স্মৃতিকথা

* কাশ্মীর : (প্রথম পর্ব) *

শু ভ্র জী ৎ  বি শ্বা স

পাহাড় ছোট বেলা থেকেই খুব টানতো। সুযোগ এলো তখন সদ্য কলেজের গন্ডি পেরিয়েছি। পড়াশুনার সূত্রেই ভূ-স্বর্গে প্রথম পা রাখা। শিলিগুড়ি থেকে মহানন্দা এক্সপ্রেস-এ দিল্লী, তারপর শালীমার এ কোনো রকম রাত কাটিয়ে পরেরদিন ভোরে জম্মু। আমি আর ক্যাল্ডেল অনেক খুঁজে একটা টেলিফোন বুথ জোগাড় করে বাড়িতে জানালাম বেঁচে থাকার কথা। তারপর নাকে মুখে খাবার গুঁজে এক দীর্ঘ বাস জার্নি।শরীর ক্লান্ত। মুঠোফোন গুলো অকেজো। তবে প্রকৃতির অপরূপ রূপ যেন মাথা ও শরীরের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিচ্ছিলো। দূরে পাহাড়ের চূড়ায় সাদা বরফের চাদর সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা করেছে পথযাত্রীদের। মাঝে দু'তিন জায়গায় খাওয়ার জন্য বিরতি। যখন শ্রীনগরে প্রথম পা রাখলাম রাত তখন ৯.৪০ হবে। শীতের রাত। রাস্তাঘাট ফাঁকা। বলে রাখা ভালো সে সময় (শীতে) দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়েই জম্মু থেকে কাশ্মীর ও কাশ্মীর থেকে জম্মু আসা যাওয়া করা যেত বাই রোড। যাই হোক বাসের দরজা খোলার পর যখন প্রথম পা'টা মাটিতে রাখলাম তখন মনে হলো কেউ যেন ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। রীতিমতো জমে যাওয়ার উপক্রম।  উপস্থিত মেয়েরা তাঁদের নির্ধারিত ঠিকানায় ও ছেলেরা তাঁদের নির্ধারিত ঠিকানায় চলে গেলো। এবার আর সহ্য হয় না। একে ঠান্ডা দুই প্রচন্ড খিদে। অবশেষে উমর ভাই এর সহযোগিতায় ডাল আর ভাত পাওয়া গেলো। বিশ্বাস করুন ঐ মুহূর্তে তা অমৃতকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো। এরপর শুরু হলো রুম বিভ্রাট। অতো রাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় কে কার খোঁজ রাখে। যে যেখানে পারলো স্লিপিং ব্যাগ,  ব্লাঙ্কেট খুলে শুয়ে পড়লো, কারণ দীর্ঘ প্রায় ৫ দিনের জার্নিতে (সবই মহানন্দার কৃপা) শরীরে আর এতটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিলো না। উমর ভাই এর সাথে আমার সম্পর্কটা প্রথম দেখা থেকেই প্রচন্ড গভীর। তার সুবাদে তৎক্ষণাৎ রুম পেয়ে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম ।





* হিমেল হাওয়া *
 
সু ন ন্দা চ ক্র ব র্তী

জগদ্ধাত্রী পুজো যেতে না যেতেই আমাদের সোদপুরের বাড়ির চারপাশটা কেমন যেন ঝিম মেরে যেত বিকেল ফুরাতেই। সন্ধ্যা যেন বিকেলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলত। টুক করে সন্ধ্যা নামতেই ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত মঙ্গল প্রদীপ আর শঙ্খের ফুঁএর আওয়াজ। আমার পাশের বাড়ির মেয়ে সুমি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইত – রাজপুরীতে বাজায় বাঁশী বেলা শেষের তান…। আমাদের মফঃস্বলের বাংলা মিডিয়াম স্কুলে তখন ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এদিকে ঠাণ্ডা পড়ছে জম্পেশ। লেপ থেকে বের হয়ে পড়তে বসতে ভারী আলিস্যি। লেপের তলায় পা ঢুকিয়ে লাল সোয়েটার পরে আমি পড়ছি না ঘুম ঘুম আমেজে ঢুলছি তা আজ মনে হলে নিজেরই ভাবনাগুলো সব গুলিয়ে যায়। 
উনুনের ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাগানের দিকে কুয়াশার সাথে মিশে এক অদ্ভুত রহস্যময় জগতের সৃষ্টি করে। আমার জানলার একটা দিক খোলা থাকত। সেখান দিয়ে শিনশিনে হাওয়া এসে শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিত। পূবের বারান্দায় শালিমার নারকেল তেলের কৌটো সান কিসে গলছে ভিতরে ভিতরে। বাবা বাজারের ব্যাগটা মায়ের সামনে ঝপ করে নামিয়ে স্নানের আয়োজনে ব্যস্ত। রেডিওতে প্রাত্যহিকী শুরু হয়েছে। তারপরেই রবীন্দ্রসঙ্গীত অশোকতরুর কণ্ঠে – তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি…।। 
 রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ফুলকপি ভাজার গন্ধে খিদেটা বেশ চাগাড় দিয়েছে। সামনেই পরীক্ষা – কিন্তু কেমন জানি সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছুই জানি না। কি লিখব কে জানে? ভয়ে ভয়ে দুরুদুরু বুকে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। কিভাবে জানি পরীক্ষা শুরু হয়ে আবার ফুড়ুৎ করে শেষ হয়ে যেত। পরীক্ষা হলে ঢোকার পর একটা ভূত ভর করে সব লিখিয়ে নিত আমাকে দিয়ে। এবার দীর্ঘ ছুটি। 
শীতের হাওয়ায় শুষ্ক ঠোঁটে আমি পরীক্ষার পর নিয়ম করে বেঙ্গলি টু ইংলিশ ট্রান্সলেশন আর নতুন ক্লাসের ম্যাথস একটু করে শুরু করতাম। বাবার নির্দেশ – সাথে হাতের লেখা প্র্যাকটিস। সুমিদের বাড়ির মস্ত বাগানে আয়েস করে ডিমের ঝোল, ভাত দিয়ে পিকনিক। তারপর লুডোর দান – ছক্কা, পুট, খাওয়া। সামনের বাড়ির কাজলিদির হাতে কখনও সোয়েটার কখনও মাফলারের কাটা, ক্রুশ, উল। বাহারি রঙের উল ঘাসের মধ্যে গড়াগড়ি খায়। মাঝে মাঝে কাজলিদির পোষা মেনি উলের বলের সাথে খেলতে থাকে। সুমির ঠাম নতুন গুড়ের পায়েস বানায়। সুমিদের বাড়িতে ইতুর ঘট স্থাপন হয়। আমিও উমনো ঝুমনোর গল্প শুনি। সুমিদের বাড়ির উঠোনের কুল গাছ নাড়ালেই টক মিষ্টি কুল পড়ে আর আমি সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাবই না। সিঁথির মোড়ে অলিম্পিক সার্কাস দেখতে যাই মামার হাত ধরে, কখনও দাদুর সাথে চিড়িয়াখানা বা মেসোর সাথে মিউজিয়াম। ট্রামে করে যেতে যেতে ওয়েলিংটনে শীতের রঙ দেখছি ভুটানিদের সাথে। কত রঙের সোয়েটার, চাদর। সব কিনে নিতে ইচ্ছে করে। 
এইভাবেই শীত আসে শীত যায়। কমলালেবুর গন্ধে পৌষের মিঠে রোদে গা এলিয়ে স্বপ্ন রচনায় আমি একাকী বসে ভাবি আকাশ কুসুম। আজও সেই ভাবনার সাথে হাত ধরে ঘুরে আসি শৈশবের দিনরাত্রি, আমার শীতের আমেজের গল্পে। হিমেল হাওয়ার গল্প উড়িয়ে দিই মধ্যবয়সের ব্যালকনি থেকে।





* ছোটোবেলার মুশকিল আসান *
              
শি বা নী চৌ ধু রী

এখন একলা হলেই ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড়িয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।পাতার পর পাতা বিনা কসরতেই উল্টে যায়। সে যেন এক রূপকথার রাজ্য! সবার হয় কি না জানিনা, তবে সংগোপনে বলে রাখি...মনে মনে ফেলে আসা সেই রূপকথার রাজ্যে হাঁটতে হাঁটতে বর্তমান আমিকে ভুলে যাই অবলীলায়! সে বড়ো সুখের যাত্রা!

 বাংলার হুগলীর প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান তারকেশ্বর থেকে সামান্য দূরে সবুজে সাজানো এক গ্রামে কেটেছে আমার শিশুবেলা থেকে মেয়েবেলা। অনেক গুলো কাকাতুতো ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়ো হবার সুবাদে একটু নেতৃত্ব দেওয়ার লোভ সম্বরণ করাটা বেশীর ভাগ সময়েই হতোনা।

গাছে ওঠা, সাঁতার কাটা, সাইকেলের টিউব গাছে বেঁধে দোল খাওয়া, গরুর গাড়িতে চড়া, ধানের শীষ কুড়িয়ে পরে খ‌ই ভাজিয়ে নেওয়া, কালবৈশাখীতে আম, ভাদ্রে পাকা তাল কুড়ানো, ছিপে মাছ ধরা কোনো কিছুই বাদ যেত না সদলবলে।

আমাদের চাষের জমিতে কাজ ও বাড়ির ফাইফরমাশ সর্বদা হাসি মুখে যে মানুষটি করে দিত সে আমাদের সবার প্রিয় ভোলাদা। ওর মাকে পিসি ও বৌকে বৌদি বলে ডাকতাম। তখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে খাসি কাটার দোকান ছিল না। মাসে দু'বার গ্রামের বাজারে খাসি কাটা হতো। দায়িত্বে ভোলাদা।
বাড়ি বাড়ি তালপাতার ঠোঙায় মাংস পৌঁছেও দিত একমুখ হেসে।

সবচেয়ে বড়ো গুণ যেটা ছিল তাহলো কোনোও কাজ করতে বললে কখনও 'না' বলতো না। হাসিমুখে বলতো আজ সময় হবেনা কাল করে দেবো। তবে ওই 'কাল' আসতে কখনো একমাসও হয়তো পেরিয়ে যেত।
আমার ঠাকুমাকে দিদিমা, মাকে মাওইমা, সেই সুবাদে আমাকে বোন বলে ডাকতো। কখনো নাম ধরে ডাকেনি বা তুইতোকারি করেনি।

ফুলগাছ বসাবো, বেড়া দিয়ে দিতে ভোলাদার ডাক, ডাংগুলি তৈরী, কলার ভেলা তৈরী, গাছের পাকা কুল পাড়তে ভোলাদার ডাক, সরস্বতী ঠাকুরের প্যান্ডেল করা থেকে ঠাকুর আনা সবেতেই ওই একজনের আন্তরিক সহযোগিতা। ঠাকুর বিজয়াতেও। বাড়ির সামনেই দোলমঞ্চ। দোল উৎসবের আগেরদিন খড় দিয়ে চাঁচড় বানাতে হাঁকডাক, রঙ খেলার জন্য বাঁশের পিচকিরি বানাতে হাঁকডাক....কাকে! না মুসকিল আসান ভোলাদাকে। ভাদ্রমাসের অরন্ধনের সময় কচুশাক রান্না হবে। কচুশাক জোগান দেওয়ার দায়িত্ব‌ও তার।বাড়ির যেকোনোও অনুষ্ঠানে কলাপাতা জোগান দেবে ওই মানুষটাই (তখন গ্রামে যেকোনও অনুষ্ঠানে কলাপাতায় খাওয়ানো হতো)। এমনকি আমাদের কিছু আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতেও সে সাগ্রহে কলাপাতা সাপ্লাই দিয়েছে।

একটু আধটু মদের নেশা ছিল কিন্তু কোনোদিন কাউকে অসম্মান করতে দেখিনি বা মুখে খারাপ ভাষা শুনিনি। মা ভাগ্না বলে ডাকতো এবং খুব স্নেহ করতো।

মানুষটা পরলোকে চলে গেছে কম বয়সেই অসুখে ভুগে বহুবছর আগেই, তবু আমার ছেলেবেলা আর ভোলাদা মনে হয় একে অপরের পরিপূরক। সেই সরল সাধাসিধে মানুষ গুলো একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসেনা। ভালো থেকো ভোলাদা যেখানেই থাকো।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪