নাটক

একটা মৃত্যু, একটি প্রশ্ন

র থী ন্দ্র না থ রা য়

চরিত্রলিপি
নন্দন: রাজনৈতিক নেতা
আশীষ: রাজনৈতিক কর্মী
বলাই: ঐ কর্মী
সতীশ: বিধায়ক
রামনারায়ন: শিক্ষক
রমেন: শহীদ রঞ্জনের পিতা
অদিতি: রঞ্জনের স্ত্রী
নন্তে: জনৈক মাতাল 

[শোকসভা। পাশেই কালো কাপড়ে ঢাকা শহীদবেদী। মঞ্চে চেয়ার, টেবিল, ফুলদানি, ছবি, মালা, জলের বোতল ইত্যাদি।]

নন্দন: ( মাইকের সামনে) হ্যালো চেক, হ্যালো... জিরো, নাইন, এইট, থ্রি, ফোর... নমস্কার, উপস্থিত দর্শকমন্ডলী তথা এলাকার শুভানুধ্যায়ী জনগন... আপনাদের অজস্র অভিনন্দন। আপনারা এমন একজনের শোকসভায় এসেছেন যার পরিচয় এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। সে যে আমাদের অন্তরের কতখানি আত্মীয় ছিল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। প্রত্যেকেরই একদিন মৃত্যু হবে, তবু রঞ্জনের এই অকাল মৃত্যুকে মেনে নেওয়া যায় না। ভগবান আমাদের রঞ্জনকে জোর করে কেড়ে নিয়েছেন। জন্ম মৃত্যুর ওপরে মানুষের হাত নেই। তবু অন্তরের বোবাকান্নাকে কিছুতেই চেপে রাখা যায়না! আমরাও চেপে রাখতে পারিনি। তাই এই শোকসভা আর একটু স্মৃতিচারণ। রঞ্জনের বিদেহী আত্মা যেখানেই থাকুক না কেন আমরা তার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, রঞ্জন আমরা তোমাকে ভুলে যাইনি। তোমার আসন আজো খালি পড়ে আছে। 

[আশীষ আসে। তার হাতে কতকগুলো ফুলের মালা। পরণে জিনস, জ্যাকেট ইত্যাদি।]

আশীষ: (নন্দনের কানে কানে) আবে নন্দন, শ্লা তাড়াতাড়ি কর। গুরুচন্দ্রিকা করতেই একঘণ্টা কাটিয়ে দিলি। ওদিকে শ্লা ফেমাস ম্যানগুলো তাড়াতাড়ি করছে। 

নন্দন: ( ইশারায় থামিয়ে দিয়ে ) বন্ধুগণ, এবারে আমরা সভার কাজ শুরু করছি। আজকের এই সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য আমি স্থানীয় বিধায়ক তথা জননেতা, তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী সতীশ মিত্রের নাম প্রস্তাব করছি।

আশীষ: (মাইকের সামনে) আমি এই প্রস্তাব সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি।
 
[নেপথ্যে করতালি]

সতীশ: (চেয়ারে বসে) নন্দন আর কেউ আসবেন নাকি? আমার আবার একটা কনফারেন্স আছে। 

নন্দন: (একটা কাগজের লেখা দেখে) এবারে প্রধান অতিথির পদ অলঙ্কৃত করবেন এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষক রামনারায়ণ চক্রবর্তী।

[রামনারায়ণ আসে। সাধারণ ভদ্রস্থ চেহারা। আসন গ্রহন করে।]

নন্দন: আজকের এই অনুষ্ঠানে আমরা আরো দুজনকে ডেকেছি। তাঁরা হলেন নিহত রঞ্জনের শোকাতুর পিতা এবং শোকাতুর স্ত্রী। তাঁদেরকে সমবেদনা জানাবার ভাষা আমার নেই। যে অপূরণীয় ক্ষতি এদের হয়েছে তা কখনোই পূরণ হবার নয়। 

[রঞ্জনের পিতা রমেন এবং স্ত্রী অদিতি আসে। শোকার্ত উসকো খুসকো চেহারা তাদের। বিধবার পোশাকে অদিতি। আশীষ তাদের যথাস্থানে বসিয়ে দেয়।]

সতীশ: (উঠে) এবারে সভার কাজ শুরু করছি। প্রথমে স্মৃতিফলকের আবরণ উন্মোচন করবেন এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী রামনারায়ণ চক্রবর্তী। 
রাম: (উঠে) না, মানে আমি স্মৃতিফলকের আবরণ উন্মোচন করব?

সতীশ: হাঁ, করবেন। কেন ভয় করছে?

রাম: না মানে, জীবদ্দশায় যাকে একটুকুও সাহায্য করতে পারিনি, তারই মৃত্যুতে এসেছি ঘটা করে শোক জানাতে? এ যে কতো বড়ো প্রহসন!

আশীষ: প্রহসন! আমরা শ্লা প্রহসন করতে এসেছি?

নন্দন: (আশীষের কাছে এসে) আহ্! কি হচ্ছে কি? পাবলিকের সামনে! ছিঃ ছিঃ, এমন একটা মহৎ কাজে মাথা হট করতে নেই। আমি সভার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। (মাইকের কাছে এসে) এবারে স্মৃতি ফলকের আবরণ উন্মোচন করছেন বিশিষ্ট শিক্ষক রামনারায়ণ চক্রবর্তী।

নেপথ্যে কোরাস -- বিশিষ্ট সমাজসেবী রঞ্জন গোস্বামী অমর রহে, অমর রহে। 

রাম: (স্মৃতি ফলকের আবরণ উন্মোচন করে) 

নেপথ্যে কোরাস: রঞ্জন, আমরা তোমায় ভুলছিনা, ভুলবনা।

রাম: রঞ্জন আমারই হাতে গড়া, আমারই শিক্ষায় শিক্ষিত। মানুষের বিপদে আপদে যে সব সময় সাহায্য করার জন্য ছুটে যেত। যার মৃত্যুটা আজ একবছর পরেও ধোঁয়াশাতেই ঢাকা থেকে গেল। কি বলব আজ? মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তবে বলি, রঞ্জন তুমি আমাদের ক্ষমা কোরো। ভালোবাসা ছাড়া আর তো কিছু দিতে পারিনি, সেটা আমাদেরই লজ্জা হয়ে থাক। আমার বলার মতো আর কিছু নেই। নমস্কার আপনাদের (হাত জোড় করে)।

[রাম চেয়ারে এসে বসে]

সতীশ: রঞ্জন এমন একটি চরিত্র, এমন একটি নাম--- যার কথা এলাকার কারোর অজানা থাকার কথা নয়। সুখে দুঃখে যে ছিল সবার আত্মীয়, সেই রঞ্জন আজ আমাদের মধ্যে নেই, এটা ভাবতেও বড় কষ্ট হচ্ছে। প্রতিবেশীর প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া ছিল যার কাজ, সেই রঞ্জনের ও যে শত্রু থাকতে পারে, তা আমরা ভাবিনি কখনো। (চোখ মুছে) মৃত্যু প্রত্যেকেরই হবে। তবু এমন মৃত্যু যেন কারোর না হয়।

আশীষ: (স্বগতোক্তি) ড্যাম ইওর ড্যাম! শ্লা বাতেলাবাজ, বাত ঝারছে। নেহাৎ শোকসভা।
(প্রকাশ্যে) স্যার একটা কথা বলছিলাম কি--- 

সতীশ: বলে ফেল---

আশীষ: এটা তো একটা শোকসভা--- তাই বলছিলাম কি--- ছোট মানে একটু ছোট করে। বুঝতেই তো পারছেন মানুষের হাতে এখন সময় বড্ড কম। 

[বলাই আসে, মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে থাকে।]

সতীশ: ছবি নেবে? আচ্ছা দাঁড়াও। আমি যখন প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করব তখন একটা ছবি নিও। নন্দন, মাইকে ঘোষণা করে দাওতো।

নন্দন: (মাইকের সামনে) এবারে শহীদ রঞ্জনের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করছেন জননেতা তথা স্থানীয় বিধায়ক সতীশ মিত্র। 

সতীশ: (মালা হাতে নিয়ে) বলাই অনুষ্ঠানের ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করে দিও। (ছবির কাছে গিয়ে হাসি হাসি মুখে মাল্যদান করে ও বলাই ছবি তোলে।)

নন্দন: এবারে আমাদের অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রধান অতিথি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রামনারায়ণ চক্রবর্তীকে কিছু বলতে বলা হচ্ছে। 

রাম: (উঠে) আমি আর কি বলব। তবু অনুষ্ঠানে এসে কিছুই বলবনা, তা হয়না। এলাকার লোককে বলে দিতে হবেনা, রঞ্জন কে ছিল, কি তার পরিচয়? রঞ্জনের মধ্যে এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যাতে করে সে ধনী দরিদ্র তথা আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে আসন করে নিতে পেরেছিল। রঞ্জনের কাছে ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির কল্যাণই ছিল তার জীবনের মূলকথা। এমন ছেলের মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না। সমাজ জীবনে আজ একটা ধ্বস্ নেমেছে। সেই ধ্বসের হাত থেকে রঞ্জনদের বাঁচাতেই হবে। নাহলে রাজপথে, রেলস্টেশনে নিগৃহীতা মেয়েদেরকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে যাবেনা। কিন্তু দুঃখের কথা আজ একবছর হয়ে গেল তবু পুলিশ একজন আসামীকেও খুঁজে পেলনা? আজও অজানাই রয়ে গেল রঞ্জনের হত্যাকারী কে?
 
আশীষ: (স্বগতোক্তি) মাস্টারটাকে বসিয়ে দিতে হবে, নাহলে শ্লা সব কিচাইন করে দেবে । (প্রকাশ্যে) স্যার বলছিলাম কি!

রাম: কি ই বা বলবে তুমি! কি ই বা বলতে পারো তোমরা। রাজনীতির কাছে তোমরা তোমাদের বিবেক, মনুষ্যত্বকে বাঁধা দিয়েছ। তাই আজ আর তোমরা কিচ্ছু বলতে পারবেনা। অন্তঃসারশূন্য রাজনীতির কারণে আজ একটা অবক্ষয় শুরু হয়েছে। সমাজের সর্বস্তরে যৌবনের সঙ্গে আজ প্রতারণা চলছে। যুবশক্তিকে আজ ফাঁকি দিয়ে, ভুল বুঝিয়ে তাদের বিপথু করে তুলেছে এই রাজনীতি। 

[বলাই, আশীষ, নন্দন নিম্নস্বরে আলোচনা করে।]

নন্দন: (মাইকের কাছে এসে) একটি বিশেষ ঘোষণা--- আমাদের সভার কাজ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে, কেননা পার্টির কনফারেন্সের জন্য সতীশবাবু এখনই চলে যাবেন। এখন যে শেষ কাজটি বাকি রয়েছে তা হল নিহত রঞ্জনের পরিবারবর্গকে আমাদের পার্টির তরফে কিছু সাহায্যদান।

অদিতি: (উঠে) না, আমরা সাহায্য নিতে আসিনি। তাছাড়া সাহায্য নেবার কথা আমাদের আগে বলাও হয়নি।
 
আশীষ: তবে কেন এসেছো মা মনি? রূপ দেখাতে?

নন্দন: আশীষ, চুপ কর।
 
অদিতি: না, আমাকে রূপ দেখাতে আসতে হয়না। তোমাদের মতো পতঙ্গেরাই আমার রূপ দেখার জন্য ছুটে আসে। ভাবতেও লজ্জা করে এদের মা আছে, বোন আছে। (হাত জোড় করে) সমবেত ভদ্রমণ্ডলী, শুনুন, রঞ্জন কে, কেন কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, তার মৃত্যুর পিছনেই বা কাদের হাত, তা আপনাদের বলে দিতে হবেনা। আমরা কারোর কাছে সাহায্যের আবেদন নিয়ে আসিনি। রঞ্জন মারা গেছে; মৃত্যু একদিন হতোই। কিন্তু এমনভাবে মৃত্যু ! আপনারাও তো ভাই, বোন, আত্মীয়, পরিজন নিয়ে বাস করেন। তাদের কোনও রহস্যজনক কারণে মৃত্যু হলে আপনারাও কি স্থির হয়ে থাকতে পারতেন? আমরাও পারিনি। কিছু চাইতে আমরা আসিনি। শুধু একটা প্রশ্ন করতে এসেছি। রঞ্জন মারা যায়নি, তাকে খুন করা হয়েছে। সেই আততায়ীরা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের দেখতে পায়না। কিন্তু কেন?

রমেন: বৌমা তুমি কাদের কাছে প্রশ্ন করছ? কতকগুলো দলদাস আর কাঠের পুতুলের কাছে? 

[দর্শকদের মধ্যে থেকে উঠে আসে নন্তে। ঈষৎ অপ্রকৃতিস্থ]

নন্তে: ম্যাডাম, প্রশ্নটা আমার কাছে করুন আমি উত্তর দেব। তবে আগে আমাকে একটা বোতল, মানে ছোট হলেও চলবে।

আশীষ: (নন্তের কলার ধরে) এই শ্লা নন্তে, মাতলামি করার আর জায়গা পাসনি? এমন একটা থাপ্পর লাগাবো যে বদনের সেপটাই পাল্টে যাবে। যা, শ্লা, ভাগ এখান থেকে। 

নন্তে: সমবেত ভদ্রমণ্ডলী, শুনুন--- আমি জানিনা--- আমি কাউকে খুন হতে দেখিনি। কি করে দেখব? অন্ধকার, হঠাৎই কারেণ্ট চলে গিয়েছিল--- তারপর রক্তাক্ত অবস্থায় টলতে টলতে রঞ্জন আমার কাছে আসল--- তখনও তার পিঠে ছুড়িটা গেঁথে ছিল। আমি বাজার থেকে ফিরছিলাম। রঞ্জন বললে, নন্তু আমাকে বাঁচা। কিন্তু আমাকে কিছু করতে হয়নি, ও নিজেই মরে গেল--- হা হা হা।(কাঁদতে থাকে)

বলাই: কি রে শ্লা, যাবি এখান থেকে--- না একটা থাপ্পর খাবি?

নন্তে: দোহাই আর একটু মিথ্যে কথাটা বলতে দাও। কাল আর এটা মনে থাকবেনা। একটু মাল পেটে পড়লেই সব ভুলে যাই। (জনতার দিকে) শুনুন ভদ্রমহোদয়গণ---

বলাই: ভাগ শ্লা--- (মুখে একটা ঘুষি মারে) 

নন্তে: (মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে) ইস কতো রক্ত! হাতটাও লাল হয়ে গেছে। ভারি মজা তো! বলাই, শ্লা তোর রক্তের রঙটা কি রে?

বলাই: আবে মুখ সামলে কথা বল শূয়োরের বাচ্চা! (পকেট থেকে পিস্তল বের করে) নাহলে বাপের নাম খগেন করে ছেড়ে দেব। 

নন্তে: দেখুন, দেখুন আপনারা, প্রকাশ্য জনসভায় এরা আমাকে খুন করতে চাইছে। দেখুন, ল'আ্যণ্ড অর্ডার কাকে বলে!

সতীশ: না, আর নয়! সভা আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। নন্দন সভার সমাপ্তি ঘোষণা করে দাও। 

নন্দন: বলাই কি করলি বলতো! পাবলিকের কাছে প্রেস্টিজ থাকবে আমাদের?

বলাই: সব দোষ আমার। মাছ খায় সবাই, দোষ হয় মাছরাঙার। নন্দনটা নেতা হয়ে আমাদের চিনতে লারচে! এই আশীষ, আবে ফোট শ্লা!

নন্তে: (অদিতি ও রমেনকে দেখে) না, না, আমি কাউকে খুন হতে দেখিনি। কাউকে না। চুপ ডোণ্ট টক। কেউ শুনতে পাবে। 

রমেন: বৌমা, প্রতিবাদ করতে এসেছিলে না? পারলে প্রতিবাদ করতে? পাথরগুলো মজা দেখতে এসেছিল। চলে গেছে।

অদিতি: আমাদের কথা কেউ শুনবেনা, তাই না বাবা?

রমেন: কেন শুনবে? আমরা তো আর কেষ্ট বিষ্টু নই। চল মা, এই অরণ্যে আর রোদন করে লাভ নেই।
 
অদিতি: তাহলে রঞ্জনরা কি এভাবেই মারা যাবে? 

রমেন: জানিনা, জানিনা--- (কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ে) 

[যবনিকা নেমে আসে]






মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪