স্মৃতিকথা


কাশ্মীর: (দ্বিতীয় পর্ব)

শু ভ্র জী ৎ  বি শ্বা স



ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরে সব সেট যদিও ঠান্ডার সাথে বনিবনা তখনো পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি, এবার আসি আমাদের পাঁচতারা হোটেলের খাওয়া দাওয়ার পর্যায়ে। সকালে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে চা। দুপুরের খাওয়া বেশীর ভাগ দিনই হতো না। আর রাতে ঠান্ডায় লাইনে দাঁড়িয়ে আবার খাওয়া। ঐ ঠান্ডায় নিজের থালা নিজে পরিস্কার করার যে এতো আনন্দ, সেটা থেকে বাঁচতে একটাকা দামের প্লেটে খাওয়া শুরু করেছিলাম। আর রাতেও কোনো কারণে সময়ের পর ঢুকলে জল ছিলো একমাত্র সম্বল। এই ছিল আমাদের রুটিন। খাবারের কথা যখন আসলই মেনুটা না শোনালে আবার খাদ্য রসিকরা তেড়ে আসবেন। যাই হোক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মেনু ছিলো


দুটো রুটি, দু-হাতা ভাত আর ডাল। তাই বলে ভালো মন্দ খাইনি যে তা নয়। কাছেই একটা খাবারের দোকান ছিলো। এই যা রক্ষে! সেই ভদ্রলোকের বাড়ি আবার আমাদের কাছেই ইসলামপুরে। উনি ব্যাবসার খাতিরে শ্রীনগরে থাকেন।  যখন খুব ঠান্ডা পড়ে তখন দোকান-টোকান বন্ধ করে মাস দু-এক এর জন্য বাড়ি চলে আসেন ইসলামপুরে। সেবার ইংরেজি জানুয়ারি মাসের পয়লা তারিখ ওখান থেকে ৪ টে সেদ্ধ আলু, দুটো লঙ্কা, একটু নুন আর তেল নিয়েছিলাম। বিনিময় মূল্য দিয়েছিলাম তবে তা খুব সামান্য আসলে একই দেশের (উত্তরবঙ্গর) লোক হলে যা হয় আর কি। একটা দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পরিচয় পর্ব থেকে। যাই হোক তারপর আলু সেদ্ধ, ডাল আর ভাত। আহহহ! সেই তৃপ্তি মুখে প্রকাশ করার ভাষা নেই। ছোট থেকেই শুনেছি যে ক্রাইসিস মানুষ কে বদলে দেয়।


আমরাও তার ব্যাতিক্রম ছিলাম না। যদিও খাওয়া নিয়ে তেমন আদিখ্যেতা কখনোই করিনি। তবুও একটা পছন্দ অপছন্দর বিষয় একটু হলেও ছিলো। ঐ পরিস্থিতিতে পড়ে সেটাও ঠিক হয়ে গেলো। নিজেকে দিয়ে বলতে পারি কাশ্মীর পর্ব মেটার পর আজ পর্যন্ত একটা আলুর ছাল পর্যন্ত কোনো দিন ফেলিনি। কোনো কিছু না খাওয়ার বিষয় তো কোন্ ছাই! হা হা হা হাসি পাচ্ছে তো কথাটা শুনে?  স্বাভাবিক! আসলে নিজে প্র্যাকটিক্যালি ঐ পরিস্থিতিতে না পড়লে হয়তো আমিও হাসতাম।  শ্রীনগরে যাওয়ার দিন তিন চারেক পর এলো সেই ভয়ঙ্কর রাত, যা মনে পড়লে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। তখন প্রায় মাঝ রাত প্রচন্ড শীত। আমাদের নিবাসস্থলের সামনের কম্পাউন্ডটা সাদা হয়ে আছে। হঠাৎ বীভৎস চিৎকার। রুমমেটরা আগেই উঠে ছিলো। আমার অত মাথা ব্যাথা ছিল না। শুয়ে আছি। একজন তো ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে গেটের বাইরে পর্যন্ত পালিয়েছে। বিষয় টা হলো ভূমিকম্প। আমাকে এক বন্ধু রীতিমতো ধাক্কা মারতে মারতে বাইরে নিয়ে গেলো আর তারপর কাঁচা খিস্তি। আসলে বাড়ির থেকে অতটা দূরে নিজেরা নিজেদের খেয়াল না রেখে উপায় নেই তাই। বাইরে বেরোনোর সময় জুতোটা পরার কথা মাথায় ছিলো না। মাথায় আসলো ভূমিকম্পতে না মরলেও এবার নির্ঘাত ঠান্ডায় মরে যাবো।


ওদিকে তখন চারিদিকে চাঞ্চল্য। ভূমিকম্প থামার পর অনেকেই নিজের বাড়িতে ফোন করে ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করলো। অনেকে সশব্দে কান্না।  কারো আবার দু-চোখ বেয়ে নিস্তব্ধ বর্ষা নামলো ভূ-স্বর্গের বুকে। পরদিন সকালে বাড়িতে ফোন করে বুঝলাম যে ভূমিকম্পর বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।





প্রথম রান্নার স্মৃতি

অ নি ন্দি তা  না থ


"উদাসী পবন ধীরে বয়ে যায়,
অতীত স্মৃতি পরাণে জাগায়।"
- আমি তখন সদ্য নবম শ্রেণীর ছাত্রী। শুরু হল নতুন শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়া। বড় বড় ভাব, গম্ভীর। তিনটি কথা বললে একটি জবাব মেলে কি মেলে না। তবে সর্ব বিষয়ে কৌতূহলী মন। সেই সঙ্গে ছোটদের জ্ঞান দেওয়া- সেটাও চলত। বয়সের ধর্ম যে এটাই। 
বাবা ও মা সরকারী চাকরি করতেন। তাই আমাদের বাড়িতে একজন রাজুর মা দিদি থাকত। রাজু ছিল দিদির ছেলের নাম। আমরা তিন ভাই ও বোন তাকে "রাজুর মা দিদি" বলে ডাকতাম। 

হঠাৎ একদিন আমার মাথায় ভুত চাপলো। রান্না করবো।সে সময় কাঠের উনুন ও স্টোভে রান্না হতো। কথা শোনা মাত্র মায়ের বড়ো আপত্তি। যদি আগুন
লেগে যায়! আমিও গোঁ ধরেছি। অবশেষে ঠিক হলো 
দিদি পাশে বসে থাকবে।জীবনের প্রথম রান্না ভাত, ডাল, পালং শাক।

রবিবার দুপুরে খেতে বসে সবাই রান্নার তারিফ করছেন, ভালো হয়েছে- বলছেন। কাকু "বাহারে নন্দলাল" কবিতার লাইন দুটো বললেন মজা করে। প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। লজ্জিত হয়ে নিজের আঙুল রগড়াতে লেগেছি।আনন্দকে গোপন করলাম।মনে মনে ভাবলাম রান্না শিখে গেছি। এতো বড় খবর স্কুলের বান্ধবীদের যে জানাতেই হবে।

পড়াশোনা, গান, আবৃত্তি, গল্পেরবই নিয়ে,আড্ডা মেরে- "এমনি করে যায় যদি দিন যাক না" দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছে। এদিকে রাজুর মা দিদি সাত দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছে। তিনদিন পর মা অসুস্থ হয়ে যান। বাবা রান্নার কিছুই জানেন না। উপায় না দেখে মা বললেন, "আজ তুই রাঁধ মা, আমি পাশে থাকব"।

আমি সবজান্তা ভাব নিয়ে গিয়ছি রাঁধতে।ভাত, ডাল, ইলিশমাছ। বিপত্তি বাধল ইলিশমাছ রাঁধতে গিয়ে। মা বলছে- "বেগুন দিয়ে মাছেরঝোল পাতলা করে কর।" যতই জল দিচ্ছি ততই বেগুন উপরে উঠে আসে। কিছুতেই ডুবে যাচ্ছে না।বেগতিক দেখে মাছগুলো ঝোলে ফেলে দিলাম ।
তারপর গামলায় ঢেলে রাখলাম। 

বাবাকে খেতে দিয়েছি , আর ভাবছি কখন আজকের রান্নার গুণগান শুনবো। খেতে বসে বাবার চক্ষু ছানাবড়া। বাবলি-'মাছ কোথায়? "আমি-"গামলার মধ্যে।"
বাবা-"আমায় একটা গামছা দে,গামলায় নেমে মাছ 
খুঁজতে হবে।" বলেই হাসিতে ফেটে পড়েন। মা এ কীর্তি দেখে- "হা রাম"- বলে কপালে হাত। পরে বললেন- "বেগুন ভাজা হলে জল অল্প করে দিতে হয়, মা।"

যা খুশি হয়ে বাবা খেলেন! "এভাবে জীবনে হাবুডুবু 
খেয়ে ই সব শিখতে হয়, তা নাহলে বড়ো হওয়া যায় না।" আজ ৬৫ বছর বয়সে এসে ভাবছি কতো মূল্যবান কথাই না সেদিন বলেছিলেন বাবা।





এক গামলা দুধে এক ফোঁটা চোনা

ন ন্দি তা  সো ম


ভূমিকা- আজ তোমাদের একটি সত্য কাহিনী শোনাবো। গল্পটি আমার শাশুড়ী মায়ের কাছে শোনা। সেই গল্পই নিজের মতো করে বলছি। অবশ্য লেখার আগে গল্পের নায়কের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি। ঢাকা জেলার অন্তর্গত একটি জায়গা- যার নাম মুড়াপাড়া, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। তার অনতিদূরে অবস্থিত আধুরিয়া নামে একটি গ্রাম। সেটা আবার সোমেদের গ্রাম বলে পরিচিত বেশী।। কারণ সব বাসিন্দাই সোম পদবী ধারী। সেই গ্রামে ছিলো আমার শ্বশুরবাড়ি। আম, জাম, লিচু, কাঁঠালে ঘেরা চারিদিক। সামনে পিছনে বিশাল পুকুর। আর ছিলো বিশাল গোয়ালঘর। আদর যত্নে সুপুষ্টু গাভী সব।। প্রচুর দুধ মিলতো সেখান থেকে।
বাড়িতে লোকসংখ্যাও কম ছিলো না। আমার শাশুড়ীর চার ছেলে, তিন মেয়ে। তাঁর জায়ের তিন ছেলে তিন মেয়ে। নানা সম্পর্কিত আত্মীয় স্বজন তো ছিলোই। আর ছিলেন দাদু ঠাকুমা। তাঁদের অঙ্গুলি নির্দেশেই নাকি ঘরের পাতা হেলতো।রোজ রান্নার পরে কম আঁচে বড়ো কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হতো। তাতে নাকি দুধ ভালো ঘন হতো এবং দুধের ওপরে খুব মোটা করে সর বা মালাই পড়তো। এটা ছিলো আমার কর্তার অর্থাৎ বাড়ির সব থেকে ছোট ছেলের অতি প্রিয় খাবার। কিন্তু রোজ সেটা তার ভাগ্যে জুটতো না। কারন দুধের পরিমাণ বেশি ছিলো যেমনই, তেমনই  দুধ খাবার মুখ অনেক বেশিও ছিলো। কিন্তু সর বা মালাই পরিমিত ছিলো। তাই রোজ ছোট ছেলেকে বেশি পরিমাণে দুধ সর দিতে শাশুড়ী সংকোচ বোধ করতেন। ছোট ছেলে সংসার বুঝতো না। কিন্তু দুধ বুঝতো। খুব রাগ পুষতো মনে মনে। সে আবার হামাগুড়ি দিতে পারতো না। একটু দেরিতে হাঁটাও শিখেছে। বাবু হয়ে বসে পা ঘষে ঘষে চলতো। কিন্তু মাথা ছিলো অজস্র দুষ্টমিতে ভরা। তার সাগরেদ ছিলো তার থেকে দুইবছরের বড়ো খুড়তুতো দাদা।
ভাই যা বলতো দাদা নির্বিকারে তা পালন করতো।
এদের ঘরের পাশে ধানের গোলা ছিলো। তার পাশে  ধান ঝেড়ে তুঁষ জমা রাখা হতো। একদিন দাদাকে হুকুম করলো অনেকটা তুঁষ নিয়ে আসতে। দাদার কারণ জানার দরকার নেই। ভাই বলেছে- দাদা হুকুম তামিল করলেন। ভাইয়ের নির্দেশমতো সেই তুঁষ দুধের উপর ছড়িয়েও দিলো।বিকালে সেই দুধ দেখে আমার শাশুড়ীর মাথা
খারাপ। বুঝতে বাকী রইলো না এই অপকর্মটি কার। পিঠে ঘা কতক দিয়ে উনি বলেছিলেন এই এক কড়াই দুধে তুই চোনা ফেলে দিলি। পুরো দুধ নষ্ট। গ্রামের ছেলে,- ভালো করে জানে চোনার অর্থ। সেও কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো, "আমি চোনা দিইনি। আমি তো তুঁষ ফেলেছি। চোনা তো নোংরা। আমি আনিনি।" মা কাঁদবেন না হাসবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। যুদ্ধ কতক্ষন চলে ছিলো সেটা জানা নেই। তবে সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন ঠাকুমা এসে। আদেশ জারী করেছিলেন--এখন থেকে দুধ জ্বাল দেবার পর সর্বপ্রথম ছোট নাতি দুধ পাবে---- পরে বাকিরা।।
উপসংহার- কেটে গেছে অনেক বছর। দাদু, ঠাকুমা গত হয়েছেন। আর থাকা যাচ্ছিলো না গ্রামে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৫০ সনে আমার শ্বশুর শাশুড়ী পুত্র কন্যাদের নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। আমার বড় ননদের শ্বশুরবাড়ি টালিগঞ্জে ছিলো। সেখানে উঠে - রিফুজি কমিটির মাধ্যমে জমি পান কাটজুনগরে-(পরে সেই জমি আইন মোতাবেক অনুসারে নিজেদের হয়) -উষা কোম্পানির (জয় ইঞ্জিনিয়ারিঙ ওয়ার্কস লিমিটেড) পিছনে। এটা পুরোনো কলকাতার চিত্র- অনেকেই হয়তো চিনবেন না বা জানবেন না। তাই নতুন নাম বলে দিচ্ছি---- সেই উষা কোম্পানি উঠে গিয়ে তৈরি হয়েছে সর্বাধুনিক সাউথ সিটি মল।
ফিরে যাই ১৯৫০ সনে। অনেক কষ্ট করে দিন কাটিয়েছেন ওঁরা। ঢাকা থেকে আসার সময় যেটুকু টাকা পয়সা এনেছিলেন- নতুন করে সংসার পাততে সব শেষ হয়ে যায়। উপার্জনকারী একজন -- বাড়ির বড় ছেলে। বাটাতে কাজ করতেন, সপ্তাহান্তে ৪৫ টাকা বেতন পেতেন। এরমাঝে দুধ ভুললে চলবে কি করে? তাই কেনা হয়েছিলো দুটি দুগ্ধবতী গাভী। নিজেরা খেয়ে বাকিটা বেচে দেওয়া হতো। কিন্তু বেশিদিন সম্ভব হয় নি। কারণ দুধ দোয়া, বেচা অনেক খাটুনি। তাই গরু বেচে দিয়েছিলেন। এর পরের কাহিনী- সংগ্রামের কাহিনী। তাহলে, এবার সমাপ্তি টানি----
       আমার কথাটি ফুরুলো,
      আজকের কাহিনীর নটে গাছটি মুড়োলো।।





স্মৃতি পটে

বি ধা ন  ঘো ষ


ভাবতেই পারিনি বিপদ আমার জন‍্যে এইভাবে ওঁত পেতে অপেক্ষা করছিলো। নীচে 'চশমায়' স্নান করতে গিয়েছিলাম। চশমা বলতে ছোট্টো একটা জলাশয়। চারিদিকের পাহাড় থেকে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে এখানে জমা হতো। ওখানেই স্নান করা, জামাকাপড় কাচা ও অন‍্যান‍্য সমস্তরকম কাজ সারা হতো। আবার এই জলই ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে পাহাড়ের মাথায় আমাদের ক‍্যাম্পে তোলা হতো, পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। জলাশয়ে মশা, সাপ, ব‍্যাঙ, জোঁক ইত্যাদি হরেক রকম কীটপতঙ্গের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান! আর সূর্য ডোবার পর জলাশয়ের দখল চলে যেতো হাতি, ভালুক, বুনো শুয়োর, হরিণ প্রভৃতি জংলী শ্বাপদদের দখলে!

চৈত্র মাসের ভরা দুপুর। চারিদিক শুনশান, শুধু গাছ থেকে পাতা খসার আওয়াজ! আর থেকে থেকে জঙ্গল থেকে বনমোরগের আওয়াজ ভেসে আসছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফিরছিলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে 'পেট্রোলিং ডিউটি ' তে বার হতে হবে। ওপারেই বাংলাদেশের সিলেট জেলা। তারকাঁটার বেড়া তখনও হয়ে ওঠেনি। চোরকারবারিদের টুকটাক উপদ্রব লেগেই ছিলো।

ক‍্যাম্পে ওঠার রাস্তা একদম খাড়া, সরু পাকদন্ডি! দু'পাশে অকাট্য জঙ্গল। একধরনের ঘন সরু বাঁশগাছ দিনের বেলায় চারিদিক অন্ধকার করে রেখেছে। আপনমনে হাঁটছিলাম। হঠাৎ খিলখিল হাসির আওয়াজে চমকে উঠলাম! এতো নারীকণ্ঠ! আশ্চর্য, কোথা থেকে আসছে! কাছাকাছি কোনো জনবসতি নেই! দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবতে লাগলাম ... সীমান্তের ওপার  বাংলাদেশ থেকে জঙ্গলে কাঠকুড়াতে মেয়েরা দলবেঁধে এপারে আসে। তারা নয়তো! কিন্তু তারা তো প্রচণ্ড ভয় পায় আমাদের! ক‍্যাম্পের এত কাছাকাছি আসার দুঃসাহস কোনোমতেই দেখাবে না!

বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না! আওয়াজটা আরো স্পষ্ট শোনা গেলো। আহা! কি মিষ্টি। কতোদিন শুনিনি! উপরের দিকে তাকালাম। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো! চার চারটে স্বল্পবয়সী মেয়ে! একঝলকেই বোঝা যাচ্ছে ডেঁপো মেয়ে সব! নেমে আসছে উপর থেকে। মাথা, চোখমুখ, সারাদেহে রং মেখে ভূত! হাতে সবার আবীরের প‍্যাকেট! আমার দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলো, এক মুহুর্তের জন্য! তারপর কি হাসি! সামনেই যে লোভনীয় শিকার! সদ‍্য গোঁফ গজানো এক নব‍্য জওয়ান! উদোম গা! একেবারে নিরস্ত্র! 

 এদিকে আমার অবস্থা শোচনীয়! গলা দিয়ে স্বর বার হচ্ছেনা! পালানোর রাস্তা নেই! কোনোরকমে মিউ মিউ করে বললাম- 
  
 রঙ মত লাগাইয়ে!!!
                                                                                      সমস্বরে জবাব এলো-  কিঁউ দোস্ত! আজ তো হোলি হ‍্যায়!!!

বললাম- হাম আভি নাহাকে আ রহা হুঁ!!!

... তো ফির! দোবারা নাহাওগে!!!
 
বললাম- ডিউটি যানা হ‍্যায়! ছোড় দো মুঝে!!!

... বাহানা মত বানাও! আজ না ছোড়েঙ্গে হাম!!!

বুঝতে পারলাম নিস্কৃতি নেই! একবার ভাবলাম জোরে চিৎকার করে উঠি- মুঝে বাঁচা লো! আমার আওয়াজ সেন্ত্রির কানে ঠিক পৌঁছে যাবে! পরমুহূর্তেই ভাবলাম ছিঃ! আমি না পুরুষ মানুষ! ফৌজি জওয়ান!! তাই আত্মসমর্পণ করলাম, চার গোপিনীর কাছে! শুধু দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে পরণের কাচ্ছা তোয়ালেটাকে শক্ত করে চেপে ধরলাম! যাতে বে-আব্রু না হয়ে যাই!! 

না, শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটলো না। ওরা সবাই মিলে আমার দুটি গালে ও মাথায় ইচ্ছেমতো আবীর মাখালো! তারপর নীচের দিকে তরতরিয়ে নামতে শুরু করলো! ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দিলো! একদম বুকে এসে আঘাত করলো! মরীয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-  আপলোগ কাঁহা রহতে হ‍্যায়!... দূর থেকে আওয়াজ ভেসে আসলো-  বলডোভা! (আমাদের ক‍্যাম্প থেকে অনেক দূরের এক পাহাড়ি বস্তি)
চিৎকার করে বললাম-  হাম যায়েঙ্গে উধার! কোনো সারা পেলাম না। শুধু পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হলো আমার আওয়াজ- হাম যায়েঙ্গে উধার!!

ভালোলাগার এক অদ্ভূত আবেশের মধ্যে ক‍্যাম্পে পৌঁছলাম! ক‍্যাম্পের পরিবেশ অদ্ভুত ঠেকলো!সবাইকে অস্বাভাবিক উৎফুল্ল লাগছিলো! আমার ওই অবস্থা দেখে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো!   কুক ঝান্ডুরাম হাসতে হাসতে বললো- বি.সি. (সহকর্মীরা সবাই আমাকে এই নামেই ডাকতো) তেরেকো ভি নেহি ছোড়া উও লোগ!
আমি জিজ্ঞেস করলাম কোনলোগ! 
... আরে ও হাসিনো! চার হাসিনো! ইঁহা আয়ি থি হোলি মানানে কে লিয়ে!... সবিকো রং লাগাকে চলি গয়ি! হাম শোচ রহে থে আপ বাঁচ গয়ে!! এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো ঝান্ডু!

এবার বুঝতে পারলাম সবকিছু! ব‍্যারাকে ঢুকতেই দেখলাম অর্জুন, গুজরাটি অর্জুন ভাইয়া হাউমাউ করে কাঁদছে! আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো-  বিসি, মেরে লাল! ম‍্যা তেরেকো আপনে দিল কি বাত কহে রহা হুঁ!... সারি জিন্দেগী মে মেরেকো ইতনে খুশিয়া নেহি মিলি, যিতনি আজ মিলি, কসম সে!! (হতে পারে দ্রব্য গুণের পরিণাম!)

মনে মনে আমিও বললাম- কসম সে!!!!

( দিনটি ছিলো আজকের মতোই হোলি উৎসবের দিন- ১৯৯০ সাল। স্থান- মেঘালয়ের গারো হিলসের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার এক বিওপি )








মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪