ভ্রমণকাহিনী
পথে যেতে যেতে (পর্ব : ২)
ড রো থী দা শ বি শ্বা স
এলো থার্বো টি এস্টেট, পাহাড়ের ঢালে চা বাগান, গুডরিকের, ছন্দবদ্ধভাবে, বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ত্রিকোণ ঝুড়ি পিঠে বেঁধে রঙ বেরঙের পোশাক পরিহিতা দক্ষ মহিলা শ্রমিকেরা চা-এর দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তুলছে,কুঞ্চিত ত্বক, নাকে তাদের কাঁচা সোনার নোলোক, হাতে দু'তিনটি করে সাদা চুড়ি, শাখার বিকল্প যেন। এমন দৃশ্য দেখলেই "ধনরাজ তামাং" চলচ্চিত্রের ঐ দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে যায় ... "টিপাই টিপাই, টিপাই টিপাই, টিপাই টিপাই রে ... ও ... দুটি পাতা একটি কুঁড়ি সবুজ বাগানে ..."এখানকার পাহাড়গুলো গোল গোল। উল্টোনো কচ্ছপের পিঠের মতো, কখনো মনে হলো পাহাড়টা ঠিক যেন উটের কুঁজের মতো। হ্যাঁ, এইবার মনে পড়েছে, এমন ভূমিরূপের ছবি তো ভূগোলবইএ পড়েছি, ঠিক যেন উল্টানো ডিমের ঝুড়ির মতো, এরকম ভূমিরূপকে তো ড্রামলিন বলে। হিমবাহের চলনের দ্বারা পাহাড় কর্তিত হয়ে ড্রামলিন তৈরী হয়। বহুযুগ আগে এসব অঞ্চল তাহলে হিমবাহ অধ্যুষিত ছিলো!!! দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। এমন দৃশ্য দেখলে গুনগুন করে মন।
"পহাড়ো কো চঞ্চল,
কিরণ চুমতী হ্যায়
হওয়া হর নদী কা
বদন চুমতী হ্যায়
ইহা সে উহা তক্
হ্যায় চাহো কে সায়ে
ইয়ে দিল ঔর উনকী
নিগাহো কে সায়ে ..."
গোলপাহাড়ে পালসারের সারি। লক্ষ লক্ষ বছর আগে এ সব অঞ্চল হিমবাহ অধ্যুষিত ছিলো। উষ্ণতা বাড়ার সাথে সাথে হিমবাহ গলে গিয়ে জন্ম নিয়েছে অনেক নদনদী, ঝোরা। সেই নদনদী পাহাড়গুলোকে কেটে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তার সাথে কাজ করেছে আবহবিকার। Dramlin - আইরিশ শব্দ "Droimnin" থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো "Littlest ridge". এই বিশেষ ধরণের ভূমিরূপ ঠিক যেন উল্টানো ডিমের ঝুড়ির মতো। এগুলি সাধারণতঃ লম্বায় ২৫০ মিটার থেকে ১০০০মিটার, এবং চওড়ায় ১২০ মিটার থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ড্রামলিনের দৈর্ঘ্য প্রস্থের অনুপাত ১.৭ থেকে ৪.১ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই অনুপাত থেকেই বোঝা যায় হিমবাহের গতিবেগ কত ছিলো। দীর্ঘ ড্রামলিন নির্দেশ করে ধীরগতির হিমবাহের কার্যকারিতা। হিমবাহের গতিবেগ বেশী থাকলে ড্রামলিনের আকার ছোট হয়।ড্রামলিনের উচ্চতা সাধারণতঃ ৫ মিটার থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত হয়। এখানে ড্রামলিনগুলো সেই উচ্চতাই Achive করেছে। অনেকগুলো ড্রামলিন Basket of eggs topography তৈরী করে।পৃথিবীর মধ্যে উইসকনসিনে সবচেয়ে বড় Basket of eggs topography দেখা যায়, আমরা দেখলাম থার্বো থেকে গোলপাহাড়ে।
থার্বোতে একটা নার্সারী আছে। সানি-রা সেখান থেকে একটা রডোডেনড্রনের চারা নিয়ে ইউনিভার্সিটির বোট্যানিক্যাল গার্ডেনে লাগিয়ে দিয়েছিলো। এখনো বেঁচে আছে, ফুল ফুটিয়েছে।থার্বো হায়ার সেকেন্ডারী স্কুলের কাছেই পাহাড়ে ধাপ কেটে কেটে সিঁড়ি তৈরী করে সেই সিঁড়ির দু'ধারে বাঁশের সুন্দর রেলিং করে দেওয়া হয়েছে। থার্বোর পর এলো Okayti Tea Estate. এখানে স্মিতহাস্য বুদ্ধিষ্ট লামাদের দর্শণ মিললো। এখানেই গোলপাহাড় ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়গুলো অর্ধবৃত্তাকার হয়ে নেমে এসেছে। সম্পূর্ণটাই চা বাগান। কি সুন্দর সব রিসোর্ট এখানে, হোম স্টে-ও আছে, পর্যটকের ভিড় রয়েছে এখানে। গোলপাহাড় ভিউ পয়েন্ট থেকে প্রতিটি ড্রামলিন খুব সুন্দর ভাবে লক্ষ্য করা যায়। গোলপাহাড় ভিউ পয়েন্ট দেখে ভীষণ উত্তেজিত আমরা। এমন ভূমিরূপ এই প্রথম দেখলাম আমি।সবুজে সবুজ, যেন মনে হচ্ছে চারদিকে সবুজের ফাগ ছড়ানো, এখানে শীতের জীর্ণ জরার ছদ্মরূপ নেই, পাতায় ঘাসে নেই পান্ডুরতা, এই উচ্চতায় পর্ণমোচীর দেখা মেলে না। প্রকৃতির সাজ বদল হয় এখানে। নেই সাজ খসানোর খেলা, প্রকৃতির সকল ভূষণ উন্মীলিত যেন। চা গাছ ছাড়া ফার্ণের দেখা মেলে প্রচুর। টেরিস বাইঅরিটা ফার্ণের ছড়াছড়ি। একজন Traditional knowledge holder-এর কাছ থেকে শুনলাম এর পাতা ক্ষত নিরাময়ের কাজে লাগে। আমরা এখানে আজ অফিসের কাজেই এসেছি, কিন্তু ব্যায়ভার সম্পূর্ণ নিজের। "চাকরিটা নিয়ে এখন আর ভাবছিনা -"বাজছে, এরপর অঞ্জন দত্তের সেই গানটির প্রেক্ষিতে গৌতম কুমার ঘোষের গাওয়া "বেলা বোস তুমি সুখেই আছো ... "চোখ বন্ধ করে খানিক শুনছি। এলো সি-ইওক-ফটক। সি ইওক ফটক ছোট্ট একটি জনপদ। এখানে "টি প্রোমোটার সিইওক অর্গ্যানিক টি" আছে।
এখানেও বৃন্দাবন লজ!!!অলিন্দে তারে সারি সারি ঝুলছে লাল সবুজ প্লাস্টিকের টবে রঙবেরঙের বাহারি ফুল। এলো এস.এস.বি ক্যাম্প ছাবিশে। এখান থেকে নেপালের পশুপতি আট কিলোমিটার মাত্র। এ জায়গার নাম চ্যামঙ্ টি এস্টেট। এরপর পশুপতি ফটক পেরিয়ে এলাম সীমানা।সীমানা থেকে নেপাল দেখা যায়। সীমানা থেকে যে পথে সোজা চলেছি সে পথেই সুখিয়াপোখরি, এখনো ৩ কিলোমিটার দূরে। সীমানার পর বাঁ-দিকে যে রাস্তাটি গেলো, সেটি জোড়পোখরি যাবার রাস্তা। সোজা চলেছি, প্রাচীন দৈত্যাকার ক্রিপ্টোমেরিয়া, যাকে আমরা ধুপিগাছ বলি, ডাইনে গভীর খাদ থেকে উঠে গেছে আকাশমুখী হয়ে।রহস্যে মোড়া নির্জন স্থান পার হচ্ছি।
যখন বি.এড. করছি তখন দেশে বুদ্ধদেব গুহ-র "অবরোহী" নামক ধারাবাহিক উপন্যাসে পড়েছিলাম,"নির্জনতা মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে, তার জীবনের গতিপথের আঁক-বাঁক, তার নানাবিধ মূল্যবোধের অল্কা পল্কা রকমগুলি সম্পর্কে অবহিত করে..."এখানে না এলে বুঝি একথার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারতাম না।
আমার দৃষ্টি চলেছে পর্যটন পথরেখা ধরে,
অরণ্যছায়ায়, পাখপাখালির খোঁজে, পত্রমর্মরে
স্তব্ধতা খেলা করে মেঘ রোদ নিয়ে।
সম্মোহিত আমি,
যাই স্বপ্ন উড়িয়ে।
ধুলোময় শিকড়ে অলিখিত গল্পরা নীরব,
পথশ্রমে জানা হয়ে ওঠে না যে সব।
কুয়াশাচুম্বিত চোখ,
তবু দৃষ্টিপাত অপলক, ফিরতে হয়ে যাবে রাত।
(তাই)চোখ মেলে দেখে নেওয়া দিনের আলোয়,
কি কথা লিখেছে পথ গাছের পাতায় ...
সুখিয়াপোখরি বাজার।প্রত্যেকটি পার্বত্য বাজার একই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ঘিঞ্জি এলাকা। বাড়িগুলি যেন একটি আর একটির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বসতি। মেঘগুলো যখন দুই পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, তখন প্রতি মুহুর্তেই ভাবছি, এই বুঝি তারা বাড়িগুলির খোলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে যাবে। সুখিয়াপোখরি ও জোড়পোখরিতে Himalayan newt বা জলের গোসাপ দেখা যায়। এরা বিপন্ন প্রজাতি।
সুখিয়াপোখরি থেকে মানেভঞ্জনের পথে "U"টার্ণ নিলো গাড়ি। সুখিয়াপোখরি থেকে মানেভঞ্জনের দূরত্ব সাত কিলোমিটার, এই সাত কিলোমিটার রাস্তা ভীষণ বৈচিত্র্যহীন। জনবসতিহীন, ভাঙা রাস্তা, ধুলোমলিন গাছপালা, চড়াই উৎরাই বা তীক্ষ্ণ বাঁক নেই এ পথে। জনবসতিহীন বলেই বোধ হয় ভোট নেই, তাই রাস্তাও নেই। সমগ্র যাত্রাপথে একঢালা এই অংশটিই সবচেয়ে ক্লান্তিকর ও একঘেঁয়ে। আরিটার যেতেও বেশ খানিকটা রাস্তা এরকম ক্লান্তিকর বৈচিত্র্যহীন। এইসময়ে বিপরীত দিক থেকে সাকুল্যে দুটো মাত্র যাত্রীবাহী গাড়ি আমাদের অতিক্রম করলো।সুখিয়াপোখরি থেকে মানেভঞ্জনের দিকে যে রাস্তায় চলেছি সেটা "তোদে" যাবার রাস্তার কথা মনে করিয়ে দিলো। আকাশ মেঘলা হলেও মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে রোদের ঝলক।বেলা ২:৩৫, পৌঁছলাম মানেভঞ্জন, উচ্চতা ২১২৮ মিটার। এখানে আকাশ জুড়ে যেমন ভীষণ কালো মেঘ, তেমনই ভীষণ ঠান্ডা। এখন তো পুরো মেঘের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি,চালকের দিকে গাড়ির কাঁচ সামান্য খোলা, মারাত্মক ঠান্ডা। এটা টংলু রেঞ্জ। মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু মাত্র ৩১ কিলোমিটার। বাঁ-দিকের রাস্তাটিই সান্দাকফু যাবার রাস্তা। ফরেস্ট চেক পোস্ট। ডানদিকে নীচের রাস্তাটা ধরে চললাম। ধোতরে এখান থেকে ১৯ কিলোমিটার। এই রাস্তায় ভারী যান চলাচল নিষেধ। ধ্বসপ্রবণ এলাকা।কেমন গা ছমছমে ভুতুরে পরিবেশ, আবার কিছু দূর এসে মায়াবী আলোয় যেন এটা যাদুকর ম্যানড্রেকের দেশে পরিণত হয়ে গেলো। কি বিশাল উচ্চ শৈলখন্ড, বড় বড় Rocks. কেরালার Rocks এর সাথে এগুলোর সাদৃশ্য আছে। স্তব্ধ গুরুগম্ভীর এই সাত কিলোমিটার পথে এই প্রথম একটা বনভূমি পেলাম। পাইনগাছ আছে এখানে। পাইনগাছের দেখা তো সহজে মেলে না। ক্রিপ্টোমেরিয়ার ডালের ওপর দিয়ে ঝুলছে গাঁদাফুল।
মানেভঞ্জন থেকে ধোতরের রাস্তা খুবই ভালো। আকাশ এখানে একটু আলোময়। এখান থেকে লোধোমা ৩২ কিলোমিটার। সান্দাকফু যেতে মেঘমা, ধোতরে যেতে লোধোমা, নামগুলো কি সুন্দর! বিশাল এক ক্রিপ্টোমেরিয়া উপড়ে পড়ে আছে। এই গাছের কাঠই ধুপিকাঠ। এই কাঠ সহজে পচে না, ঘুণেও ধরে না।পাহাড়ি অঞ্চলের অনেক বাড়িতে টিনের চালের পরিবর্তে এই ধুপিকাঠের ছাউনি দেওয়া হয়। একটার পর একটা জাহাজী প্যাটার্ণে সাজিয়ে কাঠের দেওয়াল গড়ে তোলা হয়। সিলিংও তৈরি হয়। ধুপিকাঠ দিয়ে সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট তৈরি হয়,রেস্টুরেন্ট অলঙ্করণ করা হয়। তিন কিলোমিটার আসার পর ধোতরে যখন আর ১৪ কিলোমিটার দূরে,তখন দেখলাম রাস্তার দু'পাশে এক ধরণের ছোট বাঁশগাছ যা সনাক্তকরণ সম্ভব হয় নি, সাথে আর এক ধরণের বাঁশগাছ, যার নাম Arundinaria faberi. এই বাঁশ দিয়ে মাছ ধরার ছিপ তৈরী হয়। প্রত্যেকটি বাঁশের মাথা ভাঙা, অর্থাৎ কচি অগ্রভাগ রেড পান্ডা খেয়ে নিয়েছে। বৃক্ষবাসী লাজুক রেড পান্ডা পূর্ব হিমালয়ের বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের একটি বিপন্ন প্রজাতি। সিংগালিলা জাতীয় উদ্যান রেড পান্ডা সংরক্ষিত এলাকা। এরা প্রধাণতঃ তৃণভোজী হলেও শুনেছি পাখির ডিমও খায়। রেড পান্ডার Re-introduction (জন্মাচ্ছে চিড়িয়াখানায়,ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বনে)-এর ওপরে "Cherub of the mist" নামক একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন রাজেশ বেদী ও নরেশ বেদী, যেটা Best Conservation & Environmental Film"-এই পুরস্কারটি জেতে, ২৯তম International Wild Life Film Festival - মন্টানাতে
গাড়ি এখন ৩০ কিলোমিটার বেগে চলছে। বাঁকবহুল পাহাড়ি রাস্তায় এর চেয়ে বেশী স্পীড ওঠানো সম্ভব নয়। একটা পাখি কোথাও ডাকছে না, একটা ঝিঁঝি পোকার ডাকও শোনা যাচ্ছে না। প্রচন্ড ঠান্ডায় সব প্রাণীই সম্ভবতঃ নীচে চলে গেছে। এই উচ্চতায় শুধুমাত্র উদ্ভিদ আর উদ্ভিদ, যাকে বলে উদ্ভিদের একছত্র রাজত্ব। এখানে হেমন্তিকার পরণে মেঘরঙ শাড়ি, যার পাড় ও আঁচল ঘন সবুজ। এখান থেকে বাঁশবোটে ২৬ কিলোমিটার। মার্টিন ব্রীজ পার হলাম। এরপর সোজা ধোতরে বনবস্তি। পৌঁছলাম বিকেল ৩ :২৪ এ।
সিংগালিলায় বৃষ্টিপাতও যথেষ্ট বেশী। বছরে মোট বৃষ্টিপাত ২৮৭৬ মিলিমিটার।সবচেয়ে বেশী বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে, প্রায় ৮০০ মিলিমিটার। পাহাড়ের গা থেকে ঝুলছে ফার্ণ, গাঁদাফুলের সমারোহ যত্রতত্র। সমতলে না ফুটলেও এখানে ফুটেছে।
ধোতরে পূর্ব হিমালয়ের সিংগালিলা শৈলশিরায় অবস্থিত। ধোতরের বনভূমির তিনটি Eco-region যেমন : Eastern Himalayan sub alpine conifer forest, Eastern Himalayan broad leaf forest,Himalayan sub-tropical pine forest. এই বনভূমিতে রয়েছে Thick bamboo, ওক, ম্যাগনোলিয়া, রডোডেনড্রন, ছোটগাছ, লতাগুল্ম, প্রিমুলা, জেরেনিয়াম, স্যাক্সিফ্রাগা, বিসটর্ট, সেনেসিও, কটোনিস্টার, অর্কিড, অ্যারিসিমা(হিমালয়ান কোবরা লিলি), অ্যাকোনিটাম, গলথেরিয়া ইত্যাদি। এ অরণ্যে প্রাণীদের মধ্যে রেড পান্ডা বিপন্ন প্রাণী। সংখ্যা মাত্র ৪২, চিতাবাঘের কবলে পড়ে শেষ। ট্রেকিং রুটে সবচেয়ে ভয় হলো ভালুকের ভয়। হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার খুব সাংঘাতিক। বার্কিং ডিয়ার যেমন আছে, তেমনি আছে চিতা। প্রায় ১২০ প্রজাতির পাখি আছে, এর মধ্যে হিমালয়ান ভালচার বিখ্যাত। এককথায় এ অরণ্যের জীববৈচিত্র্য অসাধারণ। মানুষের অদম্য ইচ্ছা মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় তা "Singalila in the Himalaya"-নামক চলচ্চিত্রটি দেখলে বোঝা যায়। George Thengummoottil - এর পরিচালনায় ২০১৬ সালে এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। এর কাহিনী হলো : কর্ণিয়া ক্রমাগত পাতলা হয়ে যায়, ঝাপসা দৃষ্টি, উচ্চ আলোক সংবেদনশীলতা -এই রোগের নাম Keratoconus. এই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত এক যুবক সিংগালিলায় ট্রেকিংএ বেরিয়ে পড়ে এবং ১৪ দিনের যাত্রাপথে সে উপলব্ধি করে এখানকার সবুজ সৌন্দর্য হলো এই রোগের সেরা ওষুধ।ধোতরেতে আগে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রোপওয়ে ছিলো, যার মাধ্যমে বনবিভাগের Timber log সংগ্রহ করা হতো।
ধোতরের প্রবেশপথে স্বাগত জানালো "Dhotray Medicinal Plant Conservation Area"-এর প্রধান ফটক। সবুজ লাল সাইনবোর্ডে লেখা আছে "Directorate Of Forest Office Of The Range Officer, Dhotray Range." চোখে পড়লো মাইলস্টোন যাতে লেখা Dhotray 0km. আমরা এখন ২৫৯০ মিটার বা ৮৫০০ ফিট উচ্চতায়। দার্জিলিংএর চেয়ে ৫৪৮ মিটার বা ১৮০০ ফিট বেশী উচ্চতায় অবস্থান করছি।এইদিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্ব নিম্ন তাপমাত্রা -১১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। স্থানীয় একজন নেপালী ব্রাহ্মণ যিনি পেশায় পুরোহিত, উনি জানালেন রাতে এমন বরফ পড়ে যে সকালে রাস্তা পিছল হয়ে যায়। বছরের শীতলতম মাস জানুয়ারীতে ধোতরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা -৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আমি তো ভাবতেই পারছি না। পাহাড়ের গা বেয়ে রেড অ্যালগি যেন লালচে কমলা রঙ গালিচা মেলে দিয়েছে।হলুদ সাদা ডেইজি ফুলগুলি শৈত্যপ্রবাহে অস্থির হয়ে মাথা দোলাচ্ছে। একটি ছোট তিনচূড়াবিশিষ্ট বুদ্ধমন্দির (মনাস্ট্রী) রঙবেরঙের ধর্মীয় পতাকা লাঞ্ছিত। গাড়িটিকে শেরপা লজের সামনে দাঁড় করিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে উপরে উঠলাম। ঠান্ডায় হাত জমে যেতে লাগলো। সেখান থেকে ধোতরের অপরূপ সৌন্দর্য, ক্রিপ্টোমেরিয়ার জঙ্গলের অসাধারণ দৃশ্য দেখলাম। এই সময়েও হঠাৎ মেঘ কেটে সূর্য উঁকি দিলো। সমান্তরাল আলোকরশ্মি কুয়াশৃর জাল ভেদ করে সার সার ক্রিপ্টোমেরিয়ায় বাধা পেয়ে মাটিতে পর্যায়ক্রমে আলো ছায়ার কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে যেন। এভাবেই বুঝি "রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে ..." ভূমিসংলগ্ন ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়ের মাথা সে আলোয় ঝলমল করছে। যে পাথুরে রাস্তা ধরে আমরা হেঁটে চলেছি সেই পথ ধরে ৬ কিলোমিটার চড়াই ভাঙলে সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে টুমলিং পৌঁছনো যায়। এটাই ট্রেকিং রুট। এই পথেই কিছুদূর হেঁটে আমরা একজনের কাছে পৌঁছবো। ১/২ কিলোমিটার হাঁটার পর একটি সমতল জায়গায় এলাম যা খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হয়। তার পাশেই একটু উচ্চে ধোতরে ফরেস্ট ভিলেজ প্রাইমারী স্কুল। এটি ১৯৭৫ সালে স্থাপিত হয়। যেহেতু এখানে বসতি কম, তাই ছাত্রসংখ্যাও ন্যূনতম। দার্জিলিং থেকে একজন শিক্ষক আসেন প্রতিদিন। স্থানীয় শিক্ষকও আছেন। এই স্থান ভেষজ উদ্ভিদে পরিপূর্ণ। স্থানীয় মানুষেরাও ভেষজের ব্যবহার জানেন। বেলা ফুরিয়ে আসছে, পা চালিয়ে চললাম ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। চলার পথে দেখলাম পাহাড়ের ঢালে ধাপ কেটে ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মূলো, রাইশাক, আলু ও মটরশুঁটির চাষ হয়েছে। রাস্তায় তিনমাথার মোড়ে সিংগালিলার বিভিন্ন ট্রেকিং রুটের মানচিত্র রয়েছে। ছোট্ট পরিসরে অনেকগুলি হোম স্টে ও ট্যুরিস্ট লজ রয়েছে। সেগুলির খুব সুন্দর নাম যেমন : অর্কিড ডেল হোম স্টে, পদ্ম হোম স্টে।মোমোর দোকানে কোলকাতা থেকে আগত পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়, ধোতরেকে কেন্দ্র করে সেখান থেকে এরা যাবে শ্রীখোলা, রিম্বিক, রাম্মাম, গোর্খে, টুমলিং বা মল্লি। চাইলে এখান থেকে খুব সহজেই সান্দাকফু ও ফালুটও ঘুরে আসা যায়। তবে শীতকাল, তুষারপাতের কারণে Off season. চলে এলাম একটি মন্দিরের সামনে। সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। মন্দির দর্শণ করে তৎসংলগ্ন স্থানীয় তিব্বতীয় বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রী "Kagyu sect" -এর প্রার্থনা চক্র ঘোরালাম।
সংসারের ঘেরাটোপে সততই বিনা প্রতিরোধে চলে নিজস্বতার অবদমন ... তাই এমনই এক প্রাকৃতিক বাতাবরণে বড়ো ইচ্ছে করে শুনতে শান্ত সমাহিত কোন অন্তরের আহ্বান ... জীবনটা যদি হতো নিজস্ব খাতে বয়ে চলা নদীর মতো ... সৃষ্টি হতো ছলাৎ ছলাৎ শব্দের অনুরণন .. . কঠিন কোমল শিলাস্তরে ভেঙে ভেঙে গড়ে উঠতো প্রাকৃতিক সোপান ...যেখানে দু 'দন্ড বিশ্রাম নিত মন!!!
মনাস্ট্রীর ঠিক পাশেই ভেষজ উদ্ভিদের সংরক্ষিত এলাকাটি। নাম না জানা অসংখ্য উদ্ভিদের সাথে অ্যারিসিমা, বন্য স্ট্রবেরী, বারবেরিজ, রুবাস এবং Polygonaceae,Rhamnaceae Family-র গাছ রয়েছে। এর মাঝখান দিয়ে একটা পাথুরে রাস্তা উপরে উঠে গিয়েছে। চারপাশ ঘিরে এখানে পাইনগাছ থাকায় রাস্তাটি পাইনের ঝরে যাওয়া নিডিলএ খয়েরি হয়ে রয়েছে। এরপর ভিউ পয়েন্ট। মেঘের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা না গেলেও পশ্চিমাকাশে নীলচে ধূসর পর্বতরাজির মাথায় কমলা সাদা হলদে কালো মেঘের আনাগোনা। কখনো মেঘ সরে গিয়ে নীল আকাশ এবং অস্তমিত সূর্যের লাল রশ্মি সব মিলিয়ে যেন চিত্রকরের ক্যানভাস। সবুজ ঘিয়ে রঙের ভিউ পয়েন্টটি চারদিক থেকে স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে ঢাকা। এখানে ঢুকে ঠান্ডা বাতাসের হাত থেকে কিছুটা রেহাই পেলাম। এখানে আমরা গরম চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখলাম। বাইরে প্রবল বাতাসে পাইনগাছগুলো এমনভাবে নড়ছে যেন মনে হচ্ছে সুন্দরভাবে আঁচড়ানো চুল কে যেন এলোমেলো করে দিচ্ছে। অসংখ্য পাইন কোন (পাইনের ফুল) শাখা-প্রশাখায় ফুটে রয়েছে। পাইনগাছের Male cone -এর পরাগ হাওয়ায় উড়লে হলুদ মেঘের মতো দেখায়। একে সালফার বৃষ্টি বা Shower of sulfur বলে। এই সালফার বৃষ্টির দৃশ্য দেখতে হলে বসন্তকালে অর্থাৎ মার্চ এপ্রিলে আসতে হবে এখানে। আমরা সেটা দেখিনি ঠিকই কিন্তু সূর্যের লাল রশ্মি যে পাইনের সবুজ খয়েরি নিডিলে পড়ে কি যে মায়াবী দৃশ্য সৃষ্টি করেছিলো, সেটা দেখেছি। পাইনগাছের নীচে ছোট ছোট রডোডেনড্রন গাছ। এরা উচ্চতায় খুব বেশী হলে প্রায় ৬ ফিট হবে। দূরে উপত্যকায় ম্যাগনোলিয়ার মহীরুহ। এরা সবাই বসন্তে সেজে উঠবে। এখন যেন তারই প্রস্তুতি চলছে। এরপর ফিরে আসার পালা। গাড়িতে উঠে ঘড়ি দেখলাম, ঠিক পাঁচটা। গাড়ির কাঁচ ঘোলাটে হয়ে ঘষা কাঁচ যেন। ফেরার সময় সকলেই অবসন্ন। দূরের পাহাড়গুলি সেজে উঠেছে আলোকমালায়। ক্রিপটোমেরিয়ার জঙ্গল রাতের বেলায় যথেষ্টই রহস্যজনক।
"संसार की हर शय का इतना ही फ़साना है
एक धुंध से आना है एक धुंध मे जाना है
ये राह कहा से है ये राह कहा तक है
ये राज़ कोई राही समझा है ना जाना है
एक पल की पलक पर है ठहरी हुयी ये दुनिया
एक पल के झपकने तक हर खेल सुहाना है
क्या जाने कोई किस पल किस मोड़ पर क्या बीते
इस राह मे ई राही हर मोड़ बहाना है ..."
অন্ধকার ভেদ করে দৃষ্টি আর চলে না। চোখ বুজে এলো।গা এলিয়ে দিলাম। হয় তো ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। ৩১০ কিলোমিটারের সমগ্র যাত্রাপথ পেরিয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফিরলাম।
পালানোর পাঁচকথা
মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত
(দেওরিয়া তাল পর্ব)
ঘোর ভাবনায় পড়ে গেলাম। এদিকে প্রথম। বাস আর যাবে না। যাবে না, মানে যেতে পারবে না। বাঁদিকে নীচে থই থই জল নিয়ে দ্রুত নামছে অলকানন্দা। পর পর দাঁড়িয়ে বাস জিপ লরি। এত পথ ট্রেন জার্নির পর ভোর থেকে বাসে। গন্তব্য ঢের বাকি। কন্ডাক্টর ভাড়ার অংশ ফেরত দিলেন। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। অচেনা জায়গা। তারপর ছাত্রবেলার ছাত্র অশোককে ট্রেকিং-এ টেনে এনেছি।
অমৃতসর মেল রাত বারোটা নাগাদ লাকসর জংশনে নামিয়ে দিয়েছে। লাইন পেরিয়ে খাবার হোটেলে রুটি-সবজির স্বাদু ডিনার সেরে স্টেশনে ফিরে ঢুলে ঢুলে সময়টুকু পার করেছি। ভোর চারটেয় ট্রেন আসবে। হরিদ্বার যাব। থামা নেই। ভোরের বাস পাকড়ে নিলে সুবিধে। একটা দিন অকারণ ফালতু না-যায়, সে জন্য এই রুটে এমন অনেকবার করেছি। ট্রেন লেটালে অবশ্যি খানটুক এলোমেলো হয়ে যায় তাবৎ প্ল্যান। তবু এগিয়ে যাওয়া যায় কিছুটা হলেও।
পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ছোট যাত্রা শেষে হরিদ্বারে সিধে উখিমঠের বাস মিলল। চাকা গড়াতে কী খুশি! বিকেলতক পৌঁছে গেলে ঠাঁই খুঁজে পেতে পরেশান হবে না। চিনি না কিছু। ডায়েরিতে ক'টি তথ্যই প্রদর্শক।
আঁকন-বাঁকন শৈলমার্গের দু'পাশে রম্য প্রকৃতিতে মুগ্ধ। নির্বাক অবাক হয়ে চেয়ে আছি হিমালয়ের বৈচিত্র্যময় দৃশ্যের দিকে। দেবপ্রয়াগ গাড়ি থেকে দেখেই কেমন হচ্ছে ভিতরে। বইয়ের পৃষ্ঠার বন্দিত্ব ঘুচিয়ে চোখের সামনে সত্যি সত্যি পেয়ে যে পুলক, সে অ-লেখ্য, অবচনীয়।
পৌড়ী গঢ়ওয়াল জেলা পেরিয়ে রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় ঢুকে পড়েছি কি পড়িনি, না বলে-কয়ে থেমে গেল চলমান যানটা। সামনে প্রকাণ্ড ধ্বস। শ্রীনগর আর রুদ্রপ্রয়াগের মাঝে রাস্তা হারিয়েছে নুড়িবালির তলায়। কী হবে! ভরসা দিলেন সহযাত্রীরা। কাঁদো-কাঁদো হয়ে যখন জানাচ্ছি উখিমঠ যাব, বললেন, পুল পেরিয়ে তিন-চার কিমি হেঁটে ফের পুল পেরোলেই হল। ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে থাকলে গ্রামপথে চিনতে অসুবিধে হবে না।
ট্রেকিংটা শুরু হয়ে গেল বিশ্রামের ফাঁক না-দিয়ে। কত লোক বউ-বালবাচ্ছা সমেত পদব্রজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদের হাঁটা অন্যরকম। পটুত্ব আছে। আমরা আনাড়ি। তায় দু'রাত নিম-জাগার তরে চোখমুখ পাঁশুটে মেরে আছে।
সরু পুলে পা রেখে ভাল লাগল। গভীর খাদ বেয়ে আলোড়ন তুলে চলেছে অলকানন্দা। পাক খাচ্ছে জলরাশি। বাঁকের মুখে উপলবাঁধায় দুগ্ধফেননিভ অজস্র বুদবুদ উৎপন্ন হওয়া-মাত্র হারিয়ে যাচ্ছে। নদী টপকে এপারের মাটিতে পা রেখে দাঁড়াতে শোনা গেল ভয়-জাগানো আওয়াজ। ঠাস ঠোস খটাস। দেওয়ালির রাত যেন। পটকা ফাটছে।
নিরাপদ তফাতে দাঁড়িয়ে ধ্বস দেখছি। তখনও অনেক উঁচু থেকে গড়াচ্ছে স্বস্থানচ্যুত ছোট-বড় পাথর। একটার গায়ে আর একটা পড়তেই অমন শব্দ। ভেঙে টুকরো হয়ে লুটিয়ে পড়ছে নদীর উপর। দুর্বার স্রোত সে-সব ঠেলে কোথায় পাঠাচ্ছে কে জানে! পরে অন্যত্র অনেক ল্যান্ডস্লাইড পেয়েছি, এমন সশব্দ কোথাও দেখিনি। কানাঘুঁষো, তিনজন নাকি তার নীচে.....।
গুজব হলেই ভাল।
আদেখলাপনা লম্বা করা গেল না। লোকজন পাতলা হয়ে আসছে। ফাঁক নেই যদিও। পরের গাড়িগুলোও তো থমকে যাবে। অর্থাৎ বাধ্য ট্রেকার হতে হবে সক্কলকে।
চিড়বিড়ে রোদ্দুরে গাছপালার ফাঁকফোঁকর গলে, সরুর চেয়ে সরু পা-পথ মাড়িয়ে এগোই দু'জনে। সহপথিকের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে সান্ত্বনা-আশ্বাস পেতে পেতে হাঁটা। সবজিখেত, হ্যামলেট পড়লে ভাল লাগছে। ছোট্ট বাড়ির উঠোনে গৃহবাসীর চোখে কৌতূহল। বোঁচকা-পিঠে কোঁচকানো চেহারার দিকে যেন বেশি করে চাইছে তারা। ট্রেকিং? দ্যাখ কেমন লাগে!
উঠছি নামছি হাঁটছি। অলকানন্দা দৃশ্যমতি নয় আর। ডানদিকে কিছু এগোলে নীচে নীচে এবং নীচে সে। জল ছুঁয়ে শিলীভূত পাহাড় হঠাৎ নদীগর্ভ থেকে মাথা উজিয়েছে। ওপারে গাড়ি থেকে এমনই লাগে।
বিশ্রাম-টিশ্রাম ভুলেছি। সবার সঙ্গে তাল রেখে ছুটতে হবে। কেননা, আবার পুল পেরিয়ে গাড়ি মিলবে কি না, এই ট্রেইলে একলা হলেই ক্যাবলা, বাড়তি হয়রানি এবং সন্ধ্যের আগে উখিমঠ পৌঁছনো। অতএব ছোটো।
এক ভদ্রলোক অশোকের গা ঘেঁষে খুব গুজগুজ করছেন। মাঝেমধ্যেই। উনি বুঝেছেন, অশোক রসিক। তাঁর কাছে আংরেজি রস আছে। থোড়া পি লো। নারাজ হওয়ার পরও ঘ্যানঘ্যানাচ্ছেন। এ-সব ক্ষেত্রে সঙ্গী পেতে নাকি উদার হয় মানুষ। হতে পারে। মিথ্যেও হতে পারে।
নালা পড়তে জুতো-মোজা খোলো, প্যান্ট গোটাও। কোথার থেকে নেমে আসা ধারায় তেষ্টা মিটল। ঠান্ডা নুড়ির উপর পা রাখলে অন্য অনুভূতি হয়। জলতরঙ্গ কথা বলে এখানে। অলকানন্দার গায়ে লুটোতে চলেছে সে।
যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে এই অ-নির্ধারিত ট্রেকে। না-থেমে এগোবার জন্য এগোনো শরীর-মনে চাপ রাখছে। তবু তাজা থাকার তরে ইতিউতি তাকাই। গাছ-পাখি-ফুলকে গুরুত্ব দিই। তিন-চার কিমি শুনেছিলাম। শেষ হয়নি?
আর এক চওড়া নালা পার করে দৌড় চলল। ঘণ্টা তিনেক পর লোহার সাঁকো নজরে এল। গাছগাছালির ফাঁকে ওপারে মানুষজনের আভাস পেতে শান্তি। আট কিমির কম নয়। সামনে কি খাবার দোকান? খিদে খিদেকেই খেয়ে নিয়েছি ইতিমধ্যে।
কাছিয়ে দেখি, ক'জন খাওয়া সেরে উঠছেন। ফাঁকা ভাতের থালা ছেড়ে। ভাত-ডাল-সবজি তিরিশ টাকা। —আগে দুই প্লেট দাও বাপু। প্রকাণ্ড ডেকচি চেঁছে কুলিয়ে গেল। সবজি ফিনিশ, ডালের তলানি সাফাইয়ের জন্য তৈরি। ও-ই দাও বন্ধু।
গোল গোল ভাত, বিচ্ছিরি ডালের ঝোল, লঙ্কা, পিঁয়াজ। দলা পাকিয়ে গলা দিয়ে দিলাম ঠুসে। পেট-ট্যাঙ্কির আজন্ম খাঁই-দাবি চুকাতে হল এ-ভাবে। দোকানি দাদা হেসে কুড়োনো খাবারের দাম পাঁচ রুপিয়া কম নিলেন।
আশপাশে অনেকগুলো ঘোড়া বাঁধা। ছাউনি। সহিসরা গাল-গল্পে। আবার চাল ফোটানো চলছে। এত! কী হবে? লোকালয় নেই। তাহলে! ঘোড়ার খাবার নাকি! তরকারি লাগে ঘোড়ার? দু'পা পরে এক পাত্রে একজন ঘোড়ি ভাত টোকাচ্ছেন। অশোকের সঙ্গে মুখ তাকাতাকি হল। বেচারা বড় টিপটপ থাকে। শুধু হাসি দিল। ঘোড়েওয়ালারাও খায় হয়তো।
যা-ই খাই, গতরে ঘোড়ার এনার্জি এল। অভিধান-ছাড়া ট্রেকিং সেরে নদীর অন্য পারে এসে জিপ জুটে যেতে কী আনন্দ। যাবে রুদ্রপ্রয়াগ।
কন্ডাক্টর ভাই রুদ্রপ্রয়াগে ডেকে ডেকে তুলছেন উখিমঠের বাসে। স্যাকদু'টো ঠেললেন ডিকিতে। সন্ধ্যের আগে পৌঁছব তো? জরুর। একগাল হাসিসুদ্ধ জবাব।
বাড়ি থেকে যেন দৌড় লাগিয়েছি। বাসের দু'পাশে ছুটন্ত প্রকৃতি মনোরম। যাত্রীর ওঠানামা, গাড়ির থামা-ছোটা দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে পড়ল। কুণ্ড মোড়ে সব্বাই উতরাতে দু'জন পড়ে রইলাম। ঘন উৎকণ্ঠা নিয়ে বাসভাইকে কই, 'নয়া আদমি। ভারত সেবাশ্রমের কাছে নামিয়ে দিয়ো গো।'
বাইরে কালো হয়ে আছে।
সাড়ে সাতটার পর থামল এবং ভূমি-স্থ হয়ে দেখি —না কিছুই দেখি না। দুর্বল বাতি ধরে এগোই। সবাই ঝাঁপ ফেলেছে। একটিই খোলা। নির্জন। ঢুকে পড়ি। মৃদু কথাকথি শুনে দোতলায় উঠলে একজন অপেক্ষা করতে বললেন। ফের উদ্বেগ! না-পেলে বাইরে কোথাও হাতড়ানো যেত।
সুরাহা হল। সংঘ কর্তৃপক্ষ সব শুনে ঠাঁই দিলেন। বিল কাটার সময় বললেন, 'রাতে খাবেন?' তা হলে একই সঙ্গে কুপন নিতে হবে।
না করার প্রশ্ন নেই। ঠাঁই-খাই জুটল দুই-ই। ধন্যবাদিয়ে ঘরে ঢুকে মনে হল, তিনদিন পর স্বাভাবিক হলাম।
ভোর ছ'টাতেই বেরিয়ে পড়েছি। আরটু আলসেমির সাধ ছিল। বিশেষ রাতের খাওয়া চমৎকার হয়েছিল বলে। গায়ে কুয়াশা মেখে কিমিখানেক উজিয়ে বাসস্ট্যান্ডে হাজির হই। পুছতাছ করি, মাস্তুরা কোন গাড়ি যাবে ভাই? দেওরিয়া তাল যাব। চৌখাম্বা শৃঙ্গ দেখব। ওখানে নামলেই হবে তো? সারি গ্রামের কথা শুনে-পড়েছিলাম।
মিলল শেয়ার জিপ।
ভোরের পাহাড় যেন সদ্যোজাত। ফুলেরা পাপড়ি মেলছে, পাখিরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে শাখায় শাখায়, ঝরাপাতারা ভেজা ভেজা, তুলতুলে রোদ্দুর ডাল-পাতা হড়কে ঢের চেষ্টায় পিচপথে আঁকছে আলপনা। গাড়ি চলছে। বাঁক বদলাচ্ছে। ভাবছি, কতক্ষণ আর। মোটে দশ কিমি। এমনই চমৎকার সকাল যে, মনে হচ্ছে জিপ চলে তো চলুক। আরও, আরও, আরও।
থেমে গেল মাস্তুরা। চুপচাপ গ্রামে পাহাড়ের গা-সাপটানো সরু পথ ধরিয়ে দিলেন একজন। হাঁটো আড়াই কিমি খাড়াই পথে। সারি গাঁও পৌঁছে চেষ্টা হবে তালের কাছে রাত কাটানোর ইচ্ছে মিটবে কিনা।
একদম চড়াই চড়া। পাথর ফেলে ধাপ করা। দমফৌত হওয়ার জোগাড়। সহপথিক দু'জন হাসলেন, 'কাঁহা সে?'
—কলকাতা। দেওরিয়া তাল যাব। ঠিক যাচ্ছি তো?
সারি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা-শিক্ষক। তেইশ কিমি দূরের বাড়ি থেকে গাড়ি ধরে মাস্তুরা এসে নিত্যি এমন আড়াই কিমি ভেঙে পৌঁছন স্কুলে।
গল্পে গল্পে স্কুল চত্বর। ছোট ছোট পড়ুয়ারা অপেক্ষায় ছিল। চার-পাঁচ জনের দল ফুলগাছে জল দিচ্ছে। আমাদের সকলে জোড়হাতে নমস্তে জানাল। দু'জন ইতিমধ্যে চার গ্লাস জল এনে সামনে ধরতে কুণ্ঠিত হয়ে পড়লাম। আদরমাখা তৃষ্ণাবারি। একতলা বাড়ির ঘেসো উঠোনে ঝলমলে রোদ্দুরে ছোট্ট টেবিলের সামনে চেয়ারে বসলেন শিক্ষিকা। অবাধ আশ্চর্য প্রকৃতি সবদিকে। সুশৃঙ্খল শিশুদের দেখছি। মাস্টারমহাশয় বসতে বললেন। আমাদের এগোতে হবে। সবিনয়ে বিদায় জানিয়ে গাঁও পানে পা রাখি।
শৈলপল্লির পাথুরে আবাসের গায়ে সবজি, রামদানা।
চা খেতে খেতে এলাকার গাইডের নামে খোঁজ করতে তাঁর দেখা মিলল না। এগিয়ে এলেন সহায়ক একজন। দেওরিয়া তালের ধারে দু'জন থাকব। চারজনের তাঁবু ভাড়া কীভাবে....। আমাদের আত্যন্তিক সাধ আর অন্য খ্যামতা সম্যক বুঝে সুভদ্রলোক আশ্বস্ত করলেন। রাতে খাওয়াও জুটবে। তাঁর নাতনি আছে ওখানে। সোচো মত।
বল পেয়ে আরটু এগোই। অন্তরে লুকোনো ইচ্ছেটা বাইরে আনি। —'দাদা, আমরা উপর থেকে উপরে-উপরে বন ফুঁড়ে হেঁটে যেতে চাই চোপতা। পথ নেই। দামড়া দামড়া ভালু-মালু নাকি চরে। কোনও গাইডের যদি ব্যবস্থা করেন.....'
এবারও কোনও ব্যাপার না বোঝালেন। একটি ছেলেকে উনি বলে দেবেন। ও ঘোড়া নিয়ে তালে গেছে। ফিরলে ফের পাঠিয়ে দেবেন কাল সকালে। খুশি হলেন আমাদের প্ল্যান জেনে। ও-পথে বিশেষ কেউ যায় না।
আমরাও খুশি হলাম যেতে পারব বলে।
প্রাপ্য চুকিয়ে অনুরোধ জানাই, 'যদি ডায়েরিতে একটু লিখে দেন, আমরা তো কাউকে চিনি না। কেউ আমাদেরও চেনে না।'
উনি লিখলেন, "পূজা নাতিনি , কৃপয়া শ্রীমানবেন্দ্র দাদাজি কো এক টেন্ট লগা দেনা। ২ ম্যাট্রেস ২শিলিপিঙ্গ ব্যাগ দেনে ভি...."
ব্যাস, পাসপোর্ট পেয়ে গেলাম। চলো, লেটস গো।
ছবি: দেওরিয়া তাল, ধ্বস ও চৌখাম্বা শৃঙ্গ।
গঢ়ওয়াল, উত্তরাখণ্ড। অক্টোবর ২০২২।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন