পত্রসাহিত্য
কল্পনার বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া কিছু কথা- এক শিক্ষার্থীর আর এক শিক্ষকের
প ল্ল ব সে ন গু প্ত
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন কোনোও শিক্ষক বা শিক্ষিকা থেকেই যান যার বা যাদের কথা মনে পড়লেই মনে হয় যদি তারা সেই সময় জীবনে না আসতেন জীবনটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। এই চিঠিগুলো কোনো নির্দিষ্ট একজনের নয়। সবার। কল্পনার বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া কিছু কথা। এক শিক্ষার্থীর আর এক শিক্ষকের। সবাই যদি কোনো না কোনো জায়গায় নিজের সাথে, নিজের জীবনের কোনো স্মৃতির সাথে মিল খুঁজে পান, তাহলেই এ লেখা সার্থকতা পাবে।
চিঠি ১
স্যার, আমার প্রণাম নেবেন। কতদিন আপনাকে দেখিনি। শেষ দেখা একটু অদ্ভুতভাবে, তাই না স্যার? NCERT -র ক্যাম্পাসে। জাতীয় শিক্ষা কনফারেন্সে। আমি ধরাচুড়ো পড়ে সক্কালবেলা সেমিনারে যাচ্ছি। দেখি আপনি উল্টোদিকের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসছেন। বয়সের ভারে একটু ন্যুব্জ শরীর কিন্তু চোখের দৃষ্টি এখনও তেমনই উজ্জ্বল। কাছে গিয়ে প্রনাম করতেই বললেন, 'কেমন আছিস রে?' কি বলবো স্যার? আমি কেমন আছি, নিজেই তো জানিনা। আজকাল কেমন গুলিয়ে যায় সব। সারাদিন না না কাজ, মিটিং, কনফারেন্স, পেপটক, ক্লায়েন্ট মিট সব সেরে রাতে যখন ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিই, তখনও ফোনটা খোলা রাখতে হয়। নিজের নিভৃত অবসরের মুহূর্তেও আমি নিজের নই স্যার। কর্পোরেট জগতে ব্যক্তিগত কিছু নেই, থাকতে পারে না। তাই সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আপনার সামনে। মনে হচ্ছিল সময় যেন থমকে দাঁড়ালো একবার। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অনুকম্পার হাসি। বললো 'যা, দিলাম তোকে কিছুক্ষণ।' আর আমি হারিয়ে গেলাম প্রায় কুড়ি বছর আগের দুপুরবেলাগুলোতে। ইংরেজি খাতায় কবিতা লেখা আবিষ্কার করে আপনি সেই ক্লাস এইটের ছাত্রীটিকে আদেশ করছেন, 'কি লিখেছিস সবার সামনে পড়ে শোনা।' কিংবা বাবার কাছে ফর্ম ফিল আপ করার টাকা নেই শুনে চুপচাপ স্কুলের অফিসে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে স্লিপটা হাতে গুঁজে দিয়ে বলছেন, 'জ্যাঠামো করতে হবে না। সব কি, কেন র জবাব দিতে পারবো না। বাড়ি গিয়ে চুপচাপ পড়তে বসবি।' আমি জানি স্যার শুধু আমি নই, আমার মতো এমন অনেকেই আপনার কাছ থেকে এমন বকুনি শুনেছে, বছরের পর বছর। তারপর, সেই আপনাদের বাগান থেকে আম চুরি করে আপনাকেই মেখে খাওয়ানো? বন্ধুদের কাছে পাঁচ টাকা বাজি জিতেছিলাম। তখন কি জানি শোভন আর সুহানা চিট করে আপনাকে বলে দিয়েছে আমরহস্য? আপনি আমের টুকরো মুখে দিয়ে বললেন, 'বাহ্! বেড়ে মেখেছিস তো। আমগুলোও খুব ভালো। একেবারে আমার বাগানের মতো।' সেই দিনগুলো কোথায় গেল স্যার, সেই দুপুরগুলো? আমি কবি হই নি স্যার। আপনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি নি। আজ আমি মাস গেলে মোটা মাইনে পাওয়া কর্পোরেট জগতের এক ধোপদুরস্ত চাকরানী। কাজ, কাজ, কাজ। দিন নেই, রাত নেই শুধু কাজে ডুবে থাকা। সোশ্যাল স্টেটাস, ভার্চুয়াল স্টেটাস আর কর্পোরেট স্টেটাস। ইঁদুর দৌড় আর ইঁদুর দৌড়। একচুল নড়চড় হওয়ার জো নেই। প্রতিদিন প্রতিযোগিতা... সমাজের সাথে, কোম্পানির সাথে, সহকর্মীর সাথে ... নিজের সাথে। শুধু আমি নই স্যার, জিততে জিততে হারিয়ে যাচ্ছি আমরা। যারা চাকরি করি তারা একভাবে, আর যারা করি না, তারা অন্যভাবে। খেলবার মাঠ নেই, শৈশব নেই, নেই বাল্যকাল। ঘরের বাইরে লড়াই, ঘরের মধ্যে লড়াই। পায়ে বল নেই, পায়ের তলায় ঘাস নেই, ফুসফুসে বাতাস নেই। তবু হাতে মুঠোফোন আছে। আছে ভার্চুয়াল ভালোবাসা আর তাতেই ডুবে যাওয়া। মনে আছে আপনি 'প্যারাবোলা স্যার' গল্পটা শুনিয়েছিলেন। তখন মনে হতো আপনিই আমাদের সেই প্যারাবোলা স্যার। কোথায় আপনি স্যার আজ? রাস্তার মোড়ে চলমান ছুটন্ত জগতে আটকা পরে দাঁড়িয়ে আছে আজকের প্রজন্ম। একা। কোথায় স্যার আপনারা? আপনাকে, আপনাদের যে আজ বড় দরকার।
ইতি
.......
ধরা যাক মহাকালের বাতাসে ভাসতে ভাসতে সে চিঠি এসে পড়লো মাষ্টারমশায়ের হতে। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে স্তব্ধ রইলেন কিছুক্ষণ। চোখের কোণ কি চিকচিক করে উঠলো তার? ছাত্রীটির সেই ঢলঢলে মুখ, ওদের ব্যাচের সব কজনের চেহারা একে একে ভেসে উঠল মনে। লিখে ফেললেন উত্তর। নিজে যেতে না পারুন। ওর হাতে, ওদের হাতে জবাব পৌঁছে দেওয়া যে বড় প্রয়োজন।
চিঠি ২
মা আমার,
কিসব লিখেছিস তুই ছাইপাশ? এত দুঃখ পেতে হয় নাকি রে? এত জ্বলতে হয়? তোকে কে বললো সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। শেষ তো হবেই, হচ্ছেও। তবে সব নয়। যা যাচ্ছে, ধরে নে তা যাবারই। এমন তো হতেই পারে যা যাচ্ছে বলে ভাবছিস, তার চলে যাওয়ার দুঃখে যা রয়ে যাচ্ছে বা যা নতুন করে আসছে, তাকে দেখতে পাচ্ছিস না। আমি মানছি সত্যি অবক্ষয় নেমে এসেছে। মূল্যবোধগুলোকে কেমন যেন অর্থহীন মনে হয় থেকে থেকে। কিন্তু তারপরেই এক একটা ঘটনা চমকে দেয় অন্তরটাকে। দেখি অতিমারির সময় সোনারপুরের দেবাশীষ তার টোটো নিয়ে ছুটে চলে এদিক ওদিক বিনে পয়সায় রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবে বলে। বা মগরাহাটের মনিরুল কাঁধে করে নিয়ে চলে অক্সিজেন সিলিন্ডার ফুসফুসে ফুসফুসে পরিশুদ্ধ বাতাস যোগান দেবে বলে। তখনই মনে হয় কিছু শেষ হয় নি, সব আছে। জানিস মা, যেদিন যাদবপুরের ছেলেটা খুন হলো আর তারপর খড়গপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এলো ছেলেমেয়েগুলোর অসময়ে মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ, একরাশ কান্না নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এত অমানবিকতা, এত নৃশংসতা, এত হিংসা? এক সন্ধ্যায় দেখি স্টেশনের এক কোণে কতগুলো বাচ্চা বই নিয়ে বসেছে। আর তোদের মতো দু তিনটে ছেলে মেয়ে পড়াচ্ছে ওদের। হোমটাক্স দেখে দিচ্ছে। বাচ্চাগুলো স্টেশনেই থাকে। ওদের বাবা মা স্টেশনে ভিক্ষে করে কিন্তু ওরা স্কুলে যায়। রীতিমত পড়াশুনো করে। আর ওদের ওই স্যার ম্যাডামরা স্কুলে কলেজে পড়ে। উচু ক্লাসে। কী নির্মল। কী সহজ। তখন মনে হলো সব শেষ হয় নি। সব শেষ হয় না। তুই প্রযুক্তির অপব্যবহারে বিচলিত। প্রযুক্তি আসবেই। আর তার হাত ধরে আসবে পরিবর্তন। Change is the only thing constant in life. একে পাল্টানো যায় না, যাবে না। তবে একে বহন করে নয়, বাহন করে চলাটাই শিখিয়ে যেতে হবে। আর এই শেখানোর চেষ্টায় কোনোও কমতি থাকলে চলবে না। তাই যত পারিস বুঝিয়ে যা। যা শিখিয়েছিস, ছড়িয়ে দে। এটুকুই করতে পারিস তোরা। এটুকুই অনেক।
তোর চিঠি পড়ে মনে হল ক্লান্ত তুই। সম্ভব হলে চলে যেতাম তোর কাছে। সেই পুরোনো কবিতা শুনতে চাইতাম। তা যখন সম্ভব নয় তখন স্মৃতির ডায়েরি ঘেঁটে আমিই পাঠিয়ে দিই অনেক কাল আগের একটা লেখা। তোর ভালো লাগলে আমার ভালো লাগবে।
ভালবাসা ঝুলিয়ে দে
গাছের শাখায়, মেঘহ্যাঙ্গারে
বৃষ্টি হয়ে পড়ুক ঝরে।
এর বেশী কে চাইতে পারে?
সবাই বলে বুক বাজিয়ে
'অনেকটা জল আছে আমার,
হৃদয় যেন সবুজ তরু'।
আসলে থাকে সব সাজিয়ে
পরত খুললে রঙিন জামার
বেরিয়ে পড়ে ঊষর মরু।
যখন দেখবি মেঘের কালো
ঈশান কোণে জমছে ঘন,
নিভিয়ে দিয়ে মনের আলো
সিটিয়ে ভয়ে রোস না যেন।
দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে
মেঘের কাছে হ্যাঙ্গারটা চা।
দেখবি জলদ হাসবে জোরে,
বলবে তোকে, 'এই নিয়ে যা'।
তারপর কি করতে হবে
কোথায় অঝোর ঝরতে হবে,
কোন দুখীকে ভরতে হবে
তোর থেকে কে ভালো জানে?
যখন সকল শূন্য হবে,
মেঘতো রবে, যুঝতে হবে,
নতুন করে খুঁজতে হবে
ভালবাসার সহজ মানে।
ভালো থাকিস।
ইতি
আকাশকে মৃত্তিকার পত্র
কৌ শি কী ঘো ষা ল
প্রিয় আকাশ,
চিঠিপত্র লেখা আজকাল প্রায় উঠে গেছে। সেই লাল ডাকবাক্স গুলো আজ জরাজীর্ণ। তবু তোমাকে চিঠি লেখার বড় সাধ হলো। আজ তোমার সঙ্গে আমার ভৌগলিক দূরত্ব তত টুকুই যতটুকু তৈরি হয়েছিল সেই ন বছর বয়সে, যেদিন আমি এক শীতের সকালে, বাবা-মা বোনের হাত ধরে, ঠিকানা বদল করেছিলাম। কিন্তু না বোধহয় ঠিক বললাম না। আমার ঠিকানা বদল হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আমার নিকটআত্মীয়ে ভরপুর, তোমার অন্দরমহলে আমার ছিল অবাধ গতি। বস্তুতপক্ষে যেদিন থেকে আমি নতুন ঠিকানায় অভ্যস্ত হয়েছি সেদিন থেকে আসলে আমার দুটো ঠিকানা হয়েছে একটা তোমার ঠিকানা, আর একটা আমার নতুন বসতবাড়ির ঠিকানা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমি পৌঁছে গেছি তোমার কাছে।আমার হাই স্কুল, কলেজের নৈকট্যের জন্য তোমার অন্তরেই কাটিয়েছি, আবার কয়েকটা বছর। তাই ন বছরের আপেক্ষিক বিচ্ছেদ, একুশ পর্যন্ত কোন রেখাপাত করেনি আমার জীবনে। এরপর আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম, আমার জীবনের ওঠা-পড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তোমার কাছে যাওয়া হতো না বহুদিন। আর একদিন, তুমি আর আমাদের কারো রইলে না, হাত বদল হলো তোমার মালিকানার। আজও মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হয় তোমার বুকের ভেতর একবার সেঁধিয়ে যেত। সেই লাল সিমেন্টের উঁচু উঁচু সিঁড়ি গুনতে গুনতে পৌঁছে যেতে তিনতলায়। তিনতলার লম্বা টানা বারান্দায় একবার দৌড়ে নিতে, একবার ঐ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশমুখী হয়ে বিশ্বকর্মা পুজোর লাল নীল ঘুড়িতে মোড়া আকাশখানা দেখতে। চারতলার ন্যাড়া ছাদ যেটায় পৌঁছতে গেলে ভাঙতে হতো চওড়া কাঠের মই, সেই ছাদটা আরএকটিবার নতুন করে এক্সপ্লোর করতে। দোতলার এক চিলতে ছাদটা ছেয়ে থাকা একরত্তি বোগেনভেলিয়া গাছটার নিচে দাঁড়াতে। আমাদের শোবার ঘরের কোণের গরাদ দেওয়া লম্বা কাঁচের জানলার ধাপিতে বসে, মন খারাপের মুহূর্ত গুনতে। কৈশোরের অজানা অন্যমনস্ক দুপুরের মতো বারান্দার কোণের টিনের ঘরটায় দুপুর কাটাতে। জানি এসব কিছুই হবার না, তবু আজও উত্তর কলকাতার ওই অঞ্চলে গেলে, গলি ভেঙে বড় রাস্তায় পৌঁছোই, তোমাকে একটিবার দেখার আশায়। যদিও জানি তুমি আজ অন্য কারোর, অন্যরকম ছাদ তোমার বহিরাবরণে। কিন্তু আমি কি করে ভুলি-তুমি আমার প্রথম লিখতে শেখার ঠিকানা, আমার ছেলেমানুষী সব আবদারের সাক্ষী তুমি, তুমিই আমার কৈশোরের মন হারানোর গল্প জানো। তোমার টানা বারান্দার ঢালাই লোহার রেলিং এর কারুকার্যের গায়ে গায়ে আমার রূপকথারা ছড়িয়ে আছে। আমার সমস্ত শৈশব, কৈশোর যৌবনের প্রারম্ভ- প্রথম স্কুলে পা রাখা, কলেজ বেলার হইচই সব তোমার ইঁট, তোমার কড়িকাঠ, তোমার লাল মেঝে জানে। আমার পূর্বতন দুই প্রজন্মের গল্পও তোমার অজানা নয়। তবু আজ তুমি বড় দূরের, বাইরে থেকে এক ঝলক তোমাকে দেখা ছাড়া, আর কোনো অধিকার তোমার ওপর নেই। এ যেন অনেকটা পুরনো কোন টানের মত, যা কখনো খুব কাছের ছিল সহজ নিজস্বতায়, আর একদিন অকারণ অজান্তেই হারিয়ে গেল। সে টান সে আবেগ আর কখনো ফিরবার নয়, তবু অবুঝ মন অকারণ অজান্তেই, সেই চির পরিচিত টানকে না চেয়েও চেয়ে ফেলে, ফেলে আসা নিজস্বতার বোধে। আর প্রত্যেকবার খোঁচা খাওয়া কেন্নোর মতো গুটিয়ে যায় নিজের সত্তার মধ্যে। কিন্তু এ তো শুধু আমার কথা, একতরফা। তোমার কি কিছুই বলার নেই, যে চিঠি আজ তোমাকে লিখলাম তা একদিন ফেলে আসবো, চির পরিচিত মিত্তিরদের রকে দাঁড়িয়ে থাকা লাল ডাকবাক্সটাতে। এই চিঠি কি কোন অনন্তলোকের পথ বেয়ে তোমার ইঁট কাঠের পাঁজরে গিয়ে বাজবে?
ইতি...
মৃত্তিকা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন