ভ্রমণ কাহিনী
পালানোর পাঁচকথা : পঞ্চলিঙ্গেশ্বর-কেন্দুঝর : পর্ব ক
মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত
ট্রেনের জানলার বাইরে ফ্যালফেলিয়ে চোখ রাখা হয়নি কতকাল! দু'টি বচ্ছর। যেন দীর্ঘনিদ্রা ভেঙে ফের অনিঃশেষ প্রকৃতির পানে চাওয়া, তার মেদুর-পেলব আশ্রয়ে সমাহিত হওয়া।
গাড়ি না-ছাড়া পর্যন্ত ভরসা-শান্তি পাচ্ছিলাম না, এক-টিকা ছাড়পত্র পাবে কি না। হাজারো নিয়ম, হাজারো গুজব রোজ হচ্ছে-ছড়াচ্ছে-থামছে। সে সব অতিবিক্রমের ব্যাপার অতিক্রম করে জনশতাব্দী এক্সপ্রেসের বুক্ড সিটে চারজনে। নাক-ঠোঁটে ঠুলি মাস্ট। সেভাবেই বকবকাইতে বকাইতে বালেশ্বর আসি গিলা বিকেল নাগাদ।
সিধে গাড়ি পাওয়ার জো নেই। অটো অটোক্র্যাসি চালিয়ে ভাড়া হাঁকছে। 'কী করি-কী করব' ভাবনার সঙ্গে পা হাঁটছে কাছের বড় রাস্তার দিকে। বাস যদি মেলে।
"মিলবে।" বললেন পার্শ্বচর একজন। "আমি প্রায়ই যাই, চলুন না।"
হব-হব সন্ধ্যে। বাসের পর বাস আসে। ছুটি। —না, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর যাবে না। শেষে নিরুপায় বলে এক এসি বাসে ওঠা গেল। শেরগড়ে নামতে হবে।
পার্শ্বচর বেশ সহযোগী মানুষ। বড় রাস্তা ছাড়িয়ে নীলগিরি যাওয়ার পথে মোড়ের মিষ্টির দোকান চিনিয়ে দিলেন। "আরে, শেরগড়ে পাঁচটাকার রসগোল্লা খাবেন না?" সস্তায় এমন সুস্বাদু দ্রব্য কলকাতায় দুর্লভ।
ঠাসা এক ট্রেকারে নিজেদের ঠুসে দিয়ে... না, নিশ্চিন্তি নয়। এও থেমে যাবে নীলগিরি। তারপর? —তারপর বুবাই জানা জানেন। উনি এই কাটাকাটি যাওয়ায় অভিজ্ঞ। —"চলুন না, কিছু জুটে যাবে।" শুনে খানিক ভরসা। রাতের অন্ধকারে ডানদিকে উঁচুতে আলো দেখে মালুম হল, পাহাড় আছে।
কী বাহারি ঝুড়ি কুলো ঝোড়া পথ-বাজারে সাজানো। যাবার সময় পেলে বগলদাবা করতে হবে। ভাবতে ভাবতে নীলগিরি বাস স্ট্যান্ড থেকে হাঁটা শুরু।হাঁটছিই।
"ভাই, আমরা কি এবার হেঁটেই....?"
"না না, ঠিক পেয়ে যাব।"
অন্তত দু'কিমি হেঁটে রাস্তা পেলাম এক। কিছুই ঠাওর হচ্ছে না। বাস-অটো নেই। সাড়ে ন'কিমি এই অন্ধকারে কীভাবে যাওয়া যাবে!চৌকস জানাবাবু একটা পিক-আপ ভ্যান ম্যানেজ করলেন। —"একটু নামিয়ে দেবে গো পঞ্চলিঙ্গেশ্বর চক?" "কত নেবেন" জিগাতে বিপদতারণ ড্রাইভার শুধু উঠে পড়তে বললেন।
টপাটপ চালের বস্তার উপর পাঁচজনে থিতু হয়ে গেলাম। এবার স্বস্তি। যাচ্ছি তা হলে! সুপথ পেয়ে সাঁইসাঁই ছুটছে ম্যাটাডোরের মতো মাঝারি গাড়িটা। দু'পাশে ঘোর আঁধার। লোকালয় মনে হচ্ছে না। বরং চাষখেত আর ঝোপজঙ্গলের আধো-আভাস। হাওয়া কাটছে কান ছুঁয়ে। ঠান্ডা ঠান্ডা, উপভোগ্য।
চকে পৌঁছে মাসিমার দোকানে চা। নিয়মিত খদ্দের জানাবাবু। কাপ হাতে ভাবছি, কীভাবে কখনও কখনও সহজেই সাহায্যের হাত এগিয়ে আসে! বালেশ্বর থেকে সঙ্গী ভদ্রলোক আছেন, আছেন পিক-আপ ভ্যানের ড্রাইভার মানুষটিও। অন্ধকারে হাতড়ানোর দুঃসময়ে গাড়িতে নিয়ে এলেন। নিলেন না একটি পয়সাও। বিশেষ, লুটেরা সংস্কৃতির যুগে। টিঁকে থাক এইটুকু।
অন্ধকারে দু'কিমি হেঁটে গিয়ে শকুন্তলা নিবাসে থাকা-খাওয়ার ইন্তেজাম পাকা করে ফেললাম। ফোনে বাতচিত হয়ে রয়েছিল। নয়, নিবাস-চত্বরে সদ্য-সঙ্গী বুবাইবাবুর পাতা টেন্টে বেশ ঢুকে পড়া যেত।
পায়চারি করতে করতে সকালে বন-পাহাড়ের শুরুতে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দিরের দিকে এগোই। পুণ্যার্থী নই। লক্ষ্য, চত্বর পেরিয়ে জঙ্গলে ঢোকা। একটি নালা ঝরনার আকার নিয়েছে ধাপে ধাপে। তারই এক খাঁজে ধারাতলে পাথরে পাঁচটি লিঙ্গের আদল। বহমান জলে হাত ডোবালে আভাস মেলে। ওতেই পুণ্য বলে ভক্তদের বিশ্বাস। আগেরবার ছুঁয়ে বোঝা সারা হয়েছে। এবার গেলাম না। এবং দু'জন গিয়ে ফিরে জানাল, বন্ধ আছে।
পেশাদার পাদুকারক্ষকরা নাছোড়। গাইড ছাড়া জঙ্গলে ঢোকা যাবে না। হাতি আছে। ভল্লুকও নাকি ঝাড়েবাঁশে বেড়েছে। বন অফিস খোলা নেই। গাইড হওয়ারও কেউ নেই।
না-এদিক না-ওদিক। ইতিউতি ঢুঁড়তে পুছতে ক'ধাপ সিঁড়ি উতরিয়ে ঝরনার ছবি তুলছি। বব আর কিশোর একজনকে জুটিয়ে ফেলেছে।
বুনি মল্লিক। হাসিহাসি মজারু অল্পবয়সি যুবক বয়সটাকে আরও অল্প করে জানিয়ে লাগাতার কিছু-না-কিছু বলেই যায়। মন্দিরের চৌহদ্দি পেরোলেই অরণ্য। গাছ-নুড়ি-জল এধার-ওধার। ঘেসো রাস্তায় জলকাদায় গেঁথে-থাকা পাথরে পা ফেলে, দরকারে লাফ-ঝাঁপ করে এগোতে বাঁয়ে থালা-থালা চরণচিহ্ন দেখা গেল। সেদিনের মর্নিং ওয়াক নিশ্চিত। কিমিখানেক গিয়ে জলাশয়ের ধারে ঘোলা জলে মালুম, তেনারা কেলি করে গেছেন। প্রান্তে ছোট মন্দির। বনদেবী বা বনদুর্গার। স্থানীয়রা বলে, মা বড়ম্বা। সামনে পার্বতীকুণ্ড। খুব ধীরে একটা-দুটো বুদবুদ। সামান্য জল অবিরাম গড়িয়ে মিশছে পোখরিতে। বড়ো বড়ো কুলের মতো প্রচুর ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক গাছ। কন্টিফল। আঁটিসর্বস্ব পশুখাদ্য। পাশে শাল গাছ ফুল ফুলিয়েছে। ওদের ডালপালার নীচ দিয়ে এগোলাম। মোটা গাছটিতে বাকল খানিক মসৃণ। হালকা ডালপালা দোমড়ানো। গা চুলকে সুখ নিয়েছেন ঐরাবতকুল।
হাঁটতে হাঁটতে চওড়া বহতা নালা। পাথর ফেলে পা-দান করা আছে। তাক করে পদভার রেখে চলো।
এগিয়ে এক চাতাল পাওয়া গেল। এদিকে এটাই লক্ষ্য। অনেকটা সমান রক-টেব্ ল। হাতায় ছোট ডোবা। মনুষ্যেতর জীবেরা তেষ্টা জুড়োতে আসে। চুপটি ধৈর্য্য সাথী করে বসে থাকলে সাক্ষাৎ মেলার সম্ভাবনা। তবে খুব উপাদেয় না-ও হতে পারে। সকলে সতর্ক করেছে, ভালু ও হাতি অঢেল। লেপার্ডও দুর্লভ নয়। ক'টি পাখি প্রজাপতি বরাতে ছিল। খুদে খুদে জোঁকদের জন্য অবশ্যি আমরা সকলেই কিছু রক্ত ডোনেট করতে বাধ্য হই।
চাতাল-পোখরি পিছনে ফেলে বেশি বেশি পাখির লোভে বুনি অন্য ফিরতি পথে নিল। কিশোর ভাল পাখির ছবি তোলে। স্বভাবতই খুব উৎসাহী।
উপরে উঠে নিশ্চুপ বসে বাদামঠোঙা ফাঁকা করি। পাখিরা পাতার আড়ালে সাড়া দিল, দেখা দিল না। দেখা দিল গলায় ঘণ্টা বাজিয়ে একপাল ছাগল। বিস্তর আদিখ্যেতায় গায়ে পড়ে ঢুঁসিয়ে বাদাম চিবিয়ে বিদায় নিল তারা। লতাপাতা-পাথরে ঘেরা রহস্য-জোগানো এক প্রাচীন মন্দিরের গা বেয়ে নেমে আসি। আবার জলধারা। নড়বড়ে টুকরো পাথরে সাবধানে পা রেখে দু'জন পেরোল ঠিকঠাক। প্রায় পৌঁছে শ্যাওলায় হড়কে বিচ্ছিরিভাবে পড়ল বব। তিন মিটার তফাতে থেকেও ছুটে ধরবার সুবিধে নেই। নিরুপায় দাঁড়িয়ে দেখতে হল, দুই পাথরের মাঝে ফুটখানেক জলে আটকেও দামি ক্যামেরাটা উঁচু করে ধরে রেখেছে। তপন, কিশোর হাত বাড়িয়েছে। বিপদ গা ঘেঁষে গেল যা-হোক। খোঁচা খোঁচা নুড়িতে ভরতি জায়গা। কোমর বাঁচল, ময়শ্চার লাগা বাদে ক্যামেরা রেহাই পেল। ছাড় পেল না জুতোজোড়া। সোল থেকে হাঁ।
এগিয়ে ডানদিকে শুঁড়িপথ ধরব। ফিরে যাবে কি-যাবে না ভাবতে ভাবতে জুতোর ফিতে খুলে আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে পায়ের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে পা বাড়াল আধোভেজা আগ্রহী বন্ধু বব। বুনির গাইডত্বে আমরা যাচ্ছি ঘন বনপথে কিছু দূরে চত্বরিতে। উঁচু আর উঁচু। কত না-চেনা লতা! এই মোটা মোটা। কোথায় যে উঠে গেছে! গাছও হরেক কিসিমের। গা-ছমছমানো অরণ্যভূমি। হামেশাই হাতি নামে এদিকটায়। এমন নিসর্গে সতত মনে পড়ে প্রকৃতি ভালবাসতে শেখানোর সফল শিক্ষক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বড়ো প্রিয় তিনি।
থামলাম খোলামেলা প্রশস্ত ক'টি শিলাখণ্ডের উপর। তিন পাশে মুক্ত অবাধ। দৃষ্টি থামে বাঁয়ে এক পাহাড়চূড়ায়। গাঢ় সবুজ তার বাহার। চোখ ঘুরিয়ে ডান দিকে আনলে কেবলই পাহাড় আর পাহাড়। দেবগিরি নাম। হিমালয়ের মতো স্নো-পিক বা চাঁছা নয়। শ্যামল চাদরে মোড়া মালভূমির পাহাড়। নয়নশোভন। একেবারে ডানহাতে কাছেই এদিককার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। যেতে-আসতে পুরো দিন লাগে। বনপালের অনুমতি লাগে। নিরাপত্তার জন্য। লিখেছি, চতুষ্পদের আধিক্যের কথা।
সুন্দর এই কোলাসিরা চত্বরি। বুনি হাতির গোবর, থুড়ি, হস্তিবর খুঁজছে। আমাদের দেখাবেই। পেয়েও গেল ঠিক। সুমুখের অগভীর খাদের ঝোপ-জঙ্গল মোচড়ানো। সেখানে ওই বর্জ্য যথেষ্ট পড়ে আছে। বরাবর গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছে হাতি চলাচলের সরু পথটা। উপর থেকে স্পষ্ট।
হাওয়া বইছে শিনশিনিয়ে। দুলছে গাছের পাতারা, আর নাম-না-জানা বনফুলগুলি। অনেকক্ষণ কাটালাম এমন সুন্দর জায়গায়। তিনদিকেই ঢেউ খেলানো পাহাড়-ফ্যামিলি। অতীব মনোরম। তবে সবসময়েই আতঙ্কের বাতাবরণ সক্রিয় আছে।
উঠাই পথটা নামাই হতে সহজে ফিরতে পারলাম। ওড়িশা পর্যটন দফতরের পান্থশালার পিছনে মিনিট দশেক হেঁটে এক পুকুরে এসে থামি। ইচ্ছে, বহুদিন পর একটু সাঁতরে চান সারা যাবে। দেখি, জলের তলায় এবড়োখেবড়ো বোল্ডার ছড়িয়ে। অতএব ঘাটের কাছে বুক সমান জলে আঁজলা ভরে পুঁচকে মাছেদের সঙ্গে খেলা করতে করতে চমৎকার স্নান হল। কী নিরালা মালভূমির এই অংশটুকু!
আবার হাঁটা শুরু হয়েছে বিকেল চারটে নাগাদ। দেরি করেছি। যেতে হবে সাড়ে চার কিমি পথ। বেশিটাই জঙ্গল। গুড়িখোঁড়া গ্রাম পেরিয়ে বনের ভিতর দিয়ে শর্টকাটিয়ে নিয়ে গেলেন সেই বুবাইবাবু।
যাচ্ছি খুমকুট ড্যাম দেখতে। জানা থাক, গাড়িতে পাঁচ কিমির অন্য পথ আছে। শাল-সেগুন জঙ্গলের নিভৃতে একবার 'গাঁওখুট' দেখতে পেলাম। মারাংবুরুর উপাসনাস্থল।
লম্বা পা ফেলে এগোচ্ছি। পথজোড়া গাছের ডাল কখনও হাত দিয়ে নুইয়ে, কখনও ঘাড় কাতিয়ে।
অরণ্য কী ভাল লাগে, আহা! ডান হাতে এক প্রকাণ্ড শিলাময় পাহাড় দেখা যাচ্ছে। প্রায় ছুটছি। লাঞ্চ-লব্ধ এনার্জি ব্যয় করতে হবে তো। আবার, সন্ধ্যের আগেই পৌঁছতে হবে দেখতে চাইলে।
দেখার কিছু কখনওই কম নেই। লাল মেটে পথ গিয়েছে তালসারির হাত ধরে। বাঁয়ে হালকা আদি-বসতি। তাবড় তাবড় দ্রুমদলের সঙ্গে অন্ধকারের নিবিড় সখ্য। কত রহস্য তার অন্দর-লোকে!
ঘাসকাদায় মাখামাখি খানিকটা জমি পেরিয়ে ছোট্ট নালা। তাকে ডিঙিয়ে উঠতে হবে বড় রাস্তায়। তিনজনায় দিব্যি টপকাল। লম্ফঝম্প, দৌড়োদৌড়িও জীবনে জরুরি। ওগুলো এড়ানোর ফল মিলল ফলত। ডান হাতে স্টিক, বাঁ হাতে ক্যামেরা আঁকড়ে না-হড়কে, দুই ঠ্যাঙ দুই মেরুতে ঠেলে মোক্ষম লাফ দিয়ে ল্যাদলেদে হাফ-তরল ভূমিতে 'ফুল'-শয্যা গ্রহণ করলাম। ওবেলা ববের ধপাস দেখেছি, এবেলা আমার দেখল সবাই। হাস্যোদ্বেগ সহ ওরা দাঁড় করাল। অক্ষত এবং আপাদমস্তক কর্দমাক্ত! নালার ঘোলা জলে ঝুঁকে আংশিক সাফাই-কর্মের সময় তপন কলার পিছনে টেনে রাখল।
খুমকুট গ্রামের একান্তে প্রকাণ্ড জলাধার। তার জলে পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষিভূমি প্রাণ পায়। মাঝখানে পুরনো ভাঙাচোরা জলটুঙি। রাজা-উজিরদের নিরাপদ শিকারকেন্দ্র। হায় রে, কত জীব যে নিহত হয়েছে বিনোদনের জন্য! এ কারণে শিকার-কাহিনি কোনওদিনই বিশেষ টানেনি। ও জাতীয় লেখার আর দরকার আছে কি না ভাববার সময় এসেছে। সামনের ঘাটে লাল চেলি, মাটির ঘোড়া জানান দিচ্ছে, এটি পূজা-পরবের থান। জুটে গেছে বেখাপ মলিন পোশাক, খালি-পা ছোটরা। একটি লজেন্সেই মুখে খুশি ভাসছে। গণেশঅ, রমেশঅ, রামঅ, দাসঅ চুল সাইজ করে ছবির জন্য পোজ দিল।
গোধূলি ছেড়ে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে। ফেরার পথে পদক্ষেপণে গতি বাড়াতে হল। টিমটিমে বাল্বের নীচে বড়ো বড়ো হাঁড়িতে ধানের চোলানো রস আর শুয়োরের মাংসের আয়োজন। সাঁওতাল তরুণী জানালেন, জন্মদিনের অনুষ্ঠান আছে।
দৌড়চ্ছি। আঁধারে ভয় কাছিয়ে আসে। গুড়িখোঁড়া গ্রামে মহাকায় বটগাছ। রাশি রাশি দুলন্ত ঝুরি। মেলা বসে মকর সংক্রান্তিতে। অগ্নিকুণ্ড ঘিরে জনাকয় মেহনতি মানুষ। টর্চ জ্বেলে তাঁরাও খেয়াল রাখছেন। ধানগাছ যে পূর্ণগর্ভা। সতর্ক করলেন, রাতপথে হুঁশিয়ার থাকা চাই। হাতিঠাকুর, ভালু বহুত। তারপর খারাপ সংবাদ পাওয়া যাবেই। একই দিনে হাতি দু'জনকে শুঁড়ে জড়িয়ে, পায়ে পিষে... অথবা গুঁতো মেরে পেল্লায় দাঁতটা তরোয়ালের মতো হতভাগ্যের পাঁজরায়... নাঃ, শুনতে মন চায় না।
জোরদার টর্চের আলো ঢেলে বুবাইবাবু ফিসফিসিয়ে ঘোষাইলেন, "এগিয়ে কিমি দেড়েক টুঁ-ও করবেন না। আমাকে ফলো করুন শুধু।"
"পিছন থেকে এলে কী করব?"
"তখন দেখা যাবে। লেট'স স্টার্ট।"
মসিকৃষ্ণ চরাচরে আটটা পা পড়ছে ধপধপ। নিঝুম ঘর-গেরস্থালি ছাড়িয়ে, চরমতম উৎকণ্ঠা নিয়ে যেন পাঁইপাঁই পালানো। বেঁচে আছি বোঝাতে খুক কাশতেও মানা।
রাঙামাটির পথ ধরে তালসারি আর দু'পাশের সবুজালির সুখানন্দ পেতে পেতে বিকেলের পদক্ষেপ যেমন ছিল, নিখুঁত অন্ধকারে ফেরাটা আদৌ তেমন হচ্ছে না। কালো-কোলো ধুমসো জন্তুগুলো কোথায় কী করছে কে জানে!
আর একটা ভয় জানিয়েছেন বন্ধু-গাইড মহাশয়। রাতবিরেতে উচ্চারণ না-করে। একাধিকবার সাক্ষাৎ পেয়েছেন বলে লাইটের কাটাকুটি খেলা থামছে না। মাটিতে, এপাশে-ওপাশে, কাছে-দূরে, আগে-পাছে ফোকাস ঝলসে উঠছে। যদি হঠাৎ আবির্ভাব হয় ফণাধরের!
সাড়ে চার কিমি একটানে হেঁটে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর পৌঁছে পুনর্জাত মনে হল নিজেদের। দোকানে চায়ের কাপ হাতে তাকিয়ে থাকি কুহকিনী নিশারণ্যের পানে। পড়তে পারি, বনপল্লির জীবনকথা। এত বিপদ-আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা সেখানে আজন্মমৃত্যু সঙ্গী!
(ক্রমশঃ)
ছবি: পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের কাছে, বনপথে, কোলাসিরা চত্বরি ও খুমকুট জলাধার। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, ওড়িশা। অক্টোবর, ২০২১।
আমার ছোট্ট সফর- মাতৃভূমি ঢাকা- পর্ব ৯
সু জা তা দা স
ভালোবাসা শব্দটা অর্থহীন নয়, অনেক শব্দ বহন করে, তা আমি আমার বাংলাদেশ সফরে অনেক ভালো ভাবে বুঝে এসেছি--- দেখে এসেছি ভালোবাসা বা আন্তরিকতার মানে, দেখেছি ভালোবাসার ক্ষেত্র ধর্ম মানে না, আন্তরিকতার ক্ষেত্রে ও না--- আমার কখনও মনে হয়নি আমি মুসলিম নই বলে প্রভেদ থাকছে,
আমরা প্রত্যেকেই এক বাড়ির- এই অনুভূতিই সদাই জাগ্রত থাকতো---
আমার বাংলাদেশ ভ্রমনের সময়-আমি নিজেকে একজন মানুষ ভাবতে পেরে গর্ব অনুভব করেছি।
আমি জয়পাড়াতে যেই বাড়িতে ছিলাম আমার সাথে তাঁদের কোনও রক্তের সম্বন্ধ ছিল না কোনও দিক দিয়ে- কিন্তু ঐ বাড়ির পুত্রবধূ হ্যাপি যার নাম, অনাত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও যে আন্তরিকতার সাথে আমাদের দেখাশোনা করেছেন গঙ্গা পাড়ের মানুষরা হয়তো কখনও কল্পনাতেই আনতে পারবেন না।
এখানে (হয়তো )কথাটা না লিখলেও চলতো তবুও লিখলাম এই কারণে কিছু ব্যতিক্রম হয়তো এখানেও আছে তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেই ছবিটা অনেক কম।
হ্যাপির আন্তরিকতা আমাকে আপ্লুত করেছে বার বার, আমরা যেদিন চলে আসবো সেই দিন ভোর বেলায় উঠে রান্না সেরে ফেলেছে আমাদের জন্য---
আসার দিন হঠাৎই শরীর খারাপ হওয়ার কারণে আমি না খাওয়ায় কতবার যে বলেছে (দিদি একটা ছোট্ট বাটিতে দেই একটু খেয়ে যান না হলে আরও শরীর খারাপ লাগবে) কিন্তু সত্যিই আমার শরীর খারাপ ছিল বলে আমি খেতে পারিনি, কিন্তু গাড়িতে ঢাকা আসার সময় বার বার মনে পড়েছে এই কথা।
মনে থাকবে অনেক অনেক সময় এই হ্যাপির কথা, যে সম্পর্কের পরিধিতে জা হন কিন্তু বয়সে আমার ছেলের-বৌ বা মেয়ের সমান, ভালো থাকুন ওরা সবসময় এই আশীর্বাদ রইলো ওঁদের জন্য-----
আমার এক বাংলাদেশি বন্ধু একটা অদ্ভুত কথা বললেন এই ব্যাপারে, আমি এখনও কথাটা পুরোপুরি স্বীকার অথবা অস্বীকার করে উঠতে পারিনি- সেটা হলো এই বাংলার সম্পত্তি বিভাজন অর্থাৎ ছেলে মেয়ের সমান অধিকার সম্পত্তিতে, এই কারণেই নাকি আন্তরিকতা নষ্ট হচ্ছে ইন্ডিয়াতে---
কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি চুপ করে ছিলাম কথাটা শুনে, কোথাও গিয়ে নাড়া দিয়েছিল আমাকে এই কথাটা, তবে এটাও ভেবেছি যদি রক্ত ও আন্তরিকতার সম্পর্ক এতো ঠুনকো হয় তবে ঐ সম্পর্ক না থাকলেও চলবে বলে আমি মনে করি--- আমার মনে হয় জীবন ও জীবনীকার এই দুটো শব্দই অনেক স্পর্শকাতর কারণ জীবনও নিজের খেয়ালে চলে আর জীবনীকার ও কোনও বাঁধা মানেন না, বেঁধে রাখার শক্তি ও নেই নিজেকে দুজনেরই--- আসলে মানুষ পারে না বলে কোনও কথা নেই সেটা আমার থেকে ভালো বোধহয় কেউ জানে না।
আমি যখন ঢাকা বিমানবন্দরে নিজে ইমিগ্রেশন ফর্ম ফিলাপ করছি হঠাৎই নিজের অজান্তেই চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছিলাম, বারবার হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে হচ্ছিল বলে বকাও খেলাম তপনের কাছে---
একটা কষ্ট একটা মন খারাপের ব্যথা জন্মভূমিকে ছেড়ে যাওয়ার ব্যথা যেন বুকে কষ্ট দিচ্ছিল,
যদিও আমার দাদার মানে ঠাকুরদার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়নি এই যাত্রায় কিন্তু অনেক আশা নিয়ে ফেরত এসেছি আবার হয়তো যাবো শেষের আগে একবার--- এই আশা নিশ্চয়ই পূরণ করবেন আমার মাতৃভূমি আর মাতা ঢাকেশ্বরী।
তবে কোলকাতা বিমানবন্দরে পা দিয়ে বাসায় ফেরার একটা অনুভূতি (নিজে হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা)- উবারে মালপত্র তুলে বসার পর যখন গাড়ি ভি আই পি রোড ধরলো, তখন একটা কথাই মনে হয়েছে তবু তুমি সুন্দরী কতও কোলকাতা-
আমার কর্মভূমি যে জন্মভূমির মতোই প্রাণ চঞ্চল আর গতিময় আমার কাছে---
তারপর আরও কতবার যে কত পরিবারের ডাকে আমার জন্মভূমির মাটি স্পর্শ করেছি নিজেও বলতে পারবো না,
নিজের জন্মভূমির এক আলাদা টান যেন সবসময়ই আমাকে আচ্ছন্ন রাখে----
শাহানূর এখন বলে দিদি সত্যিই তোমার নাড়ি পোঁতা আছে এখানে না হলে এভাবে ছুটে আসতে না সবার ডাকে। হয়তো ওর কথা ঠিক না হলে অপরিচিতেরা আপন হয় কীভাবে, কীভাবে থেকে যেতে পারি তাদের মাঝে কোনও রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়া, কীভাবে চলে যেতে পারি মাওয়াঘাটে ইলিশ খেতে, কী ভাবে ভাই বোনের সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয় হিন্দু মুসলিম হয়েও---
আসলে মানবিকতা যেটা কাঁটাতার ভাগ করতে পারেনি তাই নিশ্চিন্ত হয়ে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেনে উঠে পড়তে পারি নিশ্চিন্তে আজও, এখানে শেষ করবো যদিও ফিরে ফিরে দেখবো আমৃত্যু সময় অসময়ে, যা আমার পাথেও হয়ে থাকবে আমার জন্মভূমির কল্যাণে, যা আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি---
আজ কলম এখানেই বিশ্রাম চাইছে হয়তো দ্বিতীয়বার লিখবো নতুন ভাবে দ্বিতীয়বারের সফর অথবা তারপরের তারপরের------
(সমাপ্ত)
সুন্দরী পুরুলিয়ার মায়ায়
শ ম্পি তা রা য়
বেশ কিছু মাস বাড়ি থেকে না বেরোলে মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তরকারিতে নুন বেশি, কম হয় যায়, মেজাজটাকেও অনেক কষ্টে নিচু তারে ধরে রাখতে হয়। এটা
শুধু আমার নয়, আমাদের দলের সবার হয়। এই রকম একটি তিরিক্ষে মেজাজের আড্ডায় হঠাৎ ঠিক হলো চলো পুরুলিয়া।যেমন ভাবা। অমনি আমাদের করিৎকর্মা ছেলের দল মাথা নিচু করে গুগল ঘেঁটে রিসোর্ট ও ট্রেনের টিকিট কাটা শুরু করলো। ঠিক হলো মার্চের ১২, ১৩, ১৪ (২০২২) কাটবো মুরুগুমা লেকের পাশে পলাশবিতান রিসোর্ট-এ। অপেক্ষায় থাকলাম কাঙ্ক্ষিত দিনগুলোর জন্য। আমরা হাওড়া থেকে চক্রধরপুর ট্রেন ধরে পরের দিন সকাল ৬টায় পুরুলিয়া জংশনে নামলাম। গাড়ি আগেই বলা ছিলো, তাই সময় নষ্ট না করে ১২ জনের দল দুটো গাড়িতে ভাগাভাগি করে উঠে বসলাম।গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার ভাই এক
বাক্স পেঁড়া ও এক বোতল জল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। ব্যাস ওখানেই আমরা গলে জল। শহর ছাড়িয়ে বেরোতেই চোখ আটকে গেলো দু প্রান্তরে, লাল পলাশে। কালো পিচের রাস্তা আর দুধারে লাল পলাশ, রঙের এই contrast, এক কথায় অসাধারন। এত লাল রং যে কত দিন দেখি না! যাই হোক প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর পৌঁছলাম পলাশ বিতানে। এই পলাশ বিতান সম্পর্কে আমি একটু পরে বলছি। প্রকৃতি ঢেলে সাজিয়েছে এর চারপাশকে। এখনকার প্রতিটি ঘরের নাম এক একটি গাছের নামে। ফ্রেশ হয়ে চা, জলখাবার খেয়ে লেকের ধারে বেড়াতে গেলাম। এই মুরুগুমা লেক অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে। বিশাল এই লেকের থেকে জল যায় আশপাশের গ্রামে। লেকের পাশের অপার নিস্তব্ধতা, পাখির ডাক আর ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই আমরা ঠিক করলাম ওই দিন
কোথাও যাবো না, সন্ধ্যে বেলা লেকের জলে ডুবন্ত সূর্যের রঙের খেলা দেখবো। সন্ধ্যে বেলা সূর্য ডোবার পরে চারিদিকে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, যেটা কলকাতায় আমরা ভুলে গেছি। তখন খালি মনে হচ্ছিল সভ্যতার সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ, একেই বুঝি বলে। পরের দিন লুচি, আলুর তরকারি, ডিম সেদ্ধ, মিষ্টি দিয়ে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিন করতে। প্রথমে গেলাম বামনি ফলস দেখতে। প্রায় ১৫০টা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলাম, তাও সেটা অর্ধেক রাস্তা। কিন্তু ওখান থেকেই উপর থেকে নেমে আসা জলোধারাকে অপূর্ব লাগছিল।এরপর একে একে মার্বেল ফলস, চরিদা মুখোশ গ্রাম, upper dam ও lower dam দেখলাম। চড়িদা গ্রামে গিয়ে বিমুগ্ধ হতে হয়।এখনকার সব মানুষই ছৌ নাচের মুখোশ তৈরিতে নিযুক্ত। আমি তো অবাক হয়ে বাড়ির দাওয়ায় বসে ওনাদের হাতের কাজ দেখছিলাম। কত অভাবে, কত অনাদরে এই সব গুণী শিল্পীরা গ্রামে পড়ে থাকেন! যোগ্য মানুষদের প্রাপ্য সম্মান আমরা বোধহয় আজও দিতে শিখলাম না। পুরুলিয়া যেহেতু মালভূমি অঞ্চল তাই এখানের পাথুরে মাটিতে চাষবাসও তেমন হয় না।কিন্তু অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গলের বড়ো বড়ো শাল গাছ তাদের বিশালতা দিয়ে আমাদের মাথা নত করিয়ে নেয়। যাকে বলে নিবিড় মহা দ্রুম।
শাল ছাড়াও মহুয়া, শিরীষ, অর্জুন, কুসুম, বাঁশ ইত্যাদি গাছ চোখে পড়লো। সব জায়গা ঘুরে শেষে আসলাম সুইসাইড পয়েন্ট-এ সূর্যাস্ত দেখতে। বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের সুবাদে অনেক সূর্যাস্ত দেখেছি, কিন্তু এই দৃশ্য সবাইকে ছাপিয়ে গেলো। সূর্যটা যেনো খাদের ওপারে পাহাড়ের পিছনে হঠাৎ করে ডুবে গেলো। ডোবার আগে কাউকে জানান দিলো না যে উনি ডুবছেন। হতবাক হয়ে গেলাম।আবার ওখান থেকে নেমে লেকের পিছনে আবার ওনাকে দেখলাম লেকের জলে খেলা করছেন। কিছু সময়ের ব্যবধানে দু দুবার সূর্যাস্ত এই প্রথম দেখলাম। এবার কিছু স্মৃতিচারণ করি "পলাশ বিতান" সম্পর্কে। এই রিসোর্ট টি অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি।এখানে অনেকগুলো কটেজ, মাঝখানে ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট, পুকুর ইত্যাদি নিয়ে বেশ খোলামেলা। খাওয়ার আলাদা জায়গা ছাড়াও আড্ডা মারার একটা বড় জায়গা রয়েছে, যেখানে আমরা বেশির ভাগ সময় কাটাতাম। ভোরবেলা উঠে ঘরের বাইরে বেরোলেই টিয়া পাখি, বউ কথা কও, টুনটুনি ও আরো অনেক নাম না জানা পাখির কলতান আমাদের চুপ করিয়ে দিত। চারিদিকে অযোধ্যা পাহাড়ের সারি, মুরাগুমা লেকের ঠাণ্ডা বাতাস মনকে শান্ত করে দিত। এর সাথে মন ভালো করে দিত এখনকার মানুষের ব্যবহার। ওনাদের যত্ন ভোলার নয়। মনে আছে চলে আসার দিন লাঞ্চ এ বেশি করে ভাত খেয়ে যেতে বলছিলেন, বড়ো দাদার মতো বোঝাচ্ছিলেন কলকাতায় পৌঁছোতে রাত হবে, একটু বেশি করে খেয়ে যান। ফিরতি পথে আমরা দেউলঘাটা হয়ে স্টেশনে পৌঁছলাম। কংসাবতী নদীর তীরে অনেকগুলো মন্দিরের মাঝে পুরনো দুটি দেউল মন্দির এখনও অবশিষ্ট আছে। এই মন্দির ছাড়া অষ্টভূজা দেবী মূর্তি, গণেশের
প্রস্তর মূর্তি, দশভূজা দেবী মূর্তি ইত্যাদি অতি প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে মন ভরে গেলো। আসার সময় আমরা রূপসী বাংলা ট্রেন ধরেছিলাম। ট্রেন বসে ভাবছিলাম যে ভূগোলে মালভূমি অঞ্চলকে খনিজ সম্পদের ভান্ডার বলে। ছোটনাগপুর মালভূমির এই অংশে আমরা যে খনিজ সম্পদ খুঁজে পেলাম তা ভোলার নয়। রঙিন প্রকৃতি ও প্রকৃতির মাঝে পালিত মানুষদের আন্তরিক ব্যবহার আমাদের বারে বারে এখানে টেনে আনবে। আমরা আবারও যাবো শাল, মহুয়া, পলাশের জঙ্গলে হারিয়ে যেতে।কেননা কলকাতায় মোদের মানাইছে না রে, এক্কেবারে মানাইছে না রে।
আশ্চর্য ভ্রমণ- ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া
দে বি কা চ ট্টো পা ধ্যা য়
বছর দু'তিনেক আগে স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে একটা এডুকেশনাল ট্যুরে গিয়েছিলাম রামপুরহাট থেকে লোকাল ট্রেন ধরে রামপুরহাট মন্দারহিল রুটে শিকারিপাড়া স্টেশনের কাছে। রামপুরহাট থেকে ট্রেন স্টেশনের আউটার সিগন্যাল ছেড়ে যাওয়ার পর বাইরের দিকে তাকিয়ে চারিদিক দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোন কোন গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইনটা গেছে। আমরা যখন বীরভূম-ঝাড়খন্ড সীমান্তে ছোট্ট এক
সাঁওতালি গ্রাম তুম্বুনির কাছেই থাকতাম এবং স্কুলে পড়তাম তখন থেকেই শুনে এসেছি রামপুরহাট থেকে দুমকা পর্যন্ত রেললাইন বসানো হবে শিগগিরই। সেই রেললাইন বসানো হলো যখন, তখন আমার ছেলেমেয়েরা রামপুরহাটের স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ছে। এই রেললাইন নিয়ে কত গল্পই না করতাম ছোটবেলায়। তুম্বুনি গ্রামের পাশ দিয়ে নাকি তা যাবে। দেখলাম, সত্যিই তাই, তুম্বুনি গ্রামের পিছন দিয়েই সেই লাইন গিয়েছে। ট্রেন চলাচল করলে তুম্বুনির মাঠে দাঁড়িয়ে সেই ট্রেনের ঝিকঝিক আওয়াজ পাওয়া যায়। একসময় তুম্বুনি গ্রামের আশেপাশের ঐ সব জায়গাগুলো আমার কাছে অগম্য ছিল। ছোট ছিলাম বলে বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেতে ভয় পেতাম, এখন ভেবে ভীষন আফশোষ হয়, কেন তখন পায়ে হেঁটে ওসব জায়গায় ঘুরে বেড়াইনি। ওখানেই তো বাস করতাম, এখনকার মত পড়াশোনার চাপও তো কোনো দিন ছিলনা তেমন, অথচ তুম্বুনির পিছনে কাঁদর পেরিয়ে আরান্দা
গ্রামটাও ভালো করে ঘুরিনি।আসলে তখন এই দেখার মনোভাব বা ইচ্ছেটা মনের মধ্যে তৈরীই হয়নি। আজ কেবলই মনে হয় ঐ সব গ্রামগুলো পায়ে হেঁটে ঘুরি। তুম্বুনির পিছনে আরান্দা, পশ্চিমদিকে সুরিচুয়া, সিজুয়া, দক্ষিণ দিকে বিশাল এরোড্রাম পেরিয়ে কাঁচপাহাড়ি গ্রাম, পূবে ফরেস্ট, কাঁদর, ক্ষেত পেরিয়ে মুর্গাডাঙা--- আরো কত কত গ্রাম যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যে গ্রামগুলো থেকে পায়ে হেঁটে নানা মানুষ আসত আমাদের পাড়ায় পুকুরের মাছ, হাঁস মুরগির ডিম, দুধ এসব নিয়ে বিক্রির জন্য। তখন তুম্বুনিতে কোনো দোকান বাজার ছিল না। এদের উপর ভরসা করেই জীবন কাটাতে হত সবাইকে। এই সব মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল। কত সময় বাড়তি দুধ বা একটা ছোট মাছ এমনিই দিয়ে দিত। সেই সব মানুষের খোঁজ নেওয়ার স্বপ্ন দেখি হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে। কিন্তু কোথায় তার অবকাশ? কেই বা এই স্বপ্নের মূল্য দেবে? সমমনস্ক মানুষের বড়োই অভাব। তাই ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করছিলাম আমার
স্বপ্নের সেই গ্রামগুলোকে। কিন্তু নাঃ! কিছুই চিনতে পারলাম না। আশেপাশের গ্রামগুলোর দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকাই সার হল। ঝোপঝাড় নালা পুকুর গাছপালা পেরিয়ে ট্রেন পিনারগড়িয়া স্টেশনে পৌঁছে গেল। দুমকা রোড ধরে তুম্বুনি থেকে দুমকার দিকে গেলে সুরিচুয়ার পরে বাংলা-বিহার (এখন ঝাড়খন্ড) বর্ডার পেরিয়ে পিরালগড়িয়া বলে একটা জায়গা ছিল, সেটাই কি এখন পিনারগড়িয়া স্টেশন হয়েছে? কি জানি? কেউ কিছুই বলতে পারেনা। আসলে কারো এসব জানার আগ্রহই নেই। ঐ গ্রামের বাসিন্দারাই একমাত্র বলতে পারে। সেই জন্যই পায়ে হেঁটে এইসব গ্রামে ঘোরাঘুরি করতে হবে। পিনারগড়িয়া স্টেশন রামপুরহাট থেকে বেশ অনেকটাই দূর, লোকাল ট্রেনে প্রায় ২৫ মিনিট লাগলো। এরপর আরো দু'টো স্টেশন পেরিয়ে চতুর্থ স্টেশন হল শিকারিপাড়া, এখানেই ছিল আমাদের গন্তব্য।পুরো যাত্রাপথটা ছিল অচেনাকে চেনার আনন্দে ভরা। জানা পথের অজানা পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হচ্ছিলাম সমানে। হরিণশিঙা স্টেশনের কাছে দু'পাশে পাহাড় ও নীচে দিয়ে বয়ে চলা নদীর শোভা যে কতটা সুন্দর হতে পারে না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। রেললাইনের একপাশে পাহাড় অন্যদিকে অনেক নীচে হরিণশিঙা নদীর জল বয়ে যাচ্ছে তিরতির করে। দুপাশে সাদা বালি,
ছোটবড় কিছু পাথর ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। দু'এক জন সেই পাথরের উপর কাপড় কাচছে, কেউ স্নান করছে। শীতের শেষে তখন নদীতে অল্প জল, বর্ষায় এই নদীই হয়ে উঠবে দুরন্ত পাহাড়ী ঝর্ণা।অপরূপ সে দৃশ্য দেখে মনে যে অপরিসীম আনন্দের বন্যা দু কূল ভাসিয়ে বয়ে যাচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এ আনন্দ একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হয়ে আমার সমস্ত সত্তাকে ভরিয়ে তুললো। বারবার এই আনন্দ পেতে চাই, অথচ হয়ে ওঠেনা যে কেন জানি না।
শ্রীনগরে দুই দিন
নি ভা চা ক লা দা র
দিল্লী ইন্দিরাগান্ধী বিমানবন্দর হতে সকাল ৯ টা ৩০ মিনিটের শ্রীনগরগামী উড়ানে চেপে বসেছি আমরা পাঁচ জন। বিমান শ্রীনগর অভিমুখে চলতে শুরু করল। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সেটা অবতরণ করতে লাগল শ্রীনগর বিমান বন্দরে। উপর হতে নীচের হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য যেন হাতের মুঠোয়। কোথাও তুষারাবৃত পর্বত, কোথাও বা ধবল মেঘের আস্তরণ, কোথাও পর্বতের ঢালে গাছপালা আবছায়া, পার্বত্য উপত্যকা ছবির মতো ভাসছে---
অপূর্ব দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।দেখতে দেখতে রান ওয়ে ধরে বিমানটি দৌড়াতে শুরু করল। মাটির বুকে নেমে পড়ল। একে একে বিমান হতে বাহির পথে বন্দর পেরিয়ে এলাম আমরা। ইরফান গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য। আগে থেকে বুক করা Sher-e Kashmir Sciences & Technology Guesthouse এর উদ্দেশ্য আমাদের নিয়ে গাড়ি ছুটে চলল।পথে বিখ্যাত
ডাল লেক, লোকজন এর ভীড় চোখে পড়ার মতো। আমরা গেস্ট হাউসে পৌঁছে গেলাম। দুটো রুম নীচ তলায় পাশাপাশি, কেয়ারটেকার ঘর খুলে দিতে বলেন, আমরা ব্যাগ রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়ি। একটি হোটেল এ দুপুরের খাবার সেরে টিউলিপ গার্ডেন-এ চলে এলাম। টিকিট সংগ্রহ করে ভিতরে প্রবেশ করে নয়ন অভিরাম টিউলিপ বাগিচা দেখে মুগ্ধ। যে দিকেই তাকাই ফুল আর ফুল থরে বিথরে, হিমালয় পর্বত খুবই কাছে, যেন হাত বাড়ালেই নাগালের মধ্যে পাই। কি অপূর্ব হিমালয় আর তারই পাদদেশে এই টিউলিপ
বাগিচা। দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য মাঝে মধ্যেই বসার আসন পাতা। এই বাগিচা দর্শনার্থীদের জন্য এপ্রিল একটি মাস প্রবেশের সুযোগ। এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পর্যন্ত দেখেও যেন আশ মেটে না। সন্ধ্যা নেমে আসে, এবার বেড়িয়ে এসে গাড়িতে উঠে ফিরে চলেছি গেস্ট হাউসের দিকে। আবারও সেই ডাল লেকের ধার দিয়ে গাড়ি চলছে প্রকৃতির কোল ঘেঁষে। অপলক চোখ বাহির পানে। শীতল হাওয়া গায়ে লাগছে। পৌঁছে গেলাম সেই অস্থায়ী আস্তানায়। রাতে ওখানেই খাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন বা ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন ভোর বেলা কাঁচের জানালা দিয়ে তুষারাবৃত হিমালয়ের রূপ দেখতে পেলাম। চায়ের ব্যাবস্থা ঘরেই ছিলো। চা পর্ব সেরে স্নান করে তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পড়ি। ইরফান ও এসে গেছে।
শ্রীনগর যেন ইরফানের হাতের তালু, আমাদের নিয়ে এলো প্রসিদ্ধ শালিমার বাগে। পরিপাটি সাজানো বাগ-টি ফুল গাছ, ছোট বড় নানান গাছে ভরা। মাঝে মাঝে সবুজ ঘাসের লন। কাশ্মীরি পোশাক এর পসরা সাজিয়ে বসে আছে দুটি গ্রুপ। ঐ পোশাকে সাজিয়ে ছবি তোলার জন্য দর্শকদের ঘিরে ধরে। ওদের নিরাশ করতে মন চাইলো না।পোশাক পড়ে ছবি তুলে নিলাম। তারপর গোটা বাগ-টি ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম। ছবিগুলি সংগ্রহ করে আবার ও গাড়িতে। এবার মুঘল গার্ডেন, বর্তমানে এই গার্ডেন নিশাদ গার্ডেন নামে পরিচিত। উঁচু পর্বত ঢালে এই বাগিচা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম। আহা কি সুন্দর! কি সুন্দর! ক্রমশঃ উঁচু ধাপে ধাপে সাজানো। পথের পাশে আবার ফোয়ারা। চোখে তাক লেগে যায়। পুরোটা হাঁটা কষ্ট হচ্ছে, নীচ থেকেই একদম উপর দেখে সন্তুষ্ট হতে হলো। মোবাইল ক্লিক এ কিছু দৃশ্য বন্দী করে নেমে এলাম। ডাল লেকের একটি ঘাটপারে শিকারা ভাড়া করে সবাই জলের বুকে ভেসে চলেছি। এদিক হতে ওদিক শিকারা চলেছে। লেকের তীর ঘেঁসে কতো বিপণী। কেহ বা দেখছে কেহ বা কিনছে জিনিসপত্র। শিকারা তীরে এসে দাঁড়াল। এক এক করে সন্তর্পনে নেমে এলাম। কাছেই গেস্ট হাউস। আমরা বিশ্রাম করে চা পান করে ডাল লেকের রাতের শোভা দেখতে বেড়িয়ে পড়ি। কৃত্রিম আলো লেকের জলে, পর্বত এর উপর এখানে সেখানে আলো জ্বলছে। দারুণ লাগছে সেই দৃশ্য। দোতলা বাস গোটা লেক ঘেঁসে পথে নেমেছে। আমরাও একটিতে উঠে পড়ি। লেকের জলে আলোর ফোয়ারা নৃত্য করছে। ভীষণ খুশি মন। ফিরতি বাসে ফিরে এলাম। গাড়ি নিয়ে ইরফান পৌঁছে দিল গেস্ট হাউসে। পরদিন আমাদের পাহেলগাঁও যাওয়া। ফিরে এসে বোট হাউজ এ একরাত লগইন লেক এ।
(পরবর্তী সংখ্যায় কাশ্মীরভ্রমণের বাকী অংশ লেখার ইচ্ছে রইল।)
একটি গ্রীষ্মকালীন প্রকৃতিপাঠ শিবির
ড রো থী দা শ বি শ্বা স
একটি এক দিনের শিক্ষামূলক ভ্রমণ- "প্রকৃতি পাঠ শিবির" সংঘটিত হলো ভবেশ চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দ দ্বারা।
১) স্থানের নাম: CPCRI, RC মোহিতনগর, জলপাইগুড়ি।
২) ভ্রমণপথ: ভবেশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়, শিরিষতলা থেকে মোহিতনগর, জলপাইগুড়ি।
৩) শিক্ষামূলক ভ্রমণের সময়সীমা: একদিন
বেলা সাড়ে দশটা থেকে বেলা দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
৪) শিক্ষার্থীর সংখ্যা:
ক) পঞ্চম শ্রেণী-
খ) ষষ্ঠ শ্রেণী-
গ) সপ্তম শ্রেণী-
ঘ) অষ্টম শ্রেণী-
ঙ) নবম শ্রেণী-
চ) দশম শ্রেণী-
মোট- ৩২ জন
৫) শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী- ১০ জন
৬) শিক্ষামূলক ভ্রমণের বর্ণনা- ভবেশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীবৃন্দ ২৯৷০৫৷২০২৩ শিক্ষার্থীদের নিয়ে জলপাইগুড়ির মোহিতনগর CPCRI, RCতে একটি একদিনের শিক্ষামূলক ভ্রমণ সংঘটিত করেন। ঐ দিন ছাত্রীদের সকাল সাড়ে দশটায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিলো। সবাই ছাতা, জল, পেন,একটা করে খাতা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। শ্রেণী শিক্ষিকারা বলে দিয়েছিলেন-- টিফিন ওখানে দেওয়া হবে। প্রজেক্টের নম্বর আছে এর ওপর। আশেপাশের ছাত্রীদেরও খবর দিতে বলেছিলেন। আমরা ১১টায় ই.রিক্স করে স্কুল থেকে রওনা দিলাম। আমরা ১১-২০ টার সময় মোহিতনগর ফার্মে পৌঁছোলাম।এটি একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা।
এই সংস্থার কার্যক্রম ও লক্ষ্য হলো:
১) দেশী ও বিদেশী ভ্যারাইটির সুপারী জার্মপ্লাজমের মূল্যায়ণ
২) উচ্চফলনশীল ও শীতসহনশীল নারকেল ভ্যারাইটির মূল্যায়ণ
৩) আবাদের ভিত্তিতে শস্যপ্রথার উন্নয়ণ
৪) আবাদী শস্যের কৃষিকৌশলের লক্ষ্য স্থিরিকরণ
৫) আবাদী শস্য ও মশলার বিস্তারণকৌশলের লক্ষ্য স্থিরিকরণ
৬) কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে পরীক্ষিত কৌশলগুলি বন্টন করা।
৭) প্রধানতঃ কোকো, সুপারী ও নারকেল নিয়ে গবেষণামূলক কাজ হয় এখানে।
CPCRI, RC মোহিতনগর-এর মানচিত্র দেখলাম--- ছবিও তুললাম।
এই রিসার্চ সেন্টারের সায়েন্টিস্ট ইনচার্জ আমাদের সঙ্গ দিলেন এবং এই রিসার্চ সেন্টার সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য দিলেন। আমরা জানলাম-- মোহিতনগর রিসার্চ সেন্টার স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে রিজিওনাল অ্যারিকানাট রিসার্চ স্টেশনে যেটা সেন্ট্রাল অ্যারিকানাট রিসার্চ সেন্টারের অধীনে ছিলো। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে এই সেন্টারকে সেন্ট্রাল প্লান্টেশন ক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কাশাড়াগড়-এর সাথে যুক্ত করা হয়। এখানে শস্য ও মশলার উন্নতিকরণ, উৎপাদন, প্রতিরোধ, আবাদ বর্ধিতকরণ-এর উপর গবেষণা করা হয় এবং এই গবেষণালব্ধ জ্ঞান তরাই অঞ্চল ও দেশের অন্যান্য অংশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এখানকার সায়েন্টিস্ট ইনচার্জ হলেন অরুণ কুমার শীট।
অবস্থান: এটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। ভবেশচন্দ্র স্কুল থেকে প্রায় ছয় কিমি দূরে। এন জে পি থেকে এর দূরত্ব ৪৫ কিমি। বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে ৬৫ কিমি দূরে। ভৌগোলিক ভাবে এর অবস্থান 26°31"N অক্ষরেখায় এবং 88°5" E দ্রাঘিমারেখায়, উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 91.3 মিটার।
জলবায়ু: এখানকার জলবায়ু হিমালয় পাদদেশস্থ কৃষির উপযুক্ত। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩২০ সেমি, এর ৯০% বৃষ্টিপাত দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমীবায়ুর প্রভাবেই হয়। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা 18°c - 38°c, সর্বোনিম্ন তাপমাত্রা- 6°c - 18°c।
মৃত্তিকা: তিস্তার পলিগঠিত মৃত্তিকা, কিছুটা বালুকাময়, হিউমাস সমৃদ্ধ, আম্লিক (মাটির pH 4.5 - 6.0)।
ক্ষেত্রফল: ৬৫ একর জমির ওপর সুপারী, নারকেল, অয়েলপাম ট্রী, কাজুবাদাম ও বিল্ডিং নিয়ে এই রিসার্চ সেন্টার গড়ে উঠেছে।
সুপারী বাগান, তার সাথে গোলমরিচ লতিয়ে ওঠা কি সুন্দর বাগান। কোকো, কফি, কাজুবাদাম, অয়েল পাম, নারকেল, নাসপাতি, অল স্পাইস, তালসুপারী, ড্রাগনফল- সব আছে। আমরা বেশ কিছু গাছের ছবি তুলেছি।
আমরা টিফিন খেলাম --- বেলা দুটোর সময়।
আমরা ফিরে এলাম --- সাড়ে তিনটায়।
******************************
গত কাল ২৯৷০৫৷২০২৩ আটটা ই.রিক্স নিয়ে ৩২ জন ছাত্রীসহ আমরা রওনা দিলাম মোহিতনগর CPCRI এর উদ্দেশ্যে।
একটা বিশাল শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে থাকা সবেদা গাছের নীচে ছায়াচ্ছন্ন সবুজের মাঝে ছাত্রীরা সার বেঁধে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে--- মোহিতনগর CPCRI -এর সায়েন্টিস্ট ইনচার্জ স্যার অরুণ কুমার শিট ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে তাঁদের পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে অবগত করেন। এই প্রসঙ্গে বন সৃজন, জল দূষণ, মাটি দূষণ, বায়ু দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ ইত্যাদি বিভিন্ন দূষণ সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করেন। ব্যাপক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কুফল সম্পর্কে জানান। একটা সময় জাপান সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করত, এখন অবশ্য প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রভাবে এর ব্যবহার কমে এসেছে। এই প্রসঙ্গে ব্লু বেবী ডিজিজের লক্ষণ ও কারণ বর্ণনা করেন। গোরুর দুধে NO3 আসছে কিভাবে সেটার ব্যাখ্যাও দেন। বিভিন্ন প্রকার দূষণ ক্যানসারের কারণ। মাত্রাতিরিক্ত বাইকের ব্যবহার বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতাটির উল্লেখ করেন--- ছাত্রীদের কবিতাটি পড়তে বলেন। পরিশেষে জানান যে এখনো যদি আমরা পরিবেশকে বাঁচাতে সচেষ্ট না হই তাহলে এই সবুজ গ্রহের পরিণতি লাল গ্রহের মতই হবে।
পরিবেশসংক্রান্ত ভীষণ সুন্দর মনোজ্ঞ আলোচনার পর ডঃ অরুণ কুমার শীট ছাত্রীদের উদ্ভিদ চেনাতে নিয়ে গেলেন। তিনি একে একে কোকো, কফি, সুপারী, নারকেল, অয়েল পাম, তালসুপারী, নাসপাতি, অল স্পাইস, কর্পূর, ড্রাগনফলের গাছ, কাজুবাদাম স্পাইল্যানথাস, অর্কিড--- প্রভৃতি গাছের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ডঃ অরুণ কুমার শীট জানান- বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৩ উদযাপন উপলক্ষ্যে নির্ধারিত কর্মসূচী ও স্লোগান হল- "Lifestyle for Environment" উনারাও এই নির্ধারিত কর্মসূচীতে সামিল হয়েছেন।
জীবনশৈলি কি--- খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি--- তিনি বললেন--- বর্তমানে ব্যাপক প্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নতির কারণে, নতুন নতুন দ্রব্য উৎপাদন কৌশল ও নতুন জ্ঞান, তথ্য আহরণে বৃত্তিজগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, ফলে আধুনিক জীবন পরিবর্তনশীল যা অভিব্যক্তি বা ক্রমবিকাশের ধারায় প্রবহমান। ফলে প্রয়োজন জীবনব্যাপী সঠিক শিক্ষার। এটাই জীবনশৈলি। আজকাল বাচ্চাদের ১১ বৎসর বয়স থেকেই বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়। এই সময়ে তাঁদের দেহের বৃদ্ধি ও মনের বিকাশ হয়। বিপাক ক্রিয়ার হার বাড়ে, হরমোনের পরিবর্তন ও কার্যকলাপ বাড়ে। হাড়ের বৃদ্ধি ঘটে। এ সময়ে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনযুক্ত সুষম ও ফাইবারযুক্ত খাদ্য গ্রহনের মাধ্যমে সঠিক পুষ্টি দরকার। অতিরিক্ত ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় দেহের ওজন বাড়ায়। তাই অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার বাদ।
তিনি আরও জানান--- গার্হস্থ্য ও বৈশ্বিক চাহিদা সৃষ্টি করতে এবং মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য যোগাতে ভারত সরকার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কাছে প্রস্তাব রেখেছে '২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ'ঘোষণা করা হোক। বিশ্ব উষ্ণায়ন, পরিবেশের যেরূপ পরিবর্তন, তাতে খাদ্য সুরক্ষার জন্য, পুষ্টির জন্য ও স্থিতিশীল কৃষিব্যবস্থায় মিলেট চাষের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ খরা বা স্বল্প বৃষ্টিপাতে, কঠিন পরিস্থিতিতে মিলেট জন্মাতে পারে। মিলেট ফাইবারযুক্ত এবং প্রোটিন ভিটামিন ও খনিজসহ অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। আমাদের দেশে পার্ল মিলেট (বাজরা), ফিঙ্গার মিলেট (রাগি), ফক্সটেইল (কাউন), প্রোসো (মাইলো, জোয়ার), বার্ণইয়ার্ড মিলেট (শ্যামা চাল), কোডো মিলেট (বাজরা), লিটল্ মিলেট (সামা), ব্রাউনটপ মিলেট (বাদামী শীর্ষ বাজরা), কুইনোয়া মিলেট (ওট), টেফ মিলেট (বাজরা), বাকহুইট (ঢেমশি) প্রভৃতি নানা রকম মিলেট জন্মে। এমনকি লাল ডাঁটা শাকের বীজকেও মিলেট বলা হচ্ছে।
বিজ্ঞানী ডঃ অরুণ কুমার শিট জানালেন-- মোহিতনগর CPCRI-তে প্রধানতঃ কোকো, কফি, নারকেলের সাথে সুপারী নিয়েও গবেষণা হয়। সুপারী বাগানের দিকে নির্দেশ করে বললেন--- এখানে মোহিতনগর ভ্যারাইটির মাঝে খর্বাকৃতি সুপারী গাছ আছে। একটি খর্বাকৃতি সুপারীগাছ দেখিয়ে বললেন--- এই গাছটির বয়স ত্রিশ বছর।
মোহিতনগর ভ্যারাইটি- ১৯৯১ সালে এই ভ্যারাইটি আবিষ্কৃত হয়। এই গাছের সুপারী আকৃতির দিক থেকে সমআকৃতিসম্পন্ন। কারণ মঞ্জরীদন্ডের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা ভাবে সুপারীগুলি বিন্যস্ত থাকে। এই কারণেই উদ্ভিদজীবাণু দ্বারা সুপারী আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও কম। এটাও টানা উচ্চ ফলনশীল। এক একটি গাছ প্রতি বছর ৩.৬৭ কেজি সুপারী দেয়।
ভিত্তাল অ্যারিকানাট হাইব্রীড ২ (VTLAH-2), খর্বাকৃতি সুপারীগাছ। মাঝারী প্রস্থবিশিষ্ট কাণ্ড, পর্বগুলি একের ওপর আরএকটি - এইভাবে সজ্জিত। পাতার চাঁদোয়ার আকৃতি ছোটো, পাতা সুবিন্যস্ত। মাঝারী উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার ফল আনতপ্রকৃতির হয়। দ্রুত ফলনশীল গাছ। একটা গাছ থেকে বছরে ২.৬৪ কেজি সুপারী পাওয়া যায়।
কোকো- কোকোর বিজ্ঞানসম্মত নাম: Theobroma cacao. Malvaceae পরিবারভুক্ত। দেখলাম--- বড় বড় গাছের ছায়ায় ঝোপঝাড়সহ খুব সুন্দর করে বেড়ে ওঠা কোকো গাছ। ফুল দেখতে পাইনি। বড় বড় লম্বাটে ফল ঝুলে থাকতে দেখেছি। ডঃ অরুণ কুমার শিট স্যার একটা পড়ে থাকা ফল নিয়ে ভেঙে দেখালেন--- কি সুন্দর সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে বীজগুলো। তিনি জানালেন--- পাকা ফলের রঙ তিনরকম হতে পারে। মেটে লাল, গাঢ় হলুদ ও বাদামী। পাকা ফলের বীজগুলি বের করে শুকিয়ে রোস্ট করে গুঁড়ো করে যে পাউডার পাওয়া যায় তা দিয়ে চকোলেট তৈরি হয়। ফলের নরম শাঁস থেকে কোকো বাটার তৈরি হয়। এই ফলে জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম হয়।
তিনি ছাত্রীদের শাঁসসহ কোকোবীজ খেতে দিলেন। তিনি বললেন, এটি খেতে মিষ্টি কি না--- ওরা প্রথমে জানালো এর স্বাদ নোনতা, পরে বললো টক, তেতো। আসলে শাঁস মিষ্টি হলেও বীজ টকটক ও তেতো।
তাল সুপারি, অ্যারিকা পাম (Areca triandra) Arecaceae পরিবারভুক্ত multi stemed palm. এটি Ornamental plant. এর ফুলে পুংকেশরের সংখ্যা তিন। ডঃ অরুণ কুমার শীট একটি লাল টুকটুকে ফল নিয়ে ছাত্রীদের দেখালেন। বললেন--- ফলের শাঁস বা পাল্প ঠিক খেজুরের মত, মিষ্টি স্বাদযুক্ত। শাঁস যেমন খাওয়া যায়, বীজও সুপারির মত খাওয়া যায়।
বীজ মৃদু মাদকধর্মী, ট্যানিনযুক্ত, ক্ষারধর্মী। সুপারির মত খেলে এটি লালা নিঃসরণে সহায়তা করে, হৃৎপিন্ডকে অধিক সক্রিয় করে, ঘাম নিঃসরণ করে, খিদে কমায়, কৃমিনাশক।
ড্রাগন ফলের গাছ- শুনেছি ড্রাগন ফলের উপকারিতা অশেষ। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এ ফল ভীষণ উপকারী। ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ ফলের জুড়ি নেই। এ গাছ রুক্ষ শুষ্ক বেলে মাটিতে, খরাপ্রবণ এলাকাতে, ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলে- সবখানেই জন্মে। তাই বুঝি বর্তমানে এ ফলের গাছ চাষ বিশেষ লাভজনক।
মোহিতনগর গবেষণাকেন্দ্রে দেখলাম ড্রাগন ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। দুটি গাছের মধ্যে দূরত্ব প্রায় দু'মিটার। প্রত্যেকটি গাছ খাঁচা দিয়ে ঘেরা। দেখেই বোঝা যায় এ গাছ ফণীমনসার মতো, ক্যাকটাস। স্যার অরুণ কুমার শীট জানালেন- এটি Cactaceae পরিবারেরই গাছ।
ফুল নাকি এসময়েই হয়। কিন্তু চোখে পড়লো না। ড্রাগন ফলের বিজ্ঞানসম্মত নাম- Hylocereus costaricensis.
ড্রাগন ফলের উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে স্যার বললেন--- এই ফলের বহিঃত্বকের রঙ অত্যন্ত আকর্ষণীয় হলেও শাঁসের রঙ সাদামাটা। যে ফলের শাঁস যত রঙীন সেই ফল তত বেশী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। যেমন পাকা পেঁপে ড্রাগন ফলের চেয়ে বেশি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট।
অলস্পাইস গাছ- অদ্ভুত একটি গাছ। ছাত্রীরা স্যারের নির্দেশে গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে ঘ্রাণ নিতে লাগলো। আমরাও পেলাম পুরু, উজ্জ্বল, চকচকে, সুঘ্রাণযুক্ত, ওভাল শেপের সেই পাতা। কেউ বলছে- এলাচের গন্ধ, কেউ বলছে তেজপাতার মতো, কেউ বলছে লবঙ্গ হতে পারে, কারো মনে হলো দারচিনি নয়তো? ডঃ অরুণ কুমার শিট জানালেন--- এর নাম অলস্পাইস, যার অর্থ সবরকম মশলা। জায়ফল, জৈয়েত্রী, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ, এলাচ, তেজপাতা, কর্পূর- এই আট প্রকার গন্ধ পায় অনেকে। যাঁদের ঘ্রাণশক্তি আরো প্রখর তাঁরা আরো বেশি মশলার গন্ধ পেতে পারে। রান্নায় এই পাতা ব্যবহার করা হয়।
দেখলাম--- কি সুন্দর সাদা ছোটো ছোটো ফুল ধরেছে। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি আসলো না।
এই গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম--- Pimenta dioica. Myrtaceae পরিবারভুক্ত অর্থাৎ জারুল গাছের পরিবার।
শুনেছি অলস্পাইস গাছ কফি গাছের শেডট্রী হিসেবে লাগানো হয়।
কাজুবাদাম গাছ--- বিজ্ঞানসম্মত নাম Anacardium occidentale, Anacardiaceae পরিবারভুক্ত উদ্ভিদ। চিরহরিৎ। ডঃ অরুণ কুমার শীট খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন--- কাজুর দুটো অংশ। কাজু আপেল ও কাজুবাদাম। হালকা লালচে হলুদ রঙের অংশটি অপ্রকৃত ফল, এই অংশ একটি ফুলের শক্ত বৃন্ত (Pedicel) প্রসারিত হয়ে ফলের মত তৈরি হয়। একে কাজু আপেল বলে। এর পাল্প ও জুস থেকে astringent fruit drink (non-alcoholic), সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত অ্যালকোহলিক ড্রিঙ্কস তৈরি হয়। এই অংশ নিঃসৃত ফেনলিক রেজিন, অ্যানাকার্ডিক অ্যাসিড চামড়ার অ্যালার্জীর কারণ। কাজুবাদাম প্রকৃত ফল (Drupe). এর বীজ বহিঃস্ত্বক (Testa) ও বীজ অন্তঃস্ত্বক (Tegmen) কোনটি, সেটিও দেখিয়ে দিলেন। কাজুবাদাম সংগ্রহ পদ্ধতি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। কাজুবাদাম প্রথমে রৌদ্রে শুকোতে হয়, তারপর বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে শাঁস বের করতে হয়।
এরপর স্যার দেখালেন আশ্চর্য সেই নোনী গাছ- যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Morinda citrifolia. কফি পরিবার Rubiaceae family-র সদস্য। প্রাকৃতিকভাবেই এর বিস্তৃতি সর্বত্র। আশ্চর্য সেই শক্তিশালী ফল, যার গন্ধ বমির মত, তাই একে famine food বলে, যদিও এসময় আমরা তার দেখা পাইনি--- এই ফলের পাল্প কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার সমৃদ্ধ বলে কোনো কোনো সাংস্কৃতিক সমাজের মানুষের প্রধান খাদ্য এটি। Traditional medicine, food supplement ক্যাপসুল ও জুস হিসাবে এটির ব্যবহার দেখা যায়।
ফিরে এলাম CPCRI এর মূল ভবনে। স্যার দেখালেন গাঢ় লাল কান্ডযুক্ত, শাখা-প্রশাখায় জড়ানো, সূক্ষ্ম সবুজ ফার্ণ পাতার মত জলপ্রপাত উদ্ভিদের ঝাড়, নাম ফাইল্যানথাস। সুন্দর করে সোফার আকৃতি দেওয়া--- ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, বসবি নাকি সোফায়? ভারি অদ্ভুত সুন্দর উদ্ভিদ, এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Phyllunthus multiflorus, এটি Phyllanthaceae বা আমলকির পরিবারভুক্ত। এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য হল যতই এর পাতাগুলিকে যৌগিক পত্রের পত্রকের মত দেখাক না কেন, এগুলি আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌলিক পত্র। এজন্য প্রতিটি পর্ব থেকে একান্তর পত্রবিন্যাসে বিন্যস্ত থাকে। প্রতিটি পর্ব থেকে ফুল ও ফল হয়। যার ফলে মনে হয় যেন পাতার নীচ থেকে ফুল ফল জন্মে।
এভাবে টানা প্রায় আড়াই ঘন্টা স্যার প্রকৃতির মাঝে আনন্দের সাথে আমাদের সব চিনিয়ে দিলেন, বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে--- কি বিশাল কর্মযজ্ঞ এ গবেষণাকেন্দ্রের, এরপর স্যার আমাদের আলো বাতাসপূর্ণ সুসজ্জিত কনফারেন্স হলে বিশ্রাম নিতে বললেন। পানীয় জল ও টয়লেটের সুন্দর ব্যবস্থা। লিকুইড সোপ, ডাস্টবিন- পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার সকল নিদর্শন সেখানে। খেতে খেতে মন জুড়ানো সুশীতল কক্ষে আলোচনা চলতেই থাকলো শিক্ষিকা-ছাত্রীদের।
কি বলে ধন্যবাদ জানাবো শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী ডঃ অরুণ কুমার শীট স্যারকে?
বিখ্যাত লেখিকা ও কবি কেতকী কুশারী ডাইসনের ভাষায় বলি---
"উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের আমি সত্যিই শ্রদ্ধা করি। কত কী জানেন তাঁরা। আর সবই জরুরী জিনিস, কাজে লাগে, কোনোটা ফালতু নয়। বই খুললে চোখ খুলে যায়, বিস্ফারিত হয়ে যায় দু'চোখ। ওঁরা যে-জ্ঞানের টুকরোগুলো পরিবেশন করেন সেগুলো যেন আলু, কচুশাক, বা কলমীর মতো, সিদ্ধ ক'রে খেয়ে বাঁচা যায়। আজকালকার মটরকড়াই-চিবোনো হিং-টিং-ছট-আওড়ানো মানববিদ্যার পণ্ডিতদের মতো ওঁরা আগাপাছতলা প্রলাপ বকেন না। কিংবা আমাদের অভিধান রচয়িতাদের মতো "ফুলবিশেষ" বা "বৃক্ষবিশেষ" ব'লে ঘুমোতে চ'লে যাননা, বাস্তবের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করেন। একটা জিনিস যে ফুল বা গাছ তা তো পাঠক একেবারে নতুন ভাষাশিক্ষার্থী না হলে প্রসঙ্গ থেকেই অধিকাংশ সময় বুঝে নিতে পারেন। কিন্তু তারপরেই জানতে ইচ্ছে করে ফুলটা বা গাছটা কোন্ জাতের, কী তার ধর্ম। তাকে দেখতে কেমন, তার পাতার আকৃতি কেমন, ফুলের রঙটা কী। এইসব জানলে তবেই না বোঝা যায় একটা টেক্সটে কেন তার উল্লেখ রয়েছে।"
সত্যিই আজ আমরা সবাই শিখলাম- "জ্ঞানের টুকরো সরবরাহ করা কাকে বলে।"
(শব্দ সংখ্যা- ১৯৭৭)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন