গল্প

 
প্রথমা

পা ভে ল ঘো ষ

উত্তরের হিমেল হাওয়া বইছে সকাল থেকে সিরসির করে। সোয়েটার ভেদ করে একদম হাড়ে আঘাত করছে, সেটা ভালোই টের পাচ্ছে সুরেশ। সন্ধ্যে থেকেই কুয়াশার ঘনঘটা। স্ট্রিট লাইটটা ঝাপসা দেখাচ্ছে।

বিবেকানন্দের মতো হাতদুটো গুটিয়ে পুরোনো একটা হিন্দি গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে ও।মাঝে মাঝে হাত দুটো ঘষে নিচ্ছে।এতে বেশ আরামই লাগছে সুরেশের। অফিস থেকে ফিরতে আজ দেরিই হয়েছে ওর।মোবাইলে ঘড়িটা দেখে নেয় সুরেশ। রাত "ন'টা দশ"। রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে।
অমর মিত্র লেন ধরে শেষ প্রান্তে জামাইয়ের চায়ের দোকান। তারপরেই সিমেন্ট বাঁধানো সরু গলিটা। গলির শেষ প্রান্তে ছাতিম গাছটার সামনের বাড়িটাই ওর।
বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে কলিং বেলটা বাজায় সুরেশ।কোনো সাড়া নেই। হয়তো কানে ইয়ারফোন গুঁজে ইউটিউবে কোনো রান্নার রেসিপি দেখছে সীমা। সীমা সুরেশের 'দ্বিতীয় পক্ষ'। 

সে অনেক কাহিনী।একটা কালো কুৎসিত মেয়ের সঙ্গে বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন সুরেশের। ওনার বন্ধু কন্যা। সুরেশ তখন সবে ব্যাংকে ক্লার্কের চাকরিটা পেয়েছে। অল্প বয়স। একটা আবেগ কাজ করতো সবসময়। "রূপ নয় গুণই আসল, পরে বুঝবি। সোমা কালো হতে পারে, কিন্তু তোর যত্নআত্তির কোনো অভাব হবে না। দেখে নিস।..."বাবার কথা সেদিন ফেলতে পারে নি সুরেশ। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে বন্ধুদের টিপ্পনি, আত্মীয়দের বাঁকা কথার সামনে আত্মসমর্পণ করে বসে ও। 
সোমার সঙ্গে দূরত্বটা কয়েক মাসের মধ্যে হয়ে যায় কয়েক যোজন। বছর দুয়েকের মধ্যে সব শেষ। সেই দিনটার কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় সুরেশের। নিজের হাতে সোহাগ করে মিষ্টির সঙ্গে বাবার হাই ডোজের প্রেসারের ওষুধটা খাইয়ে দিয়েছিল সুরেশ।সঙ্গে ঘুমের ওষুধ। নিভৃতে, অজান্তে ঘুমের দেশে নিশ্চিন্তে পাড়ি দিয়েছিল সোমা। পরের দিন ভিতরে আনন্দের বন্যাকে কান্নার বাঁধ দিয়ে আটকেছিলো ও। একবছরও যায় নি। ফর্সা,টুকটুকে বউ এনেছিল সুরেশ। সীমাকে দেখে আত্মীয়-বন্ধুদের চওড়া হাসি দেখে বড় তৃপ্তি পেয়েছিল ও।
হঠাৎ সরু মিনমিনে কণ্ঠে  ও শুনতে পায় গীতা দত্তের সেই বিখ্যাত গান, "কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার...."
চমকে ওঠে সুরেশ। বড় চেনা চেনা কণ্ঠ..! খালি গলায় সোমা গান ধরেছে? না, না, এটা কি করে সম্ভব? আস্তে আস্তে সদর দরজাটা খোলে ও। সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন পেরিয়ে দেখে, ঘরের মূল দরজাটা হাট করে খোলা। টেনশনে ওর কপালে এই ঠান্ডায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে থাকে সুরেশ।
বেডরুমের অর্ধেক খোলা দরজার পাশে থেকে খুব সন্তর্পনে উঁকি দেয় ও। দেখেই চমকে ওঠে সুরেশ। এ কি...! ও তো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না..! চোখ বন্ধ করে সীমা গান গেয়ে চলেছে..! কিন্তু কণ্ঠ তো অবিকল সোমার। এই গানটা সুরেশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে প্রায়ই গাইতো সোমা। সীমার সামনে পাতা হারমোনিয়ামটা দেখে আরো অবাক হয় ও। এত সাবলীলভাবে ও হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে...! কিন্তু ও তো জানে... সীমা জীবনে গানই শেখে নি। তাহলে কি....? গায়ে কাঁটা দেয় ওর। 

হঠাৎ সীমা প্রায় একশো আশি ডিগ্রি ঘাড়টা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। সীমার চোখের দিকে নজর চলে যায় সুরেশের।অবিকল সোমার চোখ। সেই ধূসর বাদামী রঙের মনি। তবে চাহনির মধ্যে স্নিগ্ধতার পরিবর্তে প্রতিহিংসা যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে।
"সোমা..."  মুখ থেকে সুরেশের অস্ফুট স্বর বেরিয়ে আসে অজান্তে, অনিচ্ছায়। হঠাৎ ঘরের আলো চলে যায় কাকতালীয়ভাবে। গলায় একটা তীব্র চাপ অনুভব করছে সুরেশ।দুটো অদৃশ্য হাত গলায় চেপে বসছে ওর। বুঝতে পারছে দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। শেষ মুহূর্তে বাঁচার একটা তীব্র তাগিদ অনুভব করছে ও। গাঢ় অন্ধকারের দেশে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে সুরেশ; যেখান থেকে ফেরার রাস্তা চিরদিনের মতো বন্ধ।

কান্না ভেজা কণ্ঠে গানটা তখনও ধীরে ধীরে  ভেসে আসছে সুরেশের কানে, "কানে কানে শুধু একবার বলো...!" শেষবারের মতো একটা ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে এলো সুরেশের গলা থেকে,"বাঁচ....!" শেষ শব্দ, শেষ বার..! একটা অস্ফুট নিষ্ঠুর হাসি কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে। নিঃশব্দে মৃত্যু প্রবেশ করে। এই নিয়ে ওই ঘরে দ্বিতীয়বার...!







মাতৃত্ব

পা প ড়ি  রা য়

বিরাট একটা সফল অপরেশন করে আজ নামকরা ডাক্তার "পৃথ্বিরাজ"। হ্যাঁ, এই নামেই 
তিনি পরিচিত। পৃথার সন্তান পৃথ্বিরাজ। মায়ের সেই ছোট্ট বাবিন মার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। মামনিই তার মা, তার বাবা, চোখে জলের ধারা নামছে পৃথার। সুদূর অতীতে চলে যায় তার স্মৃতি।

সন্দীপের সাথে বিয়ে হয়েছে দশ বছর হতে চলল। এখনো মা ডাক শুনলো না পৃথা। এতগুলো বছর ধরে প্রতি মাসে অপেক্ষা করে যাচ্ছে, একটু মা ডাকের আশায়। আশাহত প্রতিবার। 

বিয়ের একবছর পর থেকেই নানা গঞ্জনা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, বাঁজা বলে উপহাস--- কি না শুনতে হয়নি পৃথাকে। 

ননদের সাধের দিনে খুব ইচ্ছে ছিল একটু পায়েস রান্না করে খাওয়ায় তার প্রিয় অনুকে। ওই তো একমাত্র বন্ধু ছিল তার এই বান্ধবহীন সংসারে। কিন্তু পারলো কি? 

"না না ওই বাঁজা মেয়েমানুষ আমার মেয়ের সাধের পায়েস রান্না করবে না। ওর হাতের পায়েস খেলে আমার অনুর সন্তানের অকল্যাণ হবে।" এই ছিল শাশুড়ি মায়ের বিধান।ঘরে দরজা বন্ধ করে হাপুস নয়নে কেঁদেছে পৃথা। কি তার দোষ? ডাক্তারের রিপোর্টে তার তো কোন দোষ পাওয়া যায়নি, তবে?
রাশভারি ব্যরিষ্টার সন্দীপকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি পৃথা সন্দীপেরও পরীক্ষার প্রয়োজন আছে। পরীক্ষা করতে পৌরুষে লেগেছিল প্রতাপশালী ভট্টাচার্য্য বংশের একমাত্র ছেলের। কোন দোষে দোষী না হয়েও সকলের অবহেলার পাত্রী আর হতে পারছিল না পৃথা। একটু মা ডাকই তো শুনতে চেয়েছিল সে, এত নিষ্ঠুর কেন ভগবান, কেন এমনভাবে আশাহত হয় প্রতিবার?

আজকাল সন্দীপ তাকিয়েও দেখেনা পৃথাকে, কেমন ছাড়া ভাব, কষ্ট হয় পৃথার। সত্যি তো একটা ছোট শিশু আধো আধো বুলিতে কথা বলবে, টলমল পায়ে হাঁটবে, তবেই না পূর্ণতা আসে সংসারে। নিজের উপর বিশ্বাস যেন আর রাখতে পারে না, কেন এমন হয় কিছুতেই বোঝেনা, ভালোবাসার অভাব, তাই এমন?পারছে না আর পৃথা, কিছু একটা করতেই হবে।

মনে মনে ভাবে পৃথা শুধু কি জন্ম দিয়েই মা হওয়া যায়, ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুললে সে কি মা হয়না? নিজের ইচ্ছার কথা সন্দীপ কে জানাতে এক ঝটকায় ঠেলে সরিয়ে দেয় পৃথাকে। বলে ডট্টাচার্য্য বংশের পরিচয়ে কোন অজাত কুজাতের সন্তান বড় হতে পারে না। এসব করলে এ বাড়িতে 
জায়গা হবে না তার। জেদ চেপে যায় পৃথার, বলে মা সে হবেই, তার জন্য সব কিছু মেনে নিতে রাজী সে।

সেদিন অনাথ আশ্রমে ছোট্ট একমাসের শিশুটাকে দেখে বড় মায়া লেগেছিল তার, যেন তার কোলে আসার জন্যই মায়াভরা চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল। দ্বিতীয়বার ভাবেনি পৃথা, বুকে তুলে নিয়েছিল তার ছোট্ট বাবিনকে। সম্পর্ক রাখেনি সন্দীপ, আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। 
একক মা আজ আইনসিদ্ধ, বাবিনকে পেতে কোন অসুবিধা হয়নি পৃথার।

সেই থেকে শুরু, হেরে যায়নি পৃথা, হেরে যায়নি ওর মাতৃত্ব। বুকে আগলে বড় করেছে বাবিনকে। স্কুলের চাকরিটা ওকে জীবনযুদ্ধে হারতে দেয়নি, একটু একটু করে আদর ভালোবাসায় মমতায় বড় করে তুলেছে তার ছোট্ট বাবিনকে।

আজ বাবিন জীবনের প্রথম বড় অপরেশনটা করে মাকে প্রণাম করে। ওর মুখে ব্যারিষ্টার সন্দীপ ভট্টাচার্য্যের নাম শুনে চমকে ওঠে পৃথা। বাবিন বলে ওর হাতেই জীবন ফিরে পেয়েছেন ব্যারিষ্টার ভট্টাচার্য্য, সফল বাইপাস সার্জারীর মাধ্যমে। বলে নিঃসন্তান ভট্টাচার্য্য দম্পতি দুহাত ভরে আশীর্বাদ করছেন ওকে।
মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয় পৃথা। নোনাজলের ধারা গাল বেয়ে নামতে থাকে, বাবিনকে বুকে জড়িয়ে মনে মনে বলে, যোগ্য সন্তানের কাজই তুই করেছিস বাবা, আজ আমি সার্থক মা।....







সমাপন

স র্বা ণী  রি ঙ্কু  গো স্বা মী 

মৃত্যুর কথা সে আগে তেমন করে ভাবেনি কখনো। ভাবতো, "আসুক... তখন দেখা যাবে।" আগে থাকতে ভেবে যারা মাথার চুল পাকিয়ে ফেলতো, তার মায়াই হতো তাদের দেখে। মৃত্যু তো আসবেই, হয়তো আচমকাই আসবে। আগে থেকে ভেবে প্রস্তুতি নিয়ে যারা গুছিয়ে রাখতে গেছে, একটা মুচকি হাসি দিয়ে মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের সব চেয়ে অপ্রস্তুত সময়ে!

অতএব সে জীবন কাটিয়েছে হেসে খেলে ভালোবেসে। জমানো কড়ি দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়েছে গাছ পুঁতেছে ফল ফুলের। ধনেপাতা হবে বলে খালি টবের মাটিতে এক মুঠো ধনে ছড়িয়ে দিয়েছে খেয়ালবশতঃ, তারপর বেমালুম ভুলে গেছে। তার বেশির ভাগটা খুঁটে খেয়ে গেছে চড়ুইপাখিতে, এক দুটো তাও যখন মাথা তুলেছে কচি পাতা নিয়ে... ভারি খুশি হয়েছে সে। সে গ্রিলের আশকারায় জলের বাটি রেখেছে পাখপাখালির জন্য, ঘরের নাড়ুগোপালের জন্য সোয়েটার আর টুপি কিনেছে ছোট্ট ছোট্ট। আমের আচার বানিয়েছে, কুলের আচারও, আলপনা দিয়েছে লক্ষ্মীপুজোয় আর মনে করে পোস্টকার্ডে  খুদে খুদে হরফে গুরুজনদের প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখেছে বিজয়ায়।

চুল পেকেছে তারও। কমজোর হয়েছে নজর। একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করেছে হাঁটু মুড়ে বসতে কষ্ট হচ্ছে তার, অথচ এ যাবৎ সে হাঁটু মুড়ে বসেই পুজো করেছে আলপনা দিয়েছে। ছুঁচে সুতো পরানো একদিন তার কাছে জলভাত ছিল, এখন তাকে চশমা পরতে হচ্ছে। চশমা পরতে হচ্ছে না হলে হেডলাইন ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারছে না খবরের কাগজে। বইয়ের ছোট ছোট হরফ যেন তাকে আগের মতোই হাতছানি দিচ্ছে তবু ভারি আলসেমি লাগে তার আজকাল। খোলা বইয়ের ওপর চশমাটি খুলে সে ভুলে যায় ইদানিং, সেই তাগিদ যেন হারিয়ে ফেলেছে পড়ার যার জন্য একদিন সে মোটা মোটা বই অবহেলায় শেষ করেছে।

আজকাল বেড়াতে যেতেও যেন তেমনটা ভালো লাগে না। টিকিট কাটো পোঁটলা গোছাও ঘর দোর বন্ধ করো থেকে মনে রাখো ওষুধবিষুধ, কোনখানে কোন চাবি। মোবাইলের কোনখানে টিপলে টিকিটের ছবি কোথায় হোটেল বুকিঙের প্রমাণ... বড় ক্লান্তিকর সব। সমুদ্র পাহাড় জঙ্গল মরুভূমি যেখানেই যায় মনে হয় এটা ওটার মতো ওটা সেটার মতো। রাজার  অট্টালিকার শ্বেত পাথরের মেঝেতে পা দিয়েই মনে হয় এখানে সে আগেও হেঁটেছে, কেল্লার দেওয়ালে দেওয়ালে তারও অস্ত্রের ঝনঝনানি লেপ্টে আছে। মন্দিরের ঘন্টাটি এর আগেও সে বাজিয়েছে বহুবার, ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া পুষ্করিনীর সিঁড়িতে সে কতোবার যে কলস রেখে জিরিয়েছে... তার ইয়াত্তা নেই। কতো জন্ম আগের স্মৃতি কে জানে সে সব, বড় চেনা চেনা লাগে এখন... সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে দ্রুত, অতএব ঘরে ফিরে আসার তাগিদটি চেপে বসে বুকে।

ঘরে ফিরে তার বিষন্ন লাগে, ব্যথা বেদনাগুলো জানান দেয় নতুন করে। আপন জনেরা যেচে পড়ে শুনিয়ে যায়, "এবার একটু থিতু হয়ে বসো, বয়েস হচ্ছে তো! পরকালের কথা আর কবে ভাববে হে?" কেউ কেউ ভগবানকে ডাকতে বলে, সে ভাবে যিনি সঙ্গে আছেন তাঁকে বারবার ডেকে আবার বিরক্ত করবার দরকারটাই বা কি! সে চুপ করে নিজের বিছানায় বসে জানলা দিয়ে বাইরের একফালি আকাশ দেখে, আকাশে কি যেন উড়ছে একটা... চশমা চোখে দেয়নি বলে সে ঠাহর পায়না পাখি না ঘুড়ি। যাই বা হোক, সেও ভারি একলা... ঠিক এই মানুষটি যেমন। হঠাৎ করেই চোখে জল আসে তার, মনে পড়ে এতদিন সে যাদের ভালোবেসেছে আপনজন ভেবেছে গাছে ফল ফুল ধরলে ভাগ দিয়েছে বা বিজয়ার চিঠি লিখেছে মনে করে, তাদের কাউকে সে নিজের দুঃখটুকু বোঝাতেই পারেনি!

একদিন সে ঘুমের মধ্যে টের পায় বড় আরাম লাগছে তার, ব্যথা বেদনা ভালো না লাগা কিচ্ছুটি নেই আর। পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে তার শরীর, আলোর সুড়ঙ্গ দিয়ে সে কোথায় যেন যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর যেন কেউ বলে দেয়... "এই মৃত্যু"। সে নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বোজে, যেখানে পৌঁছে যাওয়ার সে ঠিক চলে যাবে সে জানে। এইবার তাকে কোনো ব্যবস্থা করতে হয়নি মনেও রাখতে হয়নি কিছু, বড় নির্ভার নিশ্চিন্ত যাত্রা। 

ফিরে গিয়ে সকলকে সে এই কথাই জানিয়ে দেবে ভেবে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটা। এখন সে আলো শুধুই আলো, ভাবতে ভাবতেই সামনের আলোর সমুদ্রে মিশে যায় সে... অনাদিকালের জন্য।







কাঁচবাক্স

স র্বা ণী  রি ঙ্কু  গো স্বা মী

কাঁচবাক্সটি কাঁধে বসিয়ে কতবছর ধরে যে গ্রাম থেকে গ্রাম চষে বেরিয়েছে কাশীনাথ এখন আর তার হিসেব নেই। যদ্দূর মনে পড়ে যে বছর সেই খুব ফুঁসে উঠলো কালসোনা নদী আর তাদের দোফসলী জমিখানা পার হয়ে খালি মাইলের পর মাইল বালি জল নামার পর, হালের বলদ দুটো বেচে খেতে হলো দুমাস। তারপর ভেদবমিতে পরপর মরলো বাপ আর রসিককাকা। পরের বছর ঘরে এলো রসিককাকার মেয়ে ময়না আর কাশীনাথ কাঁধে গামছা বসিয়ে তুলে নিলো এই কাঁচবাক্স।

কাঁচবাক্স বলতে কাঁচ দিয়ে বাঁধানো কাঠের আংটা লাগানো বাক্স। ভেতর মনোহারি সব টিপ দুল হার নাকছাবি ক্লিপ সেফটিপিন ফিতে এমন কি সিঁদুর আলতাও। এক কাঁধে এই, আরেক কাঁধে একখানা কাপড়ের ঝোলা তাতেও ঐ সব হরেকমাল ঠাসা। সব মেয়েদের ব্যাপার তো, তারা একটু নেড়েচেড়ে দু দশটা দেখে তবে পছন্দ করতে ভালোবাসে তাই রাখতে হয় হালফ্যাশনের হরেককিসিম। ঐ কাঁচবাক্স কাশীনাথের শো কেস আর ঝোলাখানা বলতে পারো গোডাউন। সে নিজেই তো একখানি চলমান দোকান, সাধুভাষাতে যাকে বলে সজ্জা বিপণী!

তা এই দুখানি হিমালয় এতোবছর ধরে বয়ে কাশীনাথের অর্ধেক চুল কাশফুলের রঙ আর পায়ের গুলি গুলো যেন পাথর। ময়না বলে গামছাখানার ওপর বাক্স বসিয়েও কাঁধ নাকি কালচে রঙ ধরেছে, তা হতেই পারে। বলদদেরও অমন হয়, তিনমন জোয়াল বয়ে। বিক্রি করে দেওয়ার হায় লাগেনি তাদের, তাই হয়? শিবে আর লালু কতো যে আদরের ছিলো, চাউনিগুলো বুকে গেঁথে আছে কাশীনাথের। গ্রাম থেকে গ্রামে চলতে চলতে সে ভাবে, "তোদের বদলে এই কাঁচবাক্স রে... আমিই বই!"

এই কাঁচবাক্স বয়েই সংসারটি আজ থিতু তার, খাওয়াপরার অভাব নেই, একমেটে চালাটিও মাথার ওপর। বাক্সভর্তি ঝকঝকে জিনিসে কতো মন যে খুশি হয়, কতো কাঁদন যে চুপ হয় সে কাশীনাথ স্বচক্ষে দেখেছে। তার ব্যবসা হলো খুশি বিলোনো ব্যবসা, এই মনে হয় তার। একবার কোনো গাঁয়ে ঢুকে "মনোহাআআআআরিইইই"...হাঁকটি দিলে হলো, পিলপিল করে বউ মেয়ের দল আর নিমেষের মধ্যে কাশীনাথের আর দম ফেলার ফুরসৎ নেই। বিয়ে সাদি বা পুজোর আগে তো মাল আনতে না আনতে এক দু পাড়াতেই শেষ।মহাজনকে বলে রাখতে হয় আগে থাকতে তাও কুলোতে পারে না।

এবছর এই উটপটাং রোগে সব্বোনাশ করলো যে, বিক্রি করবে যে বেরোনোরই উপায় নেই। মেয়ের বিয়ে হয়েছে দূর গাঁয়ে তার খবর আসে ফোনে, বলে সেখানেও একই অবস্থা, মোড়ে মোড়ে পুলিশ চৌকি, মুখে মুখে মুখোস। পয়লা বোশেখের হিড়িকটাও অমনি গেলো, দুবছর ধরে চাহিদা দেখে কাশীনাথের লাট করা সুতো আর মাটির গয়না। পলাশফুলের মতো ক্লীপ, পাঁজা ধরে পচবে সব!

পচবে না বটে, তবে রঙ ফিকে হবে জোলুষ চলে যাবে বৈকি।দামি তো নয়, অল্প পয়সার গিল্টি সব। কথার বাহারেও বিক্রি করতে হয় খানিক, কতো আনসান বকতে হয়, এ সিরিয়াল ও সিরিয়াল সব নাম করতে হয়। মুখে মাখার স্নো পাওডার কিরিমের ওপর হিরোইনের ছবি দেখিয়ে বলতে হয় ওরা এসব মেখেই এমনটা, তবেই না বিক্রি।সব বাজে কথা, কাশীনাথ নিজেও জানে ওদের এসব মাখতে বয়ে গেছে, তবু পেট যে তাতে চলে ওর আর ময়নার।

একমাস ঘরে বসে বসে গা হাত সব জমে যাচ্ছে কাশীনাথের, ঘরে সবই কমছে আসতে আসতে। বর্ষা আসার আগে চালও ছাইতে হতো সে উপায়ও নেই। কি যে করে তার মাথায় কিছুই আসছে না। এদিকে দরজার সামনে রোজ মাইকে হেঁকে যাচ্ছে "ভয়ঙ্কর রোগ করোনা, ঘরে থাকুন,বাইরে বেরোবেন না, ভীড়ে যাবেন  না, জ্বর সর্দি কাশি হলে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রে আসুন। "আবার আরেকদল এসে বলছে "পঞ্চায়েত অফিসে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে! "এরমধ্যে কাশীনাথের কাঁচবাক্সের কোনো সুরাহা তো কই দেখছে না সে।

আজ বেদম জ্যোৎস্না। আকাশ এতো পরিষ্কার যে মনে হচ্ছে চাঁদ বুঝি দুধে চান করেছে বহুদিন পর। সন্ধেবেলা ঘরে বসে কাঁচবাক্সটির ডালা খোলে কাশীনাথ, তারপর ভারি নরম করে বলে..."আয় তো বউ, আজ তোকে সাজাই এই সব দিয়ে। দেখি আমার ময়নাকে চেনা যায় কিনা!"

কাঁচবাক্সটি হেসে লুটোপুটি খায়, এতোদিনে তার সম্পত্তির একটা সুরাহা হলো... এতোদিনে।







পাগলী

কা বে রী বো স নী ল বৃ ষ্টি 

নির্জন রাত বার বার টিনার মা বারণ করা সত্বেও নাইটশো-ই গিয়েছিলো তারা দেখতে, অনেকেই ছিলো, টিনার বোন তার বর, টিনার মাসির ছেলে, তার বৌ আর তারা সবাই যে যার গন্তব্য এ চলে গেছে, এখন সে আর টিনা একা ফিরছে, ঘড়িতে পৌনে বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে!! না উচিত হয়নি এতো রাত করা!! তার শাশুড়ি মা বিচক্ষণ মানুষ যা বলে তাই ঘটে এটা মানে আকাশ, টিনার সাথে তার প্রেমের বিয়ে , আকাশের মা রাজিই ছিলোনা কিন্তু টিনার মা এসে কথা বলেই সব রাজি করিয়েছে!! আকাশ বাবাকে হারিয়েছে ছোটোবেলায়, তার জীবনে তার মা-ই সব ছিলো কিন্তু সত্যি টিনার মা আসার পর সব ধারণা পাল্টে গেছে আকাশের, এতো বিচক্ষণতা কারোর ভেতর পায়নি সে!! তার নিজের মা'র যে গুণগুলো এতোদিন দেখতো সেগুলো আসলে দোষ ছিলো সেই চোখে ঠুলি পড়ে ছিলো, টিনার মা সব চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো তাকে, তার মায়ের মাথাটাও ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করলো!! ডাক্তার ঘর করে কোনো লাভ হলোনা তারপর একদিন এই এতোবড় বাড়িতে সত্যি খুব বেমানান হয়ে গেলো মা তাই তাকে সামনেই এক আশ্রমে রেখেছে আকাশ, মাঝে মধ্যেই সেখান থেকেও বেড়িয়ে রাস্তায় ঘোরে মা!! সেটাও অল্প পয়সায় তার শাশুড়ি মা-ই ব্যাবস্থা করে  দিয়েছে। অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা করে, হাতে ইঁট নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সবাই এখন জানে তার মা পাগল হয়ে গেছে!! কি আর করবে আকাশ!! যা করার তাতো করেইছে আর কি করবে!! হঠাৎ টিনা তার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরলো, আকাশ দেখলো সামনে কতগুলো লোক তাদের দিকেই আসছে, মতলব ভালো নয়!! পাড়াটা এখন অ্যান্টিসোশ্যালদের দখলে প্রায়!! তারা গোল হয়ে ঘুরছে ওদের পাশে অশ্লীল মন্তব্য করছে টিনাকে!! আকাশ কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা!! একজন হাত বাড়ালো টিনার দিকে হঠাৎ আর্তনাদ করে  লোক টা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে!! কোথা থেকে একটা থানইঁট এসে পড়েছে তার মাথায় !! আরো ইঁট ছুটে আসছে তাদের দিকে! ওরা ভয়ে দৌড়চ্ছে আর পাগলীটা আলুথালু ভাবে ওদের পেছনে!!! আর আকাশ বহুদিন পর ওই পাগলীটার পেছনে ছুটছে চিৎকার করতে করতে মাআআআআআআ!!!







রোদন ভরা বসন্ত

কা ক লী  ব সু

দোতলার ঘরের দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই কৃষ্ণচূড়া গাছটায় দৃষ্টি পড়লো নিবেদিতার। আপন মনে গেয়ে উঠলো রবি ঠাকুরের গানের দুটো কলি "মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এলো ফাগুন দিনের স্রোতে/এসে হেসেই বলে যাই যাই যাই!" সত্যি, এইতো দিন কুড়ি আগেও গাছটাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা বিটপের কঙ্কাল।আর আজ যেন লালে লালে ভরিয়ে দিয়েছে। যেন লাল টুকটুকে বেনারসী গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে গাছটা। গুনগুন করে গাইতে গাইতে এবার অন্য দিকে মনটা চলে গেলো ওর। ভাবলো, যাই তো, গিয়ে দেখি কাঞ্চন ফুলের গাছটার কি খবর! পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে দেখলো সেটাও ফুলে ফুলে সাদা। এবারো সে বিড়বিড় করে রবি ঠাকুরের সেই সহজ পাঠের কবিতা, "কাল ছিলো ডাল খালি/আজ ফুলে যায় ভরে।"

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে  বারান্দায় রাখা চেয়ারটিতে বসে পড়লো সে। এক পলকে মনটাকে পৌঁছে দিলো সেই ছোটোবেলায়। যেখানে সে এমনই ফাগুন দিনে বন্ধুদের সাথে প্রজাপতির পিছু ধাওয়া করতো। মৌ পিয়াসী পতঙ্গগুলি ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতো। কিছুতেই ধরা দিতো না নিবেদিতার কাছে। এমনই এক বসন্তের দিনে সখীদলবলে মিত্র বাড়ির আম বাগানে গিয়েছিলো আমের গুটি কুড়োতে। ওরা নাকি ঐ ছোট্ট ছোট্ট নিম ফলের মতো  আমের গুটিগুলো নুন লঙ্কা দিয়ে মেখে খাবে। কয়েকটি কুড়িয়ে নিয়েছে সেদিন। এখনো সকলে ভাগ করে খাওয়ার মতো পরিমাণ হয়নি, এমন সময় মিত্তির বাড়ির  ছেলে সৌগত ওদের ধমকে উঠলো, "এই তোরা কি করছিস রে আম বাগানে! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।" এ কথা শুনেই দলনেত্রী নিবেদিতার নির্দেশে সবাই দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার উদ‍্যোগ করতেই সৌগত ধাওয়া করলো ওদের। দৌড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো নিবেদিতা। দৌড়ে এসে সৌগত টেনে তুললো। ব্যাস্ হয়ে গেলো! প্রথম স্পর্শেই শিহরণ ও মন হরণ। এরপর সুপার ফার্স্ট ট্রেনের মতোই ধাবিত হলো জীবন। কিশোরী নিবেদিতা যুবতী আর সৌগত যুবক। সেকালে প্রেম যেন দণ্ডণীয় অপরাধের মধ্যেই পড়তো‌। অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে ওদের প্রেম পরিণতি লাভ করলো। কিন্তু সবার কপালে তো সুখ সয় না। তাই সন্তান না হওয়ার অপরাধে সৌগত নিবেদিতাকে ছেড়ে চলে গেলো । ঘর বাঁধলো অন্য একজনের সাথে। শুনেছে দুটি সন্তান উপহার দিয়েছে সৌগতকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী।

এখন পৈতৃক ভিটেতেই থাকে নিবেদিতা। দুটো রেল স্টেশন পরে একটা প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে শিক্ষকতা করে দিন চালায়। চলে যায় কোনোভাবে দিন। পুরোণো স্মৃতি সুযোগ পেলেই পিছু ধাওয়া করে। নিবেদিতা কেমন ছেলেমানুষের মতো আজও ভাবে, সৌগত যেন অফিস থেকে ফিরে তাকে বলছে, "ঝটপট দু'কাপ চা করে আনো তো নীতা।" হ‍্যাঁ! ঐ নামেই ডাকতো সৌগত তাকে। হঠাৎ পাশের বাড়ির মৌমিতার সন্ধ্যা দীপ জ্বালানোর সময় শঙ্খ ধ্বনির শব্দে সম্বিত ফিরে আসে নিবেদিতার। অনুভব করে সেই রবি ঠাকুরের গানই সে গুনগুন করে গাইছে নিজের অজান্তেই, "এতোদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে/দেখা পেলেম ফাল্গুনে"।








বকুল ফুল

অ র ণ্যা নী

ক্লাস টেনে পড়ে অম্লান। বন্ধুরা কেউ কেউ প্রেম করতে শুরু করেছে। কিন্তু নিজের প্রেমের কল্পনা যেন বন্ধুদের সঙ্গে মেলে না অম্লানের। আজকাল একটু একা থাকতেই বেশি ভালো লাগে। স্কুল যাওয়ার সময় মাথার উপর খোলা আকাশের দিকে যখন চোখ যায়, দু'দন্ড থমকে দাঁড়িয়ে মেঘেদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অদ্ভুত এক অজানা উদাসীন অনুভূতি মনকে নাড়া দিয়ে যায়। স্কুলের তাড়া থাকে। তাই বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তাছাড়া মানুষের প্রশ্ন, "কিছু আনতে ভুলে গেছ? টিফিন বাক্স ফেলে এসেছ?" না, অনুভব করার সময় থাকে না হাতে।

রাতের আকাশে ছাদে উঠে তারাদের দিকে চোখ চলে যায় অম্লানের। পড়ায় মন বসতে চায় না আজকাল। আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কেমন এক অজানা শিহরণ খেলে যায় মনে। আলো ছায়ায় ঢাকা বিশাল আকাশে মন যেন পাড়ি দেয় কোন এক অজানা দেশে। রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না চোখে। মায়ের লাগানো গাছ থেকে বেল ফুলের গন্ধ ভেসে আসে জানলা দিয়ে। কাছাকাছি বকুল গাছটা থেকে হয়তো এখন একটা একটা করে ঝরছে ফুল গুলো। তার সুবাস ভেসে আসছে আঁধার ঘরে। মিষ্টি সুবাসে চোখে কখন ঘুম নামে। যেন এক অচেনা মুখ ভেসে ওঠে স্বপ্নে। শ্যামল মিত্রের গানটা যেন ঘুমের মধ্যেই শোনা যায়, "আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা আছে, সাত সাগর আর তেরো নদীর পাড়ে।"

একই পাড়ায় পল্লবীর এখন ক্লাস এইট। সবে একটু বড় হয়ে উঠেছে। এ সময় সব মেয়ের মুখেই একটা অন্যরকম শ্রী ফুটে ওঠে। চোখ দুটোয় দেখা দেয় স্বপ্ন মায়া। সকাল হলেই পল্লবী জানলার গ্রীলটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আনমনে। ওদের বাড়ির সামনের অশথ গাছটার কচি সবুজ পাতা গুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। বাড়ির সামনে দিয়ে অম্লান সকাল বেলা দোকানে যাচ্ছিল সেদিন। হঠাৎ চোখ পড়ল পল্লবীর দিকে। ছোটবেলায় ওরা একসঙ্গে পার্কে খেলা করেছে। এখন বড় হওয়ার পর কথাবার্তা তেমন হয় না। আজ হঠাৎ যেন পল্লবীকে নতুন করে দেখল অম্লান। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পল্লবীর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল। লজ্জা পেয়ে পল্লবী সরে গেল জানলার কাছ থেকে। মনের ভেতর একটা মনকেমনকরা-কে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেল অম্লান।

শেষ বসন্তের আকাশ সেদিন মেঘে ঢেকে গেল। অম্লান মনে মনে পল্লবীর কথাই ভাবছিল। পল্লবী যেন একরাশ সুগন্ধী বকুল ফুল গুলোর মতোই সুন্দর। কিন্তু ওকে দেখে তো চলে গেল। সে কথা মনে আসতেই মনের আকাশে যেন মেঘ জমতে শুরু করল। অনেকক্ষণ জানলা দিয়ে মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে রইল অম্লান। মন খারাপ গুলোকে মেঘেদের সঙ্গে উড়িয়ে দিতে চাইল। স্কুল যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। কী ভেবে অম্লান বকুল গাছটার নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো কুড়িয়ে দু'হাত ভরে নিয়ে এগিয়ে গেল। আজও সেদিনের মতোই জানলার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে সবুজ পাতায় ছাওয়া অশথ গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে পল্লবী। মেঘলা সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে সবুজ ডালপালাগুলো। আজ আর অম্লানকে খেয়াল করতে পারল না পল্লবী। অম্লান জানলার কাছে এসে পৌঁছতে পল্লবীর চোখ পড়ল ওর দিকে। কিন্তু আজ আর অম্লান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল না, বা নীরবে পল্লবীর দিকে চেয়েও রইল না। সোজা জানলার সামনে এসে নিজের দু'হাত ভরা বকুল ফুল পল্লবীর হাতে তুলে দিতে চাইল। পল্লবী ঘরের চারপাশে একবার ভীরু চোখে তাকিয়ে অম্লানের দিকে জানলার গ্রীল দিয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে দিলে, দু'হাতের অঞ্জলি ভরা ফুল অম্লান পল্লবীর হাতে তুলে দিয়ে বলল, তুমি আমার বকুল ফুল।







গোধূলি গগনে মেঘে
 
শ্যা ম ল  কু মা র  মি শ্র 

মুখুজ্জে বাড়ির ছোট মেয়ে সৌমি।কলকাতার ভবানীপুর এলাকার বনেদি পরিবার। পারিবারিক ব্যবসায় বাবাকে বছরের বেশিরভাগ সময় কলকাতার বাইরে থাকতে হয়। মায়ের কঠোর তত্ত্বাবধানে সৌমির বেড়ে ওঠা। কলকাতার এক নামী স্কুলের ছাত্রী সৌমি। পড়াশুনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতেও ছিল সৌমির অবাধ সঞ্চরণ। রবীন্দ্র নৃত্যে সে ইতিমধ্যে কয়েকবার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে। ফলে সৌমিকে এক ডাকে স্কুলের সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকাকে চিনতেন। 
একসময়ে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ভালো ফল করার সুবাদে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার সুযোগ এসে যায়। প্রথম বর্ষের প্রথম দিনের ক্লাস। দেরি করে ফেলে সৌমি। ক্লাস শুরুর একটু আগেই ঢোকে। সমস্ত বেঞ্চ প্রায় ভর্তি। কোথাও সিট খালি নেই। শেষের দিকে একটি বেঞ্চে একটি ছেলেকে খুব জড়সড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে সৌমি। ওর পাশের সিটটা খালি। অগত্যা সেখানে গিয়ে বসে সৌমি। ছেলেটি যেন আরও একটু জড়োসড়ো হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। প্রথম পিরিয়ডে এসে স্যার রোলকল করে প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা বলার পরে চলে যান। যাওয়ার আগে বলে যান এখন তোমাদের সিনিয়র দাদাদিদিরা তোমাদের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ের সাথে সাথে তোমাদের বরণ করে নেবেন। 

খানিক বাদে সিনিয়ররা ঢুকলেন। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ হলো। জানা গেল সৌমির পাশের ছেলেটির নাম কমল হাঁসদা। ঝাড়গ্রামের রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত একলব্য স্কুল থেকে এসেছে। এরপর সিনিয়র দাদাদিদিরা বললেন--যে যে বেঞ্চে বসেছে তাদের দুজনকে একসাথে কিছু একটা করে দেখাতে হবে। সেটা অভিনয় হতে পারে গান হতে পারে নাচ ও হতে পারে। যা কিছুই করা যেতে পারে। সৌমি খুবই স্মার্ট। সে কমলকে বলল-- কি করবে বলো? কমল যেন লজ্জায় আরো অধোবদন হয়ে যায়। কিছুতেই কথা বলে না। সৌমি ওর কাছে গিয়ে বলে--দেখ এরা কিন্তু ছাড়বে না। কিছু একটা করতে হবে। তুমি কি করবে বলো? আমি নাচতে পারবো। তুমি কি গাইতে পারবে? না আমার সঙ্গে নাচবে? সৌমির কথার মধ্যে এমন একটা মজা লুকিয়ে ছিল যে কমল না হেসে পারল না। ধীরে ধীরে কমল বলল-- আমি একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইবো। সৌমি তখন হাততালি দিয়ে বলে উঠল-- ঠিক আছে। আমি তাহলে তোমার গাওয়া গানের সঙ্গে নাচবো। রবীন্দ্রনাথের গান আর নাচের সঙ্গে সৌমির যে আবাল্য সম্পর্ক। যেকোনো রবীন্দ্র গানে সৌমি সহজে নাচ তুলে ফেলে। কমল সেই প্রথম সৌমির দিকে তাকায়। খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান কমল। বাবা দিনমজুর। রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের অনুকূল্যে পড়াশুনা। কমল কিন্তু পড়াশোনায় ভীষণ ভালো। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ভালো র‍্যাঙ্কের সুবাদে এখানে ভর্তি হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশনই সব খরচ বহন করছে। কলকাতায় খুব বেশি আসার সুযোগ আগে হয়নি কমলের। শহরের ছেলে মেয়েদের সম্পর্কে কেমন একটা ভয় ভয় ভাবছিল। কিন্তু সৌমির আন্তরিক ব্যবহারে খানিকটা হলেও কমলের আড়ষ্টতা ভেঙ্গে যায়। একের পর এক জুটি পারফর্ম করছে আর পারফরম্যান্স শেষে দাদা দিদিরা ওদের হাতে একটা গোলাপ, পেন আর ললিপপ ধরিয়ে দিচ্ছে। সবাই খুব এনজয় করছে। অবশেষে সৌমি আর কমলের পালা। শেষ বেঞ্চের শেষ জুটি। ডায়াসের কাছে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা করা হয়েছে। এতক্ষণ যারা পারফর্ম করেছে হয় আবৃত্তি না হলে গান করেছে। সৌমি এসে মাইক্রোফোনটা হাতে তুলে নিয়ে ঘোষণা করে-- আমি সৌমি আর ও কমল। আমি একটা রবীন্দ্রনৃত্য প্রদর্শন করব আর সেই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি গাইবে কমল। কমলের চেহারা দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি করল। সিনিয়ররা বলল--ঠিক আছে। তবে শুরু কর। সৌমি এসে কমলের কানে কানে বলল-- নিজেকে উজাড় করে দাও কমল। তোমাকে পারতেই হবে। সৌমির কথাগুলো যেন কমলকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেল। চোখ দুটো তুলে সৌমিকে দেখে নিল। তারপর সৌমির হাত থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে গাইতে শুরু করলো--

গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা 
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা। 

ধীরে ধীরে সমস্ত ক্লাসরুমে নীরবতা নেমে এলো। নিমেষেই সবাই বিস্ময়ে কমলের দিকে তাকিয়ে রইল। কমলের গানের সঙ্গে সমানতালে এক অপূর্ব নৃত্য পরিবেশন করলো সৌমি। পারফরম্যান্স শেষে হাততালি যেন আর থামেনা। সিনিয়াররা এসে ওদের জড়িয়ে ধরে। 

ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে যায়। সেই থেকে কমল আর সৌমি খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। কমল মেসে থাকত। তাই অধিকাংশ দিনই সৌমি তার টিফিন কমলের সঙ্গে ভাগ করে খেত। সেদিনের সেই বন্ধুত্ব কখন যে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে তা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। 

দেখতে দেখতে কেমন করে যেন চারটে বছর কেটে গেল। কমল এখন অনেক স্বচ্ছন্দ্য। ক্যাম্পাসিং এ কমল খুব ভালো চাকরি পেয়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়। সৌমি ও সেক্টর ফাইভে চাকরি পায়। ভিডিও কলিং এ প্রতিদিনই কথা হয়। ইতিমধ্যে মুখুজ্জে বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য মা উঠে পড়ে লেগেছেন। কোনভাবে বোধহয় মুখুজ্জে গিন্নির কানে কথাটি পৌঁছেছিল। তাই দ্রুত একটা ব্যবস্থা করতে উঠে পড়ে লাগেন। এদিকে সৌমি জানিয়ে দেয়-- বিয়ে করলে সে কমলকেই করবে না হলে নয়। বাবা রাজি হলেও মা বেঁকে বসেন। মায়ের প্রধান আপত্তি কমল অন্ত্যজ গোষ্ঠীর। সৌমি বলে কমলের পরিচয় তার সংস্কৃতিমনস্কতায়। তার আচার আচরণে। কখনই তার জন্ম পরিচয়ে নয়।  সে এক কৃতী বিজ্ঞানমনস্ক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। এটাই তার আসল পরিচয়। সৌমির বাবা ও বোঝান। অবশেষে মা রাজি হন।

সেদিনটা ছিল ২৫শে বৈশাখ। কবিগুরুর জন্মদিনে গোধূলি লগ্নে বিয়ে স্থির হয়। সল্টলেকে বাবা মাকে নিয়ে কমল একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। মুখুজ্জে  বাড়ি সেদিন আলোকমালায় সেজে উঠেছে। সানাইয়ে বিদায়ের সুর। বন্ধুরা সুন্দর করে সাজিয়ে তুলছে সৌমিকে। বাইপাস ধরে কমলের গাড়ি ছুটছে। সঙ্গে দুজন বন্ধু। চিংড়িঘাটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে বাঁক নেওয়ার মুখে একটা ঝোপের আড়াল থেকে একটা আর্ত চিৎকার শুনতে পায়। নিমেষেই গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে যায় কমল। দেখে ঝোপের আড়ালে এক বিবসনা মেয়েকে খুবলে খেতে চাইছে দুই যুবক।  কমলদের  অতর্কিত আক্রমণে ছেলে দুটি পালিয়ে যায়। গলার উত্তরীয় দিয়ে মেয়েটিকে ঢেকে দেয় কমল। তারপর মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেয়। 

ঘড়িতে তখন রাত নটা। মুখুজ্জে পরিবারে লোকেরা তখন বিষাদগ্রস্ত। ফোনে অনেকবার চেষ্টা করেও কমলকে ধরা যায়নি। মায়ের মুখ ভার। এমন সময় কমলের গাড়ি পৌঁছোয়। ক্লান্ত বিধ্বস্ত কমলকে দেখেও হাজারো প্রশ্নের বান ধেয়ে আসে। সবার প্রশ্ন কি হবে? সৌমি যে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে গেল। সব শোনার পর সৌমি ঘোষণা করে--- এক অসহায় মেয়ের জীবনদানই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় লগ্ন। কমলের হাত ধরে সৌমি এগিয়ে যায় চন্দ্রাতপের দিকে। সানাই এ তখন বেজে চলেছে--- 
গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা।

(শব্দ সংখ্যা: ৮৯৪)







নীলা

সি রা জু ল  ই স লা ম

"আমার ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর কারিগর/ভালোবাসার শূন্যঘরে কেউ বাঁধলোনা ঘর...!"

অস্তমিত সূর্যের শেষ আলোয় গাঙপাড়ের বালুচরায় বসে রইচউদ্দিন তার দোতারায় সুর সেঁধে চলেছে। ঢলে পড়া সূর্যালোকের তীর্যক আলো এসে চিকচিক করছে তার দু'চোখ থেকে ঝরে পড়া তপ্ত লোনাজল। স্থায়ী হয় না, টুপ করে ঝরে পড়ে। আবার নতুন করে দু'ফোঁটা জল জমা হয় চোখের কার্নিশে। সে জলকে বাধা দেয়না রইচউদ্দিন।

রইচউদ্দিন  আত্মভোলা ভবঘুরে পাগল মানুষ। বয়সের উন্মাদনায় ভালোবেসেছিলো গগনপুরের  সুন্দরী তন্বী ষোড়শী নীলাকে। খাঁড়ুজলের ছলাৎচ্ছ্বল তরঙ্গ তুলে ত্রস্তাহরিণীর মত ছুটে বেড়ায় সে প্রমত্তা যমুনার কোল ছুঁয়ে ছুঁয়ে।

ব্যবসায়ী বাবার মাল বোঝাই কোষা-নাও নিয়ে ভাঁটির টানে ফিরছিলো রইচউদ্দিন। বৈশাখের ঝড়ে নদীতে নৌকাডুবি। অচেতন রইচউদ্দিন চেতন ফিরে নিজেকে খুঁজে পায় অপরিচিত গগনপুরের গাঁয়ে। নীলাদের ঘরে। পরে সে জেনেছিলো, স্রোতের তোড়ে ভেসে এসেছিলে উজান থেকে।  তার অচেতন দেহটাকে নদীপাড়ে পড়ে থাকতে দেখে, অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে নিস্তেজ দেহটাকে তুলে এনেছিলো নীলার বাবা। মা মরা নীলার সেবা-শুশ্রূষায় সে যাত্রা ধকল কাটিয়ে ওঠে রইচউদ্দিন। ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে যুবক রইচউদ্দিন। বাধা দেয় নীলার বাবা। দুর্বল শরীর নিয়ে পথ চলতে নিষেধ করে। ক'টা দিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয় নীলার বাবা।

অখণ্ড অবসর। বাজার থেকে একটা দোতারা কিনে আনে রইচউদ্দিন। নির্জনতায় গাছতলাতে টুড়ুং টুড়ুং সুর তোলে সে। মন উদাস হয় নীলার। সেই সুরের মোহমায়াতে কখন যেন মন দিয়ে বসে আছে সে পরদেশী রইচউদ্দিনকে। চান্নিপশর রাতে সুরের মূর্চ্ছনায় নিজেকে সামলাতে পারে না নীলা। দীঘির ঘাটলায় তখন সুর তুলেছে রইচউদ্দিন, "মিলন হবে কতদিনে / আমার মনের মানুষেরও সঅঅনে!" দমকা বাতাসের মাতাল হাওয়ার মতই ছুটে এসে নীলা ঝাঁপিয়ে পড়ে রইচউদ্দিনের বুকে। রাত গভীর হয়। দু'জনে স্বপ্নের জাল বোনে।
মাঝরাতে মেয়েকে ঘরে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে নীলার বাবা দীঘির ঘাটলায় এসে দু'টো পাথরের মুর্তিকে আলোআঁধারীতে বসে থাকতে দেখে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে  রইচউদ্দিনকে ফিরে যেতে অনুরোধ করে নীলার বাবা।
বিদায়বেলা নীলা চোখের জল মুছে বলে, "আমাকেও সাথে নিয়ে চলোনা গো!" বুকে জমা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রইচউদ্দিন জানায়, "অপেক্ষা করো! আমি আসবো। সাতনরী হার গলায় পরিয়ে, বউ সাজিয়ে নিয়ে যাবো তোমাকে!" আঁচলে চোখ মুছে যমুনার পাড় থেকে ফিরে আসে নীলা।

চঞ্চলামনের ত্রস্তাহরিণীসম নীলাকে এখন বিষণ্নতায় ঘিরে ধরেছে। কোনো কাজে আর মন বসে না তার। সব কাজে বারবার ভুল হয়ে যায়। সময়ে অসময়ে ছুটে যায় নদীপাড়ে। দূরগামী সওয়ারী বোঝাই নৌকার দিকে  চেয়ে থাকে সতৃষ্ণ নয়নে। দু'চোখের কোণে কালশিটে পড়ে গেছে তার।

মেয়ের এহেন আচরণে ব্যথাতুর বাবার হৃদয়। সম্বন্ধ নিয়ে আসে একদিন উজানের দেশে এক সওদাগরের সাথে। গত বছরই যার বউটা মারা গেছে দু' দু'টো বাচ্চা রেখে।

মাসাধিক পরে যেদিন ঘরে ফিরে এলো রইচউদ্দিন, তখন সব শেষ হয়ে গেছে। ঝড়ের কবলে ব্যবসায়ী নৌকাডুবি; একমাত্র সন্তান নিখোঁজ সংবাদে হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেলো রইচউদ্দিনের মায়ের। তীব্র শোকে পাথর রইচউদ্দিনের বাবা স্ত্রী আর সন্তানের শোক সামলাতে না পেরে আত্মঘাতী হলেন।

পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনদের সান্ত্বনায় স্বস্তি পায় না রইচউদ্দিন। কী যেন এক অব্যক্ত ব্যথা তাড়া করে ফেরে তাকে। একটু শান্তির প্রত্যাশায় একদিন রাতের অন্ধকারে সাধের দোতারা হাতে নিয়ে পথে নামে রইচউদ্দিন। কোথায় যাবে?  কার কাছে? মনে পড়ে নীলার মুখ। ভরা পূর্নিমার মতন নিটোল মুখটাকে ভেবে মনে শান্তি পায়। বাধা দেয় বিবেক। কোন মুখে আজ সে দাঁড়াবে নীলার সামনে! তাকে তো বলে এসেছিলো, সাতনরী হার গলায় পরিয়ে বজরা না'য়ে বউ সাজিয়ে নিয়ে যাবে। হলো কই? আজ যে সে পথের কাঙাল।

মনস্থির করে শেষে একদিন নাও সাজিয়ে রওয়ানা হয় সে গগনপুরের দিকে। স্বপ্নের জাল বুনে বুনে উজানের পথ পাড়ি দিয়ে যখন গগনপুরে পৌঁছুলো তখন ভোরের আকাশের সোনাগলা রৌদ্রকিরণে যমুনায় রঙ ধরেছে। আবেগী মনে তর সয় না আর। সঙ্গী সাথিদের নিয়ে ধীরপায়ে পৌঁছুলো নীলাদের ঘরের দ্বারে। কিন্তু এ কী?
কোন জনমানবের সাড়া নেই বাড়ীটাতে।

প্রতিবেশীরা জানালো, মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাতে ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে, এখানকার আবাস গুটিয়ে চলে গেছে নীলার বাবা ; নীলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার ক'দিন পরেই।

আজও বড়গাঙের পাড়ে বসে কাঁদে রইচউদ্দিন! অস্তমিত সূর্যের শেষ বিদায়ে প্রগাঢ় অন্ধকারে ঘিরে আসে দিকচক্রবাল। হৃদয় মথিত করা আর্তনাদের সুর ভেসে আসে,ফুরায়ে যাবে গো সাধেরও যৌবন/আর তো হবেনা মানবজনম/দয়াল বান্ধব রে/একবার দেখা দাও আমারে...!"







প্রেয়ার ফ্ল্যাগ

শাঁ ও লি দে

পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গ্রামগুলো ছবির মতো সাজানো। অনেক বেশি উচ্চতায় উঠলে নিচের দিকে তাকালে মনে হয় কালী পূজায় নিজস্ব ছোট্ট পাহাড় বানিয়েছে পাড়ার কচিকাঁচারা। রাতের বেলা ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে উঠলেই ঠিক যেন দীপাবলীর সাজ, একেবারে মনোমুগ্ধকর। 

নিজের চার চাকায় একটু একটু করে ওপরে উঠছে অনির্বাণ।পাহাড় ওকে ইদানিং পাগলের মতো টানে, যখনই এক দু’দিনের ছুটিছাটা ম্যানেজ করা যায় তখনই পাহাড়ের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায় ও। এ যে কী এক নেশা কাউকে বলে বোঝাতে পারে না সে। বাড়িতে এই নিয়ে অশান্তিও কম হয় না। কিন্তু পাহাড় ডাকলে সে ডাকে সাড়া না দিয়ে ওর কোনো উপায় থাকে না। ওর এই পাহাড়ের টান কাউকে কি বোঝানো সম্ভব?

এবারে ছুটিটা একটু লম্বাই হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার একটা ছুটি পড়েছে, শনিবারটা ম্যানেজ করলেই শুক্র, শনি আর রবি তিনদিন টানা পাওয়া যায়। সোমবার সকালে নেমে দিব্যি অফিস ধরা যাবে। সুতরাং আর নিজেকে বেঁধে রাখার কোনো মানেই হয় না। পাহাড় দেবতাকে স্মরণ করে তাই ওর এবারের যাত্রা শুরু। 

বেশিরভাগ সময়ই অনির্বাণের যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে না। রওনা দেয়, তারপর যেখানে সন্ধ্যা নামে সেখানে হোম স্টে বা ছোটখাটো কিছু পাওয়াই যায়, ফলে থাকার কোনো অসুবিধা হয় না। বহু বছর ধরে পাহাড় চষে বেড়াতে বেড়াতে অনেক আটঘাঁটই ওর জানা হয়ে গিয়েছে। সুতরাং সমস্যা তেমন হয় না। আর পাহাড়ে ওর আসল কাজ তো খোঁজ, ফলে রাতের কোথাও আশ্রয় না পেলেও চিন্তা নেই, গাড়ি চালাতে চালাতেই রাত কেটে যায়। এইসব এলাকার ছোটখাট ফাঁড়িগুলোর পুলিশরাও এতদিনে ওকে চিনে নিয়েছে, ফলে আটকায় না কেউই। এত বছরে অনেকেই জেনে গিয়েছে এই শহুরেবাবুর কথা, ওর খোঁজের কথা। কেউ কেউ আড়ালে পাগলবাবুও ডাকে। ওরা জানে যে ছুটি পেলেই এক পাগলবাবু আসে আর খুঁজে চলে ওর হারানো সম্পদকে। সবাই আসল সত্যটা জানলেও কেউ আর বাঁধা দেয় না। এতদিনে ওরাও বুঝে নিয়েছে পাগলবাবুকে আটকানো যাবে না। মৃত্যুর আগ অবধি ও খুঁজেই যাবে, খুঁজবেই। 

দূর থেকেই পাঁচ রঙা কাপড়ের টুকরোগুলো চোখে পড়ল অনির্বার্ণের। এক মুহূর্তেই বিষাদাক্রান্ত মনটা ওই রঙিন কাপড়গুলোর মতোই ঝলমল করে উঠল। পাহাড়ি হাওয়ায় একভাবে উড়ে যাচ্ছে পতাকাগুলো। পাহাড় উঠতে উঠতে পাথুরে আঁকাবাঁকা রাস্তায় যখনই ওগুলো চোখে পড়ে মনটা এমনই হয়ে যায়। এই অনুভূতি কাউকে বোঝানোর নয়। গাড়ির গতিও এইসময় কমে যায় ওর। পতাকাগুলোর কাছাকাছি আসতেই গাড়ি থামিয়ে দেয় ও। ধীর পায়ে নেমে আসে অনির্বান। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে পতাকাগুলোর নিচে হাঁটু মুড়ে বসে। দু'হাতের আঙুলের মধ্যে আঙুল জড়িয়ে প্রণামের ভঙ্গি করে চোখ বুজে প্রার্থনা করে। কত সময় গড়িয়ে যায়, অনির্বাণের প্রার্থনা শেষ হয় না। পাশ দিয়ে হু হু করে ছুটে যায় কত শত গাড়ি। ওর হুঁশ ফেরে না। অনির্বাণ প্রার্থনা করতেই থাকে। এই প্রার্থনার জোর কতখানি ও জানে না, ও শুধু জানে একদিন ঠিক দেখা হবে, হবেই। 

দার্জিলিঙ থেকে কিছু দূরের এক পাহাড়ি গ্রাম মাঙ্গওয়া। শান্ত সমাহিত এক গ্রাম, নিরিবিলিও। এখনও সেভাবে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে এসে পৌঁছায়নি। এখানকারই একমাত্র হোম-স্টে-তে উঠেছিল ওরা সেদিন। একপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা তো অন্য পাশে নাথুলা রেঞ্জের অভিনব সহাবস্থান। অনির্বান নেট ঘেঁটে খুঁজে বের করেছিল এই অপূর্ব 'ডেস্টিনেশন'। হানিমুনের জন্য এর চাইতে 'পারফেক্ট ডেস্টিনেশন' আর হয় নাকি! 

সকাল হতে না হতেই কাচের ফিনফিনে কাপে ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিঙ চা দিয়ে গেল হোম-স্টে-র ছেলেটি। কাচের জানলায় চোখ রেখে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া মুগ্ধ চোখে দেখছিল অনির্বান। সাদা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়ে যেন শীতের আমেজ নিচ্ছে সুউচ্চ পর্বতটি। ঘাড় ঘুড়িয়ে নিজেদের বিছানার দিকে তাকাল অনির্বান। গত রাতের তীব্র আদরের পর ক্লান্ত শ্রান্ত ঐশীও নিজেকে ঢেকে রেখেছে সাদা গরম চাদরে। অনির্বাণের মুগ্ধতা আরও বেড়ে যায়। ঐশী ওর কাছে এক পাহাড়ি ঝরনার মতো। আর সেই ঝরনায় খড়কুটোর মতো ভেসে যায় অনির্বাণ। 

বিছানার এক কোণে বসে ঐশীর এলোমেলো চুলগুলোর মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে দেয়। কপালের কাছে জড়ো হওয়া কালো রেশম সরিয়ে দেয় আদর করে। তারপর নিজের মুখটা ঐশীর ঠোঁটের একদম কাছে নিয়ে এসে আলতো করে চুমু খেয়ে নিজের মনেই বলে ওঠে, 'আমার পাগলিটা'। 

ঐশী টের পায়, ছদ্ম বিরক্তি মাখিয়ে বলে, 'উফ্, যাও তো! সক্কাল সক্কাল তোমার শুরু হল।' অনির্বাণ হাসে, ঐশীর ঘাড়ে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, 'সে না হয় যাচ্ছি, কিন্তু ম্যাডাম উঠবেন কখন! এই না কাল বললে, সকালে হাঁটতে বের হব!' 

ঐশী চোখ খোলে। অনির্বাণকে একবার দেখে নিয়েই চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর বলে, ধুর! শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে শুয়েই থাকি।

অনির্বাণের ভ্রু কুঁচকে ওঠে মুহূর্তেই। চিন্তিত স্বরে বলে,  এ্যাই তোমার কী হয়েছে বল তো! আসার পর থেকে শুনছি ভালো লাগছে না। শরীর ঠিক আছে তো? 

চোখ সরিয়ে নেয় ঐশী। যেন এই মুহূর্তে কিছুতেই ধরা দেবে না ও অনির্বাণের কাছে। পাহাড়ের মতো জীবনেও কিছু রহস্য থাকা ভালো। ও অনির্বাণকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে। তারপর ঘুম জড়ানো গলায় বলে ওঠে, নাহ্, ঠিকই আছে। চলোহ্...

পাহাড়ের রাস্তায় উঠতে কষ্ট হয় খুব। ধীর পায়ে অনির্বানের হাত ধরে হাঁটছিল ঐশী।  হাফ ধরছিল একটুতেই। মনে হচ্ছিল একটু কোথাও বসলে ভালো হয়। কিন্তু অনির্বাণের কথা ভেবে সেটা বলাও হচ্ছিল না। অফিসের চাপে তেমন কোথাও বেরও হয় না ছেলেটা। তাই এই হানিমুন নিয়ে ও নিজেই খুব উত্তেজিত ছিল। খুব আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখছিল ও, আর ইচ্ছেমতো ছবি তুলে যাচ্ছিল কখনো পাহাড়ি নানা দৃশ্যের কখনো ঐশীর। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ফুটে ওঠা গোলাপি ফুল তুলে গুঁজে দিচ্ছিল ঐশীর চুলে। ওর এইসব ছেলেমানুষী তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল ঐশী। অদ্ভুত মনমাতানো এক শীতল হাওয়া ওদের দুজনের শরীর ও মনকে ভিজিয়ে দিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল কে জানে! ঐশী সেই অদ্ভুত আবেশ গায়ে মাখতে মাখতে হেঁটে যাচ্ছিল অনন্ত পথ। 

পাহাড়ের আবহাওয়া মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায় ঠিক মানুষের জীবনের মতো। বাঁকের পর বাঁক শুধু রহস্য। গত রাতে এখানে প্রবল বৃষ্টি ছিল, পিছল রাস্তাঘাট তার কিছুটা প্রমান দিচ্ছে। তবে এখন ঝলমলে রোদ উঠছে তার ওপর অদূরের রঙ্গীত নদী থেকে বয়ে আসা মিষ্টি বাতাস তো বইছেই। দূরে কোনো নাম না জানা ঝোরা থেকে অঝোরে জল পড়েই যাচ্ছে। তারই শব্দ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে পাখির কিচিরমিচির। পাহাড়ি বুলবুল নাকি হোয়াইট ক্যাপড রেডস্টার্ট ? গলা শুনে ঠিক ঠাহর করতে পারে না ঐশী। কিন্তু শব্দটা কানের ভেতর দিয়ে একবারে হৃদয়ে গিয়ে স্পর্শ করছে। পাহাড়ের সব অনুভূতিই স্বর্গীয়। 

ওরা উঠছে, উলটো দিক থেকে নেমে আসছে পাহাড়ি কিছু মহিলা।  পিঠে বেতের ঝুড়ি আর তাতে বোঝাই কুড়িয়ে নেওয়া টুকরো টাকরা লকরি। গায়ে জড়ানো জংলি ছাপের জামা আর লুঙ্গি। মাথাতেও ওই একই ধরনের কাপড় জড়ানো। অনির্বাণ পটাপট ছবি তুলে নিচ্ছে। ঐশীও ওদের সঙ্গে পোজ দিয়ে দাঁড়ালো। পাহাড়ি মানুষগুলোর কঠিন মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা সহজ সরল মন। ওদের হাসিমুখ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। অনির্বাণ ছবি তুলছে একের পর এক। স্মৃতিগুলো ধরে রাখছে ভবিষ্যতের জন্যে। ঐশীর শরীর খারাপ লাগলেও মন ভরে যাচ্ছে এক আশ্চর্য আবেশে। 

হাঁটতে হাঁটতেই আরও কিছুটা ওপরে ওঠে ওরা। অনির্বাণ সরু চোখে ছয় মাস পুরোনো বউয়ের দিকে তাকায়, আদর মেখে বলে, চলো এবার ফিরি। ঐশীরও তাই ইচ্ছে, তবু ও কিছুক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, চলো না ওইদিকটায় একটু যাই একটা মন্দির আছে মনে হয়। 

অনির্বাণ বলে, কী করে বুঝলে? ঘন্টা বাজল নাকি? শুনতে পাইনি তো! তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তোমার এই জায়গা আগে থেকে চেনা। 
কিছু একটা চিন্তা করছিল ঐশী। হঠাৎই যেন থতমত খেয়ে বলে উঠল, না, না ঘন্টা নয়, ওই দেখো প্রেয়ার ফ্ল্যাগ উড়ছে, তাতেই মনে হল আশেপাশে কোনো মন্দির বা মনাস্ট্রি আছে বোধহয়। 

প্রেয়ার ফ্ল্যাগ আবার কী? অনির্বাণ অবাক গলায় জানতে চায়। 

ঐশী সস্নেহে ওর বরের গালটা টিপে দিয়ে বলে, বুদ্ধু বরটা আমার কম্পিউটার ছাড়া আর কিচ্ছু জানে না! আরে পাহাড়ে পাহাড়ে ওই যে রঙিন কাপড়গুলো ঝোলানো থাকে না, ওগুলোই হল প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বা প্রার্থনা পতাকা। 

সে তো বুঝলাম, কিন্তু এগুলোর অর্থ কী? কেন থাকে তাও তো জানি না। বলো তো শুনি। অনির্বাণ বলে ওঠে। 

অল্প অল্প হাঁফাচ্ছিল ঐশী। তবু যুগলে এগিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ি পথ ধরে। আন্দাজটা ঠিকই করেছিল ঐশী। তবে মনাস্ট্রি নয়, একটা ছোট্ট মন্দির দেখা যাচ্ছে সামনেই। বড় বড় কতগুলো কালো পাথরের ওপর ছোট্ট একটা কাঠের মন্দির। সামনে দিকে টাইলসে বাঁধানো রাম সীতা লক্ষ্মণ আর হনুমানের ছবি। পাথরের ওপর ফুটো করে করে সরু সরু করে বাঁশ পুঁতে ওতেই লাল, নীল, হলুদ পতাকা ঝুলিয়ে রাখা। 

কালো পাথরটায় গায়ে সিঁড়ির মতো কয়েক ধাপ বানানো খোদাই করে। কাছে আসতেই বোঝা গেল মন্দিরটা পাথরের ওপর নয়, পেছনে। কিন্তু বানানোই এমনভাবে যে মনে হচ্ছে যেন ওপরে বানানো। অনির্বাণ ওই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল।  ঐশী চিৎকার করে বলল, সাবধানে পেছনে কিন্তু খাদ! অনির্বাণ উঁকি দিয়ে দেখে অবাক হল৷ সত্যি নিচে ভয়ঙ্কর খাদ। ও খাদের দিকে মুখ করে দু'হাত দু'পাশে মেলে ফিল্মি কায়দায় বলে উঠল, আই লাভ ইউ ঐশীইইইইই। মুহূর্তেই ওর এই চিৎকার হাজারগুন বেশি হয়ে ওদের কাছেই ফিরে এল৷ ঐশী একটু লজ্জা পেল, ওপর থেকেই মনে হল অনির্বাণের। ও এক পা এক পা করে নিচে নেমে এল ঐশীর কাছে।  
 
কালো পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। ঐশী বলল, এই যে চার কোণা আকৃতির রঙিণ কাপড়গুলো উড়ছে এগুলো পাহাড়ি এলাকার অন্যতম ধর্মীয় বিশ্বাস, জানো! লক্ষ্য করে দেখবে প্রতিটি কাপড়ে কাঠের ব্লকের ছাপ দিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য কিম্বা ছবি ছাপানো থাকে। পাহাড়ের লোকেরা মনে করে এই কাপড়গুলো পতাকার মতো ওড়ালে ঈশ্বরের করুণা বজায় থাকে। 

অনির্বাণ হাসে। ঈশ্বর দেবতায় ওর একেবারেই বিশ্বাস নেই। তবু ও আগ্রহভরে শোনে বউয়ের কথা। 

ঐশী বলে চলে, দেখবে বা দিক থেকে ডান দিকে মোট পাঁচটি রঙের সেট থাকে, পাঁচটি খাঁটি রঙ। এইসব অঞ্চলের মানুষরা মনে করে পতাকাগুলো যা কিছু লেখা আছে সেইসব বাণী বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে চারিপাশে। বৌদ্ধরা যেমন মনে করেন এর ফলে অহিংসার কথা ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। অবশ্য সেই অতীশ দীপঙ্করের আমল থেকেই এই বিশ্বাস জড়িয়ে রাখে এই পাহাড়ি মানুষগুলোকে। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস নেয় ঐশী৷ 

পাহাড়ের সব কিছু জানো না? অনির্বাণ ঐশীর কপালে হালকা টোকা দিয়ে বলে। 

জানোই তো পাহাড় আমার কত্ত প্রিয়। বাবার সঙ্গে এইসব পাহাড়ের আনাচেকানাচে ঘুরে বেরিয়েছি কত। তখন তো এত হোম স্টে, রিসর্টের বাড়াবাড়ি ছিল না, ছিল না এত মানুষের আনাগোনা। প্রকৃতি ছিল নির্ভেজাল, এখানকার মানুষগুলোর মতোই সহজ সরল, অনাঘ্রাত। 

খুব সুন্দর বললে তো! অনির্বাণ মুগ্ধ হয়ে তাকায় ওর স্ত্রীর দিকে। মাঝেমাঝে এই মেয়েটাকে পাহাড়ের মতোই দুর্বোধ্য মনে হয়, আবার অনেক সময় হালকা, নির্ভার ওই নাম না জানা ঝোরাগুলোর মতো। 

ঐশী এক দৃষ্টিতে উড়তে থাকা পতাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনির্বাণ ওকে বিরক্ত করে না। কাঁধে ঝুলতে থাকা ডি এস এল আর দিয়ে বন্দি করে ফেলে নানান মুহূর্ত, দৃশ্য। 

পাহাড় কত রুক্ষ, তাও কত সুন্দর না? ঐশীর কথায় এদিকটায় ফিরে আসে অনির্বাণ। ঐশী বলতেই থাকে, জানো মনে হয় যেন এই পাহাড়ই আমার সব। এখানে এলেই আমি প্রাণ খুঁজে পাই। 

অনির্বাণ ওর কাঁধে আলতো হাত রাখে। ঐশী ধীর গলায় বলে, এখানে এলে আমি বাবার গন্ধ পাই। জানি বাবাও এদিকেই কোথায় কোনো দূর পাহাড়ের ভাঁজ থেকে আমায় ঠিক দেখছে। 

অনির্বাণ ঐশীর বাবার ঘটনাটা জানে, ট্রেক করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল পাহাড়প্রেমী মানুষটা। ঐশীও ট্রেক করত, কিন্তু বাবার এই ঘটনায় ওর মায়ের অনিচ্ছের জোরেই সেসব বন্ধ হয়ে যায়। বিয়ের আগেই এসব কথা জানত অনির্বাণ। তাই তো হানিমুনের জন্য পাহাড়ি এলাকাই বেছেছিল ও, অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। হাঁটতে হাঁটতে যেন ঐশী খুঁজছিল ওর বাবাকে, বুঝতে পারছিল ও। পাহাড়ে এসে ভালো লাগছিল ওর, আর এতেই অনির্বান স্বস্তি পাচ্ছিল মনে মনে। 

ঐশী ঘোর লাগা গলায় বলে উঠল, জানো বাবা আর আমি ওই প্রেয়ার ফ্ল্যাগের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতাম। হাত জোর করে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। পতাকাগুলো হাওয়ার উড়ত আর আমাদের মনে হত সব প্রার্থনা পৌঁছে গেল ঈশ্বরের কাছে। 

পরিবেশটা হঠাৎই কেমন ভারি হয়ে গেল। অনির্বাণ তা হালকা করার জন্য বলে উঠল, তা ম্যাডাম কী প্রার্থনা করতেন? আমার মতো বর পাওয়ার? কথাটা বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল অনির্বাণ। কিন্তু ঐশীর মুখে হাসি নেই। অনির্বান ওকে ঠেলে দিয়ে বলল কী ভাবছ এত? 

ঐশী অদ্ভুত অচেনা চোখে তাকালো অনির্বানের দিকে। অনির্বাণ ঐশীর চোখ, মুখ এমন আগে দেখেনি কখনো। ওই অদ্ভুত চাহনিতেই অনির্বাণের চোখে চোখ রেখে ঐশী বলল, বাবার সে প্রার্থনা পূরণ হয়েছে জানো। শুধু আমারই...

কোন প্রার্থনা? কী পূরণ হয়েছে? ঐশীর কথায় কেমন যেন লাগে অনির্বাণের। ঐশী হাসে, অথচ সে হাসিতে কোনো উচ্ছ্বলতা নেই, উচ্ছ্বাস নেই। ঐশী যেন এখন কোনো পাহাড়ি ঝরনা নয়, এক শান্ত সমাহিত গভীর নদী যাকে বোঝা আরও শক্ত। 

বাবা পাহাড়েই মিশে যেতে চেয়েছিল। যাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি মৃত্যুর পর তার কোলেই বিলীন হয়ে যাওয়া... ঐশী ধীর গলায় বলে থামল কিছুক্ষণ। 

অলক্ষ্যে সামান্য কেঁপে উঠল অনির্বাণ। পাহাড়ি হাওয়া গায়ে লাগছে এবারে। কাঁটার মতো বিঁধছে। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য ও বলে উঠল, কাল রাতে কী বলতে চাইছিলে? 

ঐশী যেন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ওই মুহূর্তে যেন সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ ও। অনির্বাণ আবার বলে ওঠে, কাল রাতে বললে না, আজ একটা খবর জানাবে? কী সেটা? 

ঐশীর ডানহাতটা নিজের পেটের ওপর রাখে। তারপর অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না, না? যাওয়ার আগে বলেছিল ফিরে এসে একটা খুশির খবর দেবে, সেটা কী আজও জানা হল না। খুব জানতে ইচ্ছে করে জানো! 

আচ্ছা, আচ্ছা হয়েছে। এবারে চলো ঘরে ফেরা যাক। খিদেও পেয়ে গিয়েছে। অনির্বাণ বলে ওঠে। 

ঐশী বলে, মন্দিরে প্রণাম করে আসি তবে! 

পারবে? শরীর ভালো লাগছে না বলছিলে না! অনির্বাণ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় ওর দিকে। 

ঐশী হাসে। অনির্বাণ জানে এই হাসির অর্থ। ও বোঝে কয়েক বছরের অনভ্যাসেও পাহাড় এতটুকু অচেনা হয়নি ঐশীর কাছে। হাফ ধরলেও বেশ তাড়াতাড়িই ওপরে উঠে যায় ঐশী। একটু একটু করে এগোয় মন্দিরের দিকে। অনির্বাণ চিৎকার করে বলে, বেশি এগিয়ো না, সামনে খাদ। পটাপট কয়েকটা ছবি তোলে ও ঐশীর ও আশেপাশের। ঐশী দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটার সামনে, প্রার্থনা করছে হয়ত। অনির্বাণ এক ঝলক দেখেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। উলটো দিকের দৃশ্যাবলী ভরে নিতে থাকে ক্যামেরার মেমোরিতে। 

দূরে ঝোরার আওয়াজ আর দু'চারটে পাখির ডাক। হঠাৎ হঠাৎ দু একটা করে গাড়ি যাচ্ছে, আসছে হর্ণ দিতে দিতে। এরই মাঝে ঝপ করে একটা আওয়াজ পায় অনির্বাণ। পলকে ঘাড় ঘুরিয়েই দেখে ঐশী নেই। চারপাশ যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। অনির্বাণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশ্চুপ, নিঃশ্চল। 

হাসপাতালের বেডে যখন নিজেকে আবিষ্কার করে তখন ওর সামনে ঐশী নেই কোথাও। নিজের বাবা, মা, ভাই আর ঐশীর মা। সবাই কাঁদছে। শুধু অনির্বাণের চোখে জল নেই। ও কেমন অদ্ভুতভাবে সবার চোখের দিকে তাকায়, হয়ত ঐশীকে খোঁজে, কিন্তু ও তো কোথাও নেই, কোত্থাও না। 

একটু সুস্থ হলে ঐশীর মা জানায়, এই কারণেই পাহাড় যেতে বারণ করতেন তিনি৷ সারাদিন শুধু একই কথা, বাবা কী কথা বলতে চেয়েছিল সেটা শোনা হল না। বাবা তো এমন করে না কখনো। মেয়েকে দেওয়া কথা বাবা রাখবেই। তাইতো সে কথা শুনতেই মেয়ে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে পাহাড়ে। ওর খোঁজ এতদিনে হয়ত মিটেও গেছে৷ ঐশীর মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অনির্বাণের শ্বাস পড়ে না। ও শুয়ে থাকে মড়ার মতো, নিথর। 

পাহাড় এভাবেই হয়ত মানুষকে টানে। আগে ঐশীর বাবাকে টানত, পরে ঐশীকে, আর এখন অনির্বাণকে। দশ বছর ধরে তাই অনির্বাণ পাহাড়ে পাহাড়ে এই একই উত্তর খুঁজে চলে।  যদি কোথাও ঐশীর দেখা মেলে, যদি ওই পতাকায় গায়ে ওর প্রশ্নের দমকা হাওয়া এসে ঐশীকে জাগিয়ে দিয়ে যায়! ঐশী কি সেদিনও বলবে না, সেই রাতে ও কী বলতে চেয়েছিল?

পাগলবাবু এখন তাই মাঝেমধ্যেই পাহাড়ে আসে। যেখানেই ওই প্রেয়ার ফ্ল্যাগ ওড়ে হাঁটু মুড়ে বসে যায় ও। চোখ বুজে ওর প্রার্থনা পৌঁছে দেয় ঈশ্বরের কাছে। 

সেদিন রাতে পাহাড়ের এক  ভাঙা ঘরে বসে অনির্বাণ স্বপ্ন দেখে। এক সুন্দর রিসর্টে বসে আছে ওরা দুজন। ঐশী আর অনির্বাণ। ঐশী  চোখদুটো আলতো করে বোজে, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে নিজের জীবনকে মিশিয়ে নিয়েছে ও। আজ এই মুহূর্তে ওর চোখেও লেগে আছে অনির্বাণর স্বপ্নের পেলব পরশ। ও বিশ্বাস করে, ওদের দুজনের ভালোবাসার জোরে সেই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই। আর সেদিন ওরা ড্রাইভ করে চলে যাবে দার্জিলিঙের ছোট্ট গ্রাম মাঙ্গওয়ার হোম স্টেতে, যার একদিকে নাথুলা রেঞ্জ অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই হোম স্টেতে যেখানে হামিমুনের পর আর যায়নি অনির্বাণ। সেই রিসর্টে বসেই সেদিন ওরা এমনই প্রথম দেখা হওয়ার দিনের অথবা অন্য কোনোদিনের স্মৃতিচারণ করছে হাতের ওপর হাত রেখে।  ঐশী অনির্বাণের কানের কাছে মুখ এনে বলে ওঠে, তুমি বাবা হতে চলেছ। 

অনির্বাণ খুশিতে জড়িয়ে ধরে ঐশীকে। ঐশী গায় ওর মায়ের থেকে শেখা গানটা, 'এমনই বরষা ছিল সেদিন, শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন, তব হাতে ছিল অলস বীন', আর অনির্বানও ওর বেসুরো গলায় সুর মেলাচ্ছে ঐশীর সঙ্গে আর প্রিয়তমার চিবুকটা ধরে বলে উঠছে, 'মনে কি পড়ে প্রিয়?'

কাছেপিঠের কোনো পাহাড়ী রাস্তায় লাল, নীল, সবুজ, হলুদ প্রার্থনার পতাকা হাওয়ায় পতপত করে উঠবে। অনির্বান আর ঐশীর এইটুকু চাওয়া কি ওই প্রার্থনা পতাকা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দেবে না ?  অনির্বান খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ওর দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ের গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে ঐশীর কাছে গিয়ে পৌঁছায় কিনা কে জানে ?

পাহাড়ে আধো অন্ধকারের ভাঙা এক ঘরে চোখ খুলে শুয়ে থাকে একা অনির্বাণ। এই পাহাড়ে কখন ভোর হবে কে জানে!







এবং যতোদূর জানি

ভী ষ্ম দে ব  বা ড়ৈ

ঐশ্বর্য! পাশের কলেজে পড়ে। অনিমেষ জানতে পারে তার মাসতুতো বোন সুমিত্রার কাছ থেকে। ভীষণ দুরন্ত আর চঞ্চল। টেরাকাটা কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। লাভ-লকের বিলম্বিত পটভূমি তার আয়ত চোখের বেলাভূমিকে সর্বদা ঢেকে রাখে।  উজ্জ্বল টানা টানা চোখ, কপালের আড়াআড়ি উজ্জ্বল টিপ--- কোন দিন সবুজ, কোনো দিন নীল, কোন দিন চন্দন-আভা রঙ। নীল রঙের শাড়ি তার ভীষণ পছন্দ। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কলারঅলা ব্লাউজ আর টিপ। মেয়েটি এ যাবৎ রবীন্দ্র, শরৎ, বিভূতি, মানিক, নজরুল মিলে শ'খানে নভেল পড়ে ফেলেছে। ত্রিশোত্তোর প্রায় সব আধুনিক কবিদের কবিতা তার মুখস্ত। চঞ্চলতার প্রচ্ছন্নতার মাঝে একটি সীমারেখা মেনে চলে সে। তুখোড় বিতার্কিক। ছেলেরা তাকে মনে মনে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু গা ঘেঁষতে ভয় পায়। মাসতুতো বোনের কাছ থেকে তার কথা শুনে অনিমেষ মনে মনে ভীষণ ঐশ্বর্যের প্রেমে পড়ে যায়। অনিমেষ কবি এবং সঙ্গীত শিল্পী। অনিমেষ মনে মনে গুনগুন করে গান গায়- 'তোমায় চোখে দেখার আগে তোমার স্বপন চোখে লাগে, বেদন জাগে গো--- না চিনিতেই ভালোবেসেছি।'

কলেজের এক বিতর্ক সন্ধ্যায় অকস্মাৎ তাদের দু'জনের মুখোমুখি দেখা হয়। দু'জনে বিপরীত দলের দলপতি, প্রধান বক্তা। কি প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের লাবন্য! নীল শাড়িতে স্বর্গের দেবযানী! অনিমেষ অন্তর্মুখী মানুষ, আর কোন দিন তার সাথে দেখা হয়নি। অনিমেষ নীল রঙের একটি ডায়েরিতে কবিতা লিখে চলে, তার অনাগত ঐশ্বর্য নামে। মেঘদূত জমিয়ে তোলে মনের চেরাপুঞ্জিতে। 

দু'বছরের মাথায় মাসতুতো বোন সুমিত্রা একদিন বলল- জানো দাদা, ঐশ্বর্যের অমতে তার বাবা তাকে এক অধ্যাপকের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো, বছর দুয়েক সংসার করার পর তার স্বামী হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যায়। ঐশ্বর্য এখন বিধবা, একটি কোলের শিশু নিয়ে ভীষণ অসহায়! অনিমেষ তার নীল ডায়রিতে কবিতা লিখে চলে। মনের ভাষা চোখের জলে ভিজে যায়।

চাইলেই হয়তো পারতো কিন্তু, সংসার, সমাজ আর লোকলাজের ভয়ে অনিমেষ কোন দিন তার কাছাকাছি যেতে পারেনি। আমরা জানতে পারি অনিমেষ আর কোন দিন বিয়ে করেনি। হঠাৎ একদিন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায় অনিমেষ। বছর বিশেক পরে অনিমেষ ট্রেনযোগে ফেরার পথে অদূরে ট্রেনের কামরায়, এক তরুনকে নিয়ে এক পরিশুদ্ধ বিধবা, একটু ব্যতিক্রম, একটু আলাদা- তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যতা চোখে পড়ার মতো। তরুনটি 'মা' বলে তাকে সম্বোধন করছে। তিনি একমনে পড়ছেন মৈত্রেয়ী দেবীর নহন্যতে। বেঞ্চিতে পাশেই গুছিয়ে রাখা গীতাঞ্জলি, তিথি ডোর, কাছের মানুষ, প্রথম আলো। ছোট সাউন্ডে বাজছে এইচএমভির রেকর্ড প্লেয়ারে- অখিলবন্ধু ঘোষের গান! ভদ্রমহিলা শরতের বিচ্ছিন্ন অবকাশ ঠেলে উদাস মনে অসীম আকাশের দিকে বারবার চাইছিলেন। ফাঁকে ফাঁকে অনিমেষকেও লক্ষ্য করছিলো।  ট্রেন চলছে---

দু'স্টেশন বাদে অনিমেষ নেমে গেল। কিন্তু মনের বেখেয়ালে ট্রেনের কামরায় রেখে গেল আজীবনের সাথী কবিতার 'নীল ডায়েরী'। ঐশ্বর্য লক্ষ্য করলো। কিন্তু যখন লক্ষ্য করলো, ততক্ষণে অনিমেষ অলক্ষ্যে চলে গেছে। ঐশ্বর্য ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলো। একটু ভিতরে চোখ পড়তেই ঐশ্বর্য প্রায় পঁচিশ বছর আগের স্মৃতিতে ফিরে গেল, কলেজের সেই বিতর্ক সন্ধ্যার আপাদ বর্ননা। অনিমেষ অংশগ্রহনকারী সবার নাম লিখে রেখেছিল ডাইরীর প্রথম পাতায়। ঐশ্বর্যের নাম লেখা ছিলো- সোনালী কালিতে একটি আলাদা পাতায়। ঠিক নিচে একটি গোলাপ ফুল, তার নিচে- একটি তিন লাইনের ইংরেজী কবিতা-
"It's our first meet,
I meet with heart,
Your shadow writes a poem
In my eyes."

-To Aishwarja

ডায়েরীর কোথাও ঠিকানা পাওয়া গেল না। ঐশ্বর্য কাঁদছে। অনন্তের পথে চলছে ট্রেন---

কয়েক মাস পরে মাসতুতো বোন সুমিত্রা অনিমেষের পুরানো ঠিকানায় চিঠি লিখলো- 
দাদা, ঐশ্বর্য পুনরায় নিজের ইচ্ছেতে আবার এক বয়স্ক লোককে বিয়ে করেছিলো। স্বামী জলধর রায় চৌধুরী, বিশাল এক ওষুধ কোম্পানীর মালিক। এর আগে একটি সংসার ছিলো, বউ-বাচ্চা ছিলো। ঐশ্বর্যকে আলাদা বাসা ভাড়া করে দিয়েছিলো জলধর। অনেকটা টাকার জোরে আলাদা সংসার পেতেছিলো। কিন্তু কোন দিন ঐশ্বর্যকে স্বীকৃতি দেয়নি, মন থেকে ভালোবাসেনি। জলধর ছিলো অ্যাডিক্টেড। মোহ কেটে গেলে জলধর ঐশ্বর্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিরুপায় ঐশ্বর্য সবেধন নীলমনি ছেলেকে নিয়ে অজানার পথে নিরুদ্দেশ হয়েছে। কেউ আর তার খোঁজ পায়নি! 

অনিমেষ দু'মাস পরে পুরানো আস্তানায় গিয়ে চিঠিখানা পেল। পৃথিবীর সমস্ত হাহাকারে আজ এতো বছর পরে যেন ঐশ্বর্যের জন্য মন প্রাণ কেঁদে-কেটে একাকার হয়ে যাচ্ছে। যে ঐশ্বর্যের কপালে অনিমেষ একদিন রাজটীকা দেখেছিলো- সে আজ দ্বিতীয় বৈধব্য নিয়ে এক ফেরারী ভিখারিনী! 

অনিমেষ পৃথিবীর তল হারিয়ে আবার অতলে হারিয়ে গেল! নিরুদ্দেশ অনিমেষ! নিরুদ্দেশ ঐশ্বর্য!  

আমরা ঐশ্বর্য বা অনিমেষের আর কোন খোঁজ জানতে পারিনি। অবশেষে অনিমেষ আর ঐশ্বর্য অন্তঃহীন নিরুদ্দেশের পথে এক হতে পেরেছিল কিনা তাও আমাদের অজানাই থেকে গেল! কতো ঐশ্বর্যরা এখনো এভাবেই রাত-দিন কেঁদে চলছে সময়ের নিয়মে, এ পৃথিবীতে কে কার খোঁজ রাখে-----?






নীতা এবং একটি না-বলা গল্প

র থী ন্দ্র  না থ  রা য়
 
নীতা এবং সুজাতা একপ্রকার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সেই স্কুলবেলা থেকেই দুজনের একসঙ্গে ওঠাবসা, একসঙ্গে পড়াশোনা। দুজনেই দুজনের কথা একে অপরকে না বলে থাকতে পারেনা। এমনকি একজন নিজের সুখের ভাগ অপরজনকে না দিয়ে থাকতে পারেনা। কিন্তু সুজাতার বিয়ের ব্যবস্থা হতেই একটা আশঙ্কা পেয়ে বসে নীতাকে। এবার তাকে একা একা ঘোরাফেরা করতে হবে। নিজেকে বোঝায় বন্ধুকে দিয়ে তো জীবনের সব প্রয়োজন মেটেনা। সুতরাং- সুজাতার কাছ থেকে নিজেকে বেশ কিছুটা সরিয়ে নিয়ে পড়াশোনায় মন দেয় সে। এম এ'র পরীক্ষা সামনেই। অতএব পড়াশোনার মধ্যেই ডুবে যায় সে। ইতিমধ্যে সুজাতার বিয়ের দিনটা এসে পড়ে। ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হল। বিশেষতঃ সুজাতার ভাই সুজন বারবার ওকে ডাকতে আসল। আসলে সুজনের জন্যই -- নাহলে আবার ও বিরক্ত করবে। এই ভয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসল নীতা। বিয়েবাড়ির প্রায় প্রত্যেকটি মেয়েই সেজেছে। একমাত্র সে ছাড়া। সুজন একপ্রকার জোর করেই তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। সেজন্য ওর ওপরেই রাগ হয়। 

সুজাতাও কেমন যেন বদলে গেছে। কথা বলল বটে। কিন্তু সে উত্তাপ ছিলনা। কেমন যেন একটা নিয়মরক্ষার মতো। কোনও রকমে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরে আসে নীতা। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ পাত্রপক্ষের বাড়িতে প্রীতিভোজের নিমন্ত্রণে ওকে যেতেই হল। না গিয়ে উপায় ছিলনা। সুজন বিকেল থেকে এসে বসেছিল। ওর ঘরে এসে বলল, তোমাকে আজ সাজতেই হবে। 

কথা রেখেছিল নীতা। বাসে ওঠার আগে সুজন বলল, ফাইন ! দেখো , তুমি আজ কারোর প্রেমে পড়বেই। 
--যাঃ, বড্ড ফাজিল হয়েছিস ! 
কৃত্রিম রাগ দেখাল মিতা। কিন্তু সবসময় সুজনের কাছে কাছেই রইল। সুজাতা বেশ খুশি হল নীতাকে দেখে। বলল, বিয়ের দিন তোর সঙ্গ ভালো করে কথা বলতে পারিনি। কিছু মনে করিসনি তো?
--না, না; মনে করব কেন? কিন্তু মুখে কিছু না বললেও ভেতরে অখুশিই হয়েছে সে। নতুন মানুষকে কাছে পেয়ে সুজাতা বুঝি একেবারেই পাল্টে গেছে। 
সুজাতা সেদিন বড্ড ব্যস্ত। ফেরার সময়ে আরও কাছাকাছি হল সুজন। বাসের মধ্যে পাশাপাশি বসেছিল ওরা। নীতার মনটা বেশ ভারাক্রান্ত ছিল। এটা বুঝতে পেরে সুজন আরও কাছে এল। বলল, দিদির জন্য কষ্ট হচ্ছে না? --না, না। তা কেন হবে?  --আমি বুঝতে পেরেছি। 

ওর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল সুজন। নীতার মনে হল সুজন বুঝি সুজাতাই। বয়সে বেশ কিছুটা ছোট হলেও ওর সারল্যের জন্য বেশ ভালো লাগে ওকে। দিনে দিনে সুজনের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা বেড়েই চলল। নীতার যেন ওকে ছাড়া একদিনও চলত না। ওকে যে কোনও সময় ডেকে পাঠাত। এমনকি যে কোনও সময় ওর কাছে চলেও যেত। এতে ওদের দুজনের পরিবারের কেউ কিছু মনে করতনা। 

ইতিমধ্যে নীতার পরীক্ষা হয়ে যেতে মেলামেশার পরিমানটা বাড়ল বৈ কমলনা। একদিন সুজনের সঙ্গে দেখা না হলে বেশ খারাপ লাগত নীতার। সুজন যেন ওর মনের সবটুকু দখল করে নিয়েছে। সেদিন সুজন এল নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা পরে। অন্যদিনের মতো ততোটা উচ্ছ্বলও ছিলনা। কেমন যেন উদাসীন। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বললনা। ওকে নিয়ে পার্কে এল নীতা। ভাবল যদি ওর উদাসীনতা কেটে যায়। পার্কে ঘুরতে ঘুরতে নীতা বলল, কি হয়েছে আমাকে বলবেনা ?
--না মানে, কিছু হয়নি তো।
--এড়িয়ে যাচ্ছো?
সুজন চেয়ে থাকে নীতার দিকে।
সুজনের মনে হয় নীতা যদি তার ক্লাসের শিপ্রা হত? তাহলে? দূর, তাই কি হয়?

পাশ দিয়ে কয়েকটা মেয়ে চলে যায়। ওদের মধ্যে একজন মন্তব্য করল, শুধু দেখে যা। সুজনের মনে হল এর প্রতিবাদ করে।
নীতা ওর বাঁ হাতটা ধরে বলল, না।

একটু নিরিবিলিতে গিয়ে বসল ওরা। বেশ কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে নীতা বললে, তাহলে তুমি আমাকে বন্ধু বলে মনে করোনা?
সুজন অবাক হয়। দিদির বন্ধু কি তার বন্ধু হতে পারে? বিষ্ময়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে। ক'দিন আগে শিপ্রাকে কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু সে শোনার আগেই বলেছিল, আই হেট ইউ। খুব মুষড়ে পড়েছিল সুজন। ভেবেছিল আর কাউকে কিছু বলবেনা। কোনও মেয়ের দিকে আর চোখ তুলে চাইবেনা। কিন্তু নীতা বুঝি তাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। 
ইতিমধ্যে সারাটা আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দে ঝড় উঠতেই ওরা টের পেল। সুজন বলল, চলো ফেরা যাক। নীতা বলল, না, ফিরবনা আজ। 
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতেই পার্কটা প্রায় ফাঁকা হয়ে এল। একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে রইল নীতা। সুজনের অনুরোধ সত্ত্বেও সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সুজন বলল, বৃষ্টিতে ভিজে যদি শরীর খারাপ হয়? --বেশ হবে! ক্রমে বৃষ্টি আরও জোরালো হল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে অসংখ্য বৃষ্টিকণা ভিজিয়ে দিল ওদের। সুজন বৃষ্টিভেজা নীতার দিকে চেয়ে রইল। সে যেন তার কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা এক জলছবি। 

সেদিন সন্ধ্যার বেশ কিছুটা পরে ঘরে ফিরল নীতা। মায়ের কাছে বকুনিও খেল। কিন্তু সুজনের কথা ভুলতে পারলনা। সুজন যেন তার চিন্তায়, চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিন রাত্রেও কিছুতেই ঘুমাতে পারলনা সে। চোখের পাতা বন্ধ করলেও সুজনের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু পরপর ক'দিন সুজনের সঙ্গে দেখা হলনা। একটা ভয় হতে থাকল। সুজন ওকে ভুল বুঝলনা তো? ইতিমধ্যে ওর মাসতুতো বোন মেঘনা বেড়াতে এল ওদের বাড়িতে। ও বড্ড ডেসপারেট আ্যণ্ড স্মার্ট। সাজপোশাকেও বেপরোয়া। জীবনবোধেও তাই। ওর মতে এনজয়মেন্ট যদি করতেই হয় তাহলে বিয়ের আগেই করা উচিত। নীতাকে বলে, তুমি বড্ড সেকেলে। না করলে প্রেম, না করলে এনজয়মেন্ট। নীতা রুষ্ট হয়। কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। 
মেঘনাকে নিয়ে একদিন সিনেমায় যেতে হল। হলে গিয়ে আশ্চর্য হল সে। সিনেমাহলের লাউঞ্জে একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছে সুজন। নীল জিনস আর সাদা সার্টে ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ওর খুব কাছে এসে নীতা বলল, কি ব্যাপার, ক'দিন দেখা করনি যে? জবাব দিলনা সুজন। নীতা মেঘনার সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিল। মেঘনা ওর করমর্দন করে বলল, হাই। 
সুজনের ইচ্ছে না থাকলেও প্রত্যুত্তরে বলল, হাই! সুজন দেখল মেঘনাকে। বড্ড বেপরোয়া ওর সাজ। যেন একটা আবেদন ছড়িয়ে রয়েছে ওর সর্বাঙ্গে। অপরদিকে নীতা শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর। ওদের সঙ্গে পাশপাশি বসে ছবি দেখল সুজন। একসময় মেঘনা নীচুগলায় বলল, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো না তো?
--যাঃ! লজ্জা পেল নীতা। ওই ঘটনার ক'দিন পরে মেঘনা ফিরে যায়। কিন্তু যাবার সময় বলে, ডরো মত্! গো থ্রো! তোমার বন্ধু কিন্তু মানুষ হিসেবে বেশ ভালো। 
কিন্তু নীতার মনে হয় সুজন যেন তার কাছ থেকে ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছে। আর আগের মতো তাকে কাছে পায়না। ফলে হারানোর একটা আশঙ্কা বাড়তেই থাকে। 
সুজনও যেন কেমন হয়ে গেছে। নীতাকে ছাড়া সে কিচ্ছু ভাবতে পারছেনা। একটা অপরাধবোধও তাকে পেয়ে বসেছে। বয়সে বেশ ক'বছরের বড়। আবার দিদির বন্ধু। তবু তাকে একান্তে নিজের করে পেতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে হয়, " নীতা আই লাভ ইউ।" কিন্তু আবার ভয়ও হয় । শিপ্রার মতো নীতাও যদি ফিরিয়ে দেয়। বেশ কিছুদিন পর মন্দির থেকে ফেরার পথে নীতার সঙ্গে দেখা হল সুজনের। সুজন নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকে। নীতা বেশ লজ্জা পায়। সুজন বলে, খুব সুন্দর। নীতা বলে, আমার সঙ্গে আর দেখা করনা কেন? সুজন জবাব দিলনা। শুধু নির্নিমেষ নেত্রে চেয়েই রইল নীতার দিকে। ওর মনে হল সুজনের চোখদুটো বুঝি ওকে গিলে ফেলতে চাইছে। বুকের ওপর শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে বলে, আসবে বলো? --হাঁ।
ঘরে ফিরে নীতার মনে হল সে কি কোনও অন্যায় করছে? কিন্তু সুজনের ভাবনাকে কিছুতেই নিজের মন থেকে মুছে দিতে পারলনা। নিদ্রায়, জাগরণে-- সবসময় শুধু সুজনের কথা মনে হতে লাগল। ক'দিন পরে মোবাইলে একটা মেসেজ পেল নীতা। সুজন যা মুখে বলতে পারেনি, তা সে লিখে জানিয়েছে। " আমি জানিনা, এটা আমার ধৃষ্টতা কিনা, তবু আই লাভ ইউ ।"
আনন্দে ওর চোখদুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠল। পরদিন বাজার থেকে ফিরছে এমনসময় হঠাৎ দেখা হল সুজনের সঙ্গে। ক'দিনের না দেখায় মনে হল ও যেন বেশ কিছুটা রোগা হয়ে গেছে। আরও লম্বাও হয়েছে বলে মনে হল।
সুজন নীতার বেশ কিছুটা কাছে সরে এসে বলল, আগামীকাল বিকেলে আমাদের স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তোমাকে আসতেই হবে। --আসব। --আর একটা অনুরোধ, বলো রাখবে-- 
--অনুরোধ নয়, বলো আদেশ-- 
--না ঠিক ততোটা নয়। আমি ঠিক বলতে পারছিনা-- ব্যাপারটা হল শিপ্রা-- আমার ক্লাসমেট। ওর সামনে আমাকে কিস্ করতে হবে। 
--যাঃ! লজ্জিত হল নীতা। সুজনকে সে ভালোবাসে। তাকে সে সব দিতে পারে। কিন্তু কারোর সামনে? ছিঃ! সুজনের যেন লজ্জাশরম বলতে কিছু নেই। 
--প্লীজ নীতা। আমি বাজি ধরেছি। 
--অসম্ভব। চলে আসে নীতা। সুজনের প্রতি রাগ হয়। ঠিক করে সুজনের সঙ্গে আর কখনো সে কথা বলবেনা। কিন্তু পরদিন বিকেল হতেই আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। সাজল সে। এমনভাবে আগে কখনো সাজেনি। নির্দিষ্ট সময়ে সুজনের স্কুলে আসতেই দেখল অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। নাটক চলছে। ক্ষুদিরামের জীবন নিয়ে নাটক।‌‌
কিছুক্ষণ পরে সুজন আসল। বলল, জানতাম তুমি আসবে। 
-- কিন্তু আমি কাউকে বাজিতে জেতাতে পারবনা। আশাহত হল সুজন। চলে গেল সে। নাটক দেখছিল নীতা। কিছুক্ষণ পরে দুটো মেয়ে নীতার কাছে এসে পাশের চেয়ারে বসে বলল, এক্সকিউজ মি, তোমার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। 
ওরা কথা বলতে বলতে স্কুলের পিছনে বাগানে আসে। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে কোনও ভণিতা না করেই বলল, সুজন তোমার কথা আমাদের কাছে এতোবার বলেছে যাতে তুমি আমাদেরও চেনা হয়ে গেছো। --তাই? বাগানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখা হল সুজনের সঙ্গে। সে এড়িয়ে যেতে চাইছিল। নীতাই ওকে ডাকল। কাছে এসে দাঁড়াতেই নীতা ওকে একটা চুম্বন করে বলল, খুশি তো? মেয়েদুটি লজ্জিত হয়ে সেখান থেকে চলে গেল। পরদিন হঠাৎ সুজনের বাড়িতে এসে হাজির হল নীতা। আগেও এসেছে বহুবার। কিন্তু আজ আসতে গিয়ে কেমন যেন একটা ভয়ভয় করতে লাগল। বাড়িতে ঢুকেই মনে হল ফাঁকা ফাঁকা। সুজনের সঙ্গে দেখা হবেনা এরকম একটা আশঙ্কায় ফিরে আসবে এমন সময় ওপরের ঘর থেকে নেমে এল সুজন।বলল, ভাবতেই পারিনি যে তুমি আসবে। 
-- কেন? তুমি বাজি জিতেছ, পাছে তার জন্য কিছু দিতে হয়-- সেই ভয়ে? --না মানে, আমি কৃতজ্ঞ। বলো এর জন্য কি দিতে হবে? --জানিনা। সুজন ওর বাঁ হাতটা ধরে বললে, ইউ আর মাই হার্ট। নীতার মুখটা লজ্জায় রক্তিম হয়ে আসে। বুকের ভেতরটা ধকধক করতে থাকে। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আজ না।
একপ্রকার পালিয়েই আসল নীতা। আবার পরক্ষণেই মনে হল, কেন চলে আসল? ও তো সুজনের বাহুডোরেই বাঁধা পড়তে চায়। তবে?

সেদিন রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল নীতা। সুজনের সঙ্গে সে কোথায় যেন হেঁটে চলেছে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। চারদিকে শুধু অন্ধকার। একসময় মনে হল তার পায়ের নীচের থেকে কিছু একটা যেন সরে যাচ্ছে। আর সে অতল গহবরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে ডাকছে, সুজন, সুজন কোথায় তুমি? হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু স্বপ্নের কথা মনে করতেই আবার একটা ভয় পেয়ে বসল তাকে। যদি সুজন তার কাছ থেকে হারিয়ে যায়?
কিন্তু আশঙ্কাটা বাড়তেই থাকে। এখন সুজন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেনা সে। পরদিন সুজনকে ফোন করল নীতা। বলল, বিশেষ দরকার। মা আসতে বলেছেন। সুজনের ইচ্ছে না থাকলেও আসল। নীতাকে জিজ্ঞেস করল, মাসিমা কোথায়?
--সোনাডাঙায়, তাঁর মায়ের কাছে গেছেন। --তাহলে তুমি মিথ্যে বলেছ? --না হলে তো আসতেনা। 
সুজন একটু হাসল। নীতাকে আরও একবার জরিপ করল। সে তার চেনা। তবু আজ ওকে অচেনা বলে মনে হয়। একটা খুব হালকা নাইটি পড়েছে নীতা। এমন পোশাকে ওকে আগে কখনো দেখেনি। ওই পোশাকের নীচে এক নারী শরীরের অস্তিত্ব। সুজন চেয়ে থাকে নীতার দিকে। নীতা সুজনের দৃষ্টি থেকে বুকটাকে আড়াল করতে চায়।  কিন্তু সম্ভব হয়না। নাইটিটা এরকমই । বুকের বেশ কিছুটা অনাবৃতই থাকে। 
এগিয়ে আসে সুজন। বাধা দেয়না নীতা। সুজন ধীরে ধীরে ওর মুখটাকে তুলে নেয়। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয়। নীতা অনুভব করে ওর শরীরে এক পুরুষের স্পর্শ।  ওর চোখে জল। বলে, ডোন্ট ফরগেট মি। এরপর থেকেই নীতা কেমন যেন একটা বিজাতীয় ভয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। সে কি ঠিক করল? এক অসমবয়সী কিশোরকে ভালোবেসে ভুল করলনা তো? তার পরিবার যদি মেনে না নেয়? তবে কি করবে সে? নিদারুণ এক আশঙ্কায় তার আহার নিদ্রা সব কমে আসতে থাকে। বেশ শীর্ণ হয়ে পড়ল সে। 
কিন্তু হঠাৎ সেদিন একটা সংবাদ শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। ধানবাদের নিকট ভয়ঙ্কর এক রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে সুজন। 
নিজের ঘরে সবার অলক্ষ্যে সুজনের একটা ছবিকে বুকে চেপে ধরে বলল, সুজন আমি যে তোমাকে ভালোবাসতাম।






মঙ্গলালোকে

অ র্পি তা  মু খা র্জী  চ ক্র ব র্তী

আজ এখানে আসা থেকেই সুভদ্রার প্রায় ছায়া সঙ্গীনি হয়ে ছিলেন তিনি। না, কথা হয়নি একটিও তার সঙ্গে। তার চেহারা, সাজপোশাক সবকিছু ছাপিয়ে সহজ সরল মুখটি বারে বারে নজর কাড়ছিল সুভদ্রার। দশমীর সিঁদুর ছোঁয়ানোর সময়টুকুতে বারেবারে এই মুখ তার দিকে হাসিহাসি চোখদুটি মেলে ভিড়ের মাঝে টালমাটাল তার হাতে ধরা বরণের থালাটিকে সামলে নিয়ে প্রতিমাগুলিকে মিষ্টিমুখ করাতে সাহায্য করেছে। কখনোবা প্রদীপের শিখা বাঁচিয়ে শাড়ির আঁচলখানি নিপুণ হাতে গুঁজে দিয়েছে তার কোমরে। তাদের এই শহরের বেশ কয়েকটি বাসন্তী পুজোর মধ্যে শহরের বহু পুরোনো এই মন্দিরটির এই পুজোকে ঘিরে শহরবাসীর টান অনেকটাই।বাহুল্যবর্জিত ছিমছাম ঘরোয়া এই পুজোর চারটি দিনে তাই অঞ্জলি দেওয়ার জন্য যেমন  বহু মানুষের সমাগম হয়, তেমনই ভিড় হয় মাকে দশমীর  সিঁদুর ছোঁয়ানোর জন্যও।

না, চেনা কেউ নন ইনি।যদিও আজকাল সুভদ্রা চেনা কোনো কোনো মানুষকেও চট করে ঠাহর করতে পারেনা অনেক সময়।মুখটি খুবই চেনাচেনা লাগলেও নাম ইত্যাদির বিস্মরণ ঘটে দেখা হওয়ার সেই মুহূর্তটিতে। কিন্তু এ মানুষটির ক্ষেত্রে মুখটিই আনকোরা নতুন। বিশেষত্ব বিহীন নেহাতই সাদামাটা সধবা আর পাঁচটি মহিলার মতো হলেও একে আগে কখনো দেখেনি সে এটা নিশ্চিত। সেই মুহূর্তে বেশ দ্রুততার সঙ্গেই সকলে বরণ করে নিচ্ছিল মূর্তিগুলিকে। সালঙ্কারা বাসন্তী মাকে তার সন্তানসন্ততির সঙ্গে বরণ করে পান, মিষ্টি, সিঁদুর দেবার পর নাটমন্দিরের সামনের দিকে বসানো মা অন্নপূর্ণার দিকে এগিয়ে গেল সুভদ্রা। মায়ের কপাল, সিঁথি রাঙিয়ে দিল সিঁদুরে। কয়েকমাস আগের দুর্গাপুজোর কথা খুব মনে পড়ছিল। সেসময় মেয়ে পুজোর প্রতিটি আচারে প্রতিদিন তার সঙ্গে সঙ্গে ছিল। মেয়ে বলে, এগুলো ওর কাছে নিয়ম বা সংস্কার নয়। শুধুই নির্ভেজাল আনন্দ। কিছুদিন হলো একটি কাজে মেয়ে শহরের বাইরে অনেকটাই দূরে আছে। শরীরও খুব একটা ভালো নেই তার। সুভদ্রা সারাদিনের সব কাজের মাঝেও দূর থেকেই জড়িয়ে রাখে মেয়েকে। সংসার ফেলে রেখে মেয়ের একলা থাকার অস্থায়ী ঠিকানায় তার সঙ্গে চলে যাওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু মন পড়ে থাকে মেয়ের কাছেই। মনে পড়ছিল দুর্গাপুজোর দশমীর দিনটি। ভিড়ে কখনো একটু চোখের আড়াল হয়ে গেলেও মেয়ের গলার স্বর আশ্বস্ত করছিল সেদিন সুভদ্রাকে। 'এখানেই আছি মা..', 'আমি এদিকে বইখাতা ছুঁইয়ে নিচ্ছি..' 'ভিড়টা একটু কমলেই তোমার কাছে চলে আসছি..' 'পাশের কাউকে বলো থালাটা ধরে একটু সাহায্য করবে তোমাকে, মাকে বরণ করতে', 'প্রদীপ জ্বলছে, আঁচল সামলে রেখো ..' ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে সেদিন যেমন কথাগুলো ছাড়া ছাড়া হয়ে কানে আসছিল, আজও ঢাক বেজে উঠতেই কথাগুলো মনের মধ্যে বেজে উঠলো আবারও। নাটমন্দির জুড়ে তখন দলে দলে কয়েকজন করে এয়োস্ত্রী একে অপরকে সিঁদুর পরাতে ব্যস্ত। সুভদ্রাও এগিয়ে গেল সেদিকে। সিঁদুর বিনিময়ের মাঝে সেই মহিলাকে খুঁজে ফিরছিল সুভদ্রার চোখ, যিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়েও মাকে বরণের প্রায় পুরো সময়টাই সুভদ্রার সঙ্গে ছিলেন একান্ত আপনার হয়ে। এদিক সেদিক অনেক খুঁজেও তাকে আর পেলনা সুভদ্রা।

ব্যাগের ভেতরে রাখা মুঠোফোন জানান দিল কেউ মনে করেছে তাকে। ভিডিও কলে মোবাইলের স্ক্রিনে মেয়ের মুখ ভেসে উঠতে আনন্দে ভরে উঠলো মন। 
'খুব ভালো হয়েছে। মায়ের মুখটা দেখে নে একবার।' মায়ের পরিবারের সঙ্গে মাকে দেখিয়ে অন্নপূর্ণা মায়ের দিকে মোবাইলের ক্যামেরা ঘোরালো সুভদ্রা।
ততক্ষণে ভিড় উপচে পড়েছে দর্পণে মায়ের মুখ দেখবার জন্য। করজোরে মায়ের সিঁদুর মাখা মুখটির প্রতিবিম্বকে প্রণাম করলো সুভদ্রা। মায়ের মুখের ঠিক পাশটিতে সিঁদূরে মাখামাখি একটি মুখ উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল হঠাৎ। খুব চেনা লাগলো মুখটি। আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো ভিড়ের মাঝে, মেয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায়। মেয়েকেও  দর্পণে মায়ের মুখ দেখালো সুভদ্রা। আর অল্প সময় পরেই মায়ের নিরঞ্জন। দর্পণে মায়ের মুখে তখন বিষন্নতা। মেয়ের চোখও ছলছল করছে জলে। এর মাঝেই বলে উঠলো,
 'মনখারাপ কোরোনা মা। দূরে থেকেও সবসময় তুমি আমার সঙ্গেই আছো; আমার ইচ্ছে হয়ে, শক্তি হয়ে আর সমস্ত কাজের অনুপ্রেরণা হয়ে।' জলে ভরে এল সুভদ্রার চোখদুটিও। ঢাক বেজে উঠলো তালেতালে। প্রতিমার ম্লান মুখে এক টুকরো হাসির ঝিলিক অপার স্নেহ হয়ে খেলে গেল বিদায়ের শেষ লগ্নে। শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনিতে মুখরিত তখন নাটমন্দির। সুভদ্রার একেবারে পাশটিতে এসে তার কাঁধে হাত রেখে দর্পণে মায়ের মুখ দেখবার জন্য মুখ ঝুঁকিয়ে দিল কেউ।  দর্পণে মায়ের মুখ ছাপিয়ে আরও মুখের ছায়ার মাঝে সুভদ্রা দেখতে পেল সেই মুখখানি, যাকে একটু সিঁদুর ছোঁয়াবে বলে তার চোখ খুঁজে ফিরেছে। ঠিক তখুনি উপলব্ধি করলো খানিক আগে দর্পণে মায়ের মুখের পাশে এই মুখটিকেই দেখেছে সে। মুখ ঘুরিয়ে তাকানোর অবকাশেই সেই মুখ উধাও হলো। নিশ্চয়ই এই ভিড়েই কোথাও আছেন তিনি'..' মনে মনে বলল সুভদ্রা। আবার দর্পণে চোখ রাখতেই মায়ের মুখের সঙ্গে প্রায় মিলেমিশে সেই মুখটি নজরে এল আবারও। তার দিকে একমুখ হাসি নিয়ে চেয়ে আছে আলোমাখা সেই মুখটি। পেছনে ঘুরে তাকিয়েও কোথাও তাকে দেখতে পেলনা সুভদ্রা। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো এবার। কাঁধে যে স্পর্শটুকুর রেশ রয়ে গিয়েছিল তাতে মেয়ের ছোঁয়া পেল যেন হঠাৎই। 'মা','মা' ধ্বনি উঠলো ঢাকের আওয়াজ আর উলুধ্বনির সঙ্গে। বিস্ময়ের ঘোরমাখা সুভদ্রার ঝাপসা চোখের সামনে দর্পণে মায়ের মুখটি তখন একবার মহামায়ার মুখ হয়ে আবার সেই মহিলার আন্তরিক মুখটি হয়ে আবার তার নিজের মেয়ের মুখ হয়ে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছিল বারংবার।







নন্দিনী

স ঞ্চি তা  গো স্বা মী

জুলাই মাসের মাঝামাঝি। বিকেল গড়িয়ে চলেছে নিজের মতো। আজ সকাল থেকেই ধারা বর্ষণের জেরে শহর কলকাতার জনজীবন বিপর্যস্ত প্রায়। রাস্তায় যানবাহন , মানুষজন খুবই কম। বিভিন্ন রাস্তা ইতিমধ্যেই জলমগ্ন। নতুন করে শহর যেখানে ডালপালা মেলে দিচ্ছে, সেই সাজানো গোছানো রাজারহাটের এক বিশাল বড়ো ঝাঁ চকচকে অফিস বাড়ির ৬ তলার ওপর নাম করা আই টি কোম্পানির অফিস। বহুজাতিক সংস্থা। সুসজ্জিত অফিস রুমের ভেতর আনমনা হয়ে বসে আছে অরুণিমা... অরুণিমা সেন। সামনের বিশাল গ্লাস উইন্ডো দিয়ে দেখা যাচ্ছে অপূর্ব সবুজের সমারোহ। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খুশিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে বড়ো বড়ো গাছগুলো। সত্যি বলতে কি, এখান থেকে দেখে মনেই হয় না, এটা কলকাতা শহরের মধ্যেই। হয়তো আর বেশিদিন এমন থাকবে না, কারণ--- ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গল মাথা তুলছে খুব দ্রুত। তবুও, এখনও এই জায়গা শহরের বিশুদ্ধ অক্সিজেনের উৎস।

অরুণিমা আঠাশ বছরের ঝকঝকে তরুণী। এই অফিসের যথেষ্ট উঁচু পোস্টে আছে সে। তার একটু চাপা গায়ের রঙের সাথে নির্মেদ ছিপছিপে শরীর আর বড়ো বড় চোখের সুন্দর মুখশ্রী ভারী সুন্দর লাগে দেখতে। পরনে তার ফরমাল পোশাক। এই অফিসে এটাই নিয়ম। সবাইকেই ফরমাল পরেই আসতে হয়। নিজের টেবিলে বসে ভাবছে অরুণিমা। আজ তার কতো খুশির দিন। একটু আগেই সুখবরটা পেয়েছে সে। তার কোম্পানি তাকে প্রমোশন দিয়ে আমেরিকার ওয়াকোহামায় পাঠাচ্ছে। একবারে দু'ধাপ প্রমোশন পাচ্ছে সে। অনেকটাই স্যালারি হাইক হবে তার। আহহহ... এই তো সে চেয়েছিল এতদিন। আদ্যন্ত ক্যারিয়ারিস্ট মেয়ে সে। অনেক কষ্ট করে নিজেকে ঘষে মেজে তৈরি করেছে এখানে আসার জন্য। বলতে গেলে কেউ তার পাশে ছিল না। কিন্তু... অনেকগুলো ভাবনা তাকে পিছু টানছে।

বাবা মায়ের প্রথম সন্তান সে। আদরের ছিলো অবশ্যই। তার যখন পাঁচ বছর বয়েস, তখন তার একটি ভাই হলো। ভাই জন্মানোর জন্য খুব খুশি হয়েছিল সে। খেলার সঙ্গী হলো একটা। কিন্তু, আস্তে আস্তে তার বাবা মায়ের ব্যবহার বদলে যেতে লাগলো। বিশেষ করে তার মা... কী অদ্ভুত পরিবর্তন!! ঐ ছোট্ট বয়সেও সে বুঝতে পারতো মা আর তাকে ভালোবাসে না। সে আদর করে ভাইকে কোলে নিতে গেলেও মা হা হা করে ছুটে আসতো। অরু নাকি ভাইকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দিচ্ছে। বড়ো হবার সাথে সাথে খাওয়া পড়া সব কিছু নিয়ে শুরু হলো বৈষম্য। ভাইয়ের জন্য বড়ো মাছ, ফল ভালো ভালো খাবার। আর, সে পেতো সব ঝরতি পরতি জিনিস। হয়তো মা কোনো সময় দু'জনকে নিয়ে খাওয়াতে বসতেন, ভাই পেতো সত্যিকারের ডিম। আর অরু কে শুধু ডিম ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে খাইয়ে দেওয়া হতো। বাবা যদিও বা কোনো সময় কিছু দিতেন, মা দেখলেই রাগারাগি করতো। ওর পেছনে কী জন্য পয়সা খরচ করছো? সেই তো বিয়ে দিতে এক কাঁড়ি টাকা খরচ করতেই হবে। তার ওপর রং কালো। ওকে বেশি লেখাপড়া শেখানোর দরকার নেই। বয়েস হলে আরো কুশ্রী হয়ে যাবে। যতো তাড়াতাড়ি পার করা যায় ততই ভালো। অরু চুপচাপ শুনত। কষ্ট হতো খুব। মনে মনে ভাবে, কেনো এমন করে মা বাবা? সে তো কোনো অপরাধ করেনি। ভাই অবশ্য খুবই সুন্দর দেখতে। ভাইয়ের নাম অনির্বাণ। মায়ের দেখাদেখি ভাইও দিদিকে হেলা তুচ্ছ করে। অরু কিন্তু লেখাপড়ায় ভীষন ভালো। প্রতি ক্লাসে প্রথম হয় সে। এইভাবে চলতে চলতে যখন অরু মাধ্যমিক দেবে, তার কিছুদিন আগে তার বাবা একটি রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। একটি মাঝারি মানের বেসরকারি চাকরি করতেন উনি। অগাধ টাকা না থাকলেও মোটামুটি সংসার ভালোই চলে যেতো। কিন্তু, ওনার অকাল মৃত্যুতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পরিবারের ওপর। অরুদের তেমন আত্মীয়-স্বজনও নেই। যারাও বা ছিলেন, সাহায্য করার ভয়ে সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লো অরুর মা... নীলিমা দেবী। ইতিমধ্যে অরু মাধ্যমিক দিলো। পরীক্ষা তার ভালোই হয়েছে। সে শুরু করলো টিউশন পড়ানো। তার বাবার অফিস থেকে এককালীন কিছু টাকা পাওয়া গেলো। আর, তাদের নিজেদের তো একটি ছোটো একতলা বাড়ি ছিলই। কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সংসার চলতে লাগলো। জীবন যুদ্ধ শুরু হলো অরুর। যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করে সে কলেজে গেলো। টিউশন করেই সে নিজের পড়ার এবং হাত খরচ জোগাড় করতো। তার মা স্পষ্টই বলে দিয়েছিলেন, তার পেছনে খরচ করা যাবে না। ছেলেকে মানুষ করা বেশি দরকার। সুতরাং, অরু নিজেরটা নিজেই চালাতে লাগলো। তার কোনো সাধ আহ্লাদ ছিলো না। ছুটির পর ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে কিছু মুখে দিয়েই বেরোতে হতো ছাত্র পড়াতে। অনেকগুলো টিউশনি করে বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে দশটা বাজতো। শরীর আর চলতে চাইতো না। কোনরকমে কিছু খেয়ে নিয়েই নিজের পড়া নিয়ে বসতো। তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। এক অমানুষিক জেদ নিয়ে চালিয়ে যেতো ঘুম আর ক্লান্তির সাথে লড়াই যথারীতি এইচ এসের রেজাল্ট হলো দুর্দান্ত। কিন্তু, তার joint এ বসা হলো না। তার থেকে অনেক কম নম্বর পেয়েও অনেকেই দিলো joint। কিন্তু, সে দিলো না। কী হবে দিয়ে?? সে জানে, পরীক্ষা দিলেই সে ভালো rank করবে। কিন্তু, তারপর?? চার বছর পড়ার খরচ টানবে কে? হোস্টেলের খরচ, পড়ার খরচ...... নাহ্, ওসব তার কাছে দুরাশা। সে সাইন্স নিয়ে ভর্তি হলো কলেজে। সমানে চলতে লাগলো টিউশনি। এদিকে তার ভাই ও বড়ো হয়েছে। অভাবের সংসারে তার কিন্তু কোনো কষ্ট নেই। সে দিব্যি রাজার হালে রয়েছে। তার মা তার গায়ে আঁচটুকু লাগতে দেন না। প্রতিটা সাবজেক্টের জন্য আলাদা আলাদা টিউটর। অরু ও চেষ্টা করে ভাইয়ের যেনো কোনো কষ্ট না হয়। কিন্তু, এতো করেও অনির্বাণ কোনো পরীক্ষাতেই ভালো করতে পারে না। ঐ কোনমতে টেনেটুনে পাস। এই ভাবে তারও মাধ্যমিক এসে গেলো। অরু নিজের পড়ার পাশাপাশি ভাইকেও পড়ায়। কিন্তু, সে কোনো কথা শুনলে তো!! এরমধ্যেই সিগারেট খাওয়া শিখেছে। অরু নিজের চোখে দেখেছে , ওর থেকে বয়সে অনেক বড়ো ছেলেদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ঐটুকু ছেলে রাত করে বাড়ি ফেরে। মা কে বলে কোনো লাভ হয় না। মা বলেন, তুই ওকে হিংসা করিস। ওর ভালো তোকে দেখতে হবে না। যথারীতি সে ফেল করে মাধ্যমিকে। আর অরু ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে অনার্স পাস করে। তার রেজাল্ট নিয়ে আনন্দ করার কেউ নেই। দিন রাত এক করে চাকরির জন্য প্রস্তুত হয় অরু। পেয়েও যায় একটি চাকরি। কিন্তু, মাইনে তেমন বেশি নয়। অরুর মন ভরে না। কিন্তু, সে এটাও বুঝতে পারে তার এইটুকু ডিগ্রি নিয়ে খুব বেশি কিছু হবে না। তাই কম্পিউটারের একটি special কোর্স করার জন্য সে মায়ের কাছে কিছু টাকা চায়। প্রায় লাখ চারেক টাকা লাগবে সেখানে। সে চাকরি পেয়েছে বটে, কিন্তু নিজের আর সংসারের খরচ চালিয়ে সামান্যই হাতে থাকে। এতো টাকা কোথায় পাবে সে?? মা শুনেই প্রথমেই না বলে দিলেন। অরু মা কে বোঝায়। তুমি আমায় ধার হিসেবে দাও। আমি সুদ সমেত শোধ করে দেবো। মায়ের টাকা বলতে, তার বাবা মারা যাবার পর অফিস থেকে পাওয়া ৮ লাখ টাকা। সেখান থেকে ৩ লাখ চায় অরু। বাকি এক লাখ সে নিজে ম্যানেজ করবে। অনেক কথা কাটাকাটির পর তার মা রাজী হয়। কারণ, উনি মনে মনে হিসেব করে দেখলেন, অরু যদি কোর্স করে, অবশ্যই ভালো চাকরি পাবে। সি এসের একটি কোর্স করে অরুর বর্তমান চাকরি হয় আজ দু'বছর হলো। এরমধ্যে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। অরু সংসারের পুরো ভার নিয়েছে। তার মায়ের ফ্যামিলি পেনশনের টাকা পুরোটাই জমে নয়তো অনির পেছনে খরচ হয়। অনির লেখা পড়া হয়নি। বার বার ফেল করে সে  স্কুল ছাড়ে। বদ সঙ্গে পড়ে নেশা করতে শুরু করেছিল। অনেক কষ্ট করে তাকে সুস্থ করেছে অরু। মায়ের কথায় দু'বার ব্যবসা করার জন্য অনিকে প্রচুর টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু অনি কিছুই করতে পারেনি। খুব সম্প্রতি সে বড়লোক বাবার একমাত্র অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করেছে। আশা করা যায় খুব শিগগিরই সে শ্বশুরবাড়িতে উঠে যাবে। নীলিমা দেবী সেই একই রকম আছেন। ছেলের প্রতি অন্ধ আর মেয়ের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। এর মধ্যে ওনার হার্টের প্রবলেম হওয়ায় নার্সিং হোমে ভর্তি করে স্টেন্ট বসাতে হয়েছে। প্রচুর টাকার ধাক্কা। সব সামলেছে অরু। 
 সেই কলেজ লাইফ থেকেই অরুর এক প্রেমিক আছে। শুভেন্দু। এক ই ক্লাসের বন্ধু ছিলো তারা। বন্ধুত্ব ক্রমে প্রেমে গড়ায়। অরুর খুব সন্দেহ হয় এখনও সেই প্রেম আছে কিনা। আশ্চর্য ভাবে তার থেকে অনেক ছোটো ভাইয়ের বিয়ে হওয়া সত্বেও তার বিয়ে নিয়ে বাড়িতে কোনো আলোচনা হয় না। সবাই যেনো ধরেই নিয়েছে অরু কোনো দিন বিয়ে করবে না। সারাজীবন এই সংসারের বোঝা টেনে যাবে। শুভেন্দু ও বিয়ের কথা কিছুই বলে না। অরু যদি কখনো বলে, সে উত্তর দেয়, তুই এই চাকরি ছাড়। আমার মা খুব গোঁড়া। এতো রাত করে তোর বাড়ি ফেরা মা মানবে না। তুই বরং স্কুলে যোগ দে। শুনে মাথায় আগুন জ্বলে যায় অরুণিমার। এতো পরিশ্রম করে, এতো ঘাম রক্ত ঝরিয়ে আজ সে এইখানে। শুভেন্দু বললেই সে চাকরি ছাড়বে?? কঠিন মুখে সে বলে, তুই তোর মায়ের পছন্দের কোনো ঘরোয়া মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হ। আমি মুক্তি দিলাম তোকে। অনেক করে বোঝাতে যায় শুভেন্দু। অরু আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। 

বৃষ্টি দেখতে দেখতে এসব কথাই ভাবছিল অরুণিমা। একটু আগে তার বস্ নিজের চেম্বার এ ডেকে ওকে সুখবরটা দিলেন। বললেন, অফিস থেকে জরুরি ভিত্তিতে ভিসা রেডি করা হচ্ছে। ওকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ওখানে জয়েন করতে হবে। অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, এই অল্প দিনের চাকরিতে এতো কম বয়সে তুমি যা অ্যাচিভ করেছো, অনেকেই পারবে না। তোমার জন্য গর্বিত। খুশি মনে বসের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের কেবিনে আসে অরু। তাহলে, কলকাতা ছাড়তে চলেছে সে!! এখনও যেনো ঠিক বিশ্বাস হয় না। একটা বিশাল পাখির মতো দুই ডানায় এতদিন মা আর ভাইয়ের সংসারটা আগলে ছিলো সে। এই খুশির খবর কাউকে বলতে খুব ইচ্ছে করছে এখন তার। কিন্তু, কাকে বলবে?? তার তো নিজের কেউ নেই। সে ঠিক করলো, আজ নিজেই সেলিব্রেট করবে। নিজেই নিজেকে কিছু গিফট দেবে। নিজেই ট্রিট দেবে নিজেকে। উঠে পড়ে অরুণিমা। লিফটে করে নেমে আসে নিচে। আজ আর ক্যাব বুক করে নি। যাবার বেলায় বড়ো মায়াবী লাগছে এই বৃষ্টি ধোয়া শহরকে। সে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে ভিজে ভিজে। বিশাল পাখিটা এবার বিরাট এক উড়াল দেবে। অন্য মহাদেশে। সাত সাগর পেরিয়ে তার যাত্রা। তার আগে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে পাখি। আর কখনো ফেরা হবে না এখানে। চোখ দুটো কী জ্বালা করে উঠলো? নাহ্...... পাখির অশ্রু বৃষ্টি ধুয়ে দেয় সাথে সাথে।







সুতাং নদীর পাড়ে

কো য়ে ল  তা লু ক দা র

কিছুদিন ধরেই একটা ব্যাপার মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। তা হলো নদী। এই জীবনে কত নদী যে দেখেছি। কত নদীর জল ছুঁয়ে দেখেছি। নৌকায়, লঞ্চে, ইস্টিমারে কত রাত্রিদিন নদীতে ভেসেছি। আবার অনেক নদী আছে আজও দেখা হয় নাই। নামও জানি না। আজ কয়েকদিন ধরে মন বলছিল কোথাও গিয়ে একটু নদী দেখে আসি।

কিন্তু কোথায় যাব? কোন্ নদীর কূলে গিয়ে দেখব জল? কোনোই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। 

কাউকে কিছু না বলে একদিন ভোরবেলা বিমানবন্দর স্টেশনে চলে যাই। একটি ট্রেন তখন  স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। কাউন্টারে টিকিট মাস্টারকে বলি- এই ট্রেনটি কোথায় যাবে? 

-এটি পারাবত এক্সপ্রেস। সিলেট যাবে। 
-আমাকে এই ট্রেনের একটি টিকেট দেন।
-কোন্ ক্লাসের টিকেট দিব? 
-শোভন ক্লাসের। 

সিলেট পর্যন্তই টিকেট কাটলাম। ভাবলাম, ট্রেনে যেতে যেতে নদী খুঁজব। যে নদীটা দেখতে ভালো লাগবে সেই নদীর কাছাকাছি কোনও একটি  স্টেশনে নেমে পড়ব।

ট্রেন চলছে। আন্তঃনগর ট্রেন। খুব দ্রুত চলছে। জানালার কাছে সিট। খুব ভালো লাগছে। মাঠ ঘাট খালি প্রান্তর পেরিয়ে ট্রেনটি ছুটে চলেছে। মনে পড়ছিল সেই কবে ইন্টার ক্লাসে রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের একটি কবিতা পড়েছিলাম -
'Faster than fairies, faster than witches, Bridges and houses, hedges and ditches; And charging along like troops in a battle, All through the meadows the horses and cattle...'

কিছুক্ষণ পড়েই দেখি- ট্রেনটি বিকট শব্দ করে একটি ব্রিজ ক্রস করছে। নীচে চেয়ে দেখি নদী। নদীটির নাম শীতলক্ষ্যা। এই নদী এর আগে অনেক দেখেছি নারায়নগঞ্জের নিতাইগঞ্জে। নদীটা ভালো লাগলো। কিন্তু মন টানলো না তেমন। আর ট্রেনটা ছিল দ্রুতগামী। ঘোড়াশাল ফ্লাগ স্টেশনে ট্রেনটি থামল না। 

হঠাৎ মনে পড়ল আমার এক ফেসবুক বান্ধবীর কথা। কাকতালীয় ভাবে ওর নাম ছিল 'নদী'। পুরো নাম নদী ইসলাম। এখানে পলাশে ওদের বাড়ি। সে এখন আয়ারল্যান্ডে ডাবলিন শহরে থাকে। ও ইনবক্সে আমাকে বলেছিল- ওদের বাড়ির কাছে নাকি 'হাঁড়িধোয়া' নামে একটি নদী আছে। নদীটা নাকি দেখতে খুব সুন্দর! আঁকাবাঁকা সর্পিল। ও এও বলেছিল যদি পারো কোনও একদিন গিয়ে এই নদীটা  দেখে এসো। ট্রেনটা এখানে যদি থামতো তাহলে নাহয় নেমে এই হাঁড়িধোয়া নদীটাই দেখে যেতাম।

ট্রেনটি একসময় ভৈরব জংশন পার হয়ে আরও একটি সেতু অতিক্রম করছিল। ট্রেন থেকে নীচে চেয়ে দেখি, এ যে মেঘনা। এই নদীও দেখেছি এর আগে অনেক বার। ট্রেনটি ছুটছে দ্রুত গতিতে আখাউড়ার দিকে। এখানে কাছাকাছি কোনও স্টেশনে থামবে না।  তাই এখানে আর নামা হলো না। তাছাড়া নামতামও না এখানে। কারণ  আমি খুঁজছি স্বচ্ছতোয়া ছোট কোনও নদী। 

ট্রেনটি একসময় আখাউড়া গিয়ে পৌঁছে। ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নামি। একটি চা'র দোকানে বসে  চা খাই। একবার ভাবছিলাম, এই ট্রেনটি ছেড়ে দিয়ে অন্য আর একটি ট্রেনে নাহয় চট্টগ্রামের দিকে যাব। কিন্তু তা আর হলো না। ট্রেন ছাড়ার সাইরেন বেজে উঠে। আমি দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ি।

ট্রেনটি শায়েস্তাগঞ্জ জংশন পৌঁছার আগে কোথাও কোনও স্টেশনে আর থামল না। এরই মাঝে ছোট বড় দু-তিনটে নদী দেখলাম। ভালোও লেগেছিল। কিন্তু নেমে আর দেখা হয়নি। 

শায়েস্তাগঞ্জ জংশনেও ট্রেন থেকে একটু নামলাম। ইতস্ততভাবে ঘোরাঘুরি করছিলাম প্লাটফর্মের উপর দিয়ে। একটা টং দোকানে বসে চা খেলাম। সিগারেটও খাই। মনে পড়ছিল অনেক বছর আগের কথা। 

আশির দশকের হেমন্তকাল। সেবার আমরা কয়েকজন তরুণ কর্মকর্তা একটাি অফিসের কাজে এসেছিলাম হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট। আমাদের সাথে দুটো মেয়েও ছিল। মনে পড়ছিল এই স্টেশনের কাছে কোথাও একটি হোটেলে আমরা লাঞ্চ করেছিলাম। আরও মনে পড়ছিল অনেক কথা। একটি নদীর কথা। অনেক স্মৃতি ধেয়ে আসছিল অস্পষ্ট করে অনেক পিছনের পুরনো  জীবন থেকে। 

আরও একটি সিগারেট ধরাই। ইতোমধ্যে ট্রেন ছাড়ার সাইরেন বাজতে থাকে। আমি নির্বিকার চেয়ে থাকি ট্রেনটার দিকে। ট্রেনটি ছেড়ে চলে গেল। আমি বসেই রইলাম চা' র দোকানের সামনে বেঞ্চের উপরে। 

তখন দ্বিপ্রহর হয়ে গেছে। চা'র দোকান থেকে উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে স্টেশনের বাইরে আসি। সেই খাবার হোটেলটি খুঁজতে থাকি। কত বছর আগের কথা। নামও মনে নেই হোটেলটির। শেষ পর্যন্ত হোটেলটি খুঁজে পেলাম। তখন ছিল টিনের চালার হোটেল। এখন সেটি পাকা। দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম হোটেলটিতে। 

হোটেল থেকে বেরিয়ে স্থানীয় একজন লোককে জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা,  সুতাং যাব কীভাবে?  আমি নিজেই বললাম, আগে তো ট্রেনে যাওয়া যেত। 

লোকটি বলল - ঐ সেকশনে এখন আর ট্রেন চলে না। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আপনি লোকাল বাসে অথবা অটোতে করে সুতাং বাজার যেতে পারবেন।

আমি বাসে না উঠে একটি খোলা অটোতে করে চলে যাই সুতাং রেল স্টেশনে। কেমন অপরিচিত লাগছিল স্টেশনটি। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। কোনও কর্ম চাঞ্চল্য নেই। টিকিট ঘরটি আছে। স্টেশন মাস্টারের ঘরটিও আছে । কিন্তু কোনও কর্মচারী নেই। ছোট্ট একটি স্টেশন। শুধুমাত্র লোকাল ট্রেন এখানে থামত। 

সেবার অফিস ট্যুরের সময় আমার আর নমিতার উপর দায়িত্ব পড়েছিল সুতাং নদীর পাড়ে খাসিয়া পুঞ্জিতে গিয়ে কয়েকটি পরিবারের সাথে আর্থ সামাজিকের উপর কিছু তথ্য জেনে নেওয়া। আমি আর নমিতা চুনারুঘাট থেকে একটি লোকাল ট্রেনে করে এসে নেমেছিলাম এই সুতাং স্টেশনে।

এই সুতাং স্টেশনের অদূরেই সুতাং নদী। কেমন যেন প্রকৃতিকালও মিলে গেল আজকেও। সেবার ছিল হেমন্ত সময়। আজকেও হেমন্ত। ঝকমকে রোদ চারদিকে ঝিকমিক করছে । কিন্তু মনটা প্রফুল্ল লাগছে না। সেবার আমার সাথে ছিল নমিতা ৷ এবার কেউ নেই। কী উচ্ছ্বল ছলছল ছিল মেয়েটা। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য ভূগোলে স্নাতকোত্তর করে এসেছিল। লম্বা লম্বা চুল ছিল ওর। চুলের গোছা ছড়িয়ে পড়ত  কটিদেশের উপরে। আমি ওকে বলতাম- এই যে কাজল কালোকেশী মেয়ে! কখনই চুল বাঁধবে না তুমি! নদী যেমন বুক উজাড় করে জল কলকলিয়ে চলে তেমনি তোমার চুল ছড়িয়ে দেবে আদিগন্ত তোমার পিঠের উপরে।

আমরা সেদিন হাঁটছিলাম সুতাং নদীর পাড় ধরে। কোথাও পাহাড়ি পথ, কোথাও আঁকাবাঁকা সমতল। আবার কোথাও উঁচু-নিচু পথ। সব পথের ধুলোয় লুটিয়ে থাকে পাহাড়ি লাল মাটি ও ঝকঝকে বালি। যেতে যেতে সবুজ প্রকৃতির মাঝে দেখা মেলে দূরের পাহাড়। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ের থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।

পথে চলতে চলতে পড়ছিল টিলা। পথের দুপাশে কত নাম না জানা জংলী ফুল ফুটে আছে। বিচিত্র সব সুবাসে বাতাস ভরে আছে। সুতাং এর স্বচ্ছ জল ছোঁয়ার জন্য নমিতা আকুল হয়। পাড়ে থেকে জলের কাছে যেতে ও ভয় পাচ্ছিল। নমিতা আমাকে কুসুমে কোমলে ডাকে-  রঞ্জন, তুমি আমার হাতটি ধরো। 

কি পাগল মেয়ে যে নমিতা! আমার একটি হাত ওর পাঁজরে জড়িয়ে নিয়ে জলের কাছে চলে যায়। ও বলছিল- এত টলটলে জল, এত স্বচ্ছ রূপ! এত পবিত্র! আমার সাথে তুমিও এই জল স্পর্শ করো। আমাকে তুমি অশেষ করো। দাও জগৎ  দাও। দাও তোমার মঙ্গল ছোঁয়া। তুমি  নিয়ে নাও আমার ধনদৌলত, সকল ঐশ্বর্য। সেই কত যুগের আগে তোমাকে দেখেছিলাম। সেই কতকাল ধরে এমনই ক্ষণ আমি চেয়েছিলাম। এমনই একটি নদীর কাছে তোমার মতো কাউকে আমার সমস্ত কিছু দান করতে ইচ্ছে জাগত। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে আমার জীবনে। তুমি ফিরিয়ে দিও না।

কী বিমুগ্ধ জীবন পায় মানুষ! হিরণ্য আখরে দাগ কেটে রয় তা জীবনের পরতে পরতে। 

নদী থেকে চলে আসি ঝর্ণার ঝিরিপথের বাঁকে। এযে রবি ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের গান এখানেও। কেমন ভয়ংকর নির্জনতা চারদিকে! নমিতার বুক ধকধক করছিল। ও বলছিল- এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে! এ যে স্বর্গ এখানে নেমে এসেছে! সবকিছু স্বপ্ন নয় তো! 

তখন ছিল অপরাহ্ন সময়। সুতাং নদীর জল ছিল স্থির। ডাহুক উড়ছিল। পানকৌড়িরা বসেছিল শিয়ালপোতা গাছের ঝাড়ে। তখনও রৌদ্র করছিল ঝিলমিল। নমিতা ওর বুকের পাঁজর থেকে আমার হাত সরিয়ে এনে আমার বুকের ভিতর ওর বুক সমর্পণ করে। আবারও বিহ্বলতা!  দীর্ঘ আলিঙ্গন যেন শেষ হতে চায়নি সেদিনের সুতাং নদীর পাড়ে মনুষ্যহীন নির্জন সেই অপরাহ্ন বেলায়।

আজ এত বছর পরে সুতাং নদীর কূল ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন চারদিক থেকে কী এক নস্টালজিক বেদনা এসে মনকে আচ্ছন্ন করছিল। সুতাং নদীতে জল বয়ে চলেছে আগের মতোই কিন্তু কেমন যেন বিষাদ হয়ে আছে সে জল। পায়ে পায়ে চলছিলাম ধীরে। কিন্তু পা চলছিল না। পথ চলতে ব্যথা করছিল দু'পায়ে।

আরও কিছু দূর চলে যাই সেই টিলাটার কাছে।  টিলার গায়ে লতাগুল্মে ভরে আছে। শুধু পাশের ঝর্ণার জল আজ আর ঝরে পড়ছে না। সব আজ শব্দহীন। ভাবছিলাম আর এগুবো না সামনের দিকে। মনও চাইছিল না এগুতে। ফিরে চলে আসতে থাকি পরিত্যক্ত সুতাং স্টেশনের দিকে। 

পথ দিয়ে ফিরছিলাম আর ভাবছিলাম সেই তরঙ্গায়িত যৌবন সময়ের কথা। কতজনকেই তো ভালো লেগেছিল। নমিতা ছিল তাদেরই একজন।  মনে হতো মেয়ে তুমি আমার কিছু একটা হও। স্বপ্নও দেখতাম ওকে নিয়ে। এ রকম কত স্বপ্ন যে ভেঙ্গে গেছে সেই সময়ে। সেই ভাঙ্গা গড়ার সময়কাল কখন যে শেষ হয়ে গেছে তাও বুঝতে পারিনি। আমার গত জীবনকাল ধরে নমিতার মুখচ্ছবি যে মনে ভেসে উঠেনি তা নয়। এই সুতাং নদীর পাড়ে ওর বুকের সেই উষ্ণতা আজও আমাকে বিচলিত করে। কখনও কখনও নিজেকে  খুব খালি খালি লাগে। ওর মায়াময় মুখখানি  সুতাং নদীর জলের মতো হৃদয়ের ক্যানভাসে এখনও অস্পষ্ট জলছবি হয়ে আছে। সৌম্য বাতাসে কান পাতলে তার পায়ের ধ্বনি বাজে। সেই কবে নমিতা আমার হতে চেয়েছিল এক হৈমন্তিকা দিনে। ঝরা পাতাচিহ্ন ফেলে সে আর পুনরায় ফিরে  আসবে না কোনোদিন। অথচ বনফুলবিজড়িত গন্ধ বাতাসে আকুল হবে এই সুতাং নদীর পাড়ে শতসহস্র বছর কাল।

কত যে ভ্রম আজও হয়! সুতাং স্টেশনে গিয়ে টিকেট ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। মাস্টার মশাইকে বলি- আমাদের ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনের দুটো টিকেট দেন। কেউ কোনও উত্তর দিচ্ছে না। টিকেট ঘরটি যে তালাবন্ধ! ভিতরে কেউ নেই। পাশে চেয়ে দেখি- নমিতাও নেই।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪