অণুগল্প

অণুগল্প 

সমগ্র বিষয় তাৎপর্য প্রতিবিম্বিত করাই অনুগল্পের উদ্দেশ্য ও শিল্পরূপের প্রেরণা। অণুগল্প হচ্ছে ছোটগল্পের নবজাতক শিশু। তবে, অণু বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে গিয়ে গল্পের রূপ রস সৌন্দর্যকে লুপ্ত করলে চলবে না। পাঠকের পাঠ তৃপ্তিদায়ক হতে হবে। শব্দ ও স্বাদের ব্যবহার শিল্পের রূপ বহনকারী হতে হবে। সুপ্ত কলা -কৌশল সামান্য কিছু শব্দের মাধ্যমে নিপুণ গাঁথুনি সৃষ্টি করবে। 
এক কথায় বলি...  স্বল্পতে সমুদ্রতল। ( সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত ) - গীতশ্রী সিনহা।

দুটি সম্পর্ক নিয়ে অণুগল্প 



(১) ঝড়

গী ত শ্রী  সি ন হা 


 হৃৎস্পন্দনের ঝংকার তুলে আকাশ তখন উগ্র মূর্তি। বিদ্যুতের ঝলকানি তে টুপুর দৌড়ে এসে আশ্রয় নেয় বাবার বুকে। রূপকবাবু অলীক কল্পনার সুখে টেনে নেন টুপুর-কে। সম্বিত ফেরে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে। টুপুরের জীবনটা ছিল পেন্সিলে আঁকা একটি ছবি - হঠাৎ করে রাবারের স্পর্শে মুছে যায় সব কিছু...  সদ্য সন্তানহারা পিতা ভাবেন, আজ হয়তো-বা টুপুরের বাবা বেঁচে থাকলে এইভাবেই মেয়েকে আশ্রয় দিতেন। স্বর্গীয় শান্তির ঘ্রাণ জড়িয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে... স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন ...  যেন শিশির ঝরা নরম পালক...



(২) সিঁড়ি


বাঃ দারুণ ! একদম অন্যরকম স্বাদ! গোগ্রাসে খেতে থাকেন রাধারানী, যেন গান্ডেপিন্ডে গিলছে লোভার্ত তার দৃষ্টি। ইস্! আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম! 
বউমা... ও বউমা... শুনছো বউমা! তুমি  তু  তুমি খাবে না মা? 
কলঘর থেকে গলা উঁচিয়ে বলে বউমা ---- আমি খেয়েছি মা, ভালো লেগেছে তাই আপনার জন্য অফিস ফেরত নিয়ে এলাম। 

সব টাই আমি খাবো বউমা?  বউমা, রূপ খাবে না ? 

অফিসে আপনার ছেলে রোজ ভালো - মন্দ খায় মা... 

খাবারের স্বাদ যেন আরও তৃপ্তি এনে দিলো !  দুমড়ানো আটপৌরে হতচ্ছাড়া মলিন জীবনে তামাটে সময়ের দাগ লাগতে লাগতে... সময় ঝুঁকে পড়েছিল দাঁত খিঁচানো সিঁড়ির ভাঁজে... স্যাঁতসেঁতে  উচ্ছিষ্ট  চিলেকোঠার গন্ডিতে। আধপাকা অগোছালো জটপাকানো চুলের গোছা, শীর্ণ দেহের পান্ডুলিপি শরীরের আনাচে-কানাচে উঁকি মারছে, জ্বলজ্বলে চোখ - বিষাদের ঠোঁটে  আজ ফাগুনের ছায়া।   
সে-ই দশ বছর আগে মেয়ে দেখতে গিয়ে কিছু অসংলগ্ন কথা বলে ফেলেছিল রাধারানী... 
 পরে বুঝেছিল মেয়েরা কোনো বাজারি প্রোডাক্ট নয়... সব যাচাই করা যায় না। 
তাই আজ শীর্ণ হাত দেয় হাতছানি...





প্রীতমের ঘুম

প্র তী ক  মি ত্র


অসময়ে ঘুম পেতেই থাকে প্রীতমের। সময়ে কখনই ঘুমোতে পারে না।কাজ আর কাজ। রবিবারটা ছুটি। ছুটির দিন একটু যে নিজের জন্য দেবে সেটাও হয়ে ওঠে না।দাড়িটুকু কাটা হয়ে ওঠে না।খ্যাপাটে ভাইটা সারাদিন চিৎকার করে। বুড়ি মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান্নাঘর থেকে ছোটো ছেলের মুখ থেকে গড়ানো জল মোছান।সকালে প্রীতম ছাতু-মুড়ি খেয়েই চলে যায়। কারখানায় লোহা-লক্কড়ের কাজ সামলে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। রাতের খাবারটা প্রীতমই বানায়। ভাইটা খাওয়া নিয়েও নখড়া করে। প্রীতম তারই ফাঁকে পাতকো তলায় যায়। বেশ ক’বালতি মাথায় জল ঢালার সময় ও একটু চোখদুটো বোজে। ওর কিছু কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটার নাম ছিল প্রিয়া সাউ। ওদের বাড়ির ক’টা বাড়ি পরে থাকতো। ওকে প্রীতম বিয়ে করবে বলে যখন বাবার সাথে প্রায় হাতাহাতির সামিল তখনই প্রিয়ার ভাইএর বেপাড়ায় গুন্ডাগিরি করে জেলে যাওয়ার খবর আসে। আর প্রীতমের বাবাকে বেশি বাধা দিতে হয়নি। প্রিয়ার বাড়ির লোকজন সব তল্পিতল্পা গুটিয়ে এ তল্লাট ছেড়ে চলে যায়। বেশ ক’বছর পর ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার পথে প্রিয়াকে দেখেছিল ধ্যাবড়া খানেক কমলা রঙের সিঁদুর সিঁথিতে নিয়ে গোমড়া মুখে হেঁটে যেতে। প্রীতমের ফ্যাক্টরির লাইনে অন্য ফ্যাক্টরিও আছে। হয়তো সেখানেই কাজ করতে যাচ্ছিল। না প্রীতম দেখা করেনি প্রিয়ার সাথে। স্নান শেষ হলে প্রীতমের ঘুম ঘুম পায়। কিন্তু তখনও অনেক কাজ বাকি। ভাবনাগুলো কেন যে আসে? মাএর খোঁটা, ভাইএর অসুস্থতা, ওর নিজের একাকিত্ব...সব নিয়ে প্রীতমের দমটা বন্ধ হয়ে আসে। রবিবারের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সেই রবিবারও ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। প্রীতম সময়ে ঘুমিয়ে উঠতে পারে না।অসময়ে ঘুম আসতেই থাকে।





শেষ বসন্ত

ম ঞ্জু  চ্যা টা র্জি


ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শ্বেত শুভ্র কেশে শীলা হাত বুলোতে বুলোতে ভাবে, মূর্তিমতী ইডিয়ট একটা! দিব্যি রং চঙে জীবন একটা নিজেকে উপহার দিতে পারতো, তখন তো জীবন খোলাই ছিলো তা না করে অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে নিজেই পদার্পন করলো, আয়নার দিকে তাকিয়ে বহু বসন্তের ফেলে আসা ঝরা পাতার জীবন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একটু আনমনা হয় শীলা।
কেউ কি বেল বাজালো সদর দরজায়? আর বাজলেই বা কি, কারো পদধ্বনি শুনলো মনে হয়! সবই ভুল, কতকাল ধরে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনি না। শুধুমাত্র সকালে কমলা এসে ঘরের সব কাজ করে দিয়ে যায়। দুটি সন্তান ছেলে কর্মসূত্রে বিদেশে, মেয়েও দূরে নিজের সংসার সন্তান সামলে  চলছে। ফোনের মাধ্যমে  যোগাযোগ আছে অবশ্যই সে আর কতটুকু সময়।

মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, কলেজ জীবনে অনিমেষের কথা বাড়িতে মুখ ফুটে বলতে পারেনি পারবেই বা কি করে, শীলার কথা না শুনে শুধুই  পার্টি পলিটিক্স, টিউশনি এই নিয়েই পরে রইলো অনিমেষ। বলতো আমাদের ঠিক চলে যাবে এতে কিছু ভেবো না। তাই কি হয়!! রাশভারী বাবার সামনে এসে শীলাকে চেয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহসটুকু যোগাড় করতে না করতেই শীলার বিয়ের সানাই বেজে উঠলো।

বিয়ে টাও কিন্তু খুব সুখের হয় নি শীলার, শ্বশুর বাড়িতে পরিবারের সদস্যরা ও স্বামী কেউই শীলার উপরে সন্তুষ্ট ছিলো না। কেননা একটি ছোট স্কুলে শীলা শিক্ষিকার কাজটি কিছুতেই ছাড়তে পারে নি। বাড়িতে ঢুকলে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে রান্নার গ্যাসের আগুন তাকে লোভ দেখাতো পুড়ে মরবার জন্য।

এসব কথা আমি কেন ভাবছি, কি হবে ভেবে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যে ছটা বাজতে চললো, এই সময়টা শীলা ডাক্তারের নির্দেশে সামান্য একটু পথ হেঁটে নেয়, নিজের ওষুধ দরকার মতো কিনতেও হয় সঙ্গের লাঠিটি কিন্তু নিতে ভোলে না। শরীরের ক্ষয় ক্ষতিটা ঝালিয়েও নেওয়া যায়, এই ভেবেই বেরোনো আর কি নিয়ম করে।

আচ্ছা, আজ কেমন অসমান লাগছে রাস্তাটা, প্রতিটি পদক্ষেপ বড় অচেনা লাগছে মনে হচ্ছে মাথার ওপরের আকাশটা ঝুঁকে নামছে নিচের দিকে, কি করবো বাড়ি ফিরে যাই ভাবতেই হাতের লাঠিটা ছিটকে পড়লো টাল সামলাতে না পেরে টলে উঠলো শরীর টা ঠিক সেই সময়, হাতটা ধরো আমার! হাত ধরে সোজা হয়ে উঠতেই চোখ পড়লো শীলার "সব পথ এসে মিলে গেলো শেষে তোমারই দু'খানি নয়নে নয়নে'। একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে অনিমেষ বলে আমি অনিমেষ চৌধুরী। দুটো হাত সৌজন্যের ঝাঁকুনি খেয়ে ফিরে এলো নিজের নিজের জায়গায়।





পুপুর মা

শ্যা ম ল  কু মা র  মি শ্র


শশাঙ্ক শেখর নাইয়া ওরফে এস এস এন বাংলা সাহিত্যের এক প্রথিতযশা অধ্যাপক। এস এস এন এর ক্লাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে ছাত্রছাত্রীরা। স্যার ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে থাকতে বেশি ভালোবাসেন। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে স্যার ক্লাসে আসেন। একঘন্টা কখন যে পেরিয়ে যায় তা যেন ছেলেমেয়েরা বুঝতেই পারেনা। লোকসাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্য। সেইসঙ্গে সুরেলা গলায় ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, ঝুমুরের সুর যেন গলায় অনায়াসে খেলা করে।

সে দিনটা ছিল শুক্রবার। সকাল থেকেই অঝোরধারায় বৃষ্টি পড়ছে। টিফিনের পরেই এস এস এন স্যারের ক্লাস। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট পেরিয়ে গেলো। স্যার এলেন না। সবাই উসখুস করছে। এমন সময়ে ধীর পায়ে স্যার ঢুকলেন। অন্যদিনের মতো পারিপাট্য নেই। চুলগুলো উস্কোখুস্কো। দেখে মনে হয় একটু আগেই বোধহয় কোন একটা ঝড় বয়ে গেছে। অধীর আগ্রহে সবাই তাকিয়ে আছে।
স্যার ধীরে ধীরে ডায়াসের উপর উঠলেন। আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলেন। দশ মিনিট দেরির জন্য আমি দুঃখিত। আসলে আজ আমি আমার এক খুব কাছের মানুষকে হারালাম। তাকে শেষ যাত্রায় পৌঁছে দিতে আমার একটু দেরী হল। রত্না প্রশ্ন করে-কে তিনি? মানুষটি সম্পর্কে একটু বলুন না স্যার। 
স্যার বলতে শুরু করলেন। সে  এক রূপকথা যেন। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে- সেদিনটাও ছিল এমনি এক বর্ষণমুখর দিন। ভোররাত থেকে উঠে ঘর-গেরস্থালি কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবিতা। পুপুর বাবা আজ নৌকা নিয়ে যাবে গভীর জঙ্গলে। পুপুর বয়স মাত্র পাঁচ বছর। পুপুকে ঘিরে বাবা-মায়ের কত স্বপ্ন। পুপুকে বড় করতে হবে। গভীর রাতে ঘুমন্ত পুপুকে দেখতে দেখতে কত স্বপ্নের জাল বুনে যায় সবিতা। আজ পুপুর বাবা মাতলায় নাও ভাসাবে। এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা দুরু দুরু করে করতে থাকে সবিতার। নাও চলে যাবে অনেকদূরে। দুদিকে ঘন জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে বইছে নদী। ঐ জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ করবে।

কোন কাজে মন নেই আজ সবিতার। সকাল সকাল মাটির হাঁড়িতে চাল জল বসিয়ে দেয় সবু। আদর করে মরদটা এই নামেই ডাকত। পুরনো নানা কথা আজ মনে পড়ে যায় সবিতার। এমন সময় পুপুর বাবা এসে ডাকে---'তোমার কি হইল? আমায় যে এবার যাইতে হইব পুপুর মা। রওশনরা আইল বইল্যা'।
'হাঁ, তুমি আইস। আমি ঠাঁই কইরা দিছি'। 
নিজের হাতে খাবার দেয় সবিতা। কী আর খাবার। ফেনা ভাত, মান কচুর ভাতে আর পাতলা ডাল। 
'চেটেপুটে খাইল পুপুর বাপ। যাওয়ার সময় আদর কইরা কইলো--- কষ্ট পাইও না সবু, আমি যাইব আর আইব'।

'দিন যায় রাত যায়। একদিন রওশনরা ফিরল বটে কিন্তু পুপুর বাবা আর ফিরল না'। বনবিবির স্থানে কত মানত করল কিছুই হলো না। 
রওশনরা জানাল---'মাছ ধরতে ধরতে পুপুর বাবা অনেক দূরে চলে যায়। তারপর আর ফিরে নি'। দিনের আলো তখন পড়ে আসছে, রওশনরা আর জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার সাহস পায়নি। তবে আসার সময় দূরে পুপুর বাবার খালুইটা পড়ে থাকতে দেখেছে। সবিতা সেই থেকে যেন কেমন পাথর হয়ে গিয়েছিল। শুখা চুলে তেল দিত না, চুল ও বাঁধত না। তবে নিয়ম করে সিঁথিতে সিঁদুর দিত আর ভাবতো এই বুঝি এলো পুপুর বাপ।

পুপুর বাবা আর ফেরেনি। শুরু হলো সবিতার নতুন করে বাঁচার লড়াই। ছোট্ট পুপুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত আর বলত---'পুপু সোনা! তুরে অনেক বড় হইতে হইব, অনেক বড়। লিখাপড়া মন দিয়া করিস বাপ'। পাঁচবাড়ি কাজ করে সবিতা সংসার চালাত। রাতে টেমির আলোতে পুপু যতক্ষণ পড়ত ততক্ষণ জেগে বসে থাকতো সবিতা। পুপু বলতো-- 'তুমি শুয়ে পড়ো মা'। মা বলতো--'তা হয় না বাপ। তুকে অনেক বড় হইতে হইব। পুপুর বাপ দেইখা অবাক হইয়া যাইব'।  পুপুর চোখ দুটো আজও জলে ভরে ওঠে।

ধীরে ধীরে পুপু বড় হয়। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে পাস করে। রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হয় পুপু। ভালো রেজাল্টের জন্য ওর সব ফ্রি হয়ে যায়। পুপু মন দিয়ে পড়াশোনা করে। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে গোল্ড মেডেল পায়। মাকে এনে সেই মেডেলটা পরিয়ে দেয় পুপু। মাকে বলে---'এটা তোমার লড়াইয়ের পুরস্কার'। মায়ের দুচোখ জলে ভরে ওঠে। সুমনা বলে ওঠে-- তারপর, তারপর? তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে পুপু আজ কলকাতার একটি কলেজের অধ্যাপক।
সুদীপ্ত বলে ওঠে-- পুপুর মায়ের কি হল? 
পুপুর মা তাঁর গ্রাম, নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আসেনি। পুপু কলকাতায় সংসার পাতে। সপ্তাহ শেষে মায়ের কাছে ফিরত। সবিতাকে আর কাজ করতে হয় না। কিন্তু সকাল সন্ধ্যা সে মাতলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। ভাবে ওই বুঝি পুপুর বাবা এল।

মায়ের জন্য কষ্ট হয় পুপুর। একদিন শীতের রাতে ঘুম ভেঙে দেখে মা নদীর তীরে বসে আছে। দুচোখে জলের ধারা। গায়ের চাদরটা মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে আসে পুপু। 
এবার সবাই প্রশ্ন করে-- সবিতা এখন কোথায়? 
ধীরে ধীরে বলতে থাকেন স্যার। গতকাল রাতে সবিতা মারা গেছে। মাতলার কোলে অন্ত্যেষ্টি করে খানিক আগে ফিরেছে পুপু। ক্লাস একেবারে নীরব। ঘন্টা কখন পড়ে গেছে। কারো কারো চোখ জলে ভরা। শুধু একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে- স্যার পুপুর মায়ের এই বাঁচার লড়াইকে হাজারো কুর্ণিশ। কুর্নিশ পুপুকেও। পুপু মাকে কোনদিন ভোলেনি। ধীরে ধীরে জলভরা চোখে বেরিয়ে যান এস এস এন স্যার।





লিপইয়ার

মো য়া ল্লে ম  না ই য়া
           
    
  -----"দাঁড়ান বাবা, আজ তো আপনার এ বাড়িতে আসার কথা নয়!"
অবাক বিস্ময়ে অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক 'রসময় দত্ত' থমকে দাঁড়ালেন; তারপর অনেক কষ্টে স্পল্ডিলাইটিসে আক্রান্ত ঘাড়টা কোনোক্রমে উপরে তুলে দেখতে পেলেন, দোতলায় কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে  তাঁর ছোট বউ'মা।
----"সারা জীবন তো ভূগোল পড়িয়ে এলেন, অথচ জানেন না ২০১৬'র ফেব্রুয়ারী মাস ২৯'শে হয়!"
----'রসময় দত্ত' কিছু বলতে চান, কিন্তু দুপুরের প্রখর রৌদ্রে এক মাইল হাঁটার ধকলে তাঁর গলা থেকে কেবল শুকনো বাতাস টুকু ছাড়া আর কিছুই বের হলনা।
-----"আজ ২৮'শে ফেব্রুয়ারী এখনো একদিন আপনার বড়ো ছেলের বাড়িতে খাওয়ার কথা। না জেনে আপনার এখানে আসা উচিত হয়নি।"
---- এক সময়ের দোর্দন্ড প্রতাপ, ছাত্র-ছাত্রীদের অতি প্রিয় ভূগোল শিক্ষক 'রসময় দত্ত' ছোট বউমার এই উপর্যোপরি প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না। শুধু একবার নির্বাক করুণ চোখে দোতলার দিকে তাকালেন, তারপর যে পথ দিয়ে এসে ছিলেন সেই পথ ধরে দুপুরের প্রখর সূর্যকে মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলেন। কেবল জানতে পারলেন না ---- তাঁর বাকি জীবনে 'লিপইয়ার'টা কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে।।





মানবিকতার জের

বি কা শ  গুঁ ই


রাত্রি দশটা। সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে বাইপাস ধরে ছুটছে গাড়িটা। গাড়িতে সুমনা আর তার প্রেমিক স্বামী অনিক। একই অফিসে চাকরি করে। বাড়ি ফিরছে ওরা। হঠাৎ দূর থেকে হাত দেখিয়ে গাড়িটার সামনে দু'টো ছেলে হাতজোড় করে দাঁড়ালো…

সরি স্যার! ম্যাডাম! আমার মায়ের অসুখ। সামনেই ডাক্তারখানায় নেমে যাব। কাইন্ডলি যদি একটু লিফ্ট দেন!

আহা, মায়ের অসুখ! সুমনা ভাবল। অনিক রাজি না হলেও, সুমনা বলল, ঠিক আছে। উঠে আসুন।

কিছুদূর যাওয়ার পর ওরা নেমে যেতে চাইল। গাড়ি দাঁড়াতেই- ওদের মধ্যে একজন আচমকা এক হ্যাঁচকায় ড্রাইভারকে টেনে নামিয়ে, লাথি মেরে ফেলে দিল। তারপর একলাফে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেওয়া গাড়ি চালিয়ে দিল। অন্যজন তখন অনিকের মাথায় পিস্তল ধরে বলল, চুপচাপ নেমে যান‌ গাড়ি থেকে। অনিক কয়েক মুহূর্ত ওর চোখে চোখ রেখে পিস্তল সমেত হাত চেপে ধরল। প্রচন্ড ধস্তাধস্তিতে আচমকা গুলি ছিটকে বেরিয়ে অনিকের কপাল ফুঁড়ে দিল। সুমনা অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরতে ‌‌দেখল, বাইপাসের ধারে এক হসপিটালে। অনিকের অপারেশন চলছে … বাইরে অফিসের অনেকেই উৎকন্ঠায়!

বলাইবাহুল্য, সেদিন সুমনাদের ‍ড্রাইভার টহলদারি পুলিশকে খবরটা দেয়। ওদের সহযোগিতায় শেষমেশ অনিক প্রাণে বাঁচলেও একটা ব্রেনলেস চাইল্ডের মতো বেঁচে আছে। শুধু ফ্যালফ্যাল‌ করে চেয়ে‌ থাকে। 

ঘুমের মধ্যে সুমনা শিউরে উঠল। রাত ন'টা বাজলেই সুমনাকে একটা আতঙ্ক তাড়া করে … মেয়েটা তো এখনও ফিরল‌ না! একমাত্র মেয়ে পারমিতা বাবার মতোই জেদি। মা বাবার অফিসেই চাকরি করে।

কলিং বেল বেজে উঠতেই সুমনা ছুট্টে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। পারমিতা মাকে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলে, আমার সোনা মা। জানো তো মা, আজ অফিসে বাবাকে সম্বর্ধনা দিয়েছে।
তাই একটু আসতে দেরি হয়ে গেল। আর একটা কথা রাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলবে বলে- মনে মনে ‌রেখে দিল।

রাতে খেয়ে দেয়ে শুয়ে গল্প করতে করতে মায়ের কানেকানে বলল,- মা, তোমার অর্ণববাবুকে মনে পড়ে?

কে অর্ণব! তোর কলেজের বন্ধু ?

না মা, অফিসের অর্ণব বসু। বাবার জুনিয়র। যাকে বাবা একটা প্রোজেক্টের জন্য ফরেনে পাঠিয়েছিল। সাকসেসফুলি প্রোজেক্ট কমপ্লিট করে সে কাল ফিরেছে। বাবার সম্বর্ধনা সেই তো অর্গানাইজ করেছে।

ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ফরেনে যাবার আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল একবার, তোর বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

আচ্ছা। বাবার কথা, তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। একদিন ওনাকে আসতে বলেছি।

খুব ভালো করেছিস। ছেলেটা খুব ভালো রে! পিতৃমাতৃহীন, মামার কাছে মানুষ। বড় অমায়িক।

হ্যাঁ মা, ও একটা প্রোপোজাল নিয়ে তোমার কাছে আসছে। 

বলিস কি রে! তোর বাবারও খুব ‌স্নেহের পাত্র ছিল। তোর বাবা সুস্থ থাকলে কী যে আনন্দ পেত! দু'চোখ জলে ভরে ওঠে সুমনার।

আমার সোনা মা! মাকে পরম স্নেহে, শ্রদ্ধায় আরও আরও জড়িয়ে ধরে।








মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪