প্রবন্ধ



"মহালয়া" কী ও কেন ...

তপন পাত্র

কথা হচ্ছিল দু'চার জন গৃহবধুর সাথে । প্রসঙ্গ: "মহালয়া"। তাঁরা তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী। মহালয়ার ভোরে প্রায় জোর করেই তাঁদের জাগিয়ে দেওয়া হতো। স্কুল মাঠের বকুলতলায় ঢুলু ঢুলু চোখে বসে পড়তেন তাঁরা। ছোট্ট আয়তাকৃতির একটা বাক্স থেকে ভেসে আসতো কী সব গান আর খুব গম্ভীর গলায় যত্তোসব মন্ত্র!

একসময় সকাল হয়ে যেত। তাঁরা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করতেন, ''তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে মহালয়া দেখতে পেয়েছিস?" উত্তর আসতো-"না"।
আর তুই?
প্রতিউত্তর-"না"।
দীর্ঘ কয়েকটা বছর তাঁদের ধারণা ছিল মহালয়া মানে, ভোর বেলায় আকাশে হয়তো বিশেষ কিছু দেখতে পাওয়া যায়, তাঁদের দুর্ভাগ্য তাঁরা দেখতে পাননি। কড়া মেজাজের দিদিমণিদের এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করারও সাহস হয়নি।

পরে ধীরে ধীরে বড়ো হবার সাথে সাথে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো তাঁদেরও ধারণা বদলালো। তাঁরাও ভাবলেন, মহালয়া মানে বাণীকুমার সম্পাদিত গীতি আলেখ্য "মহিষাসুরমর্দিনী"। এক ঝাঁক সংগীত তারকার ভুবনমাতানো গান এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ।

সত্যি কথা বলতে কি, আপামর বাঙালীর কাছে আজও মহালয়া মানে ওই আলেখ্য। মহালয়া মানে পুরানো রেডিও, ভাঙাচোরা রেডিও সারিয়ে সেই বিশেষ ক্ষণটির জন্য দিন গোনা, প্রহর গোনা।

সময় বদলের সাথে সাথে দূরদর্শন মহালয়ার ভোরে কতো অনুষ্ঠানই না করলো, কতো নাচ, কতো আঙ্গিক, কতো প্রেক্ষাপট, রূপসজ্জা, দৃশ্য সজ্জা, লোকনৃত্যের আমদানি। কিন্তু একটু বয়স্ক বাঙালী "মহালয়া" বলতে ওই বিশেষ আলেখ্যটি নিয়ে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে যায় । আরো অনেকদিন হয়ে যাবে ।

কিন্তু এ তো অন্য কথা ।
আসল কথা হল "মহালয়া" টা কী এবং কেন?

আমরা অনেকেই বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে। যদিও অনেক কথাই প্রচলিত আছে "মহালয়া"কে অবলম্বন করে ।

তিথিগত দিক থেকে "মহালয়া" হল পিতৃপক্ষ । "মহালয়া" বলতে যে দিনটিকে বুঝি, সেটি এই পক্ষের পঞ্চদশতম দিন। পিতৃপক্ষ বা মহালয়া পক্ষের ১৫ টি তিথি। এগুলি হল প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা।
এরপরই দেবীপক্ষের সূচনা। মহালয়া পক্ষের শেষ দিনটি আমাদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে হিন্দুধর্ম বিশ্বাস করে এই শুভক্ষণে মা দুর্গা দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অনুমতি নিয়ে কৈলাস থেকে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

মহালয়ার সর্বাপেক্ষা মাধুর্যমন্ডিত মুহূর্তটি হ'ল এই বিশেষ সন্ধিক্ষণ - 'পিতৃপক্ষের সমাপ্তি ও মাতৃ পক্ষের সূচনা', এটি এক পক্ষ কাল ব্যাপী পিতৃতর্পণের শেষ লগ্ন।

সকলেই অবগত আছেন, চিরন্তন ও আসল দুর্গাপূজা টি হ'ল বাসন্তী পূজা, যা অনুষ্ঠিত হয় বসন্তকালে। মহাকাব্য "রামায়ণ" অনুসারে সীতাদেবী কে উদ্ধারের জন্য শ্রীরামচন্দ্র কে অকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করতে হয়। সময়ের সাথে সাথে দেবীর অকালবোধন এই শারদীয়া দুর্গাপূজাই সর্বজনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ধর্ম মতে কোন মঙ্গল কর্ম করতে গেলে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। তর্পণ হ'ল তিল- তুলসী- জল, ফলমূল দানের মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষকে তৃপ্ত করা। ভগবান রামচন্দ্র সীতালক্ষ্মীকে উদ্ধারের আগে মহালয়ার দিন এমন কাজই করেছিলেন।

এখন প্রশ্ন হলো, এই মুহূর্তটির নাম "মহালয়া" হ'ল কীভাবে? 
সংস্কৃত "মহ" শব্দটির অর্থ "পিতৃগণ" আর "আলয়" শব্দের অর্থ "আগমনকাল"। মহ+আলয়=মহালয়। তার সাথে স্ত্রীলিঙ্গে "আ" যোগ করে "মহালয়া"।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর "বাঙ্গালা ভাষার অভিধান" এ বলেছেন: "শ্রাদ্ধকালে যে সময়    পিতৃলোকেরা শ্রাদ্ধ ভোজনের জন্য আনন্দ সহকারে এসে থাকেন, সেই মুহূর্তটির নাম মহালয়া"।
শারদীয়া পূজার অব্যবহিত পূর্বে আরম্ভ করে অমাবস্যা তিথিতে এই আগমন শেষ হয়। পিতৃ বিসর্জন মন্ত্র আছে, "যমলোকং পরিত্যাজ্য আগতা যে মহালয়ে"।

হিন্দু পুরাণ অনুসারে মর্ত্যলোক এবং স্বর্গলোকের মাঝখানে পিতৃলোক নামে একটি স্থান আছে। মৃত্যুর পর মৃতের আত্মা পিতৃলোকে অধিষ্ঠান করেন। সেখানে যমরাজ সর্বময় কর্তা। যমরাজের অধীনে সেখানে তিন পুরুষের আত্মা বাস করেন। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন পুরুষের তর্পণ করা হয়। পরবর্তী এক পুরুষের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের এক আত্মা স্বর্গলোক গমন করেন। অর্থাৎ পিতৃলোকে সর্বদা পিতা, পিতামহ এবং প্রপিতামহ বিরাজ করেন। তর্পণে এই তিন পুরুষের আত্মাকেই অঞ্জলি দেওয়া হয়।

কথিত আছে, রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি এই ভব সংসারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বনে গমন করেছিলেন। গভীর অরণ্যে তাঁরা দু'জন ধ্যানমগ্ন হবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফেলে আসা জীবনের সুখ-দুঃখ এবং ঐশ্বর্যের চিন্তা ভুলতে পারছিলেন না। তাই তাঁরা মেধা ঋষির আশ্রমে যান, সেখানে শ্রীশ্রীচণ্ডী বিষয়ে আলোচনা চলছিল। সুরথ ও বৈশ্য সমাধি ঋষিকে তাঁদের সমস্যার কথা জানালেন। তখন ঋষি বললেন, এই ভব সংসারের মোহ-বন্ধন এবং মুক্তি - সমস্ত কিছুই মাতৃ আরাধনার মধ্যে নিবিষ্ট রয়েছে। তাঁরা পরম মাতৃদেবীকে লাভ করার জন্য মাতৃপক্ষের প্রারম্ভ কালে নদীসমীপে তর্পণ করেছিলেন এবং মায়ের দর্শন লাভও করেছিলেন। এই স্থলে আমাদের ভারতীয় সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, মহালয়ার পুণ্য তিথিতে অশুভের বিনাশ এবং সৌভ্রাতৃত্বের ভাব বজায় রাখার জন্য বর্তমান যুগেও পিতৃ মহালয়া উপলক্ষে পিতৃতর্পণের মধ্য দিয়ে শুভ ভগবতী মা দুর্গার আরাধনা শুরু হয়। এই তিথিতে সমস্ত জ্ঞানী-গুণীজন নিজের পূর্ব তিন পুরুষ, এবং যে কোন আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব - সকলেরই পূর্বপুরুষের পারোলৌকিক আত্মার শান্তি কামনায় এই তর্পণ করে থাকেন। 

পুরাণ মতে, কর্ণ যখন মারা যান, তখন তাঁর আত্মা স্বর্গে গেলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে খাদ্য রূপে স্বর্ণ ও রত্ন দান করেন। কর্ণের আত্মা বিস্ময়ের সঙ্গে ইন্দ্রের এই আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, জীবদ্দশায় কর্ণ কখনো পূর্বপুরুষকে কোন খাদ্য বা জল তর্পণ করেননি, যা দান করেছিলেন তা শুধু সোনা। তাই কর্ণকে ১৫ দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে এসে এই মহালয়ার তিথিতে পিতৃতর্পণ করতে হয়, এই হল মহালয়ার গুরুত্ব।

এই তর্পনের প্রভাবে বিশ্বতর্পণ, রামতর্পণ, লক্ষণতর্পণ ক'রে  হিন্দুগণ সমস্ত আত্মীয়বর্গের তর্পণ করেন। শুরু হয়ে যায় মাতৃপূজা। কারণ জগজ্জননী দেবী দুর্গা বলেছেন -
"সর্ব্ববাধাবিনির্ম্মুক্তো ধনধান্যসুতাণ্বিতঃ।
মনুষ্যো মৎপ্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ।।"

অর্থাৎ আমার কৃপায় মানুষ সকল বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত হয় এবং ধন, ধান্য ও সন্তানাদি লাভ করে।




আড্ডা, নাম না বদনাম

গীতশ্রী সিনহা 

সর্বতোমুখী শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান আড্ডা। এই বর্ণময় শব্দটির ঠিকঠাক কোনও প্রতিশব্দ এর বিকল্প হতে পারে বলে জানা নেই। সভাসমিতি, আখড়া, ঠেক, চক্র, আসর থেকে শুরু করে ইংরেজি শব্দ ক্লাব, কর্ণার, পার্টি কখনও কখনও আড্ডায় মুখরিত হয়ে উঠলেও সর্বার্থে আড্ডা আখ্যা পেতে পারে না। দুটি মাত্র শব্দকে পেয়েছি যারা আড্ডার নিকটাত্মীয়। এক - বৈঠক, দুই - মজলিশ। আড্ডাবাজ মানুষদের সঙ্গে মজলিশি মানুষদের কিছু মিল পাওয়া যায়। তা ঠিক প্রতিশব্দ না হোক, তা নিয়ে মাথাব্যথা অভিধান প্রণেতার। আড্ডা একটি অবিকল্প মনের জানালা। স্পর্শকাতর, উচ্চমানের অসাধারণ শিল্প এই আড্ডা। যৌথ শিল্প বললে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ার কথা নয়। মহাকাশ থেকে মহিলা, মেশিন থেকে মন, বিজ্ঞান থেকে বিরহ, তত্ত্ব থেকে দেহতত্ত্ব, শিল্পচর্চা, পরচর্চা এই মিল-গরমিলের এজেন্ডাহীন অনুদ্দেশ আসরের স্বাদ পাই আড্ডায়।
বঙ্গসংস্কৃতির উৎসভূমিই হলো আড্ডা। আমাদের সাহিত্য এবং সাহিত্যিককে আড্ডাই বাঁচিয়ে রেখেছে। সাহিত্যের জগতে সর্বত্র আড্ডার শতরঞ্চি বিছানো। লেখক এবং কবিরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন, অনেক চিন্তাভাবনার শুরু এই আড্ডা থেকে। আশ্চর্যরকম প্রাণবন্ত সে আড্ডা, যেখানে হাসি-মজার মধ্যেও নানান লেখা নিয়ে আলোচনা, পান্ডুলিপি শোনা, লেখার প্রুফ দেখা, কোথায় লেখা ছাপানো হলো বা হলো না কেন, এসবই আড্ডার অনায়াস মুহূর্তে চলে আসে। এমনও দেখা যায় এই আড্ডার মধ্যে থেকে কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে ভালো লেখক বা কবি হয়ে উঠেছেন। 

চায়ের দোকানের আড্ডা নিয়ে গবেষণা করতে পারলে প্রারম্ভ পর্ব থেকে প্রসার পর্ব পর্যন্ত একটা ইতিহাস তৈরি হবে। ইংরেজদের গোড়ার আমলে রাজারানির যুগে মহিলাদের প্রসব হবার পর বেদনা বিনাশক ঔষধ হিসাবে চা খাওয়ানো হতো। এমন একটি দৃশ্য আজ কল্পনা করতে গেলে হাসি পায়। তখন চা আসত চীন থেকে। রাজতন্ত্র থেকে যেমন গণতন্ত্র, সেইরকম বাবু আভিজাত্যের ফিকে ছায়া থেকে সাধারণতন্ত্রে নেমে আসার প্রথম লক্ষণ চায়ের দোকানের আড্ডা। স্বামী বিবেকানন্দ ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, একদিন কলকাতার রাস্তার মোড়ে মোড়ে চা-চপ-কাটলেটের দোকান হবে। শুনেছি ফরাসিরা কাফেকে নিজের বৈঠকখানার এক্সটেনশন বলে মনে করে। ভাবনাটা এইরকম - এক কাপ গরম পানীয়কে সাক্ষী রেখে সৃষ্টিশীল মানুষের সামনে খুলে যাবে নতুন নতুন সৃষ্টির দ্বার।

কফি হাউস, নন্দন, রবীন্দ্র সদন, বইমেলা চত্বরের বা কলেজ স্ট্রিটের চায়ের দোকানে দোকানে মফস্বলের কবিরা কি একটু সান্নিধ্য-সুখের জন্য যান না? নামমাত্র দামের উষ্ণ চা সামনে রেখে তুমুল ঝড় তোলা আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে নিজেকে বারবার আরও একটু আবিষ্কার করা - ভাবের আদান-প্রদান পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভোগ করার জন্য রোজকার নিয়মের মধ্যে থেকে পালিয়ে যান কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা। স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, আমারও প্রায়ই এধরনের আড্ডায় হাজিরা দিতে ইচ্ছা করে, অবশ্য সুযোগ পেলে যে যাই না, তা নয়।
এবার, আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে - আড্ডার মূলে কি আছে কর্মবিমুখতা? ফাঁকি আর আড্ডা কি হরেদরে সমার্থক? বিশ্বের উন্নত ও সুসভ্য রাষ্ট্রের লোকেরা কি আড্ডা দেয় না? কর্মযোগীদের কি আড্ডা দেওয়া নিষেধ? আমরা জেনেছি গ্রিক পন্ডিতেরাও নাকি পতিতালয়ে বসে পরস্পর আড্ডা দিতেন। আবার আমরা এও জানি, সে আমলে রাজারা আড্ডা দেওয়ার জন্য মাসমাইনে দিয়ে পর্ষদ রাখতেন। বড়ো বড়ো রাশভারী ব্যক্তিত্ব তাঁদের অমূল্য সময়ের কিছুটা ব্যয় করতেন বৈঠকখানায় নিয়মিত আড্ডা দিয়ে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও প্রিয় সঙ্গে সময় কাটাতেন। তাই বলছি, আড্ডা শুধুই কর্মবিমুখতা নয়। অলসের অবসর বিনোদন বলেও চিহ্নিত করা যাবে না, আসলে আড্ডায় ভাবের বিনিময়, জ্ঞানের আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক বন্ধুত্ব ঘটে। আমি খুব বিশ্বাস করি, মানুষের পেশায় যতটা চেনা যায় তার চেয়ে ঢের বেশি চেনা যায় তার নেশাতে।
আড্ডার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বয়স। বয়সের সাথে সাথে বাছাবাছি আসতে থাকে সমমানসিকতা, সমপর্যায়, সমরুচি, সভ্যতা, শিক্ষা।
তবে, পিতৃ অন্নে লালিতপালিত, পড়াশোনা ছেড়ে বা স্কুল, কলেজ থেকে পালিয়ে মুখের ভাষা আলাদা করে, অন্য ঢঙে কথা বলে যে আড্ডা, তাকে নিশ্চয়ই আমরা সুস্থ মানসিকতার আড্ডা বলব না। সমাজে এগুলি মেনে নিতেই হবে। ভালোর পাশাপাশি মন্দ থাকবেই।

উষ্ণ, আন্তরিক, নিঃস্বার্থ, নিরবচ্ছিন্ন আড্ডাতে অংশ নিতে পারেনি বা তেমন কোনও আড্ডায় উপস্থিত থাকার যোগ্যতা যে মানুষের নেই তার পক্ষে আড্ডা সম্বন্ধে ধারণা হবে কি করে? আসলে আড্ডা তো উঠে আসে যাপিত জীবন থেকে। তাবৎ আঁতলামি আর নতুন ভাবনার দেখনদারির নীচে চোরাবালির মতো হারিয়ে না গিয়ে আমরা নতুন কনসেপ্টে বিশ্বাস করি। মনে করি দেশ, কাল, পাত্র নির্বিশেষে মানুষের চিন্তা মানুষের সম্পত্তি। দেখুন না, কি মিষ্টি নাম 'সুনামি', অথচ এরই মধ্যে ঠাসা আছে মৃত্যুর ভয়াল থাবা।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি সাহিত্যের সাথে আড্ডার যোগসূত্র কোথায়।
নিজেদের মধ্যে রেষারেষি, কলহ, মতান্তর এসব কোনও কারণে আড্ডা যেন না ভাঙে। বন্ধুত্ব, প্রীতির সম্পর্কই তো 'আড্ডা'কে বাঁচিয়ে রাখবে। তার সঙ্গে গত দিনকে কয়েক ঘন্টার জন্য ফিরে পাবার ব্যাকুলতা।
ভাবতে ভয় হয়, একদিন আড্ডা হয়তো আমাদের কাছে নষ্টালজিয়া হয়ে ফিরে আসবে।
আড্ডার জাত মেরেছে বাংলা ভাষার প্রতিশব্দের অভাব। এই আড্ডার বেজায় তারিফ করেছেন বিদগ্ধ আড্ডা রসিকেরা। বার্লিনে বিখ্যাত দিলীপ কুমার রায় ও তাঁর বন্ধুরা মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় কয়েকজন রুশ বান্ধবীর গৃহে এসে জুটতেন। বন্ধুদের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার ডাকসাইটে অধ্যাপক শাহেদ সুরাবর্দিও ছিলেন। বান্ধবীরা ছিলেন বিদুষী, সুরসিকা, গান-বাজনা, হাসি-গল্পের সমঝদার। চলত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। এই বান্ধবীরা একদিন বাঙালিদের জিজ্ঞাসা করলেন বাঙালির বৈশিষ্ট্য কী? সুরাবর্দির হাজির জবাব : যা আর কারও নেই- 'আড্ডা'। কথাটার অর্থ কী তা বোঝাতে দুই বাঙালি পন্ডিত মানুষের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
সেকালের সাহিত্য আড্ডা বলতে গেলেই বলতে হয় পত্রপত্রিকার কথা। প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র', সুধীর সরকারের 'মৌচাক', সজনীকান্ত দাসের 'শনিবারের চিঠি' আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সম্পাদিত 'বেতার জগৎ'। ১৯২৭-২৮ সালের কথা, কলকাতা বেতারকেন্দ্রের নাম ছিল 'ইন্ডিয়ান ষ্টেট ব্রডকাষ্টিং কোম্পানি। ঠিকানা ছিল ডালহৌসি পাড়ার গার্ষ্টিন প্লেস। কেন্দ্রের প্রোগ্রামারের কর্তা ছিলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। তাঁর সঙ্গে এসে জুটতেন রাইচাঁদ বড়াল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বানীকুমার ও প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তাঁর লেখা 'মহাস্থবিক জাতক' একটি অসাধারণ গ্রন্থ। আসতেন হাসির গানের বিখ্যাত গায়ক নলিনীকান্ত সরকার, হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট যোগেশ বসু, যিনি গল্পদাদুর আসরের প্রতিষ্ঠাতা। নৃপেন মজুমদার, বীরেন ভদ্র, বানীকুমার তো থাকতেনই, আর প্রায়ই থাকতেন পঙ্কজ কুমার মল্লিকও। রোজকারের এই জমাটি আড্ডা ছিল সংস্কৃতি ও সংগীতের আড্ডা, সৃষ্টিশীল আড্ডা।
ইন্টারনেট, ফেসবুক আমাদের জীবনকে গুটিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বাসী করে তুলছে ভার্চ্যুয়াল জগতের জীবনধারাকে। জীবন্ত আড্ডা হারিয়ে স্বপ্নরাজ্যে বাস করছি সবাই।

প্রাসঙ্গিক ভাবে একটু না বললে, লেখাটা এক সময় ইতিহাস বহনকারী তথ্য হয়ে উঠবে না, এমন আমরা করোনাভাইরাস আক্রান্ত সময়ের মধ্যে চলছি, গৃহবন্দী অবস্থায় আছি, সময়ের শিকার অবহেলা করলে সমাজ সংসার বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তারমধ্যে দেখা দিলো আমফানের ভয়াল থাবা! আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি বলেই সকল মানসিক এবং জাগতিক ব্যাধি প্রতিরোধ, অতিক্রান্ত করে উঠতে পাচ্ছি। আবার সুস্থ সুন্দর পৃথিবীতে দেখা হবে আমাদের আগের মতো করে নতুন উদ্যমে। আড্ডা আছে, চলবে, থাকবে, থাকবে সৃষ্টির সুখ প্রতিনিয়ত।




                    মূল পাতায় যান



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪