সাহিত্য সমালোচনা
আলো অন্ধকারেই চেতনার সাঁকোটা দুলছে...
পা র মি তা ভৌ মি ক
চিন্ময় গুহর "ঘুমের দরজা ঠেলে"--- থেকে বিকিরণ হচ্ছিল কিছু অজগতী কম্পন। পড়তে পড়তে নিবিষ্ট হয়ে দেখলাম, কেবল দৃষ্টবস্তু নয়, দৃষ্টবস্তুকে ঘিরে একটা অ-দৃষ্ট বস্তুজগৎ আছে। তার একখানি অবগুণ্ঠনও আছে। সেই অবগুণ্ঠন সরে গিয়ে চিন্ময় যেন এ আলেখ্যর কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে, দেখতে পেলেন একটা অতিজাগতিক স্পেস যেখানে জীবিত-চিন্ময়ের সঙ্গে দেখা হচ্ছে মৃত অথবা অতিজীবিতদের। অবচেতনের মাইক্রোচিপ থেকে উঠে আসছেন চিন্ময়ের প্রিয় মানুষেরা। সে এক অলৌকিক উদ্ঘাটন।
ব্যক্তের পিছনে অব্যক্তের স্বীয়-সত্তার ও শক্তির একটা লীলাখেলা সর্বক্ষণ চলছে। আশ্চর্য হয়েছি যখন দেখেছি তারই সন্ধান গুহাহিত হয়ে আছে চিন্ময় গুহের দৃষ্টিসৃষ্টির ও চেতনার অন্বেষণের আস্পৃহায়।
আমরা কেবল চোখে দেখা জগতের সাতটা রঙ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি। কিন্তু চিন্ময়ের কাছে ধরা দেয় তৃতীয় অন্য আরো রঙ--- সে রঙ লালের নীচে এবং বেগুনীর ওপরে--- সে রঙ আলট্রা-ভায়োলেট ও ইনফ্রা-রেড।
পার্থিব জীবন ও মৃত্যুর যে ছবি সবার পরিচিত, তার বাইরেও চিন্ময়ের কাছে ধরা দিয়েছে অন্য আর একটি জগৎ, যেখানে জীবিত ও মৃতের আনাগোনায় স্বপ্নচারণার তৃতীয়বিশ্ব গড়ে দিয়েছেন চিন্ময় গুহ। বলাবাহুল্য, এই বিশ্বেই লুকিয়ে আছে নতুন-রহস্য।
ধ্বনি সম্পর্কে এবং তার বিন্যাস সম্পর্কেও ঐ একই কথা খাটে।
আমাদের শ্রবণশক্তি ধ্বনির কয়েকটি গ্ৰাম মাত্র ধারণ করতে পারে। তার চাইতে তীব্রতর কিম্বা মৃদুতর শব্দ আমরা শুনতে পাই না। এখানেই ফুটে ওঠে আঁধারে-আলো-ভাবের নীহারিকা।
চিন্ময়ের 'ঘুমের দরজা ঠেলে' গ্রন্থখানি আমাদের সেই পাঠ-আস্বাদন দেয় যেখানে স্বপ্নে শুনতে পাওয়া যায় জল-কল্লোলের শব্দ, যেখানে অনেক রাতে ঘুম ভেঙে চিন্ময় দেখেন তিনি কাঁদছেন, কিন্তু কার জন্যে? তিনি দেওয়ালে মাথা ঠুকছেন আর বলছেন--- 'সিলভিয়া, সিলভিয়া---।' একটা রক্তের ধারা গড়াতে গড়াতে দেওয়ালের মাঝখানে শিশির হয়ে থাকল। পাঠমগ্ন আমিও কিন্তু দেখেছি সে রক্তের রঙ। দেখেছি ঐ শিশিরের রঙও... ইনফ্রা-রেড।
আবার "ঘুমের দরজা ঠেলে" প্রসঙ্গে আসছি। চিন্ময় দেখছিলেন স্বপ্ন-জাগরণে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গ্যাস আভেনের ভেতর অনেক দূর মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছিল সিলভিয়া। সিলভিয়া প্লাথ। সংবেদী চিন্ময় আত্মিক যন্ত্রণায় প্রশ্ন করেছেন---"যন্ত্রণার এমন দোমড়ানো মোচড়ানো রূপ কি শুধু কবিদের ভবিতব্য?"
চিন্ময় গুহকে পড়ে মনে হয়েছে জাগ্রত চেতনার বাইরে প্রসারিত যে অজানা-স্পেস, যে অব্যক্ত,
তার অভিমুখেই চিন্ময় গুহর অন্তর্শায়ী কবি বা লেখকের চিত্তের অভিযান চলে। কিন্তু সেখানে আমরা, যারা সাধারণ মানুষ, তারা সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত।
এই রাস্তা আমরা চিনি না, আর চিনি না বলেই একা একা যাবার বিপদও তো আছে। চিন্ময় তাঁর ঘুমের দরজাটি ঠেলে আমাদের নিয়ে চললেন সেখানে। আমরাও তাঁরই মতো একটা সমনাম্বুলিস্ট ঘোরে চললাম তাঁর পিছনে। আমাদের অভিভাবকত্ব করলেন চিন্ময়। আমাদের মেন্টর চিন্ময়।
'ঘুমের দরজা ঠেলে' পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে যে আমাদের যতটুকু জাগ্রতের অঞ্চল তা অতি সামান্য। আমাদের মধ্যে যতটা সুস্পষ্টের ও গঠিতের তা অপেক্ষা অনেক বেশিই আছে অস্পষ্টের ও অগঠিতের। তাই বুঝি সেসব দেখা ও বোঝার জন্য এমন একখানি গ্ৰন্থ চিন্ময় রচনা করেছেন। বইটি পড়ে মনে হয়েছে যা স্ফুট বা প্রকাশিত, তা হয়তো ফল হতে পারে কিন্তু বীজবপন থেকে পুষ্পোদ্গম পর্যন্ত সমস্ত ধারাটাই লুকিয়ে রয়েছে অপ্রকাশের মধ্যে।
চিন্ময় গুহ যে জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তা আমার কাছে মূলতঃ ধরা দিয়েছে তিনটি ধারায়--- এক) জাগ্রত চেতনার উর্দ্ধে রয়েছে বা থাকা সম্ভব এক উজ্জ্বল চিন্ময়-জ্যোতির সাগর, দুই) জাগ্রত চেতনার নীচে রয়েছে আর এক চেতনার জগৎ--- তামস সাগর--- অপ্রকেত়়ং সলিলং।
এইভাবে দুইপাশে আলো-আঁধারী বিস্তারের মাঝখানে জাগ্রতের ক্ষুদ্রগন্ডীটুকু আমাদের জন্য রক্ষিত। জাগ্রত ভেঙে সেখানে ঢুকে পড়া বিপজ্জনক, সেটি জেনে অথবা না জেনেই কি ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন চিন্ময়? তবে সেটি না হলে হয়তোবা এমন একটা তৃতীয় জগতের সন্ধান আমরা অর্থাৎ পাঠকরা, পেতামই না।
এর জন্য শরীরে ও মনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় নি কি চিন্ময় কে? হওয়াটাই কিন্তু খুব স্বাভাবিক। চিন্ময় গুহ, জাগ্রতের বাইরে এই জগৎ ও সৃষ্টিতে সত্যনিষ্ঠ বিচরণ করেছেন আর তাই প্রথমেই তাঁকে জাগ্রতের বৃত্তি ছাড়তে হয়েছে।
মনে হয় এইভাবে অপ্রত্যক্ষ লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করার জন্য চিন্ময়ের ভিতরেই ছিল সেই অনুযায়ী অপ্রত্যক্ষ নিজস্ব কোন বৃত্তি। আর সেটি অনিবার্য ভাবেই উদ্বোধিত হয়েছিল। এই অপ্রত্যক্ষ জগতের মধ্যে হঠাৎ না জেনেশুনে গিয়ে পড়লে কত রকম যে ভালো মন্দ শক্তির মুখ খুলে যায় তার কোন ঠিকানা নেই। কবি-লেখকগণের সেসব অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আছে। আমার তো মনে হয় সেটি চিন্ময় গুহ মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। তাঁর লেখা থেকে তাই ঝরে পড়েছে বিন্দু বিন্দু রক্ত আর আয়ু। কষ্টে অন্তরটায় মোচড় লাগে যখন চিন্ময় বলেন--- "আমি এক অলৌকিক সমুদ্রসৈকতে শুয়ে আছি। আমার সামনে খুলে যাচ্ছে আকাশের হাজার জানলা। খুব জোরে দৌড়চ্ছে কেউ, কাচ ভাঙার শব্দ। অবশেষে একটি সাদা পাতা। চুপ। সাদা। সাদা রঙের আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
আমি সেই সাদা পৃষ্ঠার শান্তি ছুঁয়ে থাকি।" ----এই স্তব্ধতা ভেঙে বারবার আবার আলোর জন্য যাত্রা করেছেন কবি-চিন্ময়, গদ্যকার চিন্ময়, জীবনশিল্পী চিন্ময়।
দৃশ্য জগতের মূলীভূত সত্য আত্মগোপন করে আছে অদৃশ্য জগতের মধ্যে। তাই যদি হয় তবে মধ্যস্থ এইসব স্তরগুলোর মূলশিকড়টি কোথায় প্রোথিত? মনে হয়, ক) ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে পদতল―― এই দুটি প্রান্তের মধ্যে মানুষের যে মানুষী-আধার, তা হলো মানুষের ব্যক্তরূপ। খ) কিন্তু পায়ের তলা থেকে নিচের দিকে প্রসারিত হয়ে আছে তার নিজেরই আধারের আরও একটা প্রতিরূপ। দেহের, প্রাণের মনের গুপ্তকথা সব এইখানে বাসা বেঁধে আছে--- একেই বলতে হয় মগ্নসত্তা (subliminal self) অবচেতনা।
সেই অবচেতনাকেই আজ খুঁড়ে বার করেছে মানুষ। তা করুক। কিন্তু সেপথে সশস্ত্র যেতে হয়। বলাবাহুল্য, চিন্ময় গুহ তা জানতেন। এ তাঁর ঐতিহ্যগৌরব থেকে জানা। তাই সবসময়ই তাঁর হাতে ছিল, সাথে ছিল, জাদুলণ্ঠনের আলো। পথ হারানোর ভয় তাঁর ছিলনা। লণ্ঠনের স্তিমিত আলো-আঁধারেই তিনি আমাদের পথনির্দেশ করেছেন। আমরাও দেখেছি সেসব চলমান ছবি। চলেছি সেই অন্ধকার অবচেতনার টানেলের মধ্যে দিয়ে। আমরাও তখন গ্রস্ত। তবে সঠিক সময়ে, সঠিক ভাবেই পেরিয়ে গেছি সেসব অন্ধকার ও তামস-সমুদ্রের মৃত্যুলাঞ্ছিত হাতছানি।
এরই টালমাটাল পর্বান্তরে ভাসতে ভাসতে চিন্ময় বলছেন অদৃশ্য- ক্রুশবদ্ধ মৃত্যুলীন মানুষের কথাই--- "অনেক রাতে যখন ঘুম ভাঙল, দেখলাম আমি কাঁদছি। কোন সে দূর দেশের বনলতা, সুচেতনা, অরুণিমা সান্যালের জন্য ভিজে যাচ্ছে আমার শিথান?কোন সে হারিয়ে যাওয়া নারী যে বিড়ালীর মতো নিঃশব্দে এসে রাতে আমায় কাঁদায়? যার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না। কার জন্য আমি দেওয়ালে মাথা ঠুকছি আর বলছি 'সিলভিয়া, সিলভিয়া..."
পুরাণেও চতুর্দশ ভুবন এর কথা আছে। তার মধ্যে সাতটি অবসর্পিনী তরণে উপরের দিক থেকে পৃথিবী পর্যন্ত নেমেছে আর অন্য সাতটি পৃথিবী থেকে আরও নিচের দিকে, পৃথিবীর অন্তরালের যে জগৎ আছে, সেই রসাতলের মধ্যে নেমেছে। আজকে আমরা খুঁজে চলেছি যত অজ্ঞাত, লুকানো সত্যের শক্তির পরিচয়।
আগে যে আলোর জগতে বিচরণ করত মানুষ, আজকাল সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। এসব যুগের ম্যালাডি। ডুবো জাহাজের মত স্বভাবের অতলে নেমে চলেছি আমরা। ভুলে গেছি উজানের পথ। এইভাবে যত অবতরণ করেছি, স্বাভাবিকভাবেই ততই সেখানকার প্রকৃতি সম্পর্কে সজাগ হয়েছি। এর ফলে অনন্ত আলোর চেতনা ক্রমাগত হীনপ্রভ হয়েছে এবং সৃষ্টি করেছে হয় সান্ধ্য-আলোছায়া নয়তো অপ্রভ কোন কৃত্রিম আলো। যে আলোয় স্পষ্টতা নেই।ঠিক এই জন্যই কি চিন্ময় গুহর সমস্ত "ঘুমের দরজা ঠেলে " বইখানিতে রয়েছে কেবল অন্ধকার রাত্রির কথা? ভাষায় ভাবনায় উপমায় কিম্বা উপমাকল্পে? কিন্তু আশ্চর্য এই যে তারই মধ্যেও তো জেগে থেকেছে আশাময় একখানি নিষ্প্রভ জাদুলণ্ঠন? মায়াময় আলোকসিঞ্চনি?... যা অন্ধকার কে অ্যারেস্ট করে রাখে নিজস্ব আলোর অস্তিত্ব দিয়ে। ঐটুকুই কি বাঁচিয়ে রেখেছিল চিন্ময়ের অবচেতনের ডুবন্ত আত্মাকে??
মাটি নেই পায়ের তলায়। অস্তিত্বের নিদারুণ সংকট আর তাই সমুদ্র সৈকতে কেবল বালি অথবা লাল কাঁকড়ার অনন্ত চলাই সার হয়েছে কেবলমাত্র?! Malady of the age....!?
অথবা আরও অনেক রকম প্রকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে চিন্ময় এর রচনাগুলো!! কখনও সমাধিক্ষেত্র, কখনওবা উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে আসতে দেখেছেন চিন্ময়, শেলীর রূপময় শব, ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল ও চিকনসুন্দর, আলোয় চকচকে ।
কখনওবা সিলভিয়ার প্রতিবাদী ভয়ঙ্কর মৃত্যুরূপে এসেছে অন্ধালোর বৈভব। এমন আরো কত শত ঘটনা এসেছে যার নাভিকেন্দ্রে রয়েছে একটা যন্ত্রনা যা নাকী ব্যথিত করেছে সংবেদনশীল চিন্ময় গুহকে। চিন্ময় গুহ ওই অবচেতনার, ওই ঘুমের, ঐ রাত্রির, ওই স্বপ্নের মধ্যেই তাঁর দুঃসাহসিক অভিযাত্রা শুরু করেছেন কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে প্রজ্ঞাবান চিন্ময় গুহর সঙ্গে ছিল পৃথিবীর আলো, পৃথিবীর, জাদুলণ্ঠনের অনির্বাপিত জ্বলে থাকা একটা আশাবাদ। অনেক আগের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখব সে সময় মানুষ তার ফেলে যাওয়া জীবনকে পরিশ্রুত করেনি। সেসব সঙ্গেও নিয়ে যাওয়া হয়নি তার। অথচ এই স্তরটিরও রূপান্তর ও ধর্মান্তরের দরকার ছিল। কিন্তু সেকথা মানুষ বোঝেনি। পার্থিবতারও চিন্ময় রূপান্তর প্রয়োজন ছিল।
মানুষ তখন অমূত্রের সিদ্ধির জন্য ঐহিকের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। এর ফলে উপরের দিকে উঠতে উঠতে যত সে আলোয় চলেছে নিচের দিকে ফেলে গেছে ততটাই অন্ধকার।এর ফলে মানুষের ব্যবহারিক আধার সর্বাপেক্ষা তমসাগ্রস্ত হয়ে রইল। শুরু হল বেমক্কা টানাটানি। অদ্ভুত বিস্ময়ে চিন্ময় গুহ কিন্তু লক্ষ্য করেছিলেন এই অপূর্ণতাকে।
আর দেখেছি তাঁর লেখায় মুদ্রিত হয়ে গেছে একটি সত্য যে মানুষের অপূর্ণতাই সংবেদনশীল চিত্তের বেদনার মূল কারণ। আমার বিশ্বাস এইখানেই আমরা সংবেদনশীল বেদনার্ত চিন্ময় কে পাই। চিন্ময় কাঁদেন। এমন করে কয়জন লেখককে আমরা কাঁদতে দেখেছি?
মানুষ একদিন যখন আরোহণের ব্যস্ততায় এইসব নিচের অন্ধকার স্তরগুলোকে অবহেলা করে চলে গেছে আলোর দিকে তখন কিন্তু সত্যিকারের বিবর্তনের জন্য ঐহিকের একটা পূর্ণ রূপান্তর ঘটল না অথচ সেটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল। তাই আজ, সেই ক্রমবিবর্তনের জন্য সেই স্তরগুলোতে আবার ফিরে নেমে আসতে হচ্ছে মানুষকে। এই সত্যটিকে মণীষা-দ্রীপ্র ও চরম সংবেদী চিন্ময় খুঁজে বেড়িয়েছেন আর সঠিকভাবে এই বেদনার উৎসের সন্ধান করেছেন। একা কোনো মানুষের কথা নয় যুগান্তরে একের পর এক বিসর্জিত হয়েছে যে আত্মিক দীপ ও দীপাবলী, চিন্ময় তাকেই খুঁজতে বেরিয়েছিলেন এই মৃত্যু ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। আশ্চর্য সাহস ও প্রাতিভ শক্তির অধিকারী আমাদের চিন্ময় গুহ।
যে প্রকৃতিকে মানুষ বিসর্জন দিয়ে গেছে, বাতিল করেছে তার পরিণতি, কী হয়েছে সে কথা শেষের দিকে মানুষ অবচেতন, ও অচেতন সত্তা খুঁড়ে দেখতে এলো।
চিন্ময় এর আত্মিক কবিসত্তা বুঝেছে প্রকৃতির ক্রমগতির লক্ষই হচ্ছে দৃশ্য-জড়ের মধ্যে শুদ্ধ চৈতন্যকে মূর্ত করে তোলা,... পৃথিবীকে দেবত্বের স্বাদ এনে দেওয়া।
বস্তুতঃ "ঘুমের দরজা ঠেলে" গ্রন্থে দেখেছি, অবচেতনকে দেখতে এসে পরিত্যক্ত ঐসব সত্তাদের ব্যথাতেই চিন্ময় গুহ কেঁদেছেন। মনে হয়েছে যা হয়েছে তা বড় নিঃশ্রেয়স।
তবুও ঠিক এখানেই চিন্ময় বড় আশাবাদীও। এসব কিছুর মধ্যেই তিনি প্রতিটি আগত ও আহূত চরিত্রের অন্যান্য সব জীবনবৈভবকে চিহ্নিত করেছেন। এই সুগভীর আশাবাদের জন্য আমরা তাঁর কাছে ঋণী থাকবো।
চিন্ময়ের হাতে ধরা আছে একটা জাদু লন্ঠন। তিনি বুঝেছেন এবং বুঝিয়েছেন যে সমগ্র পৃথিবীকে জ্যোতির্ময় করে ধরতে হলে দুদিক থেকে কাজের প্রয়োজন। পরিত্যক্ত সত্তাদেরও দিব্যরূপান্তর চাই, না হলে আলোর সাধনা অপূর্ণ থেকে যাবে।
এযাবৎ সাহিত্যে দেখেছি প্রকৃতির সাধনা আর সিদ্ধিক্ষেত্র ছিল―১) বিজ্ঞানময়, ২) মনোময় আর ৩)প্রাণময় জগতকে ঘিরে। কিন্তু পৃথিবীর নিচেকার অবচেতন জগৎ যদি আলোকিত না হয়, যদি তা কেবল যন্ত্রণা, মৃত্যু, অসুস্থতা, আত্মহত্যা, ও কলহময় হয়ে ওঠে তবে পৃথিবী তো পূর্ণ আলোকিত হবে না। শুধু তাই নয় উপরকার জগৎ-ও সবটুকু সাধনার আলোয় ঝিঁকিয়ে উঠবে না কখনও। সাহিত্য সাধনার ধারাও এমনটা। মানবজীবনের সহিত চলে যা তাইই সাহিত্য। "ঘুমের দরজা ঠেলে" গ্রন্থখানি পড়লেই দেখব, চিন্ময় মাঝেমাঝেই সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ওই আলোর স্ফুরণ লক্ষ্য করেছেন। গ্রন্থখানি পড়লে মনে হয় পৃথিবীর নিচে অবচেতনা আর স্বপ্নের মেলামেশাতে কবি-গদ্যকার চিন্ময় গুহ সেই আলোর পথখানিই চিহ্নিত করতে এসেছেন। সেখানে জনচেতনার অন্তরে ফুটে উঠবে আলোর ফুল, তা না হলে তো মানুষের পূর্ণবিকাশ হবেনা। বোধ হয় এই জন্যই কল্পজগতে আমরা পেয়েছিলাম- sphinx, centaur , Satyf, mermaid...দের।
এদের নিচের অর্ধেকের মধ্যে বাস করে অমানবিক হৃদয়, আত্মহত্যার অন্ধকারময় প্রবণতা। কেবলমাত্র অদ্ভুত এক জৈবনিক অস্তিত্বের সংকট মাথা তোলে।
বেশিক্ষেত্রে এই নিচের দিকের সত্তাকে আমরাও অবহেলা করে ছেড়ে চলে গেছি উপরের সাধনায়। ফলতঃ সে সাধনা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ফিরে ফিরে এসেছে মানুষের জীবনকে ঘিরে ঘন তামস। আত্মহননের অন্ধকূপ খনন হয়েছে। পুরুষার্থকে রেখেছি প্রকৃতির বাইরে। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছে আত্মিক যন্ত্রণার অলঙ্ঘনীয় বিপরিচিতি।
চিন্ময় এ ব্যাপারে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। সাহিত্যের ও জীবনের ক্ষেত্রে প্রকৃতিকে অবচেতনা খুঁড়ে ব্যক্ত করেছেন । দেখতে গেছেন সিলভিয়ারা কেন কাঁদে। ব্যক্ত করেছেন এইসব অজ্ঞাত অবজ্ঞাত যন্ত্রণার, বিনাশের, ধ্বংসের লোক বা স্তরগুলো। সেখানে আলো প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করতে চেয়েছেন।
বলাবাহুল্য আমরাও চিন্ময় গুহর জাদু লণ্ঠনের আলোতে সেইসব দেখতে পেয়েছি। জেনেছি পুরুষার্থ ও প্রাকৃত সত্যের মেলবন্ধনেই কেবলমাত্র সত্যকার আলো আসা সম্ভব।
বস্তুত সংবেদনশীল চিন্ময় গুহ এইসব আশ্চর্য তত্ত্ব ও তথ্যসংবাদ দিয়ে আমাদের বাংলাসাহিত্যকে বিজ্ঞানের আলোয় যুক্তিসিদ্ধ করে উপহার দিলেন। আমাদের সত্যকার সত্তার উন্মীলনের পথ দেখালেন। বলাবাহুল্য, এই নবতর সাধনা ও সিদ্ধির জন্য তিনি নিজেও অনেক ব্যথার পাথর সরিয়ে হেঁটেছেন।
তাই বলতেই হয়, মেন্টার চিন্ময় গুহ, মানবদরদী ও সংবেদী চিন্ময় গুহ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন