স্মৃতিকথা
আশ্বিনের শারদপ্রাতে
ডরোথী দাশ বিশ্বাস
ঝুম বর্ষা শুরু হলো, আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, সারাদিন ঝিরঝির ঝমঝম একটানা বৃষ্টি, সন্ধ্যাবেলা বৃষ্টি থামলেও আকাশের মুখ ভার। এ কি শরত? এ যে বর্ষাকাল না হয়ে যায় না। চারিদিকে জল থই থই, মাঠ ঘাট জলে জলময়। করলা, বুড়ি তিস্তা ব্রীজের নীচ দিয়ে বয়ে চলা কলাইনদীতে বেশ জল দেখলাম। বিলে কচুরীপানার ভিড়ের মাঝে ছোট্ট ছোট্ট শালুক পাতার সহাবস্থান। কচুরীপানার নীল ফুল ফুটে রয়েছে সর্বত্র, তবে শালুক ফুলের দেখা নেই। একগুচ্ছ পুষ্ট কাশফুল জলে ভিজে ভারি হয়ে নুয়ে পড়েছে জলার ধারে। বহির্বাড়ির উঠোনে পোয়ালপুঞ্জী ভিজে জবজবে, একটা চালার নীচে দাঁড়িয়ে তিন চারটে গরু বৃষ্টিতে ভিজে আড়ষ্ট। বিকেলে দেখি, জলার ধারে একটা বক নিশ্চুপ হয়ে এদিক ওদিক দেখছে। আরও কিছু দূরে আরও একটা বক। একটা বাজে পোড়া পত্রবিহীন গাছের প্রত্যেকটি ডালে প্রচুর পাখি - কিন্তু তাদের ডাক শোনা যাচ্ছে না। সীসের মতো রঙ ধরেছে আকাশ। এ বর্ষাকাল না হয়ে যায় না। অথচ আজ ভোরেই মহালয়া - ভাবা যায়? শরতের চেনা রূপ কোথায় !!! "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে"- মনে হয়? "বাজলো তোমার আলোর বেণু "? মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা। মহালয়ার আগেই দাদু তাঁর ১৯৩৪ সালে কেনা হিজ মাস্টার্স ভয়েস্ কোম্পানীর গ্রামোফোনে বাজাতেন - ধীরেন দাসের কন্ঠে "দি টুইন" - কোম্পানীর রেকর্ড "আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে ..." যার অপর পিঠে ছিলো, "আজ আগমনীর আবাহনে, কি সুর উঠেছে বেজে ..." শব্দবাজীর একটানা শব্দ, আমি আর বোন খুব ছোট তখন। মহালয়ার আগে রাত্রে জেগে পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকা, মনে আগমনীর আগমনে চোরা আনন্দস্রোত বয়ে চলা। চোখে কি আর ঘুমের ঘোর লাগত না? লাগত বৈ কি। তবে রাত ভোর হলেই মহালয়া তো, তাই জাগতে হবে মনে করেই জেগে থাকা। আজ বড় বেশী করে মনে পড়ে ফেলে আসা সেই দিনগুলির কথা। ভাড়া বাড়ি, এক ঘরে দুটো খাট পাতা। পিতল দিয়ে সুদৃশ্য কাজ করা লোহার স্প্রীং-এর শৌখিন খাট একটা - সেটা দাদুর। আর একটা সেগুন কাঠের বড়সড় খাটে আমি, দিদা, মাসী ও বুনু। ভাই মামণি বাবার সাথে থাকতো অন্য ঘরে। আমরা যে ঘরে থাকতাম সে ঘরে একটা ছোট্ট কাঠের আলমারী ছিলো। তাতে দাদুর চিঁড়া, সাবু, চিনি, গুড়, কদমা, বাতাসা, কলা - থাকতো। রাতের খাবার খাওয়া হলে মাটির রান্নাঘর থেকে ধোওয়া কাঁসার বাসনপত্র এনে এই শোবার ঘরের খাটের নীচে রাখা হতো। ফুটোনো খাবার জল থাকতো ঘরে। সিমেন্ট করা মেঝেতে আসন পেতে বসে লন্ঠনের আলোয় পড়তাম আমি আর বোন। রাত জাগলে খিদে পাবেই, তাই আলমারী থেকে সাবু বের করে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতাম। মহালয়া শুরুর আগেই মামণি-ও উঠে পড়তেন, স্নান করে সেই পুণ্যলগ্নে শঙ্খ বাজাতেন। আমরাও চিনি কলা দিয়ে সাবু মেখে খেয়ে নিতাম দু'জনে। নিজের আবিষ্কার ও নিজ হাতে তৈরী এই খাওয়াই যেন তখন অমৃত মনে হতো। পড়তে পড়তে রাত যত বাড়ত তত ভোরের শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, মাটির ওপর টুপটুপ ঝরে পড়া শেফালি, তিস্তা স্পারের কাশ, রাজবাড়ির পদ্মদীঘির পদ্ম যেন ইশারায় ডাকতো, মন আনচান করে উঠতো, ওদিকে রেডিওতে "আশ্বিণের শারদ প্রাতে ... বাজলো তোমার আলোর বেনু ... জাগো, তুমি জাগো ..." আর এদিকে সাথিদের আগে থেকে বলে রাখা নির্ধারিত সময়ে টুক করে বেরিয়ে পড়া। জবা, সবিতা, টুলু, আমি, বুনু - এই পাঁচজনের দল এক সাথে হৈ হৈ করতে করতে আমাদের খেলার স্থান লাইফ ইন্সিওরেন্স বিল্ডিং পার হয়ে শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে মাসকলাই বাড়ি হনুমানজীর মন্দিরকে বাঁ- এ রেখে ডাইনে শ্মশানকালীবাড়ি ছাড়িয়ে করলাব্রীজে ওঠা। এর একদিকে মহাশ্মশান, অপর দিকে বিসর্জনের ঘাট। বিসর্জনের ঘাট যেদিকে সেদিকে জলে নেমে তর্পণ করত অনেকেই। ব্রীজের ওপর যত বোম পটকা ফাটাতো সবাই কারণ শব্দের সাথে সাথে প্রতিধ্বনি মিশে শব্দবাজীর শব্দ আরো জোরালো হতো যে। বুনুর হাত ধরে ভয়ে ভয়ে সেই ব্রীজ দ্রুত পার হতাম আমি।করলাব্রীজ পার হয়ে সোজা রাণী অশ্রুমতী টি.বি. হাসপাতাল, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউশন, গভঃ ইঞ্জীনীয়ারিং কলেজ - একে একে পার হয়ে ৩১ নং জাতীয় সড়কের পশ্চিম দিকে দেবী চৌধুরাণী মন্দিরের গা ছমছমে নির্জন পরিবেশে এসে পড়তাম। সেই সময়ে পণ্যবাহী বড়ো বড়ো ট্রাকের মিছিল, তাদের ভারে মাটির কম্পন অনুভব করতাম। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষ ফুটে উঠতে দেখা যেত। পুবদিক ক্রমে লাল হয়ে উঠতো, যথাসময়ে সূর্য্য উঠে যেতো। কোন কোন বছর ভোরে বৃষ্টি হতো না যে তা নয়। কখনো দেখেছি শারদীয়া আকাশ বর্ষার মেঘভারে নুয়ে পড়তো। অবশেষে ভোর হতে একটানা ঝিরঝির বৃষ্টিতে সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যেতো। বৃষ্টি ধরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। ঈশ্বর হয় তো আমাদের মনের কথা শুনতেন। ধরেও যেতো বৃষ্টি। তারপরেই বেরিয়ে পড়া। বৃষ্টির জলে ভেজা পিচরাস্তা জুড়ে বাজী পটকার লাল সোনালী কাগজ এঁটে থাকতো। বাতাসে ছড়িয়ে থাকতো পোড়া বারুদের গন্ধ। ঐ বয়সেই ভাবতাম, মানুষ বাজী পুড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করার মাধ্যমে কত টাকাই না নষ্ট করে।
আমার স্মৃতিতে মহালয়া
শুভ্রজীৎ বিশ্বাস
সংস্কৃতি, কৃষ্টি মানুষকে ছোট থেকেই প্রভাবিত করে। যখন ছোট ছিলাম মহালয়ার আমেজটাই ছিলো আলাদা। মহালয়ার আগের দিন স্কুল থেকে ফিরেই শুরু হয়ে যেতো পিকনিক এর জন্য বন্ধুরা মিলে টাকা তোলা। মেনুতে চিকেন আর ভাত। এরপর বিকেল গড়াতেই দল বেঁধে হই হই করে ব্যাগ নিয়ে বাজার যাওয়ার পালা। তখন গুঁড়ো মশলার চল অতো ছিলো না। পেঁয়াজ থেকে শুরু করে লঙ্কা, চাল, মাংস সব দরদাম করে কেনা হতো। সাথে কফি আর ভুজিয়া কেনার কথাটা কখনো ভুলতাম না। ফিরে এসে বাড়িতে হাত মুখ ধুয়ে কিছু মুখে দিয়েই সোজা পাশের মাঠে। মহালয়ার আগের দিন পড়াশুনা সব তোলা থাকত।এরপর শুরু হতো এর বাড়ি থেকে খুন্তি ওর বাড়ি থেকে কড়াই চেয়ে আনার পালা। তিনটে ইঁট দিয়ে সুন্দর করে গড়ে উঠতো আমাদের সাধের উনুন। রাত ৮ টা বাজতেই রান্না শুরু হতো। প্রথমে ভাত তারপর মাংস। মাঝে দু'একটা লঙ্কা বোম এর প্যাকেট ফাটানো, সাথে কফি ভুজিয়া সহযোগে একটু গান গল্প বা হিন্দি সিনেমার তালে তালে নাচ চলতো। অন্য দিকে কয়েকজন আবার বাড়ির পেছনে থাকা কলাগাছ থেকে কলাপাতা আনতে যেতো, ওতেই খাওয়া হবে যে। মাঝে রান্নার খড়ি কম পড়লে প্রতিবেশীদের বেড়া ভাঙ্গা হতো। যদিও কেউ কোনোদিন সে বিষয় নিয়ে রাগারাগি করেনি। রাত ৯ টা ৯:৩০ বাজতে বাজতে রান্না শেষ। এবার খাওয়ার পালা। লেগপিস নিয়ে প্রতিবার সমস্যা লেগেই থাকতো। আনন্দে সময়টা কি করে বয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম না। খাওয়া শেষে বাড়ি ফেরা। সঙ্গে তাড়া। তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে, পরদিন আবার কাকভোরে না উঠলেই তো কেলো। ভোর ৩:৩০ নাগাদ বাবার ডাকে উঠে এক কাপ চা নিয়ে রেডিও-তে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহালয়া শোনার যে অসীম আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তারপর অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ডিডি বাংলার সেই মহালয়া দেখা আজও খুব টানে। রাস্তায় কত মানুষ এই দিনটায় ভোরে ঘুরতে যেতেন। আজ কংক্রিটের জীবনে সব আছে কিন্তু উৎসবে সেই প্রাণ আছে কি? একটু ভাবলেই থমকে যেতে হয়। রেডিও-র জায়গা নিয়েছে ইউটিউব। ধুলোমাখা রেডিও-টা আজ হয়তো হাতে গোনা মানুষের কাছে বছরে একটা দিনই ব্যবহার হয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর যুগে বন্ধুরা মোবাইলের এক ক্লিক এ থাকলেও পাশে নেই। রোজ তো অসংখ্য মেসেজের আনাগোনা, তবুও দিনটা আসলেই মনে হয় তারা যেন আজ কত আলোকবর্ষ দূরে!সবাই নিজের পৃথিবীতে মত্ত। সেই মাঠটাও আজ আর ফাঁকা পড়ে নেই। সেখানে এখন বাড়ির ভিড়। সত্যিই আমরা অনেক বড় হয়ে গেছি। তাই সে মহালয়ার আমেজও হয়তো আর পাই না।
ডুয়ার্স টু দিল্লি
কবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
'পুজো' শব্দটাই এমন যা আট থেকে আশি পর্যন্ত সবাইকেই আন্দোলিত করে। বাঙালির প্রাণের পুজো দুর্গা পুজো । সারা বছরের অপেক্ষা... সবই ওই পাঁচটি দিন ঘিরে। নতুন জামা কাপড়, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, বেড়াতে যাওয়া , সবই যেন ঝুলি থেকে একসঙ্গে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে... যার যেটা ইচ্ছে বেছে নেয়। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সপরিবারে মা, আলোর রোশনাই আর সেই আলোতে আলোকিত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এই রকমই ছিল পুজোর ছবি কিন্তু গত বছর থেকে সম্পূর্ণ ওলটপালট হয়ে গেল। মা এখনো আসেন, তবে সাধারণ মানুষ তাঁকে ছুঁতে পারে না। শ্রদ্ধা সুমন পৌঁছিয়ে দেয় মনে মনে। অসহায় মনের স্মৃতিচারণ ছাড়া গতি কি? আমিও সেই চেষ্টায়...
পুজো দোরগোড়ায় ... জানান দিচ্ছে আকাশ, টের পাচ্ছি ভোরের শিরশিরে হাওয়ায়; ঠিক এমনই হাওয়া বইতো যখন আমি ছোট ছিলাম, থাকতাম নর্থবেঙ্গলে। বড়মামার ট্রান্সফারেবল জবের জন্য অনেকগুলো জায়গায় থেকেছি কিন্তু পুজোর কথা ভালো করে মনে পড়ে শুধু ওদলাবাড়ির। ওদলাবাড়ি তে তখন দুটোই পুজো হত একটা বাড়ির কাছে (পাড়ার নাম মনে নেই) আর একটা কলোনিতে (রেললাইন পেরিয়ে)। মনে আছে একবার পুজোয় বাড়ির কাউকে না জানিয়ে কলোনির পুজোর (নবমীর রাতে) ধুনুচি নাচ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। পুরস্কার স্বরূপ পাওয়া একটা সাবান-দানী আনন্দের সঙ্গে কি আতঙ্ক জাগিয়েছিল সেটাই বলি। ছোটমামা জানিয়ে দিয়েছিলেন দশমীর দিনেই আমাকে কলকাতায় বাবা-মার কাছে রেখে আসবেন, (যাই হোক সেই যাত্রায় দিদার কান্না-কাটিতে আর সেটা করেননি) সারাদিন দমবন্ধ করা সাসপেন্সের পরে ঘীস নদীর ধারে প্রতিমা নিরঞ্জন দেখা আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে।
লাটাগুড়ির, বেলাকোবার পুজোও দেখেছি, পুজো দেখেছি মালবাজারেরও, কিন্তু মনে ছাপ রেখেছিল ওদলাবাড়ি। একবার এক অসাধারণ বিসর্জন দেখেছিলাম জলপাইগুড়িতে। করলা নদীর বুকে নৌকোয় করে ঠাকুরকে ঘোরানো তারপরে বিসর্জন দেওয়া হতো। খুব কষ্ট হয়েছিল দেখে, মনে হয়েছিল ওই আলো-ঝলমলে নৌকোয় যদি আমি থাকতাম তাহলে মাকে জল ফেলার সময় ঠিক বাধা দিতাম।
আমার এরপরের কয়েকটি পুজো কেটেছে কলকাতায়। সেখানে শুধু ঠাকুর দেখা আর পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া মনে রাখার মত আর কিছু ছিল না। অবশ্য প্যান্ডেলের সজ্জা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা সকালে সন্ধ্যায় একই ঠাকুরের সামনে সাজ পরিবর্তন করে করে যেতাম। দশমীর দিন সকাল বেলায় বাবা দূরে কোথাও আমাদের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন।
পুজোর অভিনব স্বাদ পাই দিল্লিতে এসে, এখানে আসার আগে মনে হতো কলকাতার এত জাঁকজমক ছেড়ে দিল্লিতে থাকবো কি করে, বিশেষ করে পুজোর দিন গুলোতে..., কারণ কলকাতায় এত গায়ে গায়ে পূজো হয় যে বাড়িতে বসেও মাইকে পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র, ঢাকের আওয়াজ শোনা যায়, কিন্তু দিল্লিতে তা হবার নয়; পূজো প্যান্ডেলের কাছে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত সবটাই খাঁ খাঁ ... কিন্তু আমি মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ সত্যিকারের পুজোর আনন্দ এখানেই। প্রায় এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় নানা রকম প্রতিযোগিতা (পুজো উপলক্ষ্যে)। তাতে বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আমি এই প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা খুব উপভোগ করেছিলাম তখন, যখন দিল্লি তে এসেই প্রথমে আমি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম প্রতিযোগী হিসেবে।
পরবর্তীতে (এখন ও পর্যন্ত) একটু রদবদল, অর্থাৎ বিচারকের আসনে আমার জায়গা হয়েছে।
দিল্লিতে বাড়ির মহিলারা যথার্থ পুজো উপভোগ করে থাকেন। তিন দিন প্রায় সব বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। সকাল থেকেই সেজেগুঁজে প্যান্ডেলে, পুষ্পাঞ্জলির পর গোল হয়ে বসে আড্ডা, দুপুরে ভোগ খেয়ে বাড়ি ফিরে কোনরকমে কাজকর্ম সেরে আবার প্যান্ডেলে ফেরা, সন্ধ্যারতি দেখা এবং তার পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রায় রাত এগারোটা পর্যন্ত। এইসবের মাঝখানে কখনো কখনো প্যান্ডেল হপিং আবার তার পরে নিজেদের প্যান্ডেলে ফিরে আসা। খাবারের পর্যাপ্ত স্টল ...এক একটা পুজো প্যান্ডেল একএকটা বিশেষ খাবারের জন্য বিখ্যাত। দিল্লির সুপ্রাচীন পুজো কাশ্মীরী গেটের পূজো, তবে এই পুজো আরো একটা কারনে বিখ্যাত, সেটা হল বিরিয়ানি। পূজোর সময় বিশাল লাইনে হত্যে দিয়ে তবে এক প্লেট পাওয়া বিরিয়ানির স্বাদই আলাদা .... পুরো দিল্লিবাসী ওই একটা কারণে ওখানে যায়ই। আগে সমস্ত পুজো-আয়োজকরা নবমীর দিন বাসে করে দিল্লির সব বড় বড় পূজোর প্রতিমা দর্শন এর ব্যবস্থা করতো। দর্শনার্থীরা যে কোনো প্যান্ডেলে ভোগ প্রসাদ পেতো, এখন আর সেসব হয় না । আর এখন তো সবটাই স্তব্ধ! দিল্লিতে ঠাকুরের ভাসান একটা সুন্দর নিয়মে হয়। সারা দিল্লির ঠাকুর নিজ নিজ প্যান্ডেলে বরণের ও সিঁদুর খেলার পরে নিউ দিল্লি কালীবাড়ি তে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে সিরিয়ালি বিসর্জনের নাম্বার দেওয়া হয় এবং সেই অনুযায়ী যমুনায় বিসর্জন হয়। বিসর্জনের কথায় একটা মজার ঘটনা মনে পড়লো। দিল্লিতে আসার পরে প্রথম দুর্গাপুজোর ভাসান। যমুনা-পাড়ে মা তখন কৈলাশে যাওয়ার অপেক্ষায়। মায়ের সামনে ভক্তরা ধুনুচি নাচ নাচতে ব্যস্ত। নাচছিলাম আমিও, নাচতে নাচতে বালিতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলাম। কতক্ষণ নেচেছিলাম জানিনা, তবে আমার কর্তামশাইয়ের ভাষায় , তিনি নাকি প্রমাদ গনছিলেন !
সবই এখন স্মৃতি.... পূজোর আনন্দের অংশীদাররাও এখন অনেকেই নেই, তবু ভাবতে তো দোষ নেই যে তাঁরা আছেন এবং বেশি করেই আছেন।
এখন অপেক্ষায় ....
জীবন আবার ফিরুক সমে ,পুজো আবার হোক্ সকলের জন্য, মা আসুন দেশে, বিদেশে, প্রবাসে।
মিষ্টি কথা
সুনৃতা রায় চৌধুরী
ও ও ও আয়রে ছুটে আয়
পুজোর গন্ধ এসেছে
ঢ্যাম কুরকুর ঢ্যাম কুরকুর বাদ্যি বেজেছে....
এই গান শুনে বড় হয়নি, এমন কোনো বাঙালী শিশু নেই। কিন্তু পুজোর গন্ধ মানে কি?
আমার কাছে পুজোর গন্ধ মানে কয়েকটি গন্ধের সংমিশ্রণ। শিউলি ফুলের গন্ধ,ধুনোর গন্ধ, নতুন জামা কাপড়ের গন্ধ, নৈবেদ্যর গোবিন্দভোগ চাল, ঘিয়ের গন্ধ, ভোগের খিচুড়ির গন্ধ। কিন্তু পুজোর গন্ধ অসম্পূর্ণ থাকে যদি নাড়ুর জন্য নারকেল গুড়ের পাকের গন্ধ না থাকে।
আমাদের ছোটবেলায় বিজয়ার মিষ্টিমুখে সবসময়ই ঘরের তৈরি মিষ্টিই প্রাধান্য পেত। বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হতো নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, খইয়ের মোয়া, চিঁড়ের মোয়া, কুচো গজা, জিভে গজা, বেসন দিয়ে তৈরি সিঁড়ির নাড়ুও তৈরি হতেও দেখেছি কোথাও। আর হতো নারকেলের তক্তি। ঝুরোঝুরো করে নারকেল কুরিয়ে চিনি দিয়ে পাক দেওয়া হতো, তার পর একটা কাঠের বারকোশে তা ঢেলে একটু তাপ কমলে ছুরি দিয়ে বরফি আকারে কেটে নেওয়া হতো। তাতে কখনো ছোট এলাচ গুঁড়ো অথবা কর্পূর দেওয়া হতো। কিন্তু পাক কম হলে তক্তি হবে না আবার বেশি হলে ভেঙে যাবে। তাই সাবধানে পাক দেওয়া হতো, রং থাকতো ধবধবে সাদা, একটুও লেগে ধরলে চলবে না। কখনো মাঝখানে একটা কিসমিস বসিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হতো। নারকেল বেটেও তক্তি করা হতো একই ভাবে, কিন্তু তা এত সাদা হতো না।গুড় দিয়েও বাটা তক্তির পাক দিতে দেখেছি কাউকে কাউকে।
আমার মাকে দেখতাম নারকেল বাটা আর ক্ষীর মিশিয়ে চিনির পাক দিয়ে ছোট এলাচ গুঁড়ো সামান্য দিয়ে হাতে পাকিয়ে তাকে লিচুর আকারে গড়তে। তার ওপর শুকনো খোলায় ভাজা পোস্ত ছড়িয়ে তৈরি হতো ক্ষীরের লিচু। তাতে লবঙ্গ দিয়ে বোঁটা বানানো হতো।
নারকেল চিনির পাকের মধ্যে ঘিয়ে ভাজা বেসন আর ছোট ছোট করে কাটা কাজু কিসমিস আর ছোট এলাচের দানা অল্প ছড়িয়ে সে এক অপূর্ব সুস্বাদু লাড্ডু তৈরি হতো।
শুধু আমাদের বাড়িতে না, আশেপাশে সব বাড়িতেই তখন মিষ্টিমুখের আয়োজন। ছোট থাকতে আমাদের কাছে খবর থাকতো কোন বাড়িতে কোনটা স্পেশাল। আমরা যেতে কুণ্ঠাবোধ করতাম না বা তাঁরাও বিরক্ত হতেন না, বরং খুশি হতেন। আমাদের মা-বাবার তখন এত অহেতুক ভয় ছিল না আমাদের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে।সবাই সবার বাড়ি অবাধে যাতায়াত করতো। টিভি তখন সন্ধ্যাগুলোকে গ্রাস করেনি।
একটা গল্প মনে পড়লো। মা বাবার কাছে শোনা। আমার জন্মের অনেক আগে আমার বাবা তখন উত্তরবঙ্গের এক জেলা শহরে। সেখানে অফিসারদের একটা ক্লাব ছিল। সন্ধ্যা বেলায় সবাই সেখানে জমা হয়ে গল্প গুজব খেলাধুলা করতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হতো। একবার বিজয়ার সময় আমার বাবা প্রস্তাব দিলেন একেক দিন একেক বাড়িতে যাওয়া হবে বিজয়া করতে। এবং সবার বাড়ির খাদ্যতালিকায় নতুনত্ব কিছু থাকতে হবে। পুনরাবৃত্তি চলবে না। সবাই হই হই করে সমর্থন জানালেন কিন্তু বাবাকে জব্দ করার জন্য বললেন যে আমাদের বাড়িতে সবার শেষে যাবেন সবাই। বাবা নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়লেন। মা সব শুনে কিন্তু একটুও বিচলিত হলেন না। প্রথম দিকে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তো নাড়ু, নিমকি কেনা রসগোল্লা পান্তুয়া দিয়ে পার পেয়ে গেলেন। অবশেষে কালী পূজার অল্প আগে আমাদের বাড়িতে এলে মায়ের হাতের ফুলকপির সিঙাড়া, তক্তি নাড়ু, ঘরে তৈরি রসমালাই ইত্যাদির সঙ্গে মা দিলেন গঙ্গাজলি।
নারকেল সাবধানে কুরিয়ে নিয়ে তার থেকে দুধ কিছুটা বার করে চিনি দিয়ে শুকনো করে পাক দিয়ে বেটে নেওয়া হতো। পেতলের তৈরি গঙ্গাজলির ছাঁচে পাতলা মলমল কাপড় দিয়ে তার ওপর গুঁড়ো নারকেলের পাকটা দিয়ে খুব চেপে চেপে ভরে পরে আস্তে করে কাপড়টা টানলে সেটা ছাঁচ থেকে বেরিয়ে আসতো। রং একেবারে ধবধবে সাদা। মুখে দিলে মুখে মিলিয়ে যায় আর একটা ঠাণ্ডা ভাব ছড়িয়ে পড়ে। যার পর নাই প্রশংসা পেয়েছিল এই গঙ্গাজলি। বাবাকে জব্দ করতে না পেরে সবাই ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।
সেই সব মিষ্টি দিন, মিষ্টি হৃদয়, মিষ্টি ব্যবহার, সর্বোপরি মিষ্টি সম্পর্কগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।আজ তাদের আর খুঁজে পাইনা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন