গল্প
অমিতাভ
পা ভে ল ঘো ষ
(১)
"ও স্যার...!" কথাটা কানে আসতেই মনে হলো, কতদিন শুনিনি এমন আন্তরিকতায় ভরা ডাক। প্রাণ জুড়িয়ে গেলো আমার। নিশ্চিত কোনো প্রিয়জন হবে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি, অনুমানটা একদম সঠিক। এতো সেই অমিতাভ..!
"কেমন আছিস...?" ঘাড় উঁচু করে বললাম।
সেই আগের মতোই আছে অমিতাভ। ছ'ফুটের মত লম্বা, রোগা আর মুখে লেগে থাকা সেই লাজুক হাসি। হাতদুটো পিছনে মুঠো করে বিনীত স্বরে বললো, "ভালো স্যার..।"
"কোথায় যাচ্ছিস শুনি..?" আমি একগাল হেসে বললাম।
"স্যার, আপনি যতদূর যাবেন.." অমিতাভর মুখে কথাটা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই অবক্ষয়ের যুগে এমন ছাত্রও আছে..!
পালসিট স্টেশনের পাশ দিয়ে ঝাঁ চকচকে দূর্গাপুর এক্সপ্রেস হাইওয়ে সোজা পাড়ি দিয়েছে উড়ালপুল হয়ে বর্ধমানের দিকে। এই উড়ালপুলের পাশেই স্বস্তিপল্লি। আর এই স্বস্তিপল্লিই হলো অমিতাভর বাসভূমি। ওর সঙ্গে আমার পড়ানোর সূত্র ধরেই পরিচয়। অনিমেষবাবু ছেলেকে হাত ধরে আমার কাছে নিয়ে এসে বলেছিলেন,
"অনিরুদ্ধ, আমার ছেলেটাকে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। একটু দেখো..!" তখন অমিতাভ একাদশ শ্রেণী। হালকা ও অস্পষ্ট গোঁফের রেখা। মুখে নিষ্পাপ হাসি। প্রথম দিনেই মনে হয়েছিল, কতদিনের চেনা। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিলাম, "চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো.!"
"ও স্যার..." আবার সেই চেনা কণ্ঠ শুনে নিজের জগতে ফিরে এলাম। অমিতাভর কাঁধে হাত রেখে একপ্রকার জোর করেই বসিয়ে দিলাম সামনের সিটে। তারপর ওর মাথায় বিলি কেটে জিজ্ঞাসা করলাম, "হেঁয়ালি না করে বল তো, কোথায় যাবি..?"
"বলছি স্যার..., আপনার সঙ্গে গল্প করবো বলেই ট্রেনে উঠেছি। অন গড বলছি...!"
"তাই নাকি...? দারুন ব্যাপার...!"
"তবে আজকে আপনাকে একটা দারুন খবর দেবো।" মুচকি হেসে বললো অমিতাভ।
"কি খবর রে..?" আবেগে আপ্লুত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
"স্যার, আমি এস.এস.সি পরীক্ষায় পাস করেছি।আগামী বুধবার আমার কাউন্সেলিং।"
"দারুন খবর তো। আগে জানাস নি...? ফোন করলে তো পারতিস। যাক...। দেখেশুনে স্কুল নির্বাচন করিস। লিস্ট দেখেছিস তো...?"
অমিতাভ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। পুরোনো দিনের স্বর্ণালী মুহূর্তগুলো আলোচনায় চলে আসছিল বারবার। ইতিমধ্যে এসে গেলো আমার গন্তব্য স্টেশন। আমার সঙ্গে অমিতাভও নেমে গেলো স্টেশনে।
ট্রেন থেকে নেমেই অমিতাভ হাত নেড়ে বললো, "স্যার, আপ লোকালের খবর হচ্ছে। আমি আসি...।"
আমি ওর পথের দিকে চেয়ে রইলাম। ট্রেন আসতেই অমিতাভ উঠে পড়লো। এই প্রচন্ড গরমে ও যেন ঠান্ডা বাতাস বইয়ে চলে গেলো । সত্যি...! বড় আরাম পেলাম আজ।
(২)
মাস দেড়েক পর স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনিমেষবাবুর সাথে দেখা। উনিও স্কুল থেকেই ফিরছেন, বুঝলাম। গায়ে সাদা ধবধবে ধুতি ও পাঞ্জাবী। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে যেন অস্তমিত সূর্যের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন।
"ও মাস্টারমশাই, অমিতাভ কোথায় শিক্ষকতা পেলো..?"
অবাঞ্ছিত প্রশ্নটা করার পরেই লক্ষ্য করলাম অনিমেষবাবুর চোখে যেন অসীম শূন্যতা বিরাজ করছে। গোটা মুখ থমথমে। চোখের জল যেন জোর করে ধরে রেখেছেন।
"অমিতাভ আর নেই...!" অনিমেষবাবু পাথর চোখের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
"তার মানে...?" প্রশ্নটা করেই আমি হতবাক চোখে চেয়ে রইলাম ওঁর দিকে। জীবনে মনে হয়, এমনভাবে বিস্মিত খুব কম হয়েছি। নির্বাক হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। কি শুনলাম আমি...? অনিমেষবাবুর সঙ্গে আর কথা বলার সুযোগ হলো না। ট্রেন ততক্ষনে পালসিট স্টেশনে ঢুকে পড়েছে।
"ভাই, তুমি কিছু জানো না...?" পাশে বসা অসীমদার কথায় আমার টনক নড়লো। অমিতাভদের পাড়ারই লোক এই অসীমদা। কৌতুহলী হয়ে ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, "অসীমদা, অমিতাভর কিছু..."
উনি আমার মুখ থেকে কথাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, "কাউন্সেলিংয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় সাইকেলে হাইওয়ে পার হতে গিয়ে পথ দুর্ঘটনায় অমিতাভ মারা যায়। জানো ভাই..., ওইদিন আবার ওর জন্মদিন ছিল। নেমন্তন্নও ছিল আমার। কিন্তু বিধাতার কি অদৃষ্ট পরিহাস ভাই...!"
"সত্যি...?" ঘটনাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই যাচাই করার জন্য অসীমদাকে আবার প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
এত প্রাণচঞ্চল, সহজ সরল ছেলেটা এইভাবে চলে যাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। প্রতিদিনই স্কুল যাওয়া আসার পথ পালসিট স্টেশন এলেই মনে পড়ে যেত অমিতাভর চেনা কন্ঠটা, "ও স্যার..."
(৩)
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দিন যায়, রাত আসে। সূর্য ওঠে, আবার ঝুপ করে ডুব দেয় পশ্চিমাকাশে। কিন্তু অমিতাভ যে মৃত্যুর একবছর পরেও এমনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে, ভাবতেই পারিনি।
বছর খানেক পরে আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। আনমনা হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে কি সাতপাঁচ ভাবছিলাম, আমি নিজেই জানি না।
"স্যার , কেমন আছেন?" আচমকা এই প্রশ্ন কানে আসতেই নিজের জগতে ফিরে এলাম। মুখ ফেরাতেই দেখি জাহির। সেই কোঁকড়ানো চুল, আর একগাল হাসলেই যার গজদাঁত বেরিয়ে আসতো। এবারও ঠিক তাই। সেই হাসি, কিন্তু মাথার দিকে তাকিয়ে দেখি, চুলের ঘনত্ব কিছুটা কমেছে।
"আমি ভালো আছি। তুই কেমন?" জহিরের কাঁধে হাত রাখলাম আমি।
"ভালোই স্যার। এখন একটা স্কুলে আছি।" বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাটা বললো জাহির।
"বাঃ..! দারুন খবর তো। কতদিন পেয়েছিস...? "
"এই এস.এস.সি তে স্যার। তবে বাই চান্স..."
"বাই চান্স মানে..?"
"হাঁ স্যার। আমি তো ওয়েটিংয়ে ছিলাম। একটা ছেলে শেষ মুহূর্তে না আসায় আমার হয়ে গেলো।"
এলো না কে...? চাকরীর এখন যে হারে আকাল চলছে। জাহিরের কথা শুনে অমিতাভ আমার স্মৃতিতে বুদবুদের মত ভেসে উঠলো। মনে একটা সংশয় তৈরী হলো আমার। দূর করার জন্য বললাম, "এই মন্দার বাজারে কে এলো না রে জাহির...?"
"যতদূর মনে পড়ছে, 'অমিতাভ মুখার্জী' নামের একটি ছেলে স্যার। হয়তো কোনো বেটার জায়গায় চান্স পেয়ে আসেনি। যাক স্যার, আমি তো নিশ্চিন্ত হয়েছি। ছেলেটাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানিনা। ও না এসে আমার যে কি উপকার করেছে...! চাকরিটা আমার ভীষন দরকার ছিল স্যার..."
জাহির এক নিঃশ্বাসে শেষ করলো। ওর মুখে চোখে একটা প্রশান্তির ছাপ লক্ষ্য করলাম।
হে ঈশ্বর, এমনও হয়...! জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, সূর্যটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে ট্রেন।
আরে ওই তো অমিতাভ...! অস্তমিত সূর্যটার ঠিক পাশ থেকে যেন ডাকছে আমায়, "ও স্যার...!"
মিলন
ন ন্দি তা সো ম
দুই পাশে ঘন জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে কারওয়ার হুবলী রাজপথ।
আমি মুর্শিদাবাদ রাজবাড়ীর ছেলে উদয়নারায়ন সিংহ বেড়াতে এসেছি কারওয়ারে আমার কলেজের বন্ধু ভিমাপ্পার বাড়িতে। গ্রাম বলতে আমি বুঝি--- কাদা জলে ভরা মাটির কাঁচা রাস্তা। হেটো ধুতি শাড়ি পরা নরনারী। সেখানে আমি হচ্ছি ঠাঁটেবাটে চলা বড়লোকের সৌখিন ছেলে। ভিমাপ্পার আমন্ত্রণ অনেকবার এড়ালেও এবার আর পারলাম না। ওদের গ্রামের বাড়ি দেখে চমকিত। খড়ে ছাওয়া ঝকঝকে তকতকে গাছগাছালিতে ভরা বাড়ী। পাশাপাশি সব বাড়িই তাই। পরের দিন সকালে ভিমাপ্পা আমায় ওদের গ্রাম দেখাতে নিয়ে বেরোলো। মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন ছেলেকে "তুমি বাইক নিয়ে কবে গ্রামে যাও?" ইশারায় আমায় দেখিয়ে বললো "ও এতো হাঁটেনা"। লজ্জা করলো কিন্তু কিছু করার নেই। জঙ্গলের মাঝে দিয়ে চলে গেছে ৬৬ নম্বর রাজপথ। রাস্তার ডানধারে একটি গাছের নিচে বাইক দাঁড় করিয়ে হাঁটা লাগালো। আমিও সাথে--- শুনলাম-- ভিমাপ্পা যাচ্ছে স্কুলের এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। সরু একটি পায়ে চলা পথ ঢুকে গেছে জঙ্গলের ভিতরে। দুইধারে গাছের সারি। সব গাছ অজানা। ভিমাপ্পা চেনালো চেরী ব্লুসম, রুদ্রপলাশ, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল। ঠান্ডা হাওয়া প্রাণ জুড়িয়ে দিলো। ভিমাপ্পার দিকে তাকাতে আমায় দেখালো সামনে বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা। কুলকুল করে বয়ে চলেছে উত্তর কর্ণাটকের কালী নদী। চারিদিকে ছড়ানো কিছু গ্রাম্য বাড়ি। মাছ ধরার জাল শুকাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার মতো একটি ঘাগরা ব্লাউজ পরা এক মাথা কালো খোলা চুলের মেয়ে ছুটে এসে আমার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে নিজের ভাষায় কতো কিছু বলে চললো। আমি নির্বাক নিষ্পলক। ওদের কথার মাঝেই ভিমাপ্পা আমায় বললো-- মেয়েটির নাম রাধা। ওর বন্ধুর বোন ও ভিমাপ্পার মায়ের পাতানো মেয়ে। গ্রামের এক স্কুলে বারোক্লাসে পড়ে। শহর অপছন্দের জায়গা। রাধার কাছে প্রকৃতিমা বড়ো শিক্ষিকা। কোনো কথা কানে ঢুকছেনা রাজপুত্রের। অনুভব করছে মুর্শিদাবাদ রাজবাড়ীর খাঁচার দরজা খুলে গেছে। প্রকৃতি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাঁচার পাখিকে বনের পাখির সামনে। কে জানে কি ছিলো বিধাতার মনে! খাঁচার পাখির দেখা হলো মুক্ত বিহঙ্গের সনে। দুই আঁখি মিলেছিলো কি না কে জানে? তবে নদী, আকাশ, প্রকৃতি সাক্ষী রইলো তাদের মনের মিলনে।
ইটি
প্র সে ন জি ৎ আ রি য়া ন
পল্লী গ্রামে বিপ্লববাবুর পুত্র যেশনো এবং ইটি নামে একটি ছেলে থাকতো। ইটি গরিব ঘরের ছেলে, এরা একে অপরের ভালো বন্ধু ছিল। এদের ভাবনাচিন্তা ছিলো আলাদা। একই প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করত। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ে দু'জনে আলাদা হয়ে যায়, ভিন্ন স্কুলে ভর্তি হয়, ইটির টাকা ছিলনা এজন্য সে সাধারণ একটি স্কুলে যেশনো ইন্ডিয়ার বেস্ট স্কুলে ভর্তি হয় যেখানে এডমিশন ফিসই ছিল ৭ লক্ষ টাকা। ইটির পক্ষে এতো টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না, যেশনোর পরিবার ইটি কে পছন্দ করত না। ইটি এর জন্য যেশনোর বাড়িতে যেত না। বছরে দু'বার যেশনো ইটির বাড়িতে এসে ইটির সঙ্গে দেখা করত, একে অপরের সাথে অনেক গল্প মজা করত... কাকু কাকিমা নেই- ফোর থেকে ফাইভ এ উঠতেই ইটির মা-বাবা দুজনেই মারা গেছে। ইটির পরিবার বলতে দুটি কুকুর জ্যাক ও টমি, প্রকৃতি আর একটি ত্রিপল টাঙানো বাড়ি।
-আজ আসি ভালো হয়ে থাকিস৷
-বেশ দেখেশুনে যাস।
ইটি ভাবে সকালে উঠে ভোর পাঁচটা থেকে নটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। বিক্রমবাবুর বাজার এনে দেওয়া, ভোলা দাদুর পেপার দেওয়া, জ্যোতি কাকু দোকানে জল দিতে হবে, কলি মাসির ভ্যান ঠেলে দিয়ে বাজার সাজানো, রকি ভাইএর চায়ের দোকানে তিন ঘণ্টা কাজ করার পর কুড়ি টাকা পাব যা দিয়ে কলা পাউরুটি কিনে খেতে পারি। কলি দেন মাসের রুটি আর তরকারি, বিক্রমবাবু দেন পান্তাভাত আর বাসি খাবার, ভোলাদাদু মাঝে মধ্যে দেন ডাল ভাত তরকারি। দাদুর খাবার নিয়ে বাড়ি যেতে হবে ৯ টার মধ্যে। ৯ থেকে ৯: ১০ এর মধ্যে আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
যে যা দিতো তা নিয়ে বাড়িতে ন'টা থেকে দশটার মধ্যে চলে আসত ইটি। পুকুরে স্নান করে পান্তা ভাত খেয়ে পাউরুটি কলা টিফিন নিয়ে যেত
জ্যাক ও টমিকে দুটো রুটি খাইয়ে ৯:২৫ এর মধ্যে স্কুলে বেরিয়ে যেত... স্কুলে যেত পায়ে হেঁটে ৫ কিমি, প্রতিদিন তার এই নিয়ম ছিল। স্কুল যাওয়ার পথে অন্ধদের রাস্তা পার করিয়ে দেওয়া স্কুল ভ্যান রিক্সা ঠেলে দেওয়া কারো বাজারের ব্যাগ নিয়ে যাওয়া, গরীব মানুষ দেখে ১/২ টাকা দিত, তারপর স্কুলে পৌঁছতো ১০:২৫ থেকে ১০:৪০ এর মধ্যে। স্কুলে সব থেকে গরীব আর মেধাবী দেখে ইটিকে এই স্কুলে ভর্তি নিয়েছিল। ক্লাস শেষ করে টিফিনে কোনদিন কলা পাউরুটি কোনদিন শুধু পাউরুটি ও জল খেত। স্কুল ছুটির পর খিদে পেলে বাইরের খাবার কিনে টাকা খরচ করতো না, জল খেয়ে নিত। পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে কারো সাহায্য নিত না, নিজেই অপরকে সাহায্য করত। বাড়িতে এসে হাত মুখ ধুয়ে ভাত ডাল তরকারি খেতে, তবে বেশিরভাগ দিনই বাসি ভাত জুটতো কপালে... জ্যাক টমিকে খাইয়ে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখত রাতের জন্য। ৫:৩০ থেকে ৬ টা পর্যন্ত মাঠে খেলা করতো বাড়িতে এসে পুকুরে হাত পা ধুয়ে ৬:৩০-এ পড়তে বসতো ৮:২০-তে পড়া শেষ করে জ্যাক ও টমি কে খাইয়ে কোনদিন মুড়ি পিঁয়াজ লঙ্কা বা বাসি খাবার খেয়ে ৯ টাতে বিছানায় উঠে যেত। শুয়ে শুয়ে হিসেব করত সারাদিনের.. রকি ভাইএর চায়ের দোকান থেকে ৬০০ টাকা পায় সে, তার থেকে গরীবদের এক দেড়শ টাকা সাহায্য করে, খাতা পেন আড়াইশো টাকা, কেরোসিন তেল দেড়শ টাকা, কুড়ি টাকার মুড়ি দশ টাকার চানাচুর, কুড়ি টাকা জমে মাসে। রোববারে কর্মকার এর দোকানে কাজ করে একশো টাকা সবমিলিয়ে চারশো কুড়ি টাকা। এদিকে বাড়িটা ঠিক করার জন্য লাগবে দুই হাজার টাকা, স্কুলের ড্রেসের জন্য হাজার টাকা, নিজের জামা প্যান্টের জন্য হাজার টাকা, চল্লিশ টাকা জমাতে লাগবে- এ হিসেব কষা শেষ হলে ঘুমিয়ে পড়ে ৯:৩০এ। সকালে উঠে বলে, আজ রোববার- প্রিয় বন্ধুর কাছে যাওয়ার দিন, কামারশালার কাজ শেষ করে স্নান খাওয়া-দাওয়া করে দোকান থেকে পাঁচ টাকা ছোলা পাঁচ টাকার বাদাম আর প্যাকেটে ঘাস নিয়ে ৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, কোয়া নদী পার হয়ে ২০০ মিটার জঙ্গলের ভেতরে বটগাছের নিচে কাঠবিড়ালি ও পাখিগুলোকে ছোলা বাদাম আর ঘাসগুলো হরিণকে খেতে দিত। এগারোটার সময় বটগাছ তলায় ধ্যানে বসে, প্রকৃতির যতরকম শক্তি সব গ্রহণ করে। ৫ ঘণ্টা পর বিকেল চারটের সময় চোখ খুলত। দু'বছর পর যেশনো আসে, ইটি এইটে পড়ে যেশনো যখন আসে ইটি একটি গাছ উপহার দেয়, যেশনো ক্যাডবেরির টাকা দিত, ইটি টাকা নিতো না।
যেশনো বলে- ইটি এই স্কুলে পড়ে চাকরি বা অন্য কিছু করতে পারবি না। মাধ্যমিক দেওয়ার পর ভালো ইস্কুলে পড়িস, বাবা আজ পাঁচ বছর পর কলকাতা থেকে আসবে, মা গেছে স্টেশনে আনতে। এখানে আমাকে দেখলে খুব বকবে, আজ আসি রে, ভালো হয়ে থাকিস। ফিরে একবার তাকায় যেশনো, ইটি মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে.....
যেশনো চলে যাচ্ছে... ইটি তার দিকে তাকিয়ে বলছে...
পুঁথিগত শিক্ষা সব ইস্কুল থেকে অর্জন করা যায় রে, কিন্তু জ্ঞান নিজের অন্তরের অনুভব। বাংলা বিষয়ে ৫২ টি অক্ষর, ইংরেজিতে ২৬ টি লেটার আর ১০০ টি নাম্বার এটা বইয়ের অংশ রূপ।এর বাইরে আর সৃষ্টি হয়নি। আমি জ্ঞান অর্জন করব সেই জ্ঞান দিয়ে সবাই কর্ম করবে পৃথিবীতে। এইট, নাইন, টেন পড়ে অক্ষরগুলোকে নিজের মত তৈরী করে নেয় সে। ইটি চাইলে অক্ষরগুলো নিজেই সৃষ্টি করতে পারতো। সে মাধ্যমিক দেওয়ার পর পৃথিবীর যতগুলো পুঁথিগত বিদ্যা ছিল সবগুলো আবিষ্কার হচ্ছিল ইটির মধ্যে, সেটা ইটি বুঝতে পারে। যে কোন নতুন বই নিয়ে চোখ বুলোতেই মনে হত তার- এ বই তো এক মাস আগেই তার পড়া। মস্তিষ্কই জানান দিতো এসব। পাঁচ বছরের মধ্যে ইটি পৃথিবীর সব বই শেষ করে ফেলে, এরপর সে নিজের বই আবিষ্কার করে...
ওয়ার্ল্ড-এর এক নম্বর ডক্টর যেশনো ভট্টাচারিয়া, দশ বছর ইটি সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। যেশনো জানতোনা ইটির পুরো নাম কি? ইটির পুরো নাম - ইটি বর্মন ...
ওয়েবসাইটে যেশনো ই. বর্মনের লেখা ডাক্তারী বই পড়তো। ই.বর্মন তার খুব প্রিয় মানুষ।
ইটি বলে- ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘন্টা কাজ করো... কখনো হসপিটালে, সাইন্সল্যাবে, ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে, কখনো পৃথিবীর যে কোন বৈঠকখানাতে ...পৃথিবীতে যে কাজ সকলের অসাধ্য সেটি ইটির কাছে জলভাত।
যেশনোর বাবা ইটির ব্যবহারিক জ্ঞান নিয়ে ব্যবসা আরো বড় করেছেন। ইটিকে যেশনোর বাবা চিনতেন না, ইটি কোনদিন নিজের পরিচয় দেয়নি। যেশনোর ডক্টর ক্যারিয়ারের রেকর্ড ছিল আজ পর্যন্ত কোন রোগীকে সে মরতে দেয়নি। জাপানের রাষ্ট্রপতির মেয়ে কৃষ্টির অসুখ হয়, সব জায়গায় দেখানো শেষে এক নম্বর ডক্টর যেশনোর কাছে রেফার করে। একমাস চিকিৎসা করার পর যেশনো বলে এ রোগের চিকিৎসা আমার সাধ্যের বাইরে। রাষ্ট্রপতির পরিবারে কান্নার রোল পড়ে গেলো।
যেশনোর পি.এ জানালো- ইন্ডিয়াতে একমাত্র ই. বর্মনই ঠিক করতে পারবে। ই.বর্মন?ঐ গাছের সিম্বল দেওয়া জার্নাল যার? যে জার্নাল পড়ে সে ইন্সপায়ার্ড?
দিনটা ছিলো শনিবার। হাসপাতালের চারিদিকে তুলসী গাছ, নিস্তব্ধ শান্ত এক পরিবেশ। চৈত্র মাস শুরু, ইটি গাড়ি থেকে নামে, হাতে তার কোকিলের খাঁচা। যেশনো ইটিকে চিনতে পারেনি, ইটি যেশনোকে চিনতে পেরেছে। টেবিলের উপর খাঁচাটি রেখে ইটি এবং যেশনোর পি.এ- আই.সি.ইউ তে ঢুকে কৃষ্টিকে দেখে একঘন্টা পরে আই.সি.ইউ থেকে বেরিয়ে এসে বলে, "কাল অপারেশন হবে", যেশনো এ কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। পরের দিন ভোর পাঁচটার সময় অপারেশন করে ঘরে বসে আছে ইটি। রাতে বেলা শুয়ে শুয়ে কৃষ্টিকে নিয়ে ভাবছে... পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ধ্যানে বসে আছে সকাল নটার সময় উঠে কোকিল পাখিগুলোকে খেতে দিয়েছে। ১৫ দিন কেটে গেল যেশনো এবং কৃষ্টির পরিবার প্রতিদিন আইসিইউএর বাইরে থেকে কৃষ্টিকে দেখতো। ৩০ দিন পর বসন্ত মাস শুরু। কালকে হসপিটালে যেশনো, কৃষ্টি ছাড়া কেউ থাকবে না। দিনটি ছিল রোববার। হসপিটালের আইসিইউএর জানালার সামনে গাছের উপর দুটি কোকিল পাখি এসে বসতো। ইটি কৃষ্টির বেড থেকে কুড়ি হাত দূরে আইসিইউএর টেবিলে কোকিলপাখিসহ খাঁচাটা রেখে দিলো। এরপর সে আই.সি.ইউএর জানালাটা খুলে দেয়, চারিদিক নিস্তব্ধ অন্ধকার জানালা দিয়ে চাঁদের আলো কৃষ্টির শরীরে পড়ছে। দু'ঘণ্টা কেটে গেছে, গাছের ডালে বসে থেকে কোকিল পাখি ডেকে ওঠে তার সঙ্গে ঘরের কোকিল পাখিগুলিও ডাকে... কৃষ্টি কোকিলের ডাকেই কোমা থেকে বাইরে চলে আসে। ইটি জানালাটা বন্ধ করে দেয় লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। জানালা বন্ধ করা দেখে যেশনো এবং কৃষ্টির পরিবার চলে আসে। যেশনো আবার অবাক হয়ে যায়, ইটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ইটি যেশনোকে ডেকে বলে, আমার পরিচয় গাছ। একটি ছোট ঘটনা বলি, রাস্তার ধারে ত্রিপল ঘরে একটি ছেলে থাকতো, তার বাবা-মা মারা গেছিলো নয় বছর বয়সে। তার বন্ধু যখনই দেখা করতে আসত তার জন্য ক্যাডবেরি আনত, শেষবার দেখা করেছিল ক্লাস এইটে থাকতে। ১৫ বছর আর যোগাযোগ করেনি। যেশনো এটাতো আমার বন্ধুর কথা? আমিই সেই বন্ধু ইটি, মানে ইটি বর্মন। যেদিন শেষ বার দেখা করে যাচ্ছিলি সেই দিন মনে মনে বলেছিলাম এমন মানুষ তৈরি হবো পৃথিবীর মানুষকে শিক্ষা, জ্ঞান দেব। পুঁথিগত শিক্ষার থেকে (শিক্ষাটাকে) বেশি দেখাবো।
ভালো থাকিস বন্ধু আমি এখনই বেরিয়ে যাব এই নে একটি গাছ আর ক্যাডবেরি আমি আসছি...ইটি চলে যাচ্ছে... যেশনো তাকিয়ে বলছে আমরা হয়তো পুঁথিগত শিক্ষা নিয়ে ডক্টর, ইঞ্জিনিয়ার, সাইন্টিস্ট হই। জ্ঞানী বা শিক্ষা অর্জন করার জন্য অন্য মানুষ হতে হয়।
নক্ষত্ররা নিয়মিতভাবে জন্মায় গরীবের ঘরে যা এই পৃথিবীকে আলোকিত করে।
তুই নিজেকে আবিষ্কার করেছিলি পৃথিবীর কাছে রে বন্ধু...
শূককীট
সূ র্য না রা য় ণ ঘো ষ
লোচন লাটুর মদের নেশা বেশ উচ্চ মানের, এক বোতলে এমন কিছু মাতাল ফিলিং দেয়না। তার মদ গেলার শুরু, সেই তার তেরো চোদ্দো বছর বয়স থেকে। প্রায় বারো তেরো বছরের এন্ডলেস প্র্যাকটিস বলে কথা।
সেদিনও লোচন তার আরও দু'জন বন্ধুর সঙ্গে ঘোপানির ঝিলের পাশের অর্ধনির্মিত কারখানার দক্ষিণ দিকের পাথরকুচির পাশে তাস আর বোতল নিয়ে আসর জমিয়েছিল। সূর্য তখনও মুখ লুকোয়নি, দিগন্তে ভেসে বেড়ানো মেঘেদের সঙ্গে বাধ্যতামূলক লুকোচুরি খেলছিল।
এমন সময় যন্ত্রের ক্যাচোরকোচর আওয়াজে ওদের গভীর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় তারা সচকিত হয়ে ওঠে। এই দিকটায় তো খুব একটা কেউ আসেনা, তাও এই সময়। ধীরে ধীরে আওয়াজ বেড়ে চললো এবং সন্ধ্যার আলোয় দেখা দিলো একটা সাইকেল, চালকের আসনে একজন কমবয়সী ছেলে, আর পেছনের ক্যারিয়ারে একজন মেয়ে।
'কে রএ...' লোচন গর্জে উঠল।
সাইকেলটা কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল। মানুষ দুটির ইতঃস্ততা তাদের সাইকেলে ধরা পড়লো।
'এইহ, এদিকে আয়..' ল্যাংরা ধলাইয়ের ক্রোধ মাখানো তীর ছুটে এলো।
সাইকেল এবং মানুষ দুটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো।
'এই চ'তো।' লোচনের আদেশে তিনজনই দৌড়ে গেলো সাইকেলের কাছে।
পরদিন ঘোপানির ঝিলে লোকে লোকারণ্য। একটা যুবক ছেলের লাশ ভেসে উঠেছে।
এরপর খোঁজ খোঁজ খোঁজ। জানা গেলো ছেলেটি পাশের শহরতলীর, নাম রমেন। কলেজে পড়তো। বাড়ি থেকে কলেজে যাবে বলে বেরিয়েছিল, কিন্তু এতো দূরের এই ঝিলের ধারে কী করতে বা কেনো এসেছিল সে সম্পর্কে কারোরই কোনো ধারণা নেই।
বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারা গিয়েছে যে, কোনো একজন মেয়ের সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। তার সঙ্গে সময় কাটাতেই এদিকে আসা।
এবারে আরো খোঁজ।
ডুবুরি নামিয়ে পচাগলা একটি মেয়ের শরীর উদ্ধার হলো। গলায় তারই পোশাক দিয়ে বড়ো ভারী পাথর বাঁধা ছিল।
খুঁজতে খুঁজতে বাকি দুজনের হদিস পাওয়া গেলেও.. লোচন হাওয়া।
এরপর প্রায় সাত আট বছর কেটে গেছে। যে যার রোজকার পার্থিব জীবনের মায়ায় আবদ্ধ। হঠাৎ লোচনদের বাড়িতে পুলিশের আবির্ভাব। জানতে পারা গেছে লোচন নাম পাল্টে, অন্য এক রাজ্যে সংসার পেতেছে। দুজন সন্তানের পিতা।
বছরখানেক ধরে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। মেয়েটির পরিবার পিছু ছাড়েননি। তাদের চেষ্টাতেই পুলিশের কাছে এই গোপন সত্যটা আলোকিত হয়।
লোচন ধরা পড়ে। কোর্টে কেস ফাইল হয়। লোচনের উকিলের বক্তব্য "তার মক্কেলের আক্কেল তখন কম ছিল, এখন তিনি সম্পূর্ণ শুধরে গেছেন। এবং বর্তমানে তিনি একজন দায়িত্ববান নাগরিক ও দয়াবান পিতা। তাই তার পূর্বকৃত কর্মকে ক্ষমার চোখে দেখা হোক। তাছাড়াও, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। অতীতের কোনো এক ঘটনার জন্য কারো বর্তমান নষ্ট করা কী অন্যায় নয়!"
বিচারপতি বললেন,"___"
মমতা
অ দি তি ভ ট্টা চা র্য (অ র ণ্যা নী)
বালিকা বেলা অতিক্রম করে যখন কৈশোরের শিশির ভেজা ঘাসে প্রথম কেউ পা রাখে, তখন বাল্য কৈশোর মিশে গিয়ে শরতের প্রথম ঝলমলে একঝাঁক রোদের মতই সাবলীল উচ্ছলতা তাকে এক অপূর্ব সৌন্দর্য দান করে যায়। তার এই সৌন্দর্য, পরিপূর্ণ এক যুবতী, দুই কন্যার মা শুভমিতার স্মরণে এনে দিয়ে যায় তার গ্রামের কৈশোর বেলার স্বপ্ন মাখা দিনগুলির কথা। শুভমিতার বয়স এখন ৩৪ অতিক্রম করেছে। কিন্তু মনের অন্তরালে লুকানো কৈশোরের প্রকাশ ঘটে যায় মাঝে মাঝে তার শিশু কন্যা দুটির কাছে। তবে গ্রাম্য কিশোরীর সঙ্গ তো সে পায় না। তাই ওই বাল্য-কৈশোর মিশ্রিত মেয়েটিকেই একটু বেশি প্রশ্রয় দেয় সে।
মেয়েটির নাম মমতা। তখন সে তার সদ্য কৈশোরের অবোধ উচ্ছ্বাস দিয়ে মাতিয়ে রেখেছে পাড়ার দোকানদার, অটোচালক, রিকশাচালক, সমস্ত যুবকগোষ্ঠীকে। অনেকেই তার কাছ থেকে ওই উচ্ছ্বাসটুকুই চায়। আর তা দিতে পেরে মমতা যেন দ্বিগুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। শুভমিতাও ওই উচ্ছ্বাসটুকুর জন্যই সুযোগ খোঁজে। পছন্দের জামা, জুতো, সাজের জিনিস, কত কিছুই কিনে দেয় মমতাকে। অবশ্যই মমতার মালকিনের অনুমতি নিয়েই। মমতা একটি বাড়িতে খাওয়া পড়ার কাজ করে। সে বাড়ির মালকিনের সঙ্গেও শুভমিতা ভাব করে নেয়। তবে শুভমিতার বাড়িতে মমতার প্রধান আকর্ষণ ছিল তার দুই শিশু কন্যা।
মমতা বাড়িতে এসে ঢুকলেই যেন শুভমিতার বাড়িতে এক ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। আনন্দের জোয়ার নামে। দুই কন্যাকে নিয়ে শুভমিতার তখন স্বচ্ছল সুখী সংসার। মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে থেকে, স্বামীর সঙ্গে মান অভিমানের রোমান্সে বেশ ভালোই দিন কাটছিল তার। কিন্তু মমতা এনে দিল স্বাধীন উচ্ছল কৈশোর। যেটা থেকে সে দীর্ঘদিনই বঞ্চিত। কৈশোর শেষে তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর মৃত্যুর পর থেকেই বলা যেতে পারে।
একদিন হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেল শুভমিতা! মমতা তার মালকিনের সঙ্গে ঝগড়া করে কাজ ছেড়ে দিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দারিদ্র্যের সংসার মমতার। কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে খাবার জোটানোই মুশকিল। শুভমিতা জানে, এই বয়সের অবোধ কিশোরীর নিরাপত্তার যে কতটা অভাব। ফলে এই সুযোগে শুভমিতা নিজের বাড়িতেই আশ্রয় দিল মমতাকে। যদিও স্বামী শুভঙ্কর প্রথমে কিছুটা আপত্তি প্রকাশ করেছিল পরের মেয়ের দায়িত্ব নিতে। কিন্তু সারাদিনের ব্যস্ততার পর, বাড়ি ফিরলেই দুটি শিশুর আবদার সামলাতে হিমশিম খেয়ে যেত বেচারা শুভঙ্কর। সারাদিন স্ত্রী সঙ্গ দেয় বাচ্চাদুটিকে। ফলে ঘরে ফিরে সে দায়িত্ব নিতে না পারলে স্ত্রীর মেজাজ বিগড়োয় মাঝে মাঝে। সেছাড়া শুভঙ্কর তখন পরিণত ব্যক্তি। স্ত্রীকে কৈশোরের সঙ্গ দেওয়ার ক্ষমতা তো তার আর নেই। ফলে স্ত্রীকে এতটা আনন্দিত দেখে শুভঙ্কর রাজি হয়ে গেল। পরিণামে কাজের শেষে ঘরে ফিরে মমতার উচ্ছ্বলতার ভাগ সকলের সাথে শুভঙ্করও নিতে থাকল।
বেশ চলছিল শুভমিতার সংসারটা। ভরা যৌবনে শারীরিক সামর্থ্যও তখন তার অনেকের অপেক্ষা বেশি। ফলে কাজের থেকে খেলা, ঘোরা, বেড়ানোর সময় সে যথেষ্ট পেতই। আবার এখন সহযোগী হয়ে মমতা আসায় আরও দ্বিগুণ আনন্দের সঙ্গে তার দিন কাটতে থাকল। গ্রামের কৈশোরের সাথীদের প্রতি যতটা স্নেহ ছিল, তা আজ মমতাকে উজাড় করে দিতে পেরে বেশ মানসিক পরিতৃপ্তি বোধ করল শুভমিতা। মমতাকে বড় কন্যার সঙ্গে বসিয়ে সন্ধ্যাবেলা লেখাপড়া শেখাতে লাগল। ঠিকে কাজের লোকটি যেমন ছিল তেমনই রইল। বাড়ির সকলকে আনন্দ দেওয়া ছাড়া মমতার তেমন কোনও কাজ ছিল না।
সংসারের কাজ চলতে চলতে মমতা আর শুভমিতার ব্যাডমিন্টন খেলা চলতে থাকত। বড় মেয়ে অরুণিমাকে তখন সকালের খাবার খাইয়ে টিফিন সহ নার্সারির বাসে তুলে দিয়ে আসা হয়ে গেছে। একদিকে মাস খানেকের শিশু অনুরাধাকে প্যারামবুলেটরে শুইয়ে রেখে, কড়ায় রান্না বসিয়ে, বাড়ির সামনের লনটাতে একটুখানি খেলা, আর পালা করে ছুটে গিয়ে গ্যাসে চাপানো রান্নাটা খুন্তি দিয়ে নেড়ে আসা, এই চলত। শুভমিতা কৈশোর থেকেই ব্যাডমিন্টন খেলায় বেশ দক্ষ ছিল। ফলে নতুন খেলতে শেখা মমতাকে সে বার বারই হারিয়ে দিত। শুভমিতাকে এভাবে খেলতে দেখে তার সমবয়স্ক দু'একজন প্রতিবেশী গৃহিণীও এসে যোগ দিত তাদের সঙ্গে।
৩৪ ঊর্ধ্ব শুভমিতা হঠাৎই যেন কিশোরী হয়ে উঠতে থাকল। এরপরই শুরু হল শুভমিতার সাজগোজের পরিবর্তন, যা বিয়ের পর এক সময় ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। স্বামীর স্বচ্ছল অর্থনৈতিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নিজে ও তার সঙ্গীনী মমতাকে শহুরে আধুনিক পোশাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। স্বামীর নিষেধ অমান্য করে শুভমিতার গায়ে উঠল আবারও হাঁটুর নিচে ফ্রক, স্কার্ট, জিন্স। তাই দেখে মমতারও শখ হল জিন্স পড়ার। এতটা স্বাধীনতা শুভমিতা ইতিপূর্বে কখনও পায়নি। ফলে মমতাকেও নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে তখন তার যৌবনের আনন্দ উপভোগ চলতে লাগল। যতই কিশোরীর মতো আচরণ হোক, আসলে তো সে পূর্ণ যুবতী। আর নিজের অনেক শখের দুই কন্যার তখনও কৈশোর আসতে ঢের দেরি। তাই মমতার সঙ্গেই কৈশোর ও যৌবনের উচ্ছ্বলতার খেলা চলতে থাকল।
অন্যদিকে শুভমিতার দুই কন্যাও তাদের একটা নতুন দিদিকে পেয়ে যতটা খুশি, মমতাও দুটি শিশুকে নিয়ে তার ফেলে আসা শৈশবের আনন্দও উপভোগ করে ততটাই তৃপ্তি পায়। শুভমিতার বাড়িতে তখন আনন্দের জোয়ার। স্বামী শুভঙ্করও সেই আনন্দের সঙ্গী। তা'বলে বয়স কারুরই থেমে থাকতে পারে না। শরীরে তা ধরা দেয়। এতদিন যে কুঁড়িটি পাপড়ির দ্বারা আবৃত হয়ে ফুটব ফুটব করেও ফোটেনি, ধীরে ধীরে নতুন আলোয় পাপড়ির বন্ধন মুক্ত হয়ে সে প্রস্ফুটিত হতে থাকল। একটি কুঁড়ি ফোটার পূর্বেই যেখানে মৌমাছি, ভ্রমর ও কীট পতঙ্গের দলের অপেক্ষা সয় না, সেখানে নিরাপদে কুসুমটি যখন তার পাপড়ি গুলি মেলল, তখন সেই সৌরভে চারপাশে গুঞ্জন উঠতে থাকল। মমতার শরীরে যৌবন এল। পাড়া প্রতিবেশীরা নানা বিষয়ে সতর্ক করতে থাকল শুভমিতাকে। কিন্তু শুভমিতা কোনদিনই সামাজিক বন্ধনকে মেনে নেয়নি। সমাজই তাকে মেনে নিয়েছে চিরকাল। ফলে মমতাকেও শুভমিতা নিজের মতই স্বাধীনতা দিয়ে দিল সমাজকে অমান্য করে। শুধু সমাজ সম্পর্কে তাকে যথেষ্ট সাবধান করে দিল। কারণ নিজেও সে কৈশোর থেকে স্বাধীনতা ও সচেতনতার মধ্যেই বড় হয়েছে।
পাড়ার এক মিষ্টির দোকানের কর্মচারী তাকে ভালোবাসে বলেই জানত মমতা অবোধ কৈশোর থেকেই। তখনও ভালোবাসা কী, কিছু বুঝে ওঠার বুদ্ধি তার হয়নি। গোপনে একটু হাসি, চোখের ইঙ্গিত, দুটো কথা বলা, প্রেমের অর্থ ছিল এই তার কাছে। আগের বাড়িটাতে কাজ করার সময়, ও বাড়িতে কোন ভালো রান্না হলে লুকিয়ে এনে খাওয়াত তার প্রেমিককে। সেই মেদিনীপুর থেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে আসা অল্প বয়সী যুবকটিরও এই কোলকাতা শহরে আপনজন বলে কেউ ছিল না। গ্রাম ছেড়ে আসা মন কেমন করা কাটত তার মমতার ওইটুকু সাহচর্যেই। মমতার যৌবন এবার তাকে ক্রমশ আকৃষ্ট করে তুলল আরও বেশি করে। কারণ তার মতো সাজ পোশাকের কোনো যুবতীর দেখা নিজের শ্রেণীতে মেলা ভার। প্রতিবেশীদের মুখে খবর এল শুভমিতার কাছে। শুভমিতা সরাসরিই প্রশ্ন করে সবই শুনলো মমতার কাছ থেকে। মমতা স্বীকারও করল, যে শঙ্কর নামে ওই যুবকটিকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। শুভমিতা ভেবে পেল না এতে কী দোষ আছে! শুধু বিবাহের পূর্বে সন্তান এসে যাওয়া সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দিল আর একবার। আর খুব কৌতূহল প্রকাশ করল মমতার প্রেমিকটিকে দেখার।
মমতা শুভমিতাকে কাকিমা বলত। মমতার গোপন অভিসারের সঙ্গী হয়ে বেশ রোমাঞ্চ বোধ করল শুভমিতা। মিষ্টির দোকানে সাক্ষাৎ হল মমতা ও তার কাকিমার (শুভমিতা) সঙ্গে মমতার প্রেমিক শঙ্করের। এ ব্যাপারে সহযোগিতা করল ওই দোকানেরই আর এক কর্মচারী। শুভমিতা তাকিয়ে দেখল শঙ্করের থেকে এই কর্মচারীটিকে দেখতে ফর্সা ও সুন্দর! ওই শ্রেণীর মধ্যে এমন সুদর্শন যুবকের সন্ধান পাওয়া ভার। সেই যুবকটি দোকানে বসিয়ে মমতা ও শুভমিতাকে মিষ্টি খাওয়াল কোন অর্থ বিনাই। শুভমিতা যুবকটির দিকে চোখ তুলে ভালো করে আর তাকাতে পারল না বেশিক্ষণ। বাড়ি ফিরে এসে মমতাকে প্রশ্ন করল, "এমন একটা সুন্দর ছেলে থাকতে তুই শঙ্করের সঙ্গে কেন প্রেম করলি? এর সঙ্গেই করতে পারতিস।" মমতা জবাবে তেমন কিছু বলতে পারল না। তবে মমতা, ও শুভমিতার তার কন্যাদের সহ ওই মিষ্টির দোকানে রোজই প্রায় বাড়ির জন্য মিষ্টি কেনার ছলে যাতায়াত বাড়তে থাকল। একটি পর্দার আড়ালে শঙ্কর ও মমতা একটু সময় প্রেম করত। শুভমিতা একটি বেঞ্চিতে বসে মেয়েদের সহ মিষ্টি খেত, আর ফর্সা সুদর্শন যুবকটির সঙ্গে দু একটি কথা বলে আলাপ করত। কিন্তু উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক বিবাহিতা নারীর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে সেই যুবকটি লজ্জায় লাল হয়ে উঠত। এটিও যেন এক আনন্দের ছোঁয়া দিয়ে যেত শুভমিতার মনে।
এমন কত রঙিন রোমান্টিক দিন কাটতে লাগল শুভমিতা ও মমতার। শুভঙ্করের অনুপস্থিতিতে মমতার প্রেমিক শঙ্করেরও বাড়িতে মাঝে মাঝে যাতায়াত শুরু হল। দুই মেয়ে সহ শুভমিতা, মমতা ও শঙ্করের মেলা দেখতে যাওয়া, সেখানে শুভমিতার ছোট মেয়েটিকে নিয়ে ছল করে মমতার শঙ্করের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া, তারজন্য শুভমিতার কাছ থেকে বকুনি, একসাথে মেলায় ফুচকা খেতে গিয়ে ফুচকাওয়ালার দু'জনকেই বড় ও ছোট বৌদি সম্বোধন, ইত্যাদি নানান ঘটনা খুবই আনন্দ দিয়ে যাচ্ছিল শুভমিতা ও মমতা দু'জনকেই। ফুচকাওয়ালা তো শুভমিতার বড় মেয়েটিকে নিজের মেয়ে, আর ছোটটিকে মমতা ও শঙ্করের মেয়ে ভেবে বসল। তাই নিয়ে সেদিন কত লজ্জা মিশ্রিত হাসিই না তারা হেসেছিল। গ্রাম্য মেলায় হিন্দি সিনেমার গানের সঙ্গে অদ্ভূত সাজগোজ করা কয়েকটি মেয়ের নৃত্য দেখে শুভমিতা সেদিন ভীত ও বিস্মিত দুইই হয়েছিল।
শুভমিতার মেয়েরা ইতিমধ্যে বড় হয়েছে। অরুণিমা নার্সারির গন্ডি অতিক্রম করে ক্লাস টু। ছোট মেয়ে অনুরাধাও কবে হাঁটতে চলতে শিখে গেছে। মুখে কথা ফুটতেই তাকেও নার্সারিতে ভর্তির ব্যবস্থা চলছে। মমতা এতদিনে দিব্যি লিখতে পড়তে শিখেছে। ইংরেজিও একটু আধটু উচ্চারণ করতে পারে। ওষুধের নাম পড়তে পারে। মমতার শরীরে ক্রমশ ভরা যৌবনের সৌন্দর্য ফুটে উঠছে। চাপা গায়ের রঙের আকর্ষণ যেন আরও বাড়ছে। সমস্ত পাড়াকে সে মাতিয়ে তুলেছে তার যৌবনের ঢেউয়ে। মাঝে মাঝে একটু তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর পুরুষকেও। আর শুভমিতা রোমান্স উপভোগ করছে কিছুটা মমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
শীতের দুপুরে, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় দু'জনেই প্রায় সমবয়স্ক যুবতীর সাজে পাড়া ভ্রমণে বের হয়। কখনও শুভমিতার মেয়েরাও সঙ্গে থাকে। তাদের কারুরই তখনও কিছু বোঝার বয়স হয়তো হয়নি। শুধু বড় মেয়ে অরুণিমার প্রশ্নের উত্তরে একদিন শুভমিতা বলেছিল, "ওটা মমতা দিদির বর হবে।" কতবার মিষ্টির দোকানে যাতায়াত, সেই যুবকের সঙ্গে একটু চোখাচোখি, এ যেন মমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুভমিতার দ্বিতীয় বার কৈশোরের পর যৌবনে পা। পাড়ার দোকানদার ও অটো চালকদের সঙ্গে শুভমিতারও ভাব জমে গেল। তা'বলে স্বামীর প্রতি রোমান্সে একটুকুও ঘাটতি পড়ল না তার। শুভঙ্করের মনেও কখনও তার স্ত্রীর সম্পর্কে সন্দেহের উদয় হয়নি। কারণ গ্রীষ্মের রাতে হাওয়া খেতে খেতে পড়াশোনার শেষে দুই মেয়ে ও মমতাকে নিয়ে স্বামীর অপেক্ষাতেই রাস্তার মোড়ে কতদিন দাঁড়িয়ে থেকেছে শুভমিতা।
কবে যেন দু'জনের মনেই বসন্তের সমাগম ঘটল। শুভমিতারটা অপ্রকাশ্য হয়ে মনের গভীরে উপভোগের মধ্যেই তৃপ্ত হতে থাকল। কারণ তার স্বামীর কাছ থেকেও তো সমাজ স্বীকৃত রোমান্স সে যথেষ্টই পায়। আর এটা তার প্রথম যৌবনও নয়। কিন্তু প্রথম যৌবনের প্রেমের নেশা, মমতাকে করে তুলল উত্তাল। প্রকৃতিতে এলো ঋতুরাজ বসন্ত! শুভমিতার বাড়িতে শুভঙ্করের অনুপস্থিতিতে চলল হোলি খেলা। মমতা, শঙ্কর, শুভমিতা ও তার দুই মেয়ে, সকলেই সেই সন্ধ্যায় পরস্পর রঙের খেলায় মেতে উঠল। আর সেদিনই সুযোগ বুঝে শুভমিতা শঙ্করের কাছ থেকে মমতার হয়ে প্রতিশ্রুতি আদায় করল ওদের সম্পর্কের। শুভমিতা মমতাকে শঙ্করের সঙ্গে বিশ্বাস করে সিনেমা দেখতেও ছেড়ে দিতে থাকল একা। তবে সঙ্গে নিজের বড় মেয়েটিকে তাদের মাঝখানে দিয়ে মমতার নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা করেই। এই পর্যন্ত সবকিছু যথাযথই ছিল। কিন্তু যৌবনের এই প্রবল স্রোত যে কোনদিন সব বাঁধ ভেঙে দিতে পারে, সে অভিজ্ঞতা শুভমিতার ছিল না।
একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শুভমিতা মমতাকে তার ঘরে শঙ্করের সঙ্গে চুম্বনরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে নিজেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ল। সেদিনই প্রথম বুঝতে পারল, কোথাও তার কিছু ভুল হয়ে গেছে হয়তো। তবুও পরে মমতাকে বুঝিয়ে কিছু বলল। তবে তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। মমতার বাঁধ ভাঙ্গা নদীর জল অনেক দূর এগিয়ে গেছে। পাড়ায় রটছে অনেক কথা। শুভমিতা তবুও নিশ্চুপ। কিছুদিনের জন্য বাড়ি যাওয়ার ছুটি চাইল মমতা। এভাবে আগেও ছুটি নিয়ে সে বাড়ি গেছে। তবে শুভঙ্কর তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসেছে, আর মমতার মা নিজে সঙ্গে করে মেয়েকে ফেরত দিয়ে গেছে শুভমিতার বাড়িতে। এবার মমতা দাবি করল সে বড় হয়েছে যথেষ্ট। একাই বাড়ি যেতে পারবে। শুভমিতাও তাকে সমর্থন করল এই মনে করে, যে তারই মতো একজন স্বাধীন নারী হিসাবে মমতা যেন নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। শুভঙ্কর রাজি হল। মমতাও তার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
হঠাৎ দু'দিনের মাথায় মমতার মা এসে হাজির শুভমিতার বাড়িতে এক সন্ধ্যায়। শুভঙ্কর তখনও বাড়ি ফেরেনি। মমতা ছুটিতে বাড়ি গেছে, শুভমিতার কাছে এ কথা শুনে মমতার মায়ের মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা! প্রচন্ড আবেগের সঙ্গে সে বলতে লাগল - ছি ছি, এ কী করল মেয়ে! তার আগে গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে মরতে পারল না? এভাবে বাড়ির মুখে কালি লেপে গেল! এই কথাগুলি শুনে শুভমিতাকে চমকে উঠতে হল। কৈশোরের বন্ধু বিচ্ছেদের এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল। এভাবেই একটা জীবন শেষ হয়েছিল সেদিন। শুভমিতা ভীত হয়ে অনেক চেষ্টা করে মমতার মাকে শান্ত করল। কিন্তু মমতার মা আর বেশিক্ষণ থাকতে পারল না তাদের বাড়ি। শুভমিতা মিনতি করে শুধু বলল, মেয়ে ফিরে এলে তাকে মারধর, অপমান না করতে। শুভমিতার সারল্য ও ঔদার্যের কারণে মমতার মা, শুভমিতাকে দোষারোপও করতে পারল না। সংক্ষেপে শুধু বলল, "অমন মেয়ের মুখ দর্শনও আর করব না কখনও জীবনে। বিয়ের আগেই এই কান্ড!"
শুভমিতা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতে লাগলো। নিজের স্বামীর কাছেও বলতে পারল না কিছু। বার বার মনে হতে লাগলো, জীবনে দ্বিতীয় বার একই ঘটনা ঘটতে চলছে না তো? প্রতিবেশীদের কাছে পরামর্শ চাইতে গেলে, তারা সহানুভূতির সঙ্গেই শুভমিতার ভুলগুলো ধরিয়ে দিল। এই বয়সের একটি কাজের মেয়েকে এত স্বাধীনতা দেওয়া তার ঠিক হয়নি। শুভমিতার ভাগ্য ভালো, যে মমতার মা তাকে দোষী সাব্যস্ত করেনি। তবুও এখনও নাকি সেই ভয় কাটেনি। মেয়েটির অন্য কোন ক্ষতি হয়ে থাকলে তার বাড়ির লোক শুভমিতার স্বামীকেই সেই ক্ষতির জন্য দায়ী করে সমাজের সামনে অপদস্থ তো করতেই পারে, সেইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ বাবদ যা খুশি অর্থও দাবি করতে পারে। তবে ঠিকে কাজের মাসি, মমতার মা, এরা সকলেই শুভমিতাকে এতটাই স্নেহ করত, যে প্রতিবেশীদের এই সমস্ত নোংরা কথা সে বিশ্বাস করেনি। কেউ বিশ্বাস করবে বলেও তার সন্দেহ হয়নি।
বরং অন্য অনেক দুশ্চিন্তা তখন শুভমিতার মাথায় ঘুরতে থাকল। ছেলেটি যদি মমতাকে বিক্রি করে দিয়ে থাকে? একাধিক যুবকের মধ্যে মমতাকে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যদি মমতা কারুর হাতে খুন হয়ে গিয়ে থাকে? কত বছর আগে তার বান্ধবীর মৃত্যু হয়েছিল? এরমধ্যে দ্বিতীয় বার জন্ম নিয়ে মমতার বয়সী কি তার হওয়ার কথা? যারা অল্প বয়সে অপঘাতে বা আত্মহত্যা করে মারা যায়, লোকে বলে তারা পরের জন্মেও বেশি দিন বাঁচে না। মনে মনে বছরের হিসাব করতে থাকে শুভমিতা। চিন্তারা কূল কিনারা ছাড়িয়ে চলে যায়।
কয়েকটি দিন এভাবে কাটার পর, একদিন সন্ধ্যায় মমতা তার ব্যাগ সুটকেস নিয়ে হাজির হল শুভমিতার বাড়ি। মমতাকে নিরুদ্বিগ্ন ও নিশ্চিন্ত মনে খোলা দরজা দিয়ে এভাবে শুভমিতার ঘরে সরাসরি প্রবেশ করতে দেখে শুভমিতা মনে মনে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তবে নিজেকে সংযত করে গম্ভীর ভাবে শুধু বলল, "মাথায় সিঁদুরটা দিয়ে আসা উচিত ছিল।"
এরপর থেকেই শুভমিতার বাড়ির পরিবেশের পরিবর্তনের সূচনা। কোথায় গেল শুভমিতার সেই পূর্বের স্নেহ! অনেক রকম বিধি নিষেধ আরোপ হতে থাকল মমতার উপর। শুভমিতা মমতার উপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগল শঙ্করকে বিয়ের জন্য। এদিকে দোকানের মাইনে বাবদ শঙ্কর যা পায়, তাতে সংসার চালানো সম্ভব নয়। শুভমিতা একদিন ডেকে পাঠাল শঙ্করকে তার বাড়িতে। শুভমিতার দাবি, শঙ্কর যতদিন না আর একটু গুছিয়ে নিতে পারছে নিজেকে, ততদিন পর্যন্ত শুভমিতাই মমতার দায়িত্ব নেবে। শঙ্কর জানাল, ভবিষ্যতে টাকা জমিয়ে তার নিজের একটি দোকান করার ইচ্ছা আছে। শুভমিতা এ কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, "ঠিক আছে, সে যখন হোক
সময় মতো কর। কিন্তু তোমাদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা খুব দ্রুত সারতে হবে।" শঙ্করের প্রশ্ন - একবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কিভাবে নিজের স্ত্রীকে আমি অন্যের বাড়ির কাজের মেয়ে হিসাবে রাখতে পারি? শুভমিতা - ও আমার বাড়ির কাজের মেয়ে নয়। আমি ওকে সেভাবে রাখিও না। ও আমাদের কাকিমা, কাকু বলে ডাকে। তাই এটা ওর বাপের বাড়ি হিসাবেই দেখ। কিন্তু সামাজিক সংস্কারের দোহাই দিয়ে শঙ্কর রেজিস্ট্রি বিয়েতে রাজি হল না। এতে শঙ্করের সম্পর্কে শুভমিতার মনে সন্দেহ দেখা দিল। শুভমিতা মমতাকে সে কথা বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। কারণ শঙ্কর তার পূর্বেই মমতাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে রেখেছে। আর মমতারও তখন সে কথায় অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না।
প্রেম তখন এতই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে, যে কোন সন্দেহের স্থান সেখানে নেই। শুভমিতার সঙ্গে এরফলে মমতার ক্রমশ সংঘাতের সৃষ্টি হতে থাকে। মমতার প্রেম শুভমিতাকে অগ্রাহ্য করে চলতে থাকে। শুভঙ্কর কাউকেই তখনও কড়া কথা বলতে শেখেনি। শুভমিতাকেই যথা সম্ভব পাহারায় রাখতে হচ্ছে মমতাকে। মমতার বাবা মা-ও এসে সেই পরামর্শই দিয়ে গেছে শুভমিতাকে। শঙ্কর যদি শীঘ্র বিয়ে করতে না পারে, তবে মমতার জন্য অন্য পাত্র দেখার সিদ্ধান্ত মমতার অভিভাবকের সঙ্গে শুভমিতাও নিয়েছে।
এভাবে হঠাৎ করে যৌবনের উচ্ছ্বলতার ঢেউয়ের উপর প্রথম বাঁধ দেওয়ার পর মমতার সেই মুখের হাসি কিভাবে থাকতে পারে? শঙ্করের সঙ্গে গোপন প্রেম তার চলতে থাকে। কিন্তু শুভমিতার কাছে তা গোপন রাখা যায় না। ফলে শুভমিতার বাড়িতে আনন্দের জোয়ারে তখন বাধা পড়তে থাকে। শুভমিতার বাড়িতে মমতা এখন গম্ভীর ও চিন্তিত মুখেই সময় কাটায়। শুভমিতার কাছে তা অসহ্য বোধ হতে থাকে। যে আনন্দের জন্য মমতাকে সে নিজের মেয়ের মতোই যত্ন ও স্নেহ দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিল, সেই মমতাই আজ তার কাছে ক্রমশ নিরানন্দের কারণ হয়ে উঠছে। বাড়িতে সমস্যার সৃষ্টি করে বাড়ির আনন্দের পরিবেশ নষ্ট করছে মমতা। শুভমিতার অবচেতন মন হয়তো অজান্তেই প্রশ্ন তুলেছে - কী লাভ, তবে আর বেশি দিন মমতাকে এ বাড়িতে রেখে? যদি সে আনন্দটাই না দিতে পারে?
মমতার জীবনে এরপর এল চরম বিশ্বাসঘাতকতার সেই দিনটি। শঙ্করের এক মামা খবর পেয়ে মমতাকে দেখতে আসতে চান বধূ হিসাবে সে কতটা উপযোগী। শুভমিতার মনে কিছুটা আশা জাগল। যাক্, যদি পার হয়ে যায় তো ঘাড় থেকে বোঝা নামে। কিন্তু শুভমিতার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছনোর পূর্বেই ভাঙচি পড়ল। পাত্রের মামাকে জানিয়ে দেওয়া হল, মেয়েটি ওই বাড়িতে কাজ করে। কাজের মেয়ের সঙ্গে একটা গ্রাম্য প্রাচীন সংস্কার অনেকের মনেই রয়ে গেছে। বাড়ির মালিককে ধরে রাখতেই মালকিনরা সর্বক্ষণের জন্য যুবতী মেয়ে কাজে রাখে! মামা দেশে ফিরে যাওয়ার পূর্বে শঙ্করকে জানিয়ে গেল, তারা ওখানেও আর একটি মেয়ে দেখে রেখেছে তার জন্য এবং সেখানেই শঙ্করের বিয়ে স্থির হয়ে যাবে শীঘ্র।
পরদিন শঙ্কর এসে সব জানাতে, শুভমিতা আবারও রেজিস্ট্রি বিয়ের কথা তুলল। শঙ্কর জানাল, মমতাকে বিয়ে করলে সে দেশের বাড়ির সমস্ত জমিজমা, বাড়ি, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। তখন তার পাশে কে থাকবে? নিজের স্ত্রীকে অপরের বাড়িতেও দীর্ঘদিন রেখে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে বাড়ির দেখা পাত্রীকেই তাকে বিয়ে করতে হবে। নাহলে শুভমিতা যদি ৬০০০০ টাকা তাকে দেয়, তবে একটা দোকান খুলে সে বছর খানেক পর মমতাকে বিয়ে করবে। শুভমিতার পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন মমতা নীরব দর্শক হয়ে শুধু সবই শুনে যাচ্ছিল। আর মাঝে মাঝে ঘর থেকে কী কারণে যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল।
শুভমিতা একবার কৌতুহল বশতঃ মমতাকে অনুসরণ করে দেখল, সে রান্নাঘরের বেসিনে বার বার চোখ মুখ ধুয়ে আসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এক ফোঁটা অশ্রুও সে তার বিশ্বাস ঘাতক প্রেমিককে দেখাতে চায় না। শুভমিতা ও মমতা দু'জনেই সেদিন কথার ধরনে বুঝেছিল শঙ্করের মতলব। মমতার কাছে শুধু অস্পষ্ট রয়ে গেল শুরু থেকে এতদিন যে নিবিড় সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল, সেটা তবে কী ছিল? অভিজ্ঞ শুভমিতা জানত। কতজনেরই এই পরিণতি সে দেখেছে!
এর পরের ঘটনা অতি সাধারণ। মমতা না চাইলেও, মমতার বাবা মা ও শুভমিতার চেষ্টায় মমতার অপর এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। মমতা প্রথমে চেয়েছিল, আগের মতোই শুভমিতার বাড়িতে থাকতে। কিন্তু এই নিরানন্দ, বিরহিনীর সঙ্গ শুভমিতার কাছে আর কাম্য ছিল না। শুধু মমতার অনুরোধে বহু দূরে, ভিন্ন রাজ্যের এক পাত্রের সঙ্গেই তাকে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল, যাতে বিবাহের পর শঙ্করের সঙ্গে কখনও আর দেখা না হয়।
মমতা চলে গেল। রেখে গেল আনন্দময় কিছু দিনের স্মৃতি। আনন্দের ভাগ নিতে মানুষের অভাব নেই। কিন্তু দুঃখীর সঙ্গী হয়ে তার দুঃখের ভার কমানোর ইচ্ছা, বা সময়, কতজনেরই বা থাকে?
বন্ধু হারায় না
অ শো ক কু মা র মো হা ন্ত
আজ একটাও মাছ পড়েনি নয়ানের জালে। উল্টে জালটাই ছিঁড়ে ফর্দাফাই। মনে হয় কোন বড়সড় মাছ পড়েছিল। জাল ছিঁড়ে পালিয়েছে। অথবা কেউ হিংসে করে ছিঁড়ে রেখে দিয়ে গেছে। বহু কষ্টে মেঠো জালটাকে বীরনগরের হাট থেকে কিনেছিল, সে জালের এমন অবস্থা দেখে পুরো মাথায় হাত নয়ানের। সারানোর মতোও অবস্থায় নেই। নয়ানের জীবন প্রবাহের মতো তা যেন শতছিন্ন। কি করবে ভেবে পায় না নয়ান। কি নিয়েই বা আজ বাজারে বসবে! পাশের ক্ষেতে শিবুও জাল পেতেছিল, ও জাল তুলছে। এসেছে দুইজনে একই সাথে। ও জাল তুলছে , নয়ান দেখছে শিবুর জাল ভর্তি মাছ উঠছে সাদা সাদা। ল্যাটা, শোল, দু একটা শিং মাগুর আর চুনো মাছ। শিবু ডাকল, "ও নয়ান, কি হলো তোর? বসে পড়লি কেন অমন করে?" নয়ান উত্তর দেয় না। শিবু নিজের জাল টাকে সযত্নে গুটিয়ে রেখে এসে নয়ানের গোটানো জালটা তুলে ধরে। একেবারে ছিন্ন ভিন্ন। শিবু বলে, "কি করে হল রে? চিন্তা করিস না। এ মাসের দুধের টাকা থেকে তোকে টাকা দেব। আরেকটা কিনে নিস্। বাড়ী চল। "
শিবু নয়ানের সেই কোন ছোট বেলার বন্ধু। গলায় গলায়। পাশাপাশি অবস্থান। ছোটবেলায় দুজনেই প্রাইমারিতে ভর্তি হয়েছিল। নয়ান প্রাইমারী গন্ডী পেরোতে পারেনি। থমকে গেছিল জীবনের চাকা বালির মধ্যে আটকে যাওয়া গাড়ির মতো। দারিদ্র্য ও অশিক্ষার নিষ্ঠুর থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছিল নয়ান। সে চাকা জীবনভর কসরতে আর ওঠাতে পারেনি। ও হিসেবটা খালি করতে শিখেছিল। ক্লাস থ্রী ফোরে শিবুর দু'একটা অঙ্ক মিললেও নয়ানের কোনদিনই উত্তর মিলত না। বুঝত এসব ওর জন্য নয়। তাই জীবনের অঙ্কটাও যেন মেলাতে শেখেনি নয়ান। সেখানে ও ফাঁকি। নয়ান পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিল মাছ ধরা। বাজারে গিয়ে বসে। যা দু'পয়সা হয় একার পেট চলে যায়। অন্য দিকে শিবু হাইস্কুলের দু'একটি শ্রেণীর দরজার গোড়া পর্যন্ত গিয়েছিল। তারপর পথ হারিয়ে ফেলেছিল। সেও আর এগোয় নি বেশীদূর। মাঝখানে বন্ধুত্বের রাশ খানিকটা আলগা হলেও পুরোপুরি ছিন্ন হয় নি। আবার দুইজন পুরোনো রাগিনীতে ফিরে এসেছে। শিবুই এখন নয়ানের একমাত্র বন্ধু তথা অভিভাবক। শিবুর পরিবার আছে। নয়ানের পরিবার নাই। শিবুর একমাত্র ছেলে -অজয়। একেবারেই ছোট। সবে ছ'য়ে পা দিয়েছে। শিবুর অবস্থা নয়ানের চেয়ে ভালো। বাপের কাছ থেকে বাড়ি আর দু'বিঘে ধান জমি পেয়েছে। বিলে জমি। জলা ধান ছাড়া কিছু হয় না। সারা বছর প্রায় খালিই থাকে। শিবু জাল পাতে নিজের বিল জমিতে। নয়ান জাল পাতে অন্যের জমিতে। শিবুকে মাছ বেচতে হয় না। ধানি জমি চাষ আর গোরুর দুধ, এ দিয়ে শিবুর তিনজনের সংসার চলে যায় কোনমতে। ফাঁক ফোঁকরে একটু আধটু টোটো চালিয়ে দু'পয়সা আয় করে। নয়ান বুঝতে পারে না জালটা কীভাবে ছিঁড়ল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শিবুর দিকে।
যাই হোক কষ্টেসৃষ্টে নয়ান আরো একটা জাল জোগাড় করে নিয়েছে। শিবুর সাথে নয়ানের বন্ধুত্বের রজ্জুবন্ধন কখনও শিথিল হয়নি। হাজারো ঝড় ঝঞ্ঝায় সে বাঁধন যেন আরো দৃঢ় হয়েছে, শক্ত হয়ে গিঁঁটটা বসে গেছে। বন্যায় আশ্রয় নেওয়া এ চিলতে জায়গায় অহি নকুল সম্পর্কের প্রানীরা যেভাবে সম্পর্কের নিবিড় সংশক্তিবন্ধনে সংঘবদ্ধ হয়ে সহাবস্থানে থাকে তেমনিভাবে। বিপদে এ ওর পাশে দাঁড়িয়েছে। ওপার বাংলা থেকে বাপ মায়ের সাথে এসেছিল নয়ান সেই কোন ছোট্টবেলায়। তারপর শিবুদের বাড়িতে ওঠেছিল। শিবুদের দেওয়ালের সাথে একটা ছোট চালা বেঁধে কোনক্রমে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। জীবন সংগ্রামের মরীয়া চেষ্টা। সর্বশক্তি দিয়ে বেঁচে থাকার আমরণ লড়াই। সে লড়াই শুধু বাঁচার লড়াই ছিল। কি যেন সম্পর্ক ছিল শিবুদের সাথে নয়ানদের কয়েক পুরুষ আগে। নয়ানের মা জানত ওসব সম্পর্কের হিসেব কিতাব। নয়ান শিবুর কারোরই মনে নেই সে হিসেবের খতিয়ান। মনে রাখার কথা ও নয়। ওরা বন্ধু এই পর্যন্ত। ব্যস্। নয়ান আর শিবুর মা বাবা কেউই আর বেঁচে নেই। তাই সম্পর্কের ও হিসেব গুলোও যেন ওদের সাথে গঙ্গা প্রাপ্তি ঘটেছে। হারিয়ে গেছে বুদ্বুদের মতো। কিন্তু বন্ধুত্বের অলিখিত সেই তমসুকটা কোনদিন মলিন হয়নি। সেটা তেমনই টাটকা আছে। মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে গেলেও রশ্মিছটার উদ্গীরন যেমন মেঘের পর্দা ছিঁড়ে অস্তিত্ব জানান দেয়, তেমনই যেন বন্ধুত্বের লাল আভা টুকু আকাশ জুড়ে অমলিন ভাবে ছিটিয়ে ওদের বন্ধুত্বের নিশান পতপত্ করে উড়িয়ে রেখেছে।
নয়ান সরকারী পাট্টা দেওয়া দুশতক জমি পেয়েছে শিবুর বাড়ির কাছে। সামান্য একটু দূরে। ঐখানে একটা চালা ঘর তুলেছে নয়ান। জীবনের প্রথমদিকে বিয়ে করেছিল। একটা ফুটফুটে বৌ ও এনেছিল ঘরে। কিন্তু বিধাতা পুরুষ তখন মুখ টিপে হেসেছিলেন বোধহয়। বিদ্রূপ করেছিল নয়ানকে। বৌটা পাশের গাঁয়ের পুলিনের বখাটে ছেলেটার সাথে আড়ালে আবডালে ভাব জমাত। মেলায় গিয়ে দেখা করত। জিলিপি কিনে খেত, নয়ানের নজরে এসেছে দু'একবার এসব,নয়ান আমল দেয়নি, থাক, অভাবের সংসারে এতে যদি বৌটার মনটা একটু হালকা থাকে, ক্ষতি কি! কিন্তু বজ্জাত মেয়ের যে পেটে পেটে এত শয়তানি তা বোঝা যায় নি। ও যে এত বড় ক্ষতি করবে বুঝতে পারেনি। একদিন নয়ানের ঘর ফাঁকা করে পালিয়ে গেল হারামজাদি। পুলিনের ছেলের সাথে বেপাত্তা হয়ে গেল। যাবার সময় নয়ানের সঞ্চিত কুড়ি হাজার টাকা, বিয়ের সব গয়নাগাঁটি হাতিয়ে নিয়ে চলে গেল।নয়ান হল সর্বস্বান্ত। নয়ান এসব কাউকে জানায়নি। থানা পুলিশ ও করেনি। আর ঘরে তুলবে না, তাই ঝামেলায় ও যায় নি, এ কথা পাঁচকান করেনি। নিজের মনের ব্যাথার পাখিটাকে জোর করে বুকের পিঞ্জরে আটকে রেখেছে। কাউকে দেখতে দেয় নি। আর নিজেই তার ঝটপটানির শব্দ শুনেছে কান পেতে। শুধু প্রাণের বন্ধু শিবুকে পাখির খাঁচার দুয়ার খুলে একটু দেখিয়েছে। জানিয়েছে শুধু শিবুকে। ছুঁতে দেয়নি পাখিটাকে। শিবু সান্ত্বনা দিয়েছিল। "ভুলে যা ওসব শয়তানীদের। যা হয়েছে ভালো হয়েছে। ও তোর ঘর করতে আসেনি। তোকে আবার আমি বিয়ে দেব।" নয়ান ও ওকে মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। বিয়ে আর করেনি। কানার লাঠি একবারই হারায়। এদের চক্করে পড়ে জীবনের সব হারাতে রাজি নয় নয়ান।রাধাবল্লভের উপর জীবনের সব ভার ছেড়ে দিয়ে নয়ান নিশ্চিন্তে থাকে। সকালে মাছ ধ'রে বাজারের এক কোণায় বসে। যা হয় তাই দিয়ে একার সংসার চলে। নয়ানের আলাদা একটা গুণ ছিল। ভালো মৃদঙ্গ বাজাতে পারে। সাথে সুরেলা কন্ঠ। বিকালে নয়ান শিবু মিলে গিরিধারী আশ্রমে যায়। আশ্রমে নয়ান খোল বাজিয়ে গান ধরে,
"ভাবে মজতে পারবে যেজন,
লাগবে না তার সাধন ভজন
তৈছে মুক্তি কইছে তুলসীদাস।"
শিবু করতালে সঙ্গত দেয়। আশ্রমিকরা নয়ানের গান শুনে বহবা দেয়। হরিধ্বনি দেয় সমস্বরে। মেয়েরা উলুধ্বনি দিয়ে আশ্রমের ভাবরসকে আরো সিক্ত করে তোলে। ঘনীভূত করে তোলে। সবাই বলে, "রাধাবল্লভ নয়ানের সব নিলেও এই আসল রত্নখানি দিয়ে গেছে, এটাকে কেড়ে নেয়নি।"
চারিদিক হঠাৎই অজানা রোগে ছেয়ে গেল। মৃত্যুর প্রজ্জ্বলিত বিভীষিকা। স্বজন হারানোর কান্নায় আকাশ বাতাস মুখরিত। মৃত্যু সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। টীকা আসবে আসবে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আসছে না। কবে আসবে কেউ জানেনা। সবাই উন্মুখ। অক্সিজেন সিলিন্ডারের আকাল দেখা দিয়েছে। মহামারীর পদধ্বনি। অশনি সংকেতে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। অজানা আতঙ্কে সবাই প্রহর গুনছে। দুয়ারে শমনের উকিঝুঁকি। নয়ান শিবু ও আতঙ্কিত হয় কিন্তু আমল দেয় না। জন্তুটা এলে তখন না হয় একটা কিছু ভাবা যাবে।
একদিন সন্ধ্যায় শিবুর বাড়ীতে এল দুজন অচেনা লোক। শিবুকে ডাকতে। জানাল, নয়ানের অবস্থা ভালো নয়, প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। শিবু ছুটল দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে। শিবুই সব ব্যবস্থার ভার নিল। দুদিন পর রিপোর্টে জানা গেল নয়ানের কোভিড পজিটিভ। শিবুকে কেমন পাগল পাগল লাগছিল কদিন। ওদিকে শিবুর বৌটা ও সকাল থেকে অসুস্থ । শিবু কোনদিক যাবে ভেবে পায় না। দু'দিক নজর দেবার সময় পায় না। নয়ান কে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটিতে শিবুও ক্লান্ত। শিবু দিগভ্রান্ত উন্মাদ যেন। টাকার সংস্থান করতে টোটোটা জলের দরে বেঁচে দিল। নয়ান অশক্ত শরীরে একটু বল পেয়েছিল ক'দিনে হাসপাতালে ভর্তির পর।বৌয়ের অসুস্থতার কথা শিবু জানায়নি নয়ানকে। কিন্তু একটু সুস্থ হলে নয়ান যেই শুনল শিবুর বৌ অসুস্থ নয়ান হাসপাতাল থেকে দৌড় লাগাল। দুইবন্ধু মিলে বৌটাকে বাঁচাতে পারেনি। শিবুর বৌটা আর মাত্র দুদিন বেঁচে ছিল। তারপর হাসপাতালেই মারা গেল । অনেক দেরী হয়ে গেছিল যে হাসপাতালে নিতে। কিছুদিনের মধ্যে শিবুর ও শরীর খারাপ হতে থাকল। শিবুর তিনকুলে কেউ নেই। শ্বশুর শাশুড়ি কবেই চলে গেছে। একটা শ্যালক, সেও শিবুকে বরাবরই পর ভেবে এসেছে। খবর নেয় না শিবূ্দের।
নানান ধকলে স্ত্রীর মৃত্যু শোকে শিবুর শারিরীক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। অনিয়মের জন্য হিমোগ্লোবিন ৬ এর নীচে নেমে গেল। গায়ে সব সময় জ্বর। এ সব কথা নয়ানকে জানাত না। ও বেচারা কি করবে একা একা! পয়সাই বা কোথায় পাবে! একদিন নয়ানকে ডেকে বলল "নয়ান, আমার ও বোধহয় দিন ফুরিয়ে আসছে। তুই আমার সব কিছুর মালিক হবি আর আমার অজয়কে ও তোর হাতে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি । ওকে ভালো দেখে একটা বিয়ে দিস্। নিজের তো বিয়ের সাধ মিটল না। ওকেই ছেলের মতো মানুষ করিস্। সুন্দর দেখে বৌমা আনিস্। বৌমা তোকে আদর যত্নে রাখবে।" শিবু বলে চলে। "চুপ কর, শিবু। আমি তোকে যেতে দেব না। আমার সব দিয়ে তোকে সুস্থ করে তুলব, তোর কিছু হয়নি।" নয়ান কঁকিয়ে ওঠে। কান্না ঝরে পড়ে নয়ানের গলা দিয়ে। জড়িয়ে ধরে শিবুকে। নিজের বাড়ী ফেলে নয়ান শিবুর বাড়ী পড়ে রইল। ভূমিকম্পে যখন মাথার উপর গৃহ ভেঙে পড়ছে তখন গৃহকোণে রক্ষিত ক্ষুদ্র আসবাবপত্র যেমন কেউ লক্ষ্য করে না, তেমনি নিজের বাড়ির সব ভুলে নয়ান পড়ে রইল শিবুর বাড়ি।
এত করেও বাঁচাতে পারেনি শিবুকে। শেষের দিকে শিবুর লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছিল।
আজ বড় একা নয়ান। বড় নিঃসঙ্গ। নিস্তরঙ্গ। জীবনের অক্ষরেখাটা বড্ড আঁকাবাঁকা। বড্ড চঞ্চল। গন্তব্য বিন্দুতে পৌঁছনোর আগে তা এলোমেলো ভাবে ছুটে চলে। গতিগবেগটাও যেন আগোছালো। কখন ও অশ্বগতি, কখনও পবনগতি, কখনও বা শম্বুকগতি। কোন নিয়ম রীতির ধার ধারে না। ছোটবেলাকার সেই সরল অঙ্কের মতোই জটিল। নামেই সরল অঙ্ক কিন্তু বড় কুটিল। মেলানো ভার। ইতিমধ্যে শিবুর ছেলে অনেকটা বড় হয়েছে। নয়ান ওকে হাইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। শিবু যেখানে জাল পাতত সেই জায়গাটা বড্ড ফাঁকা লাগে। তাই নয়ান আর যায় না মাঝ ধরতে। নির্বান্ধব নয়ানকে শিবুর সংসারের সব ভার বইতে হচ্ছে। কালের ফেরে। ওকে আশ্বস্ত করবার আজ আর কেউ নেই। আশ্রমে আর যায় না নয়ান। ওর মৃদঙ্গে আর বোল ওঠে না। বায়ার উপর আঙ্গুল গুলো খেলে না। রাধাবল্লভের উপর অভিমান হয়। আর গান শোনায় না রাধাবল্লভকে। ছিন্ন সংসারের দুয়ারে নয়ান বিকেলের ফিকে রোদে বসে কত কথাই না ভাবছে। জীবনের সব অঙ্কগুলো নয়ানের ভুলে ভরা। অজয়, ইস্কুল থেকে এসে নয়ানের কাঁধে হাত রাখে। বলে, "কাকা জাল পাততে যাবে না? চল না কাকা, আজ থেকে তোমার সাথে আমিও জাল পাততে যাব বিলে। তুমি আমাকে সব শিখিয়ে দেবে।"
মায়ের বোধন
দী পা ন্বি তা চৌ ধু রী
"বাজলো তোমার আলোর বেণু"--- ঘুম ভাঙতেই মহালয়ার গানটি কানে বাজলো মহামায়ার। শরৎ ভোর হলো মাত্র। অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ এলো শিউলি ফুলের। নিচের তলায় বেশ সরব আওয়াজ হচ্ছে সবার। আজ দেবীর বোধন।মহাষষ্ঠী। এমনি এক ষষ্ঠীর দিনে পাঁচ বছর আগে মহামায়ার বধূবরণ হয়েছিল। শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে আলতায় পা দিয়ে এ ঘরে প্রবেশ হয়েছিল তার। দিব্যনাথের বড় ছেলে অনিমেষ মহামায়ার স্বামী। প্রচন্ড মদ খেয়ে এসে মারধর করতো তাকে। দুবছর আগে এমনি এক দূর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিনে মারধর করতে করতে অনিমেষের লাথিটা গিয়ে পড়ে আটমাসের অন্তঃসত্তা মহামায়ার পেটের উপর। ব্যাস্! প্রচন্ত ব্লিডিং এর পর বাচ্চাটাকে আর বাঁচাতে পারেনি ডাক্তার। সেই থেকে মহামায়া অন্যরকম হয়ে গেছে।মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। কোন কিছুতেই যেন তার আর মন লাগে না।
তবে অনিমেষ মদ খাওয়া ছেড়েও ছাড়েনি। মারধর আর করে না। উদভ্রান্তের মত মাঝেমধ্যে কোথায় চলে যায় আবার চলেও আসে। অনিমেষ আজ আসবে কি না মহামায়া এখনো জানে না।
বউমনি! ও বউমনি উঠলে!
মহামায়ার ননদ শারদা ডাকতে এলো তাকে।
ছোড়দি তুমি যাও। আমি একেবারে স্নান সেরে নিচে আসছি। বলল মহামায়া।
সিঁথি ভরতি সিঁদুর আর গরদের লাল পাড়ের শাড়িতে মনে হচ্ছিল মা যেন স্বয়ং দিব্যনাথের বাড়িতে চলেই এলো।
চুপচাপ মহামায়া মন্ডপে গিয়ে বসলো।
বাসনা রাণী মহামায়াকে দেখে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলো। মহামায়া তার ছেলের বউ হলেও মেয়ের মতই আগলে রাখতে চান মহামায়াকে। ভাবেন আর কাঁদেন। আজও মায়ের কাছে মহামায়ার জন্য বুঝি তার প্রার্থনা।
কি রে মা! চুপচাপ বসে আছিস! পুজোর মালাটা গাঁথতে হবে তো। রমলা পেছন থেকে এলো হঠাৎ- 'কি করছো বড়দি!'
মায়াকে বলছ বোধনের মালা গাঁথতে! বলিহারি বাপু তোমার! ঘরের মঙ্গল-অমঙ্গল দেখবে না তুমি। একে তো মরা সন্তান দিয়েছে। তার উপর কন্যা সন্তান তার চেয়ে বড় কথা এমন দিনেই তো এসব হয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে!'
বাসনা কঠিন ভাবে বললো তাতে মহামায়ার কি দোষ? বল আমায়। সব দোষ অনিমেষের। মেয়েটাকে এ পুজোয় না কাঁদালেই নয়?
এদিকে সব শুনে মহামায়ার চোখে জল উপচে পড়লো। দৌড়ে গিয়ে উপরতলায় উঠে গেল। দরজায় দোর দিয়ে মা দুর্গার ছবির সামনে বসে রইলো।
মুখে রা-টি নেই। শুধু তাকিয়ে আছে অপলক মা ত্রিনয়নীর দিকে।
ধুনুচির ধোঁয়া ও দীপের আলোয় উদ্ভাসিত মন্ডব। কাঁসর ঘন্টায় মুখরিত।ঢাকের বাজনায় আজকের সন্ধ্যাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। ঘরের সবাই প্রায় পূজোর মন্ডপে। মহামায়া ঘরের সব আলো নিভিয়ে মা দুর্গার ছবির সামনে এখনো বসা। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। তিনবার রিং হওয়ার পর মহামায়া ফোন তুললো।
হ্যালো! কে?
-মায়া আমি শ্যামা। জয়ার অবস্থা ভালো নয়। তুই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়।
জয়া মহামায়ার ছোট বোন।
মহামায়া খুব ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শাশুড়ীকে খুঁজছিল। না পেয়ে না বলেই বের হয়ে গেল।
মহামায়া যখন হাসপাতালে পৌঁছাল তখন জয়ার অবস্থা খুব খারাপ।
-দিদি বল আমি না থাকলে তুই ওকে দেখবি! কাঁদছিল আর বলছিল জয়া। এটাই শেষ কথা ছিল জয়ার।
মহামায়া আর জয়ার মা বা নেই। মামার কাছেই মানুষ।
মহামায়া চিৎকার করে কেঁদে উঠলো 'জয়াআআআআ'- বলে। 'আমার জয়াকে আমার মতো মেরে ফেলোনা ভগবান।ওকে অন্ততঃ বাঁচাও।' সে হাসপাতালের সিঁড়িতে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লো। পেছন থেকে অনিমেষ মহামায়ার চুলে হাত দিতেই মহামায়ার কান্নাটা যেন আরো বেড়ে গেল।
'ওঁয়াওওঁয়াও' কান্নার শব্দ শুনে তারা দুজন ওটি রুমের সামনে গেলো। নার্স জয়ার কন্যাটিকে মহামায়ার কোলে তুলে দিলো।
-আমরা দুঃখিত আপনার বোনকে বাঁচাতে পারলাম না।
মহামায়ার চোখ মুখ অদ্ভুত রকমের হয়ে গেল। যেন এ মুর্হূতে সে পৃথিবীর সব চেয়ে অভাগী এতিম। হঠাৎ জ্যোতির আলো যেন পড়লো তার চোখে মুখে।
অনিমেষ বললো, মহামায়া দেখো কি অদ্ভুত! বাচ্চাটি কি সুন্দর করে হাসছে তোমার কোলে। যেন তোমার কোলে মা দুর্গার বোধন হচ্ছে। আজ থেকে ওর নাম গৌরী।
পাশের মন্ডপ থেকে মহাষষ্ঠীর বোধনের আরতির সুর ভেসে আসছিলো।
ভুল ভুলাইয়ার শেষে
র থী ন্দ্র না থ রা য়
হৃষিকেশবাবু নিতান্ত ধনী না হলেও গরীব নন। মোটামুটি স্বচ্ছল। নিজের চাকরি, ছেলের ব্যবসা। ছেলে যদিও আলাদা থাকে। দোতলা বাড়ি। যে বাড়িটা থেকে এখনো নতুনের গন্ধ পাওয়া যায়। দুই মেয়ে। সুজাতা এবং সুতপা। সুজাতা বড়। স্বভাবে দুই বোন দুজনের উল্টো। সুজাতা যতখানি শান্ত, সহজ, সরল, সুতপা ঠিক ততখানি দুরন্ত, জটিল।
এই সুতপার সাথে প্রথম যেদিন কুন্তল ওদের বাড়িতে এসেছিল সেদিন অবাক না হয়ে পারেনি সুজাতা। অদ্ভুত বৈপরীত্য সুতপা ও কুন্তলের মধ্যে। তবু ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছে। কুন্তল যখন লজ্জায় কুঁকড়ে বসেছিল, সুজাতা এগিয়ে এসে বলেছিল , "ছেলেরা যে এতো লাজুক হয় জানতাম না। "কুন্তল সেদিন জবাব দিতে পারেনি। শুধু একবার চেয়ে দেখেছিল অভিব্যক্তিহীন সুন্দর দুটি চোখকে।
কুন্তল ও সুতপার মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল এটা বলাই বাহুল্য। হৃষিকেশবাবু ভেবেছিলেন যদি ওদের দুজনের মধ্যে বিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাঁর ভাবনা কিছুটা কমবে। তাঁর ধারণা ছিল সুতপা যেরকম উড়ুক্কু স্বভাবের তাতে কুন্তলের মতো শান্ত ছেলেই ওকে সামলে রাখতে পারবে। বড় মেয়ে সুজাতার বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। এখন সুতপার জন্যই ভাবনা।
কিন্তু সেই সুতপাই একদিন বললে, সে কুন্তলকে ভালোবাসে না। পাড়ার বখাটেদের হাত থেকে রেহাই পেতে কুন্তলের সঙ্গে মেলামেশা করত। কারণ কুন্তলের জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্ট। ওই আলুভাতে মার্কা ছেলেটার সাথে প্রেম করা যায়, রেস্তোরাঁয় যাওয়া যায়, কিন্তু বিয়ে করে ঘর বাঁধা যায়না। যাই হোক একপ্রকার হতাশ হয়েই কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে এক ব্যাঙ্ক অফিসারের সঙ্গে বিয়ে দিলেন সুতপার।
সুতপা শ্বশুরবাড়ি গেল।
অপরদিকে কুন্তলের মা মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসলেন। হাতে ছোট্ট একটা চিঠি-- "আমার জন্য তোমরা কেউ ভেবোনা। আমি চললাম। কোথায় চললাম জানিনা। খোঁজার চেষ্টা কোরোনা-- ইতি কুন্তল।" বন্ধুরা বলল, অসম প্রেমের পরিণতি এমনিই হয়। হ্যাঁ, সুতপা এবং কুন্তলের মধ্যে ফারাক ছিল বৈকি! সুতপার বাবার আর্থিক স্বাচ্ছল্য থাকলেও কুন্তলের ছিলনা। সবে মাত্র গ্রাজুয়েট হয়েছে। তখনও কোনও চাকরি যোগাড় করতে পারেনি। তাই সুতপা যখন লাল বেনারসি পড়ে সুউপায়ী, সুপ্রতিষ্ঠিত বরেনের সাথে গাড়িতে উঠল তখন কুন্তল আড়ালে চোখের জল ফেলল মাত্র। বেশ কয়েক বছর পরের কথা। ইতিমধ্যে গল্পের চরিত্রগুলোর কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। সাতঘাটের জলখাওয়া সুতপা এখন পতিব্রতা সতীসাধ্বী রমণী। আর একটা দুর্ঘটনায় সুজাতার স্বামী মৃণাল মারা গেছে। সুজাতা এখন বিধবা। তবে অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্য্যস্ত হয়নি। কারণ মৃণালের চাকরিটা ও পেয়েছে। সেই সুজাতাকে একদিন বরাকর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে দেখে আশ্চর্য হল কুন্তল। অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে।-- কি দেখছ? বিধবা হয়েছি বছর তিনেক হল। জানি সুতপাকে তুমি ভালোবাসতে। তাই তার উপেক্ষা সহ্য করতে পারোনি। কিন্তু সুতপাই তো শেষ কথা নয়। ওর থেকেও অনেক ভালো মেয়ে আছে। তাদের মধ্যে কাউকে বিয়ে করে অবশ্যই সংসার করতে পারো।
কুন্তল লজ্জাবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন সুতপা বলেছিল, "তুমিই আমার সব।" অথচ সেই সুতপাই যখন টাকাপয়সার ব্যাপারটাকে বড়ো করে দেখল তখন জীবনের অর্থটাই অর্থহীন হয়ে পড়ল।
-- কি করছ আজকাল ?
-- পাথর ভাঙার কাজ।
সুজাতা ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। এক মুখ দাড়ির মধ্যেও পাথর ভাঙার মতো কঠিন পরিশ্রমের ছাপ পড়েছে ওর চোয়ালে এবং লাজুক চোখদুটিতে।
-- কোথায় রয়েছ?
-- আসানসোল।
-- ও তাই? আমিও তো রয়েছি ওখানে। তা আসানসোলের কোথায়?
কুন্তল যা বলে তাতে বোঝা যায় যে সেটা একটা পরিচিত বস্তি।
-- ঠিকানাটা? অবশ্য দিতে যদি আপত্তি না থাকে।
-- না, না; আপত্তি নয়। অবশ্য আমি যেখানে থাকি সেটা একটা বস্তি। সেখানে ওপরতলার লোকেরা যেতে পারেনা।
কুন্তল আর কিছু বলেনা। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পরে সুজাতা নিজের ডায়েরী আর কলমটা এগিয়ে দেয়। কুন্তল আরও একবার বিষ্মিত হয়। মেয়েদেরকে ও বুঝতে চায়। তবু বোঝা হয়না। ওরা যেন এক অতলান্তিক রহস্যময়ী।
--কি ভাবছ ?
--কিছু না।
--ওঠো। ট্রেনের সময় হয়ে আসল।
দুজনে ওয়েটিং রুমের বাইরে আসে। আর কিছুক্ষণ পরেই ধানবাদ প্যাসেঞ্জার এসে পড়বে। তাই এখন গোটা স্টেশনটাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ট্রেনে উঠেও নিজের মধ্যে সিঁটিয়ে থাকে কুন্তল। কিছুতেই নিজেকে খাপমুক্ত করতে পারেনা। যখন এক কাপ চা নিয়ে সুজাতা ডাকল ঠিক তখনই কেমন যেন একটা শঙ্কায় কেঁপে উঠল তার হাত। কিছুটা টলকে পড়ে যায় সুজাতার সাদা শাড়িতে। কুন্তল ব্যস্ত হয়ে রুমাল বের করতেই সুজাতা বলে, থাক ঘরে গিয়ে কেচে নেব। কিন্তু তুমি কিছুতেই সহজ হতে পারছনা। কুন্তল তবু চুপ করে বসে থাকে। কানের মধ্যে সুজাতার শেষ কথাটার রেশ থেকে যায় অনেকখন। ট্রেনের মধ্যে হাজার রকমের শব্দ। তবু সবরকমের শব্দকে ছাপিয়ে শুধু একটি শব্দই ছাপ রেখে যায় প্রাণের মাঝে। সুজাতার সামনে বসে থেকেও মনে হয় সে যেন আর এক সুতপার সামনে বসে রয়েছে। মনে হয় সে যেন আর এক ছলনাময়ী। ভাবতে ভাবতে কখন যেন সে আসানসোল পৌঁছে গেছে বুঝতে পারেনি। সুজাতা সীট থেকে উঠে বলে, কি এখনো বসে থাকবে ? কুন্তল তাড়াতাড়ি উঠে বলল, বুঝতে পারিনি। কি যেন সব ভাবছিলাম। সুজাতা একটু হেসে বলল, ভাবনাটা কম করো। প্রাকটিক্যাল হও।
তারপর ওভার ব্রিজের ওপর এসে নিজের ঠিকানা লেখা কার্ডটা ওর হাতে দিয়ে বললে, কবে আসছ ?
--বলতে পারছিনা। তবে আসব।
কুন্তল সুজাতার মুখের দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। যেন খুব চেনা চেনা লাগে মুখটা। যেন কিছুটা হলেও ভরসা করা যায়।
কয়েকদিন পরের এক রবিবারের কথা। কেন জানিনা, সেদিন সকাল থেকেই সুজাতার মনে হচ্ছিল আজ কুন্তল আসবে। তাই বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু সেটা যে কেমন ধরণের ভালো লাগা; তা হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারছিলনা। প্রথম যেদিন কুন্তল ওদের বাড়িতে এসেছিল সেদিনও ভালো লেগেছিল। তবে সেদিনের ভালো লাগার সঙ্গে আজকের ভালো লাগার বুঝি একটা মূলগত তফাৎ রয়ে গেছে। আজ বুঝি একটা অপরাধবোধ ওকে তাড়া করে ফিরছে। সে না বিধবা? নতুন করে কারোর কথা মনে আনাও যে পাপ। আবার পরক্ষণেই মনে হয় কিসের পাপ? জীবনে কি পেয়েছে সে? যে নেই, যে কখনো ফিরে আসবেনা; কেন তার স্মৃতি বয়ে বেড়ানো? যে ছবিটাকে সে প্রতিদিন ফুল দিয়ে সাজাতো, আজ সেই ছবিটাকে বুকের মাঝে ধরে বলল, ক্ষমা কোরো।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ হতেই ত্রস্তে ছবিটাকে আলমারির মধ্যে রেখে দিয়ে দরজা খোলে। সুজাতা আজ যার কথা সারাদিন ভেবেছে সেই কুন্তল। ক'দিন আগের দেখা সেই কুন্তল। অথচ মনে হয় সেই প্রথম দেখার কুন্তল। তেমনি সৌম্য, শান্ত, সুন্দর।
--এস।
কুন্তল ঘরে আসে। চারদিকটা নিখুঁত ভাবে সাজানো। দামী আসবাবে ভর্তি। একটা মিষ্টি গন্ধ চারদিকে ছড়ানো।
বাইরের দরজা বন্ধ করে সুজাতা ওর সামনে আসে। মনে হয় ও বুঝি অনেকদিন আগের দেখা সেই সুজাতা। পরণে একটা মিষ্টি গোলাপি রঙের সিনথেটিক শাড়ি। চুলগুলোও খোলা। পিঠের ওপর ছড়ানো।
--কেন জানিনা আজ সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল তুমি আসবে।
কুন্তল কিছু বলতে পারেনা। শুধু নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে থাকে সুজাতার দিকে। কিছুক্ষণ পরে বলে, আপনি?
--আপনি নয়, তুমি।
--এটা হয়তো ঠিক হচ্ছেনা।
--ঠিক বেঠিক জানিনা। তুমি প্রত্যাখ্যান করলে হয়তো কষ্ট পাবো। কিন্তু কখনো তোমাকে বিরক্ত করবনা। আমার জীবনে একজন এসেছিল সেটা সত্যি। সে তো না আসার মতোই।
এরপর সময় কেটে যায়। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে পারেনা। সুজাতা সারাদিন ধরে যে আয়োজন করেছিল তা যন্ত্রবৎ পৌঁছে দেয় কুন্তলের সামনে। সে ফিরিয়ে দিতে পারেনা। সুজাতা বুঝি একদিনেই তাকে বদলে দিয়েছে। এমন সেবা এবং সান্নিধ্য আগে কখনো পায়নি। তাই অজান্তেই বুঝি সুজাতা ওর মনের এক কোণে ঠাঁই করে নিয়েছিল। ফেরার সময় দুজনেই কাছে এসেছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেনি। কেন, কে জানে?
প্রায় কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। এই সপ্তাহগুলোতে যখনই কলিংবেল বেজেছে তখনই মনে হয়েছে কুন্তলের কথা। কিন্তু হতাশ হয়েছে। সুজাতা বারবার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে। ওর ভেতরের আর একটা আমি বলে, ছিঃ এর চেয়ে তোর মরণ হলনা কেন?
কুন্তলকে ভুলতে চেয়ে সারাদিন শুধু কাজ নিয়ে পড়ে রইল। কিন্তু ভুলতে চাইলে আরও বেশি করে মনে পড়ে যায় ওর কথা। তাই একদিন বিকেলে অফিসের ছুটির পরে কুন্তলের ঘরে গিয়ে পৌঁছায়। তবে সেটাকে ঘর না বলে খুপরি বলাই ঠিক হবে। দুপাশে সেরকমই অনেকগুলো ঘর। কোনো ঘরেই যে আলো বাতাস প্রবেশ করে তা বলা যাবেনা। তখনও দিনের আলো শেষ না হয়ে এলেও ওদের ঘরে অন্ধকার এসেছে বুঝি অনেক আগেই।
কুন্তল সবে মাত্র কাজ থেকে ফিরে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে দড়ির খাটিয়ায় নিজেকে সমর্পণ করেছিল। সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর কাজ থেকে ফিরে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। ঠিক তখনই পাশের ঘরের বিহারী এক মহিলা তাকে ডেকে বললে, ভাইয়া দেখোতো কৌন আয়া? কুন্তল বাইরে এসে নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারেনা।
সুজাতা এগিয়ে এসে বলে, চিনতে পারছনা বুঝি!
--না মানে--
সুজাতা মাথা হেঁট করে ঘরের মধ্যে আসে। মধ্যেটায় বেশ অন্ধকার। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো হাঁড়ি, কড়াই, বালতি-- দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিষপত্র। বিরক্ত হয়ে বলে, আলোটাও জ্বালাতে পারোনি... কুন্তল ঘরে আসে। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। অন্ধকারেই সুজাতার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। এই সুজাতা যেন ক'দিন আগের দেখা সেই সুজাতা নয়। সে যেন তার কল্পনার প্রতিমূর্তি। যার একটুখানি সোহাগ স্পর্শের জন্য তার হৃদয় উন্মুখ হয়ে আছে। আলো জ্বালা হলে সুজাতা বলে, বসতেও বলবেনা? কিন্তু অপেক্ষাও করেনা। নিজেকে লুটিয়ে দেয় দড়ির খাটিয়ার ওপরে। ইতিমধ্যে বিহারী মহিলাটি দু'কাপ চা নিয়ে আসে। সঙ্গে কিছু লেড়ুয়া।
লেড়ুয়া সহযোগে চা সুজাতার বেশ ভালো লাগে।
তারপর আবার নীরবতা। দুটি হৃদয় বলতে চায় অনেক কথা। কিন্তু কারোরই বলা হয়না। ঘড়ির কাঁটাগুলো শুধু সময়কে পাহারা দিয়ে চলে। একসময় সুজাতা উঠে বললে, আজ আসি।
কুন্তল ওকে গলির মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কিন্তু কোনো কথা হলনা।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। মনের মনিকোঠা থেকে কুন্তলকে সরিয়ে দিতে গিয়েও পারেনি। শুধু অগোছালো হয়েছে তার জীবনটা। ঘরের কাজের জন্য একজন মহিলাকে নিয়োগ করেছে। তার হাতেই সব কাজের ভার ছেড়ে দিয়েছে। একদিন অফিস থেকে ফিরতেই মোবাইলে একটা মেসেজ পেল সুজাতা। যাতে লেখা হয়েছে, "আমি অসুস্থ, তোমার সাহায্য চাই-- ইতি কুন্তল।"
সুজাতার সামনেটা বুঝি অন্ধকার হয়ে আসে। এতদিন যার কথা শুধু ভেবেই এসেছে, আজ তার ডাকে সে কি সাড়া না দিয়ে পারে? কাজের মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে গো দিদিমনি ?
--আমাকে একবার বেরোতে হবে। আমার এক বন্ধু বেশ অসুস্থ। তুমি ঘরের দিকে লক্ষ্য রেখো।
তারপর বেশ কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কুন্তলের ঘরে পৌঁছাতেই ও শিশুর মতো তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাকে বাঁচাও সুজাতা। সুজাতা ওর উত্তপ্ত কপালের ওপর হাত রেখে বলল, আমি এসেছি তো।
তারপর কুন্তলকে নিয়ে এল নিজের বাড়িতে। আর কুন্তলের ঘরের চাবিটা রেখে দিল নিজের হাত ব্যাগটায়। ডাক্তার অরিজিৎ চৌধুরী বললেন, এমন কিছু নয়। সাধারণ জ্বর। তবে হসপিটালে নিয়ে গেলে ওরা করোনা সন্দেহে ট্রিটমেন্ট না করেই ফেলে রাখত। আসলে কি জানো, অতিরিক্ত পরিশ্রম, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করা-- তারপর জ্বর, আর এই জ্বর থেকেই টাইফয়েড। এখন দরকার ফুল রেষ্ট। ওষুধপত্র দিলাম। খাওয়াদাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখো, তাহলেই সেরে উঠবে। আসলে কি জানো মা, এই ধরণের ছেলেরা বড্ড জেদী হয়। আর এদের জেদ কখনো কখনো এদের বিপদের কারণ হয়।
কুন্তলের কপালের ওপর হাত বুলোতে বুলোতে কখন যেন তন্দ্রার মতো এসেছিল। হঠাৎ জেগে উঠে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে একটা। অনেক রাত হয়ে গেছে।
--সুজাতা?
সুজাতা ওর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে বললে, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
--না। তোমার হাতটা একবার দেবে?
তারপর শীর্ণ হাত দিয়ে ওর ডানহাতটা ধরে বলে, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দেবেনা তো?
সুজাতা কিছু বলতে পারেনা। ওর চোখদুটো বুঝি জলে ঝাপসা হয়ে এসেছিল। কখন যেন ওর উত্তপ্ত ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁটদুটো ঘষতে ঘষতে বলল, না, না, না--
মনে জাগে নেশা
গৌ রী স র্ব বি দ্যা
রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে গাড়ির এক সিটে বসে চললো এক যুবক। অন্য সিট খালি। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ, ঠান্ডা হাওয়া সব মিলিয়ে মনের মধ্যে এক শান্তির আবেশ।
অনেকদিন পর মনে হলো সংসারের ঝামেলা থেকে একটু মুক্তি পেলো সে।কতক্ষণ আর সংসারের চাপাকলে নিজেকে আবদ্ধ রাখা যায়। কিছুক্ষণ একা সময় কাটাতে পারলে শরীরটা কিছুটা চাঙ্গা লাগে।
চলতে চলতে একসময় দেখে এক মহিলা তার পাশের সিটে। যেমনটি কোমল দেখতে তেমনি খুব সুন্দরী।মনটা দ্বিগুণ খুশিতে ভরে গেলো।
একদিকে সুন্দর প্রকৃতি অন্যদিকে সুন্দরী ললনা।আহ!
আজ দিনটা বেশ ভালোই যাচ্ছে।
চুপচাপ বসে বাইরের দৃশ্য দেখছে সুন্দরী রমণী। এমনটা কি ভালো লাগে? ইস্ একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলবে সে কথা? একটু কাশি দিয়ে নড়েচড়ে বসলো যুবক।
কোন ইচ্ছে না দেখে গান শুরু করলো...
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না॥
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে,
উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায়, ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা-- মন চায়
মন চায়, হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে।
রমণী বলে ওঠে, আমরা কি সিট বদলাতে পারি?
যুবক প্রফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি আমাকে কিছু বললেন?
রমণী মাথা নেড়ে আবার... আমরা কি সিট অদল-বদল করতে পারি? যুবক মিষ্টি হেসে সম্মতি জানিয়ে সিট ছেড়ে রমণীকে জানালার পাশে বসতে দিল।
রমণী সত্যজিৎ রায়ের গল্পের বই খুলে পড়ছে। বাইরের হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি শুরু হলে, বৃষ্টির ছাট এসে রমণীর চোখে-মুখে পড়ছে আর রমণী যুবকের দিকে হেলছে।
চুলের মিষ্টি গন্ধে মাতাল হয়ে আবার মনে মনে যুবক গান ধরে.....
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
হৃদয় গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে রসের ধারা বরষে।।
হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। গল্পের বই বন্ধ করে ফোন ধরে রমণী। হ্যালো! হ্যালো! কর্তার ফোন। আর কতক্ষণ লাগবে? তোমার মেয়েকে অনেক কষ্ট করে সামলেছি। আর পারছি না!
রমণী- চিন্তা করো না আমি কাছেই চলে এসেছি।রান্না, ঘর গোছানো, মেয়ে সামলানো সব এসেই করছি।
যুবক ফোন নাম্বারটা নিতে চেয়েও, নিলো না!
আর রমণী মনে মনে ভাবে, আজ তিনদিন হলো অফিসের কাজে বাসা থেকে বের হয়েছি। বাসায় গিয়ে দেখবো সবকিছু এলোমেলো পড়ে আছে। স্নান সেরে রান্না ঘরে ঢুকতে হবে। জমানো কাপড়-চোপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা আরো কত কাজ!
কিভাবে কাজগুলো দ্রুত শেষ করে একটু বিশ্রাম নেওয়া যায়!
গন্তব্যে পৌঁছে রমণী বাস থেকে নামার আগে যুবকের দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানায়।তারপর বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে যায়।
যুবক গাড়ির জানালা দিয়ে পেছন থেকে তাকিয়ে থাকে!
মনে মনে আরেকটা গান ধরে....
আমার মন মানে না-- দিনরজনী।
আমি কী কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি।
ওগো, কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি--
ওগো সজনি॥
জীবনের ঢেউ
চ ন্দ ন চ ক্র ব র্তী
ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় সে বিদায় জানিয়ে গেল। তার নাকি সময় নেই আমার মত ছেলেকে সময় দেবার! আমি আসলে চার বছর চাকরির প্যানেলে ঝুলে থাকা একটি নাম। যতদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে না আসে, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। জোর খাটাতে পারি না, মন বিষাদে ছেয়ে আছে। সপ্তমীর দিন ঘরে বসে খুব বাজে কাটলো। অষ্টমীর সকালে বকখালির সমুদ্রে চলে এলাম।
বেলা বারোটায় পৌঁছে, হোটেল ঠিক করে, চান খাওয়া-দাওয়া সেরে, ঘুম লাগালাম। পরিশ্রম হয়েছে, ঘুম ভালই হলো।
বিকেলবেলা সমুদ্রের উদ্দেশ্যে হাঁটছি। রাস্তার পাশে স্থানীয় বুনোদের গ্রাম। মাছের শুঁটকি তৈরি হচ্ছে । অনেক জাল টাঙানো আছে।
কোনো বিবাহিতা যুবতীকে দেখলাম কোমরে কাপড় বেঁধে কাজ করছে। মাজা কালো তার গায়ের রঙ, ঢুলুঢুলু আঁখি। না আছে প্রসাধন, না আছে ঢঙ! এদের আর্থিক অবস্থা কেমন সহজেই অনুমেয়। অথচ স্বাস্থ্য! ভারি মাজা, বুক, সরু কোমর। লম্বা কালো চুলের গোছ। শরীর থেকে যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে!
শহরে সুন্দরীদের পুরু প্রসাধনে, তাদের চিনতে বেগ পেতে হয়। মিশতে গেলেও অনেক দ্বিধা, অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক শর্ত। আর এখানে, কোন আড়াল নেই, যা মানুষকে চিনতে জানতে দূরে সরিয়ে রাখে। নিমেষে কাছাকাছি হওয়া যায়, নিঃশর্ত আদিম কালের মত।
কাছে গিয়ে কিছু প্রশ্ন করলাম। কোন দ্বিধা নেই, কোনো বাধা নেই! সহজেই উত্তর মিলল এবং ওকে অনেকটাই জানা হয়ে গেল। স্বামী আছে, ছোট একটা বাচ্চা আছে, আর আছে ওদের নিজেদের হাতে বানানো কাঁচা ঘর। এটাই ওদের জীবনের চাওয়া পাওয়া। সঞ্চয় নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না। খাটে খায়।
আবার হাঁটা শুরু করলাম। পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। সূর্য এখন অস্তমিত। দিকচক্রবালে তার রক্তিম আভা জলের ওপরে পড়ে রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। উড়ন্ত সী-গালেরা একে একে ঝাউবনের দিকে নিরুদ্দেশ। আঁধার নেমে আসছে। জোয়ারের উথলে ওঠা সবে শুরু। ঢেউগুলো ফুলে ফুলে কূলের দিকে ধেয়ে আসছে। মনে হল যেন আমার মনের দেয়ালে বার বার ধাক্কা খেয়ে সারা শরীরময় ছড়িয়ে যাচ্ছে। শহরে থাকলে আমাদের, কখন দিন হয় কখন রাত হয়, খেয়াল থাকে না। আমরা তখন তারিখে বাস করি। কিন্তু এখানে প্রকৃতির প্রহরে প্রহরে যে বদল সহজেই প্রতিভাত হয়।
ফেরার পথে ভাবছি, এক দিনে প্রকৃতির কাছ থেকে যা পেলাম, বেশ ক'টা দিন ভালো কাটবে।
বস্তির সামনে এসেছি। তাদের ঘরে ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাইরে কারা দাঁড়িয়ে বলাবলি করছে। বুঝলাম তার কথাই বলছে। তার স্বামী নেশা করে এসে মারধর করছে। এখন নারী কন্ঠে কান্নার ধ্বনি শুনতে পেলাম। এটা ওদের ব্যক্তিগত বোঝাপড়া। তৃতীয় কোন ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। কাজেই ফিরে এলাম।
কি জানি! এটাই বুঝি ওদের প্রেমের প্রকাশ! মার খেলে বুঝি সম্পর্ক ঘনীভূত হয়! প্রেম উথলে উঠে, ঢেউয়ের মত দোল খেয়ে ভাঙ্গে, যেন সমুদ্রের মত বিশাল তার পরিসর। আমাদের দাম্পত্য জীবনে, না আছে ঢেউ, না আছে জোয়ার ভাটা, মৃত নদীর মত।
আর, ওদের বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, টাকা নেই, তবু ওদের সব আছে। এখন ওদের জীবনটাকে আমার খুব দামী মনে হচ্ছে ।
সিঁদুর
সু ন ন্দা চ ক্র ব র্তী
বুবুন এবছর নতুন ঠাকুর বরণ করবে, সকাল থেকেই উচ্ছ্বসিত। পাশের বাড়ির খেলার সাথী দোলনকে অনেকবার এর মধ্যেই বলা হয়ে গেছে যে সাধারণ করে শাড়িটা যাতে দোলন একটু পরিয়ে দেয় আর খোঁপাটাও করে দেয়। ছোটবেলা থেকে বুবুনের খুব শখ বিয়ে, সিঁদুর, শাখা, পলা, বর আর হানিমুন। সেই অষ্টম শ্রেণী থেকেই যাকে পছন্দ হয় মনে মনে বর ভেবে নেয় আর দোলনকে এসে গল্প করে।
দোলন হাসতে হাসতে বলে , "এটা জানি তোর কত নম্বর ভালোলাগা?"
বুবুন দোলনকে বলে, "অতো তোর পড়াশুনা পড়াশুনা বাতিক কেন রে? সেই তো একদিন না একদিন বিয়ে করবি। এখন থেকেই যদি ভাবিস তোর কেমন বর পছন্দ তাহলে দেখবি পেয়েও যাবি"।
দোলন যখন কলেজে ঢুকল বুবুন তখনও মাধ্যমিক দিয়ে সবে হায়ার সেকন্ডারি বিল্ডিং এ পা রেখেছে। সবেতেই উৎসাহ, শুধু পড়াশুনা ছাড়া। বিয়ে বাড়ি থেকে এসেই পরেরদিন দোলনকে গল্প করে কত কত মুগ্ধ চোখ ওকে দেখছিল। বিয়েবাড়িতে মাসি, পিসিদের বেনারসি, সাউথ ইন্ডিয়ান পরে যায়, খুব সাজে। সেবার তো মেজমামির হলুদ চুমকি বসানো শাড়িটায় বুবুন কে এতো মিষ্টি লাগছিল যে দোলন হাঁ করে তাকিয়েছিল। বুবুনের খোঁপায় পাড়ার সানুদাদের বাড়ি থেকে হলুদ চন্দ্রমল্লিকা চেয়ে এনে লাগিয়ে দিয়েছিল দোলন। কানে কানে বলেছিল, "আজ একটা হিল্লে তোর হবেই"। বুবুন সেদিন ওর বন্ধু তুলিকার বিয়েতে যাচ্ছিল ।
তুলিকার পিসতুতো দেওরের সাথেই শেষ মেষ বুবুনের বিয়েটা হয়ে গেল। বুবুনের পড়াশুনা ডকে উঠল। সারাদিন ভাবে আজ কোন শাড়িটা পরে থাকবে আর বর অফিস থেকে ফিরে বাইকে করে বেড়াতে নিয়ে যাবে। আর কিছু না হোক, বাপের বাড়ি ঘুরিয়ে আনবে। দোলনকে বরের কথা, বরের ভালোবাসার কথা বলবে। দোলন কলেজ থেকে ফিরে বই নিয়ে বসলে মাঝে মাঝে বুবুন আসে ইয়া বড় লাল টিপ, সিঁথির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি সিঁদুর। লাল টকটকে ঢাকাই শাড়িতে বুবুনকে দোলন মাঝে মাঝে "এই যে কমরেড এলো" বলে ক্ষেপায়। বুবুন দোলনকে পুরীর সমুদ্রের গল্প, স্নানের গল্প, কাকাতুয়ার জিবেগজার গল্প করে। দার্জিলিং এর পাকদণ্ডী বেয়ে হাঁটতে গিয়ে মচকে যাওয়া পা নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলে ওর বর কিভাবে কোলে তুলে নিয়েছিল তার গল্প বলে, সেবার কুলুমানালিতে কি বরফ আর তা ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলার গল্প করে। ও জানে , দোলন ওর মুগ্ধ শ্রোতা, আর আরেকটা ব্যাপার যে দোলনের কোনও হিংসা নেই। বুবুনের ভর ভরন্ত সংসারে একবার দুবার দোলন গেছে, বুবুন দারুণ আতিথেয়তা করেছে। বারবার দোলনকে বলেছে যে পড়াশুনা করছে ভালো কথা কিন্তু একজন প্রেম ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন। মেয়েদের সিঁথির সিঁদুরই আসল বলে গানও শুনিয়েছে, যুগটা নাহয় বদলে গেছে বদলে গেছে কাল/তবু সুখী মেয়ের সিঁথির সিঁদুর তেমনি আছে লাল...।। দোলন বুবুনের এরকম সিনেমাটিক ডায়ালগ শুনে হেসে হেসে কুটিপাটি হয়।
বুবুনের কোল আলো করে একটা ছেলে হয়েছে। গেলবার দুর্গা পূজায় এসে মা দুর্গা কে বরণ করার পর দোলনের গালে সিঁদুর মাখিয়ে দিয়েছে, "অনেকদিন আইবুড়ো থেকেছ, এবার বিয়ে করে ফেল্। এম এ তো হয়ে গেলো, বিয়ের পর পি এইচ ডি করিস। আমার খুব স্বপ্ন আমরা দু'বন্ধু একসাথে মা কে বরণ করব"। দোলনেরও তার পরের বছর ফাল্গুনে বিয়ে হয়ে গেল। কোলে কচি বাচ্চা নিয়ে বুবুন এসেছিল, কানে কানে কত যে টিপস দিয়েছিল দোলনের মনে হচ্ছিল এ যেন উপন্যাসের প্রথম পাতা উল্টিয়েই লাস্টের পাতা পড়ে ফেলেছে। মোবাইলে অনেক গল্প করেছে, দোলন বরাবর শ্রোতা তাই বুবুনের কথা বলতে সুবিধা বেশি।
নবমীর দিন দোলন এসেছে বাপের বাড়িতে, সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির অনেক লোকজন। সারাদিন কিভাবে যে কেটে গেছে, সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর দেখতে যাওয়া। মায়ের সাথে পরেরদিন বিকেলে মা কে বরণ করতে গিয়ে পাড়ার বৌদিরা সারামুখে লাল সিঁদুর মাখিয়ে দিল, দোলনের বর অনিরুদ্ধ অনেক ছবি তুলল। দোলনের চোখ পড়ল তিন বাড়ির পর ফ্যকাশে হলুদ বাড়িটার দিকে। শ্যাওলা ধরা ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে বুবুন ফ্যাকাশে ধুলো রঙের শাড়ি পরে। শূন্য সিঁথি, শূন্য কপাল, শূন্য দৃষ্টি দেখে কেঁপে উঠল দোলন। মনে মনে বারবার বলল, বুবুন আমি যে এভাবে তোকে কোনোদিন দেখতে চাইনি...। তুই এতো গল্প করতিস, কোনোদিন বলিস নি তো যে তোর বর মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে, এই পাঁচ বছরে লিভার টা একেবারে শেষ হয়ে গেছে।
স্বর্গেও সমস্যা
মো য়া ল্লে ম না ই য়া
—হ্যালো মা…
কি হলো 'কেতো' ? তোর গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে কেনরে বাবা! তোর কি শরীর খারাপ?
— এখানে একদম ভালো লাগছে না মা।
রাতদিন শুধু পড়া আর পড়া। দম একেবারে হাঁপিয়ে ওঠার জোগাড়। স্বর্গের স্কুল এর থেকে ঢের ভালো ছিল।
কার্তিকের কথা শুনে দুর্গা মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়। ফোনের ও প্রান্ত থেকে সে বলে,
—-মামার বাড়িতে তোকে আর গণশা'কে রেখে এসেছি পড়াশোনার জন্য। গনশার তো কিছুই হলো না, ও ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। ভেবেছিলাম তোর হবে ৷ তুইও তো দেখছি বেটো বাউন্ডুলে হয়ে গেছিস! গনশার ব্যবসাটা মহারাষ্ট্রে ভালো চলতো কিন্তু শুনছি ওখানে পালাবদলে গণেশ একেবারে উল্টে গেছে। কি করে যে তোদের নিয়ে চলবো… ভেবে কূল পাচ্ছি না! আর তুই বলছিস কিনা পড়তে ভালো লাগছে না?
কার্তিক বুঝতে পারে দুর্গা'মা প্রচন্ড রেগে গেছে সে নরম সুরে বলে…
— প্লিজ মাম রাগ করোনা ৷ সত্যি বলছি এখানে আমার একদম মন টিঁকছে না। ওখানে তুমি যা বলবে তাই শুনবো। শুধু একবার এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাও।
কার্তিকের কাকুতি মিনতিতে দুর্গার মায়া হল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে বলল,
— তুই এক কাজ কর ৷ অগ্নিপথ প্রকল্পে সেনা নিয়োগ হচ্ছে। ওখানে তো তুই দরখাস্ত করতে পারিস? দাদু মামাদের বল, একটা ফর্ম এনে পূরণ করে দিতে। তোর চেহারা ভালো, ফিট আছিস, অস্ত্রও ভালো চালাতে পারিস।
মা'র কথা শুনে কার্তিক হেসে গড়িয়ে পড়ে। ফোনের ওপার থেকে সে বলে,
—মা, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে! আমি তীর ধনুক চালাতে পারি। কিন্তু দাদুদের এখানে যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে তা আমাদের স্বর্গে কোথাও নেই। স্বর্গ সেই ব্যাকওয়ার্ডই রয়ে গেল। বিশ্বকর্মাও দিন দিন অকর্মার ঢেঁকি হয়ে যাচ্ছে, কিছুই জানে না। পৃথিবী কত বদলে যাচ্ছে! নিত্য নতুন কত কি আবিষ্কার হচ্ছে! সেসব কি ও খোঁজ রাখে? ইন্দ্রকেও বলি, সামরিক ক্ষেত্রে টাকা না ঢাললে ভালো কিছু আবিষ্কার হয় নাকি? সেই সেকেলে তীর ধনুক আর গদা-শঙ্খ…এই নিয়ে কি এখনো যুদ্ধ চলে! নেহাত অসুররা নেই, না হলে স্বর্গ নেপালের হাতেও দখল হয়ে যেত ৷
— নে, নে, তোকে আর বেশি জ্ঞান দিতে হবে না। বিয়ে'থা করবি না বলে তো ঠিক করেছিস?
কলেজে পড়তে পড়তে কি কারো ভালো টালো লেগেছে? যদি লাগে বল, মামা দাদুদের বলে মেয়ের বাবার সঙ্গে একেবারে কথা বলে আসি।
— তুমি না মা, একেবারে যা তা।
বোঝা যায় কার্তিক লজ্জা পেয়েছে।
—নারে বাবা, গণশা'টার কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না। তাই কলাবতীর বাপের সঙ্গে কথা বলেই রাজি করিয়েছি। ওর বাপ কি রাজি হয়! নেহাত হাতির সঙ্গে অনেক মিল আছে বলে কলাবতীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হল। শুনেছি, কলাবতীর কোনো দিদিকে খেতে গিয়ে হাতি নাকি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলাবতীকে চুম্বন করে বলেছিল… 'আই লাভ ইউ' ৷ সেই থেকে হাতির প্রতি কলাবতীর একটা টান। হাতি আর গণেশের মুখের আদল এক হওয়ায় কলাবতী এক কথায় রাজি। বাধ্য হয়ে কলাবতীর বাবা এই বিয়েতে সম্মত হয়েছে। না হলে অমন হাতিমুখো, পেটুক ছেলেকে কি কেউ জামাই করতে চায়!
— ওসব ছাড়ো তো মা, আমাকে তুমি কবে নিয়ে যাবে বলো?
— আরে নিয়ে তো আসবো কিন্তু স্বর্গে কি কোন কাজ আছে! লক্ষ্মী সরস্বতী সবাই এখন বেকার। বাইজুস, আকাশ, পাথফাইন্ডার এর মত কোচিং সেন্টার উঠেই সরস্বতীর চাকরিটা গেল। ও এখন দিব্যি ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে, খাচ্ছে আর ঘুমোচ্ছে।
… লক্ষ্মীটার হয়েছে এক জ্বালা। তোর বাবার তো রোজগার নেই, জানিস। লক্ষ্মী যাহোক করে এর তার ফাঁকি দিয়ে টাকা পয়সা আনতো। এখন তো দেখছি আলিয়া, মালিয়া কোটি কোটি টাকা লুট করে বিদেশে বহাল তবিয়তে সময় কাটাচ্ছে। ফলে ওর ভাঁড়ার একেবারে শূন্য!… এই দুটো বড় বড় মেয়েকে নিয়ে এখন আমি কি যে করি, বুঝে উঠতে পারছি না!
—মা সরো'কে এখানে গানের টিউশনি করতে বলো। দেখবে, লতা-সন্ধ্যারা মারা গেছে ওর নাম লোকের মুখে মুখে ফিরবে। আর বাংলায় মাস্টারদের টিউশনিও বন্ধ। লক্ষ্মী যদি সরোর কাছে একটু তালিম নিয়ে এখানে টিউশনি করতে পারে, দিব্যি বেশ কিছু টাকা রোজগার করে বাড়িতে পাঠাতে পারবে।
— রেগে গিয়ে দুর্গা বলে, তুই তো সবার সবকিছু বাতলে দিলি। তোকে যে বললাম অগ্নিবীর নিয়োগে দরখাস্ত করতে, তুই করবি তো? গতকাল তোর বাবার সাথে শ্মশানে এক মৃত কর্নেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। উনি জানালেন, এ ব্যাপারে সব ব্যবস্থা ওই কর্নেল করে দেবেন।
— মৃত কর্নেল কিভাবে সুপারিশ করবেন মা!
— আরে হয় হয়, সব হয়। তোর মামার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, ওরাই তো বলল। ভুয়ো ডাক্তার, ভুয়ো অফিসার, ভুয়ো মাস্টার… সব যদি হতে পারে, মৃত কর্নেলের সুপারিশ চলতে পারবে না কেন?
— তা যা বলেছ মা। এখানে সবকিছু হতে পারে।
— শোন, সামনে পুজোয়… আমি, সরো, লক্ষ্মী.. সবাই যাব। এই কটা দিন তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ওখানে গিয়ে তোকে যা হোক একটা ব্যবস্থা করে দেব। আর বাড়ি আসার নাম করিস না বাবা! জানিস তো, করোনার পর গোটা দুনিয়ায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। যা হোক কোন একটা সুযোগ যদি পাস, তাহলে সেখানে ঢুকে পড়। ভালো থাকিস। ফোনটা এবার রাখ। ফোনের বিল অনেক উঠে যাচ্ছে। তোর বাবা ভিক্ষে-টিক্ষে করে তোদের হাত খরচ পাঠাচ্ছে, আর তোরা যদি এভাবে উড়িয়ে দিস!…. দুর্গার গলা ধরে আসে।
—-কার্তিক ওপ্রান্তে নরম কন্ঠে বলে সরি মা, তুমি কিছু মনে করো না। আর আমি বায়না করব না, দেখো। যেমন করে পারি কোর্স কমপ্লিট করে কিছু না কিছু কাজ করবই। তোমার আর বাবাকে আর খাটতে দেবো না।
— দুর্গা চোখ মোছে। ফোনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে মাতৃ অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। দেবতা হলেও সে তো মা! অপত্য স্নেহ তাকেও ব্যথায় ভরিয়ে তোলে।
নতুন পথের সন্ধানে
তু লি মু খা র্জি চ ক্র ব র্তী
রাতের অন্ধকারে ছুটে চলেছে ফুলমনি, নিজের জেলা, রাজ্যের জঙ্গলমহলের সীমা সব ছাড়িয়ে চলে যাবে বলেই কাঁচা রাস্তা, কাঁটা জঙ্গল সব উপেক্ষা করে ছুটে চলেছে সে। ছুটতে ছুটতে বড় রাস্তা। মুম্বই রোড। একটা চলন্ত লরি ধরে ঝুলে পড়ে সে। কিছুটা আসতেই একটা ছোট্ট স্টেশন দেখতে পায়। বড় রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে। চলন্ত লরি থেকে লাফিয়ে নেমে আবার ছুট। ছোট্ট স্টেশন ক্ষীরাই এসে পৌঁছায় ফুলমনি। একটা সাধারণ টিকিট কেটে সামনে দাঁড়ানো বড় ট্রেনে উঠে পড়ে সে। পায়ে যন্ত্রণা হলেও অভ্যাস হয়ে গেছে এই ক'বছরে।
ভিতরটা দেখে একটু ভ্যাবাচাকা খেলেও তরতর করে উপরে উঠে গদী সিটে শুয়ে পড়ে ফুলমনি। সাইড ব্যাগ থেকে একটা ওড়না জড়িয়ে নেয় গায়ে। বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। লোকজন খুব কম কামরায়। এটা কোনো এক্সপ্রেসের থ্রি টিয়ার সেটা ওর জানা ছিল না। চেকারবাবু আসায় জানতে পেরে জরিমানা দিয়ে সিটটা দখল করে। খুব ক্লান্তিতে ফুলমনি ঘুমিয়ে পড়েছিল বিগত কয়েক দিন ঘুমহীন কাটিয়ে আজ অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে।
হঠাৎ ঝাঁকুনিতে ঘুমটা ভেঙে যেতে বাইরে দেখার চেষ্টা করে সে। একদম উপরের সিট থেকে বাইরে কিছুই দেখা যায় না। তাও উঁকি দিয়ে মনে হয় তার অন্ধকার। ভোরের দেরি আছে। বিগত চারবছরের জঙ্গল এবং জঙ্গি জীবন পিছু ছাড়ছে না তার। একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সে ঘর ছেড়েছিল সেদিন। কিন্তু চারবছরের স্বপ্ন ভাঙে তিনদিন আগের ঘটনায়।
ট্রেন চলতে শুরু করলে ছায়াছবির মতোই সেদিনের দৃশ্য ভেসে ওঠে ফুলমনির চোখের সামনে, ঘুম আর এলো না।
দশ ক্লাস পাস করে জড়িয়ে পড়ে আন্দোলনে ফুলমনি। যে সে আন্দোলন নয়, নিজেদের ন্যায্য পাওনা নিয়ে চরমপন্থী আন্দোলন। বারো ক্লাসে মানব মুর্মু ছিল স্কুল নেতা। সব আদিবাসী ছেলে মেয়েদের এক ছাতার তলায় আনা খুব গোপন সংগঠন। ধীরে ধীরে বঞ্চনার কথা জানল ওরা সবাই। পান্তা পেঁয়াজ লংকা খেয়ে, মাটির বাড়ি থাকা তো ওদের প্রাপ্য নয়। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরোলেও বড়লোকের জমিতে সেই মুনিষ খাটাই ওদের ভাগ্যে। সরকারী বেসরকারী কোনও চাকরি ওদের জন্য নয়। বাঁচার জন্য নূন্যতম সাহায্য ওরা পায় না। পায় কেবল বঞ্চনা.... বঞ্চনা আর বঞ্চনা। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে লড়াই করতে ঘর ছেড়েছিল ফুলমনি আরও অনেকের মতোই। জঙ্গলে থাকা খাওয়া। নেতাদের রক্ত গরম বক্তৃতা আর অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া আত্মরক্ষার জন্য এবং যারা বঞ্চিত করেছে তাদের নিধন করার জন্য।
ভালো মন্দ সবই ছিল জেহাদ। সেদিনও এমন এক জেহাদী প্রতিবাদ শেষে ডেরায় ফিরেছে ফুলমনি আর কিছু ছেলে মেয়ে। নেতার উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে ওরা ভীষণ খুশি। 'সঠিক পথে এগোচ্ছি আমরা। এ লড়াই অধিকার ছিনিয়ে নেবার। আমরা সফল হবোই'
হাট্টাগাট্টা জোয়ান নেতা বীরু মাহাত কে ঈশ্বর মেনেছিল ফুলমনি। সেই বীরুই আড়ালে পেয়ে জোর করে ফুলমনির উপর। এবার ফুলমনি আত্মরক্ষার অস্ত্র প্রশিক্ষণকে কাজে লাগায়। পিস্তলটা বার করে ছটা গুলি ঠুকে দেয় বীরুর বুকে। রক্তাক্ত বীরু ওরই বুকের উপর এলিয়ে পড়ে। গুলির আওয়াজে সবাই ছুটে আসার আগেই এক ধাক্কায় বীরুর শরীরটা সরিয়ে দৌড়াতে থাকে ফুলমনি। জঙ্গলের ভিতরে দেখা সহযোদ্ধা এবং এক গ্রামের নবীন মাণ্ডির সাথে। রক্তাক্ত ফুলমনিকে দেখে ও থমকে জিজ্ঞেস করে, ফুলমনি সব বলে। নবীন ওকে সাথে নিয়ে গ্রামের বাইরে গাছের আড়ালে অপেক্ষা করতে বলে। একটু সময়ের মধ্যে নবীন দুটো পরিষ্কার শালোয়ার কামিজ ওড়না, কিছু শুকনো খাবার আর দুই হাজার টাকা আর একটা নতুন সিমকার্ড দিয়ে বলে, 'এবার তুই পালা ফুলমনি, তোর রাস্তা এখন একদম আলাদা। ধরা পড়লে কি হবে জানিস, সামনে যে স্টেশন পাবি সেখানে ট্রেন ধরে চলে যাস ভুবনেশ্বর। ফাদার লবটোকে আমি তোর কথা বলে রাখব। ওখানে নতুন নামে নতুন জীবন শুরু করিস। সব থিতিয়ে না আসা পর্যন্ত এ পাশকে আসবিনি। আর হ্যাঁ, পুরোনো কার্ডটা চেঞ্জ করে নতুনটা ভরিস ফোনে। আমি যোগাযোগ করব। এই নম্বরটা আমার বাবার। কেউ জানে না দলের।'
বুকে কষ্ট আর চোখে আগুন নিয়ে সেই ছোটা শুরু ফুলমনির।
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙতে সময় দেখতে গিয়ে মোবাইলে একগাদা মেসেজ দেখেছিল। পুরোনো আনস্মার্ট ফোনে নতুন সিম। নাম ওঠেনি কারোই।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ভোর হয়ে গেল। চা ওয়ালাকে ডেকে গরম একভাঁড় চা নিতেই বেজে উঠলো ফোনটা।
হ্যালো...
ফুলমনি, আমি নবীন...
হ্যাঁ বলো....
বীরুর ডানহাত এবং দলের দ্বিতীয় নেতা চন্দ্রকান্ত তোর খোঁজে জঙ্গলে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে। তোকে না পেলে তোর বাবা মা কে জানে মেরে দেবে...
সেকী!! মানে
হ্যাঁ রে....
দাঁতে দাঁত চেপে ফুলমনি বলে 'আমি মার্গারেট, মুছে দিলাম অতীত'
ফোন কেটে ভাবে, আগের যে পথ দিয়ে ও নতুন পথের সন্ধানে যাচ্ছে, কিছুতেই ফিরবে না আর সেই পথে। নিজের কর্তব্য ঠিক করে মনে মনে নিজের নাম ঠিক করে রেখেছিল 'মার্গারেট'। ফাদার লবটোর সাথে দেখা হলে ধর্ম পরিবর্তন করে সে এই নামেই সমাজসেবা করবে।
হারিয়ে খুঁজি
আ র তি ধ র
-বড় বড় দুটো চটের ব্যাগ সাথে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দিয়েই মাথার ঘোমটা আর একটু টানতে টানতে কর্তার দিকে তাকিয়ে বেশ রুক্ষ স্বরে গিন্নি বলতেন "শাক, তরকারি যা মনে চায় আইনো, কিছু কমু না, তয় মাছ কিন্তু একটু দেইখা শুইনা আইনো, এই কইয়া দিলাম?"
কর্তা তখন দুই আঙুলের ফাঁকের বিড়িতে শেষ টান দিয়ে যেন আড়মোড়া ভাঙ'ত গিন্নীর কথায়!
-দেইখা শুইনা মানে? কি কইতে চাও তুমি শুনি? মাছ কি চোখ বন্ধ কইরা কিনা আনি?
গিন্নীর সুর নরম এবার! বলতেন, আরে তাই কইছি নাকি! ওই কই, টাকি আইনো না, একজন তো কাটতে বইলে আঙুল ফুটা করে আরেকজন এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ কইরা দেয়?
কর্তার বোধগম্য হয় কিনা কে জানে, গিন্নীর কথার মানে! কোনো উত্তর না দিয়ে পা সোজা সাইকেলের প্যাডেল এ...।
বড় একখানা আড় মাছ ছোট্ট ব্যাগের থেকে নামিয়ে হাসিমুখে ডাকেন, ও গিন্নী বড় বঁটিটা আইনো? বঁটি হাতে গিন্নী আসতে আসতে কর্তা একটা জলচৌকি নিয়ে বসে যেতেন উঠোনের এক কোণে, ওখানে মাছ কাটা হয়, গিন্নী এসে মাছের সাইজ দেখে মনে মনে খুশি হলেও মুখে কপট রাগের ছায়া ফেলে বলতেন, তুমার এই এক দোষ, এত বড় মাছ কাইটা আনতে পারো তো?
-আরে অরা কাটলে মনের মত সাইজ হয় নাকি! পিস দেইখা তো মনে হয় ব্লেড দিয়া কাটছে, লেজটা আরেকটু বড় রাখো দেখি?
মাছের পিস, মাছের ইতিহাস দুজনে মিলে গল্পে মাছ কাটা শেষ হতেই কর্তার বিড়ির শেষাংশ ফেলে উঠে যেতেন, গিন্নী গামলা ভরা মাছ, বঁটি আর ওই ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে চলে যেতেন কলতলায়। ধুয়ে শুকিয়ে আবার যথাস্থানে, আগামী দিন আবার একই পরিক্রমা...।
এ গল্প আজকের নয়, সত্যি আজ এ গল্প যেন ইতিহাস মনে হয়! সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে আমাদের যাপন চিত্র। আজ কত সহজ হয়েছে জীবন যাপন। আজ বাজারে যাবার জন্য তৈরি হতে হয় না। আজ বাজারের ফর্দ লিখতে হয় না। ওই অফিস ফেরত একটু ম্যাসেজ চেক করলেই থাকে বাজারের ফর্দ। এক নজরে দেখে কাছাকাছি কোনও শপিং মল এ ঢুকে গেলেই ল্যাঠা শেষ!
মাছের বাজার হয়েছে আরও সহজ। মিসেস কে জিজ্ঞাসা করতে হয় না কি মাছ লাগবে! আশ বঁটির দিন শেষ হয়েছে। অনলাইন খাবারের চাহিদা তুঙ্গে, দুপুরে ক'পিস মাছ লাগবে জানাতে গিয়ে রাতের খাবার অর্ডার দেবার ব্যাপারটা জানালেই ঝামেলা শেষ আজকের মতো!
সত্যিই...! সব সহজেই পেয়ে, পেয়ে আমরা আজ যেন সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে গেছি!
-তবে সব ক্রিয়ারই যেমন সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তেমনি সব সহজের কিছু কুফল ও আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়েছে!
-ঘরে আজও বাজার আসছে, ব্যাগ বন্দী হয়ে নয়, পলিথিন বন্দী হয়ে। কিন্তু বাজার পলিথিন বন্দী হয়ে আসছে, নাকি আমরা বন্দী হয়েছি পলিথিনে আষ্টেপৃষ্ঠে...!
শহরের রাস্তাঘাটে আগেও পড়ে থাকত, বিড়ির প্যাকেট, মুড়ির ঠোঙা তবে সেসব দুদিনেই মিশে যেত মাটিতে, কিন্তু এভাবে অবিনশ্বর পলিথিনের পাহাড় জমত না কখনো!
-আর গ্রামের সড়ক পথে? চলতে চলতে কখনো গন্ধ ভেসে আসত নাম না জানা কোনো ফুলের, কখনো পাকা কাঁঠালের, কখনো বা পচা গোবরের! কিন্তু আজ চলতে গিয়ে গন্ধ ভুলে নিচে তাকাতেই দেখি চিপসের খালি প্যাকেট, নানা ধরনের সুপারি জাতীয় জিনিসের প্যাকেট, এমনকি বিড়ির প্যাকেটটাও তার আগের কাগজের মোড়ক হারিয়ে পলিথিন বন্দী! তার অবিনশ্বর প্যাকেট!
সময়ের সাথে বদলে যেতে হয়, বদলে গেছিও! তবে হারিয়েছি যে কতকিছু! হয়তো সেগুলোর আজ কানাকড়ি মূল্য নেই তবুও ফিরে পেতে ইচ্ছে করে সেই ছোট্ট মাছের ব্যাগটা। ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে গ্রামের ছোট ছোট দোকানগুলোতে খবরের কাগজের তৈরি হরেক সাইজের ঠোঙা! হাসিমুখে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে 'ও কাকু দুশো গ্রাম মুড়ি আর দশ টাকার চানাচুর দাও তো?'
- দাম চুকিয়ে দু'হাতে দু সাইজের দুটো ঠোঙা চটের সুতলি দিয়ে বাঁধা, কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে এসে মুড়ি, চানাচুর সহ চা পান করতে করতে নজর দিতে ইচ্ছে করে ঠোঙার গায়ে, তবে ওই যতটুকু উদ্ধার করা যায় ততটাই! তারপর ঠোঙা দুটো লেগে যাক উনুন জ্বালোনোর কাজে. ...!
গল্পটা শুরু হোক
মৌ সু মী পা ল
ভাদরের বেলা। ঋতুমতী বৃষ্টি আর বুকের অনুরণন হৃদপ্রদাহে প্লাবন এনেছে আজ। বন্ধ কাজ। অনুরাগী চেতন বেশরম। আসবে সে। যে আমার কাঙ্খিত পুরুষ। রূপ যৌবন কামনা যার আদরের ভাঁজে ভাঁজে সিক্ত আমি, আমার বাসনা। হায় লজ্জাবতী! নুয়েছে সে আগেই আদর বৃষ্টির বেত্রাঘাতে। ঘরে ঘরে অন্ধকার আর থেকে থেকে মেঘের ধাক্কা ফাটিয়ে দু'ফালা করে আমার হৃদয়।বেলাশেষে সলতের আলোতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তার ভালোলাগার আলোবেলার স্পর্শ। শ্বাসের অবাধ্যতায় প্রদীপের শ্বাসরোধ।।
কামনার দেহে তখন সূর্য আগুন। অনুরাগী দেহাকাশে তখন রামধনুর স্বেচ্ছাচার। বাজের শব্দ আর বস্ত্রের খসন। আগুন আর বৃষ্টি, বৃষ্টি আর আগুন পারস্পরিক।।
বোঝাপড়া শেষ হলে নবারুণ ডাকলো___ নীলাম্বরী!
বুকের ভাঁজে মাথা গুঁজে মেঘ বলেছিল___ এটা বুঝি আমার নতুন নাম?
নব : পছন্দ?
মেঘ : (মাথা নেড়ে ) না।
নব : বেশ, তবে মাধবীলতা?
মেঘ : সগর্বে বুক থেকে উঠে বলল___ এই আমি তোমার বুক থেকে মাথা তুললাম অবলম্বনের বেড়াজাল ভেঙে।
আমি মুক্ত হতে চাই নব!
নব : বুঝলাম। তবে তুমি মঞ্জুলিকা অথবা অভয়া।
মেঘ : আর একটু কিছু ভাবা যায় না সাহস করে?
নব : আরোও...... বেশ তবে ....একটু সাহায্য কি পাওয়া যায় না?
মেঘ : হলুদ রঙ আমার প্রিয়।
নব : পেয়েছি ... বাসন্তী...
মেঘ : (আঁৎতে উঠে)... ডেকেছিল কেউ ... আর বইতে পারবো না। ছুরিকাঘাত করেছে ওই নামে। বিদায় দিয়েছি বসন্তকে চিরতরে! আমি তেজ চাই নব! আজ যেখানে তুমি নিয়ে গিয়েছিলে... সেই সেখানে...
যেখানে কান্না নয়, দুর্বলতা নয়, নয় আক্ষেপ। থাকবে শুধু আলোর মুক্তি।
নব : তুমি ...
মেঘ : সূর্যমুখী। নব অরুণ রাগে সূর্যমুখী ফুটুক, টুটুক অন্ধকার। আমি হয়ে উঠি নবারুণের সূর্যমুখী।।
অন্ধকার কেটে সকাল হলো নবকিরণে দুলছে দূরে কোথাও সূর্যমুখী।।
যার ব্যাখ্যা মেলেনি
অ নি ন্দি তা না থ
নীলরতন কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন বাবা। ছোটবেলা থেকেই শখ ছিল গ্রামে চিকিৎসা করবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সঙ্গে জুটে গেল আরো চার বন্ধু। সে ১৯৫৬ সালের ঘটনা। ছোট্ট পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরা। রাজধানী আগরতলা। বাবার পোস্টিং মফঃস্বলে। জায়গাটির নাম বিলালগড়। বিজলি বাতির দেখা মেলেনি। লন্ঠনের ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। কুড়ি বেডের হাসপাতাল। অন্য সব ধরনের স্টাফ বা কর্মচারী ছিলেন, কিন্তু বাবাই ছিলেন হাসপাতালের হর্তাকর্তাবিধাতা। হাসপাতাল এলাকায় মধ্যেই আবাসন।সুন্দর বাঁশের তৈরি কোয়ার্টার্স। রাতে হাসপাতালের জন্য হ্যাজাক
জ্বলতো। ভালই কাটছে সময়। বাবা ছিলেন ভীষণ সাহসী। তখন কার দিনে জাত মানতে না। হঠাৎ একদিন এক অগ্নিদগ্ধ মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন তার আত্মীয় স্বজন। শোচনীয় অবস্থা। যমে মানুষের টানাটানি।শীতকাল। বাবা ঠিক করলেন রুগীর কাছে রাতে থাকবেন। সিস্টার শুনে খুব খুশি। সঙ্গে ওয়ার্ড বয় ও ডিউটি করতেন। বলা বাহুল্য ঠাম্মা বিয়ে দিয়ে বৌমাকে পাঠিয়ে দেন বাবার সাথে। রাত দশটা নাগাদ, খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ, বড়ো ফ্লাস্ক-এ চা নিলেন। প্রচন্ড শীত হেতু গরম চাদর ও আরাম কেদারা নিয়ে হাসপাতালে ঢুকলেন। চেয়ার পেতে চাদর মুড়ি দিয়ে, তবে মুখ বাইরে রেখে রুগী দিকে দৃষ্টি তাঁর। প্রথম দিন: রাত তিনটে নাগাদ কাচের জানালার দিকে নজর পড়ল। কুয়াশাভেজা জানালার কাচের পাল্লায় ওটা কি, এ যে দু'টো হাতের ছাপ! যাই হোক এসব পাত্তা দিলেন না।সিস্টারের তখন একটু ঝিমুনি ভাব এসেছিল। যাই হোক, এ ব্যাপারে বাবা কাউকে কিছু বলেননি। তখনকার সময় অবস্থা খারাপ- এমন রোগী থাকলে কালো পর্দা দিয়ে চারদিকে ঢাকা থাকতো। অন্য রুগীরা যাতে ভয় না পায়। দ্বিতীয় দিন: একইভাবে বাবা পেশেন্ট পাহারা দিচ্ছেন। সিস্টারকে বলে দিলেন পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ, কাজেই চা এর উপর নির্ভর করে রাত জাগতে হবে। তিনি রাজী হলেন। রাত সাড়ে এগারোটা থেকে রোগীর অবস্থা গুরুতর। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে। সিস্টার ও ডাক্তার- দু'জনেই নিবিষ্ট রোগীর প্রতি। রাত তিনটে নাগাদ সিস্টার বললেন: 'ঠান্ডা লাগছে ফ্লাস্ক থেকে চা খেয়ে নিই।' বাবাও রাজী হলেন, সিস্টার চা চেয়ার ছেড়ে কাপে চা ঢালছিলেন।তৎক্ষনাৎ এক আজব কান্ড ঘটলো-- ঔষধ রাখার টেবিলটা কে যেন এক হাত দূরে সরিয়ে দিলো। সিস্টার তো ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। মুখে বলতে লাগলেন- 'ভুউউউত... ভুউউউত স্যার'-
বাবা-- "ভুত আমি বিশ্বাস করবো তখনই, যদি আপনার চেয়ারটা শূণ্যে ভাসে।" চেয়ারটা শূণ্যে ভাসলো বটে, তবে সেটাও এক হাত দূরে সরে গিয়ে। বাবা বললেন- "বুঝেছি এটা সাহেবভুত।" সিস্টার তো ভুতের ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েই যান। আর আশ্চর্য! সেই মুহূর্তেই সেই রোগীও মারা যান। বাবা দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য- ভেন্টিলেটর দিয়ে কুয়াশার মতো কি যেন বেরিয়ে গেলো। ওয়ার্ড বয় সিস্টারের মাথায় জল ঢেলে জ্ঞান ফেরালেন। বাবা অনেক বন্ধুর কাছে এ ঘটনা বিবৃত করে ব্যাখ্যা চাইলেন। কিন্তু সঠিক জবাব পেলেন না।
নবজন্ম
ম ঞ্জু চ্যা টা র্জি
গোপাল, বলি ওরে ও গোপাল হতচ্ছাড়া ল্যাংড়া, হার মাস জ্বালিয়ে কালি করেও শান্তি নেই নাকি! বলি কটা বাজে সে খেয়াল আছে? বাবুদের গাড়ি তো বেড়িয়ে যাচ্ছে। তা যাও সোনা, ভিক্ষার বাটিটা নিয়ে গাড়ির সামনে যাও। দেখো কটা পয়সা পাওয়া যায়। তা নয় তো উনি ঝুপড়ি তে বসে স্লেট পেন্সিল ঘষছেন।
হ্যাঁ এই যাই মা, তবে এখন সব গাড়িতে ঠান্ডা মেশিন চলে ঠক ঠক করলেও খুলতে চায় না। আমায় একটা মাস্ক দাও মা, ওটা না পরলে আরোই কেউ জানালা খুলবে না মা...
হ্যাঁ তা আর না! বলি দশ টাকার নীচে মাস্ক আছে? এলেন গোপাল ঠাকুর রে আমার মাস্ক পড়বো!! যা বলছি দশ টাকা মেলে কিনা তাই দেখ গে গিয়ে।
গোপাল কথা আর না বাড়িয়ে এগোয়। সেই কোন জন্মে কি এক অসুখে একটা পা নষ্ট হলো। তার নিজের মা থাকলে কিছু একটা করে হয়তো ব্যাবস্থা করতো। কিন্তু আর তা হবার নয়। তাড়াতাড়ি এগিয়ে দেখে ট্রাফিকে অনেক গাড়ি, বেশ বড়সড় একটা গাড়ি দেখে ঠক ঠক করতেই কাঁচ নাবলো। কি সুদর্শন এক ভদ্রলোক। মনে হয় একটু বেশি টাকা মিলতে পারে!!
কি চাই? পয়সা বাবু। দশ টাকার একটা নোট দেখিয়ে বলে, দিতে তো পারি, আগে বল তুই এর বিনিময়ে আমাকে কি দিবি? বিনিময়!! সে কি বাবু?
আমি? আমি কি দেবো আপনাকে? আমার তো কিছুই নেই দেওয়ার মতো? এই নে টাকাটা। সে তুই ভেবে দেখ কি দিবি, এই পথেই আমি ফিরবো ঠিক এই সময়ে কিছু তো তোকে দিতেই হবে। সিগন্যাল সবুজ সংকেত দিলো। গাড়ি হুশ করে চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে গেলো।
গোপাল হা করে দশ টাকার নোটটা নিয়ে দাঁড়িয়ে, এমন কথা তো কেউ বলে নি কোনদিন। এনার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ, পাগল লোক। খুব জোরে গাড়ির হর্ণে আওয়াজ পেয়ে সম্বিত ফিরলো গোপালের, এই ল্যাংড়া, আরেক পা খোয়াবি না কি রে মাঝ রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে?
গোপাল আজ আর কোন গাড়ির কাছে গিয়ে হাত পাততে পারলো না। মাথার মধ্যে একটাই কথা ঘুরছে!!বিনিময়!! কিছু একটা দিতেই হবে ওনাকে।
সৎ মায়ের গঞ্জনা শুনেও রোজ কিছু ভাত অন্তত খায়। আজ আর ভাত গলা দিয়ে নামছে না। কি দেবো আমি? কি দিতে হবে আমাকে কাল? লোকটা সত্যিই দাঁড়াবে কি আমার জন্য? দূর যত আবোল তাবোল চিন্তা!! স্লেট পেন্সিল আজ রেখে একটা কাগজ কুড়িয়ে নিলো গোপাল। ভয় যে হচ্ছে না তা না। ওই কাগজ দিয়ে উনুন জ্বালাবে মা সন্ধ্যের সময়।
নিজের মনে কিছু গাছ পালা, মধ্যিখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছে একটা আর গোলাপ ফুল আঁকলো। কিছুই মনে আসছে না। তবুও গোলাপ ফুলটা পেন্সিল দিয়ে আরো সুন্দর করার চেষ্টা করলো। রং পেন্সিল তো নেই তা হলে লাল করা যেত। এটাই ভেবে রাখলো কাল ওনাকে এই আঁকাটাই দেবে।
তৎক্ষণাৎ এটাকে একদম লুকিয়ে নিজের জামার পকেটে রাখলো। হাত ছাড়া করা যাবে না। আর দেবোটাই বা কি আমি এ ছাড়া? নিলে নেবে না হলে রাস্তায় ফেলে দেবে। যথা রীতি সকাল হলো।
বেলা দশটা নাগাদ আজ মা আসার আগেই উঠে চলে গেছে রাস্তার মোড়ে গোপাল। ওই তো ওই গাড়ি টা!! আজ কি সিগন্যালে দাঁড়াবে? কি জানি!
ওই তো বাবু হাত নাড়ালো। গাড়ি সাইড করে জানালার কাঁচ নামিয়ে জিগ্যেস করলো কি রে কি দিবি আমায় দশ টাকার বিনিময়ে?
গোপাল লজ্জ্বায় লাল হয়ে বলে বাবু আমার তো কিছু নেই এই যে এই আঁকাটা নিলে খুব ভালো হয়। বাবু আঁকাটা নিয়ে খুব খুশি, বলে যাক কিছু তো এনেছিস। এই নে, এটা তোর পারিশ্রমিক। একটা হাজার টাকার নোট এগিয়ে দেয়। আর এও বলে... এই টাকা নিয়ে তুই কি করবি সেটা তোর ব্যাপার। গোপাল তো অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে। এতো টাকা!! এ তো জন্মে পায় নি সে। গাড়িটা চলে গেলো সামনে দিয়ে....
গোপাল বুদ্ধি করে বাড়ি না ফিরে দোকানে গিয়ে সেই টাকা দিয়ে ফুলমালা, বেলপাতা দুর্বো- সব কিনেছে। আর একটা প্লাস্টিকের চাদর, তাই বিছিয়ে বসতে না বসতেই কত ফুল মালা যে বিক্রি হলো। একেই বড় রাস্তার মোড় তার উপর কাল জন্মাষ্টমী। লোকেরা হেঁটে বাজারে না গিয়ে গোপালের কাছ থেকেই কিনে নিলো।
বেলা তো কম হলো না!!ল্যাংড়ার দেখা নেই বলে মা একখানা লাঠি নিয়ে আসে কোথায় সেই হতভাগা? সব দেখে শুনে মায়ের তো মূর্ছা যাবার দশা। কেঁদে কেটে ওমা আমাদের গোপাল না কি? তোমরা কে আছো গো দেখে যাও আমাদের গোপালের যে আজ নবজন্ম হলো। বাছা আমার ফুলের দোকান দিয়েছে।
সেই সন্ধ্যে বেলা গাড়ির ভদ্রলোকটিও গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফুলমালা সব কিনেছেন। ড্রাইভার এসে বড় বোর্ড রং পেন্সিল, কাগজ পেন, খাতা সব নামিয়ে দিয়ে গেলো। গোপালের আজ বড় সুখের দিন। কাল কে জন্মাষ্টমী।
নায়িকার সন্ধানে
আ স গা র আ লি ম ণ্ড ল
সকাল থেকে একটা ব্যাপার নিয়ে সৌমেনের ব্যস্ততার শেষ নেই। নিজের লেখা চিত্রনাট্যের জন্য আর বুঝি মানানসই নায়িকা খুঁজে পাওয়া যাবে না। নায়িকার খোঁজে এখানে ওখানে, হাটে-বাজারে অনেক সময় অতিবাহিত করেছ। এবার হাল ছেড়ে দেবার পালা।তবুও মন মানে না। আর একটি বার চেষ্টা করে দেখার জন্য মনস্থির করলো।
সেই মতো পরের দিন সকালে স্নান খাওয়া সেরে বাউড়িয়া স্টেশন থেকে বর্ধমান জংসনের একটা রিটার্ন টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসলো। ট্রেন চলতে লাগলো নিজের গতিতে।সৌমেন চোখ বন্ধ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে মনের মধ্যে অনেক চিন্তা নিয়ে। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন যখন পৌঁছালো বেলা তখন দশটা। এবার পূর্ব রেলের ট্রেনে চাপতে হবে বর্ধমান যাওয়ার জন্য।
স্টেশনের মাইকে ঘোষণা শুনে সেই মতো চার নম্বর প্লাটফর্মে উপস্থিত হলো।থেমে থাকা ট্রেনের জানালার ধারে একটা সিটে গিয়ে বসলো। ঠিক সাড়ে দশটার সময় ট্রেন ছাড়লো।ডানকুনি, মশাগ্রাম ছাড়িয়ে ট্রেন যখন বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছালো তখন দুপুর বারোটা। টি স্টল থেকে একটু চা খেয়ে স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে সিয়ারাবাজার গামী বাসে উঠতেই এক অপরূপা সুন্দরী মহিলার দেখা মিললো।সৌমেনের বাঁ চোখটা আনন্দে নেচে উঠলো। এত দিন পর একটা মনের মতো নায়িকার দেখা পাওয়া গেছে। কিন্তু না, ভালো করে নিরীক্ষণ করার পর কপালের উপরে একটা কাটা দাগ দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে সৌমেনের মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। এ জন্মের মতো আর বুঝি নায়িকা পাওয়া যাবে না।
সিয়ারাবাজারে বাস থেকে নেমে বেশ খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালো সৌমেন। ভালো কিছু চোখে না পড়ায় ওখান থেকেই আবার বাসে চেপে সোজা চলে এলো কার্জন গেট।পড়ন্ত বেলায় রাস্তায় লোকজনের ভীড়ও রয়েছে।এবার কিছু খেতে হবে খুব ক্ষিদে পেয়েছে সৌমেনের।একটা খাবারের দোকান দেখে সামান্য কিছু খেয়ে নিলো। তারপর যে ভাবে বর্ধমান পৌঁছে ছিলো ঠিক সেই ভাবেই সেই পথ ধরেই বাউড়িয়া স্টেশনে ফিরে এলো। প্লাটফর্মে বসে ভাবতে লাগলো কি করা যায়! ভাবনা একটা এলো বটে, তবে কতটুকু ফল পাওয়া যাবে সেটাই চিন্তার ব্যাপার।স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এসে একটা টো-টো গাড়ি চেপে চলে এলো বাউড়িয়া লঞ্চ ঘাটে। সূর্য তখন অস্ত চলে গেছে। চারিদিকে নেমে এসেছে অন্ধকার। দূরে নদীবক্ষে জেলেদের নৌকায় টিম-টিম করে জ্বলছে তেলের বাতি। দু'পাড়ে জ্বলে থাকা লাল সাদা আলো নদীর শোভা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। তেলের জাহাজগুলো সেজে উঠেছে অপরূপ আলোক মালায়।
পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে লঞ্চের এক কোনে গিয়ে বসলো সৌমেন। সামনে বসে থাকা এক মহিলার উপর চোখটা আঁটকে গেল। গায়ের রঙ দুধে আলতায় গোলা।নাকটা বাঁশির মতো, পটলের মতো চোখ, ঠোঁট দুটি কমলা লেবুর কোয়ার মতো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। একবার দু'জন দু'জনের চোখে চোখ রাখলো। পরক্ষণে দু'জনেই খুব লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
বজবজ কালীবাড়ি ঘাটে লঞ্চ ভিড়লো। ওরা দু'জনেই লঞ্চ থেকে নেমে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। সৌমেন একবার ভাবলো নামটা জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়।পরক্ষণে আবার ভাবলো জিজ্ঞাসা না করাই ভালো।কোথা কি ভেবে বসবে! এই ভাবে দু'জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় পড়ে থাকা একটি ডাবের খোলে পা লেগে গেল সৌমেনের।সঙ্গে সঙ্গে ডাবের খোলটি রাস্তার মধ্যে ঘড়-ঘড় শব্দ করে গড়িয়ে যেতে লাগলো।তা দেখে মহিলাটি মুখে হাত চাপা দিয়ে খিল-খিল করে হেসে উঠলো। সৌমেন খুব সংকুচিত হয়ে গেলো মরমে।
দুলকি চালে হাঁটতে-হাঁটতে ওরা দু'জন পৌঁছে গেল বজবজ প্লাটফর্মে। থেমে থাকা বজবজ-শিয়ালদহ ট্রেনের কামরায় জানালার ধারে একটা সিট দেখে মহিলাটি বসে পড়লো।অগত্যা উপায় কিছু নেই ভেবে সৌমেন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলো। অফিস ফেরত লোকজনে ভরে উঠলো ট্রেনের প্রতিটি কামরা। এক সময় সবুজ আলোর সিগন্যাল দেখা দিতেই হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। সৌমেন দেখলো মহিলাটি হাত নাড়ছে তাকে উদ্দেশ্যে করে। বিদায় জানাচ্ছে। এই সব দেখে সৌমেনের চোখের কোন জলে ভিজে গেল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে লাগলো এবং মনে মনে ভাবতে লাগলো, একেই বোধ হয় বলে ভালোলাগা। চাকার ঝনৎকারে ক্ষণিকের ভালোলাগা ঝুরঝুর করে ঝরিয়ে দিয়ে প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল ট্রেন।
চাকরির ভুত
অ ত সী ম ন্ড ল
রাহুলের বাবা অমলেন্দুর একটি ছোট্ট ব্যাবসা আছে, হাটে হাটে মশলা ডাল কড়াই বিক্রির। তা উপার্জন ভালোই হয়। রাহুল এম এ পাশ করে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। কিন্তু এই দুর্মূল্যের বাজারে সরকারি চাকরির নিয়োগ হচ্ছে কই? অথচ রাহুলের ইচ্ছে, সে চাকরিই করবে এবং সরকারি। না হলে এত পড়াশোনা করে কি লাভ হল? এই পথে দেদার খরচ জেনে টিউশনি ও করছে বছর খানেক ধরে। রাহুল টিউশনি করে যেটুকু টাকা পায় তা ফর্ম পূরণ করা, বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার জন্য বই কেনা, অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া, এই সব করেই ব্যয় করছে। অবশ্যি শুধুমাত্র নিজের পয়সা খরচ হচ্ছে তা মোটেই না, বাবার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও ধ্বংস করছে, পড়াশোনা শেষ করার পর থেকে। এই নিয়ে বাড়িতে বাবা ছেলের প্রায় অশান্তি হয়। এই তো সে দিন সন্ধ্যা বেলা- রাহুলের মা কনিকা দেবী, হাট ফেরত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত স্বামীকে কড়া করে এক কাপ চা দিয়ে নিজেও নিয়ে, এক সঙ্গে বসে টুকিটাকি কথা বিনিময়ের মাধ্যমে চা পান করছেন। এমন সময় ঝোড়ো বাতাসের মতো রাহুল হাজির হয়ে বলে, মা বাবা কে বলো এক লাখ টাকা দিতে। আমি কালই বি এড কলেজে ভর্তি হব। বি এডটা করলেই শিক্ষকের চাকরিটা পাক্কা। অমলেন্দুবাবু কন্ঠ সপ্তমে তুলে বললেন-- কনিকা তোমার নবাব পুত্র কি জানে যে বি এড করেও হাজার হাজার ছেলে বুড়ো আঙুল চুষছে। আর আমি কি টাটা বিড়লা, কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে তোমাদের মা ছেলে কে খাওয়াই। তোমার ছেলেকে বলে দাও আমি একটা টাকাও দেব না। দেখলে মা দেখলে-- রাহুল বলল। একটু নরম হয়ে রাহুল বলল-- আরে, বাবা তুমি বুঝতে পারছ না বি এড টা কমপ্লিট হলেই নিশ্চিত চাকরি। আমার বন্ধু শোভন, মনে আছে তোমার? ওর মেসো তার ভাইয়ের বন্ধু এস এস সির ইন্টারভিউ বোর্ডে জব করেন। শোভনের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে আট লাখ টাকা দিলেই চাকরি পাক্কা বাবা। অমলেন্দু বাবু বলেন- তা আট লাখ কে দেবে তোমায়? ও বাবা, কি যে বল, আচ্ছা ঠিক আছে, দেখো তুমি আমায় ধার দিও চাকরি পেয়ে সব শোধ দেব-- কথা গুলো বলার সময় রাহুলের মুখের ভাবখানা যেন টাকা নয় মানিব্যাগের অভাব। কিন্তু অমলেন্দুবাবু কিছুতেই একটিও টাকা দিতে রাজি না। ছেলেও নাছোড়বান্দা-- মা আমিও বলে দিলুম বাবা যদি টাকা না দেয় তবে এখন থেকে আর কিচ্ছু টি খাব না। এই বলে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। এর পর দু'দিন কেটে গেল রাহুল মুখে কিছুই তুলল না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কণিকাদেবী আর স্থির থাকতে পারলেন না। অবশেষে ছেলের হয়ে কণিকাদেবী মাঠে নামলেন । অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন রাহুলের বাবাকে।
এরপর তিন বছর কেটে গেছে। রাহুল বি এড করার পাশাপাশি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে আর মাঝে মাঝে আট লাখ টাকার তাগাদা দিচ্ছে শোভনকে। তবে তাগাদা দিয়ে বিশেষ লাভ কিছুই হয় না। প্রতি বারেই শোভন বলে- প্যানেলে তোর নাম আছে সরকারি ব্যাপার, কত ফর্মালিটি! সব ই তো বুঝিস। একটু ধৈর্য ধর। এ দিকে রাহুল বাবাকে কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারে না। রাহুলের নিজের ও চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।
একদিন শীতের দুপুরে ঘরে এসে রাহুল দেখে মা বাবার মাথায় জল ঢালছে। পাড়ার লোক ও জড়ো হয়েছে । রাহুল কে দেখে পাড়াতুতো এক কাকা হ্যাঁচকা টেনে সোজা বাইরে নিয়ে যায়। আর বলে-- রাহুল কি করছিস, তোর বাবার কাছে একদম যাস না। রেগে লাল হয়ে আছে পোড়া লোহার মতো। কিন্তু কি হয়েছে? রাহুল বলে। আসলে তোর বাবা শুনে এসেছে যাকে মানে শোভনের ঐ মেসো আসলে চিটার। এ রকম অনেকেই টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়েছে। শোনা মাত্র রাহুলের যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেল। এমন সময় অমলেন্দুবাবু কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। রাহুল কে দেখে আর ও রেগে লাল হয়ে বলেন-- তোর যা ইচ্ছা তাই কর। এই শর্মা আর কোন দিন বাধা দেবে না। পারলে এই ঘর বাড়ি ও বিক্রি করে দিস। আমি চল্লুম। তুমি কোথায় যাবে বাবা, না বাবা তুমি কোথায় যেও না। রাহুল প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলে- অমলেন্দু বলেন-- সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিতে চল্লুম। আর কোন চিন্তা নেই তোর।
তখন রাহুলের সম্বিত ফেরে। বাবার পায়ে ধরে বলে: বাবা আমি আর কোনো দিন চাকরির পেছনে ছুটব না। তোমার ব্যবসাটাই করব।কাল থেকেই তোমার সঙ্গে হাটে গিয়ে বসব। প্লিজ বাবা বাড়ি ছেড়ে যেও না। যেও না বাবা। আমায় তুমি মারো বকো, যা ইচ্ছা তাই কর। প্লিজ বাবা।
এরপর বছর খানেক কেটে গেছে-- ব্যবসায় ছেলের উৎসাহ, মনোযোগ ও খদ্দেরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে দেখে বাবা অমলেন্দু ধাতস্থ হন। অমলেন্দু মনে মনে ভাবেন , ইয়েস আমি পেরেছি! ছেলের চাকরির ভুতটা মাথা থেকে নামাতে। যাক এবার একটি মেয়ে দেখে বৌমা বাড়িতে আনতে হবে- এই ভেবে একটি প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভালোবাসা
ছ বি ব্যা না র্জি
নীপা সদ্য এক কাপড়ে বিয়ে করে এসে সৌরভের ওয়ানরুমের ফ্ল্যাটটা দেখে প্রথমেই একটা জোর ধাক্কা খেল। ডাইনিংএ সোফাসেটের বদলে একটা তক্তপোশ, তোষক আর নতুন চাদর দিয়ে টানটান করে পাতা। তক্তপোশের পাশে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার। একটা ছোটো সস্তা ডাইনিং টেবিল দুজনের বসার মতো। নীপা পায়ে পায়ে ঘরে এসে দেখল সেগুন খাটের সাত ছয় একটা খাট, আলমারি আর একটা ড্রেসিং টেবিল।সবকটাই সদ্য কেনা আর দামী।
সৌরভ বলল--নীপা আগে চেঞ্জ করে নাও। আলমারিতে তোমার কিছু পোশাক কিনে রেখেছি। কাল তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসের একটা লিস্ট করে দিও। আমি ততক্ষণে একটু চা করে আনি। আজ রাতের খাবারটা অনলাইনে আনাবো।
নীপা বলল--কেন তোমার রান্নার মাসী নেই?--না, রান্নার মাসী, কাজের মাসী কেউ নেই। ওদের কাজে রাখার মতো যথেষ্ট টাকা আমি রোজগার করিনা। নীপা বলল--তুমি তো একটা হাই স্কুলের টিচার। একটা বাইরের কাজের মাসী রাখার ও তোমার ক্ষমতা নেই?
সৌরভ বলল--আমি হাই স্কুলের ইংরাজির আংশিক শিক্ষক। ওই চাকরি আর টিউশন মিলিয়ে মাসে আঠাশ হাজার টাকা মতো আমার রোজগার। তার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা এই ফ্ল্যাটের ভাড়া। ওই টাকার মধ্যেই কিছু টাকা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হয়।টিউশনি করে আরো কিছুটা রোজগার বাড়াতেই পারতাম। কিন্তু আমাকে চাকরির পরীক্ষায় বসার জন্য কিছুটা সময় নিজের জন্যে রাখতে হয়।
নীপা বলল-- তুমি প্যারাটিচার? সামান্য ওয়ান রুমের ফ্ল্যাটটাও তোমার নিজের নয়? এসব কথা তুমি আগে কেন বলোনি?
সৌরভ বলল-- তুমি আমাকে বলার কোনো সুযোগ দাওনি।একবার ভেবে দ্যাখো নীপা তোমার আমার আলাপ পরিচয় হয়েছিল এক অটোতে একসংগে তোমার কলেজ আর আমার স্কুলে যাওয়ার পথে। কয়েকদিন টুকটাক কথা বলার পর তুমি নিজে উপযাচক হয়ে আলাপটা ঘনিষ্ঠ করেছিলে। ওই সামান্য সময়টুকু তোমার সান্নিধ্যের জন্য মনে মনে উন্মুখ হয়ে থাকলেও কখনও নিজের সীমা অতিক্রম করিনি।
তুমি আমার সংগে সিনেমা যেতে চাইলে আমি অ্যাভয়েড করেছি। তিন চারবার তোমার প্রচন্ড আবদারে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গেছি। তুমি বারবার আমার মা বাবার কথা জানতে চেয়েছিলে।আমি বলেছি খুব ছোটোবেলায় আমি বাবা মাকে হারিয়ে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছি। মা বাবার স্মৃতি আমার কাছে ধূসর। তুমি সেদিন চোখ ছলছল করে আমাকে সহমর্মিতা দেখিয়েছিলে। তোমার সংবেদনশীল মন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমার অবস্থান ও অস্থায়ী চাকরির কথা বারবার তোমাকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি। আরো মনে করে দ্যাখো তুমি তোমার ভালোবাসার কথা বারবার বললেও আমি কিন্তু একবার ও বলিনি।
নীপা বলল--কিন্তু তুমি তো আমাকে দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে। খাবারের বিল বেশ মোটা অঙ্কের থাকত।নিজে এত কৃচ্ছ্রসাধন করে কি করে খাওয়াতে?
সৌরভ বলল--নীপা ভালো রেস্টুরেন্টে সবাই তো মাঝে মধ্যে খেতে যায়। আর সেটুকু সাধ্য আমার বরাবর থাকবে।আমি তোমার আকাশচুম্বী চাহিদা মেটাতে না পারলেও ছোটো ছোটো চাহিদা খুশি মনেই মেটাতে পারব।দৈনন্দিন জীবনে আমি আয়ের সংগে সঙ্গতি রেখে ব্যয় করি। আমি কৃচ্ছ্রসাধন করিনা। আমি মিতব্যয়ী।আমার খুব ছোটবেলা থেকে পরিশ্রম করা অভ্যেস ছিল।তাই একার জন্য অহেতুক কোনো কাজের মাসী রাখার দরকার মনে করিনি।
-- নীপা তুমিই মাত্র চারদিন আগে রেস্টুরেন্টে বসে আমাকে প্রোপোজ করেছিলে।আমি সেদিন ও তোমাকে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম আমার সুন্দর চেহারা আর স্থায়ী চাকরি করি ভেবে তুমি সাময়িক আবেগে প্রোপোজ করছ। সবটা জানলে তোমার এই মোহ কেটে যাবে।
তুমি তখন উন্মুখ হয়ে বললে--তুমি কিছু বলবে না? সৌরভ ভালোবাসা কি হিসেব কষে হয়? আমি বললাম--আমাকে সাতদিন সময় দাও। তার আগে আমার সব কথা তোমাকে শুনতে হবে। তুমি বললে--আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু মুখে উচ্চারণ করতে তোমার এত দ্বিধা কেন সৌরভ?বললাম-তোমার ভালো চাই বলে।
সৌরভ একটু থেমে বলল--তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে নীপা তুমি প্রোপোজ করার ঠিক চারদিন পর তুমি উদভ্রান্তের মতো রেস্টুরেন্টে আমাকে ডেকে বললে-- সৌরভ তুমি আমার দায়িত্ব নিতে পারবে? আমি বললাম--কি হয়েছে নীপা?তুমি বললে--বাবা আমার বিয়ে এক জায়গায় প্রায় ঠিক করে ফেলেছে। ওরা বলেছে বিয়ের পর ওরা লেখাপড়া আর চাকরি করাতে কোনো আপত্তি করবে না।
--সৌরভ আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমরা কালকেই বিয়ে করব। সৌরভ বলল-- কিন্তু নীপা আমার চাকরিটা তো-- তুমি আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বললে-- আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা। তুমি স্পষ্ট করে বলো তুমি আমার দায়িত্ব নিতে পারবে কি পারবে না?
--সৌরভ বলল-- সেই সময় তোমার কথাটা আমাকে সাহস দিয়েছিল। সত্যিই তো ভালোবাসা কি হিসেব কষে হয়? আমি জোর গলায় বললাম নীপা তোমার লেখাপড়া, সুখ দুঃখ, ভরণ পোষণের সব দায়িত্ব আমি স্বচ্ছন্দে নিতে পারব।আমাকে শুধু একটা দিন সময় দাও।
নীপা ওই একদিনে আমি খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবিল দিয়ে ঘরটা সাজিয়ে রেখেছিলাম। আমার ঘরে শুধু একটা তক্তপোশ একটা আলনা আর চেয়ার টেবিল ছাড়া কিছু ছিল না। মামা মামির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে দিয়ে সংসারের অনেক কাজ করিয়ে নিলেও গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত পড়িয়েছেন। আর আমার মায়ের রেখে যাওয়া গয়নাগুলো দিয়েছেন। যেটা মামি ইচ্ছে করলে আমাকে না দিতেই পারত। এম এ পড়ার খরচ আমি টিউশনি করে চালিয়েছি।
--আমি ভেবেছিলাম তুমি সবটা জেনেই আমাকে বিয়ে করেছো। নীপা আমি একবারই এস এস সি-তে বসে ভাইভাতে আটকে গেছিলাম। আবারও শুধু স্কুলেই নয়, অন্যান্য চাকরিতে বসার ও প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে।কিন্তু প্রস্তুতি নিলেই যে চাকরি পাব এমন নিশ্চয়তাও কিন্তু নেই। আমি এই সব কিছুই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম।
--নীপা আমি বুঝতে পারছি তোমার আশা ভঙ্গ আর মোহভঙ্গ দুটোই হয়েছে।এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ভালোবাসাও হিসেব কষেই হয়। আমার সব কথা আগে জানলে তোমাকে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। চিন্তা কোরোনা এই ভুলটা ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।তোমার চেঞ্জ করার দরকার নেই।তুমি বরং তোমাদের বাড়িতে একটা ফোন করে বলে দাও তুমি বান্ধবীর বাড়িতে আছো ফিরতে একটু দেরি হবে।বিয়েটা মন্দিরে হয়েছে।মন্দিরে প্রতিদিন বিশ পঁচিশটা বিয়ে হয়েই থাকে।কোনো সাক্ষী টাক্ষী থাকে না। তোমার পরিচিত কেউ বিয়েটা দেখেই নি। তুমি সিঁথির সিঁদুরটা বরং ধুয়ে এসো। বাড়ি ফিরে তোমার বাবা মার নির্বাচিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে সুখি হও।বিশ্বাস করো এটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। তোমাকে আমি দোষারোপ ও করব না
নীপা বলল-- কিন্তু তোমার কষ্ট করে সঞ্চিত প্রচুর টাকা ফার্ণিচার কিনতে শুধু শুধু খরচ হয়ে গেল যে?
সৌরভ বলল-- সঞ্চয় তো মানুষ প্রয়োজনেই খরচ করে নীপা। হয়তো এখন প্রয়োজন ছিলনা। কিন্তু ভবিষ্যতে তো প্রয়োজন হবে। ব্যাপারটা আমার কাছে একই। এটা নিয়ে প্লিজ তুমি ভেবো না।হয়তো আমার সবটুকু জেনেই ভবিষ্যতে কেউ সত্যিকারের ভালোবাসার হাতটা একদিন আমার দিকে বাড়িয়ে দেবে। আমি বিশ্বাস করি সৎ পরিশ্রম আর ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। আমার মতো হাজার হাজার ছেলে মেয়ে তো এভাবেই জীবনকে ভালোবেসে লড়াই করেই বেঁচে থাকে।
নীপা ফোনটা বের করে বাড়িতে মাকে ফোন করে বলল-- মা আমি দুদিন আমার বান্ধবীর বাড়িতে থাকব। ও প্রান্তের উত্তরে বলল-- আরে বাবা মণিকাদের বাড়ি। তুমি তো ওকে চেনো। আমি তো কয়েকবার থেকেছি। মণিকা ও আমাদের বাড়ি অনেকবার থেকেছে। ভেবোনা আমি ফোন করব।
ফোনটা কেটে নীপা মণিকাকে ফোন করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে ম্যানেজ করতে বলল।
সৌরভ নীপাকে ফোন করতে দেখে রান্নাঘরে চলে গেল।একটু পরে একটা প্লেটে দুটো রসোগোল্লা আর একটা ডিমের ওমলেট এনে বলল--নীপা তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে? এটা ধীরেসুস্থে খেয়ে নাও। তোমার বাড়ি ফিরতে দেরি হবে জানিয়ে দিয়েছো তো?আর ঠান্ডা চা টা খেতে হবে না। তোমার খাওয়া হলে আমি তোমার বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় ছেড়ে আসব।
নীপা বলল-- সৌরভ আমাদের হাতে মাত্র দুটো দিন সময় আছে। আমি বাড়িতে ফোন করে বলেছি দুদিন আমি বন্ধুর বাড়িতে থাকব। তার মধ্যে আমাদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা সেরে ফেলতে হবে। না হলে মন্দিরে বিয়েকে পাত্তা না দিয়ে আমার বাবা ঘেঁটি ধরে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে।
সৌরভ বলল--নীপা না জেনে আবেগের বশে ভুল করাটা অন্যায় নয়। কিন্তু জেনেশুনে তোমাকে আমি দ্বিতীয়বার ভুল করতে দেব না। একবার রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করলে আইনি ডিভোর্স পাওয়া অনেক হাঙ্গামার ব্যাপার। নীপা বলল--আমি এখানে এসে প্রথমটাই হতাশ হয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু এখন আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।--- কিন্তু আমার চাকরি পেতে যদি দেরি হয়, কিংবা যদি স্থায়ী চাকরি না পাই?
নীপা বলল--তুমি আমাকে একটা বিরাট প্রতিশ্রুতি দিয়েছো। আমার সুখ দুঃখ ভরণপোষণের সব দায়িত্ব তুমি স্বচ্ছন্দে নিতে পারো।এতবড় কথাটা আমি কি করে ভুলে গেলাম বলো তো?দরকার হলে আমি লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিউশনি করব। আমরা লড়াইটা দুজনে একসঙ্গে মিলে করব। যে মুহূর্তে তুমি একটুও রাগ না করে এই বিয়ে থেকে মুক্তির পথ বলে দিলে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তোমার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান আমার চতুর্গুণ বেড়ে গেল।তবে আমার একটা শর্ত আছে।
সৌরভ বলল--কি শর্ত শুনি।
প্রথম শর্ত হল-- তুমি আমাকে বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। যেটা তুমি আজ পর্যন্ত কোনোদিন মুখে উচ্চারণ করোনি।সৌরভ বলল--অবশ্যই বলব। পরশু রেজিস্ট্রি করার পর বলব। আজ আর কাল পুরো দুটো দিন তুমি মাথা ঠান্ডা করে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ভাবো। বন্ধুকে সবটা খুলে বলো।
নীপা বলল-- তুমি আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছ? এখনও আমাকে বিশ্বাস করছ না? সৌরভ বলল--নীপা তুমি একজন অ্যাডাল্ট মেয়ে। কয়েক মাস পর তোমার বি এ ফাইন্যাল পরীক্ষা। তোমাকে আমি একটুও অবিশ্বাস করছি না।তবুও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিও না। নীপা আগে আমি তোমার একজন হিতৈষী বন্ধু। দুদিন পর রেজিস্ট্রি বিয়ের পর না হয় স্বামী হব।সেদিন আমি গোলাপ ফুল আর আমার সাধ্যমতো উপহার দিয়ে আমার মনের কথা মুখে উচ্চারণ করব। ওই বিশেষ দিনে তুমি নতুন বেনারসী পরবে। আর আমার মায়ের রেখে যাওয়া কিছু গয়না পরিয়ে আমি নিজে তোমাকে সাজিয়ে দেব। এটা কিন্তু আমার তাৎক্ষণিক ভাবনা নয়। এটা আমি অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলাম।
ঘুড়ি
অ সী ম পা ঠ ক
দক্ষিণ বঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার বাসটি বার কয়েক গোঁ গোঁ শব্দ করে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লো। ড্রাইভার কোনোভাবেই স্টার্ট করতে পারছে না। জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠফাটা দুপুর, কোলকাতা থেকে লালমাটির পুরুলিয়াগামী একটি বাস হঠাৎই যান্ত্রিক গোলযোগে থেমে পড়ল। ড্রাইভার জানালো দেরী হবে। ঘন্টা দুয়েক যাত্রীরা কাছাকাছি বিশ্রাম নিতে পারেন। নিকটবর্তী শহরে যোগাযোগ করা হচ্ছে মেকানিকের জন্য।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লো সব যাত্রীরা। ভিড় ঠাসা বাস থেকে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর জিনস পরিহিত ব্যাগ কাঁধে নামলেন উদীয়মান সাংবাদিক বিমান ব্যানার্জি। সবে তার ক্যারিয়ার শুরু। জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেলের স্বল্প পরিচিত মুখ বি. বি। মোটা ফ্রেমের পুরু লেন্সের আড়ালে বুদ্ধিদীপ্ত দু'চোখে ব্যাকুলতার সুস্পষ্ট ছাপ। মাইলস্টোনে দেখলো শ্রীকৃষ্ণ পুর। দুপাশে জঙ্গল। একটু গঞ্জের মতো জায়গা। হাত বিশেক দূরে বাসযাত্রী প্রতীক্ষালয়। এই জঙ্গলে মাঝে মাঝে হাতির দল হানা দেয়। বিমানের গন্তব্য স্থল সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে খ্যাত জয়চন্ডী পাহাড়... শ্রীকৃষ্ণপুর তার পরিচিত জায়গা। বছর দশেক আগে একবার এসেছিলো, দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র সাথে। সেই স্মৃতি এখনো টাটকা। গ্রামে ঢোকার মুখে তাল তমালে ঘেরা বিরাট পুকুর। বাস স্টপে কয়েকটা ঠেলাতে চপ ঘুগনী ফুচকা আর খড়ের চাল দেওয়া দোকানে চা পকোড়া মুড়ি চা সন্দেশ গুড়ের লাড্ডু এসব ই পাওয়া যায়। সামনের চা দোকান গুলোর দিকে এগিয়ে যায় বিমান। দেখে নেয় গ্রামে ঢোকার মাটির রাস্তা এখন কংক্রিটের। আর দেখে মাটির দেওয়ালের বড়ো ঘরটা, বাইরে কাঠের মাচা। আচ্ছা ডাক্তার বাবু কি এখনো এখানে বসেন? দুপুর দেড়টা। দোকানপাট সব বন্ধ। যাত্রীরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছের ছায়ায় বিশ্রামে মগ্ন, কেউ বা সেলফিতে। দু'ঘন্টা সময় কম নয়... তবুও কনডাক্টর কে বলে, দাদা কতো দেরী হবে? একটু এই গ্রামের ভেতরে ঘুরে আসতাম। কনডাক্টর বলে আরামসে যান দাদা, আড়াই ঘন্টার আগে নয়, দেড়টা বাজে চারটায় গাড়ি ছাড়বো, তার মধ্যে আসুন।
গ্রামের ভেতরে এগিয়ে যায় বিমান।
দশ বছর... সময়ের স্রোতে কোথায় দাঁড়ালো সে। একটা জঘন্য অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খায়। সে এসেছিলো এখানে তার এক পিসতুতো দাদার সহযাত্রী হয়ে। গঞ্জের ডাক্তার মাধব বাবুর ছেলে অরুন ছিলো বিমানের দাদা সমীরের বন্ধু। সেই সূত্র ধরেই তার গ্রাম দেখতে আসা। সে তখন কলেজ স্টুডেন্ট। এখানে তখন ছিলো শরতকাল। বিকালে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো হয়েছিলো। যে কয়েকটি বর্দ্ধিষ্ণু পরিবার রয়েছে গ্রামে তাদের মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানোর চল ছিলো সে সময়। আজও কি আকাশে ঘুড়ি ওড়ে? মাত্র দুটো দিন এখানে কাটিয়েছে। এলাকায় প্রায় চুরি হয় বলে ডাক্তার বাবুর ঘরের বারান্দায় একটা দোনলা বন্দুক শোভা পেতো। সব ছবির মতো মনে পড়ে বিমানের। সেবার দুপুরে চারাপোনার ঝোল আর ডিমের কালিয়া দিয়ে পেটপুরে ভাত খেয়ে বেশ লম্বা ঘুম দিয়েছিলো বিমান। ঘুম ভেঙেছিলো এক কিশোরীর মিষ্টি কন্ঠে। কেমন যেন মায়াবী মুখ। বিমানের সমীরদার বন্ধু অরুনের বোন রিম্পা। ক্লাশ টেনের ছাত্রী। খিলখিলিয়ে হাসলে গালে টোল পড়তো রিম্পার। একবারই তো দেখা। রিম্পা মজা করে বলেছিলো, কোলকাতার লোকগুলো খালি ঘুমায়। চলো, ছাদে ঘুড়ি ওড়া হবে। ওখানেই চা খাবে। বিমান ছাদে গিয়ে দেখে সবাই ঘুড়ি ওড়ানোর তোড়জোড়ে লেগেছে। ডাক্তারবাবু এলাকার একমাত্র ডাক্তার। এম বি বি এস না হলেও পশার মন্দ নয়। বেশ রাশভারী। ঘুড়িটা বিমান কোনোকালেই ওড়াতে শেখেনি। তার ভালোও লাগতো না। ছাদের সেদিনের আয়োজনে সে ছিলো নীরব দর্শক। পাশাপাশি বেশ কিছু বাড়ি থেকে ঘুড়ি উড়তে শুরু করে। সমীর বলে ঘুড়ি ওড়াটা একটা আর্ট। অরুন বলে নারে যুদ্ধ বললে ভুল হয়না। কতোরকম সব আয়োজন। গ্রাম্য বিনোদনের এক নির্ভেজাল টনিক। সমীর বিমানকে দেখিয়ে রিম্পাকে বলে, এটাও তোর একটা মিনি দাদা। এ ভালো ছবি আঁকে। রিম্পা বেশ খুশী হয়ে বলে, মিনি দাদা কাল সকালে বাড়ির সদর দরজায় একটা ঘুড়ির ছবি এঁকে দেবে তো। হঠাৎ বিমানের খেয়াল হয় রিম্পার বাড়ির দরজায় তার সযত্নে আঁকা ঘুড়ির ছবিটা দশবছর পরে কেমন আছে দেখতে হয় তো, কি জানি আছে কি নেই ... পকেট থেকে সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সামনে এগোয় বিমান। তার পা কাঁপছে। ডাক্তার বাবুর পরিবারেরকেও যদি চিনে ফেলে, তারপর ভাবে- না, সম্ভব নয় চেনা। মাত্র দুদিন, তারপর দশটা শরত পেরিয়ে এই গ্রীষ্মের দাবদাহে সে অতীত হাতড়াতে ব্যস্ত। আসলে যা হারিয়ে ফুরিয়ে যায় তাকে রোমন্থনের মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি থাকে, শান্তি থাকে।
বিমানের মানসপটে সব যেন উজ্জ্বল থেকে উজ্বলতর। মনে পড়ে কচি পাঁঠার ঝোল মেখে ভাত খাওয়া। অরুনের সাথে বুনো হাঁস শিকার। জঙ্গল ঘেরা গ্রামের মাঠে ভলিবল খেলা। আর দু'টো বিকালে জমজমাট ঘুড়ি ওড়ানোর মেলা। দু'দিনে সবার সাথে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় অরুন সমীর দুজনে বাইকে করে দেশী মুরগির খোঁজ করে বেড়াচ্ছে, বোধহয় কাছের শহরে দু'এক পেগ রঙিন পানীয় গিলেই আসবে। বিমান অবশ্য ও রসে বঞ্চিত। বিমান ছাদে সিগারেটে টান দিয়ে শরতের মেঘমুক্ত নির্মল আকাশে তারা দেখছে। হঠাৎই পরিচিত সেই খিলখিলিয়ে হাসি। তাকিয়ে দেখে, পেছনে রিম্পা। বলে ওঠে মিনি দাদা তোমার আঁকা ছবিটা আমি মুছতে দেবো না কাউকে। বিমান গুনগুন করে গেয়ে ওঠে, ও আকাশ সোনা সোনা, গলা মেলায় রিম্পা, এ মাটি সবুজ সবুজ ... নতুন রঙের ছোঁয়ায় হৃদয় রেঙেছে ... দু'জন দু'জনের মুখ পানে তাকায়। রিম্পা বলে বাঃ তুমি গান জানো! বিমান বলে তুমিও দারুন গান করো... তারপর কথা শেষ ... পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারা। তারাভরা আকাশের নীচে দুটি সবুজ প্রানে অনাবিল খুশীর উচ্ছ্বাস। রিম্পা বিমানের হাতে হাত রেখে দূরে বাঁশবনের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে ওখানে পেত্নী থাকে। বিমান বলে আর আমার পাশে যেটা আছে সেটা কি শাঁকচুন্নী ... রিম্পা কপট রাগে বিমানের ফোলা গালগুলো দুহাতে ধরে টান মেরে বলে, এই গলুমলু তুমি একটা কচ্ছপ। হঠাৎ কি হয় বিমানের নিজেই বুঝে উঠতে পারেনা। আচমকাই বুকে টেনে নেয় রিম্পাকে। রিম্পা যেনো যন্ত্র চালিতের মতো মোহাচ্ছন্ন। কোন বাধা দেয়না। মাংসল বুকে বিমান যেনো মিশিয়ে নিতে চায় রিম্পাকে। ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। শরীরের উষ্ণতায় সংযমের পারদ গলতে শুরু করে ।
হঠাৎই নীচে বাইকের শব্দে ঘোর কাটে দুজনের। বিমান মাথা নীচু করে ছাদের একপাশে সরে যায়। রিম্পা শুধু বলে, নীচে যাচ্ছি, চলে এসো। তারপর কিছুটা গিয়ে ফিরে এসে বিমানের ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলে, কিছু ভাববে না ।
এ কি করলো বিমান? গ্রামের স্কুলে পড়া সদ্য ফোটা এক কিশোরী মেয়ে, তার সাথে । পাপবোধে মাটিতে মিশে যেতে থাকে বিমান।
না সে রাতে তার দেশী মুরগির ঝোল খাওয়া হয়নি । মাথা ধরার অজুহাতে রুমের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে নিয়েছিলো। গোটা রাত চোখের পাতা এক হয়নি বিমানের। ভোরবেলায় যখন কোলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখেছিলো ছাদের উপরে এক নিষ্পাপ পবিত্র মুখের অসহায় করুন দৃষ্টি।
কোলকাতায় ফিরে রিম্পার একটা চিঠি পেয়েছিলো সে। রিম্পা লিখেছিলো তার কৈশোরের প্রেমকে তার সব কিছু নিবেদন করতে সে রাজি। আগামীর স্বপ্ন দেখে তাকে নিয়ে। বিমান সে চিঠির উত্তর দেওয়া তো দূরের কথা, টুকরো টুকরো করে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিলো। কেননা তার পক্ষে এভাবে প্রেম করা সম্ভব ছিলো না। তার ভবিষ্যৎ পড়াশোনা সাংসারিক দায়িত্ব, অনেক চাপ ছিলো মাথার মধ্যে। তবে রিম্পার কাছে সে অপরাধী মনে করতো নিজেকে। হয়তো এই ক্ষনিকের ভুল, অপরাধ বোধ থেকেই সে এখনো বিয়ে করতে পারেনি কাউকেই, প্রেম তার জীবনে আর আসেনি।
এসব ভাবতে ভাবতেই আনমনা হয়ে পড়ে বিমান। কখন সে ডাক্তারবাবুদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, নিজেই জানে না।
সম্বিত ফিরে আসে স্কুটির হর্ন এর শব্দে। পেছনে তাকিয়ে দেখে হলুদ স্কুটিতে গোলাপি চুড়িদারের উপরে সাদা অ্যাপ্রন পরা একটি মেয়ে। হেলমেট খুলে সে বলে , আপনি কি কাউকে চাইছেন? বিমান আমতা আমতা করে বলে, না মানে ওই বাসে আসছিলাম, বাসটা খারাপ হলো ভাবলাম গ্রামটা ঘুরে দেখি। মেয়েটি বলে, হ্যাঁ ওই রাস্তা দিয়েই আমি এলাম, আমি তো এখানের প্রাইমারি হেল্থ সেন্টারে নার্সের জব করি। তা আপনি কি এই গ্রামে আগে এসেছেন? বিমান স্তম্ভিত হয়ে যায়, কি উত্তর দেবে। এরপর আশ্চর্য চমক, মেয়েটি হেলমেট খুলে বিমানের দিকে তাকিয়ে বলে, মিনি দাদা একটু ঘোলের সরবত খাবে? বিমান আঁতকে ওঠে, এ যে রিম্পা! রিম্পা বলে যাক বাবা শেষ অবধি সামনাসামনি দেখাটা হলোই। পালিয়ে বেড়াতে পারলে না।
এমন সময় এক বয়স্ক মহিলার কোলে একটি দু বছরের বাচ্চা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে আসে। রিম্পা স্কুটি দাঁড় করিয়ে বাচ্চাকে কোলে তুলে বিমানকে বলে এটি আমার ছেলে বল্টু। যা বিচ্ছু। ঘুড়ি ওড়াবে তার বায়না। পাশের গ্রামেই বিয়ে, কি করবো বলো, তুমি তো মগ্ন মৈনাক হয়ে গেলে। বিমান নিরুত্তর। তারপর বিমানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে এই বেটু ওই মামা টা না দারুণ ছবি আঁকে। তারপর বিমানের দিকে ঘুরে বলে তোমার সব খবর রাখি, আলাদা একটা ফেসবুক আইডিতে তোমার ফ্রেন্ড লিষ্ট এ আছি। বিমান বলে ডাক্তার বাবু অরুন দা এরা সব ভালো আছে তো ?
রিম্পা বলে সব গল্প কি বাইরেই করবে। ভেতরে এসো, তোমার আঁকা ছবিটা দেখো বিবর্ণ হয়ে গেছে, তবুও আছে। বিমান বলে না আসলে বাস ছাড়বে তো। পরে আসবো কোনো সময়। রিম্পা বলে আর সময় হবেনা তোমার, বাবা গতবছর হঠাৎই হার্ট আ্যটাকে মারা গেলেন। দাদা দিল্লিতে থাকে, বৌ বাচ্চা সব সেখানে। আমার হাজব্যান্ড প্রাইমারি স্কুল টীচার। আমি এখানে মায়ের কাছেই বেশী থাকি।
চলো না একটু চা খেয়ে যাবে। বিমান বলে আজ থাক রিম্পা। দশ বছরে একদিনের জন্য ও তোমাকে ভোলা যায়নি বলেই আমি আজো একা। চললাম, আবার দেখা হবে। ভালো থেকো রিম্পা।
রিম্পার চোখের কোণে জল চিকচিক করে,... বিমান কিছু দূর এগিয়ে হাত নাড়ে। রিম্পা বলে আমার ছেলের ভালো নাম ভালোবেসে রেখেছি বিমান। ডাকনাম বল্টু। কিছু না হোক লোক চক্ষুর সামনে ভালোবাসার নাম ধরে ডাকতে তো পারবো। বিমানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, ফিরতে হবে... তার চলার পথে ভালোবাসার মাইলস্টোনটা আজ বড্ড ফাঁকা। অবহেলায় যা হারিয়েছে অপরাধবোধে যে ভালোবাসার সলিলসমাধি ঘটিয়েছে সে... এভাবেই কত শত ভালোবাসার ফুল চোখের আড়ালে ঝরে যায় কে তার খবর করে। চারদিকে খবর করতে করতে সাংবাদিক বিমান নিজের খবর রাখতেই যে ভুলে গেছে। লাটাই বিহীন ঘুড়ির মতো জীবন। ঝাপসা চোখে দেখে আকাশের নিঃসীম শূন্যতায় দূরে কোথাও যেনো একটা ঘুড়ি উড়ছে।।
বাচিকশিল্পীর বাড়ি
দে বা শি স দ ণ্ড
শুদ্ধশীল যাবে বাচিকশিল্পী সুপর্ণা মজুমদারের বাড়ি। আমাকে সঙ্গে নিয়েছে। শুদ্ধ কবিতা বলে। বিশুদ্ধ উচ্চারণ। দাঁতনে কবিতার কর্মশালায় সুপর্ণাদির সঙ্গে ভাব হয়েছে। দিদি বলেছেন- নজরগঞ্জে গিয়ে যে কোনও কাউকে জিজ্ঞাসা করবে, বাচিকশিল্পী সুপর্ণা মজুমদারের বাড়ি কোনটা, দেখিয়ে দেবে। স্টেশনে নেমে টোটোওলাকে হুবহু তাই বলা হয়েছিল। টোটোওলা একটা স্কুলবাড়ির পাঁচিলের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে কেটে পড়েছে।
আমি কবিতা বলি না। লিখিও না। তবু শুদ্ধশীলের সঙ্গে কেন যে বন্ধুত্ব হল ভেবে পাই না। আমার রসের দোষ। র আর স-- দুটোই ভুল বলি। শুদ্ধশীল ক্যাঁক করে চেপে ধরে। উচ্চারণ শেখানোর চেষ্টা করে। আমার রস কেটে তাঁড়ি হয়ে যায়। ভয়ে মিনিট দশেক কথাই বলি না। তবু বন্ধুত্ব।
একটা লোক সিটি মারতে মারতে আসছিল। নিখুঁত সিটি মারছিল লোকটা। পল পল দিলকে পাশ...। কালচারাল মাইন্ডেড মনে হল। শুদ্ধশীল বলল- আচ্ছা দাদা, বাচিকশিল্পী সুপর্ণা মজুমদারের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?
: বাটিক? বাটিক প্রিন্টের বাড়ি এ লাইনে তো পাবেন না বদ্দা।
: বাটিক নয়, বাচিক।
শুদ্ধশীল আরেকটু স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে।
: অ বাটি? ধুর মশাই, বাটি কোথায় পাব? আমি কি ভিখিরি?
লোকটা রেগে সিটি মারতে মারতে চলে গেল-- পল পল দিলকে পাশ...।
খানিক দূরে একটা পানের দোকান পাওয়া গেল। দোকানদার পানপাতায় চুন লেপছিল। আমি বলতে গেলাম, আচ্ছা দাদা সুপন্নাদির...
আমার উচ্চারণে বোধহয় কোথাও ভুল ছিল। শুদ্ধশীল চিমটি কেটে থামিয়ে দিল। তারপর নিজেই শুরু করল- গুড ইভনিং। দোকানদার চুন লেপতে লেপতে বলল- হঁ হঁ।
: বলছিলাম বাচিকশিল্পী সুপর্ণা মজুমদারের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?দোকানদার পান হাতে করে খানিকক্ষণ উদাস হয়ে কি যেন ভাবল। রাস্তা দিয়ে একটা ছেলে আইসক্রিম চুষতে চুষতে যাচ্ছিল। তাকে বলল- অ্যাই পল্টা, বাচ্চুর মায়ের নামটা কী রে? সুপন্না? শুদ্ধশীল বলল- আহা, আমি বাচ্চু বলিনি। বাচিক বাচিক।
: বাচি? বাচি মানে কী? বাচ্চাকাচ্চা হবে নাকি?
শুদ্ধশীল বিড়বিড় করে- পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। এই বয়সে কি বাচ্চাকাচ্চা হয়!
দোকানদার এবার খেপে গেল- কী বলছেন পষ্টাপষ্টি বলেন না। ঠিক করে কথাবাত্রা বলতে জানেন না নাকি? আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বললাম- ভদ্রমহিলার নাম সুপর্ণা মজুমদার। উনি কবিতা বলেন। ঠিক আছে? ওনার কবিতার শেখানোর স্কুল আছে। ঠিক আছে? এবার সোজা কথায় বলুন, ওনাকে চেনেন কি চেনেন না।
: অ সুপন্নাদি? আমার সানুকে পইদ্য শিখায় তো। অই তো হইলদা বাড়িটা।
আচার্য্য চাটুজ্যে মশাই
অ নু কূ ল বি শ্বা স
ঢং ঢং করে ঘন্টা পড়ল। পিলপিল করে ছাত্র-ছাত্রীরা সারিবদ্ধ ভাবে স্কুল গেট দিয়ে বের হতে লাগলো। চাটুজ্যে মশাই স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি ফেরার এই চমৎকার দৃশ্য দেখতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শ'পাঁচেক ছাত্র-ছাত্রী বেরিয়ে গেল। এখন স্কুল বাড়িটা শুনশান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বরাবরই চাটুজ্যে মশাই এই রীতি মেনে চলেন। স্কুল ছুটি হলে যতক্ষণ না ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই স্কুল থেকে বের না হয় ততক্ষণ তিনি স্কুল গেট পেরোন না। তাঁর দীর্ঘ তিরিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একটি দিনও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সন্তানের ন্যায় মনে করেন। বরাবরই দুধ সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে তিনি স্কুলে আসেন। জ্ঞানী, সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে দশ গ্রামের মানুষ তাঁকে একবাক্যে চেনেন। ছাত্র দরদী শিক্ষক বলতে যা বোঝায় তিনি আসলে এমনই একজন শিক্ষক। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে তার সহকর্মী ও শিক্ষা কর্মীরা সকলেই তাঁকে সমীহ করেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষকতায় একনিষ্ঠতা সকলের শ্রদ্ধা আদায়ে তিনি সক্ষম হয়েছেন।
বিদ্যালয় থেকে চার কিমি দূরে পলাশডাঙ্গা গ্রামে তিনি বাস করেন। রোজ সাইকেলে যাতায়াত করেন। বঙ্গোপসাগরের পাড়ে তার এই বিদ্যালয়টি অবস্থিত। এলাকার অধিকাংশ মানুষ সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো কোনদিনই তেমনভাবে প্রবেশ করেনি। বলতে গেলে অধিকাংশ পরিবারই তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। সন্তান বাবা-মায়ের কাজে সাহায্য করবে সেটাই তাদের পরম্পরা।
চাটুজ্জে মশাই অর্থাৎ নীলকান্ত চ্যাটার্জী প্রথম যখন এই স্কুলে যোগদান করেন তিনি গ্রামের মানুষদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। এখনো যত ছাত্র-ছাত্রী এই স্কুলে আসে তারা প্রায় সবাই ই দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে আসে। অথচ স্থানীয়দের সেসব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। সারারাত সমুদ্রে মাছ ধরে সকালে বাজারে বা আড়তে বিক্রি করো এটাই এদের ধ্যান-জ্ঞান। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত। তবে গ্রামে পরিবারে মহিলাদের কর্তৃত্ব বিদ্যমান।
মাছের কারবার থেকে একশ্রেণির মানুষ প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। যারা সারারাত জেগে মাছ ধরে তারা পান যৎসামান্য। ফলে এলাকায় ধনী-দরিদ্রের বিস্তর ফারাক পরিলক্ষিত হয়। মূলতঃ মাছের আড়তদাররাই দিনকে দিন অর্থের ভান্ডারে ফুলেফেঁপে উঠছেন। প্রকৃত জেলেরা প্রতিনিয়ত শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন। আড়তদাররা মাছের ওজন ও দাম- দুটোতেই জেলেদের ঠকাচ্ছেন। জোর করে স্থানীয় আড়তদারদের কাছে মাছ বিক্রি করতে তাদের বাধ্য করছেন। এসব কাজে প্রত্যেক আড়তদার একদল পেশিশক্তি পুষে রেখেছেন। তাদের দৈনন্দিন কাজ হল জেলেদের ভয় ও হুমকি দেখিয়ে তাদের আড়তে কম দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য করা। অথচ অন্যত্র বিক্রি করলে এর থেকে দ্বিগুণ দাম পান তাঁরা। এইভাবে গরিব খেটে খাওয়া মানুষগুলো প্রতিদিন বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। তাদের এই বঞ্চনা দেখেশুনে চাটুজ্যে মশাইয়ের খুব কষ্ট হয়। ইচ্ছে থাকলেও তাদের জন্য তিনি কিছু করতে পারেন না।
চাটুজ্যে মশাই নিজের বাড়িতে কিছু টিউশন পড়ান। সেখান থেকে প্রতিমাসে যে অর্থ আসে তা দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার জন্য ব্যয় করেন। তিনি নিজের গ্রামে একটি সান্ধ্যকালীন অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলেছেন। তিনি ছাড়া আরো দুজন শিক্ষক সেখানে পড়ান। তারা দু'জনই চাটুজ্যে মশাইয়ের ছাত্র। তাদের তিনি যৎসামান্য মাইনে দিতে পারেন। তারা অবশ্য তাতেই খুশি। প্রিয় স্যারের সঙ্গে পড়ানোর কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে পেরেছেন সেটাই তারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেন। সেই বিদ্যালয় প্রায় এক'শ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। তাদের পোশাক, বই-খাতা ও অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রীর খরচ সবই তিনি বহন করেন। গ্রামের গরিব খেটে-খাওয়া অতি সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়ে এরা। তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করছে সেটাই তাদের কাছে ভীষণ খুশির খবর। চাটুজ্যে মশাইয়ের মন তো তাদের জন্য অনেক কিছু করতে চায় কিন্তু অর্থের অভাবে পেরে ওঠেন না। তিনি লক্ষ্য করেছেন সন্ধ্যায় অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে খালি পেটে পড়তে আসে। তাদের শুকনো মুখগুলো দেখে তাঁর খুব মায়া হয়, কষ্ট হয়। তিনি মনে করেন পড়াশুনার চেয়ে খাদ্য এদের অনেক বেশি জরুরী। কিন্তু তিনি কী করবেন? তাঁর ক্ষমতা যে সীমিত। তবুও তাঁর স্নেহ পাগল মন ও আন্তরিকতায় যতটুকু সম্ভব করার চেষ্টা করেন।
একদিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছেন তিনি। বাড়ির দরজায় পৌঁছাতে দেখেন একজন মহিলা একটি শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মহিলা ও শিশুকে তিনি আগে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। শিশুটির বয়স খুব বেশি হলে দশ থেকে এগারো বছর হবে। তিনি যখন গেট দিয়ে বাড়ি ঢুকতে যাবেন এমন সময় ওই মহিলা বলে উঠলেন "এই যে শুনুন, এটা কি নীলকান্ত চ্যাটার্জির বাড়ি"?
"হ্যাঁ, আমিই নীলকান্ত চ্যাটার্জী। কিছু বলবেন"?
"বলবো বলেই তো দাঁড়িয়ে আছি। এটা আমার ছোট ছেলে। একে আপনাকে পড়াতে হবে। যত টাকা লাগে দেবো"।
"দেখুন আমার সময় নেই।ওকে আমি পড়াতে পারবো না"।
"ছাড়ুন তো সময়-টময়ের গল্প। মাসে দশ হাজার টাকা দেবো। কবে থেকে আসবে বলুন"?
অনেকটা ধমকের সুরেই মহিলা কথাগুলো শেষ করলেন। চাটুজ্যে মশাই বুঝতে পারলেন এই মহিলা নাছোড়বান্দা। তাছাড়া টাকার অংকটাও খারাপ নয়। তাই আর কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেলেন।
আগামীকাল সকালে আসতে বলে ঘরে ঢুকতে যাবেন এমন সময় মহিলা বলে উঠলেন "শোনো মাস্টার, আমার একটা শর্ত আছে। ছেলেকে কিন্তু পাশ করাতে হবে"।
মহিলা যে সুরে কথা বললেন চাটুজ্যে মশাইয়ের সেটা একদম পছন্দ নয়। মনে মনে তাঁর খুব রাগ হচ্ছিল। কিন্তু দশ হাজার টাকাটা যে তাঁর খুব দরকার, তাই তিনি রাগ সম্বরণ করে বললেন "ঠিক আছে দেখছি"।
পরের দিন সকালে ঝাঁ-চকচকে এক গাড়িতে চড়ে ছেলেটি পড়তে এলো। গাড়িতে তার সঙ্গে আরো দুই তিন জন গাট্টাগোট্টা ষন্ডামার্কা ছেলে ছিল। ছেলেটির সঙ্গে তারা কেন এলো চাটুজ্যে মশাইয়ের মাথায় সেটা ঢুকলো না। তিনি প্রতিদিন খেয়াল করে দেখেছেন ওই ছেলেগুলো তার সঙ্গেই আসে। তবে এ ব্যাপারে তিনি আর মাথা ঘামালেন না। ছাত্রটির নাম পিন্টু সর্দার।
দিন পনেরো পড়ানোর পর তিনি বুঝতে পারলেন এই ছেলেকে পাস করানো খুবই মুশকিল। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পর্যন্ত ঠিকমত লিখতে ও পড়তে পারে না, এমন ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। তবুও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলেন। বাড়িতে কোন কাজ দিলে করে আনে না, কেন করে আনে না তার কোনো সদুত্তর নেই। চাটুজ্যে মশাই জীবনে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়লেন। তিনি সারা জীবন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বহু কাজ করেছেন তাই চ্যালেঞ্জে ভয় পাওয়ার মানুষ তিনি নন। তবুও কেন যেন তাঁর মনে হচ্ছে এই ছেলেকে দিয়ে কিছু করানো খুব মুশকিল।
বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন যে এখান থেকে পাওয়া দশ হাজার টাকা এখন তিনি অতিরিক্ত আয় করছেন। তাই সেই টাকা দিয়ে তাঁর স্বপ্নের সান্ধ্যকালীন স্কুলের ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। প্রতিদিন বিভিন্ন রকম টিফিন খাওয়ানো হবে। মাসের শেষে টাকা বাঁচলে সব শিশুদের একদিন বসে পেটভরে খাওয়ানো হবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। পরের মাসের এক তারিখ থেকেই শিশুদের টিফিন খাওয়ানো শুরু হলো। তার এই টিফিনের খবর খুব দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তাই ক্রমে স্কুলের ছেলে মেয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। সেটা চাটুজ্যে মশাইয়ের যেমন খুশির খবর ছিল, তেমনি মাথাব্যথার কারণও হয়ে উঠেছিল। ফলে তাদের প্রতিদিনের টিফিনের ব্যবস্থা করতে তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাটুজ্যে মশাইয়ের মতন সজ্জন ও পন্ডিত ব্যক্তিদের অর্থের অভাব হওয়ার কথা নয়।কিন্তু তিনি তিনি তো যার তার কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারেন না।
এদিকে তিনি বখাটে পিন্টুর পড়াশোনায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি তেমন লক্ষ্য করতে পারছেন না। এই বয়সেই বিভিন্ন রকম অসামাজিক, অসভ্য ভাষা প্রয়োগ করতে শিখেছে। সেগুলি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাটুজ্যে মশাইয়ের মাথার ঘাম পায়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মাঝে মাঝেই বিচ্ছিরি ধরনের ভাষা প্রয়োগ করছে ছেলেটি। "কোথায় শিখেছিস"- জিজ্ঞেস করলে সে বলে "কেন, বাড়িতে মোরা এই ভাষাতেই কথা কই"। চাটুজ্যে মশাইয়ের বুঝতে অসুবিধা হলো না আসলে গোড়ায় গলদ।
যত দিন যেতে লাগল চাটুজ্যে মশাইয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ তত ঘন হতে লাগলো। একে মানুষ করার সাধ্য বুঝি তাঁর নেই। তবুও যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলেন। বছরের শেষে বার্ষিক পরীক্ষায় তবুও শেষ রক্ষা হল না। সবগুলো বিষয়ে পিন্টু ফেল করলো। স্কুলে বসেই তিনি খবরটা পেলেন। স্বাভাবিকভাবেই চাটুজ্যে মশাইয়ের মনটা খারাপ হলো। মন খারাপ নিয়ে বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন একদল লোক তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের হাতে কোন না কোন অস্ত্র রয়েছে। কারো হাতে শাবল তো কারো হাতে চাকু, কারো হাতে ছুরি তো কারো হাতে হাসুয়া, কারো হাতে কুড়ুল তো কারো হাতে পিস্তল। সামনে থেকে সেই মহিলা পুরো টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে চাটুজ্যেমশাইয়ের অসুবিধা হলো না। তাই মনে মনে তিনি নিজেকে একটু সাবধান করলেন। বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছানো মাত্রই সামনে দাঁড়ানো সেই মহিলা চিৎকার করে বলে উঠলো "এই মাস্টার দাঁড়াও। আজ তোমার সঙ্গে আমার কিছু হিসেব নিকেশ আছে। আমার ছেলে ফেল করল কেন"?
চাটুজ্যে মশাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং ধীর স্থির গলায় বললেন "দেখুন আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনার ছেলের মাথায় কিছু নেই, তাই ওর পক্ষে পাস করা সম্ভব হয়নি"।
"আমি অতশত বুঝিনা। তোমায় ভরসা করে ছেলেকে দিয়েছিলাম, তুমি ভরসা ভেঙেছো। আমি তোমায় ছাড়বোনা"।
তিনি কোন কথা না বলেই ভাবলেশহীন ভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর এমন ভাবলেশহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা দেখে মহিলাটি আরো ক্ষেপে গেলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন "আমি প্রীতিলতা সর্দার। এই এলাকায় আমার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়।তুমি মাস্টার আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করছো।আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম যে আমার ছেলে যেন পাশ করে। তুমি কথাও দিয়েছিলে। তাহলে আমার ছেলে ফেল করল কেন"?
মহিলার অসভ্য ভাষা ও ঔদ্ধত্য দেখে চাটুজ্যে মশাই বিস্মিত হলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলার এতোটুকু ইচ্ছে বা মানসিকতা কোনোটাই তাঁর নেই।
প্রীতিলতা রাগে, ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলেন। তিনি ডজন দুয়েক পেশিশক্তি সঙ্গে নিয়েই এসেছেন। এদের সকলের চিৎকার চেঁচামেচিতে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে জড়ো হতে লাগলেন। ওদিকে চাটুজ্যে মশাইয়ের ছাত্রছাত্রীরা গ্রামে ছুটে গিয়ে খবর প্রচার করে দিল যে মাছের সবচেয়ে বড় আড়তদার প্রীতিলতা সর্দার মাষ্টার মশাইয়ের ওপর হামলা করেছেন। পিলপিল করে এলাকার মানুষ ছুটে আসতে লাগল। প্রীতিলতার লোকজন সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না। প্রীতিলতা হুংকার দিয়ে বললেন "সারাবছর তোমায় যত টাকা বেতন দিয়েছি সুদে আসলে তা দু'লক্ষ টাকা হয়েছে।আমার দু লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দাও, নইলে আমার লোকজন তোমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে"।
"আমার পক্ষে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়"।
"এই ভ্যাবলা, ক্যাবলা, পিলু, ডালু মাস্টারের বাড়ি জ্বালিয়ে দে"।
প্রীতিলতার আহবানে সাড়া দিয়ে তার লোকজন দলবেঁধে চাটুজ্যে মশাইয়ের বাড়ির দিকে এগোতে লাগলো। ভয়ে তাঁর হাত পা কাঁপতে লাগলো। তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
গ্রামবাসীরা দূর থেকে এসব দৃশ্য দেখছিলো। এবার আর তারা চুপ থাকতে পারলো না। তৎক্ষণাৎ লাঠি, বাঁশ, কোদাল, হাতা, খুন্তি... যার হাতে যা ছিল নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলে একসাথে প্রীতিলতার গুন্ডা বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাজার হাজার গ্রামবাসীর এলোপাথাড়ি আক্রমণে তারা ভয় পেয়ে গেল। তারা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই এমন তীব্র হামলা হলো যে, তারা প্রতি আক্রমণের সুযোগই পেল না। যে যার মত প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে গেলো প্রীতিলতা। গ্রামের পুরুষেরা ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে পড়লো। মাঝে প্রীতিলতা। গ্রামের মহিলা বাহিনী যথেষ্ট ভাবে তাঁকে পেটালো। বহু দিনের জমানো ক্ষোভ একে একে উগরে দিলো। কেউ বলছে মাছের দাম ইচ্ছে করে কম দিতিস, কেউ বলছে মাছ ওজনে ঠকাতিস, কেউ বলছে গুন্ডা দিয়ে প্রতিদিন ভয় দেখাতিস। দ্যাখ্ কেমন লাগে! আজ তোঁকে কে বাঁচাবে"? শোষিত মানুষগুলি আজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। আজ যেন তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সিদ্ধহস্ত। যেদিন লাঞ্ছিত সাধারণ মানুষ শোষকের উপর চড়াও হয়, সেদিন শোষক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জয় হয় সাধারণ মানুষের।ক্ষমতার দম্ভের পাহাড় সেদিন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। কোন প্রতিরোধই তখন তাদের পক্ষে কাজ করে না। তাইতো আজ প্রীতিলতা সর্দারের মত অসৎ, প্রবঞ্চক ও ক্ষমতালোভী মানুষদের রাস্তায় পড়ে পড়ে এই ভাবে মার খেতে হয়। সেদিন তাদের রক্ষা করার কেউ থাকেনা। স্বয়ং ঈশ্বরও সেদিন মুখ ফিরিয়ে নেন। সেদিন পাপীর উপযুক্ত শাস্তি হয়।
এতসব হট্টগোলের মধ্যে চাটুজ্জে মশাইয়ের জ্ঞান ফিরলো। চারিদিকে এত মানুষ কেন? চোখ খুলে দেখেন হাজার হাজার গ্রামবাসী তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ চাটুজ্যে মশাইয়ের জন্য ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে। এর মধ্যে কয়েকজন গ্রামবাসী প্রীতিলতাকে টানতে টানতে তাঁর কাছে নিয়ে এলো। "এই নিন, শয়তানিকে ধরে এনেছি। আপনি এর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিন।আমরা আপনার আদেশের অপেক্ষা করে আছি।
ততক্ষণে তিনি পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছেন। এত গ্রামবাসী তাকে বাঁচানোর জন্য ছুটে এসেছে।
"না, না। ওকে ছেড়ে দাও" -বিনয়ের সঙ্গে চাটুজ্জে মশাই বললেন। রাগে, ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা গ্রামবাসী তাকে ছাড়তে রাজি নয়। "দেখো, ক্ষমা মানুষের সর্বোত্তম গুণ। এর চেয়ে মহান কাজ ত্রিভুবনে নেই। ওকে শোধরানোর একটা সুযোগ দাও। ও তোমাদের মতই একজন মানুষ। অর্থের লোভে, ক্ষমতার অহংকারে ও সাময়িক অমানুষ হয়েছে"।
অনুরোধের সুরে চাটুজ্যে মশাই কথাগুলি বললেন। চাটুজ্যে মশাইয়ের এমন ক্ষমাসুলভ মানসিকতা বুঝে প্রীতিলতা ছুটে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন "আমাকে তুমি বাঁচাও"। চাটুজ্যে মশাই বললেন "আমি ক্ষমা করার কেউ নই। গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চাও। ওরা যদি তোমাকে ক্ষমা করেন আমার কিছু বলার নেই"। এরপর প্রীতিলতা উঠে দাঁড়ালেন। সকলের সামনে হাতজোড় করে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেন। গ্রামবাসীরা চাটুজ্যে মশাইয়ের মনের ইচ্ছে বুঝতে পেরে আস্তে আস্তে নিজেদের রাগ সংবরণ করলেন। ততক্ষণে স্থানীয় থানার পুলিশ এসে পৌঁছে গেছে। তারা প্রীতিলতাকে থানায় নিয়ে গেলেন।
ধীরে ধীরে চাটুজ্যে মশাই উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে বাঁচানোর জন্য এত মানুষের সমাগমে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না । কিছুক্ষণ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষন করলেন। তারপর গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন "আপনাদের এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না। আপনাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো করবো না। শুধু একটি কথা বলব ঠিক আজকের মত আপনারা একসঙ্গে লড়াই করে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিন। সকলে একসঙ্গে লড়াই করলে কোন কাজই অসম্ভব নয়। সেটা আপনারা আজ নিশ্চয় বুঝতে পারলেন। মনে রাখবেন সত্যের জয় অনিবার্য। সকলে একসঙ্গে গর্জে উঠলো- "ন্যায় প্রতিষ্ঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা"।
বংশধারা
গৌ রা ঙ্গ সু ন্দ র পা ত্র
এখন যখন তখন লাঠি নিয়ে ছেলের বউয়ের দিকে তেড়ে আসে দীননাথ। বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে। কথায় কথায় বউমার কাজের খুঁত ধরে। একমাত্র ছেলে অনুপম এম.এসসি.পাশ করার পরে ব্যাঙ্কে চাকরি করছে। বয়স যখন ১৪ বছর তখনই মাকে হারিয়ে বাবার স্নেহ ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছে সে। স্ত্রীর প্রতি বাবার দুর্ব্যবহার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও অনুপম কিছু না বলে চুপ করে থাকে। সেদিন ছেলেকে কাছে পেয়ে দীননাথ বলল, "তোর বউয়ের যা চ্যাটাং চ্যাটাং কথা এ বাড়িতে আমি আর থাকতে পারবো না। তুই বউয়ের পায়ের দাস হয়ে থাকতে পারিস আমি নই। তোর মায়ের গায়ে আমি হাত তুলতাম ঠিকই কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না। তুইও বউকে শাসন করবি, দরকার পড়লে গালে চড় মারবি।"
ছোটতেই অনুপম দেখেছে দাদুকে গলাধাক্কা দিয়ে তার বাবা পথে বের করে দিচ্ছে।চশমাটা ভেঙ্গে গিয়েছিল আর চশমা কিনে দেয়নি।বাবাকে বাধা দেওয়ার মতো সাহস তার মায়ের ছিল না।কারণ মাকেও সে মারধর করত। তখন কতই আর বয়স অনুপমের! বড় জোর ১০ বছর। আজ সেই বাবা স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার শিক্ষা দিচ্ছে। সে অনুভব করল বংশধারার একটা বিষধর সাপ তার মেরুদণ্ড বেয়ে ওঠা নামা করছে। সেও কি বাবা দাদুর মতোই শেষ বয়সে বাবার গায়ে হাত তুলবে? পাঁচ বছরের ছেলে সুমনের মুখের দিকে চেয়ে তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। সে বইয়ে অনেক নীতি উপদেশ পড়লেও তার রক্তকণিকাগুলি সে বিষয়ে অজ্ঞাত।
সেদিন বাজার থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল।তাড়াতাড়ি স্নান করে খেয়ে অফিস যাবার তাড়া ছিল।ঘরে ঢুকতেই সে দেখল তার বাবা মোনালিকে লাঠি দিয়ে মারছে আর তার স্ত্রী লাঠিটা ছাড়িয়ে নেবার জন্য টানাটানি করছে। ছুটে এসে অনুপম বাবার হাত থেকে লাঠিটা ছাড়িয়ে ছুঁড়ে দিল।দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সে মোনালিকে দু কথা শুনিয়ে দেবার পরে বাবার দিকে হাত ওঠাতেই দেখল তার ছেলে সুমন ছোট্ট দুটি হাত নিয়ে তাকে মারছে। রাগ সংবরণ করে হাতটা নামিয়ে নিলো সে। ছেলের মুখের দিকে চেয়ে অনুপম ভাবল কখনো সে বাবা বা স্ত্রীকে মারধর করবে না।
কিছুক্ষণ পরে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হতেই সে মোনালিকে বলল বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার জন্য আমি সব বন্দোবস্ত প্রায় করে ফেলেছি। তোমাদের দুজনের ঝগড়া আর আমি সহ্য করতে পারবো না। ঘরতো নয় যেন একটা নরক। এ ঘরে শান্তি চাই। বাবা থাকলে সেটা সম্ভব নয়। বিস্ফারিত চোখে মোনালি বলল, "সে কি! বাবা না হয় বুড়ো হয়েছেন রাগের মাথায় লাঠি নিয়ে মারতে আসেন তাই বলে আমরা তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবো এ কখনো হতে পারে না। যত অশান্তি হোক উনি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।তুমি ভেবে দেখো আমাদের সুমন এই বংশধারা থেকে কী শিখবে?" স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরল অনুপম। তার কপালে কপোলে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিয়ে বলল, "না গো, আমি তোমাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম তুমি কি চাও।বুঝলাম তুমি সত্যি আমার গৃহলক্ষ্মী।" এ কথা বলেই নিজের শোবার ঘরে ছুটে গেল অনুপম। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। ভিজে গেল বালিশ। দীর্ঘদিনের বংশধারার তীব্র বিষ আজ অশ্রুর রূপ নিয়ে সমাপ্ত হলো। সে যে কত বেশি আনন্দের- কাউকে তা বোঝানোর নয়।
সন্ধানী
সু নৃ তা রা য় চৌ ধু রী
আজ স্পষ্ট সঙ্কেতটা শুনতে পেলেন অধ্যাপক মৃণালবাবু। ছোটবেলা থেকেই ওনার মাথার মধ্যে কি একটা বাজতো, অনেকটা ঝিঁঝিঁপোকার মতো। স্যারের বকুনি খেলে, বা ফুটবল, ঘুড়ির লড়াইয়ে হেরে মনখারাপের রাতে বেশি তীব্র হতো আওয়াজ। সেই সব রাতে কোন কচিবেলায় হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা মনে পড়তো। তার পর তো কতগুলি বছর লেখাপড়া, গবেষণা, চাকরি ইত্যাদি নানা ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেছে। সাফল্যময় জীবনে সেই ঝিঁঝিঁর ডাকের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু আবার মনে করিয়ে দিলো বিশেষ কিছু ঘটনা।
বিয়ের পর অনেকগুলি বছর কেটে গেলেও সন্তানাদি না হওয়ায় স্ত্রী সুলেখার আচরণ কেমন বদলে গেল। উদ্বেগ এবং অকারণ সন্দেহ নিয়ে মন্দির,ঠাকুরঘর,সাধু-গুণীন,তিথিনক্ষত্র, ধোয়ামোছা, এঁটোকাঁটা বিচার করে করে নিজেকে একটা আবরণে ঢেকে নিলেন যেখানে মৃণালের কোনো জায়গা নেই। না, একদিনে হয়নি, প্রথম দিকে ডাক্তার দেখিয়েছেন বিস্তর। অনেক চিকিৎসা, ফল হয়নি কিছুই। শেষ পর্যন্ত সুলেখার একাকিত্ব কাটানোর জন্য দত্তক নেবার কথাও বলেছিলেন। সুলেখা রাজি হননি। রসায়নের অধ্যাপক মৃণাল বাবু জীবনের এই সমীকরণটি কিছুতেই মেলাতে পারলেন না। অম্লমিতি ক্ষারমিতি, জারণ, বিজারণ, কোনো কিছুর মধ্যেই এ হিসাব মেলে না। তাঁর মাথায় সেই বাল্যকালের ঝিঁঝিঁপোকা ফিরে এসেছে। আজকাল তাঁর মনে হয়, এটা কি কোনো মহাজাগতিক সঙ্কেত? কোনো ভিনগ্রহ থেকে তাঁকে কি কেউ ডাকছে? সারাদিন অধ্যাপনা, নিজের পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকলেও রাতে বাড়ি ফিরলেই দেখেন ঘরসংসার এলোমেলো, রান্নার লোক, কাজের মেয়ে যেমনতেমন করে রেখে গেছে, সুলেখা জল ঘাঁটছেন, বকবক করছেন নিজের মনে। মৃণালবাবু রাতের খাবার নিজে নিয়ে খেয়ে দরজা বন্ধ করেন। মাথায় অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক জয়ন্তকে একদিন বলেই ফেললেন, "ভাই! তুমি বলতে পারো মহাজাগতিক কোনো সঙ্কেত পৃথিবীর মানুষ শুনতে পায় কিনা?" জয়ন্ত বললেন, "শুনতে পায় কিনা জানিনা, তবে রাডারে ভিন গ্রহের কিছু সঙ্কেত ধরা পড়ার কথা শুনেছি। কেন? কি হয়েছে?"
"আমি জানো, একটা ঝিঁঝিঁ আওয়াজ শুনতে পাই। বাইরে কোথাও না, আমার মাথার থেকে আওয়াজটা আসে। আমার মনে হয় এটা কোনো ভিনগ্রহের ডাক।"
জয়ন্ত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, "মৃণালদা', বৌদি, আপনি দুজনেই একজন মনোবিদের কাছে দেখান। একটা দুটো কাউন্সেলিং, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।"
কিন্তু সেকথা একটু ঠারেঠোরে সুলেখাকে বলতেই তিনি ভয়ঙ্করী হয়ে উঠলেন। ঠাকুরসেবা করেন বলে তাঁকে পাগল ভাবা? পাগলের ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ে তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত? হাতের সামনে যা পেলেন, ছুঁড়ে মারতে লাগলেন। একটা পিতলের ফুলদানি মৃণালের মাথায় এসে লাগলো। কাঁচের বাটির ঘায়ে হাতমুখ কেটে গেল। কিছুক্ষণ তাণ্ডবের পরে সুলেখা অচেতন হয়ে পড়লেন। মৃণাল বাবু তড়িঘড়ি জ্ঞানহীন সুলেখাকে যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে শুশ্রূষা করে জ্ঞান ফিরিয়ে গরম দুধ, ওষুধ খাওয়ালেন। সুলেখা ঘুমোলে মৃণালের মনে হলো ঝিঁঝিঁর ডাক তীব্রতর হয়ে উঠেছে।
আর পারলেন না। আজই দেখতে হবে, মহাবিশ্ব থেকে কে ডাকছে তাঁকে। গভীর রাতে আহত, ক্ষতবিক্ষত, অভুক্ত প্রৌঢ় চললেন সেই সত্য উদঘাটনে।
সবে মাত্র গল্প গুলো পড়ব বলে বসে অমিতাভ গল্পটি পড়লাম। এই মুহূর্তে অন্য গল্প আর পড়া গেল না। রেশ রয়ে যাবে। বেশ কিছুটা সময় অধিগ্রহণ করলো এ গল্প।
উত্তরমুছুন