প্রবন্ধ
আমার ভাবনায় প্রাবন্ধিক হাসান আজিজুল হক
গী ত শ্রী সি ন হা
হাসান আজিজুল হকের যাবতীয় খ্যাতির নেপথ্যে অবশ্যই তাঁর গল্পসম্ভার। 'আগুনপাখি' উপন্যাসটিও তাঁর সাহিত্য ক্ষমতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বাড়িয়েছে যথেষ্ট। আপাত-সামান্যা এক গৃহবধূর জবানীতে আটপৌরে চালে এই উপমহাদেশীয় ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক কালখণ্ডকে মূলে-স্থূলে পাওয়ার সৌভাগ্য এযাবৎ বিশেষ হয়নি আমাদের। এরকম উপন্যাস বাস্তবিকই অঙ্গুলিমেয়, ভাবনার স্বচ্ছতা যেখানে বিষয়কে অযথা জটিল হতে দেয় না, সামাজিক গহীনের সমূহ চলমানতা, ভাঙনকে যেখানে পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন মর্মে মর্মে -- লেখকও যেন পান্ডিত্য ও মেধার আরোপে ভারাক্রান্ত হতে দেন না তার সৃষ্ট চরিত্রের ভাবনা ও ভাষাকে। এই একই প্রতিক্রিয়ার বিস্তার তাঁর ছোটগল্পেরও জোর, প্রত্যক্ষের পরিবেশনে তিনি এমন কিছু সত্যকে ছুঁয়ে যান নির্ভার সহজ গদ্যে যে, পাঠকের দৃষ্টি প্রসারিত হওয়া সম্ভব।
তাঁর গল্প-উপন্যাস তাঁকে আদ্যোপান্ত বাস্তবলগ্ন ও খর চেতনার লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়--- এ বাংলার যে কোনো পাঠকের সিদ্ধান্ত হতে পারে এরকম, এই নিয়ে আজ দ্বিমত পোষণের অবকাশও নেই। চিরকালই হাসান আজিজুল হক-- এর হ্রস্বতম রচনাতেও নিষ্ঠা ও বাস্তবটি আমাদের দৃষ্টি এড়ায় নি। তার উপর লোকজীবনের কথার আদলে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত গদ্যও লভ্য হয়েছে এই বাংলায়, আর এতে এখানকার পাঠকেরা আরও নিবিড় করে পাচ্ছেন তাঁকে। বাস্তবে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিষয়ও কিভাবে ধাক্কা আনছে তাঁর গভীরে, চারপাশ থেকে কিভাবে তিনি সংগ্রহ করছেন রচনার উপাদান, এমন কি সমাজের নিচু তলার মানুষের তীব্র ক্লিষ্ট যাপনের প্রত্যক্ষতার মাঝে- মাঝে নিমগ্ন সাহিত্যপ্রয়াস প্রসঙ্গেই একটা অহৈতুকীর ভাবনা কেমন টলিয়ে দিচ্ছে তাঁকে---- লোকজীবনের কথা (যেমন, 'চালচিত্রের খুঁটিনাটি') হিসাবে পরিবেশিত গদ্যগুলোর এমন সব বিষয় আমাদের মূল্যবান প্রাপ্তি।
কিন্তু পরিতাপের কথা, প্রবন্ধ রচনায় এই লেখকের অভিনিবেশ এই বাংলার পাঠকের কাছে বিশেষ বিজ্ঞাপিত নয় বললেই চলে। এখানকার কোনো প্রকাশক আজ অবধি প্রাবন্ধিক হাসান আজিজুল হককে তুলে ধরতে পারে নি, এটা ঘটনা--- কারণ যা-ই হোক। এবং বক্ষ্যমানের ধারণা, সেক্ষেত্রে হাসান সাহেবের সাহিত্যকৃতির একটা বড় দিক হয়তো অলক্ষ্যে থেকে যাবে এই বাংলার সন্ধিৎসু পাঠকের কাছে, যেটা তাদের সাপেক্ষে একটা ক্ষতিও বটে।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এই রচনা হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধগুলোর পূর্ণাঙ্গ কোনো বিশ্লেষণ নয়, প্রবন্ধের পরিসরে হাসান আজিজুল মেধা ও মননের যে- ঋজুতায় প্রতিষ্ঠিত, তার খানিক হদিস পাবার প্রয়াসমাত্র। এবং এতে তাঁর খুব অল্প ক'টি প্রবন্ধই উল্লিখিত হবে তাঁর প্রাবন্ধিক চরিত্রের দিক- নির্দেশক হিসেবে।
হাসান আজিজুল যদিও জানিয়েছেন অনুরোধ-উপরোধের চাপেই সৃষ্ট তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধ, তবু পাঠক্রিয়ায় তাদের একটাকেও অযত্নম্ভূত মনে হয় নি, শিথিলভাবে দিনগত পাপক্ষয় করেছেন তিনি, অভিনিবেশে খামতি ঘটিয়েছেন কোথাও। বরঞ্চ বিষয় যা-ই হোক-- লিখনপ্রক্রিয়াটি যে তাঁর কাছে বিশেষ গুরুত্বের, আন্তরিক তাগিদ বোধ না করলে যে লেখেন না একটিও শব্দ--- এ- সত্যই বনেদ পায় তাঁর প্রবন্ধরচনার অনুষঙ্গে। গুরুগম্ভীর দুর্বোধ্য ভাষায় নয়, অসম্ভব ঋজু, সহজ গদ্যেই এতএব তিনি লিখে যেতে পারেন অনর্গল, ক্রমাগত ভাবনার আবর্তে টানতে পারেন পাঠককে, উস্কে দিতে পারেন বিতর্কের-পর- বিতর্ক, ধাক্কা আনতে পারেন আমাদের আজন্মলালিত বেশ কিছু বিশ্বাসে, ব্যক্তি ও পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সিদ্ধান্তে, যাকে সহজে নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না, যার বিরুদ্ধে চলে না কোনো অগভীরতার অভিযোগ। আর এভাবেই বিশেষ আলোচ্য হয়ে ওঠার শক্তি ধরেন প্রাবন্ধিক হাসান আজিজুল।
হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে কখনো কোনো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব, কখনো ভাষা ও সাহিত্যের কিছু সমস্যা ও প্রবণতা, কখনো শিক্ষা, কখনো সামাজিক প্রসঙ্গ, মাঝেমাঝে শিল্প ও শিল্পীর দায়-দায়িত্বও। এককথায় চলতিকালের যেকোনো প্রসঙ্গই তাঁকে মনোযোগী করে, এবং সব বিষয়েই তাঁর কিছু মৌলিক বক্তব্য আছে। কোনো বিশেষ বিষয়ে আটকে থাকার মানুষ নন তিনি। বহির্জগতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তাঁর সজাগ মানসে এক-একটা বিশেষ অর্থ বহন করে। তিনি খোলা মনে ভাবতে পারেন তা নিয়ে, আর এই ভাবনার প্রকরণেই দাঁড়িয়ে যায় তাঁর প্রবন্ধ।
যেমন, সাহিত্য ও শিল্পীর দায় বিষয়ে হাসান আজিজুলের অসংখ্য প্রশ্ন আছে, সুচিন্তিত বক্তব্য আছে, আছে ঐতিহ্যকে মান্য করেই সাম্প্রতিক থাকার সৎ চেষ্টা। কখনও তিনি অতি-চেনা কিছু কথা বলেছেন। যেমন, 'সমকালের সমাজ ও মানুষকে আতল দেখার চেষ্টা একজন কথাসাহিত্যিক করেছেন কিনা সেটাই বড় কথা! '(জীবনের জঙ্গমতা; লেখকের দায়)। কিন্তু এরকম আপ্তবাক্যকে কেন্দ্র করে তিনি যখন তাঁর সমকালীন প্রবণতাকে বিচার করতে বসেন তখনই আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে তাঁর মননের গভীরতা। বক্তব্যের স্বপক্ষে তাঁর সাজানো যুক্তি বলয় প্রায় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট দুর্ভেদ্য মনে হয়। যেমন, 'পঞ্চাশের দশকে সমাজে বড় ঘটনা তেমন কিছু নেই, সমাজ সম্পূর্ণত স্থবির--- এরকম সরলীকরণে আমার বিশ্বাস নেই। তাহলে তো সবই অঙ্কের মতো মিলে যায়, স্থবির সমাজের সাহিত্য স্থবির হয়েছে, তাতে আশ্চর্যই বা কী, দুঃখই বা কী, অসন্তোষের কারণই বা কী। এভাবে চিন্তা করলে সাহিত্য- সমালোচনারও তো কোনো দরকার দেখি না। গতিহীনতার সাধারণ কথাটিকে মেনে নিয়েও লেখকরা সেখানে কী করতে পারতেন, তা বিচার করতে হবে। সচেতন ব্যাখ্যাতার দায়িত্ব লেখককে সব সময়ই বহন করতে হবে। তা না হলে সাহিত্যের তাৎপর্যই বা কি। আর সাহিত্য নিয়ে সমালোচকদের একাংশ নড়ে-চড়ে বসবেন।
কিন্তু এরপরই যখন তাঁরা পড়বেন লেখক পরিবেশিত খারাপ স্লোগানধর্মিতার প্রসঙ্গে সিদ্ধান্তটি, তাঁরাও বোধহয় খানিক ভাবিত হবেন, বুঝবার চেষ্টা করবেন লেখক ঠিক কোন গতিপথের, ঠিক কোন রোহভূমির, আসল কথাটা এ যে সব সাহিত্যই কোনো না কোনোভাবে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যাবেই। লেখক যে প্রতিক্রিয়া পাঠকদের মধ্যে ঘটাবার জন্যে লেখেন, তার লেখা যখন ঠিক সেটাই প্রবলভাবে তৈরি করতে পারে, তখন সেই লেখাকে আমরা ভালো বলি। অভীষ্ট প্রতিক্রিয়া লেখাটি যে অনুপাতে কম সৃষ্টি করে, ঠিক সেই অনুপাতেই তা কম সার্থক। কাজেই লেখা যদি অনুপ্রাণিত করে সামনে চলার পথ দেখিয়ে দেয়, বিশ্লেষণ করে, বুঝিয়ে দেয়, তবে তাতে দোষ হবে কেন? সব লেখকই জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে তাই তো চান। বরং বিশ্লেষণ ও বুঝিয়ে দিতে পারার ক্ষমতায় যখন ঘাটতি পড়ে, দেশ ও সমাজের বাস্তবতার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানে যখন সাহস ও পরিশ্রমের অভাব দেখা দেয়, পাঠকের অনুভূতি ও উপলব্ধির জগতে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে লেখক যখন অক্ষম, একমাত্র তখনই দেখা দেয় খারাপ অর্থে স্লোগানের সাহিত্য, হৈ-চৈ করে বাজিমাত করার সাহিত্য বা বড় বড় ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে প্রাণ সাহিত্য
হাসান আজিজুলের একটি সার্থক রচনা 'শিল্পীর দায়িত্ব'।
এ এক বহুচর্চিত বিষয়। তবে মাঝে-মাঝেই, পরিস্থিতির দাবিতে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা কাম্য, যেহেতু শিল্পকর্মের মৌল শর্তগুলো নিয়ে ক্রমাগত ভাবনার প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে বিতর্কের। হাসান আজিজুল যেমন বহুশ্রুত কথাগুলোই যত্নে সাজিয়েছেন, 'সমাজে শিল্পীর দায়িত্ব অনেকটা ইতিহাসগতভাবেই স্থির হয়। ইতিহাসই শিল্পীকে একটি অবস্থানে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয়। ইতিহাসের তীব্র সূচিমুখ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে নিজের সময়কে পর্যালোচনা ও পরিমাপ করা ছাড়া শিল্পীর কোন উপায় থাকে না।' তিনি মনে করেন, 'প্রচন্ডতম শোষণের সঙ্গে অজেয় জীবনীশক্তির সংঘর্ষে এক উৎকট বাস্তবতা' শিল্পীর সাহিত্যের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসাটাই ভবিতব্য। 'বাংলাদেশের মতো 'বিচিত্র বাস্তবই গঞ্জনার মধ্যে ভবিষ্যৎ রচনার কঠিন দায়িত্বে শিল্পীকে লিপ্ত করবে'। 'দায়িত্ব ঘাড়ে না নিয়ে বাংলাদেশের মতো সংক্ষুব্ধ পরিবেশে শিল্পীর কাজ করা অসম্ভব বলেই ধারণা হাসান আজিজুলের।
ফলতঃ পাঠকের কাছে একটা সুযোগ এসে যায় লেখকের সমগ্র সাহিত্যকৃতির অনুষঙ্গে এই সিদ্ধান্তগুলোকে মিলিয়ে নেবার। বাস্তবিকই, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুলকে বোঝার চেষ্টায় এধরণের প্রবন্ধ পাঠকের কাছে বিশেষ গ্রহণীয় হয়ে উঠবে, প্রাবন্ধিক হাসান আজিজুলই একাজে তাদের অন্যতম ভরসাস্থল। কথাগুলো জোর দিয়ে বলার কারণ, সম্প্রতি তাঁর 'বিধবাদের কথা' গল্পটি নিবিষ্ট পাঠের অভিজ্ঞতা। 'দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে' লেখা বলতে হাসান আজিজুল ঠিক কোন প্রক্রিয়াকে নির্দিষ্ট করেছেন, এই গল্পের সূত্রে পাঠক হয়তো তার খানিক হদিস পাবেন। ভাষা সম্পর্কে হাসান আজিজুলের স্পষ্ট একটি অবস্থান আছে। এবং সেই অবস্থান গ্রহণে তিনি সাধারণ পাঠকের দাবিকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। মনে হয়, পাঠকের এক চিরকালীন চাহিদা প্রকাশপথ পেয়েছে তাঁর কলমে। 'মুখের কথা', 'লেখার ভাষা' নামাঙ্কিত প্রবন্ধে তিনি এব্যাপারে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। এর শেষ তাঁর পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত আমাদের একটা আবহমান সমস্যার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। যেমন... 'চিন্তার ক্ষেত্রে, দর্শন বা তত্ত্বালোচনার বেলায় বা গদ্যের নানা ব্যবহারের সময় মুখের কথাকে জায়গা দেওয়ার চেষ্টার মধ্যে শুধু অসুবিধা নয়, আমাদের দেশে একটা বিরোধও আছে। সেই বিরোধটি তৈরি হয়েছে অতি সামান্য সংখ্যক শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে কোটি কোটি নিরক্ষর মানুষের চিন্তাগত, ভাবগত, সংস্কৃতিগত, জীবনযাপনগত আকাশচুম্বী ফারাকের ফলে।'
এর অব্যবহিত পরেই লেখক আরও যেন ক্ষুরধার হয়ে যান। তাঁর বাচনে জড়িয়ে থাকে বাংলা গদ্যের ভবিষ্যৎ বিষয়ে আশঙ্কা, একই সঙ্গে একটি সঙ্গত ক্ষোভও, 'এ অবস্থাকে বদলাতে না পারলে বাংলা গদ্যকে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। চারিদিকে শত শত দেয়াল তুলে রেখে, পরস্পরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে স্বাধীন চলাফেরার কথা বলা যায় না।'-- এখানে তিনি সোয়া কোটির মানুষকেই যেন কাঠগড়ায় দাঁড় করান। সমস্ত দেয়াল ভাঙার দায় আসলে তাঁদেরই--- হাসানসাহেবের এ- বক্তব্য বিতর্ক তুলবে। তিনিও হয়তো সেটাই চান। আত্মসমালোচনার ভার বুদ্ধিজীবীরা সইতে পারেন না--- এ- বাস্তবই যেন তাঁর লক্ষ্যবিন্দু। বিতর্ক উস্কে দেবার এই প্রক্রিয়াটিতে শ্রদ্ধেয় শিবনারায়ণ রায় যে তাঁর অগ্রণী, সে প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি শ্রীযুক্ত শিবনারায়ণকে নিয়ে লেখা তাঁর অতি গুরুত্বের এক প্রবন্ধে।
প্রকৃত প্রস্তাবে, একজন সচেতন লেখকের অসংখ্য জিজ্ঞাসারই সাক্ষ্য বহন করছে হাসান আজিজুলের প্রবন্ধ। এবং যে পর্যবেক্ষণের সূত্রে এসব জিজ্ঞাসার উত্থান, তার ধার ও ভার পাঠক অস্বীকার করবেন কী করে? এতে প্রশ্নাতুর পাঠকের ক্ষুধাই বেড়ে যায়, যে- ক্ষুধার তীব্র সদর্থক এক মাত্রা আছে। প্রবন্ধ বিষয়ে আপ্তবাক্যটি ( Essays are the grains of salt which will rather give an appetite than offend with sateity.) এখানে পাঠকের মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। 'একুশের ভাষা আন্দোলন' নামের প্রবন্ধে একটা অসামান্য সম্ভাবনার অপমৃত্যুকে তিনি যেভাবে চিহ্নিত করলেন, সেরকম সত্যকথনের টানেই আরও বেশি করে পাঠ্য হয়ে ওঠার দাবি রাখেন হাসান আজিজুল। উদাহরণ, 'গত তিরিশ বছরে ভাষা আন্দোলন কালেই বিপ্লবী রাজনীতিতে লিপ্ত থেকেছেন.... তাঁদের কথা থেকেই বোঝা যায়, ভাষা আন্দোলন তাঁদের ছাত্রজীবনে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাই ছিল মাত্র, সেই রাজনীতি তাঁদের পরবর্তীকালের রাজনীতির সঙ্গে সংগঠনভাবে যুক্ত হয়নি। যে মশাল তাঁরা বাহান্ন সালে জ্বালিয়েছিলেন সেই মশাল কালগতভাবে আন্দোলনের মূল বক্তব্যের প্রয়াস ঘটিয়ে একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ সমাজদেহে ঘটানো সম্ভব ছিল একমাত্র বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে তাকে যুক্ত করতে পারলেই। সেটা ঘটেনি এবং যারা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের অংশীদার ছিলেন ও পরে বিপ্লবী সংগঠনে এসেছিলেন, তাঁরা ভাষা আন্দোলনকে একটি মহান ঘটনা বলে বর্ণনা করলেও বাহান্ন সালেই সেই ঘটনা চুকিয়ে ফেলেছিলেন।
হাসান আজিজুল হকের বেশ কিছু প্রবন্ধের বিষয় হয়ে এসেছেন সাহিত্যরথীরা। এবং সেসবে আমরা তাঁর পাঠের ব্যাপ্তি ও সাহিত্যবিচার- সম্পর্কিত ভাবনার হদিস পাই।'
ভাষারীতি- 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়'- এ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা বিষয়ে লেখকের অনুধ্যান ও সিদ্ধান্তের সূত্রে পাঠক আরও সচেতন মূল্যায়নে উৎসাহী হবেন শ্রীযুক্ত মানিকের সাহিত্যকৃতির। বলা বাহুল্য -- ভাষার সূত্রে হাসান আজিজুল শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র সাহিত্য প্রয়াসকেই তাঁর লক্ষ্যবিন্দু করেছেন। প্রকৃতই শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দিককার রচনার 'বিষাক্ত তিক্ত স্বাদ', 'মর্মান্তিক শ্লেষ- বিদ্রূপ' শেষের দিকে হারিয়ে গেছিল। একদা বাংলা গদ্যকে 'নিজের তৈরি হাতিয়ার'-এ পরিণত করতে পেরেছেন মানিক--- এটা স্বীকৃত সত্য। তাঁর ভাষা- বিষয়ে যে চুড়ান্ত নির্ণয় পরিবেশন করেন লেখক প্রবন্ধের বিভিন্ন অংশে, তাতে সত্যকথনের তীব্র ঝাঁজটা প্রাবন্ধিক সততাকেই স্পষ্ট করে, পাঠক বুঝে যান-- মূল্যায়নের পরিসীমায় হাসান আজিজুল আপোসে আগ্রহী নন। উদাহরণ, 'কথাশূন্য, ফাঁপা উলটো লজিক রাস্তায় ঘন ঘন স্পিডব্রেকারের মতো লেখাকে আটকে ধরে, বৈজ্ঞানিকতা তুচ্ছ বাগাড়ম্বরে দম চাপা হয়ে মারা পড়ে।' এরকম মূল্যায়নে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ দিককার রচনাগুলিকে নির্দিষ্ট করলেও লেখক তার মোটামুটি যুক্তিগ্রাহ্য কারণও চিহ্নিত করে দেন স্বভাবসিদ্ধ ভাষা-ভঙ্গিমায়, 'বিজয় শব্দে নয়, গোঙানির আওয়াজ' করে এসেছে উপমহাদেশের স্বাধীনতা। মানিকের চোখের সামনে তখন বিধ্বস্ত পৃথিবী। ম্যাড়মেড়ে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আলো কুষ্ঠের ক্ষতের উপরে খেলা করছে। অসুস্থ, আশাশূন্য, মোহশূন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময়ে কলমটাকে পেষা ছাড়া আর কি করতে পারতেন কে জানে।' তাঁর একটি উক্তির সঙ্গে বিশেষ সহমত পোষণ করি--- 'আসলে আর তাঁর দেবার মতো কিছু ছিল না।' হাসান আজিজুল এইভাবেই তাঁর অকপট বাচনে আমাদের চেনা ভাবনাগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে চলেন। তাঁর এই নির্মোহ দৃষ্টি অত্যন্ত কালোপযোগী। এই সূত্রে পাঠক ভাবতে শেখেন, প্রত্যক্ষ ও গ্রাহ্য সবকিছুর পুনর্মূল্যায়নের দরকার আছে।
শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকৃতিকেও একইভাবে নির্মোহ চোখে দেখছেন লেখক। শরৎচন্দ্রের সূত্রে সমতুল্য মূল্যায়ন আগে এ- বাংলাতেও হয়েছে। আমরা আবার নতুন শব্দে পড়লাম সেটা। যেমন, 'শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসেই মানুষ সম্পর্কে--- ভাববাদী রোমান্টিক দৃষ্টি জীবন সম্পর্কে তাঁর অগভীর অভিজ্ঞতারই প্রমাণ দিচ্ছে। মানুষ ভালো, একটি চিরন্তন মানবপ্রকৃতি আছে, মাঝে-মাঝে পারিপার্শ্বিকের চাপে মানবিকতা বোধ আবৃত আচ্ছন্ন হয় মাত্র--- তাঁর এই বিশ্বাসগুলি অনেকটা উনিশ শতকীয় রেনেসাঁসৃষ্ট, খানিকটা ভারতীয় ভাববাদ সৃষ্ট--- সর্বোপরি এই দৃষ্টিভঙ্গি রোমান্টিক। স্থান-কালে আবদ্ধ মানুষের সমগ্রতার সন্ধান শরৎচন্দ্র কখনোই পাননি।' এ- মন্তব্যটি যে- কালের (১৯৭৬) মাটিতে দাঁড়িয়ে, সেই কাল চুড়ান্ত অস্থির ও বিপর্যস্ত। মানুষ তার চর্চায় ও চর্যায় বদলে গেছে আমূল। শরৎচন্দ্রের সমকালেও গল্প- উপন্যাসে চরিত্র-পাত্ররা আরও বেশি ভাবালুতা বর্জিত ও কঠোর বাস্তবতামন্ডিত চিত্রায়ণ দাবি করে--- এর স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ তখনকার ঐতিহাসিক ও আর্থসামাজিক চলনই যোগায় আমাদের। সাহিত্য সফল হওয়া আর বিপুল পাঠক আনুকুল্য পাওয়া--- দুটি এক জিনিস নয়, এই বোধ তো আবহমানের। শরৎচন্দ্রের মূল্যায়নে আমরা হাসান আজিজুল হককে যথার্থ এক আধুনিক মেজাজে দেখি, যে- আধুনিকতা অনুভবীকে নিরন্তর আকৃষ্ট করে গড্ডালিকা প্রবাহের বিপরীত দিকে।
এই লেখকের 'ফুরায় না সব লেনদেন' শিরোনামে এক অলোকসামান্য রচনা আছে যা সাহিত্য মূল্যায়নের জগতে তাঁর সম্ভবত অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। এ- রচনার কেন্দ্রে যদিও বুদ্ধদেব বসু, তবু এর বিস্তারে হাসান আজিজুল হক বাংলাসাহিত্যের মূল প্রবাহটিকে কম- বেশি ছুঁয়ে গেছেন। শুধু ছুঁয়ে গেছেন বললে ভুল হবে, তার অন্তঃসারকে উন্মোচিত করেছেন আশ্চর্য মৌলিকতায়। তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত প্রায় অভ্রান্ত। যেমন, 'বুদ্ধদেব বসুর বই দুটি, অনুবাদের নির্ভরতা সত্ত্বেও যেন ইতিহাসেরই ভীষণ দাবি। 'তিনি এমন কিছু সত্য উচ্চারণ করেন প্রবন্ধটির নানা পর্যায়ে যা নিয়ে কোনো কোনো পক্ষের ভ্রুকুঞ্চন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু প্রতিস্পর্ধায় উচ্চারণগুলির মুখোমুখি দাঁড়াতে গলায় খুব বেশি জোর মনে হয় ফুটবে না তাদের। বাস্তবিকই 'পঞ্চাশের দশকের পাষাণভার অনড় হয়ে বসে।' অন্যদিকে 'একজন সতীনাথ, একজন জ্যোতিরিন্দ্র, একজন ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, রশিদি করিম বা আবু ইসহাক কিংবা কমলকুমার বা অমিয়ভূষণ চল্লিশের দশকের আগুন নিয়েই মিটিমিটি জ্বলতে থাকেন।'
পাঁচের দশকের কথাসাহিত্যে কবিতায়... একগাদা লেখক কবিদের নাম দুই দেশেই করা যায়, কিন্তু চেঁচিয়ে বলতে ফুসফুসে বাধে। 'অগত্যা' ভয়ানক অপেক্ষা ষাটের কালের।' এমতাবস্থায় বুদ্ধদেব বসুর দুটি অনুবাদ কবিতার বই ('মেঘদূত' ও 'শার্ল বোদলেয়ার- তাঁর কবিতা')' প্রচন্ড শক্তিতে ছুঁড়ে দেয়া অগ্নিমুখ বর্শা যেন।' লেখকের পর্যবেক্ষণে, 'যাঁরা সাহিত্যে কাজ করতে চাইছিলেন, সরাসরি তাদের মধ্যে এসে পড়ে বৈশ্বিকতা, মানুষতা, তীব্র ব্যক্তিমুখিতা, যা বাংলা সাহিত্য কখনোই গ্রহণ করেনি।' বুদ্ধদেবের বিশেষজ্ঞতা ও পারঙ্গমতাকে অকুন্ঠ স্বীকৃতি জানিয়েও লেখক তাঁর কিছু নিজস্ব ভাবনা পরিবেশন করতে সংকুচিত হন না আদৌ। তিনি বুদ্ধদেবের অনুবাদগ্রন্থটিকে চিহ্নিত করেন আজকের স্বতোৎসারিত সাহিত্যধারার 'গোমুখ' হিসাবে। কিন্তু আলোচনা পরিণতিতে হাসান আজিজুল যেখানে গিয়ে দাঁড়ান, সেই অবস্থানটি এক অতি সংগত বিরুদ্ধ অনুভবের। এমন অবস্থানে দাঁড়ানোয় একটু হলেও সাহস লাগে-- যে সাহস লেখকের সজাগ চৈতন্য ও নিবিড় চর্চার ফল। উদাহরণ, 'হঠাৎ একালে এসে নিজের দেশকালের ইতিহাসটিকে এক অদ্ভুত বোধহীনতায় পুরোপুরি ভুলে গিয়ে এর ওপর চাপিয়ে দিলেন খুব পুরনো অবক্ষয়িত একটা দর্শনের খোলস। যেমন গোটা উনিশ শতক তাঁর কাছে প্রায় ইতিহাসশূন্য তেমনই একই শূন্যতায় তিনি বিশ আর তিরিশের দশকের উপার্জিত শিল্পদর্শনকেও মিশিয়ে ফেলেন তাঁর নতুন সাহিত্যভাবনার সঙ্গে।' হাসান আজিজুল তাঁর বক্তব্যবিন্যাসে কোথাও কোনো অস্পষ্টতা রাখেননি, যেহেতু বুদ্ধদেবের বোদলেয়ার- পরিবেশনের ভ্রান্তিটুকু শনাক্ত করতে পেরেছিলেন তীব্রভাবে.... 'প্রশ্ন বোদলেয়ারকে নিয়ে নয়... তাঁর ইতিহাসহীন ব্যাখ্যা নিয়ে। তাঁর কাব্যের উত্তুঙ্গ মহত্ব নিয়ে নয়... তাঁর আত্মিক সঙ্কট সুমহান পতন, তীব্র জ্বালাময় নরক-যন্ত্রণা নিয়েও নয়... এই সবকিছুকে সাহিত্যের উচ্চতার, আধুনিকতার মানদন্ড করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা নিয়েই আমাদের প্রশ্ন।'
অজস্র জিজ্ঞাসার আবর্তে আমাদের টেনে নিতে নিতে প্রাবন্ধিক হাসান আজিজুল হক আধুনিক মননের একটা দৃষ্টান্তই যেন স্থাপন করে চলেন প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ। এবং তাদের পাঠক্রিয়ায় আমরা যেন খানিক পরিমার্জিত, কখনও পুনগঠিত করে নিতে পারি নিজেদের। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়- ব্যাপ্তিও বিশেষ আকর্ষণীয়। প্রত্যক্ষ নিয়ে গভীর চর্চাকে প্রবন্ধের পরিসরে আনার এমন উদাহরণ কোথায় এমুহূর্তে ? 'মার্কস ও এঙ্গেলস- তাঁদের নারীবাদী তত্ত্ববিষয়ে দু'একটি মন্তব্য'--- এমন কিছু বিষয়ে গভীর কিছু লিখতে গেলে যে তথ্য ও ভাবনার সাথসঙ্গত দরকার, তা আজকের কতজন কথাসাহিত্যিকের পরিবেশন করার সাধ্য আছে, সেটাই প্রশ্ন...
এবং সব থেকে বড়ো কথা, একেবারে আমাদের চেনা বাস্তবের সঙ্গে তত্ত্বকে মিলিয়ে তার সীমাবদ্ধতা- অসম্পূর্ণতা নির্দিষ্ট করা, এককথায় তত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন, তাও আবার স্বচ্ছন্দ, সহজবোধ্য গদ্যে--- এরকম প্রাপ্তি খুব বেশি প্রাবন্ধিকের সাহচর্যেও ঘটে না। হাসান আজিজুল হক ঠিক এ- জায়গাতেই বিশিষ্ট। যে-কোন রচনাতেই লেখক যেভাবে তাঁর স্বভূমির আর্থ-সামাজিক পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাতে তাঁর এক বিশেষ ভূখণ্ডের লেখক হিসেবে দায়বদ্ধতাটাই যেন জোরালো হয়ে ওঠে। আমরা একটা অনুকরণযোগ্য প্রয়াসের সম্মুখীন হই। আসলে হাসান আজিজুলের প্রাবন্ধিক সত্তা সময়ের দাবিতেই এমন প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠা দরকার ছিল। তাঁর গল্প-উপন্যাস দুরূহ, জটিল সমকালকে ধরেছে-- প্রবন্ধও ধরেছে। দুটি ভিন্ন আঙ্গিক। তবু কোথাও যেন মনে হয়, প্রবন্ধের সীমায় আমরা কথাসাহিত্যের হাসান আজিজুলের সঙ্গেই রয়েছি। আসলে এর কারণ, তাঁর অকম্পিত চোখে বাস্তবকে দেখার প্রবণতা। সময়ের চাপেই তাঁর সাহিত্য- অভ্যাসে অহেতুক ভাবলুতার কোনো স্থান নেই। প্রখর দৃষ্টি ও তীব্র ভাষাভঙ্গিমায় কিভাবে বিষয়কে বিষয়াতীত একটা মাত্রায় পৌঁছে দিতে হয়, সেটা বিলক্ষণ জানেন তিনি। আর, এই দক্ষতাই এক গ্রন্থিতে বেঁধে ফেলেছে তাঁর প্রবন্ধ ও কাহিনী-সাহিত্যকে।
বাংলা সাহিত্যের উৎস সন্ধানে চর্যাপদের কাব্যমূল্য
ছ ন্দা চ ট্টো পা ধ্যা য়
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যচর্চার উৎসাহ ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। কোন্ বিবর্তনের ফলে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হলো, তা বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী সব ছাত্র, পাঠকই জানেন। আজ আমি আদিযুগের বাংলা ভাষার সর্বাংশে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন-"বৌদ্ধগান ও দোহা"- নামক গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত চর্যাপদগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা করবো।গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন পণ্ডিতপ্রবর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। বাংলা সাহিত্যের আদিগ্রন্থ এখনো চর্যাপদকেই বোঝানো হয়।
প্রাচীনতম বাংলা পদসঙ্কলন চর্যাগীতিকা মূখ্যতঃ তত্ত্ববাদের বাহক, গৌনতঃ কাব্য, যা মূলতঃ তত্ত্বদর্শনের মধ্যে বিধৃত এবং মুমুক্ষু চিত্তের কাছে অধ্যাত্ম আশ্বাসের ইঙ্গিত বহন করে। চর্যাপদ বিশুদ্ধ কাব্যের আদর্শে বিচার্য নয়। চর্যাপদ গুলি ছোট ছোট গীতিকবিতারই সমষ্টি। এদের বয়স প্রায় হাজার বছরের কাছাকাছি। বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সাধকগণই এই পদ গুলির রচনাকার। ঠিক সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা নয়, রচনাগুলির সক্রিয় উদ্দেশ্য ছিলো সহজিয়া মতবাদের প্রচার। তার তান্ত্রিক ভাবধারা ও গুহ্য যোগসাধনার প্রকাশ। চর্যার সংখ্যা ৪৬/৪৭ টি। মোটামুটি ২৪ জন পদকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়।
চর্যাপদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন এবং বাক্ নির্মানের শিল্পকৌশল রক্ষিত হয়। কেউ কেউ কাব্যনির্মাতার পারিভাষিক রীতি অর্থাৎ আলঙ্কারিক বিচারপ্রক্রিয়ার সাহায্যে চর্যার ছন্দ, অলংকার
ধ্বনি, বক্রোক্তি, রস বিশ্লেষণ করে এর কাব্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এই রীতির কাব্যবিচার নিতান্তই বাহ্যিক। চর্যাকারগণ সচেতনভাবে কাব্য রচনার প্রয়াস পাননি। তাঁরা একটা বিশেষ ধরনের তত্ত্ববাদ ও গুহ্য সাধনাকে প্রাকৃত অপভ্রংশের প্রকীর্ণ কবিতার মতো স্বল্পতম আয়তনের মাধ্যমে নানা সংকেতের সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন।
যে ভাষায় চর্যা লেখা হয়েছিল তাকে বাংলা তো নয়ই, একটা অপরিচিত ভাষার মতো সন্দেহ হয়।কারণ বাংলা ভাষা তখনো সৃজ্যমান, সবেমাত্র অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে স্বতন্ত্র একটি রূপ নিতে শুরু করেছে। তাই এর বিশেষ আদল বুঝতে গেলে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার প্রয়োজন হয়। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন চর্যাপদগুলির বহিঃরূপ ও অন্তর্নিহিত রূপের অর্থবৈষম্য আছে। চর্যাগীতির আসল রহস্য তাঁরাই বুঝবেন, যাঁরা বৌদ্ধ সহজপন্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। একটি পদ উদ্ধৃত করলে বোঝা যাবে,
-"চিঅ সহজে শূন সংপুন্ন।
কান্ধবিয়োএঁ মা হোহি বিসন্না।
ভন কইসে কাহ্ন নাহি।
ফরই অনুদিন তৈলোএ পমাই।
মূঢ়া দিঠ নাঠ দেখি কাঅর।
ভাগ-তরঙ্গ কি সোষই সাঅর।
মূঢ়া অচ্ছন্তে লোঅ ন পেখই।
দুধ-মাঝে লড় অচ্ছন্তে ন দেখই।
ভব জাই,ণ আবই এথু কোই।
অইস ভাবে বিলসই কাহ্নিল জোই।।"- পদটিতে ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে একালের বাংলা ভাষার বিস্তর প্রভেদ। এর আদল অনেকটা ভারতীয় মধ্যযুগের আর্যভাষা প্রাকৃতের শেষ স্তর অপভ্রংশেরই মতো। আর রূপক-উপমাদি প্রয়োগের মাধ্যমে এই পদে যা প্রচারিত হয়েছে, তা সহজসিদ্ধাদের গুঢ় তত্ত্বকথাই বটে। এতে সহজসাধক কৃষ্ণাচার্য সিদ্ধাবস্থায় তাঁর অনুভবের কথা বলেছেন। জগতের অনিত্যতা সম্বন্ধে তিনি জ্ঞানলাভ করেছেন।
দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বদর্শনের কথা বলতে গিয়ে চর্যাগীতিকার নানা রূপক, প্রতীকের ও চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্দিষ্টার্থকে মনোরম করে তুলতে চেয়েছেন। এই চিত্র প্রতীকগুলি একদিকে যেমন উদ্দিষ্ট অর্থকে সংহত আকারে প্রকাশ করেছে, তেমনই চিত্রকল্প ও রূপকল্পকেও আবার অজ্ঞাতসারে একটা শিল্পমর্যাদা দিয়েছে। অনেক সময় রূপক ও প্রতীকের সাহায্যে দূরূহ তত্ত্বকেও স্পষ্টতর করা হয়েছে। যেমন-- শরবৃক্ষ (১), ভবনদী পারাপার (৫), হরিণশিকার(৬), ডোম্বী ও শবরীর আৎষঙ্গ(১০,২৮), শবর ও শবরীর মদমত্ত উল্লাস(৫০), দরিদ্রা গর্ভিনী রমনীর মনোবেদনা(২০), গৃহদাহ(৪৭), জলদস্যুর আক্রমণ (৪৯), প্রভৃতি বাহ্যিক রূপকের সাহায্যে আচার্যগণ চর্যার গুঢ় রহস্য অদীক্ষিতের নিকট সংবৃত রাখলেও দীক্ষিতের নিকট বিবৃতই করেছেন। এর মধ্যে কোথাও বা চিত্রকল্প, সৌন্দর্যানুভূতি, কোথাও বা লোকজীবনের প্রতিচ্ছায়া ধরা পড়েছে। একটি চিত্র দেখা যাক-- যখন চারদিক ঘিরে হাঁক পড়ে, মাংসলোলুপ শিকারীর দল হরিণকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, মৃগের নিজের মাংসই যে তার শত্রু!! তখন আর্ত হরিণ আশ্রয় খুঁজে পায়না।-"হরিণা হরিণর নিলঅ ন জানী"- তবু হরিণী হরিণকে পথ দেখিয়ে দেয়। হরিণ মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে ছুটে বনান্তরে চলে যায়। এর মধ্যে হরিণীর যে প্রেমিকা সত্তার চিত্রটি ফুটে উঠেছে তার মানবিক মূল্য অনস্বীকার্য। আবার একটি ছবি বা মুভি দ্রুতধাবম যদি দেখি? দ্রুত ধাবমান মৃগের আত্মরক্ষার জন্য উদ্দাম পলায়নের চিত্রটি সহজেই নান্দনিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কাহ্নপাদ ডোম্বীকে বিবাহ করার জন্য পটহ, মাদল বাজিয়ে যাত্রা করলেন।বিবাহ অন্তে যৌতুক লাভ করলেন,--"অমুত্তর ধন্ন"-। সারারাত কেটে গেল -" অপহঁরহেঁ"- এর নিহিতার্থ যাই হোক না কেন, এর মধ্যে দিয়ে প্রেমের উল্লাসই উপলব্ধি হয়। পদ (১৯)।
চর্যাগীতিকার সবশেষ পদটি নরনারীর তীব্র আসক্তিপূর্ণ জীবনলীলা স্বল্পতম পরিবেশে চমৎকার ফুটেছে। যেমন--- শবরের বাড়ির চতুর্দিকে কাপাস ফুল ফুটেছে, রাত্রির আকাশ বেয়ে জ্যোৎস্না নেমেছে, কাঁকনিদানা পেকেছে। শবরী ও শবর কাঁকনিদানা থেকে প্রস্তুত আসব পানে মত্ত হয়ে উঠেছে।-"কভু না পাকেলারে শবরা শবরী মাতেলা, অনুদিন শবরো কিম্পি ন চেবই মহাসুঁহে ভোলা।"- একটি গৃহবধু টিলার ওপর বাস করে, পাড়াপড়শি নেই, নিরন্ন সংসার, তবুও অতিথি এসে ভীড় করে। ভেকের সংসারের মতো বহু অপত্যবিশিষ্ট দুঃখের জীবন।পদ(৩৩) এর ৩/৪ পর্ব গুলি তত্ত্বানুসন্ধিৎসুর নিকট গভীর অর্থবহ সন্দেহ নেই। কিন্তু দারিদ্রক্লিষ্ট গৃহিনীর জীবনটি স্বল্পতম রেখার সাহায্যে যেন ছোটগল্পের উপাদানে পরিণত হয়েছে। পদ (১০) এও তত্ত্বরসের অতিরিক্ত একটি আখ্যানের ইঙ্গিত আছে। কোথাও কোথাও পদকর্তা দুইচারিটি রেখার সাহায্যে অতি সহজেই পূর্ণতর চিত্রাঙ্কনে সক্ষম হয়েছেন। শুঁড়িনী চিকন বাকলে মদ বেঁধে রাখে।দুয়ারে সাংকেতিক চিহ্ন দেখে মদ্যপায়ীর দল হাজির হয়। সারি সারি চৌষট্টি সরায় সুরা ভরা আছে। তারা মদ গিলতে শুরু করলে আর উঠতেই চায়না। ছোট ছোট ঘড়ায় সরু নল দিয়ে মনের সাধে মদ গিলেই চলে। পদ(৩)। লক্ষণীয় যে, কত সহজে স্বল্পতম বর্ণনায় শুঁড়িবাড়ী ও মদ্যপায়ীদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
শুধু চিত্রধর্মই নয়, গোটাকয় প্রহেলিকাজাতীয় চর্যার রচনাকৌশলও প্রশংসনীয়। কাছিম জাহিয়া পাত্রে ধরছে না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খেয়ে ফেলে। উঠানকেই ঘরের মতো ব্যবহার করে।পদ(২)। কিংবা শাশুড়ি, ননদ, শালীকে মোর নাকে আনাত (অনাথ) করে কাহ্নপাদ কাপালিক হলেন।পদ(১২)। -"বলদ বিয়ালো,গাই বন্ধ্যা থাকলো।"- -"তিন সন্ধ্যা পাত্র ভরে ভালোই দোয়া হয়।"--"যে বুদ্ধিমান সেই বুদ্ধিহীন"-। -"যে চোর সেই সাধু।"- -"রোজই শেয়ালে সিংহের সঙ্গে শোয়।"- এই রহস্য সংকেত করে চর্যার ঢেন্ঢনপাদ বলেছেন -"ঢেন্ঢনপাদর গীতি বিরলে বুঝঅ।"- চর্যা(৩৩)।অর্থাৎ তাঁর গান কম লোকেই বোঝে।
এই কারণেই চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধ্যাভাষা বা সান্ধ্যভাষা বলা হয়।সন্ধ্যাবেলায় দিনের আলো নিবে গেলেও আঁধার পুরোপুরি নামে না। আলো আঁধারে একটা রহস্যময় অদ্ভূত সংমিশ্রণ ঘটে।চর্যাগীতি তেমনই এক রহস্যঘন দুর্বোধ্য ভাষা। যে ভাষাকে বুঝতে সম্যক ধ্যানের প্রয়োজন হয়। যদিও চর্যাকারগণ সম্পূর্ণ ধর্মীয় চেতনাবশে এগুলি রচনা করলেও তাঁদের মধ্যে রীতিমতো কবিত্বশক্তি ছিল।প্রতীকরূপের সাহায্যে চিত্রসৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানবচরিত্রের মধ্যে, সুখ-দুঃখ, বিরহমিলনের দৈনন্দিন জীবনচিত্রগুলি চর্যার দর্শন ও তত্ত্বের নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীবতা দান করেছে। অতএব প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্যে নিদর্শন হিসেবে চর্যাগীতির মূল্য অসামান্য।
(এই প্রবন্ধ লেখার জন্য আমি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের সম্পাদিত বৌদ্ধগান ও দোহা এবং চর্যাচর্যবিনিশ্চয় গ্রন্থে উল্লেখিত কিছু তথ্য এবং ডঃ শহীদুল্লাহ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন,পণ্ডিতগনের লেখা,ও ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসের ওপর বিভিন্ন বই থেকে তথ্যঋণ গ্রহণ করেছি। তাঁদের আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।)
শাক্তপদে পারিবারিক সমাজজীবন
ত প ন পা ত্র
বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর "আমরা" কবিতায় বলেছেন-"দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি,/আকাশে প্রদীপ জ্বালি,/আমাদের এই কুটীরে দেখেছি,/মানুষের ঠাকুরালি।" -কথাটি বাঙালি পরিবারে এবং এই বাংলার সমাজ জীবনে সর্বাংশে সত্য। কেননা বাংলার আকাশ, বাতাস, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর, কুটীর, রাজপথ সাধনার ধন প্রাণের দেবদেবীকে কল্পরাজ্যের স্বর্গে থাকতে দেয়নি, নামিয়ে এনেছে ধুলো ধূসরিত মর্ত্যের ধুলায়। তাই বাংলার সমস্ত ধর্মীয় সাহিত্যের মতো শাক্ত সংগীতেও সমসাময়িক পারিবারিক জীবন তথা সমাজ জীবন তথা মাতা-কন্যার সম্পর্কের বা বাৎসল্য রসের বিশেষ ছায়াপাত আমরা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করি।
শাক্ত পদাবলীর "লীলা" অংশে অর্থাৎ "বাল্যলীলা", "আগমনী" এবং "বিজয়া"র পদগুলিতে বাংলা সুপরিচিত সাংসারিক আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। পারিবারিক সমাজ জীবনের ছবি রয়েছে "ভক্তের আকুতি" পর্যায়ের গান অর্থাৎ শ্যামাসঙ্গীত গুলিতেও। এই চিত্র অত্যন্ত মধুর। সাধারণ পারিবারিক জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনার মর্মস্পর্শী বাণীরূপ বড়ই হৃদয়গ্রাহী।
সাধারণভাবে পিতা-মাতা এবং সন্তান-সন্ততি নিয়ে এ দেশের পরিবার গঠিত। বয়স্ক বয়স্কারাও থাকেন; ঠাকুমা, ঠাকুরদা। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশীদেরও একটা যোগ থাকে বৈকি। আনন্দ উৎসবের দিনে তাঁরা আনন্দে এবং দুঃখ-বেদনার দিনে বেদনায় অংশগ্রহণ করেন। আবার প্রতিবেশীদের সামাজিক সমালোচনাও যেকোনো পরিবারকে বিব্রত করে। কিছু কিছু সংসারে জামাতারও একটা বিশেষ প্রভাব নজরে আসে।
শাক্ত পদাবলীর আগমনী এবং বিজয়া পর্যায়ে বর্ণিত চরিত্রগুলি দেবাদিদেব মহাদেব, জগজ্জননী দুর্গা, গিরিরাজ হিমালয় এবং তাঁর স্ত্রী মেনকা। এঁরা সকলেই দেব চরিত্র কিন্তু শাক্ত কবিদের হাতে পড়ে যেন মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। এই সকল পদাবলীতে যে স্থানগুলির বর্ণনা আছে, সেগুলিও বাংলাদেশের চৌহদ্দীর মধ্যে এসে পড়েছে। কৈলাস পর্বত ও মানস সরোবর যেন আমাদের ডোবার ধারে, পানাপুকুরের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আগমনী ও বিজয়ার গানে যেমন শাশ্বত মানবিক আবেদন আছে, তেমনি আবার সেগুলি তৎকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজজীবনের সুস্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য দলিল-এ পরিণত হয়েছে।
বাল্যলীলার পদগুলিতে জগৎ জননী শ্যামা মায়ের অনন্ত লীলামাধুরী বর্ণিত হলেও দেবী এখানে স্নেহের দুলালী রূপে মর্ত্য জননীর কোলে আবির্ভূত হয়েছেন। রামপ্রসাদের একটি পদে মা মেনকা গিরিরাজ হিমালয়ের কাছে বলছেন, "আমার উমা সামান্য মেয়ে নয়", ... "ওহে কার চতুর্মুখ, কার পঞ্চমুখ, উমা তাদের মস্তকে রয়"। চতুর্মুখ ব্রহ্মা এবং পঞ্চানন শিব উমাকে মস্তকে ধারণ করেন, কন্যা উমা "রাজ-রাজেশ্বরী হয়ে হাস্য বদনে কথা কয়"। রাজ-রাজেশ্বরী দশমহাবিদ্যার মধ্যে দেবীর একটি রূপ। স্বপ্নে মেনকা দেবীর এইরূপ দর্শন করলেও বাস্তবে দৈনন্দিন জীবনে গিরিরাণী গিরিরাজের কাছে উমার অভিমান ও দুষ্টুমির কথা বলে অনুযোগ জানান- উমা অভিমান করে কাঁদে, মাতৃদুগ্ধ পান করতে চায় না। ক্ষীর, নবনীও খেতে চায় না। গগনে চন্দ্রোদয় হলে তা ধরে দিতে বলে। মায়ের আঙুল ধরে মাকে টেনে নিয়ে যায়। মা মেনকা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আকাশের চাঁদ ধরা যায় না। তখন উমা অলংকার দিয়ে মাকে প্রহার করতে যায়। স্ত্রীর কাছে কন্যা সম্পর্কে এ সব কথা শুনে গিরিবাজ কন্যার কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেন।
"উমা কেদেঁ করে অভিমান,/ নাহি করে স্তন্যপান/নাহি খায় ক্ষীর ননী সরে।।/অতি অবশেষ নিশি, গগনে উদয় শশী,/বলে উমা, ধরে দে উহারে।/কাঁদিয়ে ফুলালে আঁখি, মলিন ও মুখ দেখি,/মায়ে ইহা সহিতে কি পারে?/আয় আয় মা মা বলি, ধরিয়ে কর-অঙ্গুলি,/যেতে চায়, না জানি কোথা রে।/আমি কহিলাম তায়, চাঁদ কি রে ধরা যায়,/ভুষণ ফেলিয়া মোরে মারে।।/উঠে বসে গিরিবর, করি বহু সমাদর/গৌরীরে লইয়া কোলে করে।।"
আবার কবি রাধিকাপ্রসন্নের একটি পদে মা মেনকা বলছেন- "আর জাগাস্ নে মা জয়া, অবোধ অভয়া,/কত করে' উমা এই ঘুমালো।/মা জাগিলে একবার , ঘুম পাড়ানো ভার . . . " জয়া যেন উমাকে না জাগায়। চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে উমা, তাকে ঘুম পাড়ানোই দায়। এখানে মা মেনকার কথাটি একেবারে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের আটপৌরে মায়ের মতন।
কালী মির্জা বা কালিদাস চট্টোপাধ্যায়ের বাল্যলীলা পর্যায়ের একটি পদে দেখছি, গিরিবালিকা মা মেনকার হাত ধরে চলেছেন, কখনো বা সখীদের সঙ্গে তিনি খেলা করছেন, সখীরা তাঁর "কালী" নামটি ধরে ডাকছেন। এই কালী বা কালিকাই এখানে গিরিবালিকা। "চঞ্চল চরণে চলে অচল নন্দিনী, .........../ জননীর হাতে-ধরা, হাঁটিছে সুধা অধরা/সব সখী সঙ্গে খেলে ,কালী কালী বলে..." এই পদে হাড়-মাংস, শিরা-উপশিরায় গড়া মানবী উমার মধ্যে যেমন দেবীর মহিমা কীর্তিত হয়েছে, তেমনি আবার পারিবারিক জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে, সখীদের সঙ্গে উমার খেলাধুলার ইঙ্গিতটি ব্যক্ত হয়েছে।
আবার যখন বর্ষা বিগত প্রায়, মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ, এখানে-ওখানে কাশফুলের দোলা, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, পুকুরে দীঘিতে পদ্ম শালুকের লুকোচুরি, ভোরের শিরশিরে বাতাসে কনে বউয়ের মতো হলুদ বোঁটার সাদা ফুল শিউলি টুপ্ টুপ্ করে ঝরে পড়ছে; রোদ্দুরের লেগেছে চাঁপা ফুলের রং, তখন মা মেনকা বলছেন- "সুনীল আকাশে ঐ শশী দেখি,/কৈ গিরি,/আমার কৈ শশীমুখী.........../শরতের বায়ু যখন লাগে গায়,/উমার স্পর্শ পাই,/প্রাণ রাখা দায়/যাও যাও গিরি, আনগে, উমায়,/উমা ছেড়ে আমি কেমন করে রই।"
গোবিন্দ চৌধুরীর লেখা আগমনী পর্যায়ের এই পদটিতে উমা-জননী মেনকা তাঁর অন্তর্বেদনার কথা গিরিরাজ এর কাছে প্রকাশ করেছেন। নির্মল নীল আকাশে শরতের চাঁদ উঠেছে, কিন্তু গৌরীর মুখশশী এখনও দেখা যাচ্ছে না। উমার বর্ণ নিয়ে শিউলির আগমন ঘটেছে, কিন্তু সে এখনো এলো না। শরতের মৃদু শীতল বায়ু গায়ে এসে লাগছে, উমার স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। মায়ের প্রাণ রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই গিরিরাণী গিরিরাজকে অনুরোধ জানাচ্ছেন উমাকে পিতৃভবনে নিয়ে আসার জন্য।
আমাদের শাস্ত্র বিধান দিয়েছে, "অষ্টম বর্ষে ভবেদ গৌরী"। স্বাভাবিকভাবেই উমা আট বছরে পদার্পণ করলেই পুণ্য লাভের আশায় গিরিরাজ হিমালয় তাকে পাত্রস্থ করেছেন, এখন সুদূর কৈলাস থেকে বৎসরান্তে মাত্র তিন দিনের জন্য কন্যার আগমনকে কেন্দ্র করে যে সকল করুণ বিষয়গুলি শাক্ত সংগীতে বর্ণিত হয়েছে তাতে মেনকা আমাদের বাঙালি ঘরের মা হয়ে উঠেছেন। মনে মনে যখন কন্যাকে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন, গিরিরাজ কে এ বিষয়ে অনুনয়-বিনয় করছেন, তখনই গিরিরাজের কাছে বলছেন- "গিরি, এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না।/বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।।/যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, উমা নেবার কথা কয়-/এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া জামাই বলে মানবো না।"
-এবার কোনমতে একবার কন্যা উমা বাপের বাড়িতে এলে তাকে আর শ্বশুরবাড়িতে পাঠাবেন না মা মেনকা। এতে যদি লোকে নিন্দা করে, অপবাদ দেয়, তাতেও কারো কথায় তিনি কান দেবেন না। এমনকি স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয় অর্থাৎ জামাতা মহাদেব যদি এসে মাকে নিয়ে যাবার আবেদন জানায়, তবুও তিনি পাঠাবেন না বরং মা ও মেয়ে জোট বেঁধে ঝগড়া করবেন, জামাইয়ের সম্মানটুকুও রাখবেন না।
কন্যা উমার জন্য মা মেনকার নিদ্রাতেও শান্তি নেই। দুঃস্বপ্নের অতর্কিত আক্রমণে জেগে ওঠেন এবং গিরিরাজকেও জাগান। "কুস্বপন দেখেছি গিরি উমা আমার শ্মশানবাসী;/অসিতবরণ উমা মুখে অট্ট অট্ট হাসি/........../উঠে হে উঠ অচল, পরান হল বিকল,/ত্বরায় কৈলাসে চল, আন উমা সুধারাশি।"
শারদীয় দুর্গাপূজার সময় উমা পিতৃগৃহে আসবে তার আগেই হতদরিদ্র পরিবারের কন্যার দুরবস্থার কথা ভেবে মায়ের উদ্বেগ ও ব্যাকুলতার অন্ত নেই। মেনকা এখানে স্নেহময়ী চিরন্তনী জননী। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন উমা শ্মশানবাসিনী। তার গৌরবর্ণ কালো হয়েছে। মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে সে অট্টহাসি হাসছে। ভিখিরির সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ের জীবনে সুখ-শান্তির কণামাত্র নেই কোনোদিন। এখানে পৌরাণিক তত্ত্ব বঙ্গ-মৃত্তিকার জীবন রসে প্লাবিত হয়েছে। উৎকণ্ঠায় ও আবেগের মাঝে মেনকার কন্যাবাৎসল্য মাতৃমূর্তিকে জীবন্ত, প্রাণবন্ত করে তুলেছে। উমার জন্য মা মেনকার জাগরণে অশান্তি ও দুশ্চিন্তা আর নিদ্রায় শুধু মন্দ স্বপ্ন। মা মেনকা তাঁর স্বপ্নকথা স্বামীর কাছে বর্ণনা করেছেন। কন্যাকে তিনি স্বপ্নে দর্শন করলেন কিন্তু গিরিরাজ অচৈতন্য হয়ে নিদ্রা যাচ্ছেন। ওদিকে তার কন্যা একাকিনী শ্মশানবাসিনী। চারদিকে শুধু শেয়ালের ডাক। গিরিরানী প্রায় চোখের জলে ভাসছেন। গৌরী সঠিক কেমন আছে, সে খবর কে আর এনে দেবে? "আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে!/গিরিরাজ অচেতনে কত না ঘুমাও হে /............../আর শুন অসম্ভব চারিদিকে শিবা-রব হে।/তার মাঝে আমার উমা একাকিনী শ্মশানে।/বল কি করিব আর, কে আনবে সমাচার হে?/না জানি মোর গৌরী আছে কেমনে !" আগমনী পর্যায়ের এই পদটি মনস্তাত্ত্বিক এবং তত্ত্বগত মূল্যে ভরপুর। সে সময় কুল রক্ষার তাগিদে কুলীন ঘরের মেয়েকে ভিখারি নেশাগ্রস্ত বৃদ্ধ পাত্রের হাতে সমর্পন করতে হয়েছে। মায়েরা বহুবিবাহে বিবাহিত জামাইয়ের কারণে মেয়ের দুর্দশার কথা ভেবে বেদনা দীর্ণ হৃদয়ে কাল কাটিয়েছেন।
দাশরথি রায়ের একটি পদে মা মেনকা গৌরীকে স্বপ্নে দর্শন করেছেন। সে স্বপ্নে দেখা দিয়ে চৈতন্য করিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই অন্তর্ধান হয়েছে।তাই মা বলছেন- "দেখা দিয়ে কেন হেন মায়া তার!/মায়ের প্রতি মায়া নাই মহামায়ার।/আবার ভাবি গিরি, কি দোষ অভয়ার/পিতৃদোষে মেয়ে পাষাণী হলো।।"
মায়াবিনী কন্যা তার সম্মোহনী শক্তি দিয়ে দেখা দিয়েও অদৃশ্য হয়ে গেল। মায়ের প্রতি মহামায়ার দয়া মায়া নেই। অভিমান বসত মেয়েকে অপবাদ দিতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ বলছেন, কন্যার কোন দোষ নেই। তার পিতা যেহেতু পাষাণ, তাই কন্যাও পাষাণ হৃদয় হয়ে উঠেছে। এই অভিমান, অভিযোগ বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পায় না। দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে শুধু দুশ্চিন্তা। কবি হরিশচন্দ্র মিত্র তাঁর আগমনী পর্যায়ের একটি পদে বলছেন,"বাছার নাই সে বরণ, নাই আভরণ,/হেমাঙ্গী হইয়াছে কালীর বরণ;/হেরে তার আকার, চিনে উঠা ভার, সে উমা আমার উমা নাই হে আর।" পদটিতে পারিবারিক জীবনের একটি বিশেষ দিক ফুটে উঠেছে। সমকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক দুর্দশার চিত্রটি চিত্রিত হয়েছে। কৌলিন্য প্রথার চাপে অনন্যোপায় পিতা-মাতা বৃদ্ধ ভিখারির সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন নিজের ৮ বছরের মেয়ের। অভাবের চাপে, দুঃখে, মনোবেদনায় প্রিয় কন্যার গাত্রবর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মেয়ের সোনার বরণ কালো হয়েছে। তার চেহারা দেখে তাকে চেনা যাচ্ছে না।
এই দুর্দশার কথার পরিচয় পেয়ে যাই ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তেরও একটি পদে- "তুমি তো অচল পতি, বল কি হইবে গতি,/ভিক্ষা করে ভগবতী কুমারী আমার।/বাঁচি বল কার বলে,/দুঃখানলে মন জ্বলে,/ডুবিল জলধি-জলে প্রাণের কুমার।"
অন্তর্বেদনায় জর্জরিত হয়ে গিরিরাজের কাছে মেনকা বলছেন, কন্যার জন্য হৃদয়হীন গিরিরাজের কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। মেনোকা সংবাদ পেয়েছেন স্বামীগৃহে স্নেহের দুলালী উমা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করছে। কিছুদিন আগেই পুত্র মৈনাক জলে ডুবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। এখন মেয়ের এই দুর্দশা। তাই দুঃখ যন্ত্রণার মর্মদাহে দগ্ধ হচ্ছেন মেনকা। হিমালয় তো পাষাণ হৃদয়, খুবই নির্মম, নিষ্ঠুর; মেয়ের কথা তিনি আদৌ ভাবেন না।
কন্যাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা যে যথেষ্ট কারণ রয়েছে, তার পরিচয় পাচ্ছি কমলাকান্তের গানে- "হরের বসন বাঘছাল, ভুষণ হাড়মাল,/জটায় কাল-ফণি দুলিছে।/শিবের সম্বল ধুতুরারি ফুল/কেবল তোমারই মন ভুলেছে।।/একে সতীনের জ্বালা, না সহে অবলা, যাতনা প্রাণে কত সয়েছে।"
জামাই-শিব নেশাখোর। তার সম্বল ধুতুরার ফুল। পরণে বাঘছাল। জটায় ফণী। মেয়ের সতীন গঙ্গাকে শিব খুব আদর স্নেহ করে। উমার প্রতি অবহেলা অনাদর করে। সতীন সর্বদা উমাকে নানান কটু কথায় যন্ত্রণা দেয়। উমার অন্তহীন জীবন যন্ত্রণা। তাই মা মেনকা বলছেন- "আমি শুনেছি শ্রাবণে, নারদ বচনে,/উমা মা মা বলে কেঁদেছে।" কারণ "ঘরেতে সতিনী জ্বালা সদা করে ঝালাপালা", আর "সারাদিন ঘরে ঘরে ভোলানাথ ভিক্ষা করে"।
তাই মায়ের মন আর ধৈর্য ধরছে না। বারবার গিরিরাজকে অনুরোধ করছেন মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য। তিনি বলছেন- "কবে যাবে বল গিরিরাজ, গৌরীরে আনিতে।/ব্যাকুল হৈয়েছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে।"
কখনো বলছেন- "যাও গিরিবর হে, আনো যেয়ে নন্দিনী ভবনে আমার।/গৌরী দিয়ে দিগম্বরে, কেমন রয়েছো ঘরে,/কি কঠিন হৃদয় তোমার হে।"
নিধুবাবু মানে রামনিধি গুপ্তও মেনকার কন্ঠে প্রায় একই কথা বসিয়েছেন- "গিরি, কি অচল হলে আনিতে উমারে,/না হেরি তনয়া-মুখ হৃদয় বিদরে।/ত্বরান্বিত হও গিরি, তোমার করেতে ধরি,/উমা 'ও মা-' বলে দেখো ডাকিছে আমারে।"
আর অন্ধ চন্ডী বলছেন, "আন তারা ত্বরায় গিরি,/নয়নে লুকায়ে রাখি,/হেরিয়ে গগন তারা, মনে হল প্রাণের তারা,/শুনেছি তারা কে নাকি পাঠাবে না তা'রা।"
আসলে শরৎ আসতেই মায়ের মনে আর ধৈর্য ধরছে না। মেনকা বারবার গিরিরাজ কে কৈলাসে যেতে অনুরোধ করছেন। শুধু মেয়েকে নয়, জামাই নাতি নাতনি এবং প্রতিবেশীদেরও আমন্ত্রণ জানাতে বলছেন। মেনকার বক্তব্যের মধ্যে একজন সমাজ সচেতন নারীর প্রগাঢ় অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে রাম বসুর একটি পদে। পদটি হল- "গিরি হে তোমায় বিনয় করি, আনিতে গৌরী,/যাও হে একবার কৈলাসপুরে।"
কিন্তু অচল, পাষাণ প্রাণ গিরিরাজের টনক নড়ে না মেনকার পুনঃপুনঃ অনুরোধেও। মনোমোহন বসু তাঁর একটি পদে মা মেনকার মুখ দিয়ে বলছেন, গিরিরাজ আর কবে প্রাণের কন্যা উমাকে আনতে যাবেন? তিনি যদি মা হতেন, তাহলে মায়ের বেদনা কী তা বুঝতে পারতেন। তখন তিনি আর কন্যাকে আনার বিষয়ে ছলনা করতেন না। মেনকার প্রাণ কাঁদছে কিন্তু হিমালয় নির্বিকার। নিষ্ক্রিয়। মা মেনকা কল্পনা করছেন, উমা এবং পাড়া-প্রতিবেশীরা যদি আমাকে পাষাণী বা হৃদয়হীনা বলে দোষারোপ করে, তবু অসহায় আমার কিছু করার নেই। কেমন করে বোঝাবো আমি আমার মাতৃ হৃদয়ের যন্ত্রণা? "উমা ভাবে মা পাষাণী, লোকেও কয় পাষাণী রাণী,/আমি যে পাষাণ-অধিনী, এ কাহিনী কেউ জানে না।"
অবশেষে গিরিরাজের মন গলেছে, তিনি বলছেন- "আর কেন কাঁদো রাণী, উমারে আনিতে যাই।" তিনি কন্যার গৃহে পৌঁছে উমাকে বলছেন, তার মায়ের বেদনাঘন অন্তরের হাহাকারের কথা। এবং জামাইয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে বাপের বাড়িতে আসার কথা। পিতার মুখে সমস্ত কথা শুনে কন্যা উমা দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে গিয়ে প্রায় অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলছেন- "ওহে ত্রিলোচন শুন মোর বচন/যাব মোর পিতার ভবন।/সপ্তমী দিনেতে যাব অষ্টমী নবমী রব/দশমী দিনেতে ফিরবো তোমার ভবনে।"
দুর্গার অশ্রুসিক্ত বিষন্ন বদন দেখে মহাদেব দরদের সঙ্গে জানালেন- "জনক ভবনে যাবে, ভাবনা কি তার? আমি তব সঙ্গে যাব, কেন ভাব আর!/আহা আহা মরি মরি বদন বিরস করি,/প্রাণাধিক প্রাণেশ্বরী কেঁদো নাকো আর।/.........../প্রাণপ্রিয়ে যাবে যথা, সঙ্গে সঙ্গে যাব তথা,/ক্ষণমাত্র সঙ্গ ছাড়া হব না তোমার।"
পিতার সঙ্গে কন্যা উমা বাপের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। গিরিরাজ বলছেন , "গিরি রাণী এই নাও তোমার উমারে। ধরো ধরো হরের জীবনধন।" উমাকে তার পিতা কৈলাস ধাম থেকে নিয়ে এসেছেন। মেনকার হাতে সমর্পণ করেছেন। জানিয়েছেন হরের প্রাণধন উমাকে তিনি নিয়ে এসেছেন বহুকষ্টে শিবকে তুষ্ট করে।
উমাকে কাছে পেয়ে মা মেনকার আনন্দে অশ্রু ঝরছে। নারদ সহ অন্যান্য কত লোকের মুখে হর-পার্বতীর দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণা নিয়ে কত কথাই না শুনেছেন গিরিরাণী, বেদনায় তাঁর মাতৃহৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। আজ কাছে পেয়ে তিনি মেয়েকে বলছেন- "ওমা কেমন করে পরের ঘরে/ছিলি উমা বল মা তাই।/কত লোকে কত বলে,/শুনে ভেবে মরে যাই।/মা'র প্রাণে কি ধৈর্য ধরে,/জামাই নাকি ভিক্ষা করে!/এবার নিতে এলে, বলবো- হরে, উমা আমার ঘরে নাই।"
কিন্তু মায়ের কাছে কন্যা উমা মায়ের দুর্ভাবনা দূর করার জন্যে বলছেন -- মা, আমি হরগৃহে বড়ো সুখে আছি । কে তোমায় বলেছে, তোমার জামাই শ্মশানবাসী। যে ঘরে আমার বসবাস তার শোভা বর্ণনায় আমি অপারগ। বহু মণিমাণিক্য খচিত সেই গৃহে সর্বদা রাশি রাশি রবি শশীর উদয়। সেই অতুলনীয় আলোকমালায় দিনরাতের ব্যবধান পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই। তোমার জামাই বাঘ ঝাল পারেন, গায়ে ছাই মাখেন আর মাথায় জড়িয়ে রাখেন সাপ- এ কথা সত্য। কিন্তু তিনি বিশ্বেশ্বর। এই জগতের সর্বময় কর্তা। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র পারিজাত ফুল নিয়ে তাঁর চরণে প্রণাম জানান। বাহিরের রূপ দেখে তোমার জামাইকে সাধারণ মানুষ চিনতে পারেন না মা। তিনি ষড়ৈশ্বর্যৈর অধিকারী। ভিক্ষা তাঁর জীবিকা হতে পারে না। একথা সত্য যে সুরধনী নামে আমার সপত্নী আছে, কিন্তু তাকে ঘিরে আমার দুঃখের কোন কারণ নেই। সে বড়ো দিদির মতো আমাকে ভগ্নিজ্ঞানে আদর করে।
-অম্বিকাচরণ গুপ্তের লেখা "ছিলাম ভাল জননী গো হরেরি ঘরে" -পদটিতে উমার জবানী শুনে মা মেনকার হৃদয় শান্ত হয়েছে কি না আমরা জানি না। তবে মায়ের বেদনা কন্যা বুঝতে পারছে না বলে, মা বলছেন- "বুঝাবো কি মায়ের ব্যথা, গনেশকে তোর আটকে রেখে"। উমা কিন্তু মায়ের কাছে নিজের সন্তান সন্ততি পরিবৃত সংসারের কথা বলে এবং তাড়াতাড়ি স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে চায়। মা বলেন- "এসেছিস মা, থাক না উমা দিন কত।"
কিন্তু উপায় নেই । মাত্র তিন দিনের জন্য জামাইয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে উমা এসেছে। বিজয়াদশমীর সকালে তাকে ফিরে যেতে হবে। তাই মা মেনকার জীবনে নবমীর রাত্রি কালরাত্রি। তিনি কখনো ভাবছেন- "কালকে ভোলা এলে বলবো, উমা আমার নাইকো ঘরে।" আবার কখনো বা নবমীরাত্রিকে অতিশয় খলনারী রূপে কল্পনা করে নিন্দাবাদ করছেন। বলছেন- "খলের প্রধান যত, কে আছে তোমার মত।/আপনি হইয়ে হত, বধরে পরেরি প্রাণ।"
কখনো বা অনুনয়-বিনয় করছেন- "যেও না রজনী, আজি লয়ে তারাদলে।/গেলে তুমি দয়াময়ী, এ পরাণ যাবে!/উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে,/নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে।"
কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ হয় না। প্রাকৃতিক নিয়ম কে খন্ডাবে? একসময় নবমী নিশি ভোর হয়। "কি হলো, নবমী নিশি হইল অবসান গো।/বিশাল ডমরু ঘন ঘন বাজে, শুনি ধ্বনি বিদরে পরণ গো।"
দশমীর সকাল হতে না হতেই মহাদেব গৌরী কে নিয়ে যাবার জন্য এসে উপস্থিত। "বিছায়ে বাঘের ছাল, দ্বারে বসে মহাকাল।/বেরোও গণেশ মাতা ডাকে বারবার।"
কন্যা বিচ্ছেদ ব্যাকুল মেনকার যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয়ের ছবি ফুটে উঠেছে বিজয়ার পদগুলিতে। মা ভেবেছিলেন মায়ে-ঝিয়ে ঝগড়া করে হলেও জামাইকে ফেরত পাঠাবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কন্যা উমাই আর দেরি করতে চায় না।
উমা মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে ছেলেমেয়েদের সাথে করে কৈলাস অভিমুখে রওনা দিচ্ছে। মা মেনোকা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলছেন- "এস মা এস মা উমা/বলো না আর যাই যাই/মায়ের কাছে হৈমবতী/ও কথা মা বলতে নাই।।"
উমা চলে যায় । তখন মা মেনকার একমাত্র সান্ত্বনা- "ভালোবাসি যারে, সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।"
তাই আমরা এতটুকু দ্বিধা না করে বলতে পারি, শাক্ত পদাবলীর লীলাপর্ব হলো পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালে বাংলার পারিবারিক সমাজজীবনের সংগীতময় বাণীরূপ। তবে লীলাপর্বের পদগুলি ছাড়াও অন্য পদে যেমন ভক্তের আকুতিতেও এই পারিবারিক জীবনের ছবি দুর্লভ নয়। ভক্তের আকুতি পর্যায়ে মায়ের প্রতি সন্তানের যে মাতৃভাবের বর্ণনা পাই, তা-ও লৌকিকভাবেই পরিপূর্ণ। স্নেহ-আদায়ের ছলে সন্তানের অভিমান, অনুযোগ, ক্রোধ, সংশয়, একান্ত নির্ভরতা প্রকাশ পেয়েছে অত্যন্ত জীবন্ত রূপে। সন্তান চিত্র সেখানে প্রাণবন্ত। এমন স্নেহের লুকোচুরি, এমন মনের কথা বলাবলি শাক্তপদ ছাড়া বুঝি পৃথিবীর আর কোনো ভাষার কোনো সাহিত্যে নেই।
কাব্য-সত্য
র ঞ্জি ত রা য়
বিখ্যাত কূটনীতিক সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলীর প্রয়াণের প্রায় মাস তিনেক আগে আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁর লেখা একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করে। প্রবন্ধটি ছিল মূলতঃ তাঁর কাকা সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীকে নিয়ে। সেই প্রবন্ধে নানা মূল্যবান তথ্য থাকলেও একটা আপাত- তুচ্ছ প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছিল। বিষয়টা ছিল, একদা তিনি তার কাকা সৈয়দ মুজতবা আলীকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি যখন কাবুলে থাকতেন তখন কি 'শবনম' নামে একজন মহিলা তার গৃহে নিয়মিত আসতেন? উত্তরে মুজতবা আলী বলেছিলেন যে, সে সময়ে তার গৃহে একজন মহিলা আসতেন দুধ দিতে, যার বয়স ছিল ৮০ বছর। এরপর মুজতবা আলী সাহেব একটু মজা করে বললেন", আমার ভাইপো যে এমন গাঁড়ল তা তো জানতাম না!"
এইযে প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম, এর কারণ হলো লেখক কর্তৃক শবনম চরিত্রের যথাযথ প্রাণ প্রতিষ্ঠা অথবা তাকে রক্তমাংসের মানবী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লেখক আলী সাহেবের মুন্সিয়ানা। ঠিক এই কারণেই আমি নিজে যখন 'শবনম' উপন্যাস পড়েছিলাম, তখন আমারও মনে হয়েছিল যে, শবনম বাস্তবেই ছিল। এটাই কাব্য সত্য বা সাহিত্যিক সত্য যা বাস্তব না হয়েও বাস্তব হিসেবে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন পায়। 335 B.C তে রচিত অ্যারিস্টটলের Poetics গ্রন্থে কাব্যসত্য সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, তার ইংরেজি করলে হয়,"not what has happened but may happen in accordance with the law of probability." অর্থাৎ যে ঘটনা হয়তো ঘটেনি কিন্তু ভবিষ্যতে ঘটতেও পারে, অন্তত ঘটা অসম্ভব নয়, সেই ঘটনা নিয়ে লেখা কাব্য সত্য বলে বিবেচিত হবে।
আমরা ২০০০ এর ও অনেক বেশি বছর পরে অর্থাৎ আধুনিককালে যদি অনুসন্ধান করি, তবে দেখব, রবীন্দ্র রচনাতেও এর প্রায় অনুরণন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ভাষা ও ছন্দ ' কবিতায় শুরুতে রামায়ণ রচনার নেপথ্যে যে পুরান কাহিনী রয়েছে তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে মূল ঘটনায় চলে এসেছেন। সেই নেপথ্য কাহিনী আমরা কম বেশি সবাই জানি যে, তমসাতীরে মহর্ষি বাল্মীকি মৃদু পদবিক্ষেপে যখন চলেছিলেন, তখন দেখলেন এক অপরূপ দৃশ্য ---ক্রৌঞ্চ- ক্রৌঞ্চী মিথুনরত অবস্থায় আনন্দ ক্রীড়ায় রত। আর তারপরেই ঋষি দেখলেন এক ভয়াবহ ঘটনা। এক ব্যাধ নিষ্ঠুর ভাবে শরবিদ্ধ করে ক্রৌঞ্চকে বধ করল আর ক্রৌঞ্চী সেই শোকে বিলাপ করতে লাগলো। এই দৃশ্য ঋষি কবির হৃদয়কে দ্রবীভূত করলো। তাঁর মনে উপজাত শোক শ্লোক হয়ে অনুস্টুপ ছন্দে অভিশাপ বাণী রূপে ব্যাধের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হলো,
মানিষাধপ্রতিষ্ঠাংতমগমশাশ্বতীসমাঃ
যৎক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধিকামমোহিতাম ।
(ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর মিলনাবস্থায় নিষ্ঠুর ভাবে শর নিক্ষেপ যে ক্রৌঞ্চকে বধ করলে, হে ব্যাধ, আমি অভিশাপ দিচ্ছি, কোনদিন সমাজে তোমরা প্রতিষ্ঠা পাবে না।)
এই স্বর্গীয় ধ্বনিতে উচ্চারিত শ্লোকে কবি নিজেই মুগ্ধ ও চমৎকৃত হলেন। এর পরের ঘটনাও কম বেশি অনেকেরই জানা, সেই দিন সন্ধ্যাবেলায় সেই তপোবনে পিতামহ ব্রহ্মা কর্তৃক প্রেরিত হয়ে মুনি সমীপে এলেন দেবর্ষি নারদ। ঋষি কবিকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
"এই ছন্দে গাঁথি লয়ে কোন্ দেবতার যশঃকথা,
স্বর্গের অমরে কবি, মর্তলোকে দিবে অমরতা ।"
বলাবাহুল্য, কবি কোন দেবতার যশোকথা বর্ণনা করতে চাননি, তিনি চেয়েছেন কোন 'নরচন্দ্রমাকে' নিয়ে কাব্য রচনা করতে, যিনি হবেন পূর্ণ মনুষ্যত্বের আধার। নারদ জানালেন সেই 'নরচন্দ্রমা' হলেন অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র। কবি বললেন, তিনি রামচন্দ্র সম্পর্কে কিছু শুনেছেন বটে কিন্তু সম্যকভাবে তিনি তাঁর সম্বন্ধে জানেন না। পাছে মিথ্যাচারদোষ ঘটে বলে কবি রাম কাহিনী রচনায় কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত হন। তখন নারদ তাকে সেই চরম কথাটি বলেন যাকে আমরা বলি কাব্য সত্য----
"সেই সত্য যা রচিবে তুমি
ঘটে যা তা সব সত্য নহে,
কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান/ অযোধ্যার চেয়ে সত্য যেন ।"
লক্ষণীয় এখানে নারদ বর্ণিত তথা রবীন্দ্র কথিত কাব্য- সত্য সম্পর্কিত কথাগুলি aristotle এর কথারই অনুরণন বলে মনে হয়।মোদ্দা কথা, কাব্যসত্য হলো তাই, যা কবির সৃষ্টি- নৈপুণ্যের গুণে উপস্থাপিত অসাধারণ কাহিনী অথবা কবিসৃষ্ট অসাধারন চরিত্রগুলো চিরকালীন সত্য হয়ে ওঠে, যা বাস্তবের চরিত্রগুলো হয় না। অর্থাৎ কোটি কোটি মানুষ পৃথিবীতে আসছে আবার তারা হারিয়েও যাচ্ছে কিন্তু তারা কেউ অমরত্ব পাচ্ছে না। অথচ কবিসৃষ্ট রাম-সীতারা বা কৃষ্ণ-রাধারা অমরত্ব পেয়ে চিরকালীন সত্য হয়ে উঠছে। এখানে কবি প্রজাপতি ব্রহ্মার মত স্রষ্টা। ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টি করেন আর কবি কাব্য সৃষ্টি করেন, অসাধারণ চরিত্র সৃষ্টি করেন। তাই বলা হয়,
"অপারে কাব্য সংসারে কবিরেক প্রজাপতি" আর তাঁর সৃষ্টি নৈপুণ্যের গুণে তার সৃষ্ট কাহিনী ও চরিত্র চিরসত্য হয়ে চিরকাল মানুষকে কাঁদায়, হাসায়, আনন্দ ও বেদনা দেয়। আমাদের ঘরের কাহিনী, পরিচিত কাহিনী ততটা সত্য নয়, যতটা রাম, সীতা, কৃষ্ণ বা রাধাদের কাহিনী সত্য বলে মনে হয়। এটাই কাব্য সত্য।
সরল প্রক্ষেপন: ড. সৌমিত্র শেখরের “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নজরুল"
ভী ষ্ম দে ব বা ড়ৈ
বইটির প্রচ্ছদ দেখেই আমার ভীষণ লোভ হয়েছিলো। কি মায়া মায়া হৃদয়কাড়া প্রচ্ছদ- রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "শাল বনের নীলাঞ্জন"। হ্যাঁ বলছি- আমার শিক্ষাগুরু খ্যাতিমান লেখক ও অধ্যাপক, নজরুল গবেষক ড. সৌমিত্র শেখরের লেখা "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নজরুল" বইয়ের কথা। ভীষণ গতিময় এবং প্রাণময় এ বইটি যেন নজরুল সম্বন্ধে এক ‘কালের সাক্ষ্য’- পুরাকালের ‘গোপন সিন্ধুক’।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৬ সনে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলেও জীবদ্দশায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন পাঁচ বার। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর এ আগমন, একবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে নয়। সুস্থ অবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কোন সম্মাননা বা সংবর্ধনাও পাননি- জাতি হিসেব এ এক গভীর লজ্জা ও বেদনার বিষয়। আরো অবাক হওয়ার ব্যাপার, ঢাকা থেকে কাজী নজরুলে ইসলামের লেখা প্রকাশ হয়েছে লেখক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা পাবার অন্ততঃ ছয় বছর পর! বইটিতে উঠে এসেছে- নজরুলের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা শিক্ষার্থী ফজিলাতুন্নেসা, রানু সোম এবং উমা মৈত্রের সম্পর্ক।
বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ- "নজরুলের সমাধি: কাজী সব্যসাচীর কান্না"- কি হৃদয় বিদারক ঘটনা! জীবদ্দশায় কাজী নজরুলের শেষ ইচ্ছা ছিলো তাঁর সমাধি যেন চুরুলিয়াতে সহধর্মিণী প্রমীলার সমাধির পাশে হয়। কিন্তু তদানীন্তন বাংলাদেশের সামরিক সরকার তাঁর বা তাঁর ইচ্ছাকে এতটুকু গুরুত্ব দেয়নি। বরঞ্চ সরকারের হীন উদ্দেশ্য ছিলো- নজরুলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিম জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে ক্ষমতায় টিঁকে থাকা। এ কারণে কাজী সব্যসাচী ও পুত্রবধূ কল্যানী কাজীকে সামরিক সরকার ভিসা প্রদানেও গড়িমসি করে, তাঁদের এদেশে আসতে বিলম্ব করায়। বেঁচে থাকা একমাত্র পুত্রও তাঁর পিতার মুখ শেষবারের মতো দেখতে পারেননি- এর চেয়ে বেদনা আর নিষ্ঠুরতা কি হতে পারে?
"নজরুলের বিয়ে এবং প্রমীলা" প্রবন্ধে ড. সৌমিত্র শেখর অনেকগুলো প্রচলিত ভ্রান্তি তিনি অকাট্য যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে দূর করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ১৯২৪ নজরুল প্রমীলার বিয়ে মুসলমান রীতিতে (প্রচলিত ধারণা) হয়নি, হয়েছে- আহলুল কিতাব (কিতাবওয়ালা) রীতিতে। এই রীতি অনুসারে স্ত্রীরা আপন আপন রীতি ও ধর্ম পালন করতে পারবেন। তিনি প্রমাণের সহিত আরো দেখিয়েছেন- প্রমীলা বিয়ের পর "প্রমীলা নজরুল" নাম ধারণ করেননি- তবে পরবর্তীকালে তিনি সংস্কারবশত পেনশন বা অন্য কাগজে স্বাক্ষর দেবার সময় নিজের নাম "প্রমীলা নজরুল ইসলাম" হিসেবেই লিখতেন।
ড. সৌমিত্র শেখর "বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় কাজী নজরুল ইসলাম" প্রবন্ধে লিখেছেন- বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আদর্শিক ধ্রুবতারার মতো। বঙ্গবন্ধু নিয়মিত সওগাত, মোহাম্মদী, আজাদ পত্রিকা রাখতেন। এসব পত্রিকায় নজরুল লিখলেন, তাই কাজী নজরুল ইসলামের রচনা ও তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য ও পরিচয় কিশোর বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধু পেয়ে পেয়েছেন। কাজী নজরুলের অনেক কবিতা ও গান ছিলো মুক্তি যুদ্ধের প্রেরণা। 'জয় বাংলা' স্লোগান কিভাবে আসলো তা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর একটি প্রবন্ধে। আর তাঁর লেখাতে উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯৭১ সনে বঙ্গবন্ধু ছিনিয়ে আনেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকাতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। তিনি তাঁর ভাতাসহ চিকিৎসা ব্যবস্থা করান। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করেন, তাঁর বাসভবনে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো।
বইটিতে নজরুল এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ নেতাজি সুভাষ বসু সম্বন্ধে রয়েছে গভীর ও অনেক অজানা আলোচনা।
বইটি পড়ে একটি মজার তথ্য আমরা জানতে পারি; বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব ঘটে একজন কবি হিসেবে নয়- একজন উপন্যাসিক হিসেবে, সর্বশেষ সংযোজন কাব্যগ্রন্থ। এই বইয়ে কবির মাত্র চার মাস ব্যাপীর কালজয়ী পত্রিকা 'লাঙল' নিয়েও আছে চমৎকার ইতিহাস।
তৎকালীন সময়ে সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলন যেখানে মূলতঃ উচ্চ শ্রেণী এবং শিক্ষিত মহলে সীমাবদ্ধ ছিলো, কাজী নজরুল ইসলাম গান, কবিতা, লেখা তথা সশরীরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে আসলেন।
নজরুল আমাদের; কিন্তু আমারা কোন নজরুলকে চাই? নজরুল মানে কি দু'একটি কবিতা বা কিছু গান? নজরুলের প্রায় চার হাজার গান থেকে আমরা বিশ-পঁচিশটির বেশী গান কি জানি বা শুনি? আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তাঁর পঞ্চাশটি গান শুদ্ধ করে গাইতে পারেন, এমন শিল্পী একজন-দু'জনের বেশী নয়।
নজরুল নিজে ছিলেন মাতাল প্রাণের সূত্রধর, তাই তিনি তরুণদের অভিহিত করেছেন- "মাতাল প্রাণের সূত্রধর" হিসেবে। তিনি বিদ্রোহী আবার একাধারে তিনি উদার এবং অখণ্ড মানবতার পক্ষে, জাত-পাত, পৈতা, টিকি, টুপির ঊর্ধ্বে।
কবিরা হাজার বছর সামনে হাঁটেন- কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবন্ত উদাহরণ। তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্বকর্মা। তিনি বলেছেন- 'মানুষ এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোনো।' তিনি একাধারে সমাজসংস্কারে বিদ্রোহী, আমার দেহ-মনে প্রেমিক কবি। তিনি শুধু একজন আধুনিক কবিই নন, তিনি সর্বকালের কবি, তিনি আমাদের স্মরণীয় এবং শরণীয়।
পরিশেষে আমার মনে হয়- এ দেশ, এ জাতির মুক্তির জন্য নজরুল চেতনাকে আগুনের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়া উচিত- আর হৃদয়, মন আর মননে আত্মস্থ করা উচিত ড.সৌমিত্র শেখরের "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নজরুল" বইটি।
ফার্মি প্যারাডক্স
ই মা ম মে হে দী আ শ ফী
আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। খালি চোখে পরিষ্কার আকাশে আমরা একেই দেখতে পাই। তো খালিচোখে কতগুলো তারা দেখি আমরা? খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে পুরো দিগন্ত সমেত এই আকাশেও কিন্তু আমরা ২৫০০ এর বেশি তারা দেখতে পাই না। যা কিনা এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ১০০ মিলিয়ন ভাগের একভাগ মাত্র। আর ব্যাপ্তির হিসেবে আমাদের দৌড় মাত্র ১০০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত, যা ছায়াপথের মোট ব্যাসের ১% মাত্র।
অথচ এই এক ছায়াপথেই আছে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। বিজ্ঞানীদের ধারণা আমাদের মহাবিশ্বে ঠিক একই পরিমাণ ছায়াপথ আছে। তো এত এত তারার দেশে নিশ্চয়ই এদের নিজেদের চারপাশেও আছে এক একটা জগৎ। যেখানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে গ্রহদের দল। তার মাঝে শুধু কি সূর্য নামক এই একটি তারার জগতেই ঘটেছে প্রাণের বিস্তারণ, উন্মেষ ঘটেছে আমাদের মতো উন্নত প্রাণের? আমাদের মতো কেউ কি নেই ওখানে?
চলুন তবে দেখা যাক গাণিতিক সম্ভাব্যতার বিচারে কী আসে ফলাফল?
মহাবিশ্বে মোট ছায়াপথের সংখ্যা প্রায় ১০০ – ৪০০ বিলিয়ন। আর এর প্রত্যেকটিতে আছে ১০০ – ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। তাহলে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বেই মোট তারার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১০^২২ – ১০^২৪। অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীতে যত বালুকণা আছে তার প্রত্যেকটি বালুকণার বিপরীতে আছে ১০,০০০ টি তারা। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন এতগুলো তারার মাঝে মাত্র ৫ – ২০% তারা আকৃতি, তাপমাত্রা আর উজ্জ্বলতার বিচারে আমাদের সূর্যের মতো। তো বেশি বেশি না ধরে মনে করি মাত্র ৫% তারা সূর্যের মতো। এদিকে তারার সংখ্যাও কম ধরেই হিসেব করা যাক অর্থাৎ ১০^২২ টি। সে হিসেবে আমাদের মহাবিশ্বে সূর্যের মতো নক্ষত্র আছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন বিলিয়ন।বুঝলাম এতগুলো সূর্য আছে মহাবিশ্বে। কিন্তু সবগুলোর চারপাশে নিশ্চয়ই পৃথিবীর মতো এরকম একটা গ্রহ নেই, যেটা কিনা সূর্য থেকে এমন একটা আবাসযোগ্য অঞ্চলে থাকবে। কারো কারো মতে প্রতিটি সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো গ্রহ থাকার সম্ভাব্যতা অর্ধেকেরও বেশি। এদিকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে কম করে হলেও এ সম্ভাব্যতা ২২%। আমরাও কম ধরেই আগাই। অর্থাৎ ৫০০ বিলিয়ন বিলিয়ন সূর্যের মধ্যে ২২% সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো একটি করে গ্রহ আছে। সংখ্যার বিচারে, এ মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বিলিয়ন পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে, যা কিনা মহাবিশ্বের মোট তারার ১ শতাংশ। আরো আগানো যাক। এতক্ষণ পর্যন্ত যা যা হিসেব করে আসলাম সেখানে খুব বেশি গোঁজামিল নেই। যতই এদিক সেদিক করা হোক না কেন এই মহাবিশ্বে মোটামুটি এতগুলোই পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে। এখন সামনের দিকে যেতে হলে আমাদের কিছুটা আন্দাজের মাধ্যমে যেতে হবে। পৃথিবীতে যেমন ১ বিলিয়ন বছর পর প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে, আমরাও ধরে নেই এই গ্রহগুলোর অন্তত ১% গ্রহে উদ্ভব ঘটেছে প্রাণের। এবারও ধরে নিই প্রাণধারী এসব গ্রহের মধ্যে মাত্র ১% গ্রহে বিকাশ ঘটেছে আমাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণের। এর মানে হলো শুধু পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বেই মানুষের মতো ১০ মিলিয়ন বিলিয়ন উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব আছে। দূরে থাক মহাবিশ্ব, আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কথাই ধরা যাক। একই হিসেবে করে আমরা দেখি এই ছায়াপথেই আছে ১ বিলিয়ন পৃথিবী সদৃশ গ্রহ আর ১ লক্ষ মানুষের মতো উন্নত সভ্যতা। পৃথিবীর সে সংস্থাটি এরকম উন্নত সভ্যতা খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরন্তর, তার নাম SETI (Search for Extraterrestial Intelligence). এই সংস্থাটি সবসময় আকাশের দিকে অ্যান্টেনা তাক করে বসে আছে। যদি আমাদের ছায়াপথেই এক লক্ষ উন্নত সভ্যতা থাকে এবং তাদের কিয়দাংশও যদি পরষ্পরের সাথে যোগাযোগ করে তবে সেই বেতার তরঙ্গের একটা অংশ হলেও তো SETI এর রাডারে ধরা পড়ার কথা! না, এখনো কেউ আমাদের হ্যালো বলে নি, কেউ কাউকে হ্যালো বলতে শুনি নি.....
গোষ্ঠ বিহার মেলা
মি ঠু ন মু খা র্জী
মেলা হল মিলনক্ষেত্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ এই মেলাতে মিলিত হয়। গতানুগতিক একঘেয়ে জীবনযাত্রা থেকে মানুষকে একটু শান্তির বারি দান করা হল মেলার কাজ। এই মেলা বিভিন্ন রকমের হয়। বই নিয়ে বইমেলা, খাদ্য নিয়ে খাদ্য মেলা, নাটক নিয়ে নাট্যমেলা, সঙ্গীত নিয়ে সঙ্গীত মেলা। তাছাড়া সংস্কৃতি ও প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্যও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সকল মেলার উদ্দেশ্য, মানুষকে একত্রিত করে আনন্দ দান করা। মানবধর্মে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়া।
উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ছোট্ট একটি মফস্বল শহর গোবরডাঙ্গা। 'গো' অর্থে পৃথিবী, 'বর' অর্থে শ্রেষ্ঠ ও 'ডাঙ্গা' অর্থে স্থান। অর্থাৎ 'গোবরডাঙ্গা' শব্দের অর্থ হলো--- 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান'। এই গোবরডাঙ্গাতে প্রায় দুশো বছর আগে থেকে একটি মেলা হয়ে আসছে, যে মেলা গোবরডাঙ্গার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আজও বহন করে চলেছে। এই মেলার জন্য গোবরডাঙ্গা ও আশেপাশের বেশ কিছু জায়গার মানুষ সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে। এই মেলার শুভ সূচনা হয়েছিল জমিদারদের হাত ধরে। তারাই মেলাটির নাম রেখেছিলেন 'গোষ্ঠ বিহার মেলা'। এই মেলার শুভ সূচনা হয়েছিল ১৮২৩ সালে জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। জমিদার বাড়ির পাশের যমুনা নদীর তীরে একটা বড় ফাঁকা মাঠে এই মেলার শুভ সূচনা হয়। কথিত আছে দ্বাপর যুগে এই মাঠে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ গরু চরাতে আসতেন। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে গোষ্ঠ বিহার মেলা। বর্তমানে এই মেলা দুশো বছরে পদার্পণ করেছে। আশেপাশের ও দূরদূরান্তের বহু মানুষ বাংলা নববর্ষে এই মেলার অপেক্ষায় থাকেন। চাতক পাখি যেমন বৃষ্টির বারির জন্য অপেক্ষা করে, ঠিক তেমনি।
জমিদারি শাসন গোবরডাঙ্গায় যত বছর চলেছিল, তত বছরই এই মেলা পরিচালনার ভার জমিদারদের হাতেই ছিল। বংশপরম্পরায় এই মেলা তাঁরা পরিচালনা করে এসেছিলেন। পরবর্তীতে জমিদারীরাজ শেষ হলে একটা কমিটি তৈরি করে মেলা পরিচালনার দায়িত্ব তাদের উপর অর্পণ করা হয়েছে। তারাই মেলা পরিচালনা করে। তবে সিলেকশনের মাধ্যমে কমিটির সদস্য-সদস্যাদের পাঁচ বছর অন্তর পরিবর্তন করা হয়।
এই মেলায় একসময় সার্কাস থেকে শুরু করে জাদু, মরণকূপ, বায়োস্কোপ সবই আসতো। কিন্তু বর্তমানে বন্য পশুদের সার্কাসে খেলা দেখানো নিষিদ্ধ বলে সার্কাস আসে না। তাছাড়া জাদু, বায়োস্কোপ সময়ের সাথে সাথে এখন তেমন চলে না। বর্তমানে নাগরদোলা, মরণকূপ, প্যারাসুট, বাচ্চাদের চড়ার হাতে টানা গাড়ি, ম্যাজিক, বিভিন্ন খেলনা ও প্রসাধনের দোকান, খাবারের দোকান, কাঠের আসবাবপত্রের দোকান, মাটির তৈরি জিনিসপত্রের দোকান, আইসক্রিম, ফুচকা, হোটেল আরো অনেক দোকান দেখা যায়। তবে মেলা কমিটি জায়গার ভাড়া এত পরিমানে বিগত পাঁচ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে যে কারণে অনেক দোকানদার এই মেলাতে আসেন না। ওই দশ দিন অন্য কোথাও মেলা থাকলে তারা সেখানে দোকান পাতেন।
গোষ্ঠ বিহার মেলাটি যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তার জন্য স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্কুলের এনসিসির ছাত্ররা মেলায় ও মেলার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই কদিন গাড়ি ও মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও বড় বড় গাড়িগুলিকে উপযুক্ত কারণ না পেলে, সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত মেলা চলার দিনগুলিতে ওই রাস্তায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। মেলা চলার কদিন বিকল্প রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো যেতে বলা হয়। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে এনসিসির সদস্যদের জল ও টিফিনের ব্যবস্থা করা হয়। মেলা কমিটির এই দশ দিন একটা বড় অঙ্কের টাকা আয় হয়। যদিও এই টাকা বিভিন্ন কাজে খরচ হয়ে যায়।মেলা অফিসের উন্নতি করা থেকে শুরু করে, যারা সারা বছর মেলা অফিস দেখাশোনা করেন ও মেলা পরিচালনার জন্য এই কদিন কাজ করে থাকেন তাদের পারিশ্রমিকও এখান থেকে দেওয়া হয়। এছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ও দশ দিন ধরে বিধান স্মৃতি সংঘের মাঠে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় তাতেও ব্যয় করা হয়। এই দশ দিনের শিল্পীদের ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করা সদস্যদের টিফিন বাবদও একটা বড় টাকা ব্যয় হয়।
যমুনা নদীর তীরে মূলত এই 'গোষ্ঠ বিহার মেলা'টি অনুষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার অপর পারে গোবরডাঙ্গা কালীবাড়ি বিধান স্মৃতি সংঘের মাঠে এই দশ দিন ধরে মশলার মেলা চলে। দেখার মতো সেই মেলা। গোটা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় এরকম মশলার মেলা হয় না। পয়লা বৈশাখের আগের দিন রাত থেকে ফুল পাঞ্জাব লরি বোঝাই করা বিভিন্ন মশলা (সরিষা, জিরে, হলুদ, ধনে, লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, মৌরি, মেথি, মগজ আরো অনেক কিছু) এই মাঠে প্রবেশ করে। দেখে যেন মনে হয় রাত দিনের ব্যবধান একেবারে ঘুচে গেছে। সারারাত এক প্রকার জেগে, পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের ভোর থেকে বেচাকেনা করে সকলেই। এই মশলার মেলার জন্য বাইরের ও স্থানীয় ব্যবসাদাররা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। হাজার হাজার ক্রেতা সারা বছরের সংসারের প্রয়োজনীয় মশলা, বাজারের তুলনায় কম দামে এখান থেকে কিনে রাখেন। তবে যে সকল মশলা সারাবছর থাকবে, এমনই মশলা বেশি নেন। আশেপাশের এলাকার বৃহন্নলারা আয়ের সুযোগ মনে করে, ওই দিন এই মশলার মেলায় আসেন এবং হাজার হাজার টাকা আয় করে নিয়ে যান। এই গ্রীষ্মের দাবদাহে শরীরকে ঠান্ডা রাখার জন্য মশলার মেলার পাশ থেকে অনেকে আখের রস, আইসক্রিম, ঠান্ডা পানীয়, লেবু জল ও লস্যির দোকান দেন। তাদের বেচাকেনাও খারাপ হয় না। মশলার দোকানগুলো থেকে বিধান স্মৃতি সংঘ একটা ভালো টাকা ভাড়া বাবদ আয় করে থাকে।
বিকেল পাঁচটা থেকে মেলাতে মানুষ আসা শুরু করে। তবে সন্ধ্যা সাতটার পর মানুষের ঢল নামে। আবালবৃদ্ধনিতা এই মেলায় ভিড় জমায়। তিনটি রাস্তা থাকে মেলায় ঢোকার জন্য। তাছাড়াও যমুনা নদীর পাশ থেকে মেলায় প্রবেশ করা যায়। রাত নটার সময় পা ফেলার জায়গা থাকে না। হাত ধরে না চললে সঙ্গভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ভিড়ের মধ্যে চোর-পকেটমারের সমস্যাও লক্ষ করা যায়। সারিবদ্ধভাবে ফুচকার দোকান, হোটেল, মনোহারী দোকান, কাঠের আসবাবপত্রের দোকান, মাটির পাত্রের দোকান বসানো হয়। যাতে ক্রেতাদের কিনতে কোন সমস্যা না হয়। দশটা দোকান জিজ্ঞাসা করে কিনতে পারে তারা। এতে দোকানদাররাও কারো কাছ থেকে বেশি দাম নিতে পারেন না। তবে সপ্তাহের শনিবার ও রবিবার অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ভিড় হয়। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা কুইজের আয়োজন করা হয়। জেনারেল নলেজ ও গোবরডাঙ্গার ইতিহাস এই কুইজের বিষয় থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে কুইজ অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচটা প্রশ্নের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেন, তাদেরকে পেন ও বই পুরস্কার স্বরূপ দেওয়া হয়ে থাকে। মেলার দশম দিনে একটা বৃহৎ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেন মেলা কমিটি। নয় দিন পর্যন্ত স্থানীয় বিভিন্ন নাচের, গানের ও নাটকের দল অনুষ্ঠান করে থাকে। শেষ দিন মূলত কলকাতা থেকে বিখ্যাত সব বেতার ও দূরদর্শন শিল্পীদের গান ও নাচ করানোর জন্য নিয়ে আসা হয়। তবে গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন কারণে কলকাতার শিল্পী আনা বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষেরা বলতে গেলে দশ দিনই মেলায় যান ও আনন্দ উপভোগ করেন। যেহেতু বৈশাখ মাস, সেহেতু কালবৈশাখী ও বৃষ্টির কারণে মেলা চালানোর সমস্যা হলে, মেলা কমিটি দোকানদারদের কথা চিন্তা করে কোন কোন বছর দুই-তিন দিন মেলা বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন। গোষ্ঠ বিহার মেলা যে মাঠে হয়, বর্ষাকালে সেই মাঠ দেখলে মনেই হবে না এখানে এত বড় মেলা বসে। যমুনা ও মাঠ জলে সমান হয়ে যায়। কিন্তু বৈশাখ মাস আসার আগে সেই জল শুকিয়ে গিয়ে মেলা বসার যোগ্য হয়ে ওঠে। মা প্রসন্নময়ীর কৃপাতে হয়তো এটা সম্ভব হয়।
এই মেলার পাশেই রয়েছে জমিদারদের নির্মিত প্রসন্নময়ী কালী ও দ্বাদশ শিবলিঙ্গের মন্দির। এই মন্দিরটি জমিদার খেলারাম মুখোপাধ্যায় নির্মাণ শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ১৮২২ সালে মন্দিরটি সমাপ্ত করেন। এই মন্দির রানী রাসমণি দেখে গিয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। একই আদলে তৈরি এই দুটি কালী মন্দিরই। যারা প্রসন্নময়ী মায়ের মন্দির ও দ্বাদশ শিবলিঙ্গ কখনো দেখেননি, তারা গোষ্ঠ বিহার মেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে এই কালী মন্দিরও দর্শন করে পুন্য সঞ্চয় করেন।
তবু অনন্ত জাগে
ম ঞ্জি রা ঘো ষ
১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ আমাদের প্রাণের ঠাকুর আপামর বাঙালির- সকল প্রার্থনা ও বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেলেন অমৃতলোকে। বয়স আশি। অজস্র ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে নিয়ত লড়াই করেও তিনি বিশ্ববন্দিত। শোকে সন্তাপে পুড়তে পুড়তেও তিনি আনন্দময় প্রশান্তির বাহক। তিনি রবীন্দ্রনাথ। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঊর্ধ্বে তাঁর মহিমা বিরাজিত। তাঁর দৈহিক মৃত্যুতে ভেঙে পড়ল কলকাতা-- পত্রিকায় হেডলাইন হল "রবি অস্তমিত"। বলা বাহুল্য, সারা বছর প্রতিক্ষণে তিনি আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে লীন হয়ে আছেন। অথচ বাইশে শ্রাবণ দিনটাতেই এক ভয়ানক শূন্যতা এসে বাসা বাঁধে মনের কোণে। প্রাণপ্রিয় রবিঠাকুর, যাঁকে কখনো জীবদ্দশায় দেখা সম্ভব হয়নি, তাঁরই আরাধনা করে চলেছি নিভৃত যাপনে। "নয়ন তোমায় পায় না দেখিতে, রযেছো নয়নে নয়নে।" তাঁর সম্পর্কে লিখতে গেলে দুচোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে, কণ্ঠনালী রোধ হয়ে বেদনার ধারা বয়ে যায় তনুমনে। বাইশে শ্রাবণ শুধুমাত্র কবির মৃত্যুদিবস নয়, বাইশে শ্রাবণ ব্যাক্তিত্বের সীমানা পেরিয়ে অসীম অনন্তলোকে কবির সত্য হয়ে ওঠা।
জীবনকে সর্বৈবভাবে আলিঙ্গন করলেই মৃত্যু নিয়ে ভাবার অবকাশ থাকে।জীবন, সুখ ও দুঃখের আলোআঁধারির পথ পরিক্রমায় নিশ্চিত ভাবে আশ্রয় পায় চিরশান্তি মৃত্যুর কোলে। সেই মৃত্যু ভাবনায় কবি অবশ্যই স্বতন্ত্র ও সুন্দর। কখনও তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন বন্ধুরূপে, কখনও দুর্নিবার ঝড়ের রূপকল্পে।
"যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে।"
আবার স্বীয় শক্তিতে অতিক্রম করেছেন চিরসত্য বেদনাবহ মৃত্যুকে। কৈশোরে মায়ের মৃত্যু, যৌবনে বন্ধু প্রতিমবৌদির, পরবর্তীতে স্ত্রীর ও সন্তানের অকাল মৃত্যুতে কবি-হৃদয় ক্ষত বিক্ষত। মাঝে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মত্যুতে ছায়াশূন্য মরুদাহে দগ্ধ। আশি বছরের জীবনে প্রায় চল্লিশটি (আপনার জনের) মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে কবিকে। জীবনের এই অনিবার্য পরিণতি তাঁর চিন্তার স্তরে স্তরে প্রতিফলিত হয়েছে উপনিষদিক উপলব্ধিতে। তিনি লিখলেন,
"জীবনেরে কে রাখিতে পারে/আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।"
জীবন ও মৃত্যুকে তিনি পরস্পরের পরিপূরক ভাবতে পেরেছেন বলেই আত্মস্থ হয়ছেন এই ভাবনায়--- "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু-----" স্থিতধী কবি, জীবন মরণের নিরবিচ্ছিন্ন বিধ্বংসী খেলায় জর্জরিত। কবি ক্রমাগত প্রিয়জনদের হারাতে হারাতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান কোন কোন সময়। 'সানাই' কাব্য গ্রন্থে 'ক্ষণিকা' কবিতায় লিখলেন
"এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি
মনে মনে ভাবি এ কি
ক্ষণিকের পরে অসীমের বরদান
আড়ালে আবার ফিরে নেয় তার
দিন হল অবসান।"
অপেক্ষমান কবি অন্তরের নিভৃতে অভিমানী। যে বিশ্বসংসারে নিজেকে মেলে দিয়েছেন, দেহাবসানের পর তিনি কি স্মরণীয় হবেন, যে কবি চেয়েছেন--- মানুষের মাঝে একাত্ম যাপনে থাকতে।
"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে"
আবার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পরম সুখের সন্ধান তিনি করেছেন, তা অনন্ত জীবনেরই ইঙ্গিতবাহী। মৃত্যুকে আহ্বান করেছেন,
"জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণা ধারায় এসো…
হৃদয় প্রান্তে হে জীবন নাথ শান্ত চরণে এসো।"
যা ইন্দ্রিয়াতীত, অলীক সুখ আনন্দ বহির্ভূত সেই মৃত্যুকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, "আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব–"
মৃত্যু যেন সব পরিণতির এক অসীম আনন্দলোক, জীবনের সব প্রাপ্তির আরাম, সব তর্কের শেষ।অন্তরের অন্তঃস্থলে মৃত্যুর ভাঙচুর আত্মস্থ করেছেন নীরবে, "তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে"। আপাত অন্ধকার, আপাত ব্যথাতুর হলেও মৃত্যুই পরম প্রাপ্তি, জীবনের শতধারার স্নানে সফল ও পূর্ণতার নির্দিষ্ট সীমানা পার হয়ে সে অনির্দিষ্ট অমর। স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যুর বাইশ বছর পর আন্দেজ জাহাজে বসে লিখলেন
"তোমার আঁখির আলো, তোমার পরশ নাহি আর/ কিন্তু কি পরশমণি রেখে গেছ অন্তরে আমার,/সঙ্গী হীন এ জীবন শূন্য ঘরে হয়েছে শ্রীহীন/সব মানি, সব চেয়ে মানি, তুমি ছিলে একদিন।"
দেহগত মৃত্যু যন্ত্রণাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি অনন্তলোকের যাত্রী। পরিশেষে বলা যায়, তাঁর কবিসত্তায় কখনও তিনি কবি শেলীর রহস্যময় অতীন্দ্রিয় সত্তার গূঢ় আত্মপ্রকাশ, কখনও বা কীটসের অনিঃশেষ সৌন্দর্য চেতনার অবগাহন। আছে ব্রাউনিং'এর দার্শনিক ও শৈল্পিক বিশ্লেষণ। আবার ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিশ্বপ্রকৃতির গভীর রহস্যের মৃত্যু ভাবনার ছোঁয়া। আবার কোলরিজ ও বায়রণের মতো বস্তুগত অভিব্যক্তির প্রসঙ্গ ও উঠে আসে যথার্থ নান্দনিকতায়। তবু, তারপরও তিনি অনন্য, অসীম, মৌলিক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন