রম্য রচনা
* নামচরিতমানস *
দি ব্যে ন্দু ধ র
(১)
নাম নিয়ে আমার ধাষ্টামো আজ যদি কাউকে আহত করে তবে ক্ষমা করবেন। নেহাতই সময় কাটাতে এই মজার অবতারণা করছি। একে সিরিয়াসলি নেবার চেষ্টাও করবেন না।
একদম ছোটবেলার কথা বলি। প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারমশাই অম্বিকা বাবু। বাংলা পড়ান পটল স্যার। তাঁর নামের ইতিহাস কখনো জানা হয়নি তবে স্যারের ছেলেও নাকি বাজারে এই বলে পরিচয় দিত , 'আমি পটল স্যারের ছেলে'।
তখন কাজের সুবাদে বিহারের গুমলা জেলার ঘাটোবাগিচায় থাকি। কাজ তেমন কিছু একটা নেই। নিয়ম রক্ষা করতে সকালে অফিসে যাই বিকেল পর্যন্ত থেকে ফিরে আসি মেসে। অফিসের আর্দালি গুল প্রসাদ। নেহাতই সাদামাটা গুল প্রসাদ। গুলপ্রসাদ যাদব বা এরকম কিছু নয় যে সারা পৃথিবী তাকে নিয়ে আলোচনা করবে। আমার কিন্তু তার নামটি বড় মনে ধরে গেল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এরকম কেন তার নাম। সে খুব মজার কথা বলল। বলল, হজৌর গুল-জারি লাল হলেও তো আমি এই চাপরাসিই থাকতাম। মহাজন বাক্য স্মরণ করলাম "What's in a name ..."
ভাবলাম দেখো আমাদের গুল প্রসাদ অবহেলায় যা জানে, তাই নিয়ে কোনো লেখক বইই লিখে ফেলেছে। সেই গুল প্রসাদের সাথে পাথরের লরির পিঠে বসে আমি নেতারহাট গিয়েছি দু-তিনবার। যাহোক নাম নিয়ে কথা হচ্ছিল, শিবের গীত নয়।
ভেবে দেখলাম গুল প্রসাদ এমন কিছু সাধারণ নাম নয়। সে যদি আফগানিস্তানে জন্মাত তবে সে হয়ত তালিবান নেতা গুল মহম্মদ হত আবার নেপালে সে-ই মহান বীর গুলবাহাদুর । আরবে সে হয়ত গুল-এ-বকাওয়ালী হয়ে কিস্যা শোনাত হাজার এক রাত ধরে অথবা গ্রীসে গোলিয়াথ হয়ে যুদ্ধের ময়দানে। জার্মানিতে গুলস্টাইন হয়ে সে আবিষ্কার করত নিত্যনতুন তত্ত্ব। ইংল্যান্ডে জন্মালে ক্রিকেট ব্যাট হাতে রিভার্স সুইপ মারত রবার্ট গুল হয়ে। ফ্রান্সে ভিনসেন্ট গুলিস্তা হয়ে ভুবনজয়ী ছবি এঁকে সকলের মন জয় করে নিতো বা শ্রীলঙ্কায় গণ্ডামারি গুলনায়েকে মারকুটে ওপেনিং ব্যাটসম্যান। আষাঢ়ে গপ্পের বাজারে নায়ক গুলিভার হোক বা হিন্দি সিনেমার ভিলেন গুলশান গোবরা, কোনোটাই খারাপ নয়। কবি হলে গুল-মা স্টেশনে প্রেমিকাকে রিসিভ করবে গুল-ঞ্চ ফুলের গুল-দস্তা দিয়ে। তারপর ' গুল-মোহর এর ফুল ঝরে যায়' গাইতে গাইতে গুল অফ জামুন তুলে দেবে প্রেমিকার ঠোঁটে। তবে কোলকাতা নৈব নৈব চ। কোলকাতায় তার নাম ঠিক হয়ে যেত গুলে বা গুইল্যা।
এহ বাহ্য , আগে কহো আর ...
আমার এক ছাত্রীর বাবা মা তার নাম রেখেছেন পিউপা , এখনো সে প্রজাপতি হতে পারল না, তবে বিয়ে সামনেই। আমি ছেলের নাম রাখতে চেয়েছিলাম 'রিহান' , মা বেঁচে তখন, বললেন এই বয়সে আমাকে আর জাতিচ্যুত করিস না।
আমার গল্পের এক নায়িকার নাম দিদিয়া পালচৌধুরী দাশগুপ্ত, তিনি আবার ডাক্তার, ফলে সই করতে হয় অগুন্তি। তাই তিনি সংক্ষেপে লেখেন দিপাদা।
আমার স্কুলের বন্ধু , বাবা মা তার নাম রেখেছেন " গুরু" । পদবী 'দেব'।
হিন্দি সিরিয়াল প্রেমিক মা মেয়ের নাম রেখেছেন সোয়েতা। ওর এক বন্ধু সেদিন বলল "সোয়েটার বিয়ে হয়ে গেল স্যার।"
দুর্দশা শুধু পদ্মিনীর। ঠাকুমা শখ করে নাম রেখেছিলেন। পদ্মিনীর বিয়ে হল হিন্দি বলয়ে। বাকিটা নাই বা বললাম।
মাল পদবীর পরিবারে বিয়ের পর বান্ধবী মালা রায় 'মালা-মাল' হয়ে গেল।
রবি মামা পেশায় পুরোহিত। সবাই ডাকে রবিঠাকুর, এক পাতা না লিখেই তিনি know bell জয়ী।
বোন-ধুর বোন-কে একদিন গদগদ হয়ে বললাম, শেষের কবিতা পড়েছ নিশ্চয় ...
বলল, পড়িনি তবে শুনেছি অনেকবার সৌমিত্রবাবুর আবৃত্তি।
বললাম, আরে সেতো কবিতা একটা মাত্র ...
সে বলল, আমিও তো সেই কথাই বলছি, একটা কবিতা ...
চুপ করে রইলাম। কে না জানে বোন-ধুর বোন আর বোনের বন্ধু ... সহস্র বছরের সাধনার ধন।
বৈঠকখানা বাজারে গেছি কিছু ছাপা সংক্রান্ত তদবির তদারকির কাজে। কাজের দায়িত্ব রমণী বাবুর। প্রুফ দিতে বললাম। ছোকরাকে ডেকে বললেন, ওরে জয়শ্রীদাকে ডাকতো। প্রুফের বাণ্ডিল নিয়ে আসে যেন। ছোকরা ঘুরে এসে বলল, জয়শ্রীদা বললেন, প্রুফ পিনাকীদির কাছে। (জয়শ্রীদা ও পিনাকীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)।
আমাদের হেডমাস্টারমশাই বলতেন, দেখ বিলেতে জন্মানোর অনেক সুবিধা আছে। এই দেখ না , আমাদের দেশের ময়রারা লোকের দোকানে কাজ করে আর বিলেতের ময়রারা লর্ড হয় যেমন 'লর্ড ময়রা'।
সদ্য ইতিহাস শুরু করা কিশোর কলকাতায় বেড়াতে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা এই রাস্তার নাম কি ? বাবা বললেন, আর্মহার্স্ট স্ট্রিট । আর যেখানে প্রথম গিয়েছিলাম ?
বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট। দেখো বাবা , বিদেশি লোকগুলো কেমন বোকা। আমাদের দেশের রাস্তার নাম দিয়ে কেমন ভাইসরয়গুলোর নাম রেখেছিল।
বারাক ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে চায়ের দোকানে মিল্টন ঘোষণা করল, দেখ বাঙালির মতো ভবিষ্যতদ্রষ্টা জাত হয় না। দিব্যি কত বছর আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার নাম স্মরণীয় করে রাখতে স্টেশনের নাম রেখেছে বারাকপুর। আবার টোটোগাড়ি বাজারে আসার কত আগেই বাঙালি বলে গেছে, ছেলেতো টোটো কোম্পানির ম্যানেজার। সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়ায়।
বিয়ের রজত জয়ন্তী বর্ষে নিউটনদা অফিস কলিগদের নেমন্তন্ন করেছেন। সন্ধ্যায় তারা এলে নিউটনদা হাঁক দিলেন, রত্নাবলী কেকটা নিয়ে এসো। চুলে গজরা লাগানো রত্নাবলী কেকের ট্রে এনে সেন্টার টেবিলে রাখতেই অবিনাশ বলে উঠল, বৌদি আপনার নামটা ভুল করে শেফালি লিখেছে দেখুন। নিউটনদা তাড়াতাড়ি জিভ কাটলেন। পাশের ঘর থেকে প্রসাধনরতা এক মহিলাকে টেনে এনে আলাপ করিয়ে দিলেন, ইনি হলেন আমার স্ত্রী শেফালি আর রত্নাবলী হল শেফালির হেল্পিং হ্যাণ্ড।
নামচরিতমানসে দুটি নাম না বললেই নয়। ফেলুদা আর প্রোফেসর শঙ্কু। ফেলুদা হয়ত সত্যজিৎ রায় নিজেই অথবা তাঁর মানসপুত্র। কিন্তু নামটি দেখুন ফেলুদা। শার্লক হোমস সম্ভবত একটি কেসে অকৃতকার্য হয়েছিলেন কিন্তু ফেলুদা কখনো ফেল করেননি। তার নাম কিনা ফেলুদা ! প্রোফেসর শঙ্কু একটি ইউনিক নাম যার কুম্ভের মেলায় হারিয়ে যাওয়া কোনো জড়ুয়া ভাই পর্যন্ত নেই।
যারা শান্তিনিকেতনে যান তারা ঢাল-স্টেশন গুলির সাথে পরিচিত আছেন। ঝাপটের ঢাল পার হলেই দেখবেন নোয়াদার ঢাল (No other Dhal)। আপনি আশ্বস্ত হবেন এই ভেবে যে আর কোনো ঢাল নেই কিন্তু অবাক হয়ে আপনি দেখবেন তার পরেও রয়েছে পিচকুরির ঢাল।
(২)
নামের কথাই উঠল যখন তখন নামের বিড়ম্বনার কথাও আসুক। দেশীয় নাম দিয়েই শুরু করি। রোহন গাভাস্কারের কথা বা অর্জুন তেণ্ডুলকরের কথা ভাবুন। তাদের ক্রিকেট জীবন দীর্ঘায়িত হওয়া কখনোই সম্ভব নয় কারণ যত বড় নামের উত্তরাধিকারী তারা সেই উচ্চতায় এক শতকে এক আধজন লোকই পৌঁছাতে পারেন। এ বিষয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন অবশ্য জন ব্র্যাডসেন। নামটা অচেনা মনে হচ্ছে তো? হ্যাঁ, আসলে এটা একটা ক্যামোফ্লেজ, যাতে আপনি চিনতে না পারেন। বাবার নামের খ্যাতির বোঝায় আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগছিলেন ছেলে আর সেই সমস্যা সমাধানের জন্য নিজের নামই বদলে ফেললেন ডন ব্র্যাডম্যানের ছেলে ১৯৭২ সালে। অবশ্যই ২০০৮ সালে তিনি সে নাম আবার ফিরে পেতে চান।
ছোটবেলায় শুনতাম চাকরির ইন্টারভিউয়ে আবেদনকারীকে প্রশ্ন করা হত পি.টি.উষার পুরো নাম কি ? তারা রাত জেগে সেই নাম মুখস্থ করতেন। এখন তো গুগল বাবাকে পি.টি. লিখলেই এসে যায় পিলাভুলাকান্দি তেক্কেরাপারাম্বিল উষা। তবে সত্যি কথা বলতে কি এসব নামও একটা বোঝা।
গুগলবাবার কৃপায় জানলাম আমেরিকার অধিবাসী এক জার্মান তিন পুরুষ ধরে দীর্ঘতম প্রথম নামের অধিকারী যা গিনেস বুক রেকর্ড।
ইংরেজি অক্ষরেই তার নাম লিখতে হচ্ছে কারণ এর বাংলা হয় না।
Hubert Blaine Wolfeschlegelsteinhausenbergerdorff Sr সেই সৌভাগ্যবান মানুষ যার পিতার নাম ছিল Elvis Wolfeschlegelsteinhausenbergerdorff এবং পুত্রের নাম Hubert Blaine Wolfeschlegelsteinhausenbergerdorff Jr.
একবার ভেবে দেখতে পারেন এরকম একটা বিশ্বরেকর্ড আপনিও করতে চান নাকি।
সভার মাঝে যখন পড়ল কথা তখন ছোট্ট নামটাও হয়ে যাক। মাত্র একটি অক্ষর দিয়ে সেই নাম! হ্যাঁ পৃথিবীতে মাত্র দশজন মানুষ আছেন এরকম। তাদের মধ্যে নরওয়ের এক বাসিন্দা Å , সুইডেনের একজন Ö , ফ্রান্স ও আলাস্কার একজন করে বাসিন্দা Y নামে নিজেদের পরিচয় দেন।
সারা পৃথিবীতে ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার নাকি রাখা হয়েছে জেমস নামটি। অবশ্য এটি মিডিয়ার হাইপ হতেও পারে। কারণ সারা ভারতে যত ছেলের নাম 'রাম' বা পশ্চিমবঙ্গের 'পচা' সে সংখ্যা বোধহয় সব রেকর্ড ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে।
বিনা মন্তব্যে দুটি নামের উল্লেখ করি। একটি বিদেশি অন্যটি দেশি।
(এক) Pablo Diego José Francisco de Paula Juan Nepomuceno María de los Remedios Cipriano de la Santísima Trinidad Ruiz y Picasso.
(দুই) শ্রীপোবর্মারা আতাপাত্তু জয়সুরিয়া নটবরা শ্রীরামকৃষ্ণা শিওওয়াচনক রাজশেখরা শ্রীনিবাসনা ত্রিচিপল্লী ইয়াকিপারমপির পেরাম্বদুর চিন্নাস্বামী মুথুস্বামী ভেনুগোপাল আইয়ার।
প্রথম নামটি কি আপনার চেনা চেনা মনে হচ্ছে? মনে হলে আমার সাথে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারেন। আর দ্বিতীয়টি নিশ্চয় মনে পড়েছে। না মনে পড়লে 'ধামাল' সিনেমাটি আরেকবার দেখে নিন। এর আনন্দ আপনাকে নিজের সাথেই ভাগ করে নিতে দিলাম।
পাড়ার শ্যামলা ও শ্যামা নাম্নী তরুণীটির বিড়ম্বনা ছিল নাম নিয়ে। রকবাজেরা তাকে দেখলেই গেয়ে উঠত 'নেচে নেচে আয় মা শ্যামা, আমি মা তোর সঙ্গে যাব'।
আর থাকতে না পেরে একদিন সকালে পালের গোদাটার বাড়ি গিয়ে হাজির হল শ্যামা।
একহাতে আঁশবটি আরেক হাতে সার্ফের কৌটো (তখন অন্যান্য ডিটারজেন্ট বাজারে প্রায় ছিলই না)।
গোদাটার বাপকে ডেকে তুলে বলল, নেচে নেচেই এলুম রে। শুনলাম তোর ছেলে নাকি আমার সাথেই যেতে চায়। তাই নিতে এলুম। পাড়ার লোকের মুখে শুনলুম তার নাকি গানের খুব শখ। তাই সাথে করে এট্টু সার্ফও এনেছি। জিভটা টেনে এনে ঝামা দিয়ে ঘষে দিয়ে যেতুম, গানের গলাটা পরিস্কার হত।
কই ডাক তোর ছেলেকে। নাহলে এই আঁশবটি দেখেছিস ? আজ করালবদনা হব। গোদাটার ততক্ষণে ঘুম পালিয়ে গেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই একদম পাকড়াও।
শ্যামা বলল, অ্যাও, যাচ্ছিস কোথায়? চল আমার সঙ্গে।
ছেলে তো সাথে সাথেই কেঁদে ফেলল।
বুড়ো বাবা শ্যামার দুটি হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, মা আমায় ক্ষমা করো মা। আমি শিক্ষা দিতে পারিনি ছেলেকে। তুমি আমায় সেটা দেখিয়ে দিলে। শ্যামা বুড়োর পা ছুঁয়ে বলল, ক্ষমা করুন কাকাবাবু, এছাড়া আমার আর কোনো উপায়ও ছিল না। কাকাবাবু শেষ পর্যন্ত শ্যামাকেই বৌমা করে এনেছিলেন আর বিয়ের পর মুখ দেখে একটি রুপোর বটি উপহার দিয়েছিলেন।
কলেজ জীবনে যখন চুটিয়ে ছাত্র রাজনীতি করছি। তখন আমাদের মেন্টর ছিলেন 'ভাইয়াদা'। পরে জেনেছি সেটি তার পিতৃদত্ত নাম নয়। মানে তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন বয়োজ্যেষ্ঠরা তাকে ভাইয়া বলে ডাকতেন। সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলিতেছে। পরবর্তীকালে তার সাথে 'দাদা' অ্যামালগ্যামেট হয়ে 'ভাইয়াদা' হয়েছে।
খোকাদা মারা গেলেন পরিণত বয়সে। সকলের মুখে তখনও 'খোকাদা'। এবং এক্ষেত্রেও 'খোকা' বলে তাঁর বাবা-মাই প্রথমে বাড়িতে ডাকতেন।
কোনো বাঙালি পুরুষের কখনোই 'রুবী রায় সিনড্রোম' হয়নি একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রুবী রায় নামটির প্রকৃত উৎস কিন্তু 'ছবি রায়'। একবার ভেবে দেখুন তো, যদি বলা হয় 'কিতনে প্রতিশৎ পুরুষ 'ছবি রায় সিনড্রোম'পে আকরানত হ্যয়' ? উত্তরটা কি হবে।
অস্যার্থ 'গোলাপ তাকে যে নামেই ডাকো' ডাহা ভুল কথা। গোলাপ ফুলের নাম ঘেটু ফুল হলে কেমন হত একবার ভেবে দেখা যেতে পারে।
পিতৃদত্ত নামের প্রতি সকল মানুষের আবার একই রকম টান থাকে না। কিরকম ?
সাইনবোর্ডে এক ডাক্তার বাবুর নাম দেখলাম পি. শুভাশিস। হয়ত দক্ষিণী ভদ্রলোক। যেমন টি সুভাষচন্দ্র , এন উত্তমকুমার ইত্যাদি। ভাবলাম ভেতরে গিয়ে 'হোয়াট্টা ইওরা প্রঅবলেম ?' শুনতে হবে। তার বদলে শুনলাম , 'হ্যাঁ , বলুন।'
ব্যাপারটা কি? তদন্ত কমিটি গঠন করে জানা গেল উনি শুভাশিস প্রামানিক।
এ বিষয়ে খবরের কাগজে 'নামপদবী পরিবর্তন' কলাম একটি মজার জায়গা।
একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে 'আমি জন্মাবধি সি. পি. সরকার, বিশেষ আইন বলে অদ্য হইতে পি. সি. সরকার হইলাম।'
বোঝো ঠ্যালা। ম্যাজিক নাকি !
আরেকটি বিজ্ঞাপন এরকম , 'আমি শ্রী চিন্ময় কান্তি ঘোষ অদ্য হইতে শ্রী মৃন্ময় কান্তি ঘোষ নামে পরিচিত হইলাম এবং আমার জমজ ভ্রাতা শ্রী মৃন্ময় কান্তি ঘোষ অদ্য হইতে শ্রী চিন্ময় কান্তি ঘোষ নামে পরিচিত হইল।
কি সর্বনেশে কাণ্ড! একেবারে আইডেন্টিটি বদল !
'বৈদুর্য রহস্য' সিনেমায় প্রায় এরকমটা হয়েছিল। অথবা 'আমি শ্রী জগদীশ্বর সর্বাধিকারি অদ্য হইতে তারকব্রহ্ম বৈরাগী হইলাম।'
অভিনেতাদের ক্ষেত্রে পিতৃদত্ত নাম পরিবর্তন আকছার ঘটে কারণ একটা ক্যাচি নাম না হলে দর্শক 'খায়' না, এরকমটা জ্ঞানীরা বলে থাকেন। এজন্য অরুনকুমার চট্টোপাধ্যায় হন উত্তমকুমার , শিপ্রা রায়চৌধুরীকে মহুয়া রায়চৌধুরী হতে হয় বা
দীপক চক্রবর্তী হন চিরঞ্জিত। সর্বভারতীয় চলচ্চিত্রে এর উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি।
আগেকার মহিলারা স্বামী , ভাশুর বা শ্বশুরের নাম উচ্চারণ করতেন না।
এক গৃহিণী সকালবেলায় রাধুনীদিদিকে নির্দেশ দিচ্ছেন। ছোটখোকার পাউরুটি সেঁকে মেজঠাকুর মাখিয়ে দাও ভালো করে। দুকুরের মাছের ঝোলে নম্বা নম্বা করে বড়ঠাকুরকে কেটে দিও আর নারকেলগুলো কুড়িয়ে রেকো। বিকেলে খোকার বাবা বানাতে হবে।
বলাবাহুল্য মেজঠাকুর অর্থাৎ মেজ ভাশুর হলেন মাখনলাল , বড়ঠাকুর পটললাল এবং খোকার বাবা নাড়ুগোপাল।
আদালতে জনৈক ব্যক্তি জজসাহেবকে এভাবে পরিচয় দিচ্ছেন। মি লর্ড, মাইসেল্ফ জ্যাকেল ঘাষু। বিরক্ত হয়ে জজসাহেব বললেন , এক্সপ্লেইন।
তিনি বললেন, জয়কালি ঘোষ। জজসাহেব আবার বললেন, জয়কালি জ্যাকেল বুঝলাম কিন্তু ঘাষু এক্সপ্লেইন করুন। তিনি বললেন, মি লর্ড, বোস যদি বাসু হয় তবে ঘোষ কেন ঘাষু নয় ?
অকাট্য যুক্তি।
ইংরেজি শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তরে ছাত্র বলল, মাই ফাদার্স নেম ইজ বাটার রেড গভর্নমেন্ট অর্থাৎ মাখনলাল সরকার। মহাজন কথা বাদ থাকে কেন। সত্যজিৎ রায় নিজে বলেছেন, প্রদোষ চন্দ্র মিত্র মানে 'সন্ধ্যা শশী বন্ধু'।
সুকুমার রায় প্রসঙ্গে সেই বিখ্যাত উক্তি,
"ভালোমন্দ প্রহার করে শেষে দিলে রায়
সকলের মন জিনেছ তুমি নিজের প্রতিভায়।"
জানেন না এমন বাঙালি কম আছে।
সাহিত্যিকরা হামেশাই ভানুসিংহ , আন্নাকালী পাকরাশী , যাযাবর, নীললোহিত , কালকূট বা চন্দ্রহাঁস হয়েছেন।
আবার নীরদ সি. চৌধুরী কোনদিনই নীরদ চন্দ্র চৌধুরী হননি।
উমেশ চন্দ্র বনার্জীও ব্যানার্জী হননি।
* ভোট আসে ভোট যায় *
ত প ন পা ত্র
ভোটের পরে ভোট। দু'দিন ছাড়াই ভোট।
লজ্জায় একটি একটি করে গাছের সকল পাতা ঝরে পড়ে।
পলাশ বলছে, যে বছর ভোট হবে আমি সে বছর পুরুলিয়া যাবো না।
যে মাসে ভোট হবে, সেই মাসের ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে পূর্ণিমা দিনটা মুছে দেবো বলছে আকাশের চাঁদ।
নদী বলছে, আমি বইবো না, আমার তরঙ্গ লোপাট হয়ে যাচ্ছে।
জঙ্গল বলছে, আমার নাভিশ্বাস উঠছে, আমার ভিতর লুকিয়ে পড়ছে যত আগ্নেয়াস্ত্রধারী মানুষখেকোর দল!
শিশুরা বলছে হাসবো না।
এমন কি তিনদিনের উপোসী, নিরন্ন ভিখারি বলছে,
দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করবো না।
আমার তালপাতার আগুড় দেওয়া ভাঙা দুয়ারে কারা, কারা পাতছে প্রলোভনের ফাঁদ?
তোমাদের নগ্ন করুণা তোমরা ফিরিয়ে নাও।
কবি ছড়া কাটছেন ---
"সময় এলে নেতা বলেন,
বন্ধু দিয়ে ভোট।
দেশের তরে, দশের তরে
এসো বাঁধি জোট।
ভোটার বলে, বন্ধু! সে কী
বলছো কেমন করে --
ভোটের সময় বন্ধু অমন
হই যে বারেবারে।
না গো বাবু, এবার আমরা
করছি না আর ভুল।
বুঝেছি ভোট পেলেই তুমি
হবে ডুমুর ফুল!"
---তাতে ভোটের কিছু যায় আসে না। ভোটমাগাদের, ভোটভিখিরিদের কিছু যায় আসে না।
ভোট আসে, ভোট যায়!
অসুস্থতা জমে থাকে ফ্রিজের ভেতর।
পরীক্ষা, পড়াশোনা সবকিছু বাতিল।
কিন্তু মন্দিরে-মসজিদে-গীর্জায় কাঁসর-ঘন্টা-আজানের সুর চড়া হয়।
ওরা জেনেছে, ভোটের জন্য এইসব বেশি বেশি করে দরকার।
সাধারণ মানুষ সবাই প্রশ্ন তোলে,
ভোটে কী হয়?
---ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তের হোলি খেলা,
স্বামী-স্ত্রীতে কোন্দল,
প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ,
সুদীর্ঘকালের বন্ধুত্বের ইতি,
পড়াশোনায় ও চিকিৎসায় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন,
হু হু করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি।
---এইসব ভয়ঙ্কর কালো কালো বীভৎসতা ছাড়া
ভোটে আর কিছু হয় না। ভোটে তোমার আমার চিন্তা-চেতনা, কর্ম, সৃজন, নান্দনিকতা --- কোন কিছুরই উত্তরণ ঘটে না।
প্রতি পাঁচ বছরে তিনবার ভোট!
কখনো কখনো কোথাও কোথাও দুর্ভাগ্যের অতি বাড়বাড়ন্তবশতঃ চার-পাঁচবারও হ'তে পারে!
মানুষের কিছু লাভ নেই। সত্যের লাভ নেই।
প্রকৃত কর্মশক্তি ও প্রতিভা-প্রতিবাদের কোন মূল্য নেই,
মূল্যায়নও নেই।
হয়তো দু'চারটা পাগলা ভেড়া উত্তেজিত ষণ্ড হয়ে দাপিয়ে বেড়াবে সমাজের বুকে
--- শুধু তার জন্য ভোট। অকর্মণ্যদের পটু এবং দক্ষদের অদক্ষ প্রমাণের জন্য ভোট!
মুষ্টিমেয়র সুবিধার্থে মুষ্টিমেয়র জন্য মুষ্টিমেয়ের ষড়যন্ত্রের নাম যখন গণতন্ত্র,
তখন সেই বৃহত্তম গণতন্ত্রের ফিবছর যখন ভোট পরব হবেই,
তখন সেই পরব সামলানোর জন্য মহামান্য রাষ্ট্র বা সরকার কেন আলাদা একটা বিভাগ সৃষ্টি করছেন না?
ক্ষমতা যদি থাকে,
তাহলে লক্ষ লক্ষ দক্ষ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতিদের নিয়োগ করা হোক
সেই মেগা আড়ম্বরপূর্ণ কর্মকাণ্ড সামলানোর জন্য ।
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সরকারি দাক্ষিণ্য প্রাপ্ত চাকরেরা
যখন যেন-তেন যোগ্যতার ভিত্তিতে হলেও নিযুক্ত হন,
তখন কি তাঁরা এই সমস্ত অকাজের কাজ সামলাবার জন্য নিযুক্ত হন,
না বিশেষ একটি বিভাগ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য নিযুক্ত হন?
---এই প্রশ্ন বহু মানুষের।
এই প্রশ্ন সুস্থ চিন্তাভাবনার বিবেকবান, বুদ্ধিমান মানুষের ।
কিন্তু প্রশ্ন
প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়।
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
অদ্ভুত আঁধার নেমে এসেছে এই দেশে আজ!
অন্ধরাই এখানে সবচেয়ে বেশি দেখে চোখে!!!
জীবন, জীবিকা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও
মানুষ গর্জে উঠতে পারে না।
প্রতিবাদ আজ মৃত।
মেরুদন্ডের অস্তিত্ব নেই।
নানান শ্রী-তে শ্রী-তে বিশ্রী অবস্থা!
ক্ষমতাসীন পার্টির পিছনে ঘুরলে গুটা, গোবরটা --- সবটাই পেয়ে যাচ্ছে নপুংসক মেষের দল।
সিঁদকাঠি লোন থেকে পুয়াতি লোন পর্যন্ত সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে
অফেরতযোগ্য শর্তে। কাজকর্মের দরকার নেই, বিনে পয়সায় চাল নাও,
ভাত খাও আর বলো আমাদের স্বর্গ ছুঁতে আর এক পা-ও বাকি নেই।
চমৎকার! কেয়াবাৎ! কেয়া বাৎ!
ইউরেকা! ইউরেকা!
অনেকেরই মনে হতে পারে,
এসব উদ্ভট চিন্তাভাবনা প্রসূত প্রলাপ মাত্র,
এসব সংবিধান বিরোধী কথাবার্তা দণ্ডনীয় অপরাধ!
তা বাবা, সংবিধানের পাঁচটা কথার কোনোটাই তো দু'চোখ দিয়ে দেখতে পেলাম না!
" সার্বভৌম" কোথায় থাকে, ভিতরে না বাহিরে?
" সমাজতান্ত্রিক" মানে কি একেকটি বর্ণের পাশে সমাজ শব্দটি জড়িয়ে দিয়ে আন্দোলনের মুর্খামি বা গোঁয়ার্তোমির অধিকার?
"ধর্মনিরপেক্ষ" শব্দটি শুনলে একটি শিশুরও আর হাসি থামতে চায় না!
স্বাধীনতার এত বছর পরেও গণতন্ত্রবাবু অন্তত ভারতবর্ষে এসে প্রবেশ করেননি।
আর
সাধারণতন্ত্র নিছক পার্টিতন্ত্র, সুবিধাতন্ত্র ছাড়া কিস্যু নয়।
কাজেই দয়াকরে সংবিধানের ভয় দেখাবেন না। ওটা কিছু সুবিধাবাদীর সুবিধা আদায়ের একটা ষড়যন্ত্রের জীবন্ত কাগুজে অস্ত্র মাত্র।
ভোট আসে, ভোট যায়। গরিবের পকেট থেকে চাঁদা বেরোয়।
দিনের-পর-দিন মানুষ চালের দাম তেলে মেটায়,
বহুৎশ্রীর টাকা মিটিয়ে দিতে হয় ওষুধের দামে, জামা-কাপড়ের ফাঁকে,
নিত্য প্রয়োজনীয় নানা দ্রব্যের রোমকূপ দিয়ে। বউ পাবে ৫০০ টাকা প্রতিমাসে, সেই টাকা তার স্বামীকে শোধ করতে হবে মদ খেয়ে, ট্যাক্স দিয়ে।
তাহলে ভোটে কার লাভ?
কিছু অকর্মণ্য, মতলববাজ, তেলবাজ, সুবিধাবাদী ধান্দাবাজ, ক্ষমতালিপ্সু, মানবতাহীন অন্ধ ছাড়া কারো কোনো লাভ নেই!
দু'চারজন সৌভাগ্যবান পা-চাটা আমলা ছাড়া কারো কোন লাভ নেই!
আমার, আপনার মতো সকল সাধারণ মানুষের শুধু ক্ষতি। ক্ষতি।
শুধু চাপ।
শুধু ভোট পরবর্তী সময়ে বাঁচার জন্য নিতান্ত দরকারি সামগ্রীর আরও অধিকতর দাম দেওয়ার প্রস্তুতি মাত্র।
ডান হোক, ভূত হোক, প্রেত হোক, লাল হোক, সবুজ হোক, গেরুয়া হোক -----সেইতো যে লঙ্কায় যাবে সেই-ই হবে দশ মুন্ড রাবণ।
সেই তো লাল কাপড় ছেড়ে সবুজ,
সবুজ কাপড় ছেড়ে গেরুয়া।
অমানুষটা তো সেটাই।
চোরটা তো সেটাই।
নিমকহারাম টা তো সেটাই।
অমানবিক নির্লজ্জতার মূর্ত বিগ্রহ তো সেটাই।
তাহলে পোশাক বদলের এই নাটক কেন?
রাজা বদল এর জন্য মানুষের পেটের অন্ন মেরে কোটি কোটি টাকার এই অপচয় কেন? উত্তর নেই। কে দেবে উত্তর? যুব সমাজের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে, শিক্ষা করেছে আত্মহত্যা, চেতনা নিখোঁজ, বিপ্লব ঘুমিয়ে পড়েছে কালো টাকার নরম বালিশে মাথা রেখে। তাই নির্বিঘ্নে ---
ভোট আসে, ভোট যায়।
রাজা বদলায়,
হাল বদলায় না।
ভোট আসে, ভোট যায়;
হাল বদলায় না।
জাল বদলায়,
জেলে বদলায়,
জল বদলায় না।
* করোনাকালে মা দুর্গার মর্ত্যে আগমন *
ন ন্দি তা সো ম
আমি গোয়ার ভাস্কো ডা গামা বাসিনী। গোয়ায় আট থেকে দশটি দুর্গাপুজো হয়। সবথেকে পুরোনো পুজো ভাস্কোতে। ৫৪ বছরের পুজো--বিশাল প্যান্ডেল করে পুজো হয়। এবারে সব বন্ধ। আমাদের কালীমন্দিরে এবার ঘট স্থাপনা করে পুজো হবে। গোয়ার সব শহরেই তাই-- একমাত্র জুয়ারী নদীর কিনারে পোণ্ডা শহর ছাড়া। সেখানে এবারে পুজোর তিন বছর পূর্তি। তাই পোণ্ডা বঙ্গ সমিতিকে এবার প্রতিমা দিয়ে পুজো করতেই হবে।
বাতাসের আগে খবর ছোটে। তাই এই খবর পৌঁছে গেলো সুদূর হিমালয়ের কৈলাস শহরে মা মহামায়া ও বাবা মহাদেবের বৈঠকখানায়। মহামায়ার মন এমনিতেই খুব খারাপ ছিলো-- বছরের চারটে দিন বাপের বাড়ি যাওয়া হবে না বলে। তাই এই খবরে উৎফুল্ল হয়ে বৈঠকে সবাইকে ডেকে বললেন আমরা কিন্তু সবাই পোণ্ডা যাচ্ছি। কারুর আপত্তি আমি শুনবো না। মহাদেবের দিকে তাকিয়ে বললেন--- তুমিও আসছো আমাদের সাথে।
মহাদেবের মাথায় হাত। তুমি কি জানো কত মুখবন্ধনীর দরকার। কত কিছু কেনাকাটা করতে হবে। এতো টাকা আসবে কোথা থেকে? তাছাড়া সময় কোথায়? হঠাৎ নজরে এলো মহামায়া ও লক্ষ্মী মিটিমিটি হাসছে। একটু রাগত স্বরে জিগ্যেস করলেন--- তোমাদের ব্যাপারটা কি? মহামায়া মিষ্টি হেসে বল্লেন -- তোমায় কিছু চিন্তা করতে হবে না। আমি একটু আভাস পাচ্ছিলাম। তাই বিশ্বকর্মাকে দিয়ে কিছু বাজার করিয়ে এনেছি। সবার জন্য মুখবন্ধনী, জুতো ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস এসে গেছে। কিন্তু টাকা পেলে কোথায়-- সোজা প্রশ্ন স্ত্রীকে। লক্ষ্মী হেসে বললো-- বাবা, চিন্তা করো না। আমার ভাঁড়ের টাকা বোনাস হিসাবে মা কে দিয়েছি বাজার করার জন্য। হঠাৎ গনেশ দৌড়ে এসে বাবা বলে কেঁদে ফেললো। সবাই হতবাক-- গণেশের আবার কি হলো? ""আমার মুখ বাঁধা থাকলে আমি খাবো কি করে?"" মহামায়া স্নেহের স্বরে বলে উঠলেন -- পাগল ছেলে--- আমি নারকেল দিয়ে নাড়ু বানিয়েছি, এছাড়া লাড্ডু, গজা সব ঝোলায় পুরে দেবো। যখনই খিদে পাবে মুখবন্ধনী সরিয়ে খেয়ে নিবি। আর তোর জন্য বিশেষ মুখবন্ধনী বিশ্বকর্মা তৈরি করছেন। এছাড়া সবার জন্য ফল, মিষ্টি নিয়ে নেবো। একটা কথা মনে রেখো-- আমরা নন্দী, ভৃঙ্গি, অসুর, সিংহদের নিচ্ছি না। অতো বিভিন্ন প্রকারের মুখবন্ধনী আনাতে পারিনি। আমি ওদের বুঝিয়ে বলবো।
এবার মহাদেবের প্রশ্ন--- আমরা যাবো কি করে? কোনো যানবাহন চলছে না। মহামায়া শান্ত স্বরে বল্লেন-- হেঁটে যাবো। শুনেই সবাই চিৎকার করে উঠলো। উনি হেসে বল্লেন -- আমরা বাড়ি থেকে দোলায় করে নদীতীরে যাবো। নৌকার মাঝি পার করে দেবে আমাদের। ওখানে বিশ্বকর্মা তাঁর বাহন গজরাজদের প্রস্তুত রাখবেন। গজরাজরা আমাদের বণ্ডলা জঙ্গলের কাছে ছেড়ে দেবে। ওখান থেকে ঘোড়া করে আমরা জঙ্গল পার হবো।
তারপর হেঁটে যাবো আমার কন্যা সরস্বতীর মন্দিরে (পুরো ভারতবর্ষে দশটি সরস্বতী মন্দির আছে। যার একটি গোয়ার পোণ্ডায় )। ওখানে বিশ্রাম নিয়ে আমরা মণ্ডপে পৌঁছে যাবো। আর কোনো প্রশ্ন? সবাই নিরুত্তর। হঠাৎ মহামায়ার মনে পড়লো একটা কথা বলা হয়নি। তাই বল্লেন-- আমরা যখন ফিরবো-- লক্ষ্মী আমাদের সাথে ফিরবে না। পাঁচদিন পরে ওর পুজো। ও কারুর পুজোর ঘরে থেকে যাবে। প্যাঁচা ওকে নিয়ে ফিরবে। ওর তো মুখবন্ধ লাগবে না। উড়ে যাবে ও উড়ে ফিরবে।
দুর্গা দুর্গা উচ্চারণে সবাই রওনা হলো। সরস্বতী মন্দির পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো। সমস্যা শুরু তারপর। খাবার সব ফুরিয়ে গেছে। প্রচণ্ড খিদেয় সবাই কাতর। অনভ্যাসে মহাদেব আর কার্তিকের পায়ে জুতোর কারণবশত বিশাল ফোস্কা পড়েছে। মন্দির ফাঁকা, বাপ, ছেলে প্রথমেই দুজনে জুতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মন্দিরে ঢুকলো। গণেশের পায়ে ফোস্কা পড়েনি কারণ--- মূষিক প্রবর গণেশের ভুঁড়ির নীচে লুকিয়ে চলে এসেছে। খুব খিদে পেলে গণেশের নাগরার পিছন এমন চিবিয়েছে যে ফোস্কা পড়ার রাস্তা বন্ধ।
এখন কি করা যায়? এদিকে প্যাঁচা মন্দিরের চূড়ায় বসে পাহারা দিচ্ছে। দেখা গেলো মূষিক প্রবর গণেশের ধুতির খুঁট ধরে টানাটানি করছে। গণেশ রেগে লাল। মহামায়া শান্ত স্বরে পুত্রকে বললেন -- যা বাবা দেখ ও কি বলতে চাইছে। গণেশ ওর সাথে মন্দিরের একধারে গিয়েই চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো। মূষিককে আদর করে দেখালো -- মন্দিরের একধারে এক ব্যাগ খই ও বাতাসা রাখা। মনের আনন্দে খই বাতাসা দিয়ে পেট ভরিয়ে মণ্ডপের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পথ দেখিয়ে চললো প্যাঁচা ও মূষিক।
মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যার পুজো শুরু হয়ে গেছে। মহামায়ার নির্দেশে সবাই নিজের কাঠামোয় প্রবেশ করলো। বাবা মহাদেব উপরে ঝোলানো ফটোর মধ্যে প্রবেশ করলেন।
খুব সুন্দর ব্যবস্থা। কঠিন নির্দেশানুসারে সবাই মুখবন্ধনী পরিহিত হয়ে একে অপরের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিচ্ছে। প্রসাদ, ভোগ সব সুন্দরভাবে বিতরণ হচ্ছে। দারুণ সেই ভোগের স্বাদ। সবাই মন ভরে, পেট ভরে ভোগ খেলো।
নবমীর দিন সকাল থেকে মহামায়ার চিন্তা শুরু হলো। পরেরদিন চলে যেতে হবে। চোখের জল বাঁধ মানছে না। এদিকে লক্ষ্মীর কি ব্যবস্থা করে যাবেন বুঝতে পারছেন না। সেদিন আবার সন্ধ্যায় যাত্রাপালা আছে-- স্থানীয় বাসিন্দারা করবেন।
যাত্রাপালা শুরু হতেই লক্ষ্মী কাঠামো থেকে বেরিয়ে এলো। ওর আর বন্দী থাকতে ভালো লাগছিলো না। হঠাৎ কানে এলো কিছু কথোপকথন। এক ভদ্রলোক পুরোহিতকে ডেকে জিগ্যেস করছেন ---" ও ঠাকুরমশাই, আমার লক্ষ্মী প্রতিমা এনেছেন? আর পুজোর দিন কখন আপনাকে নিয়ে যাবো?" ঠাকুরমশাই হেসে ওনাকে আশ্বস্ত করে বললেন--"চিন্তা করবেন না। সব ঠিক আছে। কাল বৌদিকে নিয়ে সিঁদুর উৎসবে আসবেন যখন -- সব বুঝিয়ে দেবো।"
শুনেই লক্ষ্মী একছুট্টে গিয়ে মহামায়াকে সব বললো। মা নিশ্চিন্ত হলেন। সবাই এবার মনোযোগ দিয়ে যাত্রাপালা দেখে ঘুমাতে গেলো। কিছু ফল, মিষ্টি মহামায়া সবাইকে ভাগ করে দিয়ে রাখলেন।
পরেরদিন মহাদশমী। মহামায়া আগেই বলে রেখেছিলেন সবাইকে-- দশমীর পুজোর পরেই পুরোহিতমশাই দর্পণ বিসর্জন করবেন। তার সাথে সাথে আমরাও কাঠামো থেকে বেরিয়ে পড়বো কৈলাসের উদ্দেশ্যে। সব পরিকল্পনামাফিক চললো। একটু গণ্ডগোল হলো যখন দর্পণের বিসর্জনের পরে দধিকর্মা মাখার জন্য খই পাওয়া গেলো না। কানাঘুষা শোনা গেলো সরস্বতী মন্দিরে রাখা খই আর বাতাসা উধাও।
মণ্ডপের একধারে রাখা লক্ষ্মী প্রতিমার ভিতরে লক্ষ্মী ঢুকে রইলো। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে রওনা হলেন মহামায়া সবাইকে নিয়ে। প্যাঁচা পথ দেখিয়ে ওঁদের পৌঁছে দিলো বণ্ডলা জঙ্গলের কাছে। যেখানে ঘোড়ারা ওঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
মণ্ডপ ছাড়ার আগে ভক্তদের সাথে সুর মিলিয়ে নিজেকেই প্রতিশ্রুতি দিলেন মা মহামায়া--- আগামী বছর সব কিছু শুভ হবেই হবে। চোখের জলে নয়--- হাসিমুখে, আনন্দে সবাই মাতবে মাতৃবরণ উৎসবে।
* ভুত প্রেত কেনা বেচার ভুতহাট *
প্র দী প দে
পাঁঠার ঝোল আর রুটির ডিনার সারলাম আজ রাতে। খেয়েদেয়ে হজম করতে সামনের বাগানে পায়চারি মারতে শুরু করে দিলাম। কি ভালো না লাগছে! ফুরফুরে বাতাসটা আমার হাতের আঙুলের মাংসের গন্ধ মেখে আমায় জানান দিচ্ছে আমি কতই না বড় লোক! না হলে এই বাজারে কেউ দুবেলা পাঁঠার মাংস খায়? কিন্তু আমি খাই -- আমি হলাম গিয়ে বংশধর হালুই।
আমার বংশধরেরা একেবারে সোজা সহজ সরল ছিল না, উল্টে তারা মানুষ ছিল ভীষণই জটিল। সব সময়েই লোকের ক্ষতি করা, লোকের জমিজমা সম্পত্তি ভুলিয়ে ভালিয়ে অথবা বিপদে ধার কর্জ দিয়ে শেষে গায়েব করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এরকম করে জমিদারি রাখা এবং সম্পত্তি বাড়াতে তারা ছিল সিদ্ধহস্ত।
আমিও যেন তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করি তাই আমার নামেই বংশধর লাগিয়ে আমাকে তাদের পালকযুক্ত করেছিল। সত্যি কথা বলতে ভয় নেই। আমি আমার গুনের বংশের কথা অকপটে স্বীকার করে নিলাম।
ভাবার সময় পেলুম না সামনেই জ্যাঠামশাই লাঠি হাতে জ্যাঠামি হাসি হেসে চলেছে। আমি অবাক। জ্যাঠার আগমনে। কোথা দিয়ে উদয় হলেন কে জানে?
-- কিরে বংশ কেমন আছিস? সামনেই তো ভোট?
-- হ্যা হ্যা করে গাল ভর্তি হাসি এলো। শালা গুরুজন এসে গেল। তবুও --
-- তুমি এখন কোথা দিয়ে? মুক্তি হয়নি তোমার?
-- দূর শালা কেউ তো এখনো কিনলো না -- সবাই টিপে-টাপে চলে যায়। দাম দেয় না -সব কিপ্টের দল!
-- সে আবার কি কথা? ভুতকে কেউ কিনবে নাকি? মুক্তির সংগে তার যোগই বা কি?
-- হ্যাঁ রে তোর দেখছি এখনো বুদ্ধি হয়নি! আমাদের বংশধর হিসাবে তোকে মানায় না। দেখছিস না চারিদিকে কিরকম নেতা কেনা বেচা চলছে?
-- আরে তার সংগে ভুতের কেনা -বেচার কি সম্পর্ক?
-- আরে শোন ভোটে নেতার মত ভুত ও কেনাবেচাও চলে সমান তালে।
-- সেটা আবার কি?
-- দেখতে চাস? চল আমার সংগে হাটে ---
জ্যাঠা মানেই ভুত। আর ভুতে ধরলে রক্ষা নেই। পিছু নিলাম, না পা দুটো ওঁর পিছনে এগিয়ে গেল, বুঝলাম না। কিছুটা যাওয়ার পর অন্ধকার একটি মাঠ পেলাম। সেখান থেকে কলরব নেকী সুরে গান আর ঢপাস ঢপাস ঢেপসি নাচের আওয়াজ পেলুম। অনেক ভিড় -- সকলের চোখে যেন টুনি বাতি চকমকিয়ে জ্বলছে।
জ্যাঠা বললে -- এটা ভুতহাট - ভুতমাঠ।
প্রথমদিকে ভয় পেলেও পরে আশ্বস্ত হলাম - চেনা জানা সবাইকে দেখে। আমার পূর্বপুরুষ প্রায় সকলেই আছে প্লাস আমার জানাশোনা মৃতরা!
আসল কথা বদমাশেরা সকলেই আছে যাদের কপালে, পাপকর্মের ফলে, এখনো মুক্তি জোটে নি
ভুতপ্রেত ছাড়া আমার মত অনেক লোক থলে হাতে বাজার করছে। কি বাজার?
-- সব ভুত প্রেত পেত্নী দক্ষ -দানব এই সব।
মানুষের মধ্যে আমিই একা যার হাতে থলে নেই।
মানে আমিই একমাত্র যে এই বাজারের হদিশ জানতাম না।
যা হবার হয়েছে যাকগে,-- এসেছি যখন একটু ঘুরে দেখি ---
অবাক কান্ড ---
তান্ত্রিকেরা বস্তা করে ভুত পেত্নী কিনেছে এবং বেশ কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করেই। একজন সাইকেলে ভুতভর্তি বস্তা বাঁধছিল, ধরলাম -- দাদা এগুলো কি কাজে লাগবে? ভয় লাগে না?
-- হা হা হা --- হেসে উঠলেন ক্রেতা -- না না দাদা ভুতে ভয় নাই -- ভুত ভাল। ওদের দিয়ে মানুষের অনেক উপকার হয়। তুকতাক বশীকরণ আরো কত কি! আর মানুষ? ছ্যা - ছ্যা মানুষ? ওদের দিয়ে কোন কাজ হয় না, শুধু ক্ষতি করতে জানে।
আরো কিছু রাজনৈতিক দলের লোকজনদের দেখলাম -ভুত কিনছে।
জিজ্ঞাসা করলাম -- দাদা ভুত প্রেত কেন কিনছেন?
-- দাদা -সামনে ভোট। নেতার সঙ্গে সঙ্গে ভুতও কিনে ষ্টক রাখতে হচ্ছে। ওরাই তো আমাদের শেষ অস্ত্র, শেষ ভবিষ্যৎ!
আমার দাদুকে একজন কিনলো। মৃত আত্মীয়রা দেদার দামে কয়েক মাসের চুক্তিতে বিকিয়ে গেল।
ভুতের ভুতুড়ে হাটে -- মৃতজনেরা মরা পর হাপিত্তেশ করে বসে থাকে নিজেদের দাম গুনে বিকিয়ে যাওয়ার আশায়!
আমি মানুষ হয়ে লজ্জায় ফিরে এলাম -- মানুষের কোন দাম নেই দেখে -- আবার ভুতেদের না কিনে না উপকার করে, ওদের কোন কাজে না লাগতে পেরে। লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল!
ওম্ শান্তি ওম্!
* ট্যাংগোদা অসুস্থ কেন *
অ শো ক বো স
ট্যাংগোদা অসুস্থ। ব্যস এতটাই খবর। শরীর গরম না পেটগরম..এতটা ডিটেইল নেই। যাইহোক, আমাদের ট্যাংগোদা, কী হয়েছে সেটাতো জানতেই হবে, তাই ছুটলাম ট্যাংগোদার বাড়ি।
জেঠিমা আমায় দেখে বলল - দেখনা বাবা, মাসির বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে একটা কথাও বলছে না ঠিকমত। শুধু ফ্যালফ্যাল ক'রে চেয়ে আছে। কী হয়েছে, সেটাই বোঝা যাচ্ছনা। ডাক্তারও হার মেনে নিয়েছে...
বুঝতে অসুবিধা হলনা যে, খুব চিন্তার কথা! ঢুকলাম ট্যাংগোদার ঘরে।
চেনা ঘর। সবকিছুই দেখছি একইরকম চেনা আছে। সেই টেবিলের উপর সযত্নে ছুড়ে রাখা নোংরা জুতো, জুতো রাখার র্যাকে অসহায় ডায়েরি, বিছানার উপর ভেজা গামছা....সব অতি পরিচিত, কিন্তু ট্যাংগোদাকে চেনা লাগলো না। আমি নাম ধরে ডাকার পরেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলনা অবধি। ছাদের দিকে তাকিয়েই আছে হা করে। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। ডাক্তারবাবুর মত ভিজিট নিইনি, তাই স্যরি বলে চলে যাওয়ায় যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু কেস বেশ জটিল।
- কেমন আছ, খবরাখবর নেই কেন, চাকরিটা করছ?-- এসমস্ত প্রশ্নের কোনটাই ট্যাংগোদার মুখ খোলাতে পারলনা। চুপ তো চুপ। পাড়ার কে কালিঘাটে মন্দিরে বিয়ে করেছে, কে আবার কালিঘাটের পার্টিতে জয়েন করেছে...সব প্রসঙ্গই তুললাম, কোনটাই বাদ দিলাম না। না, ট্যাংগোদা সেই যে লগড অফ হয়ে আছে, কিছুতেই লিংক পাওয়া যাচ্ছেনা।
আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। এক্সপেরিমেন্টাল স্বনামধন্য ডাক্তারের মত একটার পর একটা ওষুধ ট্রাই করে চলেছি। কোননা কোনও ওষুধ আমার মান রাখবে, এই বিশ্বাস মনে বল আনলো, আর সহজপাঠ শিখিয়েছে ( শুধুমাত্র রবিঠাকুরের সহজপাঠ) মনের বল বড় বল। কিন্তু ওষুধগুল যখন মনের বলকে বলদের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি দেরি না ক'রে কবিতার কথা পাড়লাম। এইবার বোধহয় সঠিক ওষুধ পড়ল। না, ট্যাংগোদা এখনও দেখছি তার পুরনো পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেনি! এক্স ফ্যাক্টর কবিতার নাম শোনামাত্র ট্যাংগোদার মুখ খুলল। লিংক রিওপেন্ড।
- হ্যাঁ রে অশোক, কদিন আগে নাকি ঝড় হয়েছিল ? কেমন একটা অদ্ভুত গলা ট্যাংগোদার।
- হ্যাঁ হয়েছিল তো।
-হুম..বাংলাদেশে তুলকালাম ক'রে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ঝড়টা নাকি উড়িষ্যায় গেছে?
একি রে! এতো দেখছি ঝড়ের গতিপথটাই উল্টে দিয়েছে ট্যাংগোদা! ব্রেন পাল্টি খেল নাকি!!
না, এ ব্যাপারে আমি ওকে আর ঘাটালাম না। ঝড় যেদিক থেকে যেদিকেই যাক, মরেতো মানুষই, সে যে দেশেরই হোকনা কেন।
-মাসির বাড়ি কোথায়, কবে গেলে ট্যাংগোদা, এরকম ভ্যাবাচ্যাকা মেরে প'ড়ে আছই বা কেন?
-সে অনেক অনেক দূররে অশোক। একদম অজ পাড়াগাঁ। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। একটু রাত হলেই পিচের মত অন্ধকার..
-ও বাবা কোথায় সেটা?
-সেটা মনে করতে পারছি নারে, তবে কৃষ্ণপদ লোকালে করে যেতে হয়।
গেছে গেছে, ট্যাংগোদার মাথা একদম গেছে! কৃষ্ণনগর লোকালকে বলে কিনা কৃষ্ণপদ লোকাল!!! এরপর শান্তিপুর লোকালকে না শান্তিপ্রিয় লোকাল বলে বসে! কিন্তু আমি আজ ঠিক করেছি, ট্যাংগোদাকে ঘাটাবনা, শুধু বলতে দেব। এতটাতো বোঝা গেল যে, কৃষ্ণনগরের কোনও একটা গ্রামে ওর মাসির বাড়ি। নিশ্চই...নিশ্চই কিছু ঘটেছিল ওখানে...আর সেটাই জানতে হবে।
-সেখানেকি কিছু ঘটেছিল ট্যাংগোদা...কিছু একটা?
-যাওয়ার সময়তো স্টেশন থেকে আমাকে নিজের গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে গেছিল মেসো। অনেকটা পথ।
-বেশ, তারপর?
-বেশ কিছুদিন কাটালাম সেখানে। এবার ফেরার পালা। কিন্তু ফেরার সময় গাড়ির বন্দোবস্ত ছিলনা। মেসো গাড়ি নিয়ে শহরে গেছিল।
-আচ্ছা তারপর কী হল?
-বাসে করে রাতের বেলা স্টেশনের দিকে রওনা দিই...মাটির রাস্তা ধরে চলছে বাস। জনমানবশূন্য এলাকা। চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার, জোনাকির আলো পর্যন্ত নেই। ড্রাইভারের ভরসা বলতে শুধু বাসের হেডলাইট...রাস্তাও শেষ হচ্ছে না।
-তারপর ট্যাংগোদা, তারপর কী হল?
এবার আমার দিকে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে ট্যাংগোদা জিজ্ঞেস করল -আচ্ছা অশোক, তোদের বাসরুটের স্টপেজগুলোর কী নাম...
-কেন, ঐ তোমার ঘোলা, চন্ডিতলা, তীর্থভারতী, কাঠগোলা, এইচ বি, অমরাবতী...
-ওখানাকার বাস স্টপেজগুলোর নাম জানিস?! রাতের ঐ ঘন অন্ধকারে কী সমস্ত বাস স্টপেজের নাম তুই জানিস!..আমি চোখ বন্ধ করে ভগবানের কাছে তখন শুধু প্রার্থনা করেছি, ভগবান স্টেশন আর কতদূর, তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও...
-কী নাম স্টপেজগুলোর??
ট্যাংগোদা আবার ছাদের দিকে ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল -একেকটা করে স্টপেজ আসছে আর বাস কন্ডাকটার তার নাম বলে যাচ্ছে..
- হ্যাঁ, কী নাম সেই স্টপেজগুলোর?
এবার ট্যাংগোদ মুখস্থর মত বাসস্টপেজগুলোর নাম বলে চলল : মাথাকাটা.. ফাঁসিকাঠ ..রক্তফোঁটা নির্জনগাঁ..কবরস্থান.....শ্মশানঘাট...আর আর....
-আর...? পরের স্টপেজের নাম??
-শেষ যাত্রা....
ট্যাংগোদা এরপরে আর একটি কথাও বলেনি।
আমিও আর কিছু না বলে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম...এখানেও রাত হয়েছে...লোডশেডিং...রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আজ যেন মনে হল রাতের ভৌতিক অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হাঁটছি....গা ছমছম করছিল কি? কে জানে..
* মধু *
ম ঞ্জু চ্যা টা র্জি
বছর ষাটেকের পঞ্চানন বাবুর চাকুরীরতা মেয়ে ওনাকে একটা স্মার্ট ফোন উপহার দিয়ে মোবাইল ফোনের হাল হকিকত সব বুঝিয়ে দিয়েছে। ফোন পেয়ে তো উনি মহা খুশি। নিজে ফেসবুক একাউন্ট খুলে বন্ধুদের সাথে দিব্যি মজায় রয়েছেন। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেরই বেশ ক'জন মহিলা বন্ধু আছে দেখে পঞ্চানন বাবুর ও ইচ্ছে হলো কিছু মহিলা বন্ধু পাওয়ার।কয়েক জনকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে পেয়েও গেলেন। বেশ রূপসী অপ্সরী কয়েক জনকে।
বয়স্কদের বেশির ভাগ মেয়েরা একটু ইগনোর করার চেষ্টা করে। একজন তো বলেই বসলো you are looking 70 years old, পঞ্চানন বাবু তো পড়লেন মহা ফাঁপরে, কি এত বড় কথা!! ষাট বছর কে বলে কিনা সত্তর বছর!! খুব মুষড়ে পড়লেন। অথচ অতসী দেবীর সাথে কথা বলতে বেশ ভালোই লাগে,, শুধুমাত্র মাত্র এই কথায় বন্ধুত্ব নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।
কি করে নিজেকে একটু সুন্দর করা যায়। এই ভাবনায় খালি আয়নার সামনে নিজেকে জরিপ করেন আর টেকো মাথায় হাত বুলোতে থাকেন। খাওয়া দাওয়ায় তেমন রুচি নেই। কিন্তু স্ত্রীর দৃষ্টিকে তো ফাঁকি দেওয়া যাবে না। "বলি হলো টা কি তোমার? না খেয়ে শরীরের কি হাল হয়েছে দেখেছো? পঞ্চানন বাবু কিছুই উত্তর করে না স্ত্রীর কথায়।
একদিন বউ যখন ঠাকুর ঘরে ব্যস্ত, বিরস মনে উনি বউয়েরই কটা বাংলা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় চোখ আটকে ফেলেন। সেখানে লেখা আছে, "চেহারায় তারুণ্য ভাব ধরে রাখতে ও ত্বককে উজ্জ্বল করতে নিয়মিত মধু পান করুন, বা মধুর প্যাক ব্যাবহার করুন, এটি এন্টিঅক্সিডেন্ট'। খাঁটি মধু মেখে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, বা স্নান করে ফেলুন এতে ত্বকের ভাঁজ পড়া বা বুড়িয়ে যাওয়া হ্রাস পাবে। আপনি অচিরেই তারুণ্য ফিরে পাবেন।
'হরি হে মাধব' দেখেছো আমার কি হাল? হাতের কাছে এত উপায় থাকা সত্ত্বেও আমার কিনা এত হেনস্থা!! বার্ধক্যর শেষ প্রান্তে এসে পঞ্চানন বাবুর মনে হলো একটু আগে যদি নিজের দিকে যত্নবান হতাম তাহলে ফালতু এইভাবে অপদস্থ হতে হতো না। এই পদ্ধতিতে মধু মেখে চেহারায় তারুণ্য ভাব আনতেই হবে। যে করেই হোক।
বহু জায়গায় ঘুরে, শেষ পর্যন্ত এক মধু ব্যবসায়ীর শরণাপন্ন হন। প্রচুর খাঁটি মধুর সন্ধান পেলেন ওখান থেকে। ব্যবসায়ীর পরামর্শ মতো সুন্দরবনের মধু একটু বেশি দাম দিয়ে নিলেন। পঞ্চানন বাবু ওনাকে জিগ্যেস করলেন ঠিক বলছেন তো এই মধু মাখলে চেহারায় তারুণ্য আসবে তো? আসবে মানে? একদম কার্তিক ঠাকুর টির মতন হয়ে যাবেন। তবুও সন্দেহ যায় না মন থেকে, ব্যবসায়ী কে বলেন, এতই যদি খাঁটি মধু তো আপনি খান না? আপনাকে তো দেখতে বেশ বয়স্ক লাগছে। চট জলদি উত্তর দোকানির, কত বয়স লাগছে আমাকে? সত্তর পঁচাত্তর তো লাগছেই!! দোকানি বলে, ওটাই তো এই মধুর জাদু, আমার বয়স এখন বিরাশি বলে হাঃ হাঃ হাসতে থাকে।
খুব নিশ্চিন্ত হয়ে পঞ্চানন বাবু মধু নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। আজ থেকেই শুরু করে দেবেন পরিচর্যা। ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে বউ টিভিতে মশগুল হয়ে আছে, মেয়ে তো নিজের ঘরে ল্যাপটপে ব্যস্ত। এই সুযোগ বেশ করে মুখে শুধু নয়, ঠোঁটে, সারা হাতে ঘাড়ে অনাবৃত জায়গায় বেশ করে মেখে খানিকটা পান ও করেন।
সোফায় বসে নিউজ পেপারে চোখ বোলাতে থাকেন। স্ত্রী বসার ঘরে আসার আগেই স্নানটা সেরে ফেলবেন ভেবে রাখেন। ভাবতে ভাবতে সারা দিনের ক্লান্তিতে চোখ টা জুড়িয়ে আসে..স্বপ্নে অতসী দেবীর সাথে লেকে বসে গল্প করছেন, এক তোড়া গোলাপ ফুল উপহার দিচ্ছেন ওনাকে এই সব দেখতে দেখতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
ওদিকে পঞ্চানন বাবুর স্ত্রী প্রেমের সিনেমা দেখে সবে মাত্র বসার ঘরে এসে দেখে স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছে বড্ড মায়া হলো দেখে। লোকটি তো কম পরিশ্রম করে না কি করলে আমি আর মেয়ে ভালো থাকবো তার জন্যে নিজে অনেক কিছু ত্যাগ করেছে। এই সব ভেবে, আর এইমাত্র প্রেমের সিনেমা দেখেই বোধহয় স্বামীকে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে চুম্বন করতে গেলেন, যেই না ঠোঁট ছুঁয়েছে ব্যস মধুর আঠালো তে দুই ঠোঁট জুড়ে কি হালখানাই না হলো দুজনের!!
অতসীর স্বপ্নে বিভোর পঞ্চানন বাবুর গায়ে মনে হলো বিশাল ভারী গাছ এসে পড়লো। সেই মুহূর্তে মেয়েও ল্যাপটপ ছেড়ে কিছু খাবারের খোঁজে এসে দেখে এটা কি? মা কেন বাবার মুখের ওপরে? হাসবে না কাঁদবে ভেবে উঠতে পারছে না মেয়ে। বাবার গায়ে ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখে সোফার ওপর পিঁপড়ের সারি মধুর লোভে। দু'একটা পিঁপড়ের কামড় খেয়ে মেয়ে চট করে নিজের মোবাইলে মা বাবার এই হালৎ খানার একটা ছবি তুলে রাখলো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন