প্রবন্ধ

মৃত্যুচেতনা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যে

গী ত শ্রী সি ন হা

'মৃত্যুরে কে মনে রাখে?/... মৃত্যু সেও মুছে যায়।/যে তারা জাগিয়ে থাকে/তারে লয়ে জীবনের খেলা ভুবনের মেলা।' মৃত্যুকে নানাভাবে, নানা রঙে রঞ্জিত করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর কাব্যে। তাঁর "প্রথমা" কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু করে জীবনের অন্তিমসময়ের কবিতাতেও যা নজর পড়ে। মৃত্যু-ভাবনা কখনো তাঁর কাব্যে একটি সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। জীবন ও অভিজ্ঞতার পরতে পরতে ঘটেছে বদল। নানা ঢঙে, নানা রূপে মৃত্যুভাবনা তাঁর কবিতায় উপস্থিত হয়েছে জীবনদর্শনের উৎকৃষ্ট ফসল হিসেবে। তাঁর "প্রথমা" কাব্যগ্রন্থে দেখি তিনি মৃত্যুকে নিয়ে অবহেলা করেছেন। মৃত্যুকে তাঁর 'মৃত্যুরে কে মনে রাখে' কবিতাটিতে।কবিতাটির শুরুতেই তাঁর শ্লেষোক্তিতে যা ধরা পড়ে...মৃত্যুরে কে মনে রাখে?/... মৃত্যু সেও মুছে যায়।/ যে তারা জাগিয়ে থাকে তারে লয়ে জীবনের খেলা/ ভুবনের মেলা।" প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতন মৃত্যুকে নিয়ে এমন অবহেলা জীবনানন্দর কবিতাতেও আমরা পেয়েছি। বিশেষ করে তাঁর "রূপসী বাংলা"-র কবিতাতে। তবে মৃত্যুকে জীবনানন্দ উল্টিয়ে-পালটিয়ে বহুভাবে দেখেছেন। অবহেলাও যেমন করেছেন তেমনি মৃত্যুতে কখনো আচ্ছন্ন হয়েছেন বিষাদে-হতাশায়, ঘন বেদনায়। আবার এই মৃত্যুর কাছেই খুঁজে পেয়েছেন পরিশেষে পরম প্রশান্তি। কিন্তু মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি হওয়ার জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যলোকের ভুবন অন্য খাতে বয়। অন্য প্রকৃতির পরিমন্ডল নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবি-মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গি। 'মৃত্যুরে কে মনে রাখে' কবিতাটি পাঠ করলে দেখ যায়, কবি প্রেমেন্দ্র মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে সাবলীলতায় জীবনের উদ্দাম কল কল্লোলে জানিয়েছেন তাঁর অভিপ্রেত ইচ্ছের কথা... 'ওরে ম্রিয়মান কবি উঠে বোস,/শোক-শয্যা তোল/বন্ধুর বিরহ-ব্যথা ভোল,/কান পেতে শোনো বসে জীবনের উন্মত্ত কল্লোল.../আকাশ বাতাস মাটি উতরোল আজি উতরোল।' 

অবশ্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের চোখে জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, আনন্দ, দুঃখ ও সুখ সবই বিধাতার তামাশা বলে মনে হয়েছে। এ কারণে তাঁর "প্রথমা" কাব্যে একটি বিষয় বিশেষ করে নজরে পড়ে... মর্ত্য প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কবি মনে মৃত্যুচেতনারও অমোঘ দানা বেঁধেছিল। এ কারণে "প্রথমা" কাব্যে একদিকে যেমন নজর পড়ে মৃত্যুকে অবহেলা করে যৌবনের জয়গান, তেমনি আবার তিনি মনে করেছেন...  মৃত্যুর শাসন উপেক্ষা করা যায় না বলেই যৌবনেতে ভোগ করাই শ্রেয়। এই দ্বান্দ্বিকতায় বলা যায় তাঁর "প্রথমা" কাব্যগ্রন্থটি রচিত। এখানে কিছু দৃষ্টান্ত রাখছি... ১) মাটির ঢেলা, মাটির ঢেলা,/রঙ দিলে কে তোর গায়ে?/গড়তে তোরে কোন আদলের ছাঁচে?/ভূখ দিলে যে বুক দিলে যে/দুখ দিলে লেলিয়ে পাছে পাছে (মাটির ঢেলা- "প্রথমা") ২) মৃত্যু শাসায়, শুনতে কি পাস?/দেখতে কি পাস, শ্মশান পাতা সকল ঠাঁই, বিশ্বজুড়ে চিরটাকাল কালের হাতে নেই কামাই।/ওরে অন্ধ, ওরে হতাশ।/লুট করে নে যেথায় যা পাস,/আকাশ বাতাস, প্রেমের প্রকাশ/নারীর দেহে রূপের বিকাশ,/যেথায় যা পাস। (ইহবাদি- "ঐ") ৩) দেখি মৃত্যু শিয়রে নেওয়া চির-বিলাপের শপথ শাপ হয়ে ওঠে/শুনি বৃদ্ধ তার যৌবনের প্রেম নিয়ে পরিহাস করছে। (সংশয়- "ঐ")

"মৃত্যুর মৌতাতে বুঁদ হয়ে গেছি সব রমনী ও মরণেতে ভেদ নেই!"--- "সম্রাট " কাব্যগ্রন্থে এ সে কবি প্রেমেন্দ্রের মৃত্যু-ভাবনা নতুন পথের মোড় নিয়েছে। বেশকিছু কবিতায় চোখে পড়ে তাঁর মৃত্যুচিন্তা নতুন নতুন রূপে আলোকিত হয়েছে। "সম্রাট" কাব্যগ্রন্থের 'নীলকন্ঠ' কবিতাটিতে তাঁর মৃত্যু চিন্তাভাবনা সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ' নীলকন্ঠ ' কবিতাটিতে তাঁর মৃত্যু-ভাবনা দেখি অনেক অর্থে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তিনি যখন বলেন... "মৃত্যুর মৌতাতে বুঁদ হয়ে গেছি সব/রমনী ও মরণেতে ভেদ নাই।" সহজেই বুঝতে পারা যায় কবি প্রেমেন্দ্র মৃত্যুকে রমণীর মতো উপভোগ করতে চান। রবীন্দ্রনাথ "ভানুসিংহের পদাবলী"-তে মৃত্যুকে মধুরতায় দেখেছিলেন... 'মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান' বলে। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন মৃত্যুকে ঠিক ভক্ত-ভগবানের প্রেম-ফল্গুধারা হিসেবে। কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্র দেখেন ইন্দ্রিয়াতীত দৃষ্টিভঙ্গীতে যৌবনবতী প্রিয়ারূপে ভোগ-বাসনার কামনায়। কবি জীবনানন্দ দাশের মধ্যেও অবশ্য কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের এ ভাবনার সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। আমরা সহজেই বুঝতে পারি তিনি মৃত্যুকে সারসত্য মনে করেন। কারণ, তিনি জানেন মৃত্যুর কষ্টিপাথরে জীবনকে ঘষলে মৃত্যুকে কিছুতেই অবহেলা করা যায় না। জীবনের সঙ্গে যে মৃত্যুর একটা চিরন্তন গাঁটছড়া বাঁধা আছে... এ সত্য বেরিয়ে আসে। তাই তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন, 'মৃত্যু জীবনের শেষ সার আবিষ্কার'।

'নীলকন্ঠ' কবিতাটিতে কবি যখন বলেন... 'সভ্যতাকে সুস্থ করো, করো সার্থক।'/আনো তীব্র, তপ্ত, ঝাঁঝালো, মৃত্যুর স্বাদ,/সূর্য আর সমুদ্রের ঔরসে যাদের জন্ম/মৃত্যু-মাতাল তাদের রক্তের বিনিময়'--- এখানে প্রেমেন্দ্রের কবি মনের আর একটি ডাইমেনশন আমরা পেয়ে যাই। যতদিন যৌবন, ততদিনই মৃত্যুর সাধ পাবার বাসনার কথা এখানে স্পষ্ট। কবি প্রেমেন্দ্র যে সময়ের সঙ্গে মৃত্যুকে এক বিশেষ যোগসূত্রে দেখেছেন তা বোধকরি 'নীলকণ্ঠ ' কবিতাটিতে দৃশ্যমান তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এ কারণেই বলা যেতে পারে 'নীলকন্ঠ' কবিতাটিতে 'মৃত্যুচেতনা' বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে ভোগে, স্বাদে ও বর্ণে রঞ্জিত হয়ে। কবিতাটি সম্পর্কে আর একটি কথা না বললে নয়, হুইটম্যানের সঙ্গে প্রেমেন্দ্রের এই একটি ক্ষেত্রে মেলবন্ধন ঘটেছে। হুইটম্যান মৃত্যুকে ঠিক প্রেমেন্দ্রের মতনই ধারণা করেছেন ... 'Copulation is not mare rank to me than death is (Inseription, leaves of grass, ---line 521)' নগর-সভ্যতার কৃত্রিম জীবনযাপনকে কবি প্রেমেন্দ্র ভালো চোখে দেখেননি।তিনি কৃত্রিম নগর সভ্যতার অন্ধ আধুনিকতার মধ্যে লক্ষ্য করেছেন মানুষের মানবিকতার মৃত্যু'।  'সম্রাট' কাব্যগ্রন্থের 'বাঘের কপিশ চোখে' কবিতাটিতে বিশেষ করে লক্ষ্য করা যায় যখন তিনি একথা বলেন... 'স্রোতাহীন চেতনার, গাঢ় দৃঢ় অতল সলিলে,/অনেক প্রাচীরে ঘেরা,/অনেক শৃঙ্খলে জোড়া,/নগরের ছায়া গেছে নেমে,/নেমে গেছে অরণ্যে আরেক.../সে অরণ্যে নব-মৃত্যু মোরা সৃজিয়াছি।'

(শব্দ সংখ্যা: ৭৬২)

                                   চলবে...






রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী জর্জ বিশ্বাস

র ঞ্জি ত  দে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কয়েক শতাব্দীতে একবারই জন্মায় কারন বহু লেখক কবি গায়ক গান রচয়িতা পৃথিবীতে প্রচুর ছিল আছে থাকবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? তিনি নিজেই একাধারে লেখক, কবি, গায়ক, গান রচয়িতা সবটাই ছিলেন। এবং সেটা যে শুধুমাত্র নামমাত্র ছিল তা একদমই নয়, সবেতেই তিনি সেরার সেরা ছিলেন। তার প্রমান গীতাঞ্জলি কাব্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নোবেল পুরস্কার অর্জন। তার লেখা কবিতা গল্প উপন্যাস নিয়ে বলতে গেলে বিরাট ইতিহাস হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথের লেখা এবং সুরারোপিত গান গেয়ে বছরের পর বছর ধরে বহু শিল্পী নাম যশ খ্যাতি অর্জন করেছেন, রবীন্দ্রনাথের সবরকমের গানের সংখ্যা ২২৩২। তাই রবীসঙ্গীতের জগত অনেক বড়। আজ শুধু আলোচনা করবো রবীন্দ্রনাথের লেখা গান গেয়ে যারা বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং যাদের ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা ভাবাই যায় না তাদের মধ্যে অন্যতম এক কিংবদন্তী শিল্পীকে নিয়ে। অনেকেই নামকরা গায়ক ছিলেন তাদের সময়কালে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাদের গলায় মধু ঝরে পড়ত, তাদের গাওয়া গান শ্রোতার হৃদয়ে আলোড়ন তুলতো, তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন নিজেদের মতো করে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়কী অন্য সব গানের থেকে অনেক আলাদা।সেই গায়কীতে সফল ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া শিল্পীকে নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। বিচার করার কথা স্বপ্নেও ভাবিনা শুধু শ্রোতা হিসেবে অনুভূতি প্রকাশ করছি মাত্র। এই নামটা আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছি তার কারন নামটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রোতাদের অত্যন্ত পরিচিত শুধু নয় সঙ্গীতেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক হিসেবে একদম সামনের সারিতেই অবস্থান করেছিলেন তিনি দেবব্রত বিশ্বাস ওরফে জর্জ বিশ্বাস।

দেবব্রত বিশ্বাস ওরফে জর্জ বিশ্বাস জন্মগ্ৰহন করেছিলেন ১৯১১ সালে ২২শে আগস্ট পূর্ববঙ্গের অধুনা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। রাজা পঞ্চম জর্জের‌ দিল্লিতে আসার আগে তার জন্ম হয় বলে তার নাম জর্জ রাখা হয়েছিল। পিতা দেবেন্দ্রমোহন বিশ্বাস, পিতামহ কালীমোহন বিশ্বাস ব্রাহ্মধর্ম গ্ৰহনের কারনে নিজের গ্ৰাম থেকে বিতাড়িত হন। সেই কারনে কিশোরগঞ্জ স্কুলে ম্লেচ্ছ হিসেবে গন্য করা হতো দেবব্রতকে। মা অবলাদেবীর মাধ্যমে ব্রহ্মসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার‌।অল্প বয়সে কিশোরগঞ্জের স্বদেশী সভা সমিতিতে দেশাত্মবোধক গান গাইতেন তিনি। ১৯২৭ সালে মেট্রিক পাশ করে তিনি সিটি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় ব্রাহ্মসমাজ এবং পরে শান্তিনিকেতনে গান গাইবার জন্য আমন্ত্রণ পান। ১৯২৮ সালে  ব্রাহ্ম ভদ্রোৎসবে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রথম দেখেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার ছেলে সুবীর ঠাকুরের সাথে পরিচয়ের সুত্রে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে তার পদার্পণ। সেই সুত্রে ১৯৩৮ সালে শিল্পী কনক দাশের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন। সেই গান জনপ্রিয় হওয়ায় পরবর্তীতে এইচ এম ভি এবং অন্যান্য রেকর্ড সংস্থা তার গান রেকর্ড করতে শুরু করে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে তিনি গণসঙ্গীত পাশাপাশি অন্যান্য গানও গেয়েছেন একসময়।একসময় তার নজরুল ইসলামের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল তখন নজরুল তাকে গান শুনে তাকে শিখিয়ে দুটি গান রেকর্ডিং করিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি গান ছিল 'মোর ভুলিবার সাধনায় কেনো সাধো বাদ' অন্য গানটা জানা যায়নি যদিও এই গান দুটি দিনের আলোর মুখ দেখেনি কোনোদিন। এসব তার আত্মজীবনী সুত্রেই জানা যায়।আরো জানা যায় যে ১৯৪৪ সালে 'তাসের দেশ' নৃত্যাভিনয়ে দেবব্রত বিশ্বাস রাজপুত্রের গলায় গান গাইবার আমন্ত্রণ পান আর এই সময় থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রথাগত বিরোধ লাগে। ঘটনাটা ছিল তাদের দেশ দু'তিন রাত অভিনয় হবার পর পরিচালক শান্তিদেব ঘোষ তাকে শেষ গানটি গাইতে বলেন। গানটি ছিল 'বাঁধ ভেঙে দাও' তখন দেবব্রত বলেন গানটি আনন্দের সঙ্গে (with pleasure)গাইবো নাকি আনন্দ ছাড়া(without pleasure) গাইবো, শান্তিদেব নির্দেশ দিলেন আনন্দের সঙ্গে গাইতে। তখনকার সময়ে এই গানটা খুব পেলব বা নরম সুরে গাওয়া হতো। দেবব্রত বিশ্বাসের কথায় "আমি তখন গণনাট্টের অনুষ্ঠানে যেভাবে গানটা দ্রুত লয়ে গাইতাম ঠিক সেভাবেই গাইতে শুরু করলাম, তখন দেখা গেলো দক্ষিন ভারতীয় নৃত্যশিল্পী কেলু নায়ার মনের আনন্দে মঞ্চে ধুলো উড়িয়ে নেচে বেড়াচ্ছে আর অন্যেরা কেউ সেভাবে সুবিধা করে উঠতে পারছে না। বলা বাহুল্য পরের দিকে দেবব্রত বিশ্বাসকে আর ওই গান গাইতে হয়নি।

পরে কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে তিনি কয়েকটা গান রেকর্ড করেন তার মধ্যে একটি গান 'তুমি রবে নীরবে 'গানটি অনুমোদন করতে বিশ্বভারতী অস্বীকার করে।বিশ্বভারতীর স্বরলিপি সমিতির সম্পাদক  অনাদি কুমার দস্তিদার দেবব্রতকে ডেকে বলেন গীতবিতানে গানের কথা লেখা আছে 'মম দুঃখ বেদন মম সফল স্বপন' তা তুমি সফল স্বপনের জায়গায় 'সকল' স্বপন গাইলে কেনো? তখন দেবব্রত তাকে বলেন বীনাবাদিনী পত্রিকায় এই গানটার যে স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল তাতে সফলের জায়গায় 'সকল' লেখা আছে, অনাদিবাবু বলেন ওটা ভুল হয়েছিল, তখন দেবব্রত বলেন 'ভুল যখন হয়েছিল তখন একবছরের মধ্যে সংশোধন করা উচিত ছিল কিন্তু তাও অনাদিবাবু গানটি অনুমোদন করতে রাজি হননি তখন নীহারবিন্দু সেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং প্রমথ চৌধুরীর স্ত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে এ ব্যপারে মতামত চেয়ে চিঠি লেখেন, প্রত্যুত্তরে ইন্দিরা দেবী তার চিঠিতে লেখেন 'আমার স্মৃতি ও যুক্তি ইহাই সাক্ষ্য দেয় যে 'সকল' কথাটাই ঠিক।পরে নৃপেন্দ্র চন্দ্র মিত্র ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে এই ব্যপারে দেবব্রত বুঝিয়ে বললে তাদের নির্দেশে অনাদিবাবু ওই গানে অনুমোদন দিয়ে দেন।

এভাবে বার বার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার এবং বাদনযন্ত্র ব্যবহারের কিছু নিয়ম ছিল রবীন্দ্রভারতী মিউজিক বোর্ডের। সেখানে দেবব্রত বিশ্বাসের গায়কী এবং বাদনযন্ত্রের ব্যবহারে তাদের আপত্তি ছিল। তাই মিউজিক বোর্ড দেবব্রত বিশ্বাসকে ছয়টি শর্ত দিয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ব্যপারে‌। ১ক)এসরাজ, বাঁশি, সেতার সারেঙ্গী, তানপুরা, বেহালা, দোতারা, একতারা, বাসবেহালা বা অর্গান ১খ) পাখোয়াজ, বায়া তবলা, খোল, ঢোল ও মন্দিরা ২)প্রতি গানের মূল আবেগের দিকে লক্ষ্য রেখে অনুকূল আবহসঙ্গীত যন্ত্রে রচনা করা। গানের আরম্ভে এবং যেখানে গায়কের কন্ঠের বিশ্রাম প্রয়োজন সেখানে তা প্রয়োগ করা
৩) যে কটি যন্ত্রের উল্লেখ করা হয়েছে গানের সঙ্গে তার সবকটা বাজানো যেতে পারে কিন্তু কোন যন্ত্র কিভাবে বাজবে সেটা গায়ককে ঠিক করতে হবে গানের ছত্রের ভাবের দিকে লক্ষ্য রেখে।
৪)বাদনযন্ত্রের ব্যবহার কখনো গায়কের গলাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। গানের শুরু থেকে গানের মধ্যে বিশ্রামের সময় পুরোটা লক্ষ্য রাখতে হবে বাজনদারদের। ৫)তালযন্ত্রের সঙ্গতের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে তালের ছন্দ যেনো কথার ছন্দ ও লয়ের বিপরীত না হয়। অর্থাৎ দ্রুত ছন্দের গানে যেমন দ্রুত লয়ের ঠেকার প্রয়োজন ঢিমালয়ের গানে তেমনি ঢিমালয়ের ঠেকার প্রয়োজনকে মানতেই হবে ৬)এবং কথার উপরে ঝোঁক দিয়ে অনেক গান গাইতে হয়। এইসব গানের সঙ্গে সঙ্গতের সময় তালবাদ্যেও কথার ছন্দের অনুকূল ঝোঁক প্রকাশ পাওয়া দরকার, তাতে গানের ভাবের সঙ্গে কথার ভাবের সঙ্গতি থাকে। মিউজিক বোর্ডের এতোগুলি শর্ত ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার ব্যপারে কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্যময় সঙ্গীত রীতির অনুকূল ছিল না এই শর্তাবলী। এসব দেখেই একসময় তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত আর রেকর্ড করবেন না বলেই ঠিক করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়কী ঠিক রেখে তাকে আরো শ্রুতিমধুর করে তুলতে তিনি বার বার নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গিয়েছেন, বলাবাহুল্য তা কখনো পছন্দ করেনি রবীন্দ্রভারতী। দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া যে গানগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি' 'কেনো তোমরা আমায় ডাকো' 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে' 'অরূপ তোমার বানী' প্রমুখ।আধুনিক হিন্দি বাংলা গানে অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়ক কিশোরকুমার তার বেশ কিছু গানে গলা খেলিয়ে গেয়েছিলেন যা পরবর্তীতে উডলিং নামে পরিচিত এবং সেই গানগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু কিশোরকুমারের অনেক আগেই প্রচ্ছন্নভাবে না হলেও দেবব্রত বিশ্বাস তার কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীতেও এরকম উডলিং ব্যবহার করেছিলেন, যেমন 'কেনো তোমরা আমায় ডাকো' 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে' 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে'--- এইসব গানে।শ্রোতারা যদি দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি' গানটি শোনেন তাহলে বুঝতে পারবেন 'ঝড়ে'এবং 'ঘরে'এই শব্দ দুটিতে সামান্য উডলিং ব্যবহার করেছিলেন। 

তৎকালীন বিখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক দেবব্রত বিশ্বাসকে দিয়ে তার 'মেঘে ঢাকা তারা' ছবিতে গীতা ঘটকের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে 'যে রাতে মোর দূয়ারগুলি,' কোমলগান্ধার ছবিতে 'আকাশ ভরা সূর্য তারা' এবং যুক্তি তর্ক এবং গল্প ছবিতে স্বয়ং ঋত্বিক ঘটকের ঠোঁটে 'কেনো চেয়ে আছো গো মা' গাইয়েছিলেন যা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সেসময়ে।১৯৬৪ সাল থেকে বিশ্বভারতীর সঙ্গে তার মতবিভেদ হওয়ায় তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াই বন্ধ করে দেন। ১৯৭১ সালের পর রবীন্দ্রসঙ্গীতের আর কোনো রেকর্ড করেননি। তার শেষ রেকর্ড এই মতবিরোধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক অভিমানে - 'ক্যারে হেরা আমারে গাইতায় দিল না/আমি বুঝতাম পারলাম না/জাইন্যা হুইন্যাও কেউ কিসুরাও করে না,,,,গানটি গেয়েছিলেন। এই কারনে শিক্ষিত মহলে বিশ্বভারতী অনেক সমালোচিত হয়। ২০০১ সালে ভারতে রবীন্দ্র রচনার কপিরাইট বিলুপ্ত হলে তার বহু অপ্রকাশিত এবং অননুমোদিত গান প্রকাশিত হয়।প্রায় ৩০০ রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন তিনি। মৃত্যুর পর কয়েকদশক পরেও তার জনপ্রিয়তা এখনো অটুট। তার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রেমের গানে সেইসময় অনেক প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয় উদ্বেলিত হয়েছে অনেক প্রেম বন্ধন গড়ে দিয়েছে সারাজীবনের জন্য। সেই সময় দেবব্রত বিশ্বাস তার গায়কী দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয় ভরিয়ে দিতেন, প্রেম যেনো তার গানে বার বার হৃদয় উজাড় করে দিতো, ব্যাক্তি জীবনে তিনি অকৃতদার ছিলেন কিন্তু শোনা যায় তার জীবনেও প্রেম এসেছিল কিন্তু সেটা পরিণতি পায়নি, তাই কি তার গানে বিরহ অসাধারণত্ব পেতো? রবীন্দ্রভারতীর অপছন্দের গায়ক হলেও অগনিত শ্রোতা, সাধারণ গায়ক এবং রবীন্দ্র অনুরাগীদের কাছে আজও তিনি সমানভাবে জনপ্রিয়। তার ১৭৪ রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে যেনো সবসময় বৃষ্টি নামতো কারন সেখানে ছিল এক 'বিশু পাগল'। প্রেমের অভিধানে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে যেমন অভিমান বিরহ তেমনই বিদ্রোহ, তবে তা কিন্তু বর্তমান বাংলা সিরিয়ালের মতো নয় প্রেমের অভিমান বিরহ সম্পূর্ণ আলাদা। সংসারে যা প্রতিনিয়ত ঘটে এবং ঘটে বৃহত্তর নাট্যদালানেও। জর্জ বিশ্বাস সৎ প্রেমিক ছিলেন বলেই তার তথাকথিত বিদ্রোহটিও সৎ ছিল। গান তার প্রেম ছিল প্রেম ছিল রবীন্দ্রনাথও। সেই প্রেমের কারনেই তার গানপথের পথিকদের প্রতিও তাঁর ভালোবাসা ছিল অগাধ। তাদের কারো কারো থেকে আঘাত পাওয়া তার প্রেমের গানে অভিমানের ছায়া পড়েছিল। কিন্তু তার প্রেম ছিল উদার, সৎ প্রেমিকদের যেমন হয় আর কি। 'তুমি যাহা চাও তাই যেনো পাও' আমি যতো দুঃখ পাই গো'এই গান গেয়েছিলেন তিনি যেনো গানটা তার অভিমানের প্রতীক। শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিক করলেন সতীর্থ বা কারো সঙ্গে তিনি যুদ্ধে যাবেন না। কার্যত নিজের গানকে ঘরবন্দী করে ফেললেন তিনি। অনেক মর্মস্পর্শী ঘটনা ওনার জীবনে সঙ্গী ছিল প্রতিনিয়ত। জর্জ বিশ্বাসকে নিয়ে যতই লিখিনা কেনো তা কখনোই ফুরোবে না এতোটাই বর্ণময় ছিলেন তিনি। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৮০ সালে ১৮ই আগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাথে সাথে এক বর্ণময় চরিত্রের অবসান ঘটে রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতে। এ ক্ষতি আর কখনো পুরন হবে না।দেবব্রত বিশ্বাস পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু আজো তার গাওয়া গান এবং তিনি সাধারণ অতি সাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কদের  হৃদয়েও সমানভাবে রয়ে গেছেন।যারা শুধু মাত্র তাকে অনুসরণ করে অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আজো সেইসব গান গেয়ে চলেছে।






নিধুবাবু

অ নি ন্দি তা  না থ

সঙ্গীত শব্দটি শুনলেই মনে আনন্দের বন্যা ঝরে। গান একাকিত্ব,দুঃখ-কষ্টকে লাঘব করে। সঙ্গীতের এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা! প্রচীন যুগ হতেই মানব গোষ্ঠী তাদের নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদে ভাষার মতো সঙ্গীতের জন্ম দিয়েছে। আদিম মানুষ তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস বিভিন্ন আওয়াজের মাধ্যমে প্রকাশ করত। সেই ধ্বনিকে 'নাদ' নামে অভিহিত করা হয়। সুরের সঙ্গে কথা, ও তালের সমন্বয়ে গীত বা সঙ্গীতের উৎপত্তি।

কথিত আছে পারস্যের রাজ দরবার থেকে শুরু করে ভারতের সম্রাট আকবরের রাজসভায় সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। শোনা যায় অন্ত্যোষ্টি ক্রিয়া তথা তাজিয়ার সময় গানের প্রয়োজন হতো, এখনও অন্তিমযাত্রায় ধর্মসঙ্গীতের পরিবেশনায় শোকসন্তপ্ত হৃদয়ের সন্তাপহরণ, শিহরণ যাই বলা হোক না কেন হয়— অদ্ভুত ব্যাপার! বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত বিশ্বে আছে। গুণীজনের দক্ষতা সেখানে। আমরা সবাই শুনে থাকি। 

সেরকমই আমার গানের একটি প্রিয় বিভাগ 'টপ্পা' সম্পর্কে কিছু কথা বলছি। যদিও এর পরিবেশনা নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। বেশ মজাদার গান। অনেকের মতে টপ্পা হলো কলকাতা অঞ্চলের বাংলা লোকগান। পাঞ্জাবের মূল গানের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবে পরিচিত। রামনিধি গুপ্ত এর উদ্ভাবক। 

প্রধাণতঃ উটের গাড়ি চালকের মুখে টপ্পা গান বেশি শোনা যেত। শোরী মিঁয়া নামে একজন সঙ্গীতজ্ঞ টপ্পা-কে সাঙ্গীতিক আদর্শে সম্পূর্ণ আলাদা একটি  গায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। A.F strangways-তাঁর 'MUSIC of lndia' গ্রন্থে বলেছেন— পাঞ্জাবের উট চালকদের লোক গান থেকে এর উৎপত্তি। কাপ্তেন উইলাভ উদ্ধৃতি কে অনুসরণ করেন।

রাজ্যেশ্বর মিত্র, বাংলা গানের গীতিকার। বাংলা গানের নানা দিক হতে টপ্পার উৎস সম্পর্কে তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন— "রাজপুতনার উষ্ট্রচালকদের গীত। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উঠের পিঠে চেপে বাণিজ্য করতে আসতো বণিকরা, সঙ্গে গান গাইতে গাইতে আসত। তাদের গানের দানাদার তানকেই বলা হতো 'জমজমা'। জমজমা কথাটির শব্দ-"দলবদ্ধ উষ্ট্র"বোঝায়।"

বাংলার আদি টপ্পার ব্যক্তিত্ব ছিলেন কালী মীর্জা (1780-81),  অবশ্য লক্ষ্নৌ অঞ্চলে শোরী মিঁয়ার টপ্পা ও জনপ্রিয় ছিল সে যুগে ।

এবার নিধুবাবু প্রসঙ্গে আসছি। নিধুবাবু জন্মের পরে বর্গী হামলার জন্য  মাতুলালয়ে কিছু দিন থাকেন। তার পিতার নাম হরিনারায়ণ কবিরাজ। তিনি কলকাতা এলেন, এবং তিনিই প্রথম ইংরেজিঅভিজ্ঞ কবিয়াল ও স্বাদেশিক সঙ্গীতের রচয়িতা। নিধুবাবু জনৈক ইংরেজি পাদ্রির নিকট ফার্সি ও ইংরেজি শেখেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করেন। পরে ছাপার অঞ্চলে কালেক্টরি অফিসের কেরানি হিসেবে চাকরি করেন। মুসলমান ওস্তাদ সারি মিঞার কাছে তালিম নেন। ওনার দু'বোন ছিল। পরে চাকরি  ছেড়ে, শোভা বাজার আটচালায় টপ্পা গানের জমজমাট আসর বসান। কিন্তু তাঁর সাংসারিক জীবনে বহু জ্বালা-যন্ত্রণা ছিল। প্রথমা স্ত্রী ও পুত্র শোকে মনমরা ছিলেন বহুদিন। আবার দ্বিতীয় বিবাহ করেন, সেই স্ত্রীকেও হারান। তৃতীয় বার বিবাহ করেন জোড়াসাঁকোতে। এই বিবাহে তাঁর চার পুত্র দুই কন্যা জন্ম গ্রহণ করে। তার একটি গীতিকা সংকলনের নাম 'গীতি রত্ন'। অধিকাংশ ধনাঢ্য বা সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন তার ভক্ত। টপ্পা সাধারণতঃ করুণরস, প্রেম এবং প্রধানত বিরহকে বিষয়বস্তু করে রচিত। সূক্ষ্ম ''শিল্প বোধ"-এর সংমিশ্রণ প্রচলিত ছিলো। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা দুই ধারা উপভোগে অভ্যস্ত ছিলেন। ওনারা পার্থক্যটা বুঝতেন না। বিনোদন, আনন্দ, উপভোগ ছিল তাদের কাছে প্রধান। টপ্পার উপযোগী কিছু বিশেষ রাগও আছে। যেমন--ভৈরবী, খাম্বাজ, দেশ, সিন্ধু, পিলুওবারোয়া। নিধুবাবুর গানে বিরহের প্রকাশ কত মার্জিত, পরিশীলিত। তিনি সৃষ্টি করলেন সংগীতের নতুন ধারা। হালকা, চটুল কিংবা লঘু, স্হূল রুচির কথা তাঁর উদ্দেশ্য ছিলনা। 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সেখানে বিদ্যাবাগীশের অনুরোধে ব্রহ্মসংগীত পরিবেশন করেন, 'পরমব্রহ্মাকক্ত্বৎপরাৎপর পরমেশ্বর'।
    
উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে অর্ধ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের হিসেবে টপ্পা একটি বিশেষ স্হান দখল করে আছে। সংস্কৃত লম্ফ শব্দ রূঢ়ারার্থে হিন্দুস্স্থানী সঙ্গীত গৃহীত  হয়েছিল। খেয়াল বা ধ্রুপদের সংক্ষিপ্তরূপে। খেয়াল বা ধ্রুপদের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে হিন্দিতে 'টপ্পা' শব্দটি গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী সময় টপ্পা স্থায়ী আসন লাভ করে। 

বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ নিধুবাবুর গানকে অশ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন। কয়েকটি গানের নিদর্শন— এক) 'নানান দেশে নানান ভাষা"। দুই) 'সখি! কোথায় পাব তারে, যারে প্রান সঁপিলাম।" তিন) 'অপার  মহিমা তব, উপমা কেমন দিব।" –যাই হোক নিধুবাবুর পর শ্রীধর কথক টপ্পা-কে সচল রাখেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে শ্রী রামকুমার চট্টপাধ্যায় টপ্পাকে সঙ্গীত হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলেন ।

রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুরের টপ্পা অঙ্গের গানগুলো জন সাধারণের মনে বিশেষ স্থান দখল করে। অবশেষে বলবো সঙ্গীতশিক্ষা মানুষকে সৃজনশীল করে তোলে। শোনা যায় ভগনী নিবেদিতা নিধুবাবুর গানের প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন। নিধুবাবু চলেন দিলখোলা, তবে মানুষের দোষে-গুণ থাকবেই। মৃত্যুর পর কিছু কুরুচিপূর্ণ টপ্পা তাঁর নামে গাওয়া হত। যাই হোক না কেন নিধুবাবুর সঙ্গে 'টপ্পা' শব্দটি অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে গেছে। 
                                
(তথ্যসূত্র- সঙ্গীত বই ও গুগল)






রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো বেড়াতে আসেন নি

রা না  স র কা র

রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে বহু বিদেশী সুরের পাশাপাশি, ভারতীয় মার্গসঙ্গীত এবং বাউল, কীর্তন, সারিগানের মতো নানান লোকসঙ্গীতের সুর ব‍্যবহার করলেও, উত্তরবঙ্গ তথা কোচবিহারের লোকসঙ্গীত "ভাওয়াইয়া" সেখানে অনুপস্থিত।ভ্রমণপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটির বেশি দেশ এবং ভারতের অধিকাংশ দেশীয় রাজ‍্যে গেলেও, কখনো আসেননি ভাওয়াইয়ার পীঠস্থান কোচবিহারে। অথচ কোচ রাজপরিবার সেসময় শিক্ষা-সংস্কৃতির অত‍্যন্ত অনুরাগী ছিলো। তাহলে রবীন্দ্রনাথ এখানে এলেন না কেন? আসুন,একটু ফিরে দেখা যাক।

1828 সালে রাজা রামমোহন রায়ের হাতে কোলকাতায় যে ব্রাক্ষ্মসমাজের সূচনা হয়েছিলো, তারা ছিলেন একেশ্বরবাদী এবং তৎকালীন সমাজের তুলনায় প্রগ্রেসিভ। 1833 সালে রামমোহনের মৃত‍্যুর পর এই সমাজের হাল ধরেন তার সাথী প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ। 1857 সালে এই সমাজে এসে যোগ দেন তরুণ কেশবচন্দ্র সেন, যার আসাতে ব্রাক্ষ্মসমাজ আন্দোলন এক নতুন গতি পায়। কিন্তু অচিরেই তুলনায়  রক্ষণশীল দেবেন্দ্রনাথের সাথে প্রগতিশীল কেশবচন্দ্রের মতপার্থক‍্য শুরু হয়। ফলস্বরূপ, কেশবচন্দ্র "ভারতীয় ( নববিধান ) ব্রাক্ষ্মসমাজ" নামে এক নতুন সংগঠন গড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।ফলতঃ এখান থেকেই দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারের সাথে কেশবচন্দ্র ও তাঁর পরিবারের একটা মানসিক দূরত্বের সূচনা হয় বলে অনেকে মনে করেন। 1872 সালে কেশবচন্দ্রের উদ‍্যোগে   পাশ হওয়া সিভিল বিবাহ আইনে একবিবাহ বাধ‍্যতামূলক হয় এবং কনে ও বরের বিয়ের ন‍্যূনতম বয়স যথাক্রমে ১৪ এবং ১৮ স্থির হয়।

এদিকে ঘটলো আর একটি ঘটনা।তৎকালীন প্রিন্সলি স্টেট কোচবিহারের তত্বাবধায়ক ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের উৎসাহে ও প্ররোচনায়, কোচবিহার রাজবাড়ি থেকে যুবরাজ নৃপেন্দ্রনারায়নের  বিয়ের প্রস্তাব এলো কেশবচন্দ্রের বড় মেয়ে সুনীতির জন‍্য। নৃপেন্দ্রনারায়ন এবং সুনীতি কারোরই তখন বিয়ের বয়স হয়নি। অথচ শিক্ষিত, প্রগতিশীল কেশবচন্দ্র আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন।বাংলার সমাজে সমালোচনার ঝড় উঠলো। তরুন ব্রাহ্মসমাজীরা প্রতিবাদপত্র পাঠালেন।কিন্তু কেশবচন্দ্র অনড়। তিনি প্রতিবাদপত্র পড়েও দেখলেন না। ফলে, 1878 সালের ৬ই মার্চ যুবরাজ ও সুনীতির বিয়ে হয়ে গেলো। ইতিহাসে তা "কোচবিহার ম‍্যারেজ"নামে পরিচিত। কিন্তু ভাঙ্গন ধরলো ব্রাক্ষ্মসমাজে। শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু-রা কেশবচন্দ্রের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়লেন "সাধারন ব্রাহ্মসমাজ"।
 যাইহোক, বিয়ের পরে কোচবিহার রাজপরিবারে বহুবিবাহ ও রাজ‍্যে সশ্রম কারাদন্ডের প্রথা রদ হয়।নৃপেন্দ্রনারায়ন নিজেও নববিধান ব্রাহ্মধর্ম গ্রহন করেন। এই দম্পতিই 1882 সালে কোচবিহারে গড়ে তোলেন দঃ-এশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্রাহ্মমন্দির।কোলকাতার অভিজাত "ক‍্যালকাটা ক্লাব" নৃপেন্দ্রনারায়নেরই প্রতিষ্ঠিত এবং "উডল‍্যান্ডস"  হাসপাতালটিও তৈরী হয় তারই জমিতে।অপরদিকে, নারীশিক্ষাবিস্তারে সুনীতিদেবী কোচবিহারে গড়ে তোলেন "সুনীতি একাডেমি"। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি প্রথম ইংরেজীতে "অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যন ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস" নামে আত্মজীবনী লেখেন। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে 1898 সালে স্বামীর সাথে রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ‍্যাভিষেকে যোগ দিতে বিলেত যান। হিজ হাইনেস নৃপেন্দ্রনারায়ন এবং হার হাইনেস সুনীতিদেবী ছিলেন তৎকালীন ভারতের অত‍্যন্ত আধুনিক রয়াল জুটি।

যাইহোক, ব্রাক্ষ্মসমাজকে কেন্দ্র করে কেশবচন্দ্র সেন ও তার পরিবারের সাথে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির যে মানসিক টানাপোড়েন তৈরী হয়, তার আঁচ কি কোচবিহার রাজবাড়িতেও পড়েছিলো? তাই কি শিক্ষা-সংস্কৃতির গুনগ্রাহী কোচবিহার রাজবাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ রবীন্দ্রনাথের কাছে এলোনা! তাই কি রবীন্দ্রনাথও নিজে থেকে আর  সেখানে  গেলেন না? 

নৃপেন্দ্রনারায়ন-সুনীতির দার্জিলিং-এর বাসভবনে গেলেও ঘরের কাছে কোচবিহার রাজবাড়িতে আসেননি কখনোই। আর তাই কি রবীন্দ্রসঙ্গীতের  সুরেও ভাওয়াইয়া রয়ে গেলো অনুচ্চারিত! কথাগুলো আমাকে ভাবায়। যদিও এর পক্ষে জোরালো কোনো প্রমান নেই, তবু তৎকালীন ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি  দেখলে সংশয়টা থেকেই যায়।






সোভিয়েত কবি ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো

শং ক র  ব্র হ্ম

কবি 'ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো' নিজের মিউজিয়াম তৈরি করে গিয়েছেন। দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন আড়াই দশক (পঁচিশ বছর প্রায়) আগে। সেখানেই মারা গেলেন গত ১লা এপ্রিল ২০২১ সালে। ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো আজও রুশ কবিতার এক উজ্জ্বল উদ্ধারকর্তা। 

ইয়েভতুশেঙ্কো কবিতা: ‘বাবি ইয়ার’ কবিতা: ‘বাবি ইয়ারের মাথায়/স্মৃতিস্তম্ভ নেই কোনও/খাড়া পাড় সোজা/নেমে গেছে নীচে/...দেখে ভয় হয়, মনে হয় বুঝি/ইহুদি জাতির মতো আমিও নিজেই/বুড়ো হয়ে গেছি।’ ---প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠছিল ট্রাজেডির দৃশ্য।

'বাবি ইয়ার' ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের একটি গভীর খাত। ১৯৪১-এর ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অভিযানে নাৎসিরা এই অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসী ও পুলিশের সহায়তায় ৩৩,৭৭১ জন ইহুদিকে হত্যা করে ওই খাতে ফেলে দেয়। এত অল্প সময়ে, এক দফায় এত বেশি সংখ্যক ইহুদি নিধনের ঘটনা আর কোথাও কখনও  ঘটেনি। ঘটনাটি ভীষণ স্পর্শকাতর,স্থানীয় অধিবাসীরা এতে জড়িত ছিল। ফলে সোভিয়েত আমলে এর উল্লেখও ট্যাবু ছিল। 

১৯৬১ সালে ইয়েভতুশিয়েনকোর এই কবিতা প্রকাশের পরই ঝড়  ওঠে। ইহুদি-বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেওয়ায় কবি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের শুধু নিন্দাই করেননি। আরও বলেছেন, এই গোপনীয়তার অর্থ নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো। ক্রুশ্চেভের আমলে এর সোভিয়েত প্রতিক্রিয়া কি ছিল? পার্টি নেতৃত্ব জানালো, রাজনৈতিক অপরিপক্বতা। রাজনৈতিক বোধের অভাবেই নাকি কবি, দুনিয়ার অন্য নাৎসি শিকারের কথা বলেননি, বিচ্ছিন্ন ভাবে ‘বাবি ইয়ার’-এর কথাই শুধু  বলে ছেড়ে দিয়েছেন। আর এই কবিতাই তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি দিল। এর ভিত্তিতেই সিম্ফনি রচনা করলেন সুরকার  দ্ মিত্রি সাস্তাকোভিচ। বিশ্বের ৭২টি ভাষায় অনূদিত হল ‘বাবি ইয়ার’। কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাই করে রাখা হল আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-র হলোকস্ট মিউজিয়ামের দেওয়ালেও। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরই  ইয়েভতুশেঙ্কোকে করে তুলল রুশ কবিতার ‘অ্যাংগ্রি ইয়াং ম্যান।’

কিন্তু শাসকের রাজনীতি অন্য রকম। দেশে উদারনীতির হাওয়া বইতে শুরু করেছে, দেখানোর জন্য ক্রুশ্চেভের আমলে বারবার এই ‘রাগী ছোকরা’কে বিদেশ সফরে উৎসাহ দেওয়া হল। ঘন ঘন বিদেশে যাতায়াতে কবি তখন সরকারের প্রায় প্রতিনিধিস্বরূপ। এখানেই পূর্বসূরি মায়াকোভ্স্কির সঙ্গে তাঁর তফাত। মায়াকোভ্স্কির পক্ষে ‘রাগী ছোকরা’র ভূমিকা এবং একই সঙ্গে ‘রুশ প্রলেতারীয় লেখক সমিতি’-র নেক-নজরে থাকা সম্ভব ছিল না, সোভিয়েত সাহিত্যের উপদলীয় কোন্দলে পড়ে শেষে আত্মবলি দিতে হয় তাঁকে। ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর পরের প্রজন্মের কবি, তার মেজাজ-মর্জি অন্য রকম।

ফের দুঃসাহসের পরিচয়। ১৯৬৩-র ফেব্রুয়ারিতে বেরলো তাঁর আত্মজীবনী। বিদেশ সফরে গিয়ে কবি যে সব সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, তারই ভিত্তিতে স্মৃতিকথা। একে সোভিয়েত সরকারের বিনা অনুমতিতে সাক্ষাৎকার, উপরন্তু কমিউনিস্ট যুবসংঘ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য। ফের সরকারি সমালোচনার ঝড়। ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো পাকা রাজনীতিবিদের মতো সেই সব লেখার দায়িত্ব অস্বীকার করলেন। পরে ‘ব্রাত্‌স্ক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র’ ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির অন্তরালে’-র মতো রাজনৈতিক প্রচারধর্মী কবিতা রচনা করে সরকারের ক্ষতি পূরণ করলেন। 

ইয়েভতুশেঙ্কোকে বুঝতে পারা সত্যিই খুব মুশকিলের! নইলে এত সম্মান পেয়েও কেন শেষপর্যন্ত ইয়েল্তসিনের আমলে সপরিবার দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালেন আমেরিকায়? অভিমানে? হয়তো বা। সোভিয়েত আমল থেকে গর্বাচেভ, ইয়েল্তসিনের সময়েও তিনি হরেক রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগেও (১৯৮৭ থেকে ’৯১ পর্যন্ত) সোভিয়েত পার্লামেন্টের সদস্য। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেই সুযোগ বুঝে কখনও প্রতিবাদী, আবার কখনও নীরব।

ভাঙনকালে সবই অনিশ্চিত। নব্বইয়ের দশকে তাই বিদেশে আশ্রয় নেওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন তিনি। ভুল করেননি। ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্ক দেশ ছাড়লেন, তার কয়েক বছর পর স্বদেশে ফিরে এলেন সলঝেনিতসিন। কিন্তু কয়েক বছর পর মস্কোয় বসে তাঁকে আক্ষেপ করতে হল, ‘আজ আর কথা বলতে কোনও বাধা নেই, কিন্তু কথা শোনার লোকের বড় অভাব।’  সলঝেনিতসিন-ই সে দিন দেশে ফিরে ভুল করলেও কবি ইয়েভতুশিয়েনকো করেননি।

ইয়েভতুশেঙ্কো বিদেশে থাকলেও, কিন্তু প্রায়ই তিনি দেশে আসতেন, পত্র-পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতেন। তাঁর ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা চালু হওয়ার পর রুশ কাব্যজগতের ঘোর সঙ্কট। ইয়েভতুশেঙ্কো রুশ কবিতার এক সুবিশাল সংকলন: 'রুশ কাব্যের দশ শতাব্দী’ নামে হাজার বছরের কবিতা সংগ্রহ বিদেশে বসেই সম্পাদনা করেছেন।

২০১০ সালে মস্কোর কাছে তাঁর নিজের মিউজিয়াম উদ্বোধন করে গিয়েছেন কবি নিজেই। সেখানেই সংরক্ষিত আছে তাঁর পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র প্রভৃতি সবকিছু। আমেরিকা থেকে তাঁর মরদেহ সেখানে এনে সমাহিত করা হবে, এই চুক্তিও তিনি করে গিয়েছিলেন সরকারের সঙ্গে। গতবছর (২০২১ সালে) পয়লা এপ্রিল আমেরিকায় মৃত্যু, তার আগে এ ভাবেই নিজের ব্যবস্থা নিজে করে গিয়েছেন। তিনি তো আর আত্মঘাতী মায়াকোভস্কি নন!

ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো হচ্ছেন সেই ধরণের মানুষ, যাঁদের বেলায় বয়স দিয়ে (যাপিত জীবনের) হিসাব কষে মেলানো সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা। এর সঙ্গে খোলা মঞ্চে তাঁর অসাধারণ আবৃত্তির গুণাবলি যোগ করলে সব অর্থেই ইয়েভতুশেঙ্কো ছিলেন একজন সম্পূর্ণ মানুষ, রুশ ভাষা না জানা সত্ত্বেও যাঁর আবৃত্তি মোহগ্রস্ত ও রোমাঞ্চিত করেছিল একসময় লন্ডনের রয়াল ফেস্টিভ্যাল হল আর নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কবিতা শুনতে সমবেত হওয়া শ্রোতাদের। আর নিজ দেশ রাশিয়ায় তাঁর কবিতা শোনার জন্য যে স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে উপচে পড়ত কবিতাপ্রেমীদের ভিড়, সেটি আজ ইতিহাস।

সমালোচনার তীর অবশ্য জীবদ্দশাতেই ইয়েভতুশেঙ্কোর দিকেও তাক করা হয়েছে বারবার। ‘তিনি যত না কবি, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিবিদ’—তাঁর সম্পর্কে সমালোচকদের কারও কারও মত এই রকম। পরবর্তী সময়ে তাঁকে দলত্যাগী গ্লাসনোস্তের অনুসারীও বলা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কারও কারও দৃষ্টিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বহুরূপীর সাজ ধরা পশ্চিমের দালাল। তবে রাজনীতি তাঁর কবিতায় সেই শুরুর দিনগুলো থেকেই উপস্থিত ছিল। তাঁর প্রবল আলোড়ন তোলা কবিতা ‘বাবি ইয়ার’ও যথেষ্ট রাজনৈতিক।

নাগরিক কবি ইয়েভতুশেঙ্কোর নাগরিকত্বের পরিমাপ কোনও একটি দেশ দিয়ে করা সম্ভব নয়। সমস্ত বিশ্বকে তিনি দেখেছেন মানুষের নিবাস হিসেবে। অনুক্ষণ আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনা করেছেন, মানুষের এই আবাসভূমি একদিন হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থে 'হানাহানি-মুক্ত' বিশ্ব, যেখানে থাকবে না জাতিগত ও আদর্শগত কোন ভেদাভেদ। এখানে অনূদিত কবিতাটিতেও মূর্ত হয়েছে তার সেই আকাঙ্ক্ষা।

রুশ ভাষায় এই কবিতার নাম ‘ইয়াখাচু’। ইংরেজিতে ‘আই ওয়ান্ট’। আমি চাই.....আমি চাই/জন্ম নিতে/প্রতিটি দেশে,/চাই আমি পাসপোর্ট/সবগুলো দেশের-/ছড়িয়ে দিতে চাই ত্রাস/সব কটি/বিদেশ দপ্তরে;/হতে চাই/প্রতিটি সাগরের সমস্ত মাছ/আর পথের/সব কটি কুকুর।/চাই না মাথা নত করতে/দেবতাতুল্য কারও সামনে/কিংবা গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীদের গির্জায়/বরং চাই/আনন্দে মত্ত হতে,/বৈকাল হ্রদের গভীরে ঝাঁপ দিয়ে/ভেসে উঠতে/অন্য কোথাও;/মিসিসিপিতেই বা নয় কেন?/আমার এই প্রিয় বিশ্বে/আমি হতে চাই/নিঃসঙ্গ এক তৃণ,/তবে কোমল নার্সিসাস নয়/যে থাকে নিজের মাঝে চুম্বনে মগ্ন—/আপন খোলসে ঘেরা আয়নায়।/আমি চাই/ঈশ্বরের যে কোনো জন্তু হয়ে জন্ম নিতে/জরাগ্রস্ত শেষ হায়েনাতেও আমার আপত্তি নেই,/তবে স্বৈরাচারী হয়ে কখনও নয়/এমনকি স্বৈরাচারী বিড়াল হয়েও নয়।/আমি চাই/যে কোনো অবস্থায়/মানুষ হয়ে পুনর্জন্ম নিতে:/হতে পারে সে প্যারাগুয়ের কারাগারে/নিগৃহীত বন্দী,/হংকংয়ের বস্তির গৃহহীন শিশু,/বাংলাদেশের জীবন্ত কঙ্কাল,/তিব্বতের পুণ্যবান ভিক্ষু,/কেপটাউনের কৃষ্ণাঙ্গ,/তবে কখনও/শোষকের বেশে নয়।/কেবল তাদেরকেই আমি ঘৃণা করি/জীবন যাদের ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ-/যেন ভারী রসে/ভিজিয়ে রাখা হায়েনা।/আমি নির্দ্বিধায় শুয়ে পড়তে চাই/বিশ্বের সব শল্য চিকিৎসকের ছুরির নীচে,/হতে চাই কুঁজো, অন্ধ/ভুগতে চাই সব রকম অসুখে,/আঘাতে আর ক্ষতে/হতে চাই আমি যুদ্ধের শিকার,/কিংবা পুড়ে যাওয়া সিগারেট তুলে নেওয়া ঝাড়ুদার,/যেন উন্নাসিকতার নোংরা জীবাণু/ঢুকে না যায় নিঃশব্দে ভেতরে।/চাই না আমি অভিজাতের দলভুক্ত হতে/তবে অবশ্যই রাজি নই/ভীরুদের পালে যোগ দিতে/পালের প্রহরী কুকুর হতে,/কিংবা সেই ভীরুর পালে বসতি গড়ে নেওয়া/রাখাল হতে।/সুখী হতে চাই জীবনে আমি,/তবে কাউকে অসুখী রাখার বিনিময়ে নয়,/স্বাধীনতা চাই আমি/তবে কারও পরাধীনতার বিনিময়ে নয়।/ভালবাসতে চাই আমি/বিশ্বের তাবৎ রমণীকে,/আর সেই সঙ্গে মাত্র একবার হলেও চাই/রমণী হয়ে জন্ম নিতে.../পুরুষের মর্যাদাকে খাটো করে দিয়েছে/জগদ্ধাত্রী নিজেই।/যদি এমন হতো/মাতৃত্ব দেওয়া হতো পুরুষকে?/যদি তার হৃৎপিণ্ডের ফাঁক দিয়ে/উঁকি দিত/নিষ্পাপ কোনও শিশু,/পুরুষ তবে হয়তো বা হয়ে উঠত না/এতটা নিষ্ঠুর।/আমি হতে চাই মানুষের/প্রতিদিনের খাবার—/যেমন,/শোকাহত ভিয়েতনামী রমণীর হাতে ধরা/এক বাটি ভাত,/নেপলসের শ্রমিক পাড়ার/সস্তা মদ/কিংবা চাঁদের কক্ষপথে ঘুরে বেড়ানো/ক্ষুদ্র টিউবে ভরা পনির:/আমাকে দিয়েই চলুক না হয়/সবার ভোজন/আমাকেই সকলে করুক পান,/আমার মৃত্যু যেন শুধু/কারও উপকারেই আসে।/সমস্ত সময়ের অংশ হতে চাই আমি,/চাই ইতিহাসকে এভাবে নাড়া দিতে/সবাই যখন অবাক হবে বুঝতে পারে/কতটা সবজান্তা ছিলাম আমি।/আমি ট্রয়কায় চেপে/পুশকিনের কাছে নিয়ে যেতে চাই নেফেরতিতিকে/আমি চাই মুহূর্তের শূন্যতাকে বাড়িয়ে দিতে শতগুণ,/যেন একই মুহূর্তে/সাইবেরিয়ার জেলেদের সঙ্গে/ভোদকার স্বাদ নিতে পারি/হোমার/দান্তে/শেকস্পীয়ার/আর তলস্তয়ের সঙ্গে মিলে।/যেন পান করে যেতে পারি/শুধু কোকাকোলা ছাড়া/অন্য যে কোনও পানীয়;/যেন যোগ দিতে পারি কঙ্গোর টমটম নাচে,/রেনোর কারখানার ধর্মঘটে,/ব্রাজিলের বালকের সঙ্গে বলের পিছু ছুটে যেতে/কোপাকাবানার সৈকতে।/আমি জেনে নিতে চাই/প্রতিটি ভাষা,/ভূগর্ভের জলের রহস্য,/আর করে যেতে চাই সব রকম কাজ একই সময়ে।/আমি নিশ্চিত করে বলব/একজন ইয়েভতুশেঙ্কো ছিলেন কেবল কবি;/দ্বিতীয়জন ছিলেন পলাতক যোদ্ধা,/কোনও এক জায়গায়,/যে জায়গার নাম আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়/নিরাপত্তার কারণে;/তৃতীয়জন বার্কলের ছাত্র,/চতুর্থ জর্জিয়ার প্রফুল্ল মাতাল;/আর পঞ্চমজন/হয়তো আলাস্কার এস্কিমো শিশুদের শিক্ষক;/ষষ্ঠজন/তরুণ এক প্রেসিডেন্ট,/কোনো এক দেশের, ধরুন সিয়েরা লিওন;/সপ্তমজন/হাতে খেলনা নিয়ে দোলনায় এখনো দুলছে;/আর দশম.../শততম.../কোটিতম.../আমার জন্য কেবল নিজের এই পরিচয় যথেষ্ট নয়,/হতে দিন আমাকে সমস্ত মানুষের/সব রকম জীবনের/সাধারণতঃ থাকে যা জোড়া,/তবে কার্বন কাগজের বেলায়/ঈশ্বর ছিলেন বড্ড কৃপণ,/আর তাঁর প্রকাশনা কোম্পানি তৈরি করেছে/আমার কেবল একটি মাত্র অদ্বিতীয় কপি।/তবে ঈশ্বরের সমস্ত তাস/আমি মিশিয়ে দেব-/তাঁকে ফেলব চরম বিভ্রান্তিতে/জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত/সহস্র অনুলিপিতে হবে আমার আবির্ভাব,/যেন আমারই কোলাহলে পৃথিবী থাকে পরিপূর্ণ হয়ে/ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কম্পিউটার/বিশ্বজুড়ে আমার গণনায়/প্রতিটি প্রতিরোধে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করে যাব আমি;/হে মানবতা,/প্রতি রাতে/ক্লান্ত চাঁদের মতো মৃত্যু হবে আমার/আর প্রতিদিন সকালে হবে আমার পুনর্জন্ম/সদ্য জেগে ওঠা সূর্যের মতো,/মাথার খুলিতে/মৃত্যুহীন নরম চিহ্ন নিয়ে।/আর যখন মৃত্যু হবে/সাইবেরিয়ার সবজান্তা এই ফ্রান্সুয়া ভিলনের,/আমাকে দিয়ো না কবর/ফ্রান্সে/কিংবা ইতালিতে,/বরং কবর দিয়ো এই রাশিয়ায়, সাইবেরিয়ার মাটিতে/সবুজ এক শান্ত পাহাড়ে,/যেখানে প্রথম আমি বুঝে উঠতে পেরেছিলাম/এই আমি/আছি তোমাদের সকলের জন্য, সকলের মধ্যে।

[তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, শব্দ সংখ্যা-১৪৭৯]




ভাবনায় বৈশাখ ও পঁচিশে বৈশাখ

মৌ সু মী  মু খা র্জী
 
"এসো হে বৈশাখ, এসো এসো"
 ---নব আনন্দে জেগে ওঠার ডাক পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং কবিগুরু।
 পুরাতন বছরের মলিনতা জীর্ণতা আবিলতা দাবদাহে দহন করো।
সমাজের অবক্ষয়  রুখে নতুন করে জেগে ওঠো নব রবির সাথে।  ঊষালগ্ন থেকেই শুরু হোক পুরাতন বৎসরের যত আবিলতা পাপ, রবির উজ্জ্বল কিরণে লয় হোক। 

"আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো"   যত ব্যর্থতার গ্লানি দূর করে নতুন দিনের সূচনা হোক।
 
"রস নাই রস নাই দারুন দহন জ্বালা"

চৈত্রের শেষে বৃক্ষে বৃক্ষে নব কিশলয়। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া পলাশ জারুল পারুল গুলঞ্চ অমলতাস ফুলে রঙের আগুন ঝরে পড়ে। হালকা আতপ তাপ, কখনো আবার ঈশান কোনে মেঘের পূর্বাভাস। কালবৈশাখীর আগমন। তছনছ আম লিচুর মুকুল, বিপর্যস্ত জনজীবন।

তারপর বৈশাখের আগমন। তীব্র তাপে ছাতি ফেটে যায় তৃষ্ণায়। জায়গায় জায়গায় পথ চলতিদের জন্যে জলসত্র। মাটিও ফুটিফাটা , বৃষ্টির আশায় চাতক চাহনি।
"মধ্য দিনের যবে গান বন্ধ করেছে  পাখি" 

এই বৈশাখের মধ্যদিনে যখন পাখি পশু যে যার আপন আলয়ে বিশ্রাম নেয়, বন্ধ করে কুজন, সেই দারুন অগ্নিবানের দিনে পথ চলতি পথিক বিশ্রাম নেয় তরুতলে। জীমুত বহন করে  বারিধারার পূর্বাভাস। কখন কালো করে আসে ঈশান কোন। মেঘের সঞ্চার হয়। বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি। নামে তাপিত পরানে। সাথে কালবৈশাখী ঝড়ের উদ্দামতা।
কখন এই ঝড় প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি করে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্ম কাল। বারোমাসের তেরো পার্বণ  জুড়ে আছে বাংলা ও বাঙালি। হালখাতা, পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া জামাই বা অরণ্য ষষ্ঠী দিয়ে শুরু হয় বৈশাখ পরব।

বহু আগে এই চৈত্র বৈশাখের সময় হতো দুর্গা পূজা বা বাসন্তী পুজো। অন্নপূর্ণা, শিবের গাজন।
কোনো কোনো জায়গায় চড়ক উপলক্ষ্যে মেলা হয়। এখনো হয়, তবে বাংলায় তথা সারা বিশ্ব জুড়ে শরৎকালেই দুর্গাপূজা হয়।
সে কথা থাক, সে অন্য ইতিহাস।

শুধু উৎসব নয়, কত ফুলের সাথে কত রকমের ফল জন্মায় এই সময়ে। আম জাম লিচু তরমুজ আতা নানা রসালো ও সুমিষ্ট ফল  জন্মায় বৈশাখে, দাবদাহেও অপূর্ব  সৃষ্টি প্রকৃতির। বছরের প্রথম দিন শুরু হয় হালখাতা দিয়ে।
 তীব্র তাপদাহই শুধু গরমের বৈশিষ্ট্য নয়, বকুল, জুঁই, বেলী, রজনীগন্ধা, সুগন্ধি ফুল ও  কৃষ্ণচূড়া জারুল গুলঞ্চ চৈত্র মাসে  হলেও নয়ন জুড়ায় বৈশাখেও।
টগর, করবী, মালতীলতা  ও অন্যান্য নয়নাভিরাম ফুলও ফোটে  তাপদাহে। কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া চৈত্র মাসের ফুল তবুও  বৈশাখের  তীব্র দহনে আগুন ঝরায় গাছ, লাল সবুজের মিশ্রণ।

প্রতিটা বৈশাখ মানুষকে কম বেশি দার্শনিক করে তোলে। বৈশাখ মানেই পঁচিশে বৈশাখ। বাঙালির চিরকাল আবেগের জায়গা রবি ঠাকুর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বৈশাখেই জন্মেছিলেন। পঁচিশে বৈশাখ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনন্য পুরুষ রবীন্দ্রনাথ। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের (১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) পঁচিশে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে কবির জন্ম। রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্ভার বিপুল, বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিস্ময়কর সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তাঁর কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, সংগীত, শিশুতোষ রচনা ও পত্রসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অমর সংযোজন। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেলে বিশ্বসাহিত্যে বাংলা ভাষা পায় গৌরবময় সম্মান। স্বকীয় নান্দনিক ভাবনায় তিনি সমৃদ্ধ করেছেন চিত্রকলাকেও। তাঁর লেখা গান আমাদের জাতীয় সংগীত। বাঙালির মহান মুক্তিসংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের গান জুগিয়েছে প্রেরণা। কীর্তিময় জীবনে সাহিত্য-সংস্কৃতির বাইরেও তাঁর গতিময় জীবনের দেখা পাওয়া যায়। সাংগঠনিক কাজ ও সামাজিক উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী। কৃষক ও পল্লি উন্নয়নের কথা ভেবে তিনি চালু করেছিলেন কৃষিঋণ-ব্যবস্থা। শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তারই সৃষ্টি দিয়ে গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মত আমরা তাঁর জন্মজয়ন্তী পালন করি। নৃত্য গীত গীতিনাট্য আবৃত্তি  দিয়ে পালিত হয় রবীন্দ্র জন্মোৎসব। রামমোহন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, গ্রীষ্মেই জন্মেছেন, তাঁরা  উজ্জ্বল করেছেন বিশ্বকে স্বমহিমায়।

কবিগুরু ঋতু সৌন্দর্যের কবি। তাঁর লেখায়  ঋতু- সাহিত্যে যে বৈচিত্র্য দেখা যায় তা শুধু  আকাশে -বাতাসে মেঘে -বর্ষণে ফুলে -পল্লবেই দেখা যায় তা নয়, সেই বৈচিত্র্য শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্যে ও সমানভাবে দেখা যায়। তিনি কখনো দেখেছেন প্রকৃতির কঠোর রূপ কখনো কোমলতা, বা  স্নিগ্ধতায় সৃষ্ট রস। দারুন গ্রীষ্মে  যেমন প্রখর তপন তাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার।
তারপরেই আসে  চাঁপাফুলের ছোঁয়া, বকুলমালার গন্ধ। বৈশাখের রূঢ়তা  রুদ্রতা ও কোমলতা দিয়ে সকল গ্লানি  দূর করে পবিত্র নির্মল এক পৃথিবীর কামনা করেছেন তিনি। বৈশাখ ভাবনায় আর একটি কারণ সত্যজিৎ রায় যাপন। চিন্তার স্ফুরণ সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা সামাজিক চেতন, ভবিষ্যতের দিকে দর্শন, কালজয়ী কর্মজীবন এবং ক্ষণজন্মা প্রতিভার সমন্বয়ে উনিশ শতক ও বিংশ শতাব্দী জুড়ে বাংলার এক বৈপ্লবিক আলোড়ন  ঘটেছিল, আর সৃষ্টি হলো নবজাগরণ।
 নবজাগরণের অভিমুখ যদি  রামমোহন থেকে শুরু হয়ে রবীন্দ্রনাথে উৎকর্ষ লাভ করে তাহলে সত্যজিৎ রায়ও নবজাগরণের  পথিকৃৎ।

ভাবনায় বৈশাখ লিখতে গেলে  তাঁদের মত অনেকের কথাই বলতে বাধ্য কলম। সব মিলিয়ে এক অসীম আনন্দ  বছর শুরুর প্রারম্ভেই।

(শব্দ সংখ্যা: ৬৮৬)




একটু ভাবি না

চৈ তি  চ ক্র ব র্তী 

পৃথিবীর জল হাওয়ার মতো সবাই দূষণে ভুগি আমরা। পুরুষের সবচেয়ে বড় কষ্ট তারা কাঁদতে পারেন না। নারী কেঁদে তাঁর কষ্ট খানিকটা বইয়ে দিতে পারেন বটে। 

পুরুষদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সংসার চালানো। সেক্ষেত্রে সেটা না পারলে তাদের 'বেকার' আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। মেয়ে 'বেকার' আমরা বলি না। তাদের দায়ভার ঘরের। ছেলেরা এক জায়গায় ভীষণ অসহায় তারা আর যাই করুক যতই স্বাধীনতা থাক প্রতিভূ-র কারণে তাদের মেয়েদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। আর তার জন্যে মেয়েদের খরচ সম্পূর্ণ তারাই বহন করেন। আজকাল মেয়েরা সে জায়গাতেও এগিয়ে আসছে। 

বিয়ের পর একদিকে 'মা' একদিকে স্ত্রী দু'জনের সমস্ত আশা প্রত্যাশা তাকেই ঘিরে। দু'জনের চাওয়া নানান জায়গায় ভিন্ন হলেও দু'জনের চেষ্টা থাকে তাঁর হয়েই থাকবেন। শুরু হয় যুদ্ধ। এ জায়গায় এসে অনেকেই অসহায় হয়ে পড়েন। 

পুরুষরা যদি স্ত্রীকে শাসন করেন তাহলে তিনি অত্যাচারী। শাসন না করলে স্ত্রৈণ। স্ত্রীকে চাকরি করতে না দিলে সন্দেহপ্রবণ। চাকরি করতে দিলে অকর্মণ্য বউয়ের পয়সায় খাচ্ছে বলে দুর্নাম। বাড়ির বাইরে ঘুরলে ভবঘুরে। বাড়িতে বসে থাকলে অকর্মণ্য। যাবে তো কোথায় যাবে। 

অনেক পুরুষ অনেক সময় ট্র্যাপে পড়েন কিন্তু তারা কার কাছে গিয়ে বলবেন সেসব? পৃথিবীর সব মানুষ সমান নয়। তবু কিছু তো আছেনই যারা পেছনেই পড়ে থাকেন। তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়াও তো তাদের জন্যে সহজ নয়। 

পুরুষবর্গ ইচ্ছে করলেই নিজের আয়ে নিজে বসে আরাম করে খেয়ে দেয়ে জীবন কাটাতেই পারেন, কিন্তু না, তারা ফ্যামিলি তৈরি করেন খরচ চালান। অনেকে বলবেন সেটা তাদের স্বার্থে। আমি যদি বলি সে স্বার্থতেও তো কিছু মানুষ ভরণ পোষণ পান। ছেলে মেয়ে শিক্ষা দীক্ষা পায়, তাহলে সেটা তাঁদের মহানতা নয়? নিজের কষ্টের উপার্জন পুরোটা তুলে দেওয়া কম কথা তো নয়। কোনো উপার্জনই সহজ তো নয়।  

সব পুরুষই ধর্ষক নন। নাহলে তাদের ক্রেডিট কার্ডে স্ত্রীয়ের শপিংমলের এন্ট্রি হতো না। 
অনেক নারী তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই বিয়ে করেন। এমনটাও আছেই। রাতবিরেতে মেসেঞ্জারে টোপ ফেলে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করেন। যদি তা না পান সাপের মতো ফণা তুলে জীবন বিষময় করে দেন। আর আইন আদালত তো মেয়েদের অনেকটা নিয়মে সহায়। তার অপব্যবহার ও কেউ কেউ করেই থাকেন। 

পরিশেষে বলি লিঙ্গভেদে বিচার নয়। আমার এক কবি বন্ধু সঠিক বলেছেন সকলকে মানুষ হতে হবে। মানবিক হতে হবে। উভয় পক্ষই কষ্টের শিকার। 

তবে মেয়েরা নিজের ঘর ছেড়ে এসে কষ্ট করেন, পুরুষরা নিজের ঘরে থেকেই কষ্ট করেন। কম বেশি সকলেই দূষণের কবলে। 
মহানতা দু'পক্ষেই আছে বলে পৃথিবীতে আজও বেশ কিছু ভালো কাজ হচ্ছে চলছে চলবেও। 
দু'পক্ষকেই সমানভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে তবেই পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে। কোনো এক পক্ষ শোধরালে হবে না।

সবচেয়ে বড় প্রয়োজন যুগ অনুযায়ী সংবিধান বদলের মতো নিয়মনীতি বদলের কথা মাথায় রাখতে হবে। কোনো এক পক্ষের হাতে ক্ষমতা বেশি হলে আর এক পক্ষ কষ্ট করবেই। সমাধান হবে না। ক্ষমতা দিতেও হবে, অপব্যবহার যাতে না হয় সেটাও নিয়মে রাখতে হবে। 

পরিশেষে বলি যা লিখলাম সম্পূর্ণ নিজের ভাবনা থেকে। জানি আপনাদের বিচার বুদ্ধি
অনেকটাই উর্বর আমি নিজেকে তার সমতুল্য কোনোদিন ভাবি না। আশাকরি সেই জায়গা থেকে প্রশ্রয় পেয়েই যাব।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪