গল্প

* ক্যামেলিন *

সু জা তা  দা স

বাস থেকে যখন নামলো অনামিকা  ইকোপার্কের সামনে তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, শেষ বিকেলের রোদটা একটু জ্বালা ধরাচ্ছে শরীরে। যদিও এটা আশ্বিনের শেষ আর কার্তিকের শুরু তবুও রোদের আঁচটা গা পোড়াচ্ছে। ছাতাটা বার করে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে নিল হাতটা কপালের উপরে রেখে, তারপর ছাতাটা খুলে নিলো অনামিকা। আরও অনেকটা পথ যেতে হবে মনে মনে ভেবে তাড়াতাড়ি পা চালালো সে। নিজের জীবন নিয়ে সে একটুও আফসোস করেনা কারন সে সময়কে মানতে জানে। একসময়ের বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে ছিল সে। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল কমলেশ চৌধুরীকে।  ছন্দপতন ঘটেছিল সেই সময় থেকেই জীবনে, মেনে নেয়নি বাড়ির কেউ কোনোদিনই আর অনামিকাকে। তবে মেনে নিয়েছিল কমলেশের নিম্নবিত্ত পরিবার। একটা মিষ্টি হাসি সবসময় তার মুখে লেগে থাকতো শত কষ্টেও।
কখনও ভুল করেও তার ব্যবহার আর ব্যক্তিত্বে ফুটে ওঠেনি ফেলে আসা দিন।
সকলের মনমতো নিজেকে তৈরী করেছিল যাতে কমলেশের পরিবার দুঃখ না পায়। তারপর একদিন কোল জুড়ে এলো অমু (অমলেশ চৌধুরী)। পরিবারে আনন্দের বান ডাকলো। কমলেশের নতুন চাকরি হলো বিদেশে।
খুব কেঁদেছিল অনামিকা সেই সময় আড়ালে, একমাত্র এই লোকটির জন্য সে সব ছেড়ে চলে এসেছিল একদিন, কারন কমলেশ ছিল তার ভালোবাসা।
সেও ছেড়ে চলে যাচ্ছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার। কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বারে বারে! একটা হারানোর ভয় কুরে কুরে খেতে লাগলো অনামিকাকে। বারবারই যেন কেউ বলতে থাকলো আর ফিরবে না কমলেশ কোনও দিন।
কমলেশ জড়িয়ে ধরে বলতো, আরে আমি ছয় মাস বাদে বাদেই আসবো, তোমাদের সুখের আর ভালো থাকার জন্যই তো যাচ্ছি অনু, কম তো কষ্ট করলাম না- ছেলেটাকে তো ভালো করে মানুষ করতে হবে বলো, আমি কিছুদিন থেকেই চলে আসবো এখানে।
তুমি আমার শক্তি, তুমিই যদি ভেঙে পড় তাহলে আমি যাই কী করে-!

সবদিক গোছাতে গোছাতেই যাওয়ার দিন চলে এলো কমলেশের, নিজের শেষ সোনার টুকরোটাও তুলে দিল হাসিমুখে কমলেশের যাতে কোনও অসুবিধা না হয় প্রাথমিক ভাবে ওখানে গিয়ে।
কমলেশের মা বাবা আর সন্তানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো অনামিকা খুশি মনে। কারন তারা ছাড়া আর কেউ ছিলনা এই দুনিয়াতে।
কিন্তু কমলেশ চৌধুরী পাল্টে গেল ওখানকার স্বর্ণকেশী মিস এঞ্জেলিনার প্রেমে
পাগল হয়ে, ভুলে গেল কোলকাতার এক ভাড়া বাড়ির দুই কামরার ঘরে ফেলে এসেছে স্ত্রী পুত্র মা বাবাকে।
ভুলে গেল একদিন ভালোবেসেই অনামিকাকে বিয়ে করেছিল, ভুলে গেল তাকে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি।
এর নামই বোধহয় জীবন! ভাবলো মনে মনে  অনামিকা।

কমলেশ চলে যাবার পর কিছুদিন টাকা পাঠাতো প্রায় প্রতি মাসেই, বছর খানেক পর থেকেই শুরু হলো অনিয়মিত, চিঠিও আর ঠিক মতো আসতো না, একটা ভয় ভিতরটাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে থাকলো অনামিকার, ভাবত সে আবার কী সে ভুল করলো কমলেশকে বিদেশে পাঠিয়ে!
একদিন একটা চিঠি এলো বিদেশ থেকে কমলেশের, ডিভোর্স চাই অনামিকার থেকে। চিঠিটা হাতে নিয়ে একটু অবাক হলো অনামিকা, চোখের কোনটা ভিজে উঠলো এই কথাটা মনে করে যে এই লোকটির জন্যে সে মা বাবা সমাজ সংসার ভাই বোন পরিজন সব এক কথায় ত্যাগ করেছিল!!!
ভাবতেও অবাক লাগে আজ, এতো স্বার্থপর মানুষ হতে পারে!! নিজেকেই যেন জিজ্ঞাসা করলো মনে মনে অনামিকা।
সই করার মূহুর্তে শাশুড়ি মা বাধা দিলেন, বললেন, অনু সই করবি না তুই। তোর ছেলের দিব্বি দিলাম তোকে আমি।

তারপর কয়েক বছর হলো আর যোগাযোগ রাখেনি কমলেশ কোনও এ'দিকের সাথে। ততদিনে অনামিকা একটা বেসরকারী স্কুলে  চাকরি পেয়ে গেছে। খুব সচ্ছল না হলেও কিছুটা সামলে উঠেছে সে। কমলেশের বাবাও চলে গেছেন বছর দুয়েক হলো। খবর দেওয়া হয়েছিল কমলেশকে, কিন্তু অফিসের অজুহাত দেখিয়ে দেখতেই আসেনি। একা হাতেই সব সামলেছে অনামিকা, ছেলেকে একটা ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তিও করিয়েছে কারন সে মানুষ করবে একাই অমুকে।
অমুর জন্য সে চিন্তা করেনা সব তার ঠাকুরমা করেন, শুধু পড়াশুনাটাই সে দেখে।
খুব ন্যাওটা সে ঠাকুরমার, আর অনামিকাও তাতে নিশ্চিন্ত। মাঝে মাঝে কমলেশের মা অনামিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর নিজের মনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হয়তো ভাবেন তার থেকেও অভাগী আছে এই দুনিয়াতে।

অনেক বছর পেরিয়ে আজ অমু মানে অমলেশ চৌধুরী ডাঃ অমলেশ চৌধুরী হয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাকরিতে জয়েন করলো। সেই খুশির মুহুর্তে একটা চিঠি এলো বিদেশ থেকে অনামিকার কাছে, খুব অবাক হলো মনে মনে। কাউকে কিছু বলল না সে, কারন ঐ দিন বাড়িতে একটা খুশির আবহাওয়া ছিল। বাড়িতেই একটা গেট টুগেদার মতো হলো ছেলের বন্ধু ও তাদের বাবা মাকে নিয়ে। ঘরোয়া একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান, বাহুল্য ছিলোনা কোনো।

সবাই চলে যাবার পরে ঘরে এসে বসলো অনামিকা। সারাদিন কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে চিন্তা করেছে কে পাঠালো এই চিঠিটা!
মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছিল সে নানা চিন্তায় কারন চিটিটা অন্য ঠিকানা থেকে এসেছে!!
কয়েক যুগ পার হয়ে গেছে কমলেশ আর ফেরেনি কোনও যোগাযোগ ও করেনি। শাশুড়িমা যখন মারা গেলেন তখন তিনি অনামিকা কে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন উনার মুখে আগুন অনামিকাই দেবে,
তাই সে আর খবর দেয়নি কমলেশকে কোনও। কাজও সে করেছে ছেলেকে নিয়ে একা। আজ অনামিকা নিজের রুটিন থেকে সরে এলো চিঠিটা দেখার আগ্রহে।
রাতের বহু আকাঙ্ক্ষিত স্নান পর্বটিও আজ বন্ধ রইলো, যেটা তার বরাবরের অভ্যাস, বারোমাসের।

তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে আলমারি খুলে শাড়ির ভাঁজ থেকে দুপুরে আসা চিঠিটা বার করলো অনামিকা।
নামটা পড়লো সে, এটা কমলেশের পাঠানো নয়। একটু অবাক হলো, ভ্রূ যুগল কুঁচকে গেল আপনা হতেই।
খানিকক্ষণ খামটার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। তারপর আস্তে আস্তে খুলতে থাকলো চিঠিটা। হাতে এলো একটা বছর পনেরো ষোলো বয়সের মেয়ের ছবি, যার মুখের আদল কমলেশের কথা মনে করিয়ে দিল অনেক দিন বাদে। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে, টুকটুকে ফর্সা, এক গুচ্ছ সোনালি চুল, অনেকটা বার্বি ডল যেন।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলো সে ছবিটা তার পর চিঠির দিকে চোখ রাখলো অনামিকা। পুরোটাই ইংরেজিতে লেখা, যার সারাংশ- প্রথমেই সম্বোধন অনামিকা দিদি, আমি এঞ্জেলিনা লুইস চৌধুরী, হয়তো অবাক হবেন-
আমি অসহায় আজ, তাই আপনার কাছে আমার আর কমলেশের সন্তান ক্যামেলিন কে পাঠালাম। আপনি নিজের সন্তান মনে করে তাকে মানুষ করুন না হলে সেও হয়তো আমাদের মতো অসংযমী জীবনকেই বাছবে।
আজ কমলেশ নিজের কৃতকর্মের জন্য ভুগছে সাথে অংশীদার হিসেবে আমিও।
আমাদের ক্ষমা করে দেবেন দিদি, না হলে মরেও হয়তো শান্তি পাবো না দুজনেই।
আমাদের সময় অনেক কম দিদি, তাই তাড়াতাড়ি ওকে আপনি গ্রহণ করবেন এই আশা রাখি। নিচে একটা ঠিকানা দেওয়া রয়েছে,
এখানেই  ক্যামেলিন অবস্থান করছে, আপনি ওকে আপনার বিরাট হৃদয়ের মাঝে একটু জায়গা দিন।
                         এঞ্জেলিনা 

চিঠিটার পাঠানোর তারিখ দেখে একটু চমকালো, অনামিকা প্রায় দুই মাস আগে পাঠিয়েছে এই চিঠিটা।
তাহলে তো এসে গেছে সে কোলকাতায়!!!খোঁজ করলো না কেন তাদের, কমলেশ কী তার বাড়ির ঠিকানা দেয়নি তাকে?
সারারাত নানা চিন্তা করতে থাকলো সে কিছু অভিমান কিছু রাগ সব একসাথে জড়াতে থাকলো নিজের অজান্তেই। মাঝে আবছা ঘুমের মাঝে শাশুড়িমাকে দেখলো অনামিকা, বলছেন তুই পারবি জয় করতে হারাতে দিস না ওকে অনু।
মা বলে ডেকে উঠেছিল অনামিকা, যখন বুঝলো স্বপ্ন তখন মনে মনে বলল মা আমাকে শক্তি দিও যেন খুঁজে পাই ওকে।

খুব ভোরেই স্নান করে ছেলের সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ার মুহূর্তে অমু জিজ্ঞাসা করলো, মা তুমি বেরুচ্ছ?
হ্যারে অমু-
কেন কিছু বলবি?
না মানে কাল থেকে তুমি বারেবারেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছো, তাই ভাবছিলাম,
কিছু কী হয়ছে? বলল অমলেশ। 
সব বলবো অমু ফিরে এসে, আমি বেরুচ্ছি, চিন্তা করিস না, সাবধানে যাস কেমন? আর ঠাকুরমাকে নমস্কার করেই বেরোস। 
নিজেও বেরিয়ে পড়লো ক্যামেলিনকে খুঁজে বার করতে, অনেক দেরি হয়ে গেছে আর দেরি সে করবেনা। ফিরে এসে সব বলবে অমুকে, নিশ্চয়ই বুঝবে সব, এখন সে আর ছোটটি নেই, ডাক্তার হয়েছে-
নিউ টাউনে পৌছে একজনকে সে ঠিকানাটা দেখাল, সে হাত বাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল কী ভাবে যেতে হবে।

কোলকাতায় এমন গ্রাম আছে জানা ছিলনা তার, পাতাল রেলের ওভারব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে, তৈরি হয়েছে চৌরাস্তার মাথায় ফুডকোর্ট, তারপরও সেই জায়গায় একটু এগিয়ে এতো অনুন্নত জায়গা ভাবতেই পারছেনা। ইকোপার্কের সামনে থেকে এগারো নম্বর বাসে উঠলো সে ঠিকানায় পৌঁছাতে, একটু ভয়, নানা ভাবনা, সবার উপরে একটা অচেনা মেয়ে, সে কী ভাবে নেবে তাকে এই ভাবনাই পেয়ে বসলো তাকে। বাসের কনডাক্টরকে বলে রেখেছিল বাসে ওঠার সময়ই, ঠিকানা মতো নামিয়েও দিল সে।
এই দিকটা কখনও আসেনি অনামিকা, বাস থেকে নেমে একটা লোককেও দেখতে পেলনা সে রাস্তায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে থাকলো সে, হঠাৎ একটা বাড়ির ভেতর থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এলো, খানিকটা আশ্বস্ত হলো অনামিকা। এগিয়ে গেল সে ঐ মহিলার দিকে, ঠিকানাটা  বলল, একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে ঐ মহিলা।
অনামিকা তাড়াতাড়ি চিঠিটা বার করে দেখালো মহিলাকে, ফোটোটাও দেখালো সে মহিলাকে। এতোক্ষণে মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন কে হয় আপনার এই মেয়েটি?
অনামিকা মাথাটা একটু নিচু করলো প্রথমে, তারপর বললো, এখানেই বলবো?
একটু তাকিয়ে থেকে মহিলাটি বললেন আসুন আমার সাথে। ভিতরে এসে অবাক হল অনামিকা। বাইরেটা যেমন মাটির ঘর, ভিতরে পুরোটাই উল্টো। দামি আসবাব আর ওয়েল ডেকরেশন করা। অনামিকাকে বসিয়ে কোনও একজনের নাম ধরে ডাকলেন সেই মহিলা এবং তাকে কিছু বললেন, সে চলে যেতেই অনামিকার দিকে ঘুরে বললেন, এবার বলুন...।
অনামিকা প্রথমেই মহিলাকে তাদের বিয়ের সময়ের একটা ছবি দিলেন, তারপর সব বললেন কোনও কিছু বাদ না দিয়ে, এমনকি তার ছেলে যে অনেক বড় ডাক্তার সেটাও বললেন তাঁকে। ইতিমধ্যে একজন এসে অনামিকার জন্য মিষ্টি আর কিছু শুকনো খাবার রেখে গেছে, কিন্তু সে হাত দিয়েও দেখেনি কিছুতে। 
কথা শেষ করে তাকালো সে মহিলার দিকে, মুখে বলল একবার কী ওর সাথে কথা হতে পারে? কিন্তু আপনি এতো দেরি করলেন কেন আসতে? জিজ্ঞাসা মহিলার।
আমার কাছে কাল দুপুরের ডাকে এসেছে চিঠিটি বিশ্বাস করুন, আজ এতো বছর পরে কমলেশের উপরেই আর কোনও রাগ নেই আর ওতো আমার সন্তানসম।
এবার মহিলা একজনকে ডেকে বললেন, ক্যমেলিনকে 
আনার জন্য। যখন ক্যামেলিন ঘরে ঢুকলো, মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো অনামিকা, একদম কমলেশের মুখ কেটে বসানো, নীলচোখ সোনালি চুলে অদ্ভুত একটা মিষ্টি মেয়ে দেখলেই বুকে জড়াতে ইচ্ছে করে। একটু হালকা হেসে হাত বাড়িয়ে দিল অনামিকা ক্যমেলিনের দিকে, অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে মেয়েটি অনামিকার দিকে। আসার সময় মাম্মির দেওয়া ছবিটার মতো একদম দেখতে একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে মুখের সর্বত্র, ভাবলো মনে মনে ক্যামেলিন। কিন্তু সে দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বাবার বলা কথা গুলো হয়তো মেলাতে চেষ্টা করছিল। এবার ইংরেজিতেই বলল অনামিকা তাকে কাছে আসার জন্য। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো সে অনামিকার দিকে।
দুজনেই জড়িয়ে ধরলো দুজনকে। হঠাৎ ক্যামেলিন মা বলে ডেকে উঠলো অনামিকাকে। চমকে উঠলো অনামিকা, চোখের কোণ থেকে ঝরে পড়লো অনেক দিনের লুকানো চোখের জল। মুখে বলল, আমার আসতে দেরি হলো বলে অভিমান হয়েছিল তোর কমল? আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে অনামিকাকে। তারপর সমস্ত ফর্মালিটিস পুরণ করতে কিছু সময় লেগে গেল, সেসব করতে করতেই রাত দশটা বেজে গেল অনামিকার। ততক্ষণে ক্যামেলিন সব গুছিয়ে নিয়েছে কাগজপত্র, সব ঠিক করে গুছিয়ে নিল অনামিকাও। তারপর ক্যামেলিনকে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়িটির ভিতর থেকে।
আজ সে সত্যি ই জিতে গেছে, কারন জন্ম না দিয়েও সে আরেকটি সন্তানের মা হতে পেরেছে। উবারে বসে একটু মিষ্টি হাসলো ক্যামেলিনের দিকে তাকিয়ে। 
একবার ক্যামেলিনকে দেখে নিল, তারপর জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের কাছে পরম তৃপ্তিতে।




* বিজয়া *

সু জি ত মু খো পা ধ্যা য়

ঘটক বাড়ির বনেদি পুজো। কর্তার ঠাকুরদা আমলের। দুর্গা দালানে ফি- বছর মা আসেন। সেই আমলেই, দৌহিত্র বাঁড়ুজ্যে দের বাস শুরু।দেবোত্তর সম্পতি। বাঁটোয়ারা নিষ্পত্তি। গায়ে গায়ে বাড়ি। শরতের একই সোনা রোদ। আলসে ছুঁয়ে দু ছাদে এসে পড়ে। প্রাচীর ডিঙিয়ে শিউলি ছড়ায় দু উঠোনেই। 
মিঠে- কড়া সম্পর্ক। পুজোয় ভাঙা হাঁড়ি জুড়ে দুর্গা দালানে এক হয়ে যায়। পংক্তি ভোজন ষষ্ঠী থেকে লক্ষী পুজো।
এবার ও শরিক বাঁড়ুজ্যে বাড়ির পালা। চিরাচরিত নিয়মে মা আসে- যান। 
আজ বিজয়া। প্রথা মাফিক পুরোহিত , নাপিত আর ঢাকি বিদায় এর দায়িত্ব ঘটক বাড়ির। 
বিসর্জন সেরে লাল রোয়াকে দাঁড়ায় অজয় ঢাকি। হাতে অপরাজিতা লতাবাঁধা। 
উঠোনে এসে ই হাঁক পাড়ে অজয় ঢাকি--" মা আমার অন্নপূর্ণা কই গ্যালেন কো?

----"নেমে এসে বুড়ো ব্যাটার দন্তবত লিবেন নি?"
সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসেন গিন্নিমা ইন্দিরা। হাতে লাল পেড়ে শাড়ি, আলতা- সিঁদুর। 

বাদ্যকার বিদায়ী। 
অজয় হাঁ করে দেখে গিন্নি মা কে। এবছর অজয় ঢাকি র অন্নপূর্ণা সাদা থানে। কপাল জুড়ে সাদা চন্দনের টিপ। 
 গত কার্তিকে ঘটক কর্তা -- দেওয়াল জুড়ে ছবিতে মালা। 
গড় হয়ে প্রনাম সারে অজয়। মুখ না তুলে, দু হাত অঞ্জলি পাতে। নিরাভরণ দুধ আলতা হাতে শুধু দুটো সোনার চুড়ি---
গিন্নি মা, লাল পেড়ে শাড়ি, আলতা সিঁদুর তুলে দেয় ঢাকি বউ এর পাওনা আদায়ী।
চোখের জলে আবছা শুক্লা একাদশীর চাঁদ।
অজয় ঢাকি মাথা তুলতে ভুলে যায়। 
অন্নপূর্ণা নারকেল নাড়ু, মুড়কি মোয়া তুলে দিচ্ছে কাঁশা-বাজিয়ে অজয় এর নাতির থলেতে।
কচি চোখে ভরা বিস্ময়। দুটো বড়ো মানুষের কান্না সে বুঝতেই পারে না ।

চোখের জলে ঘটক দীঘির সিঁড়ি টা বড়ো পিছল আজ। শ্রাবনের শ্যাওলা-বড়ো বিষাদ বিজয়া।।
নীলকণ্ঠী বার্তা তখন পৌঁছে গেছে কৈলাশে ----
অজয়ের অন্নপূর্ণা মা সাদা কাশ-ফুল দেশে ।
ভেজা শিশির ঘাসে পথ মাড়ায় অজয় ঢাকি। পা চালায় বাড়ির মেঠোপথে--- 
এ পথেই চলে গেছে কৈলাশ-বিলাসী।
অপরাজিতা বিজয়া লতা টা আলগা হয়ে গেছে অজয়ের বাঁধা বাহুতে।





* চাবিওয়ালা *

নী লি মা চ্যা টা র্জ্জী

চা- বি- ও-য়া-লা...... সপ্তাহে একবার, কখনও সখনও দুবারও কেয়াতলা রোডের এই শাখাগলিটা দিয়ে চাবিওয়ালার বিশাল হাঁক শোনা যায় এবং তার সাথে সাথে একটা বেশ বড়সড় ধাতব রিং-এ লাগানো অজস্র ছোট বড় চাবির সমাহারের দুলুনিতে ঝননন, ঝননন আওয়াজ। মোটামুটি এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে এই আওয়াজটা শোনা যায়। মাঝেসাঝে কেউ ডাকে চাবিওয়ালাকে, হারানো চাবি বানানোর উদ্দেশ্যে; বেশিরভাগ দিনই ছোকরা চাবিওয়ালা হাঁক দিয়ে ঝনঝন করতে করতে গলির মুখে মিলিয়ে যায়। হ্যাঁ, আমাদের চাবিওয়ালা ছোকরাই বটে, খুব বেশি হলে বছর চব্বিশেক বয়স হবে.... লম্বা, রোগা পাতলা চেহারা, একমাথা ঘন অবিন্যস্ত চুল, পড়াশুনার হাতটা ধরেছিল বলে মনে হয় না, তবে চোখ দুটো বুদ্ধিদীপ্ত, মুখটা সদা হাস্যময়। বেশিরভাগ দিনই তার পরনে থাকে একটা ফ্যাকাশে সবুজ রংএর টিশার্ট এবং কালো প্যান্ট। রং ওঠা কিন্তু নোংরা নয়। পায়ে একটা সুখতলা ক্ষয়ে যাওয়া চটি, কাঁধে একটা ঝোলা।

সেদিন গোলাপী রংএর তিনতলা বাড়ির দোতলার বাসিন্দা বর্ণালী দোতলার বারান্দা থেকে চাবিওয়ালাকে ডাকল। বলে দিল, গেট খুলে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে সোজা উপরে উঠে এস। সেইমত চাবিওয়ালা উপরে উঠে দেখে যে বৌদি ডেকেছিল সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। একটা ছোট পলিব্যাগ থেকে গোটা তিনেক ছোট বড় তালা বের করে বলল, এগুলোর চাবি হারিয়ে গেছে, দুটো করে চাবি বানিয়ে দিতে পারবে?

চাবিওয়ালা তালা তিনটেকে ভালো করে দেখি নিয়ে বলল, পারব বৌদিমণি, তবে একটু সময় লাগবে। আমি এখানে বসে কাজ করতে পারব তো? 
বৌদি বলল, হ্যাঁ কর, তোমার হয়ে গেলে কলিং বেল বাজিও। চাবিওয়ালা মাথা নেড়ে নিজের কাজে লেগে গেল, ঝোলা থেকে নানান সাইজের চাবি এবং যন্ত্রপাতি বার করে নিবিষ্ট মনে সে কাজ করতে লাগল। 

ঘণ্টা দেড়েকের উপর লেগে গেল সব কটা চাবি বানাতে। ক্লান্ত চাবিওয়ালা কলিং বেল টিপল। বর্ণালী এসে সব তালা-চাবির পরীক্ষা নিরীক্ষা সেরে পয়সা কড়ি মিটিয়ে যখন দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, চাবিওয়ালা হাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে একটু সংকুচিত কণ্ঠে বলল, বৌদি , যদি কিছু মনে না করেন, তাইলে একটু খাবার জল দেবেন? পুজোর শেষে বাইরের আবহাওয়া তেমন গরম না হলেও, ল্যাণ্ডিং-এর ভিতরটা বেশ গরম। বর্ণালী “দিচ্ছি” বলে হাঁক পাড়ল, রাধা, এখানে এক বোতল জল দিয়ে যা তো! 

চাবিওয়ালা নিজের ঝোলা গুছাচ্ছিল মাথা নিচু করে।তার কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমেছে, কপালে লুটিয়ে পড়া চুলগুলো ঘামে লেপটে আছে। এমন সময়ে দরজা খুলে কেউ বলল, ও চাবিওয়ালা, তোমার জল নাও গো! চাবিওয়ালার মনে হল, কানে সুধাবর্ষণ হল, শীতের আগেই বুঝি বসন্তের কোকিল গান গেয়ে উঠল । হাতদুটো নিমেষে কাজ বন্ধ করল, বিস্মিত চোখদুটো অপলকে তাকিয়ে থাকল বক্তার দিকে! একটি সপ্তদশী কী অষ্টাদশী কিশোরী হলুদ রং-এর সালোয়ার-কামিজ পরে এক বোতল জল নিয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে। মুখটা নিষ্পাপ, ভারি মিষ্টি, চোখে তার গভীর মায়া, অবাধ্য কোঁকড়ানো চুলের কুচি কপালে অলসভাবে পড়ে আছে। মন্মথশরনিক্ষেপে চাবিওয়ালা মুহূর্তে আহত হল!

এরপর থেকে চাবিওয়ালা রোজই এ পাড়া দিয়ে একবার করে হেঁকে যায়, যদি গোলাপী বাড়ির দোতালার বারান্দা থেকে কিশোরীর ব্যাকুল, বিহ্বল দৃষ্টি তার উপরে কখনও পড়ে। চাবিওয়ালা গোলাপী বাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ছাইরঙা বাড়িটার সামনে হাঁক পাড়ে দু-তিনবার “চা-বি-ও-য়া-লা”, সাথে ঝননন, ঝননন আওয়াজ। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে একদিন রাধার বুঝি খেয়াল হল.... আস্তে আস্তে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। চারচোখের মিলন হল, রাধা দেখল রাস্তায় দাঁড়ানো চাবিওয়ালার ব্যাকুল চোখের দৃষ্টিতে নেমে এল সব-পেয়েছির এক প্রবল ভালো লাগার ঝলক!

এর পর থেকে সপ্তাহে এক আধবার নয়, রোজই চাবিওয়ালা ঐ গলি দিয়ে যায় হাঁক পাড়তে পাড়তে। এবং অবধারিতভাবেই রাধা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য হলেও একবার বারান্দায় এসে দেখা দিয়ে যাবে। ওরা দুজনেই জানে, এই সাক্ষাৎ নিতান্তই অর্থহীন, পরিণতিহীন, তবুও অবুঝ হৃদয় তো মানে না! 

এর মধ্যে রাধা একদিন লাল রং-এর একটা তাঁতের শাড়ি পরে এসে দাঁড়ালো। চাবিওয়ালা দেখে মুগ্ধ হল। পুলকিত চিত্তে সে রাস্তার উপর অদূরে দাঁড়িয়ে তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে “চমৎকার” জাতীয় একটা মুদ্রা দেখিয়ে হাসিমুখে চলে গেল। তারপর থেকে রাধা মাঝেমাঝেই শাড়ি পরে !

একদিন চাবিওয়ালার হাঁক শুনে রাধা যথারীতি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় “রাধা” বলে এক পুরুষ কণ্ঠের হাঁক শোনা গেল এবং তারপরই চাবিওয়ালা দেখল এক যুবক এসে বিশ্রী মুখভঙ্গি করে কী যেন বলল ও রাধাকে ঘরের ভিতরে যাবার নির্দেশ দিল বাঁহাতের তর্জনী তুলে। চাবিওয়ালা তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। ঐ যুবকটি কে? বয়স দেখে তো ঐ বৌদির স্বামী বলে মনে হয় না! যুবকটি কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে? রাধার সাথে ওরকম কুৎসিত মুখভঙ্গি করেই বা কথা বলল কেন? নানান সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চাবিওয়ালা রাস্তা হাঁটছে আজ, কাজে মন নেই। এর পর দু তিন দিন চাবিওয়ালা বিমর্ষমুখে ঝনঝন করতে করতে হেঁটে গেল, হাঁকও দিল, কিন্তু রাধার দেখা নেই। 

চার দিনের দিন অধৈর্য হয়ে চাবিওয়ালা সময়ের একটু আগেই গলিতে পৌঁছে হাঁক দিল। রাধা টুক করে বেরিয়ে এল। চাবিওয়ালার চোখে হাসি ফুটল। কিন্তু সে ভালো করে নজর করে দেখল, রাধার চোখে-মুখে যেন একটা ত্রাসের ছায়া। কিসের ভয়? চাবিওয়ালা উপর দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, সন্ধে ছটায় ফিরব! তারপর থেকে দিনের বেলায় রাধা বাইরে আসতে না পারলেও সন্ধে ছটায় বেশিরভাগ দিনই সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত। যদিও অন্ধকারে কেউ কারুর মুখ বিশেষ দেখতেই পেত না, তবুও ভালোবাসার উপস্থিতিটাই তো অনেক, পরস্পরের জন্য অনুভবই তো যথেষ্ট!

দু-চার দিন পর চাবিওয়ালা সন্ধে ছটা নাগাদ গলি দিয়ে ঢুকেছে, তিনতলা গোলাপী বাড়িটার দিকে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে.... সন্ধ্যার সময় সে হাঁকও পাড়ে না, চাবির ঝনঝনানিও বন্ধ থাকে। দূর থেকেই দেখতে পেল, তিনটে তলাই যেন অন্ধকার! নিচের তলার লোকেরা কোথাও গেছে, তিনদিন হল সে তলা অন্ধকারই থাকে, তিনতলার মানুষগুলো তো কাল অবধি ছিল, আজ নিশ্চয়ই কোথাও গেছে, তাই বাতি জ্বলছে না। কিন্তু দোতলার বাসিন্দাদের তো থাকার কথা! রাধার বৌদি কি কোথাও গেছে? সাথে কি রাধাকেও নিয়ে গেছে? ইস্, আজ তাহলে রাধার সাথে দেখা হল না! ক্লান্ত পদক্ষেপে চাবিওয়ালা বিমর্ষ মুখে এগিয়ে গোলাপী বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।

ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে দেখতে আসছিল.... বারান্দার লাগোয়া ঘরটাতে ঢোকার কাঁচের দরজাটা বন্ধ, ঐ ঘরটায় আলো না জ্বললেও, ভিতরের ঘর থেকে আলোর আভাস আসছিল। তাহলে কি ঘরে লোক আছে? এমন সময় অস্পষ্ট কিছু কথা শুনতে পেল চাবিওয়ালা। “আঃ, ছেড়ে দিন আমায়”, “আপনার পায়ে পড়ি, এ সব্বোনাশ আমার করবেন না”, “বৌদি গো , কোথায় তুমি, বাঁচাও আমায়”...... চাবিওয়ালা থমকে দাঁড়ালো, এ তো রাধারই করুণ আর্তি! পরক্ষণেই পরুষ কণ্ঠে পুরুষের চাপা হুঙ্কার, এই বেশি চিল্লাস না, বেশি সতীপনা দেখাস না, চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব! এই গলাটা কার? একটু চেনা চেনা লাগছে কি? সেদিনের সেই যুবকটি কি?

কী করবে বুঝতে পারছিল না চাবিওয়ালা। তড়িৎবেগে বাড়ির পিছনে চলে গেল। সেখান থেকে রাধার কাতর কণ্ঠস্বর আরও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। চাবিওয়ালা বুঝে নিল, নিশ্চয়ই বৌদি বাড়িতে নেই। সেই সুযোগে কেউ রাধার উপর বল প্রয়োগ করছে নিশ্চয়ই। না! তার প্রাণ থাকতে এ হতে পারে না!

দৌড়ে বাড়ির সামনে এসে দুটো করে সিঁড়ি টপকিয়ে চাবিওয়ালা দোতলায় উঠে কলিং বেল টিপল। দরজায় কান পেতে ছিল সে, দরজার ওপাশে পায়ের আওয়াজ হল। পিপহোলের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো চাবিওয়ালা। ভিতর থেকে কর্কশ কণ্ঠে আওয়াজ এল, কে? চাবিওয়ালা একটা বড় চাবির পিছন দিয়ে দরজার উপর ঠক ঠক করে দু তিনবার আওয়াজ করে, খুব গম্ভীর গলায় বলল, দরজা খুলুন, আমি থানা থেকে আসছি!

কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা! চাবিওয়ালা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে! এমন সময় আস্তে করে দরজাটা খুলে গেল। সেদিনের সেই যুবক দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে। সে কিছু বলার আগেই চাবিওয়ালা চকিতে একটা পা ও নিজের শরীরের অর্ধেক অংশ দরজার ভিতরে ঢুকিয়ে দিল সেই যুবককে গায়ের জোরে ভিতরদিকে ঠেলে দিয়ে। যুবক চেঁচিয়ে উঠল, কে আপনি? ঘরের মধ্যে ঢুকছেন কেন? আপনি কি পুলিশের লোক? মনে তো হচ্ছে না!

যুবকের কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চাবিওয়ালা প্রবল জোরে চেঁচিয়ে উঠল, রাধা, কোথায় তুমি, বাইরে এস, আমি চাবিওয়ালা!

বেগতিক দেখে যুবক প্রাণপণ চেষ্টা করল ধাক্কা মেরে চাবিওয়ালাকে ঘর থেকে বের করে দেবার, দু চারটে চড়, থাপ্পড়, ঘুঁষিও চালাল, কিন্তু চাবিওয়ালাকে এক চুলও নড়াতে পারল না। চাবিওয়ালার গলার আওয়াজ পেয়ে বিস্রস্তবসনা রাধা ফোঁপাতে ফোঁপাতে এসে দাঁড়ালো। তার চোখেমুখে আতঙ্ক, চুল এলোমেলো, গায়ের জামাটা আধখোলা, এক জায়গায় ছেঁড়া, শাড়ির কুঁচি লুটাচ্ছে, আঁচলটা দিয়ে শরীর ঢাকতে ঢাকতে প্রবল কাঁদতে কাঁদতে রাধা এসে চাবিওয়ালাকে আঁকড়ে ধরল! 

রাধার অবস্থা দেখে চাবিওয়ালার মাথায় আগুন জ্বলে গেল। মুহূর্তে দুম দুম করে দুটো বিশাল ঘুঁষি মারল ঐ যুবকের পেটে। যুবক “ও বাবাগো" বলে পেট চেপে বসে পড়ল। চাবিওয়ালা হিসহিসিয়ে রাধাকে জিজ্ঞাসা করল, শয়তানটা তোমার কোনও ক্ষতি করেছে কি? রাধা কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুটে বলল, না! 
— এ কে? তোমার বৌদিই বা কোথায়?
— বৌদি দাদার সাথে সিনেমা দেখতে গেছে, আর ইনি হল বৌদির ভাই, বেশ কিছুদিন ধরে এখানেই আছে। জানো চাবিওয়ালা, সুযোগ পেলেই উনি শুধু আমায় ছুঁতে চায়। বৌদিকে কিছু বলতেও পারি না, আমার কথা যদি বিশ্বাস না করে ! 
— শাড়ি জামা ঠিক করে পরে এস। আমার সঙ্গে থানায় যাবে। এই তো কাছেই গোলপার্কের আগেই থানা। গিয়ে আজকের ঘটনা সব বলতে পারবে তো? ভয় পাবে না তো? 
— না, ভয় পাব না, তুমি সাথে থাকবে তো?
— সাথে আছি, সাথে থাকব !

পেট চেপে কাতরাতে কাতরাতে রাধার বৌদির ভাই বলতে শুরু করেছিল শুধু, আমার অন্যায় হয়ে গেছে, আমি ক্ষমা চাইছি, এমনটি আর হবে না, তোমরা থানায় যেও না.....

দড়াম করে একটা কষিয়ে লাথি মারল চাবিওয়ালা সেই যুবককে। তারপর রাধাকে নিয়ে চলে গেল পুলিশ স্টেশনে। 

থানার আইসি সমর বসু অত্যন্ত করিৎকর্মা পুলিশ অফিসার। কেসের গুরুত্ব বুঝে নিজের ঘরেই ওদেরকে বসিয়ে এসআইকে ডেকে বললেন এফআইআর দর্জ করো, যা সত্যি, পরিষ্কার তাই লিখবে। আর এক্ষুণি ছেলেটিকে অ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা করো, দেখো পালিয়ে না যায়। নির্দেশ পেয়ে পুলিশ ভ্যান রওনা দিয়ে দিল।

 অনতিকালের মধ্যেই অপরাধী ভাই সমেত দিদি বর্ণালী ও তার স্বামী শ্যামল সবাই পুলিশের গাড়িতে থানায় উপস্থিত হল। বিপদের গন্ধ পেয়ে ভাই সিনেমা হল থেকে দিদিকে ডাকিয়ে এনেছে। ভাইকে থানার গারদে বন্দী দেখে কাঁদতে কাঁদতে বর্ণালী রাধাকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল, টাকাপয়সার লোভ দেখাল, “আমি সেই কবে থেকে তোকে খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি, আর আজ রাস্তার এক চাবিওয়ালাই তোর কাছে সব হল”.... এই কথা বলে রাধার সেন্টিমেন্টেও সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করল বর্ণালী , কিন্তু রাধা নির্বাক হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল!

পুলিশের যা যা করণীয় করার পর আই সি সমর বসু রাধার কাছে জানতে চাইলেন, তুমি এখন কোথায় যাবে? তোমার বাড়ি কোথায়? বাবাকে ডেকে আনা যাবে?
— স্যার আমার বাড়ি সোনারপুরে। বাড়িতে আমার বাবা, সৎ মা আর দুটো ভাইবোন আছে। বাবা কিছু করে না। মা লোকের বাড়ি কাজ করে কোনওরকমে সংসার চালায়.... বাবা আমাকে নিয়ে যাবে না! খুব মৃদু স্বরে রাধা জবাব দিল।
— হুম, তাহলে তো তোমাকে একটা হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়....
— না, স্যার আমাকে হোমে পাঠাবেন না.... হোমের কথা শুনে যেন আঁতকে উঠল রাধা। .... হোমও তো অনেক সময় নিরাপদ হয় না, সেদিনই তে খবরের কাগজে হোম সম্বন্ধে একটা বাজে খবর দেখলাম, স্যার। যদি অনুমতি দ্যান স্যার, তাহলে আমি ওর সাথে যাব.... এই বলে রাধা চাবিওয়ালার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল।

আইসি স্বয়ং এবং উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। বলে কী মেয়েটা। রাধা আবারও বলে উঠল, স্যার আমি দু মাস আগেই সাবালিকা হয়েছি। এখানে বৌদির সাথে আসার আগে আমি স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়তাম..... বৌদি বলেছিল এখানে স্কুলে ভর্তি করে দেবে, তাই আগের স্কুল থেকে বয়সের সার্টিফিকেটটা এনেছিলাম, বৌদি অবশ্য আমাকে পড়তে দেননি আর! তাই বলছিলাম যে আমি যদি চাবিওয়ালার সাথে যেতে চাই, আমাকে যেতে দেবেন স্যার?

রাধার চোখে মুখে আর্তি। আইসি চাবিওয়ালার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম যেন কী বললে তখন.... ও হ্যাঁ বিষ্ণু, বিষ্ণুপদ দাস। তা হ্যাঁ বিষ্ণু তোমার বাড়িতে কে আছে? রাধা যে তোমার বাড়িতে যেতে চাইছে, কী পরিচয়ে নেবে তুমি ওকে?
— আজ্ঞে স্যার , বাড়িতে আমার মা আছেন। আমার মা খুব ভালো গো স্যার, সারাদিন সেলাই ফোঁড়াই করেন, আমার থেকে বেশি পয়সা কামায় গো স্যার, রামায়ণ-মহাভারত পড়েন .... আমিই মায়ের নচ্ছার ছেলে.... মায়ের কথামত পড়াশুনা করলাম না, শেষে পাশের বাড়ির রহমান চাচার কাছে এই চাবির কাজ শিখে এখন চাবিওয়ালা হয়েছি স্যার!
— ভাগ্যিস চাবিওয়ালা হয়েছিলে, তাই তো মেয়েটার প্রাণ, মান সব বাঁচল আজ! তা ও যে তোমার সাথে যেতে চাইছে, তোমার মা রাগ করবেন না? ওকে কী পরিচয়ে বাড়িতে রাখবে?
— স্যার , ছোট মুখে বড় কথা.... আমি স্যার ওকে, মানে স্যার, ওকে বিয়ে করে বৌয়ের পরিচয়ই দেব! হাত কচলাতে কচলাতে থতিয়ে মতিয়ে চাবিওয়ালা ওরফে বিষ্ণু কথাটা বলেই ফেলল।

আইসি হো হো করে হেসেই ফেললেন বিষ্ণুর হাত কচলানো দেখে।
~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~

মাস খানেক হয়ে গেল উপরিউক্ত ঘটনার পর। রাধার সিঁথি টকটকে লাল রঙা সিঁদুরে রাঙানো। রাধা ঘর পেয়েছে, মা পেয়েছে, চাবিওয়ালার মতন যথার্থ মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেয়েছে। আইসি সমর বসুর সুপারিশে চাবিওয়ালা বিষ্ণুপদ সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজে ঢুকেছে। অদূর ভবিষ্যতে বিষ্ণুকে একজন দক্ষ সৎ পুলিশ করে তোলার ইচ্ছা আছে মানুষ চেনার জহুরি সমর বসুর!

সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার শেষে নিষ্কলুষ পূর্ণিমার তরল রুপোর মতন জ্যোৎস্নায় ধৌত রাস্তায় রাধা হাঁটছে চাবিওয়ালার হাতটা ধরে.... কেয়াতলা রোড হয়ে সাদার্ন এভিনিউতে এসে পড়ল। মনে অপরিসীম তৃপ্তিজনিত প্রসন্নতা। রাধা নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠল, তোমার চাবিওয়ালার কাজটা কিন্তু তোমাকে খুব মানাত কারণ তুমি আসলে একজন সত্যিকারের চাবিওয়ালা!
— কী রকম?
— তুমি আমার জীবনের , আমার মনের সব বন্ধ, অন্ধকার ঘরের দরজার তালাগুলো খুলে দিয়েছ গো!






* কলিংবেল *

অ জ য় কু মা র বি শ্বা স

ধূসর রঙের মেঘ দেখে সেদিন অপরূপার বুক কেঁপে উঠেছিল। বাড়িতে একা। জানালার পাশে বসে সে মেঘের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ঘন্টা খানেক আগেও আকাশ পরিষ্কার ছিল। মাঝে মাঝে কিছু সাদা মেঘ আকাশে ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল! এরই মধ্যে মেঘচিত্র এভাবে বদলে যাবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। শরৎ কালের আকাশ যে সহসা এত ভয়ংকর হয়ে উঠবে তা কে জানত! 

সন্ধ্যা হতে তখনও ঘন্টা দুয়েক বাকি। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এল। তাড়াতাড়ি করে অপরূপা ঘরের সমস্ত জানালা বন্ধ করে দিল। জোর বৃষ্টি! মুহুর্মুহু বজ্রপাতের শব্দে বাড়িঘর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কেঁপে উঠছে সে নিজেও। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ! 

"যা বাবা এই দুর্যোগের মধ্যে আবার কে এল! কে এখন আসতে পারে? "তার স্বামী তিন মাস আগে বাড়ি ঘুরে গেছে। ফিরবে সেই বড়দিনের ছুটিতে! ফৌজিতে চাকরি করলে কি আর বারবার বাড়ি আসার ছুটি পাওয়া যায়! তার বাবার বাড়ি থেকে কেউ আসলে তো আগেভাগে ফোন করে জানাত। কাজের মাসি সকালে কাজ করে গেছে। দিনে একবেলা আসে। কে আসতে পারে? অপরূপা ভেবেই চলেছে। ওদিকে কলিং বেল বেজেই চলেছে। 

বাইরের ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিপাত দেখে সবাই বলবে, এযেন অকাল শ্রাবণ! এই বৃষ্টির মধ্যে একজন পথচারীও রাস্তায় নেই। কড়কড় করে বাজ পড়ছে সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি। মনে হচ্ছে কোন খ্যাপা হ্যালোজেনের স্যুইচ নিয়ন্ত্রণ করছে। নিশ্চয় পরিচিত কেউ হবে, তা না হলে বারবার বেল বাজাতে যাবে কেন! 

অপরূপা ধীরে ধীরে মেন দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা ভয়, কিছুটা সংশয় আর কিছুটা উৎকণ্ঠা তার মনকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, "কে? কে ওখানে?" 

কোন সাড়া শব্দ নেই। সে আবারও চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, "কথা বলছেন না কেন? কে বেল বাজাচ্ছেন?" 

এবারও সে কোন উত্তর পেল না। তা হলে কি সে ভুল শুনেছে! কলিং বেলের আওয়াজ থেমে গেল। দিন কাল ভাল নয়। তাছাড়া বেশিরভাগ সময় সে একাই থাকে। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর এখন সে বি, এড-এ পাঠরতা। ইচ্ছে সে স্কুলে পড়াবে। এখন পুজোর ছুটি। কলেজ বন্ধ। খুলবে সেই ভাইফোঁটার পরে। পুজোর পাঁচদিন বাবার বাড়ি কাটিয়ে সে গতকাল বাড়ি ফিরেছে। পুজোর ছুটি শেষ হলে আবার জোর কদমে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। এখন তো আর আগের মতো দশ মাসের কোর্স নয় টানা দুই বছরের ঝক্কি! 

অপরূপা সাহস করে যেই না দরজা খুলতে যাবে ঠিক করেছে, হঠাৎ লোডশেডিং। দরজা না খুলে সে থেমে গেল। 

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। শরতের শেষ বিকেলে এরকম বৃষ্টিপাত অনেক বছর সে দেখেনি। ইচ্ছা ছিল এই অকাল শ্রাবণকে সে উপভোগ করবে। জানালা খুলে বৃষ্টির শীতলধারা স্পর্শ করবে। গুনগুন করে শ্রাবণের গান গাইবে। কলম তুলে নিয়ে কয়েক লাইন বৃষ্টির কাব্য রচনা করবে। ছাদের দরজা খুলে পাগলের মতো বৃষ্টিতে ভিজবে। গাছের শাখাপ্রশাখা যেমন খুশিতে মাথা দোলায়, ঠিক তেমনি বৃষ্টির তালে তালে তার মন নেচে উঠবে। কলিং বেল অপরূপার সমস্ত ইচ্ছায় জল ঢেলে দিল। 

একেতো বৃষ্টি তারপর লোডশেডিং আর ওদিকে কলিং বেল বাজার আওয়াজ, তার হাত পা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসছে। বাড়িতে যদি কেউ থাকত তাহলে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করতে পারত। দরজা থেকে সে একবার বেডরুমের দিকে একবার রান্নাঘরের দিকে আবার বেডরুম রান্নাঘর - পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে। এবার সে সোজা রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। সব্জি কাটার চাকু ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে আবার সে মেন গেটের দিকে এগিয়ে গেল। আজ যা হবার তা হবে। দরজা খুলে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে দুষ্কৃতীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যেভাবেই হোক নিজেকে রক্ষা করবে। আবার সে ভাবল, কি দরকার এত সাহস দেখানোর! কেউ যখন সাড়া দিচ্ছে না সে নিশ্চিত এখন আর কেউ নেই। 

হঠাৎ কি যেন ভাঙার একটি শব্দ পেল। সে বুঝতে পারল এটা সিঁড়ির কাঁচের জানালা ভাঙার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সে দ্রুত সিঁড়ি ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল কে একজন জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকছে। পুরনো ফুলপ্যান্ট গায়ে নীল রঙের টি-শার্ট। বৃষ্টিতে সে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। অপরূপা চিৎকার করে উঠল, "চোর! চোর..." 

কে শুনবে তার কথা। রাস্তা জনশূন্য। প্রতিবেশীদের জানালা দরজা বন্ধ। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।তার উপর অনেকক্ষণ বিদ্যুৎ গেছে। অবিরাম বৃষ্টিপাতে রাস্তা জলমগ্ন। লোকটি হাতজোড় করে বলল, "চিৎকার করবেন না ম্যাডাম। বাধ্য হয়েই জানালা ভাঙতে হল। আপনাকে অনিষ্ট করার আমার কোন ইচ্ছা নেই। আমাকে কিছু সময়ের জন্য একটু আশ্রয় দিন প্লিজ। বৃষ্টি থেমে গেলে আমি চলে যাব। 

এতো দেখছি বিনয়বাবুর অবতার! পরের বাড়ির জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকে বলে কি না," চিৎকার করবেন না ম্যাডাম! বাধ্য হয়েই জানালা ভাঙতে হল। "অপরূপা কথা না বাড়িয়ে বলল," বেশ, আসুন তবে। "

লোকটি মাথা নিচু করে সিঁড়ি থেকে নেমে সোজা অপরূপার ডাইনিং - এ প্রবেশ করল। তার মাথা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ডাইনিং এর মেঝের উপর পড়ছে। ভেজা টি-শার্ট গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। দেখে ভদ্রলোক বলেই মনে হল। শান্ত মাথায় অপরূপা তাকে জিজ্ঞেস করল," আপনার নাম কি? 
কোথায় থাকেন? 
কেনই বা জানালা ভেঙে অন্যের বাড়ি ঢুকতে হল? "

চল্লিশোর্ধ্ব লোকটি হাতজোড় করে বলল," আমি সুকান্ত কর্মকার। কাঁকিনাড়ায় থাকি। একটি আর্থিক সংস্থায় কাজ করতাম। প্রতিদিন খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা করা ছিল আমার প্রধান কাজ। কেউ এক বছরের জন্য আবার কেউ কেউ দুই বছরের জন্য দৈনিক সঞ্চয় প্রকল্পে টাকা জমা রাখত। প্রথম প্রথম কোম্পানি ভালোই চলছিল। প্রথম বছরে যারা এক মেয়াদের জন্য টাকা জমা রেখেছিল, মেয়াদ শেষে সবাই সুদ সমেত টাকা ফেরত পায়। দিন দিন এই প্রকল্পের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে সঞ্চয়ের পরিমাণ। গত আর্থিক বছরে কোম্পানির সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল কয়েক কোটি টাকা। কিন্তু কোম্পানি যে চিট তা আগে জানতাম না। জানলে ওই কোম্পানির হয়ে কখনও কাজ করতাম না। 

প্রায় একশো জন সঞ্চয়কারীর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তারা টাকা ফেরতের জন্য আমার কাছে আবেদন করে। আমি কোম্পানির হেড অফিসে গিয়ে দেখলাম গেটে বড় একটি তালা ঝুলছে। গেটে একটি নোটিশ টাঙানো ছিল, "আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে অফিস সিল করা হল।" - - - আর্থিক দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ। 

আমি হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। পরের দিন বিভিন্ন সংবাদ পত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশ হয় এই আর্থিক প্রতারণার খবর। দেখানো হয় টিভি নিউজে। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিরুদ্দেশ।এখবর জানাজানি হতেই সকল সঞ্চয়কারী আমার বাড়িতে হাজির হয়। তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আমাকে চাপ দেয়। আমি তাদেরকে টাকা ফেরত দেব বলে প্রতিশ্রুতি দিই এবং কিছু দিন সময় চেয়ে নিই। পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা হাতে পাই। কিন্তু তাতে মাত্র কয়েকজনকে টাকা ফেরত দিতে সক্ষম হই। সপরিবারে চলে আসি একটি ভাড়া বাড়িতে। 

অপরূপা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সুকান্ত কর্মকারের কথা শুনছিল।এমন সময় বিদ্যুৎ আসে। অপরূপার নজরে আসে সুকান্ত কর্মকারের কপাল থেকে লাল রঙের কি যেন চুঁইয়ে পড়ছে। চুলের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটি ক্ষতচিহ্ন। সে জিজ্ঞেস করল, "আপনার মাথা কি করে কেটে গেছে?" 

সুকান্ত কর্মকার বলল, "আজ দুপুরে আমার ভাড়া বাড়িতে কয়েকশো আমানতকারী হাজির হয়। প্রথমে আমার সাথে কথা কাটাকাটি তারপর হামলা চালায়। হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি আসে। আমি কোনক্রমে পালিয়ে স্টেশনে আসি। স্টেশনে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে ডাউন শিয়ালদহ লোকাল পেয়ে যাই। কয়েকটি স্টেশনের পর পলতা নামি। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে আপনাদের বাড়ি চলে আসি। জানি অন্য লোকের বাড়ি জোর করে ঢোকা অপরাধ কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি চোর, ডাকাত, ছিনতাইবাজ কিংবা ধর্ষক নই। আমি প্রাণে বাঁচতে চাই। আপনার বিচারে আমি যদি আপরাধী হই, তবে নিশ্চয় সাজা দেবেন কিন্তু ওই লোকগুলোর হাতে আমাকে তুলে দেবেন না। যদি তুলে দিতেই হয়, তবে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন। "

একথা বলেই সে তার টি-শার্ট খুলে ফেলল। লোকটির খালি গা দেখে অপরূপা আতকে উঠল। সারা গায়ে অজস্র কালশিটে। কোথাও কোথাও ফুলে উঠেছে। কি করবে অপরূপা? সে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল আবার একটু মায়াও হল। লোকটিকে সে বলল," আপনি বাথরুমে গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন, পরে বাকি কথা শুনব। "

এই বলে সে পাশের ঘর থেকে তার স্বামীর একটি জামা ও পাজামা সুকান্ত কর্মকারের হাতে তুলে দিল। 

বাথরুম থেকে লোকটি বেরিয়ে এলে অপরূপা তাকে বলল," অবিলম্বে আপনার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগানো দরকার তা না হলে সংক্রমণ হতে পারে। আমি ডাক্তারবাবুকে ফোন করে আপনার জন্য ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করছি। আপনি ডাইনিং - এ বিশ্রাম করুন। আপনার জন্য ওষুধ কিনে এক্ষুনি ফিরে আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত কোথাও যাবেন না। "

সুকান্ত কর্মকার কোন বাধা দিল না। এক ঘন্টার মধ্যে অপরূপা ওষুধ ও পথ্য নিয়ে বাড়ি ফিরল। ফিরে এসে সে সুকান্ত কর্মকারকে ডাইনিং - এ দেখতে না পেয়ে ভাবল বোধহয় টয়লেটে গেছে। কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যে তাকে বাথরুম থেকে বেরতে না দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। বাথরুমে গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই। বাড়ির সব ঘরগুলিতে ছাদে সর্বত্র খোঁজ করে যখন সে সুকান্ত কর্মকারকে পেল না, তখন ভীষণ কষ্ট পেল। তবে কি সে অপরূপাকে বিশ্বাস করতে পারেনি? এসব চিন্তা করতে করতে সেই রাতটা অপরূপার কোন রকম কাটল। 

পরের দিন সকালে খবরের কাগজ এল। খবরের হেডলাইন, "দক্ষিণবঙ্গে টানা দু'ঘন্টা বৃষ্টিপাত, বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন।" বাম দিকে ছোট্ট করে লেখা, "পলতা স্টেশনের কাছে অজ্ঞাত পরিচিত এক ব্যক্তির ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে থাকতে দেখে যায়। পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে পোস্টমর্টেমে পাঠিয়েছে। তার পরনে ছিল পাজামা ও গায়ে একটি সুতির জামা।" 

খবরটা পড়তে পড়তে অপরূপার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।





* পুনর্জন্ম *

ন ন্দি তা সো ম 

প্রতিদিন সকাল ছয়টায় আমার বারান্দায় এসে বসে মিষ্টি এক হলুদ পাখি। বসেই সে বলতে থাকে "বৌ কথা ক, বৌ কথা ক"। এতো ডাকাডাকি করলে কি আর ঘরে থাকা যায়, না আয়েশের ঘুম ঘুমানো যায়। যেই আমি বারান্দায় আসি অমনি এক ফিচেল হাসি হেসে উড়ে চলে যায়। ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু ঘুম ভাঙানোর জন্য রাগও হয়।

এতো বাড়ি থাকতে আমার বাড়ি সংলগ্ন পাতাভরা জারুল গাছ ওর এতো প্রিয় কেন?  একদিন স্থির করলাম হলুদ পাখি আসার আগেই আমি বারান্দায় দাঁড়াবো আর জিজ্ঞেস করবো- ব্যাপারখানা কি? যেমন ভাবা তেমনি কাজ।

পরের দিন পাখি আসার আগেই আমি চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে আছি। তিনি তার সময়মতো এলেন। দুটো ডাক দিয়েই আমার বারান্দার রেলিঙের ওপর এসে বসলো। কোনো ভয়ডর নেই গো। আমি অবাক। সে মানুষের স্বরে বলে উঠলো- "সোনাদিদি, তুমি আমায় চিনতে পারলে না। আমি কত পথ প্রান্তর পেরিয়ে ঠিক তোমায় চিনে তোমার কাছে এসেছি।" সোনাদিদি ডাকটা পরিচিত লাগলেও সুর মেলাতে পারছিলাম না। পাখি বলে উঠলো, "দিদি, পিয়াসী নদী ও পিয়াসা গ্রাম ভুলে গেছো বুঝি।" "দূর ... সে কি ভোলা যায় না কি?  তারা যে আমার শিকড়, অস্থিমজ্জা। কিন্তু পাখি তুমি কে? তোমায় কেন চিনতে পারছি না। বয়স যে আমার চার কুড়ি পেরিয়েছে গো। কতো কথা যে ভুলে গেছি স্মৃতি বিস্মরণে। মিষ্টি হেসে পাখি বলে উঠল, "আমি তোমায় সব মনে করিয়ে দিচ্ছি সোনাদিদি। তুমি চুপটি করে আমার কথা শোনো।"

পাখি বলে উঠলো, "তুমি ছিলে মোড়ল জ্যেঠুর মেয়ে সুন্দরী। সবাই ডাকতো তোমায় সোনা বা সোনাদিদি বলে। গাছগাছালির ভিতরে তোমাদের ছোট্ট দোতলা বাড়ি। রাংচিতা আর মেহেন্দী গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার আশেপাশে ছিলো ছড়ানো ছিটানো গ্রামের আরো কিছু বাড়ি। তোমাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ি ছিলো গোবিন্দ মণ্ডলের। ক্ষেত খামারে কাজ করতো। রোজগার খুব কম। পাঁচমেয়ের বাপ ছিলো। রোজ সন্ধ্যায় আকন্ঠ মদ গিলে এসে বউকে বেধড়ক পেটাতো। বউয়ের দোষ ছিলো। সে কেন ছেলের জন্ম দেয় নি। আর খেতে কেন কম দিতো। হায় ভগবান! বউ নিজে উপোস করে শাকপাতা সিদ্ধ করে সন্তানদের ক্ষিধে মেটাতো সামান্য ভাতের সাথে। বাকিটা বরের জন্য রেখে দিতো। তার রাত্রে খাওয়া আবার পান্তাভাত সকালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বরের মদের পয়সা কোথা থেকে আসতো জানতো না। জিগ্যেস করার সাহসও ছিলো না। একদিন ভাত কম হওয়াতে গোবিন্দ মণ্ডল এমন মার মারলো যে উপোষী বৌটা ওখানেই মারা গেলো। পাঁচটা মেয়ে অঝোরে কাঁদলো। বাপের স্বভাবের কোনো হেরফের হলো না। দিন সাতেকের মধ্যে সে বিয়ে করে নিয়ে এলো আমায়। মা বাপ মরা মামামামীর কাছে জঞ্জালের মতো পড়ে থাকা টিয়াকে। মা বাপ আনন্দ করে নাম দিয়েছিলো টিয়া। সে জঙ্গলে ঘুরতে, পাখি প্রজাপতির পিছনে ঘুরতে ভালোবাসতো। খুব ইচ্ছে তার পাখী হবার, ফুলের মধু খাবার। উপরওয়ালা সব কিছুতে বাদ সেধে তাকে চার দেওয়ালে বন্দী করে দিলো। মেনে নিলাম আমার ভবিতব্য। তুমি এলে আমায় দেখতে। বাচ্চাদের হাতে দিলে রকমারী খাবার। আর আমার কানে মন্ত্র দিলে , "বউ, চুপ করে থাকবি না। কথা ক'বি, প্রতিবাদ করবি--- নাহলে টিঁকে থাকতে পারবি না। কথা কস বউ, কথা কস।" কিছু বুঝলাম-- কিছু বুঝলাম না। মামা গোবিন্দ মণ্ডল কে আমাকে বিয়ে করার জন্য কিছু টাকা আর চাল ডাল দিয়েছিলো। সেগুলো না ফুরোনো পর্যন্ত ভালোই চলছিলো। বরের ভালোবাসাও পাচ্ছিলাম।
কলসির জল ফুরোবার মতো টাকা, চাল ডাল ফুরিয়ে গেলো। শুরু হলো গোবিন্দ মণ্ডলের পুরানো মূর্তি। রোজ মদ গিলে এসে আমায় মারধর। পেটে ভাত নেই---কিন্তু সন্তান এসে গেছে। জানার সাথে সাথে পতির শাসানি --- ছেলে জন্ম না দিলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে আমায়। পাঁচটা মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে আমায় ঘিরে থাকে। এক বিকেলে সোনাদিদি তুমি এলে অনেক খাবার নিয়ে। সুখবর এনেছো যে---তোমার বিয়ে অনেক দূরে। তুমি চলে যাচ্ছো। আমায় দেখে সব বুঝলে, জড়িয়ে ধরে বললে---- বউ আবার বলছি কথা কও, বৌ কথা ক। সহ্য করিস না। প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়া।
এরপর এলো সেই দিন---- সারাদিন কষ্ট পেয়ে সন্ধ্যায় জন্ম দিলাম এক ফুটফুটে মেয়ের। মুখ দেখে সব দুঃখ ভুলে গেলাম। অনেক রাতে দরজায় ঝড়ের আওয়াজ। গোবিন্দ মণ্ডল সম্পূর্ণ মাতাল হয়ে বাড়ি এসেছে। রাস্তায় সে খবর পেয়ে গেছে। তার রুদ্রমূর্তি দেখে মেয়েগুলো ভয়ে সরে গেলো। এসেই ছিনিয়ে নিলো আমার দুধের শিশুকে। বাধা দিলাম, চিৎকার করলাম। সে তখন বুনো জন্তুর থেকেও হিংস্র। আমার চুলের মুঠি ধরে সরিয়ে আছড়ে ফেললো দুধের শিশুকে। গলায় নিজের পা চেপে ধরলো। শিশুর চিৎকার হারিয়ে গেলো আকাশে বাতাসে। আমিও হয়ে গেলাম পাগলপারা। এককানে মেয়ের কান্না--- আর এককানে মন্ত্র " বৌ কথা ক, বৌ কথা ক"। ছুটে রান্নাঘর থেকে আঁশবটি নিয়ে এসে গোবিন্দ মণ্ডলের গলায় কোপের পর কোপ দিলাম। তারমাঝে সে আমার হাত থেকে বটি নিয়ে আমায়ও দিলো কোপ। দুজনের ভবলীলা সাঙ্গ হলো। ভগবানের কি লীলা দেখো--- আমায় সতী বানিয়ে দিলো গো। একদিকে থেকে বেঁচে গেলাম গো দিদি। আমার প্রাণ-- পাখির মতো ফুরুত করে উড়ে গিয়ে বসলো তোমার বাড়ির গাছের ডালে। তুমিতো নেই। কিছুক্ষণ বসে উড়ে গেলাম মুক্ত আকাশে। কেটে গেলো কতোদিন। আবার জন্ম নিলাম ছোট্ট হলুদ পাখি হয়ে মা পাখি ও বাবা পাখির ঘরে। কতো আদর করে, ঠোঁটে করে খাইয়ে বড়ো করলো আমায়। কর্তব্য শেষে তারা উড়ে গেলো আবার অন্য কোথাও। আমি শুরু করলাম আমার ভ্রমণ। প্রধান কাজ তোমায় খুঁজে বার করে সব বলা। আর ঠোঁটে তোমার শেখানো মন্ত্র,"বৌ কথা ক, বৌ কথা ক"।"

আমি পাখির সোনাদিদি-- বিমূঢ়, নির্বাক। আমার চোখে জল। বললাম --- আমার কাছে থাক। হলুদ পাখি হেসে বলে উঠলো---"না গো, আমার কি থাকার জো আছে? তোমার শেখানো মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে হবে নির্য্যাতিতা বধূদের কাছে। তাই চললাম --অন্য কোথায়, অন্য কোনোখানে""।
" বৌ কথা ক, বৌ কথা ক"-- ডেকে মুক্তপাখি আমার চোখে জল ভরে দিয়ে উড়ে গেলো নীল মুক্ত দিগন্তে।





* প্রত্যাশা *

অ শো ক কু মা র মো হা ন্ত 

গুড়ুম্!গুড়ুম্!
রেলস্টেশনটা সকাল বেলাতেই বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল। স্টেশনে যে দু'একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও হতচকিত হয়ে এলোপাতাড়ি ছুটতে লাগলো। স্টেশন সংলগ্ন বাজারে শাটার নামানোর ঝনঝন শব্দ। চারিদিকে কেমন আতঙ্কের ছাপ। 

একদল ছেলে আরেকদলের পিছনে ছুটছে প্ল্যাটফর্ম ধরে। পিছনের একজন চটের থলের মধ্যে থেকে বোমা বের করে সামনে ছুঁড়ছে। তার সামনে আরেকজন পিস্তল হাতে ছুটছে। আসলে সম্রাটের দলকে তাড়া করেছে কার্তিকের দল। সম্রাট সকালে স্টেশনের যে চায়ের দোকানে বসেছিল সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে, তারই পিছন দিক দিয়ে এসে সেখানেই বোমা ছুঁড়েছে কার্তিকের দল সম্রাটকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সম্রাট প্রাণে বেঁচে গেছে। 

  ক্ষমতা দখলের লড়াই আর কি। এলাকার একসময়ের ত্রাস কার্তিক দু'বছর জেলে ছিল। কালই ছাড়া পেয়েছে। কার্তিকের অবর্তমানে কালুই হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের ত্রাস।  কিন্তু কালু মস্তানের মস্তানি বেশীদিন টেকেনি। হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল। হয়তো কোনো গন্ডগোলে জড়িয়ে নিকেশ হয়ে গেছে। আর ফেরেনি। 

কালুর শূন্যস্থান দখল করেছিল কালুর বিশ্বস্ত সেনাপতি সম্রাট। সম্রাট হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের অলিখিত ডন। 

সম্রাট খুব সাধারণ ঘর থেকে এসে এ দলে ভিড়েছিল। তেমন কোনো বড়সড় কাজকর্মের কালো অতীত নেই সম্রাটের। নেই কোনো দাগী আসামীর তকমা। নিতান্ত সাদামাটা ঘরের ছেলে। বিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে স্নাতক হওয়া ছাত্র। পাশ করে দরজায় দরজায় যখন মাথা কুটছিল সামান্য একটা চাকরির জন্য,  এই সুন্দর পৃথিবীটা নিষ্ঠুর রূপে তার কাছে বড় কদর্য হয়ে ধরা দিয়েছিল। বাবার প্রত্যাশাপূর্ণ দৃষ্টি মায়ের স্বপ্নমাখা প্রতিদিনের প্রশ্নবাণ সম্রাটকে বড় বিঁধত। বিধ্বস্ত নিরূপায় সম্রাট মাথার চুল গুলো আপনি আপনি ছিঁড়ত। বিড়বিড় করত। বুকের মাঝখানটা ক্ষতবিক্ষত হত।অস্ফূট শব্দে সমাজকে ধিক্কার দিত। গালাগালি দিত। এ পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর! এক চিলতে জায়গা ও তাকে কেউ দিতে চায় না। জীবনের সৌরগতি যে স্বপ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো, ঋতু বদলাত, তা যেন ভরকেন্দ্রচ্যুত হয়ে এলোমেলো গতিপথে বক্ররেখায় ছুটতে লাগল। মনে হতো সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দেয়। 

মনে মনে দাগ কাটত। যদি কাউকে তার মনের লাভাস্রোতটা দেখাতে পারত! আগ্নেয়গিরির অগ্নোৎপাতের উৎসস্থলটা দেখাতে পারত! কারো কানে কানে এর খানিকটা শোনানো যেত! নাহ্ তেমন কেউ নেই সম্রাটের। তার কল্পনায় কেন যেন শুধু শ্রীময়ীর মুখটা ভেসে ওঠে বারেবারে। 

একদিন রাত্রে সম্রাটের বন্ধু অরিজিৎ এল চুপিচুপি। "শোন্ কালুদা একটা কাজ দিয়েছে করতে পারলে, মোটা বখশিস্, কেউ টের পাবে না" অরিজিৎ বলে।
"কিন্তু কাজটা কি "? জিজ্ঞেস করে সম্রাট ।
অরিজিৎ জানায় ,"স্টেশনে যে মালগাড়িটা দু'দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওর তিনটে বগির শাটার ভেঙে দিতে হবে!"
বাকি কাজ অন্যেরা করবে। খুব সাবধানে করতে হবে। একটু ভাবে সম্রাট। ঘোর কাটাতে সময় লাগে না বেশীক্ষণ । সমাজ তাকে কিছু দেয়নি। তাই তারও কোনো দায়বদ্ধতা নেই সমাজের প্রতি।
বেরিয়ে পড়ে সম্রাট অরিজিতের পিছু পিছু। মিশে যায় দুইজনে রাতের অন্ধকারে। 

একজন আর পি এফ টর্চ মেরে ওদের দিকেই আসছে। দুজনেই ট্রেনের তলায় ঢুকে লাইনের উপর শুয়ে পড়ল। আরপিএফের জওয়ান ওদের পাশ দিয়ে রেল লাইন বরাবর এগিয়ে চলল। ওরা আবার উঠে বেরিয়ে এল। খুব সাবধানে অল্পক্ষণের মধ্যেই কাজটা সেরে ফেলে দুইজন। অপারেশন সাকসেস্। মেসেজ পৌঁছে যায়। 

কালু মস্তানের খুব প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে সম্রাট অরিজিৎ অল্পদিনের মধ্যেই। সম্রাটের শিক্ষার মান অরিজিতের চেয়ে বেশী হওয়াতে কালু বেশি গুরুত্ব দেয় সম্রাটকে। 

তারিণী কাকা সম্রাটদের প্রতিবেশী। তেমন কোন আয় উপার্জন নেই। টোটো চালিয়ে সংসার চালায়। মাতৃহারা মেয়ে শ্রীময়ীর বারো ক্লাশের পর আর পড়া হয়নি । টিউশনি করে সংসারের বোঝা বইবার চেষ্টা করে। চোখের সামনে ছোট্ট শ্রীময়ী অপুষ্ট ব্রততীর মতো বেড়ে উঠল। সম্রাটের সেসব কথা খুব মনে পড়ে। বুকটা মোচড় দেয় মাঝে মাঝে। সম্রাট মনে মনে দুশ্চিন্তায় জড়িয়ে ফেলে নিজেকে, শ্রীময়ীর কি করে বিয়ে দেবে তারিণীকাকা! বড় অভাব যে বিপত্নীক তারিণীকাকার। শ্রীময়ীর মতো একটি মেয়ে যদি পাওয়া যেত। তবেই সেই হয়তো বিয়ে করে নিত। কিন্তু সে তো হবার নয়।  ওরা যে বড় হতশ্রী। সম্রাটদের চেয়ে অনেকটা দূরত্বে ওদের অবস্থান। দূর গ্রহের জীব। তাছাড়া সম্রাট ও তো ছন্নছাড়া। বাবা মা মানবে না। এলোমেলো হতে হতে ছিঁড়ে যায় চিন্তার রশি। 

শ্রীময়ীর হাবভাবে বোঝা যায় সেও সম্রাটকে কতখানি সমীহ করে। মান্যতা দেয়। দীঘির কালো জলের নীচে মাছ গুলো যেমন অস্পষ্ট ভঙ্গিমায় চলাচল করে, দিক পরিবর্তন করে, শ্রীময়ীকেও তেমনি ঝাপসা আবরণের আড়লে চঞ্চলা গতিমুখর মনে হয় সম্রাটের। ঝোড়ো বাতাস বাদলা মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো হঠাৎই সম্রাট ফিরে আসে আপনার মধ্যে। মা কোনদিন বিয়ের কথা তুললে ও শ্রীময়ীর নামটাই বলে দেবে মাকে। তাতে যা হবার হোক।ভাবনার প্রহেলিকায় জড়িয়ে ফেলে নিজেকে সম্রাট। 

সেদিন মাঝ রাতে সম্রাট দের বাড়ির সামনে একটা কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল ।  নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল সম্রাট ।  পিছনে ভারী বুটের শব্দ। 

তারিণী কাকার বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে ছিল। হয়তো গাড়ির  শব্দে জেগে গেছে এতক্ষণে। শ্রীময়ী ও হয়তো নিঃশব্দে অপলকে সবই দেখছে। আর হয়তো শ্বাস ফেলছে ঘনঘন। 

বাইরে থেকে পুলিশের তাড়া, তাড়াতাড়ি করুণ সম্রাটবাবু। দেরী করবেন না। 

সকালে খবরে কাগজে হেড লাইন, "এলাকার ত্রাস সম্রাট পুলিশের জালে"। বিস্তারিত খবরে  সবকিছু,  পুলিশের পাতা ফাঁদে সম্রাটের পুরো গ্যাং ধরা পড়েছে। 

দূরে দশটার ট্রেনটা হুইসল্ বাজিয়ে বেরিয়ে গেল।





* কেন এমন হলো *

কা ক লি ব সু

প্রৌঢ়ত্বের সমাপ্তি প্রায়।ঘোষিত হচ্ছে বার্ধক্যের আগমনী বার্তা। আজ পিয়ালীর আটাশতম বিবাহ বার্ষিকী।আনন্দ, আবেগ, বেদনা পিয়ালীকে কিছু লিখতে উদ্দীপিত করে।আজও ব‍্যাতিক্রম হলো না পিয়ালীর এই সহজাত স্বভাবের। হাতের কাছে টেনে নেয় খাতা কলম। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চোখে জল ভরে আসে পিয়ালীর।হাতের শিরা বেড়িয়ে গেছে।চোখের দৃষ্টিও বেশ ক্ষীণ।তবুও মনে করেছে যখন কিছু লিখবে তবে সে লিখবেই। চিরদিনের একটু জেদী স্বভাবের সে।

স্বামী পিনাকী।রাজ‍্য সরকারি কর্মচারী। শিক্ষা দপ্তরের।প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল পিনাকী আর পিয়ালীর। বলা যেতে পারে বাল‍্যপ্রেম।অনেক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে পরস্পরের প্রতি আস্হা ও বিশ্বাস নিয়ে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলো। মোটামুটি অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে পিয়ালী পিনাকীর প্লাস্টার খসে পড়া নোনা ধরা একতলা বাড়িতে। সামাজিক অনুষ্ঠান করেই বিয়ে হয়েছিল ওদের।
রাজ‍্য সরকারের করনিকের বেতন খুবই সামান্য। সেই সামান্য আয়েই আট জনের সংসার সামলাতো পিয়ালী।নিজেই অবাক হতো নিজের কথা ভেবে, যে মেয়ে চুলের ক্লিপ , হাতঘড়িটাও গুছিয়ে রাখতো না, মা বৌদিরা খাবার বেড়ে না দিলে খেতো না, সে কি করে পড়ছে সবদিক ঠিক মতো রক্ষা করে সংসার চালাতে।অবিবাহিত বড়ো ননদের হঠাৎই বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো পিয়ালী বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসার পর। "পয়মন্ত বৌ" বললো কেউ কেউ। বছর দেড়েক পরে জন্ম হলো পিনাকী পিয়ালীর ছেলে অর্কর। রুগ্ন ছেলেকে বড়ো কষ্ট করে বড়ো করে পিয়ালী। সংসারের প্রতি অত্যন্ত কর্মপরায়ণ পিনাকী পরিবারের একাধিক সদস‍্যের চাকুরী পড়াশোনা নিয়ে ঘুরে বেড়াতো রাজনৈতিক নেতাদের তৈল মর্দন করতে। একটু একটু করে বড়ো হতে থাকে ছেলে অর্ক। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি সে। স্বামীর তার প্রতি অনিচ্ছাকৃত কিছুটা উদাসীনতা তাকে কষ্ট দিলেও ছেলের সাফল্য পিয়ালীকে অক্সিজেন জোগাতো।

কালক্রমে বাবা, মা শ্বশুর শাশুড়ি বিদায় নিলেন।ছেলেও বড়ো হয়ে উঠেছে।ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত যখন তখন হঠাৎই একটি দুর্ঘটনায় কোমর ভেঙে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে পিয়ালী।পিনাকী ও অর্কর সেবা সুচিকিৎসকের সুচিকিৎসা ও ঈশ্বরের কৃপায় প্রায় পঙ্গু পা দুটোতে ভর করে দাঁড়াতে পারে সে। তবে একা চলতে পারেনা। কোনো একজন না হলে চলতে ভয় পায়। কারন ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেনা প্রায়সই। B tech M tech complete করে ছেলে চাকরি করছে। অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। একটু একটু করে বাড়ি ঘরের সংস্কারের চেষ্টা করছে পিনাকী। কিন্ত্ত অতর্কিত আক্রমণে আক্রান্ত হলো পিনাকী। তারই ছোটোভাই বিনা প্ররোচনায় গায়ে হাত তুললো পিনাকীর।স্ত্রী পিয়ালী বাধা দিতে যাওয়ায় তাকেও ছাড়লো না দেওর। গায়ে হাত তুললো বৌদির। মেয়ে বৌ এসেও মারলো পিয়ালীকে। তবুও লোকলজ্জার ভয়ে পরিবারের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে থানা পুলিশ করেনি তারা।
   আটাশ বছরের ত‍্যাগের পরিনাম এমন হবে বোঝেনি পিয়ালী। বাপের বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় দাদাদের কানে কথা যায়। কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র দাদারা কিছুই বলেনি।কোনো অভিযোগো নয়।উপদেশ দেয় নীরবে সহ‍্য করার। ওতে আরো কষ্ট পায় সে। 

তবে মনে মনে গর্ব না করে পারেনা। নিজেকে রত্নগর্ভা মনে করে সে। কারন ছাব্বিশ বছরের তরতাজা যুবক পুত্র বড়োদের মার খেতে দেখেও মাথ ঠান্ডা রাখে। অনুরোধ করে তার মাকে যেন না মারে। মাথায় ঘুষি মারাতে মাথা ঘুরে পড়ে যায় পিনাকী।চশমার কাচ ভেঙ্গে যায় তবুও ছেলে একবার মাকে আগলে ধরে একবার বাবাকে একবার সাতষট্টি বছরের বৃদ্ধ জ‍্যেঠুকে।হাতজোড় করে অনুরোধ করে কাকুকে বারংবার।যদিও অনুরোধে নিষ্ফল।তবুও করোনার করুণায় ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর প্রাপ্ত খুড়তুতো বোনের শিক্ষা বেশী হলেও ব‍্যাবহারিক শিক্ষা শূন্য। কিন্তু সারা জীবন যুদ্ধ করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা পিয়ালী ছেলেকে সুস্থ শিক্ষা দিতে পেরেছে।এখানেই হয়তো সে জয়ী।





* কথা দিলাম আবার আসবো *
 
মা লা চ্যা টা র্জ্জি

ঘুমটা কাকভোরেই ভেঙে গেল সঞ্চয়িতার। মনে মনে ভাবল এত সকালে ঘুম ভাঙলেও উঠবো না। আজ রবিবার। ছুটির দিন। অফিসে যাওয়ার ব্যাপার তো নেই। কমলামাসি আসবে সাড়ে
ছটায়। এসে হাত-পা সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ পাল্টে এবাড়িতে রাখা তার
জামাকাপড় পরবে। সঞ্চয়িতার রান্নার মাসি কাজ
 করার আগে হাত-পা সাবান দিয়ে ধুয়ে তার দেওয়া জামাকাপড় পরে রান্নাঘরে ঢুকবে এটাই পছন্দ। রোজ তাই করে কমলামাসি।

আজও তার অন্যথা হলো না। ঠিক সাড়ে ছটার
সময় এসে হাত-পা সাবান দিয়ে ধুয়ে জামাকাপড় 
পাল্টে চা করতে রান্নাঘরে ঢোকে। চা করতে করতে
বলে, "বৌদি, চা হয়ে গেছে ওঠো।" সঞ্চয়িতার স্বামী সুজন বারোমাস বেড টি খেতে ভালোবাসে। তাই নিজে চা খাওয়ার পর সুজনের চা সঞ্চয়িতাই
দিয়ে আসে বেডসাইড টেবিলে। শুধু তাই নয় ছুটির
দিনে পাশের ঘরে ছেলে অর্ককেও চা খেতে ডেকে
তোলে। অর্ক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে 
অনার্স নিয়ে বি এস সি পড়ছে। পড়াশোনায় তুখোড়।

আজ নিজে সকালের চা খেয়ে প্রথমে অর্ক তারপর
স্বামী সুজনকে চা দিতে যায় সঞ্চয়িতা। সুজন চোখ মেলে বলে, “গিন্নি, তোমার নিয়ে আসা চায়ের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করি জানো। আহা! হাতের ছোঁয়াই যে আলাদা।"
মুচকি হেসে সঞ্চয়িতা বলে,“বুড়ো বয়সে ভীমরতি 
ধরেছে। ছেলে বড় হয়েছে খেয়াল আছে।" তারপরেই বলে, “এই যে মশাই চা খেয়ে বাজারে যাও। আজ রবিবার। তপুর মাংসের দোকানে প্রচন্ড ভীড় হয়ে যাবে। লাইনের শেষে দাঁড়াবে
গিয়ে। ভালো মাংস পাবে না। কতগুলো হাড়গোড় জুটবে। তপুর পাঠার মাংসের দোকানের বেশ নাম
আছে যাদবপুরে রিজেন্টপার্কে। “বেশ, বেশ তোমার হুকুম মেনে নিলাম মহারানী।” কথাগুলি বলে চা খাওয়া শেষ করে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডের কর্পোরেশনের বাজারে পায়ে চটি গলিয়ে রওনা দেয় সুজন।

সেই সময়ই বাড়ির ল্যান্ডফোন বেজে উঠলো। 
বাজারে সুজন কোনদিনই মুঠোফোন নিয়ে যায় না
খুব অস্বস্তি লাগে তার। রান্নাঘরে কমলামাসিকে
লুচি আর সাদা আলুর তরকারী করতে বলে
খবরের কাগজে মনোনিবেশ করেছিল সঞ্চয়িতা। কাগজ সরিয়ে উঠে গিয়ে ল্যান্ডফোন ধরতেই সঞ্চয়িতার বড়দাদার গলা কানে এল, “দাদা বলল, সুজনকে একটু দে তো , জরুরী কথা আছে।”
“ও বাজারে গেছে। কী ব্যাপার রে?” জিজ্ঞাসা
করে সঞ্চয়িতা। 
একটু আমতা আমতা করে বড়দা অনীক বলে, “জানিস আজ ভোর ছটায় বড়দির ছেলে অলোক মারা গেছে।”
কীভাবে? গতমাসে তো আমার বাড়িতে বেড়াতে
এসেছিল। শনিবার সন্ধ্যের সময় এসে রবিবার বিকেলে চলে গিয়েছিল। বড়দি,বড় জামাই বাবুর এই বয়সে সন্তান শোক।” কথাগুলি এক নিঃশ্বাসে বলে চুপ করে থাকে সঞ্চয়িতা।

মনে মনে ভাবে অলোক তার থেকে ছ‘বছরের ছোট। তার এখন চুয়াল্লিশ বছর চলছে, অলোকের আটত্রিশ। ওকে নিয়ে বড়দির কম জ্বালা ছিলনা। পড়াশোনা একদম করতে চাইতো না। কোনভাবে ঘষ্টে ঘষ্টে স্কুলের গন্ডী পেরিয়েছে। এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করছিল। কি কাজ যে
করে, ভগবান জানে। বড়দি বলেছিল,“অলোক,
দুম করে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছে রূপা। 
শুনেছি, ওদের নাকি একবছর ধরে প্রেম ছিল। 
মেয়েটার বাবা জমির দালালি করে। ওর বন্ধুর বোন। বৌভাত করে আর লোকজন খাওয়াবো না। টাকাটা ওর নামে ব্যাঙ্কে রেখে দেবো, যাতে ভবিষ্যতে 
কোনো কাজে লাগে। আমার ছেলে তো অকালকুষ্মাণ্ড।”

সাত মেয়ের পর এই এক ছেলে বড়দির। তার ভাগ্য
দেখে সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল সঞ্চয়িতার মানে
রূপার। বাপের বাড়ির লোকেরা তাকে রূপা নামেই
ডাকে। মনে মনে ভেবেছিল সে বড়দির বাড়ি উলুবেড়িয়াতে গিয়ে অলোকের বৌকে দেখে
আশীর্বাদ করে আসবে।একজোড়া সোনার ঝুমকো
কিনেছিল বৌকে দেবে বলে কিন্তু নানা ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়াতে দুবছরেও অলোকের বৌকে দেখতে যাওয়া হয়নি। শেষে গতমাসে অলোক বৌ নমিতাকে নিয়ে এসেছিল। সাথে কোলের
একটা বাচ্চা। বড়দির ফোনে সঞ্চয়িতা অবশ্য শুনেছিল ওদের একটা ছেলে হয়েছে জুন মাসে। তবে নমিতাকে দেখে খারাপ লাগেনি সঞ্চয়িতার। রঙ ফর্সা না হলেও মুখশ্রীটায় একটা লালিত্য আছে। চলনেবলনেও শান্ত, বিনীত হাবভাব। তবে খুব রোগা। ডিগডিগে। কোলের ছেলেটাও মা‘র মতো খুব রোগা।

তার বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলেছিল, “আমরা
এসে গেছি ছোটমাসি। তোমাকে দেখাতে এনেছি
আমার বৌ আর বাচ্চাকে। কাল বিকেলে চলে
যাব।” তখন সবেমাত্র অফিস থেকে এসেছিল সঞ্চয়িতা। 
কমলা মাসিও দেশের বাড়িতে গেছে পাঁচ দিনের জন্য। রান্নাবান্না করে অফিসে যেতে হতো সঞ্চয়িতাকে। ঠিকে কাজের লোক তো শুধু ঘরমুছে বাসন মেজে দিয়ে যেতো। একটু বিরক্তই হয়েছিল সেই সময় অলোকদের সপরিবারে দেখে। তবুও তেতো গেলা মুখে হেসে বলেছিল, “আয়, আয় মাসির বাড়ি, আসবি না তো কোথায় আসবি। 
তোর বৌ, বাচ্চাকে তো দেখতে যেতেই পারলাম
না। আসলি কত ভালো লাগছে বলতো।”

সেদিন রাতটা থেকে পরের দিন রবিবার খেয়েদেয়ে
বিকেলে চলে গিয়েছিল অলোকরা। নমিতা বেশ
কাজের মেয়ে। ছেলেটাকে অলকের কাছে দিয়ে
হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে সঞ্চয়িতার
রান্নার কাজে সাহায্য করেছিল। শুধু রান্নায় নয়,
খেতে দেবার সময়ও হাত লাগিয়েছিল। অলোকের
বউটাকে বেশ ভালোই লেগেছিল সঞ্চয়িতার। 
ওরা চলে যাবার আগে সোনার ঝুমকো দুল নমিতার
হাতে তুলে দিয়েছিল। বাচ্চাটাকেও দু‘হাজার টাকা
আশীর্বাদস্বরূপ দিয়েছিল। 
“আবার সময় সুযোগ করে আসিস তোরা” সঞ্চয়িতা একথা বললে পরে নমিতা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। অলোক হা হা করে হেসে বলেছিল,
“কথা দিলাম আবার আসবো।”সেই কথাগুলি মনে পড়ে হু হু করে ওঠে বুকটা
সঞ্চয়িতার। কখন যে চোখের জলে গাল বুক ভেসে যায় খেয়াল থাকে না। সম্বিত ফেরে অর্কর ডাকে “মা তুমি কাঁদছো কেন?” সুজনও বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতেই বৌ-এর নীরব কান্না দেখে অবাক হয়ে যায়!
বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে “কী হেয়েছে রূপা?” তার কথায় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সঞ্চয়িতা। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “অলোক আজ ভোরে মারা গেছে। আমি যাবো ওকে শেষ দেখা একবার দেখতে। ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে
বলো।" 
“কী হয়েছিল ওর?” হতবাক্ সুজন প্রশ্ন করে সঞ্চয়িতাকে। “জানিনা, বড়দার কাছে খবরটা শুনেই আমার হাত-পা কাঁপছিল। আর দেরি করবোনা ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বার করতে।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সঞ্চয়িতা। 
“শুধু তুমি নয়, আমিও যাবো রূপা তৈরি হয়ে নাও।”
কথাগুলি বলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সুজন। সঞ্চয়িতাও কোনরকমে পোষাক পাল্টে উদাসচোখে
গাড়িতে বসে। হু হু করে গাড়ি ছুটে চলে উলুবেড়িয়ার দিকে। যেতে যেতে সঞ্চয়িতার মনে হয়, মানুষের জীবন কি অনিত্য!পদ্মপাতায় জলের মতো। 
বড়দির বাড়িতে তারা যখন গিয়ে পৌঁছায় তখন মহাপ্রস্থানের গাড়ি এসে গেছে। অলোকের নিথর
দেহ তাতে তোলার পরে সঞ্চয়িতা দেখে গাড়ির
পেছনে লেখা আছে 
 “কথা দিলাম আবার আসবো।”





* উত্তরাধিকার *

স র্বা ণী রি ঙ্কু গো স্বা মী

গলাটা যে বশে নেই আগের মত তা তন্ময় বিলক্ষণ বুঝেছে, আগেরদিন ফাংশনে চড়ায় তুলতে গিয়ে বেইজ্জত। যে সব গানগুলো এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে এবং একদা তাকে নক্ষত্র করেছিল, সে একলাইন গাইলে জনতা গেয়ে দেয় পরের দশলাইন। এই কায়দাটা কাল মোক্ষম কাজে লেগেছে, যখন টানতে পারেনি, মাউথপিস ঘুরিয়েছে অডিয়েন্সের দিকে। ব্যস, শ্রোতারাও খুশি সেও নিশ্চিন্ত।

মাচা ছাড়া গতি কি আর, তাও তো ন মাসে ছ মাসে একটা দুটো। নতুন ছবিটবি নেই, কাজেই প্লেব্যাকের যোগাযোগ ও শূন্য। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল গেয়ে কি পেট ভরে না এক নম্বর গায়কের স্ট্যাটাস রাখা যায়! লকডাউনের দুটো বছর তন্ময়কেও ভাতে মেরেছে। কোনক্রমে এক দুটো ডাক আসে যারা নিতান্তই বেহায়া অসাবধান সে রকম কর্মকর্তাদের থেকে নইলে আজকাল তো জনসমাগম মানেই শাস্তির খাঁড়া।

খরচটা এতো বাড়তো না যদি অনুরাধা থাকতো, ও খুব সংসারী হিসেবী মেয়ে ছিলো। অল্প কিছুতেই সন্তুষ্ট থাকতো, চাহিদাও তেমন ছিল না। বরং চাহিদাটা ছিল তন্ময়েরই, খ্যাতির মধ্যগগনে উঠে ওর হঠাৎ অনুরাধাকে মনে হয়েছিল বড্ড সাদামাটা, চারপাশে তখন অজস্র প্রজাপতির ওড়াউড়ি, এক-সে-বড়কর-এক সুন্দরী হাতের মুঠোয়। অতএব কিছু জরিমানা দিয়ে সপুত্র অনুরাধাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলো। উকিলকে মোটা টাকা দিয়ে ব্যাপারটা সহজে মিটেছিল তার আরেকটা কারণ চিরকালের অভিমানী অনুরাধা কোনো প্রতিরোধ করেনি। ছেলে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অস্ফুটে খালি বলেছিল, "আসছি, ভালো থেকো!"

নাহ্, ভালো থাকা তন্ময়ের আর হয়নি। পরপর প্রজাপতি এসেছে গেছে পয়সা সুবিধা নাম লুঠ হয়েছে নির্বিচারে, শান্তি আসেনি। গানের থেকে বেশি স্ক্যান্ডালের জন্য লোকে জেনেছে তন্ময়ের নাম, মুচমুচে কেচ্ছা আলোচনায় এসেছে কিন্তু নতুন একটা মনে রাখার মত গান আর তন্ময় গাইতে পারেনি। অগত্যা ঐ পুরোনো গান ই অনুরোধ করেছে লোক, দশবছর বা তারও আগের যা তন্ময়কে জনপ্রিয় করেছিল। তারপর নতুন নতুন ঝকঝকে গলার দাপটে ও খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছে তন্ময়, যা সাধারণত এইসব লাইনে হয়। তবু টুকটাক করে চলছিল, হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত ....লকডাউন।

আজকের ফাংশনে তাই তন্ময় আলতো করে গাইতে শুরু করেছে, খানিকটা হালকা চালে। গাইছে কথা বলছে আবার দু'লাইন গাইছে সামনের রো-এ বসা মহিলার শাড়ীর প্রশংসা কিম্বা কারুর হাসির। এতে খানিকটা জনসংযোগ বাড়ে আর দমও পাওয়া যায়, চট করে চড়ায় তুলতে হয়না গলা। এ কায়দাটা ব্রজদার থেকে শেখা, একসময় ব্রজদা সেরা কিশোরকন্ঠ ছিল সিজনে দম ফেলতে পারতো না। ভালোই চালাচ্ছিলো তন্ময়, পাবলিক খাচ্ছিল ভালোই হঠাৎ কাশি। দমকে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, রুমাল মুখের সামনে আনতে কয়েক ফোঁটা রক্ত। চোখে অন্ধকার দেখছে তন্ময়, একটা চেয়ার এনে বসিয়ে দিলো কেউ, একগ্লাস জল এগিয়ে দিলো আরেকটা হাত।

তন্ময়ের আধখানা গানটা গাইতে গাইতে উঠে আসছে কেউ স্টেজে, হাততালিতে ফেটে পড়ছে জনতা। তন্ময় আবছা দেখছে দুটো কচি কচি হাত উল্টো দিক থেকে হারমোনিয়ামের বেলো ঠেলছে, একটা কচি গলা বলছে "আম্মো গাইবো বাবা!"
স্বপ্ন না সত্যি কে জানে , মাইক ধরে যে ঝকঝকে তরুন সে কি তন্ময়ের যৌবন না তার উত্তরাধিকার !





* ওখানে কে *

স ঞ্জ য় বি শ্বা স

   রাহুল অরন্যাল্ড, --রোজি আর তার ১৭ বছরের ছেলে রোহনকে সঙ্গে নিয়ে গতকালই বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। বান্দ্রায় তাঁদের ঝা চকচকে ফ্লাট থাকা সত্ত্বেও পুরনো বাগান বাড়িতে কিছুদিন কাটাবে বলে আগেই বায়না করে বসে রোজি। রাহুলের তাতে অবশ্য খানিকটা আপত্তি ছিল প্রথমটায়। কারণ বেশ কয়েকবার ঐ পুরাতন বাড়িটায় কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে বলে তার শোনা,---যা রোজি এবং রোহন কেউই জানতো না। তাই ঐ বাড়িতে থাকাটা রাহুল খুব একটা পছন্দ করতো না। কিন্তু সে সব বহু পুরনো দিনের কথা; তাছাড়া অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে,- আর রাহুলও নিজের চোখে তেমন কিছুই দেখেনি কোনদিন। সবইটাই তার শোনা কথা, তাছাড়া নিজের জন্মভিটের প্রতি টানও তাকে খানিকটা হলেও রাজি করিয়েছিল। তাই রোজির প্রস্তাবে আর বাঁধ সাধেনি সে।

বিয়ের দুমাস পর একবার এই বাড়িতে একদিনের জন্য এসেছিল রোজি। তারপর বিদেশ। ছেলের জন্মও ওখানে।মোটকথা রোজির দারুণ পছন্দ তার ঐ বাড়িটা।
বাড়িটা ছিল বহু পুরনো সেকেলে মডেলের। চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।ভেতরে গাছপালায় ভর্তি। বেশ বড় বড় গাছ; ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশ। পেছন দিকটায় পুরো ঘন জঙ্গল। বিশাল এলাকা নিয়ে বাড়ি। 

বাড়িতে থাকার মধ্যে একটি মাত্র প্রাণী--তাদের পুরনো চাকর সিঁধু সামরাই। সামরাইয়ের বয়স তা এখন এখন প্রায় ৭০ ছুঁই ছুঁই। মনিব আসবেন শুনে সব মোটামুটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তিনি। 

রাতে তারা একসাথে ডিনার সেরেছে। ---"গুড নাইট " জানিয়ে রোহন চলে যায় ওর বন্ধুর ফ্লাটে। এমন বাড়িতে রাত কাটানো তার পক্ষে অন্তত অসম্ভব।

সিঁধু সামরইকে রাতে বাইরের সব আলো জ্বালিয়ে রাখতে বললেন -- রাহুল। মনিবের কথা মতো সব আলো জ্বালিয়ে রেখে নীচে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় সিঁধু।

---- সেরাতে বেশ ভালো ঘুম হয়েছিল রোজির। সকালে ফ্রেস মুডে ব্রেকফাস্ট সেরে রাহুল একটা বিশেষ কাজে বেরিয়ে যায়। রাহুল বলে যায়--"তার ফিরতে রাত হতে পারে''.....

একটু পরেই সিঁধুকে ডাকলেন রোজি-----সিঁধু বলে--- " কিছু বলবেন মা?" 
রোজি বললেন--- "আচ্ছা, সিঁধু কাকা--- দোতলার ঐ কোনার ঘরটা এভাবে বন্ধ কেন?? ওটা কি বন্ধই থাকে?? ওর কোন চাবিটাবি নেই?? কি আছে ঐ ঘরে, জানো কিছু তুমি?? আর ছাদটাই বা তালাবন্ধ কেন?? 
......দেখে তো মনে হচ্ছে কস্মিনকালেও কেউ ছাদে পা রাখেনি। সেকেলে এত্তোবড় একটা তালা ঝোলানো! তুমিও বুঝি যাওটাও না ছাদে???"
 
সিঁধু বলে,--- আমি ওটা কোনদিন খুলতে দেখিনি মা। তবে যদ্দূর শুনেছি বড় সাহেব থাকতেন ওই ঘরে। বড় সাহেব মানে -- রাহুলের দাদু পিটার অরন্যাল্ড। আমি অবশ্য তিনাকে কোনদিন দেখিনি। বড় সাহেব মারা যাওয়ার পর আর নাকি ওই ঘর কোনদিন খোলা হয়নি। 
এই বাড়িতে আমি চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই আছি। আমাদের ছোট সাহেব -- মানে তোমার শ্বশুর মশাই-- রাসেল অরন্যাল্ডও ঐ ঘরটা কোনদিনই খুলতেন না।...... জানি না কি আছে ঐ ঘরে??
আর চাবিটাবিও আছে কিনা আমার জানা নেই মা---আর আমি বুড়ো মানুষ ছাদেটাদেও উঠতে পারি না। তাই ওটা বন্ধই থাকে। তবে মা--- একটা কথা বলি-- ঐ ঘরটা না খোলাই ভালো।"

--- দোতলার দুটো রুম বাদ দিলে বাকী যে তিনটে বড় রুম সেগুলোও ভীষণ নোংরা হয়ে পড়ে আছে। তালাবন্ধ থাকায় সেগুলো এখন পোকামাকড়, মাকড়সা আর চামচিকেদের দখলে।

---- "ঠিক আছে কাকাবাবু তুমি এখন এসো।......পরে ডাকলে এসো একবার।"
"ঠিক আছে--- মা.... " বলে সিঁধু নীচে চলে গেলেন।

রোজির যেন কৌতুহলটা আরও বেড়ে গেল। কি আছে ঐ ঘরে......জানতে হবে!

এক বিস্ময় নিয়ে, দুপুরে, --- রোজি তালাবন্ধ ঘরের দিকে গেল। চুপিচুপি তালাটা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো। কিন্তু দরজা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকতে তার ভয়ও লাগছে। চারদিক শুনশান। এদিকে রাহুলও বাড়িতে নেই।

যাই হোক-- বেশ ভয়ে ভয়ে ঘরের একটা কপাট খুললো ...ভেতরটা কিচ্ছু দেখা যায় না। ঘুটঘুটে অন্ধকার; নোংরা আবর্জনা আর মাকড়সার জালে যেন জতুগৃহ, চারদিকে ধূলোবালি ভর্তি; ----হঠাৎ শোঁ করে তার কানের কাছে দিয়ে একটা কালো পাখির মতো কি যেন বেরিয়ে গেল, আচম্বিত বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো রোজির। তারপর আস্তে আস্তে ভেতরের পা রাখতেই কেমন যেন একটা বিদঘুটে গন্ধ তার নাকে আসতে লাগলো। --- বামদিকে চোখ রাখতেই দেখতে পায় বড় বড় দুটো কাঠের বাক্স। আর তার পাশেই ছোট একটা ভাঙ্গাচোরা টিনের বাক্স--- ধূলোবালি আর ঝুলকালি জাল সরিয়ে রোজি ঐ ছোট বাক্সটার কাছে যায়--- কিন্তু সেটাও তালাবন্ধ। হাতুড়িটা দিয়ে বাক্সের তালা ভেঙ্গে দেয় রোজি---- আস্তে আস্তে বাক্সটা খোলে। --- বাক্সটা খুলতেই দেখে কতগুলো পুরনো ওয়ার্ল্ড ম্যাপ, কিছু ফটোকপি, দুটো বাঁধানো ফটো, কয়েকটা কলম, আর একটা জীর্ণপ্রায় ছেঁড়া ডায়েরি-----ওদিকে বন্ধ ঘর আর ধুলোবালিতে রোজির দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি করে ধূলোবালি ঝেড়ে ডায়েরি আর একটা ফটো নিয়ে রোজি বাইরে চলে আসে। ভয়ে গা হাতপা কাঁপছে তখনও রোজির। ঘরের দরজাটা কোন রকমে বন্ধ করে দেয় সে। বাইরে আসতেই যেন দম ফিরে পায় সে।

নিজের রুমে গিয়ে তোশক উঁচু করে ফটোটা লুকিয়ে রাখে সে। ডায়েরির ওপরে চোখ বুলোতেই দেখে আবছা লাল কালিতে লেখা রয়েছে ----- -- lost of myself..

.....তখনকার মতো ধুলো ঝেড়ে ডায়েরিটাও লুকিয়ে রেখে দেয় সে।

.... রাতে রাহুল ফিরলে কোন কথাই জানায়নি তাকে। ডিনার শেষ হলে রাহুল রীতিমতো শুতে চলে যায়---- 
রোজির মাথায় তখন ঘুরছে ঐ "ডায়েরি"..... কি লেখা আছে ওতে??
   
পরদিন দুপুরে রাহুল ঘুমোলে একান্তে রোজি ডায়েরি পাতা উল্টে পড়তে থাকে ----

রাহুলের গ্রান্ডফাদার পিটার অরন্যান্ড লিখছেন----

"রাসেল তখন খুব ছোট। আমরা হেগ শহরে থাকতাম। রাসেলের দিদি শেলি অরন্যাল্ড ওর থেকে তিন বছরের বড়। আমি তখন মার্চেন্ট নেভিতে চাকরি করি। চার জনের বেশ সুখের সংসার ছিল আমাদের।
আমার স্ত্রী মরিয়ম অরন্যাল্ড আমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতো। বছরের পর বছর আমাকে বিদেশে কাটাতে হতো। রাসেল আমার সাথে বিদেশে যাওয়ার জন্য ভীষণ বায়না করতো। কিন্তু তখন ও খুব ছোটো। সেবার আমাদের শিপ ইন্ডিয়াতে আসার কথা ছিল--- রাসেলও বায়না জুড়লো। স্ত্রী মরিয়মও বললো---"ওকে নিয়েই যাও এবার" -- রাসেল ছিল ওর মায়ের নয়নের মনি। ঠিক করি রাসেলকে নিয়েই ইন্ডিয়াতে যাব। ....... রাসেলকে নিয়ে বেশ খুশি মনে ইন্ডিয়াতে পৌঁছাই;
ইন্ডিয়াটা রাসেলের ভীষণ ভালোও লেগে যায়---- গোয়ার আশেপাশের সাইডসিনগুলো ওকে ঘুরিয়ে দেখাই। .... সেদিন বিকালে আমি আর রাসেল সি বীচে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম--- সন্ধ্যার একটু আগে ফেরার সময় আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে। আমার জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে ... ছেলেকে দেখতে না পেয়ে, আমি আমার ছেলের জন্য চিৎকার করে উঠি---

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় একা আপনাকে উদ্ধার করে কারা যেন এখানে ভর্তি করে গেছে। আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল না....

একটু সুস্থ হতেই আমি বিভিন্ন জায়গায় রাসেলকে খুঁজতে থাকি। এদিকে শীপ ফেরার অর্ডার আসে। এক বুক হতাশা নিয়ে রাসেলকে হারিয়ে ফিরে যাই দেশে---- ছেলে হারানোর শোক সহ্য করতে পারেনা মরিয়ম, শুনেই অজ্ঞান হয়ে যায়-- হুঁশ ফিরতেই তার একটাই কথা--- "আই ওয়ান্ট মাই সন"। ভেঙ্গে পড়ে শেলিও।

তার একবছর পর--- মরিয়ম ও শেলিকে নিয়ে আমি ইন্ডিয়ার দিকে রওনা হই রাসেলকে খুঁজতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। জাহাজ ডুবিতে সেবার মরিয়ম ও শেলিকে হারিয়েছিলাম। কোন মতে আমি বেঁচে যাই---
স্ত্রী পুত্র কন্যা সকলকে হারিয়ে তখন আমি টোটালি ডিপ্রেসড। কি করবো কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শেষাবধি ভারতেই থেকে গেলাম রাসেলকে খুঁজে বের করার জন্য। আমার বার বার মনে হতো রাসেল বেঁচে আছে......শুরু হলো জীবন যুদ্ধ --- একদিকে রাসেলকে খুঁজে বের করা আর অন্য দিকে চাকরি খুইয়ে নতুন কাজের সন্ধান করা। কাজ পেতে অবশ্য তেমন দেরী হয়নি আমার। 
রাসেলকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে রোজ ঘরে ফিরে কাঁদতাম একা একা বসে। নিঃসঙ্গ জীবন আর চলছিল না। একটা সময় হতাশ হয়ে রাসেলের চিন্তা মাথা থেকে দূর করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারিনি.....

 এই ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে আমায় সবচেয়ে বেশি হেল্প করেছিল আমারই অফিস কলিগ তানিয়া।জীবনের স্রোতে ফিরতে দ্বিতীয়বার বিয়ে করলাম তানিয়াকে। কাজের জায়গাতেই আলাপ ওর সঙ্গে। তানিয়াও আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো।

 ------কোনদিন ভাবিনি রাসেলকে আর ফিরে পাবো। একটা সময় আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস--ছয় বছর পর ছেলেকে ফিরে পেলাম। আর সেখানেই বিপত্তির সূচনা।রাসেল তখন ১১ বছরের। রাসেল কেমন যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। --- যে ছেলে আমায় ছাড়া থাকতে পারতো না এক মূহুর্ত, সে যেন আজ আমাকে চিনতেই পারে না।
সারাদিন চুপচাপ থাকতো। দেখে মনে হতো-- সে যেন টোটালি ডিপ্রেসড একটা জীবন্ত লাশ। আর সেটা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

--- রাসেল তার নতুন মা তানিয়াকে কোনদিনই মেনে নিতে পারেনি। আর তানিয়াও জানতো না কোনদিন রাসেল ফিরে আসবে। সেও রাসেলকে মানতে পারতো না।
রাসেলের জন্য তানিয়ার জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।

 রাসেলের আজীবন মনে হয়েছিল আমি তার মা মরিয়ম ও বোন শেলিকে খুন করেছি। আর এর পেছনে রয়েছে তানিয়ার হাত।

তাই কোনদিন সে আমাকে ও তানিয়াকে মেনে নিতে পারেনি। একটা সময় আমিই হয়ে উঠেছিলাম তার সবচেয়ে বড় পথের কাঁটা।
আস্তে আস্তে সমস্যা আরও বাড়তে থাকে-- রাসেল নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো সারাক্ষণ---তার জীবন ধারাও পাল্টে যেতে থাকে----আস্তে আস্তে মিশে যেতে থাকে অপরাধ জগতের সাথে----

এখানেই শেষ হয় ডায়েরিটা।
মনে হয় কয়েকটা পাতা ছেঁড়া তারপর....

রোজির মনে বিভিন্ন প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে---- সে তার শ্বশুর রাসেল অরন্যাল্ড সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতো না। আজ কেন জানি না তার শ্বশুর সম্পর্কে খুব জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। কিন্তু কিভাবে জানবে----তাহলে কার কাছ থেকে জানা যাবে?
হঠাৎই মনে হলো--- সিঁধু কাকার কথা!

পরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হলে--- সিঁধু কাকাকে রোজি ডাকলেন---- 

সিঁধু এসে বললেন--- "কিছু বলবে মা???"
"হ্যাঁ কাকা ----- এদিকে এসো একবার। তোমার সাথে কিছু কথা আছে। আচ্ছা কাকা,----- আমার শ্বশুরমশাই সম্পর্কে কি জানো তুমি??? আমাকে একটু বলবে প্লিজ। আর একটা কথা -- রাহুলকে এ বিষয়ে কিছু বোলো না-- কাকা।"

সিঁধু বললেন--- "ছোট সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় সাহেব বিয়ে করার দুবছর পরে"--- রাহুল তখন এক বছরের।তার আগের তেমন কিছুই জানা নেই। যতদূর শুনেছি--- বড় সাহেব পিটার অরন্যাল্ড ও ওনার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নাকি ছোট সাহেবই খুন করেছিলেন এই বাড়িতে।
তবে মা---- এটা আমার শোনা কথা। আর পিটার সাহেব নাকি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তবে ছোট সাহেব খুব রাগী ও জেদী ছিলেন, কম কথা বলতেন । আমি ছোট সাহেবের মুখ দেখিনি কোনদিন। মহিলাদের ওপর ওনার ভীষণ ঘৃণা ছিল। আপনার শাশুড়ীমাকে বাইরে পর্যন্ত আসতে দিতেন না। রাহুলের বয়স যখন এক বছর তখন একদিন রাহুল খুব কাঁদছে---- খুব চিৎকার করে কাঁদছে; আমার যেহেতু উপরে ওঠা নিষেধ ছিল তাই বুঝতেও পারছিলাম না কেন কাঁদছে। অনেকটা সময় কাঁদতে দেখে আমি সাহেবকে--- ডাকি। ছোট সাহেবকেও ডাকি----
বার বার ডেকেও কোন সাড়া পাইনি---- তারপর ছুটে ওপরে যাই---- গিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় দুজনে পড়ে রয়েছে----দু'জনের চোখ উপড়ানো। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। চিৎকার করে সবাইকে ডাকি--- তারপর পুলিশও আসে।

রাহুলকে কোলে নিয়ে নীচে নেমে আসি----
তার পর বহু ঝড় বয়ে গেছে....আমার ওপর দিয়েও। ---এখনও সেই হত্যার কিনারা হয়নি। তাদের দুটো চোখই উপড়ে নেওয়া হয়। অথচ শরীরে কোন ক্ষতচিহ্ন ছিল না।
পুলিশ আজও সেই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
তখন থেকেই এই বাড়িতে থেকে গেছি। রাহুলের দেখাশোনা করতেন তার বাবার এক বন্ধু। তারপর তো তুমি সবই জানো......"

 "তুমি এখন এসো কাকা........."-------"আচ্ছা মা! সাবধানে থেকো।"
রোজির মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগলো........কাকা আজ সাবধানে থাকতে বললো কেন?? তাহলে কি কাকা গোপন কিছু জানেন --! যা আমায় বলেন নি!
তৎক্ষনাৎ চুপচাপ বসে রইলো....রোজি। রাহুল বিকেলে বাইরে যেতেই---
রোজি আবার সেই বন্ধ ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো---- কাঠের বড় বড় যে বাক্সদুটি, তার দিকেই এগিয়ে গেল। কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো ছিল দুটো বাক্সই। কাছে গিয়ে তাতে হাত দিতেই -- কাপড় খুলে পড়লো---রোজির গায়ের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।  
--- সারা ঘরে একটা বিকট আওয়াজ হতে শুরু করলো। বাক্সটা খুলতেই রোজির চক্ষু চড়কগাছ।  
একী! মুন্ডবিহীন দুটি বিভৎস নরকঙ্কাল শায়িত! ছিটকে পেছনে সরে যায় রোজি----
গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার। পা নড়ানোর শক্তি নেই। পাশেই দুটো লাল পুটুলি। আস্তে আস্তে পুটুলির দুটির দিকে এগিয়ে যায় রোজি--- গা ভারী হতে থাকে তার--- 

একটি পুটুলিতে হাত দিতেই-- কে যেন মনে হচ্ছে তার হাত চেপে ধরলো। আর কে যেন তার গলা চেপে ধরেছে-- --- দাপাদাপি করে সে লাল পুটুলিটা খুলে ফেলে-- ---- পুটুলিটা খুলতেই দেখে নর মস্তকের কঙ্কাল। বিকট বিদঘুটে দেখতে--- মনে হয় তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।.......
 এক পলক দেখে ওখানেই জ্ঞান হারায় রোজি--- খানিক পরে জ্ঞান ফিরতেই একটা গোঙানোর আওয়াজ ভেসে আছে তার কানে। রোজি কান পেতে শুনতে লাগলো আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে--- 

এদিকে পা বাড়াবে তার সাহস নেই। কালো সেই পাখিটা সারা ঘরে দাপাদাপি করছে তখনও। হঠাৎ আওয়াজটা থেমে গেল।
রোজি কোনমতে এক পা দু' পা করে হাতড়ে হাতড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।---- চুপচাপ দাঁড়িয়ে রোজি। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে বাইরে।

মনে হচ্ছে ছাদের ওপর কারোর পায়ের আওয়াজ -----কেউ ঘোরাঘুরি করছে।

রোজি আস্তে আস্তে হেঁটে ছাদের দরজায় গিয়ে কান পেতে রইলো......না! কিছুই নেই!--কোন আওয়াজ নেই।

আবার যেন আওয়াজটা নীচ থেকে আসছে শুরু করলো.......রোজি নীচে নেমে এলো....নীচে এলেই একটা হাসির আওয়াজ রোজির কানে আসতে থাকে----মনে হচ্ছে ছাদের ওপরে কেউ খুব জোরে জোরে হাসছে......তখন যেন রোজির ভয়টয় উধাও.....
সে নিজেও জানে না কার পেছনে ছুটছে সে.....এদিকে অন্ধকারও হয়ে আসছে।
তাড়াতাড়ি করে হাতুড়ি এনে ছাদের তালা ভেঙে দেয় রোজি। ছাদের ওপর একটা পা রাখতেই কালো সেই পাখিটা শো করে উড়ে যায় তার মাথার ওপর দিয়ে......সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগলো। অথচ পাতা নড়ছে না। রোজি দৌড়ে নীচে নেমে এলো।
রোজির তখন হুঁশ ফিরেছে--- এ কী! আমি কার পেছনে ছুটছি......ঘরে এসে রোজি যেন সম্পূর্ণ চুপচাপ জড়সড় হয়ে বসে আছে।
কখন রাহুল ফিরেছে তাও টের পায়নি। রাহুলকে একটি কথাও বলেনি সে। 

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুজন শুতে গেল। রাহুল ঘুমিয়ে গেলেও রোজির চোখে ঘুম নেই। রোজি ঐসব বসে বসে ভাবতে লাগলো-----"কি রহস্য এটা"?? "ওরা কারা"??
"কে ওখানে"?? জানতেই হবে আমাকে। বসে বসে এসব সাতপাঁচ ভাবতে লাগলো।

রাত তখন ১২ টা প্রায়। রাহুল ঘুমিয়ে গেছে। রোজি দেখলো হঠাৎ সব লাইট নিভে গেল। রোজি বাইরে বেরিয়ে --ওপর থেকে সিঁধু কাকাকে ডাকলেন---- সিঁধু বললেন---- মনে হয় কারেন্ট গেছে মা.....দেখো--- খাটের নীচে হ্যারিকেনটা রাখা আছে। ----- হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে রোজিও শুয়ে পড়লো....----মিনিট কয়েক পরে হ্যারিকেনটাও নিভে গেল। ---- রোজি চোখ খুললো, ভাবলো হয়তো তেল নেই। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখে পুরো তেল ভর্তি। রোজি রাহুলকে ডাকলো-- কিন্তু সে তো তখন ঘুমে অচৈতন্য। 
জড়সড় হয়ে রোজিও চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে তখন---

চোখটা সবে লেগে এসেছে আর তক্ষুণি রোজির কানে সেই গোঙানির আওয়াজটা ভেসে আসতে লাগলো। মনে হয় কাউকে মুখ বেঁধে ফেলে রেখেছে। রোজি উঠে বসলো। পাশের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিল খানিকটা।

রোজি কান খাড়া করে ভাবছে--- কোনদিক থেকে আসছে আওয়াজটা। রোজি খাট থেকে নেমে দরজার কাছে--- এসে দাঁড়ালো। ঐ একই আওয়াজ---একটু দূরে সরে গেল। হ্যারিকেনটা আবার জ্বালায় রোজি।
...হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে যায় রোজি---- ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিক। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। রোজি সামনের দিকে এগোয়, দপ করে হ্যারিকেনটা নিভে যায়---

রোজি বন্ধ ঘরটারদিকে তাকিয়ে দেখে--- দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে বাইরে--- গোঙানিটাও বন্ধ। 
...... খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে রোজি। শোবার কিছুক্ষন পরই মনে হয় কে যেন তার খাট ধরে উঁচু করছে। রাহুলকে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকে রোজি--- ততোক্ষণে ভয়ে জড়োসড়ো সে---- ঘেমে ভিজে গেছে। রাহুল চোখ বুঁজে হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলো----
"কি হয়েছে?? এতো রাতে ডাকছো কেন??"

রোজির গায়ে হাত দিতেই দেখে থর থর করে কাপঁছে রোজি।

"এরকম করছো কেন?
শরীর খারাপ লাগছে নাকি??"
 -তাড়াতাড়ি একটা জলের বোতল এগিয়ে দেয় রাহুল।

"না! তেমন কিছু নয়---
আচ্ছা রাহুল --- তুমি কিছু টের পেয়েছো?"
"------কেন? কি টের পাবো?......কি হয়েছে??"

"না কিছু না!" -বলে রোজি চুপচাপ খাটের ওপর বসে রইলো।
  
রাহুল রোজিকে--- "বললো ঘুমিয়ে পড়ো। হয়তো বাজে স্বপ্ন দেখেছো...."
বলেই রাহুল ঘুমিয়ে পড়লো---

রোজি চুপচাপ বসে-----
একটু পরেই রোজির কানে একটা কান্নার আওয়াজ এলো।মনে হচ্ছে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কে যেন কাঁদছে..... রোজি কান্নার আওয়াজ পেয়ে জিগ্যেস করলো ---"......কে ওখানে?......কে আছে ওখানে??" কোন সাড়া নেই ।
পিনড্রপ সাইলেন্স ----
তারপরই কে যেন --- ফিস ফিস করে রোজির নাম ধরে ডাকতে থাকে----রোজি উঠে বসে বিছানায়--- আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে যায়---তখনও কে যেন ডাকছে তাকে...দরজা খুলে একটা পা বাইরে রাখতেই--- রোজির চক্ষু চড়কগাছ। 
 --- সেই বিভৎস চেহারায় দাঁড়িয়ে এক মহিলা-
সাদা থান পরা মুন্ডহীন শরীর---রোজি খুব জোরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সংজ্ঞা হারায়। রোজির চিৎকারে রাহুলের ঘুম ভেঙ্গে যায়---তাকিয়ে দেখে পাশে রোজি নেই। তৎক্ষনাৎ রাহুল তাকিয়ে দেখে দরজার পাশে কে যেন পড়ে রয়েছে।
ছুটে যায় রাহুল---- গিয়ে দেখে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় অসাড় হয়ে পড়ে রয়েছে রোজি। কোন ক্রমে তুলে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয় তাকে। ---- রাহুল সিঁধু কাকাকে ডাকেন। ছুটে আসে সিঁধু কাকা--- রাহুল রোজির চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়--- খানিক পরে-- নড়ে ওঠে রোজি। হঠাৎ চোখ খুলতেই রোজি-- লাল লাল দুটি বড় বড় চোখ করে তাকায় রাহুলের দিকে।চারদিকে ঘুরে ঘুরে তাকাতে থাকে সে.....রাহুলের দিকে তাকালেই রোজির বিরক্তি বাড়তে থাকে। --- রোজির এই অস্বাভাবিক মোটিভ সিঁধুকাকা টের পায়--- সিঁধু কাকা রাহুলকে ঘর থেকে বের করে দেয় এবং নিজেও বেরিয়ে আসে---- --- হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে রোজি মোটা কর্কশ স্বরে রাহুলকে ডাকতে থাকে। কিন্তু রাহুলকে রোজির কাছে যেতে নিষেধ করে সিঁধু কাকা। --- এক পলক কপাটের ফাঁক দিয়ে রাহুল দেখে নেয় রোজির সেই চেহারা-----রোজি পায়ের ওপর পা তুলে খোলা চুলে মাথা নিচু করে বসে গোঙাচ্ছে। রাহুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সিঁধু কাকা তাকে কোনক্রমে সামলে নীচে নিয়ে যায়---খানিকটা পরে আবার রাহুল ও সিঁধু কাকা ওপরে এসে রোজির ঘরের সামনে দাঁড়ায় দাঁড়ায়---- হঠাৎই একটা কালো পাখি--- শো করে রোজির ঘর থেকে বেরিয়ে যায়---- তৎক্ষণাৎ দৌড়ে রাহুল ও সিঁধু কাকা ঘরে ঢোকে। দেখে রোজি হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।
--- রোজিকে ডাকে রাহুল।
চোখ খুলেই রোজি উত্তর দেয়----"কি হয়েছে??
এতো রাতে ডাকছো কেন??
আমার গা হাতপাগুলো ভীষণ ব্যথা করছে। দুর্বল লাগছে শরীরটা, আমি শুয়ে পড়লাম।"---- বলেই সে চোখ বন্ধ করলো।

ঐ রাত কোনক্রমে ভয়ে উৎকন্ঠায় পার হয়ে যায়---
সকালে রোজি আর ওঠে না। তখন বেশ বেলা হয়েছে। 
রাহুল নীচে সিঁধু কাকার ঘরে যায়---সিঁধু কাকা রাহুলকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। ফোন করে তৎক্ষণাৎ রোহনকে ডেকে আনে রাহুল। একটু পরেই রোজি খুব ফুরফুরে মেজাজে নীচে নেমে আসে। 
--- রাহুল ও রোহন বার বার রোজির মুখের দিকে তাকায়---রোজি বুঝতে পেরে রাহুলকে জিজ্ঞেস করে---
"এভাবে তোমরা আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন??
 কি হয়েছে??"---- রাহুল চুপ করে বসে থাকে।

তারপর সিঁধু কাকা রাহুলকে নিয়ে বেরিয়ে যায়----ঘন্টা চারকে পর ফিরে আসে--
তখন রোজি দুপুরের খাবার দিচ্ছিলো রোহনকে।--- সিঁধু কাকা ও রাহুল -- তান্ত্রিক বীরূপাক্ষ আচার্য্যকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই
রোজি খাবারের টেবিলটা উল্টে দিয়ে মাথা ঝাঁকতে লাগলো।-- বিকট ভাবে গোঙাতে লাগলো। রোহন চেয়ার হতে মেঝোতে পড়ে গেছে। কোন ক্রমে উঠে মাকে ধরতে গেলে---- রোজি রোহনের গলা টিপে ধরে।
কোনমতে ঝাড়া দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে এসে চিৎকার করতে থাকে রোহন।--- তৎক্ষনাৎ ঘর জুড়ে ভাঙ্গচুরের আওয়াজ আর বিভিন্ন রকমের অস্বাভাবিক আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। রাহুল রোহনকে শান্ত করে আচার্য্যের দিকে তাকায়। আচার্য্যও রাহুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে......
  ---- এই প্রথম নয় দ্বিতীয়বার তার এ বাড়িতে আসা। সিঁধু বাবুও ব্যাপারটা টের পায়---আচার্য্য মশাই সিঁধুকে ডেকে বলেন---- "কি করে হলো এসব??
তুমি-- রাহুল ও বৌমাকে আগে থেকে কেন সতর্ক করোনি এ বিষয়ে??"

রাহুল জানতে চায়--- "কি বিষয়ে??" আচার্য্য মৃদু হেসে বলে--- "আছে আছে----সবই দেখতে পাবে।
--- একটু ধৈর্য্য ধরো---"

আচার্য্য তার লাল পুঁটুলিটা কাঁধের থেকে নিচে নামাতেই--- বীভৎস এক পাগলিনীর মূর্তিতে নটরাজসিক ভঙ্গিতে দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে আসে রোজি---
কটমট করে নীচের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আচার্য্যের দিকে----

---- শীঘ্রই আচার্য্য দুগাছা তাগা রাহুল ও সিঁধুকে হাতে বেঁধে দিয়ে বলেন--- দ্রুত চলো ওপরে----- আচার্য্য ওদের সঙ্গে নিয়ে দৌঁড়ে ওপরে উঠে যায়--- আচার্য্য উপরে উঠতেই রোজির গর্জন যেন দ্বিগুন হয়ে যায়--- রোজি ঝাঁপিয়ে পড়ে আচার্য্যের ওপর--- কোনক্রমে চুল ধরে টেনে ধাক্কা দিয়ে ঘর বন্দি করা হয় রোজিকে। বাইরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ঘরের মধ্যে থেকে কর্কশ আওয়াজ আসতে থাকে....
ভাঙ্গচুর চলতে থাকে সারা ঘর জুড়ে। ---- রাহুল আচার্য্যকে বলেন--- "এটা তো রোজির আওয়াজ নয়...
ঘরে কে ওটা???বলুন আমায়। এটা আমার রোজির আওয়াজ নয়..."
বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রাহুল---

আচার্য্য সিঁধু আর রাহুকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়--- সেই বন্ধ ঘরের দিকে। ঘরের সামনে যেতেই আচার্য্য সিঁধুর ওপর চটে যান--- "এ কী??
এই ঘর খুললো কে???"
সিঁধু মাথা নাড়ে। সে কিছুই জানে না। রাহুল কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। --- ঘরে পা দিতেই চারদিকে যেন ভূমিকম্প হতে শুরু করলো। তীব্র আওয়াজ হতে থাকে। দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় রাহুল--- তড়ি ঘড়ি ঘর বন্ধ করে রাহুল ও সিঁধুকে নিয়ে আচার্য্য ফিরে আসে রোজির ঘরে। এসেই দেখে রোজি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। ---- রোজিকে জলতেল দিয়ে জ্ঞান ফেরান আচার্য্য।---- বললো, "এখন কেমন লাগছে মা---" রোজি বললো, "আমার কি হয়েছে??? আপনিই বা কে??"

রাহুল--- তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো।

তারপর--- রাহুলকে সব কথা খুলে বলেন আচার্য্য।

"----- দোতলার বন্ধ ঘরটি কোন স্বাভাবিক ঘর নয়। ওখানে তোমার ঠাকুরদা পিটার সাহেব ও তানিয়া সাহেবার আত্মা বন্দি অবস্থায় রয়েছে।
---- আর সেই ঘর খুলতেই যত বিপত্তি। 
রোজি তালা ভেঙ্গে সেই ঘর খুলতেই তানিয়ার রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ----
তানিয়া এই সংসারের আসার পর ছোট সাহেব মানে তোমার বাবা কোনদিন তাকে স্বীকার করেনি মা হিসাবে। তার সাথে প্রচুর দুর্ব্যবহার করেছে। শেষ পরিনতিতে পিটার সাহেব এবং তানিয়া সাহেবাকে খুন করে মুন্ড আলাদা করেছিলেন রাসেল সাহেব। আর সেই থেকেই তানিয়া সাহেবার আত্মা এই মাটিতে সক্রিয়, এই বাড়ি জুড়ে তার বিচরণ ---পিটার সাহেব নিস্ক্রিয় হলেও তার অস্তিত্ব একটু পরেই আমি তোমাকে দেখাবো।---- তুমি যখন ছোট তখন তেমার পিতা মাতার চোখ উপড়ে নিয়েছিল এই তানিয়াই।--- সে মনে প্রাণে চাইতো এই ভিটেয় যেন অন্য কারো উপস্থিতি না থাকে। পিটার অরন্যাল্ডের বংশের সব বাতি সে এক এক করে নিভিয়ে দেবে এই প্রতিজ্ঞা সে করেছিল মৃত্যুর সময়।----তানিয়ার আসল টার্গেট হলে--- তুমি।
তানিয়া রোজির শরীরে ভর করে আছে---- তোমায় শেষ করবে বলে। সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।"

শুনে রাহুল যেন ভয়ে কাঠ হয়ে গেল।
    
--- আচার্য্যকে রাহুল জিজ্ঞেস করে, "এর থেকে মুক্তির পথ বলুন মহারাজ---- আমি এসব আর সহ্য করতে পারছি না-----"
আচার্য্য রাহুলকে কিছু জিনিস আনতে বললেন--- 
তারপর আচার্য্য মশাই একাই চলে যান--- সেই বন্ধ ঘরে। গিয়ে আবার বেরিয়ে আসেন। 

রাহুলকে ডেকে বলেন--- "ঐ ঘর থেকে কিছু জিনিস সরানো হয়েছে তা যতক্ষণ সঠিক জায়গায় না রাখা হবে--- তানিয়াকে শান্ত করা সম্ভব নয়। এভাবে চললে রোজিও প্রাণ হারাতে পারে মূহুর্তে।" কিন্তু কি মিসিং তা বুঝতে পারছে না কেউই ----
আচার্য্য রোজির ঘরে যান রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে--- সারাঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও কিছু পায় না।
--- শেষে তোশক ওলটাতেই--- দেখে একটা ডায়রি ও পিটার সাহেবের একটা বাঁধানো ফটো।
যেটা রোজির মাথার নীচে ছিল। ওটা উদ্ধার করে নীচে নেমে আসে আচার্য্য--- 
রাহুলকে জানায় --- আজ গভীর রাতে ওটা পেছনের জঙ্গলে একটা বটগাছ রয়েছে তার গোড়ায় রেখে আসতে হবে।

রাহুল বলে," ---সেটা কি করে সম্ভব! কে যাবে ঐ রাতে সেখানে----!"

 আচার্য্য বললেন--- "চিন্তা কোরোনা আমি আছি তো---
আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো।"

রাত তখন বারোটা প্রায়--- রোজিকে নীচে নামিয়ে আনলেন আচার্য্য। খোলাচুল আর সাদা শাড়ি পরিয়ে তাকে স্নান করালেন।
 চুপচাপ রোজি--- কোন কথা বলছে না---- একটা আসনে বসিয়ে আচার্য্য যজ্ঞ শুরু করলেন---- আস্তে আস্তে রোজির শরীর শক্ত হতে শুরু করেছে। মাড়ি কটকট করছে, চোখ দুটো রক্তের মতো লাল হয়ে আসছে--- গোঙানির আওয়াজও আসতে শুরু করেছে----
 আচার্য্য রোজিকে জিজ্ঞেস করলেন--- "কে তুই?
বল কে তুই???"
উত্তর আসে----"আমি তানিয়া অরন্যাল্ড"।
ভয়ে ছিটকে সরে যায় রাহুল।
----"কি চাস তুই"??

------"-রক্ত মাখা চোখ!-------রক্ত মাখা মুন্ড,
প্রতিশোধ চাই ---আমি প্রতিশোধ! কাউকে রেহাই দেবো না। আমার স্বামীর ডায়েরি, ফটো নিয়ে নেওয়া!
কারোর জায়গা নেই এখানে।
এটা আমার জায়গা।"
বলেই মাথা ঝাঁকতে থাকে আর গোঙাতে থাকে।

"ডায়েরি আর ফটো পেলে মুক্তি দিবি তো?? বল মুক্তি দিবি কিনা??"

 উত্তর আসে ----- "না।"
 সঙ্গে সঙ্গে আচার্য্য একটা বাটি হতে লাল ধুনো টাইপের কি একটা গুঁড়ো ছুঁড়ে দিল।  
  জ্বলে গেল পুড়ে গেল বলে --কাঁদতে শুরু করলো রোজি।........"বল এবার মুক্তি দিবি কিনা?বল!"

"হুম..........."

আচার্য্য টেনে তুললেন রোজিকে। সঙ্গে সঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিলেন ফটো আর ডায়েরিটা। ওটা হাতে নিয়েই হাসতে থাকে রোজি! কি বিকট সে হাসি--- কোন দিকে না তাকিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করে সে---- মুহূর্তে জঙ্গলে মিলিয়ে যায় রোজির শরীর। আচার্য্য রাহুল আর রোহনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যায় বট গাছের গোড়ায়। গিয়ে দেখে রোজি ভিজে কাপড়ে পড়ে রয়েছে অজ্ঞান হয়ে। রোজিকে কোলে তুলে নিয়ে ফিরে আসে তারা। --- খানিকটা পরে হুঁশ আসে রোজির।
----ফিরে গিয়ে আচার্য্য বন্ধ ঘরের দরজায় তালা দিয়ে একটা পুটুলি বেঁধে দেয়---- আর সিঁধুকে ডেকে বলে যান---"ভুলেও ও ঘরের দরজা--- খুলো না----"
পরদিন --- রোজি আর রোহনকে নিয়ে চিরতরে ঐ ভিটে ত্যাগ করে রাহুল অরল্যান্ড।





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪