ভ্রমণ কাহিনী

* পালানোর পাঁচকথা *

মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত

পঞ্চলিঙ্গেশ্বর পর্ব:
ট্রেনের জানলার বাইরে ফ্যালফেলিয়ে চোখ রাখা হয়নি কতকাল! দু'টি বচ্ছর। যেন দীর্ঘনিদ্রা ভেঙে ফের অনিঃশেষ প্রকৃতির পানে চাওয়া, তার মেদুর-পেলব আশ্রয়ে সমাহিত হওয়া।
গাড়ি না-ছাড়া পর্যন্ত ভরসা-শান্তি পাচ্ছিলাম না, এক-টিকা ছাড়পত্র পাবে কিনা। হাজারো নিয়ম, হাজারো গুজব রোজ হচ্ছে-ছড়াচ্ছে-থামছে। সে-সব অতি-বিক্রমের ব্যাপার অতিক্রম করে জনশতাব্দী এক্সপ্রেসের বুক্ ড সিটে চারজনে। নাক-ঠোঁটে ঠুলি মাস্ট। সেভাবেই বকবকাইতে বকাইতে বালেশ্বর আসি গিলা বিকেল নাগাদ।
সিধে গাড়ি পাওয়ার জো নেই। অটো অটোক্র্যাসি চালিয়ে ভাড়া হাঁকছে। কী-করি কী-করব ভাবনার সঙ্গে পা হাঁটছে কাছের বড় রাস্তার দিকে। বাস যদি মেলে।
'মিলবে।' বললেন পার্শ্বচর একজন। 'আমি প্রায়ই যাই, চলুন না।'
হব-হব সন্ধ্যে। বাস আসে পরপর। ছুটি। —না,
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর যাবে না। নিরুপায় বলে দশ কিমি এগোনোর তরে এক এসি বাসে ওঠা গেল। শেরগড় নামতে হবে।
পার্শ্বচর সহযোগী মানুষ। বড় রাস্তা ছাড়িয়ে নীলগিরি যাবার পথে মোড়ের মিষ্টির দোকান চিনিয়ে দিলেন। —'আরে, শেরগড়ে পাঁচ টাকার রসগোল্লা খাবেন না?'
সস্তায় এমন সুস্বাদু দ্রব্য কলকাতায় দুর্লভ।
ঠাসা এক ট্রেকারে নিজেদের ঠুসে দিয়ে, —না, নিশ্চিন্তি নয়। এও থেমে যাবে নীলগিরি। তারপর? তারপর বুবাই জানা জানেন। উনি এই কেটে-কেটে যাওয়ায় অভিজ্ঞ। 'চলুন না, কিছু জুটে যাবে।' শুনে খানিক ভরসা। রাতের অন্ধকারে ডানদিকে উঁচুতে আলো দেখে মালুম হল, পাহাড় আছে কাছেপিঠে। 
কী বাহারি ঝুড়ি, কুলো, ঝোড়া পথ-বাজারে সাজানো। যাবার সময় পেলে বগলদাবা করতে হবে। ভাবতে ভাবতে নীলগিরি বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটা শুরু।
হাঁটছিই।
'ভাই, আমরা কি এবার হেঁটেই....?'
'না না, ঠিক পেয়ে যাব।' 
অন্তত দু' কিমি হেঁটে রাস্তা পেলাম এক। কিছুই মালুম হচ্ছে না। বাস-অটো নেই। সাড়ে ন'কিমি এই অন্ধকারে কীভাবে যাওয়া যাবে!
চৌকস জানাবাবু একটা পিক-আপ ভ্যান ম্যানেজ করলেন।  —'একটু নামিয়ে দেবে গো পঞ্চলিঙ্গেশ্বর চক?'  'কত নেবেন?' জিগাতে বিপদতাড়ণ ড্রাইভার শুধু উঠে পড়তে বললেন।
টপাটপ চালের বস্তার উপর পাঁচজনে থিতু হয়ে গেলাম। এবার একশো ভাগ স্বস্তি। যাচ্ছি তা হলে!


সুপথ পেয়ে সাঁইসাঁই ছুটছে ম্যাটাডোরের মতো মাঝারি গাড়িটা। দু'পাশে ঘোর আঁধার। লোকালয় মনে হচ্ছে না। বরং চাষখেত আর ঝোপজঙ্গলের আধো-আভাস। হাওয়া কাটছে কান ছুঁয়ে। ঠান্ডা ঠান্ডা। উপভোগ্য। 
চকে পৌঁছে মাসিমার দোকানে চা। নিয়মিত খদ্দের জানাবাবু। কাপ হাতে ভাবছি, কীভাবে কখনও কখনও সাহায্যের হাত আপনি এগিয়ে আসে। বালেশ্বর থেকে সঙ্গী ভদ্রলোক আছেন, আছেন পিক-আপ ভ্যানের ড্রাইভার মানুষটিও। অন্ধকারে হাতড়ানোর দুঃসময়ে গাড়িতে নিয়ে এলেন। নিলেন না একটি পয়সাও। বিশেষ, লুটেরা সংস্কৃতির যুগে। টিঁকে থাক এইটুকু.....
আলোহীন নিরন্ধ্র কালোয় ডুবে দু'কিমি হেঁটে শকুন্তলা নিবাসে থাকা-খাওয়ার ইন্তেজাম পাকা করে শ্বাস ফেললাম। ফোনে বাতচিত হয়ে রয়েছিল। নয় নিবাস-চত্বরে সদ্যোসঙ্গী বুবাইবাবুর পাতা টেন্টে বেশ ঢুকে পড়া যেত।

পায়চারি করতে করতে সকালে বন-পাহাড়ের শুরুতে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দিরের দিকে এগোই। পুণ্যার্থী নই। লক্ষ্য চত্বর পেরিয়ে জঙ্গলে ঢোকা। একটি নালা ঝরনার আকার নিয়েছে ধাপে ধাপে। তারই এক খাঁজে ধারাতলে পাথরে পাঁচটি লিঙ্গের আদল। বহমান জলে হাত ডোবালে বোঝা যায়। ওতেই পুণ্য। ভক্তদের বিশ্বাস। আগেরবার ছোঁয়া সারা হয়েছে। এবার গেলাম না। এবং দু'জন ফিরে জানাল, বন্ধ আছে। 
পেশাদার পাদুকারক্ষকরা নাছোড়। গাইড ছাড়া জঙ্গলে ঢোকা যাবেনি কো। হাতি আছে। ভল্লুকও নাকি ঝাড়েবাঁশে বেড়েছে। বন অফিস খোলা নেই। গাইড হওয়ারও কেউ নেই।
না-এদিক, না-ওদিক। ইতিউতি ঢুঁড়তে-পুছতে ক'ধাপ সিঁড়ি উতরিয়ে ঝরনার ছবি তুলছি। বব আর কিশোর একজনকে জুটিয়ে ফেলেছে। 
বুনি মল্লিক। হাসিখুশি মজারু অল্পবয়সি যুবক বয়সটাকে আরও অল্প করে জানিয়ে লাগাতার কিছু-না-কিছু বলেই যায়।


মন্দিরের চৌহদ্দি পেরোলেই অরণ্য। গাছনুড়িজল এধার-ওধার। ঘেসো রাস্তায় জলকাদায় গাঁথা পাথরে পা ফেলে, দরকারে লাফঝাঁপ করে এগোতে বাঁয়ে থালা-থালা চরণচিহ্ন দেখা গেল।
সেদিনের মর্নিং ওয়াক নিশ্চিত। প্রায় কিমি খানেক গিয়ে জলাশয়ের ধারে ঘোলা জলে মালুম, তেনারা কেলি করে গেছেন। প্রান্তে ছোট মন্দির। বনদেবী বা বনদুর্গার।স্থানীয়রা বলে, মা বড়ম্বা। সামনে পার্বতী কুণ্ড। খুব ধীরে একটা দু'টো বুদবুদ। সামান্য জল অবিরাম গড়িয়ে মিশছে পোখরিতে। 
বড় বড় কুলের মতো প্রচুর ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক গাছ। কন্টিফল। আঁটিসর্বস্ব পশুখাদ্য। পাশে শালগাছ ফুল ফুলিয়েছে। ওদের ডালপালার নীচ  দিয়ে এগোলাম। মোটা গাছটির বাকল খানিকটা মসৃণ। হালকা ডালপালা দোমড়ানো। গা চুলকে সুখ নিয়েছে ঐরাবতকুল।
  হাঁটতে হাঁটতে চওড়া বহমান নালা। পাথর ফেলে পা-দান করা আছে। তাক করে পদভার রেখে এগোও।
এগোতে এগোতে চাতাল পাওয়া গেল। এদিকে এটাই  লক্ষ্য। অনেকখানি সমান রক টেব্ ল। হাতায় ছোট ডোবা। মনুষ্যেতর জীবেরা তেষ্টা জুড়োতে আসে। চুপটি ধৈর্য সাথী করে বসে থাকলে সাক্ষাৎ মেলার সম্ভাবনা। তবে তা উপাদেয় নাও হতে পারে। সকলেই সাবধান করেছে, ভল্লুক, হাতি অঢেল। লেপার্ডও দুর্লভ নয়।

ক'টি পাখি প্রজাপতি বরাতে ছিল। খুদে খুদে জোঁকদের  জন্য অবশ্যি আমরা সকলেই কিছু রক্ত বরাদ্দ করতে বাধ্য হই।
চাতাল পোখরি পিছনে ফেলে বেশি বেশি পাখির লোভে বুনি অন্য ফিরতি পথে নিল। কিশোর ভাল পাখির ছবি তোলে। স্বভাবতই উৎসাহী। উপরে উঠে নিশ্চুপ বসে বাদামঠোঙা ফাঁকা করি। পাখিরা পাতার আড়ালে সাড়া দিল, দেখা দিল না। দেখা দিল গলায় কেঠো ঘণ্টা বাজিয়ে এক পাল ছাগল। সোৎসাহে গায়ে পড়ে, ঢুঁসিয়ে, বাদাম চিবিয়ে বিদায় নিল তারা। 
  লতাপাতা-পাথরে ঘেরা এক প্রাচীন মন্দিরের গা বেয়ে নেমে আসি। আবার জলধারা। নড়বড়ে শিলাখণ্ডে মনোযোগী পা ফেলে দু'জন পেরোল ঠিকঠাক। প্রায় পৌঁছে শ্যাওলায় হড়কে বিচ্ছিরিভাবে পড়ল বব। তিন মিটার তফাতে থেকেও ছুটে ধরবার সুবিধে নেই। নিরুপায় দাঁড়িয়ে দেখতে হল, দুই পাথরের মাঝে ফুটখানেক গভীর জলে আটকেও দামি ক্যামেরাটা উঁচু করে ধরে রেখেছে। তপন, কিশোর হাত বাড়িয়েছে। বিপদ গা ঘেঁষে গেল যা-হোক। খোঁচা খোঁচা নুড়িতে ভরতি জায়গাটা। কোমর বাঁচল, ময়শ্চার লাগা বাদে ক্যামেরা রেহাই পেল, ছাড় পেল না জুতোজোড়া। সোল থেকে হাঁ।
এগিয়ে ডানদিকে শুঁড়িপথ ধরব। ফিরে যাবে-কি-যাবে-না ভাবনার ফাঁকে জুতোর ফিতে খুলে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে পায়ের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে পা বাড়াল আধভেজা আগ্রহী ভ্রামণিক। বুনির গাইডত্বে আমরা যাচ্ছি ঘন বনপথে কিছু দূরে চত্বরিতে। 
উঁচু আর উঁচু। কত না-চেনা লতা! এই মোটা মোটা। কোথায় যে উঠে গেছে! গাছও হরেক কিসিমের। গা-ছমছমানো আরণ্যভূমি। হামেশাই হাতি নামে এদিকটায়।
থামলাম খোলামেলা প্রশস্ত এক শিলাখণ্ডের উপর। তিনপাশ মুক্ত অবাধ। দৃষ্টি থামে বাঁয়ে পাহাড়চূড়ায়। গাঢ় সবুজ তার বাহার। চোখ ঘুরিয়ে ডানদিকে আনলে কেবলই পাহাড় আর পাহাড়। দেবগিরি নাম। হিমালয়ের মতো স্নোপিক বা চাঁছা নয়। শ্যামল চাদরে মোড়া মালভূমির পাহাড়। নয়নশোভন। একেবারে ডানহাতে কাছেই এদিককার সর্বোচ্চ চূড়া। যেতে-আসতে পুরো দিন লাগে। লাগে বনপালের অনুমতি। নিরাপত্তার জন্য। লিখেছি, চতুষ্পদাধিক্যের কথা।
সুন্দর এই কোলাসিরা চত্বরি। বুনি হাতির গোবর, থুড়ি, হস্তিবর খুঁজছে। আমাদের দেখাবেই।
পেয়েও গেল ঠিক। সুমুখের অগভীর খাদের ঝোপ-জঙ্গল মোচড়ানো। সেখানে ওই বর্জ্য যথেষ্ট পড়ে আছে। বরাবর গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছে হাতি চলাচলের সরু পথটা। উপর থেকে স্পষ্ট।
হাওয়া বইছে শিনশিনিয়ে। দুলছে গাছের পাতারা, আর নাম-না-জানা বনফুলগুলি। অনেকক্ষণ কাটালাম এমন সুন্দর জায়গায়। তিনদিকেই ঢেউ খেলানো পাহাড়-ফ্যমিলি অতীব সুন্দর! কিন্তু সবসময়ই আতঙ্কের বাতাবরণ উপস্থিত রয়েছে।
উঠাই পথটা নামাই হতে সহজে ফিরতে পারলাম। 
ওড়িশা পর্যটন দপ্তরের পান্থশালার পিছনে মিনিট দশেক হেঁটে এক পুকুরে এসে থামি। ইচ্ছে, বহুদিন পর একটু সাঁতরে চান সারা যাবে। কিন্তু জলের তলায় এবড়োখেবড়ো বড় বড় বোল্ডার ছড়িয়ে। তাই ঘাটের কাছে বুক সমান জলে পুঁচকে মাছেদের সঙ্গে খেলা করতে করতে চমৎকার স্নান হল। কী নির্জন মালভূমির অংশটুকু!


আবার হাঁটা শুরু হয়েছে বিকেল চারটে নাগাদ। দেরি হয়েছে। যেতে হবে সাড়ে চার কিমি পথ। বেশিটাই জঙ্গল। গুড়িখোঁড়া গ্রাম পেরিয়ে বনের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করে নিয়ে গেলেন সেই বুবাইবাবু। যাচ্ছি খুমকুট ড্যাম দেখতে। জানা থাক, গাড়িতে পাঁচ কিমির অন্য পথ আছে।
শাল-সেগুন জঙ্গলের নিভৃতে একবার গাঁওখুট দেখতে পেলাম। মারাংবুরুর উপাসনাস্থল।
লম্বা পা ফেলে এগোচ্ছি। পথজোড়া গাছের ডাল কখনও হাত দিয়ে নুইয়ে, কখনও ঘাড় কাতিয়ে চলেছি। অরণ্য কী ভাল লাগে, আহা! ডান হাতে এক প্রকাণ্ড শিলাময় পাহাড় দেখা যাচ্ছে। প্রায় ছুটছি। লাঞ্চ-লব্ধ এনার্জি ব্যয় করতে হবে তো। আবার সন্ধ্যের আগেই পৌঁছতে হবে দেখতে চাইলে।
দেখার কিছু কখনওই কম নেই। লাল মেটে পথ গিয়েছে তালসারির হাত ধরে। বাঁয়ে হালকা আদি-বসতি। তাবড় তাবড় দ্রুমদলের সঙ্গে অন্ধকারের নিবিড় সখ্য। কত রহস্য তার অন্দর-লোকে!
ঘাসকাদায় মাখামাখি খানিকটা জমি পেরিয়ে ছোট্ট নালা। তাকে ডিঙিয়ে উঠতে হবে বড় রাস্তায়। তিনজনায় দিব্যি টপকাল। লম্ফঝম্প, দৌড়দৌড়িও জীবনে জরুরি। ওগুলো এড়ানোর ফল মিলল ফলত। ডানহাতে স্টিক, বাঁহাতে ক্যামেরা আঁকড়ে, না-হড়কে, দুই ঠ্যাঙ দুই মেরুতে ঠেলে মোক্ষম লাফ দিয়ে ল্যাদলেদে হাফ-তরল ভূমিতে ফুল-শয্যা গ্রহণ করলাম। ওবেলা ববের ধপাস দেখেছি, এবেলা আমার দেখল সবাই। হাস্যোদ্বেগ সহ ওরা দাঁড় করাল। অক্ষত এবং আপাদমস্তক কর্দমাক্ত। নালার ঘোলা জলে ঝুঁকে আংশিক সাফাইকর্মের সময় তপন কলার পিছনে টেনে রাখল।
খুমকুট গ্রামের একান্তে প্রকাণ্ড জলাধার। তার জলে পার্শ্ববতী এলাকায় কৃষিভূমি প্রাণ পায়। মাঝখানে পুরনো ভাঙাচোরা জলটুঙি। রাজা-উজিরদের নিরাপদ শিকারকেন্দ্র। হায় রে, কত জীব যে নিহত হয়েছে বিনোদনের জন্য! 
সামনের ঘাটে লাল চেলি, মাটির ঘোড়া জানান দিচ্ছে, এটি পূজা-উৎসবের থান। জুটে গেছে বেখাপ মলিন পোশাক, খালি পা ছোটরা। একটি লজেন্সেই মুখে খুশি ভাসছে। গনেশঅ, রমেশঅ, দাসঅ, রামঅ চুল সাইজ করে ছবির জন্য পোজ দিল।
গোধূলি ছেড়ে অন্ধকার নেমে আসছে। ফেরার পথে পদক্ষেপণে গতি বাড়াতে হল। টিমটিমে বাল্বের নীচে বড় বড় হাঁড়িতে ধানের চোলানো রস আর শুয়োরের মাংসের আয়োজন। সাঁওতাল তরুণী জানালেন, জন্মদিনের অনুষ্ঠান আছে।
দৌড়চ্ছি। আঁধারে ভয় কাছিয়ে আসে। গুড়িখোঁড়া গ্রামে বিশাল বটগাছ। রাশি রাশি ঝুলন্ত ঝুরি। মেলা বসে মকর সংক্রান্তিতে। অগ্নিকুণ্ড ঘিরে জনাকয় মেহনতি মানুষ। টর্চ জ্বেলে তাঁরাও খেয়াল রাখছেন। ধানগাছ যে পূর্ণগর্ভা। সতর্ক করলেন, রাতপথে হুঁশিয়ার থাকা চাই। হাতিঠাকুর, ভালু বহুত। তারপর খারাপ সংবাদ পাওয়া যাবেই। একদিনে হাতি দু'জনকে শুঁড়ে জড়িয়ে পায়ে পিষে.... অথবা গুঁতো মেরে পেল্লায় দাঁতটা তরোয়ালের মতো হতভাগ্যের পাঁজরায়.... নাঃ, শুনতে মন চায় না।


জোরদার টর্চ জ্বেলে বুবাইবাবু ফিসফিসিয়ে ঘোষাইলেন, 'এগিয়ে কিমি দেড়েক টুঁ-ও করবেন না। আমাকে ফলো  করুন শুধু।'
  'পিছন থেকে এলে কী করব?'
  'তখন দেখা যাবে। লেটস্ স্টার্ট।'
মসিকৃষ্ণ চরাচরে আটটা পা পড়ছে ধপধপ। নিঝুম ঘর-গেরস্থালি ছাড়িয়ে, চরমতম উৎকণ্ঠা নিয়ে যেন পাঁইপাঁই পালানো। বেঁচে আছি বোঝাতে খুক কাশতেও মানা। রাঙামাটির পথ ধরে তালসারি আর দু'পাশের সবুজালির সুখানন্দ পেতে পেতে বিকেলের পদক্ষেপ যেমন ছিল, নিখুঁত অন্ধকারে ফেরাটা আদৌ তেমন হচ্ছে না। কালো-কোলো ধুমসো জন্তুগুলো কোথায় কী করছে কে জানে!
আর একটা ভয় জানিয়েছেন বন্ধু-গাইড মহাশয়। একাধিকবার সাক্ষাৎ পেয়েছেন বলে টর্চ লাইটে কাটাকুটি খেলা থামছে না। মাটিতে, এপাশে-ওপাশে, কাছে-দূরে, আগে-পাছে ফোকাস ঝলসে উঠছে। যদি হঠাৎ আবির্ভাব হয় ফণাধরের!
সাড়ে চার কিমি একটানে হেঁটে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর পৌঁছে পুনর্জাত মনে হল নিজেদের। দোকানে চায়ের কাপ হাতে তাকিয়ে থাকি কুহকিনী নিশারণ্যের পানে। পড়তে পারি, বনপল্লির জীবনকথা। এত বিপদ-আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা তাদের আজন্মমৃত্যু সঙ্গী!
  
  ছবি: পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের কাছে, বনপথে, কোলাসিরা চত্বরি ও খুমকুট জলাধার। অক্টোবর, ২০২১।





* ইয়েলবং ভ্রমণ *

সা য় ন্ত ন ধ র

"ভ্রমণের জন্য বিনিয়োগ হচ্ছে নিজের জন্য বিনিয়োগ।"


ম্যাথু কার্স্টেন এর এই উক্তিকে আপ্তবাক্য করে এ বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন বাড়ি থেকে রওনা দিলাম আমি ও বাবা সকাল সাড়ে আটটায়। প্রধান সড়কে পৌঁছে দেখি, কোন ই-রিক্সাই শহরের প্রাণকেন্দ্র কদমতলায় যেতে ইচ্ছুক নয়। দেরী হচ্ছে, তবুও নির্ধারিত সময়ের অর্থাৎ সকাল ন'টা বাজার দু'মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম কদমতলা। দেখি, সেখানে কেউই তখনো সাজগোজ শেষ করে উঠতে পারেনি। বুঝলাম, সময় মেনে চলার প্রবণতা বা ইচ্ছে কোনটাই এখনো আয়ত্তে নেই কারো। শুধুমাত্র শিলিগুড়ি থেকে আসা জলপাইগুড়ি জিলাস্কুলের ভূগোলশিক্ষক শমিত বর্মন যথাসময়েই এসে উপস্থিত। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও একাদশ শ্রেনীতে পড়াকালীন মেগা ভূগোল ক্যুইজে অংশগ্রহন করার জন্য উনার অনুমতি নিয়েছিলাম, সেই সুবাদে উনার সাথে পূর্বপরিচয় ছিলো। পুনরায় আলাপ করার সুযোগ পেলাম। ভূগোল মঞ্চ দ্বারা আয়োজিত এই ইয়েলবং ভ্রমণ, তাই উপস্থিত সকলেই ভূগোলের শিক্ষক। শুধু জৈত্রদাদা ইংরেজীর আর আমি বোটানির। এই দলে আমিই সর্বকনিষ্ঠ। জৈত্রদাদার বাবা জাতীশ্বর কাকু বঙ্গীয় ভূগোলমঞ্চের জলপাইগুড়ি জেলা শাখার দায়িত্ব সামলেছেন বহুদিন। বাবা কদমতলার স্টেশনারী দোকান থেকে চায়ের জন্য কাগজের কাপ কিনতে গেলো। মানুষের বিশ্বাস কাগজের কাপ পরিবেশবান্ধব। তাই তা যেখানে সেখানে ফেলে আসা যায়। তবে তাঁরা জানেন না যে বিশুদ্ধ কাগজের কাপে চা ঢাললে তা কাগজ দ্বারা শোষিত হয়ে নষ্ট হতে পারে, কাগজের কাপও ভিজে গিয়ে তার আকৃতি হারাবে, তখন সেটা ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। তাই কাগজের কাপেও পলিইথিলিনের আস্তরণ দেওয়া থাকে।উপরন্তু কাগজ জোড়া দেওয়ার জন্য যে আঠা ব্যবহার করা হয়, তার গন্ধ চা এ এসে মেশে। পলিইথিলিনের সামান্যতম উপস্থিতির জন্য এই আপাত নীরিহ কাগজের কাপও প্ল্যাস্টিক কাপের মতোই নন বায়োডিগ্রেডেবল্ [Hocking,M.B.(1991)]। পরিবেশকে বাঁচাতে হলে যে কাপই কেনা হোক তাকে গারবেজ ব্যাগে করে ফিরিয়ে এনে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা উচিত। 


এরপর একে একে এলেন লাবণিদি ও মৌসুমীদি। কদমতলা থেকে নাইন সিটার বোলেরোতে করে রওনা দিলাম সাতজন। তখন বাজে নয়টা পনেরো। এরপর সুহৃদলেনের সামনে গাড়ি দাঁড়ালো, গার্গীদি নয়টা পঁয়ত্রিশে এলে গাড়ি ছাড়লো। আমরা শহর থেকে বেরিয়ে ডেঙ্গুয়াঝাড় রেল ক্রসিংএ আটকে গেলাম। পনেরো মিনিট কেটে গেলো।পর পর দুটো ট্রেন পাস করলো, জ্যাম সরিয়ে বের হতেই দশটা বেজে গেলো। বেলাকোবাতে আবার রেলক্রসিং এ আটকে গেলাম। অতঃপর আমবাড়ি থেকে উঠলো চিরঞ্জীবদা। আমরা নয়জন তখন গাজোলডোবা ফ্লাইওভার দিয়ে ক্যানেলের রাস্তা ধরে চলতে লাগলাম। একে একে ভোরের আলো, তিস্তা ব্যারেজ, আপালচাঁদ ফরেস্ট পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ওদলাবাড়ি। সেখান থেকে বাগরাকোট। স্কুলের সামনে গাড়ি থামলো। এখানে এই গাড়িটি ছেড়ে আমাদের স্থানীয় গাড়ি নিতে হবে। বাগরাকোট থেকে অমিতদা আমাদের সাথে যুক্ত হলো। দুটি বোলেরোতে পাঁচজন করে বসার সিদ্ধান্ত হলো। এগারোটা পঞ্চাশে গাড়িদুটো ছাড়লো। বাঁদিকে আর্মি ক্যাম্প পেরিয়ে চেল ফরেস্টের মধ্য দিয়ে একটি নির্মীয়মান হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। এটি সম্ভাব্য ৭০নং জাতীয় সড়ক, যা বাগ্রাকোট থেকে লোলেগাঁও (হ্রস্বতম পথ)হয়ে গ্যাংটক যাবে। অত্যন্ত ধূলিধূসরিত অবস্থা এখন। গাড়ির কাঁচ আটকে ড্রাইভার এসি চালিয়ে দিলো। বাবা সামনের সীটে বসে যাত্রাপথের ভিডিও করতে লাগলো। ড্রাইভার জানালো, এখানে আগে খুব সরু ও উঁচু রাস্তা একটা ছিলো। জে.সি.বি, রক ব্রেকার প্রভৃতি উন্নত যন্ত্রের সাহায্যে ডিনামাইট ব্লাস্টিং ছাড়া সেই রাস্তা ও পাহাড় কেটে তুলনামূলক নিচু ও চওড়া হচ্ছে রাস্তা। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, চারিদিকে শুধু ডাম্পার আর ডাম্পার। জে.সি.বি মেশিন দিয়ে কাটা মাটি প্রায় দশবারে একটি ডাম্পার পূর্ণ করে। বাগ্রাকোট থেকে ইয়েলবং পনেরো কিলোমিটার। রাস্তার বাঁদিকে লিস্ নদী, ডানদিকে জুরন্তী নদী। যাত্রাপথে যে গ্রামগুলি পড়বে সেগুলি হলো টি টোয়েন্টি, মন্দির খোলা, লুপপুল, লিচিদারা, ধানপানি, কয়লাখনি। ছোটবেলায় ভূগোলবইতে পড়েছি, জলপাইগুড়ি জেলার বাগ্রাকোটে টারশিয়ারী যুগের পাথুরে কয়লা, পীট কয়লা ও বোদ কয়লার খনি আছে। এটা সেটাই। লাভজনক নয় বলে এখন আর কয়লা উত্তোলিত হয় না। বৃটিশ পিরিয়ডে এই কয়লা চা-পাতা শুকোতে ব্যবহার হতো। তিনটি পৃথক কোম্পানী মিলে রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ তৈরীর অর্ডার পেয়েছে। এরমধ্যে দু'টি কোম্পানী যথাক্রমে ছত্তিশগড় ও ভূটানের, তৃতীয়টি হলো রানী কন্সট্রাকশন্স। রাস্তার ধারে ছোট ছোট গ্রাম,সবগুলোই জনবিরল। সম্ভবতঃ এ কারণেই এই গ্রামগুলির নিজস্ব কোন নাম নেই, পরিচিতি লাভ করেছে কালভার্টের নামানুসারে (যেমন টি টোয়েন্টি, লুপপুল), অথবা মন্দিরের নামে (মন্দির খোলা)। সড়ক তৈরী মানেই ব্যাপকহারে বৃক্ষচ্ছেদন। কালিম্পং জেলার মধ্য দিয়ে চলেছি এক্ষণে। এ রাস্তা জি.টি.এ (Gorkhaland Territorial Administration) -এর অধীন। কর্তিত পাহাড় দেখে বোঝা যাচ্ছে এ অঞ্চলটি হিমবাহের আউটওয়াশ প্লেন। হিমবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপ এস্কার ছিলো এক সময়ে। যেমন মিরিকের পথে গোলপাহাড় হলো ড্রামলিন। বাগ্রাকোট থেকে ইয়েলবং পর্যন্ত প্রায় ষাটটি বাঁক রয়েছে। লুপপুল থেকে লিস্ নদীর বিস্তীর্ণ চর দেখা যায়। এখানে প্রধানতঃ ঝাড়ু, বাঁশ ও আদা চাষ হয়। পাহাড়ের উপরে থাকা স্বাভাবিক উদ্ভিদই এই বনভূমির মূল অংশ। এতো বেলায় কিছু পাখি বাদে কোন বন্য প্রানীর দেখা মেলেনি। লিচিদারা নাম হয়েছে লিচু গাছ থেকে। এখানে ব্রিটিশ ফোর্ট ছিলো একসময়ে। পথে নারকেলগাছ সদৃশ তিনটি গাছ চোখে পড়লো। ওগুলি নারকেল নয়,ওগুলি Phoenix rupicola.


রুপিকোলা নামটি এসেছে পাথুরে জমিতে জন্মায় বলে। পূর্ব হিমালয়ে ভারতের সিকিম দার্জিলিং কালিম্পং ও ভূটানে এই গাছ জন্মে। এর সাধারণ নাম ক্লিফ ডেট পাম। নানান ধরনের ফার্ণ, বাঁশ, গিলা, বকুল, শাল, চিলৌনী, গরাণ, কেয়া, কারিপাতা, বট, রঙ্গন, সুপারী, আম, ছাতিম, পেঁপে, ঝাড়ু, তিতোপাতা, অ্যাগেভ, তেজপাতা, শিমুল, কলা, মুর্বা, ল্যান্টানা ক্যামারা ইত্যাদি নানা গাছ চোখে পড়লো। গাছগুলি সুবিশাল, এদের মধ্যে যেন সূর্যের রশ্মি পাবার এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। কয়লাখনি অঞ্চলের সামনে এলাম। গাড়ি থেকে নামলাম না, সময় বাঁচাতেই। হলদে ও ছাইরঙা বালিপাথরের মাঝে কয়লার কালো রঙ সর্বত্র।এরপরেই গাড়ি ডানদিকে শার্প টার্ণিং নিয়ে নীচে নামতে লাগলো। সোজা রাস্তাটি চলে গেছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত চুইখিমবস্তির দিকে। বিপজ্জনক সংঙ্কীর্ণ খাড়া কাঁচারাস্তা ধরে গাড়ি নামছে। গহন অরণ্যে মাঝে মাঝেই চুলের কাঁটার মতো বাঁক। একটি সংরক্ষিত বনভূমিতে প্রবেশ করতে গেলে যে নিয়মকানুনের বেড়াজাল টপকাতে হয়, সেরকম কোন নিয়ম এখানে নেই। জীবিকার টানে মানুষের সক্রিয় পদচারণা এ বনভূমিতে পরিলক্ষিত, তাই বন্যপ্রাণের দেখা সহজে মেলেনা। এখন শুষ্ক ঋতু। পথ জুড়ে ঝরাপাতার পুরু আস্তরণ। বর্ষাকালে কর্দমাক্ত রাস্তা আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে এ রাস্তায় গাড়ি চালানো খুবই কষ্টকর।সামনে একটা উপত্যকা, শুষ্ক ঝোড়ার অবস্থান সেখানে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জনবিরল। এ রাস্তারই শেষপ্রান্তে রয়েছে ইয়েলবং গ্রাম। পাহাড়ের শিলাস্তরগুলি বইএর পাতার মতো বেরিয়ে এসেছে। সেগুলির টেনশন স্ট্রেংগথ খুব কম অর্থাৎ ভঙ্গুর। একটু স্পর্শেই বালির মতো ঝুরঝুরে হয়ে পড়ছে। সবই আবহবিকারের ফল। পথিমধ্যে ধ্বস নেমে খুবই সংঙ্কীর্ণ হয়ে আছে রাস্তা। ধারগুলো খাড়া নেমে গেছে নিচে। পাথুরে সে ধার ঘাসগুল্মে সবুজাভ দেখাচ্ছে। আরো একটি জলহীন ঝর্ণা পেরোলাম। বর্ষাকালে আসতে হলে ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। ধূলিধুসরিত রুক্ষ শুষ্ক বালুকাময় অঞ্চলে যত্র তত্র ফুটে রয়েছে নাম না জানা ফুল। গরু চরে বেড়াচ্ছে। আরো একটি ঝর্ণা পেরিয়েই বেলা বারোটা পঁয়ত্রিশে পৌঁছে গেলাম ইয়েলবং গ্রামে। কাঠ বাঁশ ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি সুসজ্জিত রঙীন বাড়িঘর, প্রতিটি বাড়ির সামনে রঙবেরঙের ফুল, যেন এক একটি নার্সারি। ইয়েলবং গ্রাউন্ড। ভলিবল কোর্ট রয়েছে এখানে। সমতল খেলার মাঠে বেশ কিছু বিশালায়তন পাথর ইতঃস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই ভূমিরূপকে বলে রক আউট ক্রপ। ইয়েলবং ফরেস্ট স্কুল পেরোলাম। স্কুলের বাইরের দেওয়ালে একটি ঘড়ি। তখন বাজে বারোটা পঁয়তাল্লিশ। রাস্তার পাশে বেশ কিছুদূর সারি সারি অ্যাগেভ লাগানো। এই অ্যাগেভ থেকে তন্তু তৈরি হয়। খাড়া রাস্তা থেকে নেমে চারদিকে পাহাড় ঘেরা দুর্গম অঞ্চলে টাইলস্ বসানো সুন্দর একটি বাড়ি। দূরে আরো কয়েকটি বাড়ি বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রাস্তা সরু ও তীক্ষ্ণ বাঁকযুক্ত হওয়ায় গাড়ি একবারে ঘোরানো সম্ভব নয়।গাড়ির ড্রাইভাররাও এরপর রাস্তা চিনতে পারছিলো না। তাই স্থানীয় এক বালককে গাইড হিসেবে নেওয়া হলো। তার নাম জেয়ানুস সারকি। বরবট হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ে। গাইড জানালো, আরো কিছুদূর নীচে গাড়ি যেতে পারবে, সেখানে গাড়ি ঘোরানোর জায়গাও আছে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটি হোম স্টে পেলাম। এখানেই আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। হোম স্টে থেকে ২.১৩ কিলোমিটার দূরে নদীবক্ষ। বেলা এখন একটা বেজে পাঁচ মিনিট, দূরে পাহাড়ের মাথায় গৈরিবাঁশ রয়েছে যা জলের অভাবে শুকিয়ে লাল হয়ে গেছে, এর মাঝে সাদা ফাটলের মতো গর্জটি দৃশ্যমান। রাস্তা যথেষ্ট ঢালু, গতিতে এগিয়ে চলেছি আমরা। গাইড চলেছে পথপ্রদর্শক হয়ে। চারপাশে ঝাড়ু গাছের বাগান। পথিমধ্যে একজন ভারবাহী বৃদ্ধার সাথে দেখা। সদা হাস্যময়ী, নাকে নোলক, কানে মাকড়ি, সব কাঁচা সোনার।


মুখে অজস্র বলিরেখা, মাথায় এক খন্ড রঙীন কাপড় জড়ানো, পরণে ট্র্যাডিশনাল পোশাক, অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো যতদূর দেখা যায়। রাস্তার ধারে পাহাড়ের ঢালে দেখা পেলাম সিলভার ফার্ণ, গোল্ডেন ফার্ণের। চলার তাগিদে ছবি নেওয়া হলো না। ফেরার পথে দেখা যাবে, এই ভেবে এগিয়ে গেলাম। গাইডসহ এগারো জন আঁকাবাঁকা পথ ধরে নামতে লাগলাম। একটা পনেরোর দিকে আবিষ্কার করলাম, আমরা নয় জন আছি। দুইজন সম্ভবতঃ পিছিয়ে পড়েছিলো, এ পথে পিছিয়ে পড়লে পথ হারানো অবধারিত। গুঁড়ো পাথর ও বালির আধিক্য হেতু সরু ঢালুপথে নামতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে পা হড়কে যাচ্ছে। খুব ভালো গ্রীপের জুতো এবং সঠিক বডি ব্যালেন্স না থাকলে এ পথে চলা অসম্ভব একটা চল্লিশ পর্যন্ত একস্থানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে জানলাম দলের একজন সঠিক জুতো না পড়ে ফ্যাশানদুরস্ত পাম্প শ্যু পড়েছে বলে ট্রেকিংএ ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়েছিলো। তাঁকে সাহায্য করতে গিয়ে আরও একজন একই সঙ্গে থেকে যায় এবং অবশেষে তাঁরা পথ হারায়। এখানে একইরকম পায়ে চলা পথ অনেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। গাইডকে অনুসরণ না করে চললে পথ ভুল হতে বাধ্য। তবে লক্ষ্যনীয়, আমরা সবসময় প্রতিটি একাধিক রাস্তার সংযোগস্থলে এসে ডানদিকের পথটিই অনুসরণ করেছি। দূরের পাহাড়গুলো যেন জলছবি। হলুদ কালো খয়েরী লাল হাল্কা সবুজ গাঢ় সবুজ ও নীল রঙে রঙীন। এর মাঝে যেন একটা ল্যান্ডমার্ক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মাদারগাছ, সব পাতা ঝরিয়ে শুধু লাল ফুলে ভরে আছে। দেখা মিললো, কালো হীরে কয়লার। এ স্থানে স্থানীয় মানুষেরা বেআইনী ভাবে কয়লা উত্তোলন করে, যা তাঁদের জ্বালানীর চাহিদা মেটায়। আমিও ছোট এক টুকরো কুড়িয়ে নিলাম চিহ্ন হিসেবে রাখবো বলে। এরপর পেলাম একটি প্রশস্ত ঝোড়া, এই প্রথমবার বাঁদিকে বাঁক নিলাম। এই ঝোড়াটিতে এখনো জল রয়েছে। ঝোড়া বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম, কয়লার জন্য চারিদিক শুধু কালো আর কালো। পুরো ঝোড়াটিই কালো কয়লার গুঁড়ো পরিবৃত। একটা পঞ্চান্নতে আমরা নেমে এলাম রুমতী নদীর বুকে। রুমতীর জলধারা অনুসরণ করে ডান দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখতে পেলাম বেশ কয়েকটি রঙ বেরঙের তাঁবু, এগুলি রিভার ক্যাম্প, এখানে বিদেশী পর্যটক চোখে পড়লো। ছোট বড় মাঝারি অসংখ্য পাথর টপকে চলেছি, গাইডকে কখনোই চোখের আড়াল হতে দিইনি। এর মাঝেই আলাপ হলো অমিতদার সাথে। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম তার সাহচর্যে। নদীগর্ভে বেশ কিছু গাছের গুঁড়ির অবশিষ্টাংশ চোখে পড়লো। হয়তো বা কখনো হড়পা বানে সেগুলি ভেঙে মরে গেছে। পাথরের খাঁজে খাঁজে জন্মেছে ইকুইজিটামের ঝাড়। রঙ বেরঙের পাথর, জলের রঙ লালচে, যে পাথরগুলির ওপর দিয়ে রুমতী নদীর জল বয়ে গেছে সেগুলিও লাল। এ থেকে বোঝা যায় জলে আয়রণের পরিমান বেশী। বেলা দু'টো পাঁচ, এমন সময় নদীবক্ষের কিছু দৃশ্যপরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। দেখলাম,দু'টি বিশাল শিলাখন্ডের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নদী, চোখে পড়লো বেশ কয়েকটি বড় বড় পটহোল, ভৌগোলিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয়, দুটি শিলাখন্ড এক সময় অখন্ড ছিলো, খুব সম্ভবতঃ ঝর্ণার জল এর উপর পড়তো, বহু বছর ধরে ক্ষয়কার্যের ফলে শিলামধ্যস্থ নরম স্তর ক্ষয়ে গিয়ে গভীর "V" আকৃতির ক্যানিয়ন সৃষ্টি করেছে। প্রায় মিনিট পনেরো ধরে দাঁড়িয়ে সেখানকার অভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করলাম, ছবি তুললাম। দু'টো কুড়ি নাগাদ রুমতী নদীর বামতীর থেকে আসা অন্য একটি উপনদীর খাত ধরে এগোতে লাগলাম। ঘন সবুজে ঢাকা সে পথ অতি দুর্গম। অ্যাজারেটাম, ক্রোমোলিনা, মাইকেনিয়া, মেলাস্ট্রোমা, বেত, কেয়া, গৈরিবাঁশ, টেরিস ও ইকুইজিটামে সমৃদ্ধ। এখনো পর্যন্ত নদীখাত বেশ প্রশস্ত। তবে দুইধার প্রায় নব্বই ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে খাঁড়া। জল বাঁচিয়ে পাথরের ওপর দিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পনে পা ফেলে চলেছি। পাহাড়ের ধারগুলি বছরের পর বছর জলসিক্ত থাকায় অনাবৃত স্থানগুলিতে মসের আধিক্য দেখা যায়। আমরা কিছুটা পাহাড়ের পাদদেশের ধাপ দিয়ে বড় বড় পাথরের ওপর পা ফেলে উপরে উঠতে লাগলাম। কোথাও বা শুধু মাত্র কৌনিক ভাবে কাটা বাঁশের পর্বগুলির খাঁজে পা দিয়ে উপরে উঠলাম আমরা। এটা ছিলো আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একটি বিরল অভিজ্ঞতা। গাইড জানালো, এখানেই একটি গুহা রয়েছে আর রয়েছে রেনবো বা লিম্বুনি ফলস্। হাতে সময় কম থাকায় এ দু'টি আমরা দেখতে পাইনি। এরপর নদীখাত ক্রমশঃ সংঙ্কীর্ণ হতে লাগলো। পাহাড়ের দেওয়ালে পরিলক্ষিত হলো খরস্রোতা নদীর জলের ক্ষয়কার্যের শিল্প স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। এভাবে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। এ জায়গায় নদীখাত সরু হতে হতে তিন থেকে চারফুট ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুলছে গাছের শিকড়। ফাটল চুঁইয়ে পড়ছে জল।বেয়ার গ্রীল এ জায়গায় এলে হয়তো এই শিকড় ধরে ঝুলে ঝুলে উঠে যেতে পারতেন ঐ খাঁড়া পাহাড়ের মাথায়। ভূপ্রকৃতিগতভাবে এটি "I"আকৃতির গর্জ। নদীপৃষ্ঠ থেকে পাহাড়গুলি প্রায় একশো ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। আমরা দু'জন এখানেই অপেক্ষা করলাম, বাকি সাতজন জল ভেঙে গর্জের ভিতর প্রবেশ করলো। জল প্রথমে হাঁটুসমান, পরে ধীরে ধীরে গভীরতা বাড়তে বাড়তে হলো কোমর সমান। এখানে ওপর থেকে পড়ে যাওয়া কিছু গাছের গুঁড়ি এমনভাবে রয়েছে যে তার ওপরে পা ফেলে ফেলে গর্জের ভিতরে আরো কিছুদূর চলে যাওয়া যায়। গর্জের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত যাওয়া খুবই কঠিন, কোনো কোনো স্থানে জলের গভীরতা প্রায় ছয় ফুট। সাঁতার না জানলে তা পেরোনো অসম্ভব। এছাড়াও হেলমেট, দড়ি, হুক-এ সমস্ত সরঞ্জাম থাকতেই হবে। আমি বাইরে থেকে দেখছিলাম নাম না জানা গাছেদের। অসংখ্য ফার্ণ ও মস মিলে পাহাড়ের গায়ে রচেছে মস-ফার্ণ লাইব্রেরী। উপর থেকে ঝরে পড়া পাতায় পুরো জায়গাটি হলুদ ও খয়েরী রঙের মোজেইক করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তোলার পর বাড়ি থেকে আনা খাবার খেতে শুরু করলাম। হঠাৎ দেখি ভিজে চুপচুপে দুটি কুকুরছানা জল থেকে বেরিয়ে আসছে। তাদের সাথে সাথে বেরিয়ে এলো আমাদের দলের সাতজন ও একটি নেপালী পরিবার। এরাও পর্যটক। একটি কোলের শিশু ও দুটি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে তাদের মা বাবা এই দুর্গম অঞ্চল দেখতে এসেছে। তাদের প্রাণোচ্ছ্বল হাসি পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আমরা সেখানে সর্বসাকূল্যে আধঘন্টা ছিলাম। বিকেল তিনটা দশে ফেরার পথ ধরলাম। সাড়ে তিনটায় ফিরে এলাম ক্যানিয়নের কাছে। পড়ন্ত সূর্যের লাল আলোয় একদিকের পাহাড় যখন লালে লাল, অপরদিকের পাহাড়ে তখন ছায়ার খেলা। দূর থেকে সেই লালরঙে আরো তীব্র লাল ছিলো রামবাসকের দল, যেন পাহাড়ে ফুটে থাকা অগ্নিশিখা। এরপর তিনটা পঁয়তাল্লিশে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। নামাটা যতো সহজ ছিলো, ওঠাটা মোটেও অতো সহজ নয়। যথেষ্ট কঠিন। পৃথিবীর অভিকর্ষশক্তি আমরা অনুভব করি এই সময়েই। প্রথম কিছুটা উদ্যমের সাথে পেরিয়ে এলেও হাঁপিয়ে পড়লাম অচিরেই। দম নিতে যেখানে দাঁড়ালাম, সেই স্যাঁতসেঁতে পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য মার্কেনশিয়া নামক মসের দেখা পেলাম। অযৌন জননে সাহায্যকারী গেমাকাপগুলি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। ক্যামেরাবন্দী করে ও কিছু অক্সিজেন সঙ্গে করে আরো উপরে উঠতে লাগলাম। বেশ কিছু জায়গায় বিশ্রাম নিতে খানিক দাঁড়িয়েছিলাম, অবশেষে ফিরে এলাম যেখানে গোল্ডেন ফার্ণ আলো করে আছে।


তার স্বর্ণচ্ছটা ক্যামেরাবন্দী করলাম। এখানেই পথ হারানো সেই দু'জনের দেখা পেলাম। আরো দুটি পাকদন্ডী পেরিয়ে একটি নেপালী পরিবারের বসতবাড়ি থেকে তাঁরা তাঁদের উপস্থিতি হাঁক ডাকের মাধ্যমে জানালো। পা আর চলতে চায় না। কোনরকমে সেই পথটুকু নিজেদের টেনে নিয়ে চললাম আমরা। সেই বাড়ির দাওয়ায় পেতে রাখা চেয়ারে বসে গ্লুকোন ডি জল খেতে খেতে শুনলাম সেই দু'জনের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী। পূর্বেই বলেছি, একজন যে জুতো পরে এসেছিলো তা ট্রেকিংএর উপযোগী নয়। তাঁকে লাঠি দিয়ে সাহায্য করতে গিয়ে অপরজন ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এরপর একটি একাধিক রাস্তার সংযোগস্থলে তাঁরা ডানদিকের পথ না ধরে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়। সে পথও ঐ নদীতে গিয়ে নেমেছে ভীষণ সংঙ্কীর্ণ ও খাড়া ভাবে। ফলস্বরূপ অনেকটা নামার পরেও তাঁদের ফিরে আসতে হয়। খারাপ লাগছিলো, ওরা এতো কাছে এসেও গন্তব্যে পৌঁছে অসাধারণ গর্জ ও ক্যানিয়ন দেখা থেকে বঞ্চিত হলো। তবে তাঁরা অন্যরকমভাবে সময়টাকে কাজে লাগিয়েছে। একটি জায়গার ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুই তো সব নয়, জনজীবনও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরণের শিক্ষামূলক ভ্রমণে জনজীবন, ঘরবাড়ি, পেশা, জীবিকা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও কৃষ্টি সংস্কৃতি জানাটাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা সে সময়ে সেই নেপালী পরিবারের থেকে এসব বৃত্তান্ত গল্পচ্ছলে জেনে নিয়েছে। সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয় জন, বাবা মা ও চার ছেলে। ছেলেরা সব স্কুলে পড়ে, কেউ অষ্টম শ্রেনীতে কেউ ষষ্ঠ শ্রেনীতে। কেউ বারবট হাই স্কুলে, কেউ পেডংএর সেন্ট জর্জ হাইস্কুলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এদের মা তাঁদের সঙ্গে গল্প করে ও সঙ্গ দেয়। দুই ভাই নদীতে মাছ ধরতে গেছে। পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে এরা মাছ মারে। অন্য দুই ভাই বাড়ির উঠোনেই ফুটবল নিয়ে খেলছে। ওরাই বাড়ির চারপাশ ঘুরিয়ে দেখালো। দুটি মিষ্টি ছাগলছানা দেখিয়ে বললো, "কোলে নিয়ে আদর করো। "মুরগী চরে বেড়াচ্ছে, পরিপাটি করে সাজানো গোয়ালঘর, বাড়িটি রঙ বেরঙের পিটুনিয়া, দোপাটি ও নয়নতারায় সুসজ্জিত। চোখে পড়লো ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকা সজনে গাছ। তারা সজনে ফুলের বড়া খেতে জানে। এও জানে, ভীষণ উপকারী। বাড়ির জমিতে রাইসর্ষের চাষ হয়েছে। কিছু রাইসর্ষেশাক তুলে দিতে চাইলো। কিন্তু তারা ভীষণ গরীব। তাই নিতে চাইলো না মন। ওদিকে মায়ের আতিথেয়তার মনোভাব বুঝতে পেরেই ছেলেদুটি খেলা ছেড়ে তরতরিয়ে উঠে পড়লো তেঁতুলগাছে, অনেকগুলো তেঁতুল পেড়ে নেমে এলো তরতর করে, হাত ভরে সেই তেঁতুল দিলো। তারপরই চোখের নিমেষে একই ভাবে বাতাবি লেবু গাছ থেকে দুটি বাতাবিলেবু পেড়ে এনে দিলো। কে শিখিয়েছে তাদের এমন আতিথেয়তা? যাঁদের আছে ভুরি ভুরি তাঁদের তো হাত খুলে এভাবে কখনোই দিতে দেখিনি। শুধু আতিথেয়তাই নয়, তারা ছুটে গিয়ে ঘর থেকে তাদের পড়ার বই এনে দেখাতে লাগলো। ওরা ওদের ভাষায় সুন্দর সুন্দর কবিতা পড়ে শোনালো। এই দুর্গম পথেও এখানকার পুরুষেরা বাইক নিয়ে যাতায়াত করে। তবে অসুস্থ হলে দু'ঘন্টা হাঁটা পথে হাসপাতালে পৌঁছতে হয়। এইসব গল্প শুনতে শুনতে আমরা সবাই যখন গাড়ির কাছে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সময় পাঁচটা কুড়ি। পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। গোপাল ছেত্রীর হোম স্টে তে সবাই গেলো। যাত্রাপথেই খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিলো। আমি কোরনা পরিস্থিতিতে বাইরে খাইনি। সঙ্গে ছিলো চা, তাইই খেলাম। অন্যান্যরা সবাই অবশ্য সেখানে খেলো। এলাহী আয়োজন। ভাত, পাঁপড়, লেবু, আচার, ডাল, সব্জী, রাইশাক ও ডাবল ডিমের ওমলেট। আমি সেইসময় হোমস্টের বাগানের গাছপালা ও ফুল দেখছিলাম। হোমস্টের পিছনে জন্মেছে স্বাভাবিক উদ্ভিদ, সামনে অরোকেরিয়া, ঝাউ, মোরগফুল, গোলাপী লাল বেগুনী সাদা হলুদ রঙের সালভিয়া, গাঁদা, তারাগাঁদা, অ্যাজেলিয়া, বোগেনভেলিয়া, গোল্ডেন লিফ, পিটুনিয়া, ইউফরবিয়া পালচেরিমা, ইউফরবিয়া মিলি, নয়নতারা, ক্রোটন পাতাবাহার - আরো কতো কি। পৌনে ছ'টায় খাওয়া শেষে সবাই বেরিয়ে এলো। গাঢ় বেগুনী আকাশে গোলাপী সবুজ হোমস্টে কৃত্রিম আলোকছটায় ভারি মায়াবী হয়ে ধরা দিয়েছে।সেই প্রক্ষাপটে একটি গ্রুপ ছবি তোলা হলো। ছয়টার সময় আমরা রওনা দিলাম ফিরতি পথে। দূষণমুক্ত গাঢ় নীল আকাশ ও গাড়ির হেডলাইটের হলুদ আলো পথের ধুলোয় প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত দৃশ্য তৈরী করেছে। এর মধ্যেই একটি পাখীকে এক ঝলক দেখলাম, সেও ফিরছে তার কুলায়। একরাশ ক্লান্তি শরীরে, কিন্তু মনে প্রশান্তির উত্তরীয় জড়িয়ে বাড়ি পৌঁছলাম যখন তখন রাত নয়টা।





* পথে যেতে যেতে ... (পর্ব : ১) *

ড রো থী দা শ বি শ্বা স

তুমি তো গড়েছো এই সুন্দর ধরণীর রূপ ... শস্যক্ষেত্র দিগন্ত আকাশ ...সূর্যের আলোক তেজ হেমন্তের হিমেল বাতাস ... দেখি এই অপরূপ রূপ ... আমি নির্বাক নিশ্চুপ ...আমার জলশহর ঘেঁষা অপরূপা তিস্তার রূপোলী শরীর ... ফুলঝরা কাশঝাড় উত্তুরে বাতাসে নোয়ায় শির ... ঝরাপাতা পুরু হয়ে গালিচা বিছায়ে ... রচিছে রম্যপথ বটবৃক্ষছায়ে...ভোর আর সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে..পরিক্রমন করি শুধু সৌন্দর্য হেরিতে ....পরিশ্রান্ত ধরণীতে অগনিত জীবনের ভীড়ে ... একটু সৌন্দর্য ছুঁয়ে ফিরে আসা নীড়ে ...


তাই তো দীর্ঘ এগারো মাস পর গত ২১|১১|২০২০ শনিবার সকাল ৬:৫৫ টায় রওনা দিলাম মিরিক-এর পথে পাহাড়ি বনবস্তি "ধোতরে"-র উদ্দেশ্যে। বাড়ির গলিপথ পেরিয়ে গাড়ি যখন বড় রাস্তায় উঠলো তখন দেখি ষট্ পুজো সেরে নদীর ঘাট থেকে সবাই ফিরছে। ষট্ পুজোর আগের দিন করলানদীতে খুব সুন্দর করে ঘাট সাজানো হয়। প্রতি বছর ষট্ পুজোর ভোরে আমরা সেখানে যাই। এবারই ব্যতিক্রম। খাবার, জল, মাস্ক, স্যানিটাইজার নিয়ে এবারে বেরিয়ে পড়েছি ভ্রমণে। অমাবস্যা দীপাবলির পর প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী - এই শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে আমাদের পাড়ার সুইটি, পিণাক -ওদের পরিবার ষট্ পুজো করে। এখন অবশ্য পাড়ার অনেকেই এই পুজোয় সামিল হয়। 

ডেঙ্গুয়াঝাড় রেল স্টেশনের কাছে যথারীতি রেলগেট বন্ধ। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় নষ্ট হবে বুঝতে পারছি। পাহাড়ে যাচ্ছি, ধোতরের উচ্চতা ২৫০০ মি অর্থাৎ ৮৫০০ ফুট, হাই অল্টিচুড, আগের দিন গাড়ির চালক ঝন্টুকে ফোন করে অ্যাভুমিন আনতে বলে দিয়েছিলাম। স্যানিটাইজ করে খেলাম।মুখে মাস্ক, চোখে চশমা রাখলেই নিঃশ্বাসের জলীয়বাষ্প চশমার কাঁচে জমা হয়ে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে দৃশ্যমান সবকিছু। বুনু ফুট কাটলো, "সব ধোঁয়া ধোঁয়া .." শিলিগুড়ি অভিমুখে মালগাড়ি যাচ্ছে। লোকাল ট্রেন তো চলছে না। ষট্ পুজোর পর কোভিড সংক্রমণ বেড়ে যাবে, এমনই খবর, লোকাল ট্রেন ও স্কুল খুললে আর দেখতে হবে না।এরই মাঝে চলছে মাস্ক নিয়ে ক্যারিকেচার। বাপ বেটা অ্যাশ রঙের, চালক ঝন্টু নীল, আমি সাদা, বুনু গেরুয়া - বুনু বসেছে ডানদিকে জানালার পাশে। যেন ভি.আই. পি., পথ চলতি মানুষ ওকেই দেখছে বিশেষ দৃষ্টিতে। এই নিয়ে আমরা তিনজনেই খুব হাসছি। রায়পুর চা বাগান খুলে গেছে। বন্ধ থাকাকালীন বাগানটা জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। এখন আগাছা পরিষ্কার হয়েছে, গুল্মতে নতুন পাতা এসেছে, ঘন সবুজের গালিচা যেন, ভীষণ সুন্দর। বাগানটিকে প্রাণবন্ত মনে হলো। ডানদিকে রন্ধামালী। মাস্কটা এই ঠান্ডায় মাফলারের ওম দিচ্ছে। এই উত্তাপ বেশ ভালো লাগছে। জয়পুর চা বাগান, নতুন বস্তি, দারুণ রাস্তা, গেরুয়া মাস্কধারী বলছে, "এটা প্রধানমন্ত্রী যোজনা সড়ক, "ওপাশ থেকে ঝন্টু সহ তিনজনেই বলে উঠলো, "না,না ... এটা স্টেট হাইওয়ে ... রিপোর্টার ভুলভাল রিপোর্টিং করছে .." যাইহোক, এখন আমরা দুটো রাজ্যের রাজধানী দু'পাশে রেখে চলেছি। একদিকে ছত্তিশগড়ের রায়পুর,অপর দিকে রাজস্থানের জয়পুর, দারুণ ব্যাপার!!! নতুন বস্তির পর জোড়াকালী, এখান থেকে বেলাকোবা ৭ কিলোমিটার। এরই মাঝে ভুগোলবিদ তা নস্যাৎ করে বলে উঠলেন আনুমানিক দূরত্ব। অর্থাৎ মাইলস্টোন মিথ্যা!!! নেপতি নদীর সেতু, পি.ডব্লিউ.ডি.রোড দেখে রিপোর্টার এতক্ষণে বুঝলো এটা স্টেট হাইওয়ে।জয়পুর চলছে। বাঁ দিকে লঙ্কাজবার ঝাড় লালে লাল, দু'পাশে সবুজে সবুজ, পিঙ্ক সিটি নয়, এখানে জয়পুর গ্রীন সিটি।শেড ট্রীর মাথা জুড়ে ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়াশা। রাস্তার দু'ধারে সার সার সাদা কালো খুঁটি যা বিরল এখন। সার সার লাল সাদা হলুদের রিফ্লেক্টর। বিদেশ বিদেশ ভাব। ঘর থেকে বাইরে এলেই ভাবি বিদেশে এলাম। ঘরটাই আমার দেশ। গেটের বাইরে পা দিলেই ভাবি বিদেশ। তখন একবারও মনে হয় না শরীর খারাপ বা মন খারাপ। গাছের সারি, গাছই চেয়ে চেয়ে দেখি, স্থাপত্য অতো টানে না। ঐতিহাসিক জায়গা হলে তখন সেটা আলাদা। আমাদের ঘুরতে যাওয়া মানে ঝটিকা সফর। একদিনেই যতোটা দেখে নেওয়া যায়। থাকাথাকির প্রশ্ন নেই। ভাটপাড়া, রাস্তা সুনসান, জনমানবশূন্য। বেলাকোবা এখান থেকে ৪ কিলোমিটার। সাইকেলে করে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যাচ্ছে মেয়েরা। দু'চারটে পথকুকুর। আমরা গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক বা জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে নয়, এবারে যাচ্ছি শিলিগুড়ি হয়ে মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি হয়ে সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। অবশ্য "ধোতরে" আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিলো। পৌঁছোই আগে। মন্থনী এলাম। এখান থেকে শিলিগুড়ি ৩৪ কিলোমিটার দূর। মন্থনীতে করলা নদীর ওপর করলা সেতু। ভাবা যায়!!! একটা নদীকে আমরা কতোবার পার হই ? মন্থনীকে মন্থন করে চলেছি। এলো বটতলা। পথের পার্শ্বে গোবিন্দ হোটেল। ভোরের আলো হোটেল, প্রিয়া হোটেল। ল্যান্ডমার্ক।প্রত্যেকটি হোটেলের আগে বাম্প, পরে বাম্প। ডানপাশে মাহিন্দ্রা শো রুম। বাঁ দিকে পেট্রোলপাম্প। পরপর অনেকগুলি মিষ্টির দোকান। এখানে ছয় কিলোমিটারের মধ্যে দশটা বাম্প, এগারো নম্বর বাম্পটাও দেখা যাচ্ছে। ৪০-৫০ মিটার পরপর বাম্প, রাস্তাটা এতো সুন্দর, অথচ এতো বাম্প অসহ্য লাগছে।গাড়িতে যেতে যেতে বাম্প গুনছি, ঠিক যেন সমুদ্রের পাড়ে বসে ঢেউ গোনা। সকাল ৭:২০টা, এলো তালমা ব্রীজ। কিছু মানুষ প্রচুর গোরু তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সব বাংলাদেশে যাবে। ওদিকে গিয়ে মাংসে পরিণত হবে, এদিকে আসবে অস্থি ও চর্ম। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ থেকে কখনো ট্রাকে, কখনো হাঁটিয়ে আবার ট্রাকে করে বিভিন্ন গোহাটা পেরিয়ে এখানে। এখান থেকে এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবে ময়নাগুড়ি। সেখান থেকে সবশেষে মেখলিগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশ বর্ডার। গরুগুলোর জন্য কষ্ট হলো।এলো কদমতলা মোড়। এখান থেকে শিলিগুড়ি ২৯ কিমি, আমবাড়ি ১০ কিমি,
বাম্প গুনতে গুনতে কখন বেলাকোবা পেরিয়ে এসেছি খেয়ালই করিনি, ১৬নং বাম্প পেরিয়ে এলাম, বটতলা পেরিয়ে শিকারপুর, যা শিকারপুর বৈকুন্ঠপুর (অধুনা জলপাইগুড়ি)রাজ এস্টেটের ছিলো। যেখানে ছিলো ভবানী পাঠকের মন্দির। 


জলপাইগুড়ির রাজা দর্পদেব রায়কতের সময় জলপাইগুড়ি রাজ এস্টেট ছিলো রঙপুর জেলার অধীনে। সেই সময়ে রঙপুরের আর একটি স্টেট ছিলো মন্থনা। মন্থনার রানী ছিলেন জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী। তাঁর স্বামীর নাম ছিলো শিবচন্দ্র। ইংরেজ শাসনের আদিপর্বে রাজা দর্পদেব রায়কত ও দেবী চৌধুরানী একযোগে ইংরেজ অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় এঁরা ধনীদের ধনদৌলত লুন্ঠন করে প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সেই কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের "দেবী চৌধুরাণী"-উপন্যাসে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় দেবী চৌধুরাণী ও দর্পদেব রায়কতকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন ভবানী পাঠক, ফকির বিদ্রোহের মজনু সাহা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তাঁরা সকলে মিলে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করতে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণী বৈকুন্ঠপুরের দিল্লী ভিটা, চাঁদের খাল ও শিকারপুর চা বাগানের জঙ্গলে ঘাঁটি তৈরী করেন। তারই স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে শিকারপুর চা-বাগানের মধ্যে থাকা এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি। এই মন্দির সম্ভবতঃ রাজা দর্পদেব রায়কতের সহযোগিতায় তৈরী হয়েছিলো। মিঃ রেমন্ড হেলাইচ পাইন নামে একজন ইংরেজ স্থপতি মন্দিরটি নির্মান করেন। 1871 সালে এই মন্দিরটি পুনরায় সংস্কার করা হয়। এই মন্দিরটি কাঠের তৈরী। অনেকটা জাপানের প্যাগোডা ধাঁচের নির্মানশৈলী। মা-এর মূর্তিও কাঠের ছিলো। একজন ওঁরাও সম্প্রদায়ের কেয়ারটেকার ও একজন রাজবংশী সম্প্রদায়ের পুরোহিত আছেন। ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে সম্ভবতঃ প্রদীপের আগুনেই ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিলো সেই মন্দির।নতুন করে মন্দির তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমানে মাটির মূর্তিতে মা পূজিতা। কালী মূর্তি ছাড়াও তিস্তাবুড়ি, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, গঙ্গা দেবী ও সিদ্ধপুরুষ মোহনলালের মূর্তি আছে এখানে। মন্দির প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় খোলে, বন্ধ হয় বিকেল পাঁচটায়। কালীপুজো হয় আষাঢ় ও কার্তিক অমাবস্যায়। ধর্মীয় সার্কিটের সাথে যুক্ত করে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে স্থান দেওয়া হবে এ মন্দিরকে। এমনটাই প্রশাসনিক মহলের সিদ্ধান্ত।


শিকারপুর চা বাগান এখন কল্যাণীগ্রুপের। ঝন্টু বললো, "জয়পুর, রায়পুর আগে এস.পি রায়ের ছিলো। এখন সবই কল্যাণীগ্রুপের।" শিকারপুর চা বাগানের পর দুইদিক বাঁশঝাড়, কলা ও অন্যান্য সবুজ গাছপালায় ভরা। বিস্তীর্ণ অনাবাদি জমি। বসতি নেই তেমন। বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গায় একটাই স্টেশনারী দোকান। দোকানটিকে সুরক্ষিত করার জন্য দু'দিকে দুটো বাম্প। এ হলো ২০নং বাম্প। এখান থেকে আমবাড়ি ৬ কিলোমিটার। বোদাগঞ্জ থেকে বাঁদিকে যে রাস্তাটা গেলো সেটা একেবারে শিকারপুর চা বাগানের মধ্য দিয়ে গিয়ে ভবানী পাঠকের মন্দিরে গিয়ে উঠেছে। বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো এই মন্দির দেখবো, সে সুযোগ আর কোনো দিনও হলো না।ছাড়িয়ে যাচ্ছি বাগডোগরার ধুমডাঙি, করলার ব্রীজ, কিষাণকল্যাণীর চা বাগান, দূরে কুয়াশাজাল ভেদ করে চা বাগানের ফ্যাক্টরীও দেখা যাচ্ছে। চোখের পক্ষে তৃপ্তিদায়ক সবুজ চা গাছ, সোনালী ধান, কালো ননিয়া, এখনো তো ধান কাটা হয়নি এখানে। এখনো অনেক জমিতে ধান রয়ে গেছে। রাস্তা থেকে অনেকটাই নীচু ধানীজমি, ধানগাছের দৈর্ঘ্য প্রায় হাত দেড়েক হবে। সোনালী রঙ পরিবর্তিত হয়ে 'মরচে' রঙ ধারণ করেছে। একজন নেমে ধানের ছড়া নিয়ে আমার হাতে দিলো। শীষ স্বল্প দৈর্ঘ্যের ও স্থুল। বঙ্গবন্ধু ধান। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ধান। মনে পড়ে গেলো লৌকিক উৎসব "নবান্ন"-এর কথা। বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমির ওপর দিল্লী ওয়ার্ল্ড পাবলিক স্কুল। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভীষণ সুন্দর দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গটি জনো, কাবরু, পান্দিম্, নরসিম্ ও সিনিওলচু -এই পাঁচটি খাঁজ পরিবৃত।কাঞ্চনজঙ্ঘা, কুয়াশাচ্ছন্ন চা বাগান, দেবদারুবন সমাচ্ছন্ন উপত্যকা রচনা করেছে বর্ণাঢ্য অধিবাসীদের বৈচিত্র্যময় শৈলাবাস দার্জিলিঙের পশ্চাদপট। দার্জিলিঙ শহরের পশ্চিমে নেপাল সীমান্ত বরাবর উঠেছে রডোডেনড্রন বনে ঘেরা সুউচ্চ তুষারাচ্ছন্ন পর্বতমালা সিংগালিলা। গ্রীষ্মের প্রথমদিকে (এপ্রিল, মে মাসে)এই ফুলের বনে নামে গাঢ় লাল, ফিকে লাল, কোথাও কোথাও বা বেগুনী রঙের বন্যা। দিল্লী ওয়ার্ল্ড পাবলিক স্কুলের মাথায় বিশাল গ্লোব। আমবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছি, এখানেই ভূগোলমঞ্চের চামেশ্বরদার বাড়ি।আমবাড়ির তিন কিলোমিটার আগে রেলগেট বন্ধ। সেই মালগাড়িটাই। আমরা চলে এলাম। সে এখনো এখানে এসে পৌঁছতে পারে নি।অসাড় কান্নার মতো বৃষ্টি।বসে আছি চুপটি করে। মেঘলা আকাশ, রিপোর্টার গাড়ির কাঁচ খুলতে পারছে না। ওর শরীর খুব খারাপ লাগছে। তিনদিন পরপর ভোরে উঠেছি আমরা। সকাল সকাল সমস্ত রান্না সম্পূর্ণ করতে হয়েছে। রাত ১২টায় ঘুমোতে যাওয়া আর ভোর চারটেতে ওঠা। এ তো সহ্য না হওয়ারই কথা। শরীর নিতে পারে না। করতোয়া ব্রীজ পার হলাম, কে.ই. কারমেল স্কুল পার হলাম। সাহু নদীর অ্যাকোয়া ডাক্ট - উপর দিয়ে তিস্তা ক্যানেলের জল, নীচ দিয়ে সাহু নদী। সাহুডাঙি ছাড়িয়ে এসেছি। ইতিমধ্যে ঊনত্রিশটি বাম্প পেরিয়েছি। গন্ডার মোড়ের দিকে যাচ্ছি। দিল্লী পাবলিক স্কুল, এখানে প্রবীরের মেয়ে পড়ে। ডানদিক দিয়ে তিস্তা ক্যানেলের পাশ দিয়ে চলতে চলতে জোড়াপানি অ্যাকোয়া ডাক্ট পেরোলাম অর্থাৎ এখানে ওপর দিয়ে তিস্তা ক্যানেলের জল, নীচ দিয়ে জোড়াপানি নদী প্রবাহিত। ফুলবাড়ি পৌঁছোলাম। এখানেই প্রবীরের স্কুল। ফুলবাড়ি ক্রশ করে শিলিগুড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছি ক্রমশঃ। আমাদের জার্ণির এক ঘন্টা সময় অতিবাহিত হলো। হারানোকে ফিরে পাওয়ার মধ্যে আনন্দ আমার সবসময়। যখনই ভ্রমণে যাই বিশেষতঃ পাহাড়ী পথ ধরে তখনই যেন ফিরে পাই আমার শৈশবকে।পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে যেন ছড়িয়ে আছে টুকরো টুকরো হারানো শৈশব আমার। তখনকার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ অনেকটা পাগলামির পর্যায়ে চলে যায়। আশেপাশের কেউ কিন্তু বিরক্ত হয় না, বরং উপভোগ করে সবাই মিলে। পাহাড়ের অখ্যাত কোন স্থানের গাছপালা জনজীবন অরণ্য কীরকম সে সবও চোখ মেলে দেখতে দেখতে যাই, যেন কিচ্ছুটি বাদ না পড়ে। ভারী রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় সেসব দেখলে।


বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তা ভিজে গেছে। ধুলোমরা বৃষ্টি। মেঘ কেটে গেলেই জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়বে। শিলিগুড়ির ট্র্যাফিক জ্যাম এড়ানোর জন্য নৌকাঘাটের পরে একটা বাইপাসে শর্টকার্ট রাস্তা ধরে মাটিগাড়া-খাপরাইল মোড়ে উঠে মিরিকের উদ্দেশ্যে যাবো। সকাল সোওয়া আটটা। রোদ উঠলো প্রথমবার। দেখি, পাহাড়ের ওয়েদার কি বলে!!!
খাপরাইল মোড় দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমেই মোদী পাবলিক স্কুল। এখানে সানির বাবার বন্ধু প্রিন্সিপ্যাল। গাড়ির চাকায় হাওয়া ভরা হলো। মিরিকে রোদ, মেঘের লুকোচুরি। তাপমাত্রা ১৯ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। খাপরাইলের পর ফ্যালকন টিউবস্ প্রাইভেট লিমিটেড; তারপাশে গাছ ভরা পাউডার পাফ, বেগুনী রঙের বোগেনভেলিয়া ... আর্মি ক্যাম্প, এখান থেকে ৬কিলোমিটার গেলেই গাড়িধুরায় পৌঁছবো। এই নির্জন বেলায় আর্মি ক্যাম্পের আবাসনের মাথায় জলের ট্যাঙ্কের পাশে বসে বানরেরা নিশ্চিন্তে পর্যাপ্ত রোদে গা গরম করছে। প্রতিটি আবাসনের মাথায় সোলার প্যানেল লাগানো।লাইট জ্বলবে, জল গরম হবে, সব সোলার প্যানেলে। লেখা আছে -"কর্ম হি ধর্ম"।এলো সুসজ্জিত ছোট আদালপুর। এর বাঁদিকে শিমুলবাড়ী টি এস্টেট, এরপর ত্রিহানা টি এস্টেট, গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আমাদের ওয়েলকাম জানাচ্ছে। এখান থেকেই পাহাড় শুরু। চলছে ডানদিকে রহিমপুর টি এস্টেট, বাঁদিকে শিমূলবাড়ি টি এস্টেট। জিটিএ-এর কোভিড-১৯ স্ক্রীনিং টানেলের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি পার হলো।
পাহাড়ে এলে এই স্ক্রীনিং টানেলের মধ্য দিয়ে স্ক্রীনিং করেই উঠতে হয়। ডানদিকে কার্সিয়াং, রোহিনী যাওয়ার রাস্তা। যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, দূরে কার্সিয়াং পাহাড়। ত্রিশক্তি আর্মি ক্যাম্প, তার স্বাস্থ্যকেন্দ্র ত্রিশক্তি হিলার্স। বাঁদিকে রাস্তার পাশে বুনো সূর্যমুখীর ঝোপ, ল্যান্টানা ক্যামারা। শুখা মরসুমে নাম না জানা জলহীন ঝোড়া পার হলাম। এলো শুকনা ফরেস্ট, এলিফ্যান্ট জোন। শুরু হলো বাঁকবহুল সঙ্কীর্ণ কিন্তু ভালো পাহাড়ি রাস্তা। নাম না জানা নদী, শার্প টার্ণিং, পরবর্তীতে বাইক নিয়ে এ পথে আসার পরিকল্পনা চলছে। হয়, হয়। এরকম অনেক পরিকল্পনা হয়, গন্তব্যস্থলে পৌঁছে সেখানকার আকাশ বাতাস প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে বলি, "আবার আসবো"। হলদে ফুলে ছেয়ে থাকা রাধাচূড়ার গাছ, পেল্টোফেরাম টেরোকার্পাম, শুকনা চা বাগান, ইঁটভাঁটা ছাড়িয়ে এলাম গাড়িধুরায়। এখানে আছে টোটেলাগাছ, বট।দার্জিলিং অরগ্যানিক টি-এর হোর্ডিং দেখে চা-খেতে ইচ্ছে হলো খুব। ফ্লাস্কে দুধ চিনি ছাড়া চা ছিলো। কিন্তু গাড়ি থামানোর কথা বলতে পারলাম না। ছোট্ট একটি বাজার, কিছু লোকজন, কারো মুখে মাস্ক নেই, যেই ভাবলাম এই কথা, অমনি নাকের নীচ বরাবর মাস্ক পরিহিত একজন নজরে এলো। শুরু হলো মিরিক ব্লক। এখান থেকে মিরিক ২৯কিলোমিটার দূর। এটাও পি.ডব্লিউ.ডি মেইনটেন্ড রাস্তা। রিপোর্টার জল চাচ্ছে। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তল্লি শিরীষ গাছ, বিউটিফিকেশনের জন্য কিছু বিদেশী গাছ, চালৌনি, লাইকেন- এখানকার স্বাভাবিক উদ্ভিদরাজ্য গড়ে তুলেছে। প্রতিটি বৃহৎ প্রাচীন গাছের কান্ডে ভর্তি লাইকেন। সবই ক্রাস্টোজ লাইকেন। লাইকেন একমাত্র দূষণমুক্ত অঞ্চলেই জন্মায়। বসন্ত নয় আসতেই রঙীন ফুলবাহার। হলুদ রঙ এনেছে রাধাচূড়া, অ্যাজারেটাম নীল, সেগুনের গুচ্ছাকার ফুল, ধুন্দল, ডুমুর, আর বাঁদিকে সবুজ গালিচা বিছানো চা বাগান। কোথায় ফরেস্ট শুরু, কোথায় শেষ, মাঝে ঢুকে আছে চা বাগান। এলাম দুধিয়ায়, পিকনিক স্পট। দুধিয়া বাজার, আর্মি ক্যাম্প, বালুর আসন পাতা বালাসন নদী, তার ওপর সরু লোহার ভিআইপি ব্রীজ যা আর্মি চলাচলের জন্যই প্রধানতঃ নির্মিত। এখানেও শীত মরসুমী ফুলের সমারোহ। টেকোমার ঝাড় হলুদে হলুদ, পাটকেলি রঙ মুসান্ডা, সাদা ফুলেল কুটরাজ, লাল লঙ্কাজবা, ঘন্টাফুল, গোলাপী কল্কে, সাদা বোগেনভেলিয়া, লালপাতা পালচেরিমা, কলাবতী, সন্ধ্যামালতী (পাহাড়ে সকালেই ফুটেছে সন্ধ্যামালতী) তার সাথে মিলেছে বেলগাছ ,আকন্দ ,ফুলহীন,গুলমোহর, কৃষ্ণচূড়া, ঘোড়ানিম, নিশিন্দা, পিটুলি, ঝাউ, আতা, শিমূল, সজনে, কাঁঠাল, সুপারী, নারকেল, দেবদারু, জাট্রোপা, গ্রীনহাউস, হলুদ, বেগুনী, সবুজ রঙবেরঙের বাড়ি, রঙবেরঙের গরম পোশাক পরিহিত মানুষ, পত্পত্ করে উড়ছে বজরঙবলীর পতাকা। দু'পাশে দু'টো পাহাড়শ্রেনী, মাঝে উপত্যকা, দুধিয়া ব্রীজ, যেখানে আগে দোলনা ব্রীজ ছিলো। ঝন্টু বললো, "এই সেই ব্রীজ যেখানে অনুসন্ধানের শুটিং হয়েছিলো। "সরু পাহাড়ি পথ, দু'ধারে অজস্র ফুটে থাকা নীল জাতি। মিরিক এখনো ২২ কিলোমিটার দূরে। পাঁচ ছয়টি বানর পরিবার, গুনলাম তেরো, চোদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো- এরা সব শীতের নরম রোদ পোহাচ্ছে, খেলছে, উঁকুন বেছে দিচ্ছে একে অপরের, বেবী বানর ঘুম চোখে মায়ের আদর খাচ্ছে। ক্রমশঃ উঠছি উপরে, ১২নং রাজ্য সড়ক ধরে। জিগজ্যাক বাঁক, শার্প বেন্ট, পথের দু'ধারে নীলজাতি, ঝাড়ুগাছ, কুল, পাহাড়ি বাঁশ(গৈরিবাস), খাদের ধারে গার্ড করা ছোট ছোট সিমেন্টের স্তম্ভের ওপর আবারও দেখা মিললো আরো অনেক বানর পরিবারের, এরপর এ পথে এলে এদের জন্য খাবার নিয়ে আসবো। খাদের পাশ দিয়ে ঘন ঘন বাঁক নিয়ে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে উঠছে আমাদের গাড়ি,সাথে আগে পিছে সুমো, বোলেরো, সাভারি, অল্টো, সুইফ্ট, অল্ট্রোজ এরকম আরও অনেক গাড়ি চলেছে পর্যটকদের নিয়ে। মিরিক এখনো ১৮ কিমি দূরে। ধ্বসপ্রবণ এলাকা বলে পাহাড়গুলি এখানে বাঁধানো। এবারে কালচে ধরণের বানরের দলের দেখা মিললো। "তোদে"র রাস্তার ডানদিকের পাহাড়টা যেমন ভুটান পাহাড়, তেমনই এ জায়গার ডানদিকে দার্জিলিং কার্সিয়াং পাহাড়। এক কিমি এগিয়ে দেখি সূর্যমুখী ফুলগুলি সূর্যের স্পর্শ পেতে খাদের দিকেই ফুটে আছে। রাস্তায় ধ্বস সরানো ও সারানোর কাজ চলছে। বাঁক ঘুরতেই সূর্য কখনো সামনে কখনো বা পেছনে চলে যাচ্ছে। পিচ রাস্তা তৈরী হচ্ছে। রাস্তায় ইয়ামাহার নতুন মডেল দেখে আর একজন তো খুব খুশী। জলহীন পাহাড়ি প্রপাত, মুহুর্মুহু ধ্বস চোখে পড়ছে। বুনু কিছুই দেখছে না, সে দেদার ঘুমাচ্ছে। সে অবশ্য বলেছিলো, সমতলে সে ঘুমিয়েই যাবে। যাতে পাহাড়ে ওঠার সময় সুস্থ থেকে সব দৃশ্য নয়ন ভরে দেখতে পারে। পাহাড় এলো, তবুও সে ঘুমিয়েই আছে। এবারে দেখছি দু'দিকেই খাদ, হিমবন্ত ছায়াচ্ছন্ন এ এক অদ্ভুত জায়গা। লাভার পথেও রাস্তার দু'দিকেই এরকম শূন্যতার গভীরতা মাপা খাদ দেখেছি, দেখেছি এরকমই নীলচে বেগুনী রঙের ফ্যাবাসীর ফুল, লাল রঙের নাম না জানা ফুল, যারা পথচারীর মনকে কানায় কানায় পূর্ণতা দিতে পারে। পথের পাশে কমলালেবু বিক্রী হতে দেখে করোনাকে তুড়ি মেরে ওটাই কেনার ইচ্ছে প্রকাশ, মাথা নীচু দোকানঘরে টাটকা সব্জী, মূলো, রাইশাক, ঝুরি নামিয়ে রাস্তার এপার ওপার বিস্তৃত বিশাল বটগাছ, ঝাউ, লালপাতা, লঙ্কাজবা, ক্রিপ্টোমেরিয়া, বাঁশঝাড় ও ডানদিকে পাহাড়ের ঢালে চা গাছ- সব মিলিয়ে প্রকৃতি এখানে দারুণ ছবির মতো সুন্দর। শিংগো ট্রাভেল্স রিম্বিক থেকে শিলিগুড়ি অভিমুখে ছুটে চলেছে। এদের ফোন করেই পথের অবস্থা জেনে নিয়েছিলাম। আম, জাম, সফেদা, ঝাড়ুগাছ, কেয়া, বুনো সূর্যমুখী (যার ডিস্ক ফ্লোরেট হলুদ), রঙ বদলে যাওয়া ল্যান্টানা ক্যামারার ঝোপ, ঝিঁঝির ঘন্টাধ্বনি পিছনে ফেলে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। পৌঁছলাম সিংবুলি। গাড়ি নীচে পার্ক করে সেখান থেকে সাই টেম্পল এই এক কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে উপরে উঠলাম। এখানে যাঁর কাছে আসা তাঁর বাড়ির চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে বেড়ে উঠেছে সব ভেষজ উদ্ভিদ। স্থানীয় ভাষায় সেগুলোর নাম ইলামঝাড়, পাখানবেড, চিংপিং, চিপলে, বনমারা, বুরিওখাতি, থারোওনিউ এমন অনেক.. দেখলাম,দূর দূরান্ত থেকে বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার চিকিৎসার জন্য এই কবিরাজী সদনে এসেছে।


সিংবুলি থেকে দেখা যাচ্ছে সুভাষ ঘিসিং এর জন্মস্থান মঞ্জুপাহাড়। পুরো উত্তর সীমানা জুড়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত পরপর পাহাড়গুলি হলো মঞ্জু, টিংলিং, সৌরেনী ও মিরিক। দেখলাম, মিরিক পাহাড় তখনও মেঘে ঢাকা। সিংবুলি টি এস্টেট, ডানকান্স মেমোরিয়াল প্রাইমারী স্কুল, নানা রঙের ঘরবাড়ি। স্কুল চত্বর প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশের মতো খোলা মাঠে। স্কুলের বাঁদিকে খাদ থেকে উঠে আসা সুন্দর বাড়ি, মাথায় টাটা স্কাই লাগানো, অ্যাসবেস্টসের চাল, আকাশী নীল কাঠের ঘর, কাঁচের জানালা। দরজা জানালায় রেশমী কাপড়ের পর্দা ঝুলছে, পর্দার নীচে কুচি দেওয়া ঝালর লাগানো। ছোট্ট শিল্পকর্ম, কিন্তু কতো যত্নে রাখা, ফুল দিয়ে সাজানো স্বপ্নের বাড়ি। ফুল এখানে বিরহ নয়, প্রেম ছড়ায়, তাই তো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। মাটির সরসতা নয়, সরলতাই এতো ফুল ফোটাতে পারে। পাহাড়ে পালচেরিমায় রঙ লেগে যায় অনেক আগেই। পাতাগুলো হয়ে যায় টকটকে লাল। ভোলা আর তারাগাঁদার কত রকম হলুদ, কাঁচা হলুদ, কুসুম হলুদ ... ক্রোটোন, বাহারি পাতাই বা কত রকম। ধাপ কেটে কেটে নীচে নামার পথ বাঁধানো। বালি মাটি, মাচা করে সব্জী ফলানোর ব্যবস্থা। ছোট্ট ঘরটি তালা বন্ধ। কার্ণিশে বসা নাম না জানা কোন ছটফটে পাখি, বাড়ির মালিক হয় তো কাজে বেরিয়েছেন, নয় তো এ ঘরগুলি সিজন টাইমে অর্থাৎ এপ্রিল মে মাসে পর্যটন ব্যবসার কাজে ব্যবহার হয়।আশেপাশে ল্যান্টানা ক্যামারার ঝোপগুলো কেউ কাটে নি। সুন্দর বনফুল ভেবে সুন্দর বেড়া দিয়ে বেঁধে রেখেছে তাদের। রঙ বেরঙের ফুল ফোটায় যে, সেগুলির বড় যত্ন। স্কুলের ডানদিকে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে খাদে, সেখানে আকাশী রঙের কাঠের দেওয়াল, সাদা জাফরি লাগানো লাল চাল, ঠিক যেন ড্রয়িং খাতায় প্যাস্টেলে আঁকা ছবির মতো একটি বাড়ি। সাদা জাফরির কিছু অংশ বাতাসের তোড়ে ভেঙে গেছে। সে বাড়িও জনশূন্য। এখানে প্রত্যেক বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, শোঁ শোঁ বাতাস বয়ে যাচ্ছে। চুল উড়ে আসছে চোখে মুখে।ছবি তুলতে গিয়ে সূর্যের আলোর নাগাল পেতে খাদের কিনারে চলে এলাম। না হোক ভালো ছবি, যা দেখলাম এ দু'চোখে এ আলোতেই, যে টুকু সঞ্চয় তাতে জীবন চলে যাবে।এখানে নেই কোন নাগরিক ক্লান্তি, নেই কোন ব্যস্ততা, শীতের কুয়াশা ভেঙে ভোরের আলো ফুটতেই তো কতো সময় চলে যায়। ধীরে ধীরে ডানা মেলে সকালের আলো।তাই তো দিনের বয়স বাড়ে খুব ধীরে। এ প্রকৃতির মাঝে অফুরন্ত খুশীর হাওয়া, বয়স কমে যায়, উড়ন্ত ঘুড়ির দিন, মন ভালো করা নির্জনতার স্পর্শ। আকাশে বাতাসে শুনি মুক্তির ডাক। দূরে দূরে অনেকগুলি দোতলা ছাদযুক্ত লাল কমলা সাদা সবুজ হলুদ নানারঙের পাকা বাড়ি, বৃষ্টিবহুল এলাকা বলে ছাদের ওপর টিনের বা অ্যাসবেস্টসের ঢালু চাল, ঐসব বাড়িগুলির রঙের আড়ালে কতো না ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন, ধূসর স্মৃতি, সুখ দুঃখের গল্প গান জমে আছে। অলিন্দে ঝুলানো সদ্য ফোটা ফুলের হাসিতে বেদনাও চূর্ণ।ঘোরলাগা চোখে শুধুই চেয়ে থাকা। - এ সব দেখে মনে হলো শীতার্ত বাতাস, উন্মুক্ত নীল আকাশ, জীবনের সব যন্ত্রণাকে জাদুকাঠির স্পর্শে কেমন এক নিমেষে বদলে দিতে পারে। এ পাহাড়ের বুকে আকাশকুচি আলোয়ান, পিঠে রোদ্দুর ডানা, রাতভর ভেজে শিশিরে। দূরে মঞ্জু পাহাড়ের বিপরীতে যে ঢালু পথ বেয়ে নীচে নেমে এসেছি সে ঢালে চাএর বাগান। গাঢ় কালচে মন্ত্রমুগ্ধ সবুজ রঙ লেগে আছে চাএর পাতায়। এখানে কোন শেড ট্রীর প্রয়োজন হয় না। যে স্কুল চত্বরে দাঁড়িয়ে আছি, সে জায়গা বিস্তীর্ণ সমতল ধরে নিলে পাহাড়ের একটি ধাপ উঠে গেছে ডানদিকে, আর একটি ধাপ উঠে গেছে বাঁদিকে। একটা ধাপ চলে গেছে নীচে। দূরে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার কুন্ডলী, শ্রীজাতর কবিতা আসছে মনে ... "দূরের গ্রামে উনুন নেভায় ?/ ও কিছু না।/ পাগল হাওয়া।/এই এতোদিন বন্দী ছিলো।" দূর পাহাড়ে বিশাল উচ্চতায় ছুটে চলা গাড়িগুলিকে মনে হচ্ছে যেন খেলনা গাড়ি। আমরা ধোতরে যাবো, ঐ উচ্চতায় ঐ পথেই। পাহাড় ঘেরা শিংবুলির এই স্কুলচত্বরে আমি ও বুনু দীর্ঘক্ষণ ছিলাম। অদূরে গাড়িতে চালক, আর দু'জন গেছে ভেরিফিকেশনের কাজে। কি করে সময় কাটাই, একবারও এ কথা মনে হয় নি। তখন আমি আপন মনে প্রকৃতির সাথে যে একাত্ম। এদিক ওদিক ঘুরছি আপন মনে। মনে হয় মেঘেদের সাথে অচেনা এই আকাশে ভেসে ভেসে যাই।ছুঁয়ে যাই আরও উঁচু গিরিশৃঙ্গ। কিন্তু সাধ্য কি যে এভাবে তাকে ছুঁই? তুচ্ছতা তখন নিজের দিকে ধায়।কখনো মনে হয় ক্রিপ্টোমেরিয়ার ছায়া হয়ে লেপ্টে থাকি পাহাড়ের নির্জনে। এখানে দিন এতো নির্জন, রাত না জানি কি মায়াময়। পাতার আদিম পোশাক পরে জ্যোৎস্না ঘুমায় এ বনে। শিংবুলি থেকে মিরিক ১২ কিমি দূরে। আমাদের দলের দু'জন ওখানে এক ব্যক্তির খোঁজে তখন। ওরা এলে ওদের মুখ থেকে যা শুনলাম, তা হলো, ওখানে এক নামে দু'জন আছে। যাঁকে চাইছি তিনি একজন সরকারী কর্মী। শনিবার বলে অফিস বন্ধ। বাড়িতেই তাঁকে পাওয়া গেলো। বাড়ির পাশে পাহাড়ের পাথর কেটে সমতল জমি বের করে গ্যারেজ বানানোর জন্য ঐ শীতে পাথর কাটার কাজ করছিলেন। ভেষজ উদ্ভিদ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান। উনার কাছ থেকে জানলাম, জেরেনিয়াম ফুলের গন্ধে সাপ আসে না। এরপর উনি ওদের বাড়ি নিয়ে গেলেন। বাড়ির সামনেই মাচায় স্কোয়াশলতা থেকে ঝুলছে কচি স্কোয়াশ, বেড়া জড়িয়ে উঠেছে লাউডগা, ছোট ছোট ঘরে ছাগল, মুরগী, শূকর প্রতিপালিত হচ্ছে। উঠোনে মুরগীর ছোট ছোট বাচ্চাগুলিকে খাবার ও জলসহ তারজালির গন্ডীর মধ্যে রাখা, মা মুরগী তারজালির খোঁয়াড়ের বাইরে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের দিকে নজর রাখছে। ঘরের ব্যালকনি রঙ বেরঙের ফুলে সাজানো। একটি দুধ সাদা রঙের স্নোবলে চোখ আটকে গেলো। তার কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে ঐ স্কুল চত্বরে লাঞ্চ করার অনুমতি নেওয়া হলো। অনুমতি তো মিললোই, এমনকি উনি আমাদের জন্য খাবার গরম জল দিতে চাইলেন।আমাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার গরম জল আছে -এ কথা উনাকে সবিনয়ে জানানো হলো। বললেন, কোন অসুবিধা হলে আমরা যেন কোন রকম দ্বিধা না করে উনার বাড়িতে চলে আসি ও খাবার খাই। ঐ পাহাড়ি বন্ধুর ও শীতল পরিবেশে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ অভ্যর্থনা সত্যিই বিরল। আমরা স্কুল প্রাঙ্গনেই হটপটে রাখা লুচি, বোনলেস মাটনকষা ও বেলাকোবার চমচম দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। আমাদের খাবার জায়গাটা সত্যিই ভীষণ সুন্দর, নিরিবিলি ও নিরুপদ্রব। প্রকৃতির বুকে খাবার জন্য আগে কখনোই এমন সুন্দর পরিবেশ কোথাও পাইনি। লাঞ্চ সেরে আবার যাত্রা শুরু। ঘড়িতে তখন সময় দুপুর পৌনে একটা। সিংবুলির কাজ শেষ করে অনেকটাই চাপমুক্ত লাগছে।এখন গাড়িতে হাল্কা গান বাজছে - "কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই .."এখান থেকে ধোতরে ৫৮ কিলোমিটার। পাহাড়ি পথে এ বড়ো কম দূরত্ব নয়। ফুগুরি টি এস্টেট, সুসজ্জিত ফুগুরি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে এলাম। পথের দু'পাশে বসতি, রেসিডেন্স কাম শপ, এস.বি. আই এর শাখা, চালক এই স্থানের ভিডিও করতে বললো। মিরিক পর্যন্ত এলেও এরপর ধোতরের পথে সে প্রথম গাড়ি চালাচ্ছে। মেঘ কুয়াশাকে সাথে নিয়েই চলেছি। ১২:৪৮ এ এক ঝলক রোদের দেখা পেলাম।


ফুলেল উপত্যকা, ঝাড়ুগাছ, পাহাড়ের গা থেকে ঝুলে থাকা ওয়েলকাম ফার্ণ - দার্জিলিং চা বাগানের ভিউ বলতে যা বোঝায় সব এখানে থরে থরে সাজানো। ফুগুরি, সিংবুলি -কে এবার আমরা উপর থেকে দেখতে পাবো,অসংখ্য বাঁক, ক্রিপ্টোমেরিয়া জাপুনিকা -কতো ঝড়, জল, তুষারপাত, শৈত্যবাত্যা অগ্রাহ্য করে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো দন্ডায়মান, কতো অতীত ঘটনাবলীর সাক্ষী। হোর্ডিংএ "আই লাভ মিরিক" লেখা। সৌরেনী বায়ো অরগ্যানিক টি এস্টেট কে পিছনে ফেলে মেচি এস.এস.বি বর্ডার আউটপোস্ট ছুঁলাম। বুঝলাম, অনতিদূরেই মেচী নদী। এখনো মিরিক ৮ কিলোমিটার। জাহাজী কলার থোপ, সৌরেনী বাজার। রাস্তায় একটি টাট্টুঘোড়া আপন মনে ঘাস খাচ্ছে।গান বাজছে, "হারিয়ে যেতে যেতে/অজানা সংকেতে,/ছাড়িয়ে গেছি সেই পথ/কখনো মেঘে ঢাকা/কখনো আলো মাখা/ভুলেছি ভবিষ্যৎ ।।/হৃদয়ে কার যেন সন্ধানে/খুঁজেছে দুটি চোখে সবখানে।/সে চোখে যত আলো /যত আশা ভালোবাসা/খুলবে বন্ধ মনের এ জগৎ।।/অন্ধকারে তাকে যায় চেনা/শূণ্য হাতে সে আসবে না/ভাবি এ চলা কবে শেষ হবে/আলোয় ফেরা সে উৎসবে ।।/জীবনে যত কিছু 
দূর থেকে দেখে দেখে/পাইনি তো মূল্য দেবার মনোরথ ।।"গলা মেলালাম আমিও। আমরা তো অজানার উদ্দেশ্যেই চলেছি। সৌরেনী বাজারের কাছে একটি প্রাচীন বটগাছকে কেন্দ্র করে একটা সুদৃশ্য শিবমন্দির রয়েছে। পিঠে পাহাড়ের শঙ্কু আকৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ টুকরি নিয়ে কর্মফেরত সুসজ্জিত দুই মহিলা দাঁড়িয়ে গল্প করছে। বাড়িগুলি সব পালচেরিমা, চন্দ্রমল্লিকা, সালভিয়া দিয়ে সাজানো। এখানেও রাইশাক, স্কোয়াশ বিক্রী হচ্ছে। মিরিক এখনো ছয় কিলোমিটার। সৌরেনী থেকে মিরিক - প্রতিটি বাড়ি যেন এক একটি নার্সারি। এক একটি রিসোর্ট। লোকে যাকে পাইন বলে জানে আসলে সেগুলি পাইন নয়। এই সৌরেনী বাজার পার হয়ে এতক্ষণে একটা পাইন গাছ চোখে পড়লো। ডানদিকে পাহাড়ের বাঁকে শুঁড়িপথ বেয়ে চুপিসাড়ে একটি হাতিকে নামতে দেখেছি। গানগুলো কেমন করে যেন চলার পথে প্রকৃতির সাথে মিলে যাচ্ছে। এখন রূপঙ্করের গলায় "দূর থেকে আরও ঐ সুদূরে/এক অশান্ত অজানায়/পেছনে পড়ে থাকা ঐ দিনগুলো/এক অশান্ত অজানা/ছুঁয়ে যায় কোন সেদিনের স্মৃতি/এক অশান্ত অজানা/ফিরে যেতে চাই,ফিরে পেতে চাই/ এক অশান্ত অজানা/কি যে আমি তা জানি না ..."


তিনমাথার মোড়, ডানদিকে মিরিক লেক, বাজার, থানা... মেঘে ঢাকা কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে লেক ছুঁয়ে সুখিয়াপোখরির রাস্তা ধরলাম। বাঁদিকের পাহাড়ে বিশাল ধ্বস। মাটির রঙ গাঢ় পাটকেল। মেঘ নেমে আসা ক্রিপ্টোমেরিয়ার জঙ্গল। মিরিক ফায়ার স্টেশন, লেক থেক থেকে অতিরিক্ত জল বের করে দেবার জন্য যে ঝোড়া রয়েছে সেটাও পেরিয়ে এলাম। আমরা বাইপাস মোড় আলগাড়া দিয়ে চলেছি। রূপঙ্করের গলায় "মেঘ নেমে এলো তার জানালার কাছে/হাওয়া ডেকে নিলো তার আলগোছে মন/কি জানি তোমার মনে আছে কি না আছে,/মুখে যে বলেনি কিছু,আমি সেই জন।"
আমাদের গন্তব্য যে আরো দূর সেটাই যেন গানে গানে বলছে,"আজ দিনটা গেল বেশ ...."
               (ক্রমশঃ)







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪