গল্প
ঋতি
সু ল গ্না চৌ ধু রী
ঋতি আজ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবছে তার ফেলে আসা শৈশব আর কৈশোরের কথা। আজ সকাল থেকেই তার মনটা কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে, শ্রাবণের জমা কাজল কালো মেঘে যেমন আঙুলের একটা টুসকি মারলেই জমা অভিমানভরা বারিধারা ব্যথা হয়ে ঝরে পড়ে পৃথিবীর বুকে, আজ ঋতির মনের ওই একই অবস্থা, কিন্তু তার এই মন মেঘের মন্দিরে পরম মমতায় হাত বোলানোর যাঁর কথা ছিল, তার সেই পরম স্নেহ ভরা নির্ভরতাও আজ আর তার সাথে নেই, গত একবছর আগে পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে চিরনিদ্রায় সমর্পণ হয়েছেন- ঋতির "মা", যে "মা" তাকে সকল দিনে, সকল ক্ষণে বুকে আগলে রাখতেন, সেই মা এখন ঋতির অনুভবে থাকেন, অন্তরের অন্তঃস্থলে তাঁর কন্ঠস্বরখানি বেজে চলে প্রতিনিয়ত তার চারপাশে।বুক ভেঙে যায় ভাবতে বসলে যে তার মা আর নেই, পৃথিবীটাকে কেমন নীল নির্জন মনে হয়। ব্যথার রঙ যে নীল।
এ পৃথিবীতে ঋতির আপনার বলতে- তার বাবা, যিনি অসমর্থ, অশক্ত শরীরে বর্তমান, জরা এসে তাঁকে আক্রমণ করেছে, আর আছে একমাত্র সহোদর যে তাঁর নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, তাই ঋতির মনময়ূর এখন আর এই বাড়িতে এসেও পেখম মেলার সুযোগ পায়না।
ঋতি তার একরত্তি আত্মজকে নিয়ে তার মাতৃত্বের সুখ ভোগ করে, সে এখন সবে আধোবুলি, আর টলমলকরা ছোট্ট দুইখানি পা নিয়ে ঘুরে তাকে মাতৃত্বের স্বাদে মোহিত করে রাখে। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ঋতি তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় কে আনন্দে ভরে রাখতে চায়। কিন্তু পারে কই?
তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়খানি মোটেও সন্তুষ্টিপূর্ণ নয়। এই বাড়ির প্রতিটি কড়িবরগা তাকে দূরেই ঠেলে রেখেছে এই মুহূর্ত পর্যন্ত তা আর আপনার হতে পারেনি।
স্বামী অর্ণব এক প্রাইভেট অফিসে কর্মরত, ঋতি নিজেও কর্মরতা একটি প্রাইভেট কোম্পানি তে- অথচ জীবনের চলার পথে নারী-পুরুষের পদক্ষেপের মাপকাঠি বিচিত্রতায় ভরা থাকে- "ঋতি" নামের মহিলারা বারবার তারই শিকার হয়।
প্রতিদিনের রোজনামচায় খুব সকাল থেকেই ঋতির লড়াই শুরু হয়, দু'জনেই তাদের নিজ, নিজ কর্মস্থলে বের হবেন বলে, অথচ অর্ণব সকাল হলেই বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে দুই পা স্বচ্ছন্দে নাচান, আর অর্ণবের স্ত্রী তার শ্বশুর বাড়ীর প্রতিটি লোকের জন্য প্রচণ্ড পরিমানে নিজেকে উৎসর্গ করে প্রায় ছুটে গিয়ে যখন ঘড়ির কাঁটার সময় অনুযায়ী তার অফিসে প্রবেশ করে, দৈনন্দিন জীবনের বেড়াজাল টপকে, সেখানেও তার প্রবেশের নির্দিষ্ট সময় সারণী প্রায় অতিক্রম করে ফেলে দিনের পর দিন। ফলতঃ সহকর্মীদের তির্যক নজরে পড়ে যায়।
আমরা সকলেই জানি জীবনযুদ্ধটা নিজেকেই লড়তে হয়, সেখানে সমব্যথীর যে বড্ড অভাব, সমব্যথী শব্দটা কর্মক্ষেত্রে, সংসারক্ষেত্রে বড্ড ক্লিশে শোনায়, অথচ, আমরা বুদ্ধুর মতো ভাবি আমার জন্য সে, বা ওরা, বা তিনি বা তারা আছে নিশ্চয়ই! কেউ থাকেনা, থাকতেও যে নেই, প্রতিমুহূর্তে একই অভাব- "কেউ নেই", "কেউ থাকে না" প্রতিমুহূর্তে তাই ব্রহ্মনাদে শব্দ ওঠে , আপোষ করো, আপোষ করা চাই, ঘরে বাইরে, এরই নাম জীবন।
অদ্ভুত ভাবে ঋতি কে ভাবায়-প্রতিদিনের কিছু ঘটে যাওয়াঘটনা, সব মানুষেরই একখানি সহজাত ভালোবাসা আর ভালোলাগা থাকে, তা আমাদের শিরায়, শিরায়, বয়ে যায়, সে সহজাত ভালোবাসার জন্য কসরত করতে হয়না শুধু তাকে ধরে রাখার জন্য সাধনার প্রয়োজন। তার মনের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন, সেই সহজাত ভালোবাসার কাছে না পৌঁছাতে পারলে বা ভালোবাসার কাছে না পৌঁছলে মন ব্যাকুল হয়ে যে কেঁদে ওঠে!
ঋতির সহজাত ভালোবাসা হলো তার গান, সেই ছোট্ট মেয়েবেলা থেকে "মা"-এর হাতখানি ধরে গান শিখতে যাওয়া ঋতিকে মা বুঝিয়েছিলেন গান কে আত্মস্থ করতে পারলে- সেই গান তার আনন্দে, দুঃখে, সুখে, তাকে সঙ্গ দেবে, বোধকরি সব ভালোবাসা থেকে বুঝি একটা পাওনা থাকে-সঙ্গ দেওয়া আর পাওয়া। ছোট্ট ঋতি তাই গানকেই আঁকড়ে থাকতো, আর তার নমনীয় সুরেলা কণ্ঠ স্বরে যে কোনো গান জাদু হয়ে উঠতো। সে খুব ভালো বাগ্মীও বটে, অফিসে কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে দিলে ঋতি সুবক্তা হিসেবে প্রশংসাও কুড়িয়ে নেয়।
এ হেন ঋতি ইদানীং খেয়াল করে তার স্বামীটি মাঝে, মাঝেই তার কাছ থেকে গান শোনার আব্দার করেন- প্রথম দিকটায় সে যারপরনাই বেশ খুশী হয়েছিল, তারপর সে নোটিশ করতে থাকে, আজকাল কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আগে অর্ণব ঋতির কাছে গানের সুর আর কথা শিখতে চায়, ঋতিও প্রানপনে চেষ্টা করে তার স্বামীটি কে গান গুলো আত্মস্থ করিয়ে তোলে। কিন্তু বেশ মজার ঘটনা তার প্রভুটি(স্বামী)সেই অনুষ্ঠানে ঋতিকে গাইতে না দিয়ে ঋতির থেকে তুলে রাখা গান বেশ দরদ ভরে গেয়ে সকলের মন জয় করে নেয়।
আজকাল ঋতির বড্ড অভিমান হয়, যে গান তার পরম প্রিয় ছিল, যা করতে পেরে সে খুব খুশী হতো ধীরে, ধীরে কেমন করে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে তাকে। আজকাল অর্ণব নাকি অফিসের ছোটখাটো অনুষ্ঠানে গান গেয়ে নিজের বেশ কদর বাড়িয়ে তুলেছে। বাড়ীতে এসে সে তার সহধর্মিণী ছাড়া পরিবারের প্রত্যেকের কাছে সে গল্প ফলাও করে বলা ধরেছে। অথচ, শিখে যার কাছ থেকে যায় তাকে সে প্রশংসা থেকে ব্রাত্য করে রাখে। অবাক হয় ঋতি সব কিছু ভেবে তাদের নতুন বিয়ের পর থেকে দেখেছে- তার শিক্ষিত স্বামী তার অফিসের কোনো দপ্তরী চিঠির বয়ানটা পর্যন্ত ঋতি কে দিয়ে লিখিয়ে নেয়, অথচ দাম্পত্য কলহ শুরু হলেই- 'অশিক্ষিত' তকমা এঁটে দেয়, ঋতির সর্ব্বাঙ্গে। এম,বি,এ করা ঋতি তার শিক্ষার সম্মান নিয়েই সেই "অশিক্ষিত" শব্দের প্রতিবাদ করে না, শিক্ষা যে মানুষের অন্তরে, তার চিন্তায়, তার ভাষায়, আর ভাবনায়, তাই কাদার প্রলেপে কাদা না ছিটিয়ে বুদ্ধিমতী নারী চুপ করেই থাকে।
আমরা নারী এই কি আমাদের প্রাপ্য?? ভাবতে, ভাবতে ঋতি বিষাক্ত মন নিয়ে রাতের শয্যায় কুঁকড়ে থাকে, কি স্বার্থপর দুনিয়া যেদিকে তাকাও শুধু প্রয়োজন, আমরা ততক্ষণই, যতক্ষণ আমাদের দেওয়া থাকবে আমরা শুধু দিয়েই যাব? শুধু ই দেব, শ্রম দেব, সেবা দেব, শরীর দেব, অর্থ দেব? সম্মান, ভালোবাসা, স্নেহ সব বিলিয়ে দেব। পান করবো অসম্মান? অপমান?পরিশ্রম? রাতের বালিশ ভিজে যায় তার না পাওয়ার অভিমানে আর বঞ্চনার বাষ্পে।
কিন্তু কি অদ্ভুতভাবে সব রাতের শেষে একটা সুন্দর ভোর আসে, সেই সকালের নতুন আলোতে ঘুম ভেঙে ঋতির গতরাতের সকল গ্লানি অন্তর থেকে মুছে যায়। চোখ খুলে সে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে পৃথিবীর দিকে চায়, চায় তাঁর পরিবারের দিকে, সব অপমানের কদর্যতা নতুন সুর্যের আলো এসে শুষে নিয়ে যায়- সেই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি, যে দৃষ্টি নারীর চিরন্তন, শাশ্বত।
ঋতি তাঁর সুরেলা কণ্ঠস্বরে গেয়ে ওঠে-
"আমার যে সব দিতে হবে "- বিশ্ব কবির গানে বিশ্বচরাচর তখন তাঁর বড্ড পবিত্র লাগে। হেরে যায় সব কলুষতা, কদর্যতা। কন্যা রূপে, প্রিয়া রূপে আর জননী রূপে নারীর তখন মমতাময়ী মূর্তি।
ইচ্ছা
শি বা নী চৌ ধু রী
কো-এডুকেশন স্কুলের ক্লাস এইটের বাংলার ক্লাস।
ছেলে মেয়ে মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ একান্ন জন। ক্লাস নিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের খুব কাছের এক শিক্ষক মশাই।চক ডাস্টার ছাড়াও কদাচিৎ তাঁর হাতে হাত দু'য়েক একটি কঞ্চির ছড়ি দেখা গেলেও সেটির সদ্ব্যবহার করতে কখনো দেখা যায়নি। খুব জোর কখনও সখনও ছড়ি তুলে ছাত্র ছাত্রীদের ভয় দেখাতেন। ক্লাসের এক সারিতে মেয়েরা, অপর সারিতে ছেলেরা বসেছে কাঠের বেঞ্চিতে। লেখাপড়ায় ভালো ছেলেমেয়ে বলে যাদের নাম স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম বেঞ্চ তাদের দখলে।
শিক্ষক মশাই ক্লাসে এসেই বাংলায় রচনা লিখতে বললেন বড়ো হয়ে কে কি হতে চায় সে বিষয়ে। সবাই লেখা শুরু করলো প্রত্যেকেই চায় বড়ো হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক নার্স রেলকর্মী বা ব্যাঙ্ককর্মী হতে।
মেয়েদের সারিতে দ্বিতীয় বেঞ্চে বসা সাধারণ মেধার শ্যামবর্ণ মেয়েটির কলম একেবারে অন্য খাতে চলতে শুরু করলো। পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর তোলার দৌড়ে দৌড়াতে তার ভীষণ অনীহা। তাই পাঠ্য বই পড়ার সময়ও তার সংক্ষিপ্ত। বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে পড়ে গল্পের বই যেগুলো গ্রামের লাইব্রেরী থেকে আনা মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে। বৃহৎ পরিবারে বড়ো হবার সুবাদে সারাদিন কতো রকমের সাংসারিক কথা শোনা। তার কিছু ভালো কিছু মন্দ। হিংসা রেষারেষি নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া, মিথ্যাচার এমন কত কি যে ঘটতো!মেয়েটি লক্ষ্য করতো এতোগুলো মানুষ পরিবারে আছে তাদের প্রত্যেকের চরিত্র আলাদা আলাদা।নিজেকেও তো একশো ভাগ মেলাতে পারেনা কারো সঙ্গে!
সাংসারিক কূটকচালি থেকে সবসময় নিজেকে দূরে রেখে ছোটো ছোটো ভাইবোনদের আগলে রাখার চেষ্টা করতো।রূঢ়কথা কটুকথা যেমন বলতে পারতো না তেমনি কেউ কাউকে বললে বুকের ভেতরটা ব্যথায় টনটন করতো। প্রতিবাদ করতে পারতোনা হয়তো সেই বয়স হয়নি বলে! কিন্তু মনে মনে ভাবতো, সবাই মিলেমিশে হাসি খুশি হয়ে থাকলেই তো ভালো, তাহলে সবাই ভালোভাবে বাঁচতে পারে!
এসব দেখতে দেখতে মেয়েটি নিজেই নিজেকে কথা দিয়েছিল বড়ো হয়ে ভালো গৃহবধূ হবে। সেকথাই সাহস করে বাংলা খাতায় লিখেছিল। বড়ো হয়ে সে ভালো গৃহবধূ হতে চায়।
বাংলার শিক্ষক মেয়েটির খাতাটি পড়ে কিছুক্ষণ কপালে ভাঁজ ফেলে জোরে জোরে ক্লাসের সবাইকে শোনানোর পর হাসির রোল উঠেছিল সারা ক্লাস জুড়ে।
বন্ধুরা হাসতে হাসতে বলেছিল 'বিয়ে করার এতো
শখ! তাহলে আর স্কুলে আসছিস কেন? বাড়িতে বল তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে!'
শ্যামলা স্বল্পভাষী কিন্তু মনে মনে দৃঢ়চেতা মেয়েটি বন্ধুদের সাথে বাকবিতণ্ডা করেনি ঠিকই তবে নিজের সঙ্কল্প থেকে একচুলও নড়েনি। লেখাপড়া করে চাকরিই যে করতে হবে এমন দিব্যি কে দিয়েছে! নিজের ইচ্ছে স্বাধীনতার সাথে লেখাপড়ার সম্পর্ক কোথায় আজও খুঁজে পায়নি!
যাইহোক, স্কুল কলেজের পাঠ শেষ করে একদিন মেয়েটির বিয়ে হলো বিরাট একান্নবর্তী সংসারে যেখানে প্রতি পদক্ষেপে অন্যের অনুমতি নিতে হয়, স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা নেই। কারণে অকারণে তীক্ষ্ণ বাক্যবান তীরের মতো এসে বেঁধে মেয়েটির বুকে! এ যেন এক আজব পরিবেশ! চব্বিশ ঘন্টা পুতুল নাচের পুতুলের মতো যেমন নাচাবে নাচতে হবে। হে ঈশ্বর! এ কোন কঠিন পরীক্ষায় ফেললে! নিজের শখ সাধ জলাঞ্জলি দিলো। কিন্তু যে গোপন ইচ্ছেটা মনের মধ্যে লালন করে রেখেছে তার ন্যূনতম সুযোগ নেই। তবু মুখ বুজে মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে একটু একটু করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অবিরত। তবে একটা সত্য সে বুঝেছে, যে কোন পরিবারের প্রতিটি সদস্য পরস্পর পরস্পরের উপর সহানুভূতিশীল না হলে প্রত্যেকের মধ্যে একাত্মতা না থাকলে পরিবারের শান্তির পায়রা কখনো কার্নিশে এসে বসেনা।
এখন মেয়েটির একান্ত নিজের সংসার, দুই পুত্র এক পুত্রবধূ ও ছোট্ট মিষ্টি এক নাতনি নিয়ে। এখনও সে ভালো গৃহবধূ হবার লক্ষ্যে অচল। ইচ্ছেকে মূল্য দিতে গিয়ে কতো প্রতিকূলতার মধ্যে হাঁটতে হয়েছে, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে অন্তরাত্মা, নিঃশব্দ রক্ত প্রবাহে কতোবার ভিজেছে মন হিসাব নেই আর। আরও বাকি পথ চলা, হয়তো আমৃত্যু। পরিবারের শান্তিই জীবনের একমাত্র কাম্য। সফলতা বিফলতা জীবনের অংশ, তাই নিয়েই এগিয়ে চলা। ঈশ্বর অসীম করুণায় মেয়েটি সবসময় পাশে পেয়েছে তার সন্তানদের ও কন্যাসম পুত্রবধূকে।
সময়ের অপেক্ষা
সু জা তা দা স
এই যে অনিন্দ্য সুন্দর ঘন নীল অথবা শৈবাল রূপ জলরাশি, এ'তো শুধু রূপসী নয়!! সে'তো মহা জলধী-
বৈভবে পরিপূর্ণ সাগর, যার ডাকে এখানে ছুটে ছুটে আসা এর অমোঘ ডাক শুনে বারে বারে- বলতে বলতে এগিয়ে যেতে থাকলো শৈবাল জলরাশির দিকে দুই হাত ছড়িয়ে- শৈবালের এগিয়ে যাওয়া দেখে আরতি চেঁচিয়ে বলতে থাকলো আর যাবেন না শৈবালদা, এরপর জল অনেক গভীর কিন্তু-
কিন্তু শৈবালকে আজ শৈল্পিকতায় ভর করেছে, সে যেন কোনও কথা কানে নিতে চাইছে না বা কানে যাচ্ছে না। এমন ভাবেই চলতে থাকলো সকলের চিৎকারকে অমান্য করে- হঠাৎ এক হ্যাঁচকা টান, উল্টো দিকে পড়তে পড়তে এক সুন্দরী মহিলার বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে চোখ পিটপিট করতে থাকলো সকলের শৈবালদা মানে শৈবাল চট্টরাজ। কী ব্যাপার? মরার আর জায়গা খুঁজে পাননি সোজা টিকিট কেটে পুরী ধামে চলে এসেছেন? বললেন এক মহিলা উচ্চস্বরে। চমকিত শৈবাল বলে উঠলো নন ন না মানে, বলতে বলতেই হঠাৎ এক বিরাট ঢেউ এসে দুজকেই ভাসিয়ে নিলো,
নিজেকে সোজা রাখতে না পেরে আবার ঐ মহিলার ঘাড়েই হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে শৈবালদা বলতে থাকলেন সরি সরি ম্যাডাম।
কিন্তু প্রচণ্ড জলের ঢেউয়ে দুজনেই একসাথে পপাত ধরনীতলে। একটা সময় জলের ধাক্কায় নাকানিচোবানি খেয়ে পাড়ে এসে দাঁড়ালেন দুজনেই, ততক্ষণে ভদ্রমহিলার অবস্থাও শোচনীয়- মহিলার মুখের বচন আর জলের ধাক্কা সামলে শৈবালদার অবস্থাও দেখার মত তখন।
কিন্তু দুই ধাক্কায় কাহিল হয়েও শৈবালদা খুব ম্লান হেসে অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে মহিলাকে বললেন আসলে অতটা দূরে চলে গেছি আমিও বুঝতে পারিনি ম্যাডাম। হঠাৎ মহিলা হাত বাড়িয়ে শৈবালের কান থেকে টান দিয়ে একটা তার খুলে আনলেন শৈবালের চোখের সামনে, আর কটমট করে তাকিয়ে বললেন এটা কানে গুজলে আর শুনবেন কী ভাবে? আজকাল'যে কী' ফ্যাশন হয়েছে! যত্তসব!! বুড়ো মানুষেরাও বাদ যান'না বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন রাস্তার দিকে।
এতক্ষণ আরতি ও আর সকলে দুর থেকে দেখছিল ব্যাপারটা, মহিলা চলে যেতেই আরতি এগিয়ে এসে বলল কী'হতো বলুন তো শৈবালদা আমরা মাসিমাকে কী কৈফিয়ত দিতাম?
কী'যে ছেলেমানুষি করেন কে'জানে এবার চলুন ফেরা যাক, বলে হাঁটতে থাকলো আরতি পেছন দিকে না'তাকিয়েই।
সকলেই কম'বেশি বলতে থাকলো শৈবালকে, জোর বেঁচে গেলেন দাদা ঐ মহিলার জন্য, একটু ধন্যবাদ দেবেন তাঁকে।
শৈবাল কিন্তু সেই এক'রকম ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো, মহিলার কন্ঠস্বর এখনও তার কানে ভ্রমরের মতোই গুঞ্জন করছিল তখনও আর সাথে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ,
সংসারে মা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও নারীকে কখনও আনার কথা চিন্তা করেননি শৈবাল, কারন সেই মেয়েটি মায়ের সাথে যদি মানিয়ে চলতে না পারেন, মাকে সে দুঃখ দিতে পারবে'না শেষ বয়সে। আবার হাতে ধরে নিয়ে আসা মেয়েটিকে দুঃখ দেবেন কীভাবে এটা ভাবতে ভাবতেই বিয়ে আর করা হয়ে উঠলো না মধ্য পঁয়তাল্লিশের শৈবালের।
ইন্ডিয়ান অয়েলে চাকরি করা এই মানুষটি শুধু নিরীহই না বাচ্চাদের ভীষণ ভালোবাসেন এবং ভীষণ কেয়ারিং, আর মানিয়ে নেওয়ার বা মানানোর ক্ষমতাও অপরিসীম, তাই প্রতি বছর এই পুরীতে বেড়ানোয় অফিস কোলিগদের সঙ্গী হন শৈবাল। গ্রুপের বাচ্চা থেকে বড় সবাই শৈবালকে খুব ভালোবাসেন কারন এই নির্ঝঞ্ঝাট মানুষটি সব বাচ্চাদের আগলে রাখেন সন্তানের মতো এই ঘোরার কটা দিন। এহেন শৈবালদা হঠাৎ নিজেই এমন একটা কাজ করে বসবেন সেটা কেউই হয়তো ভাবতে পারেনি, তাই সকলেই একটু একটু রাগ প্রকাশ করে ফেললেন, মাসিমাকে কী জবাব দিতেন ফিরে গিয়ে যদি কোনও অঘটন ঘটত এই কারনে।
অনেকটা সময় নিজের মনেই দাঁড়িয়ে রইলেন শৈবাল সমুদ্রের ধারে ভিজে জামা কাপড়ে, হঠাৎ সম্বিত ফিরলো একজনের কথায়, দাদা এবার হোটেলে যান অনেকক্ষণ ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঠান্ডা লেগে যাবে। একটু বোকা হেসে হ্যাঁ'যাই বলে হাঁটতে থাকলেন হোটেলের দিকে, শৈবাল কিন্তু মন থেকে মহিলার ছোঁয়া আর কন্ঠস্বর মুছতে পারলেন'না কিছুতেই। বারে'বারেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন শৈবাল আর খুঁজে চলেছেন ঐ মহিলাকে যাঁর একটু স্পর্শ তাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। সেইদিন বিকেল থেকেই খোঁজ শুরু করেছেন শৈবাল অন্তত ধন্যবাদ'তো দিতে হবে, কারন তিনি হয়তো বিবাহিতাও হতে পারেন। এই ভাবেই খুঁজতে খুঁজতে একদিন মন্দিরের ভিড়ের ভিতর থেকে একটা চিৎকারের শব্দে চমকে উঠলেন শৈবাল, এক মহিলা বলছেন, আপনি তখন থেকে আমাকে ঠেলে এগোনোর চেষ্টা চালিয়ে গেলেও, আমাকে সরিয়ে আপনি এগোবেন সেটা আমি হতে দেবো'না। গলার আওয়াজ শুনেই চিনতে পারলেন শৈবালদা কারন সেদিন এই মহিলা তাকে সারা জীবনের ঝাড় একসাথে ঝেড়েছিলেন, যদিও জলে বার বার পড়ে যাবার কারনে বেশিটাই শুনতে পাননি।
মন্দিরের একটা কোনায় দাঁড়িয়ে থাকলেন এই মনে করে দেখা যখন পেয়েছি আজ ধন্যবাদ দিয়েই ফিরবো, এই মনোভাব নিয়ে-
অনেক কষ্ট করে মনকে শক্ত করে আর সাহস সঞ্চয় করে মহিলা বেরোনোর সাথে সাথে বললেন সেদিন আমাকে যে বিপদ থেকে আপনি উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ম্যাডাম। আচমকা শৈবালের কথায় অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে, ভ্রূ'যুগল কুঁচকে বললেন অঅ আপনি! ধন্যবাদ দেবার মতো এমন কোনও কাজ আমি করিনি তবে দ্বিতীয়বারে এই কাজটি করার আগে দু'বার ভাববেন কারন বারবার আমি বাঁচাতে আসবো'না। তা'তো ঠিকই তা'তো ঠিকই ম্যাডাম, বললেন শৈবাল।
আপনি একা? মানে আপনার সাথে আর কেউ মানে আপনার স্বামীকে দেখছি না ম্যাডাম? আবারও বললেন শৈবাল। হাঁটতে হাঁটতেই পেছন ঘুরে ভদ্রমহিলা কটমট করে তাকিয়ে বললেন, কেন স্বামী ছাড়া মহিলারা চলতে পারেন'না আপনাকে এই কথাটা কে বললেন শৈবাল বাবু? আর তখন থেকে মানে মানে করছেন কেন প্রতিটি সেন্টেন্সের আগে!! যতসব বাজে অভ্যাস। নিজের নামটা মহিলার মুখে শুনে একটু অবাক হলেও আনন্দে ভাসলেন এই ভাবনায় যে মহিলা তার কথা মনে রেখেছেন। মনে মনে আনন্দ পেলেও মুখে প্রকাশ না করে বললেন, না'মানে একাতো কেউ আসেন'না, মানে বিবাহিত নারী'পুরুষই তো বেশি দেখি তাই আর কী, বললেন শৈবাল।
এতো মানে মানে না করে আপনি বলুনতো আপনি স্ত্রীকে সঙ্গে আনেননি কেন? হঠাৎ প্রশ্ন মহিলাটির।
শৈবাল আমতা আমতা করে বললেন, আসলে আমার স্ত্রী নেই।
-মরে বেঁচেছেন তাহলে, বললেন মহিলা।
আরে না আমি বিয়েই করিনি মানে সময় পাইনি আরকি।
এই ভাবেই শুরু হয়ে যখন কথোপকথন শেষ হলো ততক্ষণে শৈবাল জানতে পেরেছে মহিলার নাম শিবানী এবং সে এখনও অনূঢ়া।
অজস্র বাকবিতণ্ডার মাঝেও দুজনেই অনুভব করলেন কিছু ভালো গুণ দুজনেরই আছে সুতরাং আগামীতে আবার দেখা হবে এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে আর দিয়ে ফিরে চললেন হোটেলের দিকে শৈবাল।
প্রথম প্রথম সকলেই এই অন্যমনস্কতাকে আগের দিনের সকালের ঘটনার কথাই ভাবিয়েছে, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ শৈবালদার অন্তর্ধান রহস্য সকলের কাছে পরিষ্কার না হওয়ায় সকলেই অবাক হলো বিশেষ করে আরতি। কারন একদিন আরতি দেখলো প্রতিদিনের রুটিনে বিঘ্ন ঘটেছে, শৈবালদা কারও দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজ করছেন'না সকালের চা খাওয়ার আর সমুদ্র স্নানে যাবার জন্য। তখনই ব্যাপার কী!! দেখার জন্য সকলে শৈবালের ঘরের সামনে এসে দেখলো তালা দেওয়া, তাদের না'জানিয়ে যাওয়ায় সকলেই অবাক হলো। কোথায় গেল শৈবালদা, কখনও তো এমন করেন'না,
হয়তো সকলের কথায় দুঃখ পেয়েছেন, তাই কাউকে ডাকেননি- এটা মনে করে আরতি তার ছেলে বর ও আর সকলেই সমুদ্রের দিকে রওনা দিল সমুদ্রের ধারেই আছেন মনে করে। এর মধ্যে মৈত্রেয়ী আর মৈনাক- এরা হানিমুন করতে এসেছে, তাই একটু দূরে দূরেই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর সকলেই ওদের মতো করেই চলতে দেয় কারন ওরা সকলের থেকে অনেকটাই ছোট।
একদিন মৈনাক আর মৈত্রেয়ী সকালের বাসে পুরীর আশেপাশের সাইড সিন দেখতে গিয়ে কোনারকের সূর্যমন্দিরে শৈবালদাকে ঐ মহিলার সাথে দেখে অবাক হলো, শুধু তাই নয় দুজনের অন্তরঙ্গতা দেখে তাদের দুজনের চক্ষু চড়কগাছ। যদিও শৈবালদা আর ঐ মহিলা এতটাই নিজেদের নিয়ে মশগুল যে এঁদের দুজনকে খেয়ালই করলো'না দুজনে, ওখান থেকেই আরতিকে ফোন করে এ খবর জানিয়ে দিল মৈনাক। আরতি শুনতে শুনতে প্রথমে একটু অবাক হলেও মনে মনে খুশিই হলো এই সংবাদে, কারন সেও মনেপ্রানে চাইত শৈবালদার একটা সংসার হোক্, মাসিমা আর ক'দিন, তারপর কে দেখবে এই লোকটাকে স্বার্থের সংসারে সবাই স্বার্থ নিয়েই চলে। আরতি মনে মনে ভাবলো, শুধু মহিলা সম্বন্ধে একটু ভালো করে খোঁজ খবর নিতে হবে।
অনেক রাতে শৈবাল ফিরলে আরতি এলো শৈবালের দরজায়, ঠক্ ঠক্ শব্দ করতে লাগলো দরজায়।
আসছি ... ভেতর থেকে আওয়াজ এলো এবং সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল।
আরতিকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু চমকালো শৈবাল, কারন এই মেয়েটিকে যেমন সে শ্রদ্ধা করে তেমনই অনেক ভালোবাসে আর ভয়ও পায়। আরতির দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত শক্তি আছে, ও তাকালে শৈবালের মনে হয় ভেতরটা যেন পুরোটাই দেখতে পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিয়ে শৈবাল বলল কিছু বলবি আরি?
-তোমার সময় হবে একটু শৈবালদা? বলল আরতি।
একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিয়ে শৈবাল বলল আয় ভিতরে। কোনো রকম ভনিতায় না'গিয়ে আরতি বলল, তুমি খুশি তো দাদা?
চমকে তাকিয়ে মাথা নিচু করলো শৈবাল। বারবার মাথা কেন নিচু করছো দাদা, আমি খুব খুশী, তবে আমি এটাও চাই শেষে তুমি দুঃখ না'পাও, তাই আমি একবার ঐ ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতে চাই দাদা, তুমি যদি অনুমতি দাও।
- আমিই বলতাম তোকে আরি, কারন একমাত্র তুইই আমার ভালো চাস এটা আমি জানি'রে আরি। কিন্তু তুই ব্যপারটা ভালোমতো নিবি কিনা ভাবছিলাম, তুই তো দেখেছিস শিবানীকে মা পছন্দ করবেন তো আরি?
বলে এক আকাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো আরতির দিকে শৈবাল।
আসলে বড্ড কটকট করে কথা বলে, তবে মনটা ভালোরে আরি। আরতি চমকে তাকালো শৈবালের দিকে তারপর একটু হেসে বলল, ওটা নিয়ে তুমি ভেবনা দাদা, আমি আছি তো, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো আরতি। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল মাসিমার দায়িত্ব আমার উপরেই ছাড় দাদা।
তাহলে কাল বিকেলে উনাকে ডেকে নাও আমি কথা বলতে চাই ওনার সাথে, কারন তুমি কষ্ট পাও এটা আমি দেখতে পারবোনা, - বলে বেরিয়ে এলো আরতি শৈবালের ঘর থেকে।
আজ ফিরে চলেছে সকলে পুরী থেকে, সকলেরই মন খুব খারাপ, কারন আবার হয়তো এক বছর বা তারও পরে আসবে সময় সুযোগ মতো, গাড়িতে উঠে যার যার মতো খেয়ে নিল তারপর বিছানা পেতে নিয়ে নিজের নিজের মতো সকলেই শুয়ে পড়লো।
শিবানীদি এসেছিল সকলকে সী'অফ করতে কারন তার টিকিট দুদিন পরের।
সবাই গাড়িতে উঠে এলে আরতি দেখেছিল শিবানীদির মন খারাপের মুখটা। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও শুধু আরতি জেগে রইলো, কারন সে কিছুতেই ট্রেনে ঘুমাতে পারে'না, তবে আজ ঘুম না'আসার জন্য তার কোনও খেদ নেই, কারন প্রথম দিনের ব্যবহারে একটু হলেও ভয় ছিল আরতির, কারন মহিলা যেভাবে কথা শোনাচ্ছিলেন শৈবালদাকে, তাই দেখে মনে হয়েছিল মহিলাটি জাঁদরেল। কিন্তু কাল শিবানীদির ব্যবহারে ও আন্তরিকতায় আরতি মুগ্ধ।
পেশায় উকিল হওয়ায় তার মধ্যে এই কঠোরতা চলে এসেছে, সেটা শুধু বাইরের খোলসে, ভেতরে নরম এক মাতৃভাব বর্তমান। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইবোনদের মানুষ করে বিয়ে দিয়ে তাদের সংসারে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নিজের জীবনের অনেকটা সময় চলে গেছে। তারপর মায়ের দেখাশোনা। বিয়ের কথা আর ভাবতে পারেনি।
এখানে এসে যে এরকম একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাবে সেটা দুদিন আগেও চিন্তা করেনি, আসলে মা মারা যাবার পর প্রতি বছরই আসে শিবানীদি পুরী। কোনও দিন তো দেখা হয়নি তাদের সাথে। আসলে সময়, সময় না হলে কিছুই হবে না।
আজ মনটা খুব ভালো হয়ে আছে কারন শৈবালদা এখান থেকেই দেরি হলেও নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছে।
চিন্তার মাঝেই ট্রেনের থামা আর চলার শব্দের সাথে এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশন পেরোনোর খবর জানান দিয়ে যাচ্ছিল জেগে থাকা আরতিকে। হঠাৎ শোয়া অবস্থাতেই দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকালো জগন্নাথের উদ্দেশ্যে, তারপর নিশ্চিন্ত মনে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো আরতি। আর অদ্ভুত ভাবে কখন যেন তার এতোদিনের পুরোনো অভ্যাস পাল্টে ফেলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো সে।।
উপমহাদেশের গল্প
আ শু তো ষ দে ব না থ
কুয়াশার ভোরে বেরিয়েছিল গৌরাঙ্গ ওরফে গৌর। রাত্রির আঁধার ফিকে হবার অনেক আগেই সনকা গৌর, নিতুকে ডেকে দিয়েছে, গৌর নিতুকে নিয়ে যা, নাড়া কাটে নিয়ে আয়। আমাগো রাখালি বকনাটা গাভীন হইছে। বিয়োলে অনেক দুধ দেবে। দুধ বেচে তগো শীতের জামা কিনে দেব। সনকার কথায় কোনো উত্তর দেয়নি গৌর। গাই বিয়লে দুধ হবে। দুধ যে খুব ভালোবাসে গৌর।তাছাড়া এই শীতে একটা গরম জামার যে খুবই দরকার। না হলে... তবু এই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে এই কুয়াশার ভোরে মাঠে যাবার সময় তেরো পেরিয়ে চৌদ্দয় পড়া গৌর বলেছিল, মা ফ্যানেভাত রান্ধ। রাত্তিরে খালি খুদির জাউ খাইয়ে এখন সে রকম তাগদ পাতিছেনে। গৌরের এই কথায় সনকা কিছু সময় চুপ থেকে বলেছিল, বিহান থাকতি না গেলি পাবিনে বাপ। কাল বৈকালে পোদ্দারগো ধান দাইছে। অনেক বালাম ধানের নাড়া আছে ডরে। আমি কর্তাকে বলিছি। ভোর ভোর থাকতি যা, না হলি পাবিনে। আমি পারুলকে নিয়ে বামুন বাড়ি ধান ভানতি যাতিচি। ধান ভানা হলি বামুন মা চাল দিলে নিয়ে আসে রানবানে।
গৌর তার দুঃখিনী মায়ের অবাধ্য কখনো হয় না। তাই ভোরের কুয়াশায় ভাই নিতুকে নিয়ে কাস্তে হাতে মাঠে, শিশির ভেজা আলপথে চলে এসেছে। দিগন্ত জোড়া মাঠ, নদীর ওপার থেকে এপারে পর্যন্ত ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। সেই কুয়াশায় ভোরের সূর্য খাবি খাচ্ছিল। আর তো ক্ষুধার্ত দুই কিশোর শেষ পৌষের শীতে কাঁপতে কাঁপতে শিশিরসিক্ত মাঠের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নাড়া কাটতে শুরু করে। গৌর একলাইন ধরে নাড়া কেটে রেখে যায়। নিতু সেগুলি এক জায়গায় জড়ো করে রাখে। এই ভাবে নাড়া কাটতে কাটতে কখন যে কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদ ওঠে ঝলমলিয়ে, ওরা খেয়াল করে না। রোদের তাপে ওদের জড়তা কেটে যেতেই ওরা বেশ আরাম বোধ করতে থাকে। আরো একটু বেলা বাড়তেই গৌর নাড়া কাটতে কাটতে আকাশের দিকে তাকায়। মাথার উপর দিগন্ত বিস্তীর্ণ নীল আকাশ। নদীর ওপার পর্যন্ত দেখা যায়। নদীতে তখন অনেক পাল তোলা নৌকা গোলপাতা, বিচেলী, ধান ও শীতের সবজি নিয়ে চলেছে দূরের কোনো হাটে। আর নদীর এপারে সোনালী ধানখেতের শেষে সবুজ গাছপালায় ঘেরা জনবসতি। নদী পারাপারের জন্য উঁচু টেলিগ্রাফ পোষ্ট এর মাথায় বাঁধা তারে বাতাসের শব্দ কাছে গিয়ে কান পাতলেই শোনা যায়। আকাশে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের ঘুড়ি লাট খাচ্ছে। সমস্ত ধানমাঠ জুড়ে পাকাধান কাটার উৎসব চলছে। সারা ধান মাঠ জুড়ে চাষীদের পাকা ধান কাটার সমারোহ। গৌর, নিতাই নাড়া কাটতে কাটতে ঘুড়ি ওড়ান দেখে দু'একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির জন্য দৌড়ায়। আবার এসে নাড়া কাটে। আড়াই বিঘের জমির সবটা ওরা কাটতে পারে না। রোদ উঠলে শীতের জড়তা কাটতেই চাঙ্গা হতে ওরা দুপুর পর্যন্ত নাড়া কাটে। বোঝা বেঁধে বেঁধে দুই ভাই দু তিন বার বাড়িতে রেখেও আসে। তবে আরো অনেক নাড়া থেকে যায়। এই আকাশ আর সোনালী পাকা ধানের গন্ধভরা বাতাসের মধ্যে বিস্ময়ের পর আরো বিস্ময় থেকে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের খিদের অনুভূতিও বাড়তে থাকে। শেষ নাড়ার বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ওরা দেখতে পেল ভাটার টানে খালের জল অনেক নিচে নেমে গেছে। কেয়া ঝাড়ের নিচে কাদা জলে কয়েক জনে মাছ ধরছে হাতড়ে হাতড়ে। বেলে, পুঁটি, রয়না, ট্যাংরা, চিংড়ি এইসব মাছ। বা আমরাও কিছু মাছ ধরি এমন ভাবনায় নাড়ার বোঝা নামিয়ে রেখে গৌর নিতুকে নিয়ে মাছ ধরতে নেমে গেলো। কাদা জলে এইসব ছোট ছোট মাছ ধরতে গৌর নিতাই খুবই পটু। কিছু সময়ের মধ্যেই গৌরের কোমরে বাঁধা গামছার কোচড় ভরে গেলো বেলে পুঁটি ট্যাংরা, চিংড়ি আর রয়না মাছে। কিছু সময়ের মধ্যেই খালে জোয়ারের জল ঢুকতেই নিতাই গৌরকে বলল, এই দাদা বাড়ি চল খিদে পাইছে। যাব ভাই আরেকটু জল বাড়ুক।
না। তুই চল। গোরার কথায় নিতুর ধৈর্য মানে না। সে কোনো ভাবে গা ধুয়ে উঠে পড়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে। পৌষের উত্তরের বাতাসের কামড়ে রোদ ও তেমন গায় লাগে না। গৌর জোয়ারের জলে নাইবার জন্য গামছায় বাঁধা মাছগুলো নিতুর হাতে দিয়ে বলে, ভাই দেখিস। আকাশে পাজি চিল আছে।
জোয়ারের জলে খাল ভরে যায়। কেয়া ঝাড়ের সতেজ ডগাগুলো জোয়ারের স্রোতে দুলতে থাকে তিরতির করে। গৌর শীত উপেক্ষা করে চান করে উঠে আসে। চাদর দিয়ে গা হাত পা মুছে সেই চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। প্যান্টটা খুলে নিংড়ে নিয়ে আবার পরে নাড়ার বোঝাটা মাথায় তুলে নেয় গৌর। নিতুর হাতে মাছের পুঁটলি, নিতু গৌরের পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকে।
মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় উঠে আসে ওরা। পাল পাড়া, মালো পাড়া, পেরিয়ে আরো কিছুটা বাঁশঝাড়, বেতবন আর কিছুটা বন জঙ্গল পেরিয়ে গৌর নিতুদের বাড়ি। বাড়ি বলতে তালপাতার ছাউনির কুঁড়েঘর। সামনে বারান্দা। বাঁশের কচার বেড়া। চালায় অনেক জায়গায় ফাঁক ফোকর। খুব জোর বৃষ্টি হলে ভিজে যায় কাঁথা বালিশ মশারী আরো এটা সেটা।
গৌর বাড়ি ঢুকেই কাঠাল তলায় রাঙি বকনাটার সামনে নাড়ার বোঝাটা ফেলে দেয়। গৌর নিতুর ছোট বোন পারুল কাঁঠাল তলার এক পাশে বসে দা দিয়ে বাঁশের কঞ্চি কাটছিল আখায় জ্বাল দেবার জন্য।
গৌর পারুলের কাছে জিজ্ঞেস করল, বুন মা বাড়ি আসে নেই? ভাত রান্ধে নেই?আমাগো বুঝি খিদে পায় নেই? সেই কোন বিহানে উঠে নাড়া কাটতি গেলাম। বলতে বলতে নিতু একটা ভাঙা ঝুড়িতে গামছায় বাঁধা মাছগুলো ঢেলে দিল। দেখে পারুল খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। দাদা তোমরা এত মাছ ধরিচ? আমি মাকে ডাকে নিয়ে আসি। বলেই পারুল এক দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। একচালা রান্নাঘর থেকে নিতু বটি বার করে এনে মাছ কুটতে বসলো উঠোনের একপাশে। গৌর ভিজে চাদর আর প্যান্ট খুলে রেখে তার মায়ের একখানা পুরনো শাড়ি পরে। পৌষের বেলা খুবই তাড়াতাড়ি চলে যায়। এই দুপুরে দু 'একটা শালিক পোকামাকড় খুঁজে আহার সেরে নিচ্ছে। থেকে থেকে রাঙি বকনাটা ডাকছে।
গৌর নিতাইয়ের বাবা থেকেও নেই। গায়ে গতরে তাগড়াই জোয়ান নটবর কিছুটা খামখেয়ালী ও ভবঘুরে স্বভাবের। তিনদিন কোথায়ও কোনো কাজ করেতো চারদিন বসে ভালোমন্দ খাবে। ভাত তরকারি মাছের ঝোল, দুধ, গুড়। চারজনের খাবার একাই খেতে না পারলে বেঁধে যেত চরম অশান্তি। তুমুল ঝগড়া বিবাদ থেকে মারমারি ভাঙচুরও। সবসময় সনকাকে দায়ী করত নটবর।লোকের বাড়ি কাজ করে, চেয়েটেয়ে, ধারকর্জ করে ভাত ভাল তরিতরকারি, আর ছেলেদের ধরে আনা রান্না করা মাছ। সবটাই নটবর জোর করে কেড়ে খেত। না হলে মারধর, জিনিসপত্র ভাঙা। একদিন গৌর সনকার পক্ষ নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তুমি আমার মায়ের এ মারবা না। তুমি না দেও খেতি, আর না দেও পরতি। মায়ের এ মারতি তোমার লজ্জা করে না । এতদিন ধরে গৌর পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে যে কথা শুনে এসেছে, সেই কথাটাই বলল বাবার সামনে দাঁড়িয়ে।
বারে বেটা বা! মায়ের ছেলে লায়েক হইছিস তো এখন থেকে তুই তোর মায়ে রে কামাই করে খাওয়া। বলে চুপ হয়ে গিয়েছিল নটবর। পরদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে সে। প্রায় ছয় মাস হতে চলল তার আর কোনো খোঁজই নেই। গেরুয়া কাপড় পরা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। সঙ্গে রাধা বৈষ্টমি। অনেকেই নাকি তাকে দেখেছে শিববাড়ির মেলায়।
গৌর এখন এই দুপুর গড়ানো বেলায় রান্না ঘরের হাড়ি ডেকচি কড়াই আতিপাতি করে খোঁজে। কোথায়ও কোনো ভাত পায় নাকি। সে গরম বাসি পান্তা যাই হোক না কেন। গতকাল রাত থেকেই তো আধপেটা খেয়ে আছে। সকালে মাকে ফ্যানভাত রাঁধতে বলায় তার মা বলেছিল, নাড়া কাটতে যেতে। আর বলেছিল বামুনবাড়ি ধান ভানা হলে বামুন মার কাছ থেকে চাল এনে ভাত রান্না করে রাখবে। নাড়া কেটে এসে মা ভাই বোন একসঙ্গে রোদে বসে গরম গরম ভাত খাবে বেগুন পোড়া, তেল নুন আর কাঁচা মরিচ দিয়ে। এতসব ভাবনায় গৌরের চোখে জল চলে আসে। সে বাইরে বেরিয়ে এসে নিতাইকে বলে, ভাই, তুই মাছ কুটে কী দিয়ে খাবি? মা তো ভাতই রানধে নেই। ঘরে বুঝি চাল ও নেই।
এমন সময় সনকা আসে পারুলকে নিয়ে।পরনে পুরনো তাঁতের শাড়ি। মাথার চুল রুক্ষ। অনেকদিন তেল না দেওয়ায়। মা দেক দেক দাদারা কত মাছ ধরিচে।
সনকাকে দেখে গৌর নিতাই মায়ের চোখে তাকায়। ব্যাকুল চোখের দৃষ্টিতে। তাদের ক্ষুধার্ত চোখের দৃষ্টিতে ভাতের প্রত্যাশা।
দেখে সনকার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আহারে বাছারা সারাদিন অনাহারে।
কবে যে তার এই দুর্দিন ঘুচবে? সেই সঙ্গে একটা দুর্ভাবনাও থেকে যায়। এই ছেলেরা বড়ো হলে ওরা ওদের বাবার মত হবে না তো আবার? হয় তো হবে না। এই আশার আলোয় তার চোখ স্থির হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য।
গৌর তো এখনই তালগাছ ইজারা নিতে চায়। ছয় সাতটি তালগাছ ইজারা নিয়ে বাঁশ বেঁধে তাদের মুচি কেটে রস নামিয়ে সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানালে ভালই রোজগার হয়। কিন্তু সনকা ঠিক এই মুহূর্তে রাজি হতে পারছে না। পেল্লায় তালগাছ সব গাছ ছাড়িয়ে তাতে বাঁশ বেঁধে তরতরিয়ে কাঠ বিড়ালের মত ক্ষিপ্রতায় উঠে যেতে পারে গৌর। কিন্তু কোমরের রশিতে তিন চারটা মাটির ভাঁড় ঝুলিয়ে সঙ্গে ছুরি নিয়ে তালগাছ রোজ রোজ ওঠা নামা করা তো কম ঝক্কি না। এত ছোটো ও এখন। সেই কারণে সনকা গৌরের প্রস্তাবে রাজি হতে পারছে না।
মা, বিহানে নাড়া কাটতি যাবার সময় তুমি যে বলিলে, তুমি বামুন বাড়ি ধান ভানতি যাবা। ধান ভানা হলি বামুন মা চাল দেবে। নিয়ে আসে ভাত রান্ধে রাখবা। আমরা নাড়া কাটে আসে গরম ভাত খাব বাগুন পোড়া আর কাঁচা মরিচ দিয়ে।
গৌরের এই জিজ্ঞাসায় সনকার মুখে কোনো কিছু আর বলার থাকে না। নিজেকে ভারী অপরাধী মনে হয় তার। ভীষন অপরাধী।
সনকা দাঁড়িয়ে থাকে। ক্ষুধার্ত ছেলেদের দেওয়া কথা সে রাখতে পারেনি। সে অনেক চেষ্টা করেও চাল জোগাড় করতে না পারার জন্য একটা ব্যাকুলতা থেকে যায় ভিতরে ভিতরে। অথচ সে নিজে ভাত খেয়ে নিয়েছে। দুপুরে রাত্রির বাসি কড়কড়ে ভাত দিয়েছিল বামুন বাড়ির মেজবৌ। মেজবৌ শহরের মেয়ে হলে হবে কি। রূপে গুণে আর স্নেহ মায়া মমতায় অদ্বিতীয়া। ধান ভানার ফাঁকে সেই ভাত পারুলকে নিয়ে ভাগ করে খেয়েছিল বাসি মাছের ঝোল দিয়ে। একটুকরো কাটাভরা ল্যাজার মাছ ছিল সঙ্গে। ভেবেছিল ধানভানা হলে বামুন মা যে মজুরীর চাল দেবেন সেই চাল নিয়ে ছেলেদের রান্না করে দেবে। নিজেরও খিদে পেয়েছিল সনকার। খালি পেটে তো আর ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া যায় না। বাসি ভাত খেয়ে নিয়েছে। শেষে বেলা থাকতে থাকতে ধান ভানা হয়ে গেলে সনকা বসেছিল তার ধানভানা মজুরীর চালের জন্য। তখন কর্তা মা হেঁশেলে ব্যস্ত ছিলেন। এই সময় সনকা মেজবৌকে দেখে বলেছিল, বৌদি আমারে যদি এক পাতি চাল দিতি পারেন তাহলে ভালো হয়। আমার ছেলেরা সারাদিন .....
সনকার কথায় মেজবৌ এক পাতি চাল এনে সনকাকে দিতে যাচ্ছিলেন।এমন সময় কর্তা মা এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন, করো কি কর কি মেজ বউ। ওই নতুন বালাম ধানের চালের যে এখন গোবিন্দর সেবায় দেয়া হয় নেই। তুমি ওই ধামা থেকে চাল নিয়ে ওই পোড়াকপালিকে দিচ্ছ। রাখ রাখ। রাখে দাও বলতিচি।
কর্তা মা মেজ বৌমার হাত থেকে একপ্রকার জোর করেই চালের পাতিল নিয়ে নেন। তারপর তিনি সনকার উপর পড়েছিলেন, আরে পারুলের মা তোর আক্কেলটাই বা কেমন। মেজবৌমা না হয় কলকাতার মেয়ে। সে জানে না এ বাড়ির নিয়ম কনুন কিন্তু তুই তো জানিস। আমরা নতুন ধান ভানা চাল আগে গোপালের সেবায় দিই। তারপর নিজেরা রান্না করি। আর তুই কিনা চাল চাইছিস। তারপর আজ আবার বিষ্যুৎবার। আজ তো তোকে কোনো চাল দেয়া যাবে না।
-আমার ছেলেরা যে না খাইয়ে আছে মা।
-তোর ছেলেরা না খাইয়ে আছে সেই জন্যি আজ বিষ্যুদবার গোপালের ভোগ না দিয়ে তোর ছেলেগো জন্যি চাল দিতি হবে? যা এখন বাড়ি যা। কাল বিহানে আসিস।
বামুন মার কথার উপর আর কোনো কথা বলতে পারেনি সনকা। কিছুসময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে পারুল গিয়ে ডাকতেই বাড়ি চলে আসে। বাড়ি এসে দাঁড়াতেই গৌর বলে, মা তুমি যে কইছিলে নাড়া কাটে আলি আমাগো ভাত দিবা।
কইছিলাম তো বাপ। কিন্তু আজ বিষ্যুৎবার যে। তারপর গোপালের ভোগ না দিয়ে ...
সনকা কথা শেষ করতে পারে না। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গৌর বলে,
আমাগো বুঝি খিদে পায় না। সারাদিন ডরে নাড়া কাটে আসে এখন না খাইয়ে থাকব? বলতে বলতে গৌর এমনভাবে সনকার চোখে তাকায় দেখে সনকা কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না। শুধু তার ভিতর থেকে উঠে আসা কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে যায়। চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। তখন তার কর্তা মায়ের কথাটাই মনে পড়ে যায় হয়তো সেটাই তার সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া। সনকা বলে, বলতে বাধ্য হয়। কী করব বাপ। গোপালের ভোগ না দিয়ে বিষ্যুৎবার গেরস্থের ঘরের লখখী যে বার করতে নেই বাপ।
তাই বলে আমরা সারিদিন না খাইয়ে থাকব। তুমি আর কোনদিন ধান ভানতি যাবা না বামুন বাড়ি। বলেই গৌর বাঁশের কঞ্চি আর শুকনো পাতা দিয়ে বাইরের উনুন ধরিয়ে দেয়। নিতাই কোটা মাছ গুলো ধুয়ে নিয়ে আসে। আগুন জ্বলতেই একটা কানা ভাঙা লোহার কড়াইতে নামমাত্র তেল দিয়ে একটু নুন হলুদ মাখিয়ে কোনরকমভাবে মাছগুলো আধপোড়া করে ভেজে নেয়। আর কতকগুলো মেটে আলুর বীজ উনুনের আগুনে পুড়িয়ে নেয়। সে সময়ে পৌষের বেলা ঢলতে শুরু করেছে। শীতের আমেজে উনুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে মায়ের সঙ্গে ছেলে মেয়েরা। দেখতে দেখতে শেষ বিকেলে গোধূলি রং অস্তরাগ নেমে আসার আগেই পোড়া মেটে আলুর বীজ তার সঙ্গে ছোট ছোট আধপোড়া আধভাজা মাছ দিয়ে সারাদিনের শেষে খিদে নিবারনের চেষ্টা করে।
ফাগুন সুরে আলাপ
সু জি ত মু খো পা ধ্যা য়
শুক্লা চতুর্দশী। ফাগুনের সূর্য ডুবু ডুবু। বড়ো বাঁধ ধরে বাড়ি ফিরছে শিবসুন্দর। বছর বাহান্ন-র শিবু-মাস্টার।খান কয়েক বাড়ি গানের টিউশনি করে, সেই ইস্তক শিবু মাস্টার। গোলাপি বেগুনি আলোটা এখনো পশ্চিম আকাশে। পথের দু'পাশে বুনো ঘেঁটু ফুলের সাদা খড়ি আল্পনা। শ্মশান ঘাটের গায়ে ন্যাড়া শিমুল গাছের রক্ত মাথা শাখা। ঘোড়া নিমের গাছে বেগুনি ফুল। আলুতোলা জমিতে কয়েকটা বক শেষ আলোটা চুরি করে বাসা ফিরবে।
বনেদি রায় বাড়ির বড়ো শরিকের ছেলে, শিবসুন্দর রায়। রায় বাড়ির তাল পুকুরে এখন ঘটি ডোবেনা।
শরিকি ভাগের বাঠখারায় কোঠা দালান পাটালি টুকরো। শ্যাওলা লাগা, পাকুড় গাছ গজানো দালানটা বড়ো বাঁধের বাঁক ঘুরলেই চোখে পড়ে। এ বাড়ির হারিয়েছে অনেক কিছুই- হারায় নি শুধু সুরের নেশাটুকু। এ বাড়ির রক্তে সুর। ঠাকুর্দা দ্বিজদাস রীতিমত শাস্ত্রীয় গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে এ সাধনা শুরু করেন। বাবা জ্যোতির্ময়, তাঁর বাবার হাতে ধরেই তালিম নেন। মধ্য মেধার কলেজ গন্ডি না পেরোনো শিবু ও রক্তধারা বজায় রেখেছে। সেই সুরকেই জীবিকা করে দিন গুজরান আর আছে দেবোত্তর এর বিঘে পাঁচেক জমি। রায় দীঘির সিকি পয়সার অংশীদারী। আর আছেন সাতপুরুষের কুলদেবতা রাধকান্ত দেবের নিত্য সেবার সেবায়েতি বাবদ স্বল্প আয়। বাৎসরিক বেঁধে দেওয়া কড়ারে। চলে যায় একপ্রকার বিধবা মা বেটার।
সারস্বত সাধনা আর দেবসেবা বুকে হাসি মুখেই কেটে যায় দিন। অভাবী অভিযোগ নেই শিবুর। সয়ে বয়ে নিয়ে সব কিছু মেনে মানিয়ে নেওয়াই তো সাধকের সাধন। বাবা বলতেন সুরের সাধক রাজ ভিখিরি রে শিবু।
এমন বাউল সন্ধ্যায় হারানো দিনের কথা বড়ো উচাটন করে মন। বসন্ত- ফাগুন মানেই বোধ হয় এমন হয়। দামোদর এর চরা ছুঁয়ে ফাগুনে হাওয়া বুকে এসে পুরানো ছবির এলবাম-এর পাতাগুলো একটু উল্টে পাল্টে ধুলো ঝেড়ে দিয়ে যায়।
এ হাওয়া যেনো স্মৃতির সরগম। বুকের বেলো-তে দীর্ঘশ্বাস ওঠে নামে।
বাবা জ্যোতির্ময়-এর কাছে গান শিখতে আসতো চাটুজ্যে বাড়ির অরুনিমা।ওরা রায় বাড়িরই লতায় পাতায় সম্পর্কে দৌহিত্র গুষ্টি। অরু ছিল অসাধারণ রূপসী। মেধা আর কণ্ঠ সব ছিল দেবী সাধনার উপযোগী। বাবা আদুরে নামে ডাকতো অরু। বলতো অরু আমাদের রূপে গুনে লক্ষী-সরস্বতী। শিবু ও শিখতো একই সাথে। বাবা তানপুরার সুর খুঁজতেন। শিবু আর অরু গলা মিলিয়ে আলাপ করতো সান্ধ্য ইমন এর। রায় বাড়ির লাল বারান্দায় এমনই ফাগুন সূর্য ডুবতো। সুরে গলা মিলতো। শিবু তখন বছর সতেরোর। অরু বছর দুয়েক ছোটো।
সুরের নেশা গলা থেকে লাগলো গিয়ে বুকে। বসন্ত মানেই তো চোখে চোখে সর্বনাশী ভালোবাসার বীজ বোনা। মনের ঘরে লাল আবিরের ছোঁয়া। দুজনেই ভেসে গেলো সে রঙের জোয়ারে। স্বরলিপি খাতায় লেখা হলো কিশোর প্রেমের গীতি। রাধকান্ত মন্দিরে তখন সন্ধ্যামাধবী ফুটে থাকতো থোপায় থোপায়।
কথায় আছে প্রেম আর গুপ্তরোগ চাপা থাকেনা। এ কথা কানাকানি হলো দু'বাড়িতে। পাড়ার কানাচে- কার্নিশে। অরুর বাবা বলাই চাটুজ্যে রাশভারী কলকাতায় চাকরি করা বাবু। উঠতি বড়লোক।
সৌম্য ভদ্র জ্যোতির্ময়কে বাড়ি বয়ে অপমান করে গেলো। বলে গেল,- "গান শেখানোর অছিলায়, মেয়ে ফুসলিয়ে বাড়ি আনতে চাও না কি হে জ্যোতি রায়, বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার শখ"-
মাথা হেঁট করে সব সয়ে নিল বাবা। শুধু অভিমানে লাল হয়ে নির্বাক চোখে চেয়ে ছিলো শিবুর পানে।
না সেদিন জ্যোতির্ময় শাসন করেনি। শুধু মাথায় হাত রেখে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিল শিবুর।
তারপর দামোদরের চরা ভেসেছে বহুবার। তীর ভেঙে নতুন স্রোত খুঁজে নিয়েছে নদ। মেধাবী অরু মাধ্যমিক দিয়েই চলে গিয়েছিল কলকাতা, মামার বাড়ি। সেখানেই কলেজে পড়া।
শিবু খোঁজ রাখেনি, অরু আর কোনো সন্ধ্যা ফাগুনে তানপুরা কোলে ইমন আলাপ করেছিল কি না?
তবে খবর এসেছিল গ্রামে, কলকাতায় মস্ত ধনী বাড়িতে অরুর বিয়ে হয়েছে। রাজার মতো জামাই। রাজজোটক মিল। দ্বিরাগমনে এসে ছিলো জোড়ে। সেদিনও এমন ফাগুন দিন। ছাদের আলসেতে উঁকি দিয়ে শিবু দেখেছিলো আড়ালে একবার। ভালো লেগেছিল শিবুর। বলেছিলো মনে মনে ঠাকুর ভালো করো ওদের।
না -কথা রাখেনি ঠাকুর। বিয়ের বছর আটেক বাদ তিন বছরের একটা পুতুল মেয়ে বুকে নিয়ে ফিরে এসেছিল অরু।
সন্ধ্যা টা ঘনিয়ে আসছে। আনমনা মনটাকে শাসন করে শিবু। প্যাডেল এ জোরে পা ঘোরায়। বাড়ি ফিরেই রাধকান্ত মন্দিরে সন্ধ্যারতি দিতে হবে শিবুকে। তারপর যুগলের শয়ান। মা বসে আছে পথ চেয়ে। না বিধবা মা এর হাজার অনুরোধেও বিয়ে করেনি শিবু। শিবু বাড়ি ফিরছে- ওই তো রায়বাড়ির ঠাকুর দালান। পঞ্চায়েতের ল্যাম্পোস্টে আলো জ্বলে। মাধবীলতার ঝোপে আলো পড়ে। তলায় একটা আবছা ছায়া। এসে সন্ধ্যা আহ্নিক সেরেই শিবু মন্দিরের দরজা খোলে। আজ মনটা বড়ো এলোমেলো। নাটমন্দিরের চাতালে চাঁদ জ্যোৎস্না গলে পড়ছে। কাল দোল পূর্ণিমা। আজ রূপো রং গর্ভে পূর্ণ পোয়াতি চাঁদ। ঝকঝকে পিলসুজে পাঁচ প্রদীপের বুকে কর্পূর জ্বলে। আলোর ঝিলিক রাধারাণীর লালচেলির আঁচলে। কাল এখানেই গোলাপি ফাগ উড়বে ফাগুনের। রাধকান্তের দোল, রঙে সাজবে আকাশ মাটি। চামর বুলিয়ে শাঁখ বাজিয়ে পুজো সারে শিবু। দূরে চাটুজ্যে বাড়ির পর্দা সরানো জানালায় দাঁড়ানো একটা মুখ উঁকি দেয়। শিবু জানে - সে মুখটা অরু।
নিত্য সন্ধ্যার অভ্যাসে, মন্দিরে শাঁখ বাজলে কপালে জোড় হাত কপালে ছোঁয়ায়। হয়তো আগামী জীবনের রং প্রার্থনা করে, সাদা সিঁথি আর সাদা খোলের শাড়ির জমিতে।
অরু-র চোদ্দ বছরের মেয়েটা হারমোনিয়ামে ইমন সুরে আলাপ করছে। অরুর সেই মিষ্টি কণ্ঠের অনুরণন আজ বসন্ত সন্ধ্যায়। শিবুর বুকে সে সুর এসে বাজে । যাক সব হারিয়েও গান আর সুরটুকু বেঁচে থাক। সব অভিমান মুছে ফাল্গুনী চাঁদ সাক্ষী হয়ে রাত জাগবে আজ। কাল যে রঙিন হবে রাইকিশোরী বুকের আঁচল।
আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে
শ্যা ম লী ব্যা না র্জী
ভোর রাতে জাফরানী রঙের জর্দা পোলাও এর স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুম ভেঙে গেল। আমার স্বামী দেবতাটি প্রতিদিন রবি ঠাকুরের গান শুনিয়ে আমার ঘুম ভাঙান। আজ দোল। গান বাজছে "আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে"। গান টি বড় অর্থবহ লাগে। মনে হয় আজ যেন কোনো জাতপাতের বৈষম্য চলবে না। ধনী, দরিদ্র, আপামর জনসাধারণ আজ রঙের উৎসবে মাতবে। মনকে ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যের রঙে রাঙাবে। আজকের এই নিষ্ঠুর, নৃশংস যুদ্ধের পটভূমিকায় মনের এই প্রসারতা, এই উদারতা, এই নৈকট্য আজ বড় প্রয়োজন।
উঠেই কোমর বেঁধে পোলাও রান্নায় লেগে পড়লাম। মনে হলো শ্রীকৃষ্ণের হয়তো আজ রঙের উৎসবে পোলাও খাবার ইচ্ছে হয়েছে। ঠাকুরঘর ধুয়ে মুছে মনের মতো করে পেস্তা, কাঠবাদাম, কাজু , কিসমিস দিয়ে জাফরানী রঙের জর্দা পোলাও ভোগ প্রস্তুত করলাম।। সঙ্গে ছানার কোপ্তা। ছানার বলের ভিতর খোয়া ক্ষীর, কাজু, কিসমিসের পুর দেওয়া।সব কিছু জোগাড় করে রান্না শেষ হলো প্রায় বারোটায়। রাস্তায় তখন দোলখেলায় মেতেছে পাড়ার ছেলেরা। বালতিতে রং গুলে পিচকারী আর বেলুনে ভরে ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে। মাঝে মাঝে "হোলি হ্যায়" বলে সমস্বরে চিৎকার কানে আসছে। ফুলহারে, পুষ্পে, পল্লবে সাজালাম রাধা ও শ্রীকৃষ্ণকে। পিতলের রেকাবীতে সবুজ লাল, রানী আবীর, কুমকুম, গুলাল, আর পিতলের পিচকারী সাজিয়ে রাখলাম। থালায় ভোগ সাজিয়ে নিবেদন করতে করতে মনে হলো শ্বেত পাথরের সিংহাসনে বসা পিতলের গোপালের চোখ চিকচিক করে উঠলো। সেটা আমার তৈরী পোলাও-এর সুঘ্রাণে না নারকেল নাড়ুর লোভে ঠিক বোঝা গেল না।
ভোগ নিবেদন করতে গিয়ে ঠাকুরকে বললাম "ঈশ্বর, যথা সম্ভব নিষ্ঠা ভরে
তোমার জন্য যে ভোগ প্রস্তুত করলাম, তুমি কি সত্যই তা গ্রহণ করো?"
ধূপ, মোমবাতি জ্বালছি ভোগারতি করবো বলে,এমন সময় দরজায় কচি গলার স্বর শুনতে পেলাম "দুটি ভাত দেবে মা"। ছুটে যাই দরজায়। ধূলিধূসরিত খালি গা সাত আট বছরের একটি কালো ছেলে। হাতে প্লাস্টিকের ভাঙা পিচকারীর টুকরো, মাথায় রুপোলি রাংতার হাতে তৈরি মুকুট। "এই তো আমার কালো ভগবান।" ওকে যত্নে আসন পেতে বসিয়ে পোলাও ভোগ খাওয়াতে খাওয়াতে আমার চোখ জলে ভরে আসে। "তুমি আমার প্রার্থনা শুনেছো ঈশ্বর, তাই কী আমার প্রশ্নের জবাব দিতে সশরীরে এলে?" মনে পড়ে স্বামীজীর সেই বিখ্যাত উক্তি "বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।" মনের মধ্যে অনুরণিত হয় "মানবতাই হলো শ্রেষ্ঠ ধর্ম", মানুষের মধ্যেই তো ঈশ্বরের অবস্থান। "সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।"
পাগলী
সো মা শ্রী পা ল চ ন্দ
পাড়ায় নতুন এসেছি। দেখি জমাদার যখন ময়লার ঠ্যালাগাড়ি নিয়ে ময়লা নিতে আসে, একটা পাগলী গোছের মহিলা ওর পেছন পেছন আসে। বিচ্ছিরি রকমের নোংরা একটা শাড়ি পেঁচানো গায়ে, মাথায় কাঁচাপাকা চুল অগোছালোভাবে বাঁধা। গায়ের রং ফর্সা ছিলো একসময় হয়তো। দীর্ঘদিন অযত্নে কালো কালো ছোপ পড়েছে মুখে।
ফ্ল্যাট থেকে যখন সবার ডাস্টবিন থেকে আবর্জনাগুলো ফেলা হয়, পাগলীটা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। তারপর হামলে পড়ে রাশি রাশি স্তূপাকার আবর্জনার ওপর। প্লাস্টিক ছিঁড়ে বের করে কারো বাড়ির মাছ মাংসের রক্ত মাখা প্লাস্টিক, মাছের পচা নাড়ি ভুঁড়ি, আঁশ, সব্জির খোসা, পচে যাওয়া এঁটো কাঁটা, বাচ্চাদের মলমূত্র মাখানো হাগিস, স্যানিটারি ন্যাপকিন আরও হাজার নোংরা।
জমাদার কখনো দু'তিনদিন বাদে বাদে আসে। এঁটোকাঁটাগুলো পচে পোকা বেরোয়। ভয়ানক দুর্গন্ধ। পাগলীটা নির্ধিদ্বায় সেই ময়লা ঘাঁটে। প্লাস্টিকগুলোর ভেতর মনোযোগ দিয়ে দেখে, দেখে মনে হয় কোনো দুর্মূল্য বস্তু ওতে লুকোনো, ভালোভাবে খুঁজলেই বেরিয়ে আসবে যেকোনো সময়।
সেদিন ময়লা দিতে গিয়ে জমাদারকে জিজ্ঞেস করলাম, "ওকে চেনো? রোজ ময়লা ঘাঁটে কিছু বলোনা কেন?" জমাদার হেসে বললো, "পাগলী তো, তাড়াই তাও আসে। কথা শোনেনা। শুনেছি ওর এক ছেলে ছিলো। প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করতো। এক রাতে আগুন লাগে কারখানায়। অনেকেই পুড়ে মরেছিলো সে বার। ওর ছেলেটাও। লাশটা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।"
গতরাতে মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাড়িতে খাবারের আয়োজন হয়েছিলো পাগলীটার জন্য খাবার তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ সকালে জমাদার একাই এসেছে দেখি। অবাক কান্ড! জমাদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, "সে কোই? আজ এলোনা যে?" বললো
"ওই তো দুটো গলির পড়ে যে শনি মন্দিরটা আছে। ওর পাশে গাছটার নিচে শুয়ে আছে দেখলাম। শরীর খারাপ করেছে হয়তো।"
এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ভাবলাম দেখেই আসা যাক।
মন্দিরের কাছে যেতেই পাগলীর দেখা মিললো। শুয়ে আছে মাটিতে। কাছে গিয়ে ডাকলাম, "আই মেয়ে, খাবার এনেছি, নাও খাও। "
পাগলী ছোঁ মেরে টেনে নিলো খাবারের প্লাস্টিকটা। মনে হলো খুব খিদে পেয়েছে ওর।
ফিরেই যাচ্ছিলাম। কি মনে হতেই হঠাৎ পেছন ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য! পাগলী খাবার মুখে তোলে নি একটুও। শুধু প্লাস্টিকের ভেতরটা হাতড়ে যাচ্ছে এক মনে। মনে হলো ওর হারানো ছেলেকে খুঁজে চলেছে। হয়তো ওর বিশ্বাস, কোনো না কোনোদিন প্লাস্টিকের ভেতর থেকেই খুঁজে পাবে ওর মৃত ছেলের ঠিকানা।
অনালোকিত সত্য
পা ভে ল ঘো ষ
"দাদাভাই, একটা মেয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে..." ঝিমলির চীৎকারে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলো সত্যজিৎ। এই ভর সন্ধ্যাবেলায় সবে পড়াতে বসেছে, আর এইসময়। ওঃ আর পারা যায় না। চোখে মুখে একটু বিরক্তির ছাপ দেখিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও। ঘরে তিল ধারণের জায়গা নেই।একবার পড়াতে ঢুকলে বের হওয়াটা যে কতটা অস্বস্তিকর; সে আর কে বোঝাবে ঝিমলিকে। "যাই দাঁড়া..." সাড়া দেয় সত্যজিৎ।
এই তল্লাটে বেশ নামকরা শিক্ষক ও। মাধ্যমিক দেওয়ার ৭ দিনের মধ্যে ওর টিউশন ব্যাচ ফুল হয়ে যায়।এই টিউশনের জন্য দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পাওয়া প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের চাকরিটা অবলীলাক্রমে ছেড়ে দিয়েছিল সত্যজিৎ।কারোর কথা শোনে নি ও।
কিন্তু ব্যাচ শুরু হয়ে গিয়েছে তো প্রায় ১মাস আগে। তাহলে? নিশ্চয়ই মেয়েটি জানে না। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে গিয়ে বেরোনোর সময় পরিমল ডাক্তারের মেয়ের পায়ে পা লাগলো সত্যজিতের। "লাগে নি তো রে?" একটু সহানুভূতির হাসি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ও। "ঝিমলি মেয়েটাকে ডেকে দে..." এলো চুলে একটু হাত বুলিয়ে নেয় সত্যজিৎ। "দাদাভাই, ও কিছুতেই ঘরে ঢুকতে চাইছে না..." ঝিমলি স্মার্টফোনে চোখ রেখে বলে।
ঘরের বাইরে আলো ছায়ায় কাউকে নজর করা খুব মুশকিল। সত্যজিতের বাড়িতে গাছপালা বেশী থাকার জন্য এমনটা হয়।
দরজা খুলে বেরুলো ও। বেশ লম্বা একটি মেয়ে। ওড়না দিয়ে মুখটা ঢাকা। চোখে চশমা বেশ ব্যক্তিত্বময়ী করে তুলেছে মেয়েটিকে। কিন্তু মুখ থেকে কিছুতেই ওড়নাটা সরানোর নাম গন্ধ নেই।
"গেটের বাইরে না দাঁড়িয়ে ভিতরে এসো ..." মেয়েটিকে ঘরে আহ্বান জানায় সত্যজিৎ। "আমি বেশিক্ষন সময় নেব না স্যার। মায়ের কাছে আপনার কথা খুব শুনেছি। মায়ের খুব ইচ্ছা আপনার কাছে পড়বো আমি। এক মাস আগেই আসতাম। কিন্তু মা আজ ৪ সপ্তাহ প্রায় হাসপাতালে ভর্তি। সময় করতে পারিনি স্যার। আজ মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য আপনার কাছে আসা..." খুব দ্রুত শেষ করে মেয়েটি। হাত বাড়িয়ে একটা খাম এগিয়ে দেয় সত্যজিতের দিকে। সত্যজিৎ খামটা হাতে নিতেই মেয়েটি আবার বলে ওঠে... "এই চিঠিটা মায়ের লেখা, আপনাকে... হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার শুরুর দিকে মা লিখেছিলেন। তারপরে শারীরিক অবনতি হওয়ায় আমি আপনার কাছে আসতে পারিনি স্যার।"
মেয়েটি বলে চলে... "আজকে আসি স্যার।সকাল থেকে মায়ের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতি হয়েছে ডাক্তারবাবুরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। চলি স্যার... জানিনা মাকে গিয়ে দেখতে পাবো কি না..." চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা। কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করবার সুযোগটুকুই দিলো না..একটা আবেশ রচনা করে গেলো যেন। এখনো ঘোর কাটছে না সত্যজিতের। "দাদাভাই, ছেলে-মেয়েরা কিন্তু গোলমাল করছে খুব..." ঝিমলির সতর্কবাণীতে কাজ হলো।সত্যজিৎ ছুটলো পড়াতে।
আগামীকাল আসতে আর হয়তো মিনিট দশেক হবে।সত্যজিৎ খামটা খুললো অতি সন্তর্পনে। পাশের খাটে ঝিমলি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকায় সত্যজিৎ। বিগত ১৭ বছর ধরে পোলিও আক্রান্ত ঝিমলিকে আগলে রেখেছে ও। ওর হাসিমুখ দেখলে সত্যজিৎ প্রেরণা পায়, বাঁচার রসদ খুঁজে পায়। খামটা খুলতেই চমকে ওঠে ও। কাঁপা কাঁপা হাতে মাত্র চার লাইন লেখা।
'সত্য,
'ভালো আছো জানি।মেয়েকে পাঠালাম, একটু দেখো। তবে ওকে মুখের ওড়না সরাতে জোর করো না। ও কষ্ট পাবে। তোমার হাতে চিঠিটা পৌঁছবে যখন, তখন আমি হয়তো ধরাছোঁয়ার বাইরে।'
'মালবিকা'.
চিঠিটা পড়তেই চোখে জল চলে আসে সত্যজিতের।আলো নিভিয়ে দেয় ও। ঘুম আসে না কিছুতেই। কানে আসে সাপের মুখে থাকা ব্যাঙের আর্ত চীৎকার।বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকে সত্যজিৎ। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার শব্দে আচম্বিতে উঠে পড়ে সত্যজিৎ। সবে ঘুমটা এসেছিল ওর। চোখ কচলে প্রথমেই টর্চটা নিয়ে আলো ফেলে ঘড়িটায়।
'চারটে কুড়ি'।ঘুম চোখে "অনালোকিত সত্য"
-পাভেল ঘোষ
"দাদাভাই, একটা মেয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে..."
ঝিমলির চীৎকারে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলো সত্যজিৎ।এই ভর সন্ধ্যাবেলায় সবে পড়াতে বসেছে, আর এইসময়।ওঃ আর পারা যায় না।
চোখে মুখে একটু বিরক্তির ছাপ দেখিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও।ঘরে তিল ধারণের জায়গা নেই।একবার পড়াতে ঢুকলে বের হওয়াটা যে কতটা অস্বস্তিকর; সে আর কে বোঝাবে ঝিমলিকে।
"যাই দাঁড়া..." সাড়া দেয় সত্যজিৎ।
এই তল্লাটে বেশ নামকরা শিক্ষক ও।
মাধ্যমিক দেওয়ার ৭ দিনের মধ্যে ওর টিউশন ব্যাচ ফুল হয়ে যায়।এই টিউশনের জন্য দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পাওয়া প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের চাকরিটা অবলীলাক্রমে ছেড়ে দিয়েছিল সত্যজিৎ।কারোর কথা শোনে নি ও।
কিন্তু ব্যাচ শুরু হয়ে গিয়েছে তো প্রায় ১মাস আগে। তাহলে?নিশ্চয়ই মেয়েটি জানে না।এইসব সাতপাঁচ ভাবতে গিয়ে বেরোনোর সময় পরিমল ডাক্তারের মেয়ের পায়ে পা লাগলো সত্যজিতের।
"লাগে নি তো রে?" একটু সহানুভূতির হাসি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ও।
"ঝিমলি মেয়েটাকে ডেকে দে..."এলো চুলে একটু হাত বুলিয়ে নেয় সত্যজিৎ।
"দাদাভাই, ও কিছুতেই ঘরে ঢুকতে চাইছে না..".ঝিমলি স্মার্টফোনে চোখ রেখে বলে।
ঘরের বাইরে আলো ছায়ায় কাউকে নজর করা খুব মুশকিল।সত্যজিতের বাড়িতে গাছপালা বেশী থাকার জন্য এমনটা হয়।
দরজা খুলে বেরুলো ও।বেশ লম্বা একটি মেয়ে।ওড়না দিয়ে মুখটা ঢাকা।চোখে চশমা বেশ ব্যক্তিত্বময়ী করে তুলেছে মেয়েটিকে।কিন্তু মুখ থেকে কিছুতেই ওড়নাটা সরানোর নাম গন্ধ নেই।
"গেটের বাইরে না দাঁড়িয়ে ভিতরে এসো ..." মেয়েটিকে ঘরে আহ্বান জানায় সত্যজিৎ।
"আমি বেশিক্ষন সময় নেব না স্যার।মায়ের কাছে আপনার কথা খুব শুনেছি।মায়ের খুব ইচ্ছা আপনার কাছে পড়বো আমি।এক মাস আগেই আসতাম।কিন্তু মা আজ ৪ সপ্তাহ প্রায় হাসপাতালে ভর্তি।সময় করতে পারিনি স্যার।আজ মায়ের শরীরটা খুব খারাপ।মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য আপনার কাছে আসা..."
খুব দ্রুত শেষ করে মেয়েটি।হাত বাড়িয়ে একটা খাম এগিয়ে দেয় সত্যজিতের দিকে।সত্যজিৎ খামটা হাতে নিতেই মেয়েটি আবার বলে ওঠে...
"এই চিঠিটা মায়ের লেখা, আপনাকে.. হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার শুরুর দিকে মা লিখেছিলেন।তারপরে শারীরিক অবনতি হওয়ায় আমি আপনার কাছে আসতে পারিনি স্যার।"
মেয়েটি বলে চলে...
"আজকে আসি স্যার।সকাল থেকে মায়ের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতি হয়েছে।ডাক্তারবাবুরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।চলি স্যার..জানিনা মাকে গিয়ে দেখতে পাবো কি না..."
চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করবার সুযোগটুকুই দিলো না..একটা আবেশ রচনা করে গেলো যেন।এখনো ঘোর কাটছে না সত্যজিতের।
"দাদাভাই, ছেলে-মেয়েরা কিন্তু গোলমাল করছে খুব..." ঝিমলির সতর্কবাণীতে কাজ হলো।সত্যজিৎ ছুটলো পড়াতে।
আগামীকাল আসতে আর হয়তো মিনিট দশেক হবে।সত্যজিৎ খামটা খুললো অতি সন্তর্পনে।
পাশের খাটে ঝিমলি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।ওর মুখের দিকে তাকায় সত্যজিৎ।বিগত ১৭ বছর ধরে পোলিও আক্রান্ত ঝিমলিকে আগলে রেখেছে ও। ওর হাসিমুখ দেখলে সত্যজিৎ প্রেরণা পায়, বাঁচার রসদ খুঁজে পায়।
খামটা খুলতেই চমকে ওঠে ও।কাঁপা কাঁপা হাতে মাত্র চার লাইন লেখা।
'সত্য,
'ভালো আছো জানি।মেয়েকে পাঠালাম, একটু দেখো।তবে ওকে মুখের ওড়না সরাতে জোর করো না। ও কষ্ট পাবে।তোমার হাতে চিঠিটা পৌঁছবে যখন, তখন আমি হয়তো ধরাছোঁয়ার বাইরে।'
'মালবিকা'.
চিঠিটা পড়তেই চোখে জল চলে আসে সত্যজিতের।আলো নিভিয়ে দেয় ও।ঘুম আসে না কিছুতেই ।কানে আসে সাপের মুখে থাকা ব্যাঙের আর্ত চীৎকার।বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকে সত্যজিৎ।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার শব্দে আচম্বিতে উঠে পড়ে সত্যজিৎ।সবে ঘুমটা এসেছিল ওর।চোখ কচলে প্রথমেই টর্চটা নিয়ে আলো ফেলে ঘড়িটায়।
'চারটে কুড়ি'।ঘুম চোখে সময়টা বুঝতে অসুবিধা হয়না ওর।এই হাওয়াটা কি কোনো অশনি সংকেত? মালবিকার লেখা চিঠির শেষ লাইনটা মনে পড়ে যায়।চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে সত্যজিৎ।বুকের বাঁ পাশটায় ওঠা কষ্টের মোচড়টা ধীরে ধীরে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে।পা টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ও। সকাল হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই।দূরে বট গাছ থেকে দু একটা কাক ডাকার আওয়াজ কানে আসছে। মূল দরজায় চাবি দিয়ে গেটটা আস্তে করে খোলে সত্যজিৎ।শেষ মুহূর্তে মোবাইল আর মানিব্যাগটা পকেটে নিতে ভোলে না ।গলি পেরিয়ে মূল রাস্তায় ওঠে সত্যজিৎ।মুঠোফোনটা থেকে 'ওলা ট্যাক্সি' বুক করে মিনিট কুড়ির মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে যায় ও। রিসেপশনে পৌঁছেই মালবিকার খোঁজ করে ।মনটা অস্থির হয়ে ওঠে ।কি জানি মনে হচ্ছে খারাপ কিছু শুনতে চলেছে সত্যজিৎ।
"মালবিকা বলে কেউ এখানে...?' জিজ্ঞাসা করতেই সত্যজিতের দিকে ধেয়ে আসে বিরক্তি ভরা উত্তরটা।
"এত বড় হাসপাতালে মালবিকা নামে অনেক পেশেন্ট আছে মশাই।ডিটেইলসটা বলুন,তবে তো বুঝবো।"
সত্যজিৎ বিবরণ দিতেই ভদ্রলোকের মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলেন, "উনি কাল রাত আটটায় মারা গেছেন।শেষ মুহূর্তে মেয়েকে দেখতে চেয়েছিলেন উনি।কিন্তু অন্তিম ইচ্ছে পূরণ হয় নি ।মেয়ে যখন এলো, তখন মিনিট পনেরো আগে..."
মাথায় বাজ পড়লো সত্যজিতের।আফসোসে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।নিজেকে সান্তনা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ও।মালবিকার না থাকাটা মানতে পারছে না কিছুতেই।
"বডি কি এখনো ..?'
"না, না,এখানে বডি নেই দাদা। মনে হলো, মালবিকা দেবীর মেয়ে ছাড়া কেউ ছিলো না।ওনার পাড়ার লোকেরাই তো এসে.."
"কোথায় নিয়ে গেল বলতে পারেন?'
"তা বলতে পারবো না।তবে হাসপাতালের পাশেই নির্মল ঝিল শ্মশানে নিয়ে যাবে বলাবলি করছিল.."
আর দেরী না করে শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সত্যজিৎ।আঁধার কাটছে একটু একটু করে।পাখিগুলোর তখন সদ্য ঘুম ভেঙেছে।দ্রুত পা চালায় ও।রাত জাগা ক্লান্ত কুকুরগুলোর চিৎকারও ক্ষীণ হয়ে আসছে। মালবিকাকে শেষ দেখা দেখতেই হবে।এবার ছুটতে থাকে সত্যজিৎ।অবশেষে দূর থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে থেমে যায় ও।এই শ্মশানে এখনো চুল্লির ব্যবস্থা হয় নি জানে সত্যজিৎ।ধীর পায়ে মালবিকার চিতার সামনে দাঁড়ায় ও।মালবিকা দাউ দাউ করে পুড়ছে।এ আগুনে সত্যজিতও পুড়ছে.. পুড়ছে ওর ভিতরের অসত্য ভাবনা আর মিথ্যা অহংকারগুলো।গ্লানির কার্বনকণাগুলো চিতা থেকে যেন ছুটে আসছে ওর দিকে।
ভিতর থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পায় সত্যজিৎ।
"পালাও..পালাও এখান থেকে.. সত্যজিৎ পালাও।না হলে বাঁচবে না তুমি।"
একমুহূর্ত দাঁড়ায় না ও।পালাতেই হবে ওকে।
"দাঁড়ান স্যার..."
দহন আলোয় উদ্ভাসিত মালবিকার আত্মজাকে চিনতে অসুবিধা হয় না ওর।মায়ের মতোই বাম গালে জরুলের চিহ্নটা স্পষ্ট।এতো অবিকল মালবিকার প্রতিরূপ।
কানে আসতে থাকে ২২ বছর আগের সেই কণ্ঠ.. "দাঁড়াও সত্য, আমায় ছেড়ে যেও না।এর জন্য আমি দায়ী নই।যেও না....সত্য.."
সত্যজিৎ দৌড়োতে শুরু করে।ছুটতে ছুটতে ছায়াবৃত্ত পেরিয়ে যায় ও।
মালবিকার আওয়াজ তখনও কানে আসতে থাকে ওর.. "যেও না সত্য, দাঁড়াও..." সময়টা বুঝতে অসুবিধা হয়না ওর। এই হাওয়াটা কি কোনো অশনি সংকেত? মালবিকার লেখা চিঠির শেষ লাইনটা মনে পড়ে যায়। চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে সত্যজিৎ।বুকের বাঁ পাশটায় ওঠা কষ্টের মোচড়টা ধীরে ধীরে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে।পা টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ও। সকাল হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। দূরে বট গাছ থেকে দু একটা কাক ডাকার আওয়াজ কানে আসছে। মূল দরজায় চাবি দিয়ে গেটটা আস্তে করে খোলে সত্যজিৎ। শেষ মুহূর্তে মোবাইল আর মানিব্যাগটা পকেটে নিতে ভোলে না। গলি পেরিয়ে মূল রাস্তায় ওঠে সত্যজিৎ। মুঠোফোনটা থেকে 'ওলা ট্যাক্সি' বুক করে মিনিট কুড়ির মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে যায় ও। রিসেপশনে পৌঁছেই মালবিকার খোঁজ করে।মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। কি জানি মনে হচ্ছে খারাপ কিছু শুনতে চলেছে সত্যজিৎ।
"মালবিকা বলে কেউ এখানে...?' জিজ্ঞাসা করতেই সত্যজিতের দিকে ধেয়ে আসে বিরক্তি ভরা উত্তরটা। "এত বড় হাসপাতালে মালবিকা নামে অনেক পেশেন্ট আছে মশাই।ডিটেইলসটা বলুন, তবে তো বুঝবো।" সত্যজিৎ বিবরণ দিতেই ভদ্রলোকের মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলেন, "উনি কাল রাত আটটায় মারা গেছেন। শেষ মুহূর্তে মেয়েকে দেখতে চেয়েছিলেন উনি। কিন্তু অন্তিম ইচ্ছে পূরণ হয় নি। মেয়ে যখন এলো, তখন মিনিট পনেরো আগে..."
মাথায় বাজ পড়লো সত্যজিতের। আফসোসে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ও।মালবিকার না থাকাটা মানতে পারছে না কিছুতেই।
"বডি কি এখনো ..?'
"না, না, এখানে বডি নেই দাদা। মনে হলো, মালবিকা দেবীর মেয়ে ছাড়া কেউ ছিলো না। ওনার পাড়ার লোকেরাই তো এসে.."
"কোথায় নিয়ে গেল বলতে পারেন?' "তা বলতে পারবো না। তবে হাসপাতালের পাশেই নির্মল ঝিল শ্মশানে নিয়ে যাবে বলাবলি করছিল.."
আর দেরী না করে শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সত্যজিৎ। আঁধার কাটছে একটু একটু করে।পাখিগুলোর তখন সদ্য ঘুম ভেঙেছে। দ্রুত পা চালায় ও।রাত জাগা ক্লান্ত কুকুরগুলোর চিৎকারও ক্ষীণ হয়ে আসছে। মালবিকাকে শেষ দেখা দেখতেই হবে। এবার ছুটতে থাকে সত্যজিৎ। অবশেষে দূর থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে থেমে যায় ও। এই শ্মশানে এখনো চুল্লির ব্যবস্থা হয় নি জানে সত্যজিৎ। ধীর পায়ে মালবিকার চিতার সামনে দাঁড়ায় ও। মালবিকা দাউ দাউ করে পুড়ছে। এ আগুনে সত্যজিতও পুড়ছে.. পুড়ছে ওর ভিতরের অসত্য ভাবনা আর মিথ্যা অহংকারগুলো।গ্লানির কার্বনকণাগুলো চিতা থেকে যেন ছুটে আসছে ওর দিকে।
ভিতর থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পায় সত্যজিৎ। "পালাও..পালাও এখান থেকে.. সত্যজিৎ পালাও।না হলে বাঁচবে না তুমি।" একমুহূর্ত দাঁড়ায় না ও। পালাতেই হবে ওকে।
"দাঁড়ান স্যার..." দহন আলোয় উদ্ভাসিত মালবিকার আত্মজাকে চিনতে অসুবিধা হয় না ওর।মায়ের মতোই বাম গালে জরুলের চিহ্নটা স্পষ্ট। এতো অবিকল মালবিকার প্রতিরূপ। কানে আসতে থাকে ২২ বছর আগের সেই কণ্ঠ... "দাঁড়াও সত্য, আমায় ছেড়ে যেও না। এর জন্য আমি দায়ী নই। যেও না....সত্য.." সত্যজিৎ দৌড়োতে শুরু করে। ছুটতে ছুটতে ছায়াবৃত্ত পেরিয়ে যায় ও। মালবিকার আওয়াজ তখনও কানে আসতে থাকে ওর.. "যেও না সত্য, দাঁড়াও..."
বসন্ত বেদন
সু ন ন্দা চ ক্র ব র্তী
চয়নিকা দোলের দিন সকালবেলা হলুদ রঙের শাড়িতে আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। পাড়ায় এইদিন একটা প্রভাত ফেরী হয়। চয়নিকা গানের সাথে নাচবে। তাই ভাবছিল একটা কানের পাশে ফুল হলে জমে যেত। কিছুদিন আগেই চয়নিকার দাদার বিয়ে হয়েছে। বউদি রঙ্গনা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইবে। তারপর ক্লাবের মাঠে আবীর উৎসব। এসব আগে তেমন হত না। এখন হালে হচ্ছে। বাড়ির সবাই সেদিন রান্না করে না। সকালে আর বিকেলে ক্লাবেই খাওয়া দাওয়া।
আজকের দিনটা চয়নিকার জন্য স্পেশাল। চয়নিকাকে চয়নিকার দাদার বিয়ের দিন বরযাত্রী গিয়ে অমরেশ বলেছিল,
- এবার কিন্তু তোর পালা। দোলের দিন তোকে প্রপোজ করব। না করিস না জেনো।
অমরেশদের বাড়ির সাথে এই বাড়ির খুব ভালো সম্পর্ক কিন্তু চয়নিকার মাথায় কোনদিন আসেনি যে অমরেশ ওকে বিয়ে করতে চাইবে। অমরেশ সবে চাকরি পেয়েছে। সেক্টর ফাইভে যায় সানগ্লাস পরে বাইক নিয়ে। চয়নিকার বুকে তখন ঝড় ওঠে। মনে মনে পছন্দ করলেও মুখ ফুটে বলার সাহস হয়নি আর মনে প্রত্যাখানের ভয়টুকুনও ছিল। প্রত্যাখান সহ্য করার মতন বুকের পাটা চয়নিকার নেই। একটু গরম পড়েছে বলে চুলটাকে বেণী করে নিল। রঙ্গনা ঢুকল হাসিমুখে। চুলে একটা হলুদ চন্দ্রমল্লিকা গুঁজে দিতেই চয়নিকা বলল,
- বউদি, কোথায় পেলে? আমার খুব ইচ্ছে করছিল মাথায় ফুল দেবার।
- ম্যাজিক! আমার ননদিনীর ইচ্ছে করছিল আর আমি জানব না?
- বল না বউদি কোথায় পেলে?
- কোথায় আবার? তোমার দাদাকে বললাম এনে দিতে। নাও নাও চল। সবাই রেডি হয়ে গেছে।
ক্লাবের মাঠের সামনে খুব ভিড়। সুভাষ পল্লীর আবালবৃদ্ধবনিতা এসে হাজির হয়েছে ক্লাবের মাঠে। দুটো ভ্যানকে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে তাতে শতরঞ্চি পাতা। হারমোনিয়ামটাও রয়েছে। রঙ্গনার গানের সাথে চয়নিকা নাচবে। ভ্যান আস্তে আস্তে চলবে আর তার সামনে চয়নিকা নাচবে। বাচ্চারাও হলুদ শাড়ি পরে মাথায় ফুল দিয়ে রেডি। ওরাও প্রতিবারের মতন ওরে গৃহবাসী আর ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে… গানের সাথে নাচবে। চয়নিকার চোখ কিন্তু অমরেশকে খুঁজছে। কিন্তু অমরেশ কই? আজ কি অফিসে ছুটি নেই? ধ্যাত! তাই বা কি করে হবে? আজ পাড়ায় এমন উৎসব। গান শুরু হলে বাচ্চারা নাচতে নাচতে এগোচ্ছিল। সবাই পিছনে পিছনে হাঁটছে। অনেকেই গলা মেলাচ্ছে গানগুলোর সাথে। চয়নিকার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল।
নাচ গান আর প্রভাতফেরী শেষ করে সবাই মাঠে জমায়েত হয়েছে। এবার আবীর খেলা হবে। প্রথমে বড়রা খেলা শুরু করবে। রঙ্গনা আর চয়নিকা পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। রঙ্গনাকে হঠাৎ পাশে না দেখতে পেয়ে এদিক সেদিক দেখতে গিয়ে দেখল দাদা ও তার বন্ধুরা একসাথে আবীর খেলছে, তার মধ্যে অনেকের বউ আবার অনেকের প্রেমিকা রয়েছে। ওরা নিজেরা একটা দল বানিয়ে নিয়েছে। এদিকে মা কাকিমাদেরও একটা দল। আবার বাবাকাকুদের দল। বাচ্চারা হুটোপাটি করছে নিজেদের মধ্যে। এমন সময় অমরেশকে দেখতে পেল চয়নিকা। চোখাচোখি হতে লজ্জা পেল। অমরেশ সোজা চয়নিকার দাদাদের দলে যোগ দিয়ে রঙ্গনাকে ‘হ্যাপি হোলী বউদি’ বলে আবীর দিলে চয়নিকার চোখ ফেটে জল এলো। পাড়ার বন্ধুরা চয়নিকাকে আবীর দিলে চয়নিকা ওদের আবীর না দিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলো। ঘরে ঢুকে বিছানায় বালিশ আঁকড়ে কেঁদে ফেলল।
অভিমানে বুক ফেটে যাচ্ছিল চয়নিকার। চয়নিকা মনে হয় ভুল ভেবেছে। অমরেশ ওকে কথার কথা বলেছিল। বুকের মধ্যে এমন কষ্ট হচ্ছে কেন? অমরেশ ছাড়া কি পৃথিবীতে আর কেউ নেই? মন তাও বলে তাহলে কেন সেদিন এমন কথা বলল? এই যে তিনমাস ধরে অমরেশ ছাড়া চয়নিকা কাউকে ভাবেনি এমনকি শাহরুক খানকেও আজকাল মনে ধরে না, তার কি কোন দাম নেই? নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজের উপর রাগ হল চয়নিকার।
বাড়িতে উঠোনে অনেকের গলা শোনা গেল, সাথে হাসাহাসিও। চয়নিকা শুনল মিষ্টি মুখ করানোর কথাও হচ্ছে। মনে মনে ভাবল যে বউদিটা পর্যন্ত এসে খোঁজ নিল না। মিষ্টি খাওয়ার পালা চলছে। কার কি যায় আসে চয়নিকাকে নিয়ে? এখন তো সবাই রঙ্গনাকে নিয়েই আদিখ্যেতা করে।
জানলা ধরে বাগানের দিকে তাকিয়েছিল। আমগাছে বোল এসেছে। তার একটা সুমিষ্ট গন্ধ জানলায় হাওয়ার সাথে ভেসে আসছে। হঠাৎ একটা কোকিল বিচ্ছিরি করে একটানা ডাকতে শুরু করল। পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়েও ঘুরে তাকায়নি। জানে রঙ্গনা যখন তখন চয়নিকার ঘরে আসে।
- কিরে চলে এলি যে বড়?
গলার আওয়াজ শুনে কেঁপে উঠল চয়নিকা। মুখ কিছুতেই জানলা থেকে সরাল না। আরও কেমন কান্না পাচ্ছে চয়নিকার। ফ্যাচ করে কেঁদেও ফেলল।
- তুমি চলে যাও। আমাকে আর অপমান করার প্রয়োজন নেই।
- বাবারে বাবা!! তুই খুব হিংসুটে দেখছি। অন্যদের আবীর দিলাম বলে তোর রাগ? বোকা মেয়ে!
হাতটা টেনে অমরেশ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল চয়নিকাকে। হাল্কা শরীরটা অমরেশের জিম করা শরীরের বাঁধনে বেঁধে গেল।
- পাগলী, নিচে আমাদের বিয়ের কথা হচ্ছে। আবীর ধুলে উঠে যাবে, আয় তোকে আমার রঙে রাঙিয়ে দিই।
চয়নিকা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলল অমরেশের চওড়া বুকে।
- ধ্যাত! লজ্জা করে না বুঝি? তুমি না একটা ...
অনুঘটক
স র্বা ণী রি ঙ্কু গো স্বা মী
তারণকাকার পুরো নামটা যে আসলে কি জানতোই না তনয়ারা। হয়তো ভবতারণ হবে, আজ মা থাকলে হয়তো বলতে পারতো। যখনকার কথা তখন দেখার চোখ আর ভাবার মন দুটোই একদম অপরিণত, কাজেই তারণকাকাকে দেখলেই মনে হতো বাজে পোড়া বুড়ো তালগাছ একটা, সাতঘাটে ঠোক্কর খেতে খেতে আঘাটাতে ঠেকেছে। সক্কাল সক্কাল ঐ "বৌদি" বলে ডাকটা শুনলেই ভারি বিরক্ত হতো তনয়া বোনেরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি আর ফিসফাস করলেও মায়ের সামনে কিচ্ছুটি বলার উপায় ছিলোনা। তারণকাকাও জানতো সকালসকাল একবার বৌদির শরণাগত হতে পারলেই চা বিস্কুট তো বটেই, সঙ্গে কপালে সেদিন জলখাবারটাও জুটে যাওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকে।
ওরা বোনেরা আড়ালে মুখ ব্যাঁকাতো, "তারণ না তাড়ি... গাঁজা আর তাড়ির চাক্ষুষ ফলাফল, চোখ দুটো দেখেছিস? এই সকালটুকু খালি নেশা করাটা বাদ দেয় বোধহয়!" মায়ের যে কী অদ্ভুত একটা মায়া ছিলো তারণকাকার ওপর, এসব গ্রাহ্য করতো না মোটে। রান্নাঘরে মোড়াটায় জমিয়ে বসে তারণকাকা শুরু করতো দেশ দুনিয়ার কাসুন্দি। ঘরে পাঁচবোন তনয়ারা, কাজেই মাকে জপাতে আর কতোক্ষণ? মা ও তো সাক্ষাৎ ভগবানের দূতই ভাবতো না তারণকাকাকে, ঘটক হয়ে এসে পাঁচ মেয়ের ভবতরী পার করবে! অতএব চা বিস্কুট মিষ্টিটিস্টি ভালোমন্দ কখনো সখনো জুটেই যেতো তারণকাকার।
বেজায় রাগ হয়েছিল তনয়ার যখন মেজদিকে দেখতে এসে তারণকাকার সম্বন্ধ আনা পাত্রপক্ষ গ্র্যাজুয়েট মেয়ে চাইলে মুখে রসগোল্লা টপ করে ফেলে তারণকাকা নির্বিকার বলেছিলো, "ছোট্টাকে দেখিয়ে দাও না!" মানে.....এ কি বাজার নাকি, একটার বদলে আরেকটা গছিয়ে দিলেই হলো! মাথায় একদম আগুন জ্বলে গেছিলো তনয়ার, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলো নিজেকে এমন করে তৈরি করবে, যাতে বেছে নেওয়ার মতামতটা ওর থাকে... একান্তই ওর! তবে পাঁচ পাঁচটি মেয়ের জন্ম দেওয়ার অপরাধের গ্লানিবোধ থেকেই বোধহয় মা কিন্তু সেজদিকে এভাবেই বিয়ে দিয়েছিল সেবার।
হয়তো তারণকাকা ঘেন্নার তালিকাতেই থেকে যেত তনয়ার, রাগেরও। অসম্ভব একটা বিতৃষ্ণা থেকেই শুভ্রদীপের সঙ্গে নিজের বিয়ের সময় তারণকাকাকে নেমতন্ন করেছিল তনয়া। অনেক খাবার ধ্বংস করেছে এতদিন মাকে পটিয়ে, পাঁচ পাঁচটা মেয়ে পার করতে তো এক আধটা বছর লাগেনি। জন্মের শোধ এবার নিজের বিয়েতে নেমতন্ন খাইয়ে হাতজোড় করে তনয়া বলবে ভেবেছিল, "এবার বিদেয় হও, শেষ কালো মেয়েটা এখন স্বাবলম্বী। তোমার মতো ঘটকের আর দরকার নেই আমাদের।" বিয়ের পর বিদায়ের সময় ওর মাথায় হাত দিয়ে তারণকাকা চোখ মুছে বলেছিলো..."চিরসুখী হও মা, তোমার মুখ দেখে এতোদিন আমার দাঙ্গায় কেটে ফেলা মেয়েটার কথা মনে কত্তুম যে!"
একটা ফালতু উটকো ঘটকও যে কখন বাবা হয়ে যায়, এইটুকু জীবনে তনয়ার জানা ছিলোনা এযাবৎ!
রয়ে গেলাম দায়ী
অ শো ক কু মা র মো হা ন্ত
রবি ঠাকুরের পলাতকা কাব্যগ্রন্হের 'ফাঁকি' কবিতার লাইন- "রয়ে গেলাম দায়ী, মিথ্যা আমার হ'ল চিরস্থায়ী।"
লক্ষ্মণ কাকার কাছে চুল কাটতাম। আমার বাড়ীর অদূরে লক্ষণ কাকার সেলুন। চুল কাটতে কাটতে কাকার সাথে গল্পে মেতে উঠতাম। কাকা শোনাতেন তার সোনায় মোড়া অতীতের ওপার বাংলায় ফেলে আসা স্মৃতিমেদুর গল্প। আমি আঁকতাম কল্পনায় লক্ষ্মণ কাকার গ্রামের ঝাপসা গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে অচেনা মানুষের ভীড়। কখনও শোনাতেন পুরোণো দিনের উত্তম কুমার অভিনীত অজস্র বাংলা সিনেমার গল্প। আনুপূর্বিক বর্ণনায় রঞ্জিত হতো বহ্নিশিখার গল্প। বহ্নিশিখার লতিকা কিভাবে স্বামী বিলাসের অনুপস্থিতিতে আরেকজনকে বিবাহ করে সন্তানবতী হ'ল, তারপর বিলাস বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করলে বিলাস লতিকার দ্বন্দ্ব, তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা।
আমি শোনাতাম শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনী। কখনো "চোরাবালি"-র গল্প, যেখানে নবাগত নিরীহ মাষ্টার মশাই হরিনাথ কর্তৃক হিংস্র নায়েবের ধূর্তামি ধরে ফেলা, অংক পাগল মাষ্টার মশাইকে নিজের কন্ঠ নিঃসৃত বাঘের ডাক শুনিয়ে চোরাবালিতে এনে হত্যা করে। আর জমিদার হিমাংশু রায় সেই নায়েবকে স্বহস্তে মৃত্যু দন্ড দিয়ে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার ইতিকাহিনী। কখনো শোনাই "তুঙ্গভদ্রার তীরে"-র ঐতিহাসিক রূপকথা। সেই"তুঙ্গভদ্রার তীরে" যেখানে আছে দাক্ষিনাত্যে হরিহর ও বুক্ক দ্বারা বিজয়নগরের পত্তনের ইতিহাস। যেখানে বিজয়নগরের রাজন্য দেবরায় কর্তৃক তার বাগদত্তা কলিঙ্গ রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা আর সামান্য রাজ কর্মচারী অর্জুনবর্মার পরিণয় সূত্রে আবদ্ধকরণের গল্পকথা। আর 'চুয়া চন্দনে'-র গল্প যেখানে নবদ্বীপের নিমাই পন্ডিতের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে সপ্তগ্রামের ধনাঢ্য বণিক চন্দন তার প্রণয়িনী চুয়াকে পাষন্ড মাধবের কোপদৃষ্টি থেকে উদ্ধার করে নিজের নৌযানে এনে নিমাইয়ের পৌরোহিত্যে বিবাহকার্য্য সম্পন্ন করে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার ইতিবৃত্ত। অথবা "গৌড় মল্লার" এর বেতসগ্রামের কঙ্গনার গল্প, গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের পৌত্র বজ্রের শৌর্য বৃত্তান্ত।
যদিও দুইজনের পেশা সম্পূর্ণ আলাদা, তবুও বহুদূরে কোন এক বিন্দুতে এসে মিলে গেছিল দুই ভিন্ন পথযাত্রীর গমন পথের অধিবৃত্তের চলরেখা। আমিও যেন লক্ষ্মণ কাকার সাথে গল্প করবার জন্য উন্মুখ থাকতাম, লক্ষ্মণ কাকা ও তাই। এক অদেখা সেতুবন্ধন। দুই অসম ভাবাবেগর সমাপতন। প্লেটোনিক ভালোবাসার ইশারা। একটু একাত্বতার অনুভূতিতে বন্ধুত্বের প্রলেপ।
একদিন কাকার দোকানের পাশেই মেট্রো ডেয়ারী স্টলে দুধ কিনতে গিয়ে দেখি মানি ব্যাগে খুচরো দশটাকা নেই। অথচ দশটাকা কাউন্টারে ঢোকাতে হবে, না হলে দুধ বের হবে না। ফিরে আসছি বাড়ি, টাকা নিতে বিষণ্ণ মনোরথে। কাকা ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় কাকাকে সত্যি কথাটাই বলে ফেললাম । কাকা বললেন দশ টাকার জন্য বাড়ী যাবে, আবার আসবে? আমার কাছ থেকে ধার নাও , পরের বার চুল কাটার সময় ঠিক আমি হিসেব করে আমি নিয়ে নেব। মন সায় দিচ্ছিল না। গরীব মানুষ। দশটাকা ওনার কাছে অনেক দাম। কাকার জোরাজুরিতে অবশেষে নিলাম।
দিন চারেক পর চুল কাটতে গেলাম কাকার দোকানে। কিন্তু সেই দোকানে দেখি অন্য অচেনা লোক। সসঙ্কোচে কাকার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে উনি শোনালেন, "আরে বলবেননা, দুদিন আগে দোকান থেকে ফেরবার সময় মোটর সাইকেলের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গেছে । হাঁড়ে চিড় ধরেছে। ছয়মাস বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবেন না।" ওনার বর্ণনার প্রতিটি শব্দের হাঁতুড়ির ঘা আমার বক্ষপিঞ্জরে সশব্দে আঘাত হানতে লাগল। বুঝলাম এই ফাঁকে উনি জায়গাটা দখল নিয়েছেন। হায় রে সুযোগ সন্ধানী! জিজ্ঞেস করলাম আপনি এখানে দোকান খুলেছেন, উনি কী আর আসবেন না? বলল দাঁড়ান সুস্হ হলে তো? এই বয়সে কী আর অত সহজে সুস্হ হবে! ওনার মনের অভীপ্সা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না। আমার দিকে এক পশলা দৃষ্টি হেনে বিদ্ধ করে বলে- "কাকার খরিদ্দার তাতো বুঝতে পারছি। কিন্তুু আমার কাছে আসুন না। আপনার কাকার মতোই চুল কেটে দেব।"
হায়রে মূর্খ, পাগল , আমার কাকার মতো তুই উপরে হয়তো কাঁচি বুলিয়ে দিবি! কিন্তু আমার মনের সেই কোমল পেলব জায়গাতে তোর কাঁচির স্পর্শ পৌঁছবে কী করে? ওখানে পৌঁছতে গেলে যোগ্যতা লাগে। ওখানে এখনও কাকার স্পর্শের চিহ্ন লেগে রয়েছে যে!
চলে এলাম সেদিন এক বুক বিষণ্ণতা নিয়ে। পরে পাশের অন্য এক দোকানে কাকার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলাম । আবছা হদিশ পেলাম। ও বলেই দিল "আপনি খুঁজে পাবেন না। সে প্রত্যন্ত গ্রাম। কেউ তেমন চেনে না ওনাকে।" হতোদ্যম হলাম । কৌতূহল না ঢেকে দোকানদার সরাসরি কারণ জিজ্ঞাসা করল, পাশকাটানো উত্তর দিলাম। কি করে বোঝাব ওকে আমি একজন দশটাকার ঋনগ্রস্ত অধমর্ণ। ঋণ করেছি, মহাঋণ। সেই ঋণের ভার যে বয়ে চলা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য দুরূহ। এই বোঝার ভার লাঘব করতে ওই হতদরিদ্র মানুষটাকে আজ আমার ভীষণ দরকার।
ছয়মাস অতিক্রান্ত। আমি মাঝে মাঝে ঐ কাকার দোকানের সামনে দিয়ে যাই , আর কৌতূহলী দৃষ্টি রাখি। কাকা ফিরেছে কিনা। কাকাকে দেখতে না পেয়ে চললাম একদিন কাকার বাড়ি সময় নিয়ে জেদ করে। খুঁজে পেতেই হবে আমাকে।
নাঃ! ওই ঠিকানায় গিয়েও আর টাকাটা দেওয়া হয়নি কাকাকে। পৌঁছে শুনলাম বিপত্নীক নিঃসহায় লক্ষ্মণকাকাকে তার একমাত্র পুত্র আর পুত্রবধূ মিলে যত রকম পেরেছে লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিয়েছে। সব শেষে অভুক্ত রেখেছিল বেশ কিছুদিন। অভিমানী কাকা আমার আমি পৌঁছবার দুদিন আগে তার সাজানো তার রূপকথার গল্পের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন একা একাই ।
ফিরে আসার পর
দি ব্যে ন্দু ধ র
তখনো দিগন্তে ছিল আগুনের শোক,
আকুল হাওয়ায় ছিল বারুদের ঘ্রাণ,
বিষন্ন আকাশ জুড়ে স্থবির সময়,
তখনো দুরন্ত আমি, গাই সামগান।
দীর্ঘ অজ্ঞাতবাস সেরে কালই ফিরেছি, আর সবাই ঘুমাচ্ছে। অনেকদিন পর নগর জীবনে কিভাবে সকাল হয় দেখব বলে এককাপ কফি তৈরি করে দোতলার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। বর্তমানের সাথে পুরনো কথাগুলি বারবার মিলেমিশে যেতে লাগল, মাথার মধ্যে নানা যোগ বিয়োগের খেলা চলতে থাকল।
বিশাল এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আমরা। বড়দা মাটির মানুষ, ঘোরপ্যাঁচ অতো বোঝেন না। অবশ্য তার অবিমৃষ্যকারিতার জন্যই এক বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাদের গোটা পরিবারের সকলকে। চরম প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে চলতে হয়েছে এই দীর্ঘ সময়।
হাই আর্জুন, কি ব্যাপার ? Long time no see, where have you been ? I really miss you.
চমক ভাঙল আমার । তাকিয়ে দেখি, নীচে রাস্তায় স্কুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে উত্তরা। তারুণ্যের উচ্ছলতা তার সর্বাঙ্গে। বললাম, Good morning, কিছুদিন বাইরে থাকতে হয়েছিল, কেমন আছো তুমি ? জবাব এল, এমনিতে ভাল আছি। যাবে নাকি আজ বিকেলে একটু কফিশপে। বললাম, একটু ব্যস্ত আছি, অন্য কোনদিন। ওকে বাই, বলে স্কুটিতে চলে গেল।
আলো অনেকটা বেড়ে গেছে। পাশের বাড়ি থেকে সেই পরিচিত কথোপকথন ভেসে আসতে লাগল, মর্ মর্ তুই রাক্ষুসী, আমার ছেলেটাকে তো খেলি, তাও তোর শান্তি হয় না ! রোজরোজ রংচং মেখে সন্ধে হলেই বের হয়ে কোথায় যাস তুই, অ্যাঁ ? তোর মনে এত আনন্দ কিসের? শ্রুতি নাটকের মত শুধু আওয়াজ পাচ্ছি। খিলখিল হাসির সাথে কথা ভেসে এল, হ্যাঁরে বুড়ি, আনন্দ এটাই তোকে রোজ ভাত খাওয়াতে পারছি। তা তুই মরে গেলে একার জন্য আর রং মাখবো না। বল না কবে মরবি? কানটাকে সুইচ অফফ্ করে দিলাম। সেই পুরনো কিসস্যা। আমাদের রাইভাল গ্রুপে ছেলেটা বাউন্সার ছিল, যা হয়, একদিন বেঘোরে মারা গেল। তারপর থেকে এই নিত্যকাহিনী।
কিগো, একা একাই কফি খাচ্ছো ?
যাজ্ঞসেনী উঠে এসেছে। বললাম, ডাইনিং এ তোমার জন্যও আছে, ডাকিনি ইচ্ছে করেই। কফির মাগটা নিয়ে এসে বলল, তা মেয়েটা কে?
বললাম, কোন মেয়ে? ওই যে যার সাথে গল্প করছিলে? বললাম, পাড়ার মেয়ে। হেসে বলল, তোমার তো গোটা পৃথিবীটাই পাড়া। যাই স্নানে, বলে চলে গেল। দৃষ্টি ফেরাই নিচের পৃথিবীতে আবার।দেখি, ত্রস্তপায়ে অনিন্দিতা সারা গায়ে আঁচল জড়িয়ে পার হয়ে যেতে থাকে সামনে চায়ের দোকানের জটলাটা। জটলার প্রতিজোড়া চোখ যেন জিভে পরিনত হয়েছে। আওয়াজ ফুটতে শুরু করে, আর সেও ছুটতে শুরু করে। মেজদা যদি একবার শুনতে পায় তবে ছুটে গিয়ে ওদের ছিঁড়ে ফেলবে। বোকা কিন্তু বড় ভাল মানুষটা। বিশাল শরীরের মত মনটাও বিশাল। বলশালী মানুষ, অকুতোভয়। ডাকলাম না তাকে, জানে না তো, এটা তার সময় নয়।সন্ধ্যেবেলাতেই পার্টির দাদা ডেকে শাসিয়ে যাবে। আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার, কৃষ্ণাপ্রসাদ ইয়াদব, পইপই করে বলে দিয়েছে, কোন ফালতু ঝামেলায় যেন এখন জড়িয়ে না পড়ি। সময়টা ভাল চলছে না এখন। নিখুঁত লক্ষ্যে কাগজের ছেলেটা ছুঁড়ে দিল কাগজটা। খবরের কাগজটা খুলে কটা খবর চোখে পড়ল। একটি নির্যাতিতা মেয়ের পরিবারের প্রায় সবাই দুর্ঘটনার কবলে মারা গেছে বা মৃতপ্রায়। আর অভিযুক্ত নির্যাতিতার সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন। বাহ্ , চমৎকার। আমার ছোট দুইভাই, বৈমাত্রেয় হলেও একাত্মা, এই খবর দেখলে, নির্জলা দৌঁড়ে যাবে ওদের শাস্তি বিধান করতে। তাতে যত বড়ো সমস্যাতেই আমরা পড়ি না কেন। নাঃ কাগজটা আজ হারিয়ে যাওয়াই ভাল। অন্য একটা খবরে দেখলাম, একই পরিবারের তিনজন বয়স্ক ও অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ফ্ল্যাটে শুয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেছে, কারণ কুড়িদিন ধরে তারা ভাতের মুখ দেখেননি, এক প্রতিবেশীর ভিক্ষায় বেঁচে আছেন, তারও সামর্থ্য সীমিত। তবে এটা মিথ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরও হতে পারে, কারণ রাজ্যে এখন খুশির আবহ চলছে, সামনেই মহোৎসবের ঋতু। আর এই খবরের সত্যতাও সরকারীভাবে স্বীকৃত নয়। অন্য একজন কর্মবীর যে দীর্ঘ পরিশ্রমে বিস্তীর্ণ এলাকাকে কৃষিযোগ্য করে তুলেছে, তার কোন কাজ নেই, কারণ সে সরকারী পুরস্কার পেয়েছে। সে তার সেই মেডেল গোয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। গোটা পরিবার প্রায় অনাহারে আছে। তবে এটাও স্বীকৃত নয়। কারণ দেশে এখন সুদিন এসেছে। তাছাড়া অনেক আন্তর্জাতিক সমস্যাও আছে। অবশ্য সেগুলো আন্তর্জাতিক নাকি দ্বিপাক্ষিক তা জানা যায়নি।
অন্যমনস্কভাবে নীচে তাকিয়ে দেখি এক নুলো ভিক্ষুক চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যদি কেউ দয়া করে কিছু একটা খেতে দেয়। ভাল করে তাকিয়ে দেখি সেই দুরন্ত তরুণ যে সন্ধ্যে হলেই আগুন বেঁধে রাখা সুতুলীর পিণ্ড নিয়ে ছুটে যেত দলের নেতার নির্দেশে। এই চাওয়ালাকেও বেশ কয়েকবার চড়থাপ্পড় মেরে গেছে। দেখি চাওয়ালা হাতের কাজ সামলে, হাতের ইশারায় তাকে ডেকে নিয়ে সামনে এনে দেয় চা আর পাউরুটি। আমার মা এখন আছেন আমাদের জ্ঞাতিদের বাড়িতে, ঘটনাক্রমে তারাই আমাদের রাইভাল গ্রুপ, যাদের জন্য আমাদের এই কৃচ্ছসাধন। মা থাকলে ওই চাওয়ালার মতোই কাজ করতেন। যেমন আমাদের জ্ঞাতিশত্রুদের, জ্ঞাতি ভাইদের মঙ্গল কামনা তিনি করেন।
★★★
সমরের জয় শুধু নিধনের খেলা,
সংখ্যায় মরণ আর সংখ্যায় বাঁচন।
মিঃ ইয়াদব বললেন, দেখো জেডি, কর্পোরেট দুনিয়াটাই এমন, হয় মারো নয় মরো। এখানে মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই। এখানে সবাই শ্বাপদ, তুমি হরিণ হতে চাইলেই তোমাকে হনন করা হবে।
কথা হচ্ছিল আমাদের ড্রয়িং রুমে বসে।
মিঃ ইয়াদব এসেছেন, এবার একটা নতুন নীতি নির্ধারণ এবং তার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে। মাকেও খবর পাঠানো হয়েছে, তিনিও রওনা হয়েছেন। বড়দা চান না জ্ঞাতিভাইদের কোনো ক্ষতি হোক।
কিন্তু জেডি তামাম ভারতবর্ষে তোমাকে ব্যবসার রাজত্ব বিস্তার করতে হলে, উত্তর ভারতের বাজারের দখল তো নিতেই হবে, আর সেটা তো দখল করে বসে আছে ডিডি। এখন তুমি বল সেটা কি করে সম্ভব, যে তুমি ডিডিকে না সরিয়ে ওখানে নিজেও রাজত্ব করবে ?
মেজদা লাফ দিয়ে উঠে বলল, তুমি রাখো তো ইয়াদব, আমি এখনই দিল্লিতে গিয়ে পিটিয়ে ওদের ঢিট করে আসছি। তোমরা ততক্ষণ বসে বসে তোমাদের নীতি ঠিক করতে থাকো। দাদার কথা শুনলে সারাজীবন আমাদের ছেঁড়া কাঁথাতে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে। ছোটে তুই আমার সাথে চল। তোকে কিছুই করতে হবে না, শুধু সাথে থাকবি।
আহ্ ভি এস, তোমার আবার সব কিছুতেই 'আয় দেখি তোর মুণ্ডু ছিড়ি'। এটা তোমার মল্লযুদ্ধ নয়। জানি তুমি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান, কিন্তু ওরা তো নিয়ম মেনে তোমার সাথে লড়বে না। বিলো দ্য বেল্ট হিট করবেই। আরে বোসো তো, মাথা গরম কোরো না।
আরে ইয়াদব শোনো, বড়দা বলল, দেখো আমরা যদি ব্যবসাটা অন্য কোথাও সরিয়ে নিই, তাহলে কেমন হয়।
মেজদা লাফ দিয়ে উঠে বলল, কভি নেহি, কায়র, মনে নেই ওদের হেড অফিসে যাজ্ঞসেনীকে ওই ডিডি কি অপমানটা করেছিল।
ছোটে আর প্যারে বলল, মেজদা ঠিকই বলেছে। এই অপমান ভোলা যায় না, আমরা এর শোধ নেবই। ধ্বংস করে দেব ওদের সব কিছু, কাউকে ছাড়ব না, ওদের পাশে যেসব গ্রুপ আছে তাদেরও শেষ করে দেব।
বড়দা বললেন, আর্জুন তুই কিছু বলছিস না তো। তুই কি চাস সেটা বল। তোর ওপর আমার অনেক ভরসা।
আমি বললাম, বড়দা চিন্তা করো না। দোস্ত যখন শান্ত থাকতে বলছে, তখন নিশ্চয় কিছু একটা প্ল্যান আছে দোস্তের মাথায়। ওর মত ধুরন্ধর লিগ্যাল অ্যাডভাইসার সারা পৃথিবীতে তুমি আরেকটা পাবে না। দোস্ত তুমি কি বলছ বল ?
ইযাদব বলল, দেখো জেডি, একটু ভাবো, এখন যদি তুমি ওদের স্পেস ছেড়ে দাও তবে মার্কেটে সবাই ভাববে আমাদের মন্দা চলছে, আমাদের শেয়ার পড়ে যাবে হুহু করে। আমাদের সহযোগীরাও ঘাবড়ে যাবে, শেষমেষ হয়ত ডিডির খপ্পরেই গিয়ে পড়বে। তাহলে আমরাই ধ্বংস হয়ে যাব। তাই ওটা করা যাবে না। আবার এই মুহুর্তে ওদের বিরুদ্ধে অল আউট লড়াই করার মত জায়গায়ও আমরা নেই। আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় এখন পাবলিক রিলেশন আর মার্কেট স্টাডি করতে হবে। দেখতে হবে যখন সত্যি সত্যি ঝামেলাটা শুরু হবে তখন কোন কোন গ্রুপ আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাপোর্ট করবে। যারা একান্তই সাপোর্ট করবে না, তারা যেন নিউট্রাল থাকে। এভাবেই ডিডিকে একঘরে করে হীনবল করে ফেলতে হবে। কোনো রাজনৈতিক ঝামেলার জড়ানো যাবে না। কর্পোরেটের সুপার পাওয়াররা যেন আমাদের প্রশ্রয়ের চোখে দেখে। এই গুড বয় ইমেজটা যেন থাকে। তাই আমি এখনই হা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছি না। বল দোস্ত, আমার প্ল্যানটা ঠিক কিনা।
আমি জানি দোস্ত কখনো ভুল করে না। অদ্ভুত তার মেধা, তীক্ষ্ণ তার বিচার ক্ষমতা। আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
যাজ্ঞসেনী খিলখিল করে হেসে বলল, দেখো তোমরা আবার ইঁদুরের গর্তে ঢুকে যেও না। তোমাদের গর্জন যত বেশি, বর্ষণ ততটাই কম।
সারা ঘর নিস্তব্ধ।
★★★
সমস্যাটার বীজ লুকিয়ে ছিল আমাদের জন্মের সময় থেকেই। উত্তরাধিকার সূত্রেই আমরা বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের অধিকারী। কিন্তু আমাদের বংশে অন্য একটা শাখা, ডিডি যার প্রধান, তারা এটা কখনই মেনে নিতে পারেনি। নানা ভাবে তারা আমাদের ক্ষতিসাধন করে গেছে। অবশেষে বড়দার ভালোমানুষীর সুযোগ নিয়ে তারা দখল করেছে আমাদের এই বিশাল উত্তরাধিকারের পরিচালন ক্ষমতা। ডিডি অ্যাণ্ড অ্যাসোসিয়েটস নামে চলছে সেই গ্রুপ। বেশ কিছু বড় বড় গ্রুপ যোগ দিয়েছে বা সমর্থন জানিয়েছে তাদের। এই গ্রুপ এখন এতটাই শক্তিশালী যে সারা ভারতের কর্পোরেট জগতে তারাই শেষ কথা। তাই আমাদের পক্ষে লড়াইটা এতটাই কঠিন যে আবার ক্ষমতা ফিরে পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। ভরসা শুধু একজন তীক্ষ্ণধী মানুষ, কৃষ্ণাপ্রসাদ ইয়াদব, আমার দোস্ত। আর কয়েকজন মাত্র শুভাকাঙ্খী। তার মধ্যে উত্তরার বাবা একজন। যাজ্ঞসেনীর বাবাও বেশ ক্ষমতাবান, তার সমর্থনও কম কথা নয়।
দোস্ত এখন যোগাযোগ করছে সব ক্ষমতাবান গ্রুপেগুলির সাথে যাতে আসন্ন লড়াইটাতে আমরা যত বেশি সংখ্যক বন্ধুকে পাশে পাই।
ওদিকে বড়দাকে নিয়ে মহা সমস্যা। এখনো গোঁ ধরে বসে আছে, জ্ঞাতি ভাইদের একেবারে পথে বসানোটা ঠিক না।
তাই আমরা আজ আবার ডেকে এনেছি দোস্তকে। বড়দাকে জিজ্ঞাসা করল দোস্ত, জেডি তুমি কি করতে চাইছ?
ইয়াদব, দেখো আমাদের বেঁচে থাকার জন্য কতটা সম্পদ আর চাই বল, কয়েকটা ছোটখাটো ব্যবসার পরিচালন আমাদের দিলেই আমরা খুশি, তাতেই আমাদের চলে যাবে। আর কি চাই বল ...।
দেখো, একে তুমি সরলতা বলতে পারো তবে লোকে এটাকে বোকামী বলে হাসাহাসিই করবে। আর আমাদের সহযোগীরা সবাই ঘাবড়ে যাবে, বাজারে আমাদের শেয়ারে ধ্বস নামবে, দোস্ত বলল।
তা হোক ইয়াদব, এটাই আমার ইচ্ছা, তুমি এই ব্যবস্থাই কর। আজই এয়ার টিকিট কনফার্ম করে তুমি কালই দিল্লি পৌঁছে যাও আর ডিডির সাথে কথা বল। দেরি করো না।
এতক্ষণ যাজ্ঞসেনী চুপ করে বসে ছিল। এবার নীরবতা ভেঙে বলে উঠল, শেষে ভিক্ষাবৃত্তি করাই স্থির হলো ... যত সব মুর্দার দল, আরে এরাই বলে হবে রাজা .... এর চেয়ে প্রোমোটারি করো বা সিণ্ডিকেটে যোগ দাও। তবু খেয়ে পড়ে তো বাঁচবে।
মেজদা বলল, আমাদের ব্যবসা, আমাদের সম্পত্তি, আমরা সেটাই ভিক্ষা চাইবো আর ওদের ছুঁড়ে দেওয়া রুটির টুকরো লেজ নেড়ে খাবো ! কভি নেহি , হাম লড়কে লেঙে পাকিস্তান। ছোটে আমার বন্দুকটা দে তো, দেখাচ্ছি মজা। প্যারে বলল, ঠিক বলেছ মেজদা। চলো আমিও যাবো।
বড়দা বলল, খামোশ। আমি যা বলবো সেটাই করতে হবে, আর কোনো কথা নয়। ইয়াদব এখন দেখবে ব্যাপারটা।
দোস্ত বলল, চলি তাহলে, ফিরে এসে কথা হবে।
যাজ্ঞসেনী বলল, বিফল মনোরথ হও।
★★★
রাজার দাবায় যায় উলুখাগড়ার প্রাণ
যুদ্ধে ধর্ম বলে কিছু হয় কি আবার।
শেষ পর্যন্ত যাজ্ঞসেনীর ইচ্ছাই পূর্ণ হল।
দোস্তকে দিল্লি থেকে খালি হাতেই ফিরতে হল। ডিডি তার কোন কথাতেই কান দেয়নি। উপরন্তু তাকে যাচ্ছেতাই ভাবে বিদ্রুপ করেছে। তার সমস্ত 'কোটেড ও আনকোটেড' কথাই আমাকে জানিয়েছে দোস্ত। ডিডি বলেছে যে, জেডিকে বল এসব ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে গ্রসারি শপ খুলতে, তাতে এই ক'জনের সংসার ভালোই চলে যাবে। আমার অর্গানাইজেশনে চাকরি দিতে পারব না, কারণ আমার সবচেয়ে ছোট কর্মচারীও এম বি এ/এম সি এ পাশ। তার তো এই যোগ্যতাও নেই। আর যাজ্ঞসেনীকে বল কোথাও রিসেপসনিস্টের কাজ-টাজ জুটিয়ে নিতে .... বলে বিচ্ছিরিভাবে সবাই মিলে হাসাহাসি করেছে।
শুনতে শুনতে আমার মধ্যে হননেচ্ছা জেগে উঠছিল, মাথার মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠছিল। সমস্ত পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠছিল, সমস্ত বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলছিলাম।
দোস্ত আমাকে একা থাকতে দিয়ে চলে গেল। বড়দাকে সকল কথা জানিয়ে দোস্ত বলল, বল এবার কি করতে চাও তোমরা? যত কথা বলা যেত সব কথাই তো বলা হয়ে গেল, এবার কি করবে?
মেজদা হুঙ্কার দিয়ে বলল আমি তখনই বলেছিলাম, বড়দার এসব গান্ধীগিরি দিয়ে কিস্যু হবে না, ওদের প্রাপ্য ওদের ফিরিয়ে দিতে হবে। ম্যয় উসকা খুন পী যাউঙ্গা, এক এক কো চুন চুনকে মারুঙ্গা ...।
এসব ফিল্মি ডায়ালগ দিয়ে কিছু হবে না, ভি এস। সলিড কিছু ভাবতে হবে, বুঝলে। তুমি তো ক্রিমিনাল কেসে ফেঁসে যাবে দেখছি। এনিওয়ে, আমি একটু আর্জুনকে নিয়ে কিছুদিন বেরোতে চাই।
আমি বুঝতে চাইছিলাম দোস্তের মাথায় কি প্ল্যান চলছে। সে এত শান্ত ভাবে সব ঘটনা ন্যারেট করে যাচ্ছে কিভাবে ...। কুছ তো হ্যায় , কুছ তো হ্যায়।
আমাকে বলল, চলো দোস্ত কটা দিন একটু আউটিং করে আসি। মনটাকে স্ট্রেস ফ্রি করে আসি।
বেশ তো, বলে আমি রাজী হলাম। আমারও আর এখানে ভাল লাগছিল না।
তারপরের টানা একমাস শুধু পাবলিক রিলেশন আর লিগ্যাল ফরমালিটিজ নিয়ে বহু মিটিং করে চলল দোস্ত। বেড়ানোটা বাজে কথা ছিল, আসল এটাই।
সমস্ত বড় গ্রুপগুলোকে বোঝানো হল যে, এত বেশি শক্তিধর হয়ে উঠলে ডিডি তার ডিকটেটরশিপ চালাবে সমস্ত কর্পোরেট জগতে, তার কথাই হবে শেয়ার মার্কেটের শেষ কথা, অর্থনীতিও সেই। অর্থাৎ সেই হবে অভিযুক্ত, সেই করবে অভিযোগ, সেই করবে বিচার আবার শাস্তিও সেই দেবে।
সকলেই বুঝল বিপদটার শুরু ও শেষ। সকলেই রাজি হল তাদের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধ রুখে দাঁড়াতে। তার অ্যাসোসিয়েটরা বোর্ডে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনবে আর বড়দাকে তার স্থলাভিসিক্ত করবে বলে রাজি হল।
আমি প্রথমে খুব দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম জ্ঞাতিদের ধ্বংসের পথ এভাবে মসৃণ করার কাজে নিয়োজিত হতে। প্রতিদিন দোস্ত আমার কাউন্সেলিং করেছে, সকাল সন্ধ্যায়।
আস্তে আস্তে আস্তে আমার মনটাও শক্ত হয়ে গেল।
আমি এবার বুঝতে পারলাম কেন দোস্তকে সবাই এত সমীহ আর শ্রদ্ধা করে, তার মত ম্যানেজমেন্টের লোক আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি, তাই।
এবার বুঝলাম, বড়দা যখন তাকে দিল্লি যেতে বলল, সবাই আপত্তি করল, রেগে গেল ... সে তো নির্বিকারভাবে চলে গেল, একবারও বলল না যে এতে কোনো লাভ নেই ... এটাও তার একটা স্ট্র্যাটেজি।
সে ভালভাবেই জানত, ডিডি এরকমই করবে, কিন্তু বড়দা কখনোই তার সেন্টিমেন্টের বাইরে আসতে পারত না, তাই সে ঘটনাটা ঘটতে দিল।আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসা এটাও স্ট্রাটেজি, আমাকে পুড়িয়ে ইস্পাত করে তোলা।
আমি জানি এরপর আর কিছু বাকি নেই, ওরা ধ্বংস হয়েই গেছে, বাকি শুধু শেষ দেখাটা। জানি এরপর অনেক ধুলো উড়বে, উড়বে অনেক কপাল পোড়া ছাই। অনেক অনেক হাহাকার আর ধ্বংস ... আমি জানি অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হবে এরপর, হবে অনেক রক্তক্ষরণ ... স্বজন ও দুর্জনের ...
তারপর সেই ধ্বংসস্তুপের ছাই সরিয়ে ফেলে আমরা খুঁজে নেব মাটি, করব জল সিঞ্চন, অশ্রু আর জন্ম মিলে মিশে একাকার হয়ে জেগে উঠবে ফিনিক্স পাখি।
দেব তোমায় খোলা চিঠি
ডঃ ম য়ূ রী মি ত্র
মাত্তর কয়েকটা মুহূর্ত আমার গোটা দিনটাকে মাধুর্যে ভরাল। আজ সকাল থেকেই আমার স্কুলে বাচ্চাদের মায়েরা স্কুলকিচেনে বাচ্চাদের জন্য বানাচ্ছেন নানারকম সব টিফিন। স্কুলটাইমেও মায়েদের সাথে পেয়ে আজ ভারী খুশি বাচ্চারা। পড়াশুনো তো বন্ধ আজ। ফলে একবার করে খাতায় ড্রইং করছে আর দৌড়ে দৌড়ে কিচেনে গিয়ে মায়েদের দেখে আসছে। সবচেয়ে পেটুকগুলো আবার অনেকক্ষণ ধরে ক্লাসে নেই। বুঝলাম, ব্যাটারা নির্ঘাত মায়ের কোলেই আস্তানা গেড়েছে। ক্লাসরুমে ফেরার মনই নেই তাদের। ঠিক করে নিয়েছি পড়তে জোর করব না আজ কাউকেই।
-এরই মধ্যে দেখি, দুটো ছবি আঁকিয়ে মেয়ে মন দিয়ে কী যেন আঁকছে ৷ কাছে গিয়ে দেখি, একজন আঁকছে আপেল আরেকজন ভোরের ডিমসূর্য। ডিমসূর্য মানে ডিমের কুসুমের মত সূর্য। আসলে পড়ানোর সময় এমনভাবেই রঙ চেনাই আমার বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বাচ্চাদের। তাই সূর্য- তা সে ভোর বা বিকেল- যারই হোক না কেন- এরা বলবে ডিমসূর্য। বলবেই বলবে। আজও ওমন বলতে বলতেই আঁকছিল। ডিমসূর্য- ডিমসূর্য। হঠাৎ শুনি- ডিমসূর্য বলতে বলতে কখন যেন সে বলতে শুরু করেছে- সূয্যি মা। দেখি কী- সূর্যের মাঝে নিখুঁত হিসেবে সে বসিয়েছে দুটো টানা দীঘল চোখ। বিড়বিড় করে বলেও উঠল একবার- "এ আমাদের সূয্যি মায়ের চোখ"।
দেখাদেখি পাশেরটা তার ড্রয়িংখাতায় লাল আপেলে এঁকেছে ঘন সবুজ দুই চোখ। এ বুঝি তার আপেলমায়ের চোখ। আলোকদায়িনী ও ফলদায়িনী। কত মা! কত মা!
আমাদের, আমাদের ক্ষমতামতো বিদ্যে দাও গো মা। আমরাও তোমার ছেলেপুলে মা। ভুলো না মাগো। আমাদের তুমি ভুলো না।
★★★
মূক বধির বাচ্চারা সবচেয়ে নিবিষ্ট হয় প্রানের জন্ম ও প্রাণীর বেড়ে ওঠায়। সাধারণ শিশুদের থেকে এদের প্রাণীজগতে তন্ময় থাকাটা একটু বেশি। একটু কেন অনেকটাই বেশি বা ধরে নিন মাত্রাছাড়া।
একবার হলো কি, ক্লাসরুমের টেবিলের তলায় একটি মেনি অনেক কটা বাচ্চা পাড়লো। ক্লাস করাতে করাতে টেরই পাইনা কখন মেনি এসে বাচ্চাগুলোকে দুধ খাইয়ে যায়। একদিন একটু দেরিতে ক্লাসে ঢুকে দেখি টেবিল ঘিরে বসে আছে আমার ছাত্ররা। বধির মানবশিশু হাঁ করে মেনির দুধ খাওয়ানো দেখছে। মেনির বাচ্চা দুধ খাওয়ার জন্য মুখ চুকচুক করে তো এগুলোর ঠোঁটও ফাঁক হয়। সবচেয়ে মজার কথা, টেবিল ঘিরে বাচ্চাগুলো বসেছে ঠিক সেই অর্ডারে যে অর্ডারে আমি প্রতিদিন তাদের ক্লাসে বসাই।আর ক্লাস নিচ্ছে মেনি।
বুঝি- বাচ্চাগুলো শুনতে পায় না বলেই বোধহয় বারবার ছটফট করে কিছু না কিছু শুনবে বলে।
মেনির ঘটনাটার পর থেকেই দেখছি ক্লাসের সবচেয়ে কুচিটা মাঝে সাঝেই আমার পেটে কান পেতে কী শুনছে। বিব্রত হয়ে ওর মাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন- মেনিবিল্লির দুধ খাওয়ানো দেখে বাচ্চাটা বুঝেছে ঐরকমভাবেই পেটে ছিল ও। তাই পছন্দসই কোনো মহিলা দেখলেই তার পেটে কান রেখে বাচ্চার ডাক শুনছে। শব্দ নেই। স্মৃতিও এদের দুবলা। অতীতকে প্রকাশ করতে হিমসিম খায় কথাহীন শিশু। এভাবেই হয়ত বুঝতে চায় পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে থাকা সেই আমিটাকে।
বিব্রত হই না আর আমি। প্রশ্রয় দি ওর দুষ্কর্মকে।
সরস্বতী পুজোয় স্তন আমার উথালপাথাল। আয় মুখ ডুবিয়ে দে। এক গরীব বিদ্যাধরের গল্প বলি। সে বড়ো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছিল রে। তাপ্পর সে বিদ্যে তাকে তুলে না রেখে সব্বাইকে দিয়ে দিয়েছিল। যেমন তাঁর দর্প তেমনি করুণাঘন মন। নাম তাঁর বিদ্যাসাগর ৷
শুনতে পাস না?
কাঁদিস কেন বাছা ?
কান কাজ না করে যদি
মন দিয়ে শোন তবে !
★★★
এক মানুষ দুখ দেয়৷ অন্য মানুষ জল মোছে। দৃঢ় হাতে ঘষে ঘষে তুলে ফেলে কান্নার শেষ পুঁটকি। উজ্বল হয় নতুন হর্ষ।
এক সে রাত। গোটা নিশি জুড়ে বিচ্ছিরি কান্নার কিরিকিরি চলছিল আমার। কিরিকিরি- এ শব্দ আমার। কান্না থেকে বেরোতে না পারলেই এইসব অদ্ভুত শব্দ বুনি আমি। নিজের শব্দে নিজেকে গাল পাড়ি। তো পরদিন সকাল অব্দি চলল সে গ্লানি।
বেশ খানিকটা বেলা গেলে প্রিয় মানুষের সম্বোধন এল- মন খারাপ করে না থেকে স্কুলে গিয়ে শিশুদের সাথে সরস্বতী পুজো কর। সবাই মিলে কোনো কাজ করলে যে তৃপ্তি আসে তাতেই দুঃখ ভুলবে তুমি।
সাজলাম। গহনায় নয়- আনন্দে। সাজতে সাজতে মনে হল- ওহ! দুদিন বাদে সরস্বতী পুজো। আজই তো স্কুলের পুজোর বাজার সারতে হবে। বাচ্চাদের বেখাপ্পা পছন্দের মিষ্টান্ন- কদমা, রঙিন মঠ, তিলের নাড়ু বেশি বেশি করে কিনতে হবে। শসা, আপেল ইত্যাদি ফালতু (শিশুর মতামতে) পুষ্টিকর ফল কম। আর একটি মায়াময় দেবীমূর্তি- যে কিনা তার নরম দুটো নয়নে চেয়ে থাকবে শিশুপাঠ্যে। কতকাল ধরে যে সে চেয়ে আছে শিক্ষরত মানুষের পানে!
হাঁটছি বাজারে। হঠাৎ- অদূরে অপূর্ব এক মূর্তি- মহানাস্তিকও যাকে পুতুল না ভেবে দেবী ভেবে সুখ পায়। ঠোঁট দুটো কী আদুরে কী আদুরে! সবুজ আর হলদে আভায় কী সপ্রতিভ দেবীর মুখ! দর শুরু হল। সাতশো টাকা। সঠিক দামই বলেছেন দোকানি। আর সঠিক বলছেন বলেই দাম কমাবার ব্যাপারে একেবারেই রাজি হলেন না। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও না।
একবার কেবল বললাম- "ভাই এটা একটা প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের স্কুল। আমাদের অত টাকার বাজেট নয়"।দোকানি বললেন- "অন্য ঠাকুর নিন৷"
বললাম- "এই ঠাকুরটার দুরকম রঙের মিশেল ওরা খুব ভালোবাসবে। জানেন ভাই ,এ সব বাচ্চা রঙের রকমারি খুব ভালোবাসে।"
ঘন ঘন মাথা নাড়া চলছে দোকানির। রাফ টাফ কথা বলে চলেছেন। যতদুর মনে হয়- শেষ কথাগুলো নিজের মনেই বলতে বলতে চলে যাচ্ছিলাম। চলে যাচ্ছিলাম দেবীকে ছেড়ে। বিক্রেতাকেও ছেড়ে অনেকটা দূরে যখন, দেখি- মাথা নাড়া বন্ধ করে স্থির চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। দৌড়ে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলেন। "দিদি আমার বাচ্চাটাও তো এরকম হতে পারত! আপনি ওই দামেই নিয়ে যান। এই মুর্তিটাই নিয়ে যান। দাঁড়ান- সাজগুলো পরিয়ে দি!"
দেখলাম- এতক্ষণের নারাজ দোকানি এবার রাজি হওয়ার উত্তেজনায় থরথর। কম করে শ'চারেক লোকসান দিয়ে কাঁপা হাতে আরো আরো রঙের গয়না পরিয়ে দিচ্ছেন। বাচ্চারা রঙ ভালোবাসে কিনা। ঠাকুর নিয়ে রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে ফল কিনছি। -কে যেন দেখছে আমায়! চোখ তুলে দেখি- ওপারে দোকানি। পথের অগুনতি মানুষের ফাঁক দিয়ে দুই চোখ তাঁর হাসছে। রাফটাফ চোখে এখন খুব প্রীতি! খুব।
সরস্বতী হাসে-
ময়ূরা এতো ক্যালাস তুই? আমার এমন ভক্তকে একটা নমস্কার করে আসবি তো! নে নে এখনই বাক্সে তোল তোর আজকের পাঠ। ভাগ যা ইঁদুরের পাল।
সরস্বতী আজি লালচন্দনে
চিরকাল রবে সবার ৷
এবং
সর্বত্র।
পঞ্চমীর রাতে শিশুর মিলনোৎসব।
★★★
গিয়েছিলাম তো সেদিন আমার কুসুমলতার কাছে। তবে তাঁর পছন্দের শাড়িটি নিয়ে যেতে পারিনি- সাদা খোলে সরু পাড় ছাপা শাড়ি। এ শতকের দুর্দান্ত ও দামী বুটিকের মেলায় এমন সাধারণ সাতসস্তা শাড়ি খুঁজে পেলাম না। অবশ্য খুঁজেওছিলাম যাওয়ার মাত্তর দুদিন আগে। তাঁর উপহার আরো যত্ন করে সময় নিয়ে খুঁজতে হবে এমনটা হয়ত মনে আসেনি আমার। আমার কুসুম যে এমনই- সংসার কুসুমের সেবা লুটেপুটে খায়। কুসুম সেবা করে সুখী থাকেন। ক্ষুধায় ভুগেও পূর্ণ তৃপ্ত সে মানবী।
একটা ছেলে ছিল কুসুমের। মরে গেছে। কুসুম ভাসুরঝিদের ডাকেন- ও বড়মেয়ে- ও আমার ছোটমেয়ে। বড়মেয়ে বলে- আমার বাড়ি থাকুন জেঠিমা।তিনলাখ খরচ করে কুসুম মেয়ের বাড়ি সাজান। শেষ করে ফেলেন সব অর্থ। আহল্লাদে ফেটে পড়ে মেয়ে- ও জেঠিমা বাড়ি ভেঙে প্রমোটার ফ্ল্যাট বানাবে যে এবার। মেঝে দেয়াল ঝকঝক করবে সব। আপনি কোথায় থাকবেন বলুন। জিনিসপত্তরসমেত নামিয়ে দিয়ে আসবক্ষণ। কোনো অসুবিধে হবে না।
কুসুম নিঃশব্দে উঠে আসেন তাঁর স্বামীর গড়ে তোলা সেবাকেন্দ্রে। নামিয়ে দিয়ে আত্মজন চলে যায়- কুসুম তখনো জিনিস নিয়ে চত্বরে বসে। খানিক পরে সেবাকেন্দ্রে একটি কুটুরি মেলে। তার খানিক পর থেকে ভালোবাসতে শুরু করেন কোটরের চারপাশের মানুষদের। বিশেষ করে সেবাকেন্দ্রের মুসলমান পরিবারের ছেলেগুলোকে নানারকম খাবার বানিয়ে খাওয়ান। কাউকে কাউকে নিয়মিত। তাদের ফেলে যাওয়া পাত নিজের হাতে পরিস্কার করেন।
এ পর্যন্ত শুনে আর থাকতে পারিনি। বললাম- হাঁটতে পারেন না ভালো করে। এত করেন কেন? উত্তর এল নিরুত্তরে- দ্যাখো আমার মানুষকে রেঁধে খাওয়াতে খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে ওই যে রেহানকে দেখছ- ও আমার রান্না খুব তৃপ্তি করে খায়। তবে আমার কাছে পড়তে বসে। নাহলে নয়। বাহ রে! বেজাতের শিশুর থালা মাজার ভালো যুক্তি তো আপনার কুসুম!
কুসুম অবশ্য গর্ব ভরে বললেন- "আমি কিন্তু জাত মানি। ওদের ঘরে যে খাব না তা ওরা ভালো জানে৷" জাত মানেন অথচ মুসলমান বধূদের সেলাই শেখান। সন্ধেবেলা বউয়ের রান্না খেয়ে মুসলমান বর নাক কুঁচকে বলে- "কুসুম মার থেকে রান্নাটা শিখে নিতে পারনি।" আপনি জাত মানেন অথচ আপনার পাতানো মেয়ে মৌসুমীদিকে কড়া নির্দেশ দেন- রেহান আর তার বন্ধুদের জন্য চকলেট আনতে। ওহ! পাতানো শব্দে পাপ লেগে আছে। তাই তো কুসুম? মৌসুমীদি তো আপনার সত্য মেয়ে তাই না? মৌসুমীদি আপনার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন দুজোড়া জুতো। আপনাকে পায়ে নতুন জুতো পরাচ্ছিলেন- আপনি তখনো ভ্রূক্ষেপ না করে বলছিলেন- রেহানের চকলেট?
কী ভেবেছিলেন আপনার জাত মানার মিছে কথা বিশ্বাস করব। ভালোবাসাটা দেখব না? চৌকাঠ দেখব অথচ টপকাতে পারব না। আমি পেরেছি কুসুম।আপনাকে আমরা সেদিন সবাই চিনতে পেরেছি।
আমাদের সবার মনে আছে আপনার প্রতিটি কথা- সবার। আহা আমায় থামাবেন না। আমি তো আপনার মত নীরব মানব নই। জানেন না আমি সরব খচ্চর? তাই আপনার বলা দুটো লাইন বলবই আমি। কোট আনকোট বলব।- "জানিস রে আমার হাঁটার কষ্ট তো বাড়ছে দিন দিন। এবার ঠিক করেছি আমার মরা ছেলেটার জন্মদিনে বাচ্চাগুলোকে শুধু খিচুড়িই নাহয় বানিয়ে দেব। আর কাউকে বলব পরিবেশন করে দিতে। হ্যাঁ রে- তাতে হবে না? খুশি হবে তো রেহানরা?"
আর একটা কথা শুধু আমায় বলেছিলেন কুসুম। বা সবাইকে বললেও আমি আপনার শব্দগুলো অধিকার করে নিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে- আছছা এত বঞ্চনায় এত কম পয়সায় খুশি থাকেন আপনি! এমন কোনো বিষয় নেই যাতে আপনারও কান্না পায়?
- "পায় ময়ূরী। আমারও কান্না পায়। শীতের ভোরে যেদিন বেশি কুয়াশা জমে- আমার জানলা দিয়ে শুকতারাটা আর দেখতে পাই না। মনে হয় সে আরো দূরে চলে যাচ্ছে- আজ আর ভোরের নক্ষত্র জ্বলল না। আমার তার সাথে গপ্প করা আজ হল না। তখন খুব কষ্ট হয় গো!"
আপনি হয়ত শোনেননি। বিদায়বেলায় আমাদের সেদিনকার যাত্রাপথের এক সাথী অতনু বিড়বিড়িয়ে বলেছিলেন- এমন মানুষ। মনে হচ্ছে- আজ থেকে এমন মানুষকে সেবা করাটা আমার দায়িত্ব হয়ে গেল।
-না না আমি ভুল করিনি কুসুম। কখনো মানিনি- অতনুর এ বাক্য নারীর প্রতি পুরুষের স্তুতি। বিশ্বাস করেছি- এ হল মহান মানবের প্রতি ক্ষণিকের অতিথির শ্রদ্ধা।
ফেরার পথে গাড়ি থেকে দেখলাম- আস্তে নামা সন্ধের মাঝে গরুর পাল নিয়ে ফিরছেন এক মুসলমান বৃদ্ধ আমার সেদিনের যাত্রার আরেক সাথী তরুণ গবেষক সুদীপ্তা গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন- "আরে! এই কাকুটাকেই তো সকালবেলা দেখলাম।"
আপনি আমার অর্জিত কুসুম।
যাত্রার অভিজ্ঞতা সবাইকে দিলাম।
আপনি থাকুন আমার হয়ে।
আমার স্তনে।
সবুজের ক্ষেতে ও কে রে? আমার কুসুম হাঁটে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন