছেলেটি।ছেলেটির তথ্য লিখতে লিখতে দু-একটি যা প্রশ্ন করল সে,তার উত্তর তার মা-ই দিল।ছেলেটি একই রকম নির্বাক। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় ভদ্রমহিলা ভিতরে চলে গেলেন। হিয়া কাজ করতে করতে ছেলেটির দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল ছেলেটি দৃষ্টি তার মুখেই স্থির নিবদ্ধ।হিয়ার বেশ অস্বস্তি হল। সে চোখ ফিরিয়ে নিতেই ছেলেটি বলে উঠল," আমি শ্লীলতাহানি করিনি,বিশ্বাস করো। " বলেই মাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে যেতে থাকল, আর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকল। তার এমনতর কথা শুনে হিয়া বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল।ছেলেটির মা আবার ঘরে ফিরলে হিয়া ভোটার শংসাপত্রগুলি তার হাতে ফেরত দিয়ে দরজার দিকে ধাবমান হতেই শুনল ছেলেটি সেই কথাটি পুনরায় বলছে,"বিশ্বাস করো,আমি শ্লীলতাহানি করিনি। তবু ওরা আমায় মারল।" হিয়া চমকে উঠে ছেলেটির মায়ের দিকে মুখ ফেরাতেই দেখল মহিলার দুই চোখে জল টলটল করছে। হিয়ার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি পড়ে নিয়ে মহিলা ঘাড় নাড়তে নাড়তে কাতর স্বরে বলতে থাকলেন,"আমার ছেলেটা বড় ভালো ছিল পড়াশোনায় জানো তো। ওর বাবার খুব শখ ছিল ছেলে ডাক্তার হবে।ছেলেও বাবার ইচ্ছে সফল করতে জোরতার পড়াশোনা শুরু করল।ওরা যে স্যারের কাছে বায়োলজি পড়তে যেতো, সেইখানে এক বিরাট বড় ব্যবসায়ীর মেয়েও পড়তে আসতো। মেয়েটি আমার দেবু কে খুব পছন্দ করতো। একদিন নিজের জন্মদিন বলে সে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য দেবুকে নিমন্ত্রণ জানায়। দেবু গিয়ে দেখে সে ছাড়া আর কেউ নিমন্ত্রিত নেই । মেয়েটির বাবা-মাও বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না। মেয়েটি দেবুকে সেইদিন প্রেম নিবেদন করে। কিন্তু দেবু অসম্মতি জানালে এবং তাকে বাবা-মা না থাকা কালীন ডাকার জন্য  ভর্ৎসনা করলে মেয়েটি ভীষণ রেগে যায়। বড়লোকের মেয়ে, কোনো বিষয়ে না শোনার অভ্যাস না থাকায় এই অপমান সে নিতে পারে না। হঠাৎ করে চিৎকার চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি শুরু করলে বাড়ির কাজের লোকেরা চলে আসে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটির বাবা-মা ফিরলে তাদের সে জানায় একসাথে গ্রুপ স্টাডি করার কথা বলে দেবমাল্য তার বাড়ি এলেও সুযোগ বুঝে সে তার গায়ে হাত দিয়েছে।
তার একটা সম্পর্ক তৈরিতে অসম্মতির ফল যে এমন ভয়াবহ হতে পারে তা আমার অতি সাধারণ ঘরের নিতান্ত ভালো মানুষ ছেলে দেবুর জানা ছিল না। সে একেবারে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।মেয়েটির বাবা পুলিশ ডেকে দেবুকে হেনস্থা করে, এমনকি তাকে শারীরিক ভাবেও হেনস্তা করা হয়।বাড়ি ফেরার পর থেকে আমার দেবু প্রায় সাতদিন প্রবল জ্বরের ঘোরে ভুল বকে যেতে থাকে। এই মুহূর্তে তুমি যা শুনলে,সেই এক কথা। ওর এই অবস্থা দেখে ওর বাবা শক পেয়ে হঠাৎ করেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অনেক ডাক্তার দেখালাম,কিন্তু আমার দেবু পুরোপুরি ঠিক হল না।সারাদিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকে, আর কেউ এলে তার কাছে ওই এক কথা বলে। কি যে কপালে আছে জানি না গো মা।" মিনতি দেবী কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুছলেন। হিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। মনটা কেমন যেন মুচড়ে রইল সারাদিন। কি এক মিথ্যে বদনাম যে ছেলেটার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে দিল ভেবে তার মনটাও ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। 

রাতে শুয়ে হিয়ার অনেক পুরনো কথা মনের ঘরে যেন কড়া নেড়ে যাচ্ছিল। হিয়ার গায়ের রঙ বেশ মাজা। তবে মুখটিতে লক্ষ্মীশ্রী মাখানো।হিয়ার বাবা অনেক ছোট বেলায় মারা যান। মা জামা কাপড় সেলাই করে, চাল ভেজে মুড়ি তৈরি করে বিক্রি করে তাকে আর তার দাদাকে মানুষ করেছেন।হিয়ার দাদা প্রতীক স্নাতক হওয়ার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায়। তার পরেই প্রেম করে বিয়ে করে পাশের পাড়ার একটি মেয়েকে। মেয়েটি বিয়ের পর হিয়াদের বাড়িতে সাত দিনও থাকেনি। এইরকম টিনের চালের ঘরে সে মোটেও থাকতে অভ্যস্ত নয়, আর অমন মোটা র‍্যাশনের চালও সে খেতে পারবে না। এই দোহাই দিয়ে অশান্তি করে সে বিয়ের সাতদিনের মাথায় তার বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। মা-ও ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন," প্রতীক, ও তোর বিয়ে করা বউ।ও যখন এইখানে মানাতে পারছে না, তুই বরং ওর সাথে ওর বাপের বাড়িতে গিয়েই থাক। দাদা দুরাত্তির অনিদ্রায় অতিবাহিত করে পরদিন ভোরে উঠে মাকে প্রণাম করে সেই যে গেল,দু বছরে আর এই মুখো হয়নি।অনেক কায়েক্লেশে তার ছাত্র পড়ানো আর মায়ের মুড়ি ভেজে বিক্রি করা টাকায় কোনওমতে সংসার চলেছে।হিয়ার মনে পড়ে হাসি পায়, এতো অভাবেও, আধ পেটা খেয়েও তার জীবনে প্রেম এসেছে কালের নিয়মে।জীবনের জটিলতাকে আরও জটিল করে দিতে। তার ছাত্রী প্রিয়ার মামাতো দাদা এসেছিল তাদের বাড়ি পুজোর ছুটিতে। স্কুল খুললেই বার্ষিক পরীক্ষা থাকায় পুজোর চার দিন ব্যতীত রোজ সকালে প্রিয়াকে পড়াতে গেছে।সেইখানেই তার সাথে প্রিয়ার মামাতো দাদা রক্তিমের আলাপ। রক্তিমের ইচ্ছেতে একদিন হিয়া প্রিয়া,তার ছোট ভাই সোনু আর রক্তিমের সাথে ঠাকুর দেখতেও যায়। তার মনে পড়ে, লক্ষ্মী পুজোর দিন প্রিয়াদের বাড়িতে প্রসাদ খেয়ে ফেরার পথে রক্তিম আসে তাকে বাড়ির পথে এগিয়ে দিতে। মাঝ রাস্তায় পুকুরের ধারের আলো-আঁধারিতে সে হিয়ার হাতটা চেপে ধরে বলে, "হিয়া,আমি তোমার মতো সহজ,সরল,সুন্দর মনের মেয়ে কখনো দেখিনি।
তোমার প্রতি ভালোলাগা এই কয়েকদিনে ভালবাসার রূপ নিয়েছে।ধরবে আমার হাত? জীবনের বাকী পথ চলবে একসাথে?" হিয়াকে যেন বোবায় পায়,সে কিছুই বলতে পারে না। খালি বাড়ির একটু আগে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,এবার আপনি আসুন, কাল সকালে মায়ের সাথে এসে কথা বলবেন। মায়ের আপত্তি না থাকলে আমারও কোন আপত্তি নেই।" পরের দিন সকাল আটটাতেই রক্তিম এসে হাজির। হিয়ার মায়ের কাছে হিয়াকে বিবাহ করার আর্জি জানালে হিয়ার মা তার পারিবারিক গল্প ও তার জীবিকার বিষয়ে বিস্তারিত শুনে এই সম্বন্ধে মত দেন। রক্তিম জানায় সে বনগাঁয় তার বাড়ি ফিরে গিয়ে তার বাবা মা কে সব জানাবে। সে যেহেতু আর্মিতে চাকরি করে, তাই তাকে এক সপ্তাহের মধ্যেই কর্মস্থলে ফিরে যেতে হবে, সে মাস তিনেক পরে ছুটি নিয়ে এসে বিবাহের তোড়জোড় শুরু করবে। হিয়ার মা এমন ভালো যেচে আসা সম্বন্ধ না করার কোন কারণ দেখেন না। ফলতঃ রক্তিমের বাকী সাতদিন দুইবেলা আসা শুরু হয়। হিয়াও রক্তিমকে পেয়ে আনন্দে বাঁধনহারা হয়ে পড়ে। সিনেমা দেখতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, শপিংয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো ..... সবই চলতে থাকে জোরকদমে। সাতদিন যে কোথা দিয়ে চলে যায়, হিয়া টেরও পায় না। রক্তিম চলে যাবার পর হিয়া প্রতি সপ্তাহে তাকে চিঠি দিতো।রক্তিমও মাঝে মাঝে ব্যস্ততার ফাঁকে তার উত্তর দিতো। কিন্তু চিঠির উত্তর আসা ধীরে ধীরে কমতে থাকল সময়ের সাথে সাথে। একটা সময়ের পর চিঠি আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। চিন্তায়,ভাবনায় হিয়ার ঘুম উড়ে গেল। মেয়ের এমনতর অবস্থা সহ্য করতে না পেরে একদিন মনোরমা দেবী গেলেন প্রিয়াদের বাড়ি।রক্তিমের সাথে হিয়ার সম্পর্কের কথা জানিয়ে প্রিয়ার মায়ের কাছে প্রার্থনা করবে তিনি যেন রক্তিমের বাবা-মায়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে বিষয়টি তাদের অবগত করান। কিন্তু প্রিয়ার মা সব শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি জানালেন আগের মাসেই রক্তিমের বিবাহ হয়ে গেছে আর্মিরই এক উচ্চপদস্থ অফিসারের মেয়ের সাথে,আর সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল বিবাহটি হয়েছে ছেলে ও মেয়ে পরস্পরকে পছন্দ করায়। অপমানের অভিঘাতে ভেঙে পড়া মায়ের কান্না ভেজা মুখ নিজের হাতে তুলে নিয়ে হিয়া বলেছিল," মা গো তুমি ভেঙে পড়ছ কেন? কই আমি তো ভেঙে পড়িনি।আসলে জানোতো এই সমাজে সমস্ত সম্পর্কের জোট বাঁধার প্রধান মাপকাঠিই হল অর্থ। অর্থ নেই যার,তার সমাজে সম্মানও নেই। আমিই কুঁজো হওয়া সত্ত্বেও চিত হয়ে শোবার স্বপ্ন দেখছিলাম। তাই তো সঠিক সময়ে স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠার জন্য রক্তিম আমাকে অদৃশ্য চড় মেরে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, আমাদের মতো মেয়েদের স্বপ্ন দেখার অধিকারও নেই।"
হিয়া টিউশন পড়িয়েও সময় বের করে নিজে কম্পিটিটিভ এক্সামের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে এবং সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী হিসাবে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিও পেয়েছে। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিয়া ভাবে সত্যি মানুষ কতো নীচ, কেউ ভালোবাসা দেখিয়ে ঠকিয়ে যায়, আর কেউ ভালবাসা চেয়ে না পাওয়ার গ্লানিতে পর্যুদস্ত করে উল্টোদিকের সহজ,সরল, নিষ্কলুষ মানুষটিকে, তার মুখে লেপে দেয় বদনামের বিষ্ঠা, একবারও ভাবেনা তা কেমন ভাবে একটা মানুষের বিশ্বাসকে ফালা ফালা করে দিয়ে, তার থেকে স্বাভাবিক বেঁচে থাকার ক্ষমতা টুকুও হিংস্রতায় কেড়ে নেয়। 

এর দুদিন পরে হিয়া তার আদমশুমারীর কাজ করে দেবমাল্যদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরতে গিয়ে দেখে বাড়ির সামনে বিরাট জটলা। সে কৌতুহল বশতঃ পাড়ার একটি পরিচিত মুখ ছেলের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে সে জানায় মিনতি দেবী ভোর রাত্রে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তার ছেলে দেবমাল্য কিছুতেই মায়ের শরীর দাহ করার জন্য পাড়ার ছেলেদের নিয়ে যেতে দিচ্ছে না। ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছে। খবরটা শুনে এক লহমায় হিয়ার দুদিন আগের সব কথা মনের মাঝে ভেসে উঠলো। কানের কাছে রেশ তুলল সেই শব্দ কটি, "বিশ্বাস করো আমি শ্লীলতাহানি করিনি।"
সে ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। বুঝলো চারিদিকের হতচকিত দৃষ্টিগুলি এই মুহূর্তে তার উপর স্থির হয়ে আছে। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল, দেবমাল্য তার মায়ের একটি হাত ধরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সে গিয়ে দাঁড়াতেই তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল দেবমাল্য।তারপর অস্ফুটে বলল, আমি শ্লীলতাহানি করিনি, বিশ্বাস করো। ওরা তাও মারল,আমার মাকেও ওরা কেড়ে নিল।" হিয়া ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মনে সাহস সঞ্চয় করে বিশ্বাসে ভর করে দৃঢ় কণ্ঠে হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "দেবমাল্য উঠে এসো। মা আর নেই। ওনার আত্মার শান্তির জন্য ওনাকে দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে। সবাই দাঁড়িয়ে আছেন।ওনাদের কাজ করতে দাও। উঠে এসো তুমি।" হিয়ার কথা শুনে দেবমাল্য কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে রইল।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হিয়ার হাতটা ধরে বলল, "মাকে ওরা নিয়ে গেলে আমি কার কাছে থাকব? মা চলে গেলে ওরা আমাকে আবার মারবে।" বলে সে কেঁদে ফেলল। হিয়া লজ্জা,ঘৃণা, সমাজ,সংসারের যাবতীয় ভাবনার জটিলতা ভুলে দেবমাল্য কে জড়িয়ে ধরল পরম মমতায়। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, "আমি তো আছি। কেউ তোমার গায়ে হাত দেবে না।"
দেবমাল্য শিশু যেমন করে মাতৃবুকে আশ্রয় খোঁজে, ঠিক তেমন করেই জড়িয়ে ধরে থাকল হিয়াকে। সেদিনের মতো দেবমাল্য কে খাবার খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে ঘরে ফিরল হিয়া। রাতে শুয়ে মনোরমা দেবী হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "মা রে, কি করবি কিছু ভেবেছিস?" হিয়া এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরের চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করতে করতে বলল, "মা অনেক তো স্বাভাবিক, বুদ্ধিমনস্ক পুরুষ মানুষকে জীবনে পেলাম, যারা সময় সুযোগ বুঝে আমাকে বা আমাদের ব্যবহার করে চলে গেছে। তাই এবার আরও একবার ভাগ্যের পরীক্ষা দিতে চাই।দেখি ভাগ্যদেবতা আমার কপালে কি বিধিলিপি লিখেছেন। দেবমাল্য বড় অসহায় মা। ওর আমাকে প্র‍য়োজন। ওকে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলতে চাই। তুমি আমার ইচ্ছেয় খুশী হতে পারবে তো মা? মনোরমা দেবী স্মিত হেসে বললেন, "আমি জানি আমার মেয়ের মতো সৎ চরিত্র, উন্নতমনা, দয়াশীল মানুষ ভগবান এই পৃথিবীতে খুব কমই পাঠান। তুই আমার গর্ব মা। তুই যা করবি জানবি তাতেই তোর মায়ের ষোল আনা মত আছে।" শুনে হিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কাঁদতে থাকল, "মা গো,তবু আমার মতো মেয়েরা কেন বার বার ঠকে যায় বলতে পারো?" মনোরমা দেবী মেয়েকে আদর করতে করতে বললেন, "ওরে ভগবান কষ্টিপাথরে ঘষে ঘষে যাচাই করে নেন আসল মানিকটিকে। তাই সৎ, ভালোদের উপরই তার খাঁড়া বেশী করে নেমে আসে।দেখবি জিত তোর হবেই। যে এমন নিঃস্বার্থ, আর দয়াশীলা, তাকে যে সত্যের পথে রেখে জিতিয়ে দিতেই হবে।"

ঠিক দেড় বছরে হিয়ার  টানা সংগ্রামে দেবমাল্য ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। সেও তার মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া পড়াশোনা নতুন করে শুরু করে শেষ করল। একটা সম্মানজনক চাকরিও সে জোগাড় করল। মনোরমা দেবী হিয়া আর দেবমাল্যর চার হাত এক করে দিয়ে বললেন, "এখন থেকে আমার হিয়া তোমার সম্পত্তি। তাকে ভালো রাখার দায় তোমার বাবা। এমন অরূপরতন মনের অধিকারিনী আমার হিয়া যেন দেবমাল্যর হিয়ায় চিরকালীন স্থান করে নিতে পারে। সুখী হও তোমরা। "





বাসনা কুসুম 

কোয়েল তালুকদার

আশির দশকের মাঝামাঝির বৃষ্টিমুখর এক বিকেল। তখন একলা জীবন আমার। সুখের মুহূর্তগুলো একলা উপভোগ করি। দুঃখের ক্ষণগুলো একাকী পার করি। আবার ভালো না লাগার সময়গুলো মন কেমন করে যেন কেটে যেত।

ঘরের চালে রুপোলী বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝম করে পড়ছে। একবার বিছানায় শুয়ে থাকি। আর একবার বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখি। দাঁড়িয়ে থেকে জলের শব্দ শুনি। আবার ফিরে  এসে বিছানার উপর বসে থাকি। ভাবলাম, বই পড়ব। বুকশেল্ফের কাছে গিয়ে বই খুঁজি।  কোন্ বইটি পড়ব?  চোখে পড়ল বুদ্ধদেব গুহের 'বাসনা কুসুম'। বইটি পড়া ছিল আজ থেকে বছর চারেক আগে।  কেন জানি আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। শেল্ফ থেকে বইটি বের করে পাতা উল্টাতে থাকি। পাতা উল্টাতে গিয়ে একটি চিঠি দেখতে পাই। চিঠির কাগজের রং হলদেটে হয়ে গেছে। চার ভাঁজ করা  চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি -

দাদা ভাই, 

আপনি আমার বয়সে ছোট ছিলেন। তারপরও দাদাভাই ডেকেছিলাম। আত্মপরিজনহীন এই শহরে আপনার এখানে যে ক'টি দিন ছিলাম খুব আপন করে নিয়েছিলেন। আমাদের জন্য অনেক করেছেন। চির ঋণী হয়ে থাকলাম। 

আজ চলে যাচ্ছি। আপনার সাথে আর কী কখনও  দেখা হবে ? যাবার বেলায় কেন জানি, এই চিঠিতে আপনাকে "তুমি" বলতে ইচ্ছে করছে। একবার হলেও আমাদের বাড়িতে তুমি এসো। আমি জানি, সময়ে অসময়ে তোমার কথা আমার খুব মনে পড়বে। তোমাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করবে। 

ইতি -
শারমিন ভাবী।


এই শারমিন ভাবী ছিলেন আমার ক্ষণকালীন এক সহকর্মী নাজিমউদ্দীনের স্ত্রী। নাজিমউদ্দীন ছিলেন আমার থেকে  প্রায় সাত আট বছরের বড়ো। উনি ওনার স্ত্রীকে ঢাকায়  চিকিৎসা করাতে এনে আমার বাড়িতে সপ্তাহখানেক থেকে গিয়েছিলেন।

ওনারা এসেছিলেন তিন বছর আগে।  আমার মনে পড়ছে ওনারা যখন এসেছিলেন তখন এই "বাসনা কুসুম" বইটি  সদ্য পড়া শেষ করে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছিলাম। শারমিন ভাবী যেদিন চলে যায় সেদিনই হয়ত চিঠিখানি লিখে বইয়ের ভাঁজে রেখে গিয়েছিলেন। আমি তা না দেখেই বইটি বুকশেল্ফের ভিতর রেখে দিয়েছিলাম।

এই ক'বছরে আমার কাছে শারমিন ভাবী অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। আজ এই চিঠিটি পড়ার পর সেই শারমিন ভাবীকে আবার নতুন করে মনে পড়ছে। কয়েকটি দিন উনি ছিলেন, কী আদর যত্নই না করে গিয়েছিলেন আমাকে। ঐ ক'টা দিন স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে উনি কানায় কানায় ভরে তুলেছিলেন।

মনে পড়ছে তাকে প্রথম দেখার সেই দিন। 

হেমন্তের রোদ্দুর তখন সারা আঙিনাতে মুখর।  নাজিমউদ্দীনের স্ত্রীর পরনে একটি সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি, হাতে চারটি চিকন সোনার চুড়ি, মুখে কোনো আবীর মাখা নেই। অনেকটাই নিরাভরণ। বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। মাথায় ছোট্ট ঘোমটা দেওয়া।  আমায় দেখে ঘোমটাটা আরও একটু সামনের দিকে টেনে আনেন। হেমন্তের রোদ্দুর সেই ঘোমটার ভিতর দিয়ে আবছায়া রূপে প্রবেশ করে তার মুখখানিকে বেশ উজ্জ্বল করে তুলেছিল। নাজিমউদ্দীন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন - 'এই হচ্ছে তোমার ভাবী। তোমার শারমিন ভাবী।'

আমি তখন ইউনিভার্সিটির সদ্য  মাস্টার্স পাশ করা তরুণ এক, বয়স চব্বিশ পঁচিশ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তখনও বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, মেঘদূতম্, শকুন্তলা দুস্মমন্ত'রা মগজে ঘোরাফেরা করে। সুযোগ পেলেই কল্পনায় চলে যাই, দূর শিপ্রানদীর তীরে। সেই আমি দেখলাম আজ হেমন্তের রোদ্দুর ছোঁয়া একজন কুসুমিত রমণীর অনাবৃত দুটো হাত। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন এক প্রকার নূতন স্পন্দন স্পন্দিত হয়েছিল।

শারমিন ভাবীরা সাতদিন ছিলেন আমার বাড়িতে। ঐ কয়দিনে সত্যি সত্যি আমার বাড়িটা তিনি সাজালেন। ঘরের কোণে কোণে ধূলো ময়লা জমেছিল সেগুলো তিনি নিজ হাতে পরিস্কার করলেন। বারান্দার চালে মাকড়সা বাসা বেঁধে অসংখ্য  ঝুলে  ভরে রেখেছিল, সেগুলোও ঝাড়লেন। পড়ার টেবিল গোছালেন। বিছানাপত্র সব পরিপাটি করে রাখলেন। বাড়ির সামনের বাগানে আগাছাগুলো লোক ডেকে কেটে ফেললেন। মালিনীর মতো প্রতিদিন গোলাপ, বেলী, গাঁদা ও পাতাবাহারের গাছগুলোতে পানি ঢাললেন এবং পরিচর্যা করলেন।    

হঠাৎ করেই জমিদার পুত্রের মতো জীবন হলো আমার। বাড়িতে খাবার রেডি থাকত। হাতখান ধুয়ে শুধু খেতে বসতাম। শারমিন ভাবী মুখে তুলে খাওয়ানোটাই শুধু বাকি রাখতেন।  বাকি সবই তিনি করতেন, সব তৈরি করে রাখতেন। কটা দিন ছিল শুধুই আনন্দময় দিবারাত্রি। 

শারমিন ভাবীরা যেদিন চলে যাবে তার আগের দিনের কথা। বিকেলে অফিস থেকে এসে দেখি -- শারমিন ভাবী নতুন একটি শাড়ি পরে সেজেগুজে বসে আছেন। অপূর্ব সুন্দর লাগছিল ওনাকে। কপালে টিপ পরেছিলেন। চোখে কাজল। খোঁপায় জড়ানো গাঁদা ফুলের মালা। শারমিন ভাবী আমাকে চুপিচুপি বলেছিলেন- 'আামাকে দেখতে কেমন লাগছে?'

- অপূর্ব সুন্দর লাগছে, একদম  দেবীর মতোন। 
- কেন সেজেছি জানেন?
- কী জন্য? 
- আপনাকে প্রেরণা দিচ্ছি। যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে একটি লক্ষ্মীমন্ত সুন্দরী বউ ঘরে আনেন। 
- তাই? 
- জ্বী।

চিকিৎসা শেষে শারমিন ভাবী যেদিন চলে যান, সেদিন তাঁকে দেখি - মাথার ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে স্থির শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হলো কালো চোখদুটির নীচে জগতের সকল অশ্রুভার গোপনে লুকিয়ে রেখেছেন। ঈষৎ ভারী সেই চোখ দুটো তুলে বলেছিলেন - 'আমি কিন্তু ঘরের সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে গেলাম। কোনো এলোমেলো যেন না হয়। যদি কখনও আবার আসি - ঘরে  যেন একজন লক্ষ্মীমন্ত বউ দেখতে পাই।'

চিঠিখানা পড়ে ভাঁজ করে 'বাসনা কুসুমে'র পাতায় রেখে দেই। সেদিন আর বইটি পড়া হলো না। ধীর সন্তর্পণে হেঁটে  বারান্দায় চলে যাই। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘরের চাল থেকে গড়ে পড়া স্বচ্ছ বৃষ্টির জল আঁজলায় ভরে চোখমুখ ধুয়ে ফেলি। চোখ দুটো ধুতে গিয়ে মনে হলো - কেনই ধুয়ে ফেললাম এই চোখ!  আমার চোখ থেকে তো কোনো গোপন অশ্রু ঝরে পড়েনি। 

এরপর -

তিনটি বছর চলে গেছে। এই তিন বছরে  চিঠিটি আমার চোখে পড়েনি, এজন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। কী এক কোমল অনুভব নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। ভাবলাম, শারমিন ভাবীকে দেখতে যাওয়া উচিৎ। 

আমার বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়ে আছে। আমার এই বিশেষ  দিনে শারমিন ভাবী'রা আসুক। তাদেরকে  নিমন্ত্রণ করার জন্য তাই একদিন সকালবেলা একটি লোকাল ট্রেনে করে ঢাকার অদূরে শ্রীপুরের কাওরাইদ স্টেশনে গিয়ে নামি। 

নির্জন ছোট্ট একটি স্টেশন। কোনো জনকোলাহল নেই। একটি চা'র দোকানে চা খেতে খেতে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করি - ভাই, বেলদিয়া গ্রাম কতদূর? 

দোকানী বলল - এখান থেকে মাইল দুই আড়াই হবে।
- কীভাবে যাব? 
- হেঁটে যেতে হবে। আপনি প্রথমে কাওরদীর ব্রাহ্ম মন্দির পর্যন্ত রিক্সায় যাবেন। তারপর সুতিয়া নদীর কূল ধরে মেঠো পথে হেঁটে হেঁটে চলে যাবেন। 

আমি তাই করলাম। একটি রিক্সা নিয়ে মন্দির পর্যন্ত চলে যাই। ওখানে নেমে প্রথমে মন্দির দর্শন করি। খুব ভালো লাগছিল ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের এই মন্দির। জনশ্রুতি আছে রবীন্দ্রনাথ নাকি এই মন্দির দেখতে এসেছিলেন। পাশেই অতুল চন্দ্র সেনের সমাধি। সমাধি গাত্রে লেখা আছে  - 'মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাঙলা ভাষা।'

মন্দির আর সমাধি দেখে পথে নেমে পড়ি।  নদীর তীর ঘেষে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকি সামনের  দিকে। কার্তিকের রৌদ্রছায়ায় হাঁটতে কী যে ভালো লাগছিল! পথের একপাশে স্বচ্ছতোয়া সুতিয়া নদী।  নদীটির  জল স্থির। স্রোত নেই। বক ও পানকৌড়ি উড়ছে। অদূরে  সারি সারি  গ্রাম। গ্রামগুলো সবুজ শ্যামলিমায় ঢাকা। হাতের বামদিকে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। পাকা ধানের গন্ধ মিশ্রিত বাতাস ম ম করে ভেসে আসছিল।

মাইল দুই যাওয়ার পর দেখলাম, একটা হালট। হালটটি নদী থেকে চলে এসেছে।  ছোট্ট বাঁশের পুল।  সাঁকোটি পেরিয়ে আবার মেঠো পথে উঠি। ধানক্ষেতের আল ধরে কিছু দূর যেতেই বনানী ঘেরা যে গ্রামটা দেখতে পেলাম, ওটাই বেলদিয়া গ্রাম। ঠিক পূর্বপাশ দিয়েই সুতিয়া নদী বয়ে গেছে।

বেলদিয়া গ্রামে ঢুকতেই একজনকে জিজ্ঞাসা করে নাজিমউদ্দিনের বাড়িটি চিনে নিই।

নাজিমউদ্দীনের বাড়ির আঙিনায় যখন পৌঁছোই - তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাড়িটি ছায়াঘেরা। চারপাশে আম কাঁঠালের গাছ। ছোট্ট একটি পুকুরও আছে। ঠিক অদূরে মাঠের পরে সুতিয়া নদী। আমাকে দেখে একটি আট নয় বছরের মেয়ে বাড়ির ভিতর  থেকে বের হয়ে আসে। 
আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করি - তোমার নাম কী? 
মেয়েটি বলে - নাজমা। 
- তোমার বাবার নাম কী? 
- নাজিম উদ্দীন দেওয়ান 
- উনি বাড়িতে নেই? 
- বাবা তো বেঁচে নেই। 

আমি স্তব্ধবাক হয়ে যাই। ওকে বলি - কী বলো তুমি! মেয়েটি বলছিল - আপনি জানেন না? 
- জানিনা মা। 

নাজমা বিনম্র কণ্ঠে বলে - আপনি কোথা থেকে এসেছেন? বললাম - ঢাকা থেকে এসেছি। তোমার বাবা আমার বন্ধু। একসাথে আমরা চাকুরি করেছি দু'বছর।

বললাম- তোমার মা বাড়িতে নেই? 
- আছে। 
- তুমি গিয়ে ওনাকে বলো - ঢাকা থেকে রঞ্জন চাচু এসেছে। 
- আচ্ছা।

মেয়েটি বাড়ির ভিতর চলে যায়। ভাবছিলাম -এই জগতে আনন্দহাসিরাশি কত ক্ষণকালের। কোথায় কোন্ গ্রামের নিভৃতে এসে দেখতে পেলাম, কত ফুল অনাদরে ফুটে নির্জনে তা ঝরে যায়।  কতজন কত 
অশ্রু ঝরায়…কত স্বপ্ন ভেঙে যায়..কত আশার হাসি মিলিয়ে যায়! 

একটু পর বাড়ির ভিতর থেকে শারমিন ভাবী চলে আসে। আজও দেখলাম তাকে সেই প্রথম দিনের দেখার মতো করে। আজও মাথায় ঘোমটা দেওয়া ছিল।  কিন্তু কত পার্থক্য। হেমন্ত রোদ আমপাতার ফাঁক দিয়ে আজকেও পড়েছিল তার মুখের উপর। কিন্তু প্রথম দেখার মতো  সেই স্নিগ্ধ রূপ আজ নেই।  বিষাদমাখা মুখ তার.. ... কেমন শীর্ণকায় ও মলিন হয়ে আছে। তাকে দেখে আমার বুকের ভিতর অস্ফুট কান্না গুমরে ওঠে। 

শারমিন ভাবী কিছুটা বিস্ময় কণ্ঠে বলে -'দাদাভাই তুমি! আমাদের কথা তোমার মনে আছে?' পরক্ষণে আবার বলে -'সেই তুমি এলে! যখন তোমার নাজিম ভাই আর নেই।'

আমাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে যায়। ভাবী বলছিল - আমার এই জীর্ণ পর্ণকুটিরে তোমাকে যে কোথায় কীভাবে বসতে দেই। 

তিনি আমাকে একটি দুই হাতলের কাঠের চেয়ারে বসতে দেন। শারমিন ভাবীর কাছে থেকে জানতে পারি নাজিম ভাই পাঁচ মাস আগে হার্ট অ্যাটাক করে বাড়িতেই মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার সময় পায়নি।

শারমিন ভাবীর সাথে অনেক কথা হয়। নাজিম ভাইকে নিয়ে অনেক স্মৃতিকথা বলি।  ভাবী বলছিল - 'তুমি কী তোমার ঘরে লক্ষ্মীমন্ত বউ এনেছ? ' বললাম - না। এখনও আনিনি।  তবে আনব খুব শীঘ্রই।  দিন তারিখ ঠিক হয়ে আছে। 

- খুব খুশি হলাম। দেখতে অনেক সুন্দরী নিশ্চয়ই। 
- জ্বী, আপনার মতো মায়াময়ী! 
- আমাকে দেখাবে না? 
- দেখাব বলেই এখানে এসেছি। আমার বিয়েতে আপনি যাবেন।
- তোমার নাজিম ভাই নেই যে! বরঞ্চ তুমি তোমার বউকে এখানে নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যেও।

তখন  বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। আমি শারমিন ভাবীকে বললাম - সন্ধ্যায় একটি ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে আজই ঢাকা চলে যাব। 

তিনি  কিছুতেই আসতে দিলেন না। বললেন-- কাল সকালে একটি ট্রেন আছে, সেই ট্রেনে তুমি চলে যেও। আমি তার কথা ফেরাতে পারিনি। শারমিন ভাবীর ওখানেই সেদিন থেকে যাই।

তখন সন্ধ্যা আসন্ন। শারমিন ভাবীকে বললাম - আমি একটু নদীর কূলে বেড়াতে যাব। ভাবী বললেন - যাও। ঘুরে এস। ভালো লাগবে। 

আমি জানি, এই পল্লীগ্রামে শারমিন ভাবীকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তাকে বললাম না সাথে যেতে। আমি একাই নদী দেখতে যাই।  নদীর কূলে একজায়গায় দেখি, একটি জারুল গাছ। পাতায় পাতায় অসংখ্য নীল রঙের ফুল ফুটে আছে।  আমি জারুল তলায় বসে নদীর শান্ত রূপ দেখতে থাকি। সন্ধ্যার হিমেল বাতাস বয়ে আসছিল নদী থেকে। একাকী নীরবে বসে থাকি কিছুক্ষণ। শারমিন ভাবীর কথা মনে পড়ছিল খুব । কেমন জনম দুঃখী সে। এমন মায়াময়ী একটি মেয়ের এত কষ্ট! এত যাতনা। আচ্ছা, কোনো প্রদীপ জ্বলা সন্ধ্যায়–আমার কথা সে কি মনে করবে, আমার তো মনে পড়বে।

নদীর কূল থেকে ফিরে আসি। পথে আসতে আসতে রাত হয়। বাড়িতে এসে দেখি - শারমিন ভাবী হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

ভাবী খুব যত্ন করে রাতের খাবার খাওয়ালেন। পাশের রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। আমি শুয়ে আছি। চোখে ঘুম আসছিল না। নির্ঘুমে কেটে যায় অনেকটা সময়। তারপর ঘুমিয়ে যাই...। তারপর অদ্ভুত একটি  বিস্মরণেরও  স্বপ্ন দেখি -

শারমিন ভাবী কেমন যেন  মাধুর্যের রূপ ধরে কাছে আসে। রাতের আকাশের তারার মতো কারুকার্যময় সেই রূপ! সুতিয়া নদীর মতো স্নিগ্ধ সৌম্য দেহ। অনেক দূর থেকে সে প্রাণের হিল্লোলে কাছে চলে আসছে।
তার পায়ের শব্দ জল কলতানের মতো বাজছে... হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী নতুন রঙে রঙীন হয়ে ওঠে। নিভৃত পল্লী  কোণে এক জীর্ণ পর্ণকুটিরে একজন মায়াবতীকে দেখছি বিমুগ্ধ হয়ে! কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! চরাচর জুড়ে অদ্ভুত আলো আঁধার। সেই আলো আঁধারের মাঝে শারমিন ভাবী  আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে ...। 

আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি কান পেতে থাকি। এ কী সত্যি!  আমি শুনতে পাচ্ছিলাম - পাশের ঘরে শারমিন ভাবী গুমরে গুমরে কাঁদছে। 

বাকি সারারাত দুঃস্বপ্নের অনুভব নিয়ে  কাটিয়ে দেই। তারপর ভোর হয়।  

পরিশিষ্ট -

শারমিন ভাবী আমার কেউ হয়নি। সে ছিল একটা মধুর স্বপ্নের মতো, বেদনার মতো। হঠাৎ কোনো গানের সুরের মতো কানে কানে গান শোনার মতো.. আমার জীবন ছন্নছাড়া হয়নি। একটি লক্ষ্মীমন্ত বউ এনেছি ঘরে। সেই আমার ঘর দুয়ার সাজিয়ে রাখে। সন্ধায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দেয় ....।

তারপরও মাঝে মাঝে মন কেমন করে ওঠে। এইসব দুঃখ নিয়ে আফশোস করি না। যা পেয়েছি অনেক পেয়েছি। তাই সত্য। এই পরম পাওয়া। এ যে অসীম। ফুরায় না কখনও। আর, ফুরিয়ে গেলেও তার কাছে থেকেই আবার মুঠো মুঠো করে ভরিয়ে নেই  আমার  জীবন পাত্র।





সূর্য ওঠা সফল হল

মালা  চ্যাটার্জ্জী

‘মা’তোমাদের বিয়ে ২রা বৈশাখ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে। মনে আছে? দারুণ ধূমধাম করে এবার কিন্তু পালন করব। কোন ওজর আপত্তি শুনব না। হাল্কা গোলাপী একটা বেনারসী আমি কিনে রেখেছি ওটা পরবে ঐ দিন। বাবার জন্যও ক্রিম রঙের সিল্কের পাঞ্জাবী আর মিহি ধুতি কিনেছি। বাবাও সেদিন ওটা পরবেন।তোমার ছেলেকে আমি বলেছি ভোজ ক্যাটারারকে অর্ডার দিতে। আর মিষ্টি, ওটা বাঞ্ছারামে অর্ডার দেব।' কথাগুলি বলে তৃপ্তির হাসি হাসতে থাকে সুনেত্রা, মাধবীদেবী ও অমলবাবুর একমাত্র ছেলের বৌ।

চা খেতে খেতে সকালের কাগজ মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন অমলবাবু। মুখ তুলে বললেন, ‘পারোও তুমি মা। এই বুড়ো বয়সে আবার বিবাহবার্ষিকী! এবার তো ইলেকট্রিক চুল্লিতে যাবার সময় হল মা। ও সব তোমাদেরই মানায়। আর কেন এই বুড়োবুড়ি
দুটোকে ওসব ঝামেলার মধ্যে জড়াচ্ছো।' তারপর, সস্নেহে প্রিয় পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে
রইলেন কিছুক্ষণ। ‘না বাবা, আপনারা কত দায়দায়িত্ব সেরেছেন এই জীবনে আমি সব জানি। পিসিমণি আমাকে সব বলেছে। পিসিমণি বলছে, বাবা-মা আমি, আমরা 
সবাই তো সেজদা‘র কাছেই থাকতাম। সেজদাই আমার পড়াশোনা, বিয়ের খরচ যাবতীয় একা হাতে সামলেছে। আর দুই দাদা তো বিয়ের পর আলাদা থেকে সব দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।' কথাগুলি বলতে বলতে পরম শ্রদ্ধায় পূজনীয় শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে থাকে সুনেত্রা। অমলবাবু বুঝতে পারেন অনেক মেয়ের সাথে পুত্রবধূটির ভাবনার অনেক ফারাক। হিসেব— টিসেবগুলি তাঁর গুলিয়ে যায়। কিছুটা হতভম্ব হয়ে যান তিনি। মনে মনে ভাবেন বন্ধু অনুতোষের মেয়ের সাথে ছেলে অভ্র'র বিয়ে না হয়ে বোধহয় ভালোই হয়েছে। অনুতোষের মেয়ে এষা সুনেত্রার মতো হতো কিনা কে জানে!

প্রথম যেদিন সুনেত্রা ছেলের সাথে তাদের বাড়িতে আসে তখন সাদাসিধে, আটপৌরে  চেহারার মেয়েটিকে দেখে তাঁর ও মাধবীদেবীর বিশেষ ভালো লাগেনি। একমাত্র ছেলের বৌ তাঁরা ভেবেছিলেন সুন্দরী দেখে আনবেন। এই কারণেই
এষাকে দেখে পছন্দ হয়েছিল তাঁদের। কী সুন্দর দুধেআলতা গায়ের রঙ,ছিপেছিপে
চেহারা, টানাটানা চোখ, লম্বাও বেশ, পাঁচফুট
চার ইঞ্চি। সুনেত্রা তো মেরেকেটে বোধহয় পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি হবে। তবে হ্যাঁ মোটামুটি সুলক্ষণা, কথাও বলে নরম করে সেটা প্রথমদিনই বুঝেছিলেন তাঁরা। বৌভাতের দিন দশেক পর মাধবীদেবী বুঝেছিলেন পুত্রবধূটির আবেগও বেশ আছে। কী সুন্দর  রেঁধেবেড়ে ভাতের থালা বেড়ে “বাবা, মা খেতে এসো”- বলে ডাক দিয়ে খেতে দিয়েছিল। মাধবীদেবী তখনই বুঝেছিলেন গবেষণা শুরু করলেও এ বৌ মানিয়ে গুছিয়ে চলার মেয়ে। বড় স্বস্তি পেয়েছিলেন
সেদিন।

দীর্ঘ দশ বছরে তাঁর বোঝার এতটুকু ভুল হয়নি। সুনেত্রা মেয়ের মতনই তাঁদের দিকে নজর দেয়। ছুটির দিনে হৈ হৈ করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। অভ্রকে বলে অমলবাবু, মাধবীদেবীর পছন্দের জিনিস
বাজার করায়। ছুটির দিনে অমলবাবুকে বলে,‘বাবা, আজ আপনার রেস্ট, ছেলে বাজার যাবে। কী খেতে ইচ্ছে করে বলুন। আজ বিকেলবেলায় কাছে-পিঠে কোথাও বেড়াতে যাব। মা-বাবাকেও আসতে বলেছি। একসাথে আপনাদের নাতি গোগল ও আমরা খাবো। গোগলের বয়সও তো ন'বছর হলো ও সবার সান্নিধ্য পাবে। ’


নিজের মেয়ে না, পুত্রবধূ। তার মানসিকতায় মন ভরে থাকে মাধবীদেবীর। অবসর সময়ে ভাবেন, কলেজে পড়িয়েও এত অমায়িক মেয়েটি! সকালের সূর্যর দিকে তাকিয়ে ভাবেন, সূর্যওঠা তাহলে সফল হয়েছে তাঁর পরিবারে। আনন্দে, আবেগে বুকে টেনে নেন সুনেত্রাকে। 





এক কাপ চা-এর গল্প

সায়ন্তন ধর 

বাইরে মেঘ করেছে, যশ বা ইয়াশ নামক ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে ওড়িশা ও বাংলার উপকূল অভিমুখে, তারই প্রাক প্রস্তুতি স্বরূপ বৃষ্টি ঝরছে ঝির ঝির। এখন আবার লকডাউন চলছে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কাজ অনেক থাকলেও এই ঝিমধরা দিনে, স্বল্প আলোতে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে থাকতে ঘুম এসে যাচ্ছে শুভর। তাই সে ভাবল একটু চা বানিয়ে যদি পান করা যেত! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ওর চা বানানোটা খুবই সহজ। এক কাপ জল ফুটাও, চাপাতি দাও আর এক দু' মিনিট ঢেকে রাখো। চিনি বা দুধ দিয়ে চা খাওয়ার অভ্যাস তার নেই। চা একেকজন একেকভাবে পান করে, একেকজনের হাতে চা এর স্বাদ ও হয় একেকরকম। চা মানেই চীন। চীন দেশে থেকে চা ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বে। আবার চা কে কতটা সুন্দর ভাবে পরিবেশন করতে হয়, বা চা তৈরী ও পরিবেশনাকে যে শৈল্পিক রূপ দেওয়া যায় তা জানা যায় জাপান থেকে। ভারতের দার্জিলিং চা স্বাদে ও গন্ধে জগৎ বিখ্যাত। কিন্তু উত্তরবঙ্গের তরঙ্গায়িত সমভূমিতে থেকেও কি সেই জগৎবিখ্যাত চা এর স্বাদ পায় শুভ ? শুভ কেন হয়তো সে স্বাদ থেকে বঞ্চিত অনেকেই। কারণ দার্জিলিং এর সর্বোন্নত মানের চা রপ্তানী করা হয় বিদেশ তথা পাশ্চাত্যের দেশ গুলিতে। তারা সেগুলিকে নানা রকম ভাবে প্রসেসিং করে তারপর ওদের বাজারে আনে। এতসব ভেবে চা বানাতে গেল শুভ। ও যেখানে থাকে সেটা চা চাষের জন্য তেমন উপযুক্ত না হলেও আজকাল চাবাগানগুলি সমতলেও গড়ে উঠছে। অস্থায়ী কর্মচারী দিয়ে কাঁচা পাতা রপ্তানী করে মুনাফা করে নিচ্ছে। সে চা অন্য কোন চা কারখানার সিটিসি মেশিনে ডাস্ট হয়ে বিক্রি হচ্ছে। তাই চা এর মান কমছে দিন-কে-দিন। এত সব ভাবতে ভাবতে চা এর জল টা বসিয়েছে। এমন সময় টুকটুক করে হেঁটে তার দিদা রান্নাঘরে উপস্থিত। দিদার এখন ৮২ বছর বয়স, এখনও নিজের কাজ নিজে করার সক্ষমতা রয়েছে তাঁর। দিদা তাকে বলল, "আমি থাকতে তুই চা করবি কেন? আমিও পান করব, তাই আমিই করি।" শুভর আপত্তি না শুনে নিজেই চা তৈরী শুরু করল। দিদা বলল, "তোরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা খুব স্বাস্থ্য সচেতন, এই বয়সেই যদি দুধ চিনি ছাড়া চা খাস, তাহলে আমার বয়সে কি করবি?" শুভ শুধু হাসে, আর মনে মনে বলে, "আমাদের সময়ে জ্ঞানে অজ্ঞানে কত যে বিষ প্রবেশ করছে শরীরে, আর তোমাদের মত হজম শক্তিও যে নেই।" "আজ আমি আমার মত করে চা তৈরী করব, পান করে বলিস কেমন লাগল" -এই বলে দিদা চা তৈরী করতে লাগল। শুভর ইদানীং চা পানের নেশা হয়েছে, আগে ও চা পান করত না। এখনও নেশা তেমন নেই, তবে পান করতে ভালো লাগে, কাজ করতে করতে একঘেয়েমিটা দূর হয়। দিদার হাতের চা ও কখনও পান করা হয়নি। চা তৈরী হলে দিদা তা নিয়ে এল। চা এ এক চুমুক দিতেই অসাধারণ অনুভূতি হল তার। ফেসিয়াল, ভেগাস ও গ্লসোফ্যারিঞ্জিয়ালের সাথে অলফ্যাক্টরি নার্ভ চকিতে সংকেত পাঠালো মস্তিষ্কে আর মস্তিষ্ক অপটিক নার্ভকে সচল করে দিল। শুভ দীর্ঘদিন ধরে এমন একজায়গার স্বপ্ন দেখে যেখানে সে নিজে কখনও যায়নি। সে দেখে একটি পাহাড়ি জায়গা। বাড়ি থেকে দেখা যায় টিলা। টিলার মাঝামাঝি চলে গিয়েছে রাস্তা। বেশ কিছুদূর সে রাস্তা দিয়ে গেলে একটা ফ্লাইওভার পরে। রাতেও আলোকমালায় সজ্জিত সেই ফ্লাইওভার দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে নাইটবাস গুলি। ফ্লাইওভার শেষে কাঁটাতারের বেড়া, ওপারে অন্যদেশ। রাস্তা ঘুরে সীমানার সমান্তরালে চলেছে, কিছুদূর যাওয়ার পর নয়ানজুলি রয়েছে, তারপর হাসপাতাল, শিশুউদ্যান। টিলার উপরে দুর্গম রাস্তা ধরে উঠলে ঝর্ণা দেখা যায়। মেঘের রাজ্য থেকে যেন অবিরত জল বয়ে আনছে সে। টিলা থেকে নেমে কোয়ার্টার্সের মত তাদের বাড়ি। বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকে এগোলে বিরাট হ্রদ। সে হ্রদ দিনের আলোয় টিলার মুখ দর্শনের আয়না আর রাতে নক্ষত্র খচিত কালো আকাশের প্রতিবিম্ব। স্থির জলে হাওয়াও তেমন আন্দোলন তুলতে পারে না। দিনে মাত্র দুবার আন্দোলিত হয় সে জল। যাত্রীবাহী এক ট্রেণ প্রতিদিন নিয়ম করে হ্রদের ওপরের ব্রীজ দিয়ে এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে যায়। তখন হ্রদের জলে কাঁপন লাগে। ওপ্রান্তে কি আছে ? সেটা জানে না শুভ। দিগন্ত সেখানে সরু হতে হতে যেন বিলীন হয়েছে নীলাকাশ ও নীল জলরাশির মাঝে। হ্রদে এসে মিশেছে একটি দূরন্ত পাহাড়ি নদী। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতেই অফুরন্ত জলরাশি পাহাড় থেকে এনে ঠেলে দিচ্ছে এ হ্রদে। এ নদী দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫ কিমি হবে তবে এই দৈর্ঘ্যের সাথে তার প্রস্থ যেন বড়ই বেমানান। ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। সেখানে অনেক কমলালেবুর বাগান পেরিয়ে নদীর তীর। নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু। বর্ষায় যখন জলস্তর বাড়ে, নীচের কাঠের পাটাতনের ফাঁক দিয়ে জলকণা এসে পড়ে। তখন ভয় হয় এ নদী পারাপারে। তবু যেন অতন্দ্র প্রহরী হয়ে লোহার তারগুলি এক কিলোমিটার নদী পার করে দেয়। ওপারে চা বাগান। এটুকু এসেই যেন প্রতিবার ঘুম ভেঙে যায় তার, কিন্তু আজ সে আরও অনেক কিছু শুনছে। কি ব্যাপার ! সচেতন হতেই খেয়াল করল দিদা চা বাগানের কথাই বলছে। শুভ আরও এক চুমুক দিয়ে শুনতে লাগল দিদার কথা, তার মানে এতক্ষণ দিদাই বলছিল এই বর্ণনা। অথচ শুভ এর আগে কোনদিন শোনেনি এসব। শুধু স্বপ্নে দেখেছে। দিদা বলছে, "সেই চা বাগানেই আমার ছোটবেলা কেটেছে। বিদেশী সাহেবদের আনাগোনা ছিল খুব। আমি খুব অল্প বয়স থেকেই চা বানাতে পারি, চা পান করতেও খুব ভালোবাসি। তখন কত হবে এই ১২-১৩ বছর বয়স, সেখানে একটা বিদ্রোহ হল শ্রমিকদের। কিছু অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছিল বোধহয়। সেই ঘটনার তদন্তে এল এক সুদর্শন অল্পবয়সী পুলিশ অফিসার। সবসময় বড়বাবুর বাড়ি থেকেই চা যেত অতিথিদের জন্য। সেবার বড়বাবুরা কেউ ছিলেন না, তাই অফিসবাবু মানে আমাদের বাড়ি থেকে চা পাঠাতে হবে। বাবা বলল আমাকে চা বানাতে। আমি সুন্দর করে চা বানিয়ে পাঠিয়েছি। এর সপ্তাহখানেক পর সেই অফিসার আবারও তদন্তের স্বার্থে আসে বাগানে। চা খাওয়ার প্রসঙ্গ উঠতেই বলেন এর আগেরবার যিনি বানিয়েছিলেন চা যেন তিনিই তৈরী করেন। তখন তো ছোট ছিলাম এও যে প্রশংসা তা তখন উপলব্ধিতে আসেনি। আমার তখন খেলার সময়, রাগ দেখিয়ে আর চা বানাইনি সেদিন। তারপর আর দেখিনি কখনো তাকে।" এই বলে দিদা চুপ করতে শুভ বলল, তারপর কি হল ?" দিদা বলল, "আর তো জানি না" শুভ একটু হাসল, আর বলল, "এও কি হয়? এও সম্ভব ? আচ্ছা তার পরের কথা আমি বলি শোন।" দিদা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে শুনতে লাগলো। শুভ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে স্বস্তিসূচক শব্দ করে বলল, "সেদিন যখন চা পান করল সেই অফিসার বুঝতে পারলো এ চা আগের দিনের জন তৈরী করেনি। কিন্তু স্বাদ যে লেগে রয়েছে জিভে। ভগ্নমনোরথ হয়ে যখন সে ফিরছিল জিপ চালিয়ে তখন হয়তো একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল। যার বানানো চা সে খেতে চেয়েছিল, সেই অদেখা নারীর প্রতি কোন টান অনুভব করছিল বুঝি সে। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির খুব কাছেই চলে এসেছিল, এমন সময় উল্টো দিক থেকে আসা ট্রাকের সাথে জোড় ধাক্কা। এভাবেই আক্ষেপ নিয়ে জীবনের ইতি হয় তার।" দিদা কিছু মনে পড়ার মত করে বলল, "আমি কি তোকে আগে করেছি এ গল্প? কারণ আমি পরে শুনেছিলাম যে সেই অফিসার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।" শুভ হেসে বলে, "না দিদা, তুমি বলনি, কিন্তু আমি জানি। তোমার মনে আছে তোমাকে আমি খুব ছোটবেলায় আলোরফুলকির একটা গল্পের চরিত্র 'হাজার টাকার বউ' বলতাম। ঠিকই বলতাম জান? জন্মান্তর আছে। সেই অফিসার আমিই ছিলাম আগের জন্মে। হ্যাঁ, তুমি যে যে বর্ণনা দিলে জায়গাটার আমি সেখানে না গেলেও অনেকবার দেখেছি স্বপ্নে। আমি শুধু জুড়তে পারতাম না ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নগুলোকে। আজকে তোমার চা খেয়ে আমি সেদিনের স্বাদ পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। আজ যেমন ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিন, তুমি মনে করে দেখ, সেদিনও এমনই দিন ছিল। মনে করে দেখ দিদা, সেটাও ছিল ২১ শে মে ১৯৫৩ সাল।" দিদা আর শুভ দু'জনেরই চোখে জল। ভালোবাসা তো শুধু এক ধরনের নয়, দিদা ও নাতির মধ্যেকার ভালোবাসায় পরিনতি পেল ৭০ বছর আগের জন্মান্তরের ভালোলাগা। আর সবচেয়ে বড় কথা যে চা নিয়ে এত কান্ড আজ সেই 'আন্তর্জাতিক চা দিবস'। 




                    মূল পাতায় যান



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪