রম্যরচনা
পা ভে ল ঘো ষ
রবিবারের সকাল। চা বিস্কুট খেয়ে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেড়িয়েছি, গেটের মুখে ভটামদার সঙ্গে দেখা।
"মাস্টার, তাড়াতাড়ি বাজার করে ফেরো। কথা আছে।"
ভটামদার এই কৌতূহলে রেখে কথা বলাটা আমার দুচোক্ষের বিষ লাগে। ভুরু কুঁচকে রাগ রাগ করে বললাম, "বলেই ফেলুন না ন্যাকামো না করে..."
শুনে ফিক করে হাসলেন ভটামদা। বললেন, "তোমাকে নিয়ে একটু শ্বশুর ঘর যাবো ভটাম করে। বৌমাকে বলে দিও, দুপুরে মিল অফ।"
"অ্যাঁ...! আপনার শ্বশুরবাড়ি..! কোন দুঃখে..?"
"আরে, আমার শ্বশুর লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে..! এক কোটি টাকা..!"
"ভাগ বসাতে যাবেন নাকি..?"
"ধুর মাস্টার..! মদ ছাড়া কোনো বিষয়ের উপর আমার আসক্তি নেই।"
"তাহলে গমনের হেতু..?"
"তোমার এই একটা সমস্যা মাস্টার..! সবেতেই গোয়েন্দাগিরি করা অভ্যাস। আরে বাবা, শ্বশুরের আমার হার্টের ব্যামো। ডাক্তার বলেছে, উত্তেজনা মোটেই ভালো নয়। তাই..."
"আপনি গিয়ে কি অসুখ ভালো করে দেবেন নাকি..?"
"পুরোটা শোনো..."
"বলুন...'
"শ্বশুর মশাইয়ের লটারিতে টিকিট কাটার খুব নেশা। আগে অনেকবার পড়েছে। তবে সেটা ৫০০-১০০০ - এর মধ্যে। কিন্তু এবার ভটাম করে একেবারে এক কোটি..! বুঝলে মাষ্টার!"
আমি ঘাড় নাড়তেই উনি বলে চললেন,
"তাই শালা , মানে তোমার শান্ত বৌদির ভাই আমায় বললে, ডাক্তার বলেছে কোটি টাকার পুরস্কারের ব্যাপারটা হঠাৎ করে বললে বাবা হার্ট ফেল করবে। তাই রয়ে সয়ে বললে ভালো হয়। শুনে আপনার কথা মনে এলো। তারপর প্রায় হাতে পায়ে ধরে বললো, 'জামাইবাবু,আপনিই একমাত্র পারেন ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে.."
"আপনি করবেন ম্যানেজ...!"
"আরে বাবা, শালা আমার জানে, ওর অমন দাপুটে দিদিকে আমি কিভাবে সামলাই...! আমার সঙ্গে চলো মাস্টার, চোখের সামনে দেখবে দাদার কীর্তি..."
ওইদিন গিন্নীর অনুমতি নিয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লুম। প্রথমে ট্রেন, তারপর বাস সহযোগে যখন দুজন পৌঁছলাম; তখন ঘড়িতে প্রায় পৌনে দুটো। আপ্যায়ন একদম নিখুঁত। পাতে কি নেই..! মাছ, মাংস, ডিম সব..! যাইহোক, খেয়েদেয়ে পেটমোটা করে বিছানায় একটু গড়াতে যাবো, এমন সময় হটাৎ ভটামদা হাজির।
"দেখবে চলো মাস্টার..! একটা দূর্বল হৃদয়ের মানুষকে কীভাবে ধীরে ধীরে কোনো মানসিক চাপ না দিয়ে বড় খবর দিতে হয়। শেখো মাস্টার..."
শুনে স্যান্ডো গেঞ্জির উপর জামাটা চাপিয়ে বললাম, "চলুন..."
পাশের ঘরটাতেই ভটামদার 'ভালো বাবার' বাসগৃহ। খাটের মধ্যে দু'পা ছড়িয়ে বসে আছেন উনি। আমরা যেতেই একগাল হেসে বললেন, "এসো বাবা...!"
আমি শুনে প্রণাম করতে যাবো, এমন সময় ভটামদা আমায় থামালেন। ফিসফিস করে কানের পাশে বললেন, "কমজোরি মানুষকে প্রণাম করতে নেই।"
জীবনে শুনিনি এমন ব্যাখ্যা। তাই প্রশ্ন করে বসলাম, "কেন..?"
"পায়ের দুই পাতার সঙ্গে হৃদয়ের একটা যোগ আছে। তুমি পায়ে হাত দিলেই তড়িৎ তরঙ্গের মত ওই স্পর্শ হৃদয়ে পৌঁছে হৃদয়ের লাবডুব বাড়িয়ে দেয়। ওসব তুমি বুঝবে না। তুমি বসো আর চুপচাপ আমার কাণ্ড দেখো..."
আমি ব্যাখ্যা শুনে ধড়াস করে সামনের সোফায় বসে পড়লাম।
এরপরেই শুরু হলো ভটামদা'র মনস্তত্ত্বের ক্লাস। এখানে শিক্ষক হলো জামাই আর ছাত্র শ্বশুর।
"হেঁ হেঁ.... কেমন আছেন..?"
"ভালো আছি বাবা।"
"বুকে ব্যাথা নেই তো..?"
"না, না..."
শুনে চমকে উঠলাম। কি প্রশ্ন একটা হৃদরোগীকে..!
আবার মনোনিবেশ করলাম প্রশ্নোত্তরে। দেখি, সরাসরি চলে গেছে টাকার প্রশ্নে।
"আচ্ছা বাবা, আপনি যদি হঠাৎ রাস্তায় ৫০০ টাকার নোট কুড়িয়ে পান, তাহলে কি করবেন..?"
"কি আর করবো বাবা..?ভালো, দার্জিলিং চা কিনবো।"
"যদি দশ হাজার টাকা পান..?"
"একটা ভালো মোবাইল কিনবো, তোমরা স্মার্ট ফোন না কি, বলোনা.."
'যদি এক লক্ষ টাকা পান..?"
"উমম..., তাহলে মেয়েকে একটা আর ছেলেকে একটা করে ভালো টিভি কিনে দেবো।"
"যদি দশ লাখ টাকা পান..?"
"তাহলে একটা ফোর হুইলার কিনবো! আমার অনেকদিনের শখ, বুঝলে..."
"আর যদি পঞ্চাশ লাখ টাকা পান..."
শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকলেন পুলিশ বৌদির বাবা। মিনিট দুয়েক পরে স্মিত হেসে বললেন,"তাহলে একটা বাড়ি কিনবো পাহাড়ে, বুঝলে...! এটা আমার ছোটবেলার শখ।"
উত্তর শুনে ভটামদা কিছুক্ষণের জন্য নীরব থাকলেন। বুঝলাম, প্রশ্নোত্তর পর্বের শীর্ষে পৌঁছে একটু নার্ভাস ফিল করছেন উনি। এরপর তো আসল প্রশ্ন। মানে কোটি টাকার প্রশ্ন..! আমিও প্রতীক্ষায়। মুখ দিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বেরিয়ে গেলো, "স্টার্ট...!"
শুনে ভটামদা ভ্রূ দুটো নাচালেন আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর ছুঁড়লেন শেষ প্রশ্নবাণ,
"আচ্ছা, বাবা যদি আপনি এক কোটি টাকা পান..?"
শেষ প্রশ্নে একটু রেগে গেলেন সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ। তবে সেটা মুহূর্তের জন্য। তারপরেই ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বললেন, "যদি এক কোটি পাই, তাহলে তোমাকে অর্ধেক দেবো জামাই। সত্যি বলছি..."
এরপরেই আচম্বিতে ঘটে গেল ঘটনাটা।
হাফ পাবেন শুনে আনন্দে দু'হাত তুলে লাফিয়ে উঠলেন ভটামদা। তারপরে মুখ দিয়ে একটা 'আঁ..ক' শব্দ বের করে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। আমি তড়াক করে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে ভটামদা'র সামনে ইঞ্চি দুরত্বে বসে দেখি, একী কাণ্ড.! অজ্ঞান হয়ে গেছেন ভটামদা...! মুখ থেকে ওঁর অনর্গল একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে অজান্তে, "প...ঞ্চা...শ লা..খ..."
দুদিন পরে, একটা ক্লাবের অনুষ্ঠানে পুলিশ বৌদির সঙ্গে দেখা। কুশল বিনিময় করে, ভটামদার খোঁজ খবর নিয়ে শেষে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনার বাবা ফার্স্ট প্রাইজের খবরটা জানেন..?"
"সেতো আপনাদের যাওযার আগের দিন রাতেই জানে..।"
"অ্যাঁ, কি বলছেন..?"
"তাহলে ভটামদার যাওযার কি প্রয়োজন ছিল..?"
"বাবার ইচ্ছায়..."
"তার মানে..?"
"আরে ভাই, বাবাকে খবরটা দিতেই উনি বললেন, জামাইকে পাঠিয়ে দিস। তোর ভাইকে বলে দিয়েছি, ফোন করতে। বড় বড় বাত মারে তো...! কেমন ল্যাজে খেলাই দেখিস.."
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন