মুক্তগদ্য
একঘেয়ে কাহিনীরা
চৈতালী নাথ
শিউলির সাথে রজনীগন্ধার গন্ধমেশা বাতাস মাঝে মাঝে আমার ছোট্ট ঘরটাকে এমন উদাস মদির করে তুলছিল, যেন চোখ-মন দুই-ই জুড়িয়ে আসছিল!
জুড়িয়ে গেলেই পুড়িয়ে যায় উড়িয়ে দিয়ে ছাই...
ধোঁয়া কখন মেঘ হয়ে যায় হদিশ কোথায় পাই!?
আগুন ভাসে ওই আকাশে কে জানে সে কীসের টানে?
জলের বুকে ছলের অভাব...স্বপ্ন রাখে নয়ন পানে!
বাইরে নজর পড়তেই মেঘজল ধোয়া ছলছলে আকাশ!....দেখে মনে হচ্ছিলো যেন একটি কী বিরাট নীলপদ্ম!
ভাবতে ভালো লাগছে, আজ তারই মাঝে ওই চাঁদ পদ্মমণির মতো উঁকি দেবে। আর তার চারপাশে তারাগুলো যেন আলোক ভ্রমরের মতো জ্বলবে নিভবে আপন খেয়ালে!
দীর্ঘ তপস্যার স্মৃতিতে শুধু আমারই ছবি এঁকেছি নিজেই!....ওই চাঁদ ডোবার আগেই যা কিছু সব লিখে যাই!
তারাগুলোর কাজ নেই আর, শুধু জ্বলা শুধুই জ্বালা!
সোহাগ মাখা চাঁদ যে আমার...রাতের বুকের গল্প বলা।
আঁধার! সে তো পেরিয়ে যাবে, ভোর হলে সে নিরুদ্দেশ..
জল জানে সে কোথায় পাবে আবার একটা রাতের রেশ!!
আমি এনেছি শিউলি ফুলের গোড়ের মালা....!
বিদ্রূপ করবে??
কোরো না.....!
......প্রতি বছর এমন দিনের সাঁঝবেলায় আমি শিউলি ফুলের মালা জলে ভাসিয়ে দিই।
....এ মালা তো আমার নয়!
..... এ মালা জলের জন্য গাঁথা।
প্রতীক্ষার ধন হয়তো ফিরে পাবো,
হয়তো মৃত্যুক্ষণ হাসির রঙে রেঙে উঠবে। হয়তো সারাজীবনের ক্ষতি এক মুহূর্তের কল্যাণেই পুষ্পিত হয়ে উঠবে!ফুলের গন্ধের মতো ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে বাংলার মেয়েদের এমনই চিরকেলে একঘেয়ে কাহিনীরা।
অসামাজিক
ধীরাজ কুমার গিরি
নাঃ, হিসেবটা কিছুতেই মিলছে না। সবাই কত সুন্দর সুন্দর কথা বলি, স্বপ্ন দেখি। উপদেশ বিলোই। অথচ, বাস্তবে কিছুই মিলছে না।
আচ্ছা, আমরা তো নিজেদেরকে খুবই সৎ ও স্বচ্ছ ভাবি, তাইনা? কতই না অসততা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার! কিন্তু নিজেরা মুক্ত কী?
না, এই অপরাধ থেকে মুক্ত বোধহয় কেউ নই। অনায়াসেই নিজেরা বলি, দুর্নীতিপরায়ণ নয় কে? কোথায় নেই দুর্নীতি? ভালো শব্দে আছে একটি সম্বোধন, 'কমিশন'। ওটা দুর্নীতি নয়, ব্যবসা। একটু মিথ্যে চলে ওখানে। মিথ্যে ছাড়া ব্যবসা হয় নাকি?
কত জানি আমরা। আহারে! বেচারা, এই মাগ্যিগন্ডা-র বাজারে অভাবের সংসারে ভুল করে ফেলেছে লোকটা। সবাই যখন বড় বড় চুরি করছে, এই ছিঁচকে চোরটাকেই ধরলি তোরা?
আচ্ছা, ট্রাফিকের হাত-পাতা, কিংবা অকারণে নির্দোষীদের একটু ধড়-পাকড়,- দেখেছেন? রাঘববোয়ালদের ছাড়তে হলে তাদের একটু ফাঁসানো, বর্তমান ওসব গা-সওয়া। ওগুলো ধরতে নেই।
এখন আবার নাকি সবই ভুঁয়ো বেরুচ্ছে। কোথায় নেই ভুঁয়ো? ছোট পদাধিকারী থেকে সর্বোচ্চ পদাধিকারী। এদের মাঝখানে কত মাঝারি ভুঁয়ো,- চিটফান্ড, ভ্যাকসিন, সাংবাদিক, পুলিশ, আইপিএস, সিবিআই, আরও কত চাই?
থুড়ি, আপনি বলবেন রাজনীতি হয়ে গেল। না, সত্যিটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। আমি বিশ্বাস করি রাজনীতিতে দুর্নীতি বিলকুল নেই। কেউ গুন্ডা পোষে না। সবাই জনগণের সেবায় নিমজ্জিত। দেশে ভালোর অভাবই নেই। ভালো আছে বলেই না সব চলছে, আমরা বেঁচে আছি? কিন্তু, আপনি বিশ্বাস করেন তো?
প্রশ্ন হল, কেন এনারা বড় পদাধিকারী সাজেন? আরে, এটুকু বুঝলেন না? যত বড় পদ, তত বড় চুরির আয়তন। থুড়ি, তত বেশি উপার্জন। তাতেই সামান্য বড় হতে চাওয়া?
আবার এদিকটা দেখুন, একটি 'মা', সেদিন তার সোমত্ব মেয়ের বিয়ের জন্য দরজায় কড়া নাড়ল। যেভাবেই হোক মেয়েকে ক'খানা শাড়ি গহনা দিতেই হবে। দু'চারজনকে না নিমন্ত্রণ করলে কি চলে? পণপ্রথা সেই উঠে গেছে কবে। বরপক্ষ চায়নি কিছুই, শুধু বলেছে সম্মান রেখে কনে-কে একটু সাজিয়ে দিলেই চলবে। পঞ্চায়েত কিংবা কাউন্সিলরের একটি চিঠি আছে হাতে। এতেও কি কোনো সন্দেহ আছে?
আবার দেখুন,- ক'দিন পর একটি মেয়ে' পেটের জ্বালায় নামল পথে। ধর্ষিতাও হল বটে। আপনি বললেন,- কি চলন-বলন, কি সাজগোজ বসন, ছিঃ, ধর্ষিতা হবে নাতো কি?
নাঃ, কিছুতেই হিসেবটা মিলছে না। আমরা কত লিখি, কত স্বপ্ন দেখাই মানুষকে। তবেই না লোকে আমাদের বুদ্ধির ঢেঁকি বলে? হ্যাঁ, বুদ্ধির ঢেঁকিই আমরা। তবুও, কেন সাধু হতে পারছি না? আর প্রকৃত বুদ্ধিজীবী ওদেরকেই বলে। কারণ? ওরা মিছিলে চলে।
বাঁশি
ধনঞ্জয় পাল
পাড়ায় পাড়ায় একটু অন্য ঢেউ। হাঁসচরা পুকুরের জলে বিষাদময় সূর্যাস্ত। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো থলিতে চারটে জামা প্যান্ট। কোনরকমে কষ্টের টাকায় নগদে বা ধারে কেনা ছোট দুটো নাতি-নাতনীর পোশাক।
পশ্চিম মহল্লার ওপারের বড়ো দীঘিটার জলে সূর্য ডুবলো। এবার একপাত্তর নেশা না চড়ালে হাত খুলবে না। ভাঙা ক্লাবঘরের পিছনে ঝাঁকড়া বটের নীচে দু'চারজন এসেছে। সে-ও দু'পাত্তর চড়িয়ে পৌঁছনোর পর বড়ো ড্রামটায় কাঠি পড়লো। কাঁসি-ধরা ছেলেটি এখনও আসে নি। ওর পড়ানোর দিদিমণি এখনো ছাড়েনি। দিদিমণিটিকেও বলিহারি, কী দরকার বাপু, অতো শেখানোর! ছেলের মায়ের খুব শখ ছেলেকে নেকাপড়া শেখাবে। আরে বাবা, সেই তো রাজমিস্ত্রির লেবার খাটবে। পূজোপার্বণে কাঁসি, বড়ো হলে ড্রাম বা সাইড্রাম। এর বাইরে অন্য কি জীবন পাবে ছেলেটা!
হঠাৎই দার্শনিক হয়ে যায় সে। সুখ কী, সুখ কাকে বলে, সুখের সন্ধান কোথায় গেলে পাওয়া যাবে! সেই বারোটায় দুটি ভাত গিলে সাহাবাবুদের দোকানে গিয়েছিল।ভেবেছিলো-ঐ তো দু'টো জামাপ্যান্ট, কতোক্ষণ আর লাগবে! এসে আর দুটো খাবে। কিন্তু সাহাদের দোকানে গিয়ে তার চক্ষুস্থির।চিরকালের চেনা নড়বড়ে দোকানটা কী সেজেছে!সাহাবাবুদের ছোট ছেলেটা গলার সরু চেনটা নাড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো বটে-কাকা কী চাই, সে বলতে বললো, ও-দিচ্ছি।তারপরেই একদল এসে থেবড়ে বসে বললো-একটু দেখে দাও, এবার অনেক টাকার বাজার হবে। দলে এক অষ্টাদশী ছিল। তার দিকে চেয়ে ছোটবাবু কৃতার্থ হেসে ওদের ফরমাশমতো দিতে গেল। এইভাবে একটার পর একটা দল ঢুকতে থাকে, তার দুটো সস্তার জামা আর দেওয়া হয়ে ওঠে না। সেও সবাইকে দেখতে থাকে, বলা যায় হাঁ করে গিলতে থাকে ওদের সুখ। মাঝেমধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়িতে সুখটান দেয়। কিন্তু সে দেখে আর শুনে দু'টো চারটে কেনার পর কর্তা বনাম গিন্নী বা গিন্নী বনাম ছেলে বা কর্তা বনাম মেয়ে ঝগড়া শুরু হয় দাম নিয়ে। দোকানদারের সঙ্গেও ঝগড়া হতো, কিন্তু সাহাবাবুদের ও কর্মচারীদের উদারতায় সেটা হয় না।
খুব খিদে পায় তার। এখন কিছু পাওয়া যাবে না। তাই যেটা সহজলভ্য সেটাই আর একপাত্তর চড়িয়ে বাঁশিতে ফুঁ দেয়।
হঠাৎই মন খারাপ লাগে তার ভীষণ। পাঁচ বছর আগে মন্ডপে দাঁড়িয়ে সেই সুন্দর দেখতে মেয়েটা তাকে বলেছিলো- কী সুর তোমার বাঁশিকাকু! ছড়িয়ে পড়ছে মায়ের মূর্তির চতুর্দিকে।মেয়েটির কিশোরী মুখের দিকে স্নেহভরা চোখে চেয়ে সে বলেছিল- তোমার ভালো লেগেছে, মামণি! প্রৌঢ় বুকে মোচড় দিয়েছিলো। পরের বছর সেই মন্ডপে গিয়ে শুনলো- সেই মেয়েটি সূর্যাস্তের ছবি দেখতে দেখতে মহাশূন্যে বিলীন হয়েছে।বড্ডো কষ্ট পেয়েছিল।তারপর থেকে ঐ মন্ডপে আর যায় নি কখনও।
তার মনে বড়ো কষ্ট হচ্ছে এখন সেই মেয়েটির কথা ভেবে। দোকানে থাকা সাজুগুজু মানুষগুলোর কেনাকাটা, ঝগড়া তাকে দার্শনিক বানিয়ে দেয়। সুখ কী! সুখ কেন! প্রশ্নগুলো দলা পাকাতে থাকে। বাঁশিতে ফুঁ দিতে গিয়ে আওয়াজ বের হয় না। আবার একপাত্তর চড়িয়ে নেয়, ততক্ষণে কাঁসিছোকরা এসে পড়ে।ড্রাম,সাইড্রাম সবাই এসে পড়ে। এবার পাশাপাশি দুটো মন্ডপে বায়না হয়েছে।রোজগার বাড়বে, খাটতে হবে বেশি। ছুটোছুটি করে বাজাতে হবে। তারজন্য মহড়ায় জোর দিতে হবে।একটা সাইড্রাম এবার নতুন ছেলে বাজাচ্ছে। তাকেও দেখিয়ে দিতে হবে। ছেলের বৌটা জামাপ্যান্ট গুলো দেখে ভুরু কুঁচকে এমন তাকালো--মনে হয় পছন্দ হয় নি পোশাক। তাকে দু'টো মুড়ির কথা আর বলতে পারলো না। যাকগে, এখন আর খিদে নেই। বিড়িতে টান দিয়ে বাঁশিতে নিখুঁত ফুঁ দিলো। আহা,সুরের ঝরনাধারা বয়ে চললো হাঁসচরা পুকুরের ওপর দিয়ে, সবুজ ধানখেত পেরিয়ে, পশ্চিম মহল্লার ঘরগুলো ছুঁয়ে, বড়ো দীঘিটার ঢেউয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে মহাশূন্যে হয়তো সেই কিশোরী মেয়েটির কাছে।
পূজো আসছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন